শেষ পর্যন্ত সেদিন সকালে রানী তার মহলের অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে বললেন, রূপসী, রূপচাঁদকে ডাক। রূপচাঁদ উঠতে উঠতে তাকে সিঁড়ি দিয়ে দরবার হলের দিকে নামতে দেখলো। রানী রূপচাঁদকে বললেন–নায়েবমশায়কে দরবার হলে আসতে বলল।
রানী দরবারের ঘরে বসতেই রূপসী জানাতে এলো রূপচাঁদকে সে খবর দিয়েছে। রানী মিষ্টি করে হেসে বললেন–রূপী, একবার রাজকুমারের মহলে যাও। রাজকুমারের সময় থাকলে জানিও, আমি কথা বলবো।
যদি বলা হয় নায়েবমশায় কিংবা হরদয়াল তখন জানতো না চার্চের কথা, তবে বলতে হয় দুজনেই বয়সের ভারে শ্লথ হয়ে পড়েছিলো। নায়েব শুনে নিজেকে বলেছিলো, তাতে তোমার কীরে বাপু? যে খবর এনেছিলো তাকে বলেছিলো, দূরে দূরে থাকো গা। হরদয়ালকে খবরটা দিয়েছিলো বাগচী নিজে। আবার রলের চিঠি পেয়েছিলো বাগচী। সে এই ভাবতে চেষ্টা করেছিলো, রলে হয়তো মরেলগঞ্জের এবং ইন্ডিগো কমিশনের কথা জানে না। সে ভাবছে, হয়তো এখনো সব আগের মতোই আছে। কিন্তু সংবাদটা হরদয়ালকে জানানো দরকার যদিও রলের চিঠির প্রস্তাব মতো হরদয়ালকে অনুকূলে আনার চেষ্টা সে আর করতে পারে না।
হরদয়াল ও নায়েব, প্রায় একইসঙ্গে এসেছে তারা, বসলে রানী বললেন–ফরাসডাঙায় চার্চ হচ্ছে?
–আজ্ঞা, হাঁ।
–শুনেছো কালেক্টর নিজে নাকি উদ্যোগের পিছনে।
নায়েব বললো–অতটা শুনিনি।
রানী একটু ভেবে বললেন, এবার লাটের দিন এখন আসেনি। গত সনের ফরাসডাঙার লাট নাকি পিয়েত্রোর উকিল দয়ালকৃষ্ণ দিয়েছে।
হরদয়াল বললো–এরকম কিছু অসম্ভব নয়। নতুবা গত সনে ডাকে উঠত।
নায়েবমশায় বললো–গৌরী খবরাখবর নেয়। সে বলেছিলো, পিয়েত্রো মৃত্যুর আগে দয়ালকৃষ্ণকে এই মর্মে আমমোক্তারনামা দিয়েছে যে ৬১ সন তক সে আদায় করবে এবং লাট দিতে থাকবে।
হরদয়াল ভেবে বললে–এটা একটা আইনের ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে, উকিল তো ওয়ারিশ নয়।
রানী বললেন–ওয়ারিশ নেই বলে, লাট দেওয়া সত্ত্বেও কালেক্টর কি ওটাকে খাস করে নিচ্ছে মনে করো?
হরদয়াল বললো–খাস এখনো করেনি, চার্চের সাহেবদের অনুমতি দিয়েছে, পরে খাস হবে স্থির করেছে হয়তো। চৈত্র শেষ হতে আর কদিন?
রানী যেন খুব লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন–অথচ, দ্যাখো, ভেবেছিলাম ওই টিলাটায় একটা সুন্দর বাড়ি হয়। আবার হয়তো ডিয়ার পার্ক হয়ে ওঠে।
হরদয়াল বিমর্ষ বোধ করলো, কারণ উত্তরটা সুখের হয় না। নায়েব ভাবলো, রানী কি ভেবেছিলেন যেমন শিবমন্দিরের বেলায় তেমন এই প্রাসাদের ব্যাপারে জবরদখল করে বেওয়ারিশ পিয়েত্রোর খাসজমি রাজবাড়ির সম্পত্তি করে নেবেন?
নায়েব বললো, রায়মশায় ঠিকই বলেছেন। ওটা আইনের প্রশ্নই দাঁড়াচ্ছে। মৃতের আমমোক্তারনামাও অচল। যদিবা লাট জমা পড়ে থাকে তা কিন্তু পিয়েত্রো জীবিতই এরকম বিশ্বাসে।
রানী ভাবতে লাগলেন। একবার তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো, একবার তার সুন্দর ছোটো কপালটা যেন ছায়া পড়ে বিবর্ণ হলো। তিনি হঠাৎ বেশ জোর দিয়ে বললেন না, তা হয় না। ফরাসডাঙার কিছুই খাস করতে দিতে পারি না।
এই সময় রাজকুমার বাগচীকে নিয়ে দরবারে এসে বসলো।
রানী তা দেখে বললেন রাজু, পিয়েত্রোর ফরাসডাঙা সরকার খাস করার মতলব নিয়েছে বোধ হয়।
রাজকুমার একটু ভেবে বললো–আপনার মন্দিরটাকেও দখলে নেবে নাকি?
রানী বললেন–তুমি এখন বড়ো হয়েছে, রাজু। একটু থেমে বললেন, শুনুন নায়েবমশায়, শোনো হরদয়াল। ওটা আমার চাই।
নায়েব বেশ বিচলিত হলো। হরদয়াল বললো, কী করে তা পারা যাবে যদি ওটা লাটের নিলামে ডাকার সুবিধা না হয়? আমরা জানি না কালেক্টর কলকাতায় পিয়েত্রো সম্বন্ধে কিছু লিখেছে কিনা, সেখান থেকে খাস করার মতো আনিয়েছে কিনা রেভেনু বোর্ডের।
রানীর ঠোঁটের কোণ দুটি শক্ত হলো। বললেন, তাহলে রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে লড়তে তৈরী হও।
নায়েব বললো, তার আগে কিন্তু কালেক্টর চার্চ তোলার অনুমতি দিয়ে বসেছে। চার্চ উঠে যাবে।
রানী বললেন, এমন কি কেউ নেই যে টিলাটাকে আমার দখলে এনে দিতে পারে? আমি নতুন বন্দোবস্তে তাকেই ফরাসডাঙার পত্তনিস্বত্ব দেবো।
হরদয়াল বললো, দখল করে নেওয়ার ঝুঁকি আছে এক্ষেত্রে। তাছাড়া, রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে মামলা লড়ে যাওয়ার জন্যই এমন কিছু দখল নেওয়া যায় না।
রানী বললেন, আমরা বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলেও যেতে পারি তো?
হরদয়াল মৃদু হেসে বললো, রানীমা, মামলায় তো অন্তত কিছুটা যুক্তি থাকবে। বেওয়ারিশ একজন ফরাসীর সম্পত্তির ব্যাপারে কালেক্টরের আদেশকে অগ্রাহ্য করার পক্ষে অন্তত কিছু স্বত্বের জোর থাকা দরকার।
রানীমুখ নিচু করে নিজের হাত দেখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, মুখ তার থমথম করছে, ও ফরাসডাঙার সবই রাজুর, রাজুর মাতুল-সম্পত্তি। রাজু ব্যতীত পিয়েত্রোর আর কোনো । ওয়ারিশ নেই। যেন লজ্জায় শিউরে-রানী উঠে দাঁড়ালেন।
বাগচী হঠাৎ বলে উঠলো, আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, রানীমা সঠিক যুক্তি দিয়েছেন। আমি মঁসিয়ে পিয়েত্রোর কাছে শুনেছিলাম, তাঁর মাতুলকন্যা, তিনি ব্রাহ্মণ কন্যাও বটেন, কোথাও রানী। এখন বুঝতে পারছি, তিনিই আমাদের রানীমাতা।
হরদয়াল ও নায়েবরানীর উঠেদাঁড়ানো দেখে বুঝতে পেরেছিলো দরবার শেষ হয়েছে। নায়েব আজকাল আগের মতো তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে না। সে চিন্তাকুলও বটেইতিমধ্যে। সে ধীরে ধীরে উঠে রানীমাকে নমস্কার করতে গিয়ে দেখলো রানী চলে গিয়েছেন। নায়েব চলে গেলেও হরদয়াল দু-এক মিনিট তেমনি বসে রইলো। তার বিস্ময় যেন কাটতে চাইছে না।