অনেক দিক দিয়ে সার্থক হয়েছে।কর্তব্যরত অবস্থায় উপরওয়ালার চোখে পড়া তার মধ্যে প্রথম। দ্বিতীয়টি তার চাইতেও বড়ো: সান্যালমশাই-এর ছেলে সত্যি আসেনি তার জীবনটাকে দুর্বিষহ করে তুলতে। তৃতীয় একটিও আছে, তাকে কারণ বলা যায় না, কিন্তু তাহলেও উল্লেখযোগ্য: শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রমহিলার সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আলাপ করার সৌভাগ্য সব পুরুষের ভাগ্যে রোজ ঘটে না। আর পরম কৌতুকের বিষয়-তার উপরে নির্দেশ এসেছিলো সান্যালমশাই-এর ছেলে নৃপনারায়ণকে চোখে চোখে রাখার, যখন সে লোকটি পুলিসের হেপাজতে, হয়তোবা সেন্ট্রাল জেলেই।
থানার সামনে বড়ো অশ্বত্থ গাছটার পাতাগুলিকে আলোড়িত করে একটা ঝিরঝিরে হাওয়া আসছে। বারান্দার টেবিলটার সম্মুখে বসে অস্ফুট শব্দে শিস দিতে দিতে আঙুলের ডগা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলটা ঠুকে কনক উঠে দাঁড়ালো। মুন্সিকে ডেকে বললো, আমি চলোম বিপিন, বাসাতে থাকবো। আজ আর ডাকাডাকি কোরো না।
বাসায় ফিরে স্ত্রী শিপ্রার হাতের খানিকটা সেবা নিয়ে কনক শোবার ঘরের টেবিলের সামনে বসলো। কালো রঙের মাঝারি চেহারার পুরনো ডায়েরিখানা খুলে পাতা উল্টে সেতার গবেষণার প্রচেষ্টা-স্বরূপ লেখাটা বার করে ফেলো। তার মনে হলো স্টেশনে দেখার পর পুরো তার মনের অনেকখানি জুড়ে আছে।
সান্দারদের নিয়ে সে আলোচনা শুরু করেছিলো। উচ্চাভিলাষী কিছু নয়। নিজের জানা কথাগুলির পাশে পাশে নিজের চিন্তাগুলিকে গুছিয়ে রাখা।
সান্দারদের উৎপত্তির ইতিহাসটা কনকের কল্পনাজাত। সেখানে সে লিখে রেখেছে নিজের গন্তব্য। এরা নাকি কোনোকালে বাঙালির নৌ-সৈন্য ছিলো। বাঙালির যেদিন নৌসৈন্য রাখার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো এদের একদল হয়েছিলো জলের ডাকাত আর একদল হলো যাযাবর। কিংবা যখন বাঙালির শানিত ইস্পাতের প্রয়োজন ছিলো তখন এরাই শান্দার ছিলো।
আর যাই হোক, এরা যে যাযাবর সে-বিষয়ে কনক নিঃসন্দেহহয়েছে। নিঃসন্দেহ হতে পারার কারণ বুড়ো আলতাপের সঙ্গে পরিচয়। বুধেডাঙার চরে সান্দারদের সেই নিয়ে আসে। এদিকের সান্দাররা তারই জ্ঞাতিগোত্র।
তারও আগে সান্দাররা দু-তিনটে জেলার ব্যবধানে জাত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিলো। জাত-ব্যবসায়টি যে ঠিক কী তা আন্দাজ করতে হবে। আলতাপের কথা ধরতে গেলে সেটা চুরি ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। থানায় দাঁড়িয়ে দারোগার মুখের সামনেও বুড়ো আলতাপ বলতো, ট্রেনে উঠলেই পয়সা। একখান সুটকেস সরাতি পারো পনেরোদিন অ-ভাবনা। বুধেডাঙায় আসবার আগে হয়তো সে-ও ট্রেনে উঠে চুরি করতে যাত্রীদের মালপত্র। অন্তত তাদের ওস্তাদ মেরজান সর্দার করতো। মেরজানের মৃত্যুর ব্যাপারটাই তার প্রমাণ।
প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ির পিছন দিকের জানলা গলিয়ে একটা সুটকেস নিয়ে পালালো মেরজান পুড়াদ’ স্টেশনে। হৈ-হৈ রব উঠলো যাত্রীদের মধ্যে। ইতস্তত করার সময় ছিলো না। পাশে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে, মেরজান চুপ করে একটা মালগাড়ির নিচে গিয়ে বসলো। বসে হয়তো মনে মনে হেসেছিলো সে, কিন্তু হঠাৎ মালগাড়িটাই চলতে আরম্ভ করলো। তখন সেই চলন্ত চাকার ফাঁকে বেরিয়ে আসার জন্যে কত ফিকিরই না সে করেছিলো। প্রাণ নিয়ে যখন টানাটানি তখন মানুষ তার সেরা ওস্তাদি কাজে লাগায়, নাকি সব গুলিয়ে যায় তখন, মাথায় সাধারণ বুদ্ধিও আসে না।
মেরজানের বিবির কাছে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো আলতাপ।
–চাচী, আজ তুই ঘরে দুয়ার দে।
–কেন্ রে, সর্দার আসবি নে?
–না, সর্দার, মনে কয়, আজ আসবিনে।
দু-তিন দিনেও যখন মেরজান এলোনা আলতাপ আর গোপন রাখতে পারলোনা। মেরজান বিবি হাহাকার করে উঠেছিলো।
তখন মাথাঘোরা রোগ ছিলো ফুরকুনির, শুধু অনাহারে নয়, সন্তান সম্ভাবনাতেও। একদিন আলতাপকে পথে চলতে দেখে তাকে থামিয়ে ফুরকুনি বললো–আমার কী হবি, কও?
আলতাপ চোখ মেলে দেখলো ফুরকুনিকে।
আলতাপের যাতায়াত এরপরে বেড়ে গিয়েছিলো। আহা, এ সময়ে সাহায্য না পেলে কোনো মেয়েমানুষই বাঁচে না। আর যাই হোক সে মেরজানের বংশধর বহন করছে। একথাও উল্লেখযোগ্য, মেরজান, যার কাছে সান্দারদের যে-কোনো কন্যা সহজলভ্যা ছিলো, তাকে যে বেঁধে রাখে সেই ফুরকুনিবিবি এই।
কিন্তু আলতাপের যে বয়স তাতে তার পক্ষে বিপন্নকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসা যত সহজ সেকাজে লেগে থাকা তত নয়। মাঝে-মাঝে ট্রেনে চেপে সে উধাও হয়ে যেতো দীর্ঘদিনের জন্য।
একদিন স্টেশনে বসে জুয়া খেলতে খেলতে রোখ চাপলো মাথায়। রাত যখন মাঝামাঝি তখন আর সকলে তাকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিলো ঘর থেকে। পরাজয়ের বেদনার উপর অপমানের জ্বালা। নিজের গ্রামের পথে ফিরতে ফিরতে তার মনে হলো কার কাছে কত টাকা পায় সে, পায় কিনা কারো কাছে। এরকম গোলমাল মাথায় নিয়ে পথ চলতে চলতে আলতাপের মনে হলো ফুরকুনি তাকে অনেক ঠকিয়েছে। কান্নার সুরে কথা বলে অনেক চাল, অনেক টুকিটাক খরচ আদায় করে নিয়েছে সে। এ কী অন্যায়! তার অভিজ্ঞতা কম বলেই তাকে এরকম ঠকাতে পেরেছে সকলে। চুড়ান্ত আক্রোশের একটা গালিতে চরাচরকে অভিহিত করে সে পণ করলো আজ সে হিংস্রতম প্রতিশোধ নেবে।
কানাকড়ি থাকার দিন ছিলো না ফুরকুনির, তা দিন বারোটাই হোক কিংবা রাত বারোটা কিন্তু নেশার মাথায় আলতাপ স্থির করলো–সব মেয়েরাই, বিশেষ করে সান্দারনীরা চোরাই মালের এটা-ওটা সরিয়ে রাখে। ফুরকুনি মেরজানের সময়ের কিছু কিছু কি আর রাখেনি?