রামচন্দ্র বললো, তোমার সাথে কথা আছে, কন্যে।
বসেন।
তা বসি। রামচন্দ্র ঘরের দাওয়ায় উঠে বসে বললো, মুঙ্লা আসে?
আসে।
তার বাড়িতে বউ আছে।
তা জানি তো।
এ কি ন্যায্য হতিছে তোমার?
কী অন্যাই? আমাক সকলেই তাড়াবি?
রামচন্দ্রর ক্রোধ উদ্বেল হয়ে উঠলো, কিন্তু স্ত্রীলোক যে। সে জোড়হাতে পদ্মর হাত ধরে অভারাক্রান্ত গলায় বললো, রাক্ষুসি, আমার এক ছাওয়ালেক খাইছো, আর একটাক ফিরায়ে দেও।
পদ্ম ফিক করে হাসলো।
তুমি হাসো? তুমি হাসো!
ভয় পান কে? এই বললো পদ্ম, কিন্তু তার হাসি হাসি মুখ যেন অপমানে কালো হয়ে উঠলো।
পরাজিত রামচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। মনের উপরে জোর চলে না। একবার জবরদস্তি করতে গিয়ে ছিদামের ওই দশা হলো। হে ভগোমান। ধনবল জনবল কিছুই কি আর অবশিষ্ট থাকবে না?
পদ্ম বললো, বসেন, আপনেক একটা সত্যি কথা কবো। মুঙ্লা এখনো ঠিক আছে। তবে তার মনের কথা আমি জানিনে। পদ্মর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো।
পদ্মকে সে অবিশ্বাস করেনি। ভান্মতির প্রতি মুঙ্লা যদি অবহেলা দেখিয়েও থাকে এখন তার সুখশান্তির পথে হয়তো চিরকালের জন্য কাটা পড়েনি। রামচন্দ্র কথাগুলিকে ওজন করে দেখার জন্য সময় নিতে লাগলো। একদিন চিন্তা করতে করতে তার স্মরণ হলো, একসময়ে একান্তে পদ্ম তাকে একটি অবিশ্বাস্য এবং অপূর্ব কথা বলেছিলো। এটা তার চিন্তাকে নতুন খাতে প্রবাহিত করলো।
সেদিন পূর্ণিমা নয়, এমনকী কোনো বিশেষ তিথি পর্যন্ত নয়। রামচন্দ্র আবার পদ্মর বাড়িতে গেলো। কন্যে আছো?
আছি।
পদ্ম।
কন্।
পদ্ম, তুমি বিয়ে করবা?
না।
রামচন্দ্র আবার চিন্তা করলো।
তোমাক এ গাঁ ছাড়তে হবিনে। এখানে আসো, আমার কাছে আসে বসো, মনের কথা কও।
পদ্ম ঘরের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো।
কই, আসো।
পদ্ম রামচন্দ্রর সম্মুখে এসে বসলো।
রামচন্দ্র বললো, পদ্ম, এখন থিকে লোকে জানুক তুমি রামচন্দ্র মণ্ডলের।
পদ্ম কথা বললো না, তার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো।
রামচন্দ্র বললো, আর একখান ঘর তোলবো আমার বাড়িতে। তখন তোমাক নিয়ে যাবো। গাঁয়ের লোক-সকলেক ভোজ দিয়ে জানায়ে দিবো।
পদ্ম কাঁদতে লাগলো।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রামচন্দ্র বললো, আর এক কথা। রঙিন কাপড় পরবা না। আর চুল কাটে ফেলবা। আর পান–তা পান খাতে পারো। আচ্ছা, চুলও রাখো। আর সন্ধের পর কখনো দেখা করবা না।
ঘটনাটা ঘটিয়ে দেওয়ার পর রামচন্দ্র অনুভব করলো এক কঠিন দুশ্চর পথ ধরে সে রওনা হয়েছে। যত সহজে কথাটা রাষ্ট্র করে দেওয়া যাবে ভেবেছিলো সে তত সহজ নয় বিষয়টি। এ নিয়ে আর যাই করা যাক উৎসব করা যায় না।
সনকাকেও বলা যায়নি, অথচ তাকেই তো সর্বাগ্রে সব কথা বলা দরকার।
প্রায় একমাস হয়ে গেছে। সেদিনের সেই একান্ত অদ্ভুত প্রস্তাবের পর রামচন্দ্রর সঙ্গে পদ্মর একটিবার মাত্র দেখা হয়েছে। সেদিন হাটবার। রামচন্দ্র হাটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এমন সময়ে একটি ছোটো ছেলে এসে তাকে বললো, পদ্ম নাকি তাকে ডেকেছে। . রামচন্দ্র যাবো কি যাবো না করতে করতে অবশেষে পদ্মর কুটিরে গিয়েছিলো। এবং একটি অনাস্বাদিতপূর্ব করুণ মাধুর্যে তার অন্তর সিক্ত হয়ে রইলো সমস্তটা পথ।
পদ্ম বললো, আমি হাটে গেলি কি রাগ করেন?
না। আমিই যাবো।
তাহলে আমার ভাড়ার দেখে যান কী কী লাগবে।
আচ্ছা, আচ্ছা, দেখবের হবি নে।
পদ্ম তার চুলগুলি কেটে ফেলেছে। অবশিষ্ট চুলগুলি থলো থলো হয়ে কাধ পর্যন্ত ঝুলছে। পরনে শাদা থান জোটেনি কিন্তু শারির পাড় ছিঁড়ে ফেলেছে।
রামচন্দ্র বললো, সন্ধ্যার পর সওদা দিয়ে যাবনে।
পদ্ম কেঁপে উঠলো।
রামচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো, কী হলে?
কিছু না। ছাওয়ালেক দিয়ে পাঠায়ে দিবেন সওদা। আর কাল দুই পরে ভানুমতিকে একবার পাঠায়েন ছাওয়ালের সঙ্গে।
তা দিবো।
রামচন্দ্র ভাবলো, জনবলকে সে ক্ষয় থেকে রক্ষা করেছে, কিন্তু সে নিজে কি সবদিক রক্ষা করে চলতে পারবে? বৃষ্টি নামে কই? আকাশ ফাটে বৃষ্টি নামে কই? হা-হা!
.
কয়েকদিনহলোবর্ষা নেমেছে। জলদিবা থামেভিজে ভিজে বাতাস চলতে থাকে। রামচন্দ্র জানে কাছে কোথাও ‘সাইকোলোন’ হলে এদিকে এমনটা হয়। বর্ষার জলে ভিজে এবার তার শরীরটাও খারাপ করেছে। সে নাকি একবার কোন মাঠে জলবৃষ্টির সোহগে শুয়ে থেকেছিল। একদিন একরাত। বয়স বেড়েছে সন্দেহ কী!
রামচন্দ্র তার ঘরে একটা মাদুরে শুয়ে খোলা দরজা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিলো। তার বাড়ির চৌহদ্দি নির্ণয় করার বড়ো আমড়াগাছটার কচি কচি নরম পাতায় তখনো বৃষ্টির জল দেখা যাচ্ছে। জল থেমেছে কিন্তু পাখপাখালিরা পাতার আড়ালে ঝুটোপুটি করে খেলা করলে যেমন দেখা যায় তেমনি মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে।কাঠবিড়ালিওনয়, পাখিওনয়। ছোটো ছোটো টুকরো বাতাসেই এমনটা করছে। রামচন্দ্রর দৃষ্টি অতঃপর মাটিতে পড়লো। তার বাড়ির সম্মুখে যে জমিটা, তার উপরে জলজমেছে। বিঘৎপরিমাণ হবে সেজল গভীরতায়, কিন্তু চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, বন্যার জল। তা বন্যাও হতে পারে।
রামচন্দ্র চিন্তা করলো। অনেকদিন পরে সে আবার তার নিজের মনের সাক্ষাৎ পেয়েছে। নবদ্বীপে যাওয়ার আগে সেকখনোই বুঝতে পারেনি এমন করে নিজের মনকে লক্ষ্য করা যায়।
ইতিমধ্যে রামচন্দ্র এক উপাখ্যান সৃষ্টি করেছিলো। দেশ ভাগ হওয়ার কথা শুনেই সনকা আবার প্রস্তাব তুলেছিলো নবদ্বীপে যাওয়ার। তাকে নিরস্ত করার জন্য কিছুটা মিথ্যা, খানিকটা সরস, কিছু বা নিজের কিংকর্তব্যমূঢ়তা মিলিয়ে সে বলেছিল, বুঝলা না, বউ, ধরো যে তোমার মহাভারতে ক্ষত্রিয়র ধম্ম লেখা আছে, ব্রাহ্মণের ধম্ম লেখা আছে, কিন্তু আমার ধম্ম। কই লিখছে? তাইলে আমি চাষই করবো।