জয়ন্ত কাকু একটু স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে বলল, “তাহলে টুনি, শাহানা, তোমাদের আমি কী পুরস্কার দিতে পারি?”
শাহানা বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। আমাকে মাঝে মাঝে পেইন্টিংগুলো দেখতে দিলেই হবে।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাহলেই হবে।”
জয়ন্ত কাকু স্যান্ডউইচে আরেকটা কামড় দিয়ে বলল, “সেটা তো আসতেই পার। যখন খুশি। সেটা তো পুরস্কার হলো না।”
টুনি বলল, “কোনো পুরস্কার লাগবে না জয়ন্ত কাকু। পেইন্টিং উদ্ধার হয়েছে সেইটাই পুরস্কার।”
জয়ন্ত কাকু বলল, “তোমাদের সবাইকে এক সপ্তাহের জন্যে রাঙামাটি কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনস বেড়াতে পাঠালে কেমন হয়?”
জয়ন্ত কাকুর কথা শুনে সবাই এত জোরে চিৎকার দিল যে কী হয়েছে সেটা দেখার জন্যে বাসার সবাই আবার ছুটে এলো। চিড়িয়াখানার বানরটা ভয় পেয়ে গাছের মগডালে উঠে জান দিয়ে চেঁচাতে লাগল।
এই বাচ্চাদের মতোই!
ফার্স্টবয়
টুনি স্কুলের বারান্দায় বসে মাঠে ছেলেমেয়েদের দৌড়াদৌড়ি করে খেলতে দেখছিল। তার বয়সী ছেলেমেয়েরাই সবচেয়ে বেশি কিন্তু টুনি তাদের মাঝে নেই। কীভাবে কীভাবে জানি তার মাঝে একটা বড় মানুষ বড় মানুষ ভাব চলে এসেছে তাই সে আর তার বয়সী ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে পারে না। টিফিনের ছুটিতে বারান্দায় বসে বসে তাদের খেলতে দেখে–মাঝে মাঝে মনে হয় সেটাতেই বুঝি মজা বেশি।
টুনি মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের কোনা দিয়ে দেখল তাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় রাজু আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। রাজুও অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করে খেলে না তবে তার কারণটা ভিন্ন। ক্লাসে তার কোনো বন্ধু নেই, সে বেশির ভাগ সময় একা একা থাকে। রাজু একবার ডান থেকে বাম দিকে গেল তারপর আবার বাম থেকে ডান দিকে গেল। টুনির মনে হলো রাজু হয়তো তার সাথেই কথা বলতে চাইছে, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
তাই যখন রাজু আবার ডান দিকে থেকে বাম দিকে যেতে শুরু করেছে তখন টুনি তাকে ডাকল, “এই রাজু।”
রাজু কেমন জানি চমকে উঠল। বলল, “আমি?”
“হ্যাঁ।”
“কী হয়েছে?”
“সবাই কত মজা করে খেলছে, তুই খেলিস না কেন?”
এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া উচিত ছিল পাল্টা প্রশ্ন করে, তুই খেলিস না কেন?’ কিন্তু রাজু প্রশ্নটা না করে মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে কেউ কখনো কোনো খেলায় নেয় না।”
টুনি থতমত খেয়ে গেল, কথাটা মোটামুটি সত্যি কিন্তু এরকম সত্যি কথা কেউ কখনো এভাবে বলে ফেলে না। টুনি কথাটাকে একটা ঠাট্টার মতো ধরে নিয়ে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “তুই খেলবি?”
রাজু মাথা নাড়ল, “না।”
“তুই যদি নিজেই খেলতে না চাস তাহলে তোকে খেলায় নেবে কেমন করে?”
রাজু কোনো উত্তর দিল না আবার চলেও গেল না। টুনির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কথাবার্তা না বলে দুজন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা যথেষ্ট অস্বস্তির ব্যাপার, টুনি তাই রাজুর সাথে কথা বলার চেষ্টা করল। রাজুর সাথে কথা বলার সময় বিষয় মাত্র একটাই হতে পারে, সেটা হচ্ছে লেখাপড়া। তাই টুনি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রাজু, জালাল স্যার যে অঙ্কটা দিয়েছিল সেটা করেছিস? ঔ যে চৌবাচ্চার অঙ্ক–এক দিক দিয়ে পানি আসে অন্যদিক দিয়ে পানি যায়”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল, “না। করি নাই।”
এটা রীতিমতো একটা সংবাদ। যে কাজগুলো বাড়ির কাজ হিসেবে দেওয়া হয় রাজু সেগুলো ক্লাসে বসেই করে ফেলে। আর কয়েকদিন আগে দেয়া অঙ্কটা এখনো শেষ করে নাই সেটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঘটনা। অঙ্কটা রাজু করেছে নাকি করে নাই টুনির অবশ্যি সেটা জানার আসলে কোনো আগ্রহ নাই, সে শুধু একটা আলাপ চালিয়ে যেতে চাইছিল। তাই এবারে আরেকটা পড়ালেখার প্রশ্ন করল, “বিজ্ঞান স্যার যে আলু দিয়ে কী একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে দিয়েছিল সেইটা করে দেখেছিস? আসলেই কাজ করে?”
রাজু বলল, “জানি না।”
“এক্সপেরিমেন্টটা করিস নাই?”
“নাহ।” বলে রাজু তার হাতের তালুর দিকে তাকাল তারপর ওপরের দিকে তাকাল। টুনি আড় চোখে ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল ওপরে দেখার মতো কিছু নাই।
লেখাপড়া নিয়ে আর কী প্রশ্ন করা যেতে পারে টুনি সেটা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। সেরকম কিছু মনে পড়ল না। তখন একটা প্রশ্ন বানাতে হলো। জিজ্ঞেস করল, “নাসরীন ম্যাডামের বাংলা পড়ানো তোর কেমন লাগে?”
“নাসরীন ম্যাডাম? যে নূতন এসেছে?”
“হ্যাঁ।”
“কী জানি।”
রাজু ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “খেয়াল করি নাই।”
টুনি এবারে রীতিমতো অবাক হয়ে বলল, “খেয়াল করিস নাই?”
“নাহ।”
“তুই খেয়াল করিস নাই? এটা কী হতে পারে?”
রাজু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “লেখাপড়া আর ভালো লাগে না, ছেড়ে দিয়েছি।”
টুনি প্রায় আর্ত চিৎকার দিয়ে বলল, “ছেড়ে দিয়েছিস?”
“হ্যাঁ।” রাজু আবার তার হাতের তালুর দিকে তাকাল। তারপর আবার ওপরের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নামিয়ে বলল, “লেখাপড়া করে কী হবে? খামোখা।”
টুনি এতক্ষণ ভদ্রতার একটা আলাপ চালানোর চেষ্টা করছিল। এবারে আর দ্রতার আলোচনার মাঝে থাকল না, সত্যিকারের আলোচনার মাঝে চলে এলো। চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস তুই? তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে? লেখাপড়া করে কী হবে মানে? তুই আমাদের ফার্স্টবয়, তুই লেখাপড়া না করলে কে লেখাপড়া করবে? তোর কী হয়েছে বল। সমস্যাটা কী?”