“না না না চাচি কী বলেন আপনি? আপনাকে নিজের হাতে কার্ড না দিলে কাকে দেব? আমি নিজে এসে দিয়ে যাব।”
নানি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না, না–তোমার এত কষ্ট করার কোনো দরকার নাই। তুমি কার্ডটা কুরিয়ার করে দাও। আমি পেয়ে যাব। আজকাল সবাই তাই করে।”
“সবাই করে দেখে আমিও করব? আপনার সাথে? কখনো না।”
“নানি হাল ছেড়ে দিয়ে দুর্বল গলায় বললেন, ঠিক আছে।”
“তা ছাড়া আপনি কত দিন গুটলুকে দেখেন নাই।”
নানি কেমন জানি আতকে উঠলেন, “শুটলু?”
“হ্যাঁ। গুটলু মনে নাই আপনার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। খুব ভালো করে মনে আছে।”
“একটু বেশি চঞ্চল হয়েছে। কিন্তু এই বয়সের বাচ্চারাতো একটু চঞ্চল হবেই। তাই না?”
নানি শুকনো মুখে ঢোক গিললেন। বললেন, “হ্যাঁ। একটু তো হবেই।”
“আমি কী ভাবছি জানেন চাচি?”
“কী ভাবছ?”
“গুটলুকে আপনার কাছে রেখে আমি এই এলাকায় সব বাসায় কার্ড দিয়ে ফেলি।”
নানি প্রায় আর্তনাদ করে বললেন, “না। না; আমার কাছে রেখো না। আমি ছোট বাচ্চাদের দেখে-শুনে রাখতে পারি না। বয়স হয়ে গেছে তো”
টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মহিলাটি হা করে হাসির মতো শব্দ করে বলল, “কী বলছেন চাচি? আপনার বয়স হয়ে গেছে? আপনি হচ্ছেন চির তরুণ! আপনার বয়স হয়ে গেলে আমরা কোথায় যাব?”
“না মানে আজকাল আর ছোট বাচ্চাদের সামলাতে পারি না।”
“আপনাকে সামলাতে হবে না। আপনার বাসায় আরো বাচ্চা-কাচ্চা আছে। গুটুল ওদের সাথে খেলবে।” মহিলা হঠাৎ গলার সর পাল্টে বলল, “বুঝলেন চাচি, আপনার কাছে রেখে যেতে চাই তার কারণ আপনি বাচ্চাদের আদর করেন–আজকাল কী হয়েছে কে জানে, গুটলুকে নিয়ে যাব শুনেই একজন বলে বসল আসার দরকার নাই। চিন্তা করতে পারেন?”
নানি দুর্বল গলায় বললেন, “না। পারি না।”
মহিলা আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে দিল, নানি সারাক্ষণ শুধু হু হাঁ বলে গেলেন। টেলিফোনে কথা শেষ করার পর নানি বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, তাকে দেখে মনে হতে লাগল এইমাত্র কোনো একটা মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন।
টুম্পা কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন টুনি এসে ঢুকল, নানিকে একনজর দেখে বলল, “নানি তোমার কী হয়েছে?”
নানি উত্তর দেওয়ার আগেই টুম্পা বলল, “গুটলুর মা ফোন করে বলেছে। গুটলুকে সারা দিনের জন্য নানির কাছে রেখে যাবে।”
টুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “গুটলু? মানে সেই ভয়ংকর দুষ্টু ছেলে?”
টুম্পা বলল, “তুমি গুটলুকে চেন?”
“উঁহু। শুধু গল্প শুনেছি।”
“আমাদের বাসায় কখনো এসেছে?”
“না। এখন পর্যন্ত যে যে বাসায় গেছে সেই বাসাগুলো ধসে গিয়েছে। তাই না দাদি?”
দাদি (কিংবা নানি) দুর্বলভাবে মাথা নাড়লেন।
টুম্পা জিজ্ঞেস করল, “গুটলু কী করে?”
“একজনের বাসায় ড্রইংরুমের কার্পেটে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। “সর্বনাশ!”
“আরেকজনের বাসায় তাদের পোষা বিড়ালটা মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ঢুকিয়ে গরম করার চেষ্টা করেছিল।”
টুম্পা চোখ কপালে তুলে বলল, “হায় খোদা।”
“আরেকবার একজনের বাসায় গিয়ে তাদের ল্যাপটপের ওপর কোক ঢেলে দিয়েছিল।”
“কেন?”
“কোকে নাকি ঝাজ ছিল না, সেইজন্যে।”
“কী সর্বনাশ! তারপর–”
“তারপর আর কী! ল্যাপটপটা শেষ।”
টুম্পা বলল, “তার মানে গুটলু খালি দুষ্টু না অনেক ডেঞ্জারাস।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল “হ্যাঁ অনেক ডেঞ্জারাস। পকেটে চুইংগাম থাকে, সেইটা চাবায় তারপর সেটা এখানে সেখানে লাগিয়ে দেয়। ফেবারিট জায়গা মানুষের চুল-দাড়ি, মোছ।”
“হায় হায়।”
“একটা বাসায় গুটলু গিয়েছিল পরের দিন সেই বাসার প্রত্যেকটা মানুষের কারো এক মাথায় চুল নাই কারো একদিকের মোছ নাই কারো দাড়ি অর্ধেক নাই–”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি। কোনো বাসায় গিয়ে যদি মার্কার পায় তাহলেই গেল।”
“কেন?” “সেই মার্কার দিয়ে দেওয়ালে ছবি আঁকে। স্লোগান লিখে।”
“কিসের ছবি? কিসের স্লোগান?”
“কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং। আজেবাজে স্লোগান।”
টুম্পা খানিকক্ষণ মুখ হা করে টুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “এই ছেলেটা আমাদের বাসায় আসবে? সারাদিন থাকবে?”
টুনি বলল, “সেটা তো জানি না। তারপর দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদি, সত্যি নাকি?”
দাদি দুর্বল গলায় বললেন, “তাইতো বলল। শুনে শরীর খারাপ হয়ে গেছে। ঝুমুকে ডেকে বলত বুকের মাঝে একটু তেল মালিশ করে দিতে। কেমন যেন লাগছে।”
টুনি দাদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “দাদি। তুমি চিন্তা করো না। তোমার গুটলুকে আমরা সামলাব।”
“ঐ ছেলেকে তোরা কীভাবে সামলাবি? এই ছেলে এখন পর্যন্ত যে বাসায় গেছে সেই বাসায় হয় আগুন ধরেছে, না হয় জিনিসপত্র ভাঙচুর হয়েছে না হয় কারো শরীর কেটেকুটে গেছে, না হয় বাসা পানিতে ভেসে গেছে–তোরা ওই বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবি?”
“টুনি বলল, দেখি চেষ্টা করে সামলানো যায় কিনা। দাদি, তুমি এখন আর কাউকে বলো না বাচ্চাটা দুষ্টু।”
“বলব না?”
“না দাদি শুধু শুধু সবাইকে আগে থেকে ভয় দেখিয়ে কী লাভ?”
দাদি (কিংবা নানি) দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে তুই যদি তাই চাস তাহলে বলব না। আমি আরো ভাবছিলাম আমার পরিচিত একজন পুলিশের এসআই আছে সাথে সবসময় পিস্তল থাকে, তাকে বলে রাখতাম।”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু! পরে গুটলু ঐ পিস্তল দিয়ে কিছু একটা করে ফেলবে।”