এবারে শাহানা আর টুনির একসাথে একটু মেজাজ গরম হলো। শাহানা শীতল গলায় বলল, “উল্টাপাল্টা বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?”
“উল্টাপাল্টা মানে উল্টাপাল্টা। ছোট ছেলেমেয়েরা পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব কী বুঝবে? তাদের কাছে একটা জয়নুল আর একটা রিকশার পেইন্টিংয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য নাই। কলম দিয়ে হয়তো একটা পেইন্টিংয়ের ওপর নিজের নাম লিখে ফেলল।”
শাহানা মুখ শক্ত করে বলল, “আমরা নিজের নাম লিখব না। আপনি যদি বিশ্বাস না করেন কন্ট্রোল রুম থেকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে দেখতে পারেন।” কথা শেষ করে সে ঘুরে টুনির দিকে তাকাল, বলল, “আর তোকে শিখাই কেমন করে একটা সুন্দর পেইন্টিং এনজয় করতে হয়।”
তারপর প্রথম পেইন্টিংটার দিকে তাকিয়ে লোকটাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, “এই যে এইটা হচ্ছে জয়নুলের একটা ওয়াটার কালার। ময়মনসিংহের একটা জমিদারবাড়িতে ছিল তারপর হারিয়ে গেল। অনেকদিন কোনো খোঁজ ছিল না, তারপর হঠাৎ করে গুলশানের একটা আর্ট সাপ্লাইয়ের দোকানে হাজির হলো। এটা অরিজিনাল না ভুয়া সেইটা নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, শেষ পর্যন্ত এক্সপার্টরা বলেছে এটা অরিজিনাল। তখন এটা নিলামে উঠেছিল, অনেক দামে জয়ন্ত কাকু কিনে নিয়েছেন।”
মাঝখানে সিঁথি করা এবং হিটলার ও সিরাজদৌলার মতো গোঁফের মানুষটা মুখটা হা করে শাহানার দিকে তাকিয়ে রইল। আমতা আমতা করে বলল, “তুমি এতসব কেমন করে জান?”
“আমার পেইন্টিং ভালো লাগে। জয়ন্ত কাকু যদি আপত্তি না করেন তাহলে আমি এইখানে দিনের পর দিন পড়ে থাকব।”
ঠিক কী কারণ জানা নেই শাহানার কথা শুনে মানুষটার মুখটা কেমন জানি কালো হয়ে গেল। শাহানা অনেকক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল, টুনি দেখল শাহানার চোখগুলো কেমন যেন ঢুলু ঢুলু হয়ে গেছে। তারপর একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে শাহানা পরের পেইন্টিংয়ের কাছে গেল। টুনিকে বলল, “এটা কামরুল হাসান। সবাই ওনাকে বলে পটুয়া কামরুল হাসান। শেষের দিকের আঁকা ছবি। শুধু তাকিয়ে দেখ, কী পাওয়ার ফুল ড্রয়িং, মাত্র কয়টা টান দিয়ে এঁকেছেন, লক্ষ্য কর। উজ্জ্বল রং–”
টাইট স্যুট এবং চিকন টাইয়ের মানুষটা শাহানার কথা শুনে কেমন জানি উশখুশ করতে লাগল, দেখে মনে হয় কিছু একটা বলতে চাইছে আবার ঠিক বলতে পারছে না কিছুক্ষণ ইতিউতি করে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোনো কথা না বলেই বিদায় নিল, শাহানা আর টুনি দুজনই তখন একেবারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
শাহানা বলল, “এখন শান্তিমতো পেইন্টিংগুলো দেখা যাবে।”
টুনি বলল, “হ্যাঁ। এই মানুষটার কিছু একটা সমস্যা আছে।”
“চেহারাটা ফানি। এইটা কী সমস্যা?”
“উঁহু।” টুনি মাথা নাড়ল, “চেহারা না। অন্যকিছু।”
শাহানা বলল, “বাদ দে। আয় পেইন্টিং দেখি।”
দুজন আবার ছবি দেখতে শুরু করে।
চার নম্বর পেইন্টিংটার সামনে এসে শাহানা হঠাৎ কেমন জানি চমকে উঠল। এক ধরনের আর্ত চিৎকার করে বলল, “সর্বনাশ।”
“কী হয়েছে?”
“ফেক পেইন্টিং।”
টুনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফেক? মানে ভুয়া?”
“হ্যাঁ।”
“কেমন করে বুঝলে?”
শাহানা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, “কেমন করে বুঝলাম মানে? এইটা হওয়ার কথা একটা ওয়েল পেইন্টিং, ক্যানভাসের ওপর করা। ওয়েল পেইন্টিং হয় খসখসে, পেইন্টিং শুকিয়ে থাকে। আর এইটা হচ্ছে তার একটা ছবি, পিভিসিতে প্রিন্ট করে রেখেছে। চক চক করছে দেখছিস না?”
“কী আশ্চর্য! জয়ন্ত কাকু একটা ভুয়া পেইন্টিং কিনে সাজিয়ে রাখবেন?” টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “হতেই পারে না।”
শাহানা প্রায় চিৎকার করে বলল, “হতেই পারে না মানে? নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করছিস না?”
টুনি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “শাহানাপু, আমার কী মনে হয় জান?”
“কী?”
“জয়ন্ত কাকু অরিজিনাল পেইন্টিংটাই কিনেছিলেন। কেউ একজন সেইটা চুরি করে ভুয়া এইটা এইখানে ঝুলিয়ে রেখেছে।”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “তুই ঠিকই বলেছিস। নিশ্চয়ই তাই হয়েছে। আমাদের এক্ষুনি জয়ন্ত কাকুকে বলতে হবে।”
টুনি বলল, “দাঁড়াও শাহানাপু। নিশ্চয়ই ভেতর থেকে কেউ এইটা চুরি করেছে। আমরা বললেই সে সাবধান হয়ে যাবে। আমরা যে এইটা বুঝে ফেলেছি সেটা আগেই কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না। সত্যি কথা বলতে কী আমরা এখন কী করছি সেই চোর হয়তো সিসি টিভিতে সেটা দেখছে। তাই আমাদের ভান করতে হবে যেন আমরা কিছু বুঝি নাই। খুব নরমাল দেখাতে হবে।”
শাহানা বলল, “তোর কী মনে হয় টুনি? এই ফানি লুকিং লোকটাই চোর?”
“হতেও তো পারে। তারই তো চুরি করার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখনো তো আমরা জানি না।”
শাহানা এদিক সেদিক তাকাল, “তারপর বলল, কে জানে এইটা ছাড়া আরও পেইন্টিং চুরি করেছে কি না কে জানে।”
“আগেই সেটা দেখতে যেও না শাহানাপু। আমরা একটা একটা করে দেখে যাই, তাহলে বের হয়ে যাবে।”
“এই ঘরটাতে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে, তাহলে চুরি করল কেমন করে?”
“সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলে বোঝা যাবে। কে জানে কতদিন আগে চুরি করেছে।”
শাহানা রাগ রাগ মুখে বলল, “কত বড় সাহস। মদমাইশের বাচ্চা বদমাইশ।”
টুনি শাহানার দিকে তাকিলে বলল, “শাহানাপু তুমি এখনো রেগে আছ। আগে শান্ত হও। তোমার চেহারা দেখে যেন বুঝতে না পারে যে তুমি ধরে ফেলেছ এইটা ভুয়া পেইন্টিং।”