তারপর যখন বড়ো হলাম অর্থাৎ নাইন-টেনে পড়ছি তখন আলমারি খুলে বায়া-তবলাটা দেখে মনে হল–আরে! এমন ভালো জিনিসটা পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখি না যদি বাজানো শিখতে পারি। এতে পরলোকগত দাদু রাগ করবেন কেন?
সেদিনই বাঁয়া-তবলাটা বের করে দাদুর উদ্দেশে প্রণাম করে তবলায় একটা আস্তে করে চঁটি দিতেই যেন তবলার ওপর সুরের ঢেউ খেলে গেল। তারপরে যখন প্রথম বোল তেরে কেটে তাক বাজাতে পারলাম তখন আমার আনন্দ দেখে কে?
এইভাবে রোজ আধঘণ্টা করে বাজাতে বাজাতে একদিন ভালো তবলা-বাজিয়ে হয়ে উঠলাম। কারো কাছে না শিখেই। কী করে তা সম্ভব হল, জানি না। হয়তো দাদুর আশীর্বাদ। ব্যাপারটা অসম্ভব জানি তবু …
আমাদের জায়গাটি নিতান্তই ছোটো। কিন্তু গানবাজনা হতই। আর হত স্টেজ বেঁধে থিয়েটার। তখনও মফঃস্বলে সিনেমার চল হয়নি। পুজোটুজো উপলক্ষে ছেলেরা মিলে থিয়েটার করত। আর থিয়েটার মানেই কনসার্ট, বাজনা থাকবেই। এখানে যে কজন তবলচি ছিল তাদের মধ্যে আমাকেই সকলে বেশি পছন্দ করত। তবলার ওপর আমার আঙুল যত দ্রুত খেলত তেমন আর কারো নয়। ফলে গানবাজনার আসর বসলেই সবার আগে আমার ডাক পড়ত।
এই রকম একটা ঘরোয়া গানের আসরে আমি প্রথম দেখেছিলাম চারু বিশ্বাসকে। অদ্ভুত ছেলেটা।
সন্ধ্যায় গানের আসর বসেছে। আমরা সাত-আটজন বন্ধু। অখিল বলে একটি ছেলে গাইছিল। আমি সঙ্গত করছিলাম। হঠাৎ দরজা ঠেলে কারও অনুমতি না নিয়ে ষণ্ডামার্কা একটা ছেলে এসে একেবারে আমাদের মাঝখানে বসে পড়ল। সে ঢুকেছিল কঁপা কাঁপা ঘাড় নিয়ে। তার মুখটা যে কী ভয়ঙ্কর না দেখলে বোঝানো যাবে না। নাক আর কপালের মাঝখানটা বসা। যেন বড়ো কোনো অপারেশন হয়েছিল একসময়। ডান দিকের ভুরুটা উঠে আছে কপালের ওপর পর্যন্ত। বাঁ ভুরুটা তলিয়ে গেছে বাঁ চোখের কোণে। গোটা মুখটা যে ক্ষতবিক্ষত তা নয়, অমসৃণ–এবড়ো-খেবড়ো। মনে হল তার মুখের চামড়াটা যেন গোটানো। এরকম ভয়ংকর মুখ এর আগে দেখিনি।
ওকে দেখে এ বাড়ির ছেলেরা ছাড়া আর সবাই হৈ হৈ করে উঠলকী চাই? ক চাই?
ও মাথা কাঁপয়ে বলল, আমি গান করব।
ইস! গান করবে! যা ভাগ। পালা।
ও বাড়ির ছেলে মোহন ইশারায় সবাইকে থামতে বলে চারুকে বলল, তুই ঐ এখন গিয়ে বোস।
চারু মাথা গরম করে বলল, আমায় গাইতে দিতে হবে। নইলে–
নইলে কী করবি তুই? আমাদের মধ্যে একজন তেড়ে যাচ্ছিল, মোহন থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি গাইবে। আমি ব্যবস্থা করে দেব। তবে একটার বেশি নয়।
চারু কিছুটা শান্ত হয়ে দূরে চৌকিতে গিয়ে বসল। ঐটুকু যেতেও সে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। কী করে যে একা একা পথ হাঁটে কে জানে! চৌকিতে বসে সে ঘাড়টা একবার এদিক একবার ওদিক করতেই থাকল।
মোহনকে নিচু গলায় জিগ্যেস করলাম, কে ও? চেন?
মোহন বলল, ওর বাবা বর্ধমান রাজস্টেটের ম্যানেজার। এরা খ্রিস্টান। এখানে রাজবাড়ির সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে সবে এসেছে। ছেলেটি জড়বুদ্ধি। ওকে নিয়ে ওর বাবার অনেক যন্ত্রণা। তবে গানের গলা আছে।
গান চলতে লাগল। আর চৌকিতে বসে চারু ঘাড় নেড়ে, হাতে তাল দিতে লাগল। হঠাৎ তার খেয়াল হল গানের আসর ভাঙার মুখে। অনেকেই উঠে গেছে। তখনই চৌকি থেকে লাফ দিয়ে হারমোনিয়ামটা কেড়ে নিয়ে বাজাতে লাগল। দুবার রিড টিপেই গান ধরল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হুকুম করল, বাজাও!
তার বলার ভঙ্গিতে রাগ হল। আমি বাজালাম না।
এরপর যা ঘটল তা বলবার নয়। চারু হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে শতরঞ্জি ঠেলে দিতে লাগল। কাপ, ডিশ, গেলাস উল্টে একাকার।
আমাকে ইনসাল্ট! আই মোহন, এই ছোকরা তোদের বন্ধু?
মোহন খুব বুদ্ধিমান আর শান্ত প্রকৃতির। চারুর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললে, আর্টিস্টদের মাথা গরম করতে নেই!
সাপের মাথায় যেন মন্ত্রপড়া শেকড় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চারু জল। হেসে বলল, ঠিক বলছ আমি আর্টিস্ট?
মোহন বলল, শুধু আমি কেন? সবাই বলছে তুমি আর্টিস্ট। নাও ঠান্ডা মাথায় গান ধরো।
চারু হারমোনিয়াম টেনে নিল। মোহন ইশারা করে আমাকেই বাজাতে বলল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাজাতে হল।
আসল কথা হচ্ছে, এক-একজন এমন মানুষ আছে যাকে দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়। চারু সেই রকম একজন। ওর মুখটা যে কী ভয়ংকর তা আপনি না দেখলে ভাবতে পারবেন না ফাদার।
মুখটা কি ওর জন্মগত, না জটিল কোনো অপারেশনের ফল? জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।
বললাম, জানি না। সেদিনই ওকে প্রথম দেখেছিলাম।
পাদ্রীবাবা একটু ভেবে বললেন, মনে হয় ওটা জন্মগত। জন্মগত বলেই মুখের ছাপ ওর স্বভাবে এসে পড়েছে।
একটু থেমে বললেন, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও দেখা গেছে মা-বাপের অজান্তে কোনো অশুভ আত্মা জন্ম নেয়। যেমন মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে পুণ্যাত্মারা এসে পড়েন। কে কখন আসেন সামান্য মানুষ তা জানতে পারে না। বিজ্ঞান এখানে পরাস্ত। আপনাদের চারু বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তেমনি হয়েছিল। তার জীবনটা চালাচ্ছিল একটি ভয়ংকর অশুভ আত্মা।
আমি বললাম, মোহনের কাছে শুনেছিলাম, ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা যান। তারপর যখন ওর বয়েস বছর পাঁচ ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু এই ছেলেকে ওর সত্য মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। নতুন বিয়ের পরই ওঁরা পুরীর রথযাত্রা দেখতে গেলেন। সেখানে ভিড়ে হাত ফস্কে চারু হারিয়ে যায়। কেউ কেউ বলে ওর সম্মা নাকি ইচ্ছে করেই চারুকে ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আসেন। বাবা চাইলেও ওর সত্য পুলিশকে জানাতে দেননি।