অনসূয়া কুটুম্বকে সমাদৃত করার ফাঁকে ফাঁকে চিন্তা করলেন, সান্যালমশাইয়ের মনের অবস্থাটা তার অনির্দিষ্টআলাপচারিতায় অত্যন্ত নির্দিষ্ট হয়ে ফুটেছে। রূপু চলে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের জন্য। সে যখন ফিরে আসবে তখন এই গ্রাম্য আবহাওয়ার কাছে তার কিছু পাওয়ার থাকবে না। নৃপ স্বভাবতই গ্রামের প্রতি বিমুখ। এসব কারণ থেকেই সান্যালমশাই নিজের পারিবারিক অবস্থাটাকে রায়বংশের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কিন্তু সত্যি কি সব হারাচ্ছে?
কিন্তু অনসূয়া বললেন, আপনি কিছু খাচ্ছেন না, বেয়াইমশাই; আমার মনে হচ্ছে টেবিলে না বসে নিজেকে কষ্ট দিলেন।
না না। আজকালকার দিনে এমন সাহেব আর কেউ নেই। সাহেবরাই এ দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ, সুমিতি তোমার সেই কলেজের চাকরির কথা শ্বশুর-শাশুড়িকে বলেছে তো?
এক মুহূর্ত বিচলিত হলো সুমিতি, মৃদু হেসে বললো, চাকরিটা হওয়ার মতো হলে তখন
ব্যারিস্টার চোখ তুলে অনসূয়ার মুখের দিকে চাইলেন। অনসূয়ার আশঙ্কা হলো, তার চোখের পাতা কি ঘনঘন পড়ছে? সামলালেন তাকে। বললেন, আমার বেটা বউ ঠিক বলেছে। কী যেন বলেন আপনারা, এখনই অনুমতি চাওয়াটা হাইপথেটিক্যাল হতো।
আহারাদির পর সান্যালমশাই যখন অতিথির সঙ্গে আলাপ করার জন্য স্টাডির দিকে যাচ্ছিলেন, অনসূয়া তার হাতে পান দিতে দিতে বললেন, যদি সময় করতে পারো ঘুমোনোর আগে আমার কাছে একটু এসো।
সান্যালমশাই অনসূয়ার ঘরে এসে দেখলেন তাঁর প্রিয় গড়গড়াটা শয্যার পাশে রয়েছে। ক্ষীণ সুগন্ধির ধোঁয়া উঠছে। অনসূয়া যেন বা ইতিমধ্যে শাড়ি পালটেছেন। সুমিতি যেমন পরেছিলো কতকটা যেন তেমন শাড়ি বলেই ধোঁকা লাগে। কিন্তু চেয়ে দেখলে বোঝা যায় হালকা নীলের জমিতে হালকা মটিফ তোলা ঢাকাই শাড়ি সেটা। অনসূয়ার কণ্ঠলগ্ন ন-কোনি তারার মধ্যে কাকের ডিমের চাইতে কিছু বড়ো একটা পান্না জ্বলছে। কাছে এগিয়ে গিয়ে পান্নাটা তুলে ধরে সান্যালমশাই বললেন, কোথায় যেন, কার গলায় যেন এমনটা দেখেছিলাম?
অনসূয়া হাসলেন, তার কানের পাশ দুটি লাল হয়ে উঠলো, তিনি বললেন, বোধ হয় সে আমি।
সান্যালমশাইয়ের হৃদয়ে মধুবর্ষণ করলো অনসূয়ার কথার মধ্যে লুকোনো’বোধহয়’শব্দটির মৃদু ইঙ্গিত।
সান্যালমশাই বসলে অনসূয়া বললেন, আমাকে যদি কোনো বরের প্রতিশ্রুতি দিতে, আমি বলতাম সেবর এখুনি চাই।
তোমার গলার এই মালাটির জন্যই আমি বর দেব। কী চাই বলো?
কোথাও বেড়াতে চলো।
সঙ্গে কে কে যাবে?
মনসার শাশুড়ি যদি রাজী হন তবে মনসা যাবে।
সান্যালমশাই চুপ করে রইলেন।
অনসূয়ার মনে পড়লো হঠাৎ, সুকৃতির সেই ব্যাপারে সান্যালমশাই-এর রিভলবারসমেত হাত দুটোকে চেপে ধরতে হয়েছিল।
কিন্তু সান্যালমশাই হেসে বললেন, কী ভাবছো? ছেলেরা এতদিনে রুচিতেও মধ্যবিত্ত হলো?
অনসূয়া বললেন, আগেকার দিনে রাজারাজড়ারা এত হিসেব করতেন না তোমার মতো।
সান্যালমশাই হেসে গড়গড়ার নলটা সাগ্রহে তুলে নিতে নিতে বললেন, তথাস্তু।
কিছুক্ষণ আলাপ করে সান্যালমশাই যখন নিজের ঘরে ফিরলেন তার কিছুপরেই মনসা এসে ডাকলো, জ্যাঠামশাই।
দরজা খোলা ছিলো। সান্যালমশাই বই পড়ছিলেন!
মনসা বললো, জ্যাঠামশাই, বউদির সঙ্গে ধাত্রী যাচ্ছে, তারণের মা যাচ্ছে। তুমি নাকি রামপিরিতকেও যেতে বলেছে?
যাকে না। ওর বয়স হয়েছে এখন। দেশ-টেশ দেখুক না। ট্রামে বাসে চড়ার অভ্যাস করুক। কিন্তু একথা জিজ্ঞাসা করছিস যে?
মনসা বললো, ওর ভাব দেখে মনে হয়, ও সংকোচ বোধ করছে।
বোধহয় ব্যারিস্টারসাহেবের আর্দালির লাল আর সোনালি পোশাক দেখে। ওকে বলে দিয়ে এখানে যেন রঙিন ধুতির কোমরে উড়নি জড়িয়ে হাতে পাকা লাঠি নিয়ে বরকন্দাজী করে সেটাই যেন ও সর্বত্র বহাল রাখে। ওকে বলতে হয় না, বিদেশে গেলে মেরজাই পরে ঠিকই।
কথাটা আসলে বলেছিলো সুমিতি, সংকোচটা তারই।
মনসা উঠে দাঁড়ালোলা।
সান্যালমশাই বললেন, মণি, টাকা দেওয়ার ব্যাপারে কী করি বল তো? ধাত্রীদের বেতন, বউমার হাতখরচ, এসব কীকরে দেবো, কাকে দেবো? আর তাছাড়া বউমা যদি দীর্ঘদিন থাকেন কলকাতায়, একটা গাড়ি কিনে দেওয়া উচিত নয়? তাছাড়া খোকার ফ্ল্যাটটাই কি যথেষ্ট হবে?
মনসা হাসিমুখে বললো, আচ্ছা, কয়েক রকম প্রস্তাব করে তার একটিতে বউদিকে রাজী করাবো। কিন্তু জ্যাঠামশাই, ইংরেজদের কাছ থেকে রাজনীতির চালগুলো তুমি খুব ভালোই শিখেছো। বউদিরা আপাতত এই ডোমিনয়ন স্ট্যাটাস নিয়ে থাকুক।
এই বলেও মনসা হাসলো ঝিকমিক করে।
মনসা চলে গেলে সান্যালমশাই কিছুকাল রাজনীতির কথা ভাবলেন। তারপর তার মনে হলো ওরা চলে যাচ্ছে।নৃপ যদি কিছু না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটোছুটি করে বেড়ায় তা হলেও অন্যায় হয় না। যে আদর্শটাকে সামনে রেখে প্রথম যৌবনের আনন্দঘন দিনগুলিকে তপস্যার মতো ক্লেশে সে কাটিয়ে দিচ্ছিলো সেটা যদি অর্থহীন বোধ হয় তবে অস্থিরতা আসে বৈকি মনে। সদানন্দ পাসপোর্ট ইত্যাদির জোগাড় করতে পারলে রূপুর কাছে গিয়েই থাকবে। আর তা যদি না হয়, তবে সে নৃপকেই সাহার্য দিক। সাহচর্যের প্রয়োজন নৃপরই যেন বেশি।
অনসূয়া ঘুমোত পারলেন না সহজে। তিনিও দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। একটা অস্পষ্ট জ্যোৎস্না উঠেছে। বারান্দায় তারই আলো। রান্নামহলে দু-একজন লোক এখনো কাজ করছে। বাগানের কোনো গাছ থেকে একটা বক ডাকছে। অন্দরমহলের কার একটি শিশু ঘুমের ঘোরে একবার কেঁদে উঠলো। পাওয়ার-হাউসের শব্দটাও আসছে।