হয়। তুমি ইজু না? ভালো?
হয়।
কয়েক পা এগিয়ে রামচন্দ্ররা দেখতে পেলো একটি স্ত্রীলোক পথের ধারে দাঁড়িয়ে শুকনো বাঁশ কঞ্চি কেটে কেটে ছোটো করছে।
সনকা রামচন্দ্রকে চুপিচুপি জিজ্ঞাসা করলো, এমন সুন্দর মিয়ে কার?
রামচন্দ্র এবার হাসিমুখে জবাব দিলো, কার মিয়ে সুন্দর হলে তা বাপেরা টের পায় না। তা এটা রজব আলির বাড়ি। তার এক ভাইয়ের বিটি সুন্দর হইছে, শুনছি।
এই জায়গাটা পরিচিত লাগছে না? রামচন্দ্র অনুভব করলো, এখানেই তো বিলমহলের এরশাদ, জসিমুদ্দিন, লাকেন, চিকন্দির সীমানায়। এর পরেই দাদপুরী কৈবর্তদের রাবণ, অগ্নিকুমার, মুকুন্দ, চিকন্দিতে পা দিলেই। একেকজনা শয়ে শয়ে মানুষ। আমু আর এরশাদ দাঁড়ালি কয় শ’ হয়? সে ফোপাতে লাগলো।
পৌঁছে যাওয়ার স্বস্তিটা অনুভব করতে লাগলো রামচন্দ্র।
তারা যখন নিজের বাড়ির সম্মুখে এসে পৌঁছলো তখন বেলা হয়েছে। কিন্তু তখনো বাড়ির ভিতরে যাওয়ার সব দরজা বন্ধ। এরকম হওয়া উচিত নয়। রামচন্দ্রর মনে আবার নানা অমঙ্গল চিন্তা ভিড় করে এলো। কিন্তু সনকা তাকে বাইরের বারান্দায় অপেক্ষা করতে বলে ঘরের পাশ দিয়ে গিয়ে অন্দরে যাওয়ার আগড়টা খুলে দিলো।
ভানুমতি বাড়ির মধ্যে কাজ করছিলো। সে আশা করতে পারেনি প্রায় একমাস আগে যে চিঠি দিয়েছিলো সে তার এত শক্তি হবে যে রামচন্দ্রকে টেনে আনতে পারবে। শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে সে কথা খুঁজে পেলো না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলো।
কী হইছে? কাঁদিস কেন? থির হ, সবই শোনবো’ রামচন্দ্র এবংসনকা দুজনে কথা মিলিয়ে মিলিয়ে সান্ত্বনা দিলো।
মুঙ্লা কনে? এত বেলায় ঘুমায় নাকি?
ভানুমতি বললো, অনেক রাত্তিরে ফিরছে।
হুঁ। আচ্ছা, সে সবই আমি দেখবো। তামাক সাজে আন।
তামাক খেতে খেতে হৃষ্ট হলো রামচন্দ্র। সে স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললো, জীবকালে আর নড়তেছি না, তা কয়ে দিলাম।
দুপুরে দিবানিদ্রা শেষ করে আবার তামাক নিয়ে বসে রামচন্দ্র সংসারে প্রবেশ করবে স্থির করলো। কিন্তু তখন মুঙ্লার সঙ্গে জনান্তিকে কথা বলার সুযোগ হলো না তার। কয়েকজন প্রতিবেশী এলো। আলাপ-আলোচনার ধারাটা তখনকার মতো রামচন্দ্রর তীর্থবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো। শুধু তাদের একজন দুজন প্রশ্নের আকারে উত্থাপন করলো কথাটা, তুমি তো বিদেশে গিছলে, কী শুনে আলে? দেশ নাকি ভাগ হতেছে?
বুঝি না। কোনকার কোন দুই রাজা যুদ্ধ বাধালো একবার, ধান না পায়ে উজাড় হলাম। কনে কোন শহরে দুইজনে বাধালো কাজিয়া, খেত-খামারের কাজ বন্ধ করলাম। আবার দ্যাখো কন থিকে কোন দুই জন আসে দেশ ভাগ করতিছে।
ভাগ নাকি হয়ে গেছে। একজন বললো।
তাইলে জানতাম। অপর একজন বললো।
জানবা কী করে সীমানায় খাল কাটবি, না, বেড়া দিবি?
কিছু একটা তো করবি?
তারা চলে গেলে রামচন্দ্র মুঙ্লাকে ডাকলো।
মুঙ্লা এসে বলল, কেন, বাবা, দিঘায় শুনে আলাম দেশ নাকি ভাগ-বণ্টক হবি?
তা যাক। দেশ কি তোমার না আমার? তুমি কি নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া কাজিয়া করছো?
মুঙ্লা অপরাধীর মতো মুখ নিচু করলো।
তাইলে ঝগড়া করছে। তা করলা কেন্?
ছিদামের জমি নিয়ে গোল। কেষ্টদাস কাকার কোন কুটুম দাদপুর থিকে উঠে আসছে। আসে ছিদামের ঘরবাড়ি দখল নিছে। নায়েবেক কয়ে জায়গাজমি নিজের নামে লিখাতেছে।
কে, তা করে কে?
কয়, চারদিকে গোল, চিকন্দিতে নিশ্চিন্দি।
নিচ্চায়। তার বাদে?
পদ্মক তাড়ায়ে দিছে।
হুম।
পদ্ম কাঁদে আসে কলো-আমি এখন কনে যাই?
হুম। আগো।
নায়েবেক কলাম-পদ্ম আছে থাক, খাজনা তার কাছে নেন, বাইরের লোক আনে লাভ অলাভ কী? কয় যে-মিয়েছেলে জমি-বা চবি কী, খাজনাবা দিবি কী?
ন্যায্য। তার পাছে?
কলাম–আমি জামিন থাকবো।
মণ্ডলের বেটা মণ্ডল হইছে, কেন্?
নায়েব শোনে নাই, পদ্মক উঠায়ে দিছে। কেষ্টদাস কাকার বাড়িতে তার কুটুমরা বসছে। পদ্ম মোহান্তর এক ভিটায় বসছে ঘর তুলে। তা, কোটে যায়ে মামলা করবো তা শাসাইছি নায়েবেক।
যা করছে, করছে। কোটে যাওয়া কাম নি। দেখতেছি। বললো রামচন্দ্র।
ভান্মতি শক্ত মেয়ে, রামচন্দ্র ফিরে আসায় সে নিজেকে বলিষ্ঠতর বোধ করছে। তার চিঠিতে যে কয়েকটি কথা সে লিপিবদ্ধ করেও কেটে দিয়েছিলো, সেগুলির সে পুনরুত্থাপন করলো না।
দু-চারদিন নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে গেলো। তারপর অতিক্রুদ্ধ আকাশে যেমন মেঘগুলি ধীরে ধীরে পাকাতে শুরু করে, সেই আকাশের তলে থমথমে পদ্মার মনোভাব বোঝা যায় না, বালি ওড়ে আর বালির পাড়ে আলকাতরা রঙের ছোটো ছোটো ঢেউ আছড়ে পড়ে, তেমনি করেই সংবাদটা আত্মপ্রকাশ করতে লাগলো।
একদিন সকালে রামচন্দ্র সানিকদিয়ারে গিয়েছিলো তার বেহাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। দৃশ্যটা দেখে তার সরসতা শুকিয়ে গেলো, প্রাণ আই ঢাই করতে লাগলো, কথা জুয়ালো না।
তীর্থভ্রমণ নয়, দেশ-পর্যটন নয়, শ্মশান-যাত্রা। রামচন্দ্র ব্যাপারটা অনুমান করে নিতে পারলো। এবং অনুমান করে সে মহিমের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
কাকা, এ কী দেখি?
রাম রে, তুমি আসছো? কও, এ কী হলো? এ কোন পাপ?
কিন্তুক যাবেন কে?
পাঁচ-ছটি গোরুগাড়িতে মহিমের পরিবারের সকলের অস্থাবর সম্পত্তি ধরবে কিন্তু তার স্থাবর সম্পত্তির এতটুকুও তার সঙ্গে যাবে না।