দাদি মাথা নাড়লেন, বললেন, “সেটা অবশ্যি তুই খুব একটা ভুল বলিস নাই! গুটলুকে কোনো বিশ্বাস নাই।”
টুনি তখন টুম্পার দিকে তাকিয়ে বলল, “টুম্পা, তুইও কাউকে বলিস না। এই বাসায় খালি আমরা তিনজন জানব যে গুটলু হচ্ছে সাংঘাতিক একটা দুষ্টু ছেলে।”
টুম্পা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে টুনিকে, সে মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে টুনি আপু। বলব না।”
“আয় তাহলে আমরা একটা প্ল্যান করি, দেখি কীভাবে গুটলুকে সামলানো যায়।”
টুম্পা সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, “চল টুনি আপু।”
.
গুটলুর মা গুটলুকে নিয়ে এলো পরের দিন দুপুর বেলা। দাদির (কিংবা নানির) কাছে প্রায়ই এরকম অনেকে দেখা করতে আসে। কাজেই গুটলুকে নিয়ে গুটলুর মায়ের দেখা করতে আসা যে বিশেষ কোনো ঘটনা হতে পারে সেটা কেউ টের পেল না। বাইরের ঘরের দরজা খুলে টুনি গুটলু আর গুটলুর মা’কে দাদির কাছে নিয়ে এলো। গুটলু টুনির বয়সী কিংবা তার থেকে এক-দুই বছর ছোট হতে পারে। মায়া কাড়া চেহারা, মাথায় এলোমেলো চুল দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এই ছেলেটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেগুলোর একজন। চোখের দৃষ্টিতে কেমন যেন নিষ্পাপ সরল একটা ভাব, তবে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ মাঝে মাঝে ঝিক করে ভেতর থেকে দুষ্টুমিটা উঁকি দেয়।
গুটলুর মা দাদির পায়ে ধরে সালাম করে গুটলুকে বলল, “গুটলু, চাচিকে সালাম কর।”
দাদি ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, “না, না, না। সালাম করতে হবে না। সালাম করতে হবে না। আমি এমনিতেই দোয়া করে দেব।”
গুটলু তখন সালাম না করে একটা চেয়ারে পিঠ সোজা করে বসে এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। টুনি দাদির পায়ের কাছে বসে চোখের কোনা দিয়ে গুটলুকে লক্ষ করে। টুম্পা ধারে কাছে নেই। টুনি জানে যখন সময় হবে তখন চলে আসবে।
গুটলুর মা বেশ কিছুক্ষণ দাদির (কিংবা নানির) সাথে এটা-সেটা নিয়ে গল্প করল। গল্পের বিষয়বস্তু খুবই একঘেঁয়ে। অমুক কেমন আছে তমুক কেমন আছে। অমুকের মেয়ের বিয়ে হয়েছে তমুকের ছেলের বিয়ে ভেঙে গেছে, অমুক মারা গেছে তমুক মারা যাবে যাবে অবস্থা–এরকম গল্প। পুরো সময়টাতে গুটলু পিঠ সোজা করে বসে রইল, টুনিও দাদির পায়ের কাছে বসে রইল। গুটলুর মা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সে গুটলুকে এখান থেকে সরাতে চায় না।
শেষ পর্যন্ত গুটলুর মা উঠল, গুটলুকে রেখে দাদির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেল। অনেকগুলো বিয়ের কার্ড নিয়ে এসেছে, এই এলাকায় সবার বাসায় সেগুলো দিয়ে গুটলুকে নিতে আসবে-টানা কয়েক ঘণ্টার ধাক্কা।
টুনি উঠে দাঁড়াল, গুটলুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী আমার সাথে আসবে?”
গুটলু মাথা নেড়ে টুনির সাথে সাথে ঘর থেকে বের হলো। টুনি ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র কোথা থেকে জানি টুম্পা পা টিপে টিপে এসে হাজির হলো। টুনির কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তিন তলায়।”
টুনিও এদিক-সেদিক তাকিয়ে সতর্ক গলায় বলল, “ঠিক তো?”
“হ্যাঁ ঠিক। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে এসেছি।”
“তোকে দেখেছে?”
“না দেখে নাই।”
“দোতলায় যাওয়া যাবে?”
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, “এখন যাওয়া যাবে।”
“তাহলে আয় যাই।”
টুনি গুটলুর দিকে তাকাল, বলল “এসো। কোনো শব্দ করো না।”
গুটলু একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“কাল রাতে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে।“
“কে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে?”
টুনি ঝট করে ঘুরে গুটলুর দিকে তাকাল। বলল, “তুমি জানো না?”
“কী জানি না?”
“আমার একজন কাজিন যে ম্যানিয়াক? চেইন দিয়ে অন্ধকারে ঘরের ভেতর বেঁধে রাখতে হয়? টোটাল সাইকোটিকা ডিসঅর্ডার?”
গুটলু মাথা নাড়ল, বলল, সে জানে না।
টুনি গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, “এই জন্য আমি খুবই অবাক হয়েছি যখন দেখেছি তুমি আর তোমার আম্মু আজকে আমাদের বাসায় এসেছ। দাদি তোমাদের নিষেধ করে নাই?”
টুম্পা বলল, “টুনি আপু, দাদিকে তো বলে নাই। দাদির হার্টের সমস্যা সেইজন্যে খারাপ কিছু হলে এখন দাদিকে কেউ কিছু বলে না। শান্ত ভাইয়া যে জানালা ভেঙে বের হয়ে গেছে দাদিকে কেউ বলে নাই।”
টুনি বুঝে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, “সেইজন্যে দাদি তোমার আম্মুকে কিছু বলে নাই। অবস্থা খুব ডেঞ্জারাস হতে পারে।”
গুটলু শুকনো মুখে, জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ডেঞ্জারাস?”
টুনি উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্লাড গ্রুপ কী?”
গুটলু বলল, “ব্লাড গ্রুপ?”
“হ্যাঁ।”
“জানি না। কেন?”
“কখন কী দরকার হয় কে বলতে পারে। এর আগে তানজিম বেঁচে গেল কারণ তার রক্তের গ্রুপ জানত। হাসপাতালে নিয়ে তাকে সাথে সাথে রক্ত দেওয়া গেছে।”
গুটলু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তানজিম কে?”
“আগেরবার যখন এরকম অবস্থা হয়েছিল তখন যে ভাইয়া এসেছিল। এর পরে থেকে সবসময় বাসার সামনে একটা অ্যাম্বুল্যান্স রেডি রাখা হয়।” টুনি টুম্পাকে বলল, টুম্পা দেখ দেখি অ্যাম্বুল্যান্সটা আছে কী না।”
টুম্পা জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “না, দেখি না তো।”
টুনি বলল, “কী মুশকিল।”
টুম্পা বলল, “মনে হয় ওষুধ খাওয়ানো গিয়েছে সেই জন্যে দেরি করছে।”
টুনি বলল, “তা ঠিক। পুরো ডোজ নিউরো হেক্সা গ্লাইকোজিন খাওয়ানো গেছে।”
গুটলু জিজ্ঞেস করল, “এইটা খেলে কী হয়?”