কনক বুঝতে পেরেছিলো কৃষক-জীবনে আলতাপের আপত্তিটা কোথায়।
দুর্ভিক্ষের আগে রজবআলির বাড়ির সমুখে একটা মাচায় বসে থাকতো আলতাপ আর বিড়বিড় করতো। ঠাহর করে শুনলে বোঝা যেতো সে বলছে : এতটুকু নতুনত্ব নেই জমিতে যেনতুন কিছু আশা করবে। ঐ তো গহরজান বিশ পটি ধান তুলেছে গোলায়। দুই দু-খান গোরুর গাড়ি তার, পাঁচজোড়া লাঙল বিধে। কালো কোট পরে থানায় হাজিরা দেয় সে, লাল মোল্লাকি টুপি, তফনের চেকনাই চমকে ওঠে বোদ-ভরা মাঠ পার হতে গেলে। সাদি করেছে এ-সনেও একটা। আহাম্মুখ বোঝে না ষাট বছরে ওসব ঘরে আনা শুধু নিজের খাঁচায় পরের জন্য পাখি পোষা। কিন্তু তা যতই করো, দাঁড়াতে হয় না তোমাকে সান্যালদের পেয়াদার সামনে ভেড়া-ভেড়া মুখ করে?
থুথু ফেলে চারপাশ অগম্য করে তুলতে আলতাপ। এর কিছুদিন পরে সে বলতে আরম্ভ করেছিলো–অন্য কোথাও চলো, অন্য কোথাও চলো। এমন ধানও হয়নি কোনো সালে, এমন না-খেয়ে থাকাও আর কোনোদিন হবি নে।
লোকে ভাবতো ওটা বুড়োদের ধরতাই বুলি। প্রতিবারেই তারা বলে এবারের মতো কোনো ঋতু এত প্রবল হয়ে কখনো আসেনি।
কিন্তু আলতাপের শেষ কথা চূড়ান্ত হয়ে সত্য হলো।
কনকদারোগা কলম খুলে নিয়ে কিছু-একটা লিখবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। সে লিখলো : সারা গায়ে মাটি মেখে ধূলিধুকড়ি হয়ে অকরুণ আকাশের দিকে ধানের বৃষ্টির জন্য চেয়ে থাকবে, সে-জাত এদের নয়। কোনো-একটা মেয়ের প্ররোচনায় এরা মাটিতে হাত দিয়েছিলো, এদের শ্রমে বুধেডাঙা শস্যময়ী হয়ে উঠেছিলো। আজ সুরোকে দেখে এলাম। আলতাপ সান্দারের পৌত্রী, বেলাত হোসেনের কন্যা। চোরাই ব্যবসায়ে লিপ্ত আছে। যাযাবর হয়ে গেলো। মাটির বন্ধনে পড়ে সামাজিক প্রাণী হবার যে-সুযোগ এসেছিলো সেটা চলে গেছে।
কনকের স্ত্রী শিপ্রা ঘরে ঢুকলো। সদ্যস্নাতা একটি সামাজিক প্রাণী।
শিপ্রা বললে–গবেষণা?
সময় কাটাচ্ছি।
শিপ্রা ঝিলিক তুলে বললো–কেউ যদি বলে তোমাদের সকলেরই ঐটি আসল ব্যাপার, ঐ সময় কাটানো? ওদের বাঁচা-মরা তোমাদের নির্লিপ্ত সময় ক্ষেপণের সুযোগ দিয়েছে। এই তোমাদের পলিটিক্স।
তা যদি বলো। কনক খাতা মুড়ে রাখলো–বললে, আলতাপ ফুরকুনির হাসি পাবার লোভে বুধেডাঙায় ঘর বেঁধেছিলো শিপ্রা। আমায় কী করতে হবে বলো।
০৫. মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো
মাধাই সন্ধ্যার পরে ফিরলো স্টেশন থেকে। অন্ধকারে ঠাহর করে সুরোকে দেখে সে একটু অবাক হলো–সুরো না?
–হয়।
কী মনে করে আলি, শহরে গেলি না চাল আনবের?
চাল আনবো? পুলিসের তাড়া খেয়ে পলাইছি।
পুলিস তাড়া করছে? কস কী, কনে?
ছোট ইস্টেশনে। মন কয়, দিঘার বড়ো দারোগা।
তাইলে? মাধাই বারান্দার উপরে তার সবুট একখানা পা তুলে দিয়ে দাঁড়ালো। সে জানে না তার এই দাঁড়ানোর কায়দাটা স্টেশনমাস্টার কোলম্যানসাহেবের। সে ভাবলো : রেল পুলিস ধড়পাকড় করার তোড়জোড় করে মাঝে-মাঝে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়, বোঝানোর চেষ্টা করা যায়। দিঘা থানার দাবোগাকে কী বলবে সে।
কিছু ক’লা?
কবনে। এখন খাওয়া-দাওয়া কর। রাত্তিরে তো টেরেন নাই।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে মাধাই ঘরে ঢুকলো।
রেলের সবচাইতে ছোট পরিমাপের কোয়ার্টারগুলির একটি। সাত-আট হাত দৈর্ঘ্য ও প্রায়। সমপরিমাণ প্রস্থের একখানা ঘর। ঘরের দুটিমাত্র জানলার একটার নিচে মাধাইয়ের খাঁটিয়া। দেয়ালের গায়ে পেরেক থেকে তার জামাকাপড়গুলো ঝুলছে। ঘরে ঢুকে একটা মাটির কলসি থেকে জল গড়িয়ে খেয়ে বিছানায় বসে একটা বিড়ি ধরালো মাধাই।
সুরো দরজার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলো।
মাধাই লঘুস্বরে বললো, এখনো ভাবতেছিস চালের কথা?
কথাটা মিথ্যা নয়। অপ্রতিভ হয়ে সুরতুন বললো, পুলিস ধরলি কবো–মাধাই বায়েনের লোক আমরা? র্যালের লোক ধরলি তা কই।
কইছিস একখান কথা। তোর মাধাই যে র্যালের বড়োসাহেব।–মাধাই হো-হো করে হেসে উঠলো।
হাসি থামলে মাধাই বললো, এখন খাওয়া-দাওয়া কর। কাল সকালে ফতেমারা আসবি বোধায়। তাদের সঙ্গে বুদ্ধি করিস। একটা কিছু ব্যবস্থা হবি।
মাধাই যখন বলেছে কিছু নিশ্চিন্ত হওয়া যায় বৈকি। ছোটো স্টেশনের কনকদারোগা কিংবা দুপুর রোদের দু-ক্রোশ পথ স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু মাধাইয়ের হাসিও মিথ্যা নয়।
এখন ঘুমাবা?
হয়, ডিব্টি দেওয়া লাগবে সারা রাত। স্পেশাল আসবি। বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মাধাই পোশাকপরা অবস্থাতেই খাঁটিয়ার উপরে শুয়ে পড়লো।
সুরো কিছুকাল বারান্দায় বসে থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য বাজারের দিকে গেলো।
বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে মাধাই খানিকটা ভাবলো। তার ভাবনাচিন্তা একখানি স্পেশ্যাল ট্রেনকে কেন্দ্র করে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া দরকার। এখন যে খুব পেয়েছে তা নয়। বরং ঘুমোবার সময়ই এটা নয়। কয়েকদিন আগে শুনেছে সে কথাটা, আজ সেই স্পেশ্যাল আসছে। তাকে সাদর অভ্যর্থনা করার জন্য দেহ ও মন দুটিই সজাগ থাকা চাই। চোখে এতটুকু ঘুম থাকলে হবে না। আগে থেকে ঘুমিয়ে রাতজাগার জন্য প্রস্তুত হতে সে ঘরে এসেছে। কিন্তু ঘুম প্রয়োজনের সময়ে আসে না। মাধাই শুয়ে-শুয়ে বুটসুদ্ধ পা-জোড়া দোলাতে লাগলো।
বোধ হয় একটু তন্দ্রা এসেছিলো। মাধাই ধড়মড় করে উঠে বসলো।