সত্যিই সে অনেক কিছুই জানে না। অনেক জানে এরা। গাছের পাতায় জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করতে পারে গেনদু। গাছের ছায়া নিয়ে ইচ্ছেমতো খেলতে জানে মিয়াচাঁন। টোকানি ফালানি গেনদু লাটু মিয়াচাঁন নাড়িনক্ষত্র জানে পথঘাটের। ছাগলের গলায় নুনুড়ি দেখলে কি হয়, জোড়া শালিখ দেখলে কি হয়, লাউ কিংবা পুঁইশাকের মাচায় আনজিরা দেখলে কিভাবে হ্যাক থু করে বুকে থুতু দিতে হয়, এক চোখ দেখলে কি কি অঘটন ঘটতে পারে কিংবা অসতী মেয়েমানুষের লক্ষণ কি কি—সবকিছুই ওদের নখদর্পণে। কথায় কথায় হয়তো ফালানি বললে, কি নিয়া চাটগাঁ? পট করে অন্য কেউ জবাব দিলো তখনকার তখনই, সারেঙ শুটকি দরগা! তারপর হয়তো ফালানির পালা। মিয়াচাঁন পালটা জিগ্যেস করলে, কি নিয়া ঢাকা? ফালানি বললে, মশা মোল্লা শাখা।
কখনো তর্ক হয়। গেনদু হয়তো বললো, কিন্তু যে হালায় বানাইছে কডি হেই হালায় মুতবারও আহে নাই ঢাহায়, আইলে বাখরখানির কডি ঢুকাইয়া ছারতো, তরা কি কচ?
হাঁটতে হাঁটতে গেনদু সাপের গল্প জুড়লো।
অনেকদিন আগে গেনদুদের ঘরে একটা সাপ পুরোনো তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে পাক দিয়ে জড়িয়ে ছিলো। কালো কুচকুচে গা, চকচকে চোখ, ঘনঘন জিভ বের করে–
শেষে ওঝা এলো।
ওঝা হেঁট হয়ে দাত মুখ খিচিয়ে একটানে পটাপট কয়েকগাছা মাথার চুল ছিড়ে দুচারটে তুড়ি লাফ মেরে প্রায় এক নিশ্বাসে বলতে লাগলো :
ধ্যাড়ধুড়ধুড়ধ্যাড়ধুড়ধুড়পাহাইড়াবুড়ি
ম্যাড়মুড়মুড়ম্যাড়মুড়মুড়হজরতেরমায়।
ক্যাড়কুড়কুড়ক্যাড়কুড়কুড়কুবেকলাই
প্যাড়পুড়পুড়প্যাড়পুড়পুড়হবেকনাই–
কিন্তু সাপ তেঁতুলের হাঁড়ির গায়ে যে গেরো দিয়েছে কিছুতেই তা আর খুলতে চায় না। ওঝা মুখ কাঁচুমাচু করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললে, কাম বাজছে। এযে মাজারের হাপ!
উপায় জানা থাকলে মাজারের সাপও খেদানো যায়। পাঁচসিকে পয়সা, পাঁচপোয়া সেদ্ধচাল, পাঁচটা আলু আর পাঁচটা পিঁয়াজ নিয়ে বিকেল ঠিক পাঁচটায় ওঝা পাঁচবার হাতজোড় করে সবিনয়ে মিনতি জুড়লো, হুজুর আপনে মেরবানি কইরা অহনে যান গিয়া, আমি অনে হিন্নিগুলি দিয়া আইতাছি! তারপর লাঠির মাথায় তুলো দিয়ে লাল নীল সবুজ হলুদ আর কালো এই পাঁচরঙা সুতোয় তা জড়িয়ে দুবার খোঁচা মারতেই সাপটা ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে ডালিমগাছের কোল ঘেঁসে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এদিকে ওঝার নাকে-মুখে রক্ত ওঠার জোগাড়।
মেঝের ওপর চড়াৎ চড়াৎ আছাড় খেয়ে ঠোঁট কামড়ে মাথার চুল ছিড়ে জাবনা খাওয়া গরুর মতো ফোশ ফোঁশ করে ঝোড়ো নিশ্বাস ফেলতে লাগলো সে। যায় যায় অবস্থা। অনেক পরে গামছা দিয়ে গলার ঘাম মুছে সুস্থির হয়ে বললে, যা বাঁচাড়া বাঁচছেন হেইয়া আর কইলাম না। ইচ, যাওনের সমৎ অক্করে আমার কইলজার হিকড় ধইরা টান দিয়া গ্যাছে!
গল্প শেষ হলে গেনদুর মুখের দিকে তাকিয়ে অনু সবিস্ময়ে বললে, এমন হয়?
অইবো না কেল্লা? গেনদু বললে, তুই এলায় অক্করে ম্যানথামারা পোলা, তরে লয়া চলে না।
অনু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললে, ওঝা মন্ত্র শোনালে কি হবে সাপ তো আর কানে শোনে না।
কান দিয়া না হুনুক জিব্বা দিয়া হোনে।
বাজে কথা।
গেনদু বিরক্ত হয়ে বললো, তরে কইছে! তর যেমুন সব প্যাটবানান্তি কথা, এইগুলি পাচ কই?
খার, মুতা লই বলে মিয়াচাঁন একটা কেন্নোর গায়ে পেচ্ছাব করতে করতে খুব মনোযোগ দিয়ে তার গুটিয়ে যাওয়ার খুঁটিনাটি দেখলো। তারপর বললে, বিয়ার গীত হুনছস?
অনু বললে, না।
গেনদু ভারিক্কি চালে বললে, হুনায়া দে হুনায়া দে, কামে আইবো–মিয়াচাঁন তার চিনচিনে গলায় শুরু করলো :
ঘরসে নিকলা বাবু খানেকা বাস্তে–
মুরগিক আণ্ডা খা লিয়া রসগুল্লা সমঝকে
হায় হায় রসগুল্লা সমঝকে।
ঘরসে নিকলা বাবু পিনেকা বাস্তে-–
ঘোড়ে কা মুত পি লিয়া বেরানডি সমঝকে
হায় হায় বেরানডি সমঝকে।
অনু বললে, সত্যিই খুব মজার গান।
মিয়াচাঁন চোখ ট্যারা করে বললে, বুঝবার পারচস?
গেনদু ভেংচি কেটে বললে, থো! এণ্ডা বুঝছে। ক দেহি বেরানডি কি?
অনু বললে, তুমিই বলো না হে!
তরে লয়া আমাগ এক মোশকিল বাজছে। বেরানডি অইলো গিয়া রানডিগো খাওনের জিনিস।
মিয়াচাঁন গম্ভীর স্বরে বললে, তারিউরি অইবো আর কি।
গেনদু বললে, ওইসব মাইনসে খায় ক্যান ক দিহি, কি অয় খাইলে?—
তারপর উত্তরের কোনো পরোয়া না করে পরক্ষণে নিজেই বলে উঠলো, নিশা অয়, আবার কি অইবো। আর নিশা অইলে আতের মদে নবাবি আয়া যায়, চালারে–!
মাঝে মাঝে অনুকেও কিছু বলতে হয়, শুনতে চায় ওরা, বিশেষ করে গেনদু। কিন্তু অনু নিজে ওদের গল্প যতোটা আগ্রহ নিয়ে শোনে ওরা তার ধার দিয়েও যায় না।
চা-এর জন্মবৃত্তান্ত শোনালো অনু।
একদিন বোধিধর্মা ধ্যানে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে রাগে নিজের চোখের পাপড়ি দুটোই কেটে ফেলে দিয়েছিলেন। চোখের পাতাজোড়া যেখানে পড়েছিলো পরে সেখান থেকেই চা গাছ জন্মায়।
খুব যে তুষ্ট হয়েছে ওরা কারো মুখ দেখেই তা মনে হয় না। গেনদু আর মিয়াচাঁন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলো। লজ্জায় কুঁকড়ে গেল অনু।
কিন্তু এসবই নেহাৎ ক্ষণস্থায়ী গরমিলের ব্যাপার। এইসব গান গল্প গাজনের সং কিংবা আখের সবুজ রসের লোহা লোহা গন্ধে নিবের পিঠ দিয়ে ব্লটিং পেপারে দাগ টানা কিংবা ছবি আঁকার মতো অনির্দিষ্ট আনন্দ খুঁজে পায় সে। ফলে মাঝপথে দমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয় না, ভাটা পড়ে না উৎসাহে।