এসব ধরনের কথাবার্তা শুনে মনিরুদ্দি আর-একদিন তাকে বলেছিলো–এত মনমরা কেন?
মাধাই খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলো, আমি কি একা? জেল্লা যেন সকলেরই কমে।
কমে, না বাড়ে?
মাধাই একটু চিন্তা করে বললো–ভাত-ভাত লাগে।
ভাত, সে কি খারাপ? কয় হা অন্ন, যো অন্ন।
এই কথাটা থেকে একটা তুলনা এসেছিলো মাধাইয়ের চিন্তায়। রেলের গ্রেইন-সপ থেকে একবার একরকম চাল দিয়েছিলো। সুন্দর ধবধবে ভাত হতো। কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে থু-থু করে। ফেলে দিতে হতো। তেতো হলেও তবু স্বাদ থাকে। সে ভাত ছিলো সবরকমে স্বাদহীন। ঘটনাটা মনিরুদ্দিকে মনে করিয়ে দিয়ে মাধাই বলেছিলো–সংসারটা সেই ভাতের মতো। মনিরুদ্দি হো। হো করে হেসে উঠে বলেছিলো–তুমি ভদ্রলোক হলা, বাবুমানুষ হলা, কেন?
এসব ধরনের আলাপ-আলোচনা সম্বন্ধে জয়হরি এবং মনিরুদ্দি দুজনেরই মনোভাব প্রায় এক। অন্তত একটি বিষয়ে তারা সম্পূর্ণ একমত, দৈনন্দিন সুখদুঃখও প্রয়োজনের বাইরে আলাপ আলোচনা করাটা ভদ্রলোকদের ব্যাপার।
মনিরুদ্দি বললো, মনমরা কেন্? ফুর্তি করো, হৈ হৈ করো। মদ খাবা?
ধুর। এক্কেবারে বাজে। গা গুঁটায়।
কও কী, খাইছো?
খাইছিলাম একটু একদিন।
জয়হরির কাছে শুনো, সে কেমন জিনিস। ও তো রোজ খায়। সাহেবরাও খায়।
ওদিক থেকে মনিরুদ্দিকে বাবুরা ডাকলো। সে চলে যেতে যেতে বলেছিলো–তুই ভাবিস? কাম আর কাম। বাড়ি যায়েও তাই। এটা কাঁদে, ওটা চেঁচায়।
আর একটু চা খাবে নাকি ভাবলো মাধাই। চা না খেয়ে সে একটা বিড়ি ধরালো। তার মনে পড়লো মনিরুদ্দির প্রস্তাবটা। সে বলেছিলো সাহেবরাও খায়। ও খেলে কী হয়? স্পেশ্যালে যে সাহেবরা গেলে তারা তো খানাগাড়ির মধ্যে বসে মদ খেতে খেতেই গেলো। তবে অমন মুখের চেহারা কেন তাদের?
এতদিন তার যে অনুভবটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত অনির্দিষ্ট ছিলো। সেটা এত লঘুস্পর্শ যে কথা দিয়ে সেটাকে প্রকাশ করতে গেলে অত্যুক্তি হয়ে গেছে। মাধাইয়ের নিজের কাছেই পরে মনে হয়েছে যা সে বললো সেটা সত্য নয়। স্টেশনের এতগুলি লোকের আর কেউ যা নিয়ে আলোচনা করে না সেটা তার নিজের অনুভবের ভ্রান্তিও তো হতে পারে। আজকের স্পেশ্যাল ট্রেনটাকে সে তার ভ্রান্তির বড়ো একটা প্রমাণ হিসাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলো। এত আলো, এত আয়োজন, তাহলে সংসার স্বাদহীন হবে কেন? কিন্তু স্পেশ্যাল ট্রেনটাই যেন তার অনুভবকে সত্য বলে প্রমাণ করে গেলো।
চায়ের দোকান থেকে উঠে মাধাই নিজের ঘরের দিকে রওনা হলো। অনেক লোক আছে ডিউটি করার এখন। একজন অনুপস্থিত থাকলেও কারো চোখে পড়বে না।
ডাক শুনে সুরতুন উঠে বসলো, তারপর মাধাইয়ের গলা চিনতে পেরে দরজা খুলে দিলো।
সুরতুন বললো–ফিরে আলে এখনই? গাড়ি চলে গিছে?
হয়।
তাইলে আপনে ঘরে আসে শোও। আমি বারেন্দায় শুই।
মাধাই ততক্ষণে বারান্দায় বসে পড়েছে। সে বললো, তুই এখানে আয়। গল্প করি।
পরিস্থিতিটা অভিনব। মাধাইয়ের সঙ্গে তার পরিচয় অনেকদিনের হলো। এর আগেও মাধাইয়ের ঘরে সে অনেক রাত্রিযাপন করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফতেমা তার সঙ্গে ছিলো। অনেকক্ষেত্রে এমন হয়েছে সুরো একা বারান্দায় শুয়ে ঘুমিয়েছে। তখন ভরসা ছিলো মাধাই ঘরের মধ্যে আছে, ডাকলেই সাড়া পাওয়া যাবে। অন্য দু’এক ক্ষেত্রে মাধাই স্টেশনের কাজে ব্যস্ত থেকেছে, দেখা হলে সুরোকে ঘরের চাবি দিয়েছে কিন্তু কখনো ঘুমের মাঝখানে রাত্রির অন্ধকারে এমন করে ফিরে এসে সে ডাকেনি। পুরো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
মাধাই বললো, বোস না, গল্প করি, তোর কি ঘুম পাতেছে, সুরো?
ঘড়ির মাপে রাত্রির বয়স পরিমাপ করতে না পারলেও আকাশের যেটুকু চোখে পড়লো তাতে সুরো বুঝতে পারলো তখনো এক প্রহর রাত বাকি আছে। সে যন্ত্রচালিতের মতো মাধাইয়ের অদূরে বসে পড়লো।
কথা কস না যে? মাধাই প্রশ্ন করলো।
কী কবো?
রাত্রিতে ঘুম ভাঙিয়ে তুলে কেউ যদি এমন সব কথা বলতে থাকে তবে সাধারণত তার মনের উদ্ভিন্ন অবস্থাটাই ধরা পড়ে যায়। ফতেমা যদি এখানে থাকতে হয়তো তার কাছেও মাধাইয়ের ভাবভঙ্গি অস্বাভাবিক বলে বোধ হতো। কিন্তু সে হয়তোবা মাধাইয়ের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করতো। তার থেকে আলাপের সূত্রপাত হতো। সুরোর মনে পড়ে না আর কবে মাধাই আহার্য এবং তার সংগ্রহের বিষয় ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলেছে, সেই এক পক্ষী আঁকার দিনটির কথা ছেড়ে দিলে। হাসিঠাট্টা মাধাই যে একেবারেই করে না তা নয়, কিন্তু সে-সবই ফতেমার সঙ্গে, সুরো শ্রোতামাত্র। প্রশ্নের উত্তর দিতে তবু সম্ভবত সুরো পারতো, কিন্তু নিজে থেকে প্রশ্ন করে আলাপের সূচনা করবে এমন শক্তি নিজের মধ্যে সে খুঁজে পেলো না।
তোর ব্যবসার কথা ক। কতদিন তো ব্যবসা করলি, কত টাকা জমাইছিস। সেব্যবসা নাকি বন্ধ হয়-হয়? মাধাই বললো।
পুলিস আর ব্যবসা করবের দিবিনে, মনে কয়। আর তাছাড়াও–
কী তাছাড়াও?
একদিন মোকামেও যদি চাল অ-পাওয়া হয়?
তা হতে পারে। তোরা কি ঠিক করছিস আর কোনো কালে গাঁয়ে ফিরবি না!
গাঁয়ে ফিরে আমার কী লাভ? সেখানে কেউ খাবের দেয় না। আর তাছাড়াও–
কী?
এখানে তবু আপনে ডাকে কথা কও। সেখানে না-খায়ে মরলেও কেউ কথা কয় না।
হুম। তোর এত ছুটাছুটি ভালো লাগে! আমার আর কাজ কাম ভালো লাগে না। মনে কয় চাকরি ছাড়ে দেই। তা যদি করি, আমাক তুই খাওয়াবের পারবি না? কলি না?