- বইয়ের নামঃ কালো বরফ
- লেখকের নামঃ মাহমুদুল হক
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বুড়ো আঙুল চোষা
তখন আমার অভ্যেস ছিল বুড়ো আঙুল চোষার। কখনো পুকুরঘাটে, কখনো বারান্দার সিঁড়িতে, কখনো-বা জানালায় একা একা বসে কেবল আঙুল চুষতাম। আঙুলের নোনতা স্বাদ যে খুব ভালো লাগতো, ঠিক সে রকম কোনো ব্যাপার নয়। তখন ভালোলাগা বা মন্দলাগা এসবের কোনো ঝক্কি ছিল না, যতোটুকু মনে পড়ে; পৃথিবী যে গোল, একথা শুনে কানমাথা রীতিমতো ঝাঁ ঝাঁ করতো। সে একটা গোলমেলে বিষম ব্যাপার। ভাবতা আমরা তাহলে কোথায় আছি, কমলালেবুর তলার দিকে না ওপরের দিকে; তলার দিকের মানুষজনের তো টুপটাপ ঝরে পড়ার কথা।
একবার সাধুখাঁদের ছেলে পাঁচু কাচের চুড়ির একটা শেকল আমাকে উপহার দেয়, শেকলটি তার বোন ঝুমির। ঝুমির পুতুলের বাক্স থেকে সে ঐ জিনিসটি হাতিয়েছিল। শেকলটি আমি লুকিয়ে রাখতাম। আমার ধারণা ছিল অমন সুন্দর জিনিস খুব বেশি একটা নেই কারো কাছে।
ঝুমি প্রায়ই আমাদের বাগানে ঘোরাফেরা করতো। সামনাসামনি পড়ে গেলে মুখ নিচু করে পালাতে চাইতাম, চোখ তুলে কথা বলতে পারতাম না, ভয়ে বুকের ভেতর গুবগুব করতো। ঝুমি যেদিন জিগ্যেস করলে এ্যাই, পাঁচু তোকে কিছু দিয়েছে–সেদিন ভয়ে আমি কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল নিছক কথার কথা, ঝুমি আমার কথা জানতো না।
সে যাক, রঙিন ভাঙা চুড়ির শেকল যে খুব সস্তাদরের, একথা আমি জেনেছিলাম আরো অনেক পরে।
এই ধরনের একটা বয়েস।
এটা ঠিক যে, আমার এই আঙুল চোষার ব্যাপারটা বাড়ির কারোই তেমন পছন্দের ছিল না, মার কাছে তো নয়ই। অনেক খোঁচা খেয়েছি এর জন্য। এই হাবলুটাকে নিয়ে হয়েছে আমার যতো ঝক্কি এই বলে আমার গাল থেকে আঙুল বের করে দিত মা। আমি তো জানিই, নচ্ছরটা আমাকে জ্বালাবে— রেগে গেলে মা বলতো, পেটে থাকতেও দিনরাত হেঁড়েমাথাটা কি কম জ্বালান জ্বালিয়েছে আমাকে।
দুটোর কোনোটাই বোধহয় মিথ্যে নয়। খুব সম্ভব আমি কমবেশি হাবাগোছেরই ছিলাম। ঠোঙার একটা নকুলদানা পড়ে গেলেও ধুলেমাটি থেকে তা কুড়িয়ে গালে পুরতাম। পুঁটি নামের যে আলতাপায়ে মেয়েটি রোজ আমাদের পুকুরঘাটে গুচ্ছের পেতল কাঁসার থালাবাসন নিয়ে বসতো, সেও আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়ের বস্তু।
অনেকক্ষণ ধরে বসে সে পিতলের থালা বাসনে নুড়ো ডলতো আর পিনপি করে গান গাইতো, পকেটে চেন ঝুলিয়ে চোদ্দসিকের বাবুয়ানা–তার সে মাজাঘসা আর শেষই হয় । এর মধ্যে দুচারবার ডাক তো আসবেই, পুঁটি, অপুঁটি মরলো নাকি ছুঁড়ি!
যতোবারই ডাক আসবে তার সেই একই জবাব, যাইমা–
ধেড়ে মাছ ছিল একটা পুকুরে, রুই কি কাতলা, বয়েসের কোনো গাছপাথর ছিল না মাছটার; কি করে যেন সে ঠিকই টের পেত পুঁটি ঘাটে এসেছে। পুকুরের ঠিক মাঝখানে দুচারটে ঘাই মেরে, তারপর একডুবে সে সরাসরি ঘাটের কাছে হুপুস করে ভেসে উঠতো। পুঁটি হয়তো তখন ঝিনুক দিয়ে চেঁচে চেঁচে দুধের হাঁড়ির পোড়া সর খাচ্ছে। রাখ, তোর হ্যাংলামি আমি একদিন বার করবো, কি ছোঁচারে বাবা–মাছের সঙ্গে এইভাবে কথা শুরু করে দিত পুঁটি, এতো নোলা কেন? রোজ জ্বালাতন! রোজ জ্বালাতন!
বলতাম, তোমার কথা বোঝে?
ওমা, বুঝবে না কেন। পুঁটি পড়তো আকাশ থেকে। বলতো, আমিও তো ওর কথা বুঝি। ঐ যে বুড়বুড়ি তোলে, ঐসবই তো ওর কথা। কি বলে জানিস? বলে, ও পুঁটি, তুমি কি ভালো মেয়ে, তোমার মুটুকপরা রাজপুতুরের মতো টুকটুকে বর হবে, তুমি সোনার পালঙ্কে শুয়ে ঘুমুবে, হাজারগও দাসী-বাঁদী তোমার পা টিপবে, এখন তুমি আমাকে একটু সরের চাছি খেতে দাও
সত্যি তুমি সব কথা বোঝ?
সত্যি না তো কি মিথ্যে! রোজ রোজ কতো আশীৰ্বাদ করে আমাকে! আর করবে নাই বা কেন, সর খেতে কার না ভালো লাগে!
পুঁটির যে গাছ-গাছড়ার সঙ্গে কথা হয়, এও আমার নিজ চোখে দেখা। আকন্দগাছের গোড়ায় ঘটি উপুড় করে দিয়ে সে বলতো গাছভাই গাছভাই, এই দ্যাখো আমি তোমার গোড়ায় একঘটি জল দিলাম, আমার যেন খুব ভালো বর হয়, নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, একটা ডালপালাও তোমার আস্ত থাকবে না–
শিমুলগাছ ছিল একটা, চুপি চুপি তার গোড়াতেও ঘটি উপুড় করা বাঁধাধরা কাজ ছিল। বলবে, কি থেকে কি আসে কি থেকে কি হয় তুই তার কি জানিস! সেই যে কাঁঠালে না দেগঙ্গায় শিমুল গাছের গোড়ায় একঘড়া সোনার মোহর পেয়েছিল এক মুচি, সে-কি আর এমনি এমনিই, গাছটাকে ভক্তি করতো বলেই তো পেয়েছিল। কম গয়নাগাটি লাগবে বিয়েতে। মাঝে মাঝে তো স্বপ্ন দেখিই, গাছটার গোড়ায় মাটির নিচে এই ইয়া বড় একটা লোহার সিন্দুক, একটা আলসে ময়াল সেটার ভেতরে শুয়ে শুয়ে পাহারা দিচ্ছে—
একদিন বললাম, পুঁটি সর খাওয়াবে—
পুঁটি মুখ কালো করে বললে, বলিহারি নোলা বাপু! খুব করে নজর দিস বুঝি রোজ। নোলাটাকে একটু কষতে পারিস না, কি হাঘরে! তাই তো ভাবি রোজ রোজ শুধু শুধু এমন পেট ব্যথা করে কেন!
পরে অবশ্য একটু নরোম হয়েছিল পুঁটি।
ঠিক আছে, তোকে একদিন পোড়া সর খাওয়াব, কিন্তু তার বদলে কি দিবি আমাকে?
কি আর দেবো, তুমি-ই বলো—
তোদের না, একটা পেতলের পটলচেরা কাজললতা আছে, দিতে পারবি আমাকে?
পারবো–
কাউকে বলতে পারবি না কিন্তু, আমার ছেলে হলে ধ্যাবড়া করে কপালে টিপ দিয়ে দিতে হবে না কাজলের, নৈলেপরে নজর লাগবে। কি আর এমন দাম ওটার! যদি পারিস, মাছের সঙ্গেও তোর বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেবো।
পেতলের কাজললতার বদলে হাঁচিচাঁচা পোড়া সর দুএকবার ভাগ্যে জুটলেও মাছের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব জমে নি। ও যে কি বলতো, কিংবা সত্যি সত্যিই কিছু বলতো কি না আমি তার বিন্দুবিসর্গও কোনোদিন বুঝে উঠতে পারি নি।
তার মানে, হাবা তো হাবা, বেশ ভালো রকমেরই হাবাগোবা ছিলাম। হাবা আর হেড়েমাথার। আমার মাথাটা একটু বেটপ ধরনের বড়ই ছিল। আমার বড় বোন রানিবুবু আমার মাথায় টু মেরে যখন বলতো কাল সকালেই দেখবি তোর মাথায় দুটো শিং গজিয়েছে—তখন আমার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে যেতো ভয়ে, আমি হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিতাম।
পায়ে কাঁটা ফুটেছিল, পুঁটি শুনে বললে, বের করতে পেরেছিলি তো সবটুকুন?
বললাম, মনে হলো তো সবটাই—।
না বেরুলে দেখিস কি হয়! দাঁত দিয়ে কিছুক্ষণ নিজের জিভ চুলকে নিয়ে পুঁটি বললে, শেষ পর্যন্ত চোখের মণি ফুটো করে নিজে নিজেই বেরুবে, তখন দেখবি ভোগান্তিটা কেমন—
ভয়ে হাত-পা পড়ে যাবার জোগাড়।
পুঁটি তখন ভরসা দিয়ে বললে, ভয়ের কিছু নেই, কাঁটা তাড়ানোরও মন্ত্র আছে, আগে বল কি দিবি?
ওষুধ মাড়ার একটা খল ছিল ঘরে, শ্বেত পাথরের ছোট্ট নৌকোর মতো; চুপি চুপি সেটাই খুঁজে দিই পুঁটির হাতে। সে তো মহাখুশি। সে যাত্রা কাটার হাত থেকে চোখটাকে এইভাবেই রক্ষা করা গেল।
বারান্দার চকচকে সিড়িতে বসে আঙুল চুষতে চুষতে রাস্তা দেখতাম। অনেক কিছুই আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল দেখতে দেখতে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব গাছ, কিছু কিছু ঘরবাড়ি, অল্পবিস্তর মানুষজন। যেমন ডালপুরিবুড়ো। ছোট্ট চুপড়িতে কচি কলাপাতার বিছানায় ডালপুরি সাজিয়ে দুপুরের পরপরই ডালপুর-হি ডালপুরহি হাঁক ছেড়ে চওড়া রাস্তার ধার ঘেঁষে সে হেঁটে যেতো। বুড়োটার পা জোড়া ছিল দেখবার মতো; ঠিক একজোড়া ধনুক, মনে হতো এক্ষণি মচকে পড়ে যাবে মানুষটা। মাথায় লাল টুকটুকে একটা গামছা রাখতো সে বিড়ে পাকিয়ে। শুনতাম লোকটা জাতে পোদ, কোনো এক সময় সে নাকি রণপায় চেপে ডাকাতি করে বেড়িয়েছে।
মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, শনপাড়িওলার চেহারাও। দুই পাল্লার টিনের বাক্স গলায় ঝুলিয়ে ঠিক ভরদুপুরে সে হাঁক দিত। চোখে ধরার মতো ছিল তার সাজগোজের বহর। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কালো সিল্কের জামা, কোমরে আর গলায় রুপপার জরির নকশা খেলানো। একটা কানে আবার মাকড়ি। অমন বাবরি চুলও বড় একটা চোখে পড়তো না। শণপাপড়ি আর মিহিদানা একসঙ্গেই বিক্রি হতো।
ছিল কুলপিমালাইওলা, চিনেবাদামওলা, লাল মিঠাইওলা। বাঁশের সাজিতে ধামা কুলো পাখা এইসব মিঠাই সাজানো থাকতো। একহাতে সেই সাজি, আরেক হাতে একটা আমের ডাল, পাতার ফাঁকে ফাঁকে লাল লাল আম আর লিচুর লুকোচুরি, এই হলো লাল মিঠাইওলা।
চিনেবাদামওলার ঝকাও ছিল দেখবার মতো। গাঁদা না হয় জবা, একটা না একটা ফুল দিয়ে সেটা সাজানো থাকবেই, যেন লগনের ঝুড়ি, বাবুয়ানা করে বরবাড়ি থেকে আসছে।
কাছাকাছি কোথাও ছিল গোরা সৈন্যদের ছাউনি। মাঝে মাঝে হুসহাস করে উড়ে যেতো ইয়া ইয়া নাকভোতা ট্রাক, চালাতো নিগ্রোরা।
রাস্তার দিকে পা বাড়ালেই কানমলা খেতে হতো; সুযোগমতো ছোট ছেলেমেয়ে সামনে পেলেই নিগ্রোরা নাক কঁাচম্যাচ করে তাদের চিবিয়ে ফেলে, এইসব শুনতাম। তারা যেসব গাড়ি চালাতে লোকে সেগুলোর নাম দিয়েছিল হুদমো গাড়ি।
আমাদের বাড়ির একপাশে ছিল একটা বুড়ো ঝাউগাছ। গাছটার সারা গায়ে ঠেলে উঠেছিল ডুমো ডুমো কালো গাট। গাটের নিচে ফোকর। ফোকরে জমে থাকতো সুজির মতো কাঠের গুড়ো।
গাছটার মগডালে মাঝে মাঝে শকুন এসে বসতো। একবার কি হলো, হঠাৎ রাস্তার একপাশে জিপগাড়ি থামিয়ে দুমদাম ফায়ার শুরু করলে দুজন গোরা সৈন্য। ফটাফট জ্বালা-দরজা সব বন্ধ হয়ে গেল আমাদের ঘরের, লালমুখো লালমুখো—আমরা তো ভয়ে আধমরা।
পরে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখা গেল, লালমুখোরা উধাও, কেবল রাস্তার একপাশে রজনী ভেণ্ডারের ছেলে পানু তুমুল হাত-পা নেড়ে চাকবাঁধা মানুষজনদের কিছু একটা বোঝাচ্ছে। বেশ বড় রকমের একটা ভিড়, আমাদের উঁচু বারান্দা থেকে পানুকে প্রায় দেখাই যায় না।
পানু একা সাহস করে সাহেবদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুঝিয়েছিল, ভালচার ভালচার–
সাহেবদের সঙ্গে কঠিন ইংরেজি বলনেওলা লোক দেখা সেই প্রথম আমার। দুম করে হিরো হয়ে গেল পানু।
গুলি খেয়ে একটা শকুন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, এক খাবলা মাংস উড়ে গিয়েছিল বুকের এক পাশের। এমন জখমের পরও সপ্তাহখানেক বেঁচে ছিল; আমরা কাছাকাছি গেলেই সে ঝটপট করে কোনো রকমে কয়েক হাত দূরে ঝাপিয়ে পড়তো, শুকনো পাতার ডাঁই করে নিজেকে আড়ালে রাখতো। খুব কষ্ট পেয়ে মরেছিল শকুনটা। শেষের দিকে এমনভাবে গলা করে কাঁদতো, মনে হতো মানুষ।
হাইলেচা হাইলেচা, হাইলে হাইলে হাইলেচা–এই ধরনের একটা বিচিত্র গান ফেঁদে বসতো পানু, ভোরবেলা সৈন্যরা যেসব গান গেয়ে গেয়ে দলবেঁধে রাস্তায় দৌড়াতো তারই কিছু একটা নিজের সুবিধেমতো ভেজে নিয়েছিল সে। আমাদের দেখলেই কঠিন কঠিন সব ইংরেজির তুবড়ি ছোটাতো সে, জিনজার মানে আদা, মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাঁজা। খুব অবাক হতাম পানুর বিদ্যাবুদ্ধির বহর দেখে। ভীষণ লজ্জা করতো, কতো কিছুই না জানে পানু, এমন ছোট মনে হতো নিজেকে!
ঝুমি একবার আমাকে একটা ভাঙা তেশিরা কাচ দিয়েছিল, সেটার মালিক ছিল পাঁচু। খবরদার, পাঁচু জানতে পারলে কিন্তু কেড়ে নেবে— ঝুমি চুপি চুপি বলেছিল, আমার নাম করবি না কিন্তু কারো কাছে!
কাচটা ছিল অদ্ভুত। সেটার ভেতর দিয়ে দেখলে রাস্তাঘাট গাছপালা সব থাককাটা রঙধনুর মতো মনে হতো।
ছিল এইসব, এই নিয়ে খেলা।
পুকুরের সেই শানঘাট, কতো সময় যে কেটেছে সেখানে। হাড়িডোমেরা কেঁচড় ভেঙে গুচ্ছের ব্যাঙের ছাত-ঘাটের ওপর ঢেলে রেখে পানিতে নামতে, শানঘাটের গায়ে চরে বেড়ানো গুগলি শামুক তুলে তুলে ভরে ফেলতো কৌটো; গালে বুড়ো আঙুল পুরে কেবল এইসব দেখা, এই ছিল আমার কাজ। তারপর ঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে গাল থেকে আঙুল বের করে বলতাম, মাছভাই, মাছভাই, আমি যেন খুব শিগগির লাল মিঠাইওলা হতে পারি। মাছভাই মাছভাই আমি যেন পানুদার মতো মিনজার মানে মাদা, গিনজার মানে গাজা প্লান্ডু মানে পেঁয়াজ, এইসব পটাপট বলতে পারি!
০২. চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে
রেখা চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললে, কাল অত রাত অব্দি বসে বসে কি করলে?
আবদুল খালেক বললে, এই একটু বইপত্তর নাড়াচাড়া আর কি!
বইপত্তর? আমি তো দেখলাম কি কোথায় সব লিখছিলে তুমি!
ওই আর কি–
বলতে অসুবিধে আছে?
অসুবিধে আবার কিসের—আবদুল খালেক লজ্জিত হয়ে বললে, বলার মতো তেমন কিছু নয়, এই হিজিবিজি!
ঠিক বুঝলাম না, হঠাৎ আবার তোমার ডায়েরি লেখার শখ চাপলো কেন!
আবদুল খালেক শিস টেনে কাপে চুমুক দিয়ে বললে, ধরো কোনো কারণ নেই–
শুধু শুধু সময় নষ্ট–রেখা টেবিল গোছাতে গোছাতে ঠাণ্ডা সাদামাঠা গলায় বললে, কি লাভ এসবে!
কি জানে, তুমিই বোঝ—
রেখা, আজকাল সবকিছুতে তুমি লাভ খোজো। এমন তো আর কোনো কথা নেই যে সবকিছুতেই লাভের গন্ধ থাকতে হবে–
নেই, আবার আছে! আগের চেয়ে অনেক রূঢ় শোনায় রেখার গলা। বললে, তুমি ছাড়া আর সকলেই লাভ-লোকসানে হিসেব কষে চলে। সবাইকে চলতে হয়। চলা উচিত—
আবদুল খালেক আহত হয়ে বললে, আমাদের কি চলছে না?
একে চলা বলে না, কোনোরকমে জোড়াতালি মেরে আমি চালিয়ে নিচ্ছি, তোমার মুখের দিকে চেয়ে, জোর করে। তুমি সংসার পাতোনি, অথচ তার জালে জড়িয়ে পড়েছ, তোমার অবস্থাটা এই। সব বুঝি। তুমি না পারছো গিলতে, না পারছো ওগরাতে। দিনের পর দিন তো দেখছিই, কোনো ব্যাপারেই তোমার কোনো চাড় নেই!
আবদুল খালেক বললে, তুমি কি আমাকে আমার ক্ষমতার বাইরে চলতে বলো, না কেউ তা পারে?
না পারারই-বা আছেটা কি? তোমার জায়গায় আমি হলে তাই করে দেখাতাম। চিরকাল ঠুঁটো হয়ে হাত-পা জড়ো করে বসে থাকবে, আর ক্ষমতার দোহাই পাড়বে, এটাই বা কেমন কথা! তোমার ভেতরে ছিটেফোঁটা উদ্যোগও যদি থাকতো একটু ভেবে নিয়ে রেখা বললে, কেন, তোমাদের টি. মোল্লা কতোদিন থাকলো কলেজে? মাত্র আট মাস! মাস্টারির মুখে ঝাড়ু মেরে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকে তার কি বেশি টাকা রোজগার হচ্ছে না?
আবদুল খালেক বললে, ও চাকরি টি. মোল্লার আরো আগেই পাবার কথা। নিছক বসে থাকবে না বলে ঐ সময়টুকুর জন্যে মাস্টারিতে ঢুকেছিল। ও তো নিজেই বলতো। সকলের সব সোর্স থাকে? টি. মোল্লার আত্মীয়স্বজন কারা তা দেখবে না?
তোমার মতো মানুষদের চিরকাল এইভাবেই নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে হয়, ঘেন্না লাগে আমার–
আবদুল খালেক হেসে ফেললে। কেন হাসল, নিজেই তা জানে না।
বললে, তুমি যাই বলো, আমরা কিন্তু বেশ আছি, বেশ আছি। সস্তায় খাঁটি দুধ, সস্তায় ছানা, জ্যান্ত মাছ, খারাপটা তুমি দেখলে কোথায়। শহরে থেকে দেড়-দুহাজার টাকা কামিয়েও এভাবে চলা যেতো না, বাড়িভাড়া আর গাড়িভাড়াতেই সব উবে যেতো। এখানে তোমার না লাগছে বাড়িভাড়া না গাড়িভাড়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখে, দেন-দরবার করে যে বাজে পয়সা ওড়াবে, তারও কোনো পথ নেই। আমি তো বলি আমরা অনেক ভালো আছি।
রেখা কিছু একটা ভাবলো, তারপর বললে, টি. মোল্লার স্বভাবটাই ছিল দাপুটে, তোমার মতো আধমরা নয়–
রাখো তোমার দাপুটে স্বভাব। স্বর্গে বাস করেই মানুষ স্বর্গের জন্যে কাঁদে, নরকে বাস করে অস্থির থাকে নরকের ভয়ে, চকিতে মনে হলো আবদুল খালেকের; মুখে বললে, জি.এম. মামাশ্বশুর থাকলে অমন দাপট আমারও দেখতে–
কেন কাস্টমস-এ তো তোমার আত্মীয়স্বজন খুব একটা কম নেই, তারা কেউ ভুলেও কখনো পোঁছে?
আবদুল খালেক বললে, সবাই সব পারে না—
এটা কি কোনো জীবন! কান্নায় ভেঙে এলো রেখার গলা। বললে, ইচ্ছে করে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ি। এমন একটা জায়গা নেই, যেখানে যাই। এমন একটা মানুষ নেই, যার সঙ্গে দুটো কথা বলি। জঙ্গলের ভেতরে দিনের পর দিন তুমি আমাকে পচিয়ে মারছো, এইভাবে আমাকে দিচ্ছ!
আবদুল খালেক বললে, এতো দূর থেকে কথা বলো কেন, তুমি কিন্তু তোমার মনের শান্তি নিজেই নষ্ট করছে এভাবে। তোমার সঙ্গে আমার কিসের শত্রুতা? শাস্তির কথা ওঠে কেন? আমি লোকটা এতোই খারাপ, এতোই চণ্ডাল!
পরের ঘরে মানুষ জানো বলেই তুমি ভাবো আমি তোমার জ্যান্ত মাছ আর খাটি দুধছানার কাঙাল। খেয়ে-পরেই মানুষ হয়েছি, পেটে পাথর বেঁধে থাকতে হয়নি কখনো–
নিজের জ্বালাতন তুমি নিজেই ঘটাচ্ছ, ইচ্ছে কের গায়ে পড়ে—
আমি জানি কেন তোমার এতো তাচ্ছিল্য, ভালো করেই বুঝি!
আবদুল খালেকের ঘন ঘন ভাবান্তর হয়। এক একবার মনে হয় ভেতরে ভেতরে ধারালো জেদ তাকে মরিয়া করে তুলছে। সে বললে, অতো বুঝ না, অত বুঝতে নেই। তোমার চেয়ে অনেক বিষয়েই আমি কম বুঝি। কম বুঝি বলেই তোমার মতো এমন উটকো ঝক্কিও আমাকে পোহাতে হয় না। আমি যতটুকু, ঠিক ততটুকুই। নিজেকে এর বেশি মনে করতে গেলেই গোলমাল বাধে, বুঝলে!
আমি মানে তুমি। তুমি শুধু একটা কাজই পার, আমাকে ছোট করতে। এতেই তোমার আনন্দ।
আমার সবকিছুতেই আনন্দ, এখন বাজারের থলে দাও, পরে আর কিছু পাওয়া যাবে না–
যেতে হবে না তোমাকে বাজারে!
থলে দাও, থলে দাও–
বললাম তো, দরকার নেই তোমার যাবার, আজ আমি কিছুই করতে পারবো না।
তুমি না পারলে আমি পারবো। দুপুরের পরে শুধু ডিগ্রীর একটা ক্লাস নিলেই চলবে। কেমন পটেটো চটকই আজ দেখো—
চায়ের কাপ নিয়ে উঠোন পেরোয় রেখা, তারপর রান্নাঘর থেকে বলে, বাপও হয়েছ বলিহারি, উঠে থেকে ছেলেটার একবার খোঁজ নিলে না।
উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আবদুল খালেক বললে, কেন ওটার আবার কি হলো?
একগ্লাস দুধ কোনোমতে ওষুধগেলা করে তারপর উধাও–
খুব বেশিদূর যেতে হলো না আবদুল খালেককে। গালে আঙুল পুরে পুকুরে পাকাটির ছিপ ফেলে হাবার মতো অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল টুকু।
আবদুল খালেক বললে, এইসব হচ্ছে—
টুকু বললে, আব্দু, তোমার ছংগে দাবো
আবদুল খালেক তার কপালে চুমু খেয়ে বললে, বাজারে অনেক ভিড়। এখন ঘরে যান। আপনার জন্যে পেয়ারা নিয়ে আসবো
তালে লুলতি আনবে!
লুলতি মানে গুলতি; আবদুল খালেক ছেলের গাল টিপে দিয়ে বললে, আনবো, সব আনব। টুকুবাবু, আপনি এবারে ঘরে যান—
দুটি বেলে, তিনটি ট্যাংরা, গোটা কয়েক পুরু পুরু খলশে বৈচা এলং টাটকিনি পিয়ালি আর পনেরো বিশটার মতো পুঁটি, এই নিয়ে একভাগা মাছ। পছন্দমতো জালি কুমড়াও পেল আবদুল খালেক। বেগুন কিনলো আধসের। তারপর টুকুর পেয়ারা আর গুলতি।
মুদিখানার একটা ছোকরার হাতে থলেটা পাঠিয়ে দিয়ে অন্যান্য দিনের মতো নরহরি ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে বসে আবদুল খালেক। বললে, রাত্রে ঘুমের বড় ব্যাঘাত হয়েছে—
নরহরি ডাক্তার হেঁকে চায়ের কথা বলে সিগ্রেটের প্যাকেট এগিয়ে দেয়। বললে, আমি নিজেও দুরাত ভালোমতো ঘুমুতে পারিনি। গরমটা কি! শালার বসে সুখ নেই, খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই। জল বেড়েছে কি রকম এ-দুদিনে দেখেছেন?
সেই রকমই যেন মনে হলো সকালে, ঘাটের তক্তায় পা রাখলে ডুবে যায়।
নরহরি ডাক্তার বললে, ছেলেকে দিয়ে এই একটু আগে চালতা পাঠিয়ে দিয়েছি আপনাদের বাড়িতে, দুপুরে টক খাবেন। আমার তো দুপুরে টক না হলে চলেই না।
বেশ আছেন আপনি ডাক্তারবাবু!
ঠিকই বলেছেন, বেশ আছি।
দুজন রুগী ঢোকায় নরহরি ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের নিয়ে। জহর মাঝি আর বাপের হাতধরা পাঁচ-ছবছরের একটি বাচ্চা। জহর মাঝির বগলে থার্মোমিটার পুরে ছেলেটাকে নাড়াচাড়া করতে থাকে ডাক্তার।
বললে, শরীরে মাংস লাগবে কোত্থেকে, একেবারে ফ্যাকাসে মেরে গেছে, পেট বোঝাই শুধু কেঁচো।
ছেলেটির বাপের দিকে মুখ তুলে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, অহনে কই থাকো?
মধ্যপারা।
বগলেই। বহুৎ গরম! তাপডি গিয়া লউক। কি বুঝলা?
অহনে লয়া যাইতে কন তো?
হ, তাতডি ধরলেই ভান কইরা লয়া আইবা।
জহর মাঝির বগল থেকে থার্মোমিটার বের করে নরহরি ডাক্তার বললে, দুই! বরপোলার খবর কি?
জহর জ্বরের ধকল সামলাতে সামলাতে হাঁপধরা গলায় বললে, অহনে ঢাহায় ফল বেচনের কামে লাগছে।
গ্যারেজের কামডি ছারান দিছে ক্যান?
হের আমি কি কমু।
ট্যাকাউকা দেয় তোমারে?
গেল মাসে যেমুন কিছু পাইছিলো—
পায়খানা হয়?
কষা—
জিব্বা দেহি।
জিভ দেখতে দেখতে নরহরি ডাক্তার জিজ্ঞেস করে, কই দোকান দিছে?
হুনতাছি যেমুন হোসেনি দা–
বাধা দিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, উহু, জিব্বা–শেষে বললে, শিশি আনছো?–
আনি নাই।
মিকচার লইবা কিসে?
আপনেরথে দিয়া দ্যান, ফিরায়া দিয়া যামু—
দিছ আর! লগে পয়সা আনছো কতো, সুই নেওন লাগবো তো–
আনছি কিছু। পয়সার লাইগা চিন্তা কইরেন না, আমারে চাঙ্গা কইরা দ্যান। খারইতে পারি না, মাতা ঝিক মাইরা ওডে!
গাঞ্জাউঞ্জা চারান দিছো তো? দিনে তিন দাগ। কাগজের দাগ খায় ফালায়ো না যেমুন। কাউলকা আয়া ফের সুই লয়া যাইবা, দুদরুটি, নো তালিবালি!
রুগী বিদায় দিয়ে নরহরি ডাক্তার সিগ্রেটের প্যাকেট সামনে ধরে বললে, কি ব্যাপার, চুপচাপ কেন, সিগ্রেট জ্বালান, সিগ্রেট জ্বালান!
হাঁ, কিছু যেন বলছিলেন,বেশ আছি, এই তো? তা বেশ আছি—
স্বচক্ষেই তো সব দেখছি!
মুশকিলটা ঠিক এখানেই। আরে সাহেব দেখার আড়ালেও কিছু আছে। গতরাতে কখন ঘরে ফিরেছি তা জানেন? রাত দুটোয়। ডাইনী দিয়ে ঐসব করালে শেষ পর্যন্ত যা হয়! অবস্থা যখন মরমর, আর কোনো আশা নেই, তখন ছোটো শালা ডাক্তারের কাছে, কিছুতেই রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। ইশ, বিয়ের দিন-তারিখ সব ঠিক হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন এখন একটা ডালভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে!
এইভাবে বোধহয় অনেক মরে?
মরে আবার না! সিগ্রেটে লম্বা টান মেরে নরহরি ডাক্তার বললে, সিগ্রেট টেনেও আর কোনো সুখ নেই, যে শালার ঘাস খাচ্ছি। শুনেছেন কিছু? রহমান ব্যাপারীর শালার খুনি নাকি পরশু রাতে বাহিরঘাটায় ধরা পড়েছে।
শুনিনি—
আরে সাহেব আপনাদের কলেজের অতবড় ডোনার রহমান ব্যাপারী, আর খবরই রাখেন না! আরে সেই যে হেকমত, মনে নেই, আপনাদের কলেজের ইউকশনে ব্যালট বাক্স যে ছিনতাই করলে সেবার! ব্যাপারটা নার্কি প্রেম সংক্রান্ত।
আপনি দেখছি সব খবরই রাখেন–
কানে আসে, শুনি। হতভাগাটার মেদেনীমণ্ডলের দাদন মিজির বৌয়ের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ছিল। মিজিই খারাবিটা ঘটিয়েছে।
কি হবে এখন মিজির?
কি আবার হবে, ঘোড়ার ছাই। নতুন আর দুখানা লঞ্চ চালু করেছে দাদন মিজি,–এম.এল. মীরকাদিম আর এম, এল. ভোগদা, সব মিলে হলে গিয়ে পাঁচটা। গায়ের গন্ধ মোছার জন্যে হয়তো হাতের ময়লা কিছু ঝাড়তে হবে, এর বেশি আর কি!
মিজি এক কাঁড়ি টাকা মাদ্রাসার পেছনে ঢাললো, অথচ কলেজের জন্যে এক কানাকড়িও খসালো না, বেশ কঠিন লোকটাকে বোঝা; কম ধরাধরি হয়েছে! অন্তত দুএক হাজার হলেও তার দেওয়া উচিত ছিল—।
রোগটাই এখনো ধরতে পারেননি দেখছি–নরহরি ডাক্তার হেসে বললে, রহমান ব্যাপারীর নামগন্ধ আছে যেখানে সেখানে দাদন মিজি নেই। এ হচ্ছে নতুন মালকড়িওলাদের নিজেদের ভেতরের খালবিলের নৌকো বাইচ, এ রোগের কোনো দাওয়াই নেই, কি বুঝলেন?
কথায় কথায় বেলা চড়লো অনেকখানি। আবদুল খালেকের যখন ওঠার খেয়াল হলো তখন বাজার ফাঁকা হয়ে গেছে। ফেরার পথে তার মনে হলো এতোটা ভালো নয়, সবকিছুতেই কমবেশি একট হিসেব করে চলা উচিত; মাঝে মাঝে এই যে রেখা তাকে ঝাড়াই করে তা একেবারে অকারণে নয়। সে জানে ঘরে ফিরে এখন তাকে কোন্ ধরনের কথা শুনতে হবে; ছেড়ে কথা বলবে না রেখা।
০৩. পেঁপের আঠার ফোঁটা
এক চামচ গ্লুকোজে পেঁপের আঠার ফোঁটা ফেলে আমাকে খাওয়াতে মা। কোনো কোনোদিন আবার কুমারেশ, কিংবা কালমেঘের বড়ি। বেলপোড়া, বেলের মোরব্বা, কিংবা চুনের পানি, এইসবও চলতো। ঘুম থেকে উঠে সকালে খালি পেটে খেতে হতো।
পোকা, এই ছিল আমার ডাক নাম। কেনারাম বাবুর দেওয়া নাম। তিনি ছিলেন আব্বার বন্ধু। আমরা ডাকতাম কাকা।
কেনারাম বাবুকে নিয়ে একটা ছড়া প্রচলিত ছিল:
কেনারাম কিনে আনে
তুলারাম তুলে রাখে
ফেলারাম ফেলে দেয়
বেচারাম বেচে দেয়
কেনারাম কাকাই জানেন আমার নাম পোকা দিয়েছিলেন কেন। পোকা, পোকা, পোকা আছিস– এই বলে তিনি হাঁকডাক শুরু করে দিতেন।
আমি বেরুলে বলতেন, যা, জুতো পায়ে দিয়ে আয়।
কেনারাম কাকা আমার হাত ধরে হাতিপুকুরের দিকে যেতেন। হাতিপুকুরের গোটা এলাকাটা বিশাল বিশাল রেনট্রিতে ঘেরা ছিল। আর ছিল গুলোর। গাছগুলোর নাম তার মুখ থেকেই শোনা, গাছাগাছড়ার কতো নাম যে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। এখানে সেখানে বড় বড় গাছের ছায়ায় বিছিয়ে থাকতো তেঁতুলের মতো শুকনো ফল; সেগুলো গরু-ছাগলের খুব পছন্দের ছিল।
হাতিপুকরের ঠিক মাঝখানে ঢিপির মতো দ্বীপ। লোহার সাঁকো পেরিয়ে সেখানে যেতে হতো। ঢিপির চূড়ায় গোল চবুতারার নিচে বেদি ছিল, সেখানে আমরা বসতাম।
ওখানে বসে বসে দ্বীপের গায়ের এক একটা গাছের দিকে আঙুল তুলে কেনারাম কাকা বলতেন, ঐ যে গন্ধরাজের মতো যেটা দেখছিস, ওটা হলো গিয়ে তোর হিং গাছ, আর ঐ যে পামের মতো যেটা, ওটা হচ্ছে গিয়ে তোর সাবুদানার গাছ।
ফেরার পথে বলতেন, কি খাবি, পান্তুয়া না রসগোল্লা?
বলতাম, রসমঞ্জরি!
ওই সময় কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আব্বার সঙ্গে তার অবনিবনা চলছিল, কথাবার্তা বন্ধ ছিল দুজনের। পরে অবশ্য ওসব মিটে যায়।
মাঝে মাঝে ইরানি জিপসিদের তাবু পড়তো হাতিপুকুরের পাড়ে। কুঁচিওলা ঘাঘরা পরা লম্বা লম্বা বেণী ঝোলানো মেয়েরা মাথায় ফুটতোলা রুমাল বেঁধে কামসুতোর দড়ি পাকাতো। ছুরি, কাঁচি, নানা রঙের পাথর আরমার চুলের গুছি, এইসব নিয়ে তারা ঝঝ দুপুরে বাড়ি-বাড়িতে ঘুরতো।
মনে আছে, একদিন ভরদুপুরে মাথায় রুমাল জড়ানো এক জিপসি মেয়ে কিভাবে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল। জামার ভেতর রঙিন পুঁতির মালা বের করে ফিসফিসিয়ে মেয়েলোকটি মাকে বললে, বাহোৎ কিমতি, বাহোৎ বাহোৎ কিমতি, সস্তেমে দে দেতা, লেলো, লেলো–
মার কোনো উৎসাহ না দেখে সে আবার বললে, কিসিকোত বোলনা মাৎ, সেরেফ দাশ রুপেয়া, লেও–
মার দরোজা বন্ধ করার উদ্যোগ দেখে সে ফস করে কোমরে গোঁজা ছুরি বের করলে। ভয়ে তো আমাদের হাতে-পায়ে খিল ধরা অবস্থা। সেই পুঁতির মালা শেষ পর্যন্ত মাকে নিতে হয়েছিল।
আর একবার একটা কাণ্ড ঘটেছিল। হঠাৎ এক দুপুরে এসে হাজির চিমটেওলা এক সাধু, সারা গায়ে ছাইমাখা, মাথায় গিটবাধা খোঁপা। বললে, মানস সরোবর থেকে আসলাম
মা একটা আধুলি দিলে আমার হাতে, বললে যা দিয়ে আয়—
সাধু বললে, আমি ভিক্ষে নিই না।
মা জিজ্ঞেস করলে, তাহলে আপনি কি চান?
তোর ঘরে না একটা সিন্দুক আছে কাঠের?
মা আমতা আমতা করে বললে, আছে, আমরা তাতে লেপতোষক রাখি—
জানি জানি, সবই জানি, না জানলে আর বলছি কিভাবে! তুই একটা বোকা সাধু হেসে বললে, লেপ-তোষক দিয়ে ওটাকে ভরিয়ে রেখছিস! আমি ইচ্ছে করলে তোর ঐ সিন্দুকটাকে টাকায় ভরে দিতে পারি।
সব শুনে মা হাঁ হয়ে গিয়েছিল।
শুধু একটা ফুঁ! যে টাকায় ফুঁ দেব সেটা এক লক্ষ গুণ বেড়ে যাবে–
কুড়িয়ে-বাড়িয়ে গুচ্ছে নোট এনে সামনে ধরে মা। ফুঁ দেবার পর সাধু বললে, গোপন রাখার কথাটা, বলবি না কাউকে, রাত ঠিক দুটোর সময় টাকায় আর যাবে সিন্দুক।
মেঝের ওপর টাকাগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে দুহাতে ঘেঁটে দিলে সাধু।
কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
রাতে বারবার উঠে মার সিন্দুক খোলাখুলি দেখে আব্বা সম্ভবত কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। বললে, আসলটা গুণে দ্যাখো–
সে হিসেব মার নিজেরও জানা ছিল না। কৌটো-কাটা, বিছানার তলা, বাক্স, শাড়ির ভাঁজ, এইসব হাতড়ে যেখানে যা পেয়েছিল, তাই হাজির করেছিল সাধুর সামনে। তবে বহু টাকাই যে হাতসাফাই হয়ে থােয়া গিয়েছিল তা ধরতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
মাকে ঠকানো খুব সহজ ব্যাপার ছিল। কেঁদে পড়লেই হলো। চাল-ডাল, পুরনো কাপড়, আলুটা পেঁয়াজটা বিলানো এসব তো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। খুব সহজেই মানুষের মুখের কথা বিশ্বাস করে ফেলতো মা। এভাবে প্রায়ই একে-তাকে বাড়িতে আশ্রয় দিত। তারপর দুচারদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল এটা-ওটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যথারীতি নতুন মানুষটিও উধাও।
আমরাও নানারকমে মাকে ঠকাতাম। টিপু ভাইজান ও মনি ভাইজান যোগসাজশ করে প্রায়ই বোকা বানাতো মাকে। অনেক সময় রানিবুবু বুঝতে পেরে সব ফাঁস করে দিত মার কাছে। ঝগড়াফ্যাসাদ কম হয়নি এসব নিয়ে।
এই রকম কতো কি!
শীতকালের সকালে মাঝে মাঝে পুকুরের কোণে জোড়া কুলগাছের তলায় মাদুর পেতে আসন গেড়ে বসে দুলে দুলে রিডিং পড়তো সবাই পাল্লা দিয়ে। আব্বা ডুবে থাকতো ডিকশেনারির ভেতর। কোনো কোনোদিন আবার বসে মটরশুঁটি ছিলতো। ছোলা হয়ে গেলে বলতো, পোকা যাও, তোমার মাকে দিয়ে এসো। আর কিছু ছোলার থাকলে তাও নিয়ে আসবে।
কুলগাছতলায় বসেই দুধ-মুড়ি থিন এ্যারারুট বিস্কুট, এইসব খাওয়া চলতো। তখনো বইপত্তর ছুঁইনি, মাঝে মাঝে কেবল শ্লেটপেন্সিল নিয়ে মাছ আর হিজিবিজি কাগাবগা আঁকি।
আমাদের একপাশে ছিল কলকাতার বাবুদের বিশাল বাগান, নন্দনকানন। বাগান দেখাশোনার জন্যে কুঁড়েঘর তুলে বসবাস করতো সাঁওতালরা। ওদের ডাকতে হতো সর্দার বলে। কাঠবিল্লীর ওপর ছিল ওদের ভারি লোভ, চোখে পড়লে আর রক্ষে নেই, ঘচাং করে তীর মেরে তাকে মাটিতে ফেলবে। মাঝে মাঝে দেখা যেতো তারা দল বেঁধে শিকার থেকে ফিরছে; কাঁধের বাঁশে ঝোলানো বুনো শুয়োর, বনবিড়াল আর কাঠবিল্লী। ওদের কুকুরগুলো ছিল বেজায় রাগী।
আমাদের আশুচাচাও একজন ডাকসাইটে শিকারী ছিলেন। সাঁওতালদের নিয়ে তিনি বছরে দুএকবার শিকারে বেরুতেন। খোলা জিপগাড়ির মাথায় বাঘ শুইয়ে বল্লমধারী সাঁওতালদের নিয়ে তিনি সবগুলো রাস্তায় চক্কর দিতেন। বিশেষ করে এস.ডি.ও আর মনুসেফ সাহেবের কুঠির সামনে পৌঁছানোর পর সাঁওতালদের হৈ হৈ রৈ রৈ আরো বেড়ে যেতো। হরিতলার মোড়ে এলে কিছুক্ষণের জন্যে গাড়ি থামাতেন। তারপর যখন দেখতে না দেখতে মাছির মতো চারপাশে চাক বাঁধাতো মানুষজন, তখন ব্যস্ত হয়ে বলতেন, আঃ কি মুশকিল! ভিড় ছাড়ো, ভিড় ছাড়ো, কি এমন দেখার আছে।
হরিতলায় একটা টিউবওয়েল ছিল। উড়ে নটবরকে প্রায় সারাদিনই দেখা যেতো কল পাম্প করতে। অনেক বাড়িতেই সে সময় টিউবওয়েল ছিল না। তার কাজ ছিল গালের একপাশে পানের ঢিবলে খুঁজে বাঁকে করে বাড়ি বাড়িতে পানি পৌঁছে দেওয়া। সে বেচারা ছিল ভারি ভালো মানুষ। ভালো মানুষ পেয়ে অনেকেই তার পেছনে লেগে থাকতো। আমাদের মনি ভাইজানও তাদের ভেতের একজন। নটবর উড়েকে দেখলেই সে ধক্কা মারিবি ধক্কা মারিবি, তংকা মারিবি কাঁই–বলে চিৎকার করে দৌড়ে একদিকে পালিয়ে যেতো।
সবকিছু ছিল থিতানো। কোথাও কোনো কোলাহল নেই, উপদ্রব নেই; থাকলেও সব বোঝার মতো বয়েস হয়নি তখনও।
দিন দিন একটু একটু করে রাস্তাগুলো চোখের সামনে বড় হয়, আলো-বাতাসের ভেতর নানা রঙের পালক ভেসে বেড়ায়, জানা হয়ে যায় অনেক বাড়ি, তাদের নাম। দত্তবাড়ি, মিত্তিরবাড়ি, ঘোষালবাড়ি, বোসবাড়ি, গোদবুড়ির বাড়ি, করিমন বিবির বাড়ি, এসবই ততদিন চেনা হয়ে গেছে।
মাঝে মাঝে আমরা থলে নিয়ে করিমন বিবির জঙ্গলে ডোবা বাগান গিয়ে হাজির হতাম। তার বাড়ির কাশীর পেয়ারা ঐ অঞ্চলে আমাদের জন্মাবার বহু আগে থেকেই বিখ্যাত ছিল।
হাঁকডাক শুনে একচালা মাটির ঘরের ভেতর থেকে ছেড়া ধুন্ধুড়ি মাকা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে থক খক করে কাশতে কাশতে বেরিয়ে আসতো বুড়ি। বলতো, কি চাইগ কেঁাকারা, এ্যামন হুমদাম নাগিয়েচো ক্যানো!
পেয়ারার কথা শুনে বলতো, আগে দেকেনি পয়সা কতো এনেচো, দাও–
প্রতিবারই বরাদ্দ ছিল সিকি। কাঁপা কাঁপা হাতে পয়সা নিয়ে বলতো, না বাপু, এ্যাতো কোমে কিভাবে দিই বনো দিকিনি! তা কোনো বাড়ির ছেনে তোমরা?
শোনার পর বলতো, এয়েচো যকোন ফেরাবো না। মাকে বোনো, এরপর থেকে এক টাকার কোমে আমি প্যায়রা দিতি পারবো না।
প্রতিবারই এইরকম হতো। বুড়ির কেউ ছিল না। ছানি পড়েছিল চোখে। দুতিন গণ্ডা পেয়ারার নাম করে মনি ভাইজান থলে ভরে পেয়ারা পেড়ে নিত। বুড়ির আন্দাজ ছিল সাঙ্ঘাতিক।
এইরকম আরো একজন ছিল। গিরিবালা। মুখময় তার গুটিবসন্তের দাগ। মাঝে মাঝে আমরা তার ফাইফরমাশ খেটে দিতাম। চলাফেরার তেমন ক্ষমতা ছিল না বুড়ির। আমাদের কাউকে দেখলে মাঝে মাঝে ডেকে বলতো, ও ড্যাবরাচোখে খোকা, আমারে পেঁচোর দোকান থেকে এক পয়সার ইসবগুলের ভুষি এনে দিবি বাবা–
কোদালদেঁতো, খ্যাংরাকাঠি, দেঁতোমাণিক, লগিঠেঙো, পেত্নী চোঁষা, কোমরভাঙা, হুপো—এইভাবে এক একজনকে এক এক নামে ডাকতো বুড়ি।
আমাকে বলতো, হরে ড্যাবরাচোখো, বে করবি আমারে, তোরে আমার ভারি পচন্দ।
গিরিবালাকে আমরা নাম ধরেই ডাকতাম। বলতাম, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
ভেতর থেকে বুড়ি বলতো, গিরিবালা মরেচে—
মনি ভাইজান বলতো, শ্মশানে যাবি?
তোর সঙ্গে সমরণে যাবো, নিবি?
বছরে একবার একটা অন্ধ ফকির আসতো, ফেদু। দেশ ফরিদপুর।
তার নাম করে ফেতরার পয়সা ভোলা থাকতো। সে এসে একরাত থেকে যেতো। আমরা তার কাছে নানান রকমের গল্প শুনতাম। সে বলতো ভূত ধরার মন্ত্র জানে। বলতো, বড়শিতে কাঁচা মাছ গেঁথে বাঁশের ছিপ দিয়ে সে নাকি একসময় বাড়ি বাড়ি ভূত ধরেছে।
তার ঝোলায় একটা রাক্ষসের শিং ছিল; তার ভেতরে খুচরো পয়সা ভরে মুখে ছিপি এঁটে রাখতো। একটা কৌটোয় সুগন্ধি কবিরাজি বড়ি ভরা থাকতো; কাশির দোষ থাকায় সে ঐ বড়ি গালে রাখতো। চাইলে একটার বেশি কখনোই দিত না। একবার মনি ভাইজান ফেদুর কৌটোর সব বড়ি বেমালুম সাবাড় করে দিয়েছিল।
ছোলাভাজা, মটরভাজা, কিংবা আখ চিবুতে চিবুতে গিরিবালার দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান ডাকতো, গিরিবালা, ও গিরিবালা–
গিরিবালা গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করতো, কে র্যা?
মনি ভাইজান বলতে, আমি তোর বর, মনি—
ওরে আমর ধম্মোপুত্তুর র্যা?
মটরভাজা এনেছি খাবি?
মন খারাপ থাকলে এক একদিন হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিত। অকারণেও অনেক সময় তাকে এইভাবে পা ছড়িয়ে বসে কপাল ঠুকে বিলাপ করে কাঁদতে দেখা যেতো।
মনি ভাইজান তখন বলবে, দ্যাখো দ্যাখো, কি সুন্দর বুড়ির গানের গলা!
মর আবাগীর ব্যাটা, মর! তোর ওলাউঠো হোক, জিব খসে পড়ক–গিরিবালা সুর করে এইসব জুড়লে মনি ভাইজান পকেট থেকে ভেলিগুড়ের প্যাকেট বের করে তার হাতে দিত। মনি ভাইজানের অভ্যেস ছিল চাল-তেল-চিনি সকলের অগোচরে বাড়ি থেকে সরানো। গিরিবালা খুব খুশি হলে মনি ভাইজানের গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতো, অ সোনা, অ মাণিক, রাজচক্কোত্তি হ বাপ, রাজকপালে হ বাপ, আমার মতো ফুটোকপালে যেন কেউ না হয়–
তিনকুলে কেউ ছিল না বুড়ির। একটা পলস্তারা খসা দোতলা বাড়ির কোণের ঘর আগলে কিভাবে যে পড়ে থাকতো। উঠোনময় ছিল জঙ্গল। উঠোনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা কাঁঠাল গাছ, সেখানে আস্তানা ছিল তক্ষকের। মাঝে মাঝে তক্ষকটা যখন ডেকে উঠতো, তখন গোটা উঠোন, উঠোন ঘেঁষা বাড়িটা, কেমন যেন হা হা করে উঠতো সবকিছু। উঠোনের জঙ্গলের ভেতর রাশি রাশি তারার মতো ফুটে থাকতো করমচা। সিড়ির গা ছুঁয়ে ছিল গাঁদা, দোপাটি আর সন্ধ্যামণির ঝোপ; আপনা আপনিই হতো এসব।
গিরিবালা উঠোনের জঙ্গলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মাঝে মাঝে মনি ভাইজানকে বলতো, রাতের বেলায় কারা যেন হোথায় আসে, ফিসফাস করে কথা কয়–
তোর ঘাড় মটকাবে একদিন, দেখিস?
বুড়ি বলতো, ওরা সব আমার আপনজন, একদিন তো এরা সব এ বাড়িতেই ছিল। বাড়ির মায়া, সে কি কেউ কখনো ত্যাগ করতে পারে র্যা! বড় মায়া! দ্যাখনা, দাঁতে দড়ি দিয়ে কেমন পড়ে রইলুম, সে তো ঐ মায়ার জন্যেই–
কলুদের মেয়েরা গিরিবালার বাড়ির সবগুলো দেয়ালে খুঁটে দিয়ে রাখতো। কার বারণ কে শোনে। একে ছানিপড়া চোখ, তায় হাড় জিরজিরে; এমন কেউ নেই যে তার হয়ে দুটো কথা বলে; ঘরের দেয়াল, বারান্দার গা, পাঁচিলের গা, কোথাও বাদ রাখতো না। মনে হতো গোটা বাড়িটাই ঘুঁটের তৈরি।
কলুদের মেয়েরা ছিল ভারি মুখফোঁড়া। চোপার জোর আর গলাবাজিতে তাদের সঙ্গে কেউ পেরে উঠতো না। খুব ছোট থাকতেই মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যেত।
গিরিবালার সঙ্গে প্রায়ই এটা-ওটা নিয়ে ঝগড়া লাগতো ওদের। শেষ পর্যন্ত ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে কপালে করাঘাত শুরু করতো বুড়ি। আর শাপমণ্যি, সে তো আছেই।
আমাদের বাড়িতেই ঘুঁটের দরকার হতো। মনি ভাইজান পয়সা নিজের পকেটে রেখে গিরিবালার দেয়াল থেকে থলে ভরে খুঁটে আনতো। একবার ব্যাপারটা আমি দেখে ফেলি। মনি ভাইজান বলেছিল, বলবি না কাউকে, তোকে ভাগ দেব।
বলার সাহস আমার এমনিতেই ছিল না। তবু নানাভাবে মনি ভাইজান এটা-সেটা ভাগ দিতো। যেদিন পরোটা আর ডিম হতে সকালে, আমি আগেই ডিম খেয়ে ফেলতাম। মনি ভাইজান নিজের ভাগ থেকে আমাকে ধার দিতো। এইভাবে মাছগোশ থেকে শুরু করে সবকিছুই ধার দিতো খাবার সময়। ঝগড়া বাধলেই বলতো, এক্ষুণি সব ফেরত চাই!
অবশ্য আমাকে কখনো শোধ দিতে হয়নি সেসব।
মনি ভাইজান বাক্সের তালা খোলার মন্ত্র জানতো। টিনের ফলা লাগানো তীর ছুঁড়ে গাছ থেকে এঁচোড় পাড়তে পারতো। পুকুরে নেমে পাল্লা দিয়ে টিপু ভাইজানের সঙ্গে সাঁতার কাটতো। ডুবসাঁতারে কারো সাধ্যি ছিল না তার সঙ্গে পেরে ওঠা। পোকাটা একটা ভ্যাবলা–এই ছিল মনি ভাইজানের ধারণা।
মনি ভাইজানের সামনে পড়ে গেলে সবসময় একদিকে কেটে পড়বার তাল করতো পানু। মনি ভাইজান ধরে ফেলে বলতো, এ্যাই, টিনজার মানে কি?
পানু আমতা আমতা করে বলতো, টাঁজা।
টিনচার মানে কি?
টাচা।
প্যাঁপোঁ মানে কি?
পোঁপা–
তখন মনি ভাইজান বলতো, প্যান্ট খোল হারামজাদা, প্যান্ট খোল!
পানু বোতাম খুলে প্যান্টটা ছেড়ে দিতো।
এইবার গুণে গুণে তেরোবার কান ধরে উঠ-বস কর। দম ছাড়বি না, খবরদার!
পানু তাই করতো।
এইরকম অদ্ভুত অদ্ভুত সবখেয়াল ছিল মনি ভাইজানের। ঘোষালদের ছেলে গনু একবার কুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সেই থেকে গনুকে দেখলেই মনি ভাইজান, বলতো, এই, পা টেপ, মুও ছাতুছানা করে দেব তোর।
গনু বসে বসে পা টিপে দিত মনি ভাইজানের। আর মনি ভাইজান গান ধরতো আয় বাদি আয় বেগম হবি, আমি খোয়াব দেখেছি, আমি পেখম মেলেছি, আমি সজ্জা করেছি—
মনি ভাইজানের সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে হাতিপুকুরের পাড়ে যেতাম। মনি ভাইজান বলতো, ঐ কোর্টবাড়িতে যাবার একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে পানির তলায়, সুড়ঙ্গটা বের করতে হবে। ঐ গোলবাড়িটার নিচে কি আছে জানিস পোকা? ওয়ারেন হেস্টিংস-এর গুপ্তধন। বড় হলে তার কথা জানতে পারবি।
মাঝে মাঝে হাতকড়া পরা কয়েদীর পালকে কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে নেওয়া হতো। মনি ভাইজান তখন রাস্তার ধার থেকে চেঁচিয়ে বলতো, এই যে জাহামাহাই বাহাবাহারা জিহিলিহিপিহি খাবে?
চোখে পড়লে এইসব ব্যাপার নিয়ে টিপু ভাইজান অভিযোগ তুলতো, আব্বাকে দেখতাম বকাঝকা করতে।
এমন ঘটলে মনি ভাইজান রেগে গিয়ে টিপু ভাইজানকে বলতো, দাঁড়া, তোর লাগালাগি আমি বার করছি। সব্বাইকে বলে দেবো তোর নাম দুদু।
টিপু ভাইজানের ডাক নাম ছিল দুদু। আমাদের নানীমার দেওয়া নাম। এই নাম ধরে অনেকেই তাকে ক্ষ্যাপাতো বলে শেষ পর্যন্ত সেটা বাতিল হয়ে যায়। এই নামটার ব্যাপারে টিপু ভাইজানের ভেতরে ভেতরে বোধহয় একটা ভয় ছিল।
বাধ্য হয়ে মনি ভাইজানের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হতো। বোঝাপড়া মানে, কিছু না কিছু একটা ঘুস দিয়ে তবে রফা।
প্রতি বছরই রথের মেলা থেকে কিছু না কিছু চারা অথবা কলম কেনা হতো। আব্বা আমাদের সকলের ভেতরে সেগুলো ভাগ করে দিত। ভারি সুন্দর ধরেছিল হাতের একটা ফলশা গাছ। পুঁটির কাছ থেকে শিখে আমিও ঐ গাছটার সঙ্গে কথা বলতাম। গাছটা উত্তর দিত না ঠিকই, কিন্তু জন্তুর কানের মতো চওড়া চওড়া পাতা নেড়ে খুব মনোযাগ দিয়ে সব শুনতো।
টিপু ভাইজানের লাগানো গোলাপজাম গাছের মাথায় একদিন সকালে দেখা গেল একটা খোলাপিঠে ঝুলছে। হুলস্থুল কাণ্ড। কিন্তু পিঠেটি আমাদের কারে ভাগ্যে জোটেনি। একটা হনুমান দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে এসে সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে গালে পপারে। এই নিয়ে মনি ভাইজানের একটা গান ছিল, বীর হনুমান লাফ দিয়েছে, বাঁচবে না বাঁচবে না–
কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, গোটা তিনেকপিঠে ধরেছে গাছে। টিপু ভাইজানকে তখন মনি ভাইজান বললে, তোকে ভুল করে গোলাপজাম গাছের চারা মনে করে খোলাপিঠের চারাই দিয়ে দিয়েছে—
টিপু ভাইজান বলেছিল, হতেও পারে, অসম্ভব কিছু নয়!
এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি হয়েছিল। গল্পটা রটে গিয়েছিল মধ্যমগ্রাম কি কাজীপাড়া পর্যন্ত। টিপুর ভাইজানকে দেখলে দুর্গাদাস বাবু ঠাট্টা করে বলতো, ও টিপু পিঠে বেচবে, কতো করে নেবে জোড়া?
কেউবা জিগ্যেস করতো, তোমার পিঠেগাছের ডালের তক্তা কেমন, মজবুত তো? আমার একটা জলচৌকি দরকার—
টিপু ভাইজান এইসব ব্যাপারে খুব বেশি একটা মেলামেশা করতো না কারো সঙ্গে। তার স্বভাবও ছিল কিছুটা মখুচোরাগোছের। ইস্কুল আর বাড়ি, বাড়ি আর ইস্কুল, এই ছিল তার সীমানা।
দুপুরে মা যখন কাঁথা সেলাই করতে বসতো, তখন রানিবুবু তাকে সাহায্য করতো। মা যখন নতুন কথা পাড়তো, তখন আমিও ধারেকাছে থাকতাম। ওটা বোধহয় একটা নেশা ছিল মার। সুঁয়ে সুতো পরিয়ে দেওয়া, ঝোল চেকে নুন হয়েছে কি না বলা, একটা কঞ্চি হাতে করে বসে বসে রোদে দেয়া আচার পাহারা দেওয়া আমার কাজ তো ছিল এইসবই।
পাড় জুড়ে জুড়ে বড় সুন্দর একটা দস্তরখানা তৈরি করেছিল মা। মনি ভাইজান বলতো, ওটা রেখে দাও, আমার বউ আসলে দিও–
মাঝে মাঝে দূর সম্পর্কের এক নানা আসতেন আমাদের বাড়িতে। সবাই বলতো তাঁর মাথায় না-কি ছিট। স্বদেশী আন্দোলনের সময় তিনি ইংরেজের চাকরি ছেড়ে বইয়ের ব্যবসা খুলেছিলেন। তবে সে ব্যবসা তাঁর চলেনি। পরে ইস্কুলে মাস্টারি করতেন।
আমরা যখন তাকে দেখি, তখন তাঁর ঝরঝরে অবস্থা। তাঁর কোটের পকেটে পিপড়ে আর তেলাপোকার বাস ছিল। পকেটে চিনি রাখতেন, মাঝে মাঝে কাঁকড়াবিছেও রাখতেন তিনি পকেটে! পিপড়েগুলো ছিল তাঁর পোষা। কখনো শুনিনি তাঁকে কামড়েছে।
কামড়ায় না?
কেন কামড়াবে? আমি তো ওদের কামড়াইনি! বলতেন, আল্লাতালার জীব, সব এক–
বলতেন, ম-এ মুসলমান, ম-এ মু্র্দফরাস, ম-এ মুচি, সব সমান।
তাঁর কোলে যখন আমাদের রানিবুকুর বিড়াল কুন্তি লাফ মেরে উঠে বসতে, তিনি বলতেন, বড় আদর চায় এরা, এরা আদর ভালোবাসে, সবাই আদর ভালোবাসে—
সিনেমার সন্ধ্যারানী বলতে অজ্ঞান ছিলেন। বলতেন, আমি ওকে বিয়ে করবো, বড় ভালো মেয়ে, বড় ভালো মেয়ে, আহা কি মায়া–
মনি ভাইজান বলতো, নানাভাই, আজ তোমার সেই সন্ধ্যারানী আসবে!
নানা বলতেন, সত্যি?
বিকেলে দেখো, আমি তোমার কথা বলেছি—
বিকেলে একহাত ঘোমটা টেনে দরজার সামনে যে এসে দাঁড়ালো, নানাভাই প্রথমে তাকে চিনতে পারেন নি। কেমন একটু হতভম্ব মতো হয়ে গিয়েছিলেন প্রথমটায়। অবশ্য পরে ধরতে পেরেছিলেন। ওল্টানো ছাতা ধরে তাড়া করেছিলেন তিনি শাড়ি জড়ানো মনি ভাইজানকে, সেই বড় রাস্তা পর্যন্ত। কতো কি যে হতো! রানিবুবুর ক্লাসের অনেক মেয়েরাই আসতো আমাদের বাড়িতে। ছবি, তরু, রমা, রানু, বেলা, শিবানী, আরো অনেকে। তারা সবাই ছিল চৌধুরীপাড়ার মেয়ে। দক্ষিণ পাড়ার মানুষজনের ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়টা একটু বেশিই ছিল, তারা গা বাঁচিয়ে চলতে সবসময়; তারা আমাদের বলতো মোচোনমান। গলায় গলায় ভাব ছিল ছবিদির সঙ্গে। ছবিদিকেও ক্ষেপাতো মনি ভাইজান। ব-র-ক-ধ-ঝ বললেই ছবিদি চটে যেতো। চটলে মনি ভাইজানকে বলতো, গুপ্তা।
মনি ভাইজান বলতো, গুণ্ডি।
তোর কোনো লাজলজ্জা নেই, মেয়েদের পেছনে লাগিস কেন? এই বলে বকাবকি করতো মা।
ওরা এতো গুজগুজ করে কেন?
তাতে তোর কি, তোর কি দরকার এসব দেখার?
ছবিদি আমাকে খুব ভালোবাসতো। কত জলছবিই যে আমি তার কাছ থেকে পেয়েছিলাম। একবার বইয়ের মলাটে এঁকে দিয়েছিল একটা রাজহাঁস, সে কি তার গর্বিত ভঙ্গি, আমি সেটা খুব যত্ন করে চারটে ভাঁজ ফেলে তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
তোষকের তলায় দেশলায়ের বাক্সের ভেতর পুরে টিকটিকির ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা তোলাও ছিল একটা খেলা।
ছবিদি মিত্তির বাড়ির মেয়ে। তার বাবা শিবশংকর মিত্তির ছিলেন নামকরা উকিল। রানিবুবুর সঙ্গে সঙ্গে প্রায়ই মিত্তির বাড়িতে যেতাম আমি। ছবিদির ঘরে দেয়ালের তাকে ছোট দুটো কাচের বয়ামে কুঁচ সাজানো থাকতো। একটায় লাল কুঁচ। অপরটায় লালের মাথায় ছোট্ট কালো ফোঁটা। ফাঁক পেয়ে এবার বেশকিছু কুঁচ বের করে নিয়েছিলাম। ঘরে ফিরে শিশিতে ভরে সেই কুঁচগুলো আমি তোষকের তলায় রেখে দিয়েছিলাম।
ছবিদিদের বাড়ি থেকে আমি আরো একটি বস্তু সংগ্রহ করেছিলাম, সেটি একটি রাক্ষসের ছবি। মোটা একটি বইয়ের ভেতর থেকে রঙিন পাতাটি খাসিয়ে নিয়ে বইটি যথাস্থানে আবার রেখে দিয়েছিলাম। ফেদুর ঝোলার ভেতরের কালো কুচকুচে শিং-এর সঙ্গে ছবির রাক্ষসের শিং-এর বেশ মিল ছিল।
কুঁচের কথা যেভাবেই হোক ছবিদি জেনে গিয়েছিল। একদিন বললে পোকা, তোকে আমি ভালো জানতাম—
কিছু না বুঝে আমি তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ছবিদি বললে, আমি কি দিতাম না, চাইলেই তো পারতিস, মনিদার পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তুইও—
কুঁচভরা ছোট্ট একটা বয়াম দিয়ে দিয়েছিল ছবিদি, মনে আছে।
একদিন সকলে মিলে আমাদের বাগানে চড়ুইভাতি করলে। সেদিন সকলে শখ করে শাড়ি পরেছিল। মনি ভাইজান চোখ মটকে ছবিদিকে বললে, স্টাইল!–-
সে কি কান্না ছবিদির, ছোটলোক। ছোটলোক! রানিবুবু ছুটে গিয়ে তখুক তখনই মাকে বলে দিয়েছিল।
রাখ, তোর বজ্জাতিপনা আমি বার করছি–এই বলে হাতে কাঠের বেলুন নিয়ে মা সেই কোহিতুর আমগাছের গোড়া অবধি মনি ভাইজানকে তাড়া করেছিল।
সেসব কতো কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর সব মনে পড়ে না। কতো কথা, কতো চার ভঁজ-করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কতো সকাল-দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয় নি, একদিন সবকিছুরই আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে। বড় অবহেলা ছিল পোকার, বড় অবহেলা। অযত্ন আর হেলাফেলায় কতো কিছুই যে সে হারিয়ে ফেলেছে! জিনজার এখন গানের মতো বাজে, হিনজার এখন বুকের ভেতরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ তোলে। হু হু বাতাসের গায়ে নকশা-ভোলা ফুলের মতো অবিরল আকুলতা, পোকার বুকের ভেতরের ফাঁকা দালানকোঠা গুম গুম করে বাজে, পোকা তুই মর, পোকা তুই মর।
যা কিছু নিঃশব্দ, যা কিছু শব্দময়, যা কিছু দৃশ্যগোচর, দৃশ্যাতীত, সবকিছুই একজোট হয়ে হাত ধরাধরি করে ঘিরে ধরে; অদ্ভুত এক বাজনার তালে তালে আস্ত একটি রাত মোমের মতো গলে পড়ে, জিনজার-হিনজার জিনজার-গিনজার, জিনজার-হিনজার পোকা শোনে, শুনতে পায়। পোকা পোকা হয়ে যায়।
০৪. গিরিবালা, ও গিরিবালা
গিরিবালা, ও গিরিবালা–ঘুমন্ত রেখার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে আবদুল খালেক ডাকে, তোমার এতো রাগ কেন গিরিবালা?
একটা হাত ঠেলে দেয় রেখা। বোঝা গেল, সে এততক্ষণ ঘুমায়নি; চোখ বন্ধ করে পড়ে ছিল।
।আমাকে শুতে দেবে না বুঝি–
রেখা একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দেয়। বললে, না এলেই হতো! হারিকেনের সবটুকু তেল শেষ করে তবে শান্তি হয়েছে তোমার–
আবদুল খালেক শুয়ে বললে, তুমি শুধু রাগ করো, আগের মতো আর আমাকে ভালোবাসে না
ইস্ মাঝরাতে ওনার একেবারে উপচে উঠছে। কি লাভ ওইসব ছাইভস্ম করে, তোমার এক একটা পাগলামি দেখলে গা রি রি করে জ্বলে আমার!
কি করবো, করতে হচ্ছে—
করতে হচ্ছে মানে?
আরে মালেক, মালেক, ওই হারামজাদাই তো আমাকে ফাঁসিয়েছে। ডায়েরি করে পাগল করে তুলেছে কিছুকাল যাবৎ। লেখক মানুষ, বুঝলে না, সবকিছুই ও কাজে লাগায়—
রেখা বিরক্ত হয়ে বললে, এতে তোমার কি লাভ?
বন্ধুর কাজে লাগলাম, নিজেরও কিছুটা সময় কাটলো—
রেখা বললে, সময় কাটানোটা তোমার জন্যে এখন একটা মস্ত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, বুঝতে পারছি–
আবদুল খালেক বললে, কেন যে তুমি সবকিছু বুঝতে যাও—
রেখা বললে, আমি খুব খারাপ!
তা বলি নি–আবদুল খালেক রেখাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তোমার কাজ শুধু আমাকে ভালোবাসা, জীবনভর ভালোবেসে বেসে একদম পচিয়ে দেয়া–
দিন দিন তুমি ছোকরা হচ্ছো!
ছোকরা তো আছিই, একটা মাত্র ছেলে, নবছরের বিবাহিত জীবন, টুকটুকে বৌ, বুড়োটা হলাম কিভাবে?
রেখা পাশ ফিরে শুয়ে বললে, দয়া করে এখন আমাকে ঘুমোতে দাও। তোমার ইচ্ছে না হয় বসে বসে যা ইচ্ছে তাই করো গে—
আবদুল খালেক বললে, তোমার ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না হে। হপ্তাটা মাঠে মারা যাবে নাকি?
চুপ করে শুয়ে থাকো—
ধমকাচ্ছো কেন এমন?
বলছি তো আমারূ র্শীর ভালো নেই—
শরীর, না মন?
কোন্ খবরটা রাখো তুমি! পরশু দুপুর থেকে যা খারাপ যাচ্ছে শরীর–
মাসের মাঝখানে হঠাৎ?
কি করে বলবো! কিভাবে যে কেটেছে সারাটা দিন!
আমাকে বললানি তো?
কি লাভ তোমাকে বলে? কোনো ব্যবস্থা করতে? কবে আমার ব্যাপার নিয়ে তুমি মাথা ঘামিয়েছিলে?
তবু বলা উচিত ছিল তোমার—
কেন আগেও তো এমন হয়েছে, নতুন কিছু তো আর নয়, আমার ব্যাপার নিয়ে খামোখা তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই—
কিছু একটা ভাবল আবদুল খালেক। একটা সিগ্রেট ধরালো। বললে, আমি কি বলি জানো, তোমার ঐ ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট এবার বাদ দাও। আর কতো, অনেক তো হলো—
তোমার কি, তুমি তো বলেই খালাস। তারপর কিছু একটা হয়ে গেলে?
হোক না, মন্দ কি! ছেলেপিলেয় ঘর ভরে যাক। বাগান হয়ে যাক। আমরা তো সব মিলে সাত ভাইবোন ছিলাম, মরে হেজে শেষ পর্যন্ত ঠেকেছিল চারে—
ঝক্কি সামলাতে পারবে? খাওয়াতে পারবে?
এইসব মন খারাপ করা কথা কেন তোলো রেখা?
মন খারাপ হয় কেন, নিজের গাঁটের ওজন বুঝবে না! ছেলে বলতে একটা, তা-ও কিভাবে মানুষ হচ্ছে। মানুষ হবে না ছাই। শহরে থাকলে একটা ভালো ইস্কুলে যেতো, সবকিছু শিখতো। এখানো ধুলোকাদা মাখছে, সারাদিন ইচ্ছেমতো গড়াগড়ি খাচ্ছে, চাষাভুষাদের ছেলেমেয়েদের কাছে শিখবেটা কি!
আবদুল খালেক বললে, এইতালো, কাদামাটি চিনুক, ধুলোবালি চিনুক।।
হ্যাঁ, তাতে তোমার মুখ উজ্বল হবে—
হঠাৎ কি মনে করে আবদুল খালেক বললে, রানিবুবুর চিঠির উত্তর দিয়েছিলে?
না!
সে কি কথা, তুমি না বললে তুমি জবাব দেবে।
তুমিও তো পারতে।
আমি পারলে আর তোমাকে বলতাম না, কখনো চিঠির উত্তর আমি দিতে পেরেছি? হচ্ছে—হবে, দিচ্ছি-দেববা করে শেষ পর্যন্ত কোনোদিন আমার উত্তর লেখা হয়ে ওঠে না। তোমার কিন্তু উচিত ছিল। রানিবুবুর অমন জ্বলজ্যান্ত ছেলেটা মারা গেল, যাওয়া তো হলোই না, এমনকি চিঠির উত্তরও না, খুব খারাপ হলো ব্যাপারটা।
রেখা বললে, তুমি তো দেখছি সবই বোঝ, উচিত-অনুচিত জ্ঞান তোমার টনটনে, লেখ না কেন, ধরে রেখেছে কেউ তোমাকে?
আবদুল খালেক বললে, জীবন কি রকম বদলে যায়, কি আশ্চর্য দ্যাখো। রেখা কিভাবে সবকিছু বদলে যায়।
একসময় এক বিছানায় গলা জড়াজড়ি করে শুয়েছি, এক পাতে খেয়েছি, চোখের আড়াল হইনি কেউ কারো, অথচ আজ রূপকথা, আদ্যিকালের গপ্পো। টিপু ভাইজানকেও কতোদিন দেখিনি, পাঁচ বছর হলো। এখন আর মনেই পড়ে না।
তোমার পেয়ারের ভাবী তো খবর নিতে পারে, তিনি না হয় ব্যস্ত মানুষ, ডাক্তারিতে ডুবে থাকেন। একসময় তো খুব মাখামাখি ছিল তোমার সঙ্গে।
কেন যে তুমি ওভাবে কথা বলো— আবদুল খালেক দুঃখিত হয়ে বললে, গুরুজনদের ব্যাপারে অশ্রদ্ধা, থাকতে নেই, এতে নিজের ওজনই হাল্কা হয়। এরাই বোধহয় সবচেয়ে দুঃখী–
রেখা আর কোনো কথা না বলায় অস্বস্তি বোধ করে আবদুল খালেক। সে বললে, আগে তো লিখতোই। কটা উত্তর আমরা লিখেছি। আরবের মতো একটা রুভূমিতে পড়ে আছে, ওদেরও তো কতো সমস্যা থাকতে পারে, কতোটুকুই বা আমরা জানি, কিই-বা আমরা জানি—
রেখা বললে, প্রথম প্রথম তো খুব বড়মানুষি দেখাতে পেরেছিল। কেউ এলেই এটা সেটা পাঠাতে, এখন চিঠি লিখেও পোছে না।
এক এক সময় এইরকম থাকে। মনে হয় কাউকে ছাড়া কারো চলবে না, সব সম্পর্কই দামী, সবকিছু রক্ষে করে চলতে হবে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে যার সংসারের ভেতর নাকঅব্দি ডুবে গেছে, চোখ ফিরিয়ে তাকাবার উপায়ও তার নেই। এই নিজেদের দিকেই দ্যাখো না, ইচ্ছে থাকলেও কোন্ কাজটা আমরা করতে পারছি
রেখা বললে, বড়দের একটা আলাদা কর্তব্য থাকে। টিপু ভাইজানের কি উচিত ছিল না আমাদের খোঁজখবর রাখার? তোমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ছোট ছেলে তো সৌদি আরবে গেল সেদিন, মাত্র বছরখানেক। কি না পাঠিয়েছে এর মধ্যে। টিভি থেকে শুরু করে থ্রি-ইন-ওয়ান, ঘড়ি কি না। ওনার তো আর কোনো অভাব ছিল না, তবুও তো পাঠিয়েছে। আসলে মন থাকা দরকার। তুমি কি মনে কর তোমাকে কেউ খুব গ্রাহ্যের মধ্যে একটা আনে?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তোমার ইস্কুল আলাদা, এই আর কি?
রেখা বললে, তা গিরিবালা মাগীটা কে শুনি, হঠাৎ তার কথা মনে পড়লো কেন?
আবদুল খালেক বাইরের দিকে হাত বাড়ালো। বললে, বাইরে আকাশ বলে একটা কিছু আছে, তা জান তো! সেখানে একটা চাঁদ আছে, গোল চাঁদ। ঐ চাঁদের ভেতর হাঁটুমুড়ে কতোকাল ধরে বসে আছে। চরকায় সুতো কাটছে বসে বসে।
০৫. কাগজের নৌকো
বৃষ্টি এলেই কাগজের নৌকো বানানোর ধুম শুরু হতো, আর কেউ বড়ি দিলেই বৃষ্টি আসতো।
মনি ভাইজান তৈরি করতো তিনপালের জাহাজ। এক একটা জাহাজের এক একটা নাম থাকতো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ। প্রিন্স অব ওয়েলস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে থাকতো চালভাজা, প্রিন্স অব ওয়েলস-এ কালো পিঁপড়ে, সুড়সুড়ি পিঁপড়ে। কিছুদূর গিয়েই বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় চাবচুব হয়ে জাহাজগুলো ডুবে যেত। মনি ভাইজান বলতো, ইংরেজদের দিন শেষ হয়ে আসছে–
তারপর ভাসমান পিপড়েগুলোর পাশে শুকনো পাতা ছেড়ে দিত মনি ভাইজান। বলতে লাইফবোট, অন্তত চেষ্টা করা যাক, যাতে ওরা প্রাণে বাঁচে—
তোজো আজ খুশির চোটে আস্ত একখানা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবে, বুঝলি পোকা!
তুমুল বৃষ্টির পর কেঁচো বেরুতো। রানিবুবুর বিড়াল কুন্তির খুব অপছন্দের ছিল এই কেঁচো। কেঁচো দেখলেই সে ফ্ল্যাশ ফাশ জুড়ে দিয়ে লাফালাফি করতো।
কুন্তি মনি ভাইজানের ধারেকাছে বড় একটা ঘেঁষতে চাইতো না, কি জানি, ভয় পেত বোধহয়। হয় একটা কাগজের ঠোঙার ভেতরে কুন্তির মাথা পুরে দিল, কুন্তি পিছনে হটা শুরু করলো, না হয় একটা ফিতে বেঁধে দিল কষে তার লেজে, মনি ভাইজান কুন্তিকে এইভাবে শাস্তি দিত। রানিবুবুকে কাঁদানোর সবচেয়ে সহজ রাস্তা ছিল এটাই।
রানিবুবুকে ভ্যা বললেই ক্ষেপে যেতো। মনি ভাইজান কতো কিছু যে বের করতো মাথা থেকে।
কুন্তির মারা যাওয়াটা বিরাট ঘটনা। আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই কেঁদেছিলাম। মুখে রক্ত তুলে আছড়ে-পিছড়ৈ মরেছিল কুন্তি, কে জানে কি হয়েছিল। এক সন্ধ্যায় হঠাৎ বাগান থেকে ঘরে ঢুকলো সে, ঢুকে রানিবুবুর পায়ে গা ঘসে ম্যাও ম্যাও জুড়ে দিল, তারপরই শুরু হলো তার ছটফটানি। সে কি কষ্ট! দেখা যায় না। মা বললে, ওকে কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে—
টিপু ভাইজান বললে, সাপে কামড়াতে পারে–
এতো কষ্ট পেয়েছিল! ও মরুক, এতো কষ্ট চোখে দেখা যায়। এই বলে কেঁদে উঠেছিল মা।
কান্নাকাটির ধুম পড়ায় পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড়ে ঘর ভরে গিয়েছিল, সে এক হুলস্থুল কাণ্ড।
আব্বা অফিস থেকে ফিরে এইসব কাণ্ড-কারখানা দেখে বোকা হয়ে গিয়েছিল। ছি, ছি, লোকে বলবে কি, কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই তোমাদের, এটা একটা ব্যাপার হলো?
সেই রাতেই কেনারাম কাকা থলের ভেতর ভরে একটা নতুন বিড়াল এনে হাজির করেছিলেন। অন্যেরা থামলেও রানিবুবুকে শান্ত করা যায়নি। কতো সুন্দর ছিল কুন্তি, কতো শান্ত–
হয়তো তাই, কুন্তির মতো আর হয়নি, অমন সুন্দর আর হয় না। বিছানার ওপরের একফালি চিকচিকে রোদ সারা গায়ে পাউডারের মতো মেখে রাজরাণীর মতো বসে থাকতো কুন্তি। রানিবুবুর পড়ার সময় অঘোরে ঘুমাতো সে কে।লের ভেতর। কখনো মোটা দেখে একটা খাতা বেছে নিয়ে বসতো, তার ওপর বসে বসে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতো সে মুখের দিকে।
কেনারাম কাকার দেয়া বিড়ালের নাম দেয়া হয়েছিল টোটা। টোটা ছিল ভীষণ বেয়াড়া। প্রায়ই সে পালিয়ে যেতো। তখন বাড়ি বাড়ি খোঁজা হতো। কতোবার যে ধরে আনতে হয়েছে তাকে। কারো কাছে বড় একটা ঘেষতো না সে, কেমন যেন একা একা স্বভাবের। আমাদের কাউকেই তার মনে ধরেনি। অবিশ্বাসের চোখে সে কটমট করে তাকিয়ে থাকতো। পাঁচিলের ওপরে শুয়ে শুয়ে কাটাতো সারাদিন। খিদে পেলে তবে ঘরে ঢুকতো, তারপর মিউমিউ করে ডাকতো, এমন ছিল তার জিদ।
একবার একটা শালিকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। সে ছিল খোঁড়া,, যেভাবেই হোক একটা ঠ্যাং তার ভেঙে গিয়েছিল। বাগানে গেলে আমাকে দেখলেই সে উড়ে আসতো, তারপর লাফিয়ে লাফিয়ে কাছে এসে কা কা চেঁচানি জুড়ে দিত। ধরে ধরে ফড়িং খাওয়াতাম ওকে। মনি ভাইজান একদিন বললে, শালিকটা কে জানিস?
আমি বললাম, কে?
আমাদের এক বোন। তুই দেখিসনি। তোর জন্মের ঠিক আগেই ও মরে যায়। ওর নাম ছিল তুলি–
ও তো পাখি!
মনি ভাইজান বললে, মরে পাখি হয়ে গেছে। আমরা তো ভাই, তাই আমাদের মায়া কাটাতে পারে না।
সব শুনে হাহাকার করে উঠেছিল বুকের ভেতর। তুলির কথা মনে পড়লে মাকেও দেখছি বসে বসে কাঁদতে।।
তারপর থেকে আমার একটাই কাজ, মাটির খুরিতে ভাত আর মাছ নিয়ে ফলশা গাছের পাশে সারা দুপুর বসে থাকা। বসে বসে কাঁটা বেছে মাছ-ভাত খাওয়াতাম। শুধু ভয় হতো, এই বুঝি কাঁটা বিধল গলায়। জিগ্যেস করতাম, তোমার কষ্ট হয়?
শীত লাগে না?
লেপের ভেতর শুতে চাও?
মা তোমার জন্যে এখনো কাঁদে—
সব কথার একটাই জবাব ছিল তার, ক্যাঁ, ক্যাঁ। রাগ হতো। নিজের ওপর। ও-তো সব বলে, ওর সব কথা; সব দুঃখ, সব কষ্ট সবকিছুর কথা। কেবল আমি এমন গাধা যে, তার এক বর্ণও বুঝি না।
পুঁটিকে জিজ্ঞেস করলাম একবার, পুঁটি তুমি পাখির কথা বোঝ?
পুঁটি বললে, ওমা, ওটা আবার একটা কাজ, ও তো খুব সহজ।
শালিকের কথা বোঝ?
বুঝবো না কেন! তবে শালিকদের ভাষা হলো তোর গিয়ে ওই উড়েদের মতো; তংকা বংকা হইছন্তি খাইছন্তি এই ধরনের, আমাদের নটবরের কথা শুনিসনি! তা যাই বল, বেশ কঠিন!
সব শুনে পুঁটি বললে, আমার সময় কখন যে, এতোসব শেখাবো তোকে? আমাদের বাবুদের বাড়ির দেমাকী বৌ মাগীর চোপা তো আর শুনিসনি! মাগীর দাতে আমি দড়ি হয়ে গেলাম, মলেও বাঁচি। উঠতে-বসতে শুধু কাজ আর কাজ। একটা হয়, ও যা বলে, আমি তা তোকে বুঝিয়ে দিতে পারি। কিন্তু কি দিবি আমাকে?
একটা ডবল পয়সা হাতে ভরে আমার সঙ্গে বাগানে গিয়েছিল পুঁটি। মাটির খুরি উল্টে শালিকটা যখন ভাতের ডেলা খাচ্ছে আর কা কা করছে, তখন পুঁটি বললে, ওমা, কি পাকা মেয়েরে বাবা, কি বলছে জানিস, বলছে, ও পাকা, পোকা, তোর খুব সুন্দর বউ হবে! ও পোকা, পোকা, তোমার বউ ঠিক পুঁটির মতো সুন্দর হবে। দেখেছ, কি চালাক! ওমা, পেটে পেটে কি বুদ্ধি!
বললাম, জিজ্ঞেস কর না, পা ভাঙলে কি করে?
পুঁটি বললে, ও তুলি, কি হয়েছিল তোমার পায়ে?
ক্যাঁ ক্যাঁ করে শালিকটা ডাকার পর পুঁটি বললে, দেখেছ দেখেছ, কি বজ্জাত! আমাকে নচ্ছার বলে গাল দিল। পাকিস্তান চায় বলে হিন্দু পাখিরা নাকি ওর ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে, শোন কথা! তা আমার কি দোষ বলো? ঐ শোন আবার কি বললে! বলছে, তোমার জাতভেয়েরা তো করেছে—
তুলিপাখি যে অমন গাল দিতে পারে, আমার তা বিশ্বাস হতো না। কতো দুপুর গাছতলায় বসে বসে কেটেছে। হা-পিত্যেশ করে বসে আছি, খুরিতে ভাত নিয়ে, আসে না, আসে না, কিছুতেই আর আসে না। শেষে হয়তো এলো।
যেদিন তুলি আসতো না, সবকিছু ফাঁকা হয়ে যেতো। সে যে কি কষ্ট! বুকের ভেতর গুমরে উঠতো কান্না। তখন সব পাখিদের দেখে আমার কান্না আসতো। কতো লোকের কতো ভাইবোন মরে গিয়ে এইভাবে পাখি হয়ে আছে, কেউ ওদের দ্যাখে না। কতো দুঃখ ওদের! রোদ-বৃষ্টি-শীতে কতো কষ্টই না ওদের হয়! না আছে ঘর, না লেপ-তোষক-কথা; গাছের ডালে ডালে কতো অনাদরে, কতো অবহেলায় ওদের দিন কাটে!
সেই তুলি, সেই তুলিপাখি, আমাদের সেই ছোট্ট বোন, একদিন কোথায় যে উড়ে গেল, আর সে ফেরেনি। মধুগুলগুলি আর সিঁদুর কৌটো আমগাছের ডালে শেষবারের মতো তাকে দেখা গেল; কোনো কথা বললে না সে। কি জানি, কেনু তার এমন অভিমান হলো।
এক একদিন এক একটা অদ্ভুত মানুষ এসে হাজির হতো। অবিকল গরুর মতো হাম্বা শব্দ করে দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের পয়সা বাজাতে লাগলো। একদিন একটা যমদূতের মতো লোক, তার গলায় জড়ানো মোটা দড়ি। ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছিলাম, মনে আছে। চাল আর একটা আনি নিয়ে তবে সে নড়েছিল। মার মুখে শুনেছিলাম, লোকটার নাকি গরু মরেছে। মরার সময় গরুর গলায় দড়ি থাকলে তার মালিককে নাকি এইভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ঝাড়া এক মাস বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাকে ভিক্ষে করতে হবে। কথা বলা বারণ।।
একবার এলো একটা খাড়া অন্ধ লোক। রোগা-পাতলা ছিপছিপে চেহারা। লোকটির দুটো চোখই পাথরের।
মার পরনে ছিল খুব চিকন পাড়ের সাদা শাড়ি। সে বললে, আপনার এ বিধবার বেশ কেন মা?
মা তো অবাক!
মনি ভাইজান আঙুল তুলে বললে, বলো দেখি কটা আঙুল?
লোকটি বললে, তিনটে।
এবার বলো, কি দেখছো?
লোকটি হেসে বললে, তুমি তো ভারি পাজি ছেলে হে! তুমি বক দেখাচ্ছো!
মনি ভাইজান বললে, এসব তোমার চালাকি। তুমি সব দেখতে পাও।
লোকটি বললে, দেখতে না পেলে বলছি কি করে! তবে তোমরা যেমন চোখ দিয়ে দ্যাখো, তেমন নয়!
ঠিক আছে দেখা যাবে, মনি ভাইজান বললে, আমি তোমার চোখ বেঁধে দেব, কামড়ালে কিন্তু ভালো হবে না!
গামছা দিয়ে কষে চোখ বেঁধে দেওয়ার পর মনি ভাইজান বললে, আচ্ছা এবার বলো কি দেখছো?
একটা বই, বিষাদ সিন্ধু!
এবার?
একটা ছবি, সুভাষচন্দ্র বসু!
মা বললে, তুই সর তো, আপনি কি চাল নেবেন, না পয়সা?
লোকটি বললে, ওসব নিয়ে আমি কি করবো মা? ইচ্ছে করলে আমাকে একমুঠো ভাত খাওয়াতে পারেন!
মা জিজ্ঞেস করলে, আপনি হিন্দু না মুসলমান?
সে বললে, আমি হিন্দু!
আমরা মুসলামান, আমাদের এখানে খাবেন?
মার কথার উত্তরে সে বললে, অন্নের কি কোনো জাত আছে মা?
লোকটি যখন খাচ্ছে তখন মনি ভাইজান কাছে বসে বললে, আমাকে চোখ বন্ধ করে দেখতে শেখাবেন!
কে কাকে শেখায়! শিখতে হয়।
মনি ভাইজান নাছোড়বান্দার মতো বললে, আমি আপনার পা টিপে দেব, যা বলবেন তাই করব, আপনি আমাকে শেখান।
লোকটি হেসে বললে, তোমার তো চোখ আছে বাবা, চেষ্টা করলেও তুমি পারবে না। তোমার মতো আমার চোখ নেই, তাই মন দিয়ে দেখতে হয়। মন সব পারে। ঐ যে এতো উঁচু হিমালয়, ইচ্ছে করলে এক লাফে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে ওটাকেও।
মনি ভাইজান বললে, ঠিক আছে, আপনি না হয় আমার চোখ নষ্ট করে দিন…
লোকটি মনি ভাইজানের পিঠে একটা হাত রেখে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো। বললে, তুমি খুব বোকা। চোখ দিয়ে যা দেখা যায়, তার সবই তো তুমি দেখতে পাচ্ছো; এর জন্যে আবার মনকে টেনে আনা কেন? চোখের চেয়ে মনের দেখার ক্ষমতা অনেক বেশি, সে অনেক দ্যাখে, অনেকদূর পর্যন্ত দ্যাখে, চোখ যা পারে না। তা তুমি যদি সেই সব দেখতে চাও, তাহলে আগে মনকে খুঁজতে হবে—
মনি ভাইজান বললে কি ভাবে—
যেমন ধরো আগে বের করতে হবে, সে আছে কোথায়। যখন বুঝবে সে ঐখানে, তখন তার কাছে যাবে বলবে আমি দেখতে চাই। সে আমাকে যা বলেছিল, তোমাকেই সেই একই কথা বলবে। বলবে, তুমি লোভী, লোভীরা কখনো দেখতে পায় না। তুমি সময় চাইবে। নিজেকে সংশোধন করে তারপর আবার তার কাছে যাবে। বলবে এখন আর আমার কোনো লোভ নেই, তুমি আমাকে যেমন ইচ্ছে বাজিয়ে দ্যাখো। সে পরীক্ষায় যদি তুমি টিকে যাও, তাহলে তখনকার তখনই তোমার মনের চোখ খুলে যাবে–
যাবার সময় চাপা গলায় লোকটি মাকে বললো, খেয়াল রাখবেন এর দিকে, বিশেষ যত্ন নেবেন। জগতে এমন কিছু মানুষ জন্মায় যারা, কেবল কষ্ট পেতেই ভালোবাসে–
কেমন যেন মনমরা হয়ে গিয়েছিল মনি ভাইজান এরপর থেকে। কারো সঙ্গেই মিশতো না। একা একা পুকুরপাড়ে বসে সবসময় পানির দিকে তাকিয়ে থাকতো। কখনো দ্যাখো পিঁপড়েদের চিনি খাওয়াচ্ছে, কখনো দ্যাখো গাছতলায় মাটির ওপর শুয়ে আছে, বলতে গেলে একেবারে অন্য রকমই হয়ে গিয়েছিল।
শেষে পড়লো জ্বরে। মাসখানেক ভুগেছিল। টাইফয়েড ধরনের একটা কিছু। সেরে যখন উঠলো, তখন আর চেনাই যায় না। দারুণ ভেঙে গিয়েছিল স্বাস্থ্য।
আবার সেই আগের মতো। ছবিদিকে দেখলেই চোখ ট্যারা করে বলে, স্টাইল! ব-র-ক-ধ-ঝ কুড় বা কুড় বা কুড় বা নিজ্জে—
ছবিদি খেপে ওঠে, ছোটলোক, গুণ্ডা।
রানিবুবুকে খোঁচা মেরে বলে, ভ্যাঁ!
রানিবুবু ছুটে যায় মার কাছে নালিশ করতে, তখন নিজে নিজেই কান ধরে ওঠ-বস করতে করতে মনি ভাইজান বলে, ঠিক আছে। ওকথা আর বলবো না, বলবো খ-চ-ট-ত-প-
পানুকে দেখতে পেয়ে বলে, বল ব্যাটা, ঝিনজার মানে কি?
পানু ভয়ে ভয়ে বলে, ঝাঁজা—
বাড়াবাড়িও ছিল। যেমন একবার:
গিনজার মানে কি?
গাঁজা–
চটে যাবার ভান করে মনি ভাইজান বললে, খোল ব্যাটা, প্যান্ট খোল। এই, কে আছিস, চাকু নিয়ে যায়, আজ ওর নুনু কাটবো, ওকে মুসলমান বানিয়ে ছাড়বো। বল আল্লাহ!
ভয়ে ভয়ে আলা না কি যেন বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিল পানু। সে বললে, ভগবান রাগ করবে, আমি পারবো না মনিদা, আমি পারবো না–
এ নিয়ে এক বিরাট ঝক্কি বেধেছিল। কিন্তু সেকথা যাক। কেনারাম কাকা মনি ভাইজানের হয়ে একদল উত্তেজিত মানুষের সামনে জোড়হাতে ক্ষমা চেয়েছিলেন, শুধু এইটুকু মনে আছে।
একটি বুড়ো ছিটকাপড়ওয়ালা ছিল। নমাস ছমাসে সে পিঠে ছিটকাপড়ের গাঁটরি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতো। খুব সম্ভব তার নাম ছিল জমাতালি। লোকটার সারা মুখে ছিল বসন্তের দাগ। যা সুন্দর ছিল তার হাসি! মনি ভাইজান বলতো, কোথেকে শিখেছ?
সে বলতো, শিখিনি, চাঁদনিচকের এক দোকান থেকে নগদ নসিকে দিয়ে কিনেছি।
দোকানের নাম?
হনহনে হাজরার দোকান। সবাই চেনে, জিজ্ঞেস করলেই দেখিয়ে দেবে। কতো রকমের যে ভ্যারাইটি। আসামি, মাদ্রাজি, কাশ্মিরি, বিলিতি, সে কতো রকমের। তা তুমি তো আর আমার মতো গরিব নও, তুমি কাশিরটাই নিও, দামটা একটু চড়া, এই যা। হোক চড়া, তবে সুতো খুব খাঁটি, বুননও খুব ভালো; এমন মিহি পাকা রঙের যে, রোদ-বৃষ্টির সঙ্গে বাজি ধরলে জিতে যাবে।
তখন মনি ভাইজান জিগ্যেস করতো, তোমার হাসিটা কোথাকার?
চন্দননগরের! রঙটা ভালো তবে তেমন টিকসই নয়, অনেকবার ফেঁসে গেছে। কি আর করি, নদীয়ার শালকরদের কাছ থেকে হাতেপায়ে ধরে আবার রিফু করিয়ে নিতে হয়েছে। ঐ হাসিটা আছে বলেই দুটো করে খাচ্ছি–
একবার জমাতালি মাকে বললে, বুবুজি, দোয়া করবেন, আমাদের মেয়ের বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে–
মা বললে, কোন্ মেয়ে?
মেয়ে তো আমার একটাই। তা ভালোই। ভিটেমাটি। ভিটেমাটি আছে। চেনাজানা ছেলে। দূর সম্পর্কে ভাইপো। বড় চিন্তা ছিল বুবুজি, ছবিরন আমার মা-মরা মেয়ে–
একটা পেতলের ঘড়া দিয়েছিল মা, এটা তোমার মেয়ের জন্যে নিয়ে যেও।
হাটখোলা পার হয়ে দক্ষিণ পাড়ার দিকে যাবার পথে পড়তো নগেন স্যাকরার দোকান। সময়ে অসময়ে কতো যে হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে ওই পথে। আমাদের বাড়ির সব সোনারূপোর গহনাই নগেন স্যাকরার বানানো। হয় টাকা, না হয় পুরোনো গহনা ঘর থেকে দেয়া হতো। প্রতিবারই সে টাকা ভেঙে বসে থাকতো। মনি ভাইজান আর আমাকে যেতে হতো তাগাদায়। গেলেই বলতো, মাকে বোললা, কালকেই আমি যাচ্ছি!
তার সে কাল বড় সহজে আর আসতো না। বেশিরভাগ সময়ই তাকে পাওয়া যেতো না, এমনিতেও তার যক্ষ্মারোগ ছিল। আব্বাকে না জানিয়ে মা এইসব তৈরি করাতো বলে কোনোরকমের উচ্চবাচ্য হতো না। সাধারণত আব্বা অফিসে চলে যাবার পর মা বলতো, ও মনি, বিকেলে একবার নগেন স্যাকরার কাছে যাস বাবা–
নগেন স্যাকরার বৌ-ছেলে-মেয়ে সবই ছিল। বাড়িতে গেলে তার বৌ গুষ্ঠি উদ্ধার করতো তার নাম ধরে। বলতো, কবেই বা সে বাড়িতে ছিল। দ্যাখোগে, হাটখোলায় সেই খুঁটেকুড়নি মাগীর আঁচল ধরে নির্ঘাত পড়ে আছে। এতে রক্ত ওঠে, তবু মরেও না। মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো।
শেষে হাটখোলায় মাধুর ঘরে তাকে পাওয়া যেতো। মাধু ছিল বিধবা। হাটখোলার ঘানিগাছ, বিস্কুটের তুন্দুর, আইসক্রিম ফ্যাক্টরি আর কামারশালার পিছনে একটা একচালা মাটির ঘরে সে থাকতো। বিশাল বিশাল দুটি বটগাছ পেছনে রেখে, গুচ্ছের আশ শ্যাওড়া চাকুন্দে বনমুলো কাঁটানটে আর বিড়ালহাঁচি শেকুলকাটার বন পার হয়ে, তবে সেখানে যেতে হতো।
মাধুর কেউ ছিল না। কখনো অন্য কাউকে সেখানে দেখিনি। বাড়ি-বাড়িতে সে খুঁটে আর গুল দিয়ে বেড়াতে। হাসলে তার গালে টোল পড়তো।
হয়তো নগেন স্যাকরাকে দেখা গেল, একটা গামছা কোনোমতে মালকোঁচা মেরে উঠেীনের চড়চড়ে রোদে উদোম গায়ে সটান উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাদুরের ওপর। আর তার তেল জবজবে পিঠে আচ্ছামতো মালিশ করে দিচ্ছে মাধু। হচ্ছে না কিছু হচ্ছে না, আরো চাপ দাও, আরো চাপ দাও–
আমাদের দিকে চোখ পড়ায় হয়তো মাধু বলে উঠল, ওমা দ্যাখো দ্যাখো কারা এসেছে! এসো গো খোকাদাদারা, দাঁড়িয়ে রইলে কেন, এসো–
ততক্ষণে ধড়ফড় করে উঠে বসেছে নগেন স্যাকরা। আরে, মনিবাবু যে, কি ভাগ্যি! কি ভাগ্যি! শিগগির পিঁড়ে এনে বসতে দাও মাধু, শিগগির! এ কি যে সে কথা! মনিদাদাবাবু! পোকা দাদাবাবু! অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!
আমার ছোট্ট সোনাদাদার মুখ লাল হয়ে গেছে রোদে—
এই বলে গ্লাসভরা পানি আর দুটো বাতাসা হাতে দিতো মাধু।
দু-একদিন এমন হয়েছে, মনি ভাইজান ফস করে বলে বসলো, আর নেই বাতাসা? থাকলে আরো দুটো দাও, পোকাটা একেবারে নেতিয়ে পড়েছে, কম দূরের পথ—
কাঁচুমাচু মুখে মাধু বলে, আজ তো আর নেই মনি দাদাবাবু! বেশি করে আনিয়ে রাখবো এরপর থেকে। ছোট্ট সোনাদাদাকে একদিন সন্দেশ খাওয়াব—
মা যেতে বলেছে তোমাকে আজকেই—
মনি ভাইজানের মুখে একথা শুনে নগেন স্যাকরা বলতো, আজকেই! নিজের চোখে তো দেখলে মনিবাবু, আজকে কি করে যাই! শরীরের গাঁটে গাঁটে খিল। ঝাড়ের বাঁশ, কিছুতেই আর ভাঙতে চায় না। কালই যাচ্ছি আমি, চিন্তা করতে বারণ করো মাকে–
কাল না গেলে কিন্তু ভালো হবে না–
অবশ্যই যাব, অবশ্যই যাবো! আমার নিজের গরজ আছে না? কতোদিন মাকে দেখিনি, কালই যাব।
ফেরার সময় ইচ্ছে করে একটা রূপোর আধুলি ফেলে রেখে আসে মনি ভাইজান উঠানের একপাশে। আমি দেখে ফেলায় বলে, কাউকে বলবি না, মাকেও না!
এই রকম ছিল সেসব।
একদিন দেখা গেল সত্যি সত্যিই পকেটে কোঁচা গুজে হাজির নগেন স্যাকরা। মা, মা কই— দরোজার বাইরে থেকেই চেঁচানি শুরু হয়ে যেতো তার। তারপর অনেকক্ষণ ধরে মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে বাঁধাগতে সে বলতো, ছেলেকে মাপ করে দিন মা! মাপ না করলে আমি কিছুতেই মাথা তুলবো না।
যতো রকমের নষ্টামি আছে সব শিখেছ–এইভাবে শুরু হতো ঝাড়াই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার রাগ পড়ে যেতো। বলতো, বোস, আমার জিনিস কই।
হয়ে এসেছে, এখন কেবল ছিলতে যে সময়টুকু। তা আগামী হপ্তাতেই পেয়ে যাবেন—
তোমার কথা আর ব্যাঙের মাথা!
মার যেমন কথা। দেখবেন এবারে কথার একন্নো আর নড়চড় হবে না।
একবার এলে সহজে আর উঠতে চাইতো না। বসে বসে রাজ্যির কথার ভুশুড়ি ভাঙতো সে। আঁটুলি হয়ে যেত। আমি কিন্তু চা না খেয়ে উঠব না, কতদিন মার হাতের চা খাইনি–
সে আমি জানি!
চা-মুড়ি খেতে খেতে সে বলতো, এইভাবে আপনাদের পাঁচজনের দয়ায় কোনোরকমে জীবন কাটছে মা, বড় কষ্ট!
তুমি তো নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারছো। হাটেবাজারে পড়ে থাক, ঘর-সংসার দ্যাখে কে, এখন আর তোমাকে বিশ্বাস করে কে কাজ দেবে–
দিব্যি করে বলছি মা ইচ্ছে করে কাউকে আমি ফাঁকি দিইনি। সময়মতো দিতে পারিনি, দু আনা সোনা এদিক-সেদিক হয়ে গেছে, এইটুকুই তো অপরাধ। তা সে আমি দিয়ে দেব। কড়ায় ক্রান্তিতে আমি সকলের সব পাওনা মিটিয়ে দেব, সব হিসেব আছে আমার কাছে, ফাঁকি দিলে সে নরকেও ঠাঁই পাবো না!
মা বলতো, তুমি কাজে মন দাও, ঘরে মন দাও—
ঘরে বড়ো অশান্তি মা!
ঐ মাধু মাধু করেই তুমি মরবে—
একথা বলছেন কেন মা! কি দিয়েছি আমি তাকে। এই আপনার পা ছুঁয়ে বলছি ও আমার এক পয়সাও নেয় না। উল্টো নিজের কাছে দু-এক টাকা যা থাকে দরকারের সময় তাই দিয়ে দেয়। দুঃখী মানুষের খারাপটাই শুধু দ্যাখে লোকে, আমি তো জানি— এই বলে একদিন কেঁদে ফেলেছিল নগেন স্যাকরা।
বসে বসে বিকেল পার করে দিত। শেষে মাকে বলতে হতো, নগেন এবার তুমি যাও–
প্রতিবার যাবার সময় পাঁচটা টাকা করে নিয়ে যেতো সে। সেই যে গেল, তারপর যথারীতি আর নামগন্ধ নেই আসার। আবার হাঁটাহাঁটি করতে হতো, তাগাদার পর তাগাদা শুরু হতো, শেষে সেই একই নিয়মে ঝট করে একদিন এসে হাজির। প্রায় প্রতিবারই ওঠার সময় সে বলতো, আমার কাপটা কিন্তু আলাদা করে রাখবেন মা, রাজরোগের ব্যাপার! এই বলে সে হাসতো। অদ্ভুত একটা হাসি। এ ব্যাপারে আমরা সতর্কই ছিলাম। গা ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেলে পুকুরে ডুব দিয়ে আসতে হতো মনি ভাইজানকে।
একদিন বিকেলে শেঠ পুকুরের মাঠে মনি ভাইজানরা ফুটবল খেলছে আর আমি বসে বসে তা দেখছি। পেছনদিক থেকে সাদা থান পরা একজন হেঁটে গেল, কাপড়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে সে যাচ্ছে। মনে হলো এ আর কেউ নয়, মাধু।
হাত নেড়ে ইশরা করলাম মনি ভাইজানকে। হাঁপাতে হাঁপাতে একদৌড়ে কাছে এস বললে, কিরে?
মাধু কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে–
কেন?
ঐ তো, দ্যাখো না—
মনি ভাইজান চেঁচিয়ে বললে, মাধু, ও মাধু, দাঁড়াও!
মাধুও দাঁড়াতে আমরা দুজন তার কাছে গেলাম। মনি ভাইজান বললে, কি হয়েছে তোমার, কাঁদছো কেন?
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল মাধু। কাঁদতে কাঁদতে তার গলা ভেঙে গিয়েছিল। বললে কতো মানুষের কাছে গেলাম, কেউ কিছু দিল না, সবাই দুর দুর করে তাড়িয়ে দ্যায়। আমি কার কাছে যাবো খোকা দাদাবাবু
মনি ভাইজান বললে, কেন হয়েছে কি?
মানষুটা মরে যাচ্ছে—
ঘরের দোরেই তো হাসপাতাল, ধরে বেঁধে পাঠিয়ে দিতে পারলে সেখানে?
যেতে যে চায় না, কতো করে তো বলছি! বলছি যাও, নিজের ছেলেমেয়েদের কাছে যাও, তা যাবে না। বেশি দেরি নেই, হয়ে এসেছে, মাধু আমার এখানেই বরাদ্দ— ডুকরে কেঁদে উঠে মাধু বললে, মুখে শুধু এই কথা। হাত ধরে কাঁদে আর বলে, কিছু করতে পারলাম না। ইচ্ছে ছিল! আমি কি কিছু চেয়েছি! বুক ফেটে যায়, ও বাবাগো——
মাটির ওপরে বসে পড়লো মাধু, মনে হলো এইবার সে মরে যাবে। মনি ভাইজান নাক টিপে ধরলে হাঁ করে সে আকাশের দিকে মুখ তুলে দম নিলো।
মরবে তো! মনি ভাইজান বললে, নোড়ো না এখান থেকে, যাবো আর আসবো। তারপর এক দৌড়ে অদৃশ্য।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এসেছিলো টাকা নিয়ে। খুব সম্ভব পাঁচ টাকা। আমাকে বলেছিল, খবরুদার, মাকে বলবি না পোকা, কাউকে না। কাল যদি ডিম-পরোটা হয়, আমার ভাগের থেকে আস্ত ডিমটাই তোকে দিয়ে দেব–
বলিনি। পরদিন ডিম হয়েছিল কিনা মনে নেই, তবে টাকার কথা কাউকে বলিনি। এখনো মনে আছে সে কান্নার কথা। অমন কান্না আর কাউকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। মাধুর ভালো নাম ছিলো মাধুরী। মাধুর ভেতর থেকে বোধহয় মাধুরীই কেঁদে উঠেছিল সেদিন অমন করে।
০৬. এই যে প্রফেসর
এই যে প্রফেসর, দেখা নেই যে?
আবদুল খালেক বললে, গত সন্ধ্যায় আপনি বসেন নি, আমি এসে ফিরে গিয়েছিলাম, দেখলাম বন্ধ।
নরহরি ডাক্তার বললে, বলেছিলাম। সন্ধে দিয়েই আবার বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কল ছিল। তা আপনি তো জানেনই। সেই যে। ক্রিমিন্যাল এ্যাবরশন কেসটা! বেশ কাজ হচ্ছিলো মেথারজিনে। গতকাল হঠাৎ দারুণভাবে ফল করলে টেমপারেচার। স্যালাইন ট্রানফিউশনের ব্যবস্থা করলাম। কোনো লাভ হলো না, মাঝরাতের দিকে টেঁসে গেল রুগী। চা খান। তা আপনাদের সব খবরাবখবর কি? কলেজের এ্যাফিলিয়েশনের কদ্দূর কি হলো? প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঢাকা থেকে ফিরেছেন দেখলাম। সকালে পুকুরঘাটে বসে বসে দাঁত ব্রাশ করছিলেন—
আবদুল খালেক স্বললে, খবর খুব খারাপ। এ্যাফিলিয়েশনের এখন আর কোনো আশা নেই, সেই রকমই তো বললেন।
বলেন কি?
এদিকে কলেজের অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন, যেকোন সময় দপ্ করে নিভে যেতে পারে। এ বছরে পাসের হারটা কি ছিল, ছাত্র আসবে কোথেকে!
তা বটে—
গত বছরে মোটামুটি শদেড়েক নতুন ছাত্র ভর্তি হয়েছিল। এ বছরে গোটা নয়েক, শেষ পর্যন্ত হয়তো জোরজার করে টেনেটুনে জন পনেরোয় উঠবে, এই তো অবস্থা। খুববেশি হলে আর মাস দুয়েক, তারপরে টিচারদের বেতন বন্ধ হয়ে যাবে!
নরহরি ডাক্তার বললে, আপনাদেরও কুড়েমি কি কম? সব কাজের একটা সময় আছে। সময়মতো চেষ্টা তদবিরটাই হলো বড় কথা। নতুন এ্যাফিলিয়েশন যেই বন্ধ করে দেবার কথা উঠেছে, অমনি আপনাদের ছোটাছুটি শুরু। কি দরকার ছিলো পুকুরটাকে ডাকে দেবার, কলেজ নিজের হাতেই তো রাখতে পারতো, মাছ ছাড়তে পারতো, কতকগুলো টাউটকে খুশি করা, এই তত? তা এখন সেই টাউটগুলোকে বলুন, বলুন কিছু ডোনার যোগাড় করে দাও——
আবদুল খালেক বললে, পরিষ্কার বুঝতে পারছি এখানকার পাট তুলে দেবার দিন এসে গেছে!
চেষ্টা-ফেষ্টা করছেন নাকি অন্য চাকরির?
কোথায় চেষ্টা করব, সে সোর্সও নেই, উদ্যমও নেই। তা, যা হবার একটা হয়ে যাক। তখন দেখা যাবে। এইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে ভীষণ ভেঙে পড়ি।
এক ফাঁকে একটা রুগী এসে বসেছিল। মাঝে মাঝে কাত হয়ে তার মুখের কাছে কান নিচ্ছিল নরহরি ডাক্তার। তারপর আবার সোজা হয়ে আবদুল খালেকের কথা শুনছিল। এক সময় ধমক মেরে উঠলো। অতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছ কেন ছেলে ছেলে করে, ভাইডালিনটা চলুক না, আমি কি ভেল্কি জানি যে, রাতারাতি ভালো করে দেব?
আবদুল খালেক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে বললে, হেপাটাইটিস, মানে যকৃতের ব্যাপার, প্রদাহের ব্যাপার, কি বুঝলেন! তাও আবার কিনা কনজেনিট্যাল, সারাতে সময় লাগবে না?
রুগীটি বেরিয়ে যেতেই ইমান আলিকে দেখা গেল সামনে দাঁড়িয়ে। ইমান আলি ইউনিয়ন পরিষদের ইলেকশনে চেয়াম্যান পদের জন্য দাঁড়িয়েছিল, জিততে পারেনি।
নরহরি ডাক্তার বললে, এই ডে ঢোলমার্কা ফেলুপট্টি, ভিতরে আসা হোক, ভিতরে আসা হোক!
ইমান আলি বললে, খবরটবর কি ডাক্তারবাবু!
আমদের আর খবর! দিন তো এখন তোমাদের।
ইমান আলি আবদুল খালেকের দিকে তার স্টার সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললে, শুনলেন তো স্যার, ডাক্তারবাবুর কথা?
নরহরি ডাক্তার বললে, উনি কি বলবেন, জানেনটা কি উনি! যে টাকা ঢেলেছিল ইলেকশানে, তার দ্বিগুণ-চতুগুণ ঘরে আসছে, খেলা কথা আর কি! আলুর দাম কতোয় উঠেছে, খেয়াল আছে?
ইমান আলি বললে, তাই বলুন!
বলবো আবার কি, এখনো সত্তরে গিয়ে থমকে আছে, শেষ পর্যন্ত ওই আশিতে গিয়ে ঠেকবে, তোমাদের আর পায় কে! তা ছেড়ে দিয়েছ নাকি আলু?
ইমান আলি বললে, পাঁচশো মণের মতো, এখন এই পর্যন্তই!
প্রফেসর কি বুঝলেন? নরহরি ডাক্তার বললে, কেসটা বুঝলেন। মরলো কারা, বেচারা চাষীরা। একে তো বিষ্টিতে সব পচে নষ্ট হলো, তারপর দাম পেল মোটে তিরিশ টাকা। ওতে কোনোমতে খরচও ওঠে না, লাভ তো দূরের কথা। ওদিকে কর্তারা টাউনে বসে বসে স্বপ্ন দেখছেন গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির, কৃষককে বাঁচাতে হবে, ভ্যারেণ্ডা ভাজতে হবে, সব বোগাস!
ইমান আলি চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললে, স্যারকে তো বলেছিলাম, কিছু আলু ধরে রাখুন, বেধে গেলেও যেতে পারে, তখন শুনলেন না—
আবদুল খালেক বললে, রাখবো যে তেমন সামর্থ্য কোথায়! আমার কিভাবে চলে ডাক্তারবাবু ভালো করেই জানেন!
আপনার কোনো ঝামেলা পোহাতে হতো না— ইমান আলি বললে, আমার আলুর সঙ্গেই স্টোরেজে উঠতো,মধ্যে থেকে ঘরে বসে কিছু টাকা ফাও এসে যেতো আপনার হাতে–
নরহরি ডাক্তার বললে, কাজের কথায় এসো, কলেজের তো চাট্টিবাট্টি গোল অবস্থা! তোমরা কোনো উদ্যোগ-ব্যবস্থা নেবে, না এইভাবে ধুকে ধুকে ওষুধপথ্যের অভাবে চোখের সামনে কলেজটা পটল তুলবে—
ইমান আলি বললে, মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন!
কেন, কি এমন খারাপ কথাটা বললাম! তোমাদের কি কিছুই করবার নেই? ইলেকশনে দাঁড়াবে, আবার অভিমানও করবে, টিকতে পারবে ভিলেজ পলিটিক্সে?
লোকে যাকে চায় না, তার আবার কিসের দায়দায়িত্ব?
দায়িত্বটা তারই–নরহরি ডাক্তার বললে, পলিটিক্সে আগে মার খেতে হয়, বুঝলে দাদা! গভর্নিং বডির মিটিং, কিছু খুচরো প্ল্যান-প্রোগ্রাম, আর লোক দেখানো ছোটাছুটি, এখনকার চেয়ারম্যানের দৌড় তো এ্যাদ্দুর। তোমারই উচিত কিছু করে দ্যাখানো। বড় বড় পার্টি সব ঢাকায় বসে থাকে। তারা মুততেও কখনও গ্রামে আসে না। তাদের সঙ্গে যারা যোগাযোগ রাখে, তারাই তাদের কাছের মানুষ। তাদের কাছে দৌড়বে, তাদের বোঝাবে, খুব কঠিন একটা ব্যাপার না–
ইমান আলি পা দোলাতে দোলাতে বললে, আগে দেখি, আমাদের চেয়ারম্যানসাব কি করে, তারপর ময়দানে নামবো—
নরহরি ডাক্তার বললে, চেয়ারম্যানের চেষ্টা-তদবিরেই রাস্তা আর ব্রিজের কাজকম্মো রমিজ মুন্সী পেয়েছিল, কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে রমিজ মুন্সী আর সিও ডেভের ভেতর নটখট বেধে গেছে। বাইরে রটেছে কলকাঠিটা তোমার নাড়া—
অমন অনেক কথাই রটে। একটা কাজ সেরে আসি। আপনি থাকবেন— এই বলে উঠে যায় ইমান আলি।
ইমান আলি বেরিয়ে যাবার পর নরহরি ডাক্তার বললে, কেমন একটা ডোজ দিলাম দেখলেন তো? ডোজটা ধরেছে মনে হলো। এখন আপনাদের কপাল—
আবদুল খালেক গায়ের জড় ভেঙে বললে, টুকুর মায়ের শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে–
কি রকম?
এই অসময়ে আর কি–
আগে হয়েছে আর, না এই প্রথম?
আগেও হয়েছে মাঝে মাঝে। এতোদিন কিছু বলেনি। এবারই বললে–
নরহরি ডাক্তার বললে, মেয়েদের ধরনটাই অমন। রোগটাকে পাকিয়ে ফেলে তারপর বলা। খুব বেশি কি?
তাই তো বলছে—
পিরিয়ড গেছে কতোদিন আগে?
এই দিন পনেরো আগে!
একটা স্লিপ টেনে খচ খচ করে ওষুধের নাম লিখে আবদুল খালেকের দিকে বাড়িয়ে দেয় নরহরি ডাক্তার। বললে, যাওয়ার পথে এটা নিয়ে যাবেন, আমার কাছ নেই, ট্রসটিন-এম। ঘরে ফেরার পথে ফুড়ে দিয়ে যাবোক্ষণ–
স্লিপটা হাতে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, কোনোদিকে বেরুবেন নাকি ডাক্তার একদিন না বললেন বেড়াতে বেরুবেন—
ফুরসৎ কই! গেলে আপনাকে বলবো!
আবদুল খালেক বললে, এখানে আর মন বসতে চাচ্ছে না, কি করি বলুন তো? সময় যেন আর কাটে না—
সেদিন যেন বলছিলেন রাতে ঘুমের খুব ডিসটার্ব হয়?
ঘুম হয় আমি ইচ্ছে করেই জেগে থাকি। ঐ সময়টা আমার ভালো লাগে–
বেশ রোমান্টিক লোক আপনি—
নরহরি ডাক্তারের ওখান থেকে বেরিয়ে কিছুদূর যেতেই বাজারের মুখে ওষুধের বড় দোকানটা দেখে তার মনে পড়লো, তার কাছে একটা স্লিপ আছে। স্লিপটা এগিয়ে দিল সে। ট্রসটিন-এম নেই। একবার ভাবলো, গিয়ে বলে। কিন্তু ইচ্ছা হলো না। যাক, পরে হবে। সে হাঁটা শুরু করে। কোথায় যাবে এখন! তার ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার।।
এক হয় হোস্টেলের দিকে হাঁটা। আজ বন্ধের দিন। ইচ্ছে করে। আবদুল খালেক জানে ওখানে এখন ধুমসে কাচ্চু কি হাইড্রোজেনের আসর বসেছে। সে নিজে শিক্ষক, কিন্তু তাস পেটানো সহযোগীদের কাউকেই তার তেমন ভালো লাগে না। এরা কেউ কিছু শেখেনি, এদের কারো চোখ নেই, মন বলে কোনো পদার্থ নেই, কোনোমতে একটা ভঁজকরা ডিগ্রী বগলে পুরে মাছির মতো চাক বেঁধেছে এখানে; এই রকমই তার ধারণা। এরা স্কুল, পরশ্রীকাতর, লোভী, অসৎ।
আবদুল খালেক নিজেকে আলাদাভাবে দ্যাখে। কারো সঙ্গেই তার কোনো রকমের অবনিবনা নেই। না থাকুক, তবু সে এদের একজন নিজেকে ভাবতে পারে না। বিরাট একটা ফাঁক, সে জানে না সে কখনও পার হতে পারবে না।
তা ইচ্ছে নেই এখন ঘরে ফেরার। ক্রমশ বুঝতে পারে, শুধু যে ঘরে তা নয়, কোথাও ফেরার তার ইচ্ছে নেই। এমনকি তার কোনো ইচ্ছাই নেই।
বাজারে বের হবার আগে একটা অদ্ভুত ব্যাপার তার চোখে পড়েছিল। সে জানতো না বলে হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। ভেতরে থেকে দরোজাটাকে নিছক ঠেলে না দিয়ে খিল আটকানো উচিত ছিল রেখার। সে তখন শাড়ি বদলাচ্ছিল। এই ধরনের অমনোযোগিতা খুবই অপছন্দের। না কি নিছক অবহেলা, নিজের প্রতি অবহেলা।
অস্বচ্ছ হলেও, এইসব ব্যাপারে তার একটা ধারণা আছে, সব মেয়েরাই এমন অসাবধানী নয়।
ট্রাসটিন-এম, নামটা ভারি সুন্দর।
ডায়াল-এম ফর মার্ডার, এ্যালান পোর একটি গল্প। ফ্রান্টম অব দি রু্য মর্গ, সে ছবি দেখেছিল মুকুলে। একে একে অনেক ছবি আর বইয়ের কথা তা মনে পড়ে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে দেখতে না দেখতে সে ভোঁতা মেরে গেল। কেমন একটু নুদির ভাব দেখতে পাচ্ছে পেটে। একজন নাদাপেট প্রফেসর গদাই লস্করে চালে চপর চপর পান চিবাতে চিবাতে বগলে একখানা বই নিয়ে চর্যাপদের ক্লাস নিতে যাচ্ছে, এই যদি হয় দুবছর পরের ছবি, তা কেমন হবে দেখতে।
দুবছর অনেক দূর। প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছিলেন, কলেজ উঠিয়ে দিয়ে ওটাকে একটা কোল্ড স্টোরেজ করে দিলে কেমন হয়!
তা উঠে গেলেই এক রকম ভালো। ঝক্কি চুকে যায়। পকেটে সিগ্রেটের প্যাকেট ঠেলে বেরুনো একরাশ ভ্যাদামার্কা ছেলে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এখন সেও হাঁপিয়ে পড়েছে। ছাত্র হলেও এদের অনেকেই পার্টটাইম ব্যবসায়ী, কেউ কেউ বিবাহিত, কারো কারো বয়সে কোনো গাছপাথর নেই। এছাড়াও কতো রকমের যে দুশ্চিন্তা। হাঁড়ির জিওল মাছের মতো অবস্থা, এই আছে এই নেই।
রেখা আর টুকু, এই দুজনের জন্যে তার ভাবনা। নিজেকে সে বাদ দেয়; নিজেকে নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই, কোনো না কোনোভাবে তার চলে যাবে।
এটাও একটা বাতুল চিন্তা ফালতু ধারণী। আবদুল খালেক শুধরে নেয় নিজেকে, তার ভাবনা-চিন্তায় ওদের ভূমিকা যেন নিছক বোঝার। এর ভেতরে আচ্ছন্নভাবে তার একটা অহমিকা আছে, সে চালাচ্ছে ওদের। কে ফাঁদের চালায়, আসলে তো যে যার নিজের জীবনকে নিজেই চালায়। চালানো মানে জীবনকে কোনোরকমে টেনে বেড়ানো। চেয়ে-চিন্তে, মেরে-কেটে, যেভাবেই হোক।
পায়ে পায়ে কাঁঠালতলির দিকে হাঁটতে থাকে আবদুল খালেক; উদ্দেশ্যহীন। দুএকটি ছাত্রের সঙ্গে দেখা হয়। স্যার কোথায় চললেন? জিজ্ঞেস করে কেউ কেউ। যাই দেখি— এর বেশি আর কিছু তার বলার দরকার হয় না।
একটা বিশাল অশথ গাছ আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। কোনোরকমে সে ডিঙিয়ে গেল। প্রথমে অবাক হলো। বিনা বিষ্টিবাদলাতেই এমনভাবে গাছ-গাছড়ার হুমড়ি খেয়ে পড়া সে আর কখনও দ্যাখেনি। খেয়াল করে দেখলো, গাছের গোড়াটা একেবারে ভোঁতা, শেকড়-বাকড় নেই। ক্ষয়া, পোকা খাওয়া। এই ভেবে কিছুটা অবাকও হলো, এতোদিন তাহলে গাছটা খাড়া দাড়িয়ে ছিল কিভাবেনিছক অভ্যাসবশত? না কি কোনো কিছুর অপেক্ষায়? এ পথে যতোবারই এসেছে, চোখে পড়েছে গাছটা; কেমন যেন ছন্নছাড়া চেহারা ছিল। মনমরা মনমরা। অনেক আগেই তার দিন শেষ হয়ে এসেছিল, এখন বুঝতে পারে, অনেক আগেই।।
দুপাশে ধানখেত, থৈ থৈ করছে বর্ষার পানি; হাঁসের খলবলে একটা বহর ডোবাডুবি শেষ করে খেতের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। আবদুল খালেকের ইচ্ছে কোথাও দু দণ্ড বসার। বাছাবাছির কিছু নেই, বসে পড়লেই হয়, ভয় ছাত্রদের নিয়ে। হাঁটাপথের একপাশে তাকে এইভাবে বসে থাকতে দেখে মাথামুণ্ডুহীন কতো কথাই তো তারা ছড়াতে পারে।
কোথাও কোনো আড়াল নেই। খুঁজলে পেয়ে যেতে পারে সুবিধেমতো একটা জায়গা। কিন্তু বেশি একটা আগ্রহও তার নেই, এমন নয় যে, সে হই হই করে বেরিয়েছে দিগ্বিজয়ে।
এই বর্ষা কালটা ভারি সুন্দর। প্রতি বছর চার পাশের কয়েকটা নদী পাল্লা দিয়ে ছাপিয়ে ওঠে। তারপর লোকচক্ষুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে আস্তে আস্তে ঢোকে গ্রামের ভেতর। এ গ্রাম, ও গ্রাম, এপাড়া, ওপাড়া, এই করতে করতে পুরো দেশটাকেই তারা ঢেকে দেয়। রুখু রুখু চেহারার গ্রামগুলো বন্য লাবণ্যে মায়াময় হয়ে ওঠে।
আবদুল খালেকের মনে হয় এর আগে কোনোদিন সে এতো মনোযোগ দিয়ে এসব দ্যাখেনি। আধবোজা চোখে অলস ঘুমের ভেতর তার দিন কেটেছে। এক একটা লোকের চেহারার দিকে তাকিয়ে এখন তার মনে হয়, এরা জীবনের মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষ। হয়তো ক্লান্ত, ধসনামা, তবু অবিরাম যুদ্ধ করে চলেছে।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাকার করেছে নিজের জীবনকে। কালঘুম। চেষ্টা করলেও এখন আর দেহের জড় ভাঙে না। পাথরের মতো নিরেট,কি অনড় এই মর্মান্তিক অবসন্নতা!
একটা মাছরাঙা গলাপানিতে নামা হিজলের ডালে গিয়ে বসলো। এটা একটা সম্পর্ক, এই মুহূর্তে আবদুল খালেকের তাই মনে হয়,অলিখিত—তবু যুগ যুগ ধরে এইভাবে চলে আসছে সবকিছু। না বসলেও চলে মাছরাঙার, একটা আধডোবা খাড়া কঞ্চির ওপর গিয়ে বসলেও তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। তবু হিজলের একটা শাখা,গোছা গোছা পাতার মনোরম একটা আড়াল সে যখন বেছে নেয়, তখন এক ধরনের নির্ভরশীলতা সত্য হয়ে ওঠে। বড় ক্ষণিকের এ সম্পর্ক, তবু দিব্যকান্তি।
রেখা, টুকু, রেখাটুকু—
কেবল এইটুকুই তার সামনে। দৌড়, দৌড়, লম্বা একটা দৌড়, তারপর সে পৌঁছেছে কেবল এইটুকুর সামনে।
রেখা আমার বাড়িতে মানুষ। তার নিজের ভাষায় পরের বাড়িতে। মামীর অবহেলা আর অত্যাচারে তার সমস্ত অতীত ছেঁড়া, টুকরো-টুকরো, ফালা ফালা। নিজের মনকে তাই রঙচটা তালিমারা ছাড়া অন্য কিছু সে ভাবতে পারলো না কোনোদিন।
রেখার ইচ্ছে ছিল মামীকে সে সবকিছু ফেরত দেবে; সব ঋণ–সব দেনা-পাওনা সে একদিন কড়ায়-ক্রান্তিতে শোধ দিয়ে দেবে। তার সব চিন্তা-ভাবনাকে সে এইভাবে ধারালো আর প্রতিশোধ-উন্মুখ। করে তুলেছিল। ফলে বিয়ের পরদিন থেকে এই একটা ব্যাপার আবিষ্কার করা তার পক্ষে অতি সহজ হয়ে পড়ে, যার নাম অক্ষমতা যতোই দিন গেছে, এই অক্ষমতা তার কাছে আরও প্রকট, আরো আরো নিরেট, আরো হীন হয়ে দেখা দিয়েছে। যতোবারই সে পা বাড়াতে গেছে, আশাভঙ্গের যন্ত্রণা তাকে তার নিজের কাছেই ফিরিয়ে দিয়েছে ততোবার। জীবনে এ এক ধরনের মার খাওয়া।
আবদুল খালেক মার খাওয়া রেখার ভেতরের দৈন্যদশার কথা ভেবে কষ্ট পেল। তার নিজের অপরাধও বড় একটা কম নয়, সে জানে। এমন কিছুই নেই তার কাছে জোর গলায় সে যার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। যদি বলা হয় হতোদ্যম, নৈরাশ্যপীড়িত, তারপরও কিছু বাকি থাকে; আজন্মকাল সে মাথা নিচু করে সবকিছু মেনে নেয়ার পক্ষপাতী। এইভাবে মেনে নিতে নিতে আজ সে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
ইচ্ছে ছিল মাকে কাছে রাখার। কোনোদিন সামান্য কোনো আগ্রহ দেখালো না রেখা। কথাটা সোজাসুজি কখনো না তুললেও, হাবেভাবে সবসময়ে সে বুঝিয়ে এসেছে। রেখা হয়তো দ্যাখে-একটা পেট; তার নিজের কাছে একটা প্রাণ। কতো রোগ, কতো শোক, কতো ঝড়বিষ্টিই না গেছে তার ওপর দিয়ে, রেখা তো আর সেসব কিছু দ্যাখেনি।
মাঝে মাঝে সে দুঃখ পেয়েছে, ভেবেছে এতো অনীহা কেন রেখার, এতো অশ্রদ্ধা কেন। ভেতর থেকে ভাঙা, যথাসর্বস্ব খোয়ানো, আর কখনো কারও কাছে যার কোনো দাবি নেই, এমন একটা নিরাপদ মানুষকেও রেখা একদিনের জন্যে ঠাই দিতে পারলো না।
কতো তফাৎ, আবদুল খালেক একটা বৌনাগাছের তলায় দাঁড়িয়ে এই কথা ভাবলো,-মা কি ছিল, আর রেখা কি; মাকে কিভাবে দেখেছে সে, রেখাকে কিভাবে দেখেছে। কাউকে না জানিয়ে,খুব গোপনে, টু-শব্দটি না করে, হাসিমুখে, কি অবিরল নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিল মা। সংসারের সামান্য একটা ফাটা পিরিচ, কিংবা ডাঙ ভাঙা কাপ, কিংবা ক্ষয়ধরা পেতলের খুন্তির গায়েও চোখের পানি ছিল মার। এমন কিছুই ছিল না, যার কোনো প্রয়োজন নেই, যা কখনও সংসারের কোনো কাজে লাগবে না। সবকিছু ছিল আদরের। পুরনো পাড় থেকে তোলা সামান্য যে পচা সুতো তারও যে যত ছিল, তাতে জীবনের ভার অনেকখানি লাঘব হয়। তুচ্ছ কুটোগাচা থেকে হাত-বেড়ি-খুন্তিরও অভিমান ছিল, তারাও বোধহয় মা বলে ডাকতে শিখেছিল। মনে হতো অপরাধী, ঘটিবাটির কাছে, ঘরদোরের কাছে, বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষকের কাছে। সামান্য যে ফেনফেলা গামলা, হাঁড়িধরা ন্যাতা, ঘরপোছা ন্যাতা, তিল তিল করে সে অপরাধের কথা তাদেরও বোধহয় এক সময় জানা হয়ে যেতো। সেই সে বছর, যে বছর উল্টোপাল্টা খুব ঝড় গেল, পুকুরপাড়ের বাতাবি নেবু গাছটা পড়ে যায়, টিন পড়ে সুকদেবের মার পা কেটে গিয়েছিল, রজনী ভেণ্ডারির অমন জোয়ান মেয়েটা কলেরায় মারা যায়, মনি আমার কোলে এলো–মা বলতো এইভাবে। তা, ও ছেলে তো আমার ধুলোয় ঘোঁটাকেটে মানুষ। না পেয়েছে আদর, না যত্ন। বছর না ঘুরতে কোলে এলো। টিপুর পিঠোপিঠি। কাকে দেখি, কাকে ধরি, একলা মানুষ। একটা গামছা বিড়ে পাকিয়ে মাথার নিচে দিয়ে মেঝেয় শুইয়ে রাখি, একা একা হাত-পা ছুঁড়ে খেলা করে, খিদে পেলে কাঁদে, পেট ভরা থাকলে ঘুমিয়ে থাকে, বড় অবহেলায় মানুষ হয়েছে ছেলেটা–
মার সে বলা ছিল কতো সুন্দর! ও আমার কোলে এলো–একটা গানের কলি। আজ, এই ভরদুপুরে, গরিব বৌনাগাছের নিচে দাঁড়িয়ে, এক অস্থির আবদুল খালেক, রেখা যাকে তার স্বামী বলে জানে, টুকু যাকে তার আব্বা বলে চেনে, হু হু করে কেঁদে ফেললো। এতোদিন পর, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ঝিরঝির বিপর্যয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তার মনে হলো, গাজর ঐ কলিতে ভরদুপুরেও আকাশে চাঁদ ওঠে, সব রোগের নিরাময় ঘটে, সব পাপ ধুয়ে যায়, জগৎ-সংসার ভেসে যায়। কেবলই মনে হয়, কৈ, কোথাও তো কোনো দাগ লেগে নেই!
স্যার, আপনি এখানে? আবদুল খালেকের এক ছাত্র রশিদুল বললে, কখন থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন—
আবদুল খালেক ব্রিত হয়ে বললে, এই একটু দাঁড়িয়েছিলাম। তোমাদের গ্রামগুলো ভারি সুন্দর!
রশিদুল খুশি হয়ে হাত কচলে বললে, চলুন না স্যার একদিন আমাদের বাড়িতে, আপনাকে ঘুরে ঘুরে সব দ্যাখাবো।
তোমাকে নিয়ে একদিন বেরুবো। প্রায়ই ইচ্ছে হয় ঘুরে ঘুরে সব দেখি, হয়ে ওঠে না।
আমাকে আগে থেকে বলে দেবেন। নৌকো ঠিক করে রাখবো–
আবদুল খালেক বললে, এবার ফিরতে হয়।
রশিদুল বললে, আমি বাজার থেকে আসছি। ভাবী আপনাকে ডাকার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলেন বাজারে। খুঁজছিল—
তাহলে তো তাড়াতাড়ি ফিরতে হয়।
রশিদুল বললে, আমি কিছুদূর এগিয়ে দেবো, এই রোদে একা একা ফিরবেন–
কোনো দরকার নেই–আবদুল খালেক বললে, তুমি বরং বাড়ি যাও, এ আর কতোটুকু পথ!
ফেরার পথে আবদুল খালেকের কানে বাজে অদ্ভুত একটা বাজনা, জিনজার-গিনজার ট্রসটিন-এম!
০৭. কাল থেকে ইস্কুল
মা বললে, কাল থেকে তোর ইস্কুল। কাল তুই ভর্তি হবি।
ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম, অসাড় হয়ে এলো হাত-পা। আব্বা, মা, টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, রানিবুবু, সবাইকে মনে হলো হৃদয়হীন, আমার জন্যে কারো এক ফোঁটা দয়ামায়া নেই। কেবলই কান্না আসে, মনে হয় সব শেষ হয়ে গেল, কাল হাত-পা বেঁধে এরা সবাই মিলে আমাকে পুকুরে ফেলে দেবে।
মনে হতো চিরকাল এইটুকুই থাকবো। এইভাবেই থাকবো। কেনারাম কাকার হাত ধরে হাতিপুকুর পাড়ে যাবো, শেঠপুকুরের মাঠে মনি ভাইজান ফুটবল খেলবে, একা পাশে বসে বসে তা দেখব। পাঁচু ঝুমিকে লুকিয়ে চুড়ির শেকল দেবে, ঝুমি পাঁচুকে লুকিয়ে দেবে ভাঙা তেশিরা কাঁচ; সবকিছু ধাপে ধাপে ওঠা, থাককাটা, রঙিন, এইসব দেখবো, বলবো না কাউকে। পুঁটির কাছ থেকে শিখবো পাখিদের ভাষা, তুলিপাখি ফিরে এলে বলবো, আমাদের ছেড়ে কেমন করে তুমি থাকো, তোমার কি কষ্ট হয় না? আমার তো হয়। ঘাটে যখন বসে থাকি, যখন বাগানে যাই, খেতে বসি, তোমার কথা মনে হয়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতে তোমার জন্যে কাঁদি।
মাকে বললাম, আমি ইস্কুলে যাবো না—
তা যাবে কেন, শুধু সকাল-বিকাল-দুপুর টো টো করে গাছতলায় গাছতলায় ঘুরে বেড়াবে। পাখানা যা লম্বা হয়েছে তোমার!
টিপু ভাইজানকে বললাম, আমি তোমার কাছে পড়বো, ইস্কুলে যাবো না–
নিজের পড়া নেই বুঝি আমার! ইস্কুলে না গেলে কি হয় জানিস? ঐ বিন্দের মতো ছায়াবাণীর সামনে বসে বসে পাপর আর তেলেভাজা বেচে খেতে হয়—
মনি ভাইজানকে বললাম, আমি ইস্কুলে যাবো না–
তোর ঘাড় যাবে। মনি ভাইজান বললে, টেনে টেনে কুলোর মতো করে দেবে তোর কান, মাথায় থান ইট দিয়ে একপায়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখবে, কান ধরে নীলডাউন হবি, গাট্টা খাবি, মাস্টারদের ফাসকেলাস ফাসকেলাস সব শাস্তি আছে, দেখিসখন। এক একদিন দেখবি এখানে খানিকটা গোশ নেই, পেটের এক থাবলা গোশ হাওয়া হয়ে গেছে, নাড়িভুঁড়ি সব দেখা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ করে হাওয়া ঢুকছে আর পটপট করে শব্দ হচ্ছে। যা ভালোবাসে মাস্টাররা কাঁচা গোশ খেতে–
হাউমাউ করে কেঁদে উঠে আমি বললাম, আমি মরে যাবো, মনি ভাইজান, আমি ঠিক মরে যাবো।
মনি ভাইজান একটা ছিপের সুতোয় বড়শি লাগাতে লাগাতে বললে, মরে যাওয়াতো ভালোই! মরে গেলেই পাখি হয়ে যাবি। পাখি হলে কতো মজা। যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবি। একবার বাঁশঝাড়ে বসবি, একবার আমড়া গাছে বসবি, একবার পেয়ারা গাছে বসবি, যখন যেখানে তোর খুশি। তুই মরলে মাছরাঙা হবি। ঝপাঝপ মাছ ধরবি আর খাবি। মীরজাফর মরে কি পাখি হর্বিছে জানিস, শকুন।
বললাম, শকুন তো অনেক—
তাতে কি–মনি ভাইজান বললে, এক একটা মানুষ মরে গিয়ে এক একটা শকুন হয়েছে। লর্ড ক্লাইভ, জগৎশেঠ, উর্মিচাঁদ, ওয়ারেন হেস্টিংস, নাদির শাহ, তৈমুর লং, ছবির ঠাকুমা মরার পরে ওরা সকলেই তো শকুন হয়েছে।
ছবির ঠাকুমার সঙ্গে মনি ভাইজানের খুব ঠোকাঠুকি হতো। বুড়ির ছিল শুচিবাই। হাঁটতো আর গোবর গোলা পানি ছিটাতো। মনি ভাইজান বলতো, ও বুড়ি, কাল নাকি তোমার বিয়ে? মদনা মুচিকে দেখলাম খুব ঘটা করে সেজেগুঁজে টোপর মাথায় দিয়ে তোমার জন্যে কলপুকুরে বসে আছে!
কলপুকুর এক সময় শুশানখোলা ছিল। কলপুকুরের কথা শুনেই হোক, কিংবা রগচটা স্বভাবের জন্যেই হোক, তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতো বুড়ি, ও নেড়ের ব্যাটা, তোর মাথায় বজ্রাঘাত হোক, তোর ওলাওঠা হোক, তোর কুষ্ঠব্যাধি হোক—
মনি ভাইজান বলতো, এ্যাতো ইংজিরি শিখলে কোতায়? ও বুড়ি, গোবর চচ্চড়িতে আজ হিং দাওনি?
হাতের কাছে যা পেতো তাই ছুঁড়ে মেরে বুড়ি বলতো, ওরে আবাগির ব্যাটা, তোর ধনুষ্টংকার হবে, বাঁদরের মতো খিচে খিচে তুই মরবি।
লুকিয়ে লুকিয়ে গরুর গোশ খাওয়া হয়, জানি না বুঝি–এই বলে দৌড়ে পালাতো মনি ভাইজান।
কুষ্ঠব্যাধি আর ধনুষ্টংকার এই দুটো নাম শুনলেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠতো। ধনুষ্টংকার যে কি, বুঝতাম না ঠিকই, কিন্তু দারুণ আতঙ্ক ছিল।
বুড়ি মরে গেলে মনি ভাইজান ছবিদিকে একদিন বলেছিল, আমি কাজীপাড়ার একদিল শাহর দরগায় পাঁচ পয়সা সিন্নি দিয়েছি, বাপরে বাপ, মরতে আর চায় না। ছবিদি কেঁদে ফেলেছিল শুনে। রাগ করে অনেকদিন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে আসেনি।
তারপর মনি ভাইজান বললে, পাখিদের ভেতরে যেমন দেখিস নানা জাতের পাখি, কোনোটা চড়ই, কোনোটা পায়রা, কোনোটা দোয়েল, কোনোটা কাক, মাস্টারদের ভেতরও অমন দেখবি। এক একটা এক এক টাইপের। এক রকমের মাস্টার আছে, তারা কখনও ভাত খায় না। তারা পেট বোঝাই করে শুধু রাগ খায়। এদের ধুতি খুব ময়লা, বড় বড় নখে সবসময় ময়লা লেপ্টে থাকে। দেখবি, এদের টিকিতে খুব সুন্দর সুন্দর গাঁদাফুল ফোটে। এক এক জাতের মাস্টার আছে, তারা দেখতে ঠিক নাদাপেটা গণেশের মতো। শুড়ে পেঁচিয়ে হঠাৎ দেখবি তোকে তুলে নিয়ে গেছে। জিজ্ঞেস করবে, আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছ? যদি বলিস মাছ দিয়ে, সে অমনি বলবে কি মাছ, পারশে? পারশে মাছে বড় স্বাদ হয়। অতি উপাদেয়। বেগুনের সঙ্গে ভারি চমৎকার জমে। জম্পেস করে খাওয়া যায়। আর এক টাইপের দেখবি, যারা ক্লাসে ঢুকেই বলবে, এ্যাই, এসব কি হচ্ছে এ্যা, বেতিয়ে গায়ের ছাল তুলে নেবো, পেয়েছটা কি, এটা কি গুলতানির জায়গা? তারপর বলবে, নো টক, পিনড্রপ সাইলেন্স, প্রথম বেঞ্চি থেকে শুরু করে রিডিং, এক এক করে সবাই,তারপর দেখবি ভোঁশ ভোঁশ করে নাক ডাকিয়ে সে ঘুমুচ্ছে। এরা এলে ভালোই হয়। ইচ্ছেমতো দারোগা-পুলিশ খেলা যায়, কাটাকুটি খেলা যায়, গল্পের বই পড়া যায়–
বললাম, মারে না?
তা মাঝে-মধ্যে একটু আধটু মারে বৈকি। তবে যারা খুব যত করে পাকা চুল তুলে দ্যায়, তাদের মারে খুব আস্তে করে। মার খাওয়ার কতোগুলো কায়দা আছে। হাত পাততে বললে হাত পাতবি ঠিকই, কিন্তু সপাং সপাং বেত পড়ার আগেই ঝট করে সেটা সরিয়ে নিবি, নিয়েই ওরে বাবাগো, ওরে মাগো, আপনার পায়ে পড়ি স্যার, মরে গেলাম স্যার—এই বলে চিৎকার করে উঠবি, তখন দেখবি স্যার বলবে, ঠিক আছে যাও, ভবিষ্যতে যেন মনে থাকে। আর যদি গাট্টা মারতে যায়, তখন হাত জোড় করে বলবি, মাথায় মারবেন না স্যার, মাথায় মারা নিয়ম নেই, আপনি পিঠে মারুন। এই বলে পিঠ পেতে দিবি। যেই পিঠে বেত পড়বে অমনি হুড়মুড় করে স্যারের গায়ের ওপর পড়ে যাবে, ব্যস্—
বললাম, তোমাকে মারে?
মারে আবার না? তোকেও মারবে। তা সে তেমন কিছু নয়। মার খাওয়ার কায়দা জানতে হয়। কায়দা জানলে মার খাওয়া আর এক গেলাস দুধ খাওয়া সমান কথা। তুই একটা ভিতুর ডিম। আমার কতো রকমের কায়দা আছে! এক একবার এক এক স্যারকে একেবারে অবাক করে দেই। একবার তো মার খেয়ে মরেই গিয়েছিলাম। স্যার যখন কেঁদে ফেললে, তখন বেঁচে উঠে চোখ মোছার জন্যে স্যারকে ব্লটিং পেপার দিয়ে বললাম, ঠিক আছে এবারের মতো বেঁচে উঠলাম, এরপর মারলে কিন্তু আর বাচবো না। স্যার কি করেছিল জানিস? কাউকে না জানিয়ে পঞ্চানন ময়রার দোকানে নিয়ে গিয়ে আমাকে পেটপুরে পান্তুয়া খাইয়েছিল, আর প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল যেন কাউকে না বলি। মারের বদলে পান্তুয়া খাওয়া যায়, বুঝলি, বুদ্ধি খাটাতে হয়–
ভয়ে ভয়ে বললাম, আমি যদি তোমার মতো বুদ্ধি খাটাতে না পারি?
মনি ভাইজান বললে, না পারলে না পারবি, তাতে কি! কতো উপায় আছে! তোকে মন্ত্র শিখিয়ে দেব। হাজার রকমের মন্ত্র আছে। যেমন ধর এই মন্ত্রটা। আগে গেলে বাঘে খায়, পিছনে গেলে সে পায়, শঠে শাঠ্যাং সমাচারেৎ এই বলে তিনবার বুকে ফুঁ দিবি, দেখবি মারতে গিয়েও সে থেমে গেছে, ফিক্ করে হেসে ফেলেছে।
বলতাম, অতো কঠিন কি আমার মনে থাকবে?
প্রাকটিস করতে হবে। ব্রতচারী খেলার কাঠি দুটো নিয়ে খট খট খটাং শব্দ তুলবি, আর মুখস্থ করবি, ব্যস!
কালীকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়, এই ছিল ইস্কুলের নাম। কেনারাম কাকাদের কয়েকজনের উদ্যোগে বোধহয় সে বছরই নতুন বসেছিল ইস্কুলটি। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন কেনারাম কাকাই। চৌধুরীপাড়ার এক বিশাল বাড়িতে ইস্কুল। উঁচু উঁচু ছাদ, মোটা মোটা থাম, চওড়া বারান্দা, ঘোরানো সিঁড়ি, ইস্কুল দেখে বুক টিপ টিপ করে। ভর্তি হয়ে গেলাম ক্লাস টু-তে। টু-তে যে ভর্তি হতে পারবো, এ ব্যাপারে কিছুটা সন্দেহ ছিল। ঘরে ফিরে দেখলাম সকলেই খুশি। আব্বা বললে, এবার ভালো করে লেখাপড়ায় মন দাও পোকা, এখন থেকে তো ইস্কুল।
প্রথমদিন ভর্তি হয়েই খালাস। কেনারাম কাকা বললেন, আজ থাক, একেবারে কাল থেকেই ক্লাসে আসবে।
প্রথম যেদিন ক্লাসে যাই, সেদিনকার কথা আজো মনে আছে। মনি ভাইজান একটা লাল গোলাপ আমার হাতে দিয়ে বললে, ক্লাসে প্রথম যে দিদিমণি আসবে, তাকে দিবি, এ মন্ত্রপড়া গোলাপ, খরবদার, মাটিতে না পড়ে, তোকে মারতে পারবে না।
প্রথম পিরিয়ডে এলেন করুণা দিদিমণি। নাম ডাকার সময় আমিও সকলের মতো বললাম, উপস্থিত! নাম ডাক শেষ হলে ভয়ে ভয়ে তাঁর কাছে গিয়ে ফুলটি দিতেই বললেন, বাহ, খুব সুন্দর!
ইস্কুলে পুরুষ বলতে ছিলেন কেবল বুড়ো হেডস্যার, চিত্তরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। বাদবাকি সকলেই মেয়ে। করুণা দিদিমণি, লাবণ্যপ্রভা দিদিমণি, হেম দিদিমণি, তরু দিদিমণি। ক্লাসেও ছেলেদের সংখ্যা ছিল নামেমাত্র, আসলে স্কুলটাই ছিল মেয়েদের। প্রথমদিকে বলে পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্যেই বোধহয় কিছু কিছু ছেলে ভর্তি করা হয়। আমিও সেই একই দলের। আমাদের ক্লাসে আটচল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর মাঝে ছেলে বলতে ছিলাম ভোলা বৈদ্যনাথ আর আমি।
টিফিনের সময় দেখি সিঁড়িতে বসে মনি ভাইজান। সর্বক্ষণ কেটেছে ভয়ে ভয়ে এই বুঝি কিছু হয়ে গেল, ধড়ে প্রাণ এলো মনি ভাইজানকে দেখে।
বললে, কিছু হয়েছিলো?
বললাম, না।
কি করে হবে, এ কি যে সে মন্ত্র, দেখলি তো! আমার হাতে মুড়ি-মুড়কি আর কদমার ঠোঙা দিয়ে মনি ভাইজান বললে, মন্ত্রের জোরে আমি যেকোনো লোককে চোখের পলকে একেবারে গরুছাগল-ভেড়া বানিয়ে দিতে পারি, জানিস তুই!
আমাকে হাবার মতো হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? ঐ দ্যাখ-দ্যাখ–এই বলে একটা গরুকে দেখালো। খুব কাছাকাছি গায়ে কালোর ছিটমারা একটা সাদা গরু একমনে ম্যাড় ম্যাড় করে টোঙা চিবাচ্ছিল। বললে, বল তো, ওটা কি? বললাম, একটা গরু!
তোর মাথা। ওটা হচ্ছে হরিপদ ঘোষাল। দ্যাখ না এখনো যুগান্তর কাগজের মায়া ছাড়তে পারে নি। একটা ঠোঙ্গা চিবোচ্ছে, তাও যুগান্তর কাগজের তৈরি। লাগতে আসে আমার সঙ্গে, দিলাম ব্যাটাকে গরু বানিয়ে, এরই নাম মন্ত্রশক্তি!
হরিপদ ঘোষালের ছেলে সুবলের সঙ্গে কি নিয়ে একটা ঝগড়া হয় মনি ভাইজানের, তারপর রাস্তার মাঝখানে ফেলে দে পিটুনি। হরিপদ ঘোষালের কাজ ছিল দুপুরের পর থেকে বাইরের বারান্দায় একটা ইজি চেয়ারে গাছেড়ে দিয়ে সেই সন্ধ্যা পর্যন্ত খবরের কাগজে ডুবে থাকা। তারই ফাঁকে ফাঁকে লোকটা নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে নিত। সুবলের কান্নাকাটিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সেদিন। তারপর হাঁকাহাঁকি, চিল্লাচিল্লি, থানা পুলিশ, রাজ্যের হাঙ্গামা।
মনে পড়লো বেশ কিছুদিন যাবৎ ঠিকই হরিপদ ঘোষালকে বারান্দার ইজি চেয়ারে দেখা যাচ্ছে না, কথাটা কি তাহলে সত্যি!
ক্লাস ফেলে এসেছি, আমি চললাম। ছুটির পর সোজা বাড়ি যাবি— এই বলে মনি ভাইজান চলে যায়।
প্রতিদিনই মনি ভাইজান একটা করে ফুলে মন্ত্র দিয়ে দিত। ফুল পেয়ে খুব খুশি হতেন করুণা দিদিমণি। মন্ত্রের কথা কখনো কাউকে আমি বলি নি, যদি তার গুণ নষ্ট হয়ে যায়!
আরতি, রমা, আশা, শেফালি, মল্লিকা, এক একদিন আমি এদের এক একজনের পাশে বসি। খুব ভাব জমেছিল আমাদের এই কজনের মধ্যে। বৈদ্যনাথও ছিল কিছুদিন। ওর ছিল কানপচার ধাত। ওকে পেছনের বেঞ্চিতে বসতে হতো শেষ পর্যন্ত। পেছনের বেঞ্চিতে বসতো আরো একটি মেয়ে, অর্চনা। অর্চনাই ছিল সব ক্লাসের সকলের চেয়ে বয়েসে বড়। লম্বাও ছিল। অনেকেই আমরা তার কোমর সমান ছিলাম।
তা আমরা ডাকতাম অর্চনাদি। অর্চনাদি একটু হাবা কিসিমেরই ছিল, যতোদূর মনে পড়ে। তার মাথায় উকুনও ছিল। এই জন্যে
কেউ তার কাছাকাছি ঘেঁষতে চাইতো না।
এক একদিন এমন হতো, হয়তো টিফিনের ছুটি, মেঝেতে বসে পা লম্বা করে অর্চনাদি মাথার উকুন খুঁটতে শুরু করেছে, আমাকে দেখে বললে, এখানে বস, তোর নখ দেখি—
আমি নখ বাড়াতে একটা উকুন বসিয়ে দিল তার ওপর। বললে মার। যেন পট করে শব্দ হয়—
এইভাবে পটপট করে উকুন মারতে হতো। কখনো বললে, আমার খাতার মলাটে বৌদি লেখেছে কে রে? মিথ্যে বলবি না। মিথ্যে বললে মা সরস্বতী তোকে ফেল করিয়ে দেবে, বুঝে-শুনে
বলিস—
অর্চনাদিকে নিয়ে নানা রকমের হাসিঠাট্টা চলতো। একদিন আরতি বললে, তোরা জানিস, গতকাল বরের বাড়ি থেকে অর্চনাদিকে নাকি দেখে গেছে!
অর্চনাদি বললে, গতকাল কে বললে তোদের, সে তো গেল মাসে। গণ্ডেপিণ্ডে গিলে তারপর যাবার সময় বললে, গিয়ে খবর দেবো। ঐ পর্যন্তই। কোনো খবর দেয়নি। আমাকে আর কে পছন্দ করবে, আমি তো আর তোদের মতো সুন্দর না ভাই! হাতের সেলাই দেখে যদি কেউ পছন্দ করে!
অর্চনাদি বাড়ি থেকে কৌটোয় ভরে প্রায়ই নিয়ে আসতো নানারকমের টক-মিষ্টি আঁচার। আমরাও ভাগ পেতাম।
টিফিনের ছুটিতে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়তাম আশপাশে। চৌধুরীপাড়ায় মস্ত একটা বাড়ি ছিল, বাড়িটার জানালা-দরোজা কখনো খোলা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লোকে বলতো সেটা চৌধুরীদের বাড়ি। ফটকের মুখে দুপাশে দুটো পাথরের সিংহ। আমরা যেতাম ইউক্যালিপটাসের সুগন্ধি পাতা কুড়তে। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে থাকতে পাতাগুলো।
একবার কপালে ফেটিবাঁধা একটা পাগল আমাদের ধরেছিল। বললে, ভীমনাগের সন্দেশ খাবে তোমরা? তাহলে চুপটি করে হাতটি পেতে আসন গেড়ে বসে পড়ো এই ঘাসের ওপর!
আমরা বসে হাত পাততেই সে সকলের হাতে দুটো করে ছোলাভাজা দিয়ে বললে, খাও, খেয়ে দ্যাখো কেমন মিষ্টি!
আমরা বললাম, এ তো ছোলাভাজা!
সে বললে, যাঁহা ছোলাভাজা, তাঁহা সন্দেশ। সন্দেশ পেটে গিয়ে ছোলাভাজা হয়, ছোলাভাজা পেটে গিয়ে সন্দেশ হয়। মোসলমান মরে গেলে হিন্দু হয়, হিন্দু মরে গেলে মোসলমান হয়। পেটই হচ্ছে চিতা, পেটই হচ্ছে কবর; সে হালুম-হলুম গবগবাগব গবগবাগব সব খেয়ে ফেলে, সব হজম করে ফ্যালে। হজমের পর তো সব একই—
দে দৌড় দে দৌড় বলে ভয়ে আমরা যখন ছুটে পালাচ্ছি, পেছন থেকে সে তখন আহ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেছিল।
আর একবার দেখা হয়েছিল একটা খুনখুনে ছেলেধরা বুড়োর সঙ্গে। তার পিঠে শুকনো পাতা বোঝাই বস্তা। সে আমাদের দেখে বললে, বাছারা জানো আমি কে? ঐ হোথায় কলপুকুরে শেয়ালের গর্তে আমি থাকি। যখন দাঁত ছিল তখন এমনিই জ্যান্ত জ্যান্ত বাচ্চাকাচ্চা ক্যাচম্যাচ করে চিবিয়ে খেতাম। এখন দাকা দাকা করে কেটে একঘটি জলের সঙ্গে টপটপাটপ গিলে খাই। ছাড়ো দেখি কিছু পয়সা, তা নৈলে কিন্তু রেহাই নেই—
কুড়িয়ে বাড়িয়ে সকলের সব পয়সা মিলিয়ে হলো মোট তিন আনা। সেই তিন আনা দিয়ে তবে রেহাই। লোকটা বললে, কুল্লে তিন আনা? কেমন ধারার কথা গো? তা দাও দিকি যা আছে। কাল যে কি কুক্ষণে পাঁচকড়ির ব্যাটা এককড়িকে গিলেছিলাম, সেই থেকে পেটটা কেমন দমসমে হয়ে আছে। নৈলে কি আর একটাকেও ছাড়তাম!
হামব্যায়লায় জামব্যায়লায় ঘাস ক্যামবায় খায় গাইতে গাইতে বুড়োটা একদিকে চলে গিয়েছিল।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটে। হঠাৎ শোনা গেল বুড়ি গিরিবালাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। মনি ভাইজান বললে, খামোকা বুড়িকে কষ্ট দিচ্ছে ওরা। ও কি আর কিছু জানে? বুড়ির উঠোনের জঙ্গলের ভেতর চোর-বদমাশেরা নাকি চুরির মালামাল পুঁতে রাখতে, ওখানে বসেই ভাগ-বাটোয়ারা করতো। তা বুড়ি তো ভালো করে চোখেই দ্যাখে না, ও কি জানবে।
ছাড়া পেয়ে কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল বুড়ি। আমাকে ওরা এইভাবে হেনস্তা করলে রে, কেন আমার মরণ হয় না! ও ভগমান, চোখের মাথা খেয়ে বসে আছিস, আমাকে তুলে নে, আমাকে তুলে নে। এইসব বলতো আর সমানে দেয়ালে মাথা কুটতো গিরিবালা!
রমা, আশা, শেফালি, আর আমি একদিন বিকেলে দল বেঁধে গিরিবালার ওখানে গিয়ে দেখি, মনি ভাইজান তার মাথায় পানি ঢালছে। আমাদের দেখে বোধহয় একটু লজ্জাই পেয়েছিল। বললে, কি চাস এখানে, যা ভাগ, ভাগ এখান থেকে–
এক একদিন দল বেঁধে হাতিপুকুরের কাছাকাছি যেতাম, দুপাশে বকুল গাছে ঢাকা একটা লাল সুড়কির রাস্তা ছিল সেখানে ঐ রাস্তারই এক এক পাশে এস.ডি.ও সাহেবের কুঠি, মুনসেফ সাহেবের কুঠি। সারাদিন বকুল ফুলের গন্ধে ভুর ভুর করতো ঐ অঞ্চলটা। ফুল কুড়োনো শেষ করে তারপর যে যার বাড়িতে ফিরে যেতাম।
এক একদিন আস্তো প্রমীলা ধাত্রী। সাধারণত বিকেলের দিকেই আসতো বুড়ি। সাদা মড়মড়ে থানেমোড়া প্রমীলা ধাত্রীকে আমরা সবাই ভয় করতাম। সে ছিল ভারি খটটাই মেজাজের। বসে বসে মার সঙ্গে গল্প করতো, আর একটা বড় গ্লাসে করে চা খেত। তার জন্যে একটা আলাদা গ্লাসই ছিলো। আমরা সকলেই ছিলাম তার হাতের। সে জাতে ছিল খ্রীস্টান। প্রতিটি বাড়ির অন্দরমহলের সব খবর ছিলো বুড়ির নখদর্পণে।
তা বড়টি এখন কি করছে?
এবার কলেজে ঢুকলো।
মেজ?
এবার ম্যাট্রিক দেবে—
মেয়েটি?
এই তো নাইনে উঠলো—
ভালো। তা তোমার স্বাস্থ্য কিন্তু দিন দিন কাঠি হয়ে যাচ্ছে মনির মা, দেহের দিক একটু যত্নআত্তি নিও–
মা উত্তর দ্যায়, এই নানারকমের চিন্তা-ভাবনা! পার্টিশান—
সে তো আছেই— প্রমীলা ধাত্রী বললে, এতোগুলো ছেলেমেয়ে পেটে ধরা, তাদের মানুষ করা, এ কি মুখের কথা!
আমরা ধারে-কাছে গেলেই খাঁউ করে উঠতো বুড়ি।
কি চাও এখানে? শুধু গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরা। বেচারির হাড়-মাংস সব এক করে ফেলেছে, যাও, বাইরে যাও, খেলেগে যাও খেললাগে যাও–
কখনো মাকে বললে, মনিটার দিকে একটু খেয়াল কোরো। যেখানেই যাই ওকে দেখি, এতো বেশি দস্যিপনা ভালো নয়। এখন থেকে না আর্টলে পরে পস্তাবে। লেখাপড়ায় কেমন?
পাস তো করে—
প্রমীলা ধাত্রী কিছু একটা চিন্তা করে বলে, ওকে বাইরে কোথাও রেখে পড়াতে পারো না? কোনো কোরোস্টালেও তো দিয়ে দিতে পারো।
ওকে নিয়েই তো আমার যতো ভয়, দস্যু ছেলে, চোখের আড়াল করি কিভাবে?
মায়ের স্নেহ হচ্ছে ডাইনীর স্নেহ, এই করে করে তো তোমরা ওর মাথা খাবে। একদিন দেখবে হুট করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসে আছে। এখন কি আর সেই আগের মতো দিনকাল আছে! শক্রতা করেও তো লোকে একটা কিছু বাধিয়ে বসতে পারে। এই তো শুনলাম, সেদিন ঘোষালদের ছেলেটাকে রাস্তায় ফেলে ঠেঙিয়েছে! কি না হতে পারতো এইটা নিয়ে–
দ্রুত একটা পরিবর্তন ঘটছিল চারদিকে। সেসব আমরা কিছু বুঝতাম না। হিন্দু মুসলমানদের দলাদলির কোনো ব্যাপার থেকে বালক সংঘ ভেঙে দু টুকরো হয়েছিল। কাজীপাড়ার একটা দলের সঙ্গে তুমুল মারপিট হলো একবার। তখন চলাচল ছিল মার্টিন ট্রেনের। চলতো ঢিমেতালে। কাজীপাড়ার ছেলেরা চলন্ত মার্টিনে উঠে কোনোরকমে মাথা বাঁচায়। যাওয়ার সময় বলে যায়, এর হিসেব হবে, এক একটা করে লাশ পড়ে থাকবে মাটিতে।
একদিন হরিপদ ঘোষালের সামনে পড়ে গেলাম। আমার পেটে আলতোভাবে ছড়ির ডগা ছুঁইয়ে জিজ্ঞেস করলে, কি হে বালক, তোমাদের বাড়িতে শুনি কাজীপাড়ার মোচোনমানরা দেদার মিটিং করে? তোমার বাবা পাকিস্তান চায় নাকি?
পাকিস্তান কি জানা ছিল না। বুঝতাম না এসব কিছুই। কাজীপাড়া একদিল শার দরগা ঘিরে মুসলমান সমাজের একটা বেড়; সেখানে অন্যকোনো জাতের লোক ছিল না। গরুর গোশত কিনতে হলে ওখানকার হাট ছাড়া আর উপায় ছিল না।
কিছুদিন আগে কিসের যেন একটা ভোটাভুটি গেছে; সেই থেকে দেখতাম আমাদের পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই মনমরা, কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারি, কিন্তু কি তা বুঝি না।
কিছুই জানতাম না।বুঝতাম না। মাঝে মাঝে আমাদের গ্রামের বাড়ির নিকট আত্মীয়-স্বজনরা এসে ফিসফাস করতো ঠিকই, তখন সকলের মুখেই থাকতো দুশ্চিন্তার ঝুলকালি মাখা ময়লা ছাপ; আব্বা শুধু গম্ভীর মুখে বলতেন দেখা যাক কি হয়—
আমাদের বাইরের ঘরেও মাঝে মাঝে শুনতাম তুলকালাম চলছে। আব্বা, কেনারাম কাকা, দুর্গাদাস বাবু, নির্মল বাবু আরো অনেকেই খুবই শোরগোল তুলে তর্কাতর্কি করতো। আমাদের কানে আসতো কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, জিন্না, জহরলাল, প্যাটেল, সব মনেও নেই।
আমার একটা গজদাঁত বেরিয়েছিল। হরিতাল মোড়ে গিয়ে ধীরেন ডাক্তারের কাছ থেকে পুরোনো দাঁতটাকে ওপড়ানো হয়।
রাতে দুর্গাদাস বাবু আব্বাকে বললেন, ব্যাপারটা কি হলো, আমি থাকতে ছেলেটাকে হেতুড়ের কাছে পাঠানোর মানেটা কি?
ধীরেন কম্পাউন্ডার থেকে ডাক্তার বলে পিছনে সকলেই তাকে হেতুড়ে ধীরেন নামে ডাকতো।
আব্বা বললে, ওসব ওর মা জানে—
দুর্গাদাস বাবু গলা চড়িয়ে বললেন, হেতুড়ে ধীরেনই তোমাদের কাছে বড় হলো, এর আমি ব্যাখ্যা চাই।।
চাঁপাড়ালির মোড়ে ছিল মসজিদ। কাজীপাড়া, ময়না আরো দূর দূর থেকেও অনেকে নামাজ পড়তে আসতো সেখানে। বিশেষ করে ঈদের দিন। সেবার হয়েছে কি,আমরা দল বেধে সকলে মসজিদে যাচ্ছি ঈদের নামাজ পড়তে হঠাৎ একটা ঢিল এসে পড়লো। ঢিলটি পড়লো টিপু ভাইজানের পায়ে। পেছনে কে যেন চেঁচিয়ে বললে, দ্যাখ দ্যাখ, মাথায় লেজওলা লেড়েরা কেমন কপাল ঠুকতে যাচ্ছে।
আব্বা বললে, কোনোদিকে খেয়াল করার দরকার নেই, হাঁটতে থাকো—
তা, আমরা সেইমতোই মাথা নিচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে মসজিদে গিয়েছিলাম।
সে বছরই দুর্গাপূজার সময় চারদিকে যাত্রার ধুম পড়ে যায়। সব শখের দল। কেনারাম কাকা এসে বললেন, পোকা, যাবি নাকি যাত্রা দেখতে? তোদের জামাইবাবু পার্ট করবে–
মা বললে, ও কি আর সারারাত জাগতে পারবে?
কেনারাম কাকা বললে, বুড়ার সঙ্গে থাকবে, জাগতে না পারে ঘুমুবে–
বুড়া কেনারাম কাকার মেয়ে। আর কোনো ছেলেমেয়ে না থাকায় ঘরজামাই রেখেছিলেন কেনারাম কাকা। জামাইবাবুর নাম ছিল দেবীনাথ। মাঝে মাঝে তাকে দেখা যেতো ইস্কুলে মাস্টারি করতে। ঐপর্যন্তই। গান-বাজনা ভালোবাসতো। গান-বাজনা নিয়েই থাকতো। রোজ বিকেলে দেবীনাথ জামাইবাবুর ঘরে গান-বাজনার আসর বসতো নিয়মিত। মাঝে মাঝে উঁকি-ঝুকি মেরে দেখতে গিয়ে আমি বিশ্রীভাবে ধরা পড়ে যেতাম। একটা পোষা তোতাপাখি ছিল জামাইবাবুর। দেখতে পেয়ে দাঁড়ের ওপর থেকে সে চিৎকার জুড়ে সুর করে বলতো, ওমা! দেবী দেবী দেবী! এই দেবী! এই দেবী। এই দেবী! কে দ্যাখো কে দ্যাখো কে দ্যাখো—
দেবীনাথ জামাইবাবু এক একদিন বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে পেয়ে বলতো, ও তুই, পোকা, আয় না ভিতরে এসে বস্।
কিংবা নিয়ে যেতো ভেতরে। বুড়াদিকে বলতো, আজ না তুমি গুড়ের সন্দেশ তৈরি করেছো, দাও না ওকে—
বুড়াদি কটমট করে জামাইবাবুর দিকে তাকিয়ে বলতো, সে কি আর আছে, সব তো শেষ হয়ে গেছে
কেন তাকের ওপরে যে দেখলাম?
ওতো ঠাকুরের। পুজোয় লাগবে না? তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলতো, তুই সন্ধ্যার পরে আসিস, আমি পুজোটা দিয়ে নিই—
তা দেবীনাথ জামাইবাবুও কম নাছোড়বান্দা নয়। বলতো, এও তো একটা ঠাকুর, তোমার গোপাল ঠাকুর হে! জ্যান্ত পেয়েছ বলে এভাবে ঠকিয়ো না, দাও দাও, তোমার তো লক্ষ্মীর হাত!
বুড়াদির সঙ্গে গেলাম যাত্রায়, মহারাজ হরিশচন্দ্র। সারা গায়ে গহনা পরা কালো রঙের বাঁশি কেঁদে উঠতেই ঐকতান শুরু হয়ে যায়। এমন মন খারাপ হয়ে গেল যে, তা বলবার নয়। দেবীনাথ জামাইবাবু হয়েছিল হরিশচন্দ্র। কালো ধুতি পরে, ছাইকাদা মাখা শরীরে মড়া পোড়াবে বলে শ্মশানে দাঁড়িয়ে। কেউ একজন তার পিঠে লাঠির বাড়ি মারতেই ভীষণ কান্না পেল আমার। বললাম, ওরা অমন মারলো কেন, জামাইবাবু তো আর কোনো দোষ করেনি–
বুড়াদি সে কথায় কান না দিয়ে বললে, ইস্ কি বিচ্ছিরিটাই না দেখাচ্ছে দ্যাখতো! কালি মেখে একেবারে ভূত সেজেছে! কে দেখে বুঝবে গায়ের রঙ অমন টকটকে ফরসা, ইশ!
বললাম, বুড়াদি দ্যাখো, জামাইবাবুকে ওরা আবার মারলো।
বুড়াদি এবার আমার গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেললে। বললে, কেন একবার মারলেই তো হয়! ওতো খুব ভালো পার্ট করছে, এইজন্যে হিংসে করে অমনভাবে মারছে। আগে ঘরে গিয়ে নিক, যাত্রা দলে নাম লেখানো বার করে দেবো! ইচ্ছে করে মার খাওয়া—
রাজমুকুট, টিপু সুলতান, মহারাজ নন্দকুমার, আর অনেক পালা চলেছিল। তবে আমার যাওয়া ঐ একদিনই। বুড়াদির সঙ্গে যেতে রানিবুবু। কেবল একদিনই মনি ভাইজান গিয়েছিল। ঘরে ফিরে সে কি রাগারাগি। বললে, ধুৎ বুড়াদির সঙ্গে মানুষ যায়! থির হয়ে বসতে দেবে না কিছুতেই। একবার বলে ও মনি, যা না ভাই, এক দৌড়ে আমার বাসকোর চাবিটা নিয়ে আয়, বিছানার ওপর ফেলে রেখে এসেছি, কতো কিছু রয়েছে বাসকোয়। একবার বলে মনি, যা তো, চুপি চুপি তোর জামাইবাবুকে গিয়ে বলে আয়, মুকুটটা ঠিকমতো বসে নি, কি বিচ্ছিরি দেখাচ্ছো! যতোসব ঝক্কি!
মনি ভাইজান রাগ না করলেও বোধহয় পারতো। বুড়াদির বাচ্চা হবার আগে তো মনি ভাইজান আর কম ছোটাছুটি করে নি! কি খেয়াল হলো, বুড়াদি বললে, দত্তপুকুরে বাবুদের জলপাই বাগান আছে, এনে দিবি? মনি ভাইজান ছুটলো আনতে। একবার দত্তপুকুর, একবার মধ্যম গ্রাম, একবার বিরাটিতে, একবার শুমোয়, এইভাবে ছোটাছুটি করতে মনি ভাইজান। একবার করিমন বিবির গাছ ভেঙে ডালসুদ্ধ পেয়ারা নিয়ে হাজির, বুড়াদি কি খুশি! বললে, আর জন্মে মনি আমার ভাই ছিল। কেন যে ওর এতো মায়া।
টিপু ভাইজান কলকাতার কলেজে ভর্তি হবার পর আমরা সবাই তাকে বেশ সমীহ করে চলতাম। টিপু ভাইজান যখন গোঁজামিল দিয়ে কোনো রকমে দায়সারাগোছের নাকেমুখে কিছু গুঁজে তাড়াহুড়ো বাধিয়ে বলতো, আজ প্রফেসর বটব্যালের ক্লাস আছে, অটল পাহাড়ের মতো মানুষ, সময়মতো না পৌঁছুলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে–তখন অবাক হয়ে আমরা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম।
অটল পাহাড়ের মতো মানুষের মুখোমুখি কোনোদিন কি দাঁড়াতে পিরবো, ভয় হতো। কখনো গায়ে হাত তোলেন নি করুণা দিদি মিণি। কোনোদিন কোনো কারণে যদি দেখি তার মুখ কালো ভয়ে হিম হয়ে গেছে শরীর, বুকের ভেতর সে কি দুরু দুরু! এক একদিন নিজেই কেঁদে ফেলতেন। বলতেন, ঠিক আছে কাল থেকে আমি আর আসবো না। তোমরা কেউ আমাকে ভালোবাস না, কেউ মন দিয়ে আমার পড়া কর না, আমি তোমাদের কেউ নই।।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলতাম, হে আল্লা করুণা দিদিমণি যেন কাল ইস্কুলে আসে— যেন এই গতকাল ঘটেছে সবকিছু। যেন এইমাত্র সবাই গলা মিলিয়ে গাইলাম সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, এইমাত্র হাতে ফুল নিয়ে করুণা দিদিমণি বললেন, বাহু, ভারি চমৎকার! অথচ কতোকাল আগের কথা সেসব। পোকা, ও পোকা, এমন চুপ কেন? বল আরো বল। তোমার আর কি দোষ। পোকা, ও পোকা, এমন কাঁদ কেন? তোমার আর কি দোষ, ভালোবাসার যে এতো দায়ভাগ, তুমি যে তার কিছুই জানতে না কাদো কেন?
০৮. সংসারে মন
রেখা বললে, তুমি এসব কি শুরু করেছে বলোতো? লোকে শুনলে কি বলবে! তুমি কি কোনোদিন সংসারে মন দেবে না?
আবদুল খালেক বললে, সংসারেই তো আছি।
তা আছে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই একে কি থাকা বলে? সারারাত জেগে ঐ সব লিখে কি ফায়দাটা পাচ্ছো তুমি! বন্ধু কি তোমাকে গাছে চড়িয়ে দেবে। কেন তুমি ভূতের বেগার খাটতে যাবে। একটা চিরকেলে বাজে স্বভাব; যখন যেটা মাথায় ঢুকবে কচলে কচলে তাকে তেতো না করে ছাড়বে না।
মালেক রাগ করবে, অনেকদিন থেকে ওকে ঘোরাচ্ছি! না পেলে এবারে মেরে বসবে—
মালেককে নিয়ে থাকলেই হয়, অতো যখন সম্পর্ক!
কিভাবে যে তুমি কথা বলো—
ঘরের বৌয়ের কথা কারোই মিষ্টি লাগে না। সব বুঝি, এখন তোমার একটা প্রেম করার দরকার হয়ে পড়েছে, তা করলেই তো পারো। পেয়ারে ছাত্রী তো আর নেহাত কম নয় তোমার, মনমতো একটাকে বেছে নিলেই হয়।
আবদুল খালেক দাড়ি কামানো থামিয়ে বললে, কাউকেই দেখছি তুমি বাদ দিতে চাও না!
ছাত্রীরা যেভাবে আসে, তা তো নিজ চোখেই দেখি রোজ। সাজন-গোজন ঠাটবাট দেখে গা জ্বলে যায়, যেন নাগর ধরতে এসেছে। আমরাও তো কলেজে পড়েছি, পড়তে এসে আবার এতো ঢলাঢলি কিসের!
ঢলাঢলিটা দেখলে কোথায়?
কথা তো বলে না, যেন গায়ে উল্টে পড়ে। তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে মুখে খৈ ফোটে, আবার আমাদের সামনে এলে ভিজে বেড়ালটি, সাত চড়েও রা কাড়তে চাইবে না–
আবদুল খালেক বললে, তোমার দেখায় অনেক ভুল আছে। রেখা। এভাবে দেখো না। এভাবে দেখা উচিত না। যারা এভাবে দ্যাখে, তারা কেবল নিজের মনের শান্তিই চুরমার করে।
কতো শান্তিতে তুমি আমাকে রেখেছো!
সেটা আলাদা ব্যাপার–আবদুল খালেক সাবানের ফেনার ভেতর থেকে বললে, কতো দূর দূর গ্রাম থেকে এরা আসে, কতো কষ্ট করে আসে। কত আশা এদের সামনেই। নিছক ঢলাঢলির জন্যে এত পরিশ্রমের কি কোনো দরকার আছে?
তোমাদের মতো দরদী বন্ধুদের জন্যেই আসে। লেখাপড়া না ছাই! কেন, কমার্সের আবু তালেব ছাত্রীকে বিয়ে করে নি? ঢিঢিক্কার পড়ে নি?
বিয়ে করাটা দোষের?
আমি তোমার সঙ্গে এঁড়ে তর্ক করতে চাই না–রেগে গিয়ে রেখা বললে, মুদিওলা বলে দিয়েছে আর বাকি দিতে পারবে না, এবার থেকে নগদ পয়সা দিয়ে সওদাপাতি এনো—
সে দেখা যাবে—
কোনো কথাই তো তোমার গায়ে লাগে না। একটা ডিম পচা হয়েছিল বলে পাঠিয়েছিলাম, যা-তা কথা বলেছে। মোমেনাকে ধমকে বলেছে, ইচ্ছে হয় নিবি, না। ইচ্ছে হয় না নিবি, বদল-ফদল হবে না। বলে দিস বাকিফাঁকি আর দিতে পারবো না।
আবদুল খালেক বললে, ওদেরই-বা কি দোষ, কম টাকা তো আর পাবে না?
তোমার ইজ্জতে বাধে না? ঘরের মানুষের কথা শুনলেই তো ছ্যাক করে ওঠো। একটা ছোটোলোক মুখে যা আসে তাই বলবে, আর ঘরে বসে বসে তুমি লেজ নাড়বে, তোমার আত্মসম্মান নেই?
কি করবো, ওর সঙ্গে লাঠালাঠি করবো?
সে ক্ষমতা থাকলে তো!
আবদুল খালেক হেসে বললে, হ্যাঁ এটাই হচ্ছে আসল কথা। আমি শুধু পারি, এই মুহূর্তে খুব ছোট্ট করে তোমাকে একটা চুমু খেতে–
কি যে বেহায়ার মতো ক্যাল ক্যাল করে হাসো—
রেখা আর দাঁড়ায় না। পাকাটি চিবাতে চিবাতে উঠোনের ধুলোয় গড়াগড়ি খাচ্ছিলো টুকু। হ্যাঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে হিড়হিড়িয়ে পুকুরঘাটের দিকে নিয়ে যায়।
অনেকক্ষণ পর আবদুল খালেক দরোজায় দাঁড়িয়ে রেখাকে ডাকলো। রেখা তখন রান্নাঘরে।
বললে, মাধু ও মাধু মাধুরাণী!
কাত হয়ে দরোজায় গলা বাড়ায় রেখা।
তোমার হাত খালি আছে?
মাছ কুটছি। এনেছো তো গুচ্ছের চুনোমাছ। রোজ রোজ এই একই আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না। কি করে আমাকে জব্দ করবে শুধু এই তালে থাকো। অন্য মাছ না পাও খালি হাতে ফিরবে, রোজ রোজ এই ডোগাড়া মাছ কুটতে কুটতে আমার ঘেন্না ধরে গেছে—
আবদুল খালেক বললে, ইচ্ছে করে কি আর আনি, এই ছোট্ট একটা কালকিনির দাম বারো থেকে চোদ্দ টাকা। টাকা-পয়সা যেন ময়লা। এর চেয়ে ঘাস খেয়ে থাকা ঢের ভালো!
একটু পরে হাত মুছতে মুছতে রেখা এলো। বললে, কি বলছিলে বলো।
ভরসা পাচ্ছি না যে—
আমার কাছে কিন্তু কোনো টাকা-পয়সা নেই, আগে থেকেই বলে রাখছি। যাও ছিল কায়দা করে করে তো তার সবই কুঁকে বসে আছ!
পিঠে একটু তেল মালিশ করে দেবে, গা-হাত-পায় বড়ো ব্যথা, এমন টাটাচ্ছে।
চৌকির ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে তেল মালিশ করাতে করাতে আবদুল খালেক বললে, আচ্ছা মাধুরাণী, তোমার হাত এতো মিষ্টি কেন?
ইস!দুম করে একটা কিল দিল রেখা।
আবদুল খালেক বললে, আমি জানি, তোমার হাত দুটো পঞ্চানন ময়রার তৈরি। খাঁটি ছানা আর ভুরভুরে গন্ধ!
রেখা বললে, ইয়ার্কি মারলে আমি কিন্তু মালিশ বন্ধ করে দেবো। গায়ে তো জ্বর–
ওতে কিছু হবে না!
একটু পরে রেখা বললে, আফজাল ভাই বলেছিলো ইস্কুলের পুকুরটার নাকি শিগগির ডাক হবে। তুমি চাইলে আফজাল ভাই তোমাকে সঙ্গে নেবে। কতো টাকারই-বা ব্যাপার! মাছ ছাড়লে ভালো পয়সা পাওয়া যাবে।
দেখি।
তাহলে বলে দাও।
আবদুল খালেক বললে, অসুবিধেটা কি জানো, এইসব টাউটগুলোকে আমার একদম পছন্দ হয় না। জোর করে হিন্দুর সম্পত্তি দখল নিয়েছে লোকটা, তাই দুটো করে খেতে পারছে, তা নাহলে কে পুঁছতো এদের, তোক ভালো না এরা?
তোমার অতো দেখার কি আছে।
আগে দ্যাখো কলেজ টেকে কি না। এখানকার পাটই হয়তো চুকিয়ে দিতে হবে শেষ পর্যন্ত, তুমি তো আর সব কথা জানো না! সামনের মাসে যদি মাইনে পাই, ভাববো বরাতের জোর—ডোনেশনের ওপর কলেজ চলছে। এ্যাফিলিয়েশন হয় নি। টিচার্স বেনিফিট-এর কিছু টাকা তারা পায়। হাবিব ব্যাপারীর ডোনেশন হিসেবে যে মোটা টাকা দেয়ার কথা তা পাওয়া যায় নি।
রেখা বললে, এইসব শুনলে আমার হাত-পা হিম হয়ে আসে। অমন হলে কি করবে?
তখন দেখা যাবে,খামোকা চিন্তা করে কোনো লাভ নেই, আরো জোরে চাপ দাও!
রেখা বললে, তোমার গায়ে সত্যিই জ্বর। আজ আর পানিতে নেমো না। শরীরের দিকে তোমার কোনো নজর নেই!
কোনো কথা না বলে মড়ার মতো নিঃশব্দে কাঠ হয়ে পড়ে রইলো আবদুল খালেক।
কিছুটা পরে রেখা বললে, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি!
না।
চুপ মেরে গেলে যে?
বড়ো আরাম–তুমি আজকাল অমন গুম হয়ে থাকো কেন?
কি বলবো ভেবে পাই না–
কেউ বিশ্বাস করবে একথা?
আর কারো কথা জানি না, তুমি করবে।
অনেক পরে চিৎ হয়ে শুয়ে রেখার একটা হাত বুকের ওপর নিয়ে আবদুল খালেক বললে, আজ থেকে যদি তোমাকে মাধু বলে ডাকি, তুমি কি আপত্তি করবে?
কি বলে? চোখ কুঁচকে রেখা জিগ্যেস করে।
মাধু মাধুরী–
কি জানি বাবা, তোমার কোনো কথাই আমার মাথায় ঢোকে না।
উপুড় হয়ে শুয়ে আবদুল খালেক বললে, আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমাকে ঐ নামে ডাকি!
রেখা বললে, মাধুরীটি কে?
তা জানি না। মাধুরী বলে কেউ কোনোদিন বোধহয় ছিল না। কেউ কোনোদিন তাকে দ্যাখে নি, কেউ কোনোদিন তার নাম শোনে নি, বোধহয় এই রকম— আবদুল খালেক বলতে থাকলো, কিন্তু আমার মনে হয় সে আছে, হয়তো তুমিই মাধুরী, আমি চোখ খুলে কখনো দেখি নি, তাই চোখেও পড়ে নি–
কি মানে এসবের?
ঠিক আছে–আহত গলায় আবদুল খালেক বললে, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি ঐ নামে ডাকবো না, ঠিক আছে। এতে রাগের কিছু নেই।
আমি তা বলি নি। তোমার কি দোষ জানো, কোনো কথা তুমি মন খুলে কখনো বলো না, পরিষ্কার বুঝিয়ে বলা তোমার ধাতে নেই–
আবদুল খালেক বললে, একদিন তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, তোমাকে কিন্তু রাখতে হবে, অন্তত চেষ্টা কোরো রাখতে। আমি তো তোমার স্বামী। ধরো স্বামী যদি কখনো সামান্য একটা ভিক্ষা চায়—
রেখা তাকে জড়িয়ে ধরে বললে, তাই বলে তুমি কাঁদবে? কাঁদছো কেন, কি করেছি আমি?
আবদুল খালেক কোনো উত্তর না দিয়ে সেইভাবেই উপুড় হয়ে রইলো।
রেখা নিজেও কেঁদে ফেললে। পাথরের মতো শক্ত আবদুল খালেকর গা ধরে তাকে নড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে বললে, কাঁদছো কেন, কি করেছি আমি!
তুমি কিছু করো নি, কেউ কিছু করে নি–
কাল রাতেও অন্ধকারে বসে বসে সে কাঁদছিলে। কেন এমন করে কাঁদো, হয়েছে কি তোমার?
আবদুল খালেক বললে, বুঝতে পারি না—
এভাবে কেউ কথা বলে— রেখা আবদুল খালেকের পিঠ ভাসিয়ে দিয়ে বললে, আমার কাছে তোমার জোর নেই? দাবি নেই? অধিকার নেই? ভিক্ষে চাইবে কেন? আমার কষ্ট হয় না!
ঠিকই–আবদুল খালেক নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললে, এভাবে বলাটা আমার ভুল হয়েছে। দিন দিন নিজের কাছ থেকেও যেন দূরে সরে যাচ্ছি। তোমাকে আমি সব বলবো। আগে নিজে বুঝে নিই। এক একবার মনে হয়, আমি কোনো মানুষই নই। পদার্থ বলে কোনো জিনিসই নেই আমার ভেতর। সবটুকু একটা আস্ত গোঁজামিল। জোড়াতালি।
রেখা বললে, এসব ভাববা কেন! ভেবে কি হয়! কেন তুমি নিজের সঙ্গে এভাবে শত্রুতা করবে
আবদুল খালেক কোনো কথা বলে না। সেই একইভাবে পড়ে রইলো উপুড় হয়ে। তারপর কোনো একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
দুপুরের দিকে রেখা যখন তার গা ধরে সাড়া দিয়ে জাগালো তখন তার চোখ লাল। তখনো বেশ জ্বর গায়ে। জোর করে একগ্লাস দুধ খাওয়ালো সে।
আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুই? রেখা জিগ্যেস করলে।
টুকু কই?
ঐ তো, ঘুমিয়ে—
শোও তাহলে—
রেখা আবদুল খালেকের গলা জড়িয়ে শোয়।
আবদুল খালেক মুগ্ধ গলায় বললে, তোমার গায়ের গন্ধ ভারি সুন্দর। মনে হয় কখনো কোনো মানুষজন মাড়ায় না এমন একটা চুপচাপ নিস্তব্ধ সরু রাস্তা ধরে হাঁটছি, এক চিলতে রোদ নেই, কেবল সারি সারি বকুল গাছের আদুরে ছায়া—
রেখা বললে, যা সুন্দর করে তুমি বলো, অন্য মেয়েরা শুনলে রোগা হয়ে যাবে—
খুলি?
তোমার ইচ্ছে—
আবদুল খালেক রেখার ব্লাউজের বোতাম খুলে দিয়ে একটা হাত রাখলো সেখানে। বললে, এতো নরম, এতো মায়া!
রেখা বললে, তোমার ভালো লাগে?
মরে যেতে ইচ্ছে করে—
তুমি তো আজকাল দ্যাখোই না। টুকু হবার পর থেকে তোমার যেন আর ভক্তি নেই—
টুকু যখন তোমার কোলে এলো, তোমাকে দেখলাম, গর্ব হলো, তুমি কি সুন্দরই না হয়েছে। যখন কোলে নিয়ে বসে থাকো, নানান ছলচাতুরি করে তোমাকে দেখি। মনে হয় জীবনভর দেখি। আগে দেখতাম শুধু চোখ দিয়ে, এই প্রথম আমার মন দিয়ে দেখতে শেখা—
রেখা বললে, রাতে তোমার হাত গায়ে না থাকলে আমার ঘুম আসে না–
অভ্যেস করেছে বলে হয়তো অমন হয়।
তুমি চাও না আমি ঘুমাই?
একশ বার চাই।
তাহলে অমন কুঁকড়ে হাত-পা মুড়ে শুয়ে থাকো কেন?
তুমি বললেই পারো।
আমাকে বলতে হবে? বলতে যাবো কেন। তোমার যদি ভালো লাগে, জোর করবো কেন। পুরনো হয়ে গেলে মেয়েদের কিইবা এমন থাকে।
আবদুল খালেক বললে, সব থাকে। আমি তো পুরনোই চাই।
রেখা বললে, আমার বুকটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন, এতে মন খারাপ হয়।
মন খারাপের কি আছে?
যদি তোমার ভালো না লাগে, যদি ঘেন্না হয়—
আবদুল খালেক বললে, তোমার ওপর আর অত দাবি নেই আমার। অর্ধেক আমি টুকুকে দিয়ে দিয়েছি।
অনেক পরে রেখা বললে, তোমার ইচ্ছে হয়? কিছু—
আজ থাক—
মন ভালো হয়েছে?
বুঝতে পারছো না?
কি জানি! তোমার বানান বড় শক্ত। দাঁতের গোড়া নড়ে যায়—
আবদুল খালেক বললে, এখন আমার খুব ইচ্ছে, তবু লোভটাকে দমন করতে চাই। আমরা কেউ কাউকে এখনো দেখি নি, কেউ কাউকে চিনি না। খুব শিগগির কোনো একদিন আমাদের দেখা হবে। ধরো প্রথম দেখা। দুজনে সারাদিন কাটাবো এক সঙ্গে। সংসারের কোনো কথা হবে না। না ঝগড়াঝাটি, না তর্কাতর্কি, না কোনো কাজের কথা। দেখতে চাই দিনটা কিভাবে কাটে, কেমন লাগে। তারপর হয়তো সবই হবে। কেমন হবে?
খুব ভালো হবে। কিন্তু কোথায় কিভাবে কাটাবে?
ধরো একটা নৌকোয় সারাদিন কাটাবো, পারবে না?
পারবো। খুব আনন্দ হবে—
ঐদিন আমরা দুজন দুজনের কাছ থেকে শুধু সুখ চেয়ে নেবো, শুধু আনন্দ চেয়ে নেবো, পারতো?
তুমি পারলে আমিও পারবো–
আবদুল খালেক রেখাকে বুকের ভেতরে এনে চোখের ওপর একটা গভীর চুমু দিয়ে বললে, এই কথাটাই আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম রেখা, শুধু এইটুকুই।
তাহলে ভিক্ষের কথাটা তুললে কেন?
এখন বুঝে দ্যাখো, কিভাবে তোমাকে দিতে হবে–
অনেক চিন্তা করে রেখা বললে, যদি ভুল হয়ে যায়, বলে দেবে তো?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তোমার কখন ভুল হয়?
আবদুল খালেক তখন কলেজে, মোমেনাকে দিয়ে নরহরি ডাক্তারকে ডাকিয়ে আনলো রেখা।
সকালের এই সময়টাই ভীষণ ব্যস্ত থাকে নরহরি ডাক্তার। বেলা বারোটার আগেই বাজার ভেঙে যায়, বাজারের সময়টুকুতে রুগীর ভিড় লেগে যায়, তারপর সব ফাঁকা। তালাচাবি বন্ধ করে তখন কলে বেরিয়ে পড়ে।
নরহরি ডাক্তার মোমেনাকে বলেছিল, পরে গেলে চলে না? এতো রুগী ফেলে যাই কি করে—
আপনাকে এখনই যেতে বলেছে।
রেখা মোমেনাকে বলে দিয়েছিল, একদৌড়ে যাবি। ডাক্তার বাবুকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি।
কি ব্যাপার? নরহরি ডাক্তার চিন্তিত মুখে ঢুকে বললে, আবার ট্রাবল দেখা দিয়েছে নাকি?
রেখা বললে, আপনি বসুন। শরীর আমার ভালোই আছে—
নরহরি ডাক্তার রেখার ভেতরে এক ধরনের অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য দেখতে পেল। বললে, আমাকে কিন্তু এক্ষুণি উঠতে হবে, বহু রুগী বসিয়ে রেখে এসেছি।
রেখা জড়িয়ে জড়িয়ে, খুব বিব্রতভাবে বললে, আমি খুব অশান্তিতে আছি ডাক্তার বাবু, আপনাকে কিছু বলবো–
নরহরি ডাক্তার বললে, তাহলে হাতে সময় নিয়ে পরে আসি?
রেখা জিদ ধরে বললে, কথাগুলো আমি টুকুর আব্বার সামনে বলতে চাই না। এখানে এমন কেউ নেই, যাকে এসব বলি, এসব বলা যায়। আপনাকে শুনতেই হবে, সেজন্যেই ডেকেছি—
নরহরি ডাক্তার পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড়গলা মুছলো। বললে, বেশ, বলুন–
রেখা দরোজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে দুঃখিত গলায় বললে, আপনার ওখানেই তো সব সময় ওঠা-বসা করে, কিছুদিন যাবৎ ওনার চালচলন লক্ষ্য করেছেন?
কৈ তেমন কিছু তো দেখি নি।
কারো সঙ্গে তেমন কথাই বলে না, সবসময় কেমন যেন মনমরা, মনমরা, একা একা থাকে, কি যে চায়, আমি বুঝি না—
নরহরি ডাক্তার বললে, তা উনি তো সবসময় একটু উদাসীন ধরনের মানুষ–
আমি তো ওকে চিনি– রেখা জোর দিয়ে বললে, আগে এমন ছিল না। এখন থেকে ও যেন কোনো কিছুতে নেই। দিলে খায়, না দিলে চুপ করে বসে থাকে। রাতভর জেগে জেগে কিসব করে—
নরহরি ডাক্তার বললে, এই রাত জাগাটাই হচ্ছে ওনার কাল। এতে বায়ুর প্রকোপ বাড়ে, এ্যাসিডিটিতেও ভুগছেন। আসলে উনি একটু রোমান্টিক ধরনের। রাত জাগাটা বন্ধ করাতে হবে আপনাকে।
রেখা বললে, রাতে একা বসে বসে কাঁদে—
বলেন কি?
আমার মনে হয় ও কারো প্রেমে পড়েছে!
নরহরি ডাক্তার সাপ দেখার মতো চমকে ওঠে বললে, এসব কি বলছেন আপনি? আমি তো বাজারের লোক, তেমন কিছু ঘটলে আগে আমার কানে আসতো কথাটা। এমন চিন্তা করাও অন্যায়, ওনাকে আমি খুব ভালো করেই চিনি–
আপনারা সবাই আছেন, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন–রেখা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, হয়তো এখন সময় আছে, ফেরানো যাবে। আমার মন ভেঙে গেছে—
কি আশ্চর্য কথা— নরহরি ডাক্তার বললে, আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, কোনো কিছু হয় নি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, তেমন কোনো কিছু যদি বের হয়, সোজাসুজি আপনাকেই তা জানাবো। ভাবাও অন্যায়, কি চমৎকার একটা মানুষ। আমার তো আর কারো সঙ্গে তেমন জমে না! ওই ওনার সঙ্গেই যা দুটো কথা হয়, তা নইলে এখানে আর মানুষ কোথায়!
রেখা বললে, হঠাৎ কি খেয়াল চেপেছে মাথায়, আমাকে নিয়ে নৌকোয় বেড়াতে চায়—
তা সে তো ভালো কথা!
আমার ভালো লাগছে না—
বেড়ানোর শখ তো ওনার সব সময়–নরহরি ডাক্তার বললে, প্রায়ই আমাকেও তো ধরেন। আমার কাজই হচ্ছে ঘোরাঘুরি, সময় করে উঠতে পারি না বলে যাওয়া হয় না। এই তো সেদিন কথা হলো, খুব শিগগির একদিন রাঢ়িখাল বজ্রযোগিনী এইসব দিকে ওনাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো।
রেখা বললে, আমার মন ভালো বলছে না—
এর ভেতরে আবার কি দেখলেন?
মনে মনে ও একটা কিছু ঠিক করেছে, এ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। এখন আমি ওর গলায় আটকে আছি। যে-কোনোভাবে ও আমাকে সরিয়ে দিতে চায়। কান্নায় আবার রেখার গলা ভেঙে গেল, বললে, অথচ এক সময় আমি ছাড়া আর কাউকে কখনো চিনতো না, মুখ তুলে তাকাতো না কোনোদিকে। কোনো দুঃখ ছিল না আমার। আর আজ, এই একটা ছেলে নিয়ে, কোথায় দাঁড়িয়েছি!
নরহরি ডাক্তার বললে, এসব কথা আর কাউকে বলবেন না! বলা উচিত নয়। এমনকি আমাকেও বলা উচিত হয় নি। এসব ভেবে নিজের মনের অশান্তি বাড়াবেন না, কি অবস্থায় যে আছেন, খুব ভালো করেই তা বুঝতে পারছি–
নৌকোর ব্যবস্থাটা আপনি করে দেবেন, ভালো করে বুঝিয়ে বলবেন মাঝিকে, পারবেন না?
নরহরি ডাক্তার হো-হো করে হেসে বললে, জয় গোবিন্দ! আপনাকে আমার গুরু মানা উচিত, পাগল হয়ে যাবো, আমি পাগল হয়ে যাবো! সে যাকগে, আমি এখন উঠি, বিশ্বাস আছে তো আমার ওপর?
রেখা বললে, তা না হলে আপনাকে এসব বলবো কেন?
তাহলে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে ওনার সঙ্গে বেড়াতে বেরুবেন, যা যা করতে হয় আমি সব করে রাখব, আপনি শুধু যাবেন। ঐ ট্রিপের যাবতীয় খরচ আমার। এই তো আপনাদের দোষ। কোথাও নড়াচাড়া করবেন না, ঘরের কোণায় গোঁজ হয়ে বসে থাকবেন, মন ভালো থাকবে কোত্থেকে! গায়ে একটু আলো-বাতাস লাগাতে হয়। রোজ অন্তত আমাদের বাড়ির দিক থেকেও তো একবার ঘুরে আসতে পারেন।
নরহরি ডাক্তার ফিরে এসে দেখলো; আবদুল খালেক তারই অপেক্ষায় বসে। জিগ্যেস করলে, কতোক্ষণ?
এই তো মিনিট পাঁচেক হবে। ঘণ্টা দেড়েকের একটা গ্যাপ, ভাবলাম একটু বসে যাই–
বসুন আপনি–সিগ্রেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, হাতের কাজগুলো একটু হালকা করে নিই। রুগী বিদায় করতে করতে প্রায় ঘণ্টাখানেক কেটে যায়। সামনের দোকানে চায়ের কথা বলে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বললে, খুব দেখালেন সেদিন, আমি তো গিয়ে বোবা–
আবদুল খালেক বললে, ওষুধটা পাই নি।
তা না পান, আমি তো ছিলামই, কি যে করেন আপনি!
এই সময় একটি লোক এসে দাঁড়ায় সামনের খুঁটি ধরে। নরহরি ডাক্তার এক তাড়া মেরে বললে, আবার কি? তুমি তো আজব মানুষ হে? যা করার ছিল করেছি, এখন আর আমার হাতে কোনো চিকিৎসা নেই। খামোকা ফেউ লাগো কেন পেছনে! সোজা ঢাকায় নিয়ে যাও, হাসপাতালে ভর্তি করাও, আর কোনো রাস্তা নেই–
আবদুল খালেকের হাত থেকে দেশলাই নিয়ে নরহরি ডাক্তার বললে, এগুলো একটাও মানুষ না, সব জানোয়ার! ঘরের বউগুলোকে এরা গরুছাগলের বেশি কিছু মনে করে না। এদের আর কি, ভোগান্তি হয় বেচারা বউগুলোর।
আবদুল খালেক জিগ্যেস করলে, কি, হয়েছে কি?
প্রল্যাপস্ অব ইউট্রাস! বিশদিনও হয় নি বাচ্চা বিইয়েছে বৌটা, তাকে পাঠিয়েছে বাড়ি বাড়িতে ঢেঁকিতে পার দিতে, কতো বড় অমানুষ!
আবদুল খালেক বললে, আমাকে নোভালজিন দেবেন। একটু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো লাগছে—
সে হবেখন, নরহরি ডাক্তার বললে, ভাবী ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নৌকো ঠিক করে দেবার জন্যে–
বলেন কি!
আশ্চর্য হবার কি আছে এতে। বললেন, এই বর্ষার পানিতে একদিন নৌকায় করে বেড়াতে চান, অনেকদিনের ইচ্ছে নাকি। বললেন ভালো দেখে একটা নৌকোর বন্দোবস্ত করে দিতে। আপনার ওপর ভরসা নেই আর কি, কি বুঝলেন।
আমিও আপনাকে বলতাম।
তা কবে যেতে চান?
যে-কোনোদিন, তবে বন্ধের মধ্যে হলেই ভালো হয়—
আপনাদের কলেজ তো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে?
আরো হপ্তাখানেক খোলা আছে, তারপর দেড় মাসের ছুটি। কালকের ব্যবস্থাও করতে পারেন, একটা মাত্র ক্লাস, নেবো না দরকার হলে—
কাল যেতে চান?
বন্দোবস্ত হলেই যাই—
ঠিক আছে, আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো। আজ রাতেই মরণ ঢালিকে বলবো। বেরুবেন কখন?
ধরুন সকালের দিকেই—
ঠিক আছে।
একটু পরে নরহরি ডাক্তার বললে, তা ছুটিটা কাটাবেন কোথায়?
আবদুল খালেক বললে, কোথায় আর যাবো, এখানেই থাকবো। ঢাকায় গেলেই খরচ, অতো টাকা কোথায়!
খরচ তো এখানেও আছে, নরহরি ডাক্তার বললে, এই-তো আজ সকালেই, দেড় বিঘত একটা গৰ্মার দাম চাইলো পচিশ টাকা,এসব এক সময় ফেলা যেত।
আবদুল খালেক বললে, জীবন বাঁচানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন—
তবে একটা কথাও আছে, পাহাড় মনে করলেই পাহাড়, তুলো মনে করলেই তুলো, যে যেভাবে নেয়। হিসেব করে দেখলে বুঝতে পারবেন, কত মানুষের চেয়ে আমরা ভালো আছি। কোনো না কোনোভাবে জীবন চলেই, কোথাও দাঁড়িয়ে থাকে না। এখানকার রুগীদের কথাই ধরুন। স্রেফ কারমিনেটিভ আর এ্যালকালি মিক্সচারে তাদের জীবন চলে যাচ্ছে। টিনচার কার্ডকো নেই, পট সাইট্রাস নেই, তাতে কি, ধুমসে কারমিনেটিভ দিয়ে যাচ্ছি, এ্যালকালি দিয়ে যাচ্ছি, ধড়াধড় ভালোও হয়ে যাচ্ছে, একবার ভেবে দেখুন ব্যাপারটা। যারা দশজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চায়, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। তার জীবনের ঘাটতি ছাড়া আর কিছুই দ্যাখে না, দেখতে পারে না।
আবদুল খালেকের মনে হলো তার বিশেষ কিছুই বলার নেই। পট সাইট্রাসের অভাবে এ্যালকালি চলে, হয়তো রোগও সারে, কিন্তু তার নিজের কাছে জীবন জিনিসটি এমন, সামান্য একটা অভাব সেখানে সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে। এক একজনের কাছে এক একটা দিক বড়, সেখানে সে কোনো ঘাটতির কথা ভাবতেই পারে না, সুতোর সামান্য একটু টানে সবকিছু যেখানে হুড়মুড় করে ধসে পড়ে। একটা গৰ্মার দাম একশো টাকায় উঠলে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, সে তখন মাছ খাওয়ার অভ্যেসটাকে টুক করে ফেলে দেবে, ভাববে, যাক, বাঁচা গেল। কিন্তু কেউ যদি তাকে হেলাফেলা করে, তাচ্ছিল্য করে, বলে তোমার মতো লোক দুদশটা আমার পকেটে থাকে সবসময়, তখন হয়তো তার আত্মহত্যার কথা মনে হবে। অথচ সে নিজে জানে, সে এমন কোনো মাথাওয়ালা লোক নয়, হাতি-ঘোড়া-বাঘ-ভালুক নয়, পকেটে থাকা জীব, এইমাত্র। বিয়ের আগে সে ভাবতো, প্রেম ছাড়া জীবন অচল, এখন মনে করে ওটা একটা ভোঁতা ধারণা, জীবনে এর কোনো প্রয়োজনই নেই, বরং একটা বিড়ম্বনা। বিড়ম্বনা এই জন্যেই, এর কোনো রয়ে-সয়ে চলার ক্ষমতা নেই, এ শুধু আড়ম্বর চায়, লোক দেখানো বৈভব চায়।
নরহরি ডাক্তার বললে, বাইরে থেকে দেখে আমাকে কি মনে হয়, বেশ ভালো আছে লোকটা, দিব্যি দুটো করে খাচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই। ব্যাপারটা কি সে রকম? পরপর দুদিন চুনোপুঁটি দিয়ে দায় সেরেছি, ভেতরে ভেতরে ইচ্ছে, যে দামই হয় মাছ আজ কিনবোই। গোটা বাজারে একটা মাত্রই গর্মা। দাম করছি, পেছন থেকে কেউ একজন টিটকারি মেরে উঠলো, ব্যাটা মালাউনের জন্যে বাজারে মাছ কেনার উপায় নেই, টাকার গরম দেখায়। এর কোনো মানে আছে? ভালো খাওয়ার উপায় নেই, ভালো পরার উপায় নেই, ভালোভাবে থাকার উপায় নেই, অথচ ক্ষমতা আছে, এভাবে মানুষ টিকতে পারে! দুদিন অন্তর ডাকাতি। একবার তো মুখের ওপর তারা বলেই ফেললে, যাও না শালা, পড়ে আছো কেন, তোমার বাপের দেশে যাও। তবু মাটি কামড়ে পড়ে আছি। নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিই, অনেকের চেয়ে ভালো আছি। বেঁচে থাকতে হলে কিছুটা কম্প্রোমাইজ তো করতেই হয়–
আবদুল খালেক বললে, কিছুটা নয়, বোধহয় সবটাই কম্প্রোমাইজ—
ঐ একভাবে চালিয়ে নিতে হয় বেহায়ার মতো। আমার তো ধারণা, বিদ্যাফিদ্যা জ্ঞানট্যান জীবনে কখনো কাজে লাগে না। ওগুলোর জন্যে খামোকা মানুষ নিজেকে অপব্যয় করে। কালকে কলে বেরিয়েছি, পথে খুব ইচ্ছে হলো এক কাপ চা খাই। মাঝিকে বললাম, নৌকো ভেড়াবে চায়ের দোকান পেলে। এক সময় খালের পাশে নৌকো ভিড়িয়ে সে গেল চা আনতে। চুমুক মেরে দেখি অপূর্ব চা, মাঝিকে বললাম, কোন্ দোকান থেকে এনেছে গো, খুব ভালো তো! সে কি বললে জানেন? বললে প্রথমে যে চা দিয়েছিল সে আপনি মুখে দিতে পারতেন না, গরুর চোনাও তার থেকে ভালো বরং। যখন মিথ্যে করে বললাম নৌকোয় ওসি সাহেব আছে, বেরুল স্পেশাল পাত্তি, এখন বুঝুন। মাঝিটা গোমুখ্য, তবু খুব সহজেই সে একটা সমস্যার সমাধান করে ফেললো। জীবনের সবকিছু এই হালকা চালে নিতে পারাটাই ভালো–
আবদুল খালেক উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আর বসবো না, ক্লাস নিতে হবে এবার, আপনি নোভালর্জিন দিন!
নরহরি ডাক্তার অসহিষ্ণু হয়ে বললে, এই তো আপনাদের এক দোষ, রোগটা কি না বুঝেই আন্দাজে ওষুধ গেলা কি ভালো? নিজেরা আন্দাগোন্দা নিজেদের ওপর ডাক্তারি চালাবেন না, যেকোনো সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে, না-কি মিথ্যে বলছি!
০৯. আলো ছায়ায় যুগলবন্দি
পচ্চিমে বাতাস ছারছে, লাগে জানি পানি হুকায়া যাইবো।
আবদুল খালেক জিগ্যেস করলে, মরণ, এটা কোন্ গ্রাম?
চন্দনধুল।
কাছাকাছি নদী নেই?
আছে না! হাপেরচরের শ্যাষমুখে হইল গিয়া আপনের বরগাঙ, ইছামতি।
আবদুল খালেক বললে, সুন্দর গ্রাম পড়ে পথে?
পাইবেন। গেরামের অভাব নাই। রাজাদিয়া, টেংগুইরপারা, পাওলিদিয়া, বাহিরঘাটা–
তোমার কথা ও বোঝেই নি–রেখা বললে।
আবদুল খালেক বললে, এদিকটা তোমার ভালো লাগছে?
কেমন যেন! শুধু আখখেত আর আখখেত, কোনো কিছু দেখা যায় না–
তাহলে অন্যদিকে ঘোরাতে বলি, কি বলো?
তুমি যা ভালো বোঝে।
আবদুল খালেক মরণ ঢালিকে বললে, নৌকো ঘোরাও বাপু, না হয় আড়িয়লের দিকে চল—
মরণ ঢালি বললে, আইজ আর ফেরন লাগবে না, বিলের মাইদ্যে রাইত কাটাইতে পারবেন নি-ও?
তাহলে তোমার যেদিকে খুশি সেদিকে যাও, গ্রামের পাশ দিয়ে যাবে—
একটার পর একটা গলাপানিতে ডোবা আখখেত। না দেখা যায় মানুষজন, না কোনো গ্রামের মাথা। বাতা আর ছইয়ের গায়ে তুমুল বৃষ্টির শব্দ তুলে আখবনের দাঁড়া ভেঙে লগি মেরে চলেছে মরণ ঢালি।
বনময় টুব-টু-টুব শব্দ। একটার পর একটা ঢিল এসে পড়ছে পানির ওপর, ডাইনে বায়ে, চতুর্দিকে; এইরকম মনে হয় এক একবার। কখনো মনে হয় পানির ওপরে একটা তার টান টান করে বেঁধে অবিরাম টুব-টুব-টুব বাজিয়ে চলেছে কেউ। রেখা কান পেতে শুনছিল। আবদুল খালেক বললে, ডাহুক—
তাই বুঝি—
নৌকোয় ওঠার আগে কাঁদছিলে কেন?
এমনিই!
তুমি খুব কষ্ট পাও, তাই না?
রেখা ভাঙা গলায় বললে, তোমার আর কি কি মনে হয়?
একটু ভেবে নিয়ে আবদুল খালেক বললে, আমি তোমাকে কোনোদিন বোঝার চেষ্টা করি নি, এইসব মনে হয়। বরং উল্টোটা করেছি। একতরফা তোমার কাঁধে নিজের অনেক কিছু চাপিয়েছি। তোমাকে যে আমার কিছু দেবার আছে, এসব ভাবি নি, কেবল দাবি করে এসেছি তোমার কাছে। ধর কালকের কথা, তুমি না এক সময়ে বললে, তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তাই তোমার খুব চিন্তা। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার কাছে খুব ছোট হয়ে গেলাম। একটা মেয়ে, তার জীবনের সবকিছু দিয়ে একজনকে ধরে রাখতে চায়, তার সব চিন্তার শেকড় ঐ এক মাটিতে, ঐ এক জায়গায় শক্ত করে বাঁধা, আমি ভাবতেও পারি না, কোনোদিন ভেবে দেখি নি এভাবে। এ চিন্তা তো আমারও হতে পারতো, একটি মেয়ে, জীবনভর তাকে চাই, তাকে ছাড়া আমার চলবে না, সবকিছু অন্ধকার, অর্থহীন তাকে ছাড়া, ভীষণভাবে পেতে চাই, কই কখনো তো মনে হয় নি। তাকে আমার ধরে রাখতেই হবে, যেভাবেই হোক একবারও মনে হয় নি। বেশির পক্ষে সবকিছু ছিল এই রকম, সে আছে, চলে যাচ্ছে, চলে যাবে। জিনিসটা দাঁড়াচ্ছে এই, তার তো আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, পালাবার কোনো পথ নেই, যেমন আছে, তেমনি থাকবে। শুনতে যতোই খারাপ লাগুক, একটা অস্পষ্ট ধোয়াটে ব্যাপার গোটা জিনিসটা। তুমি আমাকে অনেক সুখ দিয়েছে, রেখা আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ
রেখা বললে, তুমি না বলেছিলে কেউ কারো দুঃখ নিয়ে ঘাটাঘাটি করবো না, অন্তত এই দিনটায়, ভুলে গেলে? এসব কথায় মন খারাপ হয়ে যায়।
এসে যায়। আমরা একে অপরের এতো চেনা যে, নিজেদের বাইরে যেতে পারছি না। এর বাইরে যেতে গেলেই সবকিছু সস্তা অভিনয় হয়ে যাবে! তখন এভাবে ভেবে দেখি নি।
রেখা বললে, তুমি আর একটু ভেতরের দিকে এসে বসো, মুখে রোদ লাগছে।
আবদুল খালেক সরে এলে রেখা বললে, ডাহুকগুলো ওভাবে ডাকছে কেন?
ডিম দেয়ার সময় এখন। বর্ষার পানি থাকতে থাকতে দুতিনবার ডিম দেয় পাখিগুলো—
টুকুর জন্যে খুব খারাপ লাগছে, নিয়ে এলেই হতো—
আবদুল খালেক বললে, মোমেনার সঙ্গে ও দিব্যি থাকবে।
আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?
একদিকে গেলেই হয়–
একটা সিগ্রেট ধরায় রেখা। আলতোভাবে টান দিতে গিয়ে সে কেশে ওঠে। বললে, নাও, ধরো–
আবদুল খালেক বললে, আরো দুটো টান মার না, কি হবে।
না বাপু! এমনিতেই কেমন যেন গা গোলাচ্ছে–
দুজনে খেলে ভালোই লাগে!
মামাও এরকম বলতো—
বলতো নাকি?
তোমার বোধহয় বিশ্বাস হয় না? রেখা হেসে বললে, ওপর থেকে দেখে মামাকে ওই রকম কাটমোল্লা মনে হয়, ভেতরে ভেতরে রস আছে বুড়োর। রোজ শোবার ঘরের দরোজা বন্ধ করে মৃতসঞ্জীবনীর বোতল নিয়ে বসতো মামা। বলতো স্বাস্থ্যটা একটু ভালো করা দরকার, বল পাই শরীরে। মাঝে মাঝে মামীও খেত। মামাই বোধহয় জোর করে খাওয়াতো। তারপর সে কি হাসাহাসি। দুএক সময় এমন হুটোপুটি বেধে যেতো ঘরের ভেতর, আমার নিজেরই লজ্জা লাগতো।
আবদুল খালেক হাতের ওপর কাত হয়ে শুয়ে বললে, ভালোই তো!
রোজ রাতে মামীকে সাজতে হতো, কত রকমের যে শখ মামার! কিছু ভেবে রেখা বললে, তোমার কখনো এরকম ইচ্ছে হয়?
সাজলে ভালোই লাগে—
একদিনও তো বললে না?
তুমি যদি আবার অন্য কিছু ভাবো!
কি ভাববো অন্য কিছু?
কতো রকমের সন্দেহ থাকতে পারে—
নিজের মনের জোর থাকলে আবার কি। বলেই দেখতে!
আচ্ছা, এবার থেকে বলবো—
তবু ভালো— রেখা হেসে বললে, শুধু মনে হতো লোকটার কোনো শখ নেই, একটা মরা কাঠের তক্তা ধরে ভাসছি!
আবদুল খালেক অনেক চিন্তা করে বললে, আচ্ছা, মানুষ কি সত্যিই ভালোবাসে, না জীবনভর এইসবের অভিনয় করে?
সেটা তোমারই জানার কথা!
বোঝা গেল খুশি হয় নি রেখা।
আবদুল খালেক বললে, এই সব বোধহয় কথার কথা। সময় নষ্ট করার জন্যে কতগুলো জিনিসকে খাড়া করা। আসল সমস্যা তো ভাত-কাপড়ের–
তা তো দিচ্ছোই!
একে দেয়া বলে না।
তাহলে কি বলে?
কোনোমতে চলে যাচ্ছে। তুমি চালিয়ে নিচ্ছো—
এটাই ভালোবাসা, সত্যিই যদি এভাবে থাকো। তুমি কি মনে করো, হাতি-ঘোড়া মারার দরকার হয়? কাছাকাছি থাকলে কোনো কষ্টই নয়, তখন এক ধরনের জোর থাকে মনের, ভেতর থেকে সাহস আসে। যখন মনে হয় মানুষটা কেমন যেন একটু দূরে দূরে, কোনো কিছুতেই জড়াতে চাচ্ছে না, ব্রিত হয়ে আছে, একটার পর একটা আড়াল তৈরি করে যাচ্ছে, একটু একটু করে তখন ভেতরে ভাঙন ধরে।
আবদুল খালেক বললে, তোমার সব কথা আমি বুঝতে পারছি।
রেখা কেঁদে ফেললে। বেশ সময় লাগলো তার নিজেকে সামলাতে। এমন অদ্ভুত সব কথা তার মনের ভেতরে ওত পেতে আছে, সে নিজেই জানতো না। নিছক ওপরের সাজগোজ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল নিজেকে, কিন্তু ভেতরে এমন অগোছালো, এমন দলা পাকানো, যে সে নিজেই ভয় পেল। সে বললে, তুমি আমাকে কিছুই দিও না, তোমার কাছে আমি কিছু চাই না, শুধু একটু কাছে থেকো, চিরকাল তোমার হাত যেন আমার গায়ের ওপরে থাকে, চোখ খুলেই যেন প্রথমে তোমাকে দেখি, বেঁচে থাকার জন্যে তুমি শুধু এইটুকু আমাকে দিও—
আমি কি তা দিচ্ছি না?
হয়তো দিচ্ছে, কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারি না, বোঝার ক্ষমতাটাই বোধহয় জট পাকিয়ে গেছে। মনে হয় গায়ের ওপরে তুমি যে হাত রেখেছে তাতে রক্ত নেই, প্রাণ নেই, অন্য কারো হাত। চোখ খুলে যাকে দেখি সে যেন অন্য কেউ অচেনা। কি রকম যে হয়, তোমাকে বোঝাতে পারি না। আগে কখনো এসব মনে হতো না, ঘুমের ভেতর তুমি স্বপ্ন দেখলেও আমি বুঝতে পারতাম। এখন এতো দূর থেকে কথা বলো, এমনভাবে বলো, যেন আমি তোমার কেউ নই। এখন তুমি ভয় করে চলো, গা বাঁচিয়ে চলো; নিজেকে এমনভাবে আড়াল করে রাখো, যাতে আমার চোখে না পড়ো। তুমি তো খেয়ালই করো না, করলে দেখতে, সারাটা রাত শুধু উশপিশ করে কাটাই, ঘুম আসে না, কি যে যন্ত্রণা। একবার দেখি তুমি মড়ার মতো পড়ে আছো, একবার দেখি জেগে আছো, তবু মশারির বাইরে তোমার হাত, মশায় খাচ্ছে, তোমার সাড়াই নেই–
আবদুল খালেক উপুড় হয়ে শুয়ে গলা তুলে দেখলো রেখাকে। রেখার হাতের ওপরে একটা হাত রেখে বললে, আমি জানতাম না তোমার ভেতরে এতো কথা আছে। সকলের ভেতরেই বোধহয় এই রকম আরো একটা আলাদা সংসার পাতা থাকে, সেখানে সে তার খেলার পুতুলের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব দ্যায়, এক টুকরো ভাঙা কাচের জন্য বুক ভরে কাঁদে, নিছক কাগজের নৌকো ডুবে গেলে একেবারে সর্বস্বান্তু হয়ে যায়–
রেখা কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো তার মুখের দিকে। এই মুহূর্তে নিজেকে তার খুব অসহায় মনে হলো। সে চায় আবদুল খালেক কিছু বলুক। অনেক কিছু শুনবে বলে সে আজ তৈরি হয়েই নৌকোয় উঠেছে।
আবদুল খালেক বললে, মনি ভাইজানকেও শেষ পর্যন্ত আমি এমনভাবে দেখেছিলাম—
রেখা বললে কিভাবে দেখেছিলে?
সেকথা এখন থাক, কথা যখন উঠেছেই বলবো এক সময়–আবদুল খালেক ডুব দিয়ে ওঠার মতো করে বললে, তবু একটা জলজ্যান্ত রক্ত-মাংসের মানুষের জন্যে তুমি এমন উতলা হয়ে উঠেছে। আর আমার কথা জানো? একটা সামান্য রোগা ঠ্যাং ভাঙা শালিককে দেখতে না পেলে এক সময় এক একটা দুপুর আমার কাছে মিথ্যে হয়ে যেতো। দুপুরটাকে মনে হতো জীবন; নিংড়ে নিংড়ে তার সব আলো এখন কেউ চুষে নিয়েছে। এই রকমই হয়। এই রকম হয় বলেই হাত-পাগুলো ভাঙা থাকে মানুষের। সে খোঁড়া হয়ে থাকে, নুলো হয়ে থাকে, অথর্ব মেরে যায়। হাঁটু মুড়ে ভ্যাবলা হয়ে বসে থাকে। তা না হলে, দাঁত জানে তার কি কাজ, নখ জানে তার কি কাজ, ভেতরের ডাকাতটাকে তো মানুষ ভাত-কাপড় দিয়ে পোষেই। এই রকম হয় বলেই একটা মানুষ তার দুটো হাতকে হাসিমুখে আরেকজনকে বিলিয়ে দিতে পারে, বলতে পারে আর কি নেবে নাও, তোমার যা খুশি নাও। তা না হয়ে চোখের সামনে থেকে একটা চুলও কেউ উড়তে দিতো না, একটা কুটোগাছও তার হাত থেকে গলতো না–
রেখা ভয়ে বললে, আজ কিন্তু আমি তোমাকে রাগ করতে দেবো না। আমার মনে যা যা হয়, তোমাকে শুধু সেই কথাগুলোই বলতে চেয়েছিলাম। তুমি যদি না শোনো আর কাকে বলবো–
আবদুল খালেক অসহিষ্ণু হয়ে বললে, যখন তুমি বললে তোমার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে, তখন সব অপরা্ধের বোঝা আমি নিজের কাঁধে তুলে নিলাম। আমার তো মনে আছে, যেদিন তুমি প্রথম এলে, সেদিন কি ছিলে তুমি। দেখে আর আশ মেটে না, সকালে দেখি, দুপুরে দেখি, যতোবার ইচ্ছে দেখি, তোমার সমস্ত শরীর তখন ঝনঝন করে বাজে, শুধু লোভ হয়। একেবারে রাজছত্র খুলে বসলাম। তোমার সমস্ত শরীরকে চাইলাম পাগলামির ভেতর, গুণ্ডামির ভেতর, খুনোখুনির ভেতর। একটা নদী যখন শুকিয়ে যায়, তখন তাকে কেউ অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে না, তার কথা মনে করে শুধু দুঃখ পায়। একটা সামান্য মানুষকেও ঠিক এইভাবে দেখো। এইভাবে দেখলে তার ধ্বংসস্তৃপই কেবল তোমার নজরে আসবে। বুকের ওপর দুটো হাত জড়ো করে মার-খাওয়া মানুষ যখন বলে মুঠোয় কি আছে দেখতে চেয়ো না, দোহাই তোমাদের, এ তোমাদের কোনো কাজে লাগবে না, সারাজীবনের সঞ্চয় শুধু এইটুকুই, এই সামান্য স্বপ্নটুকুই, তখন ধরে নিতে হয় সে বেঁচে আছে বেবল স্মৃতির ভেতর। তার চেয়ে নির্বিষ, তার চেয়ে নিরাপদ জানোয়ার আর কে!
রেখা আবদুল খালেকের একটা হাত দুমুঠোয় পুরে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বললে, আমি তোমাকে কোনো দোষ দেই নি। স্বামীর কাছে পুরোনো হয়ে যাওয়ার মতো দুঃখ মেয়েদের কাছে আর কিছু নেই। বোধহয় কলঙ্ককেও তারা এতোটা ভয় করে না। তুমি যাকে অপরাধ বললে, মেয়েদের জীবনের ঐশ্বর্য ঠিক অতোটুকুই। মেয়ে হলে তুমি বুঝতে–
কি জানি, তোমরা বোঝো। ভাত-কাপড়ের বেশি আমার মাথায় বোধহয় আর কিছু ঢোকে না—
রেখা বললে, আমি বুঝি, এখন তুমি হাঁপিয়ে পড়েছে। এখন তো হেঁজিপেঁজিরাও ইচ্ছে করলে একটা চাকরি ধরতে পারে। তুমি যদি অমত না করো ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ একটা চাকরি জুটিয়ে নিতে পারি–
আবদুল খালেক হেসে বললে, আর কি কি ভেবে রেখেছো?
আগে একটু গুছিয়ে নিতে হবে, তারপর একটা মেয়ে দরকার। তোমার তো মেয়ের শখ—
ও মোমিন মিয়াবাই–মরণ ঢালি সামনের দিক থেকে আসা নৌকোর প্রস্রাবে মগ্ন সোয়ারির উদ্দেশে বললে, এলা ফিরান দিয়া হুকার পানি বদল করেন, নায়ের ভিৎরে মানু—
আমন খেতের ফাঁকে ফাঁকে এক একটি ফাঁকা চক, হয়তো পাট ছিল, এখানে সেখানে কেবল বাতাসের নাচন। গলুইতে এসে বসে আবদুল খালেক কিছুক্ষণের জন্যে। কাচের মতো পানি। তলা দেখা যায়। নানাজাতের জলজ উদ্ভিদ দোল খায়। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে পানি থেকে সবুজ ঝাঁঝি তুলতে থাকে আবদুল খালেক।
মাঝি, আমরা কতোদূর?
হপায় সুজানগর পার হয়া আইলাম—
বলেছিলে না আমাদের নামাবে কোথাও?
মরণ ঢালি বললে, জাঙ্গাইলা আয়া লউক, খাওন-লওনের কাম শ্যাষ কইরা অক্করে দিঘলীতে লয়া ফালামু আপনেগো, পদ্মা দেইখা আইবেন।
ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে বাড়িয়ে দিল রেখা। দুখানা বিস্কুট। ধনিচা বনের গায়ে নৌকো রেখে চা খেল মরণ ঢালিও!
আবদুল খালেক বললে, পদ্মার দিকে যে যাবে, ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাবে না?
মরণ ঢালি বললে, দিনে দিনে মেলা করুম, বেশি রাত হইবো। রাইতে আমার নাও বাওন তো অহনতরি দেহেন নাই, বাওয়া খেতের ওপরদা পিরপিরায়া লগি মাইরা যামু, ঘুরান পথ ধরে কোন বোন্দায়। অহনে খেতে দারা ফালাইলে ব্যাড়ারা কিলাইয়া আর আস্তা থুইবো না–
বয়েস হলেও লোকটা ঝাড়েমুলে এখনো বেশ টন্কো সপ্রাণ। আবদুল খালেকের তাই মনে হলো। নৌকা রেখে একটা ভেঁসাল থেকে সে মাছ কিনলো। ফিরে এসে আবার লগি ধরে একগাল হেসে বললে, আউজকা খাইবেন মাঝির হাতের পাক—
আবদুল খালেক বললে, বলছো কি তুমি?
এলা বয়া বয়া সব দেইখেন, কতো মাইনসেরে পাক কইরা খাওয়াছি। ডাকতরে সব বন্দোবস্ত কইরা দিছে—
দূরে দূরে এক এটি জলবন্দি নিস্তব্ধ গ্রাম। থেকে থেকে এক একবার কোড়া ডেকে ওঠে ধানখেতের মাঝখানে হু-হু বাতাসে সবুজ গন্ধ। সবকিছু শান্ত, কোথাও কোনো দাগ লেগে নেই, কোথাও কোনো জোড়াতালি নেই। এমন অকপট সবকিছু, এমন নির্দোষ যে, নিজের ভারে নিজেকে বিপন্ন মনে হয়।
রেখা বললে, ভিতরে এসে বোসসা, চুপচাপ ভালো লাগে। কেমন দমবন্ধ হয়ে যায় আবদুল খালেক বললে, তোমার ছেলেবেলার কথা বলো, শুনি–
রেখা বললে, আজ থাক, খামোকা মন খারাপ করে কি লাভ। কিছু কিছু তো জানোই। পরগাছার আবার ছেলেবেলা কি?
কখনো কারো জন্যে কাঁদোনি?
মনে পড়ে না—
পুতুলের বিয়ে দিয়ে কাঁদো নি?
সে তো ন্যাকড়ার, কাঁদবো কেন?
আবদুল খালেক হেসে বললে, তখন তোমার বুদ্ধি আরো পাকা ছিল তাহলে?
তাই বলে ন্যাকড়ার পুতুলের জন্যে কেউ কাঁদে?
এও তো ন্যাকড়ারই পুতুল, যাকে নিয়ে সংসার পেতেছো—
ঘোরালো কথা তুলতে পারবে না বলে দিচ্ছি–চোখ পাকিয়ে রেখা বললে, ন্যাকড়ার পুতুল কেন? একটা প্রেম করতে পারছে না বলে? ধরে রেখেছি বলে?
কোথায় ধরে রেখেছো, একে ধরে রাখা বলে? আবদুল খালেক হাসতে হাসতে বললে, আমি তো ছাড়াগুরু ইচ্ছে করলেই পরের খেতের ধান সাবড়ে দিতে পারি!
ইচ্ছে করলেই তো হয়!
ওই ইচ্ছে করাটুকুই হচ্ছে কষ্টের। তুমি বরং আরো একটু বেশি করে ধরে রেখো, কষে, যাতে বাবাগো বলে চেঁচিয়ে উঠি, প্রাণ বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক হাসতে লাগলো।
কি যে হাসো! বোঝা গেল, রেখা ভালোমতোই চটেছে।
আবদুল খালেক বললে, উহু, তুমি চটে যাচ্ছো, এরকম কোনো কথা ছিল না।
রেখা বললে, তুমি নিজেই তো একটা কিছু বাধাবার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছো–
আবদুল খালেক একটা সিগ্রেট ধরিয়ে খুব সহজ গলায় বললে, কেউ কাউকে ধরে রাখে না, অধিকারটাকে সবচেয়ে বড় করে দ্যাখে বলে ঐরকম মনে হয়। তুমিও আমাকে বেঁধে রাখো নি, আমিও তোমাকে বেঁধে রাখি নি। মানুষ কি গরু-ছাগল-ভেড়া যে, দড়ি দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা যাবে?
রেখা বললে, তোমার একটা কথার সঙ্গে আরেকটা কথার কোনো মিল নেই। তুমি কি সত্যিই সবকিছুকে এভাবে দ্যাখো, না কথার পিছে কথা? এসব যদি সত্যি হয়, তাহলে ঘর-সংসার করার কোনো মানে হয় না—
কেউ যখন ঘর-সংসার করে, তখন সে তার মানে খুঁজতে যায়। মানে খুঁজতে গেলেই বিপদ। চোয়া ঢেকুর তুলতে তুলতে নাককান বুজে সে শুধু তার আয়ু ক্ষয় করে যাবে, আবার কি? মানেফানে নেই বুকে হেঁটে,গড়িয়ে গড়িয়ে, ডিগবাজি খেয়ে তাকে চালিয়ে যেতে হবে, ব্যাস্!
রেখা বললে, এই নিয়ে তর্ক করতে চাই না। এ তোমার শুধু এক ধরনের বলতে পারা, এর ভেতরে কোনো বাহাদুরি নেই। তুমি চুপ করো—
আবদুল খালেক বললে, ঠিক আছে, দুই একটা মাছের নাম করো।
আগে বলো কেন?
বলছি, আগে উত্তর দাও–
ধরো রুই।
একটা পাখির নাম—
ধরো ময়না—
একটা নদীর নাম—
তিতাস—
একটা মানুষের নাম—
টুকু–
আবদুল খালেক বললে, ভেবে দ্যাখো আগাগোড়া ব্যাপারটা। তুমি রোজ খাচ্ছো চুনোপুঁটি, কিন্তু মাছ বলতে প্রথম তোমার মনে এলো রুই মাছের কথা। প্রতি মুহূর্তেই তুমি ডাহুকের হাক শুনতে পাচ্ছো, মাছরাঙা, বক, ফিঙেকে উড়তে দেখছো, তবু ময়নার নাম প্রথমেই মনে এলো। ময়না বোধহয় বাঁধাবুলি আওড়ায়, হয়তো সেই জন্যেই। আমরা যাচ্ছি পদ্মার দিকে এই একটু আগেও তুমি শুনলে, অথচ নদীর নাম বললে তিতাস। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ব্যাপারটা তো এই! অভ্যস্তার বাইরে তুমি যেতে পারলে না। একটা মানুষের কথা বললে টুকু। সামনে আমি ছিলাম, এমন কি মরণ ঢালির নামও তুমি করতে পারতে। তার মানে টুকুর কথা তুমি সবসময় ভাবছো, অথচ সঙ্গে আনো নি। সব ব্যাপারটাই হচ্ছে গরমিলের। এই গরমিলের ভেতরে হয়তো হিসেব নেই, কিন্তু সত্যি আছে। তোমার ওই ঘর-সংসারের কথাই যদি ওঠে, সেখানে দেখো ঐ গরমিলের ভেতরে সত্যিটাকে কেউ পোছেই না, তার বেলায় শুধু গা বাচিয়ে চলা, টানা-হাচড়া হয় কেবল হিসেবটাকে নিয়ে–
রেখা বললে, আমি তোমার ছাত্রী হতে চাই না।
আবদুল খালেক বললে, ভালো হচ্ছে না রেখা, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু–
ইস, তোমাকে আমি ভয় পাই? কি করবে কি?
কি করবো? অন্তত ঐ মাঝির সামনে তোমাকে জড়িয়ে ধরে চাকুম-চুকুম করে দুচারগণ্ডা চুমু খেয়ে ফেলতে পারি—
বাহাদুর!
পারি না বলছো?
তুমি সব পারো—
তাহলে দেখ নিজের বৌকেও চুমু খেতে পারছি না, তাকে অপদস্থ করা হচ্ছে।
না গো, তোমার সঙ্গে আমি ঘর করতে পারবো না–রেখা আবদুল খালেকের ঊরুতে চিমটি কেটে বললে, তুমি মানুষটা বড় ঘোরালো, জান বেরিয়ে যায়—
আবদুল খালেক বললে, তাহলে ছেড়ে দিচ্ছো?
যাও দিলাম—
আবদুল খালেক গলা বাড়িয়ে বললে, ও মাঝি, এটা কোন্ গ্রাম?
মালনি মিঠুসার—।
এখানে নৌকো ভেড়াও–রেখার দিকে তাকিয়ে আবদুল খালেক চাপা গলায় বললে, আমি এখানেই নেমে যাবো—
মরণ ঢালি বেছে বেছে একটা আড়াল খুঁজে বের করে।
গলাপানিতে দাঁড়ানো হিজল গাছের কোল ঘেঁষে ঘন বৌনার জঙ্গল। এর মাঝ দিয়ে রাস্তা করে কচু আর নলবনের ওপর মড়মড়িয়ে সে তার সুকাঠের নৌকোটাকে ঠেলে দেয়। নৌকো পাড়ে ভিড়তে না ভিড়তে আধশোয়া কাশবনের ভেতর লাফিয়ে পড়ে আবদুল খালেক দৌড় দিল,
আমি চললাম—
ইচ্ছামতো ঘুইরা লন! পাক-শাক কইরা খায়ালয়া এলা হের পর স্যান মেলা করুম মরণ ঢালি রেখাকে নামিয়ে দিয়ে বললে, জনমনিষ্য নাই, খালপাড় বরাবর ব্যাকই জঙ্গল!
কেমন যেন একটু গা ছমছম করে রেখার। বড় ভয় তার সাপখোপের। পা টিপে টিপে হাঁটে আর ঐদিক-ওদিক দ্যাখে। ওগো, তুমি কই?
কোনো সাড়া পাওয়া যায় না আব্দুল খালেকের। চেঁচামেচি জুড়ে দেয়া একটা কাঠঠোকরা উঠে যায়। যতোই এগোয়, খাড়া মাস্তুলের মতো কদমের ঘন বন দেখতে পায়। বর্শার ফলার মতো পাতার ফাঁক দিয়ে যেটুকু রোদ এসে পড়ছে তা কিছুটা ছিন্নভিন্ন, ফালাফালা, তার কোনো তেজ নেই। রেখা আবার ডাকলো, ওগো তুমি কই?
তা লুকোচুরি খেলার জায়গা বটে। রেখার মনে হয়, পাজিটা হয়তো ঘাড় গুজে চুপিসারে পেচ্ছাব করতে বসেছে কোথাও।
একজোড়া ইষ্টিকুটুম পাখি তার সাড়া পেয়ে ঝটপট করে একটু দূরে জামগাছে গিয়ে বসে। রেখা বললে, ও কুটুম পাখি, তাকে দেখেছো?
রেখার চোখ গেল একটা নধর গুইসাপের ওপর। ঝোপে ঢুকতে গিয়েও সে থেমে গেছে, ঘাড় ঘুরিয়ে খুব মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে।
দেখাচ্ছি মজা এই বলে একটা মাটির ঢেলা ছুঁড়লো সে, নচ্ছার হ্যাংলা!
আসশ্যাওড়া পাতা ছিঁড়ে নিয়ে তার গন্ধ শুকতে শুকতে রেখার মনে হলো, কোনোদিন সে এইভাবে বাইরে আসে নি! নাগালে পেলেই এক একটা পাতা ছেড়ে আর নাকের কাছে ধরে। বুনো ঝঝে মাথা ঝিমঝিম করে। এই গাছগুলোর প্রাণ আছে। এক একটা হেঁড়া পাতার গায়ে হালকা নিশ্বাসের গন্ধ, আমাকে মারলে–এই রকম। রেখা বললে, মারবো, আরও মারবো। পারলে বাধা দাও। যতো খুশি মারবো, ইচ্ছেমতো মারবো। একটা একটা করে সব পাতা ছিঁড়ে ফেলবো, সব গাছ উপড়ে ফেলবো। আমার নাম রেখা, আমি তোমাদের রানী—
রেখার নিজেকে খুব হালকা মনে হলো। গা জড়াজড়ি করা কদমের বন তাকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে, এক একটি লতা খুশিতে উপচে উঠে দোল খেয়ে বলছে, তাহলে তুমি এসেছো, এতোদিন পরে মনে পড়লো আমাদের–
রেখা মনে মনে বললে, আসতে পারি নি, কাজে বড় ব্যস্ত থাকি, তা না হলে বেশ লাগে, এই যেমন এখন—
একটা ধেড়ে কোলাব্যাঙ তিন লাফে অদৃশ্য হয় আর মার্টির হুঁকোবুড়োর মতো মাথা নাড়তে থাকে কালকচুর পাতা। ব্যাঙটা একটা বেহায়া জোকার, রেখা ভাবলো, লাফ মারার ভেতরেও পষ্ট ইয়ার্কি, হাত-ছুঁড়ে কেমন যেন তে-ফেরেঙা হয়ে লাফাচ্ছিল, ব্যাটার খুব চর্বি হয়েছে, খুব আনন্দে আছে—
বনময় সিল্কের বাতসে; পাটভাঙা, নরোম, আলুথালু। রেখার মনে পড়লো, ইস্কুলে থাকতে সেই শেষের দিকে, তারা একবার দল বেঁধে পিকনিকে গিয়েছিল শ্রীমঙ্গলে। একা একা সে শালবনের ভেতর ঘুরেছিল। কেন যে তার এমন মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন! ভীষণ কান্না পেয়েছিল। রাখ, তোকে কিভাবে জব্দ করি দ্যাখ—সমস্ত নিস্তব্ধতা যেন দাঁত কিড়মিড় করে তার দিকে তেড়ে এসেছিল। ঘরে ফিরে মার খেয়েছিল সে মামির কাছে। এমন এমন গাল শুনতে হয়েছিল তাকে যে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল নিজের ওপর। মনে হচ্ছিল, এমন দাঁতে দাঁতে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না, গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়ে মরবে।মামার আড়ালে সর্বক্ষণ পিশপিশ করতো মামি। উঠতে-বসতে খোটা দিতো। চুল আচড়াতে দেখলে হাত থেকে কাঁকুই কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতো। বলতো, সবসময় শুধু সাজন–গোজন, কুটোটি নেড়ে দুখানা করবে না, গাগতরে যে ঘুণ ধরবে। দুটো চেহারা ছিল মামীর। মামার সামনে এক রকম, আড়ালে ঠিক তার উল্টোটি, গলার স্বরই বদলে যেত মামীর। একবার অসাবধানে তার হাত লেগে তেলের বোতল উল্টে যাওয়ায় দাঁড়িয়ে লাথি মেরেছিল মামী, মামী মামী-রেখার দুচোখ ছাপিয়ে উঠলো, অনেকদিন পর একটা কষ্ট ভেতরে ভেতরে তাকে ছত্রখান করে দিল, মনে হলো কোনোদিন তার কেউ ছিল না, সে খুব একা, সে কি কোনোদিন কারো আপন হতে পারবে না।
রাজা গো! তুমি কই?
ঘু-ঘু করে ঘুঘু ডাকে। কাটবাদাম গাছের শুকনো লাল পাতার আড়ালে একটা ছাতারে পাখি উঁকি মেরে টু-কি টু-কি করে তাকে দ্যাখে। রেখা বললে, খুব মজা লাগছে না? শুয়োর—
এক একবার এক একটা কথা উঁকি দেয়। কেন যে আমি টুকু সোনাকে রেখে এলাম, এ কেমন মা! ঐ লোকটাকে আমি এখনো বুঝে উঠতে পারলাম না; যতো খারাপই হোক, তবু তো আমি নাড়ি-নক্ষত্র বুঝে ফেলেছিলাম মামীর। আর এই লোকটা, এর কিছুই বুঝি না, পা থেকে মাথা এর হেঁয়ালি, গোলমেলে। পরিপাটি করে খোঁপা বেঁধে দিলে খুশি হতো মামী। তলপেটে তেল মালিশ করে দিলে বড় আরাম পেত। সেদিন সব গোনা মাপ। সবসময় তার তালে তাল দিতে হবে, এই রকমই একটা আবদার ছিল মামীর। এই লোকটি কি যে চায় বোঝা যায় না। না, কোনো কিছুই চায় না এ লোকটা! এমন ভেতরগোজা মানুষ নিয়ে ঘর করা কি কঠিন!
পোকা, পোকামণি!
রেখার ডাকাডাকিতে বুনো গন্ধ শির শির করে, হলুদে সবুজে হু-হু করে গুমরে ওঠে শান্ত আলো। শেষ পর্যন্ত আবদুল খালেককে খুঁজে বের করলে রেখা। একটা তমাল গাছের গায়ে পিঠ রেখে পা লম্বা করে বসেছিল সে।
ঝপ করে বসে পড়ে রেখা।
তুমি এখানে?
আবদুল খালেক তার গলা জড়িয়ে ধরলো।
রেখা বললে, রাজা, তুমি আমাকে ভালোবাসো। রাজা তুমি আমাকে ভালোবাসা দাও, আমি মরে যাবো–
আবদুল খালেক তার চোখে চুমু খেল। তারপর বললে, তুমি খুব সুন্দর, তুমি জীবনভর থেকো, যেদিন মরবো, তোমাকে দেখতে দেখতে যেন মরি—
রেখা কাঁদলো; আর এমনভাবে কাঁদলো যেন তার প্রতিজ্ঞা ছিল আজ সে ঠিক এইখানে, এইভাবে, মাটির ওপর উপুড় হয়ে, শেষবারের মতো করে কাঁদবে। প্রাণভরে নিজেকে নিংড়ে নিংড়ে। তার সে কান্নায় এমন কিছু ছিল, যাতে আবদুল খালেকের এই প্রথমবারের মতো মনে হয়, ওর কোনো অভিযোগ নেই, ও কিছুই চায় না,জীবনে এত শক্ত মার খেয়েছে। সে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী আমার, কেন এমন করে জীবন দিয়ে ফ্যালো–
রেখা কোনো কথা বললে না। তার ভেতরে দারুণ একটা জিদ, আজ যদি আবদুল খালেক তাকে ধরে মারেও, সে কোনো কথা বলবে না। বলার মতো তার আর কিছুই নেই। যা বলার সব সে বলে দিয়েছে। আর সে বেহায়াপনা করতে পারবে না।
আবদুল খালেক অবলীলাক্রমে তাকে তুলে নেয়। তারপর দপদপ করে হাঁটে। কদমের বনে দামাল বাতাসের এক একটা ঝাপটা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝোপের আড়ালে নিয়ে ঘাসের ওপর শুইয়ে দেয় সে রেখাকে। রেখা বললে, ওগো আমার ভয় করে, এখানে না। কেউ যদি দ্যাখে—।
আবদুল খালেক বললে,তোকে আমি ভীষণভাবে চাই, ওরে মাধু আবদুল খালেক তার ভেতরের এক থাবাওলা, লোমশ, দাতাল অচেনা জানোয়ারকে দেখতে পেল, গাছের ছায়ায় ছায়ায়, পাখির সরল শিসে, যে এতদিন অকাতরে ঘুমিয়েছে। সে তাকে আহ্বান করলো।
রেখা বললে, রাজা, আমার পিঠে লাগে—
লাগুক—
আমাকে ভালোবাসো রাজা, আদর করো–
গরগরে চণ্ড ও আত্মবিস্মৃত আবদুল খালেক তার গহিন উন্মত্ততার পাতাল থেকে বললে, আমার মাধুরী, মাধুরানী–
রেখা বললে, রাজা আমি মরে যাবো, আমাকে আদর দাও–
অনেক অনেকক্ষণ পর আবদুল খালেক যখন উঠতে যাবে রেখা তার গলা জড়িয়ে ধরে। বললে, আমাকে ধরো, আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকো।
আবদুল খালেক রেখার কানে মুখ নিয়ে বললে, ব্যথা পেয়েছো?
রেখা কান্নার মতো করে বললে, বুঝতে পারো নি?
ঠিক ইচ্ছে করে নয়, কি ভাবে যেন হয়ে গেল—
আমি ভয় পেয়েছিলাম!
এ কথায় আবদুল খালেকের ভিত পর্যন্ত কেঁপে যায়। সে জানে তার দুটো হাত নির্বোধের মতো রেখার গলার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, যে-কোনো মুহূর্তে ভীষণ একটা কিছু ঘটে যেতে পারতো,
যে-কোনো মুহূর্তে; অশ্য তখন রেখার চোখ বন্ধ ছিল।
সে বললে, হয়তো অনেকদিন পর, তাই! আর কখনো হবে না–
রেখা বললে, আমি কিছু মনে করি নি। তোমার ভালো লেগেছে?
খুব!
তুমি সুখী হয়েছে?
আবদুল খালেক সে কথা প্রমাণ করার জন্যে রেখাকে বুকের ভেতরে নিয়ে অস্থির করে দিল চুমোয় চুমোয়।
একটা গলা ডোবানো হিজলের আড়াল নিয়ে পানিতে নামে রেখা। আবদুল খালেক বললে, ভয় নেই, ভালো করে নামো, এখানে দেখার কেউ নেই।
রেখার পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ। শাড়ি ডাঙায় রেখে সে পানিতে নেমেছে। আবদুল খালেকও নামে সেইভাবে, গাছের ডালে তার সার্ট-প্যান্ট।
রেখা আবদুল খালেকের পিঠ ধরে অনেকক্ষণ সাঁতার কাটে।
আবদুল খালেক বললে, কিছুদূর যাবে?
রেখা বললে, দূরে যেতে ভয় করে—
ধরে থাকো–এই বলে খালের বেশ কিছুদূর পর্যন্ত যায় আবদুল খালেক। বেশ কিছুদূরে ধানখেতের মাঝখানে একটা নৌকা। আবদুল খালেক আর এগোয় না। ফিরে আসে।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক ধরে তারা এইভাবে পানি ছিটোয় আর মাতামাতি করে। রেখা বললে, চলো, খুব হয়েছে, জ্বর না আসে আবার —
গেঞ্জি দিয়ে মাথা মুছে রেখাকে সেটা দেয় আবদুল খালেক। রেখা বললে, কতো অসুবিধে, এতো জানলে কাপড়-চোপড় নিয়ে আসতাম। এখন খালি গায়ে শুধু শাড়ি জড়িয়ে থাকতে হবে। কেমন দেখাবে? লোকে দেখলে কি বলবে?
আবদুল খালেক বলে, ছইয়ের ভেতরে বসে থাকবে, আমি ছাড়া আর দেখছে কে?
মরণ মাঝি কি ভাববে বলো তো?
আবদুল খালেক রেখার গাল টিপে দিয়ে বললে, ভাববে মেয়েলোকটা একটা বখাটে ছোঁড়ার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ইয়ে করে বেড়াচ্ছে–
রান্না শেষ হয়ে গিয়েছিল মরণ ঢালির। কলাপাতায় ঢেলে তিনজনে একটা গাছের ছায়ায় বসে বসে খেল। ইলিশ মাছ আর ভাত। রেখার খুব খিদে পেয়েছিল। সে পেটভরে খেল। বললে, মাঝির রান্নার হাত খুব সুন্দর। আমাকে রান্না শেখাবে?
মরণ ডালি লজ্জা পেয়ে বললে, কি যে কন? এইগুলো অইলো গিয়া আপনের ভক্কর-চক্কর, ঠ্যাকার কাম চালাইন্যা পাক…
দুপুর শেষ হবার আগেই নৌকো ছাড়ে মরণ ঢালি। জাঙ্গাইলা বোলতলী, বাইল্যাগাঁও, ভোগদা, একটার পর একটা গ্রামের পাশ কাটিয়ে নৌকো এগোয়। নৌকোর ভেতরে দালামোচড়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রেখা। মরণ ঢালি ছইয়ের মুখে একটা ছালা টানিয়ে দিয়েছিল। গলুইয়ে বসে থাকতে থাকতে আবদুল খালেকেরও যেন কেমন একটু তন্দ্রার ভাব এলো।
একটু পরে মরণ ঢালি বললে, ভিতরে গিয়ে বহেন স্যার। পাথাইল্য হোত। এলা ভান কইরা মান্দার বনে নাও ঢুকায়া দিবার পারে।
একটু একটু করে বিকেল মরে আসে। খালের ঘোলা পানি আর কলরব দেখে আবদুল খালেক বোঝে, এখন তারা পদ্মার খুব কাছে।
মরণ ঢালি একটা বাঁক পার হবার পর পানির তোড়ের দিকে চোখ রেখে বললে, রাগ দেখছেন নি!
বিকেল শেষ হবার আগেই লৌহজং পৌঁছায় নৌকো। আবদুল খালেক গায়ে হাত দিয়ে রেখাকে জাগায়। রেখা বললে, আমার তো আর বেরুনোর উপায় নেই–
নৌকোর ওপরে বসে দ্যাখো–
শাড়ির আঁচলে কানমাথা সব টেকে ছইয়ের মুখে নেমে বসে রেখা। আবদুল খালেক নৌকো থেকে নেমে হাঁটতে থাকে।
এখন তাহলে এই! এই অবস্থা!
বেশ দূরে সরে গেছে পদ্মা। পালতোলা নৌকোর বহর আবছা আবছা দেখা যায়। যা ভেবেছিল এখন আর তার কিছুই নেই। হাজা-মজা, শুকনো। এই লৌহজং নামটা তার মাথার ভেতরে অন্ধকারে দোলা দূর নৌকোর বাতির মতো এখন টিপ টিপ করে জ্বলে। গোয়ালন্দ, আরিচা, ভাগ্যকুল, তার পাশা, ষাটনল, এই নামগুলোর ভেতরে এখন সে দারুণ এক দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়।
ভাবতেই পারে নি আবদুল খালেক, এমনভাবে তাকে হতাশ হতে হবে। তার সব উৎসাহে ভাটা পড়ে। কেন এলো এতোদূর, শুধু একটা নামের জন্যে, লৌহজং একটা নাম, এই নামের জন্যে।
কতোকাল আগেকার কথা সেসব, মাঝরাতে হঠাৎ এক শোরগোল তার কানে এলো, ভাগ্যকুল, ভাগ্যকুল! তারপাশা, তারপাশা!
কতোকাল আগেকার কথা সেসব? সেই অস্ট্রিচ, সেই এমু, সেই কিউই, সেই সব ইস্টিমার, কতোকাল আগের কথা সে সব?
আবদুল খালেকের মনে হলো, তার ভেতরের সব ঘোলা পানি এখন শান্ত, তাতে আর ঢেউ নেই। এক একটা বড় ফ্ল্যাট, ক্যান্টারবেরি, পোর্টমাউথ, লীখ, হালোয়ারা, তার দেহের ওপরে থরথর করে ভেসে আসে।
এইভাবে সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়। জীবনে সেই প্রথম, এক গভীর রাতে, তার কানে বেজে উঠেছিল–লৌহজং, লৌহজং। পাশে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান, মনি ভাইজানের জামার পকেটে একটা ফিতে, ফিতেয় চুলের গন্ধ, যে গন্ধে অনেক দুঃখ, যে দুঃখে অনেক ভালোবাসা, যে ভালোবাসায় অনেক ছেলেবেলা…।
এইভাবে সবকিছু একদিন গল্প হয়ে যায়। জীবনে সেই প্রথম, এক অন্ধকার রাতে তার কানে বেজে উঠেছিল—তারপাশা তারপাশা! পাশে দাঁড়িয়ে মনি ভাইজান, মনি ভাইজানের হাতে একটা লোহার ক্লিপ। মনি ভাইজান বিড়বিড় করে হাওয়ার কানে কানে বললে, আমরা যি কোথায় যাচ্ছি!
কে জানে, কে কোথায় যায়!
গোয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ–পথ যেন আর শেষই হতে চায়। মনি ভাইজানকে দেখা যাচ্ছিল কুয়াশাছন্ন। কেউ যেন তাকে মুছে দিয়েছে। ঝাপসা, অস্পষ্ট। এইসব ভাবলো আবদুল খালেক। নৌকোয় ফিরে এলো।
তাকে ফিরতে দেখে মরণ ঢালি বললে, নাওয়ের ইলশা পাইলেন নি?
তুমি নৌকো ছাড়ো–-
আবদুল খালেক ছইয়ের ভেতরে ঢুকে কাত হয়ে শুলো।
রেখা বললে, তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
কেমন দেখাচ্ছে? অন্যমনস্কভাবে জিগ্যেস করে আবদুল খালেক।
কই দেখি—কপালে হাত দিয়ে দেখে রেখা বললে, গা তো ঠিকই আছে, ভেবেছিলাম বুঝি জ্বর এসেছে–
আবদুল খালেক কিছুটা পরে বললে, এই লৌহজং আমি আগেও একবার দেখেছি, এখন যেন অন্যরকম, না এলেই বোধহয় ভালো ছিল—
মরণ ঢালি নৌকো ছেড়ে দিয়েছিল আগেই। আবদুল খালেক লম্বা হয়ে শুয়ে হাতের ওপর মাথা রেখে বলতে থাকলো, দেখেছিলাম স্টিমার থেকে, তখন এই এতটুকু, সঙ্গে মনি ভাইজান–
রেখা বললে, আজ তোমার মনি ভাইজানের কথা বলো, কতো কথা তো হয়, কিন্তু আসল কথা তো একদিনও বললে না! আমার খুব ইচ্ছে করে জানতে–
কি বলবো, কি আছে বলার। ভাঙাচোরা মানুষকে নিয়ে কি-ইবা এমন থাকে বলবার, সে তোমার ভালো লাগবে না–
রেখা অনুনয় করে বললে, তবু তুমি বলো, লক্ষ্মীটি—
আবদুল খালেক বললে, তখন তো কিছু বুঝতাম না, একটা শালিক পাখির জন্যে কি হাহাকারটাই না ছিলো বুকের ভেতর। একদিন দেখা না পেলে সবকিছু মিথ্যে হয়ে যেত, একটা ভাঙা কাচের শেকলকে কতো যত্ন করেই না লুকিয়ে রেখেছি। এখন কাচের সেই শেকল গলায়, না পারি খুলতে, না ফেলতে, খুলতে গেলে যদি গলা কেটে যায়—
রেখা বললে, এই বুঝি তোমার মনি ভাইজানের কথা হচ্ছে?
কিভাবে বলবো, কি এমন জানতাম, না, কিছু না। আমি ছিলাম সকলের ছায়ায় ছায়ায়, কেউ চাইতো না সামান্য একটু রোদ লাগুক গায়ে, রাতে ঘুমের ঘোরেও খুঁজতাম, বিছানা হাতড়ে দেখতাম কাছে কেউ আছে কি না, এইভাবে গায়ে গায়ে, ছায়ায় ছায়ায় আমি বড় হচ্ছিলাম। কলেজে ভর্তি হয়ে যাবার পর থেকে টিপু ভাইজান হয়ে গিয়েছিল দূরের মানুষ, নাগাল পাওয়া খুব শক্ত ছিল। আমার ছিল মনি ভাইজান। যখন একা একা বসে থাকতাম চোখ ভরে আসতো পানিতে, কেবলই মনে হতো যদি কোনোদিন মনি ভাইজানের কিছু হয়ে যায় আর যদি ঘরে না ফেরে। কেন যে এরকম মনে হতো! অথচ মনি ভাইজান ছিল একেবারে উল্টো ধাচের। বকাঝকা করলে, সেদিন হাঁড়ি উল্টে আরো বেশি করে খেত। মা বলতো, বেহায়া তোর যে কি হবে! রেগে গেলে আব্বা বলতো, কি আবার হবে, পুঁতলে চারা হবে। এসব যে গ্রাহ্য করার ব্যাপার, মনি ভাইজানকে দেখে কখনই তা মনে হতো না। এরপর হুট করে একদিন পাকিস্তান হয়ে গেল। কি হলো না হলে অতো বুঝতাম না, কেবল মনে আছে আমাদের বাড়িতে একটা অস্বাভাবিক নীরবতা নেমে এলো সেদিন। বাইরে রাস্তায় হুড়োহুড়ি রসগোল্লা ছোঁড়াছুঁড়ি বহু কিছু চলছিল, অথচ আমাদের কিছু করবার নেই, আব্বা বললে, কেউ বাইরে যেও না, ঘরে থাক সবাই। তা আমরা ঘরেই থাকতাম। দুএকদিনের মধ্যেই বুঝলাম এমন একটা কিছু ঘটে গেছে যাতে আমরা কেউই ভালো নেই, আমাদের আর ভালো থাকা সম্ভব নয়, আমাদের পরিবারের সুখ-শান্তি চুরি হয়ে গেছে। আব্বাকে সবসময় দেখতাম থমথমে। মাঝে মাঝে মার সঙ্গে তর্ক হতো। আর অনেকের সঙ্গেই তর্ক হতো। শেষে সকলের অমতে আব্বা পাকিস্তানে চলে এলেন। এতদিন তবু একরকম ছিল। আমরা ইস্কুলে যেতাম, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতাম, কেউ কেউ এসে ডাকতো। এই ডাকাডাকিটা কেন যেন বন্ধ হয়ে গেল। এক সময় দেখি আর কেউ আসে না, আর কেউ এসে বাইরে যাবার জন্যে ডাকে না। কি সব কানাঘুষো হয়, হারিকেন জ্বেলে সারারাত বিছানায় বসে বসে মা আমাদের পাহারা দ্যায়, কিছু বুঝি না কেন। আব্বা পাকিস্তানে চলে আসাটাকে কেউ ভালো চোখে দেখে নি। আব্বা বলতো মাথা উঁচু করে চলতে পারাটাই বড় কথা। যেখানে মাথা উঁচু করে থাকতে পারবো, সেটাই দেশ। মা বলতো তাই বলে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অজানা এক দেশে আমাদের থাকতে হবে। এটা কোন কথা। আমি কোথাও যাবো না, মরতে হলে এইখানেই মরবো, কপালে যা থাকে তা হবে। এ কথায় খেপে উঠতো আব্বা। বলতো দেশ আবার কি, এক দেশ না ছাড়লে আরেক দেশ পাওয়া যায় না। সকলের জীবনেই একবার হিজরত আছে। রুসুলুল্লার কথা ভুলে গেলে? তিনি মদিনা শরীফকেই বেছে নিয়েছিলেন— কেনারাম কাকা মাকে প্রবোধ দিয়ে বলতেন, আমরা সবাই তো আছিই, দেশ ছেড়ে যাবে কেন, আজন্মকালের সম্পর্ক! কিভাবে যে চলছিল, মনেও নেই সব। সবসময় ঘরের ভেতর গুমোট, কারো মুখের দিকে তাকানো যায় না, এক এক সময় টিপ ভাইজান এক একটা খবর নিয়ে আসে, তাই নিয়ে সলাপরামর্শ হয়, গুজগুজ হয়, অতশত আমাদের মাথায় ঢুকে না। কেবল এটুকুই বুঝতাম, কোথাও না কোথাও একটা জটিল গলদ দেখা দিয়েছে, কারো কোনো কিছুতেই কোনো স্বস্তি নেই, কেউ মন খুলে কথা বলে না, এই রকম। মাঝে মাঝে দুএকজন জিজ্ঞেস করে, হ্যারে তোর বাবা পাকিস্তানে গেল কেনরে, তোর বাবা নাকি ভালো লোক নয়? এইসব শুনে মন খারাপ হয়ে যায় ভীষণ, ইচ্ছে করে না কারো সঙ্গে মিশি, কারো সঙ্গে কথা বলি। আমি যে মুসলমান, ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারার জন্যে কষ্টো হয়, নিজেকে অপরাধী মনে হয়। এইভাবেই চলছিল, কোনো একভাবে চলছিল, হঠাৎ টিপু ভাইজানের কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের বাইরে বেরুনো বারণ হয়ে গেল আমাদের। কেনারাম কাকা মাকে এসে কি কোথায় সব বললো। এলেন দুর্গাদাস বাবু, নির্মল কাকা। কি কোথায় সব বোঝালেন টিপু ভাইজানকে, মাকে। আমরা অন্য কেউ কিছু বুঝলাম না। মনি ভাইজান টিপু ভাইজানকে জিগ্যেস করলে, এত গুজগুজ কিসের, কি ব্যাপার। খেপে গিয়ে টিপু ভাইজান বললে, তোর অতো মাথা ঘামানোর কি আছে, সব কথা তোকে শুনতে হবে। আমরা থাকি দূরে দূরে, ভয়ে; যখন এইসব কথা হয় ধারে কাছে থাকলে টিপু ভাইজান খাউ করে ওঠে। হঠাৎ একরাতে এলো একটা ট্রাক। তাড়াহুড়ো করে কিছু বাঁধাছাদা হলো। ট্রাকে বসে নির্মল কাকা। বললেন, দেরি করো না, দেরি করাটা উচিত হবে না। বেশকিছু মালপত্র তোলা হলো ট্রাকে। টিপু ভাইজান বললে, তোরা সবাই এক এক করে ট্রাকে ওঠ, মালপত্রের সাথে বসে থাক। মা বললে, আমরা পাকিস্তান যাচ্ছি বাবা। মনি ভাইজান বললে, তোমরা যাও আমি যাবো না। মা মনি ভাইজানের পিঠে হাত রেখে বললে, টিপু যা বলছে তাই কর, চারদিকে খুনোখুনি হচ্ছে, ট্রাকে গিয়ে বোস, এই বলে মা দেয়ালে মাথা রেখে কান্না শুরু করলে। মনি ভাইজান চুপিচুপি আমাকে বললে, পোকা শোন, আমার সঙ্গে চল কাজ আছে। আমি মনি ভাইজানের চোখ দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। আমার হাত ধরে মনি ভাইজান দৌড়তে শুরু করলো। বললে আরো জোরে ছোট, পা চালা। বারবার আমি পেছনে যাই। মনি ভাইজান আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। ধমক মারে আর বলে এক গাট্টা মেরে খুলি উড়িয়ে দেবো তোর মাথার, শুয়োর কোথাকার, আরো জোরে দৌড়ো, আরো জোরে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে আমি দম নিয়ে নিই, আবার ছুটতে থাকি, ছোটা যেন আর শেষই হয় না। শেষে ছবিদিদের বাগানে পৌঁছে আমরা থামি। মনি ভাইজান বললে, একটু জিরিয়ে নে, কেউ কিছু জিগ্যেস করলে কিছু বলবি না, বলবি রানির কথা, রানি একটা বই নিতে পাঠিয়েছে। চুপি চুপি ছবিকে বলবি আমার কথা, আমি এইখানে। পারবি তো? বললাম, পারবো। সেই অন্ধকারে ছবিদিদের বাড়ির পেছনের বাগানে ডেকে আনলাম। ছবিদি পড়ার ঘরে একা বসেছিল একটা বই নিয়ে। বললাম, মনি ভাই তোমাকে ডাকে ছবিদি, পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে। ছবিদি চোরের মতো পা টিপে টিপে মনি ভাইজানের সামনে এসে দাঁড়ালো। মনি ভাইজান, পুকুরে ডুবে যাওয়ার মতো হাঁসফাস করে বললে, ছবি, আমরা চলে যাচ্ছি। ছবি, আমরা আর এখানে আসবো না, আমাকে মাফ করে দাও। কোনো কথা না বলে মাটির ওপরে বসে পড়লো ছবিদি, ফুপিয়ে উঠলো। মনি ভাইজান আবার বললে, আমরা চলে যাচ্ছি ছবি। ছবিদি বললে, মনিদা কোনোদিন মন থেকে তোমাকে গাল দিই নি–। মনি ভাইজান বললে, আমাকে কিছু দাও ছবি, আমাকে কিছু দাও। উঠে দাঁড়িয়ে ছবিদি বললে, কি নেবে মনিদা, কি নেবে তুমি? মনি ভাইজান বললে, তোমার যা খুশি, যা দিতে পারো, হাতে সময় নেই, দেরি হয়ে যাচ্ছে, দাও। ফস করে মাথা থেকে ফিতে খুলে দিল ছবিদি। বললে, এটা নেবে? মনি ভাইজান ভিক্ষা নেওয়ার মতো দুহাত পেতে বললে, তোমার মাথার কাটা, ক্লিপ, যা পারো,সব দাও। ছবিদি দিলো। দিয়ে হু-হু করে কেঁদে উঠলো। বললে, মনিদা, আমি মরে যাবো, আমি মরে যাবো। মনি ভাইজান অন্যদিকে তাকিয়ে বললে, আমি আসবো, যে করেই হোক আমি আসবো ছবি, তুমি থেকো। তারপর আবার ছোটা। ছুটতে ছুটতে আবার ফিরে আসি দুজনে। সকলে ট্রাকে। টিপু ভাইজান আমাদের জন্যে ছটফট শুরু করে দিয়েছে। কাছে আসতেই ঠাস করে একটা চড় মারলো মনি ভাইজানের গালে। বললে, শুয়োর কোথাকার, কোথায় গিয়েছিলি, লাট সাহেবের জন্যে সবাই বসে থাকবে। কোনো কথা না বলে মনি ভাইজান ট্রাকে উঠলো। কেনারাম কাকা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ভালো থেকো, যেখানেই যাও ভালো থেকো, মানুষ হয়ো–
রেখা বললে, কাঁদছো কেন?
আবদুল খালেক বললে, কি জানি, আজকাল আমার এই রকম হয়। আগে কখনো হতো না। আগে কখনো এভাবে ভাবি নি। এভাবে মনে পড়ে নি। এখন মনে পড়লেই এরকম হয়। তুমিই বলো না, কেন এরকম হয়?
রেখা হাত বুলিয়ে দিল আবদুল খালেকের মাথায়। আবদুল খালেক বললে, সেই বোধহয় প্রথম তার ছিঁড়ে গেল সবকিছুর, সে তার আর কখনো জোড়া লাগলো না। আর কখনো জোড়া লাগবে না। মনি ভাইজান পারে নি, পারতে চায় নি। যদি পারবে, তাহলে ওভাবে মরতে গেল কেন। মার সামান্য একটা কথায় অতোগুলো ঘুমের বড়ি খেতে যাবে কেন, তা না হলে? তুমি পারতে? ঐ ছেঁড়া তার জুড়ে দিতে? স্টিমারে সারারাত আমরা দাঁড়িয়ে কাটিয়েছিলাম। সারাক্ষণ আমি মনি ভাইজানের পাশে সারাক্ষণ। এক একটা ঘাট আসে, তারপাশা, ভাগ্যকুল, ষাটনল, মনি ভাইজান হু-হু করে কাঁদতে থাকে। বলতে থাকে, তারপাশা তোকে আমি মারবো, ভাগ্যকুল তোকে আমি মারবো, নদী-তোকে আমি মারবো, শেষ মারা আর শেষ হয় না কিছুতেই–
রেখা বললে, থাক, তুমি চুপ করো, ঘুমোও, তুমি যে কী—
আর কোনো কথা বললে না আবদুল খালেক। এক সময় বোধহয় তার তন্দ্রা এলো। ঘুমোবার আগে রোজ যা হয়, সেই হাত-পা মুড়ে, হাঁটু দ-করে টুকুর মতো এই এতোটুকু হয়ে গেল সে। তারপর এক সময় হাতড়ে হাতড়ে রেখার একটা পায়ের ওপর হাত রেখে সে বললে, আমাকে কোলে নাও মাধুরী–