কিন্তু বিস্ময়ের চাইতে বিস্ময়, উঁচু কেলাসের গাড়ি থেকে নামে যে-ভদ্রলোকের মেয়েছেলে সে-ও কি চালের কারবার করে!নতুবা দারোগা অমন খবরাখবর করে কেন? ওর বোধহয় বাক্স বিছানা বোঝাই চাল। চাল, তুমি কত রঙ্গই দেখালে!কন তাহলে ওর খবর পেয়েই এসেছিলো, তার নিজের মতো পাঁচসের চালের কারবারিকে ধরতে দারোগার নিজের আসা একটু অস্বাভাবিকই বটে, এখন ভাবলো সুরো।
তবু কনকদারোগার ব্যবহার চিরকালই সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। ধরতেই যদি আসা, ধরলো না কেন?
সুরো উঠে দাঁড়ালো। আজ আর কোনো গাড়িই ধরবে না। তাহলে কোন দিকে যাবে সে? দেড় ক্রোশ পথ ভেঙে গ্রামে যাওয়া যায়, কিন্তু কাল সকালেই আবার দেড় ক্রোশ পথ বেয়ে আসতে হবে স্টেশনে।নতুবা যাওয়া যেতে পারে দু ক্রোশের পথ দিঘায়। সেখানে অনেক গাড়ি থামে উত্তরে যাওয়ার। না-ও যদি পাওয়া যায়, মাধাই বায়েনের ঘরে এক রাত বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
সে দিঘার দিকে হাঁটতে শুরু করলো।
সুমিতি নিস্তব্ধ স্টেশনটির চারিদিকে চেয়ে দেখলো। পুলিসের ছোটোবড়োদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যা হয়নি এখন সেটা হলো, বিজন স্টেশনটায় বসে নির্জনতায় তার গা ছমছম করে উঠলো। ডানদিকের ব্রিজটাই বোধহয় সভ্য জগতের শেষ সীমা। এপারে গাড়ি পাওয়া যায় না এমন দেশ। গ্রাম সম্বন্ধে সমিতির ধারণা একেবারেই নেই তা নয়। রাজনৈতিক কাজে সে গ্রামে গিয়েছে। সেসব গ্রাম ম্যালেরিয়াজীর্ণ; ডোবা-জঙ্গল ও ক্ষয়িষ্ণু ভগ্নস্তূপে ভরা! কিন্তু সেসব গ্রামে গিয়েছে সে পার্টির মোটরে, সঙ্গে সমবয়সী ছাত্রছাত্রী। মোটর না চলেছে তো গোরুগাড়ির বন্দোবস্ত আগেই করা থাকতো। চড়ুইভাতির উন্নততর সংস্করণ সেসব পরিক্রমা–এই ধারণা এখন সুমিতির। এখানে এমনি বসে থাকার চাইতে পুলিসের সাহচর্যও ভালো ছিলো। দারোগাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছে, মনে হলো সুমিতির। লোকটি ভদ্র, সঙ্গে থাকলে কিছু-একটা ব্যবস্থা না করে পারতো না। পাল্কি পাঠাবে বলে গেছে বটে, কিন্তু অনেক পুরুষের ক্ষেত্রেই সুমিতি দেখেছে, সামনে দাঁড়িয়ে তাদের দিয়ে কাজ করানো যত সহজ, অলক্ষ্যে থেকে নির্দেশে ততটাকরানো যায় না। সুমিতির সেক্সপীয়রকর্ষিত মনে যে কথাটা কাঁটা দিয়ে উঠলো সেটা এই : সৌন্দর্য, সোনার চাইতেও কাউকে কাউকে বেশি প্রলুব্ধ করে।
সান্যালরা জমিদার, কিন্তু তাদের সেই দুর্গকত মাইল দূরে কে জানে। বঙ্কিমচন্দ্রের ইন্দিরার কথা মনে পড়ে গেলো সুমিতির। তার মনে হলো চূড়ান্তভাবে–এতদিন যে-সব প্রতিপক্ষের সম্মুখে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সে বিখ্যাত হয়েছে তারা ডাকাতে রাজনৈতিক মত পোষণ করে, কিন্তু ডাকাত নয়।
সে চিন্তা করতে লাগলো, ওই মেয়েটির মতো নিরাভরণ এবং মলিন মোটা শাড়ি পরে এদেশে আসা উচিত ছিলো কিনা; ঠিক এমন সময়ে হই-হুঁইশব্দ করে চার-পাঁচজন বেঁটে শুটকো লোক আলকাতরা রাঙানো একটা কাঠের বাক্স নিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। বাক্সটির গায়ে লম্বা দাঁড়া লাগানো, আর সেই দাঁড়ায় কাঁধ দিয়ে বাক্সটিকে লোক ক’টি বয়ে আনছে দেখে সে বুঝলো পাল্কি সেটা। সে তার সজ্ঞান জীবনে এই প্রথম একটি পুলিসকে ধন্যবাদ দিলো এবং ধন্যবাদ দিতে গিয়ে ইংলন্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিষয়কে প্রশংসা করলো। মনে-মনে বললো, লোকটি ইংলন্ডের পুলিসদের মতো।
কিন্তু প্রথম কথা ঐ বাক্সে ঢোকা, দ্বিতীয় কথা বাক্সে ঢোকামাত্র লোক ক’টি তাকে ভুমি থেকে সংস্পর্শশূন্য করে কাঁধে তুলবে। তারপর তাদের খুশির উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
বেহারাদের আভূমি-আনত সেলাম সে দেখতে পায়নি, এবার তাদের সসম্রম আহ্বানে ফিরে দাঁড়িয়ে তাকে হাসতে হলো। হাসিই একমাত্র মনোভাব যেটা টেনে এনে অন্য মনোভাব ঢাকা যায়। সুমিতি ভয় ঢেকে ভয়ে-ভয়ে বললো, সান্যালদের বাড়ি চেনো?
জে, মাঠান, তেনারা মুনিব।
তোমরা পথ চিনে নিয়ে যেতে পারবে তো?
জে, আপনি উঠলিই গেলাম।
যদি দরকার হয় কাল তোমাদের দারোগাসাহেব খুঁজে পাবেন?
তা আর পাবেন না! তিনি তো আমাদের বাড়ির পরে ঘোড়া থামায়ে পাঠায়ে দিলেন।
সুমিতি ওদের প্রদর্শিত উপায়ে পাল্কিতে উঠে বসলো। লোকগুলি অনাহারজীর্ণ কিন্তু অভ্যস্ত হাতে মোটগুলো পাল্কির ছাদে বেঁধে নিয়ে এক নিমেষে পাল্কিটা শূন্যে তুলে ফেলো। দুহাতে পাল্কির দেয়াল আঁকড়ে ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে সুমিতি চিকন্দির দিকে রওনা হলো।
০২. মাথার উপরে প্রখর সূর্য
মাথার উপরে প্রখর সূর্য, মেঠো ধুলোর পথে পা পুড়ে যাচ্ছে। কাপড়ের পাড় দিয়ে বাঁধা জট-পড়া লালচে চুলের খোঁপাবাঁধা মাথাটা ক্লান্তিতে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে। রোদে উত্তপ্ত হয়ে তার কটা রং লালচে দেখাচ্ছে। হাঁটার তালে তালে ডান হাতখানি দুলছে পুরুষালি ভঙ্গিতে। সে-হাতের উপরে নীল উল্কিতে আঁকা ডানা-মেলা-এক পক্ষী।
ডানা ম্যালেছে পক্ষী! স্বগতোক্তি করলো সুবো।কথাটা অন্যের মুখে শোনা। মাধাই বায়েনই বলেছিলো একদিন তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে।
মাধাই বায়েন (কখনো মাধব বাদ্যকর) আমার-তোমার চোখে নীল, কখনোবা খাকি উর্দিপরা একটি রেলওয়ে পোটারমাত্র।বড়োবড়োচুলে পাতাকাটা সিঁথি, পায়ের মাপের চাইতে বড়ো একজোড়া চপ্পল পায়ে শিশ দিতে-দিতে যে বন্দর দিঘার স্টেশন-প্ল্যাটফর্মে এর-তার সঙ্গে ইয়ার্কি মেরে বেড়ায়, সুবোর হাতে সে-ই নীলপক্ষী আঁকিয়ে দিয়েছে। সুরোর হাতে একজোড়া বাঁকা তোবড়ানোকালচে কাসার চুড়ি ছিলো এককালে। মাধাই একদিন চুড়িজোড়া খুলে ফেলে দিয়েছিলো তার অনুমতি না নিয়ে, তার বদলে কিছুই আর পরতে দেয়নি। ব্যাপার দেখে সুরো সাবধান হয়ে গিয়েছিলো। ছোটোবেলা থেকেই দস্তার যে-চিকটা তার গলায় ছিলো সেটা নিজেই একদিন খুলে ফেলেছে।