সুরো আসছিস?
বারান্দা থেকে পুরো সাড়া দিলো।
তুই ঘরে আসেও শুতে পারিস। আমি ডিব্টিতে চলোম।
ঘুমালে না?
না রে, ঘুম আসতেছে না।
ঠিক এই মুহূর্তে কেউ যদি মাধাইকে তার এই চাঞ্চল্যের কারণ জিজ্ঞাসা করতো, সে উত্তর দিতে–এ কি তোমার মেলোয়ারি ভোগা আর খায়ে না-খায়ে থাকা। এর নাম চাকরি। রেলের কামই লোক পায় না,হলো তোহলো,শালা মেলেটারি।নীল প্যান্টকোটকজন পায়, তার উপরে পাওয়া গেলো খাকি প্যান্ট, কোট, টুপি। পুলিসের দারোগারাও তাকায়ে তাকায়ে দেখে।
খাকি, খাকিই হচ্ছে এই দুনিয়ার সেরা রঙ।
মাধাই যখন গ্রাম ছেড়েছিলো তখন তার বয়স কুড়ি ছাড়িয়েছে। মাধাই এক গণস্কারকে দিয়ে হাত দেখিয়েছে। পাঞ্জাবি গণৎকার পুরোপুরি একটা সিকি পেয়ে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই মাধাই বায়েনকে রাজা করে দিয়েছিলো প্রায়, পুরোপুরি পারেনি মঙ্গলের স্থানে কী একটা দুর্যোগ ছিলো বলে। মাধাই এখন নিজের হাতের রেখা দেখিয়ে বলে–তা দেখ, ঠিক কুড়িতে যদি গাঁ ছাড়া না হতাম, জুটতো এই চাকরি?
গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঠিক তিন মাসের মধ্যে মাধাইয়ের চাকরি জুটে গেলো স্টেশনে। তেরো টাকা মাসিক বেতনের চাকরিটা মাস্টারসাহেব তাকে ডেকে দিয়েছিলো। অবশ্য কফিলুদ্দি শেখের চামড়ার ব্যবসায়ে কোথায় মাস্টারসাহেবের সঙ্গে খাতির হওয়ার যোগাযোগ ছিলো।
স্টেশনের কনস্টেবল দোবেজি একদিন এক রাজপুরীর গল্প বলেছিলো। ত্রিশ হাত উঁচু তার প্রাচীর। ভেতরে বাগান। সারি সারি ফুলফলের গাছের মধ্যে লাল আলোকোজ্জ্বল রাস্তা।
বাইরে কাঁটাভরা রাক্ষুসে লতায় ঢাকা জলা। এক-একটা কাঁটা যেন এক-একটা বিষমুখো সাপ। কিছুদিন পরে মাধাই অনুভব করেছিলো তার চাকরিটাও একটা প্রাচীর।
কিন্তু সবটাই যেন এক পূর্বপরিকল্পিত কাহিনী। কোথায় কোন দুই দেশের রাজায় লেগে গেলো যুদ্ধ। দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রচণ্ড প্রচণ্ড ইঞ্জিনগুলো খাকি-পরা লোক নিয়ে ছুটতে লাগলো। ইয়া ইয়া ইঞ্জিন আর হাজার হাজার গাড়ি। হুস হুস ঝম ঝম। যেখানে পাঁচখানা চলতে এখন চলছে পঁচিশখানা। এক সকালে তেমনি কোথা থেকে রাশি রাশি খাকির জামাকাপড় এলো। মাস্টারসাহেব থেকে শুরু করে মাধাই পর্যন্ত সবাই পরলো। প্রথম যেদিন পোশাক বিতরণ শুরু হয়েছিলো হাসাহাসির চূড়ান্ত হলো! কারো ভুঁড়ির বোতাম লাগতে আপত্তি করলো, কারো বা পোশাক আলখিল্লার মতো ঝুলঝুলে হলো গায়ে। কিন্তু এক রাত পার না-হতেই হাসির জায়গায় এলো গাম্ভীর্য। আর মাইনা বেড়ে যে কত হলো লেখাজোখা নেই। তেরো বেড়ে তেষট্টি। ছ মাসের কামাই একমাসে।
অফিসঘরগুলিতে কাজ হচ্ছে যেন ঝড়ের মতো। ফিরিওয়ালা যে এত কোথায় ছিলো কে জানতো! স্টেশনের উপরেই প্রতি প্ল্যাটফর্মে একটি করে বিলিতি খানাঘর তৈরি হয়েছে। আর কোথায় ছিলো এরা, যারা যে-কোনো দামে যে-কোনো জিনিস কিনবার জন্য গাড়ি স্টেশনে আসবার আগে থেকেই জানলায় দাপাদাপি করতে থাকে। গায়ে গায়ে ধাক্কা লেগে মাথা ঘুরে যায়, পায়ের ঠোক্করে মানুষ ঠিকরে পড়ে, মানুষ চটকে যায় পায়ের নিচে। দৃশ্যটা এ বলেও বোঝানো যাবে না। যে না-দেখেছে সে বুঝবে না, ভাবে মাধাই, এ এক নৃত্য। কিছুদিন আগে এক বাজিকর পুতুলনাচ দেখিয়েছিলো। লাল একটা গোল শতরঞ্জির টুকরোর উপরে একটা পুতুলের চারদিকে অন্য কয়েকটি পুতুল নাচতে লাগলো। তাদের নাচের তালে তালে শতরঞ্চিটাও দুলে দুলে উঠতে লাগলো। তারপর নাচ যখন উদ্দাম হয়ে উঠলোতখন শতরঞ্জিটাও বনবন করে ঘুরতে শুরু করলো। সেই শতরঞ্জিই এই স্টেশন।
অন্ধকার পথটা দিয়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে মাধাই অন্ধকারের শূন্যতাকে বুট ঠুকে একটা স্যালুট করে দিলো। ট্রেনটা এসে দাঁড়ালে শুধু সে নয়, স্টেশনে যে যেখানে আছে সবাই এমন করবে। সাধারণ ট্রেন এলেই কত করতে হয়, তার উপরে আসছে স্পেশ্যাল,ইপেশিয়াল যার নাম। পাঁচ-ছয় দিন আগেই তারে-তারে খবর পেয়েছে সারা দেশ। দক্ষিণের রাজা নাকি উত্তরের রাজাকে খুব হারিয়ে দিয়েছে। ফুল-পাতায় রঙিন কাগজে স্টেশন সাজানো হয়েছে। বড়ো বড়ো গেট। স্টেশনমাস্টারের ঘরে নাকি কয়েকজন বড়ো বড়ো যোদ্ধা চা খাবেন। তার আয়োজন করতে গিয়ে স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। সেই স্পেশ্যাল!
স্টেশনের চৌহুদ্দিতে পা দিতে না-দিতে মাধাই খবরটা পেলো। জয়হরি তারই মত পোর্টার। সে-ই বললে–একখানা নামে, আসলে দুখানা। সেই উত্তর থেকেই চারখানা ইঞ্জিনের পেছনে দুখানা স্পেশ্যাল আধ মাইল তফাতে থেকে চলছে। দ্যাখো মজা, এক লাইন ক্লেয়ারে দুখান গাড়ি চলে।
মাধাই এমনটা কখনো শোনেনি। সে বললো, পেছনের ড্রাইভার কত ওস্তাদ দ্যাখো। একটু। বে-মাপ চালাবা তো সামনের গাড়িতে ঠোক্কর।
সামনের ড্রাইভার বা কম কী? ইঞ্জিন একটু কমালে চলবি নে?
সব ইষ্টিশনে থুরু পাস?
না, এখানে থামবি।
থামবে সেটা মাধাইও জানে। প্রশ্নটা উত্থাপন করে বন্দর দিঘার স্টেশন সম্বন্ধে গর্ববোধটি নতুন করে অনুভব করার চেষ্টা করলো সে।
বাব্বা, দিঘায় না থামে কারো উপায় নাই।
সামনের ভেন্ডারের ডালা থেকে একটা পান ছিনিয়ে নিয়ে চিবোতে চিবোতে মাধাই মালবাবুর ঘরের দিকে গেলো।
মালবাবু তার ঘরেই ছিলো। মাধাই তার অত্যন্ত ভুল কায়দায় একটা স্যালুট দিয়ে বললো, দুই গাড়িতে নাকি এক ইসপেশিয়াল?