এখন সে কথাটা তার মনে পড়লো। কিছুক্ষণ কৌতুকবোধটা অনুভব করে পরে সে, স্বগতোক্তি করলো–এ জীবনে ধম্ম করা হবি নে। ভগে!মানের ইচ্ছা না।নইলে ফের সেই নতুন করে জীবন আরাম্ভন। এই দ্যাখো কী ব্যাপার! আমরা তো রোপা-ধান একবার ক্ষেত থেকে তুলে আর এক ক্ষেতে বসাই। তুমি তিনবার করলা, কে, ভগোমান?
রামচন্দ্র পাশ ফিরলো কিন্তু আত্মগত চিন্তার জের টেনে চললোধম্ম তুমি চাও না বুঝছি। আচ্ছা, তাতে আমি চটি না। তুমি পদ্মর ব্যাপারে কিন্তু আমাকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলায়ো না। সনকা কাঁদবি, তা যেন হয় না। ধম্ম আমি চাই না, যদি না দিবা। কিন্তুক সজ্ঞানে যে যাই। মুঙ্লাক, পরের ছাওয়ালেক ভালোবাসে অন্যাই করছি? আমি তো চুরি করি নাই তাক।
একদিন এমন হবি। পেরথম বর্ষার ঢল মারতি মারতি খেতে যখন এক হাত পেরমান জল, মুঙ্লা আসে কবি বাবা ওঠো, আজ ক্ষেতে যাতে হবি। না গেলিই না। ততদিনে মুঙ্লা কাজ শিখছে, কাজেই তাক ফাঁকি দেওয়া যাবি নে।কবের হবি, শরীলটা বেজুত, কাল সকালে যাব, একদিনে আর কী হবি। কাউকে জানা নাই। ভান্মতি আর মুঙ্লা যখন বাদলার ভরে বেলা টের না পায়ে উঠি কি না-উঠি করতিছে সুখশয়ান ছাড়ে, তখন সনকাকে ডাকে কবো-আমি চলোম, বউ। যাওয়ার আগে তোমাক কয়বার ‘সুনু’ কয়ে ডাকি। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আত্মার যাওয়া-আসা-কেষ্টদাস কইছে। পথে যাতি যাতি পদ্মর সঙ্গে একবার দেখা করবের হবি? তারপরও কি খেতের চারিদিকে কয়েক পাক উড়বি তার আত্মা?
জ্বরের ঘোর ও তার ভাবটা কাটলে ঈষৎআরক্ত চোখ মেলে দেখলোরামচন্দ্র, তার শিয়রে বসে সনকা।
রামচন্দ্র বললো, ভান্মতি কই? তার মনে হয়েছিলো পদ্মর গলার রুপোর চিকটা যেন ভানুমতি পরেছে। ভানুমতিদের সে কি বন্দোমানেই যেতে বলবে?
জল খাবের চালে, খাবা? সনকা বললো।
না। জ্বর বেশি আসছে, না? রামচন্দ্র হাসলো।
এমন সময়ে মুঙ্লা ঘরে এলো। তার সর্বাঙ্গ কর্দমাক্ত।
বাবা, ক্ষেতে জল হইছে পেরায় এক হাত। আটকায়ে রাখবো, না কমায়ে দেই বুলি না। ওদিকে পদ্মাও নাকি কাপতিছে।, না দেখে কতে পারি নে। কাল দেখবো। রামচন্দ্র হাসলো।’কেন, সে আবার ফোপায় কে? স্বপ্নের কথাটা মনে পড়লো তার। কিছুক্ষণ বাদেই সে শুনতে পেলো মুঙ্লা ও ভান্মতি কী একটা ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করছে। আনন্দ বোধ হলো তার।
সে বললো, সুনু, কথাখান্ গায়ে জড়ায়ে দেও।
মুঙ্লারা হাসাহাসি করছিলো না, বন্যার ব্যাপার নিয়ে যেসব কথা হচ্ছিলো গ্রামে তা নিয়ে। আলোচনা করছিলো। বিপদ নিশ্চয়ই, তাহলেও অভিনবত্ব যেন বিপদটার প্রতি উৎসুক করেছে। কলাগাছের ভেলাবাঁধতে হবে, মাছ ধরবার জন্য একটা জালও চাই, যদিও সেটা হয়তো প্রলয়ের কালো জল।
.
সুরতুন গহরজান সান্দারের বাড়িতে গিয়েছিলোতার বুড়িবিবিকে অনুনয়-বিনয় করতে। বুড়ি রাজী হয়েছে তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ফতেমাকে সাহায্য করতে। ফতেমা আসন্নপ্রসবা।
বুধেডাঙার পথে কোথাও কোথাও একহাঁটু জল। মাথার উপরে জলভরা আকাশ। পদ্মার দিকে তাকিয়ে ভয় করে। দিগন্তের পরিধি অত্যন্ত সংকুচিত। দিনদুপুরে সন্ধ্যার পূর্বাবস্থা।
ঘরে আহার্য নেই, চাল বেয়ে হু-হু করে জল পড়ে। যেভাবে বৃষ্টির জল জমে যাচ্ছে তাদের বাড়ির উঠোনে হয়তোবা বিকেল নাগাদ উঁচু ঘরটাতেও জল উঠবে। আর সেই ঘরে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ফতেমা। বৃষ্টির জল এবার কেন সহসা এত বেশি হলো এ বলা শক্ত। এমন জল থাকলে গরজানের বুড়ি বিবি কী করে আসবে? সুরতুনের নিজেরই চলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তার কষ্টর চাইতে ফতেমার কষ্ট শতগুণ বেশি। ফতেমার মতো সাহসী এবং সহিষ্ণু মেয়ে ভয়ে যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
তবে একটা কথা এই, ভাবলো সুরতুন, সব অগাধ জলে মানুষের বুদ্ধি থৈ পায় না। ফতেমার কী দোষ যদি সে নিজে ইচ্ছা করে এই কষ্টে জড়িয়ে পড়ে থাকে। সে নিজেও কী করে জড়িয়ে পড়লো এই সংসারে, তার উত্তর নেই। ইয়াজ, কোথাকার কে? সে এসে কাধ পেতে দিলো। আর যেন তার দেখাদেখি সুরতুন নিজেও এই সংসারের নৌকা ঠেলার জন্য কাদায় নেমে দাঁড়িয়েছে। লাভক্ষতির হিসাবে একে ব্যর্থশ্রম ছাড়া আর কী-ই বা বলা চলে?
ফতেমার কথাই বিচার করো। সব চাইতে শক্ত, সব চাইতে বুদ্ধিমান।কীকরলো সে? জেবু অলীক ভয়ে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলো, আর ফতেমা জেনেশুনে একী ঘটালো? এমন হতে পারে নাকি জেবুন্নিসার ভয়ই তাকে এ-পথের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো? একটা কথা সুরতুন শত চেষ্টাতেও বুঝতে পারবে না-ছাওয়াল-চাওয়া’কী করে ফতেমার জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো। সে সন্তান চাইতো বলেই ফুলটুসির ছেলেদের নিয়ে আতিশয্য করতে কিংবা তাদের সঙ্গে নকল মায়ের অভিনয় করেই ছাওয়াল-চাওয়া’ জেগে উঠেছিলো তার?
ফতেমার মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে যদি বুদ্ধিহীনার মতো ব্যবহার করতে পারে তবে পৃথিবীতে বুদ্ধিমতী কথাটাই নিরর্থক। বুদ্ধিমতী হলে সে নিজে কী করতো? মাধাইকে নেয়া তার পক্ষে বুদ্ধিমতীর কাজ হতে একথা শুধু ফতেমা বলে না, ইয়াজও একদিন বলেছিলো, এমনকী সে নিজেও ভেবে শিউরেছিল একদিন। মাঝখানের কয়েকটি দিন। তার দু পারে তার ও মাধাইয়ের জীবন পৃথকভাবে প্রবাহিত, বিস্তৃত। সে প্রবাহ কখনো কাছাকাছি এসেছে, কখনো দূরান্তরে সরে গেছে। শুধু সেই কয়েকটি দিনে জীবনের সম্মিলিত প্রবাহ কী অপূর্ব সব অনুভূতি সৃষ্টি করেছিলো। কিন্তু ভাগ্যে তখন ফতেমার মতো কোনো বোকামি সে করে বসেনি, নতুবা আজ বিপন্নতার কোন গভীরতায় তাকে নামতে হতো কে জানে।