সুরতুনের মনে হলো তার পায়ে চলার ছপছপ শব্দ ছাপিয়ে ফতেমার বেদনার্ত কান্না ভেসে আসছে।
মাধাইয়ের শেষ খবর এনে দিয়েছে ইয়াজ। মাথাই এখন আর পথে বেরোয় না। আধা মাইনার ছুটির পর এখন তার বিনি-মাইনার ছুটি চলছে। তাও নাকি আর মাত্র দু মাস চলবে। তারপর? রেল কোম্পানির ঘর ছেড়ে দিয়ে চাঁদমালার ভাটিসিদ্ধ করার উনুনের পাশে গিয়ে বসতে হবে। এসব কথা মাধাই-ই নাকি হাসিমুখে বলেছে। মাধাই নাকি একটা বাঁশি ফুকায় আর কাঁদে। সেটাই নাকি এখন তার একমাত্র কাজে দাঁড়িয়েছে। গাঁজা খায়। চাঁদমালা মদ নিয়েও আসে মাঝেমাঝে।
বর্ণনা করতে করতে দুটি বিষয়ের দিকে ইয়াজ সুরতুনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো। সানাইয়ের বাজনা শুনে প্রাণ কেমন করে, আর তার পায়ের নোংরা ন্যাকড়া বাঁধা-ঘায়ে মাছি। ভনভন করে, সেদিকে চেয়ে ঘৃণায় গা শিউরে ওঠে।
শুনতে শুনতে সুরতুনের চোখের সম্মুখে চালের মোকামে দেখা একটি ভিক্ষুকের চেহারা ভেসে উঠেছিলো।দু পায়ের সব আঙুল খসে গেছে। নোংরা চট ও কাপড়ের ফালিতে পা দুখানা জড়িয়ে বাঁধা। প্ল্যাটফর্মে ঘষটে ঘষটে চলে, বিকৃত হাত দুখানা তুলে আঁউ-আঁউ করে যাত্রীদের কাছে ভিক্ষা চায়।
একটা বিমুখতায় সুরতুন শিউরে ওঠে।
জলে ডোবা একটি গর্তে পা পড়েছিলো সুরতুনের। পড়ে যেতে যেতে সে সামলে নিলো বটে কিন্তু ব্যথাও পেলো। বিরক্ত হয়ে সে ভাবলো-যে ছাওয়ালের বাপ নাই সে কি বাঁচে? ফতেমার কাছে যে আসছে সে কষ্ট পেতে এবং দিতে আসছে। কী বোক, কী বোকা!
বাড়িতে ফিরে উঠোনের একহাঁটু জল থেকে বড়ো ঘরটায় বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে সুরতুন শুনতে পেলো ফতেমা কথা বলছে রজব আলির সঙ্গে।
কেমন আছে ভাবি? সে প্রশ্ন করলো।
এখন একটু ভালো। রজব আলি বললো, কেরাসিন একটুক আনা লাগবি। আন্ধার হলে দুই’পরে’।
সুরো বললো, কও, এমন চেহারা হলে দিনের, ভাবিক বাঁচান্ যাবি?
সুরতুন বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়ে ছিলো। দিঘার যে বড়ো সড়কটা আজকাল প্রায় পরিত্যক্ত,সহসা সুরতুনের মনেহলো তার উপরে হাট বসেছে। অবাক হয়ে সে দেখছিলো। অনেকটা সময় লক্ষ্য করে তার মনে হলো হাটটা যেন গতিশীল, সেটা এগিয়ে আসছে।
সুরতুন রজব আলিকে বললো, কিন্তু তার দৃষ্টিও সংকীর্ণ। সে দেখে কিছু ঠাহর করতে পারলো না।
ইয়াজ তার হাঁসগুলোকে খুঁজতে গিয়েছিলো, সে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলো। বারান্দায় উঠে। দাঁড়িয়ে সে ঘোষণা করলো, বান, বান।
সে কী! কনে?
এখানে, ওখানে, সব জায়গায়।
চিকন্দি থেকে সোজাসুজি দিঘা যাওয়ার সড়কটা সানিকদিয়ারের পাকা সাঁকোর উপর দিয়ে গিয়েছে। তার একটা শাখা ধরে চরনকাশি ও বুধেভাঙার পাশ দিয়ে দাদপুরের সীমানা ছুঁয়ে মনসার গ্রামে কাদোয়ায় যাওয়া যায়। এই সড়কটি পদ্মার বর্তমান খাতের সঙ্গে সমান্তরাল। রাস্তাটার যেদিকে বুধেভাঙা চরনকাশি প্রভৃতি, তার বিপরীত দিকে অর্থাৎ পদ্মা ও রাস্তাটার মধ্যবর্তী জায়গাটিতে দু-চারটি ছোটো ছোটো কিন্তু কৃষিসমৃদ্ধ গ্রাম আছে। এসব গ্রামে প্রতি বর্ষাতেই পদ্মার জল ঢুকে পড়ে। দুটি মাসকষ্টের, তারপর সেই জলই আশীর্বাদ বলে গণ্য হয়। . চিকন্দি উঁচু। সে সড়ক চিকন্দিতে সাধারণ একটা পথ, বুধেভাঙার কাছে এসে সেটা গ্রামের চাইতে ক্রমশ উঁচু করে উঠেছে। তার কারণ সড়কের কমোন্নতি নয়, গ্রামই নিচু। কিন্তু এসব মোটামুটি হিসাব থেকে বলা যায় না রাস্তার ওপারে লবচর, লুপপুর ডুবলে এদিকের বুধেভাঙা বা চরনকাশি বাঁচবে কিনা।
সুরতুন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখতে পেলে কয়েকটি বিপন্ন চেহারার লোক সপরিবারে বুধেভাঙা পার হয়ে চিকন্দির দিকে চলে গেলো। তাদের মধ্যে একজন বয়োবৃদ্ধ বুক চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে। দেখতে দেখতে ভিড়টা বাড়তে লাগলো। এই পথ ধরে যখন এত লোক আসছে, চরনকাশি আর মাধবপুরের মধ্যে দিয়ে দিঘা-সানিকদিয়ার-চিকন্দির পাকা সাঁকোর উপর দিয়ে যে-সড়ক তাতে না জানি কত লোক জমেছে।
ইয়াজ বেরিয়ে গিয়ে আসল খবরটা নিয়ে এলো। সড়কের আর পদ্মার মধ্যবর্তী জায়গাগুলিতে জল প্রতি ঘণ্টায় তিন-চার সুত করে বাড়ছে। তা বাড়ুক। চরনকাশির জোলায়। পাকা সকোর তলা দিয়ে ই-ই করে জল ঢুকছে, তা হোক। আসল খবর হচ্ছে, বাঁধটাই ফেটে গেছে। দিঘায় জল ঢুকছে। স্টেশনের উপরে ওঠেনি, বন্দরে একহাঁটু হয়েছে। আর ভয়ের কথা এই, এদিকে যেমন এক সুত দু সুত করে জল বাড়ছে তেমন নয়,কলকল করে সে জল ডাকছে, প্ল্যাটফর্মের গায়ে সে জল ছলাৎ ছলাৎ করে ধাক্কা দিচ্ছে।
বর্ণনা শেষ করে ইয়াজ বললো, ওই যে দেখছে, ওর মধ্যে দিঘা বন্দরের ভদ্রলোকরাও আছে।
কিন্তুক দিঘা বন্দর শুনছি নবাবের হইছে।
কী কও? সে কথা জিগাইছিলাম। বন্দরের একজন কলে, নবাবি আর যে রাজগি না কী কলে। তা সব সমান। খোদার গজব। রাজগির থিকে নাকি এই ঢল নামতিছে। সাম বণ্টক করে সেসব বাঁধ দিচ্ছিলো এখন সবকাটতিছে। গাং এক বহতা না হলি, এক জায়গা জমলি তালগাছও থৈ পাবি নে।
রহমান খোদা! বললো রজব আলি।
কী রহম দেখলা? ইয়াজ ভিজে গা গরম করার জন্য তামাক সাজতে বসলো।
ঘরের মধ্যে ফতেমা এসব শুনতে পেলো কিনা সে জানে। তার অব্যক্ত বেদনার আর্তনাদ মাঝে মাঝে বাইরে এদের কানে আসতে লাগলো। গহরজানের বুড়িবিবি এখনো আসেনি।