কবোষ্ণ জলে সান্ধ্যস্নান শেষ করে সান্যালমশাই স্টাডিতে গিয়ে বসেছিলেন। কিছুদিন থেকে তিনি কখনো কখনো অনুভব করছিলেন, পথ আলাদা হয়ে যাচ্ছে তার কারো কারো সঙ্গে। পূর্বের পরিত্যক্ত সঙ্গী রায়দের কথা মনে পড়ছে মাঝে মাঝে। সুমিতি এসেছিলো এবং সে চলে যাবে, এ যেন তার জীবনের সম্ভাব্য ভবিষ্যতের অকালে মঞ্চাবতরণ এবং অন্তর্ধান। নিঃসঙ্গ নয় শুধু, পরাজিতও মনে হচ্ছে নিজেকে। চিন্তার এই পটভূমিকায় নতুন করে বাড়িঘর তৈরি করা হাস্যকর কিছু বলে মনে হলো। দাঙ্গায় যে দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন তা যেন নাটকীয়তার চূড়ান্ত। লাল কাপড় পেঁচিয়ে পরে যেনবা যাত্রাদলের রাজা সেজেছিলেন তিনি।
মেজেছিলেন তিনি। রায়েদের কথাই মনে জাগছে। তাদের সকলের প্রতীকরূপে প্রথম যৌবনে যাকে মধুরতা এবং রূপের কেলাসিত মূর্তি বলে মনে হয়েছিলো তার মুখখানা বারংবার মনে পড়ছে দীর্ঘ দু তিন যুগের ব্যবধানে। বিরহ নয়, অনুতাপও নয়, একটি বেদনার মতো বিষণ্ণতা।
তাঁর মনে হলো কে যেন লিখেছে–দুদিনে আমাদের কণ্ঠরুদ্ধ হবে, রেহাই দাও। সেই ইংরেজ কবিকে খুঁজবার জন্য তিনি পুঁথিঘরে ঢুকলেন।
সান্যালমশাই কবি সম্বন্ধে মত বদলালেন। কে যেন কানাগলি সম্বন্ধে কিছু বলেছে, তার মনে পড়লো। ভারি লাগসই কথা-বজ্রপাত নয়, হুড়মুড় করে পাহাড়ের চূড়া ভেঙে পড়া নয়, ককিয়ে কাতরিয়ে বিদায় নেওয়া। যে কবি রেহাই চেয়েছিলো,এ যেন তার চাইতেও স্পষ্টভাষী।
শিশু যেমন মায়ের প্রতি অন্ধ আবেগে নির্ভরশীল বই হাতে নিয়ে চলতে চলতে তার মনে হলো-মাটি ও পদ্মার উপরে তিনি তেমনভাবে আর আকৃষ্টনন, সেজন্যই কি তিনি এখানে নিজের জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন না। সম্বন্ধটা কৃত্রিম মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে রামচন্দ্রর কথা মনে হলো। সে যেন মাটি থেকে জন্মেছে। সুমিতির কাকা চাষী দেখতে চেয়েছিলেন, তার থেকে রূপু নায়েবমশাইকে বলেছিলো, চোপদারকে দিয়ে রামচন্দ্রকে ডেকে পাঠাতে। মনে হয়েছিল, সে ই এই মাটির বলবত্তম সন্তান, মাটির মতোই ধ্রুব। খবর এসেছিলো, রামচন্দ্র তীর্থে গেছে। পরে তিনি লজ্জা বোধ করেছিলেন এই ভেবে যে, রামচন্দ্রকে যেন দ্রষ্টব্য একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাণীর মতো ব্যারিস্টারি চোখের সম্মুখে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছিলো। কেন যে এখন এমন ভুল হচ্ছে। তার! এখন তার মনে পড়লো,নায়েব বলেছিলো–রামচন্দ্র উইল করতে চায়, তাকে দিয়ে জমির শক্ত কাজ আর হবে না। ছিদামের আত্মহত্যার ব্যাপারে রামচন্দ্র জড়িয়ে পড়ার কথাও তিনি জেনেছেন। আকস্মিকভাবে তার অনুভব হলো, একটি বেদনার আর্তিতে বিকল মানুষগুলো একত্র হয়েছে।
না, তিনি ভাবলেন, এ বিষণ্ণতার কারণ অন্য কোথাও। নৃপ গৃহী হবে এখানে–এ আশা তো অযুক্তির। রূপু দীর্ঘদিন কাছে থাকবে না, এ তো তার নিজেরই ব্যবস্থা। কিংবা বলবে, এই এক সূর্যোদয়ের ক্ষণে এই এক মেঘে মেঘে কালো দিন আসছে, যখন চোখের সামনে মেলে না ধরলে নিজের হাতকে যেন দেখা যাবে না, তখন তাদের দূরে যাওয়ায় এমন নিঃস্ব বোধ হচ্ছে?
কয়েকটা আলমারি পাশাপাশি সাজানো, সান্যালমশাই তার পিছন থেকে মানুষের সাড়া। পেলেন। সদানন্দ, নূপনারায়ণ, রূপু, সুমিতি এবং মনসা হাসাহাসি করছে, কথা বলছে।
সদানন্দ ওদের কাছে টাকা চাইছে, গুরুদক্ষিণার কথাও কী একটা বলছে।নৃপনারায়ণ তাকে নানা প্রশ্নে জর্জরিত করছে। সকলেই প্রশ্নগুলির রসিকতায় হাসছে। পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকার বিনিময়ে মুঘল বাদশাদের কিছু ছবি আঁকা হাতে লেখা পুঁথি কিনতে চায় সদানন্দ। অবশ্য এ কথাও সে বলছে, যদি অনসূয়া, সুকৃতি, মনসা ও সুমিতির পোরট্রেটগুলো তাকে দেওয়া হয় তার মত বদলাতে পারে। রূপু জিজ্ঞাসা করলো, একক এগজিবিশান? মনসা বললো, শেষ সামন্ততান্ত্রিক জীবনের নজির। সকলে একসঙ্গে হেসে উঠলো।
সান্যালমশাই বই হাতে নিজের টেবিলে ফিরে এলেন। হঠাৎ তিনি যেন আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলেন। ইংরেজরা চলে যাচ্ছে তবু তাদেরই এক কবিকে তিনি তার মনের সাময়িক আশ্রয় হিসাবে গ্রহণ করছেন। এটাই তুলনা হতে পারে। দুটি মানুষ একত্র হলে পরস্পরের মনে ছাপ রেখে যাবেই। একটি বিশিষ্ট জীবনপদ্ধতি যেন আর-একটির সঙ্গে মিলিত হয়। তারা লোপ পেয়ে গেলেও কখনো তাদের একটা কথা, তাদের কোনো মন্দিরের একটি কালজীর্ণ স্তম্ভ আমাদের কালে খুঁজে পেয়ে সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জীবনের উত্তাপ আমরা অনুভব করি। জীবনের এই পরিণাম, এই একমাত্র লাভ, যদি লাভের কথা তোলো। যে ভাষার মৃত্যু অনিবার্য তার বার্ধক্যের কোনো সাহিত্যিকের প্রচেষ্টা যেন এই জীবন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন? কবোষ্ণ রক্তধারায় যা প্রবাহিত হলো?
রাত হয়েছে তখন। অনসূয়া এসে বললেন, খেতে দিচ্ছি।
সুমিতির কাকা, রূপু,নৃপ এবং সান্যালমশাই পাশাপাশি আহারে বসেছেন। রূপু এবং নৃপর নানা কথায় এটা বোঝা যাচ্ছে তাদের স্বাস্থ্য ভালো আছে এবং জীবনের প্রতি তাদের আকর্ষণ স্বাভাবিকভাবেই প্রবল। সান্যালমশাই তাদের আলাপে যোগ দিচ্ছেন এবং তার আলাপের সুরে মনে হলো সন্ধ্যার কথাগুলি যেন অবান্তর এবং প্রক্ষিপ্ত কিছু। কিন্তু হাসিমুখে পরিবেশনের খুঁটিনাটি নির্দেশ দিয়ে সুমিতিকে সাহায্য করতে করতে অনসূয়া যেসব আলোচনার অবতারণা করলেন তার সঙ্গে তার চিন্তাগুলির পার্থক্য থেকে গেলো। হাল্কা নীলে সাদা ডুরে খদ্দর পরেছে। সুমিতি। অনসূয়াকে উপদেশ দেওয়ার সময়ে তার শাশুড়ি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন খেতে দেওয়ার সময়ে শুধু পরিচ্ছন্ন নয়, সুরুচিসম্পন্ন বেশভূষাও কেন করা দরকার। অনসূয়া তখন বালিকা ছিলেন। সুমিতি যেন বলমাত্র বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে অনসূয়াও শাড়ি পালটেছেন। সুমিতির কাকা অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সের। এ-রকম আত্মীয়ের সম্মুখে সাদা শাড়ি পরাই অনসূয়ার প্রথা। আজ কিন্তু তার পরনের শাড়িতে ধূপছায়ার ছোঁয়াচ লাগলো। তার অন্তরের সঙ্গে বক্তব্যের মতোই পরিস্থিতির সঙ্গে পরিধেয়ের সচেতন পার্থক্য থেকে গেলো।