- বইয়ের নামঃ অনুর পাঠশালা
- লেখকের নামঃ মাহমুদুল হক
- প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. দুপুরে অনু একা থাকতে পারে না
দুপুরে অনু একা থাকতে পারে না, ভেবে পায় না কি করবে, কোথায় যাবে।
ঘরের সবগুলো দেয়ালের চেহারা ও হাবভাব আগেই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো; থমকানো এবং শাদা ভয়ের ছাপ মারা এমন সব অনড় আয়না যাতে কখনো কারো প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে না। বাঞ্ছারামপুরের থানে মোড়া রানিফুফুর কথা মনে হয়; এক ফুৎকারে নিভে যাওয়া নির্বিকার মোমবাতি, ঘুমের ঘোরে খিলখিল করে হাসে।
গরম হাওয়ার হলকা চোখে ছোবল মারে বলে এই সময় জানালায় দাঁড়াতেও অনুর তেমন ভালো লাগে না। ঝিমিয়ে পড়া ওলবড়ি গাছ, ঝলসানো কাক, ঘুঘু ও অন্যান্য পাখির ডাক, তপ্ত হাহা হাওয়া, সব কিছু গনগনে উনুনে পোড়া রুটির মতো চিমসে গন্ধে ভরিয়ে রাখে। লামাদের বাগানে বাতাবি লেবুর ঝোপের পাশে আচ্ছন্ন ছায়ায় পাড়া বেপাড়ার দস্যুরা পাঁচিল ডিঙিয়ে এই সময় ব্রিং খেলে, জানালায় দাঁড়ালেই সব দেখা যায়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে ব্রিং খেলা।
খুচরো খুচরো ঝগড়া, আলগা মারপিট, এইসব শুরু হয় এক এক সময়। কলরব শুনে লামাদের বাছুর-প্রমাণ এ্যালসেশিয়ান গেস্টাপো তুমুল আক্রোশে হুড়োহুড়ি-লম্ফঝম্প শুরু করে কখনো। দিনের পর দিন। সবকিছু প্রায় ধরাবাধা নিয়মে নির্বিবাদে চলতে থাকে।
দেখা যায় লামাদের বাগানের জলেশ্বর মালী আর মালীবৌকে। বাগানের দক্ষিণ কোণে তাদের বাঁশের একচালা ঘর। জানালায় দাঁড়ালে সময় সময় অনেক বিচিত্র ঘটনা চোখে পড়ে। সাধারণত ভরা হাঁ-হাঁ নির্জন দুপুরে আলগা বুকপিঠে জড়াজড়ি করে শুয়ে থাকে দুজন। কোনো কোনোদিন মালীবৌয়ের বুকে মুখ গুঁজে নিসাড় টান হয়ে পড়ে থাকে জলেশ্বর মালী। মালীবৌয়ের বুক শাদা ধবধবে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোয়, যতোক্ষণ পর্যন্ত বেলা পড়ে না আসে——হাতে পাওয়ার মতো গাছের নিচে পাউডার-পাফ কোমল সূর্য ঝুলতে থাকে। অনুর কি কোথায় সব মনে হয়; ওদের ঘরের মেঝে খুব ঠাণ্ডা, গাল পেতে শশায়া যায়, অগোচরে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়া যায়।
জানালার আকর্ষণ উত্তরোত্তর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়, প্রবল প্রলোভন এড়াতে না পেরে সেখানে দাঁড়ায় সে; রৌদ্র পরাক্রান্ত এক শত্রু, ঝনঝনে পিতলের থালা।
ছাদ আরো প্রসারিত।
অনেক বাড়ির অনেক খোলা জানালা—কোথাও নির্লজ্জ কোথাও গুমোট, বুড়ো বটগাছের ডালে লটকানো দুচারটে রঙ-বেরঙের লেজওলা ব্যাঙাচি ঘুড়ি, বরফকলের ঢেউটিনের ছাউনি, কৃষ্ণমূর্তি দানবের মতো পানির ট্যাঙ্ক, ছাদের ওপরে এইসব। ভাঙা মন্দিরের অনুজ্জ্বল চুড়া, মহল্লা সর্দার কাফুল মিয়ার চাঁদ-তারা-নিশান মার্কা বাড়ির ছাদের পেঁপেগাছ, চিলের চেরা চেরা দাগ-লাগা মালীবৌয়ের বুকের মতো নিস্তব্ধ গোল আকাশ, ছাদের উপরে এইসব।
ভালো লাগে ছাদে যেতে, কিন্তু গরমে এমন তেতে থাকে যে পা রাখতে ভয় হয়, পাছে ফোস্কা পড়ে; গালানো লোহা হড়হড় করে ঢেলে রাখে কেউ ছাদে।
সবচেয়ে বড় কথা ছাদে যাওয়া বারণ।
তার অনেক কিছুই ইচ্ছাধীন নয়, আমাদের বাগানে যেতে পারে না বারণ।
রঙ-বেরঙের বহু মার্বেল আছে বহুদিন আগেকার; কিন্তু সে ব্রিং খেলা জানে না। নিজের কাছেই সে বয়েস পার হয়ে গিয়েছে। বয়েমে সাজানো আছে মার্বেলগুলো। অদ্ভুতভাবে আলো ঠিকরে পড়ে কখনো কখনো। আর আছে এ্যাকোয়ারিয়ামে আমাজান সোর্ডের চারপাশে ছড়ানো, সিলভার ডলার এ্যানজেল আর লিওপার্ড কোরিডোরাসের খেলার সামগ্রী।
বারণ—যেন দশমাথাওলা এক রাবণ। লামাদের বাগান—যেখানে আম, গোলাপজাম, পেয়ারা, আমলকী, কাবাবচিনি, ফলসা বা ছোটো বড় হরেক জাতের গাছের সমারোহ, সে যেতে চায় পাখির সন্ধানে। এয়ারগান দিয়ে চড়ুই মেরেছে একসময়, চড়ুই এবং দোয়েল, তুলোর্টাপারি; এখন একটা এয়ারগান বগলদাবা করে ঘোরাঘুরি নেহাতই হাস্যকর। নিজে বুঝতে পারে, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে সে, বদলে যাচ্ছে সবকিছু।
পাখির শিস ভালো লাগে—নিস্তব্ধ দুপুরে।
রৌদ্রের ঝনঝনে থালা ছুঁড়ে ফেলে নির্মল ছায়া বিধৌত পাখির রাজ্যে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে, মড়ার মাথার মতো নিস্তব্ধ দুপুরে।
ঐসব হাঘরে ইতরদের সঙ্গে তোর অনেক তফাৎ,—একাধিকবার তার মা এইসব বলেছে, তোর সবকিছু সাজে না। ভালো না লাগলে রেকর্ড বাজিয়ে শুনবি। ছবি আঁকা আছে, গল্পের বই পড়া আছে, ঘরে বসে যা ইচ্ছে করতে পারিস, কেবল টো-টো করে ঘোরা চলবে না।
এক সময় সারাদিন মেকানো নিয়ে পড়ে থাকতো সে; মেকানোর পর ডাকটিকিটের অ্যালবাম। ডাকটিকিটের পর এলো বই পড়ার নেশা। তারপর ছবি আঁকা। আফ্রিকার জঙ্গলে, অভিশপ্ত মমি, মিশমীদের কবচ, ছিন্নমস্তার মন্দির খুবই প্রিয় বই ছিলো এই কিছুদিন আগেও। এখন ভালো লাগে আম আঁটির ভেঁপু। বালিশ ভিজে যায়।
বই আসা প্রায় বন্ধ; মধ্যে থেকে রাশি রাশি কমিকের বই জমে পাহাড় হয়েছে। এসব অনুর কাছে খয়েরি তেলাপোকার মতো চকলেট আর চটচটে চিউইংগামের মতোই বেজায় ফালতু মনে হয়। বরং রোডস্ দ্বীপের পিতলের মূর্তির কথা পড়তে ভালো লাগে, জানতে ইচ্ছে করে আলেকজান্দ্রিয়ার নিঃশব্দ আলোকস্তম্ভের কথা, কুফুর পিরামিড কিংবা স্ফিংস-এর বৃত্তান্ত।
ছবি কি সবসময় আঁকা যায়, না আঁকতে ইচ্ছে করে, না ভালো লাগে।
গান ভালো লাগে। বেশি ভালো লাগে বাজনা। বহুদিন থেকেই রেকর্ড কেনা বন্ধ। ছমাসের ভেতর নতুন কোনো রেকর্ড আসে নি বাড়িতে, না গানের না বাজনার। চাঁদের পাহাড় কিংবা আম আঁটির ভেঁপুর মতো কোনো বই তো দূরের কথা, কিছুই আসে নি।
কি যে করা যায়—কাতরতা অঙ্কুরিত হয়। দুপুর আর কাটতেই চায়। কি অবসাদ। কি অসহায়। ঘরের ভেতরে একা একা নিজেকে নিয়তই বন্দী মনে হয়।
ঘুমিয়ে দুপুরবেলা ওড়ানো সম্ভব হলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু ঐ সময় ঘুমোবার কথা ভাবতেও পারে না। খাটের পুরু তোশকে তুলোর গরমে ছাদের শিকারী রৌদ্র ঘাপটি মেরে থাকে। জলেশ্বর মালীর মতো, মালীবৌয়ের মতো খুব ঠাণ্ডা মেঝেয় হাত-পা ছড়িয়ে সটান পড়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ফরাশ পাতা মেঝের উপরেও শোবার উপায় নেই, মা ক্ষেপে উঠবে। অনেক কিছুই তার সহ্য হয় না, ধাতে পোষায় না। বইয়ের রঙিন মলাটে কালি পড়ে গেলে ক্ষেপে ওঠে, নাকে হাত চেপে না হাঁচিলে ক্ষেপে ওঠে, রঙের বাক্স কালি-কলম-দোয়াত এলোমেলো ছড়িয়ে রাখলে ক্ষেপে ওঠে, অনেক কিছুই মার কাছে অসহ্য। বাঞ্ছারামপুরে বেড়াতে গিয়ে গ্রামের ছেলেদের পাল্লায় পড়ে পুকুরে কলমিলতার ফুল তুলতে গিয়েছিলো সে, তাতেও চটে গিয়েছিলো মা; রাগের চোটে বেড়ানো বাতিল করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফিরে এসেছিলো ঢাকায়।
এইভাবে দীর্ঘ অসতর্ক মুহূর্তে নিজের অগোচরে তার ভেতরের যাবতীয় বোবা ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে ফ্রিজের ঠাণ্ডা বোতলের মতো যখন ঘেমে ওঠে, এবং খাঁখাঁ দুপুরের হাঘরে ছেলেদের মতো ধুলোবালি মাখা হাওয়ার গরগরে শরীর জানালা টপকে এইসব ভিজে ইচ্ছের ওপর নাক ঘষে পরক্ষণেই আবার উধাও হয়ে যায়, তখন অকারণেই সমস্ত আকুলতার ভেতরে মাকে পাবার অদম্য আগ্রহ চিলের আর্তনাদের থরে-বিথরে পালকের মতো ভেসে। বেড়ায়।
গুমরে উঠতে থাকে অনু,—মা কোনো এক মরা নদী। ইচ্ছেরা সব জলেশ্বর মালী। ইচ্ছেরা সব এক একটা চন্দনের পুরানো কৌটো।
এই ধরনের কৌটো মার ট্রাঙ্কে আছে। উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে মা। প্রপিতামহদের আমলে তাদের কেউ গোলকুণ্ডার হীরা রাখতো সেটায়। দাদু রাখতো তার অব্যবহৃত একটি পাথরের চোখ। মা রেখেছে বিষ; যতোদূর মনে পড়ে একদিন চুপি চুপি তাই-ই যেন বলেছিলো।
মস্ত এক বাড়ির খোলের ভেতর আমি,—অনুর এক একবার খুব আচ্ছন্নভাবে মনে হয়, বেদম জ্বরের ঘোরে গ্লাস উপুড় করে তৃষ্ণা মেটানোর পর যেমন ভেতরটা হাঁসফাঁস করে, এও তেমন। সব মিলিয়ে আঠারো কি উনিশটা ঘর, পুরোনো আমলের দোতলা, খড়খড়ির বড়। জানালা, মোটা মোটা কড়ি-বরগা, উঁচু ছাদ। এমন উঁচু ছাদ যে মনে হয়। ওর ওপর আর আকাশ নেই।
কোনো উদ্ৰবও নেই। অতিরিক্ত কোনো শব্দ নেই। নিজের পায়ের শব্দ নিজেকেই ভয় দেখায়; গলা দিয়ে বের হতে না পারা একটা বিশ্রী ঢেকুরের মতো এই মস্ত বাড়িটার বুকের কাছে সে আটকে গিয়েছে। কখনো দরবেশ আলি কিংবা অন্য কেউ হামানদিস্তায় কিছু কুটলে বাড়িটা খুশি হয়, দেয়ালের চেহারা থেকে খুশির এই মেজাজ সহজেই আবিষ্কার করতে পারে সে। এক সময় মা তার সব অভাবই পূর্ণ করতো, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই চিন্তাটাই ক্যাকটাসের কাটার মতো তাকে খুঁড়তে থাকে। সোডা ফাউন্টেন, কখনো বইয়ের দোকান, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কখননা, কখনো ডিজনির ছবি—এক সময় এইসব ছিলো। কখনো যাদুঘরে, কখনো কার্জন হলের বিচিত্রানুষ্ঠানে, মা এক সময় যথেষ্ট সঙ্গ দিয়েছে তাকে। কোথাও যাওয়া না হলে খুব মনোযোগ দিয়ে তার ছবি আঁকা দেখতো, উৎসাহ দিতো কিংবা আগডুম-বাগডুম সব গল্প শোনাতো পুরোনো আমলের; বুড়ো-হাবড়াদের মুখ থেকে শোনা সেসব। তা না হলে দুজনে মিলে এ্যাকোয়ারিয়ামের পানি বদল করা-ধরাবাঁধা এই কাজটা ছিলোই।
এখন ফিল্টার, এয়ার পাম্প, হিটার সবকিছু এসে সেসবের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। মা বলে-ঝক্কি মিটেছে, সাফ করাটা একটা বদখত ঝামেলা। যে-কোনো কাজ একনাগাড়ে করতে গেলেই পানসে হয়ে যায়। তার কোনো মজা থাকে না–
কথাটা মিথ্যে নয়। কিন্তু আগের মতো মেথিলিন ব্লুতে মাছগুলোকে নিয়মিত চোবানো হয় না, কি বিশ্রী ঘেয়ো চেহারা এখন মাছগুলোর, এ যেন মরে যাওয়া সব উৎসাহের এক মর্মান্তিক রূপ। সোর্ডটেল আর ব্ল্যাকলি বাচ্চা পাড়ছে আর গপাগপ গিলছে, এ্যাঞ্জেল ফিশ মরে যাচ্ছে একের পর
এক। সবকিছু ফেলে মা-ই একসময় ফাইটারের ডিম দেওয়া দেখতে ভালোবাসতো একনাগাড়ে সারাদিন ঠায় বসে। ঝক্কি চুকেছে, এখন সেসবের কোনো বালাই নেই।
সবচেয়ে আগ্রহী ছিলো মার মুখ থেকে গল্প শুনতে। শৈশবে কোনো এক সময় দার্জিলিং-এ ছিলো, সেইসব ইতিবৃত্ত এবং আব্বার প্রসঙ্গ।
আব্বার প্রসঙ্গই সাধারণত বেশি থাকতো।
অনু আব্বাকে সহ্য করতে পারে না। শয়তান মনে করে। ঘৃণা করে। যে সময় তিনি ঘরে থাকেন সে ইচ্ছে করে গা বাঁচিয়ে সন্তর্পণে বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে নিজেকে আড়াল করে রাখে। প্রথমে ছিলো ভয়। এখন ভয় থেকে ঘৃণা। ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যরশ্মি, কমলালেবু আলুবোখারা আর স্কোয়শ ফলের গল্প তার মনে যে আনন্দলোক নির্মাণ করতো তা আবার হারিয়ে যেতো আব্বার প্রসঙ্গ উঠলে। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে মায়ের গলায় কানে দার্জিলিং-এর গোল্ডস্টোনের যে দুল আর পেনডেন্ট দিনরাত ঝকমক ঝকমক জ্বলে তার অন্তরালে আত্মগোপন করে আছে বিধাতার মতো গম্ভীর নিষ্ঠুর হিংসাপরায়ণ কোনো আব্বার রাক্ষুসে অন্ধকার, যার কোনো প্রকাশ নেই, চাকচিক্য নেই, ভয়ঙ্কর গোপন জঘন্য কোপন তার স্বভাব। আর কোনো ভুবন নেই মা ছাড়া। আব্বাকে এড়িয়ে, পাতার আড়ালে পাখির মতো নিজেকে ঢেকে রেখে সে তার আলোর ভুবনে এইভাবে পরিত্রাণ পেতে চায়।
সমবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে তার অনেক তফাৎ—অনুর নিজেরই এই রকম ধারণা। নিজের ভেতরে পাথর কেটে কেটে সে নির্জন রাস্তা করে নিয়েছে, ধুলোয় মোড়া সে রাস্তা, ধূম্রজালে ঘেরা, ঘোড়ার পায়ের শব্দ সেখানে বিভীষিকা, এই রাস্তা ধরে নিরাময়ের কল্পলোকে পৌঁছুতে চায়।
মা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ভাবতে শিখিয়েছে। এখন জানা হয়ে গিয়েছে—ভাবনার ভেতরে কতো রকমেই না মানুষ নিজেকে পায়। ভাবনার ভেতরে নিজেকে সব রকমে যথেচ্ছ পাওয়া যায়। ভয়ঙ্কর যে শত্রু, টলানো যায় তাকেও এবং অতি সহজে। মাকে সবচেয়ে বড় বন্ধু ভেবে তার আনন্দ।
আব্বা অনেক দূরের মানুষ, সুদূর হিমালয়ের ওপার থেকে উড়ে এসে বাড়ির প্রাঙ্গণের ঘোড়ানিম গাছে ভয়ঙ্কর ইচ্ছে নিয়ে জ্বলন্ত বাদুড় ঝুলে থাকলে যেমন মনে হবে। কালো সুটে মোড়া আব্বাকে তার অতিকায় বাদুড় মনে হয়। রাত্রিবেলায় ঘরে ফিরে যখন আলোর তলায় দাঁড়িয়ে চামড়ায় বাঁধানো আইনের বইগুলো টেবিলের ওপর রাখতে থাকেন, যখন জ্বলতে থাকে চশমার পুরু কাচ, তখন দূর থেকে তা দেখে রীতিমতো সে শিউরে ওঠে। তার মনে হয় এই সময় সামনে পড়লে বিদঘুটে অতিকায় বাদুড়টি জ্বলন্ত চোখ আর কালো ডানা নিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে মার ওপর নিষ্ঠুর উল্লাসে।
হয়তো খুশির ভান করে—অনুর এই রকমই মনে হয় সাধারণত টাইয়ের ফাঁস আলগা করতে করতে মাকে ডেকে বললেন, একটা শক্ত খুনের আসামীকে বেকসুর খালাস করিয়ে এলুম!
ভালো–
এইটুকু বলে চলে এসেছে মা। মা কতো বীতশ্রদ্ধ ওই ছোট্ট একটুখানি ভালো ছুঁড়ে দিয়ে চলে আসা থেকে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে। পরদিন দুপুরে—যখন কেউ কোথাও নেই, কার্নিশে শুধু একটা কাক, কালো পাথরের ভাঙা যিশুখৃস্টের মূর্তির গায়ে ফর্শা টিকটিকি, তখন মা ফিশফিশ করে বলেছে খুনিদের সর্দার। চোর ডাকাত ঠ্যাঙাড়ে গুণ্ডারা তোর আব্বার জোরেই টিকে আছে, কতো টাকা নিয়ে আসে তুই তো আর তা জানিস না। সব লুটতরাজ করা টাকা, মানুষ খুন করা টাকা–
পুলিশে ধরে না কেন?
চুপ, তুলবি না ওকথা। আমরা কেউই রেহাই পাবো না, না আমি, না তুই। জেলে পুরবে সবাইকে যদি জানাজানি হয়। ঘানি টানাবে, আঁতা ঘুরিয়ে পাথর ভাঙাবে। এই নোংরা ডাস্টবিন থেকে পালিয়ে যেতে হবে আমাদের। একদিন না একদিন পুলিশে ধরবেই!
বাড়ি থেকে পালানো কতো আনন্দের, অনু বারবার রোমাঞ্চিত হয়েছে। বনে-পাহাড়ে, পদ্মার নির্জন কোনো কলাগাছ ঘেরা চরে, জেলেদের ছোট্টো কোনো গ্রামে—যার চারপাশে কেবল থৈথৈ পানি—পালালে এইসব জায়গাতেই যাবে। তা না হলে এমন কোথাও যেখানে সকলে চিৎকার করে কথা বলে, ঘাসের বিছানায় ঘুমায়, যেখানে আঠারো কিংবা উনিশটা রাক্ষুসে হাঁ-র মতো ঘর নেই, বিশাল উঁচু ছাদ নেই, যেখানে বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম, হু হু হু হু বাতাস বয়ে যায়। মা যদি চিৎকার করে বলে অ-নু-বে-শি-দূ-র-যে ও-না-আ-আ-আ তাহলে সে চিৎকার শাঁ-শাঁ আকাশের দিকে ছুটে যাবে, ধরবে বিদ্যুৎ, তারপর সেই বিদ্যুৎকে চাবুকের মতো হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারবে আর পোষ-মানা লোমশ সিংহের মতো বনরাজিঘেরা গ্রাম কেশর নেড়ে নেড়ে খেলা দেখাবে, থেকে থেকে উঠবে গর্জন–
এমনও হয়েছে, সন্দেহ-সঙ্কুল কণ্ঠে মাকে বলেছে,—সে রকম আব্বাকে তো মনে হয় না, মনে হয় কতো ভালো, কি ঠাণ্ডা! লামার আব্বার মতো হাম্বিতম্বি করে ধুম-ধাড়াক্কা মার লাগান না। তোমার সঙ্গে যে ঝগড়া করে তা-ও না!
মা উত্তর দিয়েছে-ঐখানেই তো যতো গণ্ডগোল! কেন ডিটেকটিভ বইগুলোয় পড়িস নি, খুনি-ডাকাত ফন্দিবাজ লম্পটগুলো কি চমৎকার ছদ্মবেশ ধরে সাধারণ মানুষের চোখে বেমালুম ধুলো দিয়ে বেড়ায়, ও হচ্ছে সেই জাতের মানুষ। ভালোমানুষিটা হচ্ছে খোলস, ওটা ওপর ওপর। যে কোনো সময় গলা টিপে মারতে পারে, যে-কোনো সময় বিষ দিতে পারে, সবকিছুই ওর পক্ষে সম্ভব। এখানে থাকলে এমনি করে মরে যাবো, কাকপক্ষীও জানবে না, কেউ কাঁদবে না
নতুন করে আবার সবকিছু ভাবতে হয়।
তোকে আমি কিছুতেই মরতে দেবো না বলতে থাকে মা, অনু চুপচাপ শুনে যায়—তুই জানিস না কি সাঘাতিক তোদের বংশের মানুষরা। তোর দাদা ছিলো ঠ্যাঙাড়েদের সর্দার। চরের মানুষ। কথায় কথায় মানুষ খুন। নিত্য-রোজ গায়ে রক্ত মেখে ঘরে ফিরতো, আর সারা। গায়ে সেই রক্ত নিয়ে মাটির সানকিতে ভাত খেতো। এক চাচাকে তোর সেই দাদী বুকের ওপর চেপে বসে ভোতা কাস্তে দিয়ে পুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জবাই করেছিলো, সে কী চিকার! ঘড়ঘড় করে রক্ত তুলতে তুলতে সকলের চোখের সামনে মরে পড়ে রইলো, ভয়ে কেউ ছুঁলো না পর্যন্ত, গোর দেওয়া তো দূরের কথা। শেষে, দুদিন পর যখন পচে দুর্গন্ধ হয়ে গিয়েছে লাশ তখন শেয়ালে টেনে নিয়ে গিয়েছে একদিকে। পরদিন টেনেহিঁচড়ে খেয়েছে শকুনেও।
আতঙ্কিত অনু আরো ঘনিষ্ঠ হয়েছে। মা অভয় দিয়ে বলেছে, সেই জন্যেই তো ইংরেজি শিখছি, তোকে নিয়ে আমি কোথাও চলে যাবো, চাকরি করবো। তোর ধুরন্ধর আব্বা টের পাবে না।
স্বস্তি পেয়েছে শুনে। একথায় ভয় কেটে গিয়েছে।
মার মুখে সে একথাও শুনেছে—ঐ যে স্যার যিনি আমাকে রোজ পড়াতে আসেন, উনি কিন্তু আমাদের খুব বিশ্বস্ত বন্ধু। সব জানেন উনি। আমি সব বলেছি ওঁকে। খুব ভালো লোক, উনি সাধ্যমতো আমাদের সাহায্য করবেন। তোকেও খুব ভালোবাসেন।
অনু ভয়ে ভয়ে বলেছে, আর যদি সব ফাঁস করে দেন?
দূর পাগল–মার মুখে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখতে পেয়েছে সে উনিই তো আমাদের ভরসারে বোকা ছেলে। ইশ, উনি না হলে যে কি হতো অনু, ভাগ্যিস পরিচয় হয়েছিলো! চিন্তায় চিন্তায় বোধ হয় পাগলই হয়ে যেতাম।
মায়ের স্যারকে খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর মানুষটি, অনু চমকৃত হয়েছে। তার স্কুলের গিলবার্ট প্রামাণিকের (ক্যাচূচিরিয়াস্স্যার) মতো মাথায় একরাশ অবাধ্য ঝাঁকড়া চুল, হাসি হাসি মুখ, চশমা পরেন না। উনি থাকতে অকারণে ও ঘরে যেতে বারণ আছে, যথেষ্ট ব্যাঘাত ঘটে লেখাপড়ার। ভালোমতো ইংরেজি রপ্ত করতে চায় মা। ইংরেজি না জানলে চাকরি জোটানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। চাকরির চিন্তা দারুণ নেশার মতো পেয়ে বসেছে মাকে—অনু জানে। বাঁচতে হবে তাদের। পালাতে হবে। মাত্র একদিনই দেখতে পেয়ে হাতের ইশারায় কাছে ডেকেছিলেন, সেই প্রথমদিকে, প্রায় বছরখানেক আগে।
খুব ভালোভাবে আপাদমস্তক খুঁটি জহুরির মতো নিরিখ করে আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, স্ট্রেঞ্জ! এ যে একেবারে বালক হেরম্ব, আই মিন র্যাব। ঠিক তেমনি খাড়া খাড়া ঠাসা চুল, গভীর চোখ, শাণিত দৃষ্টি, যেন জ্যোতি ঠিকরে বেরুচ্ছে, আই ওয়ান্ডার! চুলে বিদ্রোহ, চোখে বিদ্রোহ, চিবুকে বিদ্রোহ, ঠোঁটে বিদ্রোহ
তাকে একপাশে টেনে নিয়ে মা সগর্বে বলেছিলে, ছেলেটি কার দেখতে হবে তো।
পরে আবার জানতে চাইলো হেরম্ব না র্যাবর পরিচয়। স্যার উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন, র্যাশ্যার একজন রিনাউন্ড পোয়েট, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির স্টাইলের প্রবর্তকও বটে। স্তালিনের আমলে ফিল্মের নোংরা গান লেখার অপরাধে খামোকা গুম করে দেওয়া হয় বেচারাকে!
খুবই প্রানোচ্ছল মায়ের স্যার। ভালো লেগেছিলো। প্রাণের ভেতর থেকে কথা বলেন ভদ্রলোক। যেমন উজ্জ্বল তেমনি চঞ্চল, অসম্ভব হাসতে পারেন।
কিন্তু এই ভয়ঙ্কর দুপুরে কি করবে। তার ইস্কুল সেই সকালে। তারপর বারোটার মধ্যে ছুটি। মা স্যারের কাছে ইংরেজি শিখছে একতলার কোণের ঘরে, কাজ শেষ করে ঘাড়ের নিচে লাল গামছা রেখে দরবেশ আলি অকাতরে ঘুমিয়ে, পচার মা গেঁটে বাতলা পা জোড়া রৌদ্রে ছড়িয়ে গালে পান ভরে বারকোশে জলপাই আর আমের আচারের বয়েম সাজিয়ে হুস হুস শব্দে কাক তাড়াচ্ছে, এই দুপুরে কি এমন করার আছে! টুকরো টুকরো দুর্বল ইচ্ছেগুলোকে মাছির মতো তাড়ানো ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই, মনে হয় অনুর।
মা যেন কী—
ভাবতে গিয়ে কালো অস্থিরতা তোলপাড় করে। আজকাল খোঁজ নিতে একবারও ওপরে আসে না, দুপুর হলেই তার সঙ্গে যেন নিদারুণ শত্রুতার এক সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়।
শিখছে তো শিখছেই। মার কোনো ক্লান্তি নেই। কতো দূরে সরে গিয়েছে মা। আজকাল প্রয়োজনের বেশি প্রায় কথাই বলে না, দিনের পর দিন অসম্ভব গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত বদলে যাচ্ছে, অনু শঙ্কিত।
আগে তুচ্ছ ভুল-ত্রুটি নিয়ে পচার মাকে নিছক কম গালমন্দ করে নি, দরবেশ আলিও তো বটেই, আজকাল ওদের দিকে ফিরেই তাকায় না, তুলকালাম তো দূরের কথা; দিনের পর দিন সব অভিযোগ ফুরিয়ে যাচ্ছে।
অনু শিউরে ওঠে। বুকের মাঝখানে কাচের নীল পিরিচ ভেঙে খান-খান হয়ে যায়। মার যাবতীয় সুন্দর অভিলাষগুলো নির্দয় পাথরে পরিণত; এই বাড়ি ছেড়ে, শয়তানের এই থাবা থেকে আর কোনোদিন নিরাপদে পালানো যাবে না। ভয় হয়। তবু এতো ভালোবাসে সে মাকে যে প্রতি মুহূর্তেই উৎকর্ণ হয়ে প্রতীক্ষা করে, রাত্রিবেলা মাঝে মাঝে নির্বোধ শিশুর মতো বিছানা হাতড়ে কি যেন খোজে। তার কেবল ভয়, চিরকালের মতো এক দুয়ে অন্ধকারে একে একে সব মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সব ইচ্ছেগুলো যদি নির্দয় পাথর হয়ে গিয়েও থাকে তবু মনে মনে অনু সেই পাথরটা কেটে টেবিলের ওপরে সাজানো ভাঙা যিশুখৃস্টের মূর্তির চেয়ে অনেক সুন্দর তার রূপ দিতে চেষ্টা করে।
লামাদের বাগানে অনেকক্ষণ ধরে হরিয়াল ডাকছিলো। দুম করে বন্দুকের আওয়াজ ফাটলো এক সময়। ঘেউ ঘেউ করে হুঙ্কার ছাড়লো গরগরে গেস্টাপো। অনু এসে দাঁড়ালো জানালায়, বাগানের ঘাসের পাটিতে তার ছোট্ট একটুখানি শরীর নিয়ে পড়ে আছে প্রাণহীন হরিয়ালটি। ক্যাঙ্গারুর মতো জোড়া পায়ে লাফিয়ে লামার মামা সেটা তুলে নিয়ে শূন্যে ছুঁড়ে দিলো, তারপর ক্রিকেটের বলের মতো দুহাতে লুফে নিয়ে চিৎকার করে উঠলো, হাউজদ্যাট!
লাইটপোস্টের মাথায় কাকের বাসায় আগুন ধরেছে। ওপর থেকে আগুনের ফুলকি ঝরছে ফুলঝুরির মতো।
ময়লা ছেলেরা হৈহৈ করছে।
বাইরে গগনে এক মস্ত আকাশ।
বাইরে ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে গোল গোল চারকোণা নরম বাগান।
সেইসব গোল চারকোণা নরম বাগানে ছোটবড় অনেক গাছ। ফিকে সবুজ, ঘন সবুজ, নীলচে সবুজ, ধূসর সবুজ সেইসব গাছ অসংখ্য হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেছে আকাশ সমুদ্র আর সুবিস্তীর্ণ স্তেপস কিংবা কিরঘিজ প্রান্তরের ছবি, সে রোমাঞ্চিত হয়। সেইসব গাছের পায়ের কাছে পোষ-মানা আদুরে হাতির মতো কান নাড়ছে অঢেল ছায়া। সবুজ উষ্ণীষ জড়ানো সেইসব সাঙ্কেতিক গাছের অসংখ্য বাহুতে বসে নাম-না-জানা সুনীল পাখিরা দিনরাত আকুল সুরে গেয়ে চলেছে।
এইসব বিদীর্ণ দুপুরের মাঝখানে, ধু-ধু রৌদ্রের মাঝখানে, গোল চারকোণা বাগানের চেয়ে, গাছের পাতার চেয়ে, সমুদ্রের চেয়ে, পাখির
গানের চেয়ে, সুন্দর আর ঠাণ্ডা একটি মেঝে পরম নিভৃতে কোথাও আরামে চোখ বুজে অচৈতন্যপ্ৰায় পড়ে আছে জলেশ্বর মালীর মতো। অনুর মনে হলো, জলেশ্বর মালী কতো সুখী!
০২-০৭. পরদিন দুপুরে ঠিক আগের মতোই
০২.
পরদিন দুপুরে ঠিক আগের মতোই কি করবে ভেবে পেলো না অনু। গনগনে রৌদ্রে খড়খড়ির রঙ জানালার শার্সি সব চড়চড় করে পুড়ছে। নিষিদ্ধ ছাদ রৌদ্রের তাপে লোহার মতো লাল হয়ে আছে।
নতুন করে আবার ছিন্নমস্তার মন্দির বইটা নিয়ে বসলো। ভালো লাগলো না। বাসি। খুব আশ্চর্য হয়ে গেল, কিভাবে যে বইটা এতো ভালো। লেগেছিলো আগে?
বই বন্ধ রেখে মেঝের ফরাশে শুয়ে পড়লো। ভাবলো কী-ইবা এমন হবে, মা তো আর ইংরেজিচর্চা ছেড়ে দেখতে আসছে না।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলো।
স্বপ্ন দেখলো মাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
তাকে নিয়ে স্যার সন্ধানে বেরুলেন।
এক সময় বাড়ির পেছনে সাগদায় মার মৃতদেহ দেখা গেল; এয়ারগান দিয়ে বহুদিন আগে সে যেসব চড়ুই পাখি মেরেছিলো তার পাশে মৃতদেহটা মুখ থুবড়ে পড়ে, নিসাড়।
মানুষ মরে যায়, কিন্তু মা কি মরে, সে ভাবতে চেষ্টা করে। সম্পূর্ণ লোপ পায় তার বোধশক্তি; ভেতরের যাবতীয় কষ্ট ছুঁই ছুঁই করেও পরক্ষণেই আবার পালিয়ে যায়, কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে।
হঠাৎ ছাদের ওপর থেকে তাতানো লোহার মতো লাল পা নিয়ে নীলচক্ষু আব্বা ত্রুর উল্লাসে লাফিয়ে পড়লেন, হারেরেরেরেরেরেরে—তাঁর হাতে ইয়া এক শাবল!
প্রচণ্ড জোরে অমানুষিক হুঙ্কার ছেড়ে তিনি অনুর মাথায় শাবল বসিয়ে দিলেন। সে চিৎকার করে উঠলো–
যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলো রক্তাক্ত ফরাশে তার মৃতদেহ পড়ে আছে। সেখানে অন্য কেউ নেই।
০৩.
পরদিন দুপুরেও অনু অনেকক্ষণ ছটফট করতে করতে এক সময় আগের দিনের মতোই আবার ফরাশে ঘুমিয়ে পড়লো। স্বপ্ন দেখলো লামাদের বাগানে আমগাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসে লালপেড়ে শাড়ি পরা মা। গলার ওপর থেকে কেটে বাদ দেওয়া, সেখানে একটা কাস্তে।
সে দাঁড়িয়েছিলো গাছের ঠিক নিচে। ওপর থেকে মা তার গায়ে থুথু করে থুতু দিলো। দাউদাউ করে শরীরে আগুন ধরে গেল। আমগাছের ডালে কাকের ছানাগুলো পিউ পিউ করছে।
দমকা হাওয়া। হৈহল্লা হৈহল্লা হৈহল্লা।–
০৪.
অনু আর ঘুমোবে না সাব্যস্ত করেছে। জানালায় এসে দাঁড়ালো আজ। জানালার মতো পুড়তে চায়।
লামাদের বাগানে দস্যু ছেলেরা বেদম হল্লা জুড়েছে, হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট! লামার মামা দোনলা বন্দুকের গুলিতে আত্মহত্যা করেছেন, তাঁর লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কবরস্থানে। ছোট্ট একটা শোক মিছিল। এখনো এক মাসও হয় নি পুকুরে ডুবে মরেছে লামা।
অনুর কানে বাজতে থাকে হাউজদ্যাট হাউজদ্যাট।
০৫.
আজ দুপুরে ঠিক একই সময়ে অনু আবার সেই জানালায়। দস্যু ছেলেরা ব্রিং খেলছে। লামাদের বাগানে প্রজাপতির ঝাঁক নেমেছে, প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি—পাখিদের সে কি উল্লাস!
০৬.
কোনো একদিন ঝনঝনে থালার মতো দুপুরে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে গলা বাড়িয়ে একটা পাখি দারুণ চিৎকার করে উঠলো; কানে বাজলো, এসো অনু–-এসো!
০৭.
পরদিন অনু দুপুরের উদ্দেশে নিজেকে অবাক করে নিরুদ্দেশ হলো।
০৮. দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে
দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে প্রায়ই যাদের ব্রিং খেলতে দেখা যেত সেইসব ধূসর আবছা ছেলেদের সকলের নামই এখন জানা হয়ে গিয়েছে। কারো নাম ফকিরা কারো নাম টোকানি,—গেনদু লাটু ফালানি, মিয়াচাঁন আরো অনেকে।
অনুকেও তারা চিনেছে।
একদিন পকেট বোঝাই করে মার্বেল নিয়ে এলো, খেলা শিখলো। কিন্তু ফকিরা বা ফালানিদের মতো তুখোড় ওস্তাদ খেলুড়ে সে নয়, আগলিতে মারতে গিয়ে পিরিতে লাগিয়ে কিংবা পিছলির বদলে আগলিতে লাগিয়ে তার সব ব্রিং অতি অল্পক্ষণের মধ্যে সহজেই নিঃশেষিত হয়ে গেল। বেশকিছু পয়সাও গেল তার। জিত্তির মার্বেলগুলো প্রতিটি তিন পয়সা দরে তার কাছে বেচলো টোকানি, আবার খেললো এবং যথারীতি খোয়া গেল পরক্ষণেই।
কোনো আক্ষেপ নেই। মার্বেলগুলোর বিনিময়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দলের কাছে খুব সহজ হতে পেরেছে, এতেই আনন্দ। সে খুশি। যারা হেরে গিয়ে নিঃসঙ্কোচে ফতুর হতে পারে সব বাহবা তো তাদেরই–এই রকমই একটা উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য করেছিলো ফকিরা।
ফকিরা আর টোকানি বয়েসে কিছুটা বড় দলের মধ্যে। ওরা দুজন তাই সময়-অসময়ে খিস্তি আর গায়ের জোরে আপন-আপন মর্জিমাফিক নিছক স্বেচ্ছাচার চালিয়ে যায়, ছিনিয়ে নেয় অনেক কিছু এবং অনুর চেয়েও ছোটো লাটু গেনদুর মতো অসহায় ছেলেরা সে হামলা প্রতিরোধ করতে না পেরে ব্যর্থ আক্রোশে ফুলতে থাকে। বরং তুলকালাম শুরু হলে অনু মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, চেষ্টা করে কোনো একটা সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌঁছে দিতে; এখানে আর কিছুই করার নেই তার, যা সে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছের জোরে অনায়াসে চালাতে পারে।
ফকিরারা এখন লামাদের বাগানে ব্রিং-এর পাট উঠিয়ে দিয়েছে। লামার মামা–যিনি রেডিওতে খাম্বাজ হাম্বীর মালহার ইত্যাদি গেয়ে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিলেন এখন আর তিনি জীবিত নন। তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন বলেই লামাদের ছায়াঢাকা বাগানের আনন্দ বাজেয়াপ্ত হয়ে গিয়েছে।
বৃত্তান্তটা ফকিরার মুখ থেকে শোনা।
মরাকাডের কসম কর্যা কতাছি হালার পো হালা পাগলাডা হেইদিনকা আমারে একলাটি পায়া যা তারাডি করছিলো।
ফালানি প্রথমে বিশ্বাস করে নি।
সে বলেছে, গানজা মারোনের আর জাগা পাইতাছস না বুঝি?
ফকিরা নাছোড়বান্দার মতো বলেছে, যা না বে, ঘুইরা আয়না দেহি, হিম্মত আছে নি? পেরথম দেহিকি ভূত হয়া বয়া বয়া চক্ষুবন করা হালার পো হালায় গামা-উমা কয়া কাওয়ালি গাইবার লাগছে। আমার আতে আছিলো এউগা আস্তা মালপো। চক্ষু খুইলা আমারে দেইখাই অক্করে ভান কর্যা আয়া মালপোয়াডা লয়া গেলগা–
সত্য-মিথ্যা জানে না, মোটকথা এইসব সূত্রেই লামাদের বাগানের বদলে তাদের সকলকে অন্যত্র স্থান বেছে নিতে হয়েছে।
বেশকিছুটা দূর হয়ে যায়। তবু সে খুশি। সবসময় নিজেদের বাড়িটা চোখের সম্মুখে পাহারাদারের মতো খাড়া দাঁড়িয়ে থাকলে অনায়াস হওয়া যায় না, অহেতুক ভয় ভেতরে ভেতরে কেবলই দুরু দুরু করতে থাকে।
হাম্মাদের নড়বড়ে দোকানের পেছনে খুব নিরাপদ স্থান বেছে নিয়েছে ফকিরারা। ছিপ হুইল বড়শি পিঁপড়ের ডিম আর রকমারি মাছের চার এইসব সাজিয়ে বুড়ো হাম্মাদ হাতের তালুর ওপর কাত হয়ে শুয়ে থাকে, মেথির গন্ধে বুদ হয়ে সারাদিন অকাতরে ঘুমায়।
অনুর মনে হয় পিঁপড়ে কিংবা তাদের বিভিন্ন গোত্র জীবনযাপন সবকিছু একেবারে শেষ পর্যন্ত হাম্মাদের (আহম্মদ?) জানা হয়ে গিয়েছে, আর সেই জন্যই তার আর কিছু করণীয় নেই, ভাবনার নেই, শুধু এই একটা কারণেই সে নির্বিবাদে ঘুমায়।
হাম্মাদের দোকান থেকে খানিকটা দূরে একটা নুয়ে পড় আখড়া আছে। দোকানের পেছনে দাঁড়ালে আখড়ার মটকার ত্রিশূল দেখা যায়। কয়েকদিন থেকেই জয়ঢাকের গায়ে চ্যাটাং চ্যাটাং শব্দে কাঠির ঘা পড়ছে। চড়কপুজোর প্রস্তুতি। শিবের গাজনের সময় এসে গিয়েছে, দুএকদিনের মধ্যেই গাজনের সং বের হবে, পুরোদমে তারই মহড়া চলছে আখড়ায়।
গেনদু অনুকে সাধলো, চলনাবে, গিয়া একনজর দেইখা আহি! মিয়াচাঁন গেনদু আর সে, তিনজনে মিলে গাজনের সং দেখতে চললো আখড়ায়। চলতে চলতে মিয়াচাঁন হু হু করে গান জুড়লো। গেনদু ভেংচি কেটে বললো, চিল্লায়া গানাবে চান-কপাইলা, সবতে মিলা হুনুম। বিয়া হয়া গেলে সোয়ামীর লগে তো চইলাই যাবি!
অনু অবাক হয়ে গেনদুর মুখের দিকে তাকাতেই গেনদু বললে, বুঝচি, বুঝবার পারচ নাই। মিয়াচানের চারা তো সোন্দর আর হেয় গায়ও মিড়া, ঘাটুদলের মাইনসে বিয়া কর্যা লয়া যাইবার চায়। বুঝচস কিছু? অর বাপে রাজি অইতাছে না। এতোড়ি মাল ছারবার পারলেই অরে দিয়া দিবো হাত দিয়ে পরিমাণটা দেখালো সে, যাইকগা! গানা বে!
মিয়াচাঁন চিকন গলায় গান জুড়লো;
নাহে নোলক কানে ঝুমকা
মাইয়া একখান বডে
নদর গদর চলে মাইয়া
ফুশুর-ফাশুর রডে
গেনদু বাধা দিয়ে বললে, আব্বাসউদ্দিনের গীত গা না বে, রেকটের গীত ছাড়া অনু হালায় বুঝবার পারবো না। এই হালারে লয়া মুসিবত বাইধাই রইছে।
একটু ভেবে নিয়ে মিয়াচাঁন গাইতে শুরু করলো :
সগাঁর বেড়ায় টাডি টাডি
লালশাড়ি পিনদিয়া
তোলা আছে ঢাকাই শাড়ি
কাঁয় যাইবেক পিনদিয়া
ওকি খশস্যোর কি মশস্যোর করিয়া–
এইভাবে গানে সুর তুলে চালালাৎ-কি-চালালাৎ আর ক্যাররোৎ-কি ক্যাররোৎ করতে করতে মিয়াচাঁন গেনদুর হাত ধরে আখড়ার চৌহদ্দিতে পৌঁছুলো।
ঘেসোভঁড়ি জটাধারী শিব ঘেমে চাবচুব হয়ে চৌকিতে বসে বসে হাতপাখার বাতাস খাচ্ছিলো। আর একটা নড়বড়ে টেবিলের ওপর পা ঝুলিয়ে কাত হয়ে ফুক ফুক করে সিগারেটে ঘনঘন টান মারছিলো দশমহাবিদ্যার এক অর্থাৎ কালী, হাতে টিনের লাল জিভ।
কিছু একটা বলতে হয় কতকটা সেই জন্যই সম্ভবত অনু বললে, এখন আর নাচবে না মনে হচ্ছে।
কতো আর নাচবো, হালারা অহনে রেস্ট লইতাছে।
টেবিলের ওপর বসা কালী পা দোলানি বন্ধ করে হাতের পোড়া সিগারেটের টুকরো গেনদুর গায়ের দিকে ছুঁড়ে বেঁকিয়ে উঠলো, বেজাইতা পোলাপান আয়া জুটচে সব, আব্বে নাটকির জানারা ভাগলি?
গেনদু অনুর হাত ধরে বললে, চলবে! হলািগো ডট অইচে। এলায় ফয়-ফকিরনী ভারাইটা কালীর খেতায় আগুন!
হাম্মাদের দোকানের পেছনে টোকানি আর ফকিররা যথারীতি ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে আছে। গেনদু সেদিকে না গিয়ে অন্য পথে পা বাড়ালো।
অনু বললে, ওদিকে যাবে না?
গেনদু মুখ কালো করে বললে, টোকানি আমার গনজি ফাইরা ফালাইচে, জোর কইরা তিনগা পাই কাইরা লইচে, ও হালার লগে আর দোস্তি না, হালায় চোর-চোট্টা। আমাগ পোলাপান পায়া বহুৎ বাহাদুরি দেহায়। কাউলকাই তো অর বাপে কল্লায় মাটামের বারি দিয়া অক্করে খুন
বাইর কর্যা দিছিলো!
বটোকানির বাবা ছুতোরের কাজ করে। খুবই গরিব ওরা, কিন্তু টোকা নিকে দেখলে কখনোই তা মনে হয় না, মনে হয় কতো সুখী, দুনিয়ায় ওর কোনো সমস্যাই নেই, কোনো কাজ নেই, কোনো দুর্ভাবনা নেই, এপাড়া ওপাড়ায় বিভোর হয়ে ব্রিং খেলছে তো খেলছেই।
সুখী মনে হয় গেনদুকেও। তার বাবা গাড়োয়ান। ওরা প্রায়ই দুবেলা পেটপুরে খেতে পায় না। পিটুনি খেতে খেতে গেনদু শুকনো উঁটার মতো। হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার শরীরের পাচনবাড়ির অসংখ্য গভীর কালো বিষণ্ণ দাগের মতো দুঃখের অন্য কোনো করুণ চিহ্ন গেনদুর চেহারায় ছিটেফোঁটাও নেই। সেও সময় অসময়ে ব্রিং খেলায় মশগুল হয়ে থাকে। কাচের মার্বেল ফুরিয়ে গেলে কাইবিচি দিয়ে খেলে। কাইবিচি না থাকলে মাটির বাটুল।
চারপেয়ে ফ্রেমে আটকানো লোহার দাঁতাল চাকায় অসময়ের শীর্ণ আখ মাড়াই হচ্ছিলো মসজিদের মুখে, গেনদু অনুর হাত চেপে ধরে অনুনয় করে বললে, খিলাইবা নিহি বন্দু?
সে সহজেই রাজি হয়।
তিনজনে তিন গ্লাস সবুজ রস পান করলো বারো আনায়। মনে হলো তার পেট কেমন যেন ঢকঢক করছে, জিভে জড়িয়ে আছে লোহার গন্ধ।
অনু মুখ সিটকে বললে, ইশ! কী কসটে গন্ধ!
গেনদু ক্ষেপে গিয়ে বললে, তরা এসবতের কি জানস? লর গন্দে শরীল মোডা অইবো, কেঁচকি মাইরা টোকানিরে কাইত কইরা ফ্যালান যাইবো, বুঝচস? তুই হালায় অক্করে বোদাই।
সত্যিই সে অনেক কিছুই জানে না। অনেক জানে এরা। গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করতে পারে গেনদু। গাছের ছায়া নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে জানে মিয়াচাঁন। টোকানি ফালানি গেনদু লাটু মিয়াচাঁন নাড়িনক্ষত্র জানে পথঘাটের। ছাগলের গলায় নুনুড়ি দেখলে কি হয়, জোড়া শালিখ দেখলে কি হয়, লাউ কিংবা পুঁইশাকের মাচায় আনজিরা দেখলে কিভাবে হ্যাক থু করে বুকে থুতু দিতে হয়, এক চোখ দেখলে কি কি অঘটন ঘটতে পারে কিংবা অসতী মেয়েমানুষের লক্ষণ কি কি—সবকিছুই ওদের নখদর্পণে। কথায় কথায় হয়তো ফালানি বললে, কি নিয়া চাটগাঁ? পট করে অন্য কেউ জবাব দিলো তখনকার তখনই, সারেঙ শুটকি দরগা! তারপর হয়তো ফালানির পালা। মিয়াচাঁন পালটা জিগ্যেস করলে, কি নিয়া ঢাকা? ফালানি বললে, মশা মোল্লা শাখা।
কখনো তর্ক হয়। গেনদু হয়তো বললো, কিন্তু যে হালায় বানাইছে কডি হেই হালায় মুতবারও আহে নাই ঢাহায়, আইলে বাখরখানির কডি ঢুকাইয়া ছারতো, তরা কি কচ?
হাঁটতে হাঁটতে গেনদু সাপের গল্প জুড়লো।
অনেকদিন আগে গেনদুদের ঘরে একটা সাপ পুরোনো তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে পাক দিয়ে জড়িয়ে ছিলো। কালো কুচকুচে গা, চকচকে চোখ, ঘনঘন জিভ বের করে–
শেষে ওঝা এলো।
ওঝা হেঁট হয়ে দাত মুখ খিচিয়ে একটানে পটাপট কয়েকগাছা মাথার চুল ছিড়ে দুচারটে তুড়ি লাফ মেরে প্রায় এক নিশ্বাসে বলতে লাগলো :
ধ্যাড়ধুড়ধুড়ধ্যাড়ধুড়ধুড়পাহাইড়াবুড়ি
ম্যাড়মুড়মুড়ম্যাড়মুড়মুড়হজরতেরমায়।
ক্যাড়কুড়কুড়ক্যাড়কুড়কুড়কুবেকলাই
প্যাড়পুড়পুড়প্যাড়পুড়পুড়হবেকনাই–
কিন্তু সাপ তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে যে গেরো দিয়েছে কিছুতেই তা আর খুলতে চায় না। ওঝা মুখ কাঁচুমাচু করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, কাম বাজছে। এযে মাজারের হাপ!
উপায় জানা থাকলে মাজারের সাপও খেদানো যায়। পাঁচসিকে পয়সা, পাঁচপোয়া সেদ্ধচাল, পাঁচটা আলু আর পাঁচটা পিঁয়াজ নিয়ে বিকেল ঠিক পাঁচটায় ওঝা পাঁচবার হাতজোড় করে সবিনয়ে মিনতি জুড়লো, হুজুর আপনে মেরবানি কইরা অহনে যান গিয়া, আমি অনে হিন্নিগুলি দিয়া আইতাছি! তারপর লাঠির মাথায় তুলো দিয়ে লাল নীল সবুজ হলুদ আর কালো এই পাঁচরঙা সুতোয় তা জড়িয়ে দুবার খোঁচা মারতেই সাপটা ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে ডালিমগাছের কোল ঘেঁসে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এদিকে ওঝার নাকে-মুখে রক্ত ওঠার জোগাড়।
মেঝের ওপর চড়াৎ চড়াৎ আছাড় খেয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথার চুল ছিড়ে জাবনা খাওয়া গরুর মতো ফোশ ফোঁশ করে ঝোড়ো নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। যায় যায় অবস্থা। অনেক পরে গামছা দিয়ে গলার ঘাম মুছে সুস্থির হয়ে বললে, যা বাঁচাড়া বাঁচছেন হেইয়া আর কইলাম না। ইচ, যাওনের সমৎ অক্করে আমার কইলজার হিকড় ধইরা টান দিয়া গ্যাছে!
গল্প শেষ হলে গেনদুর মুখের দিকে তাকিয়ে অনু সবিস্ময়ে বললে, এমন হয়?
অইবো না কেল্লা? গেনদু বললে, তুই এলায় অক্করে ম্যানথামারা পোলা, তরে লয়া চলে না।
অনু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললে, ওঝা মন্ত্র শোনালে কি হবে সাপ তো আর কানে শোনে না।
কান দিয়া না হুনুক জিব্বা দিয়া হোনে।
বাজে কথা।
গেনদু বিরক্ত হয়ে বললো, তরে কইছে! তর যেমুন সব প্যাটবানান্তি কথা, এইগুলি পাচ কই?
খার, মুতা লই বলে মিয়াচাঁন একটা কেন্নোর গায়ে পেচ্ছাব করতে করতে খুব মনোযোগ দিয়ে তার গুটিয়ে যাওয়ার খুঁটিনাটি দেখলো। তারপর বললে, বিয়ার গীত হুনছস?
অনু বললে, না।
গেনদু ভারিক্কি চালে বললে, হুনায়া দে হুনায়া দে, কামে আইবো–মিয়াচাঁন তার চিনচিনে গলায় শুরু করলো :
ঘরসে নিকলা বাবু খানেকা বাস্তে–
মুরগিক আণ্ডা খা লিয়া রসগুল্লা সমঝকে
হায় হায় রসগুল্লা সমঝকে।
ঘরসে নিকলা বাবু পিনেকা বাস্তে-–
ঘোড়ে কা মুত পি লিয়া বেরানডি সমঝকে
হায় হায় বেরানডি সমঝকে।
অনু বললে, সত্যিই খুব মজার গান।
মিয়াচাঁন চোখ ট্যারা করে বললে, বুঝবার পারচস?
গেনদু ভেংচি কেটে বললে, থো! এণ্ডা বুঝছে। ক দেহি বেরানডি কি?
অনু বললে, তুমিই বলো না হে!
তরে লয়া আমাগ এক মোশকিল বাজছে। বেরানডি অইলো গিয়া রানডিগো খাওনের জিনিস।
মিয়াচাঁন গম্ভীর স্বরে বললে, তারিউরি অইবো আর কি।
গেনদু বললে, ওইসব মাইনসে খায় ক্যান ক দিহি, কি অয় খাইলে?—
তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে পরক্ষণে নিজেই বলে উঠলো, নিশা অয়, আবার কি অইবো। আর নিশা অইলে আতের মদে নবাবি আয়া যায়, চালারে–!
মাঝে মাঝে অনুকেও কিছু বলতে হয়, শুনতে চায় ওরা, বিশেষ করে গেনদু। কিন্তু অনু নিজে ওদের গল্প যতোটা আগ্রহ নিয়ে শোনে ওরা তার ধার দিয়েও যায় না।
চা-এর জন্মবৃত্তান্ত শোনালো অনু।
একদিন বোধিধর্মা ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে রাগে নিজের চোখের পাপড়ি দুটোই কেটে ফেলে দিয়েছিলেন। চোখের পাতাজোড়া যেখানে পড়েছিলো পরে সেখান থেকেই চা গাছ জন্মায়।
খুব যে তুষ্ট হয়েছে ওরা কারো মুখ দেখেই তা মনে হয় না। গেনদু আর মিয়াচাঁন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল অনু।
কিন্তু এসবই নেহাৎ ক্ষণস্থায়ী গরমিলের ব্যাপার। এইসব গান গল্প গাজনের সং কিংবা আখের সবুজ রসের লোহা লোহা গন্ধে নিবের পিঠ দিয়ে ব্লটিং পেপারে দাগ টানা কিংবা ছবি আঁকার মতো অনির্দিষ্ট আনন্দ খুঁজে পায় সে। ফলে মাঝপথে দমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় না, ভাটা পড়ে না উৎসাহে।
একসময় দুপুর ঝিমিয়ে আসে।
কাকের চিৎকারে অন অবসাদ ঝরে পড়ে।
চিৎপাত ব-এর মতো বেঢপ হলুদ বাড়ির ছাদে রেডিওর এরিয়েলের বাঁশ খানিকটা হেলে আছে। অনুর মনে হয় বর্বর বাতাস বাড়ির মাথায় রেফ দিয়ে গিয়েছে।
ভালো লাগে অনুর।
খুব ভালো লাগে। যে ঘরকে রাগী দুপুরের দংশন যন্ত্রণায় নিষ্পেষিত জঠর বলে মনে হতো, যে জঠরে মেঝের লাল ফরাশে শুয়ে শুয়ে এক সময় সে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নে শিউরে উঠতো,—সেই ঘর, যন্ত্রণা, দুঃস্বপ্ন, বৈচিত্র্যময় উঠতি আনন্দের অবাধ্য গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে বিবর্ণতার নিলয়ে বিলীন হয়ে গিয়েছে কবেই। ছত্রাখান জগতের এই ব্যাকুল আহ্বান নিঃশব্দ জানালায় দাঁড়িয়ে শোনার চেয়ে রৌদ্রের হিংস্রতায় পোড়া, পথ হারিয়ে পাগলের মতো ঘোরাঘুরি করা, কিংবা রাস্তার পাশের পাইপকলে মুখ লাগিয়ে এক নিশ্বাসে তৃষ্ণা নিবারণ করা তার কাছে গভীর আন্তরিকতার এক একটা চিহ্ন বলে মনে হয়।
এইসব প্রকীর্ণ চিহ্নের প্রতি অনুরক্ত অনু এখন আর মার জন্যে ভরা দুপুরে অকারণে দুমড়ে-মুচড়ে একাকার হয় না। অসংখ্য হাত বাড়ানো। পাকুড় আর গরান গাছের গরিব চেহারার মাঝখানে সে তার মার সুদ স্নিগ্ধ মুখের সেই পরম নির্ভরযোগ্য আলো দেখতে পায়।
কিন্তু গেনদু, মিয়াচাঁন, ফকিরা কিংবা ফালানি—এদের কারো মুখেই আলো খুঁজে পায় না অনু; এদের মুখের ধারালো অন্ধকারে রক্তনে রৌদ্র বিদ্যুতের মতো ঝলসে ওঠে কখনো কখনো, এইমাত্র। চৌ-পহর দিন এরা বিষদাঁত হাতড়ে ফিরছে। সামান্য একটা ব্যাঙকে যখন এরা পা দিয়ে চটকায় কিংবা এতোটুকু হালকা ঝিঝিপোকা কি প্রজাপতির ফিনফিনে শরীরকে শতেক টুকরো করে কুটকুটিয়ে ছিঁড়তে থাকে তখন এদের চোখমুখে উল্লাসের যে আগুন ঝলসে উঠে অনু তা দেখে ভয় পায়। এইতো কয়েকদিন আগেই মাঞ্জা দেওয়া করকরে লাল সুতোর টান মেরে একজনের কান উড়িয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়েছিলো গেনদু, বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েছিলো। চলতে চলতে অকারণে ঢিল ছুঁড়লো কখনো। যদি কারো মাথায় গিয়ে পড়ে, কিংবা রক্তপাত ঘটে, তাহলে তার আনন্দ দেখে কে।
মিয়াচাঁন, বারিখান তাকায়া দ্যাখ, অক্করে টেডি মাইয়াগ রহম।
গেনদুর কথায় অনুও তাকালো ঐদিকে।
বেঢপ খাড়া চারতলা লাল বাড়ি রাস্তার একপাশে তালগাছের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে। দোতলার মাঝখানে ঝোলানো বারান্দায় একটি ছেলে নিচের দিকে ঝুঁকে রাস্তা দেখছে। অনুর মনে হলো ইটের তৈরি এক অবিশ্বাস্য ক্যাঙ্গারু পেটের থলিতে শিশু নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে নিরুপদ্রব বিকেল পোহাচ্ছে।
বাড়ির সামনে শাদা ন্যাকড়ার মতো কি একটা পড়েছিলো, চোখ পড়লো তিনজনেরই। গেনদু ছুটে গিয়ে তুলে নিলো।
হিহি করে হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে ধরে বললে, এলায় ছেরিগ দুদে বান্দনের জামা! আয়না মিয়াচাঁন, তরে লাগায়া দেহি!
প্রথমে তারা সেই বেঢপ বাড়িটা ছাড়িয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেল, তারপর ঝুরিওলা এক বুড়ো বটের নিচে পঁাড়িয়ে বুকের দিক পিঠে দিয়ে মিয়ানের গায়ে শক্ত করে ফিতেগুলো এঁটে দিল গেনদু। বললে, নাচনা বে।
মিয়াচাঁন দম দেওয়া পুতুলের মতো তখনকার তখনই হাতপা ঘুরিয়ে, মাজা দুলিয়ে আগু-পিছু করে, বসে, দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে, চর্কিবাজির মতো ঘুরপাক খেয়ে, সুর ধরে। তারপর তার নিজের কায়দায় নাচন শুরু হয়। আর গেনদু দুহাতে পেটের ওপর থাবড়া দিয়ে হেইহেই হেইহেই করে মালসাট মারতে থাকে।
ঘরমে আয়া বাবু শোনেকা বাস্তে–
শালীকো লেকে শো গয়া ঘরওলী সমঝকে। হায় হায় ঘরওলী সমঝকে!
অনু দেখলো বটগাছের চুড়ায় পাতা নেই একটিও, নুলো নুলো ডাল, সেখানে শকুনের দঙ্গল ঘোঁট পাকাচ্ছে। মেলা বসিয়েছে কাকের ঝক; কেউবা ঠুকরে পালকের উকুন খুঁটে দিচ্ছে, কেউবা শকুনের পিঠে গাড়িচাপা করে খেলছে।
হঠাৎ নাচ বন্ধ করে মিয়াচাঁন রুষ্টমুখে বললে, পহা ছাড়না বে, হুদাহুদি দেহামু নিহি?
গেনদু রসিকতা করে বললে, এউগা কিচ খায়ার পারি!
মিয়াচাঁন বললে, তয় অনুরে দেওন লাগবো–
অনু খুশি মনেই পকেট থেকে দশ পয়সা বের করে দিলো।
আপন মনে পেয়ারা চিবুতে চিবুতে একটি মেয়ে একা একা এই পথ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিলো; গেনদু ওদের দুজনকে পিছনে রেখে নিতান্ত ভালোমানুষের মতো কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর সহসা এক ঝটকায় মেয়েটার হাত থেকে আধ-খাওয়া পেয়ারা কেড়ে নিয়ে চেঁচো করে দে দৌড়।
সেই সঙ্গে মিয়াচাঁনও। চোরা চাহনিতে ভেতরে ভেতরে কখন যে দুজনের ভাবের আদান-প্রদান হয়ে গিয়েছে সে তা কিছুমাত্র অনুমান করতে পারে নি।
ছুটতে ছুটতে চোখের আড়াল হবার আগে সেই দূর থেকে চিৎকার করে গেনদু বললে, কাউলকা দেহা অইবো বন্দু হাম্মাদের ওহানে–-
একেবারে ভোজবাজির মতো উধাও হয় দুজন।
বিকেলের গা থেকে হাওয়ার আঁচল ধুলোয় খসে পড়ে গিয়েছিলো, ঘূর্ণি উঠলো মেয়েটাকে চক্রাকারে বেষ্টন করে। শুকনো বিবর্ণ পাতা হেঁড়া কাগজ আর ধুলোবালি তাকে মাঝখানে রেখে প্যাঁচানো স্কুর মতো শঙ্খিল গতিতে ওপরের দিকে উঠলো ফরফর করে পাক খেয়ে; এক মুহূর্ত তাকে দেখা গেল ঝাপসা, যেন পর্দা সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো।
দলের কেউ নেই, অনু এখন একা।
প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলো মেয়েটি, তারপর বিদ্যুৎগতিতে এক টুকরো ঝামা তুলে নিয়ে অন্ধের মতো যেদিকে পারলো ছুঁড়লো। যখন দেখলো গেনদু আর মিয়াচাঁন ভেলকিবাজির মতো চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গিয়েছে, হাতের পাতায় চোখ ঢেকে সে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললো।
দারুণ বিপর্যস্ত অবস্থা অনুর। এই গেনদু আর মিয়াচাঁনরা যখন ফালানিদের হাতে অসহায়ের মতো মার খায়, ঘাড় গুঁজে মুখ বুজে সহ্য করে অন্যায় উৎপাত, তখন অন্যরকম মনে হয়েছে অনুর। কতো রকমেরই চেহারা এদের, কতো অচেনা, কতো ঝোপের আড়ালে না আত্মগোপন করে আছে এরা সকলে।
কি করবে ভেবে পেলো না সে।
কিছুক্ষণ একেবারে হাবার মতো হা করে দাঁড়িয়ে থকিলো, তারপর ভয়ে ভয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছুটা সাহস দেখিয়ে বললে, ওরা খুবই বজ্জাত, আমি তোমাকে পেয়ারা কিনে দিতে পারি, নেবে?
মেয়েটা চোখ মুছে কি যেন ভাবলো। ধরাগলায় বললে, পাবি কোথায় যে কি দিবি?
অনু সাগ্রহে বললে, চলো না, খুঁজে দেখি কোথাও পাওয়া যায় কিনা।
বোঝা গেল মেয়েটি খুব খুশি হয়েছে। ইচ্ছেমতো অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর বললে, না পেলে তোর যা খুশি কিনে দিবি।
পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলো অনু। হাঁটতে হাঁটতে বারবার তার আপাদমস্তক মুখস্থ করতে লাগলো মেয়েটি।
এক সময় বললে, তুই খুব সুন্দর দেখতে রে। তোরা সায়েব মানুষ তাই?
উত্তরের কোনো অপেক্ষা না রেখে তারপর আবার বললে, আমার আরো বন্ধু আছে। আমাদের পাড়ার বিশুয়ালাল আর হরিয়া। ওরা কতো কিছু দেয়। আমাকে। কাঁচপোকা ধরে এনে দেয়। দাদাপাখির পাখনা কুড়িয়ে এনে দেয়। ফলশা মিছরি এসব কিনে এনে দেয়। আমি মিছরি খেতে খুব ভালোবাসি।
অনু বললে, তুমি কোন্ পাড়ায় থাকো?
ঋষিপাড়ায়। আমার নাম সরুদাসী।
কতোদূর এখান থেকে তোমাদের বাড়ি?
কাছেই তো। চলনা আমার সঙ্গে, দেখে আসবি।
কি মনে করে অনু জানতে চাইলো, তোমাকে কেউ বকবে না?
বলে আমার বয়েই গেল! আমি কি কারো বকুনির পরোয়া করি? মা উঠতে বসতে কম গুতান পুঁতায় নাকি। চামারনীটা মরেও না, মরলে আমার হাড়ে বাতাস লাগতো!
পাশে একটা মুদিখানা দেখতে পেয়ে অনু সাগ্রহে বললে, পেয়ারা তো কোথাও দেখলাম না, মিছরি কিনে এনে দেবো তোমাকে?
সরুদাসী বললে, গুঁড়ো নিসনে যেন আবার, বড়ো বড়ো দেখে বেছে নিস।
তারপর হাতে মিছরি নেবার পর বললে, ভালো বাছতে পারিসনিরে, হুঁশো পেয়ে ঠকিয়ে দিয়েছে। আমি যদি যেতুম তা হলে আর ফাঁকিবাজি চলতো না। রতিরঞ্জন পসারীটার মতো বাঁদর এ তল্লাটে আর একটাও নেই, বুঝলি?
চেন নাকি তুমি?
হাড়ে হাড়ে চিনি। ওর ওই কানটো করা হাসি দেখলে পিত্তি জ্বলে যায় আমার। বেহায়ার রাজা। আশপাশের ধুমসী চাকরানী হুঁড়িগুলোর মাথা ওই-ই তো খাচ্ছে। জামা তুলে গা দেখালে দুটো বাতাসা, গায়ে হাত দিতে দিলে তেল-সাবান, কম নচ্ছার ওটা! জুতসই একটা ঠ্যাঙানি না পড়লে সিধা হবে না। আমার কাছে কিন্তু পাত্তা পায় না, হু! আমাকে কি বলে জানিস? বলে তুই এখনো এক বাতাস, দু বাতাসার যুগ্যি হস নি। পোক্ত হয়ে নে তারপর দেখবো তোকে। আমিও বলেছি, দেখিস, বাপের বেটা হলে দেখিস?
অনু চুপচাপ সব শোনে।
সরুদাসী কি মনে করে আবার বললে, জানিস, কাল দুপুরে আমি কিন্তু হরিয়ার কাছ থেকে মিছরি নিই নি–
খুব আশ্চর্য হয়ে অনু বললে, কেন?
ইশ! তখন যে আমার ঘুগনি খেতে সাধ হচ্ছিলো। আমি কি শুধু মিছরি খাবো বলেই জন্মেছি? মাখনা, ফলশা, চানা, সেঁকামাংস এসবও তো খুব মজার জিনিস। সেঁকামাংস যা মজার, ইশ! একটা কথা, তুই ওইসব হাঘরে ছোটোলোক ছেলেদের সাথে খুব মাখামাখি করিস, নারে? কুটোকাটাগুলো সব পচা জাতের, তোর ঘেন্না করে না? তুই কতো ভালো। কতো সুন্দর। আমি যদি তোর মতো হতে পাত্তাম!।
অনু নিজের অভ্যন্তরে নদী হয়ে গেল একথায়। তার মনে হলো সরুদাসী খুব ভালো মেয়ে। ফকিরা, ফালানি, মিয়াচাঁন, গেনদু সরুদাসীর পায়ের কড়ে আঙুলের যোগ্যও কেউ নয়। কি সুন্দর কথা বলে সরুদাসী; পাকা গিন্নী মনে হয় তার। কি ঝকঝকে সরুদাসীর দাঁতগুলো!
আর মনে হয় বিশুয়ালাল (কুশ্রীময়লাদরিদ্র) যা পারে না, হরিয়া যা পারে, খুব সহজে সে তা পারে। সরুদাসী ইচ্ছে করলেই যে-কোনো সময় তার কাছে থেকে খুশিমতো ঘুগনি নিতে পারে, মাখনা নিতে পারে।
এমন একটা স্বাতন্ত্র্যবোধ জেগে উঠলো তার ভেতরে যে গেনদ মিয়াচাঁনের দ্বিপ্রহরিক সব সঙ্গকে এক লহমায় ঘৃণ্য মনে হলো; এরা সবাই তাকে গাড়লের মতো গাছের গুঁড়ি বানিয়ে চারপাশে লুকোচুরি খেলা খেলছে। তাকে ঠকিয়েই ওদের আনন্দ। ওরা চায় অনু বোকা থেকে ওদের খেয়ালখুশির রসদ জুগিয়ে চলুক। কতকটা অস্বাভাবিকরকম মরিয়া হয়ে সে বললে, আমি ঘেন্না করি ওদের! ওরা লোভী হ্যাংলা।
সরুদাসী খুব সংযতকণ্ঠে বললে, মিশিস না ওদের সঙ্গে। চোর-হঁচড়া আর গাঁটকাটার পাল ওগুলো। সবকটা জোচ্চোর আর ক্ষুদে বাটপাড়! আচ্ছা তোদের বাড়ি অনেক বড় নারে?
অনু বললে, দোতলা।
ইশ কি আরাম তোদের ওপর থেকে নিচের দিকে দেখতে যা ভালো লাগে! আমি একবার চারমানবাবুদের বাড়ির দোতলায় উঠেছিলুম, মা-ও ছিলো। মা চারমানবাবুর বৌয়ের ছেলে ধত্তে গিয়েছিলো, সঙ্গে আমিও গিয়েছিলুম। আর শোন, খুব মজার একটা কথা–
অনু খুশিতে উচ্ছল সরুদাসীর মুখের দিকে ঘাড় ফেরালো।
চারমানবাবুর ছোটো মেয়েটার না, বিয়ে না হতেই পেট হয়েছে! হেসে। গড়িয়ে পড়ার উপক্রম করে মুখে হাত চাপা দিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সরুদাসী, তারপর আবার বললে, মাকে বলে কিনা পেট ফেলে দিতে পারলে পঁচিশ টাকা দেবে। যা তা ব্যাপার নাকি? মা পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছে, একশো টাকা না হলে ও কাজে হাত দেবে না, পাপ আর কি। ইশ, কী উঁচু নাকই না ছিলো হুঁড়িটার। ধরাকে একেবারে সরা জ্ঞান, দেমাকে মাটিতেই পা পড়তো না। আমি দোতলায় উঠেছিলুম বলে দূর দূর করে তাড়কা রাক্ষসীর মতো খেকিয়ে এসেছিলো আমার দিকে, তলে তলে আবার এতো! আমি হলে গলায় দড়ি দিয়ে মরতুম, ছি করো, ছি করো!
অনু বললে, তোমার বাবা কোথায় কাজ করে?
সরুদাসী কড়মড় করে দাঁতের মাড়ি দিয়ে মিছরি ভেঙে জড়িয়ে জড়িয়ে বললে, কি আবার করবে, জুতো সেলাই করে। ঋষিপাড়ায় সব্বাই তো ওই কাজই করে। অনেক ভালো ভালো কাজ পেয়েছে বাবা, কিন্তু ঠাকুরের মানা বলে সেসব করে নি। আমাদের জাত অন্য কিছু কত্তে গেলে ঠাকুরের শাপ লাগে।
অনু বললে, তোমাদের ঠাকুর বোধ হয় খুব রাগী?
কি জানি! প্রথমে উদাস থেকে তারপর চোখ বড় বড় করে সরুদাসী বললে, হ্যারে তোদের ঘরে অনেক জিনিশপত্তর, নারে?
অনু বললে, তা আর বলতে। অনেক দামি দামি সব জিনিশ, সব কাজেও লাগে না।
আবার উদাস হয়ে সরুদাসী আক্ষেপের সুরে বললে, আমাদের ওসবের কোনো বালাই নেই। বাবা সারাদিন রাস্তার মোড়ে লাইটের খাম্বার নিচে বসে জুতো সেলাই করে। সন্ধেবেলা যন্ত্রপাতির বাক্স মাথায় নিয়ে আবার ফিরে আসে। বগলি ঝেড়ে দুতিন টাকার বেশি কোনোদিনই নামে না। তারপর আবার চামড়া কেনা আছে, কাঁটা কেনা আছে। আমাদের খুব কষ্ট। এখন আগের মতো মাও আর তেমন বাইরে যায় না। কেউ ডাকেই না তো যাবে কি করে! আজকাল ধুমসী ধুমসী পোয়াতীরা গাট গ্যাট করে সোজা হাসপাতালে চলে যায় পয়সা বাঁচাবার জন্য। মদ্দা ডাক্তারের হাতে খালাস করায়। ঘেন্নায় আর বাচিনে বাপু! তুই বুঝি ইস্কুলে পড়িস?
অনু সগর্বে বললে, না পড়লে চলবে কেন। লেখাপড়ায় আমার সুনাম আছে। শক্ত শক্ত অনেক বই পড়তে হয়।
এতোটা বিশ্বাস হয় না তার, ঠিক এমনি সন্দেহের সুরেই সে বললে, যাহ, তুই বাড়িয়ে বলছিস!
সত্যি বলছি। অনু জোর দিয়ে বললে, প্রতিবারই আমি ফার্স্ট হই। সব স্যারেরাই আমাকে ভালোবাসেন!
এখন থাম—সরুদাসী অন্যদিকে তাকিয়ে নিস্পৃহকণ্ঠে বললে, আর বেশি বিদ্যে জাহির করতে হবে না।
অনুর মনে হলো তার একটুও বাড়িয়ে বলার কোনো প্রয়োজন নেই। স্কুলে সত্যিই সে নামজাদা সুবোধ ছেলে। এমন কি অঙ্কস্যার ইয়াসিন লোদী (কুইনিনস্যার) আর বাংলার খিটখিটে রতিকান্ত কুণ্ডু (ক্যালসিয়ামস্যার) সবাই তাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। সৎ এবং সুসভ্য ছাত্র হিশেবে সকলের মুখেই তার প্রচুর সুনাম। রতিকান্ত কুণ্ডু-খাই তোর মুণ্ডু কিংবা ব্ল্যাকবোর্ডে কুণ্ড দাবানল—এইসব যাচ্ছেতাই লেখার দলে সে কখনোই ভেড়ে নি। যেমন ইংরেজি টিচার টি. এ. লস্করকে নিয়ে ছাত্রদের বাজেকথা রটনা করাকে সে রীতিমতো ঘৃণা করে। লস্করস্যার (আন্ডারওয়ারস্যার) পাতলা ট্রাউজার পরেন বলে ছাত্ররা স্কুলময় রটিয়ে বেড়িয়েছে—স্যারের আন্ডারওয়ার দেখা যায় কেন, না উনি পুরোনো মশারির কাপড় দিয়ে ট্রাউজার তৈরি করনি, ইত্যাদি ইত্যাদি।
আকাশের একটা কোণে নিঃশব্দে মেঘ জমেছে। খুব আকস্মিকভাবে অল্পক্ষণের মধ্যেই আয়োজন শেষ হলো মেঘের, বলতে কি একবারে তাদের অগোচরে; দুজনের কেউই খেয়াল করতে পারে নি আসন্ন বর্ষণকে।
চোখের পলকে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেল। ভালুকের গায়ের মতো এমন কালো অন্ধকার যে অনুর মনে হলো আর একটু পরেই তারা কেউই পরস্পরকে দেখতে পাবে না, খুঁজে পাবে না।
শীতল হাওয়ার স্রোত হঠাৎ খ্যাপাটে বুনো মোষের মতো যখন দাপাদাপি শুরু করলো তখন সরুদাসীর মুখ কালো হয়ে এলো, সে বললে, আই সেরেছে! উঠোনে ছাগলের শুকনো নাদি উঁই হয়ে রয়েছে, সব ভিজে
কাদা হয়ে যাবে। কপালে আজ নির্ঘাৎ পিটুনিলেখা আছে।
সেই অমল অন্ধকারে, দামাল হাওয়ায়, অনুর একবারও ঘরে ফেরার কথা মনে এলো না। মনে পড়লো একদিন বাড়ি থেকে কোথাও না কোথাও পালিয়ে যেতে হবে তাকে, সেখানে হয়তো ঠিক এমনই ঠাণ্ডা, হাওয়া, অন্ধকার।
কি যে করছে মা ভেতরে ভেতরে—জটিল মনে হয় অনুর, সব দরোজাই বন্ধ, উপায় নেই বোঝার। রাক্ষুসে ঘরগুলো সুযোগ পেলেই বিকট দাঁত বের করে তাকে দেখে হিংস্র হাসি হাসে। সাপের মতো হিলহিলে ভয় তাকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়ায়; যেমন করেই হোক পালাতে তাকে হবেই—মনে করিয়ে দিতে হবে মাকে।
আর কতোদূর?
খুব কাছাকাছি এসে গেছি। ওরে, বিষ্টি পড়া শুরু হয়ে গিয়েছে রে–
দৌড় মার, দৌড় মারা
অনু ব্রিত হয়ে বললে, এখন যে আমরা ভিজে চাবচু হয়ে যাবো। কচি খোকা, কথা শুনলে হাসি পায়! সরুদাসী মাথার ওপর হাতের তালু বিছিয়ে বললে, আমার পিছন পিছন চলে আয়, শিল পড়ছে।
কেঁপে বৃষ্টি এলো। পলকের মধ্যে ভিজে সপসপ হয়ে গেল অনু। চুটপুট চুটপুট গুড়ুম গাড়া করে বড় বড় শিল পড়ছে। অনু রোমাঞ্চিত হলো।
কি সুন্দর এই (ঝঞাঝরঝরঝাপতালঝিঝিঝিঝিট) বৃষ্টি! কি অদ্ভুত এই বৃষ্টি! কি সীমাহীন।
বৃষ্টি। বৃষ্টি!
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি।
ফুঁসে উঠছে হাওয়া, কখনো গলায় ঘুঙুর বাঁধা বাছুরের মতো, কখনো কুঁদুলে ষাঁড়ের মতো শিঙ উঁচিয়ে; কখনো রনোন্মত্ত সিংহের মতো, দুর্দান্ত দস্যুর মতো কখনো।
ঢুকে পড় ঢুকে পড়, শিগগির ঢুকে পড়–বলে সরুদাসী একটা দোকানের ঝাপ ঠেলে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে সাঁধায়।
অনুও ঢোকে তার পিছনে পিছনে। দোকানের ভেতরে কেউ নেই।
একটা ডালাভাঙা কাঠের ক্যাশবাক্স শীতল পাটি বিছানো চৌকির ওপর পড়ে আছে, কোণগুলো পিতলের নকশা দিয়ে মোড়া। এক পাশে থাক করা জ্বালানির চেলাকাঠ। মাঝখানে ঝোলানো বড়সড় একটা কাটাপাল্লা।
অনু ভয়ে ভয়ে বললে, বকবে না দোকানদার?
সরুদাসী নির্বিকারচিত্তে বললে, দেখলে তবে তো! আমরা তো আর চুরি কত্তে আসিনি, দেখলেই বা।
ফালুক-ফুলুক করে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলো সরুদাসী; এমন সন্ধানী সে দৃষ্টি যেন কোনো কিছু একটা আবিষ্কার না হওয়া অবধি তার স্বস্তি নেই।
পেয়েছি পেয়েছি, কি মজা–বলে এক সময় ছুটে গেল ক্যাশবাক্সের কাছে, তারপর তার ভেতর থেকে বের করলো একটা কাঁচা আম ঘষা ঝিনুক আর নুনের পুঁটলি। ওলন-দোলন ওলন-দোলন এই বলে সে দোলনা চাপার মতো করে পাল্লার একদিকে বসে অপরদিকের দড়িআঁটা। তক্তায় বসতে নির্দেশ করলো অনুকে। সরুদাসীর দিকটা খানিক উঁচুতে উঠলো।
সরুদাসী একটু পরে হেসে বললে, তুই ভারে কাটিস, আমি ধারে কাটি, তাই না?
অনু বললে, ঘোড়ার ডিমের কথা, মাথামুণ্ডু নেই!
আমার ধার ঘষা ঝিনুকের চেয়েও কিন্তু বেশি, বুঝেশুনে কথা বলিস! আমের গা থেকে ঝিনুকের ফুটো দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে গালে পুরে চিবুতে লাগলো সরুদাসী। কখনো এক চিমটি নুন নিলো। কখনো মাড়িতে নিয়ে চিবুলো। কখনো টকাস টকাস করে শব্দ তুললো টাকরায়।
এক সময় বাইরে বৃষ্টি থেমে এলো। প্রচণ্ড শব্দে ঢেউটিনের চালের ওপর দুড়ুম-দাঁড়াম্ শিল পড়া শুরু হলো। মনে হয় ডাকাত পড়েছে, বর্শা ছুড়ছে এলোপাতাড়ি।
শিলপড়া বন্ধ হলো আবার।
আবার বৃষ্টি শুরু হলো।
বৃষ্টি! বৃষ্টি! বৃষ্টি!
এবারে একেবারে আকাশ ভেঙে।
অনুর মনে পড়ে যায় চল নামি, আষাঢ় আসিয়াছে—যদিও বৈশাখ চলছে এখন। চলো নামি, বৈশাখ আসিয়াছে, তাই বৃষ্টির ঢল নামছে, আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।
সরুদাসীর পরনে শাড়িছেঁড়া ফালি লুঙ্গির মতো জড়ানো। গায়ে ঘটির মতো ফোলাহাতা ছিটের ব্লাউস, যার একটাও বোতাম নেই, নাভির উপরে। গিটমারা। কোমরে কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি। ভিজে কাপড়ে ছুটতে গিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ফেঁসে গিয়েছিলো। সরুদাসী ছেঁড়া জায়গায় হাত রেখে হঠাৎ মুখ কালো করে তিরস্কারের সুরে বললে, তুই কি অসভ্যরে, হাঁ করে আমার পাছা দেখছিলি বুঝি এতোক্ষণ?
অনু লজ্জিত হয়ে বললে, যাঃ, মিথ্যে কথা!
ঠিক আছে, আর দেখিস না কখনো। তুই আর আমি যদি স্বামী-স্ত্রী হতুম তাহলে কিন্তু তোকে একথা বললে আমার পাপ হতো। বিশুয়ালালটা কি অসভ্য জানিস? শুধু পুতপুতু করে আর আমার পাছা দেখতে চায়। একটা আস্ত ভীতুর ডিম। এক ধমকেই আবার লেজ গুটিয়ে সুড়সুড় করে পালায় মেনিমুখো ছোঁড়াটা। কিন্তু হরিয়াটা একটা আস্ত গুণ্ডা। ওর গুণ্ডামি একদিন বার করবো আমি, ছাইকপালে। সেদিন বাগানে না তুই আবার মন্দ ভাববি, তোকে বলবো না। জানিস আমার মায়ের একটা খুব সুন্দর রুপোর গুজরি আছে। বিয়ের সময় আমাকে দিয়ে দেবে সেটা, মা নিজমুখে বলেছে।
অনু হাঁপানি রুগীর মতো ঘড়ঘড় শব্দ তুলে বললে, হরিয়ার কথা বলবে না?
সরুদাসী চট করে বললে, এমন গুণ্ডা তোকে আর কি বলবো! কথায় কথায় কুটকাট কোমরে চিমটি দেবে আর ছুতোনাতা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিশফিশিয়ে কেবল খারাপ খারাপ অসভ্য কথা বলবে। যা ঘেন্না করে আমার, ছি করো! সেদিন বাগানে আমার সঙ্গে রান্নাপাতি খেলা খেলতে খেলতে বলা নেই কওয়া নেই হুট করে বুকে খামচি কেটে দে দৌড়, নচ্ছার একটা! বড় জ্বালায় ছোঁড়াটা!
অনু গম্ভীর মুখে অভিযোগের সুরে বললে, তুমি তো বকতে পারো ওদের, তোমার মা-বাবাকে বলে দিতে পারো।
তুই একটা আস্ত ইয়ে! এইসব নাকি আবার কাউকে বলা যায়, মরে যাই মরে যাই! আমি সেধে না মিশলেই হলো। ছোঁড়া তো নয়, প্যাকাটি! নচ্ছারটার দুকান দুরকম, আবার ট্যাগরাও। অমাবস্যার রাতে জন্মালে নাকি অমন ছিরি হয়। এমনও হতে পারে ওর মা এঁটো হাতে পেচ্ছাব করতে বসেছিলো কখনো। একদম মড়াখেকো চেহারা, ওর মিছরি নিতে আমার বয়েই গেছে।
অনু বললে, তুমি যদি ওদের সঙ্গে আর কথা না বলো তোমাকে বাড়ি থেকে সুন্দর সুন্দর জিনিশ এনে দেবো।
ইশ, ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে সরুর যেন আর ঘুম হচ্ছে না। আমি যেচে কথা বলি ভেবেছিস? বেহায়া কি আর গাছ থেকে পড়ে? কুকুর দুটো নিজেরাই নানান ছুতোয় সুড়সুড় করে পিছনে ঘোরে। এবার থেকে দেখা হলে গায়ে থুতু দেবো, তুই দেখিস। আমার আর কি দোষ বল, আমি তো আর এর আগে তোকে চিনতাম না। এই তোর নাম কি এখনো বললি না তো? আমারটা দিব্যি কায়দা করে জেনে নেওয়া হলো, বেশতো চালাকি!
অনু—
ওমা আমি কোথায় যাবো, ওতো হুঁড়িদের নাম রে! হেসে গড়িয়ে পড়লো সরুদাসী। তারপর চোখের নিক্তিতে হুট করে মেপে নিলো দুজনের বয়েস। অনুর চেয়ে কিছুটা বড়োই হবে সে, তার ধারণা। তবু কি যেন ভেবে খুব আন্তরিকতার সুরে সে বললে, নাহ্, নাম ধরে ডাকবো না তোকে। তুই বেশ আমার—তুই বেশ আমার মনসাপাতা।
অনু বুঝতে না পেরে বললে, সে আবার কি?
তোর মুণ্ডু! ওমা কি গাধারে তুই, মনসাপাতাও বুঝিস না, আবার নাকি গণ্ডায় গণ্ডায় বই পড়া হয়? বিশুয়ালাল আমার কি ছিলো জানিস, তেঁতুলপাতা!
আর হরিয়া?
বিছুটি পাতা!
উভয়ে নীরব থাকলো কিছুক্ষণ।
কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শুনলো। মনে মনে বাজ পড়ার শব্দ গুনলো। বৃষ্টিভারাক্রান্ত হু হু হিমেল হাওয়া ঠিক ওদের মতোই ঝাপ ঠেলে ভেতরে ঢুকলো হুড়মুড়িয়ে কোনো এক সময়। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ছাউনির করোগেট একটানা রিনরিনিয়ে উঠছে।
অনু বললে, আমি যদি রোজ আসি তুমি খেলবে তো?
বারে, খেলবো না কেন? সরুদাসী তার দিকে স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বললে, তোর মিছরি খুব মিষ্টি, তোকে আমি খুব পছন্দ করি। বাবুদের বড় বাগান চিনিয়ে দেবো তোকে, সেখানে রোজ আমরা খেলবো। আচ্ছা মাগ ভাতার খেলা জানিস তো?
না!
তোকে সব শিখিয়ে দেবো। বাবুদের বাগানে কাটামুদি আর ভাঁটঝোপের ভেতর আমার খেলাঘর পাতা আছে, সেখানে তোতে আমাতে মাগ-ভাতার খেলা খেলবো। আমি মিছিমিছি চান সেরে ন্যাংটো হয়ে কাপড় বদলাবো, তুই চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকবি। দেখলে কিন্তু ভালো হবে না বলে রাখলুম। তারপর কাপড় পরে আমি তোকে বুকড়ি চালের মোটাভাত, কাঁকরোল-ভুষো চিংড়ি, মাগুরের ঝোল কিংবা জলপাই। কুচিয়ে দেওয়া গাংদাড় মাছের চচ্চড়ি দিয়ে পেটপুরে খেতে সাধবো। তুই মিথ্যে মিথ্যে রাগ করবি। বলবি, মেয়েটা কেঁদে কেঁদে সারা হলো সেদিকে খেয়াল আছে নচ্ছার মাগীর, মাই দিতে পারিস না, এইসব। পিচের কালো পুতুলটা বেশ আমাদের মেয়ে হবে। তারপর আমি তোর কাছে ঘাট মানবো। তুই ফিক করে হেসে ফেলবি। খেয়ে-দেয়ে দুজনে পাশাপাশি শোবো। তুই রাগ করে চলে যাবি। তারপর মিছিমিছি তাড়ি খেয়ে মাতলামি কত্তে কত্তে এসে আমাকে রানডি মাগী ছেনাল মাগী বলে যাচ্ছেতাই গাল পাড়বি। বেশ মজা হবে যাই বল, তাই না রে?
অনু আমতা আমতা করে বললে, আমি কিন্তু তোমাকে অতোসব বকাবকি করতে পারবো না!
দূর বোকা! খিস্তি-বিখিস্তি না করলে, মেরে গতর চুরিয়ে না দিলে, তোর মাগী কি ঠিক থাকবে নাকি? ভাতারের কিল না খেলে মাগীরা যে নাঙ ধরে তা-ও জানিস না বুঝি? আমাদের ঋষিপাড়ায় শিউশরণের সেবার কি হলো! বৌয়ের ওপর ভোদা মেনিমুখোঁটার অগাধ বিশ্বাস, ঝোপ বুঝে কোপ মেরে মাগীটা চোখে ধুলো দিতে শুরু করলো ঐ ভালোমানুষির সুযোেগ নিয়ে। রোজ রাত্তিরে শিউশরণ যখন নেশার ঘোরে আধমরা, মুখে কুকুরে মুতে দিলেও বোঝার যো নেই, রাক্ষসী বারোভাতারীটা তখন অন্য নাগরের সঙ্গে পা টিপে টিপে পিরিত করতে বেরিয়ে যায়। শেষে ধরা পড়লো একদিন। ঘরের দাওয়ায় বসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো আঁটিচোষা কেলেভূতটা, আর ওর মাগীটা তোর ঘর করবো না এই ঊনপাঁজুরে মিনসে তোর ঘর আর করবো না বলে মুখ ঝামটা দিয়ে তেজ দেখাতে লাগলো সমানে।
ওসব বাদ দাও! অনু বিরক্ত হয়েই বললে।
সরুদাসী তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকালো, তারপর হেসে লুটিয়ে পড়ে বললে, বুঝেছি বুঝেছি, তুই অন্য কথা বলবি ঐ সময়, পেটে পেটে এতো–-ওরে বজ্জাত কম না তো তুই। ওরে তিলেখচ্চর–
ধরো হরিয়া যদি আমাদের সঙ্গে শয়তানি করে?
লাথি না! অতো খ্যামাতা থাকলে তো! সে আমি একাই সামলাবো, তোকে অতোসব ভাবতে হবে না। যেমন বেটা তেমনি বাপ। হরিয়ার মড়াখেগো বাপটা দিনরাত গাঁজা-চরসে মশগুল হয়ে থাকে, আর ওর মড়াঞ্চে পোয়াতি মাটা একমুনে ধামার মতো পেট নিয়ে দোরে দোরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে শুধু নাকিসুরে কাঁদুনি গেয়ে বেড়ায়।
অনু হাবার মতো হাঁ করে নীরবে শুনতে থাকে।
তোকে একটা কথা বলা হয় নি, প্যানপ্যান করে নাকিসুরে কাঁদুনি গাইলে কি হবে ওর মা মাগীটাও কম নচ্ছার না, নটঘট লাগাবার ওস্তাদনী যাকে বলে। ঐ যে শিউশরণের কথা বললুম তোকে, ব্যাপারটা হয়েছিলো ওর থুথুড়ি মাকে নিয়ে। একশো তিরিশ বছর বয়েস বুড়ির। বাবুদের বাগানে ঝুরিওলা বট আর অশথগুলো বয়সে বুড়ির নাতজামায়ের চেয়ে ছোট হবে। বাঁ গালে এক মস্ত তিল ছিলো বুড়ির, তিলের গায়ে ছিলো কয়েকটা চোঁচের মতো লোম। হরিয়ার মা মাগী ঘুমন্ত বুড়ির ঐ তিলের নোম চুরি করে বেচে দেবে না, সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। তাড়ির ফেনার মতো মুখে গাঁজলা তুলে হাত-পা টেনে খিচে খিচে বুড়ি তো পটল তুললো, পাড়াসুদ্ধ সবাই মিলে মেরে তুলোধােনা করে ছাড়লো মাগীকে। তবু কি এখনো শিক্ষা হয়েছে মাগীর, টোটকা-ফোটকা এখনো চালায় মৌকা। পেলে। চুল কাটা, শাড়ির আঁচল কেটে আনা, পান-সুপুরি চালান করা, শতেক বিদ্যের জাহাজ মাগী। হাতযশও ছিলো একসময়; বাড়ি বাড়ি থেকে রীতিমতো ডাক আসতো। ওর ওই কূটকচালে নষ্ট স্বভাবই ওকে ডুবিয়েছে। এখন আর কেউ বিশ্বাস তো করেই না, বরং ওর নাম শুনলে লোকে ক্ষেপে যায়, বলে মাগী জ্যান্ত ডাইনী, পেটে বাণ মেরে বাচ্চা নষ্ট করতে না পারলে ওর নাকি ঘুমই আসে না চোখে।
প্রায় আপন মনে, কেউ শুনলো কি শুনলো না তার ভ্রক্ষেপ না করেই অনর্গল কথার তুবড়ি ফোটাতে থাকে সরুদাসী; একটা স্রোত—তোড়ের মুখে সবকিছু খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
অবাক হয় অনু। সরুদাসী নিজেই আশ্চর্য রূপময় এক জগৎ। তার সবকিছুই কমবেশি আকর্ষণীয়। গল্প বলার ভঙ্গি, হাত পা নাড়া, ঠোঁট উল্টানো, চোখ বড় বড় করে তাকানো, সবকিছুর সঙ্গেই বুঝিবা মখমলের (মালীরা কখনো দূরে যায়?) সুন্দর কোমলতা জড়িয়ে আছে। স্বপ্নের ভেতরে নিজেকে দোল খাওয়াচ্ছে সরুদাসী,—নিঃসঙ্কোচ, অনর্গল, সহজ, তীব্র, আবার আচ্ছন্ন।
বাঞ্ছারামপুরের কথা মনে পড়লো অনুর। রানিফুফুও কখনো কখনো অনর্গল কথা বলে, কিন্তু তার ভেতরে সত্যিই যেন প্রাণ নেই। খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ শেষ করে এই যে মুখে কথার খৈ ফোটাতে শুরু করে সারাদিন তার আর কোনো অন্ত নেই। সকলে কাজে ঢিলে দিচ্ছে, ফাঁকি দিচ্ছে, সংসারের ক্ষতি করছে এক ধরসে সবাই, একপাল কাজের মানুষের বিরুদ্ধে অন্তহীন তার অভিযোগ। চোখের সামনের জিনিস খুঁজে না পেয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠা, কারণে-অকারণে পরচর্চায় জুবড়ে পড়ে থাকা, রানিফুফু বলতে এই-ই বোঝায়। রানিফুফু বিধবা বলে মুখ নিচু করে সবাই নীরবে সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। রানিফুফু যখন তুচ্ছ একটা কারণে এইরে ঘরদোর নোংরা করে ফেললি কিংবা এ বাড়িতে অনেক বৌ শোবার সময় একটা করে কুলোয় না এইসব ঝাড়তে থাকে তখন রীতিমতো অসহ্যই মনে হয় সকলের কাছে। অন্যের দোষ ধরতে জুড়ি নেই ফুফুর, ভুলেও কখনো প্রশংসা করে না কাউকে, এক অন্য ধাতের মানুষ। তুলনা চলে না সরুদাসীর সঙ্গে, অনু মনে মনে হিশেব-নিকেশ করলো বহুভাবে।
একসময় তার বাঁ হাতের কনুয়ের কাছে একটা গেঁয়ো পিঁপড়ে কামড়ে দিলো। জায়গাটা ফুলে লাল হয়ে উঠলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। তাকে চুলকাতে দেখে সরুদাসী বললে, চুলকাচ্ছে বুঝি? ঠাকুর-দেবতা মানবি না তো হবে না ঐসব! ঠিক আছে, আমি ঘন্টাকন্নের কাছে প্রার্থনা করবো তোর জন্যে, দেখিস সব চুলকানি সেরে যাবে। জানিস, আমার বাবার মায়ের দয়া হয়েছে। লোহাগাড়িয়া বের হয়েছে সারা গায়ে। আমাদের খু-উ-ব চিন্তা।
হাসপাতালে যায় না কেন?
কেন, আমাদের কি ঠাকুর-দেবতা নেই নাকি? তুই না একটা জ্যান্ত বুন্ধু! তোকে শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষ করে নিতে গিয়ে আমার নিজের মাথাটাই না শেষ অব্দি খারাপ হয়ে যায়। তাতে অসুবিধে নেই, তুই খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে যাবি। নচ্ছার হরিয়াটা কি বলে জানিস? বলে খেলতে খেলতেই তো মানুষ সব শেখে।
অনু প্রতিবাদ করে বলে, পড়তেও হয়।
পড়ে ঘণ্টা হয়! পড়লে বুঝি সব জানা যায়? তুই জানিস কি করে জুতো সেলাই কত্তে হয়? কটা লোক ঠিকমতো জুতো সেলাই কত্তে পারে, বুকে হাত দিয়ে সত্যি করে বল দিকি। শ্রীনাথ জ্যাঠা তো সকলের মুখের ওপর পষ্ট করে বলেই। বলে কাজের কী জানিস তোরা, ফাঁকি মেরে কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে কাজ করছিস, একে জুতো সেলাই বলে না, গোঁজামিলের কাজ, জোচ্চুরি করে পয়সা নিচ্ছিস, জুতো সেলাই অতো সোজা নয়, শিখলি কবে তোরা যে পারবি, এইজন্যেই তো ঋষিদের ঘরে ভাত এমন বাড়ন্ত এখন।
অনু বললে, ও আর এমন কি কঠিন কাজ! ইশ, জুতো সেলাই কত্তে কত্তে বাবুর হাতে কড়া পড়ে গেছে কিনা, উনি সব জানেন! যত্তোসব হেঁদো কথা তোর। শ্রীনাথ জ্যাঠা ঋষিপাড়ার ফঁকিবাজ ছোড়াগুলোকে তো বলেই, বলে সব কাজই কঠিন, তাকে ভালোবাসতে হয়, নিজের মাগী করতে হয়, মাগী করলি তো ধরা দিলো, তোর যে মাগী সে তোরই জানা। পায়ের জুতো পায়েই থাকবে মাথায় উঠবে না কখনো—স্রেফ গোজামিল দিয়ে চালা, এই যদি তোর মনের কথা হয়, তাহলে শিখবিটা কেমন করে। পায়ের সেবা করলেই মাথা পাবি, মাথার মধ্যেই সব, মাথার মধ্যে বিশ্ব!
অনু বললে, আমাদের কুইনিনস্যারও এই ধরনের কথা বলেন।
সরুদাসী বললে, আচ্ছা বিশ্ব মানে কি রে?
তোমার শ্রীনাথ জ্যাঠা বলে নি?
চালাকি মারা হচ্ছে? জানিস না তাই বল। পড়লে কি আর সবকিছু জানা যায়, সেই কথাই তো বলছিলাম। নাভির ওপর কোন্ গাছের শেকড় রাখলে তাড়াতাড়ি বাচ্চা খালাস হয় বল দিকি, দেখবো কেমন সরেস তোমার ঐ হেঁড়েমাথাটি?
নিরুত্তর অনু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
বৃষ্টির শোঁ-শোঁ শব্দে কান পেতে এক সময় সরুদাসী প্রগাঢ় আচ্ছন্ন কণ্ঠে তাকে জিগ্যেস করলে, হ্যারে মনসাপাতা, আমাকে তোর কেমন লাগে সত্যি করে বল না।
খুব ভালো।
সত্যি করে বলছিস?
সত্যি!
দিব্যি?
তাই! তুই আমাকে বিয়ে করবি?
অনু একথার কোনো উত্তর না দিতে পেরে অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো।
বুঝেছি–দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সরুদাসী সকাতরে বললে, আসলে আমাকে তোর একরত্তিও পছন্দ নয়, একটা আস্ত মিথুক তুই। আর পছন্দ হবেই বা কি করে, বুঝি সব, আমরা তো আর বাবুজাতের মেয়েদের মতো চোখ কানের মাথা খেয়ে বেহায়াপনা কত্তে পারিনে। বুক উইঢিবির মতো উঁচ করে, পাছা দুলিয়ে, রঙ-চঙ মেখে, অন্যদের বোকা বানিয়ে মন ভাঙানো আমাদের ভেতরে নেই বাপু। আমরা যা—তাই!
অনু বললে, সত্যিই আমি তোমাকে পছন্দ করি, সত্যি বলছি।
মিথ্যে কথা, ডাহা মিথ্যে কথা!
একটুও মিথ্যে নয়!
তুই আমাকে ঘেন্না করিস!
বলেছে—
হরিয়া কিন্তু আমাকে ঘেন্না করে না।
আমিও করি না।
তুই একটা হাঁদু–রাঙামুলো!
বেশ তাই!
বাবুর বুঝি রাগ হলো? আচ্ছা আচ্ছা, আর বলবো না, এই ঘাট মানছি। তুই একটুতেই বুঝি চটে যাস, গায়ে মাছি বসতে পারে না—বাব্বাহ! আমি কি আর সত্যি সত্যিই তোকে রাঙামুলো বলেছি, ওতো ঠাট্টা। তোর সঙ্গে ঠাট্টা না করলে আর কার সঙ্গে করবো বল? তুই না আমার মনসাপাতা, গুলে খেয়ে ফেলেছিস বুঝি এরি মধ্যে?
তাতে হয়েছে কি?
তোর মাথায় শুধু গোবর। ইশ কি বিষ্টিটাই না হচ্ছে! যেন আকাশ ফুটো হয়ে গিয়েছে।
কি করে ঘরে ফিরবে?
দোলায় চেপে।
তার মানে?
বুঝলি না বুঝি?
সত্যিই বুঝি নি—
যাক অতো বুঝে কাজ নেই, যা সরেস মাথা তোর।
খিলখিল করে হাসতে হাসতে পাল্লার দড়ির গায়ে ঠেস দিলো সরুদাসী, তারপর হাসির দমক সামলে নিয়ে বললে, তোর কাঁধে চেপে, বুঝলি রে, গোবর-গণেশ কোথাকার!
বয়েই গেছে আমার—
কেন, তুমি বুঝি স্কন্ধকাটা, সেইজন্যে কাঁধে নিতে পারবে না? তবে লেজে বেঁধে টেনে নিয়ে যাবি!
হেসে উলটে পড়লো সরুদাসী।
পরে কি ভেবে আবার বললে, কিরে, নিয়ে যাচ্ছিস তাহলে কাঁধে করে?
ধরো নিয়েই গেলাম, তোমাকে বাড়ির কেউ বকবে না?
বয়েই গেল, বয়ে গেছে আমার ঘরে ফিরতে। কপালে যা আছে তাই হবে!
কি করবে?
তোর গলা জড়িয়ে ঐ চৌকিতে শুয়ে থাকবো। চলনারে, তোতে আমাতে শুয়ে থাকি!
তুমি যাও।
রাগ করেছিস বুঝি? গোবর-গণেশ বলেছি তাই? মনসাপাতাকে অমন অনেক কথাই শুনতে হয়। চলনা ভাই! বুঝেছি তোর লজ্জা করছে, কেউ এখানে দেখতে আসছে নাকি আমাদের? আমরা তো শুধু গলা ধরাধরি করে চৌকিতে শুয়ে থাকবো।
আজ থাক আর একদিন হবে—
ভয় করছে বুঝি?
না, তোমার গায়ে কেমন যেন আঁশটে গন্ধ। এত নোংরা থাকো কেন
তুমি?
সরুদাসী প্রায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললে, মরার কথা শোনো। গন্ধ আবার কোথায়! তোর নাকে গন্ধ। আমরা তো আর বাবুজাতের লোক নই। তোরা তো আমাদের চেয়ে অনেক নিচুজাত।
অনু ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি করে বলে, বললেই হলো আর কি!
তবে কি? সরুদাসী ভঁটো মেয়েমানুষের মতো খাড়া হয়ে মাজায় একটা হাত রেখে তর্জনী উঁচিয়ে বললে, তোদের ঠাকুর-দেবতা আছে? তোরা পুজো করিস? মরা মুরগি খাস? বল না, চুপ করে আছিস কেন?
অনু ঝট করে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললে, আমাদের জাত সব জাতের চেয়ে বড়।
সরুদাসী ধারালো কণ্ঠে বললে, অতোই যদি বড় তাহলে যেচে মিশতে আসিস কেন? কাদের জাত কতো বড় সে আমার খুব ভালো করেই জানা আছে, আমি কচি খুকি নই। কি ঝগড়াটে ছোঁড়া—ইশ!
অনু বললে, আমি আবার কখন ঝগড়া করলুম?
ন্যাকা! জাত তুলে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? যার যার জাত তার নিজের কাছে। তোর জাত নিয়ে কি আমি দুবেলা ধুয়ে খাবো, না তাতে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে? বলতিস এসব হরিয়ার কাছে তো জলবিছুটি দিয়ে ঝড়িয়ে আচ্ছামতো ঢিট করে দিতো। ওর প্যাদান একবারটি খেলে বাপের নাম আর মনে থাকবে না। যা, ভাগ এখান থেকে।
অনু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে নিতান্ত অসহায়ের মতো বললে, আমি তো তোমার জাত তুলি নি–
তা তুলবি কেন, সে সাহস থাকলে তো! শুধু আড়চোখে ঠারেঠোরে আমার পাছা দেখছিলি হ্যাংলার মতো, অসভ্য বাঁদর কোথাকার। পচা মায়ের পেটে জন্ম।
অনুর মাথায় রক্ত চনমন করে উঠলো একথায়।
এক পলকে একটা গজারির চেলা উঁচিয়ে সে ওর সামনে গিয়ে বললে, মা তুললে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, চুরমার করে দেবো মাথা!
সরুদাসীও একটা চেলাকাঠ হাতে তুলে নিয়ে এগিয়ে এসে বললে, ওরে মিনমিনে চাঁদমুখো শয়তান, তোর পেটে পেটে এতো বজ্জাতি! আমিও ছাড়বো ভেবেছিস, আমি কি ননীর পুতুল? কুত্তা কোথাকার। আগাপস্তলা চুরিয়ে দেবোমার না। মার না! মার না।
ভালো হবে না ভালো হবে না–
যাযাহ্!
আমি কিন্তু–
কতো না তোর মুরোদ, শুয়োর–
অনেকক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো অনু। কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে চেলাকাঠটা এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে সেই ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে বেরিয়ে গেল।
ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে গলা বের করে সরুদাসী চিৎকার জুড়লো, মর মর, মাথায় বাজ পড়ে মর! তুই আমার—তুই আমার মুড়োঝাটা! গয়েরখেকো, খ্যাংরা মারি তোর মুখে।
০৯. নিয়মিত স্যার আসেন
নিয়মিত স্যার আসেন; ইংরেজি শিখছে মা। সবকিছুই সেই আগের মতো। ঘরের ভেতর শয়তানের ঠাণ্ডা লাল চোখ। তোশকে ঘুষঘুষে জ্বর। ফরাশে দুঃস্বপ্ন। ফরাশে রক্ত। ফরাশে চৌচির হয়ে নিজের মৃতদেহ দেখতে পায় অনু।
হঠাৎ এ রকম করলো কেন সরুদাসী!
কদিন থেকে ক্রমাগত ভেবেছে সে, কোনো সূত্র কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় নি এ যাবৎ। কেবল মনে হয়েছে সরুদাসীর অনেক কিছুই উহ্য, অনুক্ত, সামঞ্জস্যহীন।
কোনোদিন তাকে এমন মর্মান্তিক নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয় নি।
সরুদাসীর সেই রুষ্ট ধারালো মুখের ছবির কথা মনে পড়লেই অনু কেন্নোর মতোই কুঁকড়ে যায়। রাগান্ধ গরগরে এক রাক্ষসের তাড়া খেয়ে গহন অরণ্যে বিপন্ন অনু পথ হারিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে রহস্যলোলুপ অনিশ্চিত এক কুহকে।
ব্যাকুল বিস্তীর্ণ দুপুর নিরাকার কষ্টের প্রতিকায় হয়ে বাইরে থেকে জানালার গরাদ ধরে অবসন্নের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অনুর মনে হয়। অবসাদ আক্রান্ত এই ছত্রাখান দুপুরের গা থেকে, সরুদাসীর রুক্ষ ভাসমান চেহারা থেকে, রক্তের প্রচণ্ড ভাপ উঠছে। করকর করকর জ্বালা করতে থাকে চোখ, মাথা ভারি হয়ে যায়; ফ্যাকাশে রুগ্নতা কি বিকট মুখব্যাদান করে থাকে!
পকেট বোঝাই রেজগি নিয়ে নিদ্রিত শয়তানের থাবা থেকে পা টিপে টিপে আবার বের হলো সে। মাঝে বন্ধ ছিলো বাইরে যাওয়া; আবার অনিচ্ছা ও জন্মান্ধ শাসনের সারি সারি উদ্ধত বর্শার ফলক টপকে বুক পেতে রাখা ধূলি-ধূসর উদাসীনতায় নেমে এলো।
হাম্মাদের দোকানের পেছনে ফালানি, ফকিরা, গেনদু, মিয়াচাঁন, লাটু, সবাই আছে, কেবল টোকানিকে কোথায় দেখা গেল না।
গেনদু বললে, কই থাহচ, কিরে তরে দেহি নাক্যান?
অনু সংক্ষেপে বললে, জ্বর হয়েছিলো!
ইচ! চ্যারা অক্করে পানিৎ পচা ট্যাংরার লাহান আউলাইয়া গ্যাছে তর। মাজারে হিন্নি দিচস?
না। শাসাব বাইৎ গেচস?
না।
হাতে শুঁয়োপোকা লেগেছিলো গেনদুর, হাতের পাতায় ঘসঘস করে ডুমুরপাতা ঘষতে ঘষতে বললে, তগো এলায় জাইত-ধর্ম কিছুই নাই!
মেথির গূঢ় গন্ধে মৌ-মৌ করছিলো চতুর্দিকে। হাম্মাদের নাক ডাকানি স্পষ্ট কানে আসে। অন্যান্য দিনের মতোই পরম নিশ্চিন্তে অকাতরে ঘুমোচ্ছে হাম্মাদ। দোকানের ভেতরের বাঁশের ঝালিতে রাখা কচুপাতার মোড়ক থেকে পিঁপড়ের একটা বহর বাইরের দিকে বয়ে চলেছে, তাদের মুখে সুজির গুঁড়োর মতো ডিম।
গেনদু বললে, বুঝচস কি অইতাচে? এলায় হাম্মাদের পো হাম্মাদের অক্করে তেরোডি বাইজা গ্যাছে। পিরপাগুলি ক্যামুন ব্যাব্যাক আণ্ডাটি ফিরত লয়া যাইতাচে চায়া দ্যাখ!
ভালো লাগলো না অনুর। হেঁড়া অংশটুকু কিছুতেই অর জোড়া লাগতে চায় না, বিশ্রী একঘেয়ে মনে হয়। তাদের অগোচরে অন্যদিকে সরে পড়লো সে সুযোগমতো।
এমন সব দুপুরে দার্জিলিংয়ের গল্প করতো মা।
সাধারণত যখন খুব গরম, বুকের ছাতি ফাটানো রোদ বাইরে, ঘরের ভেতরেও আগুনের হলকা, মনের রাশ আলগা করে দিতো মা। এইসব গরমের দিনে ফ্রিজ থেকে বের করে আনা বরফ গালে গলায় বুলানোর চেয়ে দার্জিলিংয়ের গল্প তার ভালো লাগতো। কাঞ্চনজঙ্ঘার গল্প তো ছিলোই সেই সঙ্গে বাংলোর বুড়ো দারোয়ান বিজয়বাহাদুর থাপাড়ের রোমাঞ্চকর সব বৃত্তান্ত। বিজয়বাহাদুর যৌবনকালে যখন শেরপার কাজ করতো তখন নাকি সে স্বচক্ষে বরফের ওপর বারোফুটের এক তুষার মানবকে ছুটে যেতে দেখেছিলো।
সব কথা ঠিকমতো মনে পড়ে না এখন।
ধীরে ধীরে গুলিয়ে যাচ্ছে সবকিছু, স্বাদহীন হয়ে যাচ্ছে, আগের ক্লাসের বয়ের মতো সব যেন পাণ্ডুর, নিরর্থক।
এখন সে সরুদাসীকে রীতিমতো ভয় পায়। সেধে দেখা করতে যাওয়ার সাহস তার নেই। কেবল একটা ইচ্ছে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো বারবার পাক খেয়ে কালো অন্তরালের ছেঁড়াফোঁড়া খেদ, বিবর্ণ ভীতি, যাবতীয় জঞ্জাল, ফরফর করে ওড়াতে লাগলো; ইচ্ছেটা এই—জরাজীর্ণ চিৎপাত দুপুরে তন্নতন্ন করে সরুদাসীকে খোঁজা। নির্দিষ্ট কিছু একটার মধ্যে ডুবে থাকার জন্যেই কতকটা। ঠিক ইচ্ছে নয় তাকে খুঁজে পাবার, মুখোমুখি হবার, অথবা ভাব জমিয়ে কথা বলার। বারবার আকুলভাবে তার মনে হতে থাকলো সরুদাসীর সেই রুক্ষ মলিন চেহারা, ছেঁড়া ময়লা কাপড়, কোমরের কড়িবাঁধা লাল ঘুনসি, ইত্যাদি সব; পরাক্রান্ত দুপুরের লোভী হাত কিভাবেই সে সব গেড়ে ফেলেছে মাটিতে।
হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না সরুদাসীর সঙ্গে। সরুদাসী যেন একটা কি।
দিগন্তজোড়া কোন জালের ভেতর থেকে প্রাণপণে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে অনু।
একা একা বাগানে ঘোরে।
সব বাগানই এক একটা ছায়াচ্ছন্ন ইচ্ছের প্রতিকৃতি। বিন্যাসের কোনো অভাবই তাকে পীড়া দেয় না। সব বাগানেই মনে হয় কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি গোপন করা আছে। ভরে আছে কমলালেবু, পাকা আলুবোখারা আর স্কোয়শ ফলের গন্ধে।
এক সময় শুনতে পায় অভিশপ্ত ঘুঘুর ডাক আর রৌদ্রদগ্ধ চিলের পিপাসার্ত চিকার। তার নির্জন অন্ধকারে দানা বাঁধতে না পারা সব ধূসর আক্ষেপ-রৌদ্রের হিংসায় ফুঁসে ওঠা তপ্ত বাতাসের হাহাকারে আর দিঘিরটলটলে নীল দুঃখের মতো পাখিদের নির্জন আর্তনাদের দিমণ্ডলে নিঃশব্দে মৃত্যুর মতো পরিব্যাপ্ত হয়ে যায়।
এখন সরুদাসী এক নির্জন কষ্টের নাম। তার মনে হলো সে যেন দড়াম করে বাজপড়া একটা কালো কুচকুচে প্রচণ্ড শব্দ নিয়ে দিকভ্রান্তের মতো খেলছে; কোনোদিনই পৃথিবীতে সরদাসীকে পাওয়া যায় না। পোড়া ঘাসের আস্তরণে পড়ে থাকা কলাগাছের শুকনো বাসনায়, নোনাধরী পুরোনো পাঁচিলের গায়ে ঘুটের চিমসে গন্ধে, মেচেতা পড়া আকাশে,—তার স্নান নাম লিখে গিয়েছে সরুদাসী। সুচারু আনন্দের গোপন তহবিলগুলো তসরুফ করে সে চিরকালের মতো উধাও হয়ে গিয়েছে।
সারা দুপুর টো-টো ঘুরে, ঘোড়ার মতো গলায় ঝালর দোলানো বাতাসের কাছে, সন্ধানী আলোর কাছে, সে শুধু সেই একফোটা সদাসীকে রুজু করে বেড়ালো।
এক সময় টোকানির সঙ্গে দেখা পথে।
হাতে তুরপুণ আর র্যাদা নিয়ে শুকনো মুখে একই পথ ধরে আসছিলো সে। অনু দাঁড়িয়েছিলো ঝুরিওলা গম্ভীর বুড়োবটের নিচে। উপরে শকুন ডাকছিলো বিশ্রীভাবে, আর ঝটপট ঝটপট ডানা ঝাপটানি।
তাকে দেখে টোকানি বললে, খারায়া খারায়া করচ কি? এমনিই দাঁড়িয়ে আছি, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
টোকানি মুখ খারাপ করে বললে, বাপ হালায় এগুলি বেচবার দিচে, অহনে কি করি ক-তো, হালায় হিয়ালের পোরা লইবার চায় না, কয়কি চুরি কইরা লইয়াইচস বুবি।
বিক্রি কেন?
টোকানি বিরক্তি উগরে বললে, বাপ এলায় এক হপ্তাথন বেমারিতে পইড়া রইচে, খায়ালয়া বাঁচতে অইবো তো!
অনু খুব অবাক হয়। এই মুহূর্তে টোকানির চোখে-মুখে দুঃখের ময়লা ছাপ সুস্পষ্ট ধরা যায়। তার সারা মুখমণ্ডলে উৎকট বিরক্তি আর যন্ত্রণার ধার অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ব্রিং খেলার সময় এইসব মুখচ্ছবি এক অবিশ্বাস্য ইন্দ্রজালে ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
কি, হয়েছে কি তোমার বাবার?
কী আবার অইবো, যা অওনের তাই, চিকি! হাসপাতালে দাও নি কেন? টোকানি বললে, অইবোটা কি হুনি? হায়াৎ থাকলে এ্যামনেই ফরফরাইয়া চাঙ্গা হয়া উটবো।
অনু সহানুভূতির সুরে বললে, আমার কাছে কিছু পয়সা হবে, লাগলে দিতে পারি।
ঈমানে? তর রহম পোলা দেহি নাই, হচাই, কসম কইরা কইতাছি টোকানি ব্যাকুল হয়ে বললে, আল্লায় তরে হায়াৎ দেউক।
দুটো আধুলি পকেটে রেখে বাকিগুলো সব টোকানির হাতে দিয়ে দিলো। অনু।
টোকানির চোখজোড়া মুহূর্তেই উজ্জ্বল আধুলি দুটোর চেয়েও চকচক করে উঠলো। তার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললে, আল্লায় দিলে তগো কিছু কমতি নাই, ঠ্যাকা-বেঠ্যাকা নাই, আমগ য্যামুন ফুডা নসিব, আধুলি দুইডা দিয়া দে বন্দু—কিরা করা কইতাছি গরে এউগা দানাও নাইক্কা!
আধুলি দুটো ওর প্রসারিত হাতে দিয়ে অনু বললে, চলো না, তোমাদের ঘরটা দেখে আসি।
টোকানি খুব খুশি হয়ে বললে, হাচা কইতচিস?
রেললাইন পার হয়ে বেশ অনেকদূর যেতে হয়। জলাভূমির মাঝখানে এখানে-ওখানে উঁচু-উঁচু ঢিবি, পথে তিন-তিনটে বাঁশের সাঁকো। খানা খন্দের পাশে টোকানিদের ঘর। সারি সারি অনেকগুলো খুপরি। সর্বত্রই আবর্জনার স্তুপ আর ভাঙা প্যাকিং বাক্সের পাহাড়। কয়েকটা ন্যাড়ামুড়ো সুপুরি গাছ শূলের মতো আকাশকে বিধছে; বিধ্বস্ত রাজপাটের বধ্যভূমির শেষ চিহ্ন ওগুলো, তাই মনে হয় অনুর।
টোকানির মা তাদের একচালা ঘরের কাদা থুথুকে উঠোনে বসে হিঞ্চা বাছাই করছিলো। সব মিলিয়ে দুটাকা চার আনার মতো দিয়েছিলো অনু টোকানিকে। টোকানি তার মার হাতে পাঁচসিকে পয়সা গুঁজে দিয়ে বললে, কর্জ কইরা আনলাম, ঐগুলি কেউ লইবার চায় না।
ঘরের ভেতর চৌকির ওপর মশারি খাটিয়ে তার ব্যাধিগ্রস্ত বাবা শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছিলো। টোকানিকে কি একটা গাল দিলেও স্পষ্ট শুনতে পেলো না অনু। উঠোনের এক কোণে ছোট্ট একটা ঘ্যানঘেনে মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে চোখ-নাক ভাসিয়ে আপন মনে নাকিসুরে কেঁদে চলেছে।
টোকানি বললে, তুই অহনে যা গিয়া, কাউলকা দেহা অইবো।
কিছুদূর এগিয়ে এসে অনুর কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে ভারাক্রান্ত গলায় পুনরায় বললে সে, ট্যাকাটার কথা মনে থাকবো আমার। যহন রিশকা চালান দরুম তগো সবতের সব পসা হিশাব কইরা অক্করে পাইতক দিয়া দিমু!
চালার ভেতর থেকে টোকানির বাবা করকরে গলায় হঠাৎ চিৎকার জুড়ে ওর মাকে উদ্দেশ করে বললে, হড়ি-হাবাইতা পোলার খেতায় আগুন, খেদায়া দাও হালারে, লাশ বানায়া দিমু জুতায়া!
টোকানি মুষড়ে পড়ে বললে, তগো বাপে এ্যামুন কয় নিকি, হালায় হেটের মদে যেমুন ঘুড্ডির মাজা দিয়া লইচে!
কি বলবে অনু, বোকার মতো টোকানির দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
টোকানি ছলছলে চোখে তার একটা হাত চেপে ধরে ধরাগলায় বললে, বহাইতে পারলাম না বন্দু, দেখলাইতো আমাগো সব, নিজেগই দানাপানি নাই তো তরে আর কি খিলামু!
টপটপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো টোকানির চোখ দিয়ে। ঘা খাওয়া গরুর মতো বড় বড় ভিজে চোখজোড়া অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো সে।
দুপুর সরে গিয়ে সেই কখন বিকেল নেমেছে।
এখন কোথায় যাবে!
কোথাও কেউ নেই।
সারা পৃথিবীর মানুষ দরোজা বন্ধ করে এখন ইংরেজি শিখতে গিয়েছে।
তাদের চাকরি চাই।
পালাতে হলে চাকরি চাই।
গেন্দু, মিয়াচাঁন, ফালানি, নেই এরাও। যখন খেলার পাট উঠে যায়, ওরা এক একজন একে অপরকে আড়াল করে ঝোপ-ঝাড়ের নিচে মাটিতে কোথাও ঘুঘুতে ডিম পেড়েছে কিনা তাই ছুঁড়তে বের হয়, কখনো মোহরের ঘড়া পাওয়া যাবে এই আশায়। নিচে মোহরের ঘড়া না থাকলে ঘুঘু কখনো মাটিতে ডিম পাড়ে না ওরা তা জানে; তলে তলে ভাগ্যকে বদলাতে সকলেই উদগ্রীব।
ক্লান্ত হয়ে পড়লো অনু এক সময়। ভালো লাগলো না আর। কি বিস্বাদ সবকিছু, কি তেতো, বিষাদময়; সব আনন্দ সুতোকাটা ঘুড়ির মতো টাল খেয়ে খেয়ে হাওয়ার উজানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে।
ফিরতে ফিরতে সেই একটি বোধই আগের মতো তার মাথার ভেতরে খোলানো শুরু করলো; পৃথিবীতে কোনো কষ্টের বিনিময়েই সরুদাসীকে পাওয়া যায় না। সরুদাসী লামাদের কিংবা তাদের সাজানো বাগানের কোনো ফুলের গর্ভকেশরে মিশে নেই; আপন স্বভাবেরই এক স্বপ্নকমল, যত্নের, কৌতূহলের, সুখ অথবা দুঃখের কোনো কিছুরই অপেক্ষা রাখে না সে; রাত্রি যেমন রজনীগন্ধার, ঠিক তেমনি প্রশান্ত দিবালোকে ফুল হয়ে ফুটে থাকে সরুদাসী, যার স্তবকে স্তবকে স্নিগ্ধ করুণা, যার গর্ভকেশরে অণু পরমাণু হয়ে মিশে থাকে উদ্ভ্রান্ত পাখির সকরুণ গান।
অনুর মনে হয় স্বপ্নের ভেতর থেকে পরিশ্রান্ত পাখির ঝরা পালক উড়ছে আকাশময়।
বিশ্বব্যাপী অপার নিস্তব্ধতা।
কি দুঃখিত কি নিগৃঢ় এই সন্ধ্যা।
বাড়িতে ফিরে এই প্রথমবারের মতো অনু মার সামনে পড়লো।
কোন্ চুলোয় যাওয়া হয়েছিলো?
বাইরে—
বাইরে কেন?
সাপ খেলা দেখতে গিয়েছিলুম! ইচ্ছে করেই মিথ্যে বললো সে।
বেশ বেশ, ঐসব করেই বেড়াও। দেখতে না দেখতে বেশ লম্বা হয়ে যাচ্ছে তোমার পা।
একটু পরে আবার বললে, মন্টু মঞ্জু সবাই তোর জন্যে সেই কখন থেকে হা-পিত্যেশ করে বসে আছে, ঘরে গিয়ে দেখগে যা!
মন্টু মঞ্জু গোর্কি ট্যামবল খুব ঘটা করে শোরগোল বাধিয়ে শ্যাডোজএর রেকর্ড বাজাচ্ছিল। অনুকে দেখে সবাই একযোগে হৈহৈ করে উঠলো। গোর্কি বললে, হাই, কোথায় ছিলি এতোক্ষণ, সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি আমরা।
অনু একথার কোনো জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না, কেবল বাণীখালার কথা জিগ্যেস করলো।
মঞ্জু বললে, মা তো নিচের ঘরে বসে, কখন টিভি শুরু হবে সেই অপেক্ষায় সময় গুনছেন। আজ নাকি ওরা র্যাডিশের আচার শেখাবে।
মন্টু সখেদে বললে, ড্যামিট, ইশ, কি পুওর কালেকশন রে বাবা, একটাও যদি পপটপ থাকে!
অনু বললে, সঙ্গে আনলেই পারতিস!
ভপ্! খুব বড় বড় কথা আওড়ানো হচ্ছে।
অনু বললে, বাব্লগাম!
ইউশাটাপ! মঞ্জু পটাপট জিগ্যেস করা ধরলো, ভিবজিওর সায়েনারার মানে কি, সিন কোনারি কে, বিটলদের চারজনের কার কি নাম, ইত্যাদি।
অনু সবগুলোর জবাব দিয়ে বললে, প্লাটার্স দলের কার কি নাম, হিরোশিমায় পড়া এ্যাটম বমের ওজন কতো ছিলো, এখন বল দেখি!
গোর্কি আর ট্যামবল মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। মন্টু হাঁ হয়ে গভীর আগ্রহে গোল্ডফিশ আর ব্ল্যাকমলির খেলা দেখতে শুরু করলো। একটু পরে বললে, লুক এ্যাট হিয়ার, গাপ্পিটাকে দ্যাখ, কি মিষ্টি!
ট্যামবল বললে, কিউট!
বুঝলাম–অনু বললে, ঠিক আছে স্টাইন দিয়ে দুটো নাম বল।
মঞ্জু বললে, এগুলো কোনো প্রশ্ন হলো—ট্রাশ।
ট্যামবল ঢোক গিলে অতিকষ্টে বললে, আইনস্টাইন, আর একটা যেন কি–
মঞ্জু নিচের ঠোঁট কামড়ে বললে, পেটে আসছে তো মুখে আসছে না—
অনু বললে, আসবে কি করে, বিদ্যেয় জাম হয়ে আছে যে চ্যানেলটা!
নিজে বলো দিকি ম্যান! ট্যামবল অবিশ্বাসের সুরে বললে।
আইনস্টাইন আইজেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, আরো কতো শুনতে চাস, বাবলগাম বাবলগাম বাবলগাম।
গোর্কি বললে, অলরাইট অলরাইট ম্যান, কতো ধানে কতো চাল নেকস্টটাইম বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, এই মাসেই আমরা এগেন হামলা করবো, উড়িয়ে দেবো না তখন।
অনু বললে, পচামার্কা টিভি দেখতে দেখতে তোদের টিবি হয়ে গিয়েছে, এখনো সময় আছে, চিকিৎসা করা। স্রেফ লুসি ডেঞ্জারম্যান আর ফিউজিটিভ দেখে কি আর বুদ্ধি পাকে?
মঞ্জু বললে, তুমি না একেবারে আঁটি পর্যন্ত পেকে গেছ, টুপ করে খসে পড়াটা শুধু বাকি তোমার—ফ্যাগোট!
ঐ পর্যন্তই। বাদানুবাদ আর বেশিদূর গড়ালো না। বুঝতে পারে তার নিজের কাছে এদের আর কোনো আকর্ষণই নেই, ভেতরে ভেতরে কি তীব্র বিরাগই না তার জন্মে গিয়েছে। কোনোমতেই সে সহ্য করতে পারছিলো না ট্যামবলদের। শুধুমাত্র ইস্ত্রিকরা দামি কাপড়ের মড়মড়ে ভাঁজ অতিকষ্টে বজায় রাখার জন্যেই ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। অন্যকে ঠকানো বোকা বানানো কিংবা চমকে দেওয়াটাই ওদের আনন্দ লুটবার একমাত্র রাস্তা; বিকল্প কোনো রাস্তা ওদের কল্পনারও বাইরে। যখন যতোটুকু খিদে থাকে স্বস্তি পায়, ঠিক ততোটুকুতেই যারা তুষ্ট সে তাদের ভালোবাসে—কথাটা আজই এই প্রথম তার মনে উঁকি দেয় চকিতে। এ যেন আপন প্রয়োজনেই প্রায় অগোচরে তৃষ্ণা মিটিয়ে নেওয়া, যা এমন কিছু মহান নয়, কিংবা গল্প নয়; অন্যদের বোকা বানানোর কোনো হীন উদ্দেশ্য থাকে না তাতে। মন্টু মঞ্জু গোর্কি ট্যামবল এরা সবাই যেন কি—
জটিল আচ্ছন্নতায় ক্রমাগত কুণ্ডলি পাকাতে থাকে অনু। অগোচরে, বুঝিবা সম্পূর্ণ নিজের মতো এমন এক নিরাকার হিরন্ময় জগৎ নির্মাণ করতে চায় সে, যেখানে নাম না জানা গোত্রহীন তুচ্ছ কষ্টের আবেদনগুলোও অতি সহজে অঙ্কুরিত হতে পারে।
নিজেকে কিছুতেই সনাক্ত করতে পারে না অনু। কখনো চৈতন্যের প্রখর এক রশ্মি চাবুকের মতো কশাঘাত করে আবার মিলিয়ে যায়। কখনো হেঁয়ালির অন্তর্লোকে দুর্বল অসহায়ের মতো মুঠো পাকাতে থাকে। হাঁসফাঁস হাপরের মতো দিনগুলোর কাছে জমে উঠেছে অপরিসীম ঋণের পাহাড়, স্বরাচ্ছন্নের মতো এইসব মনে হয় অনুর। এই হাঁসফাঁস হাপর থেকে, হানাদার হওয়া থেকে, কালবৈশাখীর কামদ উল্লাস থেকে, কিংবা রক্তাক্ত রত্নাভরণের মতো সন্ধ্যারাত্রি থেকে, বধ্যভূমির হাহাকার ছিনিয়ে নিয়ে তার আপন জগতের সভ্যতাকে নিরন্তর এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সে; যেন ধরে নিয়েছে বিশাল পৃথিবীর মাঝখানে ঘরজোড়া ঘেরাটোপের নিচে আত্মগোপনের অর্থই হলো টুটি টিপে অন্ধ বধির ঘাতকের মতো নিজেকে হত্যা করা।
বাণীখালা সাধারণত খুব কম আসে, কিন্তু হঠাৎ যেদিন এসে পড়ে সেদিন মনে হয় ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে আসে নি।
সে নিচে গিয়ে দেখা করলো।
বাণীখালা মার সঙ্গে কাঠমুন্ডু যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছিলো। বললে, যাসনে কেন, দিন দিন আমাদের কথা ভুলে যাচ্ছিস, বস এখানে!
তারপর পুনরায় সেই কাঠমুন্ডুর প্রসঙ্গ।
আমি ভাবতেও পারি নি ওরা আমাকে এভাবে ঠকাবে। যে স্মোকি টোপাজ দুশো টাকা নিয়েছে এখানেই তার দাম ষাট-সত্তর টাকা। সবচেয়ে বড় ঘাই মেরেছে তোর সোনার চাঁদ দুলাভাইকে। আমি হাজারবার পৈপৈ করে বারণ করলাম, উনি কানে তুললেন না। বেশি চালাক কিনা, বললেন। দুশো টাকায় ক্যাটসআই পাওয়া যাচ্ছে, হাতছাড়া করাটা নিছক বোকামি। এখন বোঝে, যাবে না টাকাটা গচ্চা। ঢাকায় ফিরে যে কটা জহুরিকে দেখানো হলো সবাই বললে পনেরো থেকে বিশ টাকা দামের মুনস্টোন। লাভ করতে গিয়ে মধ্যে থেকে হড়হড় করে এককাড়ি টাকা বেরিয়ে গেল। বেফায়দা!
অনু মার মুখের দিকে তাকালো। মা হাসছে।
বাণীখালা চটে গিয়ে বললে, বিশ্বাস হলো না বুঝি?
অবিশ্বাসের কি আছে এতে–মা পরিষ্কার গলায় বললে, হাসছি এই জন্যেই যে উচিত শিক্ষাই হয়েছে বেশি লোভ করতে গিয়ে!
তা আর বলতে! দুদিনে ঘুমোতে পারি নি আমি তা জানিস? আমার ননদ ব্যাঙ্কক থেকে প্যাগোডার চূড়ামার্কা প্রিন্সেস রিং আর হ-য-ব-র-ল কি কোথায় সব আনার পর থেকে দেমাকে ফেটে পড়ছে সবসময়, পা পড়ছে আর মাটিতে। ভাবলাম সবাই তো কাঠমুন্ডু গেলে কিছু না কিছু নিয়ে আসে, আমাদের ভাগ্য যে এরকম ফুটো হবে আগে কি আর তা বুঝতে পেরেছিলাম। ঠকেছি ভালোমতোই। তোকে বলতে তো আর কোনো লজ্জা নেই, চারশো টাকা দিয়ে রুবিও এনেছিলাম, শুনলে অবাক হবি ওটাও যাচ্ছেতাই নকল, একেবারে ঠগের মুল্লুক!
মা হেসে বললে, তুমিতো এখানেও কম ঠকো না। ওটা তোমার ধাত। কেন এতোদিন ধরে এই যে বেদেনীদের কাছ থেকে সস্তায় কাঁড়ি কাঁড়ি পিংকপার্ল কিনলে কি কাজে লাগাতে পেরেছো শুনি, নিছক পয়সা নষ্ট না?
তা যা বলেছিস, শুধু লোকসানই দিয়ে আসছি! সখের খেসারত। এবারে কি ভেবেছি জানিস? ওসব হিজিবিজি সখ বাদ দিয়ে বড় দেখে ডায়মন্ড কিনবো, ব্যাস্! এই নাক কান মলা, অন্য কিছুতে আর যাচ্ছিনে বাপু, ঢের সখ মিটেছে, আর নয়!
নিজেকে অপাঙক্তেয় মনে হলো অনুর। সে উপরের ঘরে চলে এলো কিছুক্ষণ পর।
ট্যামবল বললে, আমার এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে যে এ্যাঞ্জেল আছে না সেটা দেখলে তুই তোর এই ঘাঁটিগাঁইয়া ছান্দা মাছের মতো এ্যাঞ্জেলকে ছুঁড়ে ফেলে দিবি, সেটা কুইন এ্যাঞ্জেল। তোর সব মাছই কমন। আমার আর এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে টেট্রার যে ভ্যারাইটি আছে, ম্যাড হয়ে যাবি দেখলে!
অনু জানালার ধারে দাঁড়ালো।
কি গুমোট আকাশ! প্রচণ্ড গরম। দুদিন ধরে রেডিওতে একনাগাড়ে চিৎকার শোনা যাচ্ছে কক্সবাজার থেকে সাড়ে আটশো মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে; এখন বিপদ সঙ্কেত জানাচ্ছে ঘনঘন। ক্রমশ সরে আসছে ঝড়। হাঁপিয়ে উঠলো অনু।
আব্বা ঘরে ফিরলেন এক সময়।
টেলিভিশন শেষ হলো।
সবাই একজোট হয়ে আসর জমালো অনুর ঘরে। অনু নিতান্ত অসহায়ের মতো বসে রইলো একপাশে। তার মনে হলো মিথ্যা চক্রান্ত করে অকারণে জবাবদিহির জন্যে তাকে এ ঘরে ধরে রাখা হয়েছে।
বাণীখানা আব্বাকে উদ্দেশ করে সাগ্রহে বললে, নতুন কিছু শোনান, বহুদিন পর লেজ ধরা গেছে আজ, কখন থেকে আপনার জন্যে বসে আছি–
আব্বা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে তাঁর সেই ধরাবাঁধা গতে শুরু করলেন, যা দিনকাল পড়েছে, ভাবাও যায় না, মনে হয় আমি নিজেও একজন ক্রিমিন্যাল। আসল কথা এই অতি অগ্রসরমান মানুষের কাছে সবকিছু এমন গতানুগতিক এমন শাদামাঠা মনে হচ্ছে যে নতুনত্বের খাতিরে অভিনবত্বের প্রয়োজনে কোনো একটা কিছু না করা অবধি সে তার মনের মুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। নিত্যনতুন ক্রাইমের পেছনে স্বতন্ত্রভাবে মানুষের এই মোটিভ কমবেশি কাজ করছে। এর একটা কারণও আছে, সভ্যতার বিবর্তনের সাথে তাল রেখেই আমাদের ভেতরের সেই অতি পুরোনো পাথুরে বাটিটার আকারও অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। আজ সে আরো বেশি পেতে চায় নিজের মধ্যে, কেননা খোলের ভেতর ধরে রাখবার পরিসরও তার বেড়ে গিয়েছে। আসলে সবকিছুই অতি অগ্রসরমান সভ্যতার সেই ষোলকলায় পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা। আমার প্রতিবেশী জেড আহম্মদ সাহেবের শ্যালকের কথাই ধরা যাক না কেন। বেশ কিছুদিন হলো বন্দুকের গুলিতে সুসাইড করেছেন ভদ্রলোক। মোটিভ কি, না ব্যর্থতা! বেচারার ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছিলো তিনি। নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, ব্যাস্। অথচ গাইয়ে হিশেবে যথেষ্ট খ্যাতি ছিলো ভদ্রলোকের। সবসময় লাহোর-করাচি করে বেড়াতেন। পিপলস চায়নায় গেছেন ডেলিগেশনে, রাশ্যায় গেছেন, কি কোথায় সব বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু খেতাবও পেয়েছিলেন। পরে জানা গেল সেখানেও ওই একই ব্যাপার। ঐ যে বললাম, যোলকলায় পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা।
বাণীখালা বললে, অন্য কোনো কারণও তো থাকতে পারে?
তদন্তের যে রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে তা থেকেই সব পরিষ্কার ধরা পড়েছে–অনু দেখলো আরামে গা ঢেলে উত্তরোত্তর উৎসাহিত হয়ে পড়ছেন আব্বা—ভদ্রলোক ডায়েরিও মেনটেন করতেন, সেখানা আমি নিয়ে এসেছি ভালোমতো স্টাডি করবো বলে। খুবই ইন্টারেস্টিং। দুএকটা পাতা পড়ে শোনাচ্ছি। আমি আন্ডারলাইন করেছি বিশেষ কতোগুলো জায়গায়, মনোযোগ দিয়ে শুনুন,—তিনি পুনর্বার দেখা দিলেন, কহিলেন, আর কতোকাল দরবারী ভৈরবী মল্লার লইয়া পচিয়া মরিবে, উহাতে আর বিন্দুমাত্র রস অবশিষ্ট নাই, তোমার পূর্বে বহু শতাব্দীব্যাপি নানাজাতের হাহাপুঙ্গব উহার যাবতীয় রস নিংড়াইয়া লইয়াছে,—খেয়াল করে যান ভালো করে। অন্য এক জায়গায় লিখেছেন—ওরে মূখ, রাগাবলীর নিবিড় অলংকরণে অদ্যাবধিও গমকের আশ্রয়ে মিথ্যা সুরের জলাঞ্জলি দিয়া অযথা নিঃশেষিত-প্রায় তুই, অলঙ্কার উহার দুষ্টক্ষত বিশেষ, দেখিতেছ না অলঙ্কারের ভারে লম্পটের রক্ষিতার ন্যায় রাগাবলীর প্রাণ কী ওষ্ঠাগত। যাহারা শক্তিমান, সৃষ্টির নৈপুণ্যে অতুল, তাহারাই কেবল দেহ-মন-প্রাণ দিয়া শিল্পের নবজন্ম যাজ্ঞা করে, তাহাদের ধর্ম তাহাদের কর্ম তাহাদের বর্ম গতানুগতিক প্রবহমানতার ঋজু বলিষ্ঠ বিরুদ্ধাচরণ, অতঃপর তিনি হাপুস নয়নে ক্রন্দন করিতে লাগিলেন, এই দৃশ্য অবলোকন করত আমিও শোকে ভূলুণ্ঠিতা বাল-বিধবার ন্যায় নিদারুণ মর্মভেদী বিলাপে সাতিশয় মগ্নতাপ্রাপ্ত হইলাম। বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না নিশ্চয়ই, তারপর আরো লিখেছেন,—তাঁহার রাগান্ধ রক্তচক্ষুর সম্মুখে আমি বিশুষ্ক তৃণবৎ ভষ্ম হইয়া গেলাম, তিনি সবেগে পদাঘাত করিয়া কহিলেন, নরাধম, তোর গতি নাই, তোর বিকাশ নাই, তোর ব্যাবৃত্তি নাই, অনুগম নাই, আমি চলিলাম, পুনর্বার দর্শনের সৌভাগ্য হইতে রে হতভাগ্য তোকে বঞ্চিত করিলাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তিনি আর কিছুই নয়, সেই ষোলকলার পূর্ণ বাটির যন্ত্রণা। একটু ভালো করে খতিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে যায়। এই সবেমাত্র আমরা কালার মিউজিকের যুগে পা দিয়েছি, অথচ প্রায় তেইশশো বছর আগে এর সম্ভাবনার কথা বলে গিয়েছেন অ্যারিস্টটল। কই এই তেইশশো বছরের মধ্যে এ ব্যাপারে অত্যুৎসাহী কোনো সঙ্গীত সাধক তো ব্যর্থতার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে নি। আসলে প্রবৃত্তির প্রবল তাড়নায় ভদ্রলোকের বাহ্যজ্ঞান ভেদজ্ঞান সবই সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়েছিলো। অর্থাৎ এক ধরনের লোভের তাড়নায় তিনি মাত্রাজ্ঞান পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে ফেলেছিলেন। সস্তা হাততালির লোভ নয় ঠিক, বিখ্যাত হবার লোভ। চেয়েছিলেন নতুন কোনো দরোজা উন্মুক্ত করে সঙ্গীতের জগতে কোনো একটা বিপ্লব ঘটাতে। ভদ্রলোকের জন্যে সত্যিই করুণা হয়। বেচারার এগো নির্বিরম বাসনার দোর্দণ্ড প্রতাপে মার খাচ্ছিলো, পথ করে নিতে পারছিলো না নিজের; অথচ দ্বন্দ্বসঙ্কুল এই পৃথিবীতে বাস করতে হলে যতো ব্যথাই সে পাক না কেন যতো কষ্টই সে পাক না কেন নিজের অস্তিত্বের জন্যে সন্তোষজনক একটা রাস্তা তাকে খুঁজে নিতেই হবে। পৃথিবীর আলো-অন্ধকার, দুঃখ-আনন্দ, জরামৃত্যু, শোক, সবকিছুর মাঝখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে এইভাবেই এগিয়ে আসে সুপার এগো। এইভাবে পরিত্রাণ মেলে মানুষের। কিন্তু ঐ ভদ্রলোকের ভাগ্যে তা আর ঘটে নি, আসলেই ভয়ঙ্কর রকম চরমপন্থী। নির্বিকার বুদ্ধিই হলো চৈতন্য আর সবিষয় চৈতন্যই হলো বুদ্ধি; কিন্তু ভদ্রলোক চৈতন্য ও বুদ্ধির কোনো প্রভেদই ধরতে পারেন নি, গুলিয়ে ফেলেছিলেন সব। শেষের দিকে প্রায় উন্মাদই হয়ে গিয়েছিলেন, বেচারা। মানুষের মাথার খুলি দিয়ে নতুন ধরনের বীণা আবিষ্কারের মতলবে গা ঢাকা দিয়ে কবরের মাটি আলগা করতে গিয়ে ধরা পড়ে নাস্তানাবুদ হলেন, আরো কত কি! কখনো জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলতেন, কখনো গড়াতে গড়াতে এসে রাস্তায় গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতেন, এইসব যা-তা ব্যাপার। আসলে নতুন একটা কিছু সৃষ্টির বাসনা শেষ পর্যন্ত উন্মাদনায় গিয়ে পৌঁছেছিলো আর এর পেছনে ওত পেতে ছিলো নিদারুণ লোভ, তাই ব্যাপারটা এতোদূর গড়াতে পেরেছিলো। কেঁদে ভাসিয়ে দিলেও সেই অভিশপ্ত আর্তিকে গোর দেওয়া সম্ভব নয়। পূর্ণ বাটির এই যন্ত্রণাকেই আমরা খুব সীমিত অর্থে কখনো কখনো যুগ-যন্ত্রণা বলেও সহজে পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করি। যার ভেতর কিছু না কিছু চৈতন্যের স্ফুরণ ঘটেছে, এই সর্বনাশা যন্ত্রণা থেকে কিছুতেই তার অব্যাহতি নেই। জানেন, অনেক সময় ক্রিমিনালদেরও তাই ঘৃণা করার কোনো উপায় থাকে না, ফিরিয়ে দেবার কোনো উপায় থাকে না। তার আগে সেই স্বার্থপর সুন্দর বাটিটাকে চুরমার করে দিতে হয়–
রাখো তোমার বাটি। ঘরের ভেতর ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের সামনে ঐসব উদ্ভট গল্পগুলো না জুড়লেই বোধ হয় নয়? তোমার কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। অনুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছে সে খেয়াল করেছো একবার? বিরক্তিতে ফেটে পড়ে মা বললে ওকথা।
তুমি অকারণে এগুলোকে উদ্ভট বলে উড়িয়ে দিচ্ছো কেন? ধরো অনুর কথাই। ও এখনো ছোটো। নিজের কোনো সত্তাই এখনো তৈরি হয় নি। আমাদের ছায়ায় ছায়ায়, আমাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছেয় ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে ও। কিন্তু এরপর বয়েসের এমন একটা দুঃসময় আছে সেখানে পা রাখা মাত্রই নিজের সঙ্গে সাক্ষ্মতিক রকমের বিরোধের সম্মুখীন হতে হবে ওকে। তখন পুরোনো সব অভ্যেস প্রলয়ঙ্করী ঝড় আর জলোচ্ছাসে খড়কুটোর মতো কোথায় যে ভেসে যাবে নিজেও আন্দাজ করতে পারবে না। এমন বয়েস একসময় আমাদেরও ছিলো। দুপুরগুলো ঐ বয়ে: আমার কাছে ঝিনুকের ঝরঝরে ঝরনা মনে হতো, ভাল লাগতো। এক পদ্য লিখিয়ে বন্ধু ছিলো, সে বলতো জল্লাদের জঠরাগ্নি। আমি ওকালতি করছি, আর সে বেচারা মশক নিয়ন্ত্রণের তদারকি করতে করতে সেই জঠরাগ্নিতে প্রায় পরিপাক হয়ে গিয়েছে। নিজের ভেতরে একটা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে নিতে হয়, তার জন্যে চাই সুস্থ প্রতিজ্ঞা, সুনির্দিষ্ট প্রতীক্ষা। অনুর সেই প্রতীক্ষার দিনগুলো যেন নিঃসঙ্গ না হয় সেদিকেই কেবল খেয়াল রাখতে হবে আমাদের।
আব্বাকে দেখে মনে হলো অনুর এতোগুলো কথা বলার পর নিজের কাছে কিছুটা চমকৃত বোধ করছেন এখন। তাঁর চোখে-মুখে এক ধরনের লালচে রঙ ধরে গিয়েছে। মনে হলো পরম পরিতৃপ্ত : নিজের বদ্ধমূল ধারণা অতি সহজেই চালান দিতে পেরেছেন, বিশ্বাসের উপযোগী করে তুলে ধরতে পেরেছেন, এই তার আনন্দ। যাচাই করে দেখার কোনো অভিপ্রায়ই তাঁর নেই, বিতর্কে অনিচ্ছুক, সহজে পরিতৃপ্ত হওয়াটাই যেন চিরাচরিত অভ্যেস।
সহ্য করতে পারছিলো না মা।
মার মুখ কঠিন। বিরক্তি আর অসহনীয়তার আবর্তে পড়ে মাঝে মাঝে দমকা নিশ্বাস ছাড়ছিলো মা।
কথা শেষ হতে বললে, এমনভাবে কথা বলছো তুমি যেন অনু একটা খুনের আসামি, অভ্যেস খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমার, ঘর-বার সব এক তোমার কাছে!
মার মুখে এমন ধারালো দৃঢ়তার চিহ্ন দেখতে পেল অনু যে চোখ সরিয়ে নিতে হলো তাকে। এই দৃঢ়তার ফলে কি দুর্বিষহ কাঠিন্যেই না ছায়াচ্ছন্ন মার মুখ। ভেতরের চাপা অস্থিরতা বেপরোয়াভাবে উপর্যুপরি চলকে উঠছিলো সেই চেহারায়; অসন্তুষ্টি কি ভীষণ বদলে দেয় মানুষকে।
বাণীখালারা উঠলো এক সময়। যাওয়ার সময় বাণীখালা বললে, যাওয়া ছেড়ে দিলেন কেন আমাদের ওদিকে?
সময় করে উঠতে পারিনে আজকাল।
মা বললে, আমার সঙ্গেই দেখা করার ফুরসত নেই ওনার, আবার তোমাদের ওখানে যাবে।
বাণীখালা হেসে বললে, সবাইকে নিয়ে যাবেন কিন্তু। আমি বারবার এসে ঘুরে যাবো আর আপনারা যে যার গোঁ বজায় রেখে মাড়ি চেপে বসে থাকবেন সেটি আর হচ্ছে না। আপনারা না গেলে আমি আর এ পথ মাড়াচ্ছিনে, বলে রাখছি আশেই।
আব্বা মাথা নিচু করে হাসতে লাগলেন, সবকিছু লক্ষ্য করে অনু।
মা বললে, আমাকে নিয়ে বের হবেন উনি? তুমি বলছো কি, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে বুবু? আমাকে নিয়ে বের হলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে না ওঁর। আমাদের মতো চাকরানীদের সঙ্গে নিয়ে কি আর বাইরে যাওয়া যায়।
বাণীখালা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে হেসে ফেললে সেটা ঢাকার জন্যেই। বললে, অতশত বুঝিনে বাপু, মোট কথা তোমরা না গেলে আমি আর আসছিনে।
ওরা চলে গেল এরপর। গোর্কিরা শাসিয়ে গেল যথারীতি, আগামীবারের জন্যে অনু যেন প্রস্তুত থাকে, পরাজয়ের যোগ্য উপহারই নিয়ে আসবে তারা।
কিন্তু এসব বিন্দুমাত্র দাগ কাটে না তার মনে; এসব নিয়ে অনুর অতো মাথাব্যথা নেই। আব্বাকে আজ তার কেন যেন অন্যরকম মনে হলো। কি নিষ্প্রভ! কি নিস্তেজ! বিকেলবেলার নুয়ে পড়া নিরুপদ্রব শান্ত আলো মনের কোণে উঁকি দেয়; কতো বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। দারুণ ইচ্ছে হয় অনুর সারারাত গল্প শোনার। হঠাৎ ইচ্ছে করে প্রাণভরে ভালোবাসতে। অনুর মনে হয় পৃথিবীর সব বুড়ো মানুষের চেহারা ছবিতে দেখা আইনস্টাইনের মতো হয় না কেন!
বিদায় দিয়ে মা ফিরে এলো।
আব্বা বসেছিলেন আগের মতোই, যথাযথ। মাকে উদ্দেশ করে বললেন, বোসো, আজ কিছু বৈষয়িক আলাপ আছে তোমার সঙ্গে।
বাইরের গুমোট আবহাওয়া আরো ঘনীভূত হয়েছে এখন। সারা শহরের বুকে এক অনড় জগদ্দল বসিয়ে দিয়েছে কেউ। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশ দেখলো অনু। গাছপালা বাড়িঘর সবকিছু থমকে আছে। ঘরের ভেতর নির্বিকার শিলিং ফ্যান ঘুরছে, ভ্যাপসা গরম কোনো রকমেই আর কাটতে চায় না। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠে সে। হাঁসফাঁস করতে থাকে। কোনো কিছুতেই স্বস্তি নেই। ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠছে প্রাণান্তকর অশান্তি। সে গন্ধ পায়, উকট সে গন্ধ; দুর্বিষহ। তার ভেতর থেকে কেউ কানে কানে ফিশফিশ করে বলে দেয়—পালাও অনু, এখানে থেকো না, পালাও, এখানে তুমি মরে যাবে, এরা তোমাকে মেরে ফেলবে, অনু তুমি পালাও!
নীরবতা ভঙ্গ করে আব্বা এক সময় বললেন, রানিকে আমি আমাদের এখানে আনতে চাই!
রানি—অর্থাৎ বাঞ্ছারামপুরের ফুফুর কথা বলছেন।
মা নিরুত্তর।
মার ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্যে টোকা দিয়ে আব্বা আবার বললেন, ও আর গ্রামে পড়ে থাকতে চায় না। ওকেই বা কি দোষ দেবো, আর কতোকাল বেচারি একা একা গ্রামে পচে মরবে।
মা আগের মতোই মুখ নিচু করে বসে রইলো। মার এতে সায় নেই, বুঝতে পারে অনু। মাকে সে ভালো করেই জানে।
তুমি কি বলো। আমার মনে হয় আমাদের কাছে রাখাটাই উচিত কাজ হবে। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে, বিশেষ করে আমি ওর বড় ভাই যখন। কর্তব্য তো কিছুই করতে পারলাম না কোনোদিন।
মা বললে, কর্তব্য পালন করো না কেন? কে তোমায় বাদ সেধেছে? নাকি দড়ি দিয়ে হাতপা বেঁধে রেখেছে কেউ?
কথাটা তা নয়, আব্বা নড়েচড়ে বসে বললেন, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনোদিনই কিছু করতে চাই নি। এতোদিন অনিচ্ছুক ছিলো, এখন মন বদলেছে, এখানে আসতে চায় বলে লিখেছে, এই জন্যেই কথাটা তুললাম।
তোমার পেয়ারের বোন, তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে, এতে আবার আমাকে নিয়ে টানা-হাচড়া কেন। অন্যদের বেলায় তোমার কখনো কোনো অভাব নেই, যতো অভাব আমার বেলায়। ওসব কথা আমাকে জিগ্যেস করে কি লাভ এমন!
তোমাদের সঙ্গেই যখন থাকতে হবে তাকে, তখন তোমাদের মতামতের প্রয়োজন আছে বৈ কি!
আমার মতামতের তুমি ধার ধারো?
ঠিক বুঝে উঠলুম না কথাটা!
বুঝেও যদি না বোঝার ভান করো।
ভান? ভান আবার কোথায় দেখলে? পরিষ্কার করে বলো যা বলতে চাও। আমি তো আর জোর করে তোমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছিনে। সেই জন্যেই তো তোমার মতামত জানতে চাইলুম। তুমি গররাজি হলে আসতে বারণ করে দেবো, সোজা কথা, এর ভেতরে আবার ভান দেখলে কোথায়!
তোমার যদি সখ চাগিয়ে থাকে আত্মীয়তার ঢাক পেটানোর, কর্তব্যপালনের ঢোল পেটানোর—তাহলে নিয়ে এসোগে, এসবের ভেতর আমাকে জড়াতে চাও কেন! আমি কি বুঝিনে এসব লোক দেখানো। আমার কোনো মতামত নেই এ ব্যাপারে, নিজে যা ভালো বোঝো তাই করো।
এটা কি কোনো উত্তর হলো?
এর চেয়ে ভালো এর চেয়ে স্পষ্ট উত্তর আমার জানা নেই। খামোকা চটিয়ো না আমাকে।
চটছো তো তুমি নিজেই! শোনো–অনু বুঝতে পারে শেষ দেখতে চায় আব্বা। একটু থেমে খুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ঠাণ্ডা মাথায় একটু চিন্তা করে দেখার চেষ্টা করো। তোমারও তো একটা কর্তব্য আছে। আমরা ছাড়া অন্য কেউ থাকলে সেখানে না হয় একটা কথা ছিলো।
মা বললে, কেন বিধবা হবার পরপরই এখানে এনে তোলার জন্যে তো আর কম কাঠ-খড়-কেরোসিন পোড়াও নি, তখন তো কারো মতের ধার ধারে নি। তখন যখন নিজের দেমাকটাকে অতো বড়ো করে দেখতে পেরেছিলো এখন আবার আসার দরকারটা কি? এসে কি আমাদের একেবারে রাজা করে দেবে তোমার দুলালী বোন?
তুমি ভুল বুঝেছে ওটাকে দেমাক বলী তোমার অন্যায়। তুমি নিজে বুঝতে পারো না, উপায় থাকতে যেচে কেউ কারো গলগ্রহ হতে চায় কখনো, না সেটা উচিত? তখন ওর মনের জোর ছিলো। বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষমাত্রই এমনধারা ভেঙে পড়ে, দুর্বল হয়ে যায়–
মা বাধা দিয়ে বললে, মনের জোর নয়, বলো রূপের বহর ছিলো, রূপের দেমাক ছিলো, বরং এখানে ওর অসুবিধেই হতো। এখন বোধ হয় ওসবে ভাটা পড়েছে–
আব্বা অপেক্ষাকৃত গম্ভীর হয়ে বললেন, যাকগে ওসব নিয়ে মিছিমিছি তর্ক করে কোন লাভ নেই। তুমি তোমার মতো বুঝে বলছো, আমি আমার মতো বুঝে বলছি। ওর ব্যথাটা যে কোথায় আসলে তুমি আমি কেউ-ই তা বুঝবো না, কেননা আমরা ওর অবস্থায় পড়ি নি–
মা আবার থামিয়ে দিয়ে বললে, বলো আমি বুঝি নি, ব্যথাটা যে কোথায় তুমি ঠিকই বুঝেছিলে, বুঝেছিলে বলেই ছাড়াগরু করে রেখেছিলে, এখনো বুঝছো। এক রসুনের গোড়া তো সব!
তাহলে কি লিখবো বলো? বললাম তো যা বলার—
তোমার তাহলে মত নেই?
আমি কিছুই জানিনে এ ব্যাপারে।
একটা অসহায় মেয়ের জীবনের চাইতে তোমার নিজের জিদটাই তাহলে বড়ো হলো।
অসহায়? অসহায় বলতে তুমি কি বোঝতে চাও? গ্রামের বাড়িতে তো এতোদিন ওনার কোনো অসুবিধেই হয় নি, বেশ তো সুখেই ছিলেন। এতোদিন নিজের মনের মতো করে!
কী আশ্চর্য! এতদিন যা ভালো লেগেছে এখনো তাই ভালো লাগতে হবে এমন কোনো নিয়ম আছে নাকি? এতোদিন গ্রামে পড়ে ছিলো বলে এখনো থাকবে—চিরকালই থাকবে, এটা কোনো যুক্তির কথা? আমাদের কাছে আসতে চায় কেন সেটা একবার ভেবে দেখছো! ও ধরে নিয়েছে আমরা ওকে বোঝা মনে করবো না, আপনজনের মতোই খুশি মনে নিতে পারবো, সেইজন্যেই তো? তুমি কি বলতে চাও এটারও কোনো মূল্য নেই? সবদিক বিবেচনা না করে ঝটাঝট মন্তব্য কোরো না।
আমি তো তা চাই না, এখন তুমি যদি জোর করে আমাকে বলাও আমি কি করবো। আমার কোনো মতামতই কখনো তোমার মনে ধরে নি, সব জানা আছে আমার, ধরবেও না কোনো দিন। আমি তোমার নামে স্ত্রী। যেখানে আমার অমত থাকলেও তুমি তোমার দোলারবিবি প্রাণের বোনকে না এনে পারবে না সেখানে আবার নাটুকেপনা দেখিয়ে এতো জিগ্যেস করাকরির কি আছে!
ধরো তোমার অমত এতে, কিন্তু আমাকে বোঝানোর জন্য তুমি কতোগুলো কারণ দেখাবে না? না তারও কোনো প্রয়োজন নেই?
প্রয়োজন আবার কিসের? আমার সংসারে আমি যদি আগাছা-কুগাছা টেনে আনা ভালো মনে না করি তার জন্যেও কৈফিয়ত দিতে হবে আমাকে, কি আহাদের কথা! সংসার আমার আর যাবতীয় অধিকার তোমার, চাকরানীর চেয়ে বেশি কিছু নই, এই বলতে চাও তো? আমি তোমাকে সাফ সাফ বলে দিচ্ছি, খেয়ালখুশিমতো তুমি যদি নিরন্তর আমার কাঁধে এভাবে জোর খাটানো বোঝা চাপিয়ে দিতে থাকো তাহলে আমি নিজের পথ। নিজে বেছে নেবো। তখন তোমার যা মনে হয় তাই করে বেড়িয়ে, আমি ভুলেও দেখতে যাবো না। নিজের বোনের দিকটাই তোমার কাছে বড়ো, আমাদের দিকটা কিছু নয়। একজন কেপ্টেরও যে অধিকার থাকে তোমার কাছে আমার তা-ও নেই। তুমি শুধু হুকুম করে যাবে আর জীবনভর তাই দাসী-বাদীর মতো মাথা পেতে মেনে যাবো, কি সুখের কথা আমার!
আব্বা নিরুত্তর। এই মুহূর্তে মার মুখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা তাঁর নেই, অনু বুঝতে পারে। বুকের উপর মাথা ঝুলে পড়েছে তাঁর। ভেতরের কষ্টকে মানুষ কিভাবে সামলায় অনু সেই কথাই ভাবতে চেষ্টা করে।
অনেকক্ষণ কি কোথায় সব ভাবলেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, তুমি যদি সবকিছু এইভাবে বিচার করো তাহলে কোনো কথাই বলা চলে না!
আমি এইভাবেই বিচার করতে শিখেছি।
ওটা তোমার ভুল।
আমার ভুল আমার কাছে ভালো–
ভুল কখনো ভালো হয় না, ভবিষ্যতে না পড়লে বোঝা যায় না!
আবার নীরবতা।
আব্বা কাশলেন একবার।
আমার অনুরোধ রানির দিকটা তুমি ভালোভাবে একটু বিবেচনা করে দেখবে। খেয়ালখুশিমাফিক যা ইচ্ছে তাই কিছু একটা বলে দিলে সেটা সত্যিই অন্যায় হবে।
চোখ বড়ো বড়ো করে তীব্রকণ্ঠে মা বললে, তার মানে জোর খাটিয়ে আমাকে রাজি করাবেই তুমি, তার মানে তোমার হুকুমটাই কুকুরের মতো জিভ দিয়ে চাটতে হবে এই বলতে চাও তো তুমি?
আমার সব কথা বুঝেও ইচ্ছে করে অন্য পথে যাচ্ছো তুমি–অনু লক্ষ্য করলে হঠাৎ হেসে ফেলে ওকথা বললেন আব্বা; বললেন, তোমার বিবেক এতে তোমাকে ক্ষমা করবে তো?
বিবেক আবার কি? এক কানাকড়ি দাম আছে নাকি তার? তোমাদের নিজেদের বিবেক এতোদিন কোথায় ছিলো? কেন, রূপসী সতী বিধবা বোনটির সব বৃত্তান্ত কি জানতে না, তবু কানে তুলো দিয়ে চোখে ঠুলি বেঁধে ঘাড় গুঁজে ছিলে কেন এতোদিন, তখন তোমাদের ধােপা কাচানো বিবেক কোথায় ছিলো? আমার একার বেলায় কেন বিবেকের প্রশ্ন? কোন্ বিবেকে। তোমার সতী-সাধ্বী বোন আত্মীয়-স্বজনের মুখে কালি দিয়ে ঘরে জোয়ান ছেলেদের আড্ডা জমতে দিয়েছে এতোদিন, কোন্ বিবেকে আস্কারা দিয়েছে? বিবেক! বোনের শতেক কেচ্ছা শোনার পরও চিরটাকাল হাবা কালার মতো চোখ নাক কান বন্ধ করে পড়ে রইলে কেন, তখন তোমার এতো সাধের কর্তব্যবোধ কোথায় ছিলো, শিকেয় তুলে রেখেছিলে? কোথায় ছিলো তখন বিবেক? বিবেক!
মুখ নিচু করে বসে রইলেন আব্ব। সম্ভবত আহত হয়েছেন। অনুর কাছে পরিস্থিতিটা নিদারুণ মনে হলো। মাকে এতো উত্তেজিত হয়ে পড়তে আর কখনো দেখে নি সে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। একটানা অনেক কথা বলার পর শ্রান্তিতে ভেঙে পড়ছে, বিপুল বেগে দম নিতে হচ্ছে মাকে। সবকিছু মিলে কি প্রাণান্তকর পরিস্থিতি!
তোমার মুখ থেকে কর্তব্য বিবেক এসব বড়ো বড়ো বুলি শুনলে আমার পা থেকে মাথা অব্দি রিরি করে জ্বলতে থাকে। আমার বেলায় তোমার ঐসব কর্তব্য বিবেক চিরকাল বাক্সবন্দী ছিলো। কি পেয়েছি আমি তোমার সংসারে এসে? কি এমন দিয়েছো তুমি আমাকে? কোনোদিন ভুল করেও তো একবার চোখ মেলে তাকিয়ে দেখো নি আমার দিকে; কি আমার ছিলো, কি আমার আছে। আমি তোমার দুচোখের বিষ, তোমার শত্রু; এর বেশি আর কিছু ভাবতে পারো নি কখনো। এটা কি একটা জীবন? প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কি দিতে পেরেছো আমাকে, আর এই নিয়েই আহাদে আটখানা হতে হচ্ছে আমাকে, চোখে আঙুল দিয়ে সবাইকে দেখাতে হচ্ছে কতো সুখে রেখেছো তুমি আমাকে–
তোমার এইসব কথার কোনো মাথামুণ্ডু আমার মাথায় আসে না। মনগড়া দুঃখের কোনো ওষুধ নেই। সবসময়ই দেখে আসছি কোনো দরকারি কথা পাড়লেই চিরাচরিত নিয়মে তুমি এইসব বাক-বিতণ্ডার ঝড় তুলে সবকিছু ঘুলিয়ে ফেলতে থাকো। কিচ্ছু বুঝি না এসবের–
বুঝবে কি করে, বোঝার দরকার থাকলে তবে না!
এ ব্যাপারে আমার আর কিছু বলার নেই।
সে-ই ভালো। নিছক মন রাখবার জন্যে আমার মতামত না নিয়ে করে নিজের মরদতোলানি বোনকে মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করোগে যাও! ও আমি আগে থেকেই জানি।
ওর কথা আবার কেন, ওর সম্পর্কে তোমার যা বলার তুমি তো বলেই দিয়েছে, যাতে না আসে সেই কথাই লিখবো!
অনু দেখলো হঠাৎ খুব স্বাভাবিক হয়ে গেলেন আব্বা; অস্বাভাবিক রকম স্বাভাবিক, যেন এইমাত্র মামলায় জিতে হাওয়ার ভেতর দিয়ে ঘরে এসে পৌঁছেছেন।
আমি তা বলতে যাবো কেন, জীবনভর তোমার খোঁটা খাবো বলে?
খোঁটা দেবো কেন–নাছোড়বান্দার মতো কথাগুলো আব্বার মুখ থেকে আদায় করে নিলো মা, তোমার সংসার, দরকার মনে করলে আমাকেও বাতিল করে দেবার অধিকার তোমার আছে! আব্বা হেসে খুব নরোম করে মাকে বললেন, উঠো না, বোসো, আসল কথা এখনো বলা হয় নি। ভাবছি হাটখোলার বাড়িটা এবার বেচে দেবো। দাম পাওয়া যাচ্ছে ভালোই, তাছাড়া শুধু শুধু চেম্বারটা ওখানে ফেলে রাখাও আমার কাছে কাজের কাজ মনে হচ্ছে না। এখানে একবার ওখানে একবার, এ আর ভালো লাগছে না। পেরেও উঠছি না। ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারও অনেক ঝামেলার, ঝক্কি-ঝামেলা লেগেই থাকে বছরভর। ওসবের মধ্যে আর যেতে চাইনে, তুমি কি বলো?
কোনো উত্তর দিলো না মা প্রথমে। তারপর কি ভেবে নিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বললে, তোমার বাড়ি তুমি বুঝবে, আমি ওসবের কিছু বুঝি না। থাকলেই বা আমার কি না থাকলেই বা আমার কি, এসব ধ্যাষ্টামি না?
আব্বা দুঃখিত হয়ে বললেন, দূর থেকে গা বাঁচিয়ে কথা বলাটা একটা রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে তোমার। আমি যেন চিরকাল স্রেফ প্রতারণাই করে এসেছি তোমার সঙ্গে, তুমি এমনভাবে কথা বলো। বাড়ির ব্যাপারে কোনো মতামত নেই, রানির কথা জিগ্যেস করলুম, সেখানেও ঐ ধোয়াটে ধোঁয়াটে কথা। তোমার নিজের বোন হলে কি করতে?
নিজের বোন হলে শত দুর্বিপাকেও অন্তত তোমার এই হ্যাংলামুখো সংসারে এনে ভেড়াতুম না। বুড়ো বয়েসে নতুন করে যেন আবার প্রেম চাগিয়ে উঠছে তোমার। বাণীবুকে দেখলে তোমার আর মাথা ঠিক থাকে না, এতো কথাও বলতে পারো, মুখও ব্যথা করে না তোমার। আর ও নচ্ছার মাগীও কম যায় না, থেকে থেকে যেন চাগিয়ে উঠছে, একেবারে জোকের মতো লেগে থাকে–
আব্বা নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, দ্যাখো, ইডিওসিরও একটা সীমা থাকা দরকার, ছি ছি। এতো নিচ তো তুমি কোনোদিনই ছিলে না!
আর ন্যাকা সাজতে হবে না, তোমায় আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। চোখ বন্ধ করলে এক্ষুনি একটা ডবকা ছুঁড়ি নিয়ে আসবে নাচতে নাচতে। আমি ঢের সহ্য করেছি, আর নয়। তোমাকে শাসন করার যথেষ্ট অধিকার আমার আছে।
অস্বীকার করছিনে, কিন্তু সবকিছুর পিছনে কারণ থাকতে হবে তো?
তুমি কি মনে করো আমি নাকে ভাত পুঁজি? তোমার সব জোছুরি আমার কাছে ধরা পড়ে গেছে। তুমি বর্বর। তুমি ইতর। বাটপাড়। আমার সঙ্গে তোমার জাল জুয়াচুরির সম্পর্ক। তলে তলে বহু কিছু করে বেড়াও তুমি আমাকে না জানিয়ে, হোর নিয়ে পড়ে থাকো, আমি সব বুঝি, লম্পটের সংসারে জ্বলে মরছি আমি।
আব্বা দারুণভাবে হাঁপাতে লাগলেন। বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? প্লিজ একটু আস্তে কথা বলো, দোহাই তোমার। এসব কি যা-তা কথা বলছো তুমি, কোথেকে পাও এসব? সম্পূর্ণ মিথ্যে, সম্পূর্ণ মিথ্যে! কী আশ্চর্য, আমার সম্পর্কে এই তোমার ধারণা? পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন আমাদের, কি করে বললে এসব, ছি ছি! যা বলার মাথা ঠাণ্ডা করে বলো, আমি সব শুনতে রাজি। আমি যদি কোনো অন্যায় ঘটিয়ে থাকি তার জন্যে জবাবদিহিও আমাকে করতে হবে বৈকি–
ওরে আমার রে! মা প্রায় চিৎকার করে বললে, তোমার ঐ পুতুপুতু জবাবদিহি শুনবার জন্যে পেটে খিল মেরে উপোস দিয়ে পড়ে আছি কিনা! তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে, আমি সকলের সামনে তোমার মুখোশ খুলে দেববা!
বেশতো দাও না!
আলবৎ তাই দেবো, একশোবার তাই করবো। নিচ ছোটোলোক।
খামোকা বাজে তর্ক নিয়ে এমন চিকার কোরো না। মানুষের সহ্যেরও একটা সীমা আছে, বুঝলে?
মারবে নাকি? তা তুমি পারো। তলে তলে কারো পেট বানানোও তোমার দ্বারা অসম্ভব কিছু নয়–
থামো।
ভয় করি নাকি তোমার চোখ রাঙানির? নিচ, ছোটলোক! ভালো মায়ের। পেটে জন্ম হলে এমন হয় নাকি?
খবরদার! আব্বা প্রায় গাড়োয়ানের মতো চিৎকার করে উঠলেন, মুখ সামলে কথা বলো। মা তুলে কথা বললে ভালো হবে না, আমি সহ্য করবো। না, কিছুতেই সহ্য করবো না।
মা বললে, কি করবেটা কি শুনি? তোমার মুরোদ আমার জানা আছে। তুমি একটা কুকুর!
আর তুমি একটা পাগলা কুকুর, তোমাকে গুলি করে মারা দরকার, গুলি করে মরা দরকার!
ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! অনু চিৎকার করে উঠলো ঘর ফাটিয়ে, তুমি ফ্রাঙ্কেনস্টাইন–
অনু হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ঘরে ছুটে গেল। পরক্ষণেই আবার ফিরে এলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে ক্রিস্টলের একটা ভারি শিশি হাতে নিয়ে। দরোজোর সামনে দাঁড়িয়ে। বিদ্যুৎগতিতে ছুঁড়ে মারলো। কপালে লাগলো। যেন বজ্রাঘাত : কপালে লাগলো এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটলো। ফরাশে ছিটকে পড়া ভারি শিশিটার লেবেলে ছাপা আইফেল টাওয়ারের উপর টপটপ করে ফোটা ফোটা রক্ত পড়লো। দুহাতে অনুকে আগলে রাখলো মা। আব্বা অনুকে দেখলেন, ক্রুদ্ধ কিংবা দুঃখিত, অনু তাকাতে পারলো না, কি ভয়াবহ! শীতার্ত কুকুরের মতো নিঃশব্দে গা গুটিয়ে নিয়ে দুহাতে কপাল চেপে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে গেলেন। বন্ধ দরোজার ওপারে তাঁর অহো শোনা গেল। অহো ধ্বনিত হলো। অনুর মনে হলো আব্বার ভেতর থেকে বহুদিন——বহুদিন-যুগ-যুগান্তরের পর আজ সে নিজেই ভয়ানক দুঃখে ভয়ানক যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠেছে।
১০. তারপর একটা বরফযুগ চলে গিয়েছে
অনুর মনে হয় তারপর একটা বরফযুগ চলে গিয়েছে।
সে নিসাড় হয়ে পড়েছিলো। মাথা তুলতে পারে নি। চোখ খুলে তাকাতে পারে নি। কেমন করে সূর্য উঠেছে, কিভাবে দিন হয়েছে, রাত্রি গড়িয়েছে, তার কিছুই সে জানে না। ঝগড়ার সেই রাত্রেই তার জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছে, পাগলের মতো সে পৃথিবীময় একজন বুড়ো আইনস্টাইনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
দেখা হয়েছে লামার মামার সঙ্গে। ভাঙা করুণ বেহালা হাতে। পিঠের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা, আমি জেড. আহম্মদ সাহেবের শ্যালক, গাইয়ে।
বললেন, কি মনে করে সব শেখালেন, তারপর কি মনে করে আমার বেহালাটাকে জ্যান্ত জবাই করে কোথায় যে চলে গেলেন! আইনস্টাইন যেন কী!!
অনু বললে, পৃথিবীর মাস্তুল কোথায় দেখিয়ে দেবে? বললেন, সর্বনাশ, তার গায়ে যে টাটকা রক্ত। ধূর্ত কাকের ঝাঁক মাস্তুলের উপর বসে, মানে মাস্তুলের উপর বসে আহার সন্ধান করছে। তোমার একজোড়া নৌকোয় সূর্যের ডিম দুটি ঠুকরে ঠুকরে খাবে, অন্ধ হয়ো না!
তা খাক। অন্ধ হই সে-ও ভালো, তবু যেতে ভালোবাসি!
বললেন, এইমাত্র—
বললেন, এইমাত্র এইমাত্র—
বললেন, এইমাত্র এইমাত্র এইমাত্র–
অনু বললে, বুঝতে পারি না, চিৎকার করে কথা বলো, চিত্তার চিৎকার করে, চিৎকার!
এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে—ঘোষণা করে দাও, বজ্রাঘাত হানো! এইমাত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন আইনস্টাইনকে—ঘোষণা করে দাও, দাবানল জ্বালো! ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, ওগো দয়া করো, ওগো দয়া করো; এদের কোনো ধর্ম দীর্ঘনিশ্বাস বলে আজো আমাকে ডাকলো না।
আর আমি, অনু বলে প্রত্যুত্তরে, কি যেন কি যেন বলে, ঝিনুকের ঝরনা দেখতে বেরিয়েছিলাম সেই সকালে, উপনীত হলাম জল্লাদের জঠরাগ্নির মত্তহাহায়; মত্তহাহা মহাহা—এ কি নিহত গরুড় মাটি কামড়ে পড়ে আছে যে! একা চিৎপাত হয়ে এমন চিৎকার করে ধ্রুপদ গাইছিলে যে অনেক হাঁপানি খেয়েছি এবার পানি দাও তৃষ্ণার শুনতে পাও নি। তোবড়ানো গালে সরুদাসীর ঘষা ঝিনুক উল্টে রেখেছো, এখন সরুদাসী বাজিয়ে ঝঝর ঝঝর ঝাঁপতাল ঝিঝি ঝিঝি শোনাও!
বললেন, পালাও!
বললেন, আবার পালাও।
বললেন, আবার আবার পালাও। প-লা-য়-ন-চা-ই-বি-শ্বে!
বললেন, জিডি সিগন্যাল পাঁচ শূন্যশূন্যশূন্যশূন্যশূন্য পাঁচ শূন্যশূন্যশূন্য শূন্যশূন্য কাক!
অনু বললে, আমি পালাতে আবার পালাতে, আবার আবার পালাতে পারি না। এই তো আইফেল টাওয়ারের নিচে পড়ে আছি।
কোতোয়াল কাকের পিঠে চেপে নেমে এলো মা, চলো আমার সঙ্গে শীর্ষে!
তারপর মা এখন তুমি শীর্ষে।
মা বললে, তাহলে তুমি—
মা বললে, তাহলে তুমি এখন—
মা বললে, তাহলে তুমি এখন শস্যের মতো শীর্ষে।
অনু বললে, বিকেলে নদীর উপর জামবাটি উপুড় করে মস্ত বড় ডিমের কুসুম ঢেলে দেওয়া চলবে না, আমি চিৎকার করে বলবো আর তোমাকে রাত্রি পড়তে দেবো না, আমি চিৎকার করে বলবো রাত্রির গায়ে উৎকট গন্ধ কি যে, আমি চিৎকার করে বলবো-হা চিইইইইইইইইইইইইইইইত্যার করে বলবো রাত্রিকে রাত্রিকে রাত্রিকে আমার ঘৃণা, আমি চিৎকার করে বলবো পনেরোটা দিন সমানে খুবলে খুবলে চাঁদ খায়, কানাচোখে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে–
তারপর, তারপর মা এক ফুৎকারে তার চিৎকারের প্রদীপটাকে, তার চিল্কারের লীলাচঞ্চল নীল শিখাকে নিস্তব্ধ করে দশ লক্ষ কালো চাদরে ঝিনুকের ঝরনা ঢেকে দিলো।
১১. সেরে ওঠার পর
সেরে ওঠার পর প্রথমেই অনুর মনে হলো যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তাঁর খুঁজে বের করতেই হবে। বুকের ভেতর একটা আধলা ইট আটকে আছে। কতো দিন আমি রুগ্ন বিছানার উপর শুয়ে আছি, অনুর মনে তোলপাড় করতে লাগলো, কতোদিন হয়ে গেল আমি রক্তশূন্য শাদা কাফনের উপর পড়ে আছি, কতোদিন হয়ে গেল আমি সরুদাসীকে খুঁজি নি, কতোদিন যে হয়ে গেল আমার আকাশ নেই, শুধু গা পোড়া জ্বর!
ফেলে আসা এক একটি ধূসর দুপুর তাকে হাতছানি দেয়; প্রথমে পায়ে পায়ে, সন্তর্পণে, তারপর নির্বোধ চঞ্চল বালকের মতো ছায়ানৃত্যে।
রক্তমাংসহীন আমি পড়ে আছি, কেউ নিদারুণভাবে গুম করে দিয়েছে আমাকে, অসহায়ভাবে মনে হয় তাঁর ছিন্নমস্তার মন্দিরের পুরোহিত নীরবে ভ্রুকুটি করে চলেছে আমাকে, কানের চারপাশে রহস্যনীল ফিশফিশ, ঘর তো নয় একটা এ্যাকোয়ারিয়াম, ফুলে ঢোল একটা মরা মাছের মতো পড়ে আছি তার ভেতর।
মনে পড়ে সেই সব দুপুর, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো মেঘের গুহা থেকে বেরিয়ে আসা সব রৌদ্র, জ্যোতির্ময় একটি শিশু কেমন হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় আকাশময়, মেঘের কুটি একদিন, এক একদিন মাদল বাজায় মেঘ, ঝরঝর ঝাঁপতাল ঝিঝি ঝিঝিট, তারপর কি বিশাল কি অপার নিস্তব্ধতা, নিস্তরঙ্গ নিরাকার নিস্তব্ধতা; সাত কোটি বছরের এক আস্ত আকাশ হয়ে যায়, নির্ভার!
সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করতেই হবে। মেঘের গুহা থেকে নিপাট রৌদ্রের মতো যদি বেরিয়ে আসে সরুদাসী, থরে বিথরে সাজানো যাবতীয় বিষণ্ণতার উপর ছিটিয়ে দেবে ফুলের পাপড়ি।
অনেকদিন থেকেই মায়ের স্যার আর আসেন না।
মায়ের ইংরেজি শেখা একেবারেই বন্ধ।
এসব নিয়ে অনুর কোনো মাথাব্যথা নেই, চুলোয় যাক সবকিছু। এখন সে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে।
অসুখের পর থেকে নিজের বদল দেখে নিজেই চমকে যাচ্ছে। নিজের কাছেই কতো অচেনা এখন। মার উপর তার আর বিশ্বাস নেই কোনো। মা কোনোদিন পালাতে পারবে না এ বাড়ি ছেড়ে, সবই মিথ্যে প্রবোধ ছিলো এতোদিন।
তাকে পালাতে হবে একাই, আর সেই জন্যেই কপাল খুঁড়ে, পৃথিবী খুঁড়ে, আলো নিংড়ে নিংড়ে যেমন করেই হোক সরুদাসীকে তার খুঁজে বের করা চাই-ই। সে মনে মনে আওড়াতে থাকে, তোমরা আমাকে আটকে রাখতে পারবে না, ছাদের নিচে আমি হাঁপিয়ে উঠি, একা একা আমি মরে যাই, তোমাদের অনু মরে যায়, এ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতর আমাকে ঠুকরে করে খায় জ্যান্ত মাছেরা।
জানালার গম্ভীর নিস্তব্ধতায় দাঁড়িয়ে তার বুকের ভেতরের খবর পেলো অনু, সেখানে দাঁতাল পশুর মতো এক আক্রোশ মুখ গুঁজে নির্জীবপ্রায় পড়ে আছে, জনহীন ফাঁকা হলঘরে হাহাকারের প্রতিধ্বনি উচ্ছিষ্ট টুকরো টুকরো শব্দ পাখিরা ঠোঁটে করে নিয়ে গিয়েছে মৌনতার ধ্যানগম্ভীর শিখরে। লামাদের বাগানে আমগাছের নিচে সেই অতিচেনা আদুরে ছায়া পরম আলস্যভরে জলেশ্বর মালীর মতো গাল পেতে শুয়ে আছে।
পাতার ফাঁক দিয়ে পালিয়ে আসা শাদা রুমালের মতো রৌদ্র এক এক চিলতে ছায়ার কোমল মাদুরে এখানে ওখানে ছড়ানো।
ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া একটা মুখোশ কি?
না কি গুলির ঘায়ে এমনভাবে চিরে গিয়েছে ছায়ার চাদর?
তা না হলে সুখী চিতলমাছের ঝাঁক নেমেছে ছায়ায়!
চিতল কিংবা ইলিশের ঝাঁক; মাথার উপর দিয়ে বিশাল এক পদ্মা নদী বয়ে চলেছে।
মা বাইরে যাচ্ছিলো। আব্বা বারান্দার রেলিং ধরে ঝুঁকে বাগানের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। বহুদিন যাবৎ তিনিও শয্যাগত। চেনা যায় না। খুব খারাপ হয়ে গিয়েছেন।
জিগ্যেস করলেন, কোথায় যাচ্ছো?
স্যারের কাছে!
না ষাঁড়ের কাছে?
সোয়াইন! মা বেপরোয়ার মতো দপদপ করে পা ফেলে ঝটকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললে, চামার!
মা চলে গেল। মার রিকশা অদৃশ্য হলো আড়ালে। অনুর মনে হলো সে যখন চলে যাবে তখন ঠিক এই রকমই একটা কিছু হবে। রাস্তায় এখনকার মার মতোই কয়েক মুহূর্ত শুধু দেখা যাবে, তারপর এই বাড়ি থেকে আর কেউ দেখতে পাবে না তাকে, ঠিক মার মতোই এক মিনিটের মধ্যে গলির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবে সে। এই বাড়িটার আর কোনো অর্থ থাকবে না তার কাছে তখন।
জানালা থেকে সরে এসে অনু প্রথমে রেজমিতে পকেট বোঝাই করলো, তার কাছে এগুলো আকাশের তারা। পরে মার ঘরে ঢুকলো। ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে তিলধরা একটা বড়ো কড়ি নিলো যা কানে চেপে ধরলে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত শোঁ-শোঁ শব্দ শোনা যায়। একজোড়া শ্যাওলা আকিক নিলো, ঘষলে যার গায়ে অন্ধকারের এক একটা সুন্দর ইচ্ছের মতো ফুলঝুরি ঝরে। আর নিলো ফসফরাসে চোবানো একজোড়া আঙুরথোকা। দুল, রাত্রিকালে যা এক একটা দুঃখের মতো জ্বলবে।
ঐসব পকেটে ভরলো। মনকে খুব শক্ত করে নিলো সে। এক সময় বেরিয়ে পড়লো। আজ সে ঋষিপাড়ায় যাবে।
জ্বালানি কাঠের সেই দোকান, বৃষ্টির তুমুল তাণ্ডবে ভারি দমকা হাওয়ার হাত ধরে আমি আর সরুদাসী—সরুদাসী আর আমি, দুজন আমরা, সোনার কাঠি দিয়ে বোনা ঝাঁপ ঠেলে যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, প্রথমে সেইখানে, অনু মনে মনে এইসব ভাবলো।
নিঃসঙ্গ সাক্ষীর মতো একটা আমগাছ দাঁড়িয়ে। মা মরা একটি ছেলে যেন সজল নয়নে আকাশের কাছে কোলভিক্ষা করছে।
স্পষ্ট মনে আছে অনুর ঝাপ ঠেলে ঢুকবার সময় এই গাছটা পলকের জন্যে তার চোখে পড়েছিলো সেদিন, কিন্তু ঢেউটিনের ছাউনি দেওয়া সেই চালাঘর দোকানটা কোথাও খুঁজে পেল না সে।
খুব অবাক হলো, কেননা পথটাও তার চেনা হয়ে গিয়েছিলো; কোথায় ডানদিকে লাল লেটারবক্স, কোথায় রেশন শপ, কোথায় ভাঙা গাড়ি পড়ে, সবই মনে আছে এবং সবকিছুই হিশেবে মিলে যাচ্ছে, কেবল চেলাকাঠের সেই দোকানটা কোথাও নেই।
নারকেলের বালদোর ওপর ছোট্ট একটা বাচ্চাকে বসিয়ে কতোগুলো ছেলেমেয়ে পাতার ঝুঁটি ধরে টেনে টেনে গাড়ি-গাড়ি খেলা খেলছিলো। অনু তাদের একজনকে জিগ্যেস করলো, ঋষিপাড়া কোন্দিকে?
সপ্রতিভ একটি ছেলে এগিয়ে এসে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বললে, ঐ তো সামনেই!
অনু জিগ্যেস করলো, সরুদাসীদের ঘর চেনো?
খুব চিনি! কতোবার ওদের বাসায় গেছি। আমার মা চামারনী দিয়ে তেল মালিশ করাতো কিনা! চলো না, দেখিয়ে দেবোখন। ছেলেটা চোখ নাচিয়ে বললে, তোমার মায়ের ডেলিভারি হবে বুঝি? ব্যথা উঠেছে?
অনু খুব বিব্রতবোধ করলো।
নিজ থেকেই ছেলেটা অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলো ঋষিপাড়ার পথে। বললে, আমার মা বলেন ডাক্তারদের থেকেও এদের অনেক বেশি নলেজ। ডাক্তাররা স্রেফ ধোকা দিয়ে পয়সা নিয়ে যায়। আর এরা বাচ্চা খালাস করতে করতে নাড়ি-নক্ষত্র সব বুঝে ফেলে। পয়সাও কম লাগে। পাঁচটা টাকা, দুএকটা ঘেঁড়া পেটিকোট-শাড়ি, সের দেড়েক চাল, ব্যাস, এতেই ওদের পায় কে! আমার বড় বোনের সেবার এমন ব্যথা চাগালো যে ডাক্তার কবিরাজ সব ফেল, শেষে চামারনী বেটি এসে যেই না চুলের গোছা মুখে দিয়েছে
ঋষিপাড়ায় পৌঁছে সবকিছু নতুন মনে হলো অনুর। কেমন এক মাটিতে নুয়েপড়া নিস্পৃহ চেহারা এই পাড়াটার; সরল, সহজ, বৈরাগ্য-ক্লান্ত, অথচ পরম পরিতৃপ্ত আলোর ভেতর ধ্যানস্থ হয়ে আছে। অভিভূত হবার মতো নয়, কিন্তু এমন কোনো নরোম স্নিগ্ধ নিস্তব্ধতা আছে এখানে যা পরাক্রান্ত শহরের বুকে অন্য কোথাও নেই।
এখানে ওখানে চকমিলান বস্তি। বাখারি মাটি আর খোলার ঘর। একপাশে হাজা-মজা নীল সরপড়া নিস্তরঙ্গ জলাশয়। ধস নেমে মাটির চাঙড় কাত হয়ে আছে। অনুর মনে হলো পৃথিবীর সব স্রোত ঐ নীল জলাশয়ের নিথর তলদেশে বহুকাল আগে মাছের এক একটি হলুদ ইচ্ছের মতো হারিয়ে গিয়েছে।
যতোই এগোতে থাকে ততই বিস্মিত হয়। দুচোখ ভরে যায়। তাকে দেখে ধীরে ধীরে নিস্পৃহতা কেটে যাচ্ছে ঋষিপাড়ার। কলরবহীন প্রশান্ত বাতাসে সুনীল পাতার রাশ আলগা করে কয়েকটা বিহ্বল বেলগাছ উদ্ভ্রান্ত পাখির চিৎকার জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
খঞ্জনা ডাকছে।
খঞ্জনা আর খোকাহোক।
বাছুরের গলায় ঘুঙুর বাজছে। নাটাবনে ঝুমঝুমি বাজাচ্ছে ঘর পালানো বাতাস। খোকাহোক ডাকছে। পা লম্বা করে, মাটির ঝুরঝুরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দূরে আবছা মেয়েমানুষ, সুই-সুতোয় ছেঁড়াফোঁড়া রঙ-বেরঙের তালিমারা আকাশের মতো নীলকাথা সেলাই করছে।
গোবরগাদার কোলে ফুলের ভারে নুয়েপড়া ঝুমকোলতা বললে, অনু, আমার নাম মঞ্জুশী, লটপটে বিনুনি দোলানো বিকেলের মতো আমিও আমিও আমিও তোমার হাত ধরে, তোমার সঙ্গে। তালশাঁসের হিম মাংসে আমাদের ছেলেমেয়েরা কি-না সুখী! বুকের আলুথালু আঁচলের চেয়েও আমাদের সব রাস্তা নিস্তব্ধ, ধ্বনিপুঞ্জ থেকে পা হড়কে পিছলে আসা; সবুজ ঘাসের নিরহঙ্কার গন্ধে নিয়তই গুমরে উঠছে এইসব ধুলোয় নরোম রাস্তা।
এসো, তোমার গলায় আকন্দফুলের মালা পরিয়ে দেবো, স্বর্ণলতিকার ভারে নুয়ে পড়া রক্তজবার গাছ বললে—–আমাকে তুমি ফুল্লরা বলেই ডেকো, আমি তোমার গলায় আকন্দফুলের মালা দেবো, আর একলক্ষ মৌমাছির বিবর্ণ দুঃখের চেয়েও বড় বড় নীল ঘাসফুল, যতো নিতে পারো, যতো নিতে পারো।
রাঙারৌদ্র আমার ঠোঁট, বিকেল আমার বিনুনি, মঞ্জুশ্রী ফুল্লরা এরা আমার বোন, ঋষিপাড়া স্বয়ং ফিশফিশ করে উঠলো এইবার—আমাদের ঘাসের সবুজ জ্যোছনায় গঙ্গাফড়িং আর ঝিঝিপোকা তুমি, এখানে প্রজাপতির ঝাক নামে, এক দুই তিন চার গুনতে চেওনা, তা অসম্ভব, লক্ষ লক্ষ, প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি প্রজাপতি, তুমিতো প্রজাপতি ভাল বাসো। ফণিমনসার মতো মুখ এখানে পাবে না। চাঁদের আলোয় ভরাবুক মালীবৌ এখানে সবাই। ভিজে সপসপে লাল গামছা চোষা ঝঝ রোদ নেই, এখানে খঞ্জনা পাখি, বাবুদের বাগান থেকে পালিয়ে আসে শিকল হেঁড়া ময়ুর, এখানে খঞ্জনা পাখি, আসে তিতির, ঝুঁটিওলা সুখের পায়রা, এখানে খঞ্জনা পাখি, ঐ শোনো খঞ্জনা ডাকছে,–এসো, তুমি আমি ফুল্লরা সকলে হাত ধরাধরি করে সবুজ ঘাসবনে নেচে বেড়াই, ঘাস ঘেঁটুবন আসশ্যাওড়ার বন ঘৃতকুমারীর বন এসো দেখবে এসো, ঘোড়ানিমের ডালে নিমপাখির লুকোচুরি খেলা দেখছে আমাদের সব বিশুয়ালাল আর হরিয়া, দাদাপাখির খসা পাখনা বাবুই পাখির বাসা পেতলের ভাঙা আংটি কাচের ভাঙা লাল নীল সবুজ চুড়ি সুগোল নুড়ি ইঁদুরের দাঁতের মতো একরত্তি বেলে ঝিনুক ন্যাকড়ার পুতুল টিনের কৌটো কি কি চাই তোমার, আমাদের সব ফুল্লরা আর মঞ্জুশ্রী সকালে জলা থেকে চুপড়ি বোঝাই করে কলমিলতা তুলে আনে, আমাদের সব বিশুয়ালাল ন্যাংটো হয়ে ব্যাঙের মতো ঝাঁপ দেয় কলমির বনে, আমাদের সব হরিয়ার কোমরের ঘুনসি কেটে যায়, নুনু দেখাদেখি খেলা শেষে রোজ কুরকুটি দিয়ে হেসে ওঠে, ছাগলের পেছনে ছোটাছুটি করে তার গলার নুড়ি ধরে টানে, চালকুমড়োর চুনে পাজর এঁকে ভূতের ভয় দেখায়, অনু এখানে খঞ্জনা পাখি, এখানে খঞ্জনা পাখি–
অনুর মনে হলো, পৃথিবী উজাড় করে আমি ঋষিপাড়ায় হীরের মিছরি নিয়ে এসেছি।
সরু রাস্তা এক জায়গায় এসে গোল হয়ে দুদিকে চলে গিয়েছে, মাঝখানে একটা একচালা ঘর, যেন ঋষিপাড়া দুধের হাড়িধরা লোহার বাউলি দিয়ে ঘরটাকে ধরে রেখেছে। ছেলেটা বললে, এটাই সরুদাসীদের ঘর। ইশ, যা নোংরা ওরা, একেবারে হোপলেস অবস্থায় থাকে!
এখানে-ওখানে বাসক আসশ্যাওড়া আর বনহলুদের ঘুপসি ঝোপ। মাদারগাছের খুঁটি। ঘরের সামনে উঠোন। উঠোনের কোণে গাঁথুনি খসে পড়া ইন্দারা, পাশে বাঁশের খুঁটিতে দড়িবাঁধা বালতি ঝোলানো। করমচা গাছের কোণ ঘেঁসে চুপড়িআলুর লতা বাতাসে দোল খাচ্ছে। একপাশে শুকনো ছাগলের নাদি ভঁই হয়ে পড়ে আছে।
উঠোনের একপাশে ইন্দারার খুব কাছাকাছি হাড়িচর্মসার এক বুড়ি ক্ষুদ কাঁড়িয়ে কাঁকর আলাদা করছে; শনের নুড়ির মতো চুল, একটাও দাঁত নেই, আর ঘরের বারান্দায় একজন শীর্ণকায় থুথুড়ো বুড়ো শাদা ধবধবে ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নেড়ে বিভোর হয়ে একমনে পাখখায়াজ বাজাচ্ছে। বুড়োটাকে অনুর যিশুখৃস্ট মনে হলো। তার ঘরের সেই টেবিলে সাজানো ছোট্ট মূর্তিটার মতোই পেটে ভাঁজ, পাঁজরের প্রতিটি হাড় সহজে গোনা যায়, ঋষির মতো দাড়িগোঁফ।
ছেলেটা বললে, এই তো সরুচামারনী। যাওনা লজ্জার কি আছে। না হলে আমিই গিয়ে সব বলছি, আমাকে তো ওরা ভাল করেই চেনে। কি বলবো কি, ব্যথা উঠেছে?
অনু বিভ্রান্তের মতো মাথা দুলিয়ে বললে, না না, এ সে সরুদাসী নয়—
ছেলেটা অবাক হয়ে বললে, তাহলে সে আবার কে?
সে আমাদের মতোই ছোটো! অনু ঘড়ঘড় করে বললে, বাবুদের বাগানে সে হরিয়ার সঙ্গে রোজ খেলা করে বেড়ায়।
কি আবোল-তাবোল বকছো তুমি! ছেলেটা মুখ বেঁকিয়ে বললে, হরিয়াকে নিয়ে বুড়ি আবার কি খেলবে, ওর তো আর মাথা খারাপ নয়! হরিয়াই তো ওর স্বামী! ঐতো ট্যাগরা গাঁজাখোরটা বসে বসে বাজনা প্রাকটিস করছে!
যে উঠোনে অনু দাঁড়িয়েছিল এতোক্ষণ এখন সেটাকে যারপরনাই ভয়ঙ্কর বলে মনে হলো, উঠোনটা একটা ঘেয়ো জিভ। হা হয়ে জিভ বের করে রেখেছে কুটিল ঋষিপাড়া। মনে হলো বাঁশের খুঁটির গায়ে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে বালতিটা। উঠোনে ওপরের ছায়াময় লালচে আলো অসম্ভব থমথমে, বুঝিবা এক করাল বিভীষিকা। তীক্ষ্ণ বর্শার খোঁচার মতো সহসা মনে হলো অনুর পায়ে পায়ে এক কুটিল ষড়যন্ত্রের মাঝখানে অগোচরে এসে পড়েছে সে; ফণা ধরে আছে এক কালকেউটে, ছোবল। মারবে, একটু পরেই দাঁতে কাটবে তাকে।
খুব জোরে বাজাচ্ছে বুড়ো হরিয়া। আগের চেয়ে জোরে, আরো মাথা নেড়ে, বাবরি ঝাঁকিয়ে, এ-হে-আই হাঁক ছেড়ে, ধোঁয়াচ্ছন্ন এক কুহক থেকে ঘুটঘুটে করাল আরেক কুহকে উন্মাদপ্রায় যাত্রারম্ভ করেছে সে। পাখোয়াজের গায়ে প্রতিটি চাটির ভেতর সাবধান সাবধান ধ্বনি চড়বড়িয়ে উঠছে। রনোন্মত্ত হস্তিযূথকে দাবড়ে দিচ্ছে সে। হাতের চাঁটি এবং পাখোয়াজের উদ্ধত ধ্বনি এবং ঘনঘন এ-হেই–আই—ও–হুঁহ্ ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে চলেছে। অভিশপ্ত ভূগর্ভের কালো খোল ফেটে পিচকারির মতো তীব্রভাবে উদগীরিত হচ্ছে সেই মদোন্মত্ত ধুপধাপ শব্দলহরী। চিড় খাচ্ছে আর দুড়ুম-দাঁড়াম করে সেখানে সমানে স্থানচ্যুত হচ্ছে কঠিন শিলাস্তর, উত্তপ্ত এবং লেলিহান অগ্নিশিখার মতো হলহলিয়ে উঠছে প্রচণ্ড এবং ক্রোধান্ধি তুমুল শব্দরাজি; সাবধান এবং ধ্বংস এবং বজ এবং মাতঙ্গ এবং গাণ্ডিব এবং ব্যাঘ্র এবং হলাহল এবং সিংহ এবং ভুজঙ্গ এবং বৃষ এবং খড়গ প্রভূত শব্দাবলি সেই দুর্দম অগ্নিশিখার মাঝখানে। আতসবাজির মতো মুহুর্মুহু ফেটে পড়ছে। অনুর মনে হলো বুড়ো হরিয়ার হাতের এই প্রলয়ঙ্কর পাখোয়াজ নিঃসৃত শব্দবাণে পৃথিবীর যাবতীয় সভ্যতা ভেঙে চুরমার, খানখান হয়ে যাবে। রক্তবৃষ্টি। মাংসবৃষ্টি! অগ্নিবৃষ্টি। রক্তমাংস অগ্নিবৃষ্টি!
পেছনে কয়েক পা সরে এসে বিভ্রান্ত অনু বললে, চলো এখান থেকে, এ তুমি কোথায় নিয়ে এলে! এখানে অন্য সরুদাসী! এখানে অন্য সরুদাসী!
উর্ধ্বশ্বাসে ফিরে যাবার পথে বারবার অনুর মনে হলো, জারজ নিনাদে উন্নীত পাথোয়াজের উত্তরোত্তর দ্রুততর উত্তাল ফেনিল তরঙ্গমালা পিছন থেকে পরাক্রান্ত ঘাতকের মতো তেড়ে আসছে তার দিকে।