কে, মনসা? ঘুমোতে যাসনি?
রান্নার মহলে এখনো কাজ শেষ হয়নি ওদের। রুপোর বাসনগুলো দিয়ে গেলেই ভাঁড়ারে চাবি দিয়ে আমি ঘুমোতে যাবো।
হ্যাঁ রে মণি, আমি কি ওদের কাল খুব সকালেই কাজে আসতে বলে দিয়েছিলাম? মনে পড়ছে না।
সকালেই আসবে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছি সকলকেই।
অনসূয়া নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরলেন। শিবমূর্তিটির সম্মুখে যে প্রদীপটি ছিলো সেটার বুক পুড়তে শুরু করেছে। প্রদীপটা নিবিয়ে দিলেন অনসূয়া। ঘরের অতি মৃদু আলোটা গিয়ে পড়লো মূর্তিটির গায়ে। মনে হলো সেটার জটায় শ্যাওলা পড়েছে। শ্যাওলা ঠিক নয়, তামার বাসনে যে কলঙ্ক পড়ে তেমনি কিছু যেন।
কথাটা অনসূয়ার মনে পড়লো। যারা কাল চলে যাচ্ছে তাদের সম্বন্ধে গৃহিণীর অনেক কথাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। একটি সাদৃশ্য কথাটাকে শুধু সোজা পথে মনে এনে দিলো। এবং এ কথাও বোধহয় সত্যি, মনসার বর্তমান মনোভাবের সঙ্গে সেদিনের মনোভাবেরও সাদৃশ্য নয় শুধু, ঐক্যও আছে। সেরাত্রিতেও অনসূয়া রান্নামহলের তত্ত্বাবধান করে ফিরে আসতে আসতে দেখতে পেয়েছিলেন মনসা আলসেতে আজকের মতোই হাত রেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপুর। রেডিওর কোনো সুর যেন মনসাকে সংসারের কলরোল থেকে আড়াল করে রেখেছিলো।
কী হয়েছে মণি?
অনসূয়া লক্ষ্য করলেন মনসার গালের উপরে অশ্রুর রেখা।
মনসার উত্তর না পেয়ে অনসূয়া তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।
অনসূয়ার মনে হয়েছিলো, সেই দাঙ্গার পর রেখেই মেয়েটাকে এমন ভাবতে দেখা যায়। আবাল্য অভ্যস্ত নিরাপত্তার বোধ চলে গেলে তাহয় আর এখন তো পুরুষদের পৃথিবীটাইটলমল করছে। এ অবস্থায় মেয়েদের হাসি আর ঝর্ণার মতো চমকায় না, নদী-প্রমত্ততা অন্তর্লীন হয়, হ্রদের স্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্য হয়ে উঠতে পারে একটা মেয়ে। কিন্তু তার আগে রাতের অন্ধকারকে সঙ্গী করে এমন কাঁদতে হয়।
অনসূয়া আবার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে, দেখলেন মনসা তখনও আলসেতে হাত দুখানা রেখে তেমন দাঁড়িয়ে। মনসার পাশে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো সে কি পুরুষদের কথা ভাবছে? সে তত ভাবনার কথাই। বললেন, দাদার কথা ভাবছিস? তুই কি নৃপর খদ্দর থেকে সিল্কে যাওয়াটাকে খুব মনে করেছিস? সদানন্দ ওসব নিশ্চয় খাদি থেকেই জোগাড় করেছে।
মনসার গাল বেয়ে চোখের জল নামলো। এই অন্ধকারেও সেই জল দূরের কোন দেয়ালগিরির আলোকে ধরলো।
অনসূয়া বললেন, মণি, তোর দাদা তো সেই কবে থেকেই–আর তার জন্য সদানন্দই দায়ী সেই যে সামন্তদের পরে বেনেরা এমন সবকীকী,আবার একটু ভাবলেন তিনি, আবার বললেন, কে পড়তিস রে, তুই না নৃপ?–এক বুড়ো বিধে দিয়ে ঢিল বেছে ফেলছে, কুশঘাসের স্তূপ থেকে হালকা সাদা ধোঁয়া, সেই যে আ মেইড অ্যান্ড হার ওয়াইট কাম্ হুইস্পারিং বাই, সংগ্রামের ইতিহাস মুছে গেলেও, তাদের গল্প ফুরাবে না।
মনসা বললো, কিন্তু ওরা যদি আর ভালোবাসতে না পারে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার লজ্জাই তবু ওদের একত্র রাখে?
অনসূয়া খুঁজে পেলেন না কী করবেন। তার চারপাশ দিয়ে মুহূর্তগুলো এত তাড়াতাড়ি কোথায় যাচ্ছে। তিনি নিচের সেই ম্লান আলোর চকটাকে দেখতে দেখতে ভাবলেন, ভালোই যে পুরুষরা এখন ঘুমিয়েছে।বললেন, মণি, তাহলে তুই রূপোভাঁড়ারে তুলেই শুতে যাবি তো? তাই যাস।
ঘরে ফিরে এলেন অনসূয়া। মৃদু আলো জ্বালা সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
একবার তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলতে গেলেন, আমিও মধ্যবিত্ত ঘর থেকে এসেছিলাম এই পরিবারে। শিখতে হয়, এখানে এই দেয়ালগুলোর মধ্যে, অনেক ব্যাপারে, প্রথা নয়’ এই দুটো শব্দই শেষ কথা।
কিন্তু কোথাও যেন কেউ ফুঁপিয়ে কাঁদলো তার মনের মধ্যে। সুকৃতির জন্য যে আবেগ তার অন্তরে সঞ্চিত তার সহোদরাকেই যেন তিনি সুমিতির জন্যও অনুভব করলেন।
কিছুক্ষণ তিনি চিন্তা করলেন:সবকিছুতে আস্থা হারিয়ে ফেলেনতুন কিছুতে পৌঁছে যাওয়ার দুঃসাহসের এই পরিণাম, সুমিতি? আহা, তোমরা, বোধ হয়, সব কিছুই নিখাদ করতে চেয়েছিলে। যেন আমাদের এই পৃথিবীতে তা সম্ভব! দেখো সুমিতি, পুরুষদের পৃথিবী ফেটে যাচ্ছে। তুমি
বললেও তারা জানবে তাদের প্রত্যাশা ভেঙে পড়ছে। এখন কি কূলনাশিনী টান দিতে হয়? স্তব্ধ তড়াগের মতো থাকতে হয় না। নতুবা সুপেয়তার আশ্বাস কোথায় পায় তারা?
অনসূয়া বোধহয় নিজেকে মনকে অবগাহনযোগ্য করতে গেলেন। যেন সম্মুখবেগে সংহত করার চেষ্টাতে সেখানে আবর্ত আলোড়ন ঘটে গেলো। আবেগগুলো গলার কাছে চাপ দিচ্ছে। তিনি নিজের চারিদিকে চাইলেন। তার সুবিধা হলো। ঘরটা প্রায়ান্ধকার আর স্নিগ্ধ, তৈজস আসবাব পৃথক হয়ে চোখে পড়ছে না। বরং কাদের যেন স্নেহশীলা আশ্রয়গুহা। তিনি নিজেকে সেই ঘরের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন।
৩৮. রামচন্দ্রর দিন
রামচন্দ্রর দিন ভালোই কাটছিলো। তার নবদ্বীপের জীবন চিকন্দির জীবনের তুলনায় সার্থকতর মনে হচ্ছে। মনের সর্বত্র একটা শুচিতার আকাশ বিরাজ করছে। গঙ্গায় স্নান করে চরের শাদা বালির উপর দিয়ে ফিরতে তার একদিন মনে হলো, সূর্যের যে আলোটা তার গায়ে এসে পড়েছে তারও যেন মানুষকে পবিত্র করার শক্তি আছে।
সওয়া-পাঁচ আনা দাম চেয়েছিলো দোকানদার, অনেক কষাকষি করে সাড়ে চার আনায় সে একখানা ছবি কিনেছে। তাতে দেখা যায় মানুষের পাকস্থলী, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে বৃন্তল দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত কতগুলো পদ্ম আছে। একদিন সে একটি মন্দির থেকে বেরুচ্ছিলো। তখন বেলা আটটা-নটা হবে। রোদটা গায়ে পড়ে কষ্ট দিচ্ছে না কিন্তু সেটা যে দৃঢ় কিছু, তা অনুভব হচ্ছে। সে যে ছবিটা কিনেছে তার মতো কিন্তু আকারে বড়ো একটা ছবি মন্দিরের একটা থামে ঝুলোনো ছিলো সেই ছবির দিব্যকান্তি পুরুষটির দেহের অভ্যন্তর থেকে তিনটি প্রস্ফুটিত পদ্ম বিকশিত হয়ে রয়েছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রামচন্দ্রের মনে হলো, তার বুকের মধ্যেও একটি পদ্ম ফুটিফুটি করছে। সম্ভবত ছবিতে দেখা পদ্মর মতো গোলাপি নয় সেটা, তার হয়তো স্বর্ণাভা নেই, বরং বোধ হয় তার ত্বকের সঙ্গে সামঞ্জস্যে কালচে-লাল রঙেরই হবে সেটা। রামচন্দ্রর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। পদ্মগুলিকে সত্যিই অনুভব করা যায় কিনা, এবং সেগুলিকে আরও জায়গা করে দেওয়া উচিত–এই দুটি অধস্ফুট চিন্তা থেকে রামচন্দ্র গভীর নিশ্বাস টেনে খানিকটা সময় দমটা ধরে রাখলো। তার ত্বক ভেদ করে হু-হুঁ করে ঘাম বেরিয়ে এলো।