কিন্তু রামচন্দ্র বাজারে গেলো না। সে পায়চারি করতে লাগলো; কেষ্টদাস আসবে বলেছিলো, তার প্রতীক্ষাতেও দু-একবার রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। কেষ্টদাস এলো না।
রাত্রিতে রামচন্দ্র বললো, সনকা, গাঁয়ে যাওয়া লাগে।
কিও কী? আবার সেখানে কেন? জমিজিরাত সব অন্যেক দিয়ে দিছো।
সে সব নষ্ট হয় যে।
তোমার কী লোকসান?
রামচন্দ্র যুক্তিটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। সেই অবসরে সনকাও চিন্তা করলো। রামচন্দ্রকে তার জমিজিরাত এবং মণ্ডলী থেকে পৃথক করে নিলেও যে তার এতকিছু অবশিষ্ট থাকে এ সে কোনোদিন কল্পনা করতে পারেনি। সেজন্য যৌবনেও ধানে এবং ধুলোতে জড়ানো যে রামচন্দ্রকে সে পেয়েছিলো তার চাইতে ঐকান্তিক কিছু পাওয়ার তৃষ্ণা তার ছিলো না, কিন্তু এই প্রৌঢ়ত্বে এসে সে দুদিনে যা পেয়েছে তার লোভ জমিজমা সংসারের চাইতে অনেক শক্তিশালী। কিন্তু মুঙ্লার মুখটাও মনে পড়ে গেলো সনকার। ভাৰ্মতি রান্নাবান্না করতে পারে বটে কিন্তু তাহলেও হয়তো মুঙ্লা সময়মতো আহার্য পায় না। আর, নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া লেগেছে। নায়েবরা অত্যন্ত নির্দয় হয়। যদি সে মুঙ্লাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধোর করে!
নিজের হক রাখবে যোল আনা,নায়েব জমিদারও খাতির করে, সেই মণ্ডলী বুদ্ধি ছেলেমানুষ মুঙ্লা কোথায় পাবে?
সনকা অস্বস্তিতে বিছানায় উঠে বসলো।
রামচন্দ্র বললো, উঠলা যে?
এখন কী করা, তাই কও। রামচন্দ্রর প্রশ্নটা সনকার মুখে।
কী করবা? যা দিয়ে দিছি তাতে আর লোভ কেন্? রামচন্দ্র সনকার যুক্তিটায় ফিরে এলো।
লোভ না হয় না করলা। কিন্তু মুঙ্লা গান বাঁধে নায়েবের সঙ্গে ঝগড়া করে, এ কী কথা, কও?
রামচন্দ্রও বললো, লোভ না হয় না করলাম। কিন্তুক এ জীবনে যা করলাম তা যদি ছিটায়ে ছড়ায়ে যায়, কষ্ট হওয়া লাগে কি না-লাগে?
‘তা তোমার হউক না হউক। আমার ছাওয়াল-মিয়ে সেখানে, আর তুমি এখানে পলায়ে থাকবা!
পরদিন সকালে রামচন্দ্র ঘরের মেঝে খুঁড়ে সরা-ঢাকা একটা মাটির হাঁড়ি বার করলো। তা থেকে বার্লির ছবি আঁকা টিনের কৌটো বেরুলো। আপদ-বিপদে সম্বল দেড় কুড়ি টাকা। সনকা রান্নার ফাঁকে ফাঁকে উঠে এলো হিসাবের ব্যাপারে সাহায্য করতে। সে একবার বলে গেলো, বাড়িভাড়া তিন টাকা দিতে হবে; আর একবার এসে বললো, মুঙ্লার জন্য একটা ছিটের জামা আর ভান্মতির জন্য শাখার চুড়ি কিনতে হবে।
আহার শেষ করেই রামচন্দ্র বললো, কেষ্টদাস গোঁসাই আজ ঠিকই আসবি, তার আগে বারায়ে পড়ি চলো।
কেন্? তাক নিলে কেনাকাটার সুবিধা হতো।
কিন্তুক সে কবি, কবি এমন কথা নাই, যদি কয় কিছু?
তা পারে।
কেষ্টদাসের চোখে পড়তে না হয় এমন সব ঘোরাপথ ধরে রামচন্দ্র তার সামান্য কেনাকাটার ব্যাপার শেষ করলো। তারপর বাড়িওয়ালাকে ভাড়ার টাকা কটা পৌঁছে দিয়ে সনকার হাত ধরে গ্রামমুখো হলো। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার হয়েছে। পুণ্যাত্মা কেষ্টদাস আজকাল রাত্রিতে অত্যন্ত কম দেখে। পথে দেখা হলেও পাশ কাটিয়ে পালানো যাবে।
খেয়া নৌকায় বসে রামচন্দ্র সখেদে বললো, গোঁসাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আলাম না।
.
রামচন্দ্র সস্ত্রীক ট্রেনে চলেছে। গাড়িতে ভিড়। এত ভিড় ক্যান, কোথা যাতিছে এত্ত মানুষ? দুটি বেঞ্চের তলায় কোনোরকমে মালপত্র রেখে যাত্রীদের পায়ের কাছে কোনোরকমে সনকার বসবার জায়গা করে দিয়ে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তার বোকা-বোকা মুখে ও সন্ত্রস্ত চোখ দুটিতে তার মনের ভূত-ভবিষ্যৎ পরিব্যাপ্তঝড়ের কোনো চিহ্ন ফুটলেও কারো চোখে পড়ছেনা। কিংবা কারই বা দৃষ্টি আছে তখন অন্য কাউকে লক্ষ্য করার?
বন্দর দিঘার স্টেশন যেন ঠাণ্ডা হিম। শেষরাত্রির এই গাড়িটা থেকে নেমে নিদ্রাবঞ্চিত যাত্রীরা সোরগোল করলো না। তারা যেন এখানে আসতে চায়নি, কী করে এলো তাও বুঝতে পারছে না। ফিরিওয়ালারা ঘুমিয়ে রইলো। দু-একজন কুলি ঘুমের ঘোরে কুলি’বলে মৃদুস্বরে ডাকাডাকি করলো। আগের দিন প্রায় এরকম সময়েই পাশের প্ল্যাটফর্ম থেকে অনেক লোকজনের সোরগগালের মধ্যে পাশাপাশি সাজানো কয়েকখানা রিজার্ভ কামরায় সান্যালমশাই যাত্রা করেছেন। সে খবর অবশ্য রামচন্দ্রকে কেউ দিলো না।
রামচন্দ্রর বরং ভয় করে উঠলো। ভোর হওয়ার আগের মুহূর্তের ধূসর রঙের আকাশ আর কালচে নীল পৃথিবী মিলিয়ে যেন এক সুরঙ্গপথ তার সামনে। এরকম যেন সেই জীবনে এই প্রথম দেখছে।
সনকা বললো, এখনই যাবা?
রামচন্দ্র তার ঝোলাগুলোকে কাঁধে তুলে বুক চিতিয়ে বললো, মনে হয়, একটু সাহস করা লাগবি।
রূপপুরের কাছাকাছি যখন, মানুষ চেনা যায় কি যায় না। পথের ধারে দাঁড়িয়ে একজন বললো, চিকন্দির মণ্ড না? আলেন? সগলে যায়! রামচন্দ্র গোঁফে হাত রাখলো। সনকা জিজ্ঞাসা করলো, কী কয়? বোঝাটা ভার বোধ হওয়ায় রামচন্দ্র কাঁধ বদলে নিলো, বললো, চলো।
রামচন্দ্ররা যখন বুধেডাঙার কাছাকাছি পৌঁছলো তখন প্রভাত হচ্ছে। দিগন্তের কাছে পদ্মার খানিকটায় যেন আলতা গোলা, সেই আলতা ক্রমশ কঠিনের রূপ নিয়ে গোল হয়ে উঠছে।
সনকা বললো, ভোর হতিছে।
কিন্তু খেতে লোক নাই কেন্?
তুমি বাদে সকলেই জানে খেত মাটি, দু দণ্ড পরে গেলে পলায় না, রাগও করে না।
বুধেভাঙার ঘুম ভাঙছিলো। অল্পবয়সী কেউ একজন একপাল হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে পদ্মার দিকে যাচ্ছে দেখতে পাওয়া গেলো। সে রামচন্দ্রকে দেখতে পেয়ে পথের উপরে দাঁড়ালো। ছিদামের জ্যাঠা না? আসলেন?