নবদ্বীপ থেকে ফিরে এসে সনকা লক্ষ্য করেছিলো ভান্মতি যেন আগের তুলনায় বিষণ্ণ। সে স্থির করেছিলো জমিজমাসংক্রান্ত এবং সাংসারিক ব্যাপার, তার পিতৃবংশের আকস্মিক দুর্ভাগ্য, এ সবই তার বেদনার কারণ। আজ সকালের মতো ব্যাপার এর আগেও তার চোখে পড়েছে। ঘটনার কারণটা অনুসন্ধান করা দরকার এ তারও মনে হয়েছিলো। কিন্তু খুব সম্ভব এটা স্বামী-স্ত্রীর কোনো মান অভিমানের ব্যাপার এবং সে ক্ষেত্রে বাইরে থেকে খুব বেশি খোঁজ না নেওয়াই মঙ্গলের হবে কিনা এটাই চিন্তা করছিলো সে।
কিন্তু রামচন্দ্রকে উত্তর দিতে হবে। সনকা অবসর বুঝে ভান্মতিকে প্রশ্ন করলো। ভানুমতি প্রথমে স্তব্ধ হয়ে রইলো, তার পরে কাঁদলো। তারপর তার অন্তর্নিহিত বেদনাটা প্রকাশ করে ফেলো। চিঠিতে লিখেও যা সে কেটে দিয়েছিলো, এখন তা আর গোপন রইলো না।
রাত্রিতে সনকা ভান্মতির আশঙ্কা ও অভিমানের কথা বললো রামচন্দ্রকে। শুনে তার মনে হলো, ঘটেছে, এতদিনে চূড়ান্তটা ঘটেছে, সপ্তরথী ঘিরেছে তাকে। অহহ! ভগোমান! অহহ!
পর পর তিন-চারদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ালো সে। যেন সে একটা সমাধানের অন্বেষণ ও পশ্চাদ্ধাবন করছে। অন্তরের আত্যন্তিক জ্বালাটাকে ভান্মতি ও সনকার চোখের আড়ালে রাখবার চেষ্টায় বাড়িতে সে সহিষ্ণুতার পাহাড়ের মতো হয়ে রইলো। তারপর আকস্মিকভাবে একদিন সে অশ্রুপাত করার জন্য নির্জনতা খুঁজে বার করলো। শিবমন্দিরের সেই ভগ্নাবশেষে গিয়ে নিঃসঙ্গ দীর্ঘকাল বসে রইলো। তারপর একসময়ে মন্দিরের বাঁধানো চত্বরটায় লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদলো। এ কান্না তার জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিলো। আজকের সূত্রপাতটার জন্যই যেন সে অপেক্ষায় ছিলো। সকালে সে তার বাড়ির সীমায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছে, নবাবের এলাকায় কে একজন তার সনাঊয়ের জমিটুকুতে চাষ দিচ্ছে। এরকমটা হবে সে কল্পনা করেছিলো কিন্তু তাসত্ত্বেও দৃশ্যটা চোখে পড়ামাত্র পুরনো দিন তার অন্তরে গর্জন করে উঠতেই সে অন্যায়কারীর দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে শুকনো জোলার খাত পার হতে যাবে এমন সময়ে একজন প্রতিবেশীকে সাবধান করে দিলো–ওটানবাবের এলাকা। চাঁদকে চোখে দেখতে পেলেও সেখানে যাওয়ার কল্পনা করা যায় না, প্রিয়তমার মৃতদেহ চোখের সম্মুখে দেখেও যেমন আর কিছুই করার থাকে না তেমনি হয়েছিলো রামচন্দ্রর।
উঠেবসে গায়ের ধুলো ঝেড়ে চোখের জলে ভিজে যাওয়া গোঁফজোড়াকাপড়ে মুছেকিছুটা শান্ত হলো রামচন্দ্র। এ কী হলো পৃথিবীর! মানুষের এত কষ্ট কেন? কোনো কোনো রোগে রক্তমোণ করা নিয়ম ছিলো সেকালে। এ যেন তেমনি কোনো চিকিৎসা। কিন্তু রামচন্দ্র গোরর চিকিৎসা জানলেও নিজে কখনো কোনো পশুর রক্তমোণ করেনি। এ যেন কোনো অত্যন্ত খুঁতখুঁতে কৃষকের বোয়ার বেছন বাছাইকরা। মাটি থেকে শিকড়সুদ্ধ চারাগাছগুলিকে টেনে টেনে তুলছে। কিন্তু সে কৃষক যেন সাধারণ কৃষকের চাইতে কম জানে কিংবা অত্যন্ত বেশি জানে। চারাগুলিকে বারে বারে তুলছে আর লাগাচ্ছে, আর লাগানোর আগে চারাগুলির কোমলতম শিকড়ে যে মাটিটুকু লেগে থাকে আছড়ে আছড়ে সেটুকুও ঝেড়ে ফেলেছে। অহহ। একবার না, তিনবার। সেই দুর্ভিক্ষ, তারপর দাঙ্গা, তারপর এই দেশভাগ।
ছিদামের কথা মনে পড়লো। ছিদাম, ছিদাম। অহো, অহো। মানুষ যদি চারা হয় এমন চারা আর কে? কিন্তু তাকে আর একরকম! বছনে ফেলে ছিঁড়েই ফেলো। রামচন্দ্র এই জায়গায় ধর্ম ও সমাজবিধান নিয়ে মনে মনে আলোচনা করলো যদিও কোনো গূঢ় তত্ত্বের কাছাকাছি যেতে সে পারলো না, তার মনে হলো ছিদামকে আলিঙ্গন করে বুকে নেওয়ার মতো সমাজ হলে ভালো হতো। তারপর তার মনে হলো বুধেডাঙার সান্দারপাড়ায় জন্মালে ছিদাম কত সুখী হতে পারতো। কিন্তু তার নিজের বর্তমান সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সর্বপ্রকারে বিধিমুক্ত সান্দার-সমাজের তুলনাটা মনে আসতেই তার মনটা গুটিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরে সে সমাজকে ছেড়ে ব্যক্তিকে অবলম্বন করলো। সমাজে যা হয় তোক। ছিদাম কেন সুখী হতে পারলো না। ছিদামকে যে এই সমাজে পাঠালো তার কাছে কি এই সমাজের লোহার বাঁধন অজ্ঞাত ছিলো? হায়, হায়! সে কি লোহা যে আগুনে তাতানো লোহার বেড় তার গায়ে পরালে সে বেড়টাকে নিজের করে নিয়ে আরও শক্ত হবে?
একটা হিংসা তার মনের মধ্যে জাগতে শুরু করলো। তার ভূত-ভবিষ্যৎ ব্যাপ্ত করে সহস্র বাধা। সেই বাধাগুলিকে ধ্বংস করার জন্য একটা হিংস্রতা মনের মধ্যে গুঁড়ি মেরে চলতে লাগলো। চতুর্দিকের ঘনসন্নিবিষ্ট অরাজকতার অরণ্যে একক চলতে হবে তাকে। সান্যালমশাইরাও নেই। একা থাকতে হবে। একা যেন তাকে কোনো গড় রক্ষা করতে রেখে গেছে কেউ।
সপ্তাহকাল পরে এক দুপুরবেলায় হাতে একটা প্রকাণ্ড লাঠি নিয়ে রামচন্দ্ৰনতুন ঘরটির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।’পদ্ম আছো?
পদ্ম ঘরেই ছিলো, বেরিয়ে এসে রামচন্দ্রর দিকে এগিয়ে এলো। রামচন্দ্র লক্ষ্য করলো পদ্মর স্নান শেষ হয়েছে, চুলগুলি চূড়া করে বাঁধা, পানের রসে ঠোঁট দুটি টুকটুক করছে। পরনের ডুরি শাড়িটা একেবারে নতুন বলে মনে হয়। আর তার চোখ দুটি দেখে রামচন্দ্রর মনে হলো, যেন সে কাজলও পরেছে।
রামচন্দ্র অনুভব করলো এইবার লাঠিটা শক্ত করে ধরা দরকার। কিন্তু পদ্ম তো সত্যি সাপ নয়। সে এগিয়ে এসে নিচু হয়ে রামচন্দ্রকে প্রণাম করলো। প্রণাম করার সময়ে অনেকটা সময় পদ্মর দুখানি হাত যেন রামচন্দ্রর ধূলিভরা কর্কশ পা দুখানি স্পর্শ করে রইলো।