“ব্রেনের ভায়োলেন্সটা কন্ট্রোলের মাঝে আসে। তখন একেবারে নরমাল মানুষের মতো কথাবার্তা বলে। কিন্তু—”
“কিন্তু কী?”
“নরমাল মানুষের মতো কথা বলে তার মানে কিন্তু নরমাল তা না। যেকোনো সময় ক্ষেপে উঠে। তানজিম ভাইয়ার–”
টুনি কথা বন্ধ করে শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করল।
টুম্পা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বলো না টুনি আপু। প্লিজ বলো না। আমার ভয় করে।”
টুনি পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, “আয় যাই।”
“চল।”
গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে টুনি আর টুম্পার পেছনে পেছনে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যেতে থাকল। একটু শব্দ হলেই গুটল চমকে উঠছিল। দোতলায়। পৌঁছে পা টিপে টিপে তারা টুনির ঘরে ঢুকল। ঘরের দরজা বন্ধ করে গুটলু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “এখন তো আর ঢুকতে পারবে না। তাই না?”
টুম্পা হাসির মতো ভঙ্গি করে বলল, “ঢুকতে পারবে না? শান্ত ভাইয়ার গায়ে অসম্ভব জোর। এক ধাক্কায় দরজা ভেঙে ফেলবে।”
টুনি মাথা নেড়ে বলল, “দরজা ভাঙা তো পরের ব্যাপার। যদি দরজায় ধাক্কা দিলে দরজা না খুলি তাহলেই খেপে উঠবে। আমাদের একেবারে নরমাল ব্যবহার করতে হবে, যেন কিছুই হয় নাই। সবাই একেবারে নরমাল ব্যবহার করবে। তুমি দেখলে বুঝতেই পারবে না যে শান্ত ভাইয়া সাইকোটিক ম্যানিয়াক। ভয়ংকর উন্মাদ চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়। কথা শেষ করে টুনি শিউরে উঠল, টুনিকে দেখে টুম্পা আর টুম্পাকে দেখে গুটলু আরো জোরে শিউরে উঠল।
টুনির ঘরে গুটলু একটা চেয়ারে বসল। আর টুম্পা টুনির বিছানায় পা তুলে বসল। টুনির ঘরটা টুনি সব সময় সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, ঘরের ভেতরে বেশির ভাগই হচ্ছে বই কাজেই সাজিয়ে রাখা সোজা। গুটলু এদিক সেদিক তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না একটা বাসায় এসে এরকম একটা বিপদে পড়বে।
টুনি বলল, “তুমি চাইলে একটা বই পড়তে পারো। আমার ঘরে অনেক বই। সব রকম বই আছে–”
গুটলু বলল, “আমি বই পড়ি না।”
টুনি প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “বই পড় না? কোনো বই পড় না?”
“খালি পাঠ্য বই পড়ি।”
“খালি পাঠ্য বই?”
“হ্যাঁ। সেইটাও পড়তে চাই না। যখন জোর করে তখন পড়ি।”
টুনি বিস্ফোরিত চোখে কিছুক্ষণ গুটলুর দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
“ক্লাস সিক্স।”
“গুড। আমার কাছে ক্লাস সিক্সের একটা অঙ্ক বই আছে। তুমি বসে বসে অঙ্ক কর।”
গুটলু কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, “বসে বসে অঙ্ক করব?”
“হ্যাঁ। সময়টা তো কাটাতে হবে। অঙ্ক করলে সময় কেটে যায়।” বলে টুনি কয়েকটা কাগজ একটা বলপয়েন্ট কলম, আর ক্লাস সিক্সের অঙ্ক বইটা গুটলুর দিকে এগিয়ে দিল। মানুষ যেরকম করে বিষাক্ত সাপ কিংবা বিছার দিকে তাকায় গুটলু সেভাবে অঙ্ক বইটার দিকে তাকিয়ে রইল।
টুনি বলল, “যদি অঙ্ক করতে না চাও তাহলে তুমি এই কাগজগুলোতে একটি রচনা লিখতে পার।”
“রচনা?”
“হ্যাঁ। সৎ জীবন এবং মহৎ জীবনের ওপর রচনা।”
গুটলু এমনভাবে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল যেন সে খুব খারাপ একটা কথা বলে তাকে গালি দিয়েছে।
টুনি বলল, “আর যদি কিছু করতে না চাও তাহলে চুপচাপ বসে থাকতে পার।”
“আমি চুপচাপ বসে থাকি।”
“ঠিক আছে।”
কিছুক্ষণ পর টুম্পা বলল, “আমি বাইরে যাই, গিয়ে দেখি কী অবস্থা।”
টুনি বলল, “যা। খুব সাবধান কিন্তু।”
টুম্পা দরজা খুলে বের হয়ে যাবার কিছুক্ষণ পর টুনি বলল, “গুটলু, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করতে পারবে?”
“আমি? একা?”
“হ্যাঁ। আমি একটু দেখে আসি।”
“কী দেখে আসবে?”
“বাসার কী অবস্থা।”
“যদি শান্ত ভাইয়া চলে আসে?
“চলে আসলে আসবে। কোনো রকম বাড়াবাড়ি করবে না। যেটা জিজ্ঞেস করে তার উত্তর দেবে। চেষ্টা করবে চোখের দিকে না তাকাতে।”
গুটলু ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল, “চোখের দিকে তাকালে কী হয়?
“অনেক সময় শান্তভাইয়ার ভায়োলেন্সটা বের হয়ে আসে। তাকে আরেক ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়াতে পারলে আরেকটু সেফ হবে।”
গুটলু বলল, “ও।”
“ঠিক আছে? যাব?”
গুটলু শুকনো মুখে বলল, “যাও।”
টুনি তখন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। গুটলু তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিল।
টুনি শান্তকে খুঁজে খুঁজে শেষ পর্যন্ত দাদির কাছে এসেছে। সব বাচ্চারা দাদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। দাদির মুখ শুকনো এবং চেহারা বিমর্ষ। একজন জিজ্ঞেস করল, “দাদি তোমার কী হয়েছে?”
দাদি বললেন, “বুকটা ধরফর করছে।”
দাদি উত্তর দেবার আগেই টুনি বলল, “দাদির বুক ধরফড় করছে তার কারণ গুটলু এই বাসায় এসেছে।”
“গুটলু?” সবাই অবাক হয়ে টুনির দিকে তাকাল। “গুটলু কে?”
টুনি বলল, “পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে। সে যে বাসায় যায় সেই বাসায় হয় সে আগুন ধরিয়ে দেয় না হলে পানিতে বাসাটা ভাসিয়ে দেয়।”
“কী বলছিস?” একজন অবাক হয়ে বলল, “সত্যি তাই করে?”
“হ্যাঁ, সেই বাসার জিনিসপত্র ভেঙেচুরে ফেলে না হয় বাসার মানুষজনের হাত পা কেটেকুটে যায়। সেই গুটলু এখন আমাদের বাসায়।”
“কোথায়?”
“আমার রুমে।”
“তোর রুমে কী করছে?”
“আমি যখন এসেছি তখন বসে ছিল। এখন কী করছে জানি না।”
বাচ্চাদের একজন বলল, “চল দেখে আসি।”
অন্যরা বলল, “চল।”
টুনি বলল, “না, না, সবাই যেও না। শুধু একজন গিয়ে নিয়ে এসো এখানে।”