কিন্তু মিহির নির্দয়।
তার বাড়ির প্রাচীরের নিচে দিয়ে পশ্চিমমুখী একটা রাস্তা ছিলো। সরকারি রাস্তা নয়। তবু বহুদিন থেকে সাধারণের ব্যবহার্য বেশ চওড়া একটা পথ। চিকন্দি ও সানিকদিয়ারের সংযোগকারী সরকারি সড়কের বড়ো বৃত্তাংশটির দুই প্রান্ত যুক্ত করতে। সান্যালদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা। মিহির একদিন বাঁশ আর কুলকাটা দিয়ে রাস্তার অনেকটা নিজের জমির সামিল করে ঘিরে নিলো।
রামচন্দ্ররা এসে এরই প্রতিবিধান চেয়ে নালিশ করেছিলো।
সান্যালমশাই একদিন মিহিরকে বলেছিলেন–পথটা বন্ধ করে দিলে? লোকের অসুবিধা হবে।
–জমিটা তো লোকের নয়, আমার।
তিনি হেসে বলেছিলেন–সব জমিই তো কারো না কারো। সব পথই তো কোনোনা-কোনো সান্যালের জমির উপর দিয়ে।
মিহির অগত্যা বলেছিলোলোক চলে কোথায় ও-পথ দিয়ে?
কিন্তু পথ সে খুলে দেবে না এটা বোঝা গিয়েছিলো তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে।
এই দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই মামলা লাগলো। সান্যালমশাই থমথমে মুখ নিয়ে কাছারির দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন–নায়েবমশাই, মিহিরের বাড়ির নিচের রাস্তাটা আমার চাই। পুরনো কাগজ ঘেঁটে দ্যাখো একবার।
পুরনো কাগজ ঘাঁটা চললো। সারা গ্রামের কোথায় কতটুকু কোন সান্যালের, এর মোটামুটি হিসাব যত সহজ, সূক্ষ্ম হিসাব তত কঠিন। মোটা হিসাব নিয়ে রোজকার কাজ চলে,টাকা আদায় হয়, লাট দেওয়া চলে। সূক্ষ্ম হিসাব মামলা করে পেতে হয়, মামলা করে রাখতে হয়। সূক্ষ্ম হিসাবের মোট কথা এই সব জমির হিসাব জট পাকিয়ে সব সান্যালের বলে বোধ হয়। পরচা, দানপত্র, কটকোবলায় দুরূহ দর্শনের পাণ্ডুলিপি।
মামলা মানে টাকা নিয়ে খেলা। নিচের কোর্টেই কাগজপত্রের সীমাহীন ফর্দ নিয়ে যখন দাঁড়ালো সান্যালমশাইয়ের নায়েব, তখন মিহির হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। টাকার অভাবে ঠিক নয়, টাকা আঁকড়ে থাকার সহজ প্রবৃত্তিতেই বরং। সহজ বুদ্ধির অঙ্কে সে হিসাব করে দেখলো মামলার শেষ পরিণতি হাইকোর্ট। একতরফা ডিক্রি পেলেন সান্যালমশাই।
মামলাটা তার ভালো লাগেনি। জমিদারিবৃত্তিটাই মামলাসংকুল। মামলার ভয় না থাকলে এক পয়সা খাজনা আদায় হয় না। কিন্তু সেসব মামলার প্রবক্তা নায়েবমশাই, সেগুলিতে এমন করে রক্ত গরম হয়ে ওঠে না, এমন করে পুড়ে পুড়ে ক্ষয় হয় না স্নায়ু। শুধু সম্মান রাখার এই মামলায় মিহিরকে নত করাই সার্থকতা। এ-সব আর ভালো লাগে না। যেন অন্য কেউ তাঁকে নিয়োগ করেছিলো এ ব্যাপারে।
সান্যালমশাই বললেন আবার–মিহিরের কাছেই বরং যাও একবার। সে-ই খুলে দেবে পথ।
তা নয়, আজ্ঞা। মিহিরবাবু সকাল থেকেই পথ খুলে দেওয়ার জন্য লোক লাগিয়েছেন।
তবে আর কী থাকতে পারে?
রামচন্দ্র সঙ্গীদের নির্দেশ করে বললো–কর্তা, এরা যে মরে। মরার বাড়া গাল নাই। তাই হইছে এদের। মিহিরবাবু এদের ভিটাছাড়া করবেন।
ব্যাপারটা এই : মিহিরের বাড়ির অনতিদূরে শাঁখারিদের পাড়া। একসময়ে খুব বাড়বাড়ন্ত ছিলো এ পাড়ার। এমনকী দালানকোঠা তোলার মতো সচ্ছলতাও হয়েছিলো ওদের কারো কারো। এখন যারা আছে তারা শাঁখা তৈরি করা ভুলে গেছে। যারা পেরেছে শহরে পালিয়েছে, যারা পালায়নি তাদের একাংশ উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করে ধুকছে, অবশিষ্ট চাষী হচ্ছে। পাড়াটার সবটাই মিহিরকে খাজনা দেয়। যেসব ভিটায় অধিবাসী নেই সেগুলি সে বাকি খাজনার দায়ে খাস করে নিচ্ছে। খাস করে নেওয়াটার ভালোও আছে। জঙ্গলের বদলে সেগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে মিহিরের বাগান হয়েছে। স্বাস্থ্যের পক্ষে এ-পরিবর্তনটা বোধ হয় ভালো। কিন্তু খাস করতে শুরু করে সে থামতে পারছে না, বাকি খাজনার দায়ে অনবরত এর-ওর নামে ডিক্রি আনছে। শাঁখারিদের মাতব্বরস্থানীয় হরিশচন্দ্র একদিন মিহিরের স্নেহ পেয়েছে। কিন্তু এই মামলাটায় সান্যালমশাই-এর নায়েবের চক্রান্তে মিহিরের বিপক্ষে সে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে। তাই মিহিরের লোক গেছে সদরে তার নামে মামলা করতে আজকেই রাত থাকতে উঠে।
কথাটা শুনে ভাবলেন সান্যালমশাই।
কিন্তু নীরবতায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার লোক নয় রামচন্দ্র। একটু পরে সান্যালমশাই বললেন–এতে আমার আর কী করার আছে রামচন্দ্র, তোমরা যা বোঝে করো গে।
রামচন্দ্র তার গোঁফটিকে সূক্ষ্ম দু-ভাগে ভাগ করে নিলো। তারপরে বললো–রাজা যদি প্রজাকে রক্ষা না করেন, সে তো অরাজক, আজ্ঞা!
জুতসই কথা বলার সুখে রামচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগলো। সান্যালমশাই-এর বলতে ইচ্ছা হলো–আদালতে যাও তবে, রাজ্য চালানোর ভার আমার উপরে নেই। কিন্তু থামলেন তিনি। রামচন্দ্রর অবক্তব্য কিছু নেই। আদালতের কথায় হয়তো সে বলে বসবে–এই আদালত, ফিস দিব, আজ্ঞা করেন। লোকটি হামেশা আসে না কাছারিতে। খাজনা বাকি ফেলার দলে নয় সে যে তলব তাগাদায় হাজিরা দেবে।বরং তার উল্টো। খাজনা দেওয়ার সময় এমন ভাব দেখায়, যেন আরো বেশি খাজনা দিতে পারলেই সুখী হবে। তার কথাবার্তায় চালচলনে একটা নাটকীয়তা আছে। তার সরলতাকে কৃত্রিম বলে বোধ হয়।
রামচন্দ্র বললো, কর্তা, এ গাঁ গড়-চিকন্দি। রায়রা জমিদারি করেছে, সান্যালরাও। কিন্তুক কোনোদিন কোনো সান্যালকর্তা অত্যাচার করে নাই প্রজার উপর। লোকে কয়, কাছারি তো সান্যাল-কাছারি, যাও, বিচার পাবাই। দোষ করো, পায়ের কাছে লাঠি রাখে দণ্ডবৎ হও, সাতখুন মাপ। কর্তা, সেই সান্যালের দুয়ারে আসছি আমরা।