সুরতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কন্যার্তনরনারীর সন্ত্রস্ত পলায়ন লক্ষ্য করতে লাগলো।যেন কথাটা আকস্মিকভাবেই তার মনে পড়লো এমনি ভঙ্গিতে সুরতুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ইজু, দিঘার বন্দর ডুবলি র্যালের কোঅটর ডোবে?
তা হবি।
ইজু, তোমার মামু মাধাই সেখানে আছে। তার নড়াচড়ার খ্যামতা নাই।
তা নাই।
সুরতুন একটা খুঁটি চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
বিকেলের দিকে হঠাৎ সে বারান্দা থেকে নেমে দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলো, অবশেষে ছুটতে। পায়ে পায়ে জলের শব্দ হচ্ছে, জলে গতি আটকাচ্ছে।
পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে ইয়াজ যখন সুরতুনের কাছে গিয়ে পৌঁছলে তখন সুরতুন দিঘা সড়কের এমন এক জায়গায় এসে পৌঁছেছে যেখানে পথটা ধসে গিয়েছে, এবং তার উপর দিয়ে একটা জলের স্রোত চলেছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে স্রোতটার গভীরতা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা অনেকখানি চওড়া এবং অত্যন্ত তীব্র। সুরতুনের সর্বাঙ্গ কর্দমাক্ত। ছুটে চলতে গিয়ে পড়েও গিয়েছিলো সে। তার পরিধেয় বস্ত্রের দু-এক জায়গায় ফালি ফালি হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছে।
সুরতুন অন্ধকারে কালো সেই জলস্রোতের মধ্যে নামার জন্য পা বাড়িয়েছে, তখন ইয়াজ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, থামোথামো। ও জল কি পার হওয়া যায়?
সুরতুন থমকে দাঁড়িয়ে বললো, মাধাই যে একা আছে।
তাহলেও তোমাক যাতে দিতে পারি না।
কথা বলতে বলতে সুরতুন জলে নেমে পড়েছিলো। স্রোতে দাঁড়াতে পারছেনা, তবু অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে। ইয়াজ সুরতুনের চোখের অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করেছিলো। কথা বলার সময় সেটা নয়। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সুরতুনের কাছে গিয়ে শক্ত মুঠোয় তার দু হাত চেপে ধরে টানতে টানতে সড়কে ফিরিয়ে আনলো।
সুরতুন প্রথমে তার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, তার পরে হিংস্র ভর্ৎসনার সুরে বললো, যা চাও, তা তুমি পাবা না। আমাক ছুয়ো না কলাম। হাত ছাড়ো, হাত ছাড়ো।
দু হাতে সুরতুনকে জাপটে ধরে সরিয়ে আনতে আনতে ইয়াজ বললো, আ-ছি ছি। কও কী! শোনন, সুরা, শোনো। এ পথে যাওয়া যাবি নে। দ্যাখো, চায়ে দ্যাখো, জলের ওপারে এপারে লোক থ হয়ে দাঁড়ায়ে আছে। শোনন, সুরো, শোনো, দিঘায় ঘোরাপথে যাওয়া যায় না কি দ্যাখো।
সুরতুন সম্বিৎ পেলো। কেঁদে কেঁদে বললো, কে, ইজু, এত লোক বাঁচে, মাধাই বাঁচলি কী দোষ?
দোষ কী। আসো যাই, দেখি।
.
তিনদিন পরে সুরতুন আর ইয়াজ ফিরে এলো।
অনেক কায়িক শ্রম, ততোধিক সহিষ্ণু দৃঢ়তা, অনেক বুদ্ধি ও ততোধিক সাহসের পরিচয় দিয়ে ইয়াজ মাধবপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলো। সে গ্রামেরও অধিকাংশ প্রায় একটি দিন জলমগ্ন ছিলো। মাধবপুরের পর আরও দুখানা বন্যামগ্ন গ্রাম পার হতে পারলে দিঘার রেলের রাস্তায় ওঠা যায়। কিন্তু সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে তাদের থেমে দাঁড়াতে হয়েছিলো। সন্ধ্যার ধূসর দিগন্ত পর্যন্ত জল, আকাশে ফসফরাসের বিকীর্ণ তেজের মতো মেঘের স্তর চোয়ানো একটা আলো। সেই অস্পষ্টতায় জলকে সজীব কোনো ক্ষুধাতুর প্রাণীর মতো মনে হচ্ছিলো। সেই, অকূল পাথারের ওপারে মাধাই, আর এপারে সে। জলকাদায় বসে পড়ে উজ্জ্বিত জানুতে মুখ। লুকিয়ে দীর্ঘক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সুরতুন অবশেষে ইয়াজের ডাক শুনে উঠে। দাঁড়িয়েছিলো।
একটা আশ্রয় খুঁজে নেওয়া দরকার হয়েছিলো। পিছনে ফেরাও সম্ভব নয়। দিনের বেলায়। যেখানে প্রাণ হাতে করে চলতে হয়েছিলো সেখানে জল নিশ্চয়ই আরও বেড়েছে, রাত্রির অন্ধকারে সে পথে ফেরার আশা বাতুলতা। তখনো হয়তো জল বাড়ছেই। মাধবপুর গ্রামটির সব চাইতে উঁচু জমি দিঘা চিকন্দি সড়কের এই অংশটুকু, সেইজন্যই হয়তো এখনো সেখানে পায়ের তলায় মাটি ছিলো। অধিকাংশ বাড়িই পরিত্যক্ত। দু-একটিমাত্র বাড়িতে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। তাতে বোঝা যায় অধিবাসীরা ঘর আঁকড়ে পড়ে আছে। কিন্তু আরও জল বাড়লে খাঁচায় বন্ধ পাখির মতো ডুবে মরবে। ইয়াজের প্রাণও ভয়ে হিম হয়ে গিয়েছিলো।
জল, কাদা, কোথাও বা ভিজে ভিজে বালির উপর দিয়ে সন্তর্পণে চলতে চলতে চরনকাশির জোলার ধারে এসে এইমাত্র সুরতুন ও ইয়াজ থমকে দাঁড়ালো। যেখানে জোলা ছিলো, মাধবপুর যাওয়ার সময়ে যে জোলা সাঁতার দিয়ে পার হতে হতে ইয়াজের আশঙ্কা হয়েছিলো স্রোত ঠেলে সুরতুন হয়তো ওপারে যেতে পারবে না, সেই জোলায় এক ফোঁটা জল নেই। কোথাও পলি, কোথাও বালিতে ঝুঁজে গেছে সেটা। সেখানে দাঁড়িয়ে বুধেডাঙা চোখে পড়লো। কালো কাদার একটি বিক্ষুব্ধ পাথার।
তার মধ্যে মধ্যে কাত হয়ে পড়া কুটিরগুলো, হেলে পড়া কাদামাখা গাছ।
তিনরাত দুদিনের মধ্যে একবারই মাত্র খেয়েছে তারা, একরাতই ঘুমিয়েছে। একটি অপরিসীম ক্লান্তিতে চরাচর আচ্ছন্ন। শুধু চোখে-মুখে ছাপ পড়া নয়, সুরতুনের গলার স্বরও বসে গেছে, কথা বলতে গেলে অস্পষ্ট একটা শব্দ হচ্ছে মাত্র। কিছুই মনে পড়ছেনা তার, শেষ পর্যন্ত কীভাবে কোথায় তারা আশ্রয় পেয়েছিলো। আশ্ৰয়টা বোধহয় খুব উঁচু একটা কিছু ছিলো। হয়তো তা কোনো গৃহস্থের পোয়ালের পুঁজ, ইয়াজ তাকে সেখানে টেনে তুলতে হাঁপাচ্ছিলো। আর হঠাৎ যখন গুমগুম শব্দ হতে হতে আকাশ থেকে আবার বৃষ্টি নামলো ইয়াজ পাঁজা পাঁজা খড় এনে নিজেকে এবং তাকে ঢাকবার চেষ্টা করেছিলো।