একজন জানতে চাইল, “কী রকম বড়লোক?”
ছোটাচ্চু এমনভাবে কথা বলতে লাগল যে জয়ন্ত না, সে নিজেই বুঝি বড়লোক। হাত নেড়ে বলল, “খালি একটা উদাহরণ দেই। গত সামারে জয়ন্তের হঠাৎ করে ব্রাসেলস যেতে হবে। সে কীভাবে গেছে বল দেখি?”
টুম্পা বলল, “প্লেনে।”
শান্ত বলল, “ধুর গাধা। প্লেনে তো যাবেই, হেঁটে যাবে নাকি?”
প্রমি বলল, “বিজনেস ক্লাসে।”
“হলো না।”
শান্ত বলল, “ফার্স্ট ক্লাসে!”
“উঁহু” ছোটাচ্চু বলল, জয়ন্ত প্লেনের টিকিট পায় না, তখন সে আস্ত একটা প্লেন চার্টার করে ফেলল। ছোট একটা পার্সোনাল জেট!”
সবগুলো বাচ্চা তখন একসাথে বিস্ময়ের শব্দ করল। শান্ত বলল, “আমরা যেরকম সিএনজি রিজার্ভ যাই সেইরকম প্লেন রিজার্ভ?”
ছোটাচ্চু বলল, “হ্যাঁ। সেইরকম।”
জয়ন্ত বিব্রত হয়ে বলল, “দেখ শাহরিয়ার তুই এমনভাবে বলছিস যে তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি বুঝি সবসময় প্লেন চার্টার করি। একবার করতে হয়েছিল—“
ছোটাচ্চু জয়ন্তের কথাকে কোনো গুরুত্ব দিল না। নিজের মতো করে বলতে থাকল, “বসন্ধুরায় তার একটা বাসা আছে। সেই বাসায় হাতে ম্যাপ না নিয়ে যদি যাস তাহলে হারিয়ে যাবি। সেই বাসায় কী নাই! ছাদের ওপর সুইমিং পুল।
বাচ্চারা সুইমিংপুলের কথা শুনে এক সাথে সবাই বিস্ময়ের শব্দ করল। ছোটাচ্চু বলল, “টাকা খরচ করে শেষ করতে পারে না। সেজন্যে জয়ন্ত কী করেছে জানিস?”
“কী করেছে?”
“তার বাসার নিচে একটা আর্ট মিউজিয়াম তৈরি করেছে। বাংলাদেশের যত বড় বড় শিল্পী আছে তাদের সবার ছবি আছে।”
শাহানা অবাক হয়ে বলল, “সত্যি?”
“সত্যি।”
শাহানা জিজ্ঞেস করল, “জয়নুল আবেদীন?”
জয়ন্ত লাজুক মুখে মাথা নাড়ল, “আছে।”
“কামরুল হাসান?”
“আছে।”
“সুলতান?”
“আছে।”
“শাহাবুদ্দিন? কিবরিয়া? আব্বুর রাজ্জাক?”
“আছে। মোটামুটি সবারই আছে!” জয়ন্ত শাহানার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, “তোমার পেইন্টিং ভালো লাগে?”
শাহানা মাথা নাড়ল, বলল, “জী। খুব ভালো লাগে।”
শান্ত বলল, “যদি ট্যারা-ব্যাকা ছবি হয় যেটা দেখে আগা-মাথা কিছু বোঝা যায় না সেইসব পেইন্টিং শাহানাপুর সবচেয়ে ভালো লাগে।”
শাহানা শান্তর মাথায় একা চাটি মেরে বলল, “যেটা বুঝিস না সেইটা নিয়ে কথা বলিস না।”
শান্ত বলল, “তা হলে আমার কথা বলাই বন্ধ হয়ে যাবে।”
প্রমি বলল, “তখন আমাদের সবার শান্তি হবে।”
জয়ন্ত শাহানার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার যদি পেইন্টিং ভালো লাগে তাহলে একদিন আমার বাসায় এসে আমার কালেকশনটা দেখে যেও। ভালো লাগবে।”
এক সাথে সব বাচ্চা চিৎকার করে উঠল, “আমিও যাব। আমিও যাব।”
শাহানা বলল, “তোরা যাবি মানে? তোরা গিয়ে কী করবি? কোনোদিন গিয়েছিস কোনো আর্ট এক্সিবিশনে? কতবার আমি নিয়ে যেতে চেয়েছি। গিয়েছিস?”
সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করে নিল, তারা আসলে পেইন্টিং বুঝে না। তাই কখনো যায় নাই।
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা তো আমাকে কথাই শেষ করতে দিলি না, তোরা কী ভেবেছিস জয়ন্তের বাসায় শুধু সুইমিং পুল আর আর্ট মিউজিয়াম আছে?”
সবাই জানতে চাইল, “আর কী আছে ছোটাচ্চু?”
“রীতিমতো চিড়িয়াখানা। বাঘ-ভাল্লুক-হরিণ-ময়ূর কী নেই।”
“সত্যি?” বাচ্চারা চিৎকার করে উঠল, “সত্যি সত্যি বাঘ-ভালুক আছে?”
জয়ন্ত বলল, “না, না, বাঘ-ভালুক নেই। কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। হরিণ আছে, বানর আছে, খরগোস আছে, ময়ূর আছে, অনেক রকম পাখি আছে। মাছ আছে। রেয়ার গাছ আছে।”
বাচ্চারা চিৎকার করতে থাকল, “দেখব। দেখব। আমরা দেখব।”
জয়ন্ত বলল, “সবাই মিলে চলে এসো। সুইমিংপুলে গোসল করবে, চিড়িয়াখানা দেখবে, পেইন্টিং দেখবে, দুপুরে খাবে”
শান্ত চিৎকার দিল, “খাব। খাব। আমরা খাব!”
জয়ন্ত হাসি হাসি মুখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিলে বলল, “তুই বাচ্চা কাচ্চাদের একদিন নিয়ে আয়। সারাদিন থাকবে ঘুরে বেড়াবে।”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু। হ্যাঁ। হ্যাঁ।”
টুম্পা বলল, “ছোটাচ্চু আমাদের কোনদিন নিয়ে যাবে না। ছোটাচ্চুর কিছু মনে থাকে না।”
অনেকেই মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। ছোটাচ্চু সবকিছু ভুলে যায়।”
শান্ত বলল, “আমি মনে করিয়ে দেব।”
জয়ন্ত বলল, “ঠিক আছে, শাহরিয়ারকে নিতে হবে না। আমি আমার বড় ভ্যানটা পাঠিয়ে দেব, সাথে ম্যানেজার থাকবে। সে তোমাদের নিয়ে যাবে।”
সবাই আনন্দে চিৎকার করে বলল, “ইয়েস। ইয়েস। সেইটাই সবচেয়ে ভালো। ছোটাচ্চুকে কিছু করতে দিলেই ছোটাচ্চু সেটা মাখিয়ে ফেলে।”
জয়ন্ত বলল, “সেইটা আমিও বিশ্বাস করি। এই জন্যে আমরা তোমাদের ছোটাচ্চুকে ডাকতাম আধা মাধা শাহরিয়ার। মনে আছে শাহরিয়ার?”
ছোটাচ্চু মুখ বিকৃত করে বলল, “মনে নাই আবার?”
ঠিক তখন ঝুমু খালা প্লেট বোঝাই খাবার আর চা নিয়ে এলো বলে আলাপ থামিয়ে সবাই খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
.
এক সপ্তাহ পরে ভোরবেলা জয়ন্ত একটা বড় ভ্যান পাঠিয়ে দিল। সাথে ভ্যানের ড্রাইভার আর একজন হাসিখুশি ম্যানেজার। বাসার সব বাচ্চা সেই ভ্যানটাতে গাদাগাদি করে উঠে বসল। ছোটাচ্চু ছাড়াই সবাই যাওয়ার কথা, কিন্তু দেখা গেল একেবার শেষ মুহূর্তে ছোটাচ্চুও ভ্যানে উঠে বসেছে।
ছুটির দিন, তাই রাস্তায় ভিড় নেই। সবাই দেখতে দেখতে জয়ন্তের বাসায় পৌঁছে গেল। ছোটাচ্চু ভুল বলে নাই বিশাল একটা জায়গা নিয়ে জয়ন্তের বাসা, বাইরে থেকেই বোঝা যায় না ভেতরে অনেক জায়গা। বড় একটা গেট খুলে গেল, তখন বিশাল ভ্যানটা ভেতরে ঢুকে পড়ে। ড্রাইভওয়েতে ভ্যানটা থামতেই সবাই লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে শুরু করে। সিঁড়ির ওপর জয়ন্ত পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়েছিল, সে নিচে নেমে এলো। শান্ত এগিয়ে গিয়ে বলল, “জয়ন্ত কাকু, আমরা সবাই এসে গেছি।”