রামচন্দ্র আবার বললো, না গেলি হয় না?
পরে আর যাওয়া যাবি নে! জামাই তাই লিখছে।
নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে রামচন্দ্র বললো, মিয়েক দেখে যাবেন না, কাকা?
আবার নীরবতা। মহিমের দিকবিখ্যাত জোয়ান ছেলেরা পটুহাতে গোরুগাড়ি বোঝাই করছে। তাদের জোয়ান কিংবা পটু দেখাচ্ছে না। বাড়ির ভিতরে একটা চাপা কান্নার শব্দ উঠছে।
রামচন্দ্র নিজের বাড়িতে ফিরে চললো। তার চিরবিশ্বস্ত পা দুখানা যেন মোমের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। প্রথমেই তার মনে হলো, সে যে কত বড়ো বোকা এতদিনে তা প্রতিপন্ন হলো। এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটছে এবং ঘটে গেছে এ সম্বন্ধে সে একেবারে অজ্ঞ। দূরে দূরে ছিলো বলেই কি এমন হলো। ঘটনাটা সে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করতে চায়, সংবাদটা সম্বন্ধে সে অত্যন্ত বিমুখ বলেই কি সে এমন চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতায় নিশ্চিন্ত হয়ে আছে? আর মহিমের গোরুর গাড়ির বহর যখন সানিকদিয়ার চিকন্দির উপর দিয়ে দিঘার দিকে যাত্রা করবে পথের দু-পাশের লোকগুলির মনের অবস্থা কি হবে? আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের সেই ছুটোছুটির মধ্যে বুদ্ধি আবর্তে পড়ে মার খাবে। ঝড়ের মুখে নৌকো বাঁচে না।
রামচন্দ্র বাড়িতে পৌঁছে মুঙ্লাকে খবর দিলো তার শ্বশুর আসছে সপরিবারে। ভান্মতি বললো, হঠাৎ যে?
রামচন্দ্র এই সামান্য প্রশ্নটার উত্তর দিতে গিয়ে আকাশ-পাতাল অন্বেষণ করে গোঁফ চুমরে মাটির দিকে দৃষ্টি আনত করে বললো, তীখ করতে যাবি।
ভান্মতি ফোঁপানি গোপন করতে সরে গেলো।
মহিম সরকার তার গোরুর গাড়ির বহর নিয়ে এসেছিলো। একদিন একরাত রামচন্দ্র তার বেহাইকে সপরিবারে ধরে রাখলো। দ্বিতীয় দিন সকালে গাড়ির বহর নিয়ে মহিম সরকার রওনা হলো। ভাৰ্মতি কাঁদলো, সনকার চোখে জল এলো, রামচন্দ্র তার হুঁকো হাতে ঘর-বার করলো। কথাটাও গোপন রইলো না। তার পাড়ার লোকরা বলাবলি করলো, নতুন নবাব এসেই মহিম সরকারকে তাড়িয়েছে।
এরপর রামচন্দ্র সঠিক সংবাদ সংগ্রহের চেষ্টায় ছুটোছুটি শুরু করলো। একটি বিষয়ে সে কৃতনিশ্চয় হয়েছে : এদিকে এক রাজা আর ওদিকে এক নবাব। দেশ ভাগ হয়েছে। দুই নাম হয়েছে, একই ফলের দুটি টুকরোর।
একজন বললো একদিন, শুনছেন, মণ্ডল, হাজির বেটা ছমির খোনকার রায়দের ভিটা দখল নিছে?
কেন, তা নেয় কেন? রামচন্দ্র আশ্চর্য হয়ে গেলো। এটাই কি এখন থেকে কী ঘটবে তার উদাহরণ? কে দিলো তাকে দখল?
কিন্তু ঠিক কোথায় কতদূরে সেই রাজসিক সীমারেখা, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর তাকেও কি দেশ ছেড়ে যেতে হবে? ইতিমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। যে-অবস্থায় সে বসেছিলো তেমনি অবস্থাতেই সে ছুটলো সান্যাল-কাছারির দিকে। ইতিমধ্যে দু-একজন প্রতিবেশী বলেছে বটে, গড়-চিকন্দিতে সান্যালরাই রাজা থাকবে। এখানে কোনো নবাবের অনুপ্রবেশ হবে না। তাহলেও বিষয়টি নির্ণীত হওয়া প্রয়োজন।
রামচন্দ্র কাছারিতে প্রবেশ করলো দুঃসময়ে। কাছারির অর্ধেক দরজা বন্ধ। সান্যালমশাইয়ের। খাস কামরার দরজায় মস্তবড়ো একটা তালা ঝুলছে। কাছারিতে দাঁড়িয়ে অন্দরমহলের দোতলার যে জানালাগুলি চোখে পড়ে সেগুলিও বন্ধ। দুপুরের মতো তাজা রোদে এটা ঘুমের দৃশ্য হতে পারে না। এতক্ষণে অন্তত একজন বরকন্দাজেরও দেখা পাওয়া উচিত ছিলো। বরকন্দাজ এলো না। আমলারা কোথায়? প্রজারা? সব শুসান্ দিগরের গোরস্থান!নায়েব নিজেই বেরিয়ে এলো কাছারির একটি ঘর থেকে। নায়েবের হাতে হুঁকো, সে যেন বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছে। রামচন্দ্রর। মনে হলো মুঙ্লা নায়েবের সঙ্গে যে কলহ করেছে সেটা মিটিয়ে ফেলা উচিত, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটাকে মূল্যহীন বোধ হলো।
নায়েব বললো, তুমিও বুঝি সেই খবরটাই চাও? অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছে।
কী খবর?
খবরটা সত্যি। কর্তা আর গিন্নি চলে গেছেন দেশভ্রমণে।
রামচন্দ্র এত বড়ো নির্দয় সংবাদ আশা করেনি। অভিভূতের মতো সে বললো, ছাওয়ালরা?
তার আগেই গেছে। দেশ ভাগের কথা শুনলে, রামচন্দ্র?
রামচন্দ্রর মনে হলো দুঃস্বপ্নের মধ্যে কেউ তার বুকে চেপে বসেছে।
কিছুক্ষণ পরে নায়েব বললো, চৌহুদ্দিটা ঠিক কী হলো বুঝতে পারছি না।
রামচন্দ্র অর্থহীন ভাবে ‘আজ্ঞা’ শব্দটা উচ্চারণ করে উঠে দাঁড়ালো। চৈতন্য সাহা, মিহির সান্যাল কিংবা রেবতী চক্রবর্তীর কাছে সে নিজে থেকে কখনো যায় না। কিন্তু এই দুঃসময়ে প্রত্যেকের সাহায্য অন্য সকলের দরকার হয়ে পড়তে পারে।
রেবতী চক্রবর্তী গিয়েছে তার মেয়ের বাড়িতে, কৃষ্ণনগরে, সপরিবারেই। মিহির সান্যাল আপাতত সদরে বাসা ভাড়া করে আছে, সেখানে কালেকটারের অফিস কাছে, হিন্দুদের সংখ্যার কিছু জোর আছে। অবাক হয়ে গেলো রামচন্দ্র–এসব কী কথা?
রামচন্দ্র লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। অভ্যস্ত মুদ্রাদোষের ফলে তার একখানা হাত বারংবার গোঁফটাকে স্পর্শ করছে যদিও শূন্য আকাশের দিকে লক্ষ্য করতে গিয়ে তার মুখখানা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। এ কী হলো, কও?
কথাটা আকস্মিকভাবে একটা যুক্তির আকার নিয়ে মনে ফিরে এলো তার।কাঁচা কাজ কখনো সে করেনি। তার জমির প্রতিটি হাত, প্রতিটি আঙুল কাগজে লেখা, রেজিস্ট্রি করা। তার কি কিছুই মূল্য নেই?
পথে চলতে চলতে তার মনে হলো, এর আগে এদেশে নবাবের রাজত্ব ছিলো, তখন কি মানুষ চাষবাস করে নাই?