বুধেডাঙার দিকে তাকিয়ে তার ফতেমার কথাই প্রথম মনে পড়লো। তার শরীরের সেই অবস্থায় বন্যার আকস্মিক আক্রমণে সে বেঁচেছে এ আশা করা অযৌক্তিক।
আর মাধাই?মাধাই যদি চাঁদমালার সাহায্যে প্রাণরক্ষা করতে পেরে থাকে, এখন সুরতুনের মনে হচ্ছে সে বাঁচাটাই নিরর্থক হয়েছে। এই পৃথিবীতে কারো পক্ষেই বাঁচাটা লাভজনক নয়।
ক্লান্তিতে সে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যখন অন্তরে ক্ষোভ বা দুঃখ বলতে আর কিছু নেই। নিজেকেও যেন শরীরের বাইরে অন্য আর একটি শরীর বলে মনে হচ্ছে।
এখন সকাল হচ্ছে–এই অনুভবটা আবার হলো তার। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত তাদের একটা গন্তব্য স্থান ছিলো, এখানে এসে সেটা মিলিয়ে গেছে। এখন সবকিছুই পদ্মা। আকাশে দ্যাখো, সেখানে পদ্মা প্রতিফলিত শাদা শাদা বালির পাড়ের মতো মেঘগুলিকে ঢেকে ঢেকে দিয়ে ধোঁয়াটে কালো মেঘের প্রবাহ।
আর জীবন কী? সেটাও যেন পদ্মার মতো একটা কিছু। সে না থাকলে কিছুই থাকে না, থেকেও শুধু ভয় আর বেদনা। দিনের আলোয় আলোর চাইতেও প্রখর হয়ে জ্বলে,ঝড়ের সন্ধ্যায় মুখ কালো করে সে চাপা গলায় গর্জাতে থাকে কোথায় বাঁধ কাটবে। এই জীবন কখন কার কোন প্রতিরোধ ধসিয়ে দিয়ে আবর্তের মধ্যে টেনে নেবে এ কেউ বলতে পারেনা।কী সার্থকতা এই নাকানি-চোবানি খাওয়ার?
সুরতুনের অবাক লাগলোভাবতে, এত ঠকেও মানুষের শিক্ষাহয়না। তখন কিছুক্ষণের জন্য বর্ষণ থেমেছে। ভিজে খড়গুলো সরিয়ে কিছু নতুন খড় এনে ইয়াজ নিজেকে এবং সুরতুনকে আবৃত করে নিতে পেরেছিলো।
ইয়াজ বলেছিলো, কেন, সুরো, আমরা কি বাঁচবো না?
বাঁচে কী হয়?
চিন্তা করার মতো অবসর নিয়ে ইয়াজ বলেছিলো, কে, আমি চাষ-আবাদ করে তোমাকে খাওয়াবের পারি না?
কিন্তু এর সইতেও চুড়ান্ত বিস্ময়ের কিছু আছে। সুরতুনের এই শরীরের ভিতর থেকে এক অচেনা শরীর যেন আকস্মিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিলো। তার বোকামিগুলি যখন ইয়াজের ক্ষেপ কামনার উত্তর হয়ে উঠতে লাগলো, ক্লান্ত আবেগের করুণা নিয়ে তার মন তখনো মাধাইয়ের কথাই ভাবছে। কিন্তু মাধাইয়ের বেদনায় ব্যথাতুর মন নিয়েও তার সেই নতুন শরীরকে খানিকটা স্নেহ না দিয়ে পারেনি সে। এখনো সেজন্য বিষয় নয়।
আকাশে থেকে থেকে মেঘ ডাকছে। পদ্ম মুখ কালো করে আছে।
ইয়াজ বললো, ওঠো, সুরো, চরনকাশির বড়ো সেখের বাড়িত কিছু খাবের পাওয়া যায় কিনা দেখি।
সুরো বললো, তা যেন দেখবা, সে কোন দ্যাশ? দ্যাশ না ভাগ হইছে? আমরা না মোছলমান?
ইয়াজ বললো, হয়! সুরো সান্দারনি এক মোছলমান, আমুও আর এক হেঁদু। ফতেমাকে আম্মা কতাম, বাপ কেডা জানি নে। এই না চরনকাশি।
সুরতুন কাদামাটিতে আধশোয়া ভঙ্গিতে পা ছড়িয়ে বসেছিলে। তাদের কিছুদূরে একটা ছোট বেতের কুনকে কাদায় আধড়োবা। কোনো গৃহস্থ বাড়ি থেকে ভেসে এসে থাকবে। কী করে তার তলায় কয়েকটা কলাই আটকে ছিলো। ঘোরের মধ্যে সুরতুন দেখলোসরু শাদা শাদা কিছু সেখানে, কীট যেন, কল যেন। তার ভয় ভয় করলো।
ইয়াজ উঠে দাঁড়িয়েছিলো। দূরে চিকন্দির সান্যালবাড়ির উল্টানো পিরিচের মতো চুড়াটা চোখে পড়লো। সে বললো, দ্যাখো।
সুরতুন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলো।
সুরতুন দেখতে পেলো কে একজন তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। খুব ধীরে ধীরে পা মেপে মেপে জোলার ধার দিয়ে সে আসছে। একবুকশাদা শাড়ি, একটা অত্যন্ত লম্বা জামায় হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা। লোকটি এক-একবার থেমেহাতের লাঠিটাবালির মধ্যে পুঁতে দিয়ে তারপর সেটাকে তুলে লাঠির ডগাটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কী একটা পরীক্ষা করলো। এ প্রক্রিয়াটি সে অনেকবারই করছে।
ইয়াজ বললো, চরনকাশির বড়ো ভাই আলেফ সেখ না? হয়, তাই। ওই যে, সুরো, যার– ছাওয়াল কাজিয়ায় মারা গেলো।
আহা-হা, পাগল হইছে?
না, মনে কয়। চাষ দেওয়ার কথা ভাবে। বালির কত নিচে মাটি ও বোধায় দ্যাখে।
সুরতুন তখন চিন্তা করছে : ফতেমার হয়তো মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু সে নিজে রক্ষা পেলো। তার কারণ এই ছেলেমানুষ ইয়াজ ফতেমাকে সাহায্য না দিয়ে তাকে সাহচর্য দিয়েছে। শহরের হাক সুখের জীবন ছেড়ে বুধেডাঙার মাটিতে বসে কপাল চাপড়ানো যেমন ইয়াজের খেয়াল,
এটাও যেন তেমনি কিছু।নতুবা ফতেমাকেইয়াজ শুধুমুখে আম্মা’বলে ডাকতোনা, গভীরভাবে ভালোবাসত তাকে। আপন বোনের চাইতে, দিদির চাইতে কম নয়।
ইয়াজ বললল, লোকে কয়, মজিদে আল্লার সাথে কথা কয়। কয়, আল্লা, জমি দিবার হয় দিও, না দেও সেও আচ্ছা। আমাক আর জমির পিছে ছোটায় না। আমি অথব্ব। হিদুর জমি ধরি নাই। কবা, জমির লোভ খারাপ। কিন্তুক, খোদা রহমান, আমার ছাওয়াল কী লোভ করছিলো? এই কয়ে খুব কাঁদে। তার বাদে চোখ মুছে কয়, তোমাক কলাম তা কাউকে কয়ো না। তা হোক, সুরো, ওঠো আমার কাপড়ের থিকে আর কিছুছিড়ে দিতেছি, বুকে-পিঠে জড়ায়ে নাও।বড়ো সেখ তার পাকামজিদের দিকে যাতেছে। মন কয়, সেখানে আরো লোকজন আছে। কিছু খাবের পাওয়া যাতি পারে।
বন্যা থেমে গেলে হয়তো বোঝা যাবে, পদ্মা এবার আবার পাশ ফিরলো কিনা–এটা তার প্রসাদ কিংবা রোষ।
থেকে থেকে পদ্মার মুখ কালো হয়ে উঠছে তখনো, ফুলে ফুলে উঠছে তার বুক। উপরে ডড ড করে মেঘ ডাকছে। পুরাণটা যদি জানা থাকে হয়তো কারো মনে হতে পারে, কেউ যেন অন্য কাউকে বলছে : দয়া করো, দয়া করো।