এই সুবাদে মুন্সেফি আদালত থাকার গুরুত্ব থেকে গ্রামের আরও নেমে যাওয়ার কথায় স্তরে স্তরে যারা ধনী ছিলো তাদের কথা হলো। সেকালেই সেই ধনী কারিগর আর কুঠিয়াল দালাল থেকে নীলকর হয়ে পাটের সাহেবদের স্তর পর্যন্ত গ্রামের ধন ক্রমশ বেশি করে বাইরে গিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
তা ছিলো। বললেন সান্যালমশাই, সেরেস্তার পুরনো কাগজের মধ্যে চিকনডিহি মুন্সেফি আদালতের মোহর দেওয়া কাগজ পাওয়া যায়।
তাদের সকালের ভ্রমণ বুধেডাঙার প্রান্ত ছুঁয়েছিলো। বুধেডাঙার বয়স কম। দেখলে ছায়াসুনিবিড়তার কথা মনে আসেনা। সান্দাররা ফৌৎহওয়ার পরেনতুন করে যে চাষীরা বসেছে তারা তাদের জমিতে জঙ্গল হতে দেয়নি। দূর দূর বিস্তৃত তাদের নিরাবরণ জমি যেন জলের তৃষ্ণায় ক্লান্ত। ছোটো ছোটো কুঁড়েঘর, দু-একটি বিরলপত্র গাছ। পদ্মা থেকে বুধেডাঙার উপর দিয়ে প্রচুর ধুলো নিয়ে বাতাস এসে লেগেছিলো গায়ে।
ব্যারিস্টার জিজ্ঞাসা করলেন, ফসলহীন এ চৈত্র-বৈশাখেই তো খাজনা দেয়া-নেয়ার ঝোঁক পড়ে।
সদানন্দ বললো, বছর শেষ হয় যে।
সান্যালমশাই ভাবলেন, বুধেডাঙার বয়েস বাড়তে বাড়তে এমন একসময় আসবে যখন। সেটাও প্রাচীন গ্রামের সবগুলি লক্ষণ অর্জন করবে। তার গাছপালাগুলি বেড়ে বেড়ে সূর্যালোক রোধ করবে। চাষের জমির জন্য সেখানকার কৃষকরা অন্যত্র দৃষ্টি দেবে। এমন হতে পারে, এখন যে বয়োজীর্ণ চিকন্দিকে দেখা যাচ্ছে, তখন সেটা বুধেডাঙার চাষীদের চাষের জমিমাত্র হবে। তাদের হাতে পড়ে চিকন্দি আবার নতুন হবে, কিন্তু তার আগে কি তার মৃত্যুই অপরিহার্য?
সুমিতির কাকা বললেন, আজকাল যেসব গ্রামোদ্যোগের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে তার ফলে এসব গ্রামের চেহারা বদলে যাবে। সদানন্দ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো।
গ্রামের চেহারা বদলে গেলে ব্যাপারটা কী রকম হয় সেটা কল্পনা করায় কৌতুক আছে। সান্যালমশাইয়ের মনে বঙ্কিমবাবুর উপন্যাসে পড়া সীতারাম প্রভৃতির রাজধানীর চিত্রটা ভেসে উঠলো। চওড়া চওড়া মাটির পথে বড়ো বড়ো পাল্কি চলছে। সেই ছবিতে তারপরে লালমুখো নীলকরদের দাদন নিয়ে শামলা-আঁটা দিশি মুৎসুদ্দিরা ঢুকে পড়লো।
অলস অবসর। সদানন্দ কথায় কথায় উন্নীত একটা গ্রামের ছবি এঁকে ফেলো।
সুমিতির কাকা বিলেতি বারে আহুত হয়েছিলেন। তিনি শহরের উপান্তে স্লেট, সিমেন্ট, কাঠ ও কাঁচের তৈরি ছোটো ছোটো কটেজগুলোর কথা বললেন, সেই সব বিলেতি গ্রামের বাঁধানো পথ ও ইলেকট্রিসিটির আলোর কথাও।
সান্যালমশাই হেসে বললেন, সদানন্দর কল্পনার গ্রামে বিলেতি সেসব গ্রামের ছাপই পড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এদেশের কয়েক কোটি কুটিরে খড়ের বদলে স্লেট, নলখাগড়ার বদলে সিমেন্ট :হার করতে গোটা হিমালয়টাকেই গলিয়ে নিতে হবে বোধহয়। আর সেই কয়েক লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সারা ভারতে ছড়াতে একটা নতুন মহাদেশ শোষণ করা দরকার হবে সম্ভবত।
এ তোমার অতিরিক্ত পড়ার ফলে কিনা জানি না সদানন্দ, একটুপরে আবার বললেন সান্যালমশাই, কিন্তু এখানে তুমি গ্রামোদ্যোগের সাহায্যে ট্রাকটর রাখার কল্পনাও কোরো না। এ দেশের চাষীরা তো রেডইন্ডিয়ান নয় যে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে খোঁয়াড়ে পুরে রেখে এসে মনের আনন্দে শূন্য জমিতে কলের মই টানবে।
.
অন্য আর-এক সময়ে অনসূয়ার সঙ্গে সান্যালমশাইয়ের কথা হলো।
সান্যালমশাই বললেন, এ অঞ্চলে সান্যালবংশটা রায়দের দৌহিত্র বংশ।
অনসূয়া এসব কথা জানেন। তিনি বুঝতে পারলেন সান্যালমশাই রায়দের সম্বন্ধে কিছু বলতে চান, এটা তার ভূমিকা।
সান্যালমশাই বললেন, রায়দের সঙ্গে আমাদের প্রধান পার্থক্য এই,তারা বেহিসেবি ছিলেন। এবং আমার আগেকার সান্যালমশাইরা তাদের বেহিসেবিচালে সুখী হতেন,কারণ সম্পত্তি বন্ধক রেখে নগদ টাকা সংগ্রহ করা রায়দের রেয়াজ ছিলো। কলকাতায় যে ফ্যাসন ষাট-সত্তর বছর কিংবা তারও আগে আধুনিক ছিলো, তাকেই আঁকড়ে ধরে ছিলেন রায়েরা। গরমকালেও মোজা পায়ে দেওয়া, তাঁতের ধুতির পাড় ছিঁড়ে পরা, পাঞ্জাবিতে লেস বসান, এসব ব্যাপারকে তারা সযত্নে লালিত করতেন এই সেদিন পর্যন্তও। কিন্তু দীর্ঘ ও আপাতদৃষ্টিতে বলিষ্ঠ দেহ নিয়েও তারা পঞ্চাশে পৌঁছতেন না। এখন জানি, সেটা অ্যালকোহহালিজমের ফল। শেষের দিকে রায়বাড়ির মেয়ে বউদের মধ্যেও সুরার প্রচলন হয়েছিলো। আমাদের প্রথা ছিলো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে স্ত্রী সংগ্রহ করার। পাকাপাকিভাবে বোহেমিয়ানা সেজন্যেই আমাদের উপরে ভর করেনি। কিন্তু
সান্যালমশাই তার কথার মাঝখানে থেমে গেলেন। অনসূয়া বুঝতে পারলেন, সান্যালমশাই। ‘কিন্তু’ বলে কী নির্দিষ্ট করতে চান। এত সতর্ক পদচারণার শেষে আজ সান্যালরাও যেন সেই লুপ্তির কিনারায় এসে পৌঁছলো, এই যেন তার বক্তব্য। অনসূয়া ভাবলেন–জমিদারি প্রথা নিয়ে পিতাপুত্রে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব হবে এই আশঙ্কা ছিলো তার। কিন্তু যে ঘটনাগুলো ছেলেদের বেড়ে ওঠার মতো স্বাভাবিক তা যেন একটা পরাজয়ের মতো বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছে।
না-না, তিনি ভাবলেন, তিনি তো সেই অন্ধকার মন্দির বারান্দায় বসেই স্থির করে নিয়েছেন, সুমিতির এসবই আধুনিকতা, আধুনিক কালে স্বচ্ছন্দ হওয়ার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়। কখনো ভাবা উচিত নয় সুমিতির এসব সান্যালবাড়ির ভিত নড়িয়ে দেয়ার মতো কোনো স্রোত। রূপু ফিরে এলে তার চালচলনেও কত য়ুরোপের ঢং থাকবে। নিঃশব্দ সান্যালমশাইকে দেখে নিয়ে তিনি আবার ভাবলেন; তাছাড়া, দেখো, এই যে কী এক ঝাঁপটা লাগছে কালের, হয়তো এক প্রচণ্ড ঝড় আসছে, সুমিতিদের এসব হয়তো সেই ঝড়োবাতাসকে কাজে লাগিয়ে বাঁচার আদিম জ্ঞান। সমুদ্রে এরকম পাখি থাকে।