শুকনো মুখে পুরো প্রশ্ন করেছিলো–চাচা, এক চারি পানিতে বিষ মেশালে কয়ডা গোরু মরে।
রজব আলির মাথায় তখন অন্য গোরুগুলির নিরাপত্তার কথা ঘুরছে, রাগ হচ্ছিলো গোরুগুলোর উপরে। শালার জেতের খাওয়ার কামাই নি। দুইপর রাতে কলার পাতে মুড়ে সামনে যা কেন দ্যাও, উঁস করে খায়ে ফেলাবি। আর তার উপরে আছে এই ভয়ংকর পাপের প্রতিবিধিৎসা। শিশুর মতো অবুঝ প্রাণী, তাকে কিনা খাবার নাম করে বিষ তুলে দেয়। সুরোর কথা সে শুনতে পেলো না।
ইয়াকুবের স্ত্রী ঘড়ায় জল এনে দিয়েছে হাত-পা ধোবার। সেই কাদায় ভারি ময়লাটে জলে হাত-পা ধুতে ধুতে মনটা যখন রজব আলির একটু স্থির হয়েছে, তখন ইয়াকুবের স্ত্রী বললো–সুরো কচ্ছিলো অও নাকি পরী দ্যাখছে! ও কয় বেটা ছাওয়াল, আমি কই মিয়ে মানুষ।
রজব আলির হাত-পা ধোয়া বন্ধ হয়ে গেলো, সে সাগ্রহে প্রশ্ন করলো–সুরো বেটা-ছোওয়াল দ্যাখছে?
পুরুষই যদি হয় তবে কাল্পনিক জিন বা পরী নয়। তাদের চাইতে শতগুণে বীভৎস দুশমন, মানুষ–যে বিষ দেয় গোরুকে।
ঘরে ফিরে সুরতুন তখন দু-তিনটে পাটকাঠি একত্র করে একটা মশাল বানিয়ে নিজের গোরুটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখছে। যে-চারিটায় খাচ্ছিলো রজবআলির মৃতবৎসটি সেটা থেকেই নিজের গোরুটাকে খড় এনে দেয়নি এমন প্রমাণ নেই,বরং এনে দিয়েছিলো একথাটাই আশঙ্কিত মনে দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে। এমন সময় রজব আলি ডাকলো তাকে।
সেই পরীর কথা আবার। ফতেমা যখন চোখ বড়ো বড়ো করে গল্প করেছিলো, সে এক। পরীকে রোজ সকালে গোরুর চারির কাছে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে তখন সুরতুনের অন্তস্তল শুকিয়ে গিয়েছিলো। সে নিজে জিন পরীমানেনা, কাজেই তার বিশ্বাস হলো ফতেমা যদি সত্যিই কাকেও দেখে থাকে তবে সে তাকেই দেখেছে। কী সর্বনাশ! সে তখন ফতেমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য বললো–আমিও দেখছি পরী, খুব কাছে দাঁড়ায়ে দেখছি। ইয়া গালপাট্টা তার, একমাথা ঝাকড়মাকড় চুল। ফতেমার তাক লেগে গিয়েছিলো।
কিন্তু রজব আলি যখন তার দরজায় এসে হাঁক দিয়ে দাঁড়ালো তখন ভয়ে হকচকিয়ে পুরুষ জিনের কথা বলতে পারলো না সে। সে নিজেই সকালে চারির কাছে যায়, বলে ফেলো।
–গেছিলি কে, তাই ক। সুরতুন নির্বাক।
–কেন তাই ক।
সহসা রজব আলির মনে হলো সত্যটার তলদেশও সে দেখতে পেয়েছে : এটা সুরতুনের অকারণ জ্ঞাতিবৈর সাধন। জ্ঞাতির মেয়ে কিনা তাই।
প্রথম চড়টা খেয়ে সুরতুন হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলো, কিন্তু উপর্যুপরি চড় পড়তে লাগলো যখন, বোবা কান্নায় হাহাকার করতে লাগলো সে। পড়শির ভিড় জমে উঠলো রজব আলির উঠোনে। সুরতুনের গায়ের কাপড়টুকু দড়ির মতো পাকিয়ে তার গলা টেনে ধরেছে রজব আলি। অস্পষ্ট আলোয় সুরতুনের পিঠের ও পাঁজরার হাড়গুলো চোখে পড়ছে, তার ধূলিমলিন বুকের মেদহীন আকুঞ্চিত স্তন দুটি।
.
মাধাই বায়েন বিষ দিতো গোরুকে।
চামড়ার ব্যবসায়ী সানিকদিয়ারের কফিলুদ্দি সেখ। বাবোখানা ছাল পৌঁছে দেবার বরাত নিয়ে মাধাই আষাঢ় মাসে পঁচিশ টাকা আগাম নিয়েছিলো তার কাছ থেকে। কিন্তু বরাত রাখা সহজ কথা নয়। সে ছাড়াও ছাল তুলবার লোক এঅঞ্চলে আছে, কেউ-কেউ আবার কফিলুদ্দির মাইনে করা।
তিনখানা ছাল পৌঁছে দেবার পর বিপদে পড়লো মাধাই, আর গোরু মরছে না এ অঞ্চলে। ওদিকে কফিলুদ্দির তাগাদা। তাগাদা শুধু মুখেই নয়,হাটফেরতা পথে গালমন্দও বটে। এই পথে নামলো মাধাই। দুমাসে চারটি গোরুকে বিষ দিয়েছিলো সে; কিন্তু সব ক’টির ছালই যে তার হাতে পৌঁছেছে এমন নয়, তিনটিই অন্যের হাতে পড়েছে। যত ঝুঁকিই সে নিয়ে থাক, যত কৌশলেই সে কাজটা করে থাক, তার দাবির যুক্তিটা প্রতিপক্ষকে বলা যায় না। নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারে সে? কিন্তু কফিলুদ্দির কাছে সমব্যথা আশা করার চাইতে তার আত্মহত্যা আশা করা সহজ। সে ছাল চায়, যেমন চৈতন্য সাহা চায় দাদন-দেওয়া পাট। অন্য কোনো কথা বোঝার ব্যাপারে অত্যন্ত নির্বোধ বলে মনে হয় তাদের দুজনকে।
চিকন্দিতে গোরু কম। যাদের আছে তারা হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। বুধেডাঙায় গোরুর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু সান্দারদের ঘরে যেতে সাহস হয় না। সুরতুন যে মারটা খেয়েছিলো তাতেই মাধাই গুড়ো হয়ে যেতো। সব চাইতে মুশকিল করেছে রামচন্দ্র। যে-বিষ কফিলুদ্দি নিজে নারকেলডাঙা থেকে আনিয়ে দিয়েছিলো গোবধের জন্য তার কাছে রামচন্দ্রর ওস্তাদি হার মেনেছে। কিন্তু রামচন্দ্রর মণ্ডলগিরির প্যাঁচে হার মানতে হলো কফিলুদ্দিকে। গোরু মরলে মাটিতে পুঁতে ফেলছে গ্রামবাসীরা।
কয়েকদিন ধরে নানারকম উল্টোপাল্টা ভেবে আবার প্রথম যে রাতে মাধাই কলাপাতায় মুড়ে বিষমাখানো ভাত নিয়ে বেরিয়েছিল রামচন্দ্র মণ্ডলের হাতে ধরা পড়ে গেলো।
বুধেভাঙা আর চিকন্দির সীমায় হাঁক দিলো রামচন্দ্রকে যায়? ছুটে পালাতে গিয়ে মাধাই বুধেভাঙার পথ ধরেছিলো; কিন্তু বুধেডাঙায় রজবআলি সান্দার জেগে ছিলো। মনে হলো সে গলায় খাকরি দিয়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো। সেও যেন হাঁক দিলো–কে যায়?
মাধাই আর পারলো না। দৌড়তে গিয়ে তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে। পিছন থেকে রামচন্দ্র তার বিষসুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরেছিলো। বৈদ্যর চোখে দেখামাত্রই ধরা পড়েছে। অপরিসীম ঘৃণায় তার হাত ছেড়ে দিয়ে রামচন্দ্র বললো–তুই না হিঁদু!