কেট বললো–যা তার্কিক তুমি। তোমার মনে হতে পারে, ইউক্যারিস্ট নিয়ে কীবলের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
এঃ? বলে হাসলো বাগচী। কিন্তু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে সে ভাবলো, খ্রিশ্চিয়ান স্যাক্রামেন্টের আচরণ বিধিতে যে প্রতীকরূপে ইউক্যারিস্টের মদ আর রুটির কথা আছে তা তার কাছে কিছু স্থূল ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু তাহলেও তার সঙ্গে শিবপূজার প্রতীকময়তার তুলনা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বিষণ্ণ হলো সে!
সে নিজে ইউক্যারিস্ট মানে না। এটা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা যে সে, নিজের অজ্ঞাতেই প্রায়, স্যাক্রামেন্টের প্রতীককে আর এক স্কুল প্রতাঁকের সঙ্গে তুলনায় এনেছে? অর্থাৎ যেন এই কারণেই সে স্যাক্ৰামেন্ট থেকে দূরে থাকে?
তার বিষণ্ণ মন কিছুক্ষণের জন্য যেন চিন্তাশূন্য হলো। অন্য কথায় তার মন চোখের দেখা বিষয়গুলিকে অবলম্বন করলো। গাড়িটা চলছে। যেমন শব্দ করার ও ঝাঁকি দেবার তা হচ্ছে। রাস্তা দিক বদলাচ্ছে। পথের ধারে কোথাও ফাঁকা, কোথাও ছায়ার গাছ। ছই-এর ভিতরে সবসময়েই দুপুরের আলো। তাহলেও তা কিছুটা তীক্ষ্ণ, অথবা ম্যাটমেটে হচ্ছে থেকে থেকে। একবার একটা বড়ো গোছের আঁকুনি কেট ছই-এর বাতা ধরে সামলে নিলো।
বাগচী ভাবলো, রোসো, রোসো। কোথায় ঠিক মনে পড়ছে না, সে শুনেছে শালগ্রাম শিলাতেও শিবপূজা হয়ে থাকে। তাহলে? পূজার জন্য এই স্কুল প্রতীকটাই অনিবার্য না ও হতে পারে। শালগ্রামশিলা শোনা যায় অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, আর বৃত্তের চাইতে, স্ফিয়ারের চাইতে পরিপূর্ণ কী আর কল্পনা করেছে মানুষ?
আসল কথা–আরো কিছু লেখাপড়া দরকার। বেশ কিছুদিন থেকে সে যা পড়ছে তা ধর্মগ্রন্থ নয়–চিকিৎসাশাস্ত্র। এটা ভালো নয়। বাগচী হেসে ফেলো আপন মনে। রোসো, আর একবার ক্যাম্পানেলা থেকে শুরু করতে হবে। গ্রীকরাও গোলককে পরিপূর্ণ মনে করতো।
কেট বললো–কথা বলছো না যে?
না, ডার্লিং, গুঁতো খাওয়া না খাওয়ার মধ্যে যখন কাগজের মতো পাতলা সতর্কতা, তখন অন্যমনস্ক হতে চাই না।
সে হেসে নিলো। ভাবলো : হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠার উৎসবে বিলেতি খানা নিষিদ্ধ খানাই বলতে পারো। তারা রাজী হলো কেন? দেওয়ানজি, যিনি বন্ধু ও পেট্রন, বলেছিলেন বলে? ডানকান তাকে বিদ্বেষ করে, বিদ্রূপ করে, কেটের নামে চূড়ান্ত কুৎসা রটায়। অথচ এখানে কেট আজ হোস্টেস! প্রমাণ করা হলো তার। ক্রিশ্চিয়ান?
সে অবাক হলো।
.
০৮.
শিব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে এয়োস্ত্রীরা এসেছিলো তাদের পুরোধা ছিলো নায়েবমশায়ের স্ত্রী। রানী যাকে বড়োবউ বলেন। রানী চলে গেলেও তার কিছু কাজ ছিলো। এয়োস্ত্রীদের সবাইকে পান, গন্ধতেলের মশলা, বাতাসা প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা সেই কাজের একটি। বিশেষ করে রাজবাড়ির ব্যাপারে এয়োদের সংখ্যার শেষ নেই। কিন্তু সে কাজও একসময়ে শেষ হলো।
ভিড় এখন কমে গিয়েছে, যে মেলা জমে উঠেছিলো তাও এখন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যদিও দু-চারজন করে লোক এখনো আসছে। সিঁড়ি বেয়ে সেকালের হাওয়াঘর একালের মন্দিরের চত্বরে ওঠাও কম কৌতুক নয়। মিস্ত্রিরা কাজ করছে, নিচে কুমোর ছবি-টালি বানাচ্ছে–এসবই কৌতূহলের ব্যাপার। এমন সময়ে নায়েবমশায় এলেন গিন্নিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অনেক বেলা হয়েছে, নাহার হয়নি।
নায়েবমশায় দেখলেন, ভিড়ের থেকে কিছু দূরে, চত্বরের উপরে, নদীর দিকে এগিয়ে, রোদ মাথায় একা দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী। যেন নদীর দিকে কিছু দেখছে। কিন্তু এখন সেখানে কীই বা দেখা যাবে! রোদে জল ঝলমল করছে। আসলে তো বালু। চোখে ধাঁধা লাগবে। শেষ হেমন্তের দুপুর শেষ হচ্ছে।
নায়েবমশায়ের মনে হলো সেই কবে এসেছিলো তার সংসারে আট বছরের খুকিটি; তারপর এই চল্লিশ বছর গেলো চার দেয়ালের মধ্যে; এতটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে এতখানি নদীই বা কবে দেখেছে! অথচ–না, ভঙ্গিটা ভালো লাগলো না যেন।
কিন্তু সেও তো নায়েব। কথায় বলে পরগনাগুলো তার হাতের তেলো। সে তাড়াতাড়ি বললো–গাড়ি এসেছে, এসো।
মনে মনে বললো–হ্মুঃ।
হাওয়াঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বললো– আবার–তাছাড়া দ্যাখো, তোমাকে তোতা বলেছি তাঁতাঁকে বলে দিও। ধুতির ঝুল সে ক্রমেই বাড়াচ্ছে। কোচার নিচেয় দ্যাখো কাদা মাটিতে একসা। নয় মিলের খাটো ধুতিই দেখো। তাই তো পরে সকলে আজকাল।
নায়েবগিন্নি চোখ নামিয়ে আনলো। চত্বরের নিচে কিছুদুরে নায়েবমশায়ের সাদা ক্যানভাসের ছইসমেত গোরুগাড়িটা চোখে পড়লো। বললো–অনেক বেলা হলো। চলো, তোমার স্নান খাওয়া হয়নি।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছাকাছি এসে মৃদু হেসে,নায়েবগিন্নি বললো, একটু বোসো, পুরুতঠাকুরের সঙ্গে একটা কথাকয়ে আসি। নায়েবগিন্নি পূজারীদের জন্য তৈরি ঘরগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পাশে নায়েবমশায়।
নায়েবগিন্নি হাসতে হাসতে বললো–লাঞ্চো করলেও পারতে। না খেয়ে কষ্ট হতো না। কিন্তু ভাগ্যে তুমি লাঞ্চো করতে যাওনি, একা একা ফাঁপরে পড়তেম।
নায়েব বললো–হ্মুঃ!
পুরুতঠাকুরের ঘরে কাছে এসে নায়েবগিন্নি বললো–শিবপূজায় রক্তচন্দন কেন লাগে তা একটু জিজ্ঞাসা করবো। আমরাও তো গ্রামে একটা পিতিষ্ঠে করেছি, আর সার্বভৌম ঠাকুরই তখন বিধান দিয়েছিলেন। রক্তচন্দনের বাটির উপরে অষ্টধাতুর শতদোল রাখার বিধান দেননি কিন্তু।