এখন সুরা মাধাই বায়েনের ঘরের দিকেই চলেছে। মাধাই তাকে চালের ব্যবসায়ের হদিশ বলে দিয়ে রওনা করে দিয়েছিলো।
সে আর কী করেছে তার জন্য, ভাবতে গিয়ে কোথায় আরম্ভ করা যায় খুঁজে পায় না সুরো। মাধাইয়ের মুখে সে শুনেছে: পশ্চিমের মজুররা ইট তৈরি করছিলো দিঘা আর চিকন্দির মধ্যে এক মাঠে। অনাহারের প্লাবনের মধ্যে আহারের দ্বীপগুলির অন্যতম সেটি। আহারের আশায় না হোক, জলের আশায় ইট তৈরির ভেজানো কাদার একটা তালের কাছে সুরোর দেহটা মুখ গুঁজে পড়ে ছিলো। মাধাই তাকে দিঘা বন্দরে তার নিজের ঘরে তুলে এনেছিলো। কী করে আনলো?মাধাই বলেছে–তুই কী এমন ছিলি, হাড় কখানাই ছিলো। তাই সম্ভব,নতুবা মাধাইয়ের এমন-কিছু মজবুত পালোয়ানি দেহ নয়।
সুরোর যখন খেয়াল করে দেখবার-শুনবার অবস্থা হলো সে দেখেছিলো, একটা স্বল্পপরিসর ইটের ঘরের মেঝেতে সে শুয়ে আছে, আর তার মুখের উপরে ঝুঁকে আছে একটি অপরিচিত পুরুষের মুখ। মাধাই তখন অপরিচিত ছিলো। অন্নের উত্তাপে দেহ আতপ্ত হয়েছে তখন, মনের স্বাভাবিক বৃত্তিগুলি ফুটি-ফুটি করছে। পরিধেয়ের সন্ধান করতে গিয়ে সে দেখেছিলো, একটুকরো কোরাথান যেমন-তেমন করে তার গায়ে জড়ানো।
এবার পুরুষটি কথা বললো–তোর কাপড়টা ফেলে দিলাম। যা ময়লা, আর পিঁপড়ে কত!
একটু পরেই আর-একজন পুরুষ ঘরে এসেছিলো। তখন সুরো বুঝতে পারেনি, এখন তার মনে হয় সে ডাক্তার। কিন্তু মাধাই কী বলেছিলো মনে আছে আমার বুন, গাঁয়ে ছিলো।
সুরতুন্নেছার পক্ষী-আঁকা হাতখানি ঘন-ঘন দুলতে লাগলো। তার মন কল্পনায় বহু সময় লঙঘন করে যাচ্ছে।
একদিন তার প্রশ্নের উত্তরে মাধাই বলেছিলো–যে-কেউ চোখে পড়তো তাকেই আনতাম, তাকেই খাওয়াতাম।
পৃথিবীতে থাকার মধ্যে মাধাইয়ের এক বুড়ি মা ছিলো। যতদিন মাধাই গ্রামে ছিলো মায়ের সঙ্গে তার সদ্ভাব ছিলো না। বুড়ি যদি ক্ষুধার মুখে ভাতের থালা এগিয়ে দিতে না-পারতো মাধাই তাকে মারতো ধরে ধরে। আসের বেহদ্দ ছিলো সে। কিন্তু গ্রামে অনাহার এসেছে এই খবর পেয়ে সে গিয়েছিলো রেল-কোম্পানির-দেওয়া র্যাশানের চালডাল নিয়ে মায়ের জন্য। সংবাদটা কেউ তাকে দেয়নি। মায়ের পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা থালাবাসন, ঘেঁড়াখোঁড়া কাপড়চোপড় ঘটনাটা রাষ্ট্র করে দিয়েছিলো। ধূলায় আচ্ছন্ন ক্লান্তমুখ চোখের জলে আবিল করে সে ফিরে আসছিলো। পথের ধারে পড়েছিলো সুরো। মায়ের বুভুক্ষু আত্মার তৃপ্তি হয়েছিলো কিনা কে জানে, মাধাইয়ের শূন্যীভূত আত্মা একটা অবলম্বন পেয়েছিলো।
কিন্তু এ-উত্তরটা মনে-মনে উচ্চারণ করে সুরো সুখী হতে পারে না। মাধাই তার দ্বিতীয় ১ বারের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলো–একদিন তুই আমার হয়ে চোরের মার খেয়েছিলি, সেজন্যে।
সেই বিশ্বব্যাপী অনাহারের দিনের আগেও সুরোর মতো যারা তাদের অনাহারের দিন ধানের । ঋতুগুলির মধ্যেও ইতস্তত ছড়ানো থাকতো। পৃথিবীতে সে একা। তার বাবা বেলাতআলির মৃত্যুর পরও সে কী করে খুঁটে খেয়ে বারো থেকে আঠারোতে সম্পূর্ণ একা-একা পৌঁছেছিলো, ভাববার বিষয়। তার পিতৃধনের মধ্যে ছিলো একখানি কুঁড়ে, একটি গাভী।
তখন একনাগাড়ে দু-দিন ধরে তার অনাহার চলছিলো। ছোটো নিচু খড়ের চালাটার নিচে সে আর তার গর্ভবতী গাভীটি। খালি পেটে এপাশ-ওপাশ করতে করতে ভোরবেলা সে উঠে বসলো। ভাবলো, উঁশ কামড়াচ্ছে বোধ হয়। গাভীটাকে কাল থেকে বাইরে বেঁধে রাখবে স্থির করলো। ওটা বিয়োলে একটা হিল্লে হয়।
ক্ষুধার ব্যাপারটা একবার যদি মনে পড়েছে ঝাড়া দু-ঘন্টা লাগবে তোমার ভুলতে–একথায় ওকথায় ফিরে-ফিরে মনে পড়ে যাবে।
সান্যালবাড়ির তেঁকিশালের কাছে বোকা-বোকা মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলে পেট ভরার মতো ভাত রোজই পাওয়া যায়। কিন্তু পথের প্রতিবন্ধক দেবীদাস আছে। বুধেভাঙা চিকন্দি যাওয়ার পথে তার বাড়ি। মাহিষ্য দাসদের দেবী সান্দার-ছেলেদের খেলার সঙ্গী ছিলো, সুরোর বাল্যপরিচিত। কিন্তু দেবীর গলা একদিন ভার হলো। মাথায় বেড়ে ওঠার চাইতেও স্বরের পরিবর্তনটাই বেশি লক্ষণীয়, সেটা যেন রাতারাতি হলো, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি। সুরোকে আগেও দেখেছে দেবী, কিন্তু এ-দেখা অন্যরকম। দেবীদাসের ভয়ে সুরোর এ-পথে চলা কঠিন।
ভয়ের মূলে আছে তার অল্পবয়সের একটি বেদনার ঘটনা। তার বাবা বেলাত আলি তখন জীবিত। তার ফিরবার পথের দিকে চেয়ে দশ-এগারো বছরের সুরতুন্নেছা ঘাটিয়ালের ঘাটের চালায় অপেক্ষা করছিলো। শুকনো খটখটে সন্ধ্যা-আবির ছড়ানো, ঝিঁঝি ডাকা, উদাসকরা সেই সন্ধ্যায় ঘাটের অনতিদূরে ধর্ষিতা হয়েছিলো সে।
গোরুটিকে দড়ি ধরে বাইরে নিয়ে এসে ঘরের সম্মুখে বাবলার চারাটায় বেঁধে দিয়ে চারিদিকে তাকালো সে। তখন সম্ভবত পৌষ মাস। হালকা একটা কুয়াশার আবরণ মাটির আধ হাত উপর পর্যন্ত নেমে এসেছে। রজব আলি সান্দারের বাড়ির দুখানা খড়ের ঘর আর খড়ের গাদাটি আসলগুলির ছায়ার মতো চোখে পড়ছে। রজবআলির বাইরের দিকের ঘরখানির সম্মুখে তার ছোটো ধানের মরাইটার পাশে বাঁশের খাঁচায় বসানো চারিতে মুখ দিয়ে তার দুটি বলদ, দু-তিনটি বকনা গাই হুস হুস করে খড়-ভেজানো জল খাচ্ছে, চপ চপ খস খস শব্দ হচ্ছে। বলদগুলোর মুখে, সট সট করে বাবলার শুকনো বিচি চিবুচ্ছে গাইগোরুগুলো।