কাছারির সম্মুখে বিদেশী লাইম গাছটার পুরনো ডালে কালকের ঘুঘু জোড়া এসে বসেছে। বোধ হয় বাসা বাঁধবে। একটু পরেই দ্বিপ্রহরে স্তব্ধ বিশ্রামের নিকেতন হবে। তখন চঞ্চুচুম্বনের অবসরে ওরা দীর্ঘ টানা সুরে এক-এক বার ডেকে উঠবে।
ওদের কি মন আছে? চিন্তা করার মতো, স্মৃতি থেকে বিচারে পৌঁছবার মতো মন ওদের হয়তো নেই। সামান্যতম মস্তিষ্কও যখন আছে তখন স্মৃতি না-থাকার কী যুক্তি আছে বলো।
লাইম গাছটার পাতা নড়ে উঠতেই গাছটার গোড়ার কাছে রোদের সীমা এসে পৌঁছলো। বেলা তাহলে অনেকই হলো।
কাছারির সদর দরজার বাঁ-দিকে দুটি কাঠের খুঁটিতে একটি কাঠ আড় করে শোয়ানো, সেই শোয়ানো কাঠ থেকে ঝুলেছে পেতলের ঘড়ি। কিছুদিন আগেকার ব্যাপার, সান্যালমশাই দিনের বেলায় ঘড়ি পেটা বারণ করে দিয়েছেন। নতুবা সান্যালগিন্নি অনসূয়ার কাজের হাত থামতে চায় না। দুপুরের বিশ্রাম কুঁড়ে তিনি বলে বসেন–যাই, সময় হলো। আজ আবার ছানাটাও ওরা ভালো করে কাটতে পারেনি। পেটা ঘড়ি বন্ধ হওয়াতে প্রথম যেদিন সান্যালগিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, সেই দুপুরের কথাটা মনে হওয়াতে কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো সান্যালের দৃষ্টি। মামলার কয়েকটি দিন এসব তেমন নজরে পড়েনি। কী অন্যায়!
স্নানের সময় হয়েছে। এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে চাকরকে দেখতে না পেয়ে সান্যালমশাই ডাকে-আসা খবরের কাগজ আর চশমার খাপটি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চাকরও এলো।
দুপুরের ঘুম শেষ হয়েছে। শোবার ঘরের সবচাইতে ছায়া-গাঢ় কোণে গভীর একটা সোফায় ডুবে বসে আছেন সান্যালমশাই, চোখের সামনে বিলেতি পত্রিকা। তামাকের মৃদু-মৃদু শব্দ হচ্ছে।
রূপনারায়ণ মায়ের পাশে বসে ছবি আঁকছে। সান্যালগিন্নি অনসূয়া কী একটা সেলাই করছেন।
রূপনারায়ণ বললো, আজ সকালে রামচন্দ্ররা এসেছিলো কেন, বাবা?
পত্রিকার পৃষ্ঠা উলটিয়ে সান্যালমশাই বললেন–তুমি রামচন্দ্রকেও চেনো?
হ্যাঁ, লোকটি একটা কীর্তনের দল খুলেছে। ওরা বলে নাম কীর্তন করে বেড়ালে দেশের আধিব্যাধি দূর হবে। আমাদের বাড়িতে করতে চায় একদিন।
এতসব খবর তুমি কোথায় পেলে? সান্যালমশাই মৃদু-মৃদু হাসলেন।
একদিন ব্ৰজকান্তবাবুর কাছে বলছিলো ওদের একজন, শুনলাম। তোমার কাছে বলতে সাহস পায়নি।
সান্যালমশাই বই মুড়ে রেখে বললেন–ছোটোবাবু, তুমি চাঁদ কাজির গল্প শুনেছো? চার পাঁচশো বছর আগে একদল বাঙালি কীর্তন দিয়ে দেশের আধিব্যাধি দূর করতে চেষ্টা করেছিলো। তখন এ দেশের রাজা ছিলো কীর্তন শুনতে যাদের ঘোরতর আপত্তি। সেসব কীর্তনিয়া কিন্তু ভয় পায়নি।
তাহলে ওদের আসতে নিষেধ নেই তো?
ওরা তো কীর্তনের কথা আমাকে কিছু বললে না।
তাহলে তোমার আপত্তি নেই। আমি বলে আসি।
রূপনারায়ণ নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেলো।
সান্যালমশাই ছেলের উৎসাহের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসতে লাগলেন।
অনসূয়া বললেন–হাসছো যে?
সান্যালমশাই বললেন, ওদের কথায় একদিন রূপু বলেছিলো, ভালুকে চাষী। সেটা ঘৃণা করে বলেনি, ওদের শক্তির যে রূপটা চোখে পড়েছিলো তারই বর্ণনা করেছিলো ভালুকের সঙ্গে উপমা দিয়ে। তারা মৃদঙ্গ নিয়ে বৈষ্ণব হয়ে গেলে কেমন হয়, তাই কল্পনা করছিলাম।
ওদের মধ্যেও ধর্মভাব আছে। ওরা তো মাঝে মাঝে বারোয়ারি কালীপুজো করে। অসুখ বিসুখ খুব লেগে উঠলেই ওরা একটা না একটা পুজো করে।
সেসব পুজো ওদের মানায়।
কীর্তন ওদের মানায় না এ তুমি কী করে বলো? সেটা তো এখানকারই জিনিস।
গড়গড়ার নলটা দোলাতে দোলাতে সান্যালমশাই বললেন, এমন এক দুর্ভিক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের মহেন্দ্ররা কামান তৈরি করেছিলো, সত্যানন্দরা কীর্তনের বাড়বাগি জ্বেলেছিলো; এবার তোমার স্বামী পালিয়েছিলো শহরে। রাজপুরুষ শ্যালক ছিলো বলেই, নতুবা কী হতো বলা যায় না।
তোমার সব তাতেই হাসিঠাট্টা, ধর্ম নিয়েও তাই।
কে বলছে, কে বলছে? তোমার সঙ্গে হাসিমস্করা? সান্যালমশাই মৃদুমন্দ হাসতে লাগলেন, আমি ওদের আজই খবর দেবো। কীর্তন শুনতে আমিও ভালোবাসি। ব্রজকান্ত এবার যেদিন শহরে যাবে রামগোঁসাই-এর দলকে নিয়ে ফিরবে।
আসলে তুমি বিশ্বাস করো না ওদের কোনোকালে ধর্মে মতি হতে পারে।
সান্যালমশাই গম্ভীরমুখে বললেন–ধর্মে মতি হওয়া খুবই বাঞ্ছনীয় বোধ হয়।
অনসূয়া স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে গাম্ভীর্যটার কতটুকু কপট ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কিন্তু ধর্ম ও কীর্তন নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কাছারিতে ঢুকবার আগেই রূপনারায়ণকে যেমন, দোতলার এ ঘরখানাতে সান্যালমশাইদেরও তেমনি বিস্মিত হতে হলো। বিষয়টা কৌতুকেরও বটে। পাল্কিতে চড়ে এমন হুম-হাম শব্দের মধ্যে অনেকদিন কেউ কাছারিবাড়ির সীমানা পার হয়ে অন্দরবাড়ির দরজায় এসে থামেনি।
পুলিসের লোকেরা আসে। শহরের রাজপুরুষরা বছরে এক-আধবার আসে; আত্মীয়স্বজনরাও আসে। পুলিসের ঘোড়া ও সাইকেল। রাজপুরুষরা আসে সান্যালমশাই-এর ফিটনে। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে আজকাল যারা আসে তারা প্রায়ই গোরুগাড়ি করে আসে। অন্যসব যানবাহন থাকে কাছারির ফটকের বাইরে। কদাচিৎ অনসূয়া যাওয়া-আসা করেন। তার পাল্কি অবশ্য অন্দরেই চলে আসে আট বেয়ারার কাঁধে। আর একজন আসে, সে মনসা। অপরিচিতি হালকা পাল্কির এমন সোরগোল!