গাড়ি দেখতে এলে বুঝি?
দেখতে আসি নাই। পাস্ করাবো আমি। আমি ঝাণ্ডাদার। বেশ করেছে।
মাধাই মালবাবুর চোখেমুখে একটু উত্তেজনা প্রত্যাশা করেছিলো। মালবাবু যেন কীরকম! অন্য বাবুদের থেকে আলাদা।
প্ল্যাটফর্মে ডাউন গাড়ির প্রবেশপথের কাছে কর্মচারীদের ভিড় বাড়ছে। মাধাই তাড়াতাড়ি সেদিকেই পা চালাতে লাগলো। সেখানে পৌঁছুতে না-পৌঁছুতে দিগন্তে স্পেশ্যালের ধোঁয়া দেখা দিলো। স্টেশনমাস্টার নিজেই ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সঙ্গে তিন-চারজন বাবু, জন দু-এক পোর্টার, পয়েন্টম্যান। এইনা হলে জীবন? কেবিন আর প্ল্যাটফর্মের মাঝামাঝি জায়গায় মাধাই দাঁড়িয়ে পড়লো ঝাণ্ডা নিয়ে। দাঁতে দাঁত লেগে চোয়াল কঠিন হয়ে উঠলো তার। দিগন্তবিস্তৃত রেল দুখানা যেন একটু একটু কাঁপছে। স্পেশ্যাল সে-দুটিকে অবলম্বন করে এগিয়ে আসছে। লাইন দুখানার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মাধাইয়ের অনুভব হলে সে-দুটি তার দেহে প্রবেশ করে শিরা-উপশিরার প্রঋনতম দুটি হয়েছে, গাড়িখানা তার হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করবে সন্দেহ কি।
.
কিন্তু স্পেশ্যাল এসেছিলো, চলেও গেলো। মাধাই মালবাবুর ঘরের দরজায় একটি প্যাকিং বক্সের উপরে বসে পড়লো। একটু উসখুস করে মাধাই বললো, দেখলেন?
না, আমার যে অনেক কাজ।
সিগারেটের ছাই ঝেড়ে সেটাকে আবার মুখে গুঁজে মালবাবু স্টেটমেন্টে মন দিলো। মাধাই মনিরুদ্দির খোঁজে গেলো।
যে ব্যাপারটা সে লক্ষ্য করেছে সেটা আর কারো নজরে পড়লো কিনা এটা জানা দরকার। স্পেশ্যাল যখন ইন করলো তখন মাধাই লক্ষ্য করেছিলো গাড়ি দুখানি ফুলপাতা-পতাকায়। সজ্জিত। ছোটোখাটো অনেক স্পেশ্যাল ট্রেন এর আগে উত্তরে গিয়েছে, অনেক ফিরেছে। দক্ষিণে। কিন্তু এমনটা কখনো হয়নি। মাধাই ভেবেছিলো এবার সব সেরা কিছু দেখতে পাবে। আলোয় ঝলমল করতে করতে প্রথম গাড়িটা থামলো। গাড়ির আলোয় স্টেশনের আলোয় রাত দিন হয়ে গেলো। একসঙ্গে সবগুলো ভেন্ডার তাদের ডালা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিলো। সে চিৎকারে মাটির ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু সেই আলোক-উদ্ভাসিত গাড়ি যেন ঘুমিয়েই রইলো। জানলায় যে-মুখগুলি দেখা গেলো তারাও এতটুকু উৎসুক হলো না। একটি দুটি প্রথম শ্রেণীর গাড়ির দরজা খুলে গম্ভীর মুখে দু-একজন খুব বড়ো বড়ো অফিসার নামলো। তারপর তাদের নামা দেখে সাহস পেয়ে আরো দু-একজন করে সৈন্য নামলো। কিন্তু এরা যেন কোনো নতুন পৃথিবীতে পদার্পণ করছে। যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা স্টেশনটার চারিদিক দেখতে লাগলো। ভেন্ডাররা তাদের গাম্ভীর্য দেখে এগোতে সাহস করলো না। কিছুমাত্র সাড়া শব্দ নেই, একটা পয়সা বিক্রি করতে পারলো না ভেন্ডাররা। অবশ্য এটা হয়তো অত্যুক্তি। বিক্রি কি আর হলো না, কিন্তু তাকে বিক্রি বলে না। আগে দু’পয়সার জিনিস কিনতে যে হুংকার ঝনৎকার ছিলো, এখন হাজার টাকার লেনদেনেও তার সিকিটা হলো না। কেউ ডালা থেকে থাবড়া দিয়ে সবগুলি সিগারেট তুলে নিয়ে দশটাকার নোট ছুঁড়ে ফেলে দিলো না। ভেন্ডারের টিকি ধরে টান দিয়ে কেউ হো-হো করে হেসে উঠলো না। এর আগে গাড়ি থামতে-না-থামতে যারা দুদ্দাড় করে ছুটতে ইঞ্জিনের জল নেওয়ার কলামের নিচে, এক-স্টেশন লোকের সামনে উলঙ্গ শিশুর মতো স্নান করতে পারতো, সেই লোকগুলিইবা গেলো কোথায়! দ্বিতীয় গাড়ি প্রথম গাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো। একই কথা।
মাধাই মনিরুদ্দির সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, মুর্দা গাড়ি নাকি রে? মাস্টারসাহেব তো বলে খুব যুদ্ধ জিতছে ওরা।
এ কী রকম জয়লাভ মাধাই বুঝে উঠতে পারে না। জয়লাভ করা মানে চোরের মতো মুখ করে ঘরে ফেরা নাকি?
একটা চায়ের দোকানে বসে পড়লো মাধাই। দোকানিকে চা দিতে বলে সে পাশের যাত্রীটিকে প্রশ্ন করলো’দেখলেন?
দেখলাম।
যুদ্ধে জিতছে তবে আনন্দ করলো না কেন?
এখানে করবে কেন? ওদের দেশে ওদের ছেলে মেয়ে বউ আছে, তাদের কাছে গিয়ে করবে।
মাধাই শ্রদ্ধায় লোকটার দিকে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে বসলো। এতক্ষণে একটা কথা একজন বলেছে বটে। ঠিক তো। যুদ্ধজয়ের পর এখন বাড়ি ফেরার তাড়া। এখন কি আর হৈ হৈ ভালো লাগে!
লোকটির ট্রেন ধরার তাড়া ছিলো। সে উঠে গেলো। মাধাই চুষে চুষে চা খেতে লাগলো। দোকানিকে সে কথাটা বললো, যুদ্ধে জিতলে কী হবি, নিজের ঘরে না ফিরলে কি আর আনন্দ হয়!
অথচ মজা দ্যাখো, এই এত বড় ব্যাপারটা কেউ লক্ষ্য করলো না–না জয়হরি, না মনিরুদ্দি।
এটা যে আজই প্রথম হলো নয়। আজ চূড়ান্তভাবে বিষয়টি চোখে পড়েছে, কিন্তু কিছুদিন আগে থেকেই মাধাইয়ের একটা ফাঁকা ফাঁকা বোধ হচ্ছে? জয়হরি কথাটা শুনে ঠিক হেসে উড়িয়ে দেয়নি, বরং মাধাইয়ের পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে বিস্মিত হয়েছিলো। পর্যবেক্ষণটির মূল্য সম্বন্ধে সে কিছু বলেনি, মোটামুটি গভীরে চিন্তা করে সে এটাই তাদের বিস্মিত করেছিলো। তার কথাগুলো যেন কতকটা ভদ্রলোকের আলাপের মতো শোনায়।
জয়হরি বলেছিলো, মানুষ কি চিরকালই লাফায় নাকি? তুই চাকরির প্রথম দিকে ওভারব্রিজে দড়ি বেঁধে দোল খাতি, এখন তা করিস? বয়স বাড়লি ধীরথির হয়। এ-ও তেমনি। যুদ্ধের বয়েস হলো না?
কৌশল করে একটা উপমা দিতে পেরেও সুখী হলো না জয়হরি। অপ্রতিভের মতো মুখ করে সে হাসলো। উপমাটার প্রয়োগের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তার সন্দেহ ছিলো।