তা তো আসছেই। কিন্তু এখানে থাকবা কনে, খাবা কী?
করণ কী? দ্যাশ যে আমাগোর না। বাগ অইছে।
এখানে জমি চষবা? রামচন্দ্র হাসলো মনে মনে। দেখো কাণ্ড! পৃথিমি কি সানিকদিয়ার জোলা, বাঁধ দিয়ে জমিভাগ করবা?
কই পামু?
জঙ্গল কাটবা? আচ্ছা, যদি জমিত লাঙল দেই, তোমাক ডাকবো।
বাসায় ফিরে রামচন্দ্রর দুর্ভাবনার অন্ত রইলো না। সাবধানী মনে অমঙ্গলের আশঙ্কা সাধারণের চাইতে বেশি আসে। তার মনে এমন কথাও উঠলো-আঁ, তাই নাকি? মুঙ্লারাও এমন কোনো জঙ্গলের ধারে এমন বোকা বোকা মুখ করে বসে আছে নাকি? শিবো, শিবো!
কেষ্টদাসকে রামচন্দ্র তার দুঃস্বপ্নের কথা বললো। এখন কেষ্টদাস যে-কোনো পরিস্থিতির লাগসই গল্প পুরাণাদি থেকে উদ্ধার করে কিংবা নিজেও কখনো কখনো তৈরি করে বলতে পারে। ঘটনাটা এবং রামচন্দ্রর আশঙ্কার কথা শুনে সে বললো, লোভে আপনেক বিভীষণ দেখাইছে।
হতে পারে, অসম্ভব কী! লোভের মতো এত কঠিন নেশা আর কীসের হয়। রাগ বলল, হিংসা বলল, তার তবু কিছু নিবৃত্তি আছে। লোভের শেষ নেই, সারা দিনরাতে এক মুহূর্ত সে নেশা কাটে না। ঘুমে রাগ দূর হয়, লোভ তখনো বিকৃত মুখে ভয় দেখাতে থাকে।
একদিন তার পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে রামচন্দ্র শুনতে পেলো একজন খাকি-পোশাক-পরা লোক তার খোঁজ করছে। পুলিস নাকি? রামচন্দ্র কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরখানিতে গিয়ে ঢুকলো। সনকাকে বললো, কও তো, এ বিপদ আবার কন থিকে আসে?
লোকটি পুলিসনয়। ডাকঘর থেকে এসে চিঠি বিলি করে বেড়ায়। সে যখন রামচন্দ্রর দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো চিঠি আছে, চার আনা পয়সা লাগবে’তখন রামচন্দ্র সদ্য-বিপদমুক্তির স্বস্তিতে বললো, চার আনা এই চিঠির দাম, আর এই চার আনা নেন পান খাবেন।
লোকটি চিঠি রেখে চলে গেলে রামচন্দ্র কিছুক্ষণ সেটা হাতে নিয়ে বসে রইলো। একখানা বড়ো কাগজ চৌকোণা করে ভাঁজ করা, তার উপরে বড়ো বড়ো বাঁকাচোরা অক্ষরে ভুসো কালিতে বোধহয় ঠিকানা লেখা। রামচন্দ্র উল্টে-পাল্টে দেখলো টিকিট নেই কিন্তু ডাকঘরের অনেক ছাপ পড়েছে।
সনকা বললো, কে লিখছে চিঠি?
কে লিখবি কও? যদি লেখে তো সেই মুঙ্লারাই লিখছে।
এখানে একটু থিতু হয়ে বসেই সে মুঙ্লাকে চিঠি লিখিয়েছিলো, সগগে আছি। আমার জন্যি ভাববা না।
দুপুরে আহারাদির পর সনকাকে সঙ্গে করে দরজায় তালা এঁটে রামচন্দ্র বার হলো কেষ্টদাসের সন্ধানে। কেষ্টদাসকে পাওয়া গেলে তাদের আখড়ার গাছতলায়। কেষ্টদাস বললো, বসেন।
রামচন্দ্রর স্ত্রী গাছটার পিছন দিকে আড়ালে বসলো। রামচন্দ্র কেষ্টদাসের সম্মুখে বসে বললো, একখান চিঠি আসছে, পড়া লাগে।
ভান্মতি চিঠি লিখেছে। বর্ণাশুদ্ধি, ব্যাকরণ ভুল তো বটেই, হস্তাক্ষরও অনেক জায়গায় দুপাঠ্য। কেষ্টদাস পড়লো :
বাবা মা আমার পোনাম লইবেন। আমি আপনাদের বউ ভানুমতি লিখতেছি। পরে সমাচার এই চাষবাসের অবস্থা ভালো না। সানিকদিয়ারে এক নুতোন রাজা হইছে তার। ভয়ে সেথাকার হিন্দুরা পালাইতেছে। চিকোনদিহিতে নাকি আর এক রাজা, তার ভয়ে মোছলমানরা পলাবি। আর লিখি আপনাদের ছেলে চাষবাসে মন দেয় না। নায়েবের সাথে ঝগড়া করিয়াছে। সনধায় খোলকরতাল লইয়া গান করে। গোঁসাইয়ের বাড়িতে কোথা হইতে তার তিন-চারজন আপ্তজন আসিয়াছে তারা পদ্দকে তাড়াইয়া দিয়াছে। আপনারা কবে আসিবেন। আসা লাগে। ইতি।
চিঠিটায় আরও কিছু লেখা ছিলো। প্রথমে লিখলেও ভান্মতি পরে সেগুলি কেটে দিয়েছে। কেষ্টদাস অল্প চেষ্টাতেই সেই অস্পষ্ট এবং গোপন করা বক্তব্যটা ধরতে পারলো। সে লিখেছিলো, পদ্ম সাপের পাকের মতো জড়িয়ে ফেলেছে সংসারটাকে। সারা দিনরাতে মুঙ্লা পদ্মর সঙ্গে পাঁচ বার দেখা করতে যায়, ভান্মতির সঙ্গে দুটো কথা বলে কিনা সন্দেহ।
চিঠি পড়া শেষ করে সেটাকে রামচন্দ্রর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে কেষ্টদাস মাটির দিকে চেয়ে রইলো। তার গুরুর আদেশ, খুব রাগের সময়ে মাটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকবে। এটা রাগের ব্যাপার নয়। মনের চারিদিকে ধুলোমাটির হোক, গঙ্গামাটির হোক, একটা স্তর পড়েছে, কিন্তু তার উপরেও পদ্মর সম্বন্ধে ভানুমতির বক্তব্যগুলি আর রাখা যাচ্ছে না। মনের আবরণ পুড়তে পুড়তে কাঁচা মাংসে যেন তাপ লাগছে। মাটির দিকে চেয়ে থেকে তার মনে হলো এ অবস্থায় কী করা যায় গুরু বলে দেয়নি। সেজন্যই বোধহয় গুরুকে স্মরণ করেও কেষ্টদাস কিছুতেই আর নিজেকে স্থির রাখতে পারছেনা। মনের উপর থেকে অঙ্গারটিকে বাইরে নিক্ষেপ না করলেই যেন নয়।
কেষ্টদাস বললো, মণ্ডল, বাড়িতে যান। আমি পারি বৈকালে যাবে। এখন শরীলটা কাহিল লাগতেছে, একটুক শোবো।
চিঠিটা হাতে নিয়ে রামচন্দ্ররা নিজের বাসায় ফিরে এলো। ভানুমতির চিঠিতে লুকিয়ে রাখা হাহাকারে শুধু কেষ্টদাসের রোগজীর্ণ বুকের দেয়াল যেন ভেঙে পড়ার মতো হলো।
রামচন্দ্র তার স্ত্রীকে পথেই একবার প্রশ্ন করলো, কও, সনকা, কও; তুমি কও আমার কী করা এখন?
কী আর করবা। ভান্মতিক চিঠি লেখো ভয় না করে। তার বাপেক লেখো দেখাশুনা করবের।
তখনকার মতো নির্লিপ্তের ভঙ্গিতে তামাক সাজতে বসলো রামচন্দ্র। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই সে প্রশ্নটায় ফিরে এলো। এখন কী করা?
সনকা আমল দিলো না। সে বললো, একটু বাজারে যাবা? দু-চার পয়সার আনাজ আনা নাগতো।