আগে রজব আলির মতোই ঘর ছিলো সুরতুনদের। গাই-বলদ ছিলো না তেমন কিছু পাঁঠা বকরি ছিলো। এখন মাত্র একটা কাঠা জমির উপরে একখানা চালা দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের পেছন দিকের বেড়া ঘেঁষেই আজকাল রজব আলির জমি। সামনের দিকের কয়েক পা গিয়েই সুরতুনের জমির সীমানা শেষ, তার পরই রজব আলির ভূঁই। বেলাত আলি নাকি জীবিতকালে রজব আলির কাছে ধান ধার করেছিলো, সেই ধানের মূল্য রূপে রজবআলি জমিগুলি দখল করেছে।পিতামহ আলতাপজীবিত থেকেও রজব আলির কাজকে ধিকৃত করেনি, সেক্ষেত্রে এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীতে। সুরো কী করতে পারে?
কুয়াশা প্রায় কেটে গেছে। বাঁ-দিকের দু-তিনটি গোরুর রং স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আর দেরি করা যায় না।আল থেকে নরম মাঠে নেমে সোজাসুজি পাড়ি দিয়ে সুরতুন গিয়ে দাঁড়ালো লালচে রঙের বলদটার পাশে। সেটার আড়ালে হেঁট হয়ে পাশের ছোটো বকনাটার চারি থেকে পটু হাতে জানার জল হাতড়ে কুচোনো খড় আর বাবলার বিচি তুলে নিলো কেঁচড়ে। তারপর আল ডিঙিয়ে অন্য আর-একটি খেত পার হয়ে নিজের ঘরের পেছন দিয়ে ঘোরাপথে এসে দাঁড়ালো নিজের গোরুটার সামনে।
–খা, খা। কয় যে খাতি দিবি বাবলার দানা, দুধ হবি বটের আঠা।
গোরুটির খাওয়া হলে তার দড়ি ধরে সুরো পথে বার হলো। আলের পথের শেষে জেলাবোর্ডের পথটা সে আড়াআড়ি পার হলো। পথের ওপারে কাশজাতীয় বুনোঘাস এক কোমরের চাইতেও বেশি উঁচু হয়ে উঠেছে। কিন্তু জমিটা সেদিকে নিচু বলে ঘাসগুলোর মাথা জেলাবোর্ডের রাস্তার এপার থেকে বড়জোর আধ-হাতটাক চোখে পড়ে। ঘাসবনের ভিতর দিয়ে গোরুটাকে টানতে টানতে সুরতুন ওদিকের জমিটায় সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে সেটাকে বেঁধে দিলো।
গোরুকে সে একটু বেশি যত্ন করে দেখে লোকে তাকে ঠাট্টা করে, কিন্তু সে নিরুপায়। অন্য সময়ে গোরু ছেড়ে দেওয়া চলে। রাত-চরা-ধূর্ত গোরু সহজে ধরা পড়ে না, কিন্তু এখন বেচারার বড়ো কাহিল অবস্থা, মস্ত বড়াই বোধ হয় হবে বাছুরটা। কোথাও না বাঁধলে চলে না। গোরু বাঁধতে বাঁধতে তার মনে হলো মেয়েমানুষেরও বোধ হয় এমনি কাহিল অবস্থা হয়, নড়তে-চড়তেও অসুবিধা। কিন্তু সেদিন অসময়ে রজব আলি মাঠ থেকে হন্তদন্ত ফিরে এলো। বাড়ির সামনের জমিটুকু পার হতেও যেন তার তর সয় না, সেখান থেকেই হাঁক দিতে দিতে সে বাড়ির দিকে দৌড়ে এলো–ইয়াকুব, ইয়াকুব!
ছেলে ইয়াকুব ছিলো বাড়িতে, বাপের উত্তেজনায় হাসিমুখে সে বললে–চেঁচাও কেন্, আগুন লাগছে নাকি?
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে রজব আলি বললোব খাবের দিছিলো কেডা?
–জাব তো আমিই মাখে দিছিলাম, কেন্ হলে কী?
–হলে কী? শালা গিধর, বাড়া মরে যে, ধলিডা।
–কও কী?
মুহূর্তে পিতার উত্তেজনা ইয়াকুবে সংক্রামিত হয়ে গেলো–তাইলে অষুধ করছে বোধায়। হা রে খোদা!–বলে রজব আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানেই বসে পড়লো।
ইয়াকুব বললোবসলি কি হবি? বদ্যি খবর দিতি হবি। চিকন্দির রাম মণ্ডলে নাই পাই কেষ্টদাসে আনবো। তুমি তৎক্ষণ উয়ে তেঁতুল-জল খাওয়াও, তামুক-জল খাওয়াও। হাওয়ায় ভেসে ইয়াকুব দৌড় দিলো মাঠের উপর দিয়ে আল টপকাতে টপকাতে।
রজব আলির উত্তেজিত স্বরে আকৃষ্ট হয়ে যারা এসেছিলো তাদের মধ্যে ছিলো ইয়াকুবের স্ত্রী ফতেমা। তার পরীর ভয় ছিলো। জিন পরী মানুষের কাছে ঘোরাফেরা করে তার এই ধারণার কথা পরিবারের সকলেই শুনেছে, তা নিয়ে হাসাহাসিও করেছে।
সে ঘোমটার আড়াল থেকে শাশুড়িকে বললে–আমি যে কই, রোজ সকালে একটা পরী ঘুরঘুর করে চারিগুলার কাছে।
কথাটা রজব আলির কানে গেলল। সে বললে–তুই দেখছিস্ পরী?
–আপনেক আগুনের বোঁদা দিয়ে গোয়াল সুরবের গেলাম, আপনে গেলেন বাড়ির ভিতর। তখন দেখলাম পরী আসে জান্নার চারিতে হাত দিয়ে কী যেন করতিছে।
–ই আল্লা, কস কী! তারপরে করলে কী পরীডা?
কী যেন তুলতিছে চারি থিকে আর চাবাতিছে মটমট করে।
রজব আলি তেঁতুলগোলা জল, তামাকপাতার জল, আগুন জ্বালার কাঠ নিয়ে মাঠের দিকে তেমনি হন্তদন্ত ছুটলো। একটা বড়ো মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার গা শিউরে উঠলো পরী ঘোরে? সর্বনাশ। চাবায়ে-চাবায়ে খায় কী পরী? জিন্দা গোরুর কলিজা নাকি?
বকনাটাকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা হলো। চিকন্দির রামচন্দ্র এসেছিলো। ফতেমা কালীর কাছে মানত রেখেছিলো। কিছু করা গেলো না।
রজব আলি অপ্রতিভের মতো মুখ করে বললো–পরীর কামভাই, রোজাকীকরবি? রামচন্দ্র ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাসী রোজা নয়, বৈদ্য। পরীর গল্পটা সে ধৈর্য ধরে শুনলো কিন্তু মাথা নেড়ে বললো–এ যদি কুকুরমারা বিষ না হয় কী কইছি। চিকন্দিতে একমাসে পাঁচটা গোরু মরেছে।
সন্ধ্যায় দুঃখিত মনে অন্য গোরুগুলি তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে রজব আলি তামাকে হাত দিয়েছে, গোরুগুলি ছাড়া পেয়ে চারির দিকে ছুটেছে, এমন সময়ে সুরতুন এসে হাঁ-হাঁ করে তাড়ালো সেগুলোকে।
–কেন্ রে, তাড়ালি কেন্?
সুরতুন বলেছিলো–আমার মনে কয় উয়েতে বিষ আছে। কোন্ চারিতে আছে কিবা করে কবা।
–ঠিকই কইছি, জল বদলাতি হবি। সরায়ে বাঁধ রে, ইয়াকুব।
সুরতুন উসখুস করে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো। দুঃসংবাদটা সে ঘরে বসেই পেয়েছে। রজব আলির যেবাছুরটা আজ মারা গেছে সেটার চারি থেকেই খড় চুরি করে নিজের গোরুটাকে দিয়েছিলো কিনা, মাথা কুটলেও এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। বিষ এখনো ধরেনি, কিন্তু তাতেই কি নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে বিষ ধরার সম্ভাবনা নেই।