শাহানা বলল, “ঠিক আছে। আমি শান্ত ভাব দেখাই।”
শাহানা তখন শান্ত ভাব দেখিয়ে হয়ে নকল পেইন্টিংটা দেখার ভান করতে লাগল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “এত বড় ছবি চুরি করল কেমন করে?”
“কেন, বুঝতে পারছিস না? চাকু দিয়ে ফ্রেমের চারপাশে ক্যানভাসটা কেটে নেয়। তারপরে আগে থেকে প্রিন্ট করে আনা ভুয়া ছবিটা ফ্রেমের সাথে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দেয়। চুরি করা পেইন্টিংটা ভাঁজ করে একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। খুবই সোজা।”
“তার মানে ছবির ফ্রেমটা ঘোয় না?”
“না। ছবির ফ্রেম তার জায়গাতেই থাকে।”
“কী আশ্চর্য।” টুনি মাথা নাড়ল, “চোরের কত বুদ্ধি দেখেছ?”
শাহানা হাসার চেষ্টা করল, “সেই জন্যেই তো গ্রামদেশে বাচ্চা হলে সবাই দোয়া করে বলত তোমার পিঁপড়ার মতো শক্তি হোক আর চোরের মতো বুদ্ধি হোক।”
“পিঁপড়ার অনেক শক্তি, তাই না?”
“তার সাইজের তুলনায় শক্তি বেশি না? নিজের ওজন থেকে কয়েকগুণ বেশি ওজন ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে পারে। তুই পারবি?”
টুনির স্বীকার করতে হলো যে সে পারবে না।
দুজন মোটামুটি শান্তভাবে পেইন্টিংটার সামনে সময় কাটিয়ে পরের পেইন্টিংটা দেখতে গেল। সেখান থেকে পরেরটা, এভাবে একটা একটা করে দেখে যেতে থাকে। অন্য যে কেউ হলে পেইন্টিংগুলো এক নজর দেখেই চলে যেত, শাহানা মোটেও সেই মানুষ না। সে প্রত্যেকটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, টুনির সাথে ছবির ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ করল। প্রায় শখানেক ছবি দেখে শেষ করতে তাদের দুই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। এর মাঝে চারটা ছবি ভুয়া। চোর যেই হোক সে জয়ন্ত কাকুর আর্ট মিউজিয়ামের চারটা পেইন্টিং চুরি করে ফেলেছে। কী আশ্চর্য।
বেসমেন্টের আর্ট মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে ওপরে উঠে দুজন প্রথমে বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে অনেক্ষণ বিশ্রাম নিল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তাদের হাটু ব্যথা হয়ে গেছে। তারপর উঠে ভেতরে যাবার সময় দেখল পাশে একটা ছোট ঘর সেখানে অনেকগুলো টেলিভিশন স্ক্রিনের সামনে একজন মোটাসোটা মানুষ বসে আছে। এটা নিশ্চয়ই এই বাসার সিকিউরিটি রুম, এখান থেকে সবগুলো সিসি টিভিকে দেখা যায়।
টুনি বলল, “শাহানাপু চল আমরা সিকিউরিটি রুমটা একটু দেখে আসি।”
“কী দেখবি?”
“সিসি টিভি থাকলেও পেইন্টিং কীভাবে চুরি করে সেইটা।”
“আয় যাই।”
সিকিউরিটি রুমে ঢুকতেই মোটাসোটা মানুষটা তাদের দিকে তাকিয়ে ভালো মানুষের মতো হাসল। টুনি আগেও লক্ষ করেছে শুকনো মানুষের মেজাজ হয় খিটখিটে আর মোটাসোটা মানুষের মেজাজ হয় হাসিখুশি। সিকিউরিটির মানুষটা বলল, “তোমাদের কী খবর? স্যারের আর্ট মিউজিয়াম কেমন দেখলে?”
শাহানা বলল, “অসাধারণ!”
মানুষটা বলল, “আমি সিসি ক্যামেরাতে দেখলাম তোমরা অনেক সময় নিয়ে ছবিগুলি দেখেছ!”
টুনি শাহানাকে দেখিয়ে বলল, “শাহানাপু পেইন্টিং খুব পছন্দ করে। সেই জন্যে!”
“তোমাদের আগে আর কেউ এত মনোযোগ দিয়ে এই ছবি দেখে নাই!”
শাহানা বলল, “আমি আবার দেখতে আসব।”
“এসো। স্যার খুশি হবেন। কেউ স্যারের পেইন্টিং দেখতে আসলে স্যার খুব খুশি হন।”
টুনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে মানুষটার পেছনে দাঁড়িয়ে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ সেগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি একসাথে সবগুলো স্ক্রিন দেখতে পারেন?”
“আসলে দেখতে হয় না। শুধু চোখ বুলাই। যদি এবনরমাল কিছু হয় তাহলে দেখি।”
“এবনরমাল?”
“হ্যাঁ।”
“সেটা কী রকম?”
“ধরা যাক হঠাৎ যদি দেখি কোনো অপরিচিত মানুষ হেঁটে যাচ্ছে কিংবা পরিচিত মানুষ খুব সন্দেহের ভঙ্গিতে হাঁটছে–”
“কখনো কী হয়েছে এরকম?”
“না সেভাবে হয় নাই। যেমন মনে করো আজকে তোমরা যখন পেইন্টিংগুলো দেখছিলে তোমরা সারাক্ষণ নরমাল ভাবে দেখেছ। শুধু প্রথমদিকে একবার–”
টুনি আর শাহানা দুজনই এবারে মোটোসোটা মানুষটার দিকে তাকাল, “প্রথমদিকে কী?”
“প্রথম দিকে তোমরা যখন একটা পেইন্টিং দেখছিলে হঠাৎ করে খুব উত্তেজিত হয়ে গেলে, মনে হলো খুব আশ্চর্য কিছু দেখেছ।”
টুনি আর শাহানা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। মানুষটা বলল, “কী ছিল ছবিটাতে, কী দেখে এত অবাক হয়েছিলে?”
শাহানা কী বলবে বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে”
টুনি তখন শাহানাকে রক্ষা করল, বলল, “ওয়েল পেইন্টিংটা অন্য স্টাইলে আঁকা ছিল, এরকম হয় না সাধারণত। তাই না শাহানাপু?”
“হ্যাঁ। একই সাথে ওয়েল আর প্যাস্টেল
মোটাসোটা মানুষটা বলল, “আমি ভেবেছিলাম গিয়ে তোমাদের জিজ্ঞেস করি ছবিতে কোনো সমস্যা আছে কী না, কাদেরী বখস যেতে দিল না, বলল, কোনো সমস্যা নাই।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “কাদেরী বখস কে?”
“আমাদের আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর।”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “ঐ যে স্যুট পরে ছিলেন? লাল টাই?”
“হ্যাঁ।”
“চুলের মাঝখানে সিঁথি?”
“হ্যাঁ।“
“উনি কী অনেকদিক থেকে আছেন?”
“না। মাস খানেক হলো জয়েন করেছেন।”
মোটা মানুষটার সামনে রাখা স্ক্রিনগুলোর একটাতে হঠাৎ করে দেখা গেল মুনিয়া ছুটে একটা খরগোসের বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়েছে, আরেকটাতে দেখা গেল শান্ত একটা লাল হাফ প্যান্ট পরে সুইমিং পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। টুম্পাকে দেখা গেল খুব মনোযোগ দিয়ে একটা কাকাতুয়া পাখিকে পরীক্ষা করছে। একজন মানুষ যখন জানে না তাকে কেউ দেখছে তখন মানুষটাকে দেখতে অন্যরকম মনে হয়। কারণটা কী কে জানে!