কিছুক্ষণ পরে সে চারিদিকের লোকজনদের লক্ষ্য করলো। পিছনে তার স্ত্রী সনকা এবং কেষ্টদাস আসছিলো। চারিপাশের অন্য অনেক লোককে যেমন, কেষ্টদাস ও সনকাকেও তেমনি অত্যন্ত দুর্বল বলে মনে হলো তার। ওদের বুকের পদ্ম স্বভাবতই তার নিজের পদ্মটির তুলনায় স্বল্পপরিসর হবে। কেষ্টদাসের বুকের পদ্মটি দুর্গাপূজার জন্য বহুদূর থেকে তুলে আনা পদ্মকলির মতো হয়তোবা শুকিয়ে গেছে।
বাসায় ফেরার পর বহুক্ষণ ধরে একটা অব্যক্ত আনন্দ তার মনের মধ্যে ঘোরাফেরা করলো। নিচু গলায়, তার দরাজ গলা যতদূর নিচু করা সম্ভব, কয়েক মিনিট সে নামকীর্তন করলো। কিন্তু তাতেও যেন তার অনুভবটার প্রকাশ হলো না। সনকাকে কাছে ডেকে নিয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। সনকাকে যেন বিষাদ-মলিন দেখাচ্ছে, আর সেই বিষাদ গাঢ়তর তার ঠোঁটের কোণ দুটিতে। বিস্মৃতপ্রায় অতীতের বিহ্বল দিনগুলিতে সনকার অভিমান বেদনা দূর করার জন্য যা করতো তেমনি করে সনকাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে যেন নিজের স্বাস্থ্যের সৌরভে তাকে পরিপূর্ণ করে দেওয়ার জন্যই তার ওষ্ঠাধরে নিজের ওষ্ঠাধর স্পর্শ করালো।
.
অন্য আর একটি বিষয় হচ্ছে শোক। এখানেও শোকের রাজ্যপাট। তবু মন্দিরে ঘুরে দেবমূর্তিগুলিকে অনুভব করে রামচন্দ্রর মনে হলো কিছুই হারায় না।
সে ইতিমধ্যে স্থির করে ফেলেছে বাকি জীবনটা এমনি করেই কাটিয়ে দেবে। একটিমাত্র প্রতিবন্ধক আছে সে-পথে, সেটা হচ্ছে উপজীবিকা সম্বন্ধীয়। কেষ্টদাস কিছুনা করেও এ-আখড়া ও-আখড়ায় ঘোরাফেরা করে আহার্য-পরিধেয়, এমন কী একটি বাসস্থান সংগ্রহ করে ফেলেছে। যে কয়েকটি টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো রামচন্দ্র, সনকার অত্যন্ত হিসেবি হাতে খরচ হয়েও যখন সেটা শেষের কাছাকাছি এসে পৌঁছলো তখন দুর্ভাবনা হওয়ারই কথা। কিন্তু একটা ঘটনা ঘটে গেলো। শুনে কেষ্টদাস বললো, এখানে আসেও জড়ায়ে পড়লেন? আর রামচন্দ্র তার স্ত্রীকে বললো, ভাগ্যমানের বোঝা ভগোমান বয়।
গঙ্গার ওপারে শ্রীমায়াপুর ধামে গিয়েছিলো রামচন্দ্র। ফিরতিপথে পথচারীদের গল্পে সে যোগ দিয়েছিলো। তাদের মধ্যে একজন দুঃখ করে বলছিলো–তার সব জমি বেদখল হয়ে গেলো। আলাপ-পরিচয়ে কথা অনেকদূর গড়ালো। যখন তারা খেয়ার নৌকোয় উঠে বসেছে কেষ্টদাস শুনতে পেলো রামচন্দ্র বলছে: বেশ তো, চার-পাঁচ বিঘা আমাকে দেন। বর্ষার আগেই জঙ্গল কাটে বসে যাবো।বর্গাতে চষবো জমি। চাষের খরচ আধাআধি, ফসল আধাআধি। তাহলে জমিও আপনার দখলে থাকলো।
চিন্তা করেও সুখ। তার জমির পাশেই থাকবে গঙ্গা, আর গঙ্গা পার হলে নবদ্বীপধাম। আর কী চাই পৃথিবীতে? বাড়িতে মুঙ্লা অর্থাৎহকদারের হাতে জমিজিরাত-ইহলাকে সুবন্দোবস্ত। আর পরলোকের সুব্যবস্থা করার জন্য পাওয়া গেলো চার-পাঁচ বিঘা জমি।
সনকা বললো, সগ্গে যায়েও ধান ভানবা?
সে-কাম তো তোমার, সুনু। আমি খানটুক জমি পাই, নিবো। সন্নবন্ন অস্মিতের দানা ফলবি সে-জমিতে। সেখানে আমি দিবো চাষ, আর তুমি ভাব্বা ধান।
রামচন্দ্র সনকার হাত থেকে ককেটা নিয়ে ফুঁ দিতে লাগলো।
একদিন কেষ্টদাস বললো, শুনছেন মণ্ডল, দেশ বলে ভাগ হতিছে?
এসে আবার কী?
হয়। এক ভাগ হিঁদুর, আর এক ভাগ মোসলমানের।
ভাগ কে করে? ইংরেজ? তার নিজের জন্যি কী রাখবি? রামচন্দ্র হো-হো করে হেসে উঠলো।
কী আবার রাখবি! মনে কয়, খাসের জমি পত্তনি দিতেছে। মনে কয়, বিলেতে বসে খাজনা পাবি।
‘ধুর, এ হবের পারে না।
খেয়া নৌকোয় নানা ধরনের যাত্রীর মুখে মুখে অসংলগ্ন ও অসংপৃক্ত চিন্তাধারা কিছুক্ষণের জন্য একত্র হয়। একদিন সেখানেও রামচন্দ্র দেশভাগের কথাটা শুনতে পেলো।কয়েকজন বয়স্ক লোক এই ব্যাপারটার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আলোচনা করলো। একটি অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক ভদ্রলোক বললো–এর আগে মুসলমানের রাজত্ব ছিলো এ দেশে। তখন কি হিন্দু ছিলোনা দেশে? মুসলমান নবাব আর হিন্দু প্রজা মনকষাকষি করেছে, মারপিট করেছে, কিন্তু আবার মিলেমিশেও থাকতো।
অন্য একজন বললো, ওদেরই ক্যাডর, ওদেরই পুলিস এমন যদি হয়? অন্যায়ের নালিশ হবে কোথায়?
রামচন্দ্রর কৌতূহল হলো কিন্তু ভদ্রলোকদের আলাপে যোগ দিতে সাহস হলো না। তার ধারণা হলো এসব আলাপ-আলোচনা তার জ্ঞানের বহির্ভূত বিষয়।
এদিকে রামচন্দ্রর জমি চাষের ব্যাপারটা আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়েছে। রামচন্দ্র নদী পার হয়ে লোকটির বাড়িতে গিয়েছিলো। যে জমি সে দেখালো তার অধিকাংশ ময়নাকাটা, পিটুলি প্রভৃতি অকেজো গাছের জঙ্গলে ঢাকা। সে-জঙ্গল দূর করে জমি দখল কিংবা বেদখল করা,দুটিই সমান কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যার পায়ের তলায় মাটি নেই সে ছাড়া এমন মাটিতে কেউ লোভ করে না।
কিন্তু বেদখল হওয়ার ব্যাপার একেবারে মিথ্যানয়। সেই জঙ্গলের আশেপাশে খেলার ঘরের মতো ছোটো ছোটো ঘর তুলে কয়েক ঘর লোক বাস করতে শুরু করেছে। এদের মুখ চোখ দেখলে মনে হয়, দৃশ্যমানচরাচর এদের চোখের সম্মুখে পাক খাচ্ছে, মস্তিষ্ক কোনো বিষয়ের প্রকৃত ছাপটা নিতে পারছে না।
রামচন্দ্র ভাবলো, এরা কি তেমন সব গ্রামবাসী যারা কলে কাজ পাওয়ার আশায় গ্রাম ছাড়ে?
রামচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে তাদের মধ্যে একজনকে প্রশ্ন করলো, তোমরা কনে থিকে আলে?
আইলাম।