কী সারপ্রাইজ?
মনে আছে তুই আমাকে ছবি আঁকতে বলেছিলি? আমি ছবি আঁকতে পারছিলাম না–
হ্যাঁ।
আমি শেষ পর্যন্ত ছবি এঁকেছি।
সত্যি? সত্যি আব্বু?
সত্যি। আব্বু একটু হাসার চেষ্টা করলেন, বললেন, অনেকদিন পর ছবি আঁকলাম তো তাই অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু মনে হয় শেষ পর্যন্ত যেটা আঁকতে চেয়েছিলাম সেটা আঁকতে পেরেছি। তোকে দেখিয়ে আমি অবাক করে দিতে চেয়েছিলাম!
আব্বু একটু অপেক্ষা করে বললেন, টুম্পা মা আমার, তুই সত্যি যাবি না আমার সাথে?
টুম্পা আর পারল না, আব্বুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। বলল, যাব আব্বু যাব। যাব।
সিঁড়ির উপরে ছোটখালা দাঁড়িয়েছিলেন, নিচু গলায় ডাকলেন, টুম্পা! জি ছোটখালা।
যাবার আগে তোর আব্বুকে নিয়ে একটু উপরে আর, আমরা সবাই মিলে একটু গল্প গুজব করি।
টুম্পা উঠে দাঁড়িয়ে আব্বুর হাত ধরে বলল, চল আব্বু।
এক মুহূর্তের জন্যে আব্বুর মুখে এক ধরনের অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠে। আব্বু জোর করে সেটা সরিয়ে ফেলে বললেন, চল!
.
টুম্পা আব্বুর আঁকা ছবিটার দিকে হতচকিতের মতো তাকিয়ে রইলো। তার মনে হতে লাগলো তার বুঝি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে! আমেরিকার কতো আর্ট গ্যালারিতে গিয়ে সে কতো অসাধারণ পেইন্টিং দেখেছে কিন্তু এই ছবিটার মতো কোনো ছবি কী তাকে এরকম অভিভূত করেছে? ছবিটার দিকে তাকালেই সে বুঝতে পারে এর মাঝে একটা মানুষের বিচিত্র একটা ভাবনার জগৎ লুকিয়ে আছে, যে জগন্টার খোঁজ অন্য কেউ কোনোদিন পাবে না। ছবিটার মাঝে এক ধরণের বিষাদ লুকিয়ে আছে, কী জন্যে লুকিয়ে আছে সে বুঝতে পারে না, শুধু অনুভব করতে পারে।
টুম্পা আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু, তুমি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পার?
আব্বু বাচ্চা ছেলের মতো খুশি হয়ে উঠে বললেন, ভালো লেগেছে
অ-স-ম্ভব ভালো লেগেছে আব্বু। অ-স-ব ভালো! তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্টিস্ট।
ধূর বোকা মেয়ে?
আমি বোকা না আব্বু! আমি ভালো ছবি আর খারাপ ছবি বুঝি। পৃথিবীতে বিখ্যাত ছবি আছে আর ভালো ছবি আছে। সব বিখ্যাত ছবি ভালো না আর সব ভালো ছবি বিখ্যাত না! তোমার এটা ভালো ছবি আব্বু অসম্ভব ভালো ছবি।
আব্বু আবার বললেন, ধূর বোকা মেয়ে।
টুম্পা বলল, আব্বু তুমি আর ছবি আঁকবে না?
আঁকব।
আঁকো আব্বু, আমি দেখি তুমি কেমন করে আঁকো।
তুই দেখবি?
টুম্পা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ আব্বু। একটু পর আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল, আব্বু–
কী, মা?
তুমি আমাকে ছবি আঁকতে শেখাবে।
তুই ছবি আঁকা শিখতে চাস?
হ্যাঁ আব্বু। আমি বড় হয়ে তোমার মতোন একজন আর্টিস্ট হতে চাই।
আব্বু টুম্পার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, দেখিস তুই আমার থেকেও বড় আর্টিস্ট হবি।
ঠিক আছে দেখব। কিন্তু এখন তুমি আরেকটা ছবি আঁকো। আমি দেখব।
.
আব্বু তখন ইজেলে একটা ক্যানভাস বসিয়ে আরেকটা ছবি আঁকতে শুরু করলেন। টুম্পা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে–আব্বুর হাতের ছোঁয়ায় সাদা ক্যানভাসটি কী অপূর্ব একটা ছবি হয়ে উঠতে থাকে। টুম্পার কাছে মনে হয় কেউ যেন তার হাত ধরে একটা স্বপ্নের জগতে নিয়ে যাচ্ছে, যতই সামনে যাচ্ছে। ততই সেটা রূপকথার জগতের মতো তার সামনে খুলে যাচ্ছে।
ছবিটা শেষ করে আব্বু আরেকটা ছবি আঁকলেন, তারপর আরেকটা। তারপর আরেকটা। তারপর আঁকতেই থাকলেন।
দুই সপ্তাহ পর আব্বুর ছোট বাসার মাঝে একুশটা এক্রেলিকের ছবি জমা হয়ে গেল, একটি থেকে আরেকটা বেশি সুন্দর, বেশি রহস্যময়। টুম্পা তখন তার আব্বুর হাত ধরে বলল, আব্বু।
আব্বু বললেন, কী মা?
তোমার ছবির একটা এক্সিবিশান করি?
আব্বু হা হা করে হাসলেন, বললেন, ধূর বোকা মেয়ে এই এক্রেলিক পেইন্টের ছবি কে দেখবে। এগুলো ছেলেমানুষী ছবি।
টুম্পা বলল, আব্বু আমাকে তুমি ছোট বাচ্চা পাও নি। আমি ভালো ছবি আর খারাপ ছবি বুঝি। তোমার এই ছবিগুলোর এক্সিবিশান করে আমরা গ্যালারিতে দিয়ে দেব।
আব্বু হাসলেন, বললেন, ধূর বোকা! এই ছবি গ্যালারিতে দিয়ে কী হবে?
.
টুম্পা অবশ্যি অসাধ্য সাধন করে ফেলল। ধানমণ্ডিতে একটা গ্যালারি ভাড়া করলো–ছোট খালু সেটার জন্যে সাহায্য করলেন। ছবি প্রদর্শনীর জন্যে একটা কার্ড ছাপানো হলো, আব্বু নিজেই সেটা ডিজাইন করে দিলেন, ছাপানোর কাজে সাহায্য করলেন ছোটখালা। টুম্পা সুমিকে নিয়ে সেই কার্ডগুলো সবার মাঝে বিতরণ করলো এখানে সাহায্য করলো ছোটখালার ড্রাইভার। খবরের কাগজের অফিসে যখন কার্ডগুলো বিলি করতে যাচ্ছিল তখন একটা মজার ঘটনা ঘটলো।
গেটে একজন দারোয়ান তাদের থামালো, জিজ্ঞেস করলো, কার সাথে দেখা করতে চায়। টুম্পা কিংবা সুমি–পত্রিকার অফিসের কাউকেই চেনে না তাই আমতা আমতা করে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করল, একটা ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে তারা তার দাওয়াতের কার্ড দিতে এসেছে। দারওয়ান বলল, তার হাতে দিয়ে যেতে সে পৌঁছে দেবে, টুম্পা দিয়ে যেতে চাচ্ছিল সুমি রাজী হলো না, সে ভেতরে গিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চেহারার কারো হাতে দিতে চায়।
যখন এসব নিয়ে একটু কথা কাটাকাটি হচ্ছে ঠিক তখন মাঝ বয়সী একজন মানুষ অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল সে থামলো, জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে?
সুমি বলল, আমরা একটা দাওয়াতের কার্ড দিতে এসেছি–ইনি ভিতরে যেতে দিচ্ছেন না।