বাচ্চারা খাবার জন্যে খুবই ব্যস্ত হয়ে আছে। দৌড়াদৌড়ি করে সাঁতার কেটে পানিতে লাফঝাঁপ দিয়ে সবারই খিদেটা ভালো লেগেছে তাই ঘোষণাটা তাড়াতাড়ি শুনে শেষ করে দিতে চায়। জিজ্ঞেস করল, “কী ঘোষণা?”
জয়ন্ত কাকু বলল, “আসলে ঘোষণাটা দেবে তোমাদের টুনি। টুনি বলেছে বাসার সবার সামনে ঘোষণাটা দেবে। সেজন্য আমি বাসার সবাইকে ডেকেছি।” বলে জয়ন্ত কাকু গলা উঁচিয়ে বলল, “সবাই চলে এসো।”
তখন ডাইনিং রুমের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকা সবাই একজন একজন করে ঢুকতে শুরু করলে। সবাই গোল হয়ে দাঁড়াল। টুনি চোখের কোনা দিয়ে দেখল সবার মাঝে ছোটাচ্চুর আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর কাদেরী বশও আছে। কন্ট্রোল রুমের মোটাসোটা সিকিউরিটি গার্ড আছে। সকাল বেলার হাসি খুশি ম্যানেজার, ভ্যানের ড্রাইভার, দুজন লাইফগার্ড, বাবুর্চি দারোয়ান সবাই আছে।”
জয়ন্ত কাকু জিজ্ঞেস করলো, “তোমাদের মাঝে টুনি কে?”
টুনি তার চশমাটা ঠিক করে এগিয়ে গেল, বলল, “আমি।”
জয়ন্ত কাকু টুনির সাইজ দেখে অবাক হয়ে বলল, “তুমি টুনি? তুমি ঘোষণা দেবে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “জী জয়ন্ত কাকু।”
“ঠিক আছে তাহলে দাও।”
শান্ত বলল, “যা বলতে চাস তাড়াতাড়ি বল। আমাদের অনেক খিদে পেয়েছে।”
শান্ত ভেবেছিল অন্য সবাই তার কথায় সায় দেবে কিন্তু দেখা গেল খিদে পেলেও সবাই ধৈর্য্য ধরে টুনির কথা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বুঝতে পেরেছে, টুনি নিশ্চয়ই জরুরি কোনো কথা বলবে।
টুনি সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল, “আজকে সকালে জয়ন্ত কাকুর বাসায় আসার সাথে সাথে শাহানাপু সবার আগে জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন দেখার জন্যে বেসমেন্টের বড় হলঘরটাতে গেছে। আমিও শাহানাপুর সাথে ছিলাম। শাহানাপু যেকোনো পেইন্টিং দেখে সেটা নিয়ে সবকিছু বলে ফেলতে পারে। সেখানে শাহানাপু কী দেখেছে সেটা এখন একটু বলবে।” তারপর টুনি শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “শাহানাপু বল।”
শাহানা একটু থতমত খেয়ে বলল, “আমি? আমি কেন? তুইই বল।”
টুনি বলল, “না শাহানাপু। তুমি প্রথম লক্ষ করেছ তুমি বল। প্লিজ শাহানাপু।”
শাহানা তখন সবার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, “জয়ন্ত কাকুর পেইন্টিংয়ের কালেকশন অসাধারণ। মিউজিয়ামেও এরকম কালেকশান দেখা যায় না। কিন্তু—”
শাহানা একটু থামল এবং সবাই চোখ বড় বড় করে শাহানার দিকে তাকাল।
শাহানা বলল, “কিন্তু এই কালেকশানের চারটা ওয়েল পেইন্টিং চুরি করে সেই ফ্রেমে ভুয়া রিপ্রোডাকশান প্রিন্ট করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। সোজা কথায় কোনো একজন পেইন্টিং চোর জয়ন্তাকাকুর চারটা পেইন্টিং চুরি করেছে।”
এবারে সবাই একসাথে চিৎকার করে উঠল। জয়ন্ত কাকু চোখ কপালে তুলে বলল, “সে কী? কোন চারটা?”
শাহানা বলল, “একটা শাহাবুদ্দিন। একটা কিবরিয়া। একটা আব্দুর রাজ্জাক। আরেকটা কনকচাপা।”
জয়ন্ত কাকু ঘুরে সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তাকাল, “গার্ড! আর্ট কালেকশনের রুমে সিসি ক্যামেরা আছে না?”
টুনি হাত তুলে বলল, “জয়ন্ত কাকু আমি বলি। এই পেইন্টিং চোর অসাধারণ বুদ্ধিমান। সে এমনভাবে চুরি করেছে যে সিসি ক্যামেরাতে ধরা পড়েনি।”
জয়ন্ত কাকু বলল, “সেটা কীভাবে সম্ভব?”
“ক্যামেরা দুইটাকে আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি দিয়ে ব্লক করেছে। তাই কন্ট্রোল রুমে আর্ট মিউজিয়াম পুরোটা সারাক্ষণ দেখা যাচ্ছিল কিন্তু আসলে সেটা আসল আর্ট মিউজিয়াম ঘর না। সেটা আর্ট মিউজিয়ামের একটা ছবি।”
“কী আশ্চর্য!”
“জয়ন্ত কাকু, আমি আসলে বলা শেষ করিনি।”
“বল, বল, শেষ করো।”
টুনি গলা পরিষ্কার করে বলল, “দেখতেই পাচ্ছেন, আপনি যেটা সন্দেহ করছিলেন সেটা সত্যি বের হয়েছে। আপনি আমাদের বাসায় এসে ছোটাচ্চুর সাথে দেখা করেছিলেন, ছোটাচ্চু যেহেতু ডিটেকটিভ সেজন্য আপনি ছোটাচ্চুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন আর্ট গ্যালারির সিকিউরিটি কীভাবে দেওয়া যায়? ছোটাচ্চু আপনার কাছ থেকে সময় নিয়েছিল কমপ্লিট একটা প্ল্যান দেওয়ার জন্য। কিন্তু এর মাঝে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে আপনাকে একটা স্পাই পেন দিয়েছিল।”
কথাগুলো সত্যি না তাই জয়ন্তকাকু কিছু একটা বলতে চাইছিল, টুনি দেখল ছোটাচ্চু জয়ন্তকাকুর হাতে চাপ দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল।
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু বলেছিল এই স্পাই পেনটা আর্ট মিউজিয়ামের হলঘরের মাঝামাঝি কোনো একটা ফ্রেমের ওপর রেখে দিতে। আপনি সেটা রেখে দিয়েছিলেন। পেইন্টিং চোর সেটা জানত না। তাই সে সিসি ক্যামেরাকে ফাঁকি দিয়েছিল সত্যি কিন্তু ছোটাচ্চুর স্পাই পেনকে ফাঁকি দিতে পারে নাই। স্পাই পেনে তার সব কাজকর্ম রেকর্ড হয়েছে। স্পাই পেনটা মুভমেন্ট না হলে রেকর্ড করে না সেইজন্য ব্যাটারি খরচ হয় না। কাজেই আমাদের কাছে পেইন্টিং চুরির পুরো ভিডিও আছে। সেটা সবাইকে দেখানোর জন্য আপনাদের সবাইকে ডেকে এনেছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন যে যিনি চুরি করেছেন তিনিও এইখানে আছেন।”
সবাই এবারে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করে। টুনির চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখলে কাদেরী বকসের চেহারা ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেছে। মানুষটা দরদর করে ঘামতে শুরু করেছে। দুই হাত দিয়ে টান দিয়ে সে তার চিকন লাল টাইটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল।