কী কবো? আপনে যদি কও, যাকও তাই করবো। সুরতুন এত বিস্মিত হলো যে মাধাইয়ের বক্তব্যটাকে পরিহাস মনে করতেও পারলো না।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাধাই প্রশ্ন করলো, সুরো, এ দুনিয়ার আমার কেউ নাই। তোর কে কে আছে?
সুরতন মাধাইয়ের কথাটা অনুভব করলো। সে বুঝে উঠতে পারলো না এ প্রশ্নের জবাব কী দিতে পারা যায়। আত্মীয়তার হিসাবে ফতেমা তার ভাই বউ, রজব আলি তাই জ্যাঠামশাই। গ্রামের বাইরে অনাত্মীয়ময় পৃথিবীতে তাদের নিকট বলে মনে হয়, গ্রামের ভিতরে তারা প্রতিবেশীর মতো। আর চালের কারবারে নেমে ফতেমার সঙ্গে একটা বন্ধুত্বও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এসবের চাইতে বড়ো মাধাই, নির্ভরযোগ্য কোনো সম্বন্ধই যার সঙ্গে নেই, অকারণে যে প্রাণ বাঁচায়, প্রয়োজনের সময়ে যে পরামর্শ দেয়। তাকে আজকাল সুরোর সব আত্মীয়ের সেরা আত্মীয় বলে বিশ্বাস হয়। তা যদি না হতো তবে তার অনুমতি না নিয়ে কী করে কনকদারোগার তাড়া খেয়ে তার বারান্দায় এসে বসতে পারতো সে। কিন্তু এ সব কথা তো বলা যায় না। প্রকৃতপক্ষে সুরতুনের কেউ-ই নেই এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।
সুরো সম্মুখের অন্ধকারের দিকে চেয়ে রইলো।
মাধাই একটা বিড়ি ধরালো। লোহার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে সে বললো, ঘুম পালে। ঘুমাতাম, এখন কী করি বুঝি না। আমার আর কিছুই করার নাই। তুই কথা কয়ে যা, আমি শুনে? যাই।
আচ্ছা বায়েন, চাল যখন বেচা যাবিনে নুন বেচলি কি হয়? সে-ও তো দুর্মূল।নুনের মোকাম কনে?
তুই যাবি?
পথ দেখায়ে দেও।
সুমুদুর চিনিস?
হয়, শুনছি পদ্মার চায়েও বড়ো নদী।
সেখানে তালগাছ পেরমান ঢেউ। মনে কর এক-এক ঢেউ উঠতিছে পদ্মার ব্রিজের গায়ে জল লাগতিছে। সেই জল থিকে নুন হয়।
নুন কি ফেনায় ভাসে আসে?
জল শুকায়ে নুন।
জল কি পয়সা দিয়ে কেনা লাগে?
তা লাগে না।
তবে?
সুরতুন নিজেই চিন্তা করে প্রশ্নের উত্তর বার করলো। তার মতো হতভাগ্য আরো আছে। সকলেই তারা তাহলে নুনের মোকামে ছুটতো। সেখানেও নিশ্চয় পুলিস আছে। নতুন একটা হতাশায় তার মন ভরে উঠলো।
কিছুক্ষণ পরে সুরতুন আবার বললো, মনে কয় আবার না-খায়ে থাকার দিন আসতিছে।
মাধাইয়ের মনে হলো, তার নিজের যদি আহারের উপরে এমন রুচি থাকতো! অন্তত এই মুহূর্তে আহারের কথা চিন্তা করতেও তার ইচ্ছা করছে না।
সুরতুন ভাবলো, পুলিস তাহলে এ কী করছে, বেড়াজাল দিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে? সহসা তার মধ্যে সান্দারনী ফুঁসে উঠলো। সম্ভবত মাধাইয়ের মতো নির্ভর করার উপযুক্ত পুরুষ কাছে ছিলো বলেই সে ক্রোধকে ভাষা দিতে সাহস পেলো।
সে বললো, জাত-সাপ পুলিস। আমাদের শত্রুর জন্ম-জন্মের। কেন্ শোনো নাই বায়েন, আমার নানা কী কতো? আমার নানা ছিলো আলতাপ, কতো–কোনোদিনই আর মিটবি না। আমার আম্মার আগের পক্ষের সোয়ামি ছিলো এক পুলিসের কনিস্টবল! সেকালে আমার বাপ ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ এ কথা জানতো না। বুধেডাঙার কাছে এক জাহাজ ডুবি হয় গাঙে। সান্দাররা ডুবে ডুবে সেই ডুবি-জাহাজ থিকে চালের বস্তা, লোহার পাত, কাপড়ের বান্ডিল বার করে আনলো। পুলিস ঘোরাফেরা করবের লাগলো। আম্মার সাথে আগে জানাশোনা ছিলো তার আগের সোয়ামির আমলে, এমন একজন কনিস্টবল কী করে না জানি মালের লুকোনো জায়গার খবর পায়; পুলিস বাঁধে নিয়ে গেলো সান্দারদের সব বেটাছাওয়ালকে। কও এই তো পুলিস। আগের সোয়ামির কাছে থাকে পুলিসি শিখছিলো। কী ঘেন্না তাই কও।
গল্পটা বলে সুরো বেপরোয়াভাবে সোজা হয়ে বসলো। জাতিগত ঘৃণার আতিশয্য প্রকাশ করতে গিয়ে সে যে নিজের মাকেই হীন প্রতিপন্ন করলো তা যেন সে বুঝতে পারলো না। কিংবা ক্ষয়িতাবশিষ্ট সান্দারত্বের এইটুকুই বোধ হয় বৈশিষ্ট্য।
মাধাই বললো–তাই বলে তুমিও পুলিসের শত্রুর হবা নাকি?
একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়লো সুরতুনের।
মাধাই আবার একটা বিড়ি ধরালো। খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে সে বললো, তার চায়ে ভালো এক সান্দার খুঁজে বার করে বিয়েসাদি কর। সে-ই খাওয়াবি পরাবি।
কথাটা একেবারেই নতুন নয়। চালের কারবারের সঙ্গীদের মধ্যে বসে এ ধরনের কথা এর আগেও সুরতুন শুনেছে। প্রথম প্রথম উৎকণ্ঠার মতো অনুভব হলেও এখন সয়ে গেছে, কারণ সে সব রং তামাশার কথা। কিন্তু মাধাইয়ের কথাকে হাসিঠাট্টা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার মনে হলো সে কেঁদে ফেলবে। বিবাহ ব্যাপারটাকেও পুলিসের বেড়াজালের মতো দিগন্তবিস্তৃত বলে মনে হলো। তার মনের মধ্যে যে আকুলতা অস্ফুট আবেগে ছটফট করতে লাগলো সেটার কোনো অংশে যেন এমন কথাও ছিলো–মাধাই, আপনে আমাক পুলিস আর বিয়েসাদি থেকে বাঁচাও।
রাত অনেক হয়েছে। অন্ধকার ঝিমঝিম করছে। বাঁদিকে রেল কলোনির শেষ। সেখানে কিটি ছোটো জঙ্গল-ঢাকা ডোবা আছে। এখন কিছু বোঝার উপায় নেই। চাপা গলায় কোনো নিশাচর ক্ষুদ্র প্রাণী সেখানে তার ক্ষীণ হিংস্রতা প্রকাশ করলো।
মাধাই বললো–রাত পেরায় শেষ হয়ে আলো। ঘুম পায় না তোর?
পায়। আপনে ঘুমাবে না, বায়েন?
হয়। ভাবনা দিনের বেলায় হবি। মাধাই বিড়ি ফেলে আঙুল মটকে সোজা হয়ে বসলো।
উঠে দাঁড়িয়ে সে বললো, তুই বারান্দায় শুবি, আলো জ্বালায়ে দেবো? ভয় করবি না?
না। মাঝেসাজে শুই একা। ঘরে আপনে থাকবা।
তা শো। দুয়ার খোলাই থাকবি।