মাধাই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
আঁচল বিছিয়ে বারান্দায় শুয়ে পড়ার আগে সুরতুন ভাবলো–আমি আর ভেবে কী করি। না খেয়ে যখন মরতে বসেছিলাম তখন ভেবে কী করেছি।
কিন্তু নিজে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার আগে সুরতুনের ইচ্ছা হলো, সে উঠে গিয়ে দেখে মাধাই ঘুমিয়ে পড়লো কিনা। এতক্ষণে সহসা একটা অনুভব হলো তার :কী যেন একটা হয়েছে, মাধাইয়ের অসুখ করেনি তো?
একটা তুলনা দিয়ে মাধাইয়ের এই ব্যাপারটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। বোধ হয় এই রকম মানসিক অবস্থাতেই পুরুষরা স্ত্রীকে খুঁজে বার করে নিছক কথা বলার জন্যে। কথা বলা প্রয়োজন হয়ে থাকে।
০৬. শুধু পাল্কি করে আসা
শুধু পাল্কি করে আসার ব্যাপার নয়, দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সান্যালগিন্নি, সুমিতি যখন তার সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সে অনেকদিনের পরিচিতের মতো রূপনারায়ণের একখানা হাত নিজের হাতে ধরে রেখেছে, হাসছে। একটু বিব্রত হলেও সে-হাসিটা সুন্দর। প্রার্থীর মতো লজ্জার হাসি নয় যে কুণ্ঠিত হতে হবে।
সুমিতি প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালে অনসূয়া বললেন–ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না।
আমিও পারছিলাম না। তবু আমার পড়ার টেবিলে আপনার একখানা ফটো আছে, আপনি আমাকে কোনদিন দেখেননি।
কিন্তু চেনা-চেনা লাগছেও বটে।
তা লাগবে। আমি আপনাদের ছোটোবউ সুকৃতির বোন।
সুকৃতি! সুকৃতির বোন? সান্যালগিন্নি অনসূয়া হাত বাড়িয়ে ব্যানিস্টার চেপে ধরলেন।
এক মুহূর্ত পরে সুমিতির কাঁধে হাত রেখে বললেন–এসো, ঘরে এসো। তোমাদের বংশ খুব উদার। তোমাদের পক্ষেই এমন করে আসা সম্ভব। সান্যালগিন্নি দৃশ্যতই বিচলিত হয়েছেন।
সুমিতিকে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অনসূয়া বললেন–খবর না দিয়ে এসে আমাকে খুশি করেছে কিন্তু নিজে কত কষ্ট পেলে।
না, কষ্ট হয়নি। একজন দারোগা আমাকে পাল্কি ঠিক করে দিয়েছিলো।
ওঁকে বললো খবর নিতে। লোকটি তাহলে ভদ্র।
ঘরে এসে অনসূয়া সুমিতিকে প্রশ্নের মাধুর্যে ডুবিয়ে দিলেন। কিন্তু কুশল প্রশ্নের মধ্যেই হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–তুমি এখন বিশ্রাম করো। ট্রেনের ক্লান্তিটা আগে যাক, আলাপ করবো।
অনসূয়া হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন কিন্তু কান্না তার বুকের ভিতরে উদ্বেল হয়ে উঠেছিলো। সুমিতিকে নিজের শোবার ঘরে বসিয়ে এসে নিজে কোথায় যাবেন খুঁজতে লাগলেন।
পনেরো-যোলো বছর আগেকার ঘটনা। দেবরকে বিবাহ দিলেন অনসূয়া, কলকাতার ব্যারিস্টার-পাড়ায় আত্মীয়তা করলেন। অনসূয়ার বহুদিনের ব্যবধানে থেকেও সে সব কালের ছোটো-ছোটো ঘটনা, ভুলে-যাওয়া কথাবার্তা মনে পড়তে লাগলো।
সম্বন্ধগুলির মধ্যে অনসূয়া যখন এটাকেই বেছে নিলেন, মাথায় উপরে শাশুড়ি ছিলো না, সান্যাল কপট বিরক্তিতে ভু কুঞ্চিত করে বলেছিলেন–ঐ সাহেবিপাড়ায়? আমাকে কি এখন। তামাক ছেড়ে চুরুট ধরতে হবে?
সান্যালগিন্নি অনসূয়া সুকণ্ঠে ঝংকার দিয়ে বলেছিলেন–আলো আসুক, একটা জানলা কাটো। প্রাগৈতিহাসিক মিনারে বাইরের আলো প্রবেশ করুক একটু।
শুধু বিলেত-ফেরত-পিতামাতার সন্তান বলেই নয়, সুকৃতি নানা দিক দিয়েই প্রশংসনীয়া ছিলো। গায়ের রঙটা বোধ হয় এই সুমিতি মেয়েটির চাইতে আর-একটু প্রকাশিত ছিলো। তার জ্ব দুটির কোনোটিতে যেন একটা কাটা দাগ ছিলো, ছোটোবেলার দুরন্তপনার চিহ্ন। আর সে বোধ হয় কথা বলার সময়ে ঠোঁট দুটিকে কেমন একটু উল্টে দিত। অনভ্যস্ত চোখে মনে হওয়া অস্বাভাবিক ছিলো না, মেয়েটি কোনো ব্যাপারকেই খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করতে পারে না।
সমগ্র দেশের ছোঁয়াছুঁয়ির বাইরে রাজনৈতিক চাঞ্চল্যহীন গড় শ্রীখণ্ডের গড়-অধিবাসীদের জীবনে একবারইমাত্র রাজনীতি প্রবেশ করলো। খবরের কাগজে পড়া রাজনীতির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলো গ্রামটা। অনসূয়ার প্রার্থনার চাইতেও বেশি আলোক ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটা বিদ্যুৎ-জ্বালা। মিনারের খিলানে-খিলানে আলোর উদ্ভাস এলো। মিনারটিও শতধা দীর্ণ হয়ে গেলো।
সান্যালমশাই কাছারিতে এসে বসেছেন। সম্মুখে প্রজাদের একটি ছোটোখাটো জনতা। তারা এসেছিলো পাটের দাদনের টাকা নিতে। লিভোয়ালকুঠির সাহেবরা যে-দাদন প্রতি বৎসর দেয় এবার তারা তা নেবে না, অথচ না-খেয়ে মরতে হবে কোনো দাদন না-পেলে। সান্যালের পক্ষে ব্যাপারটা ছিলো অন্যরকম। পাটের সাহেবের দালালরা এবং তাদের টাকার জোয়ারভাটা যথাক্রমে সান্যালের প্রতিপত্তির ভাগ নিচ্ছিলো এবং খাজনার একমুখী সহজ স্রোতের বাধা হয়েছিলো।
এমন সময়ে পুলিস এলো। ঘোড়া ও সাইকেল চেপেবড়ো ছোটো পুলিস অফিসারের একটি বাহিনী। অভূতপূর্ব দৃশ্য। কাহিনীতে শোনা, খবরের কাগজে পড়া একটা ব্যাপার তার নিজের বাড়িতে ঘটছে।
লিন্ডোয়াল কুঠির সাহেবের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিস সাহেবের সদ্ভাব থাকা খুবই স্বাভাবিক, তবু পুলিসের নির্বোধ অভিযানে সান্যাল হাসতে পারলেন না, অপমানিত বোধ করে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। সারা বাড়িটা থমথম করছে।
কিন্তু যা ঘটে গেলো তার আশঙ্কা পুলিসরাও করেনি।
ছোটোবউয়ের বাক্স থেকে বেরুলো একখানা দুখানা নয়, পাঁচ-ছখানা চিঠি, যে-চিঠির হস্তাক্ষর পুলিসের নাকি পরিচিত। এতদিনে বোধ হয় সত্যিকারের নামটা ধরা পড়লো লোকটির।