- বইয়ের নামঃ অনুর পাঠশালা
- লেখকের নামঃ মাহমুদুল হক
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. দুপুরে অনু একা থাকতে পারে না
দুপুরে অনু একা থাকতে পারে না, ভেবে পায় না কি করবে, কোথায় যাবে।
ঘরের সবগুলো দেয়ালের চেহারা ও হাবভাব আগেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো; থমকানো এবং শাদা ভয়ের ছাপ মারা এমন সব অনড় আয়না যাতে কখনো কারো প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না। বাঞ্ছারামপুরের থানে মোড়া রানিফুফুর কথা মনে হয়; এক ফুৎকারে নিভে যাওয়া নির্বিকার মোমবাতি, ঘুমের ঘোরে খিলখিল করে হাসে।
গরম হাওয়ার হলকা চোখে ছোবল মারে বলে এই সময় জানালায় দাঁড়াতেও অনুর তেমন ভালো লাগে না। ঝিমিয়ে পড়া ওলবড়ি গাছ, ঝলসানো কাক, ঘুঘু ও অন্যান্য পাখির ডাক, তপ্ত হাহা হাওয়া, সব কিছু গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মতো চিমসে গন্ধে ভরিয়ে রাখে। লামাদের বাগানে বাতাবি লেবুর ঝোপের পাশে আচ্ছন্ন ছায়ায় পাড়া বেপাড়ার দস্যুরা পাঁচিল ডিঙিয়ে এই সময় ব্রিং খেলে, জানালায় দাঁড়ালেই সব দেখা যায়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে ব্রিং খেলা।
খুচরো খুচরো ঝগড়া, আলগা মারপিট, এইসব শুরু হয় এক এক সময়। কলরব শুনে লামাদের বাছুর-প্রমাণ এ্যালসেশিয়ান গেস্টাপো তুমুল আক্রোশে হুড়োহুড়ি-লম্ফঝম্প শুরু করে কখনো। দিনের পর দিন। সবকিছু প্রায় ধরাবাধা নিয়মে নির্বিবাদে চলতে থাকে।
দেখা যায় লামাদের বাগানের জলেশ্বর মালী আর মালীবৌকে। বাগানের দক্ষিণ কোণে তাদের বাঁশের একচালা ঘর। জানালায় দাঁড়ালে সময় সময় অনেক বিচিত্র ঘটনা চোখে পড়ে। সাধারণত ভরা হাঁ-হাঁ নির্জন দুপুরে আলগা বুকপিঠে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে দুজন। কোনো কোনোদিন মালীবৌয়ের বুকে মুখ গুঁজে নিসাড় টান হয়ে পড়ে থাকে জলেশ্বর মালী। মালীবৌয়ের বুক শাদা ধবধবে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোয়, যতোক্ষণ পর্যন্ত বেলা পড়ে না আসে——হাতে পাওয়ার মতো গাছের নিচে পাউডার-পাফ কোমল সূর্য ঝুলতে থাকে। অনুর কি কোথায় সব মনে হয়; ওদের ঘরের মেঝে খুব ঠাণ্ডা, গাল পেতে শশায়া যায়, অগোচরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।
জানালার আকর্ষণ উত্তরোত্তর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, প্রবল প্রলোভন এড়াতে না পেরে সেখানে দাঁড়ায় সে; রৌদ্র পরাক্রান্ত এক শত্রু, ঝনঝনে পিতলের থালা।
ছাদ আরো প্রসারিত।
অনেক বাড়ির অনেক খোলা জানালা—কোথাও নির্লজ্জ কোথাও গুমোট, বুড়ো বটগাছের ডালে লটকানো দুচারটে রঙ-বেরঙের লেজওলা ব্যাঙাচি ঘুড়ি, বরফকলের ঢেউটিনের ছাউনি, কৃষ্ণমূর্তি দানবের মতো পানির ট্যাঙ্ক, ছাদের ওপরে এইসব। ভাঙা মন্দিরের অনুজ্জ্বল চুড়া, মহল্লা সর্দার কাফুল মিয়ার চাঁদ-তারা-নিশান মার্কা বাড়ির ছাদের পেঁপেগাছ, চিলের চেরা চেরা দাগ-লাগা মালীবৌয়ের বুকের মতো নিস্তব্ধ গোল আকাশ, ছাদের উপরে এইসব।
ভালো লাগে ছাদে যেতে, কিন্তু গরমে এমন তেতে থাকে যে পা রাখতে ভয় হয়, পাছে ফোস্কা পড়ে; গালানো লোহা হড়হড় করে ঢেলে রাখে কেউ ছাদে।
সবচেয়ে বড় কথা ছাদে যাওয়া বারণ।
তার অনেক কিছুই ইচ্ছাধীন নয়, আমাদের বাগানে যেতে পারে না বারণ।
রঙ-বেরঙের বহু মার্বেল আছে বহুদিন আগেকার; কিন্তু সে ব্রিং খেলা জানে না। নিজের কাছেই সে বয়েস পার হয়ে গিয়েছে। বয়েমে সাজানো আছে মার্বেলগুলো। অদ্ভুতভাবে আলো ঠিকরে পড়ে কখনো কখনো। আর আছে এ্যাকোয়ারিয়ামে আমাজান সোর্ডের চারপাশে ছড়ানো, সিলভার ডলার এ্যানজেল আর লিওপার্ড কোরিডোরাসের খেলার সামগ্রী।
বারণ—যেন দশমাথাওলা এক রাবণ। লামাদের বাগান—যেখানে আম, গোলাপজাম, পেয়ারা, আমলকী, কাবাবচিনি, ফলসা বা ছোটো বড় হরেক জাতের গাছের সমারোহ, সে যেতে চায় পাখির সন্ধানে। এয়ারগান দিয়ে চড়ুই মেরেছে একসময়, চড়ুই এবং দোয়েল, তুলোর্টাপারি; এখন একটা এয়ারগান বগলদাবা করে ঘোরাঘুরি নেহাতই হাস্যকর। নিজে বুঝতে পারে, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে সে, বদলে যাচ্ছে সবকিছু।
পাখির শিস ভালো লাগে—নিস্তব্ধ দুপুরে।
রৌদ্রের ঝনঝনে থালা ছুঁড়ে ফেলে নির্মল ছায়া বিধৌত পাখির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে, মড়ার মাথার মতো নিস্তব্ধ দুপুরে।
ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ,—একাধিকবার তার মা এইসব বলেছে, তোর সবকিছু সাজে না। ভালো না লাগলে রেকর্ড বাজিয়ে শুনবি। ছবি আঁকা আছে, গল্পের বই পড়া আছে, ঘরে বসে যা ইচ্ছে করতে পারিস, কেবল টো-টো করে ঘোরা চলবে না।
এক সময় সারাদিন মেকানো নিয়ে পড়ে থাকতো সে; মেকানোর পর ডাকটিকিটের অ্যালবাম। ডাকটিকিটের পর এলো বই পড়ার নেশা। তারপর ছবি আঁকা। আফ্রিকার জঙ্গলে, অভিশপ্ত মমি, মিশমীদের কবচ, ছিন্নমস্তার মন্দির খুবই প্রিয় বই ছিলো এই কিছুদিন আগেও। এখন ভালো লাগে আম আঁটির ভেঁপু। বালিশ ভিজে যায়।
বই আসা প্রায় বন্ধ; মধ্যে থেকে রাশি রাশি কমিকের বই জমে পাহাড় হয়েছে। এসব অনুর কাছে খয়েরি তেলাপোকার মতো চকলেট আর চটচটে চিউইংগামের মতোই বেজায় ফালতু মনে হয়। বরং রোডস্ দ্বীপের পিতলের মূর্তির কথা পড়তে ভালো লাগে, জানতে ইচ্ছে করে আলেকজান্দ্রিয়ার নিঃশব্দ আলোকস্তম্ভের কথা, কুফুর পিরামিড কিংবা স্ফিংস-এর বৃত্তান্ত।
ছবি কি সবসময় আঁকা যায়, না আঁকতে ইচ্ছে করে, না ভালো লাগে।
গান ভালো লাগে। বেশি ভালো লাগে বাজনা। বহুদিন থেকেই রেকর্ড কেনা বন্ধ। ছমাসের ভেতর নতুন কোনো রেকর্ড আসে নি বাড়িতে, না গানের না বাজনার। চাঁদের পাহাড় কিংবা আম আঁটির ভেঁপুর মতো কোনো বই তো দূরের কথা, কিছুই আসে নি।