- বইয়ের নামঃ গড় শ্রীখণ্ড
- লেখকের নামঃ অমিয়ভূষণ মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাঙাল নদী পদ্মা
গড় শ্রীখণ্ড – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার
প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৭ সংস্করণ : ১৯৮৭
আমার সবচাইতে পরিচিত পুরুষ চরিত্র
বাবাকে উৎসর্গ করলাম
.
যেমন সুরতুন। সুরতুন তো প্রেমে পড়ার মুখেই ছিলো, তার অবচেতনে একটা ভয় ছিলো পুরুষের প্রতি-সেই জন্যে যাকে ভালোবাসতো সেই মাধাই বায়েনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারলো না। কিন্তু ইয়াজ তাকে তাকে উইন করছে কীভাবে? চলল আমি তোমাকে তোমার প্রেমিকের কাছে নিয়ে যাবো, মাধাই বন্যায় ডুবে যেতে পারে, তুমি একলা যেতে পারবে না–এই বলে তার সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে বন্যার জলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থায় সে-ও তো যুবক, সে-ও তো সুরতুনকে কামনার চোখে দেখে এসেছে–যেহেতু ঠিক জীবনের পরিপোষক নয়, সে মরবিড হয়ে গেছে, সেখানে জীবন ইয়াজের চেহারা নিয়ে সুরতুনকে ফিরিয়ে এনেছে। তারা ফিরে আসছে। যে-চরে উপস্থিত হয়েছে, সেখানে আদিগন্ত সেই চর থেকে জল সরে গেছে, শুধু কাদার পাথর, কিছু দেখা যায় না। শুধু দেখা যাচ্ছে, চরণকাশির আলেফ সেখ–তারও তো কলকাতার দাঙ্গায় ছেলে গেছে, যে-ছেলে জীবনকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে : ডাক্তার ছিলো, ফুটপাথে রোগী পড়েছিলো, তুলে আনতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। তা, সেই আলেফ সেখ এই বন্যা-ছেলের মৃত্যু-দেশভাগ রাজনীতি কিছু ভাবছে না : সে লাঠি হাতে দেখছে উপরে যে বালি পড়েছে তার কত নিচে পলিমাটি, অর্থাৎ পলিটা সরিয়ে সে চাষ করবে–এই দেখছে। এই দেখে সুরতুনকে ইয়াজ বলছে যে আমি আমার কাপড় থেকে আর-একটু ছিঁড়ে দি, তুই গায়ে জড়িয়ে নে। ওই দ্যাখ আলেফ সেখ, মনে হয় ওর কাছে গেলে কিছু খাবার পাওয়া যাবে। অর্থাৎ সেখানে কী? জীবন সৃষ্টি হচ্ছে সুরতুনের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করছে ইয়াজ। দেখছে, এই লাইফটা আমরা হাতে পেয়েছি, দ্যাখো ওই মসজিদটা। এবং সে সময়ে লেখকের একটা কথাই মনে হয়, সেটা হচ্ছে, উপরে মেঘ ডাকছে, পদ্মর মুখ কালো হয়ে উঠছে। পদ্মকে বলছে : হে কাল-পদ্ম যেন কাল, কালের প্রতিমা-তুমি দয়া করো। এই যে কালপ্রবাহ, পদ্মার মতো এদিক-ওদিক টার্ন নিচ্ছে, আমরা কষ্ট পাচ্ছি, বুঝতে পারছি না এর মধ্যে ক্যারাকটার তৈরী হয়ে গেছে। তাই কাল, তুমি দয়া করো, অর্থাৎ ধ্বংস কোরো না। জীবনে যারা সবচাইতে বঞ্চিত, সেই শ্রেণী জীবনে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে, তুমি দয়া করো। ছোটোখাটো জিনিস দিয়ে আমরা জীবনের আয়োজনকরছি–এটা কিন্তু চিরস্থায়ী, কালকে সারপাসকরে যাচ্ছে।–১৯৮৩
.
০১.
বাঙাল নদী পদ্মা এখানে বন্ধনে পড়েছে, ‘বিরিজ’ বলে লোকভাষায়। দুর্ধর্ষা গণগামিনী গঙ্গাকে সে কোন তরুণ আদর করে পদুমা–পদ্মা বলেছিলো এবং
আপন করেছিলো তা কেউ বলতে পারে না; সে ভালোবেসেছিলো কিন্তু বন্ধন। করার চেষ্টা করেনি। তার সর্বনাশা কূলনাশিনী গতিকে শ্রদ্ধাও করেছিলো। এখন ভালোবাসা বংশধরদের রক্তে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভয়ের সমন্বয়ে সব চিন্তা সব ভাবনার পিছনে ধর্মের অদৃশ্য দৃঢ় ভিত্তি হয়ে আছে।
রেলের লোহার আলকাতরা-মাখানো বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে পুরো আকাশের দিকে চেয়েছিলো। তার মাথার উপরে একটি বিরলপত্র শিশু ছাতিমের শাখা, বাকিটুকু চৈত্রমাসের আকাশ। ইতিমধ্যে রোদ কড়া হয়ে উঠেছে। দূরের দিকে বায়ুমণ্ডল ঝিলমিল করে কাঁপছে। চিলগুলো খুব উঁচু থেকে পাক খেতে-খেতে খানিকটা নেমে এসে উল্টোপাকে আবার উঁচুতে উঠে যাচ্ছে। ডানদিকে আকাশের গায়ে লোহার ব্রিজ।
স্টেশনে লোকজন নেই। সুরো-সুরতুন্নেছা–প্রায় একা ট্রেনের প্রতীক্ষা করছে। প্ল্যাটফর্মের বিপরীত প্রান্তে একটা হাত-তিনেক উঁচু তাঁবু খাড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছে। তাবুর কাছে রূপালী রং করা গুটিকয়েক টেলিগ্রাফের পোস্ট, পাকানো তারের বান্ডিল। সেগুলো এত উত্তপ্ত হয়েছে, মনে হয় চোখে লাগবে সেদিকে চাইলে। পেতলের বড়ো বড়ো থালা মেজে নিয়ে কয়েকজন। মজুর আধঘণ্টা আগে শেষবারের মতো তাঁবুতে ঢুকেছে। কোন দেশীয় এরা কে জানে। পশ্চিমের নয়, তা পুরো ওদের কথায় বুঝতে পেরেছে। কুচকুচে কালো, চুলগুলি ভেড়ার লোমের মতো, চোখগুলো লাল করর্চা। পায়ে ভারি-ভারি জুতো, কালচে-সবুজ রঙের প্যান্ট পরনে।
ব্রিজটা অত্যন্ত উঁচু, তার ধরাছোঁয়া পাওয়ার জন্য গ্রামের জমি থেকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মও উঁচু। এত উঁচু যে বড়োবড়ো তালগাছগুলিও পায়ের নিচে থাকে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ালে। সেই তালগাছগুলির পায়ের কাছে পোডোজমির মধ্য দিয়ে গ্রামে যাওয়ার পথ।
প্ল্যাটফর্ম থেকে ঢালু হয়ে জমি নেমে গেছে গ্রামের মাটির দিকে, সেই ঢালু বেয়ে পাকদণ্ডির মতো আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা উঠে এসেছে। সেই রাস্তার পাশে সোনালি-লতায়-ঢাকা আমগাছের আড়াল থেকে একটা ধোঁয়া পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আগুন নাকি? ভাবলো সুরো। নিচের দিকে ভালো করে তাকালো সে আবার। ধোঁয়ার পাকটা এগিয়ে আসছে। ধুলোর থাম–তাহলে বোধহয় পাল্কি আসছে, বেহারাদের পায়ে-পায়ে ধুলো উড়ছে, ঘূর্ণিপাকের মতো হচ্ছে এলোমেলো বাতাস লেগে–এই ভাবলো সুরো। সে ভালো করে চেয়ে দেখলো–একজন। কে আসছে ঘোড়া ছুটিয়ে।