মাধাইয়ের ঘরের নিচু বারান্দাটায় পৌঁছে কিছুকাল একেবারে ঝিমহয়ে বসে রইলো সুরতুন। দুপুর রোদে দু-ক্রোশ পথ চলে সে যেন অন্তঃসারবিহীন হয়ে গেছে। চলার সময়ে এতটা বোঝ যায়নি।
শরীরটা একটু স্বাভাবিক হলে আবার দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে এলো। কী হবে তাহলে? চালের কারবার কি বন্ধ করতে হবে? অনাহারে মৃত্যু? ফতেমার সঙ্গে তার পার্থক্য আছে, আবার মনে হলো তার। ফতেমার গ্রামে ফিরলেও চলবে। কষ্ট হবে, অনেকদিনই তাকে অনাহারে থাকতে হবে, তবু তার শ্বশুর এবং সে দুজনের সম্মিলিত চেষ্টায় অর্ধাহারে দিন কাটাতে পারবে। কিন্তু তার নিজের? এব্যবসা যত কষ্টের হোক, যত বিপজ্জনক হোক, এ ব্যবসায়ে নামার আগে আহার যে এমন নিয়মিত হতে পারে এ-ও সে জানতো না। পুলিসের ভয় ছিলো, চেকারের ভয় ছিলো। কিন্তু ছোট স্টেশনটাতে কনকদারোগার উপস্থিতি পুলিসি ভয়কে সহ্যাতীত করেছে, এবং টেপির কথা শুনে এবং টেপিকে দেখার পর চেকার আজ এক নতুনতর বিভীষণ মূর্তি নিলো। হায় হায়, সে কী করবে!
কিছু পরে সে অবশ্য স্থির করলো, মাধাই আসুক। যা করার সে-ই করুক। তার নিজের বুদ্ধি আর কতটুকু।
০৩. অন্দরের আঙিনায়
অন্দরের আঙিনায় সকালের পায়চারি ও আলাপচারিতা শেষ করে সান্যালমশাই কাছারিবাড়িতে এসে বসেছেন। আমলারা আসেনি, কাছারিবাড়ির বুড়ো চাকরটি সান্যালমশাইয়ের ফুর্সির জল বদলে অন্যান্য হুঁকোগুলোর দিকে মন দিয়েছে।
সান্যালমশাই বসতেই সে নিবেদনের ভঙ্গিতে বললো, তামাক দি, কর্তা?
তামাক? না, থাক।
সান্যালমশাই তামাকটা খুব বেশি খান। অনেকের চোখে তিনি ও তার তামাক অবিচ্ছেদ্য। ভৃত্যটি হুঁকোয় জল বদলাতে বদলাতে তার মুখের ভাবটি পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো। অসুখ বিসুখ করলে কিংবা খুব ক্রুদ্ধ হলে তামাকে তার মন থাকে না। এটা এদের সকলেরই জানা। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করা কাছারিবাড়ির প্রথা নয়। অন্দরের কোনো ভৃত্য হলে হয়তো সাহস করে প্রশ্ন করতে পারতো।
ভৃত্য চলে গেলে সান্যালমশাই ভাবলেন, দ্যাখো অভ্যাসটা কী! তামাকের নাম শুনে তিনি প্রায় হাত বাড়িয়েছিলেন। অথচ কাল রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে তিনি চিন্তা করে স্থির করেছেন তামাক খাওয়া কমিয়ে দেবেন। স্বাস্থ্য? না। সংযম? দূর করো। এ বয়সে সংযম-অসংযমের প্রশ্ন আর ওঠে না। পঞ্চাশ পার হলো। শুধুমাত্র স্নায়ুগুলিকে আর-একটু থিতিয়ে দেওয়া, যাতে সেগুলি সহজেই উত্তেজিত না হয়ে পড়ে। আর এ কথাগুলি চিন্তা করতে গিয়ে তিনি তার আর এক সহগামীকে আবিষ্কার করেছেন এক মুহূর্তের জন্য যে কতগুলি অভ্যাসলব্ধ মুদ্রাদোষের সমুষ্টি, কতগুলি বাঁধিবুলির রেকর্ড। এবং এই সহগামীর নাম খুঁজে না পেয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘পশ্চাতের আমি’ কথাটাই তার সম্বন্ধে প্রয়োগ করেছে। তখন সেই ‘পশ্চাতের আমি’র হাত থেকে আহোদ্ধার করার ইচ্ছাও তাঁর হয়েছিলো।
মামলাটা শেষ হবার আগে থেকেই এ সন্দেহটা হচ্ছিলো তাঁর, এটা না করলেও চলতো। কিন্তু সেটা যত সময় নিচ্ছিলো ততই স্নায়ু উত্তেজিত হচ্ছিলো আর ততই জেদের ফন্দি ফিকিরগুলো আসছিলো মাথায়।
যাক, হবার যা হয়ে গেছে।
কাল, রাত্রি তখন বারোটা, আইন-সেরেস্তার আমলা ব্রজকান্ত এসে খবর দিলো, মিটেছে। খবর দেওয়ার কথা ছিলো, সেজন্য সে নিজের বাড়িতে না গিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে অত রাত্রিতে খবরটা পৌঁছে দিয়েছিলো।
দোতলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে সান্যালমশাই নীরবে খবরটা উপভোগ করলেন, তারপর বললেন–তুমি তাহলে এবার বিশ্রাম নাও, দারোয়ানদের কাউকে বরং নিয়ে যাও, এগিয়ে দেবে।
সে চলে গেলে তামাক নিয়ে বসেছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন, আর নয়। মিহিরকে ডেকে একবার বলবেন ব্যাপারটাকে বরং তুমি ভবিতব্য বলে মেনে নিও। তাহলে আর জ্বালা থাকবে না।
দিনের আলোয় এখন তিনি অনুভব করছেন, রাত্রিতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এটা সম্ভব বলে বোধ হলেও, এ কথাগুলির দৈনন্দিন অর্থ সান্ত্বনাপ্রদ নয়। বরং মিহিরের মনে হতে পারে, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়াই তার উদ্দেশ্য। সময় তার কাজ করুক।
কিন্তু মোকদ্দমার সংবাদ প্রত্যুষেই ছড়িয়ে পড়েছিলো। রামচন্দ্র এলো, সঙ্গে আট-দশজন লোক।
রামচন্দ্রের হাতে একটা লাঠি, মাথায় গামছা বাঁধা। সে এসেই লাঠিসমেত সান্যালমশাইয়ের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলো। লাঠিটা রইলো তার পায়ের তলায়।
সান্যালমশাই বললেন–সকালেই খবর পেয়েছো বুঝি? কিন্তু একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, এ নিয়ে কোনো হৈচৈ আমোদ-আহ্লাদের ব্যবস্থা কোরো না।
আজ্ঞা না কর্তা, তা হবে না।
তিনি বললেন, তোমাদের জেদ বজায় রইলো, কিন্তু আর টানাটানি কোরো না। এখন বরং মিহিরের কাছে যাও। আমি একটু কাজ করি।
রামচন্দ্র উঠবার ভঙ্গি করলো। বারান্দা থেকে সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়ালো, তারপরে সঙ্গের লোকগুলোকে বললো, রাজার কাছে কথা, তোমরাই বলো না কেন কী কথা আছে তোমাদের।
আর কেউ কথা বললো না, রামচন্দ্রকেই বলতে হলো।
আজ্ঞা, মামলার সাথে সামিল।
সান্যালমশাই একটু উত্তেজিত স্বরে বললেন–না-না। আর বোলো না।
মামলাটার সূত্রপাত করেছিলো রামচন্দ্ররাই এমনি করে সাধারণ কথাবার্তা থেকে।
মিহিরও সান্যালবংশের ছেলে। শৈশবে তার পিতার মৃত্যু হয়। তার মা অনেক কষ্টে ও গ্রামের চোখে সান্যালদের মর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ হয় এমন অনেক কাজ করে তবে মানুষ করতে পেরেছিলো তাকে। এখন সে নিজের ভার নিজে নিয়েছে, কিছু কিছু সম্পত্তি বাড়িয়েছেও। উদ্যমশীল সে। কোনোনা-কোনো পরিকল্পনায় সে সবসময়েই লেগে আছে। ইতিমধ্যে সে নিজের বাড়ির চারিদিকে পড়ে যাওয়া প্রাচীরের জায়গায় নতুন প্রাচীর তুলেছে।