দারুণ বিপর্যস্ত অবস্থা অনুর। এই গেনদু আর মিয়াচাঁনরা যখন ফালানিদের হাতে অসহায়ের মতো মার খায়, ঘাড় গুঁজে মুখ বুজে সহ্য করে অন্যায় উৎপাত, তখন অন্যরকম মনে হয়েছে অনুর। কতো রকমেরই চেহারা এদের, কতো অচেনা, কতো ঝোপের আড়ালে না আত্মগোপন করে আছে এরা সকলে।
কি করবে ভেবে পেলো না সে।
কিছুক্ষণ একেবারে হাবার মতো হা করে দাঁড়িয়ে থকিলো, তারপর ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা সাহস দেখিয়ে বললে, ওরা খুবই বজ্জাত, আমি তোমাকে পেয়ারা কিনে দিতে পারি, নেবে?
মেয়েটা চোখ মুছে কি যেন ভাবলো। ধরাগলায় বললে, পাবি কোথায় যে কি দিবি?
অনু সাগ্রহে বললে, চলো না, খুঁজে দেখি কোথাও পাওয়া যায় কিনা।
বোঝা গেল মেয়েটি খুব খুশি হয়েছে। ইচ্ছেমতো অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর বললে, না পেলে তোর যা খুশি কিনে দিবি।
পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলো অনু। হাঁটতে হাঁটতে বারবার তার আপাদমস্তক মুখস্থ করতে লাগলো মেয়েটি।
এক সময় বললে, তুই খুব সুন্দর দেখতে রে। তোরা সায়েব মানুষ তাই?
উত্তরের কোনো অপেক্ষা না রেখে তারপর আবার বললে, আমার আরো বন্ধু আছে। আমাদের পাড়ার বিশুয়ালাল আর হরিয়া। ওরা কতো কিছু দেয়। আমাকে। কাঁচপোকা ধরে এনে দেয়। দাদাপাখির পাখনা কুড়িয়ে এনে দেয়। ফলশা মিছরি এসব কিনে এনে দেয়। আমি মিছরি খেতে খুব ভালোবাসি।
অনু বললে, তুমি কোন্ পাড়ায় থাকো?
ঋষিপাড়ায়। আমার নাম সরুদাসী।
কতোদূর এখান থেকে তোমাদের বাড়ি?
কাছেই তো। চলনা আমার সঙ্গে, দেখে আসবি।
কি মনে করে অনু জানতে চাইলো, তোমাকে কেউ বকবে না?
বলে আমার বয়েই গেল! আমি কি কারো বকুনির পরোয়া করি? মা উঠতে বসতে কম গুতান পুঁতায় নাকি। চামারনীটা মরেও না, মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো!
পাশে একটা মুদিখানা দেখতে পেয়ে অনু সাগ্রহে বললে, পেয়ারা তো কোথাও দেখলাম না, মিছরি কিনে এনে দেবো তোমাকে?
সরুদাসী বললে, গুঁড়ো নিসনে যেন আবার, বড়ো বড়ো দেখে বেছে নিস।
তারপর হাতে মিছরি নেবার পর বললে, ভালো বাছতে পারিসনিরে, হুঁশো পেয়ে ঠকিয়ে দিয়েছে। আমি যদি যেতুম তা হলে আর ফাঁকিবাজি চলতো না। রতিরঞ্জন পসারীটার মতো বাঁদর এ তল্লাটে আর একটাও নেই, বুঝলি?
চেন নাকি তুমি?
হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর ওই কানটো করা হাসি দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। বেহায়ার রাজা। আশপাশের ধুমসী চাকরানী হুঁড়িগুলোর মাথা ওই-ই তো খাচ্ছে। জামা তুলে গা দেখালে দুটো বাতাসা, গায়ে হাত দিতে দিলে তেল-সাবান, কম নচ্ছার ওটা! জুতসই একটা ঠ্যাঙানি না পড়লে সিধা হবে না। আমার কাছে কিন্তু পাত্তা পায় না, হু! আমাকে কি বলে জানিস? বলে তুই এখনো এক বাতাস, দু বাতাসার যুগ্যি হস নি। পোক্ত হয়ে নে তারপর দেখবো তোকে। আমিও বলেছি, দেখিস, বাপের বেটা হলে দেখিস?
অনু চুপচাপ সব শোনে।
সরুদাসী কি মনে করে আবার বললে, জানিস, কাল দুপুরে আমি কিন্তু হরিয়ার কাছ থেকে মিছরি নিই নি–
খুব আশ্চর্য হয়ে অনু বললে, কেন?
ইশ! তখন যে আমার ঘুগনি খেতে সাধ হচ্ছিলো। আমি কি শুধু মিছরি খাবো বলেই জন্মেছি? মাখনা, ফলশা, চানা, সেঁকামাংস এসবও তো খুব মজার জিনিস। সেঁকামাংস যা মজার, ইশ! একটা কথা, তুই ওইসব হাঘরে ছোটোলোক ছেলেদের সাথে খুব মাখামাখি করিস, নারে? কুটোকাটাগুলো সব পচা জাতের, তোর ঘেন্না করে না? তুই কতো ভালো। কতো সুন্দর। আমি যদি তোর মতো হতে পাত্তাম!।
অনু নিজের অভ্যন্তরে নদী হয়ে গেল একথায়। তার মনে হলো সরুদাসী খুব ভালো মেয়ে। ফকিরা, ফালানি, মিয়াচাঁন, গেনদু সরুদাসীর পায়ের কড়ে আঙুলের যোগ্যও কেউ নয়। কি সুন্দর কথা বলে সরুদাসী; পাকা গিন্নী মনে হয় তার। কি ঝকঝকে সরুদাসীর দাঁতগুলো!
আর মনে হয় বিশুয়ালাল (কুশ্রীময়লাদরিদ্র) যা পারে না, হরিয়া যা পারে, খুব সহজে সে তা পারে। সরুদাসী ইচ্ছে করলেই যে-কোনো সময় তার কাছে থেকে খুশিমতো ঘুগনি নিতে পারে, মাখনা নিতে পারে।
এমন একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠলো তার ভেতরে যে গেনদ মিয়াচাঁনের দ্বিপ্রহরিক সব সঙ্গকে এক লহমায় ঘৃণ্য মনে হলো; এরা সবাই তাকে গাড়লের মতো গাছের গুঁড়ি বানিয়ে চারপাশে লুকোচুরি খেলা খেলছে। তাকে ঠকিয়েই ওদের আনন্দ। ওরা চায় অনু বোকা থেকে ওদের খেয়ালখুশির রসদ জুগিয়ে চলুক। কতকটা অস্বাভাবিকরকম মরিয়া হয়ে সে বললে, আমি ঘেন্না করি ওদের! ওরা লোভী হ্যাংলা।
সরুদাসী খুব সংযতকণ্ঠে বললে, মিশিস না ওদের সঙ্গে। চোর-হঁচড়া আর গাঁটকাটার পাল ওগুলো। সবকটা জোচ্চোর আর ক্ষুদে বাটপাড়! আচ্ছা তোদের বাড়ি অনেক বড় নারে?
অনু বললে, দোতলা।
ইশ কি আরাম তোদের ওপর থেকে নিচের দিকে দেখতে যা ভালো লাগে! আমি একবার চারমানবাবুদের বাড়ির দোতলায় উঠেছিলুম, মা-ও ছিলো। মা চারমানবাবুর বৌয়ের ছেলে ধত্তে গিয়েছিলো, সঙ্গে আমিও গিয়েছিলুম। আর শোন, খুব মজার একটা কথা–
অনু খুশিতে উচ্ছল সরুদাসীর মুখের দিকে ঘাড় ফেরালো।
চারমানবাবুর ছোটো মেয়েটার না, বিয়ে না হতেই পেট হয়েছে! হেসে। গড়িয়ে পড়ার উপক্রম করে মুখে হাত চাপা দিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সরুদাসী, তারপর আবার বললে, মাকে বলে কিনা পেট ফেলে দিতে পারলে পঁচিশ টাকা দেবে। যা তা ব্যাপার নাকি? মা পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছে, একশো টাকা না হলে ও কাজে হাত দেবে না, পাপ আর কি। ইশ, কী উঁচু নাকই না ছিলো হুঁড়িটার। ধরাকে একেবারে সরা জ্ঞান, দেমাকে মাটিতেই পা পড়তো না। আমি দোতলায় উঠেছিলুম বলে দূর দূর করে তাড়কা রাক্ষসীর মতো খেকিয়ে এসেছিলো আমার দিকে, তলে তলে আবার এতো! আমি হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম, ছি করো, ছি করো!