কী হবি, কও। কী হবি, অ্যাঁ?
.
ভক্ত কামার চলে যাওয়ার সময়ে যেমন হয়েছিলো তেমনি করে প্রতিবেশীরা আবার আসতে শুরু করলো তার কাছে।
কও, রামদাদা, কিসের লোভে তুমি থাকবা?
লোভে, না?
একদিন খবর এলো মহিম সরকারের এক জ্ঞাতির মুখে।
মুঙ্লার শশুরের জমি গেছে অন্যের দখলে। দেখছে না কারা দখলে নিছে?
হুঁ।
সানিকদিয়ারের সনাভূঁইয়ের জমি তোমার গিছে ধরে রাখবের পারো।
হুঁ।
তোমার বাড়ির দশ হাতের মধ্যে নবাবের সীমানা।
জানছি। আর কত কবা তোমরা, কও ভাই? আর্তনাদ করে উঠলো রামচন্দ্র।
কী করা?
রামচন্দ্র বাক্পটু নয়। সে উঠে গিয়ে লোকটির মুখের সম্মুখে দরজা বন্ধ করে দিলো।
বন্ধ দরজার এপারে দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে তার অত বড় শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলো। আশ্চর্য! চিকন্দিও কি থাকবে না তবে?
রাত্রিতে সনকাকে সে বললো, সব গিছে তোমার। পাঁচ বিঘে ছুঁই আছে চিকন্দির।
ফিরে আসার পরে একমাসের মধ্যে রামচন্দ্র এই প্রথম তার সঙ্গে জনান্তিকে কথা বললো। অথচ নবদ্বীপে থাকার সময়ে এমন সব রাত্রিগুলি কত কথায় রামচন্দ্র পূর্ণ করে দিতো।
তুমি যে কইছিলে নবদ্বীপে একটুক জমি পাবা?
সব যাতেছে তবু তোমার ভয় নাই! রস করো?
সনকা বললো, ভয় করবের শিখাও নাই।
সনকার কথাটা মনের মধ্যে সঞ্চারিত হলে রামচন্দ্র ঘন ঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো। সঘন নিশ্বাস নেওয়ার কথা সে শুনেছে কেষ্টদাসের মহাভারত পাঠের সময়ে। কী করবে সে, আবার সেই পাঁচ বিঘা থেকে জীবন আরম্ভ করবে?
সে ভাবতে চেষ্টা করলো। গত বছরের দাঙ্গায় দাদপুরী রাবণ আর অগ্নিকুমার, বিলমহলী এরশাদ আর লাবেন, এদিকের মুকুন্দ আর ওদিকের জয়নাল খেতে লাঙল জুড়ে নবাবদের দাঙ্গা তাড়িয়েছিলো। তেমন বর্ষা কি নামবে না? হা-হা, বর্ষা!
বাইরের দরজা বন্ধ করে সে নিজের বাড়ির ভিতরে চোখ ফিরিয়ে আনলো।
আর্থিক স্বাধীনতা মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আনবে এটা স্বাভাবিক। মুঙ্লার ব্যবহারে সেরকম কিছু দৃষ্টিকটু হয়ে দেখা না দিলেও তার কিছু আছে তাও অস্বীকার করা যায় না।
রামচন্দ্র বললো, কোনদিকে আগাই, তা ক, মুঙ্লা।
একটু ইতস্তত করে মুঙ্লা বললো, শ্বশুর লিখছে–
কী লিখছে, কবে লিখছে?
কইছে বদ্ধোমানে জমি নিছে। কইছে সকলেক সেখানে যাতি।
ভান্মতিকে নিয়ে যাবা?
গেলে তাই লাগে।কইছে আমার এখানকার জমির বলা দশ বিঘা জমি পাইছেবদ্বোমানে। এক মোসলমান এখানে আসবি। আপনেকেও লেখছে চিঠি। মুঙ্লা কোমরের কাপড় থেকে একখানা চিঠি বার করে দিলো।
রামচন্দ্র চিঠিটা নিলো, অভিমানভরে বললো, যাও তবে।
মুঙ্লা কার্যান্তরে গেলে রামচন্দ্র গোয়ালঘরে কাছে গেলে। ভাগ্যে সে কোনোদিনই চিঠি পড়তে শেখেনি। এ কি আর বানান করে ছাপার অক্ষরে মহাভারত পড়ার চেষ্টা? অবাক হয়ে সে দেখলো বলদগুলি ও গাভীটির মুখের কাছে ঘাস নেই। গাভীটি রামচন্দ্রর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গভীর সুরে একটা চাপা শব্দ করলো। কিছু খড় পেড়ে বলদগুলি এবং গাভীটার সম্মুখে দিয়ে রামচন্দ্র লাঙলগুলির খোঁজ করলো। পাশাপাশি দুখানা থাকবার কথা। রামচন্দ্র লক্ষ্য করে দেখলো একখানার লোহার রং তখনো ওঠেনি, অপরখানায় মরচে ধরেছে। তখন তখনই এক টুকরো হঁট খুঁজে নিয়ে লাঙলের ফলা দুটি এক এক করে ঘষতে বসে গেলো। আধ ঘণ্টা চেষ্টার পর সে যখন উঠে দাঁড়ালো ফলাগুলি তখন অনেকটা উজ্জ্বল হয়েছে, কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে মাটির ঘর্ষণে যেমন রুপোয় পরিবর্তিত হওয়ার মতো ব্যাপারটা হয় তেমনটা অবশ্যই হলো না।
মুঙ্লার মন বন্ধোমানে গেছে এই তিক্ত চিন্তাটিকে গলাধঃকরণ করার মতো মুখ নিয়ে সে বাড়ির ভিতরে এসে বললো, ভানুমতি, তোমরা চাষবাস করো নাই, না?
সনকা বেরিয়ে এসে বললো, ভানু কি বলবি? ছাওয়ালেক জিজ্ঞাসা করো।
রামচন্দ্র কাচুমাচু মুখ করে তামাক সাজতে বসলো।
সারাদিন ছটফট করে বেড়ালো সে, সারাটা রাত জেগে কাটালো।
পরদিন সকালে, সকাল তখনো হয়নি, কিছু রাত আছে, রামচন্দ্র হাঁক দিলো, মুঙ্লা, মুঙ্লা!
হাঁকাহাঁকি শুনে সনকা ভীতস্বরে বললো, কী হইছে?
কনে তোমার ছাওয়াল? রামচন্দ্র গর্জন করে উঠলো।
ঘুমায়। কী করবি? কাম কই?
কী করবি, না? কাম নাই, না?
মুঙ্লা চোখ ডলতে ডলতে উঠে এলো।
তুমি আমার জামাই, না ছাওয়াল?
তিরস্কারে মুঙ্লার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো।
লাঙল জোড়ো। দুই লাঙল চাই।নবাবের দেশে চাষ পড়ে, তোমাগের দেশে চাষ হবিনে? কে? সময় যায়, না আসে?
কিন্তু গভীরতর কিছু অপেক্ষা করছিলো রামচন্দ্রর জন্য।
আগের দিন দু-এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভোররাতে মাটিতে পা দিয়ে রামচন্দ্র বললো, মুঙ্লাক তুলে দেও।
সনকা বললো, অনেক রাতে আসছে।
কে, কোথায় গিছিলো?
সনকা কিছু বললো না। রামচন্দ্র বাড়ির দিকের দাওয়ায় পা দিয়ে দেখলো প্রায়-অন্ধকার বারান্দায় কে একজন শুয়ে আছে।
কে?
ভানুমতি ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরে চলে গেলো।
রামচন্দ্রর খটকা লাগলো। কুয়োতলায় হাত-মুখ ধুতে ধুতে সে প্রশ্ন করলো সনকাকে, বউ বাইরে কে?
মনে হলো সনকা কিছু বলবে কিন্তু এবারেও সে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
রামচন্দ্র ক্ষিপ্তর মতো গর্জন করে উঠলো, কে, এটা কার বাড়ি? এ কোথায় আলাম?
সনকা বিপদ বুঝে ফিরে এলো। রামচন্দ্রর এরকম ক্রোধ সে এর আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারলো না। স্বরটা যথাসম্ভব নিচু করে সে বললো, এখন যদি জমিতে যাবা যাও। পরে সব কবো।