“সমুদ্রে আছে কী?” “পানি আর পানি।”
ঝুমু খালা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমার পানি দেখার জন্যে কক্সবাজার যাইতে হবে? পাকঘরে ট্যাপ খুললেই তো আমি পানি দেখবার পারি। পানি আর পানি–যতক্ষণ খোলা ততক্ষণ পানি।”
ঝুমু খালার এই যুক্তি শুনে প্রমি এতই ঘাবড়ে গেল যে সে আর কোনো কথাই বলতে পারল না।
ঝুমু খালা যেহেতু যাবে না তাই বড় মানুষদের মাঝে ছোটাচ্চুকে নেওয়া হলো। শান্ত বেশ খোলামেলাভাবে ছোটাচ্চুকে জানাল যে এটা শুধু বাচ্চাদের ট্রিপ হওয়ার কথা। তারা যে ছোটাচ্চুকে সাথে নিচ্ছে সেটা তার প্রতি এক ধরনের দয়া দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। ছোটাচ্চু যেন সেটা মনে রাখে এবং কক্সবাজার পৌঁছানোর পর ছোটাচ্চু যেন বাচ্চা-কাচ্চাদের স্বাধীনভাবে যা ইচ্ছে তাই করতে বাধা না দেয়।
ঠিক কী কারণ জানা নেই শান্তর কথা শুনে ছোটাচ্চু রেগে উঠল, হাত-পা নেড়ে চিৎকার করে বলল, “তোদের লেজ বেশি মোটা হয়েছে? (শান্ত বুঝতে পারল না লেজের বিষয়টা কোথা থেকে এসেছে) তোরা জানিস আমি যদি ফোন করে জয়ন্তকে শুধু একবার বলি বাচ্চাগুলোর লেজ বেশি মোটা হয়েছে, ওদের ট্রিপ ক্যান্সেল করে দে সাথে সাথে জয়ন্ত তোদের পুরো ট্রিপ ক্যান্সেল হয়ে যাবে। সেটা জানিস?”
শান্ত ছোটাচ্চুর ব্যবহারে খুবই অবাক হলো–অন্যেরা অবশ্যি সেরকম অবাক হলো না, তাই সবাই মিলে ছোটাচ্চুকে শান্ত করে ফেলল।
বাসায় সবচেয়ে ছোটদের ভেতরে মুনিয়ার কক্সবাজার যাওয়ার অনুমতি হলো, এর আগে সে তার আবু-আম্মু ছাড়া কখনো কোথাও থাকেনি কিন্তু মুনিয়া বারবার সবাইকে জানাল সে যেহেতু এখন বড় হয়ে গেছে আন্ধু-আম্মু ছাড়া তার থাকতে কোনোই সমস্যা হবে না। ট্রিপের সবচেয়ে বড় সদস্য শাহানা, সে সার্টিফিকেট দিল যে সে মুনিয়াকে দেখে-শুনে রাখবে তখন মুনিয়ার আম্মু তাকে যেতে দিতে রাজি হলেন।
মুনিয়ার ছোট আর তিনজন আছে তাদের একজন একেবারেই ছোট, এখনো বেশির ভাগ সময় হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। অন্য দুজন একটু বড় হয়েছে কথা-বার্তা বুঝতে শিখেছে তারাও কক্সবাজার যাবার জন্যে রেডি হয়ে গেল।
শান্ত সবাইকে অভয় দিয়ে বলল, সে এই দুজনকে সামলে নেবে যেন তারা কক্সবাজার যেতে না চায়। সত্যি সত্যি শান্ত তাদের কী বোঝাল কে জানে হঠাৎ করে তারা কক্সবাজার যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। যে পদ্ধতিতে এই দুজনকে শান্ত সামলে নিয়েছে সেটা অবশ্যি খুব প্রশংসা করার মতো পদ্ধতি নয়। কারণ শান্ত দুজনকে একটা অন্ধকার ঘরে ডেকে নিয়ে বলল, “কক্সবাজারে কী আছে তোরা জানিস, সেখানে যে যেতে চাচ্ছিস?”
বাচ্চা দুজন ভয়ে ভয়ে বলল, “কী আছে?”
“জঙ্গল। খালি কাটা কাটা গাছ। গাছের ওপর কন্ধ কাটা ভূত।”
বাচ্চা দুজন ফ্যাকাশে মুখে বলল, “কন্ধ কাটা ভূত কী?”
“যে ভূতের মাথা কাটা। মাথাটা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।”
বাচ্চা দুজন শিউরে উঠল। একজন বলল, “কিন্তু সবাই যে বলছে কক্সবাজারে সমুদ্র?”
শান্ত বলল, “সমুদ্রও আছে, কিন্তু সেইখানে লোনা পানি মুখে গেলেই ওয়াক ওয়াক করে বমি।”
“তাহলে সবাই যে যাচ্ছে?”
“সবাই যাচ্ছে কারণ যেন বমি না হয় সেইজন্যে প্রত্যেক বেলা সবার দুই হাতে দুইটা ইনজেকশান দেবে। এই মোটা সুই–” শান্ত সুইয়ের যে সাইজ দেখালো সেটা দেখেই দুজনের কক্সবাজার যাওয়ার সব সখ মিটে গেল!
যেদিন কক্সবাজার যাওয়ার কথা তার আগের রাতে বাচ্চাদের ঘুমাতে অনেক দেরি হলো কারোই ঘুম আসছিল না। তবে পরদিন সকালে কারোই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হলো না। সকাল দশটায় ফ্লাইট কিন্তু অনেক আগেই সবাই গোসল করে জামা-কাপড় পরে রেডি হয়ে থাকল। জয়ন্ত কাকুর বড় ভ্যান আটটার সময় বাসায় পৌঁছে গেল, সবাই যখন ভ্যানে উঠছে তখন মুনিয়ার চোখ এক দুইবার ছল ছল করে উঠেছে কিন্তু কেউ সেটা দেখার আগেই মুনিয়া তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলেছে। ভ্যানে ড্রাইভারের পাশে মোটা সোটা একজন মানুষ বসেছে, মেটাসোটা মানুষেরা সাধারণত হাসি-খুশি হয় কিন্তু এই মানুষটা গোমড়ামুখী। শুধু যে গোমড়ামুখী তা নয় দেখে মনে হয় একটু হাবাগোবা টাইপ। সামনের সিটে বসে লম্বা লম্বা হাই তুলে সে সবার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকল।
বাসার বারান্দায় বড়রা সবাই দাঁড়িয়ে আছে, দাদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে সবার হাত ধরে বললেন, ‘ফি আমানিল্লাহ’ তারপর কী একটা দোয়া পড়ে ভ্যানের ভেতর ফুঁ দিয়ে দিলেন। ঝুমু খালা কক্সবাজার নিয়ে সবাইকে উপদেশ দিল, যে কেউ শুনলে সে মনে করবে ঝুমু খালা বুঝি কক্সবাজারে তার জীবনের বেশির ভাগ কাটিয়েছে। চাচা-চাচি খালা-খালু ফুপু-ফুপা সবাই হাত নেড়ে বাচ্চাদের বিদায় দিল, ঠিক ভ্যান ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে কোথা থেকে জানি জয়ন্ত কাকু হাজির হলো। বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে বলল, “জয়ন্ত কাকু। তুমি যাবে আমাদের সাথে?”
জয়ন্ত কাকু মাথা নেড়ে বলল, “না, না! তোমাদের শুধু এয়ারপোর্ট নামিয়ে দিয়ে আসি।”
ভ্যান ছেড়ে দিল। বাচ্চারা আনন্দে গান গাইতে থাকে চিৎকার করতে থাকে এবং এর মাঝেই মোটামুটি ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ভ্যানটা এয়ারপোর্টের দিকে যেতে শুরু করে।
এয়ারপোর্ট পৌঁছানোর পর যখন সবাই ভ্যান থেকে নামছে, নিজের জিনিসপত্র নিয়ে টানাটানি করছে তখন জয়ন্তকাকু ছোটাচ্চুকে এক পাশে টেনে নিয়ে বলল, “তোদের সাথে যাবার জন্যে আমি কাজেম আলীকে দিয়ে দিলাম।”