- বইয়ের নামঃ ভৌতিক অমনিবাস
- লেখকের নামঃ মানবেন্দ্র পাল
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, ভূতের গল্প
অন্ধকার সিঁড়ি
সে আজ বেশ কিছুদিন আগের কথা। এই কলকাতা শহরেই আমার জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটেছিল যা মনে পড়লে এখনও ভয়ে গায়ে কাটা দেয়।
তখন আমার বয়েস কতই বা হবে? একুশ-বাইশ? বি. এ. পাস করে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোথাও চাকরি পাই না। তখন একদিন পিসেমশাইয়ের বাড়ি গিয়ে দেখা করলাম। পিসেমশাই একটা বড়ো কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টার। সব শুনে তিনি আমায় ওঁর অফিসে দেখা করতে বললেন। তার কথা মতো একদিন ওঁর অফিসে যাবার জন্যে প্রস্তুত হলাম।
দিনটা খুবই বাজে ছিল। একে পৌষ মাসের শেষ, তার ওপর অসময়ে দুতিনদিন ধরে চলছে টিপ টিপ করে বৃষ্টি। হাড়-কামড়ানো কনকনে ঠাণ্ডা। দুদিন পর বৃষ্টিটা সেদিন ছেড়েছিল। কিন্তু আকাশটা ছিল গোমরা মুখের মতো মেঘলা করে। মাঝে মাঝেই ঝোড়ো বাতাস। ঠাণ্ডা বাতাসে মুখচোখে যেন উঁচ বিঁধছিল। কান দুটো যেন কেউ বরফের ছুরি দিয়ে কেটে দিচ্ছিল। সেই অবস্থায় বেরোচ্ছিলাম, আমার ছবছরের ভাইপোটা সোয়েটার, কোট, মাংকি-ক্যাপ পরে সামনে এসে দাঁড়ালো। মাংকি-ক্যাপ পরে তাকে কেমন দেখাচ্ছিল সেটা জাহির করার জন্যে সে আমার সামনে এসে হাত-মুখের নানা ভঙ্গি করতে লাগল। আমি ওকে আদর করে বেরোতে যাচ্ছিলাম, ও বললে, তোমার মাংকি-ক্যাপ নেই কাকু?
তা তো বটে। আমার মাংকি-ক্যাপটা তো ট্রাঙ্কে পচছে। বড়ো একটা ব্যবহার করা হয় না। আজকের ওয়েদারেও যদি ওটা ব্যবহার করা না হয় তাহলে আর কবে হবে? আমি তখন আবার ফিরে গিয়ে মাংকি-ক্যাপটা বের করে সাইডব্যাগে নিলাম। খুব দরকার হলে পরব।
পিসেমশাইয়ের অফিসটা পার্ক স্ট্রীট আর ফ্রি স্কুল স্ট্রীটের মুখে। মস্ত বাড়ি। আর পুরনো। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। দিব্যি ঘষা-মাজা। শুধু খুব উঁচুতে ১৮৮০ লেখা দেখে বোঝা যায় বাড়িটা ঐ সময়ে তৈরি। বাড়িটার নিচের তলায় সব দোকান। আর পার্ক স্ট্রীটের দোকান মানেই বড়ো বড়ো কৈতাদুরস্ত ব্যাপার। বাড়িটার ওপরতলাগুলোতে যে নানা ধরনের অফিস রয়েছে রাস্তা থেকেই তা বোঝা যায়। ওদেরই মধ্যে ছতলায় পিসেমশাইয়ের অফিস।
কিন্তু ঢুকব কোন দিক দিয়ে বুঝতে পারলাম না। আষ্টেপৃষ্ঠে শুধু দোকান–আর দোকান।
অনেক খোঁজ করে বাড়ির প্রায় পিছন দিকে লিফটের সন্ধান পেলাম। কিন্তু–হ্যায়! লোডশেডিং চলছে! লিট অচল। কাজেই সিঁড়ির দিকে এগোলাম। ডান দিকে একটু এগিয়েই সিঁড়ি। এই সিঁড়ি ভেঙে দুতলায় উঠতে হবে।
লিফট যখন বন্ধ তখন সিঁড়িতে ভিড় হবার কথা। কিন্তু আমি ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই দেখে অবাক হলাম। অবশ্য অবাক হবার কিছুই ছিল না। কেননা এই বিশ্রী আবহাওয়ায় কেউ বাড়ি থেকে বেরোয়নি। নিতান্তই দায়ে পড়ে যারা এসেছিল তারা নিশ্চয় লোডশেডিং হবার আগেই ওপরে উঠে গেছে। যাই হোক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আরম্ভ করলাম।
সিঁড়ি যে এত অন্ধকার তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওপরে উঠতে লাগলাম। সিঁড়িগুলো কাঠের আর বেশ চওড়া, তাই রক্ষে। হোঁচট খাবার ভয় ছিল না। প্রথমটা অন্ধকারে উঠতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। পকেট থেকে দেশলাই বের করে লাঠি জ্বালতে জ্বালতে উঠছিলাম। তারপর অন্ধকার ক্রমে চোখ-সওয়া হয়ে গেল। পনেরো-কুড়ি ধাপ ওঠার পরই খানিকটা সমতল মেঝে। এটুকু বেশ হাঁটা যায়। তারপর আবার খাড়া সিঁড়ি। বুঝলাম সমতল মেঝেগুলো এক-এক তলা বোঝায়।
আমি ধীরে ধীরে উঠছি। বাঁদিকে লিফটের অন্ধকার খাদ। অবশ্য পড়ে যাবার ভয় নেই। লোহার শিকের জাল দেওয়া। ডান দিকে নিরেট দেওয়াল। দেওয়ালটাকে মনে হচ্ছিল যেন পাহাড়ের গা। কোথাও কোনো ফাঁক-ফোকর নেই।
আমি উঠছি তো উঠছিই।
সিঁড়িটা একে অন্ধকার তার ওপর নির্জন। ভাবলাম এরকম জায়গায় তো কাউকে ভুলিয়ে এনে দিব্যি খুন করা যায়।
ভাবতেই গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল।
এমনি কতক্ষণ উঠেছি, হঠাৎ খেয়াল হলো কতলা উঠলাম তা তো হিসেব করিনি। দুতলা পার হয়ে যাইনি তো? একথা মনে হতেই আবার নামতে লাগলাম। কী গেরো! নামছি তো নামছিই। শেষে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে, দম নিয়ে আবার উঠতে শুরু করলাম।
এবার খুব হিসেব করে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলাম।–এই হলো দোতলার মেঝে।
আর কিছুক্ষণ পর–এই হলো তিনতলার মেঝে।–এ-ই চারতলা-উঃ! এরই মধ্যে হাঁপিয়ে গিয়েছি।
কিন্তু এতক্ষণেও কাউকে সিঁড়ি ভাঙতে দেখছি না কেন? কেউ না উঠুক, নামবেও না? তবে কি অন্য দিক দিয়ে আর কোনো সিঁড়ি আছে? আমি কি তবে ভুল করে পরিত্যক্ত কোনো সিঁড়ি দিয়ে উঠছি?
এ কথা মনে হতেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল।
হঠাৎ এই সময়ে সিঁড়িতে জুতোর শব্দ পেলাম। কেউ যেন ভারী ভারী পা ফেলে ওপর থেকে নেমে আসছে। অবাক হয়ে তাকাতেই দেখি সুট-টাই-পরা একটা সাহেব নামছে। তার টুপিটা নেমে এসেছে কপালের নিচে পর্যন্ত। দুহাত কোটের পকেটে গোঁজা।
কলকাতায় এখন বড়ো একটা সাহেব-মেম চোখে পড়ে না। আজ হঠাৎ সামনে সাহেব দেখে অবাক হলাম।
সাহেব তখন একেবারে আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। অথচ পাশে যথেষ্ট নামার জায়গা।
যেহেতু আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক সেজন্যে সাহেব দেখে ভয় পেলাম না। রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বললাম–সাহেব, লোকের ঘাড়ে এসে পড়ছ যে! দেখে শুনে নামো।
সাহেব আমার দিকে ফিরে তাকালো। উঃ! কী ভয়ংকর দৃষ্টি! আর চোখ দুটো? তা কি মানুষের চোখ? আমি কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে তিন ধাপ ওপরে উঠে এলাম। তারপর আন্দাজে তলা হিসেব করে ওপরে উঠতে লাগলাম। কিন্তু মনটা কিরকম বিভ্রান্ত হয়ে গেল। হঠাৎই মনে হলো এই মাত্র যাকে দেখলাম সে যেন ঠিক স্বাভাবিক মানুষ নয়। এমন কি–এমন কি বোধহয় মানুষও নয়। মানুষ নয়–কেননা, যে পায়ের শব্দটা সামনে থেকে পেয়েছিলাম, আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় সে শব্দটা আর পাইনি। সাহেবটা যেন বাতাসে ভর করে নেমে গেল।
এ কথা মনে হতেই আমার গা-টা কেঁপে উঠল। আর তখনই মনে হলো এই অন্ধকার সিঁড়িতে আরও কিছু মারাত্মক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।
ভাবতে ভাবতে মাত্র পাঁচ-ছ ধাপ উঠেছি, হঠাৎই আমার পা দুটো যেন সিঁড়ির সঙ্গে আটকে গেল। আমার দুচোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম। দেখি মাত্র কয়েক ধাপ ওপরে একটা লোক দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে সিঁড়িতে দুপা ছড়িয়ে ঘাড় কাৎ করে বসে রয়েছে। আর গলা থেকে রক্ত পড়ছে।
এ দৃশ্য দেখেই আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আমার চিৎকার শুধু নিশ্চিদ্র দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল।
এ তো রীতিমতো খুন! আর এ খুনটা যে সাহেবটাই করে গেছে তাতে সন্দেহ মাত্র রইল না।
আমি ভাবতে লাগলাম এই মুহূর্তে আমার কর্তব্য কী। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের কাজ নয়, উচিতও নয়। সাহেবটা তো পালিয়েছে। এখন লোক ডেকে একে হাসপাতালে দেওয়া উচিত।
এ কথা মনে হতেই আমি তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। আমার পায়ে যে এত জোর তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমি কখনো কখনো একসঙ্গে দু তিন ধাপ সিঁড়ি ডিঙিয়ে নামছিলাম।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একতলায় এসে পৌঁছলাম। দিনের আলো দুচোখ ভরে দেখলাম। আমি এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে খুন-খুন– বলে চিৎকার করতে করতে দোকানগুলোয় খবর দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ করে লোক বেরিয়ে এল। তারা আমার ভয়ার্ত মুখ দেখে বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারল। উন্মত্ত উত্তেজনায় জিজ্ঞেস করল–কোথায় খুন?
আমি আঙুল তুঙ্গে সিঁড়িটা দেখিয়ে দিলাম। ওরা হৈ হৈ করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
এবার আমি কি করব ভাবতে লাগলাম। নাঃ, এখানে থাকা উচিত নয়। এখুনি পুলিশ আসবে। কে প্রথম দেখেছিল তাই নিয়ে খোঁজ-তল্লাশ হবে। আমি শুধু শুধু জড়িয়ে পড়ব। তার চেয়ে কেটে পড়াই ভাল।
এই ভেবে তাড়াতাড়ি পার্ক স্ট্রীট ক্রশ করে সামনের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এর পরেই হলো আমার মতিভ্রম। বাড়ি চলে গেলেই হতো। তা নয়, কেবলই মনে হতে লাগল খুনটা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী হলো দেখলে হয়।
এই ভেবে আবার রাস্তা পার হতে এগোচ্ছি–মনে হলো এটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। কারণ আমাকে দেখলেই কেউ না কেউ চিনে ফেলবেই। আর তখন জেরার মুখে পড়তে হবে কখন কী অবস্থায় খুন হতে দেখেছিলাম, খুন করে কাউকে পালাতে দেখেছিলাম কি না! আমিই যে খুন করিনি তার প্রমাণ কী?
তবু ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী হলো জানার জন্যে এমনই কৌতূহল যে আমি আবার রাস্তা পার না হয়ে পারলাম না। তবে হঠাৎ আমার মাংকি-ক্যাপটার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। আমি ব্যাগ থেকে টুপিটা বের করে মাথা, মুখ, গলা ঢেকে নিলাম। চোখ দুটো শুধু বেরিয়ে রইল।
সিঁড়ির মুখে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। কিন্তু আশ্চর্য–ডেডবডিটা কোথাও নেই, খুনীকে ধরা তো দূরের কথা। পুলিশও আসেনি। অথচ লোকগুলো মারমুখো। কাউকে যেন খুঁজছে।
একটু কান খাড়া করে থাকতেই শুনলাম একজন আর একজনকে বলছে–কোথায় খুন? সব মিথ্যে।
আমি অবাক হলাম। কেউ খুন হয়নি? কিন্তু আমি যে দেখলাম একজন সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে দেওয়ালে মাথা গুঁজে পড়ে রয়েছে!
তারপরেই যে কথাগুলো কানে এল তা শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল। সবাই উত্তেজিত হয়ে বলছে–সব মিথ্যে। সেই ধাপ্পাবাজ ছোকরাটাকে একবার পেলে হয়।
আমি তখন বেপরোয়া হয়ে একজন বুড়ো গোছের লোককে জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার মশাই?
সে বললে–একটা ছোকরা হঠাৎ ওপর থেকে নেমে এসে রটিয়ে দিল–সিঁড়িতে একজন খুন হয়েছে। শুনে সবাই ছুটল। কিন্তু কোথাও কিছু নেই।
মনে মনে ভাবলাম তাহলে তো কেউ খুন হয়নি। তাহলে কি দেখলাম?
কিন্তু তা নিয়ে তখন মাথা ঘামাবার আর সময় ছিল না। উত্তেজিত এক দল লোক কেবলই চেঁচাচ্ছে–কোথায় সেই ধাপ্পাবাজটা? ধরো তাকে। নিশ্চয় বেশিদূর পালাতে পারেনি।
আর একজন বললে–ধরতে তো লোক ছুটেছে। কিন্তু চিনবে কি করে?
–খুব চেনা যাবে। একজন উৎসাহী মস্তান চেঁচিয়ে উঠল। আমি দেখেছি তার কপালে মস্ত একটা আঁচিল আছে।
সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি মাংকি-ক্যাপটা ভালো করে টেনে সরে এলাম। পালাতে হবে।
কিন্তু পালাব কোথায়? গলির মুখ থেকে ফুটপাথ পর্যন্ত ভিড়। তারা বলছে–ধাপ্পা দেবার কারণ কি? নিশ্চয় কোনো বদ মতলব আছে। পাকড়াও। কিন্তু কোন দিকে গেল?–ঐ দিকে-ঐ দিকে।
আমার হাত-পায়ের তখন প্যারালিসিসের রুগীর মতো অবস্থা। এখনও যে একেবারে ওরে মধ্যে থেকেও ধরা পড়িনি তা শুধু এই মাংকি-ক্যাপটার জন্যে।
কিন্তু লোকগুলো যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যেন আমাকেই সন্দেহ করছে। মাংকি-ক্যাপটা যদি একবার তুলে নেয়, তাহলেই গেছি।
এই শীতেও সোয়েটার ভিজিয়ে ঘামছি। কি করে পালাব? চারিদিকে ক্ষিপ্ত লোক।
আমার চোখ-মুখের যা অবস্থা–আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম কেউ ভালো করে নজর করলেই ধরে ফেলবে আমিই সেই।
হঠাৎ দেখলাম কয়েকজন লোক আমার দিকেই আসছে। কি করব–কোথা দিয়ে কেমন করে পালাব ভাবছি এমনি সময়ে কারেন্ট এসে গেল। আমি তাড়াতাড়ি লিফটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরেই লিফট চালু হলো। আমি লিফটে উঠে পড়লাম। আমার সঙ্গে এবার উঠল আরও কয়েকজন ভদ্রলোক। সোজা চলে গেলাম ছতলায় পিসেমশাইয়ের নিশ্চিত হেপাজতে।
.
ঘটনাটা এখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিল। তা যে হয়নি সে শুধু আমার কপালদোষে।
সাত দিন কেটে গেছে। এই সাত দিন ধরে শুধু একটা কথাই মনে হয়েছে– সে দিন অন্ধকার সিঁড়িতে যা দেখেছিলাম তা সবই কি ভুল? সেই যে সাহেব যার কপাল পর্যন্ত ঢাকা টুপি, হিংস্র ভয়ানক চোখ–সেই যে ঘাড়-কাৎ-করে-পড়ে-থাকা মৃতদেহ–সব ভুল?
শেষ পর্যন্ত আবার সেই সর্বনেশে কৌতূহল ঘাড়ে চেপে বসল। ঠিক করলাম আবার একদিন ঐ সিঁড়ি দিয়ে উঠব। দেখি তেমন কিছু চোখে পড়ে কিনা।
যেমনি ভাবা তেমনি কাজ।
আবার একদিন সেই সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। আজ লোডশেডিং নয়। চারিদিকে আলোয় আলো। লিফটও চলছে। কিন্তু আমি সিঁড়ি দিয়েই উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ি আজও নির্জন। লিফট থাকতে কে আর কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙে। শুধু আমিই একা উঠছি। সিঁড়ির প্রতিটি বাঁকে আলো।
একতলা-দোতলা-তিনতলা করে উঠতে লাগলাম। পাঁচতলার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ালাম। কি করে, কেমন করে যেন মনে হলো এই সেই জায়গাটা। ভালো করে বোঝার জন্যে দেওয়ালটার দিকে এগোচ্ছি আর ঠিক তখনই সব আলো নিভে গেল।
আমি নিশ্চিত জানি এটা লোডশেডিং ছাড়া কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, কিন্তু তবু কেন যেন সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এক মুহূর্তে মনে হলো আমি অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে। আর ঠিক তখনই একটা কনকনে হাওয়া বদ্ধ সিঁড়িতে আর্তনাদ করে আছড়ে পড়ল। তারপরেই একটা বরফের মতো কঠিন ঠাণ্ডা হাত যেন আমার মুখটা চেপে ধরবার চেষ্টা করল। আমি চিৎকার করতে গেলাম, কিন্তু পারলাম না।
তারপর কি করে যে নিচে নেমে এসেছিলাম বলতে পারব না।
বাইরে তখন শেষ-পৌষের মিষ্টি রোদ ঝলমল করছে।
পরে পিসেমশাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, আমি একাই নই–ঐ দৃশ্যটা আরও দু চারজন দেখেছে। তবে একটি বিশেষ দিনে, বিশেষ সময়ে। আমার দুর্ভাগ্য সেই বিশেষ দিন আর বিশেষ সময়েই আমি সেদিন অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলাম। কিন্তু পরের একদিনকার ঘটনাটা–ঐ যে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, বরফের মতো ঠাণ্ডা হাত…ব্যাপার কী! না, বুদ্ধিতে সব কিছুর ব্যাখ্যা চলে না।
অভিশপ্ত ৩৭
০১.
সামনের মে মাসে আমার সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হবে। এ কথা মনে করতেই ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। একটা অজানা ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয় তার কারণ এই নয় যে, কোনো জ্যোতিষী আমার হাত দেখে মে মাসে আমার বিপদের কথা জানিয়েছেন। অন্তত আমার তা মনে পড়ে না। তবে
তবে আমার পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়েসের সময় থেকেই খুব অস্পষ্ট কিছু কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে চায়। যেমন–নির্জন দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অনেক অনেক দিন আগের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সাদা দেওয়ালে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট একটা মানুষের চেহারা। সেই চেহারার মধ্যে গোটা মানুষটাকে বোঝা না গেলেও তার নাক চোখ মুখের গঠন যে বিকটাকৃতি ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেই মূর্তি হাত তুলে কাকে যেন কিছু বলছে। যাকে বলছে তার ছায়া এতটা অস্পষ্ট যে কিছুই বোঝা যায়নি।
দেওয়ালে সেই বীভৎস ছায়ামূর্তি দেখার পর থেকে আমার যেন কিছু মনে পড়তে লাগল। কিন্তু তা খুব অল্পক্ষণের জন্য। ফেনার বুদ্বুদ যেমন বাতাসে ভাসতে ভাসতে যায়, সেই রকমই মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা বাড়ি। তারপরেই সেটা সরে যায়। দেখা দেয় একটা মৃতপ্রায় রোগী। সেই রোগী ভয়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে খোলা জানলার দিকে। মৃতপ্রায় রোগীটি কী দেখছিল জানলা দিয়ে? ঘরে। একটা লণ্ঠন জ্বলছে। তারপরেই ভোজবাজির মতো সব অদৃশ্য।
যেসব কথা বললাম তা কিন্তু স্বপ্ন নয়। একটুও বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলা নয়। যেটুকু দেখেছিলাম তাই লিখলাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার জন্মমাসের কী সম্পর্ক? ভয়ের কারণই বা কী ভেবে পাই না।
তারপর আমি পরের ঘটনাগুলো মনে করবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাছিম যেমন মাঝে মাঝে তার শক্ত ভোলা থেকে একবার মুখ বার করেই খোলের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে নেয়, তেমনি আমার স্মৃতিগুলোও একবার ফিরে এসেই পরক্ষণে দূরে মিলিয়ে যায়। মহা মুশকিল। জীবনের একটা সময়ে ভয়ংকর নিশ্চয় কিছু ঘটেছিল। কিন্তু কী ঘটেছিল তা আজ ঠিক মনে করতে পারি না। সেই সময়ের কটা মাস আমার কাছে একেবারে ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে।
এরকম হওয়ার কারণ সেই সময়ে আমি কঠিন ব্যাধিতে পড়েছিলাম। কয়েকদিন জ্ঞান ছিল না। ভগবানের দয়ায় চিকিৎসার গুণে আমি ভালো হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার স্মৃতিশক্তি। অনেক চেষ্টায় স্মৃতিশক্তি ফিরল বটে কিন্তু অসুখের সময়ের স্মৃতি তেমন ফিরল না। তবে এতদিন পর এখন একাগ্র মনে ভাবতে থাকলে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কিছু মনে পড়ে। কিন্তু সাঁইত্রিশ বছরে পড়লেই ভয়ংকর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে এমন সম্ভাবনার কথা কেউ সেদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল কিনা তা স্পষ্ট মনে পড়ে না।
তবে কেন এই বছরে এই মে মাসটা পড়বার আগেই এত ভয়?
ভয়ের কারণ আছে।
মফঃস্বল শহর। বেশ আরামে থাকি। একলা মানুষ। এক-এক সময়ে খুব নিঃসঙ্গ লাগে– বিশেষ করে সন্ধেবেলাটা। কিন্তু কীই বা করতে পারি। ইচ্ছে করলেই তো যাকে তোক ডেকে বন্ধু পাতানো যায় না।
এ বাড়িতে আমি অনেক দিন আছি–অনেক দিন। তাই এ বাড়ির গলিঘুজি আমার নখদর্পণে। এ বাড়ির উঠোনের মাঝখানে একটা পুরোনো কুয়ো আছে। খুব দরকার পড়লে সেই জল তুলে ব্যবহার করি। জলটা ভালোই। কুয়োর গায়ে একটা নারকেল গাছ। তার পাশেই একটা পেঁপে গাছ। কুয়োতলা থেকে দুধাপ উঠলে একটা রক। একটা বাঁক ফিরে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে। বাইরে যাবার এই খিড়কির দরজাটা আমি বড়ো একটা খুলি না। ওটা খিল আঁটা থাকে।
সেদিন–সন্ধে তখনও হয়নি। পুরোনো এই বাড়িতে এরই মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। কুয়োতলার অনেকখানি তফাৎ দিয়ে যাতায়াতের যে পথটা দোতলায় উঠে গেছে, আমি সেই পথ ধরে ওপরে ওঠার জন্যে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল কুয়োতলায় অন্ধকারে গা মিশিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।
নিশ্চয় চোর!
আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–কে ওখানে?
উত্তর দিল না। তবে ধীরে ধীরে খিড়কির দরজার দিকে চলে গেল।
মরুক গে। চলে তো গেছে।
নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে উঠছিলাম, মনে হল–তাই তো! চলে গেলে খিড়কির দরজা খুলেই তো যাবে। তা হলে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। আর তা করতে হবে আমাকেই।
অগত্যা সেই অন্ধকারেই কুয়োতলাটা বাঁ দিকে রেখে রকের ওপর দিয়ে এগোতে লাগলাম। কেমন যেন ভয় করছিল। হাতে একটা লাঠি পর্যন্ত নেই। খিড়কির দরজার বাঁকে যদি চোরটা দাঁড়িয়ে থাকে!
কিন্তু উপায় নেই। খিল বন্ধ করতে যেতেই হবে। পায়ে কী ঠেকল। দেখলাম একটা শাবল। পরশু দিন কুয়োপাড়ে একটা বাঁশ পোঁতবার জন্যে মাটি খুঁড়ছিলাম। ভালোই হল। সেটা তুলে নিলাম। হাতে একটা কিছু রইল।
কুয়োতলা থেকে এগিয়ে উঁচু রকটা যেখানে তিনখানা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে–আমি সেদিকে গেলাম। এখানটায় যেন বড্ড বেশি অন্ধকার। কিন্তু উপায় কী। আমি আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে থেকে এই বুঝি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তবু পালালে চলবে না। খিড়কির দরজায় খিলটা লাগাতেই হবে।
তাই অনেক চেষ্টা করে কথা বলতে গিয়ে কোনোরকমে একটা চাপা ভাঙা স্বর বেরিয়ে এল–ক্যা–? আর সেই সঙ্গে লোহার শাবলটা মাটিতে ঠুকে জানান দিলাম–জেনে রেখো আমার হাতে শাবল আছে।
যদি কেউ সাড়া দেয় তাই মিনিট দুই চুপ করে অপেক্ষা করলাম। তারপর মনে মনে জয় মা বলে এক লাফে খিড়কির দরজার কাছে।
না, কেউ কোথাও নেই।
বুঝলাম যে এসেছিল সুবিধে করতে না পেরে কেটে পড়েছে।
কিন্তু ব্যাপারটা যে এত সহজ নয় তা পরক্ষণেই খিল লাগাতে গিয়ে বুঝলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজা তো খোলাই হয়নি। খিল তো ভিতর থেকে লাগানো।
বিশ্বাস হল না। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালোম। যতবারই জ্বালি অমনি নিভে যায়। মন হল কেউ যেন খুব কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। শেষে পাঁচবারের বার জ্বলল। অমনি ক্ষণিকের সেই আলোয় দেখলাম খিলটা যেমন অনেক দিন থেকে আঁটা তেমনিই আছে। কেউ খোলবার চেষ্টা মাত্র করেনি। মাকড়সার জালগুলো পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়নি।
তা হলে কী প্রমাণিত হল?
হল এই –যাকে আমি স্বচক্ষে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম–তারপর যে গটগট করে খিড়কির দরজার দিকে এগোচ্ছিল সে কিন্তু খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে যায়নি। কারণ আমি নিজের চোখেই দেখেছি খিল বাড়ির ভিতর থেকে আঁটা।
তাহলে?
তাহলে যিনি ছিলেন তিনি শরীরধারীই হন কিম্বা দেহমুক্তই হন, বাড়ির মধ্যেই কোথাও রয়েছেন। কেমন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলেন জানি না। তবে বেরোতে পারেননি। হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরেই কোথাও রয়েছেন!
এ কথা মনে হতেই আমার মাথাটা ঝিমঝিম্ করে উঠল। কারণ তিনি যিনিই হন, এই বাড়িতে গোটা রাত্রি তাঁর সঙ্গে থাকা যাবে না।
থাকা যাবে না বললে কী হবে? না থেকে যাব কোথায়? আর সেই তিনি যে কোথায় গেলেন পরের দিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস করতে পারলাম না। অগত্যা সব কিছু ভগবান আর ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজকর্ম নিয়ে ভাবতে লাগলাম।
ভেবেছিলাম ঐ রকম ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু
সেদিন সন্ধের সময় দোতলার ঘরে বসে লেখালিখির কাজ করছি, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়াল। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়, একদৃষ্টে যেন তাকিয়ে আছে পিঠের দিকে। সেই মুহূর্তে কী করব কিছুই ভেবে পেলাম না। উঠে পালাব সে উপায় নেই। অগত্যা টেবিলের নীচে ঘাড় গুঁজে রইলাম।
কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। এক সময়ে ঘাড় টন্টন্ করায় সোজা হয়ে বসলাম। জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এল এক ঝলক, সাহস করে পিছন ফিরলাম। কেউ নেই।
এখন কেউ নেই এ কথা যেমন সত্য, তেমনি একটু আগেও কেউ যে ছিল তাও সত্য। কিন্তু কে সে? কী চায়? কেনই বা আমার কাছে এসেছিল? এইসব চিন্তা আমায় বিভ্রান্ত করে তুলল। মন হল কদিন আগে কুয়োতলায় যাকে অস্পষ্ট দেখেছিলাম সেও কি তবে অশরীরী ছিল? কী সর্বনাশ!
হঠাৎ এত কাল পর আমার বাড়িতেই এসব উপদ্রব কেন? কী চায়? এই চাওয়ার সঙ্গে এ বছর মে মাসে আমার যে বিপদের কথা–তার সঙ্গে কি কোনো সম্বন্ধ আছে?
আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।
তৃতীয় যে ঘটনাটা মাত্র গতকাল ঘটল সেটা আরও সাংঘাতিক।
বিকেলে প্রায়ই আমি রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি। খোলা জায়গায় নির্মল বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়। কাল আমি বাড়ির পিছনের গলি দিয়ে ফিরছিলাম। গলির বাঁ দিকে গৌর ঘোষের বিরাট নারকেল গাছের বাগান। সেই পথটুকু পার হচ্ছি হঠাৎ একটা গাছের ওপরে সরসর শব্দ হল যেন নারকেল পাতা খসে পড়ল। তারপরই হাওয়ার একটা জোর ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গে খুব চাপা গলায় কে যেন বলে গেল–আর মাত্র কিছু দিন। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও মিলিয়ে গেল।
আমি চমকে উঠলাম। প্রথমত যে ধাক্কা দিয়ে গেল তাকে দেখতে পেলাম না। হাত থেকে পেনটা পড়তে যতটুকু সময় লাগে তারও কম সময়ের মধ্যে শুধু একটা দমকা হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আর দ্বিতীয় যে জন্যে চমকে উঠলাম সেটা হচ্ছে কথাটা যে বলল তার গলাটা যেন চেনা চেনা অথচ কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কার গলা। তবে এটা ঠিক, গলার স্বর যারই হোক সে অন্তত এখন জীবিত নয়।
এই শেষের ঘটনায় আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এ কদিন যে সব অস্বস্তিকর অবস্থা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল–সত্যি, মিথ্যে, সন্দেহের দোলায় দোলাচ্ছিল এখন তার নিরসন হল। অর্থাৎ যা ছিল সন্দেহ আজ তা দূর হয়ে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল–ব্যাপারটা নিছক মানসিক নয়। সত্যিই কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
কথাটা আমি মনে মনেই রাখলাম। কাউকে বললাম না। বললেই নানা রকম উপদেশ, পরামর্শ যা কোনো কাজে দেবে না। তার চেয়ে বরং ভেবে দেখতে হবে গলার স্বরটা কার হওয়া সম্ভব। আর সে এমন একজন যে এখন আর পৃথিবীতে নেই।
পৃথিবীতে নেই আমার জানাশোনা এমন বহু লোক বহুদিন আগে থেকে পরলোকগামী হয়ে আছেন। তার মধ্যে থেকে ঠিক এই কণ্ঠস্বরের মালিকটিকে খুঁজে বের করা কঠিন ব্যাপার। এ তো গোয়েন্দাগিরি নয়। তবু আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
কাজেই এখন আমার প্রথম কর্তব্য হল একান্তে বসে মৃত আত্মাদের বাছাই করে ফেলা।
কী ভাবে বাছাই করব?
প্রথমে যাদের কথা মনে পড়ে এমন মৃত ব্যক্তিদের একটা তালিকা করা। তারপর সেই লম্বা তালিকা থেকে দশ বছর কি তারও কিছু আগে যারা গত হয়েছে তাদের চটপট বাদ দেওয়া। কারণ এতদিনে তাদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। এতে তালিকা একটু হালকা হবে।
এইভাবে মৃত আত্মাদের নামের ছাঁটকাট করা তালিকাটি নিয়ে কয়েকদিন পর নিরিবিলিতে একদিন বসলাম।
আমার বাড়ির পরিবেশ খুব শান্ত। কেননা আমি ঝাড়া-হাত-পা মানুষ। অর্থাৎ বিয়ে শাদি করিনি। আত্মীয়-স্বজনরা আমার খোঁজ-খবর রাখে না। তাই আমিও তাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁযি না। বাড়িতে একাই থাকি। তবে সত্যি কথা বলতে কি মাঝে মাঝে বড্ড একা বোধ করি। বাড়িতেই থোক, বাড়ির বাইরেই থোক কথা বলার মানুষ চাই।
যাই হোক, সেদিন মৃত আত্মাদের তালিকা নিয়ে কাজ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ চমকে উঠলাম। কেউ একজন আমার বসার ঘরে ঢুকে পড়ার পর বলল, আসব স্যার?
.
০২.
তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উনিশ-কুড়ি বছরের একটি ছেলে দাঁত বের করে বোকার মতো হাসছে। প্রথম দর্শনে অবাক হয়েছিলাম। কেমন যেন চেনা চেনা মুখ। অনেক দিন আগে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।
বললাম–কী চাই?
ও কিছুমাত্র সংকোচ ন! করে বলল-ভাত খাব।
বলে একটু সলজ্জ হাসল।
আমি তখন ওকে বসিয়ে ওর খবরাখবর নিলাম। নাম নকুল। ওর মা-বাবা যখন মারা যায় তখন ওর বয়েস বারো। বাধ্য হয়ে ও ওর মামার কাছে চলে আসে। মামী প্রথমে এই বয়েসের পরের ছেলের দায়িত্ব নিতে চায়নি। শেযে মামা-মামী দুজনে ঠান্ডা মাথায় পরামর্শ করে ঠিক করল বাজার-দোকান করা, জল ভোলা, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করার মতো ভারী কাজগুলো একে দিয়ে করিয়ে নিলে মাইনে দিয়ে আর লোক রাখতে হবে না।
এই সুবুদ্ধি মাথায় উদয় হতেই মামা-মামী নকুলকে ঠাই দিলেন।
কিন্তু এই সুখ বেচারির বেশিদিন সইল না। মামা-মামীর নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে বাঁচল। তারপর নানা জায়গা ঘুরে খেয়ে, না-খেয়ে, অর্ধাহারে খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন শুয়ে শেষে একদিন এখানে এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল।
ওর কথা শুনে কেমন যেন মায়া হল। বললাম–শোনো, আমার বাড়িতে রাঁধার কেউ নেই। আমি নিজেও রাঁধতে পারি না। হোটেলে খাই। কাছেই হোটেল। তুমি ওখান থেকে খেয়ে নাও। বলে একটা দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা দিলাম। ও ফের হাত জোড় করে নমস্কার করে চলে গেল।
ভেবেছিলাম একেবারেই চলে গেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই সে এসে হাজির। তাকে দেখে বেশ তৃপ্ত বলে মনে হল। বললাম, খেয়েছ?
ও ফের হাত জোড় করে বলল, অনেকদিন পর মাছভাত খেলাম। তিনবার ভাত নিলাম। বলে হাসতে লাগল।
বললাম, পেট ভরেছে তো?
হ্যাঁ–বলে মাথা দোলাল।
তারপর প্যান্টের পকেট থেকে তিনটে টাকা বের করে আমার টেবিলে রাখল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ও বলল, এ টাকাটা লাগেনি।
তাই ফেরত দিচ্ছ?
আমার যতটুকু লাগার তাই নিয়েছি।
বললাম, টাকা তিনটে তুমি রাখো।
ও যেন কৃতার্থ হল। টাকা তিনটে তুলে নিয়ে হঠাৎ আমায় প্রণাম করল। বলল, আপনার এই দয়া যতদিন বাঁচব ততদিন মনে রাখব। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাবে এখন?
জানি না স্যার। এ বেলা যা খেয়েছি তাতে দুদিন না খেলেও চলবে। আর শোওয়া? রাস্তার ধারে খোলা রক তো কতই পড়ে রয়েছে।
চলে যাচ্ছিল, ডাকলাম, শোনো।
ও ফিরে দাঁড়াল।
তুমি আমার কাছে থাকবে?
ও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর অস্ফুটস্বরে বলল, আমায় বলছেন, স্যার?
হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি।
ও তবু যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, আমি এই বাড়িতে থাকব! দুবেলা খেতে পাব?
হেসে বললাম, হ্যাঁ, তাই।
আমায় কী করতে হবে?
কিচ্ছু না। তুমি চা করতে পার?
তা আর পারি না? কত চায়ের দোকনে তো কাজ করলাম।
তাহলে তো ভালোই। তোমার কাজ হবে আমার সঙ্গে গল্প করা। আর মাঝে মাঝে চা করে খাওয়ানো। আর একটা কাজ–আমার কিছু ধানজমি আছে। সাইকেল আছে। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু দেখাশোনা করা।
নকুল এবার আর কোনো কথা বলতে পারল না। হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো আনন্দে একটা পাক খেয়ে নিল। সেই থেকে নকুল হয়ে গেল আমার সঙ্গী।
নকুলকে পেয়ে আমার সুবিধেই হয়েছে। কথায় বলে, একা না বোকা! তা সত্যি একা থাকলে কেমন ভয় ভয় করে। তাছাড়া যত উদ্ভট অবাস্তব কল্পনা মাথায় খেলে বেড়ায়।
হ্যাঁ, উদ্ভট ভাবনা। নকুল আসার পর থেকে সেই পরলোকগত আত্মাগুলির নাম-পরিচয় বাছাই করার মতো পাগলামি বন্ধ ছিল। সেই অদৃশ্য আত্মাটিও আর উৎপাত করেনি। করবেই বা কী করে? চিরকালই তো শুনে আসছি একের বেশি মানুষ থাকলে আত্মাটাত্মা কাছে ঘেঁষে না। এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত আছি।
নকুল বেশ স্বচ্ছন্দেই আছে। বাড়ির সব কাজই করে। বলতে হয় না। তবে একটু বেশি উৎসাহী। তড়বড় করে ঝুল ঝাড়তে গিয়ে সেদিন একটা ছবির কাচ ভেঙে ফেলল। এসব ব্যাপারে সে মোটেই লজ্জিত নয়। আমিও কিছু বলি না। তবু তো বাড়িতে একটা সচল প্রাণী নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।
প্রতিদিন ও কী দোকান-বাজার করল তার একটা ফর্দ দেয়। দুজন মানুষের সামান্য খরচ। তবু ও বোধ হয় নিজের সতোর প্রমাণ দেবার জন্যে নিজেই ফর্দ দেয়। আমি মোটামুটি চোখ বুলিয়ে নিয়ে হিসেব বুঝে নিই। একদিন দেখলাম ফর্দের তলায় লেখা ইঁদুর মারার ওষুধ।
আমার বাড়িটা পুরোনো হলেও আজ পর্যন্ত সাপ, বিছে, ব্যাঙ, ইঁদুরের উৎপাত হয়নি। তা হঠাৎ ইঁদুরের এমন উৎপাত হল–কী ব্যাপার?
আমি নকুলকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ইঁদুর মারার ওষুধ? বাড়িতে ইঁদুর দেখা যাচ্ছে নাকি?
ও ওর স্বভাবমতো মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে না। ইঁদুর দেখা যায়নি বটে কিন্তু মাটি তুলছে খুব।
মাটি তুলছে মানে?
প্রায়ই দেখছি এখানে-ওখানে শুকনো মাটি পড়ে। কত পরিষ্কার করি বলুন তো?
বললাম, ইঁদুর মারার ওষুধে যদি মাটি ভোলা বন্ধ হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যা বলছ এখানে-ওখানে মাটি উঠেছে তাহলে তো অনেক গর্ত। গর্তগুলো দেখেছ তো?
নকুল বলল, ইঁদুর মারার ওষুধ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়। গর্তের খোঁজ করতে হয় না!
নকুল জিগ্যেস করল, তা হলে ইঁদুর মারার ওষুধ কিনব তো?
বললাম, না কিনে তো উপায় নেই।
ওষুধ কেনা হল। নকুল বঁট দিয়ে ইঁদুরের মাটিগুলো সাফ করে দিল।
তারপর সে ইচ্ছেমতো রুটির সঙ্গে হঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে এমন করে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে দিল যে আমাকেই সাবধানে বারান্দায় চলাফেরা করতে হল। নকুল সদাজাগ্রত প্রহরীর পাহারা দিতে লাগল কখন ইঁদুর সেই রুটি খাবে। কিন্তু একটিও মরা ইঁদুর দেখা তো দূরের কথা, ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুরও রুটি খেতে এল না।
শেষ পর্যন্ত নকুল হতাশ হয়ে বলল, ইঁদুরগুলোও এখন সেয়ানা হয়ে গেছে দাদা। অত রুটি ছড়িয়ে রাখলাম একটা ইঁদুরও ত্রিসীমানায় ঘেঁষল না।
বললাম, না ঘেঁষুক। মাটি উঠলে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিও। তা হলেই হবে।
নকুল কথা বাড়াল। চলে গেল।
মেঝেতে আর মাটি উঠেছিল কিনা জানি না, ও বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবে নকুল আর ঐ নিয়ে আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করেনি। কিন্তু লক্ষ করছি ও যেন দিন দিন কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তা কম বলছে। ও কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ করেছে? জানি না। রাগ করার তো কোনো কারণ নেই। সকলেই জানে আমি কথায় বার্তায় খুব সংযত। কাউকে রূঢ় কথা কখনও বলি না।
একদিন আর থাকতে না পেরে ওকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, নকুল, তোমার কি কিছু হয়েছে?
নকুল গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে জানাল, না।
তাহলে এত গম্ভীর কেন?
ও চুপ করে রইল।
বললাম, শরীর খারাপ?
ও আগের মতো মাথা নেড়ে জানাল, না।
তবে মন খারাপ?
এবার নকুল মাথা নাড়তে নাড়তে ভেতরে চলে গেল।
এই এক নতুন ভাবনা শুরু হল। নকুলের যে কিছু হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু কী হয়েছে তা ধরতে পারছি না। ভাবনা হল–যাও বা একটা ভালো সঙ্গী পেলাম তাও বুঝি আর টেকে না।
যাই হোক, আমি আর নকুলকে ঘাঁটালাম না; ও নিজের মতো করে যে কদিন কাজ করতে চায় করুক।
একদিন দেখলাম, দুপুরে যখন কাগজ পড়ছি, নকুল নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। বললাম, কিছু বলবে?
ও মুখটা করুণ করে বলল, হ্যাঁ।
অভয় দিয়ে বললাম, বলো।
ও যেন দমকা কাশির মতো বলে উঠল, দাদা, এ বাড়িটা খারাপ।
আমি চমকে উঠলাম। ও-ও কি তাহলে কিছু দেখেছে? সামলে নিয়ে বললাম, মানে?
ও নানাভাবে বোঝাতে চাইল যে, ও নাকি প্রায় সন্ধেবেলায় কাউকে ভেতর-বারান্দায় চলে বেড়াতে দেখে। যে চলে বেড়ায় তাকে ডাকলে সাড়া দেয় না। আলো নিয়ে গেলেও দেখা যায় না। নকুল নিশ্চিত যে, দেখা না গেলেও বুঝতে পারে কেউ একজন আশেপাশে রয়েছে।
সর্বনেশে কথা। আমি ভয় পেলাম। বুঝলাম আগে যাকে দেখতাম সে তাহলে যায়নি। এখানেই আছে। ইদানিং আমায় দেখা দেয়নি।
ভয় পেলাম ঠিকই। কিন্তু নকুলের কাছে তা প্রকাশ করলাম না। একটু হেসে বললাম, তাই বুঝি?
উত্তরে নকুল তার বাঁ হাতের তালুতে ঘুষি মেরে আমায় বলল, আমায় ভয় দেখানো? আমি কিন্তু ছাড়ব না। এবার দেখা পেলে জাপটে ধরবই।
ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও সব করতে যেও না। কী থেকে কী বিপদ ঘটে যায় তা বলা হায় না। যাকে মনে করছ আছে সে থাকুক না। সে তো ক্ষতি করছে না।
কী যে বলেন দাদা! রোজ দেখছি সন্ধে হলেই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়ায়। সে। কি শুধু শুধু? ও আপনার ক্ষতি করবার মতলবেই এখানে আসে। হয়তো ঠিকমতো সুযোগ পাচ্ছে না। আপনি কিন্তু দাদা সাবধান হবেন।
মুখে হাসি টেনে বললাম, কী ভাবে সাবধান হব বলো?
নকুল বলল, আপনি বাড়িতেও একা থাকবেন না। আমাকে ডাকবেন। প্রেতাত্মাই হোক আর যাই হোক আমি একাই শায়েস্তা করে দেব। এই বলে ও বীরদর্পে ভেতরে চলে গেল।
মহা সংকটে পড়লাম। প্রেতাত্মাটি আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবেছিলাম তিনি যেমন এসেছিলেন, আবার চলেও গেছেন। ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, কিন্তু এখন তো দেখছি নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। যদিও আমার কাছে আসেননি কিন্তু নকুলকে তো দেখা দিচ্ছেন। উদ্দেশ্যটা কী? তবে কি আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হতে যাচ্ছে বলেই
সেদিন দেখলাম বাজার থেকে একটা মোটা লাঠি নিয়ে এসেছে। বললাম, লাঠি দিয়ে কী হবে?
ও বলল, একটা লাঠি বা বল্লম থাকা দরকার। কখন কী দরকার পড়ে
বুঝলাম দরকার তো একটাই। কিন্তু লাটি দিয়ে কি প্রেতাত্মা তাড়ানো যাবে? তা অবশ্য যাবে না কিন্তু এ অবস্থায় কী যে করি! কার পরামর্শ নিই তখনই ভেবে পেলাম না। দেখাই যাক না আর কোনো ঘটনা ঘটে কিনা–ভাবতে ভাবতেই কদিন কেটে গেল।
তারপর সেদিন–
রাত তখন ঠিক কত জানি না। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না ঘুমটা কেন ভাঙল। আমার ঘরের উত্তর দিকের জানলাটা খোলাই ছিল। ওদিকে একটা বড়ো পুকুর। পুকুরের ওপারে ঘন ঝোপঝাড়। তার পিছনে বড়ো বড়ো দেবদারু গাছ। শুক্লপক্ষের বোধহয় ত্রয়োদশী। ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে পুকুরপাড়ের সুপুরি গাছটার পাতায়। বাতাস নেই তবু পাতাগুলো অল্প অল্প নড়ছে ঠিক যেমন মফঃস্বলে মড়া নিয়ে যাবার সময় চালিতে শোওয়ানো মৃতের মাথাটা নড়ে এদিক-ওদিক। সুপুরি গাছটার দিকে তাকিয়ে আমার গা-টা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। এ তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, অন্য কিছু।
এমনি সময়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। নকুল আমার পাশের ঘরে শোয়। সেই ঘর থেকেই শব্দটা এল। নকুল কি ঘর থেকে বেরোচ্ছে? কিন্তু অত চুপি চুপি কেন?
নকুলের ঘরের দিকে খড়খড়িওলা একটা জানলা ছিল। জানলাটা বন্ধই থাকত। খোলার দরকার হত না। আমি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম জানলাটার দিকে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাবধানে খড়খড়িটা একটুখানি ফাঁক করলাম। ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর চোখ দুটো সয়ে গেলে কিছু যেন দেখতে পেলাম। কেউ যেন অন্ধকারে নড়ছে।
কী আশ্চর্য! যে নড়ছে সে যদি নকুলই হয় তাহলে সে তো দরজার দিকে যাবে। কিন্তু এখানে চলমান বস্তুটি দরজার দিক থেকে নকুলের বিছানার দিকে যাচ্ছে। …এর মানে কী? কে যাচ্ছে অন্ধকারে গা মিলিয়ে? কোনো চোর? ডাকাত? খুনে?
সে খুব সাবধানে এক পা ফেলছে আর শব্দ হচ্ছে খট। আবার এক পা এগোচ্ছে অমনি শব্দ খট খট্–
এ কি মানুষের হাঁটার শব্দ? এ তো হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি! কিছু ভাববার আগেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
ছায়ামূর্তিটা শূন্যে দুপা তুলে দুহাত লম্বা করে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে জলে ডাইভ দেবার মতো নকুলের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে–আমি হুঁশিয়ার করে দেবার জন্যে চেঁচিয়ে উঠলাম–ন-কু-ল–
সঙ্গে সঙ্গে একটা আলমারির পেছন থেকে উদ্যত লাঠি হাতে যে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এল সে যে নকুল তা বুঝতে বাকি রইল না।
মাত্র দু-তিন মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। ছায়ামূর্তি দুহাত আরও লম্বা করে শূন্য বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তেই নকুল সজোরে তার পিঠে লাঠি দিয়ে মারল। অবাক কাণ্ড
মোটরের টায়ার বাস্ট করলে যেমন শব্দ করে বাতাসটা বেরিয়ে গিয়ে টায়ারটা চুপসে পড়ে থাকে তেমনি একটা শব্দ করে কালো আলখাল্লার মতো কী যেন একটা বিছানায় পড়ল। তার পরক্ষণেই সেই পরিত্যক্ত বস্তুটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে সরু হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে নকুলও পিছন পিছন ছুটল।
আমি ফের চেঁচিয়ে উঠলাম, নকুল–যেও না
নকুল সাড়া দিল না–ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আমিও দেরি না করে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালোম। পাশেই নকুলের ঘর হাট করে খোলা। আমিও ছুটলাম। কিন্তু কোন দিকে যাব?
কী মনে হল, কেন মনে হল জানি না, আমি সামনের রাস্তা ছেড়ে পিছনের দিকের র্থাৎ উত্তর দিকের রাস্তা ধরলাম। আমার হাতে একটা লাঠিও নেই। তবু নকুলকে বাঁচাতেই হবে। আমার জন্যে ওকে মরতে দেব না। কিন্তু এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে কোথায় খুঁজব ওকে? ও তো সেই অশরীরীর পিছনে উন্মাদের মতো ছুটেছে।
আমিও ছুটতে লাগলাম। এই গভীর রাত্রে কেমন এক শিরশিরে বাতাস বইছে। সে বাতাস যেন পৃথিবীর বাতাস নয়। আমি দুহাত দিয়ে গা আগলে ধরলাম–যেন বাতাসটা সহ্য করতে পারছিলাম না। ছুটতে ছুটতে পুকুরধারে এসে পড়লাম।
এই রকম গভীর রাতে কোনোদিন এই পুকুরের দিকে আসিনি। আসতে সাহস হয়নি। দুর্নাম আছে পুকুরটার। গভীর রাতে এখানে এলে নাকি দেখতে পাওয়া যায় কেউ যেন মাঝ পুকুরে ডুবছে আর উঠছে। অনেকেই পুকুরের মাঝখানে জল তোলপাড় করার শব্দ শুনেছে। কিন্তু কিছু দেখতে পায়নি। ঝুপ করে কে যেন ডুব দিল। তারপর শুধু খানিকটা জল হুস করে উঠল। ব্যস্ এই পর্যন্ত। ও নাকি দেখা যায় না। আমার সৌভাগ্য এদিন ওরকম কোনো শব্দ শুনতে পাইনি। কিছু দেখতেও পাইনি। তবু যা দেখেছিলাম তাই যথেষ্ট।
পুকুরের পাড়ে মানুষের মতো কী যেন পড়ে আছে। ছুটে গেলাম। দেখি নকুল উবুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার কাছে লাঠিটা পড়ে আছে ভাঙা। হুমড়ি খেয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বুঝলাম এখনও বেঁচে আছে।
.
০৩.
আমার সৌভাগ্য যে নকুল সে যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে সময় নিল পাক্কা একটি মাস।
তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ হল বটে কিন্তু সে রাত্রের ঘটনা কিছুই মনে করতে পারত না। এমন কি অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চাইত অত রাতে পুকুরপাড়ে গেলাম কেন? কী করেই বা গেলাম? আমি অনেক ভাবে প্রকৃত ঘটনাটা মনে করাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ওর কিছুই মনে পড়ত না। বললাম, সে রাতে তুমি বিছানায় না শুয়ে আলমারির পিছনে লুকিয়েছিলে। তুমি কী করে বুঝতে পেরেছিলে সে রাত্রেই এরকম ঘটনা ঘটবে?
ও শুধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জানি না।
বললাম, তুমি যে সেই ছায়ামূর্তির পিছু পিছ তাড়া করে গিয়েছিলে তাও কি মনে করতে পারছ না?
ও শুধু মাথা নেড়ে বলল, না। সব অন্ধকার, দাদা। আমি আর বসে থাকতে পারছি না। ঘুম আসছে।
আমি তখনই ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এসেছিলাম। ভাবলাম এই বেলা এগারোটায় ঘুম! তাহলে সুস্থ হল কই?
কিন্তু কী হচ্ছে এইসব? এখন নিশ্চিত হয়েছি–এতদিন যা দেখেছি তা মিথ্যে নয়। কিছু একটা আছেই। সেই অপার্থিব বস্তুটাকে আমি ছাড়া আরও একজন দেখেছে। কিন্তু কে এই ছায়ামূর্তিটা? কেনই বা আমার ঘরেই হানা দেয়? আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়েস পূর্ণ হবার সঙ্গে তার কি সত্যিই কোনো সম্পর্ক আছে?
এই জন্যেই অনেক হিসেব-নিকেশ করে মৃতদের একটা তালিকা করতে আরম্ভ করেছিলাম। কাজটা শেষ করা হয়নি। এবার দেখছি আবার এটা নিয়ে বসতে হবে।
ভেবেছিলাম যিনি মাঝে-মধ্যে আসছিলেন তিনি হঠাৎ বেশ কিছুদিন আসা বন্ধ করেছিলেন। আবার আসছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এখন তার আক্রমণের লক্ষ্যস্থল আমি নই, নকুল। বেচারি নকুল। সে তো সবে এসেছে। এরই মধ্যে কীভাবে জড়িয়ে গেল আমার জীবনের সঙ্গে যার ফলে সেও অশরীরী ক্রুদ্ধ আত্মাটির আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠল!
আত্মাটি তার ওপর এতই ক্রুদ্ধ যে তাকে খুন করতে পর্যন্ত তার ঘরে ঢুকেছিল। এর কারণ কী?
কোন অলৌকিকতার প্রভাবে নকুলকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নির্জন পুকুরের পাড়ে? কে ভাঙল তার মজবুত লাঠিটা? কেনই বা অচৈতন্য হয়ে পড়ল নকুল? আর কীসের প্রভাবে সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলল! ঐ রাত্রির ঘটনা যেন নকুলের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।
এসবই আমাকে আবার ভাবিয়ে তুলল। যতই ভাবি কোনো কূলকিনারা পাই না। অথচ এ এমন ব্যাপার যে লোক ডেকে বলা যায় না। কারণ, এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না যা দিয়ে বিশ্বাস করাতে পারব–এমন কি নকুলের ভাঙা লাঠিটাও অবিশ্বাসীদের কাছে তেমন জোরদার প্রমাণ বলে গণ্য হবে না। অথচ এখন মনে হচ্ছে সব ঘটনা জানিয়ে পরামর্শ নেবার একজন বিশ্বস্ত লোক চাই।
চাই তো বটে কিন্তু পাই কোথায়?
তখন মনে পড়ল পাড়াতেই তো থাকেন পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনি। বয়েস হয়েছে। শান্ত স্বভাবের ভদ্রলোক। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। উনি নাকি এই সব আত্মা-টাত্মার বিষয় বোঝেন। এ নিয়ে গোপনে ক্রিয়াকলাপ করেন কিনা জানি না। তবে পড়াশোনা করেন। শুনেছি ওঁর সিন্দুকে নাকি রোমান হরফে লেখা দুষ্প্রাপ্য প্রেতের বই আছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই বই ব্যবহার করেন গোপনে।
ওঁর কাছেই যাব ভাবলাম। তবু যাব-যাব করেও যেতে উৎসাহ পেলাম না। কারণ আমার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কী করে তার কাছে গিয়ে বলবে, আমার বাড়িতে দুষ্ট আত্মার আবির্ভাব হয়েছে। হে পাদ্রী মশাই, আপনি বিধান দিন কী করে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব।
না, অসম্ভব। এ আমি পারব না। অতএব পাদ্রী-মশাইয়ের কাছে আর যাওয়া হল না। ভাবলাম আর কিছুদিন দেখাই যাক না।
এই কিছুদিনের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে গেল। নকুলের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা যখন মাইনাস করে দিয়েছিলাম তখনই নকুল একদিন সকালবেলা গজগজ করতে করতে এসে বলল, দাদা, আমি না হয় বেশ কিছুদিন ঘর ঝাট দিতে পারিনি, তাই বলে কেউ ঝট দেবে না?
আমি থতমত খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘর ঝাঁট দেওয়ার কথা কাকে বলছে? কে ঝট দেবে? আমার বাড়িতে তো আর কেউ নেই যে ঘর ঝাঁট দেবে? বুঝলাম নকুলের মাথাটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। সে কথা চেপে গিয়ে বললাম, কেন? কী হয়েছে? আবার মেঝে খুঁড়ে মাটি তুলছে?
এর আগেও নকুল এই অভিযোগ করেছিল। আমি গুরুত্ব দিইনি। আজ ভাবলাম, এ তো অদ্ভুত কথা। সিমেন্টের মেঝে। ঘরে এমন অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জঞ্জাল নেই যে ইঁদুরের বাসা হবে। তা হলে?
চলো তো দেখি।
আমার এ কথায় নকুল খুব উৎসাহ পেল। আমার সামনে সামনে বীরদর্পে এগিয়ে চলল।
ওর ঘরে ঢুকে ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম টাটকা তোলা মাটি নয়। বেশ কিছুদিন আগে উঠেছে। তারপর কিছুদিন মাটিতে পড়ে থেকে থেকে কেমন ভিজে ভিজে ঠেকছে। আমি তখন নিজেই একটা ঝাঁটা দিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে দিলাম। কিন্তু ইঁদুর কেন পিঁপড়ের গর্তও দেখা গেল না। তখন বুঝলাম মাটিগুলো কোনোদিন উপর থেকে ঝুর ঝুর করে পড়েছে। যেমন পুরোনো বাড়িতে দেওয়াল বা কড়িবরগার পাশ থেকে চুন-বালি খসে পড়ে। এতক্ষণে যেন ব্যাপারটার একটা মানে খুঁজে পেলাম। যদিও একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে কোনো খসে যাওয়া চুন-বালির চিহ্ন দেখতে পেলাম না।
একে তো ভাবনার অন্ত ছিল না। কে ঐ অশরীরী আত্মাটি? আমার ওপর কেন তার এত রাগ? কী চায় আমার কাছে? বেচারি নকুল এমন কী অপরাধ করল যে, রাতদুপুরে তার জানলা দিয়ে ঢুকে তাকে মেরে দিতে গিয়েছিল! এখন আবার নতুন ভাবনা জুটল হঠাৎ মেঝেতে মাটি এল কোথা থেকে? একবার নয়, কয়েকবার। পাদ্রীবাবার কাছে যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়।
এমন সময়ে তার কাছে যাবার একটা উপলক্ষ এসে গেল।
জগদীশ অ্যান্টনি প্রতিদিন যখন মিশনে পুরোনো চার্চের দিকে যান তখন পথে আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কথা হয় না। সেদিন দেখা হতেই উনি বললেন, এই যে বাবাজীবন, রোজই ভাবি বলব, কিন্তু খেয়াল থাকে না।
আমি নম্র গলায় বললাম, আমি কি আপনার বাড়িতে যাব?
হ্যাঁ বাবা, তা তো যাবেই। তবে একটা বই-এর খোঁজ করছি। পাচ্ছি না। তুমি যদি পার
কী বই বলুন।
উনি যে বই-এর নাম বললেন তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে ভবলাম, এ বই আজ কোথায় পাব?
তবু তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, খুঁজে দেখব। যদি থাকে–
তাই দেখো। বড্ড দরকার হচ্ছে। মানে নিতান্তই কৌতূহল। পাও ভালোই। না পাও তবু এসো। তোমাদের মতো আধুনিক মনের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ।
এই এক নতুন হাঙ্গামা। উনি ভ্যামপায়ারের ওপর বই খুঁজছেন। সে বই এখানে কোথায় পাব? মনে পড়ল ক্লাস নাইন-টেনে পড়বার সময় প্রথম পড়েছিলাম ভ্যামপায়ার বা রক্তচোষা বাদুড়ের কথা। বইটা জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম। খুঁজে দেখব যদি পুরোনো আলমারিতে কোথাও থাকে।
দুদিন পর বইটা পেয়ে বেশ উৎসাহ সহকারেই ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা দেখে উনি এমন ভাবে হেসে উঠলেন যে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। বললেন, এ তো ভ্যামপায়ার নিয়ে কিশোর-পাঠ্য গল্পের বই। এ বই নিয়ে কী করব? আমি চাই ভ্যামপায়ারের ওপর তথ্য।
হঠাৎ ভ্যামপায়ার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা মাথায় চাপল কেন জিগ্যেস করতে গিয়েও সাহস পেলাম না। শেযে উনি নিজেই বললেন, তুমি অবশ্য ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মায় বিশ্বাসী নও। ও সব নিয়ে মাথা ঘামাও না। তবু বলছি, সময়ের পরিবর্তনে ভূত-প্রেতদের ঠিকুজি কুষ্ঠিও বদলে যাচ্ছে। আগে এদের দেখা যেত শ্মশানে, কবরখানায়। কখনও আসশ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত কিম্বা পোড়ো বাড়ির ন্যাড়া আলসেতে শুয়ে শুয়ে নিশাচর পাখি ধরে চিবোত। তারপর দ্যাখো, আগে স্কন্ধকাটা, কবন্ধভূত, ব্রহ্মদত্যি, শাঁকচুন্নি, গেছোভূত, মেছোভূত কত কী ছিল। এখন তারা পাততাড়ি গুটিয়েছে। তার বদলে দেখা দিয়েছে কালো বেড়াল, মরা বাঁদরের পা, কুকুর প্রভৃতি। কিন্তু বাদুড় কোন গুণে বেশির ভাগ ভূতের কাহিনিতে জায়গা করে নিল সেটাই জানতে ইচ্ছা করে। সেইজন্যে রক্তচোষা বাদুড়ের ওপর লেখা বই পড়ে দেখতে চাই। বুঝতেই পাচ্ছ, বাদুড় যদি ভূত হতে পারে, তাহলে চিল শকুন কাক ইঁদুর ছুঁচোর ভূত হতে বাধা কী?
ওঁর এই শেষের কথাগুলোয় হঠাৎ আমি এমনই চমকে উঠলাম যে পাদ্রীবাবার কাছে ঘটা করে বিদায় না চেয়েই হঠাৎ উঠে পড়লাম।
আজ যাই। বলেই বেরিয়ে পড়লাম। সারা পথ শুধু একটি কথাই মনে হতে লাগল– তাহলে সত্যিই কি বেড়াল, বাদুড়ের মতো চিল, শকুন, কাকের মধ্যে দিয়েও প্রেতাত্মার আবির্ভাব হতে পারে? আর তাই যদি হয়
হঠাৎ যেন একটা জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তাতে যেমন সাময়িকভাবে স্বস্তি পেলাম, তেমনি নতুন ভয় শুরু হল। ইঁদুর দেখা যায় না, ইঁদুরের গর্তও চোখে পড়ে না। অথচ মাটি পড়ে থাকছে। কে তুলছে এই মাটি? কোথা থেকে তুলছে? যে-ই তুলুক সে। যে ঠিক সাধারণ কোনো প্রাণী নয়, জগদীশ অ্যান্টনির মুখের আগা একটি কথাতেই তা পরিষ্কার হয়ে গেল। ইঁদুরও তা হলে ভূত হতে পারে।
লোকে শুনলে হাসবে কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না, পরের দিনই আমি মিস্ত্রি লাগিয়ে বেডরুম, কিচেন, দালান–সর্বত্র মেঝে খুঁড়িয়ে নতুন করে সিমেন্ট করে নিলাম। যাতে দৃশ্যই হোক আর অদৃশ্যই হোক ইঁদুরের লেজটুকুও দেখা না যায়।
নকুল বললে, এ কী কাণ্ড করলেন, দাদা? গোটা বাড়ি ভাঙবেন নাকি?
রেগে উঠে বললাম, দরকার হলে তাই ভাঙবসসর্পে চ গৃহে বাসো মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ। মানে বুঝলে?
নকুল অসঙ্কোচে স্বীকার করল মানে কিছুই বুঝতে পারেনি।
বললাম, এর মানে হল একই বাড়িতে সাপ নিয়ে বাস করলে মৃত্যু নিশ্চিত।
নকুল চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আবার সাপ এল কোথা থেকে, দাদা?
.
০৪.
বাস্তবিক জগদীশ অ্যান্টনির মুখের ঐ একটি কথাই আমার মাথা গোলমাল করে দিল। আমি নিশ্চিত জানি বাদুড় কীভাবে ভূত হতে পারে–পাদ্রীবাবা এই তর্ক তুলতে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে চিল, শকুন, ইঁদুর, ছুঁচোর কথাও বলে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে ইঁদুরের ওপর জোর দেবার কোনো কারণ ছিল না। অথচ দ্যাখো, ইঁদুরের কথাটা কানে আসা মাত্র ওটা খটাস করে ব্রেনে লক্ হয়ে গেল। কেমন বদ্ধমূল ধারণা হল বাড়িতে ইঁদুর তো ঢোকেনি, ঢুকেছে ইঁদুরের শরীর ধরে একটা অশুভ আত্মা।
আমি জানি এটা আর কিছুই নয়, ভৌতিক পরিবেশে বাড়িতে বসে থেকে থেকে মনের মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে। ছি ছি, শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের ভয়ে গোটা বাড়ির মেঝে চটিয়ে ফেললাম! অথচ একটি ইঁদুরের লেজ পর্যন্ত কোনোদিন দেখা যায়নি। ঠিক করলাম এই দুর্বলতা আমাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। নইলে হয়তো পাগল হয়ে যাব।
আর আশ্চর্য যেদিন এই রকম প্রতিজ্ঞা করলাম সেই রাতেই ঘটল একটা ঘটনা। ঘটনাটা এইরকম–কেউ যেন আমার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে কড়া নাড়ছে–খটখটখট–
চমকে উঠে বসলাম। তখনও কেউ কড়া নেড়েই যাচ্ছে–খটাখটখটাখট খটাখট–
না, ভুল শোনা নয়। সত্যিই কেউ আমাকে ডাকছে। মশারির মধ্যে বসেই চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কে?
উত্তর নেই। শুধু একটানা সেই শব্দ–খটাখট খটাখট খটাখট–
আশ্চর্য! এত রাত্রে কে ডাকছে? বাইরের কেউ নয়। বাইরের কেউ হলে বাড়ির মধ্যে ঢুকবে কী করে? নিশ্চয় এ বাড়িরই কেউ। সেই কেউ নকুল ছাড়া আর কেই বা হতে পারে? চেঁচালাম, এত রাত্রে কী ব্যাপার, নকুল?
উত্তর নেই।
এবার হাঁকলাম, নকুল!
সাড়া নেই। ধরার লোক না থাকলে টেলিফোনে যেমন রিং হয়েই যায় তেমনি কড়া নাড়া চলতেই লাগল। আমি প্রচণ্ড রাগে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম।
কে-এ-এ?
তখন মনে হল কড়া নাড়ার শব্দটা যেন আর কাছে নেই। আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে।
অ্যাই নকুল–বলে খিল খুলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, খিলটা এতটা উঠে এল কী করে? আমি তো ভালো করে এঁটেই বসিয়েছিলাম। কেউ কি তাহলে বাইরে থেকে খিল খোলবার চেষ্টা করছিল? কিন্তু তাই বা সম্ভব কী করে? না, এ রহস্য আর সহ্য করা যায় না। মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে খিলটা খুলে ফেললাম।
আবার সেই গা-হিম করা অন্ধকার বারান্দা। আমি কীসের তীব্র আকর্ষণে এগিয়ে চললাম। সামনে কিছু যেন ভেসে যাচ্ছে…. কী ওটা? একটা সাদা চাদর … যেমন দেখেছিলাম সেদিন নকুলের ঘর থেকে জানলার ভেতর দিয়ে ভেসে যেতে।
হঠাৎ আমার পিছনে কার পায়ের শব্দ! তারপরই কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম–কে যেন আমাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল। বেঁচে গেলাম।
পরের দিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। সারা দেহে ব্যথা। নকুল এক বাটি গরম দুধ খাওয়ালো। ও যা বলল সংক্ষেপে তা এই
অনেকক্ষণ ধরেই কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। প্রথমটা ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি শব্দটা কোথায় হচ্ছে। পরে নাম ধরে ডাকতেই ধড়মড় করে ওঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দেখল আমি অন্ধকারেই টলতে টলতে চলেছি। আমার সামনে একটা সাদা চাদর বাতাসে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল আমার বিপদ। তাই আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি চাদর লক্ষ করে নাকি শূন্যে লাফ দিয়েছিলাম। আর তখনই নকুল আমাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছিল।
তিন দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। কিছু চিন্তা করতে গেলেই মাথায় যন্ত্রণা। তাই শুয়ে ঘুমিয়ে, অর্ধজাগরণে বাড়িতে পড়ে রইলাম। ভাগ্যি নকুল ছিল। নিজের ভাই-এর মতো ও সর্বক্ষণ আমার বিছানার পাশে। আবার নকুলকে দেখে অবাক হয়েছি। ওর মুখটা এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
এক সপ্তাহ পর যখন উঠে বসতে পারলাম তখন প্রথম যে কথাটা মনে হল তা হচ্ছে এটা কী হল? এতদিন যা হয় একরকম হচ্ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে ছায়া দেখা। সে আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা মাত্রও করেনি। শুধু দেখা দিচ্ছিল। যেন ও যে কে তা জানাতে চাইছিল। এতে শুধু কৌতূহলটাই বেড়েছিল। আর কিছু নয়। তারপর হঠাৎ নকুলকে আক্রমণ। কেন?
তারপর গভীর রাতে আমার বেডরুমে হানা। লুকিয়ে-চুরিয়ে নয় রীতিমতো কড়া নেড়ে। তারপর যেই দরজা খুললাম অমনি পালাল। কীভাবে পালাল? ছায়াশরীরটুকু নিয়েও নয়। হালকা চাদরের মতো শূন্যে ভাসতে ভাসতে। নকুল বলছে, আমি নাকি শূন্যে ভাসমান সেই চাদরটা ধরতে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য! এতখানি বোকামি আমি করেছিলাম। আর তার পরিণতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
সে না হয় যা হবার তা হত। কিন্তু প্রেতাত্মাটির আসল ইচ্ছাটি কী? সেটা জানা সহজ হত যদি জানতে পারতাম তিনি কে?
ঠিক করলাম কাল সকাল থেকেই আবার সেই মৃতের তালিকাটি নিয়ে বসব। গত পাঁচ বছরে যারা মারা গেছে তাদের লিস্টটা আগে ফাইনাল করব। অবশ্য সেই সঙ্গে একটা ছোটো তালিকা করব ওদের মধ্যে যাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে তাদের। কারণ, প্রচণ্ড ক্ষোভ না থাকলে কোনো আত্মা বারে বারে এক জায়গায় হানা দেয় না। শুধু এক জায়গাতেই নয় বিশেষ একজনকেই টার্গেট করে আছে।
পরের দিন সকালে চা খেয়ে বাইরের ঘরে বসলাম মৃতের সেই অসমাপ্ত তালিকাটা নিয়ে।
এই ছোটো শহরেই অন্য একটা বাড়িতে আমার জন্ম। সেই বাড়ি থেকেই পড়াশোনা, খেলাধূলা। সেখানেই আসত আমাদের ক্লাসের বন্ধুরা। ক্যারাম খেলা হত। আর একটা খেলা ছিল গোলকধাম। কাজেই গত পাঁচ বছরে এখানকার কারা মারা গেছে তা খুঁজতে অসুবিধা হল না। ঝাড়াই-বাছাই করে দেখলাম ঐ সময়ের মধ্যে এখানকার নজন মারা গেছে। তার মধ্যে তিনজন আমার সমবয়সী, কিন্তু ঠিক বন্ধু নয়, পরিচিত। বাকি ছজন নানা বয়সের।
আজ পর্যন্ত আমি যা লক্ষ করে দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছি যে আত্মাটি আমাকে বার বার দেখা দিয়েছে (বরঞ্চ বলি হানা দিয়েছে) সে কোনো ধীরস্থির মানুষের আত্মা হতে পারে না। অনুমান–সে কোনো উঠতি বয়সের আত্মা।
এই ভাবে বাছাই করতে গিয়ে তালিকাটা বেশ ছোটো হয়ে গেল। খুশি হলাম। দেখলাম সন্দেহভাজনের এই তালিকায় তিনজনের নাম উঠে আসছে। তিনজনেই আমার জানাশোনা, উঠতি বয়সের। তিনজনেই ছিল একটু রাগী স্বভাবের। কাজেই এদের যে কেউ একজন হতে পারে। তিনজনের মধ্যে একজনই মরেছে অপঘাতে। সাপে কামড়ে ছিল। সাপের কামড়ে মৃত্যুকে অপঘাত বলে কিনা ঠিক জানি না। অবশ্য অপঘাতে মৃত্যু হলেই যে ভূত হবে এর কোনো মানে নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন বহুজনের আত্মা প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বহুকাল। অতএব
আর একটা ক্লু পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। আমি তো কয়েকবার আত্মাটির আকার লক্ষ করেছি। দেখেছি তার হাইট প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। এখন যে তিনজনকে আমি শেষ পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় রেখেছি তাদের মধ্যে কার হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি চোখ বুজে একটু ভাবলেই ধরতে পারব।
সেই রকম চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনজনের হাইট কীরকম গোলমাল হয়ে গেল। অর্থাৎ রামের হাইট শ্যামের গায়ে, শ্যামের হাইট যদুর কাঁধে। মুশকিলে পড়লাম। কী করব ভাবছি, দরজায় শব্দ। উঃ এখন আবার কে এল? যত বাধা
কে? বিরক্তিঝরা গলায় হাঁকলাম, ভেতরে আসুন।
যিনি ভেতরে ঢুকলেন তাকে দেখেই অবাক হলাম। খুশি তো হলামই।
আপনি! আসুন-আসুন। কী সৌভাগ্য! হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন জগদীশ অ্যান্টনি মশাই।
.
০৫.
আমাদের এখানে বর্তমানে খ্রিস্টান পরিবার অল্পই। কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে এই–১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাঙালির শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা যখন এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঘাঁটি গেড়ে বসল তখন থেকেই মোটামুটিভাবে বলা যায় এ দেশে খ্রিস্টানদের বসবাস শুরু। তারপর ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হল। এই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু এ দেশেই সাহেবসুবোদের করে খেতে হবে সেহেতু সর্বাগ্রে দরকার বাংলা শেখা। বাংলা না শিখলে বাঙালিদের সঙ্গে মিশবে কী করে? সেই কারণেই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ তৈরি।
একদিকে যেমন ইংরেজরা বাংলা শিখতে শুরু করল, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে চাকরি পাওয়ার তাগিদে বাঙালিদেরও ইংরিজি শেখার তাড়াহুড়ো পড়ে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হল এ দেশের মানুষের কাছে দয়াল প্রভু যিশু খ্রিস্টের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ।
এই উপলক্ষে দেশের সর্বত্র গির্জা তৈরি হল। নানা জায়গা থেকে আসতে লাগল সংসারত্যাগী পাদ্রীরা। এই পাদ্রীদের মধ্যে অধিকাংশদের জীবন ছিল সংযত, পবিত্র। তাঁদের স্বভাব ছিল ধীর, স্থির, শান্ত। তাঁরা যিশুর মতোই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ছোটোদের কাছে টেনে নিতেন। ফলে সাধারণ গেরস্ত পরিবারগুলি পাদ্রীদের খুব শ্রদ্ধা করত। পাদ্রীদের প্রভাবে এ দেশে বহু দরিদ্র, অল্পশিক্ষিত মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করল। আশা ছিল, দুঃখ-দুর্দশায় ইংরেজরা তাদের দেখবে। হয়তো খুব বেশি সাহায্য পাওয়া যেত না তবে এই সব দরিদ্র অবহেলিত মানুষদের তারা অনেক কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
আমাদের এখানে শহরের প্রায় বাইরে যে প্রাচীন গির্জাটি আছে সেটির প্রতিষ্ঠা করেছিল চার্চ অফ স্কটল্যান্ড মিশন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে।
চার্চ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় খ্রিস্টধর্মীরা নিয়মিত ধর্মচর্চার জন্যে নিজেদের মতো করে একটি পবিত্র আশ্রয় পেলেন। দূর দূর গ্রাম থেকেও খ্রিস্টভক্তরা প্রতি রবিবার এই চার্চে প্রেয়ারে যোগ দেবার জন্যে আসতে লাগলেন।
আমরা খ্রিস্টান ছিলাম না। তবু বাবার এই সব স্থানীয় খ্রিস্টান বন্ধুরা খুব সহজেই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমরাও ভোলা মনে তাদের গ্রহণ করতাম। এখানেই প্রথম দেখি একজন লম্বা, কালো স্বাস্থ্যবান মানুষকে যাঁর সঙ্গে বাবা হ্যান্ডশেক করতেন। বাবার এক বন্ধু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এঁর নাম ফাদার জগদীশ অ্যান্টনি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর থেকে এখানকার পাদ্রী হয়ে এসেছেন।
তাঁকে প্রথম দেখেই আমার ভালো লাগেনি। কারণ অন্যরা ধুতি-পাঞ্জাবি, শাল গায়ে দিয়েছিলেন, আর উনি সাদা ফুলপ্যান্টের ওপর পরেছিলেন কালো লম্বা একটা জোব্বা। তাঁর গলায় যে রুপোর ক্রসটা ঝুলত সেটাও ছিল পেল্লায় বড়ো, তা ছাড়া তাঁর চওড়া চোয়াল, চ্যাপ্টা মুখের ওপর ড্যাবডেবে দুটো চোখ আমার ভয়ের উদ্রেক করত।
জগদীশ অ্যান্টনি তখন থাকতেন, সেই চার্চের পাশে একটি ঘরে একা। সেখান থেকে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আসতেন গঙ্গার ধারে। কখনও আমাদের বাড়ি বাবার কাছ। ছোটোবেলা থেকে তাকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ভয় পেতাম না। চেহারা অসুরের মতো হলেও মানুষটা সত্যিই ভালো।
তিনি বেশ কয়েক বছর আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি ভাড়া করে আছেন তবু কখন কোথায় যান তা লক্ষ করিনি। লক্ষ করার দরকার হয়নি। তাছাড়া, তখন আমার যৌবনকাল। খেলাধূলা, গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। একজন বাপের বয়সী মানুষকে নজরদারি করার মানসিকতা আমার ছিল না। কাজের লোকের কথায় গুরুত্ব দিইনি। এখানে প্রথম এসে পর্যন্ত ঐ চার্চে তিনি থাকতেন। একাই থাকতেন। চারিদিকে জঙ্গল। কাছেই বহু কালের পুরোনো খ্রিস্টানদের কবরস্থান। খুব দরকার না হলে বিকেলেও কেউ ওদিকে যায় না। সন্ধের পর গা ছমছম করে তবু তিনি থাকতেন। নিশ্চয় তাঁর ভয করত না। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে অদৃশ্য ভাবে রয়েছেন সদাপ্রভু যিশু। আর গলায় ঝুলছে রুপোর ক্রস। তা সেই বহুদিনের পরিচিত জায়গায় তিনি যখন খুশি, যতবার খুশি যেতেই পারেন। কার কী?
এইরকম সময়ে একদিন একটা ঘটনা স্বচক্ষে দেখে পাদ্রীবাবার ওপর একটা বিশেষ ধারণা তৈরি হয়ে গেল।
সেদিন বিকেলে আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে গিয়েছিলাম সেখান থেকে চার্চটা বেশি দূরে নয়। খোয়াওঠা ধুলোভরা মেন রোড থেকে যে পায়ে চলা পথটা ডানদিকে নেমে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে মিশেছে, সেখানেই চার্চটা তার জীর্ণ ভগ্নদশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটু দক্ষিণে এগোলেই দেখা যাবে অনেকগুলো শ্বেত পাথরের ফলক মাটিতে পোঁতা। এগুলোই এখানকার খ্রিস্টানদের কবরে এক-এক জনের স্মৃতিফলক। হঠাৎ মনে হল পাদ্রীবাবা প্রায়ই তো এই সময়ে এখানে আসেন। দেখি না গিয়ে আজও এসেছেন কিনা।
বন্ধুকে নিয়ে গির্জার চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধের অন্ধকার ধীরে ধীরে বাদুড়ের ডানার মতো নেমে আসছে। একটা ঢ্যাঙা দেবদারু গাছের মাথায় সিঁদুরের ছোঁয়ার মতো এক চিলতে রোদ লেগেছিল। পাশের চাপাবনের ওপর থেকে একঝাক পাখি যেন ভয় পেয়ে পাখা ঝাঁপটে উড়ে পালাল।
আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম পাদ্রীবাবা নেই। কিন্তু গির্জার পাশেই তাঁর ছোটো ঘরটার জানলার এক পাট খোলা। বুঝলাম উনি এসেছেন। আশ্চর্য! এই সন্ধেবেলা কোথায় বেড়াতে গেলেন!
আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি! আমার গলার স্বরে চকিত হয়ে একটা শেয়াল সামনে দিয়ে ছুটে পালাল। আবার ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি।
ও! আপনি! এই যে যাই। বলে কবরখানার পিছন থেকে পাদ্রীবাবা হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ালেন। তার পরনের পাজামা আর গেঞ্জি ধুলোয় ভর্তি। আর হাতে একটা কোদাল।
হঠাৎ এই সন্ধেবেলা এখানে! জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।
বললাম, এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম। ভাবলাম যদি আপনি এসে থাকেন, একবার দেখা করে যাই।
ভালো করেছেন। তবে দেখা পেতেন না। আমি এতক্ষণ বেরিয়াল গ্রাউন্ডের ঝোপ জঙ্গল সাফ করছিলাম।
আপনি সাফ করছিলেন কেন? করার লোক নেই?
জানি না। থাকার তো কথা। কিন্তু কাউকেই তো দেখতে পাই না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই কোদাল, গাঁইতি নিয়ে সাফ করতে হয়।
আপনি তো না করলেই পারেন। আপনি পাদ্রী। আপনার অনেক সম্মান।
পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, শুধু সম্মানই নয়, অনেক দায়িত্ব, বাবা। এটা কার কাজ এ নিয়ে তর্ক করা আমার মানায় না। এ জায়গা অতি পবিত্র। সেই পবিত্রতা আমাকেই বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আপনারা টর্চ এনেছেন তো, বাবা! বড্ড অন্ধকার। সাপ-খোপের ভয়ও আছে।
বললাম, না, টর্চ না আনলেও ঠিকই চলে যাব। আর সাপের ভয়? আপনি যদি এই অন্ধকারে এখানে-ওখানে চলাফেরা করতে পারেন তাহলে আমরাই বা পারব না কেন?
উনি কোনো উত্তর দিলেন না। এগিয়ে এসে আমাদের দুজনের মাথায় গলার বড়ো ক্রসটা ঠেকালেন।
আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। একটা হিমস্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে।
নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন করে পাদ্রীবাবার কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। চার্চের এবং বেরিয়াল ফিল্ডের সংলগ্ন জায়গার পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব কি শুধু তাঁর? তিনি যে এত নির্ভয় তা কি শুধু ঐ পবিত্র ক্রসের প্রভাবে? কিন্তু ঐ ক্রস কি বাঁচতে পারে বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে? পারে হয়তো। না, আমরা কল্পনা করতে পারি না।
শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।
তবু–
তবু কাঁটা খস্থ করতেই লাগল।
এক নম্বর–তিনি কেন আমাদের অন্যদিন বেলাবেলি আসতে বললেন না একবারও?
দুনম্বর–সন্ধে হয়ে গেছে। তবু যে ঘরটায় তিনি বসেন সেটা অন্ধকার। তখনও আলো জ্বালা হয়নি। আলো জ্বালানো হবে তো? নাকি তিনি অন্ধকারেই চলাফেরা করবেন?
আশ্চর্য! অথচ যখন আমাদের পাড়ায় থাকেন তখন আলাদা মানুষ–একেবারে সাধারণ স্বাভাবিক জীবন।
যাই হোক, এ সব ভেবে লাভ নেই। পাদ্রী সাহেব আমার বাবার বন্ধু। পিতৃতুল্য। তাঁকে যেন চিরদিন শ্রদ্ধা করেই যেতে পারি।
.
০৬.
একেবারে ঘরোয়া পোশাকে এসে বসলেন পাদ্রীমশাই। পরনে ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে ফতুয়া।
মন দিয়ে কীসের তালিকা করছেন? নিমন্ত্রিতদের লিস্ট নাকি? দেখবেন আমি যেন বাদ না পড়ি।
হেসে বললাম, এটা যদি নিমন্ত্রিতদের তালিকা হত তাহলে অন্তত আপনি বাদ পড়তেন না। আপনার চেয়ে কাছের মানুষ আমার আর কেউ নেই।
উনি গম্ভীর ভাবে বললেন, আপনি তো এখনও ছেলেমানুষ, অভিজ্ঞতা নেই। তাই জানেন না কাছের মানুষরাই বাদ পড়ে যায়।
এই একটা বদ অভ্যাস ভদ্রলোকের। তার ছেলের মতো হলেও কিছুতেই আপনি ছাড়া কথা বলবেন না। আপত্তি করলে বলেন, আমি তো সেকালের মানুষ। আর কিছুতে না হোক অন্তত কাথায়-বার্তায় ছোটোদেরও সম্মান দেখাতে হয়। কাজেই তুমি, তোমার সঙ্গে যে আপনি আজ্ঞে করি সেটা ধরবেন না। ওটা আমার মুদ্রাদোষ।
আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, আজ তো রবিবার। সকালে প্রেয়ার ছিল। চার্চে যাননি?
গিয়েছিলাম বৈকি। কাজ শেষ করেই বাড়ি ফিরে এসেছি। হ্যাঁ, বাদুড়ের ওপর বইটার কথা যেন ভুলে যাবেন না, ভাই। ওটা আমার খুব দরকার। আপনি যখন কলকাতায় যাবেন, কলেজ স্ট্রিটে বইটার খোঁজ করবেন। বাদুড় নামে হয়তো পাবেন না। প্রাণীজগৎ–এ ধরনের কোনো বই বাংলাতেই হোক কিংবা ইংরাজিতেই হোক দয়া করে একটু খোঁজ করবেন। বেশি দাম হলেও নেবেন। এই একশো টাকা রাখুন।
বললাম, টাকা এখুনি দিতে হবে না। আমার মনে থাকবে।
তখনই মনে হল পাদ্রীবাবাকে যখন হাতের কাছে পাওয়া গেছে তখন ইঁদুরের ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যাক। অন্তত একজন ঠিক ব্যক্তির অভিমত জানা যাবে। মতলবটা মাথায় খেলতেই তাঁকে বিনীতভাবে বললাম–একটা কথা আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার করে জেনে নিয়ে ইচ্ছে করছে। যদি বিরক্ত না হন–
উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, বিরক্ত হব কেন? বলুন।
আমি তখন আমার বক্তব্যটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলে গেলাম। শেষকালে যোগ করলাম, আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন বাদুড়, কালো বেড়াল-এর মতো ইঁদুরের মধ্যে দিয়েও ভৌতিক খেলা চলতে পারে?
উনি প্রথমে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যে কারণে বাদুড়ের ভূত হওয়া সম্ভব সেই একই কারণে ইঁদুরও ভূত হতে পারে। তবে কোন কোন বৈশিষ্ট্যে বাদুড়, কালো বেড়াল শয়তানের চর হয়ে ওঠে সেটা যেমন আমরা জানি না তেমনি ইঁদুর, ছুঁচো, চিল, শকুনের বৈশিষ্ট্যও জানা নেই।
আপনি বলতে চাচ্ছেন ইঁদুর ভূত ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না?
এই পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই ভাই। মানুষ যতই বলুক আমি শেষ দেখবই, সেটা হবে তার মিথ্যে অহংকার। অনেক কিছুই সম্ভব।
একটু থেমে বললেন, কেন ইঁদুর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?
ছোটো কোনো স্টেশনে অনেকক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার পর সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই গাড়ি যেমন ছুটতে থাকে তেমনি পাদ্রীবাবার সম্মতি পাওয়া মাত্র আমার কথা শতধারায় ছুটতে লাগল। কোথাও যে একটু থামা দরকার তাও খেয়ালও রইল না।
কথা শেষ করে একটু জিরিয়ে নিয়ে বললাম, এই হল ব্যাপার। আজ করাত্রি ভয়ে ঘুমোতে পারি না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে বোলাতে পাদ্রীবাবা বললেন, সব কিছুই তো ভয় থেকে উৎপন্ন। তাই
কিন্তু ভয়েরও একটা কারণ থেকে যাচ্ছে না? শুধু শুধু তো আর ভয় পাচ্ছি না।
পাদ্রীবাবা বললেন, তা হয়তো কিছুটা ঠিক, তা বলে মেঝেতে, দালানে মাটি দেখেই যদি ইঁদুর-ভূতের কাণ্ড ভেবে নেন তাহলে বেচারি ইঁদুরের ওপর অবিচার করা হবে।
তাহলে?
মাটিটা যেমন সত্য, ইঁদুর না থাকাটাও তেমনি সত্য। মনে হয় মাটির ব্যাপারে অন্য কারও হাত আছে।
বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে নড়েচড়ে বসলাম।
আবার কার হাত?
সেটাই লক্ষ রাখুন। আচ্ছা একটা অন্য কথা জিগ্যেস করি। আপনি কি আগে গানবাজনা করতেন?
যা বাবাঃ! কী কথা হচ্ছিল, কোন কথায় এসে পড়া গেল। সামলে নিয়ে বললাম, হা। করতাম। সে অনেক দিন আগে। সাবেক বাড়িতে থাকতে। তখন সবে ম্যাট্রিক দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? তখন তো আপনি আমাকে চিনতেন না।
পাদ্রীবাবা একটু হেসে আঙুল দিয়ে দেওয়ালের গায়ে সব থেকে উঁচু তাকটা দেখিয়ে দিলেন। পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছি, এক সেট বায়া-তবলা একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় কাপড় জড়িয়ে একেবারে চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম। পাদ্রীবাবারই চোখে পড়ল!
সলজ্জ হেসে বললাম, আপনি ঠিক লক্ষ করেছেন তো?
পাদ্রীবাবা হেসেই বললেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। অবশ্য প্রশ্ন আরও আছে। গানবাজনা যে করতেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ছাড়লেন কেন? তাও ছেড়েছেন যেন আর কোনোদিন ওগুলো ছোঁবেনই না প্রতিজ্ঞা করে। তাই না? সে প্রতিজ্ঞা আজও রক্ষা করে চলেছেন। কী ব্যাপার আপত্তি না থাকলে বলুন।
আমি বোবা হয়ে গেলাম। সত্যি ক্ষমতা আছে পাদ্রীবাবার। আজ হঠাৎ এসেই এমন জায়গায় লক্ষ পড়ল যেখানে আর কেউ তাকায়ওনি। শুধু লক্ষ পড়াই না, উনি একেবারে শেকড় ধরে টানতে শুরু করেছেন। জীবনের যে চ্যাপ্টারটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, সেই পরিত্যক্ত জীর্ণ পাতাগুলোই পাদ্রীবাবা নেড়েচেড়ে দেখতে চান। কিন্তু কেন? নিছকই কৌতূহল, না অন্য কোনো রহস্য আছে?
বললাম, কিছুমাত্র না। আসলে গানবাজনা ছেড়ে দেবার পেছনে
বুঝতে পারছি তীব্র অভিমান আছে।
না, অভিমান, রাগ, দুঃখ এসব কিছু নয়
তা হলে?
.
০৭.
পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনির কাছে সেদিন আমার গানবাজনা চর্চার ইতিকথা তুলে ধরেছিলাম।
আমাদের পরিবারে গানবাজনার চর্চাটা ছিলই। কেউ যে খুব নামকরা গায়ক বা বাজিয়ে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তা নয়। তবে বাড়িতে বসে নির্দোষ আনন্দ করার উপায় ছিল এই গানবাজনা।
আমি ভালো গাইতে না পারলেও মোটামুটি সুরজ্ঞান, লজ্ঞান ছিল। আমার যেমন গায়ক হবার কথা ছিল না, তেমনি বাজিয়ে হয়ে ওঠবার পেছনেও কোনো কারণ ছিল না। তবে কিনা পুরোনো আলমারির একেবারে নীচের তাকে এক জোড়া বাঁয়া-তবলা দেখে সেটা বাজতে ইচ্ছে করত। কিন্তু যেহেতু সেটা আমার ঠাকুর্দার শখের জিনিস ছিল, আর ওতে হাত দিতে সবাই বারণ করত তাই চোখের দেখা ছাড়া হাত দিতে সাহস হত না।
তারপর যখন বড়ো হলাম অর্থাৎ নাইন-টেনে পড়ছি তখন আলমারি খুলে বায়া-তবলাটা দেখে মনে হল–আরে! এমন ভালো জিনিসটা পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখি না যদি বাজানো শিখতে পারি। এতে পরলোকগত দাদু রাগ করবেন কেন?
সেদিনই বাঁয়া-তবলাটা বের করে দাদুর উদ্দেশে প্রণাম করে তবলায় একটা আস্তে করে চঁটি দিতেই যেন তবলার ওপর সুরের ঢেউ খেলে গেল। তারপরে যখন প্রথম বোল তেরে কেটে তাক বাজাতে পারলাম তখন আমার আনন্দ দেখে কে?
এইভাবে রোজ আধঘণ্টা করে বাজাতে বাজাতে একদিন ভালো তবলা-বাজিয়ে হয়ে উঠলাম। কারো কাছে না শিখেই। কী করে তা সম্ভব হল, জানি না। হয়তো দাদুর আশীর্বাদ। ব্যাপারটা অসম্ভব জানি তবু …
আমাদের জায়গাটি নিতান্তই ছোটো। কিন্তু গানবাজনা হতই। আর হত স্টেজ বেঁধে থিয়েটার। তখনও মফঃস্বলে সিনেমার চল হয়নি। পুজোটুজো উপলক্ষে ছেলেরা মিলে থিয়েটার করত। আর থিয়েটার মানেই কনসার্ট, বাজনা থাকবেই। এখানে যে কজন তবলচি ছিল তাদের মধ্যে আমাকেই সকলে বেশি পছন্দ করত। তবলার ওপর আমার আঙুল যত দ্রুত খেলত তেমন আর কারো নয়। ফলে গানবাজনার আসর বসলেই সবার আগে আমার ডাক পড়ত।
এই রকম একটা ঘরোয়া গানের আসরে আমি প্রথম দেখেছিলাম চারু বিশ্বাসকে। অদ্ভুত ছেলেটা।
সন্ধ্যায় গানের আসর বসেছে। আমরা সাত-আটজন বন্ধু। অখিল বলে একটি ছেলে গাইছিল। আমি সঙ্গত করছিলাম। হঠাৎ দরজা ঠেলে কারও অনুমতি না নিয়ে ষণ্ডামার্কা একটা ছেলে এসে একেবারে আমাদের মাঝখানে বসে পড়ল। সে ঢুকেছিল কঁপা কাঁপা ঘাড় নিয়ে। তার মুখটা যে কী ভয়ঙ্কর না দেখলে বোঝানো যাবে না। নাক আর কপালের মাঝখানটা বসা। যেন বড়ো কোনো অপারেশন হয়েছিল একসময়। ডান দিকের ভুরুটা উঠে আছে কপালের ওপর পর্যন্ত। বাঁ ভুরুটা তলিয়ে গেছে বাঁ চোখের কোণে। গোটা মুখটা যে ক্ষতবিক্ষত তা নয়, অমসৃণ–এবড়ো-খেবড়ো। মনে হল তার মুখের চামড়াটা যেন গোটানো। এরকম ভয়ংকর মুখ এর আগে দেখিনি।
ওকে দেখে এ বাড়ির ছেলেরা ছাড়া আর সবাই হৈ হৈ করে উঠলকী চাই? ক চাই?
ও মাথা কাঁপয়ে বলল, আমি গান করব।
ইস! গান করবে! যা ভাগ। পালা।
ও বাড়ির ছেলে মোহন ইশারায় সবাইকে থামতে বলে চারুকে বলল, তুই ঐ এখন গিয়ে বোস।
চারু মাথা গরম করে বলল, আমায় গাইতে দিতে হবে। নইলে–
নইলে কী করবি তুই? আমাদের মধ্যে একজন তেড়ে যাচ্ছিল, মোহন থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি গাইবে। আমি ব্যবস্থা করে দেব। তবে একটার বেশি নয়।
চারু কিছুটা শান্ত হয়ে দূরে চৌকিতে গিয়ে বসল। ঐটুকু যেতেও সে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। কী করে যে একা একা পথ হাঁটে কে জানে! চৌকিতে বসে সে ঘাড়টা একবার এদিক একবার ওদিক করতেই থাকল।
মোহনকে নিচু গলায় জিগ্যেস করলাম, কে ও? চেন?
মোহন বলল, ওর বাবা বর্ধমান রাজস্টেটের ম্যানেজার। এরা খ্রিস্টান। এখানে রাজবাড়ির সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে সবে এসেছে। ছেলেটি জড়বুদ্ধি। ওকে নিয়ে ওর বাবার অনেক যন্ত্রণা। তবে গানের গলা আছে।
গান চলতে লাগল। আর চৌকিতে বসে চারু ঘাড় নেড়ে, হাতে তাল দিতে লাগল। হঠাৎ তার খেয়াল হল গানের আসর ভাঙার মুখে। অনেকেই উঠে গেছে। তখনই চৌকি থেকে লাফ দিয়ে হারমোনিয়ামটা কেড়ে নিয়ে বাজাতে লাগল। দুবার রিড টিপেই গান ধরল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হুকুম করল, বাজাও!
তার বলার ভঙ্গিতে রাগ হল। আমি বাজালাম না।
এরপর যা ঘটল তা বলবার নয়। চারু হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে শতরঞ্জি ঠেলে দিতে লাগল। কাপ, ডিশ, গেলাস উল্টে একাকার।
আমাকে ইনসাল্ট! আই মোহন, এই ছোকরা তোদের বন্ধু?
মোহন খুব বুদ্ধিমান আর শান্ত প্রকৃতির। চারুর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললে, আর্টিস্টদের মাথা গরম করতে নেই!
সাপের মাথায় যেন মন্ত্রপড়া শেকড় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চারু জল। হেসে বলল, ঠিক বলছ আমি আর্টিস্ট?
মোহন বলল, শুধু আমি কেন? সবাই বলছে তুমি আর্টিস্ট। নাও ঠান্ডা মাথায় গান ধরো।
চারু হারমোনিয়াম টেনে নিল। মোহন ইশারা করে আমাকেই বাজাতে বলল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাজাতে হল।
আসল কথা হচ্ছে, এক-একজন এমন মানুষ আছে যাকে দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়। চারু সেই রকম একজন। ওর মুখটা যে কী ভয়ংকর তা আপনি না দেখলে ভাবতে পারবেন না ফাদার।
মুখটা কি ওর জন্মগত, না জটিল কোনো অপারেশনের ফল? জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।
বললাম, জানি না। সেদিনই ওকে প্রথম দেখেছিলাম।
পাদ্রীবাবা একটু ভেবে বললেন, মনে হয় ওটা জন্মগত। জন্মগত বলেই মুখের ছাপ ওর স্বভাবে এসে পড়েছে।
একটু থেমে বললেন, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও দেখা গেছে মা-বাপের অজান্তে কোনো অশুভ আত্মা জন্ম নেয়। যেমন মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে পুণ্যাত্মারা এসে পড়েন। কে কখন আসেন সামান্য মানুষ তা জানতে পারে না। বিজ্ঞান এখানে পরাস্ত। আপনাদের চারু বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তেমনি হয়েছিল। তার জীবনটা চালাচ্ছিল একটি ভয়ংকর অশুভ আত্মা।
আমি বললাম, মোহনের কাছে শুনেছিলাম, ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা যান। তারপর যখন ওর বয়েস বছর পাঁচ ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু এই ছেলেকে ওর সত্য মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। নতুন বিয়ের পরই ওঁরা পুরীর রথযাত্রা দেখতে গেলেন। সেখানে ভিড়ে হাত ফস্কে চারু হারিয়ে যায়। কেউ কেউ বলে ওর সম্মা নাকি ইচ্ছে করেই চারুকে ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আসেন। বাবা চাইলেও ওর সত্য পুলিশকে জানাতে দেননি।
কিন্তু অবাক কাণ্ড! দিন দশেক পরে ঐ পাঁচ বছরের ছেলে নিজেই বাড়ি ফিরে আসে। ঐটুকু ছেলের এমনই অভিমান যে, কী করে আসতে পারল তা কাউকে বলল না। বাড়ি ফিরে এসে সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। তার সমার ওপর রাগ, তার বাবার ওপর রাগ। রাগ সমবয়সী সব ছেলেদের ওপর। আমি যতটুকু জানতে পেরেছিলাম–তা হল এইটুকুই।
পাদ্রীবাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, এই জন্যেই ওর এই পরিণতি। যাক, আপনার সঙ্গে ওর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কী রকম দাঁড়াল বলুন।
বললাম, সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ছেলেটাকে পছন্দ না করলেও যেমন আমি ওর গান পছন্দ করতাম, তেমনি ও-ও আমাকে পছন্দ না করলেও আমার বাজানোটা পছন্দ করত। ও চাইত ও যখনই যেখানে গান করবে তখনই আমি যেন ওর সঙ্গে থাকি। এ এক ধরনের অর্ডার। মোহনদের বাড়ি গেলে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই বুঝি ঝড়ের মতো চারু এসে হাজির হল!
ক্রমশ চারু আমার উপর জুলুম শুরু করল। যখনই ও গাইবে তখনই আমাকে বাজাতে হবে। শুধু মোহনের বাড়িতেই নয়, অন্য কোথাও গাইতে গেলে ও ওদের বাড়ির কাজের লোকের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাত, অমুক দিন আমার সঙ্গে যাবে। কোনো অজুহাত শুনব না।
এ তো অনুরোধ নয়, আদেশ। রাগে গা জ্বলে যেত। বেশির ভাগ সময়ে ছলছুতো করে এড়িয়ে যেতাম।
এড়িয়ে যেতেন কেন? আপনিও তো আর্টিস্ট। প্রশ্ন তুললেন পাদ্রীবাবা।
বললাম, ও হয়তো মন্দ গান করত না। কিন্তু তার সেই পাথরের মতো খসখসে, উঁচু নিচু মুখ, সাপের মতো হিম দৃষ্টি আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারতাম না। তাছাড়া ওর কুচুটে মনের পরিচয় যে কেউ পেয়েছে সেইই এড়িয়ে চলত। কথায়-বার্তায় এতটুকু নম্রতা ছিল না। নিজেকে যে কী মনে করত তা ওই জানত। আমাদের মনে হত, ও আমাদের ওর বাবার মাইনে করা কর্মচারী মনে করত। তাই কখনও অনুরোধ করত না। করত আদেশ।
আর আমি যখনই ওর ডাকে সাড়া দিইনি তখনই ও আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে। আপনি ওকে, শিল্পী বলে সম্মান করছেন, কিন্তু এই কি শিল্পীর আচরণ?
একটু চুপ করে থেকে পাদ্রীবাবা বললেন, কী করে আপনাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল সেই কথাটা বলুন।
বললাম, আমি ওকে ছাড়তে চাইলেও ও আমাকে ছাড়তে চাইত না। আমি দেখলাম যেমন করে হোক ওর সঙ্গে বাজানো আমাকে বন্ধ করতেই হবে। তাই একটা ফাংশানে গিয়ে বাজাতে বাজাতে তাল কেটে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ও রাগে ফেটে পড়ল। হারমোনিয়াম ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার বাঁয়া-তবলা ভেঙে দেবার জন্যে তাড়া করে এল। আমি কোনোরকমে সে দুটি বুকে আগলে পালিয়ে এলাম। ঠিক করলাম, আর কখনও ওর ত্রিসীমানায় যাব না।
কিন্তু এর পরই একটা ঘটনায় আমি চমকে উঠলাম। সেই সপ্তাহেই একদিন ঘুম থেকে উঠে বাইরের ঘরে ঢুকে দেখলাম জানলার শিকগুলো দুমড়ানো। কী হল? চোর ঢুকেছিল? কিন্তু বাইরের ঘরে কী পাবে? এ বাবা! বাইরের দরজায় খিলও খোলা!
বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। হঠাৎ আলমারির মাথায় চোখ পড়ল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ওপরেই বাঁয়া-তবলাটা তোলা থাকে। চারুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ওগুলোকে বাড়ি নিয়ে এসে কোনোরকমে আলমারির মাথায় রেখে দিয়েছিলাম। চোর হঠাৎ বাঁয়া-তবলা নিয়ে গেল কেন? তবলা শিখবে নাকি?
হঠাৎ লক্ষ পড়ল আলমারির নীচে একটুকরো কাগজ ভাঁজ করে রাখা রয়েছে। তুলে নিয়ে পড়লাম। চিঠিই বলা যায়। সেটা এইরকম–
তবলচি সাহেব, আমার কথা যারা মান্য করে না তাদের এই রকম শাস্তিই দিই। জানি এক সেট বায়া-তবলা ফের করাতেই পার। কিন্তু এটা যে তোমার ঠাকুর্দার জিনিস। মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন! কী বল? তাই এটাই হাতালাম।
পার তো পুলিশকে জানিয়ে এ দুটো উদ্ধার কোরো।
—ইতি
চারু বিশ্বাস।
চিঠিটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে একটা কথাই ছিটকে বেরিয়ে এল–শয়তান। কিন্তু শত্রুকে উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে শুধু বাড়ি বসে গাল পাড়াটা অক্ষমের কাজ। তাই আমি চারুকে শাস্তি দেবার কথা চিন্তা করতে লাগলাম।
শাস্তি দিলেন?
হ্যাঁ, দিলাম বৈকি। তবে একটু অন্যভাবে। যাকে বলে শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ।
কী করলেন? পাদ্রীবাবা নড়েচড়ে বসলেন।
বলছি, দাঁড়ান। তার আগে একটু জল খাই। বলেই হাঁক মারলাম, নকুল, একটু ঠান্ডা জল দাও। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেছে।
নকুল দুজনের জন্য দু গেলাস জল নিয়ে এল।
আমাকেও খেতে হবে?
খান। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?
দুজনেই জল খেয়ে খালি গেলাস দুটো নকুলের হাতে দিয়ে আবার কথা শুরু করলাম। বললাম, সত্যিই গলা শুকিয়ে যায়নি। নকুলকে ভালো করে দেখাবার জন্যই ডাকলাম।
পাদ্রীবাবা অবাক হয়ে তাকালেন, ভালো করে দেখার দরকার হল কেন?
কারণ আছে। হ্যাঁ, এবার চারু বিশ্বাসকে কীভাবে শাস্তি দিয়েছিলাম বলি। একটু থেমে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোনো কোনো ছিঁচকে চোর, দিব্যি ভদ্রসমাজে থেকে যায়। পাবলিক তাদের চেনে। পুলিশও। তবু তাদের ধরে না। নিতান্ত পেটের দায়ে গেরস্ত বাড়িতে কাজ করে। তারপর সুবিধে পেলে ঘটিটা, বাটিটা হাতসাফাই করে সরিয়ে নেয়। কখনও নেয় শাড়ি, ব্লাউজ যা হাতের কাছে পায়। আমরা ছোটোবেলা থেকে এদের চিনতাম। হয়তো পুরোনো শিশি-বোতল কিনতে বাড়ি ঢুকেছে। মা অমনি সবাইকে বলে দিত, সাবধান। অমূল্য এসেছে। শুধু অমূল্য কেন, আরও কয়েকজন ছিল–গোবরা, পটকা, হারু।
যাই হোক চারুকে শাস্তি দেবার জন্যে আমি রাতের অন্ধকারে ডেকে পাঠালাম নতুন পুকুরপাড়ের গোদাকে। যে-কোনো বাড়িতে ও যেমন করে তোক ঢুকবেই। তারপর রাত থাকতে থাকতেই কাজ হাসিল করে আসবে।
আমাদের মতো বাবুদের বাড়িতে লুকিয়ে ডাক পাওয়া ভাগ্যের কথা। গোদা হাত জোড় করে এসে দাঁড়াল। বললাম, গোদা, একটা কাজ আছে। খুব সাবধানে করতে হবে। তবে তোমার পক্ষে কাজটা মোটেই শক্ত নয়।
বলুন হুজুর।
ওকে তখন কাজটা বুঝিয়ে বললাম, গোদা, আমি এইটুকু জেনেছি বাঁয়া-তবলাটা চারু ওর পড়ার ঘরে লুকিয়ে রেখেছে। তোমার কাজ হচ্ছে ওখান থেকে ওটা হাতিয়ে এনে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। এর জন্যে তোমাকে কত দিতে হবে বলো? তবে সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে।
গোদা হাত জোড় করে বলল, আমায় সাত দিন সময় দেবেন। চার দিন লাগবে লক্ষ রাখতে কে কখন বাড়িতে যায়, বাড়ি থেকে বেরোয়। তারপর বাকি তিন দিনের মধ্যে কাজ হাসিল করে আপনার জিনিস আপনার কাছে পৌঁছে দেব। তারপর আপনি খুশি হয়ে গরিবকে যা দেন দেবেন।
বলেই আবার আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে চলে গেল।
এর অনেক দিন পর নকুল যখন এল আমাদের বাড়িতে তখন ওকে দেখে প্রথমে গোদা বলেই ভুল করে ফেলেছিলাম। আশ্চর্য মিল! আমি নকুলকে জিগ্যেস করলাম তার কোনো দাদা এদিকে থাকত কিনা। ও জানিয়েছিল ওর আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও নেই।
পাদ্রীবাবা বললেন, এই জন্যেই বুঝি নকুলকে ডেকে আমাকে দেখালেন।
হ্যাঁ, নকুলকে দেখে গোদা সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারবেন।
আপনার নির্দেশমতো গোদা কাজ করতে পেরেছিল?
হ্যাঁ, নিখুঁত ভাবে।
পাত্রীবাবা বললেন, তারপর চারু যখন জানতে পারল তখন কী করল?
ও যে ঠিক জানতে পেরেছিল তা আমিও বুঝিনি। শুধু আমি কেন কেউই খবর রাখেনি। এমন কি ও যে কবে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল তাও আমরা জানতাম না। আর ধন্য তার বাবা-মা। ছেলে যে না বলে চলে গেছে তার জন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই।
তাহলে আপনার সঙ্গে আপনার বন্ধুর দেখা হল কবে?
অনেকদিন পরে। ততদিনে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে এসে গেছি। কোথায় কেন যে এমন গা ঢাকা দিয়েছিল তা আজও জানি না। একদিন রাত্রে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি চারু দাঁড়িয়ে। আমি তো অবাক। জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার? কবে এলি?
তার উত্তর না দিয়ে বলল, শোন্, আমার শরীর খুব খারাপ। তবু তোকে জানাতে এসেছি আমার ঘর থেকে বাঁয়া-তবলা চুরি করে তুই রেহাই পাবি না। আমি যেখানেই থাকি একদিন তোকে টেনে নেবই। মনে রাখিস। বলতে বলতে সে যেন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ আবার কী দেখলাম–কী শুনলাম! পরের দিন মোহনকে বললাম। ও বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু ও দেখা করল কী করে? ও তো কদিন থেকে জ্বরের ঘোরে রয়েছে। কাল দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার রোগ ধরতে পারছেন না। ভুল বকে যাচ্ছে। আমায় দেখে লাল লাল চোখ মেলে দাঁত কড়মড় করে চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই শয়তান বন্ধু! চোর কোথাকার! প্রতিশোধ নেবই। আমি বাইচান্স খ্রিস্টানের ঘরে জন্মেছি। কিন্তু যিশু ভজি না। শোধ তুলবই। বুঝলাম চিনতে ভুল করেছে।
অসুখের মধ্যেও আমার মুন্ডু চিবোচ্ছে!
তুমি কি একদিন দেখতে যাবে?
বললাম, সাহস পাই না। আমায় দেখে যদি উত্তেজনায় হার্ট ফেল করে!
তা বটে। মোহন কাজে মন দিল।
যাব কি যাব না করতে করতে কদিন গেল। তারপর স্থির করলাম, ঝগড়াই হোক আর মনোমালিন্যই হোক একসঙ্গে এতদিন গানবাজনা করেছি। একবার দেখা করে আসি। এটা কর্তব্য।
কিন্তু মনের মধ্যে খোচ থেকেই গেল। সে রাত্রে যখন সে জ্বরের ঘোরে ছিল তখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল কী করে?
.
০৮.
শ্রাবণ মাস। সেদিন আবার শনিবার। ভরা অমাবস্যা। বিকেল বিকেল গেলাম। কিন্তু মেঘে মেঘে বিকেল তলিয়ে গেছে অকাল সন্ধ্যার মধ্যে। ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম ওদের বাড়ি। ভেবেছিলাম অনেককেই দেখতে পাব। কিন্তু কোথায়? ওর বাবাকে দেখলাম কোট-প্যান্ট পরে দিব্যি হাসিমুখে একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে বললেন, এসো।
জিগ্যেস করলাম, চারু কেমন আছে?
ভালো না। বলেই তিনি চলে গেলেন। আশ্চর্য! ভালো না–তবু বাবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপটুকুও নেই। বাড়ির ঠাকুর-চাকরের অসুখ করলে বাড়ির কর্তা ভাবেন। কিন্তু এ যেমনই হোক তবু এ তো নিজের ছেলে।
সংকোচে পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। কারণ, যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি সে আমায় মোটেই পছন্দ করে না। এই যে সেদিন গভীর রাতে অলৌকিক ভাবে চারু দেখা দিল তখনও তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শাসিয়ে গেল, যেখানেই থাকি তোকে টেনে নেব। এ কথার মানে কী? আমার সঙ্গে ওর এমন বন্ধুত্ব নেই যে যেখানেই ও থাকুক আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আসলে আমাকে শাস্তি দেবার জন্যে। কিন্তু আমার অপরাধটা কী? আমি ওর ঔদ্ধত্য, প্রভুত্ব স্বীকার করতে পারতাম না। ও আমাকে যখন তখন বাজাবার জন্য হুকুম করত। ভাবত আমি যেন ওর মাইনে করা লোক। এটা সহ্য করতে পারতাম না। এড়িয়ে চলতাম, এটাই তার রাগ। সত্যি কথা বলতে কি ওর ভয়েই শেষ পর্যন্ত বাজানো ছেড়ে দিলাম।
তাই ভাবছিলাম রোগের মধ্যে এ রকম অপছন্দের মানুষকে দেখলে সে কি সহ্য করতে পারবে? যাই হোক, ভেতরের যে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম–সে ঘরেই একটা চৌকিতে শুয়েছিল চারু। দুচোখ বন্ধ। যেন ঘুমোচ্ছে। ঘরে ওদের সরকারবাবু আর রামতারণ কবিরাজ মশাই ছাড়া আর কেউ নেই। বৃদ্ধ কবিরাজমশাই খুব মনোযোগ দিয়ে নাড়ি দেখছেন। সরকার মশাই ব্যাকুলভাবে তাকিয়ে আছেন কবিরাজমশাইয়ের দিকে। কী বলবেন কে জানে?
দেখেই বুঝলাম চারু ঘোরের মধ্যে রয়েছে। রুগির এই সঙ্গিন অবস্থাতেও কি বর্ধমান থেকে বড়ো ডাক্তার আনানো যেত না? টাকার তো অভাব নেই। আমি একটু দূরে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।
অনেকক্ষণ ধরে নাড়ি দেখে কবিরাজমশাই ধীরে ধীরে চারুর হাতটা ওর বুকের ওপর রেখে দিয়ে চাদরটা দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিলেন।
কেমন দেখলেন কবিরাজ মশাই? সরকারবাবু জিগ্যেস করলেন।
কবিরাজমশাই বললেন, নতুন ওষুধ দিয়ে লাভ নেই। মকরধ্বজটা যেমন চলছে চলুক। আর হ্যাঁ, আজ আবার ভরা অমাবস্যা। রাতটা সজাগ থাকবেন।
সরকার মশাই বললেন, তেমন বুঝলে কি আপনাকে খবর দেব?
যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবিরাজমশাই বললেন, দিতে পারেন। আমার বয়স হয়েছে তো। রাতটাও খারাপ
কবিরাজমশাই লাঠি ঠক্ করতে করতে গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছু পিছু গেলেন সরকার মশাই। সেই মুহূর্তে রুগির সামনে আমি একা। ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটা লণ্ঠনও কেউ জ্বেলে দিয়ে যায়নি। পাশের জানলাটা খোলা ছিল। সেখান দিয়ে যতটা আলো আসছিল তার চেয়ে বেশি ঢুকছিল মশা।
একবার তাকালাম চারুর মুখের দিকে। একেই তো তার মুখটা ভয়ংকর, তার ওপর রোগযন্ত্রণা। মুখটা সাদা। মন হল কেউ যেন শরীরের সব রক্তটুকু শুষে নিয়েছে।
একা বসে থেকে কী করব? কেউ বসতেও বলেনি। তা হলে চলেই যাই। তখনই ভাবলাম যার জন্যে আসা তাকে দেখলাম। কিন্তু সে তো জানতেও পারল না। হয়তো ও জানতে পারল না এটাই ভালো হবে আমার পক্ষে। কিন্তু মুমূর্ষ রুগিকে একা ফেলেই বা যাই কী করে?
ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক তখনই কেমন যেন অস্বাভাবিক গলায় চারু ডাকল, বলু!
চমকে ফিরে দেখি একটা মৃতদেহ যেন দুখানা হাড্ডিসার হাত ছড়িয়ে দিয়ে বিছানার ওপর উঠে বসেছে।
চারু হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। কাছে যেতেই সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে আমায় বসতে বলল।
আমি কেমন ভয় পেলাম। তবু বসলাম। ও শুয়ে পড়ল। তারপর অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। কী ভয়ংকর দৃষ্টি!
কী দেখছিস অমন করে?
আমার কথা না শুনলে শাস্তি পেতেই হবে। সে শাস্তি যে কী সাংঘাতিক তুই জানিস না।
আমি চুপ করে রইলাম। এ তো পাগলের প্রলাপ। শোনার যোগ্য না হলে ওর কথা শুনতে যাবই বা কেন?
হঠাৎ ওর ভয়ংকর মুখটা অদ্ভুত ভাবে বেঁকিয়ে বলল, সেই কবে খবর দিলাম নিজে গিয়ে। আর এত দেরিতে এলি কেন?
সে রাত্রিতে তুই কেন গিয়েছিলি?
কেন? চালাকি হচ্ছে? আমাকে চিনতে পারিসনি?
পেরেছিলাম কিন্তু অত রাত্রে—
একদম চুপ!
এমনি সময়ে একজন ঘরে আলো রেখে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ঘরে আলো আসতেই দেওয়ালে চাদর মুড়ি দিয়ে শোওয়া অবস্থায় চারুর একটা লম্বা ছায়া পড়ল। এত লম্বা ছায়া? এ কি মানুষের ছায়া!
শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশে অন্ধকার দানা বেঁধে আছে, সেই অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশের জঙ্গলের পাতায় পাতায়। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে বিদ্যুতের আলো অন্ধকারকে এফেঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। হঠাৎ চারু গোঁ গোঁ করে উঠল! চমকে ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও জানলার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।
চারু! কী হয়েছে?
ও হঠাৎ আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল! উঃ কী ঠান্ডা হাতটা! একি মানুষের হাত!
চারু, ভয় করছে?
বলু, তুই বাড়ি যা।
না, এ অবস্থায় তোকে ফেলে আমি যাব না।
চারু কর্কশ স্বরে বলল, তুই কি কেবলই অবাধ্য হবি? যা বলছি।
কেন?
কথা বাড়াস নে। ঐ দ্যাখ জানলার বাইরে। ওরা এসে পড়েছে। তোকে দেখে খুব রাগ করছে। তুই আছিস বলে আমাকে নিতে পারছে না।
ভয় নেই, আমি তোর সঙ্গেই থাকব। বলে ওকে ভরসা দিলাম।
কিন্তু ও কী বুঝল জানি না। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, এখন নয়। আগে আমি যাই। তার কুড়ি বছর পর–তুই চলে আসবি। তুই এখন যা। যা বলছি
কুড়ি বছর পর কেন?
অত প্রশ্ন করিস না। আমি জানি না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। তুই যা—
কিন্তু জানলার বাইরে কাকে দেখে ও এরকম করছে?
উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা গেল না। মনে শুধু দু-তিনটে ছায়ামূর্তি বাড়ির কাছে ঘুরছে।
বুঝলাম চোখের ভুল। আর ও স্বপ্নের ঘোরে প্রলাপ বকছে।
বলু–বলু, তুই যা। ওই ওরা আমাকে
বললাম, তুই যখন চাচ্ছিস আমি আর না থাকি তাহলে বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।
যা খুশি কর। বলেই সে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আর তখনই একটা হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় জানলার পাটাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।
বুঝলাম চারু আর নেই। চারুর কথা যদি সত্যি হয় তা হলে যারা তাকে নিতে এসেছিল তারা কাজ শেষ করে এই মুহূর্তে চলে গেল।
সারা রাত্রি বাড়ির জন দুই মাত্র লোকের সঙ্গে চারুর মৃতদেহ আগলে বসে রইলাম। অনেক বেলায় অল্প কিছু লোক জমল। মাপে মাপে কফিন তৈরি করা হল। তারপর নিঃশব্দে মৌন মিছিল করে কবরখানায়।
আমি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। আর পারছিলাম না। কিন্তু তখনও একটি কাজ বাকি ছিল। একে একে সকলে কবরে মাটি দেবার পর আমিও কফিনের ওপর মাটি দিয়ে চলে এলাম।……..
.
তারপর? জিগ্যেস করলেন জগদীশ অ্যান্টনি।
বললাম, পরের দিন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরলেও ঘোরের মধ্যে ছিলাম বেশ কদিন। তারপর ঘোর কাটলেও অনেক কিছু মনে করতে পারতাম না। কেন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম ডাক্তার তা বলতে পারেননি। তারপর এই কিছুদিন ধরে চলছে নানা উৎপাত।
চিনতে পারছেন কে উৎপাত করছে?
বললাম, প্রমাণ পাইনি। তবে আন্দাজ করছি।
পাদ্রীবাবা এবার আর কথা বললেন না। একটু চুপ করে থেকে উঠে পড়লেন। তারপর আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, ঘটনার যখন শুরু তখন বোধ হয় আপনার বয়েস ছিল ষোলো-সতেরো। তাই না?
বললাম, হ্যাঁ।
তারপর কুড়ি বছর কাটল। তাহলে এই মুহূর্তে আপনার বয়েস সাঁইত্রিশ। বড়ো সাংঘাতিক সময় শুরু হয়েছে আপনার জীবনে। এই মুহূর্তে আপনি ঐ অশরীরী আত্মার টার্গেট হয়ে আছেন। বাডড়া সাংঘাতিক আত্মাটি। কিছুতেই ছাড়বে না।
একটু থেমে বললেন, বলুবাবু ভাই, খুব সাবধানে থাকবেন। প্রমাণ না পেলেও আমারও অনুমান আত্মাটি আপনার সেই প্রথম বয়েসের বন্ধুটিরই। যা শুনলাম তাতে বুঝেছি মোটেই ভালো নয়। এরা এক ধরনের ঈর্ষাপরায়ণ, হিংসুটে, গোঁয়ার, সব সময়ে কর্তৃত্ব করতে চায়। মৃত্যুর পরও স্বভাব বদলাতে পারে না। এ নিশ্চয় আবার হানা দেবে।
হ্যাঁ, আর একটা কথা, বাঁয়া-তবলাটা কোথায়?
বাইরের ঘরে। যেখানে ছিল।
যদি পারেন ওটা পুড়িয়ে ফেলুন। নইলে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিন। ওটার ওপর আপনার বন্ধু চারুর বিষদৃষ্টি আছে।
বললাম, তা আমি পারব না। ওটা আমার দাদুর স্মৃতি।
পাদ্রীবাবা আমার এই স্পষ্ট কথা শুনে আর কিছু বললেন না। শুধু আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাতটা একটু তুলে চলে গেলেন।
.
০৯.
আমার সব কথা শুনে সেদিন পাদ্রীবাবা আমাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। সে নাকি আবার আমার বাড়িতে হানা দিতে পারে। কিন্তু কীভাবে তা প্রতিরোধ করব তার কোনো উপায় বলে দেননি তিনি। অশরীরী আত্মার আক্রমণ থেকে কোনো মানুষ শুধু বন্দুক দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এমন কথা শুনিনি। তাহলে!
সন্ধেবেলা বিমর্ষভাবে এইসব কথা ভাবছি, হঠাৎ দাদা-দাদা করতে করতে ভয়ে উত্তেজনায় নকুল বাইরের ঘরে এসে ঢুকল।
কী হয়েছে?
শীগগির আসুন। আবার সেইউঃ কী ভয়ংকর মুখ! তেড়ে এসেছিল। কোনোরকমে–
আমি তখনই উঠে পড়ে বললাম, চলো তো দেখি। বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। বেশি দূর যেতে হল না। দেখি দালানে ঢোকার মুখেই সেই ছায়ামূর্তি। এবার আরও স্পষ্ট। হাত দশেক তফাত থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম। হাইট প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। মাথাটা নারকেলের মতো লম্বাটে। চুল নেই। এই হাইট দেখেই অনেকটা নিশ্চিত হলাম এ আমার সেই ছোটোবেলার শত্রু চারু, যে আমাকে বারে বারে হুকুম করত, শাসাত। কিন্তু সারা গায়ে এত মাটি কেন? শরীর ছাড়া ছায়ামূর্তিটি সর্বাঙ্গে এত ধুলো মাখল কোথা থেকে? সে দাঁড়িয়েছিল পিছন ফিরে। কেমন করে যেন বুঝতে পারল আমি এসেছি। তারপর ধীরে ধীরে মুখটা ফেরাল। মুখটা ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘরে কোথা থেকে আবছা আলো এসে পড়ল। সেই আলোয় যা দেখলাম তা ভোলবার নয়।
মুখ কোথায়? একটা মড়ার খুলি। চোখ নেই, আছে শুধু দুটো গর্ত। গালে চামড়া নেই, এক চিলতে মাংস মুখে নেই, কিন্তু আছে বড়ো বড়ো হলদে ছোপধরা দাঁতের সারি। সেই দাঁতের সারির ফাঁক দিয়ে একটা অচেনা কর্কশ গলার স্বর শোনা গেল।
…..কুড়ি বছর শেষ….যেতে হবে আমার সঙ্গে। বলতে বলতে দুখানা সরু সরু পা সাইকেল চালাবার মতো বাতাসের মধ্যে দিয়ে প্যাডেল করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
আমি আঁতকে উঠে দুপা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, না, আমি কোথাও যাব না।
খুলিটার মুখ দিয়ে ফ্যাসফেসে একটা হাসির মতো খানিকটা বাতাস সশব্দে বেরিয়ে এল।
স্পষ্ট শুনলাম করোটির মধ্যে থেকে আসা কথা, যেতে তোমাকে হবেই।
আমি খুব ভয় পেলাম। বললাম, কোথায় যেতে হবে শুনি।
যেখানে আমি আছি।
বিদ্রূপ করে বললাম, সেটা কোথায়? স্বর্গে না নরকে?
সে শুনে তোমার কী লাভ? তুমি তো আমার সঙ্গেই যাবে। তা যেখানেই থোক।
শোনবার দরকার নেই। তোমার গায়ে এত মাটি দেখে বুঝতে পারছি তুমি স্বর্গে থাকই না, নরকেও না। তুমি থাকো মাটির নীচে। অন্ধকারে কবরে। সেই কবর থেকে তুমি উঠে এসেছ।
হ্যাঁ, তাই। এখন আমার সেই কবরেই তোমাকে নেব। কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছর পর্যন্ত আমার একটা গিট ছিল। যে গিট পেরিয়ে আমি এখন অনেক স্বাধীন, অনেক মুক্ত। আমার ইচ্ছাশক্তি, ক্ষমতা দুইই অনেক বেড়ে গেছে। চলো শীগগির। বলে আরও এগিয়ে এল।
আমি চিৎকার করে বললাম, তোমার সঙ্গে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তুমি মৃত। এ সংসারের সঙ্গে তোমার আর কোনো বন্ধন নেই। তুমি যেখানে খুশি যেতে পার, যেখানে খুশি থাকতে পার, কিন্তু আমি জীবিত। সুস্থ শরীরে বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ভালো ছিল না। তুমি অনেকবার আমার ক্ষতি করবার চেষ্টা করেছিলে। তাই তোমার সঙ্গে কোথাও আমি যাব না। চলে যাও তোমার কবরে। আমাকে বিরক্ত কোরো না। তাছাড়া তুমি অনেকদিন থেকে নকুলকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? ও কী করেছে? আমার মনে হয় তুমি নকুলকে সেই চোর বলে ভুল করে এসেছ যে আমারই নির্দেশে তোমার বাড়ি থেকে বাঁয়া-তবলা উদ্ধার করে এনেছিল। তার নাম ছিল গোদা। নকুলের দুর্ভাগ্য ওকে গোদার মতোই দেখতে। ও কি! ওভাবে আমার দিকে এগোচ্ছ কেন? আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, নকুল! আমাকে বাঁচা!
কিন্তু কোথায় নকুল? সে বোধ হয় ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
এদিকে বাতাসে প্যাডেল করতে করতে এক পা এক পা করে চারুর হিংস্র প্রেতাত্মা আমার গলা টেপবার জন্যে এগিয়ে আসছে। তার দুই চোখের শূন্য কোটরে দপ্ দপ্ করে জ্বলছে আগুনের শিখা।
এগিয়ে আসছে…..ক্রমেই এগিয়ে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। মৃত্যু তাহলে নিশ্চিত এল সাঁইত্রিশ বছর বয়েসেই।
ভয়ে চোখ বুজলাম।
আর তখনই শুনলাম নকুলের চিৎকার–পাদ্রীবাবা, ঐ যে–ঐ যে–স্বচক্ষে দেখুন।
আমি চোখ খুললাম। দেখলাম পাদ্রীবাবা গায়ে তার সেই জোব্বা চাপিয়ে ক্ৰসখানি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছেন চারুর প্রেতাত্মার দিকে।
চারুও আমাকে ছেড়ে এক পা এক পা করে পিছোতে লাগল।
নির্ভীক প্রৌঢ় পাদ্রীবাবাও পবিত্র ক্রসটি হাতে নিয়ে চারুর মুখোমুখি হলেন। তিনি ভেবেছিলেন এই ক্রসটি প্রেতাত্মার সামনে ধরলেই অশুভ শক্তি পিছু হটবে।
কিন্তু তা হল না। মৃত্যুর পর কুড়ি বছর ধরে চারু অজেয় হয়ে ওঠার জন্যে কী কঠোর সাধনা করেছিল কে জানে! আমাদের হতচকিত করে দিয়ে সে হঠাৎ হাত দুটোকে দুটো বিরাট কালো ডানায় রূপান্তরিত করে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপর ডানার ঝাঁপটায় পাদ্রীবাবাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাতাসে ভেসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা শব্দ হল।
মনে হল কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। কিন্তু কোথায় বোঝা গেল না।
পাদ্রীবাবা উঠে দাঁড়ালেন। বিমর্ষভাবে বললেন, এমন দুর্ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটেনি। পবিত্র ক্রসকেও মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল! হাত দুটো ওর জ্বলে গেল না?
একটু থেমে বললেন, নকুল যখন ছুটতে ছুটতে গিয়ে আমায় সব কথা বলল তখন ভাবতে পারিনি আমাকে এমন একটা দুর্ধর্ষ আত্মার মুখোমুখি হতে হবে। তা হলে প্রস্তুত হয়ে আসতাম।
ভয়ে ভয়ে বললাম, তাহলে এখন আমরা কী করব? বাড়িতে তো শুধু আমি আর নকুল।
পাদ্রীবাবা বললেন, সেটা আজ রাত্তিরে ভেবে দেখব। কাল সকালে যা হয় করবেন, তার আগে এখুনি চলুন বাজটা কোথায় পড়ল দেখি।
বাজ! নকুল বলল, শব্দ শোনা গেল বাড়ির মধ্যে অথচ রাস্তার কেউ শুনতে পেল না! এ কেমন বাজ?
পাদ্রীবাবা বললেন, চলো তো ভালো করে দেখি। অত জোর শব্দ হল অথচ বাড়ির ক্ষতি হল না। আশ্চর্য!
তখনই দুটো লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঘরগুলো দেখলাম। না, কোথাও একটা ইটও ভেঙে পড়েনি।
পাদ্রীবাবা হঠাৎ আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে উঁচু করে তুললেন।
ঐ যে দ্যাখো! ওর আক্রোশ যার ওপর তার ক্ষতি করবেই।
দেখলাম আলমারির ওপর থেকে পড়ে বায়া-তবলাটা ফেটে চৌচির হয়ে পড়ে রয়েছে।
.
১০.
সে রাত্রে খুব ভয়ে ভয়ে শোবার ঘরে ঢুকে খিল লাগালাম। মনে হল, মৃত চারু আজ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তাতে ঐ কাঠের দরজা দূরের কথা লোহার দরজাও তাকে ঠেকাতে পারবে না।
অমন যে নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পাদ্রীবাবা–তিনিই পারলেন না চারুর সঙ্গে। তিনিই বলে গেলেন চারু হয়তো আবার আসবে আরও ভয়ংকর শক্তি নিয়ে আমাকে শায়েস্তা করতে। অথচ তাকে ঠেকাবার কোনো উপায়ই বাৎলাতে পারলেন না। শুধু ভরসা দিয়ে গেলেন কাল সকালে এসে ব্যবস্থা করবেন।
কাল সকাল! তার আগে গোটা রাতটা কাটবে কী করে?
ঘরের মধ্যে উৎকট নাক ডাকার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে নকুল। সাধারণত সে আমার পাশের ঘরে শোয়। আজ যে এ ঘরে এসে শোবে তার জন্যে আমার অনুমতি নেওয়াও দরকার মনে করেনি। সন্ধের মুখে এই বাড়িতেই প্রেতাত্মার ভয়ংকর হানার পরও কেউ যে একা একটা ঘরে শুতে পারে তা ভাবা যায় না। আমিও ভাবিনি। একবার ভেবেছিলাম নকুলকে ডেকে নেব। তা দেখি নকুল নিজেই এসে বেছে বেছে অপেক্ষাকর নিরাপদ জায়গা হিসেবে টেবিলের আড়ালে বিছানা পেতে নিয়েছে।
ও দেখছি আরও একটি কাজ করে রেখেছে। সব জানলাগুলি বন্ধ করে রেখেছে। এমনকি জানলার ফাঁকগুলোতে কাগজ গুঁজে দিয়েছে।
এতক্ষণে ঘুমে চোখ তুলে আসছিল। বালিশের পাশে টর্চটা ঠিক মতো আছে কিনা দেখে নিয়ে ভগবানের স্মরণ করে চোখ বুজলাম।
কতক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ হল। ধড়মড় করে উঠে বসে টর্চ জ্বালোম। দেখি উত্তর দিকের জানলার একটা পাট খুলে গেছে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই জানলার পাটটা খুলে গেল কী করে? আপনাআপনি?
নকুলেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভয়ে ভয়ে ডাকল, দাদা।
অভয় দিয়ে বললাম, ও কিছু নয়। জানলাটা খুলে গেছে।
মশারির ভেতর থেকেই নকুল বলল, কিন্তু আমি তো দাদা, সন্ধেবেলাতে সব জানলার ছিটকিনি এঁটে দিয়েছিলাম।
তার কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে টর্চ জ্বেলে জানলাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম।
এতক্ষণে মনে হল ঘরটা যেন বড্ড বেশি অন্ধকার। অথচ স্পষ্ট মনে আছে শোবার আগে ডিম লাইটটা জ্বেলে রেখেছিলাম।
সুইচবোর্ডে টর্চের আলো জ্বেলে দেখি সুইচটা অফ করা আছে। কী আশ্চর্য! আমি হলপ করে বলতে পারি ঐ সুইচ আমি নিজের হাতে অন করে আলো জ্বেলে তবে শুয়েছি।
তাহলে? তাহলে ওটা অফ করে গোটা ঘর অন্ধকার করে রাখল কে? কেনই বা করল?
নকুল ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, কিছু গোলমাল?
বললাম, না। তুমি ঘুমোও।
সকালে ধড়মড় করে উঠেই যখন দেখলাম আমার হাত, পা, ঘাড়, গলা ঠিক আছে আর নকুল ঘরের জানলাগুলো সাবধানে খুলছে তখনই মনে পড়ল সকালবেলাতেই পাদ্রীবাবার আসার কথা। তার আসাটা যে কতখানি দরকার তা শুধু আমিই জানি। সারা রাত্রি চিন্তা ভাবনা করে তিনি আজ আমাকে জানাবেন এই ভয়ংকর প্রেতাত্মার হাত থেকে কী ভাবে নিষ্কৃতি পাব। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। অপেক্ষা করছি তো করছিই। পাদ্রীবাবার পাত্তা নেই।
অধৈর্য হয়ে নকুলকে পাঠালাম পাদ্রীবাবার বাড়িতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে নকুল জানাল উনি বাড়ি নেই। তালা বন্ধ।
অবাক হলাম। সাধারণত উনি বিশেষ কোথাও যান না। যাবার জায়গাও নেই। তা হলে আজ এই সাত-সকালে দরজায় তালা দিয়ে কোথায় গেলেন?
এমন ভয়ও হল চারু ওঁর কোনো বড় রকমের ক্ষতি করে দেয়নি তো?
এইসব আবোল-তাবোল নানা কথা যখন ভাবছি তখন বাড়ির দরজায় একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। আর পাদ্রীবাবা হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালেন আমার কাছে। উত্তেজিত ভাবে বললেন, বলুবাবু ভাই, আর একটা রিকশা নিয়ে চলুন আমার সঙ্গে।
অবাক হয়ে বললাম, এই রোদ্দুরে–কোথায়? আপনি যে বলেছিলেন কী করতে হবে তার পরামর্শ দেবেন।
পাদ্রীবাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, আর সময় নেই। এখনই কবরখানায় গিয়ে আপনার বন্ধুর হাড়গোড় যা পাওয়া যায় তা তুলতে হবে।
সে আবার কী?
পাদ্রীবাবা ধমক দিয়ে বললেন, কথা পরে। ঐ রিকশাটা দাঁড় করান।
নকুল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। বলল, দাদা, আমি যাব না?
পাদ্রীবাবা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাবে। দরজা বন্ধ করে চটপট উঠে পড়ে।
ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু কবর থেকে মৃতদেহ তুলতে গেলে তো অনেক হাঙ্গামা পারমিশান-টারমিশান…
ও নিয়ে ভাববেন না। যা-যা-করার সব করে নিয়েছি। একটা অসুবিধা ছিল চারুর ফ্যামিলির পারমিশান নেওয়া। ওর সাবেক বাড়িতে গিয়ে জানলাম চারুর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।
কবরস্থানে এসে যখন পৌঁছলাম মাথার ওপর তখন মধ্যাহ্নের রোদ গনগন করছে। দেখলাম জিপভর্তি আর্মড পুলিশ আগেই এসে গেছে। চার্চের চত্বরে বসে আছে ঝুড়ি, কোদাল, শাবল নিয়ে জনা চারেক কবর খোঁড়ার লোক। একটু পরেই এসে পড়লেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান যিনি তাঁর মোটা শরীর আর বিশাল ভুড়ি নিয়ে রিকশা থেকে নেমেই একটু বিরক্তির সঙ্গে পাদ্রীবাবাকে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো মিস্টার অ্যান্টনি? আজকের দিনেও ভুত-প্রেত বিশ্বাস করতে হবে নাকি?
পাদ্রীবাবা বললেন, এতদিন বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠেনি। আজই উঠেছে।
হ্যাঁ, যা শুনলাম তা সত্যি হলে তো সাংঘাতিক ব্যাপার মশাই! আবার হানা দেবে নাকি?
পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, যাতে আর সে-সুযোগ না পায় তার জন্যেই আজকের এই ব্যবস্থা।
এখন কী করতে চান? জিগ্যেস করলেন চেয়ারম্যান।
পাদ্রীবাবা বললেন, এখানেই একটি কবরে কুড়ি বছর ধরে শুয়ে আছে চারু বিশ্বাস। তার দুরন্ত আত্মা আজও শান্তি পায়নি। এই বলুবাবুর ওপর পূর্বজীবনের রাগ পুষে রেখে তাকে মারবার চেষ্টা করছে। এই কবর থেকেই দরকার মতো উঠে এসে হানা দেয় বলুবাবুর বাড়ি। কাল সন্ধেবেলায় আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি তা ভয়ংকর।
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। তা কী করবেন?
তার অপবিত্র দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলব। তাহলেই আর হানা দেবার কেউ থাকবে না।
কিন্তু এমনও তো হতে পারে আপনার ধারণাটা ঠিক নয়। শুধু শুধু একটা সাধারণ দেহাবশেষ তুলবেন। সে কংকালটা চারু বিশ্বাসের হতে পারে। কিন্তু তা যে প্রেতযযানিপ্রাপ্ত তার প্রমাণ দিতে পারবেন?
পাদ্রীবাবা গম্ভীরভাবে বললেন, কাউকে প্রমাণ দেবার জন্যে আমি নাটক করছি না। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা কর্তব্যবোধ করছি তাই করতে যাচ্ছি। যদি না করি–একদিনও দেরি করি–তা হলে ঐ ভদ্রলোকের প্রাণসংশয় হবেই।
হঠাৎ এই সময়ে আকাশে ধোঁওয়ার মতো মেঘ জমে সূর্যকে ঢাকা দিয়ে দিল।
পাদ্রীবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, কুইক কুইক শীগগির কবর খুঁড়ে ফেলো। ও জানতে পেরেছে।
কবর তো খুঁড়বে কিন্তু কোনটা চারু বিশ্বাসের কবর তা তো বোঝবার উপায় নেই। সে সময়ে কবর কেউ বাঁধিয়ে রাখেনি। কুড়ি বছর পর
হ্যাঁ গো, বলুবাবু, আপনার বন্ধুর কবর কোনটা চিনতে পারেন?
পরপর ধসে যাওয়া মাটির গর্তগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম।
বললাম, কুড়ি বছর কম সময় নয়। তাছাড়া এতদিন এখানে আমার দরকার হয়নি। জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে মনে আছে একটা গাছের নীচে
আসুন দেখি।
পাদ্রীবাবার সঙ্গে ঝোপঝাপ ঠেলে কবরগুলো দেখতে দেখতে চললাম। ওঁর দৃষ্টি কবরের দিকে। আমি লক্ষ করছি ধারে তেমন কোনো পুরোনো গাছ আছে কিনা।
একটা কবরের কাছে এসে পাদ্রীবাবা থামলেন। হেট হয়ে মাটি পরীক্ষা করলেন। তারপর গভীর নিশ্চয়তার সঙ্গে বললেন, এইটাই—
আমি অবাক হয়ে পাদ্রীবাবার দিকে তাকালাম। পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, কী বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, পাশাপাশি অন্য কবরগুলো লক্ষ করুন। এর মাটিগুলো ঢিলেঢালা। কেউ যেন মাটিগুলো মাঝে মাঝে সরায়।
শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিল। তাহলে এই কবর থেকে কফিন খুলে, মাটি ঠেলে, উঠে আসে চারু!
চেয়ারম্যানবাবু কখন পিছনে এসে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
কবরের মাটি ছুঁলেন, মিস্টার অ্যান্টনি! বলিহারি যা হোক!
পাদ্রীবাবা হাসলেন। বললেন, কবরের মাটি খুবই পবিত্র। শেষ পর্যন্ত ঐখানেই তো আমাদের গতি! আরে! অন্ধকার হয়ে এল যে!
দেখতে দেখতে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল।
পাদ্রীবাবা ব্যস্ত হয়ে বললেন, মাটি তোলো, আর দেরি নয়। এখুনি ঝড় উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দেবে।
তখনই একসঙ্গে কোদাল, শাবল, গাঁইতি কবরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। দশ মিনিটের মধ্যেই শাবলের ঘা লাগল কফিনের গায়ে। আর তখনই উঠল ঝড়। চারিদিক ধুলোয় ধুলো।
তোলো কফিন! কুইক!
কফিন তোলা হল।
ভাঙো। যিশুর পবিত্র ক্রস হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশে করলেন পাদ্রীবাবা।
পুরোনো জীর্ণ উইধরা কফিনের ডানা গাঁইতির এক চাপে ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়ল সবাই।
একটা গোটা কংকাল শুয়ে আছে কফিনের মধ্যে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোথাও এতটুকু ধুলোমাটি নেই। মনে হল কেউ যেন কংকালটা ধুয়ে মুছে রেখে গিয়েছে।
চোয়ারম্যানবাবু খুব উঁচু থেকে নাকে রুমাল চেপে কফিনের দিকে তাকিয়ে ওরে বাবা! ও যে আস্ত কংকাল! বলে দশ পা পিছিয়ে গেলেন।
কফিনটা ওপরে তোলা হয়েছে। হঠাৎ পাদ্রীবাবু ঝুঁকে পড়লেন কংকালের ওপরে।
কংকালের পাঁজরের মধ্যে ওটা কী পাদ্রীবাবা?
সবাই দেখল সমুদ্রের বড়ো কঁকড়ার মতো কালো একটা কী পাঁজরের মধ্যে যেন বাসা বেঁধেছে।
পাদ্রীবাবা বললেন, বলা যায়, এটাই ভ্যাম্পায়ারের হার্ট। দাঁড়ান ওটা খুঁচিয়ে ভেঙে দিই।
বলে যে মুহূর্তে পাদ্রীবাবা একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন তখনি কংকালটা লাফিয়ে উঠে দুহাত বাড়িয়ে তার গলা টিপতে গেল। বিচক্ষণ পাদ্রীবাবা যেন বুঝতে পেরেছিলেন এরকম কিছু ঘটতে পারে। তিনি তার ব্যাগ থেকে একটা হাতুড়ি বের করে অব্যর্থ লক্ষ্যে ঘা মারলেন কংকালের খুলিতে। খুলি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। কংকালটা লুটিয়ে পড়ল কফিনে। আরশোলার মতো অনেকগুলো পোকা খুলি থেকে বেরিয়ে কফিনের মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগল।
যাক শান্তি! দুহাত তুলে বলে উঠলেন পাদ্রীবাবা।
তারপর চেয়ারম্যানের দিকে ফিরে বললেন, চেয়ারম্যানবাবু, আমার কাজ শেষ। এবার আপনার কাজ করুন।
চেয়ারম্যান সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! আর একটু হলেই তো আপনি মরেছিলেন। চোখের সামনে দেখলাম অত বড়ো গোটা কংকালটা লাফিয়ে উঠে আপনাকে মারতে গেল!
যাক মারতে তো পারেনি। এখন কফিনসুদ্ধ কংকালটা নিয়ে গিয়ে পোড়াবার ব্যবস্থা করুন।
তা করছি। কিন্তু আপনি?
আপনারা যান। আমি সামান্য একটু কাজ সেরে যাচ্ছি।
বলে তিনি আমাকে নিয়ে শূন্য কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু অজানা গাছের শুকনো লাল পাতা আর কিছু শুকনো লতাপাতা বের করে কবরের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।
তারপর নকুলকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠলাম। তখন ঝড় থেমে গেছে। প্রকৃতি শান্ত।
[শারদীয়া ১৪১৪]
অলৌকিক ক্যালেন্ডার
লোকটিকে প্রথম থেকেই আমার বেশ মজার লেগেছিল। কুচকুচে কালো রঙ। একমাথা রুক্ষু চুল। লম্বা নাক। চোখ দুটো জ্বলজ্বলে। পাতলার ওপর গড়ন। দেখলে মনে হয় গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু আলাপ হয়ে গেলে বেশ সহজ মানুষ বলেই মনে হয়।
এই মানুষটির সঙ্গে কিন্তু যে অবস্থায় আলাপ হয়েছিল তা বেশ সুখকর ছিল না।
সেবার পুজোর ছুটিতে দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে গিয়েছিলাম। রামেশ্বরম, মহীশূর, কন্যাকুমারিকা দেখে শেষে তিরুপতি দর্শনে এসেছিলাম। বেশ উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি হয়েছে। সেই আঁকাবাঁকা পথে বাসে করে পাহাড়ে উঠতে হয়। পাহাড়ের ওপর উঠেই অবাক! রীতিমতো শহর। যাই হোক এখান থেকে কিছুদূর হাঁটলে বা রিকশায় গেলে তিরুপতির মন্দির।
বেজায় ভিড়। দর্শনপ্রার্থীদের লম্বা লাইন। পুজো দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল। তারপর জায়গাটা ভালো করে দেখতে লাগলাম। পশ্চিম বাংলা থেকে এত দূর আসা তো আর বার বার হয় না। হয়তো এই প্রথম–এই শেষ।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যে হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি নামার জন্যে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। কিন্তু হায়! লাস্ট বাস পাহাড় থেকে নেমে গিয়েছে। আজ আর নিচে নামার উপায় নেই।
মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। কী করব এখন? এদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। কিন্তু ওদিকে–অর্থাৎ পাহাড়ের দিকে জমাট অন্ধকার। ঐ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ নেমে গিয়েছে। দুপাশে পাহাড়ী জঙ্গল। দেখলেও ভয় করে।
তাহলে? বললাম বটে জায়গাটা শহরের মতো, কিন্তু গেরস্তবাড়ি বিশেষ নেই। দোকানপাট, ব্যাঙ্ক, পোস্টাপিস এই সবই বেশি।
গেরস্ত লোক যদি বা থাকে তাহলেও কি এই অজানা অচেনা একজন বাঙালিকে কেউ আশ্রয় দেবে?
কী করব ভাবছি। এই সময়ে ঐ মানুষটির আবির্ভাব। ও যেন দেখেই আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছে। হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, বাস ফেল করেছেন?
এই রকম একটা জায়গায় ঐ রকম চেহারার মানুষের কাছে বাংলা কথা শুনব আশা করিনি। বিনীতভাবে বললাম, হ্যাঁ। লাস্ট বাস কখন জানতাম না।
–তা হলে এখন কি করবেন ভাবছেন?
–কিছুই তো ভেবে পাচ্ছি না।
লোকটি হাসল।–তবে চলে আসুন এই গরিবের কুটিরে।
তাই যেতে হলো।
কুটিরই বটে! চারিদিকে পাহাড় আর জঙ্গল। তারই মধ্যে পাথর দিয়ে ঘেরা ঘরের মতো। মাথা গোঁজার আস্তানা। ভেতরে পিলসুজের ওপর মস্ত এক পেতলের প্রদীপ জ্বলছে। তারই ঘোলাটে আলোয় গুহাটা দেখলাম। একপাশে একটা খাঁটিয়া। একটা কম্বল আর তেলচিটে বালিশ। একটা দড়ি টাঙানো। তাতে গোটা দুয়েক ময়লা প্যান্ট–একটা ছেঁড়া তোয়ালে।
গুহার ওদিকে একটা কালো পর্দা টাঙানো–যেন থিয়েটারের স্টেজের স্ক্রিন।
লোকটি বলল, তিরুপতি তো দর্শন করলেন। আমার ঠাকুর দেখবেন না?
বলে পর্দাটা সরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে যা দেখলাম তাতে আমার গা শিউরে উঠল। ফুল-পাতা ভরা একটা পুরনো কাঠের গামলার মধ্যে একটা মড়ার খুলি বসানো। খুলিটা সিঁদুরে সিঁদুরে লাল হয়ে গেছে।
এই রকম সিঁদুরমাখা খুলি আমি সাধুসন্ন্যাসীদের কাছে অনেক দেখেছি। এর জন্যে গা শিউরে ওঠেনি। শিউরে উঠেছিল অত বড়ো খুলি কখনো দেখিনি বলে।
এ কি মানুষের খুলি?
লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।
–কি ভাবছেন?
–এত বড়ো খুলি কোথায় পেলেন? এ কি মানুষের?
লোকটি আবার হাসল। বলল, দানিকেন পড়েছেন তো? সেই অতিমানবের কথা?
আশ্চর্য হলাম। এ লোকটা দানিকেনও পড়েছে।
মুখে বললাম, হ্যাঁ, ওঁর সব কখানা বইই আমার পড়া।
লোকটি বলল, আমিও ওঁর মতে বিশ্বাসী। তা ছাড়া এই খুলিটাই তো একটা মস্ত প্রমাণ। নয় কি?
–এটা পেলেন কোথায়?
এবারও এ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে বলল, তবে দানিকেনের চেয়ে আমি আরো কিছু গভীর তত্ত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছি। বলে মৃদু হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। আমিও আর কৌতূহল দেখালাম না।
সেদিন পাহাড়ের গুহায় কলা, চিড়ে আর দুধ খেয়ে খাঁটিয়ায় শুয়ে রাত্রিবাস হলো। বেশ ভালো করেই আলাপ জমল। লোকটির নাম কেশব রাও। জন্ম অনন্তপুর জেলায় পেনুকোণ্ডা শহরের কাছে। দীর্ঘকাল দেশ ছাড়া। এখন বাস তিরুপতির এই পাহাড়ে। লোকটির বিষয়ে আমি প্রথমে বলেছিলাম বেশ মজার লোক কিন্তু পরে মনে হয়েছে লোকটা বোধহয় একটু বিশেষ ধরনের পাগল।
প্রায় সারা রাত ধরে সে এমন সব কথা শোনালো যা পাগলামো ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
সে বললে, দানিকেনের মতে বহু সহস্র বছর আগে ভিন গ্রহ থেকে যে অতিমানবেরা পৃথিবী প্রায় আবিষ্কার করেছিল, এক সময়ে তারা আবার তাদের নিজেদের গ্রহেই ফিরে গিয়েছিল। এটা আমার মতে অ্যাবসার্ড–অসম্ভব।
কেশব রাও একটু হাসল। তারপর বলল, আমি মনে করি তারা কেউ ফিরে যায়নি। পৃথিবীতেই ছিল–পৃথিবীতেই আছে যে কোনো আকার নিয়ে।
তারপর ও বলল, তার এখন অনেক কাজ। সারা পৃথিবী ঘুরতে হবে। এইরকম খুলি আর কোথায় পাওয়া যায় দেখতে হবে।
একটু থেমে বলল, শুধু খুলি বা কঙ্কাল নয়। আমি বিশ্বাস করি তাদের আত্মাও এখনো বিশেষ বিশেষ জায়গায় আছে।
আমি আবার শিউরে উঠলাম।
এরপর সে যেন নিজের মনেই বলল–সবচেয়ে আগে যাওয়া দরকার ইস্ট ইউরোপে। কার্পাথিয়ান রেঞ্জ ট্রানসিলভেনিয়া–মোন্ডাভিয়াবুরো ভিনা—-বিসট্রিজ
এ সব কথা শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগছিল না। তবু কিছু বলা উচিত মনে করেই বললাম–জায়গাগুলোর নামও তো শুনিনি।
কেশব রাও সরু করে হেসে বলল, ড্রাকুলা পড়েননি? ব্রাম স্ট্রোকারের ড্রাকুলা? সেই যে রক্তপায়ী পিশাচ যারা কত কাল ধরে–অ-মৃত অবস্থায় কবরে থাকে। কিন্তু রাত হলেই মানুষ-শিকারে বেরোয়।
আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। কিন্তু সে তো গল্প।
–গল্প! কেশবের চোখ দুটো গোল গোল দেখালো।–আমি যদি তার প্রমাণ দেখাতে পারি?
সর্বনাশ! বললাম, না-না, প্রমাণে দরকার নেই।
–সেসব জায়গায় আমায় যেতে হবে। কিছু যে একটা আছে তা খুঁজে বের করতে হবে।
আমি নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কোনো কৌতূহল প্রকাশ করলাম না।
এইভাবে সেই পাথরের গুহায় রাত কাটল। আমি খাঁটিয়ায় আর কেশব মাটিতে একটা বহু পুরনো বাঘছাল পেতে শুয়ে রইল।
সত্যি কথা বলতে কি সারা রাত বেশ ভয়ে ভয়েই কেটেছে। ভয়টা কেশবকে না তার ঐ অদ্ভুত ঠাকুরটিকে না অন্য কিছুতে বুঝতে পারিনি।
ভোর হলে প্রথম বাসটাই ধরার জন্যে যখন বিদায় নিচ্ছি তখন ভদ্রতার খাতিরে কেশবকে বললাম, যদি কখনো কলকাতায় আসেন তো দয়া করে আমার বাড়িতেই আতিথ্য গ্রহণ করবেন।
কেশব তখনই বলল, হ্যাঁ, কলকাতায় একবার আমায় যেতে হবে। বলে ঠিকানাটা দুর্বোধ্য ভাষায় লিখে নিল।
.
অনেক দিন কেটে গিয়েছে, কেশবের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন আমাদের সবার বাড়িতে কেশব এসে হাজির। ওকে দেখে প্রথমটা চিনতেই পারিনি। কি করে চিনব? কুচকুচে কালো রঙ, মুখে চাপ দাড়ি আগে ছিল না–পরনে দিব্যি শাট ও ট্রাউজার–চোখে বিস্কুটে কালো সানগ্লাস। বাঁ হাতে একটা বড়ো পুঁটলি আর ডান হতে সুটকেস। কেশব রাও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাসছে।
যখন ও পরিচয় দিল তখন আমি সত্যিই খুশি হলাম। আমার মনে পড়ল সেই রাত্রে আশ্রয় দেওয়ার কথা। আশ্রয় না পেলে কী হতে বলতে পারি না। সেই আশ্রয়দাতা আজ এসেছে আমার অতিথি হয়ে। এ কী কম সৌভাগ্য!
তা ছাড়া তিরুপতি থেকে ফিরে এসে এই কেশবের কথা বাড়িতে সবার কাছে গল্প করেছিলাম। ভাইপো-ভাইঝিরা তো কেশবের কথা শুনে রোমাঞ্চিত। কবে কেশব আসবে তার জন্যে পথ চেয়ে থাকত। এত দিন পর শেষ পর্যন্ত সে সশরীরে হাজির।
ছেলেমেয়েরা বেশ আগ্রহ করেই ওর সঙ্গে আলাপ করতে এল। কিন্তু কী জানি কেন ওকে দেখে প্রথমেই ছেলেমেয়েরা কেমন ভয় পেয়ে গেল। সে কি ওর কুচকুচে কালো রঙের জন্য না কি ওর বিস্কুটে চশমাটার জন্যে?
যাই হোক দিন দুয়েকের মধ্যেই ছেলেমেয়েরা ওর সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল। ভাবটা ওদের সঙ্গে এমন জমল যে আমাকে যেন আর ওর দরকারই হয় না।
তবু দরকার হতো।
একদিন বলল, কলকাতায় পার্ক স্ট্রীট বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে নাকি খুব পুরনো কালের কবর আছে?
সর্বনাশ! এখানে এসেও যে কবরখানার খোঁজ করে!
মুখে বললাম, হ্যাঁ, তা আছে। তবে খুব আর কি পুরনো? মাত্র শ দু আড়াই বছর আগের।
–তাতেই হবে। আপনি একদিন নিয়ে চলুন।
অগত্যা কেশবকে নিয়ে একদিনযা কখনো করিনি তাই করলাম। কবরখানায় ঢুকলাম। সার্কুলার রোড আর পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে গাছপালায় ঢাকা সেই পুরনো কবরখানা। ঢুকতেই গা ছমছম করে উঠল। কিন্তু কেশবের এসব কিছুই হলো না। সে মহা আনন্দে বাঁধানো কবরগুলো দেখতে লাগল। তারপর একটা খুব পুরনো ভাঙাচোরা কবরের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর ও উবু হয়ে বসল। তারপর তার হাতের লাঠিটা চালিয়ে দিল কবরের মাটির নিচে। এক সময়ে লাঠিটা সরিয়ে নিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল।
আমি তো ভয়ে কাঁটা। সাপে কামড়াবে যে! পাগল আর কাকে বলে?
কিছুক্ষণ কবরের মাটি হাতড়াবার পর ও উঠল। আমার দিকে তাকিয়ে খুশ মেজাজে বলল, ঠিক হ্যায়।
কি ঠিক হ্যায় তা আর জিজ্ঞেস করার প্রবৃত্তি হলো না।
এরপর সে জানতে চাইল পুরনো কবরখানা আর কোথায় আছে। হুগলিতে ডাচেদের সময়ের অনেক কবর আছে শুনে সেখানে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।
এদিকে বাড়িতে যেন কেমন একটু গোলমাল শুরু হয়েছে। ছেলেমেয়েদের তো পড়াশোনা মাথায় উঠেছে। তারা কেশবকে আঙ্কেল বলে ডাকে। আর গল্প শোনে। সবই ভূতের গল্প। কেশব লোকটার এই একটা গুণ–নির্জন পাহাড়ে দেশের লোক হলেও সে বেশ মিশতে পারে। ছেলেদের সঙ্গে এই মেশবার ক্ষমতা কোথা থেকে পেল কে জানে! গুহায় বাস করে এমন শার্ট-প্যান্টই বা পায় কোথা থেকে কে বলবে!
যাই হোক রোজ সন্ধ্যের সময়ে ছেলেমেয়েরা ওকে ঘিরে ধরত।–গল্প বললো আঙ্কেল। ভূতের গল্প। তোমার নিজের চোখে দেখা ভূতের গল্প।
আঙ্কেল অমনি গল্প শুরু করে দিত। এক-একদিন শুনতাম দানিকেন-ড্রাকুলাও এসে পড়েছে। মনে মনে হাসতাম।
কিন্তু নিছক হাসির ব্যাপার যে ছিল না তা সপ্তাহ খানেক পর থেকেই টের পেতে লাগলাম।
আমার ঘুমটা বরাবরই খুব পাতলা। একটু শব্দেই ঘুম ভেঙে যায়।
কদিন থেকেই রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। আর শুতে পাচ্ছি নিচের যে ঘরে কেশব থাকে সেই ঘরে টুন টুন্ করে কিসের যেন শব্দ। ঠিক যেন কে ঘণ্টা নেড়ে পুজো করছে।
একদিন দিদিমাও সেই শব্দ শুনলেন। পরের দিন সকালে বললেন, তোর ঐ কেশবের ঘরে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল কে?
আমি হেসে উড়িয়ে দিলাম।–ধ্যেৎ, অত রাতে খামকা ঘণ্টা বাজাতে যাবে কে?
উড়িয়ে দিলাম বটে কিন্তু মনে খটকা বিঁধে রইল। কেশবই কি গভীর রাতে পুজো করে? কার পুজো? তবে কি ও ওর ঠাকুর–সেই বিকট খুলিটা এখানে নিয়ে এসেছে।
ভাবতেও গা শিউরে উঠল। কিন্তু এসব কথা কেশবকে জিজ্ঞেস করার উপায় নেই। ও বলবে না। উল্টে চটে যাবে।
সেদিন আর এক কাণ্ড! দুপুরবেলা বাড়িতে কেউ ছিল না। কেশবের ঘরে তালা বন্ধ। ওকে নিয়ে হুগলির একটা গ্রামে গিয়েছিলাম। বলা হয়নি–ইদানিং ও ধরেছিল গ্রাম দেখবে। গ্রাম দেখবে না ছাই! খুঁজবে গ্রামের পুরনো কবরখানা।
যাই হোক, বাড়িতে কেউ নেই। ছেলেমেয়েরাও ইস্কুলে। নিচে নামছিলেন। দিদিমা তো ঘুমোচ্ছেন। কেশবের ঘরের কাছে আসতেই উনি থমকে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট শুনলেন সেই বন্ধ ঘরের মধ্যে খট্ খট্ করে কী যেন চলে বেড়াচ্ছে।
মায়ের মুখে এ কথা শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
আমার স্থির বিশ্বাস হলো কেশব সেই খুলিটা এখানে নিয়ে এসেছে।
পরের দিনই–কেশব যখন স্নান করতে গিয়েছে তখন চুপি চুপি ওর ঘরে ঢুকলাম। আমার সন্দেহ ছিল ওর পুঁটলিটায় কিছু আছে। সেটা খুলে ফেললাম। দেখলাম ভেতরে কালো কাপড়ে জড়ানো কী রয়েছে। আমার হাত কেঁপে উঠল। কোনো রকমে পুঁটলিটা বেঁধে বেরিয়ে এলাম।
তারপর মনে মনে কেবলই চিন্তা করতে লাগলাম লোকটা কবে এখান থেকে যাবে।
আমি ওর চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হলে কী হবে? ছেলেরা ওকে ছাড়তে চায় না। ওরা কেবল জেদ ধরে–আঙ্কেল, সত্যি ভূত বলে কিছু আছে? সত্যি তুমি ভূত দেখেছ? তা হলে আমাদের ভূত দেখাও।
এই ভূত দেখাবার কথা হলেই ওদের আঙ্কেল কিন্তু সত্যি সত্যি চটে যায়। ধমকে উঠে বলে, ছেলেমানুষি নাকি? ভূত দেখাব বললেই দেখানো যায়? নাকি দেখব বললেই দেখা যায়?
কথাটা একটু ধমকানির সুরেই বোধহয় বলেছিল যার জন্যে আমার যে ভাইঝিটি ওকে সবচেয়ে ভালোবাসত সে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল। বলে গেল, আঙ্কেল, তোমার সঙ্গে আড়ি-জন্মের মতো আড়ি। আর কখনো তোমার কাছে গল্প শুনব না।
আচ্ছা জেদী মেয়ে এই রুণা। তারপর কতবার কেশব সাধ্যসাধনা করেছে, ও আর আঙ্কেলের কাছে আসেনি। ভূত দেখতেও চায়নি।
এর কদিন পরেই কেশব হঠাৎ বলল, চললাম।
আঃ! এর চেয়ে সুখবর বুঝি আর কিছু হয় না!
মুখে বললাম, এরই মধ্যে যাবেন কেন?
কেশব বললে, অনেক দিন তো থাকলাম। আর নয়।
–কোথায় যাবেন? ইস্ট ইউরোপ?
না, আগে নেপাল।
কেন হঠাৎ নেপাল যাবেন তা আর জিজ্ঞেস করতে সাহস হলো না।
যাবার দিন বিদায়ের পালা। ছেলেমেয়েদের চোখ ছলছল। রুণাও এসেছে। কেশব ওকেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। তাই একটু আদর করল। ওর চোখেও জল। রুণা কাদো কাঁদো হয়ে বলল, আঙ্কেল, তুমি আবার আসবে তো?
কেশব তার স্বভাব মতো হাসল–আমার ওপর রাগ পড়েছে তো দিদিমণি?
বা, তুমি তো ভূত দেখালে না?
কেশবের মুখটা শুকিয়ে গেল। বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ভূত কি কাউকে দেখানো যায়? এ কি সম্ভব?
আমি রুণাকে একটু বকলাম। রুণা মুখ ভার করে রইল।
–আবার আসবে তো? ছেলেরা জিজ্ঞেস করল।
কেশব কি ভেবে বলল, কথা দিচ্ছি না। তবে আসবার চেষ্টা করব যদি মরে না যাই।
আমার ভাগ্নেটি একটু ভেঁপো। বলে উঠল–তুমি মরে গেছ কিনা জানব কি করে? আমরা তো তোমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকব।
কেশব কী ভাবল। তারপর হঠাৎ ঘরে গিয়ে পুঁটলি খুলে কি একটা গোল করা কাগজ এনে আমার হাতে দিল। সেটা খুলে দেখি একটা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারের ছবিটা অদ্ভুত। ছাপা নয়। কেশবই বোধহয় নিজে হাতে গোটাকতক ছক কেটে ক্যালেন্ডারের সঙ্গে এঁটে রেখেছে।
ক্যালেন্ডারটা হাতে নিয়ে আমি বললাম, এটা নিয়ে কি করব?
ও বলল, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখবেন। যেদিন দেখবেন ক্যালেন্ডারটা উল্টে গেছে সেদিন বুঝবেন আমি আর নেই।
এ আবার কী কথা! অবাক হব, না হাসব, না ভয় পাব বুঝে উঠতে পারলাম না।
.
বছর দুই-তিন কেটে গেছে। কেশবের কথা ভুলেই গেছি। ছেলেমেয়েরাও ইতিমধ্যে বেশ বড় হয়ে গেছে।
সেদিন সন্ধ্যেবেলায় বাইরের ঘরে ওরা পড়াশোনা করছে। আমি একটা ম্যাগাজিন পড়ছি। হঠাৎ মনে হলো কে যেন দরজার সামনে নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে। চমকে তাকিয়ে দেখি–কেশব রাও। দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।
ওকে প্রথমে চিনতে পারিনি। সেই কুচকুচে কালো রঙ আর নেই। কেমন যেন ফ্যাকাশে। মুখটা শুকনো। ঘন কালো দাড়ির বদলে পাতলা পাতলা বিবর্ণ দাড়ি ঝুলছে। চুল এলোমেলো। সবচেয়ে অবাক হলাম–ওর হাতে সুটকেসও নেই–সেই পুঁটলিটাও নেই।
–রাও সাহেব না?
কেশব রাও একটু হেসে আমায় নমস্কার করল।
–আসুন–আসুন। স্বাগতম।
ছেলেমেয়েরাও আনন্দে লাফিয়ে উঠল–আঙ্কেল এসেছে–আঙ্কেল এসেছে
তারপরই ওরা ধরল–আঙ্কেল গল্প–অনেক গল্প
আমি ওদের ধমকে শান্ত করলাম।
–আজ উনি ক্লান্ত। দেখছ না ভালো করে দাঁড়াতেও পারছেন না। আসুন মিস্টার রাও।
যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম–আপনি কি এখন নেপাল থেকেই এলেন?
কেন জানি না রাও তার কোনো উত্তর দিল না।
তারপর কেশবকে সেই ঘরে নিয়ে এলাম। বললাম, খাওয়া-দাওয়া করে আজ বিশ্রাম করুন। কাল সবাই মিলে গল্প শুনব।
কেশব কিন্তু কিছুই খেতে চাইল না। বলল, আমি একটু ঘুমোতে চাই।
আমি ওখানেই ওর শোবার ব্যবস্থা করে দিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে অবাক। কেশব নেই। ঘর খালি। কিরকম হলো? এত সকালে গেল কোথায়?
বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম–যেমন ফর্সা চাদর পেতে দিয়েছিলাম তেমনই আছে। কেউ যে শুয়েছিল তা মনে হয় না। গেলাসে জল দিয়েছিলাম। সেটাও ঠিক তেমনি ঢাকা পড়ে আছে। অর্থাৎ ঘরে যে কেউ ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই।
মনে মনে যেমন অবাক হলাম তেমনি দুঃখও পেলামকেশবের এমনি ভাবে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।
এমনি সময়ে কে যেন এসে আমায় দ্বিগুণ অবাক করে দিয়ে বলল, পালিয়ে যাবে কি বাইরের দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধই রয়েছে।
এইবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে আবার কী?
এ রহস্যের মীমাংসা আমরা কেউ করতে পারলাম না। তবে সেইদিনই খবরের কাগজের এক কোণে একটা ছোট্ট খবর ছিল। পার্ক স্ট্রীটের পুরনো কবরখানায় এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে ছিল একটা পুঁটলি। পুটলির মধ্যে পাওয়া গেছে একটা অস্বাভাবিক মড়ার মাথার খুলি! মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। পুলিশ তদন্ত করছে।
আমার হাত থেকে কাগজটা পড়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটি কেশব রাও ছাড়া আর কেউ নয়। তার বডি পাওয়া গেছে কাল সকালে। তাহলে কাল রাত্তিরে আমার বাড়ি কে এল?
তবে কি ও নেপাল থেকে ফিরে কলকাতাতেই ছিল? তাহলে
কেনই বা শুধু এক রাত্তিরের জন্যে এল? আর–আর তার মৃত্যু হঠাৎ কবরখানাতেই বা হলো কেন?
সবই রহস্যময়। তখনই কী মনে হলো ছুটলাম পাশের ঘরে। দেখি রুণা কখন এ ঘরে এসে ক্যালেন্ডারটার দিকে জলভরা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। ক্যালেন্ডারটা এত দিন পর কে যেন উল্টে দিয়েছে।
» অলৌকিক জল্লাদ ও জীবন্ত কঙ্কাল
রহস্যের সূত্রপাত
খুব বেশি দিন না হলেও দেখতে দেখতে পনেরো বছর হয়ে গেল আমি কলকাতায় পুলিশের কাজ করছি। এই পনেরো বছরে কত চোর-ডাকাত ধরলাম, কত খুনিকে আদালতে পাঠালাম। কত মারামারি কত রক্তপাত! ফলে মনটা যেমন কঠোর তেমনি ভয়শূন্য হয়ে গেছে। সঙ্গে রিভলবারটা থাকলেই হলো।
শুধু চোর-ডাকাত-খুনি নিয়ে কারবার হলে মনে তেমন দাগ কাটত না। ওসব তো প্রায় সব পুলিশ অফিসারদের জীবনেই ঘটে। কিন্তু আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত জীবনে এমন কিছু অবিশ্বাস্য ভয়াবহ অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে যা কোনদিন ভুলতে পারব না। এই ঘটনাগুলো লিখে রাখার জন্যেই আপাতত এক মাসের ছুটি নিয়ে নিরিবিলি দেশের বাড়িতে এসেছি।
জায়গাটা নিরিবিলি। কিন্তু বাড়িটা নিরিবিলি নয়। আমাদের এই দোতলা বাড়িটা খুবই পুরনো। বাড়ির পিছনে অনেকদূর পর্যন্ত আমবাগান আর বাঁশঝাড়। এখনও গভীর রাতে শেয়াল ডাকে, খটাস বনবেড়াল ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। বাড়ির পশ্চিমে একটা পচা পুকুর। তার এদিকে একটা ভাঙা শিবমন্দির। ছোটোবেলায় ঐ পুকুরপাড়ে, আসশ্যাওড়ার ঝোপে কত চোর পুলিশ খেলেছি। তখন কি ভেবেছিলাম বড়ো হয়ে আমাকেই চোর-ডাকাত ধরে বেড়াতে হবে!
বাড়িটার সবচেয়ে আকর্ষণ বিরাট ছাদ। এই ছাদে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি, ছোটাছুটি দাপাদাপি করেছি। আজও এ বাড়ির ছোটো ছেলেমেয়েরা ছাদেই খেলা করে।
এ বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকে আমার মেজো আর ছোটো ভাই তাদের স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের নিয়ে। এখন কলকাতা থেকে আমি এক মাসের জন্যে এসেছি স্ত্রী আর বারো বছরের দুষ্টু নোটনকে নিয়ে। আমার ভাগে যে দুখানি ঘর তা উত্তর দিকে। একখানি ঘর আমার একেবারে নিজস্ব। ঐ ঘরে বসে আমি দেশ-বিদেশের যত অপরাধ কাহিনি পড়ি। আর এখন এই ঘরে বসেই লিখছি আমার জীবনে ঘটে-যাওয়া বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা।
আমার ঘরের জানলা দিয়ে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে আমাদের উঠোনের ওপর নারকেল গাছটা। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি গাছটাকে। এখনও দিব্যি আছে। নারকেল গাছটা যেন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। গাছটাকে আমরা সবাই ভালবাসি। তারপরেই চোখে পড়ে সেই বিশাল আমবাগান আর বাঁশঝাড়ের জঙ্গল। যতদূর দেখা যায় শুধু গাছের সবুজ মাথা। যখন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসে তখন ঐ বাগান-জঙ্গলকে কেমন রহস্যময় বলে মনে হয়। কেমন ভয় করে। মনে হয় যেন কোনো অজানা আতঙ্ক ওৎ পেতে আছে গাছগুলোর ডালে ডালে।
লেখাটা শুরু করা উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু হঠাৎ নেপালের কাঠমাণ্ডুতে বেড়াতে যাবার সুযোগ এসে গেল। এখন বর্ষাকাল। বর্ষাকালে কেউ বড়ো একটা পাহাড়ে যায় না। কিন্তু আমারই সহকর্মী কলকাতার পুলিশ অফিসার প্রণবেশ যাচ্ছে জেনে আমিও তার সঙ্গ নিলাম। সর্বসাকুল্যে ওখানে আমরা দশ দিন ছিলাম। ওখানে নানা জায়গায় ঘুরেছি। বেশ উপভোগও করেছি। কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তা তো হবেই। পুলিশ আর গোয়েন্দা যেখানেই যায়, তাদের মনোমতো একটা কিছু ঘটে থাকেই। যাই হোক মোটামুটি আনন্দ করে দেশের বাড়িতে ফিরে এসেছি। একটি লাভ হয়েছে। একটি নেপালী ছেলে পেয়েছি। বছর তেরো-চোদ্দ বয়েস। খুব কাজের ছেলে। নাম রাজু সুব্বা। একে পেয়ে আমার স্ত্রী আর নোটন খুব খুশি। রাজু একে নোটনের প্রায় সমবয়সী, তার ওপর বিদেশী। তাই ওর সঙ্গে নোটনের যত ভাব তত কৌতূহল ওর বিষয়ে।
এখন সন্ধেবেলা।
একটু আগেও বৃষ্টি হয়ে গেছে। গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে লিখতে বসেছি। লোডশেডিং বলে লণ্ঠনের আলোয় লিখছি। ভালোই লাগছে। কেননা এই সব খুনখারাপি, অলৌকিক কাহিনি লিখতে গেলে এইরকম লণ্ঠনের টিমটিমে আলোরই প্রয়োজন। পরিবেশটা বেশ জমে। বাড়ির বৌরা নিচে রান্না করছে আর গল্প করছে। আমার ঘরে আমি একা। লিখছি। ফাটা দেওয়ালের গায়ে একটা টিকটিকি অবাক হয়ে আমার লেখার কাজ দেখছে।
হঠাৎ পিছন থেকে নিঃশব্দ পায়ে কেউ এসে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল। মুহূর্তে ঘর অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে একটি বালককণ্ঠের প্রাণখোলা হাসি। বুঝলাম আমার দুষ্টু ছেলে নোটনের কাজ। ভয় দেখাবার জন্যে আলো নিভিয়েছে। কিন্তু–ঘরে আরও যেন কেউ রয়েছে।
অন্ধকারেই হাঁকলাম–কে রে? কে রে?
কোনো উত্তর নেই। নোটনের হাসিও থেমে গেল।
-নোটন, তোর সঙ্গে আর কে আছে রে?
উত্তর নেই।
হঠাৎ নোটন চিৎকার করে কেঁদে উঠল–ও গো মা গো! বাবা গো!
কী হলো! নোটন অমন করে কেঁদে উঠল কেন? পুরনো বাড়ি। কিছু কামড়ালো নাকি?
অন্ধকারেই আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলাম। টেবিলে ধাক্কা লেগে লণ্ঠনটা পড়ে গেল। কেরোসিন তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।
অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আন্দাজে নোটনের কাছে যাবার চেষ্টা করলাম। তার আগেই ওর কান্না শুনে নোটনের মা, ওর কাকা-কাকীমারা আলো নিয়ে ছুটে এসেছে। দেখলাম দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে নোটন তখনও ভয়ে কাঁপছে।
–কি হয়েছে?
প্রথমে উত্তর দিতে পারছিল না। তারপর শুধু বলল–ঘরে কিছু ঢুকেছিল।
–ঘরে কে ঢুকবে? কখন ঢুকবে?
–আমরা ঢোকার পরই
–আমরা?
এতক্ষণে ঘরের মধ্যে দ্বিতীয়জনকে দেখতে পেলাম। সেও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
–কিন্তু ঘরে আর কে ঢুকবে? কাকে দেখে অমন ভয় পেলি?
নোটন বলল–আমি স্পষ্ট দেখেছি দুটো জ্বলজ্বল চোখ দরজার কাছে।
এই অসম্ভব অবাস্তব ব্যাপার নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামালাম না। দোতলার এই ঘরে জ্বলন্ত চোখবিশিষ্ট জন্তু-জানোয়ারের ঢোকা সম্ভব নয়। সদর দরজা সন্ধে হতেই বন্ধ হয়ে যায়।
এবারে রাজু সুব্বার দিকে তাকালাম। সে একে রোগা ডিডিগে, কম কথা বলে, তার ওপর এইরকম কান্নাকাটিতে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। ওর চোখের স্বাভাবিক চাউনিটাও একটু অদ্ভুত রকমের। ছোটো ছোটো সরু চোখ। চোখের মণি দুটো একটু বেশি উপর দিকে ওঠা। ফলে সাদাটাই বেশি দেখা যায়। যেন চোখ উল্টে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি অন্ধ। ওর চোখের দিকে তাকালে বোঝা যাবে না ও রেগে আছে না ভয় পেয়েছে কিংবা খুশি হয়েছে।
রোগা রোগা সরু হাত, দেহের তুলনায় নারকেলের মতো লম্বাটে মাথাটা বেশ বড়। রোয়া রোঁয়া পাতলা চুল। খালি-গা হলে বুকের পাঁজরাগুলো একটা একটা করে গোনা যায়। কণ্ঠের হাড় বেরিয়ে আছে। মনে হয় একটু ঠেলা দিলেই ছিটকে পড়ে যাবে। কিন্তু এই শরীর নিয়েই সে যে কী অসম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
সুব্বা বাংলা বলতে না পারলেও বাংলা মোটামুটি বোঝে। খুব কম কথা বলে। যেটুকু বলে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে। মাঝে মাঝে সে নেপালী ভাষাও বলে ফেলে। যেমন–চাকে বলে চিয়া, কমলালেবুকে বলে সন্তালা।
একটা জিনিস লক্ষ করছি–যদিও আমিই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি তবু ও আমাকে যেন এড়িয়ে চলে। ডাকলে চট করে আসে না। সাড়াও দেয় না। যেন শুনতেই পায়নি। কেন এমন ব্যবহার তা বুঝতে পারি না। তবে নোটনের সঙ্গে ওর খুব ভাব। দুজনে গল্প করে, খেলা করে। নোটনের মাকেও পছন্দ করে। নোটন কখনো ওকে ডাকে রাজু বলে। কখনও ডাকে ওর পদবী ধরে-সুব্বা।
এই কদিনেই আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি–ও আমাকে জব্দ করতে চায়। একটা ঘটনা বলি।–প্রায়ই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়। তার জন্যে সবসময়ে কাছে ওষুধে রেখে দিই। যন্ত্রণাটা এবার অনেক দিন হয়নি। কিন্তু নেপাল থেকে ফিরে এসে উপরি উপরি তিন দিন যন্ত্রণা হলো। প্রথম দুদিন ওষুধ খাবার জন্যে সুব্বাকে জল দিতে বলেছিলাম। বেশ দেরি করে জল এনে দিয়েছিল। ওর সামনেই ওষুধ খেয়েছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিন ও জল এনে দিল না। ধমক দিলেও এমন ভান করল যেন ও আমার কথা শুনতেই পায়নি। কিন্তু আশ্চর্য ওষুধের প্যাকেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না। ওষুধ খাওয়া হলো না। সারারাত্রি যন্ত্রণায় ছটফট করলাম। পরের দিন দেখলাম ওষুধের প্যাকেটটা পিছনের জঙ্গলে পড়ে আছে। কেউ জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সবাইকে ডেকে দেখালাম। কিন্তু কে ফেলেছে কেউ বলতে পারল না। নোটন আড়ালে সুব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল। সুব্বা উত্তরে মাথা নেড়ে বলেছিল– নেহি। তবুও বোঝা গেল ওষুধটা ও-ই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু কেন? ও তো নিতান্ত ছোটো শিশুটি নয়।
আরও আশ্চর্যের কথা–পরে জেনেছিলাম সেদিন সুব্বাই চুপি চুপি একা ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিল। নোটন যে ওকে চুপি চুপি ঘরে ঢুকতে দেখে কৌতূহলের বশেই ঘরে ঢুকেছিল, সুব্বা তা টের পায়নি। ঘর অন্ধকার করে সুব্বা আমাকে ভয় দেখাতে যাচ্ছে ভেবে নোটন জোরে হেসে উঠেছিল।
কিন্তু যে ছেলেটা আমার কথা শুনতে চায় না, ডাকলে সাড়া দেয় না, কাছে ঘেঁষে না, সে কেন ঘর অন্ধকার করে আমার সঙ্গে মজা করতে এল?
এ কথা নিয়ে বাড়িতে কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি। নিজের কাছেও সদুত্তর পাইনি।
এ ছাড়া অন্ধকার ঘরে কেন কি দেখে নোটন অমন ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল তাও ঠিক আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। সত্যিই ও ঘরের মধ্যে জ্বলন্ত চোখ দেখেছিল কিনা, কিংবা কার চোখ তাও অমীমাংসিত থেকে গেছে।
.
ভয়ংকর ঘণ্টাকর্ণ
সুব্বাকে পাবার পিছনে একটা বিশেষ ঘটনা আছে।
নেপালের কাঠমাণ্ডুতে যে হোটেলে প্রণবেশ আর আমি উঠেছিলাম, সে হোটেলটি একেবারে শহরের মধ্যে। হোটেলে বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী ছোকরা কাজ করত। আমাদের যে দেখাশোনা করত সে নেপালী হলেও বাংলা বুঝত আর মোটামুটি বলতেও পারত। সে বলত–এখানে বাঙালিবাবুরাই বেশি বেড়াতে আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাংলা শিখে গেছি।
ওর নাম জং বাহাদুর। ও বাংলা জানায় খুব সহজেই ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিলাম। শুনে কষ্ট হলো ওদের মতো যারা হোটেলে কাজ করে তারা খুবই গরিব। তাই অল্পবয়সী ছেলেরাও কাজের খোঁজে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। শিলিগুড়ি, কলকাতাই তাদের লক্ষ্য।
আমার তখনই মনে হলো কলকাতায় আমার বাসার জন্যে ঐরকম একটা কাজের ছেলের দরকার। কলকাতায় তো চট করে কাজের ছেলে পাওয়া যায় না। তাই জং বাহাদুরকে বলেছিলাম–তোমার মতো একটা ছেলে পেলে আমিও নিয়ে যাই।
জং বাহাদুর বলেছিল–দেখব।
তারপর ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–কাঠমাণ্ডুতে দেখবার কী কী আছে?
ও এক নিশ্বাসে অনেকগুলো জায়গার নাম করে গেল বুড়ো নীলকণ্ঠ, স্বয়ম্ভু মন্দির, দক্ষিণাকালী বাড়ি, গুর্জেশ্বরী মন্দির, দেবী কুমারী বা জীবন্ত দেবী আর পশুপতিনাথ তো আছেনই।
জিজ্ঞেস করেছিলাম–এখানে উৎসব কী কী হয়?
ও চটপট উত্তর দিয়েছিল ত্রিবেণী মেলা, শ্রীপঞ্চমী, মাঘী পূর্ণিমা, মহাশিবরাত্রি, হোলি, নববর্ষ
বাধা দিয়ে বলেছিলাম–তা তো বুঝলাম। কিন্তু এখন কোনো উৎসব হয় কি?
–হয় বৈকি। খুব উৎসাহের সঙ্গে ও উত্তর দিয়েছিল–নাগপঞ্চমী, ঘণ্টাকর্ণ। জিজ্ঞেস করেছিলাম–ঘণ্টাকর্ণ কি?
ও হঠাৎ চোখ বুঝিয়ে দু হাত জোড় করে কারও উদ্দেশে যেন নমস্কার করল। তার। পর যা বলল তার মানে হলো–ঐ পুজোটা হচ্ছে দানব আর অশুভ আত্মাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে। এই জুলাই-আগস্ট মাসে নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে অশুভ শক্তিরা ঘুরে বেড়ায় দানবের মূর্তি ধরে। তাদের সামনে পড়লে মানুষ, জীবজন্তু কারো রক্ষা নেই। তাদের আটকাবার ক্ষমতাও কারো নেই। তাই সেই দানব-দেবতাদের পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করে সসম্মানে বিদেয় করার চেষ্টা। এই জন্যেই ঘণ্টাকর্ণ পুজো।
এইসব অশুভ আত্মা, দানব-দেবতার কথা শুনে ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখবার খুব ইচ্ছে হলো আমাদের। ওকে বলাতে ও খুব উৎসাহ করে কোথা দিয়ে কেমন করে যেতে হবে তার হদিস বলে দিল। শেষে গলার স্বর নিচু করে বললে,–এখানে যাবেন যান। কিন্তু কেউ বললেও যেন দক্ষিণের ঐ উঁচু পাহাড়টার নিচে যাবেন না।
জিজ্ঞেস করলাম–কেন? ওখানে কী আছে?
ও একটু চুপ করে থেকে বললে, ঐ পাহাড়ের নিচে একটা নদী আছে। সেই নদীর ধারে একটা গুহায় ঘণ্টাকর্ণের এক ভয়ংকর মূর্তি আছে। ওখানেও ঘণ্টাকর্ণের পুজো হয়। কিন্তু সে পুজো খুব গোপন। বাইরের লোক তো দূরের কথা–সব নেপালীরাও ওখানে যেতে পারে না। গেলে আর তাদের ফেরা হয় না।
প্রণবেশ ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে বললে যে, আমাদের দেশে যেমন নির্জন জায়গায় তান্ত্রিক, কাঁপালিকরা গোপনে কালীপুজো করে, এও সেইরকম। তান্ত্রিক, কাঁপালিকরা যেমন ভয়ংকর প্রকৃতির লোক হয়, এরাও সম্ভবত সেইরকম।
যাই হোক দিন তিনেক পরে জং বাহাদুরই একটা জিপের ব্যবস্থা করে দিল। ড্রাইভার আমাদের কাছাকাছি দুতিন জায়গায় ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখিয়ে আনবে।
বেঁটেখাটো ফর্সা ধবধবে নেপালি ড্রাইভার। ঠিক যেন একটা মেশিন। চমৎকার ড্রাইভ করে নিয়ে গেল পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে।
দুজায়গায় ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখলাম। পাহাড়ের নিচে খানিকটা সমতল জায়গায় বেশ লোকের ভিড়। সেখানে মাদলের মতো একরকম বাজনা বাজছে দ্রিম দ্রিম করে। সারা গায়ে কালো কাপড় জড়িয়ে মুখে ভয়ংকর একটা মুখোশ এঁটে একটা মূর্তি তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে। আর একজন পুরোহিতের মতো লোক ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাকে মারছে। জানলাম এইরকম করেই নাকি পুজোর মধ্যে দিয়ে অশুভ শক্তির দানবকে তাড়ানো হয়। ঘণ্টাকর্ণের নকল ভয়ংকর মূর্তি ছাড়া আর কিছুই তেমন মনে দাগ কাটল না।
এবার আমাদের হঠাৎ ইচ্ছে করল সেই পাহাড়ের নিচে নিষিদ্ধ পুজোটা দেখার। কিন্তু ড্রাইভার রাজি হলো না। ওখানকার কথা তুলতেই ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। ওকে আমরা অনেক করে বোঝালাম যে, কোনোরকম ভয় নেই। ভূত, প্রেত, দানব, অশুভ শক্তি যাই থাকুক না কেন, এই রিভলভারের কাছে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে কোটের পকেট থেকে রিভলভার বের করে দেখালাম। তাছাড়া আমরা যে দুজনেই কলকাতার পুলিশের অফিসার তাও জানিয়ে দিলাম।
তাতেও ও যখন ইতস্তত করছিল তখন একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ওর কোটের পকেটের মধ্যে খুঁজে দিলাম। আমাদের পঞ্চাশ টাকা মানে নেপালের পঁচাশি টাকা। এবার কাজ হলো। গরিব মানুষ ওরা। টাকা পেলে যমের দুয়োর পর্যন্ত যেতে পারে।
অগত্যা বিমর্ষ মনে ও গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়িতে একটা কালীঠাকুরের ছবি ছিল। ড্রাইভার সেই ছবিতে বার বার মাথা ঠেকাল। তারপর গাড়ি চালাতে লাগল।
চারিদিকে জঙ্গলভরা পাহাড়। তারই মধ্যে দিয়ে খুব সাবধানে জিপটা চালিয়ে নিয়ে চলল ড্রাইভার। কখনো অনেক উঁচুতে উঠছে, কখনও নিচে নামছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবার পর আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। ডান দিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মতোই সবুজ ধানক্ষেত। বাঁ দিকে যে সরু নদীটা ঝির ঝির করে বয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভারের কাছ থেকে নাম জেনে নিলাম–বিষ্ণুমতী নদী। ড্রাইভার সেই নদীর উদ্দেশে নমস্কার করল।
আবার সামনে পাহাড়। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাইন গাছে ঢাকা।
হঠাৎ ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষল। আমরা ঝকানি খেয়ে চমকে উঠলাম।
কি হলো?
অমন শক্তসমর্থ ড্রাইভার ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–বিল্লি!
বিল্লি! বেড়াল! তা একটা বেড়াল দেখে এত ভয় পাবার কী আছে?
দেখলাম বনবেড়ালের মতো মস্ত একটা কালো বেড়াল পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে জিপের দিকে তাকিয়ে আছে।
মনে পড়ল এ দেশের সংস্কারের কথা। নেপালে কোথাও বেড়াল দেখা যায় না। এ দেশে কেউ বেড়াল পছন্দ করে না। তাদের মতে বেড়ালের চেয়ে কুকুর ভালো। বেড়াল কোনো উপকার করে না। বরঞ্চ ক্ষতি করে। সিদ্ধিদাতা গণেশের বাহন যে ছুছন্দ্ৰ (ইঁদুর), তাদের বেড়াল হত্যা করে। কাজেই বেড়াল গৃহস্থের অকল্যাণ করে। আর যদি কালো বেড়াল হয় তাহলে রক্ষে নেই। কেননা, এদের বিশ্বাস, কালো বেড়াল অশুভ আত্মার ছদ্মরূপ।
যাই হোক প্রণবেশ গাড়ি থেকে নেমে বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দিল। বেড়ালটা ফাঁস করে কামড়াতে এসেছিল কিন্তু দ্বিতীয় বার তাড়া খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
অনিচ্ছুক ড্রাইভার আবার গাড়ি চালাতে লাগল।
গাড়ি চলেছে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপর ঘুরে ঘুরে। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি নামতে লাগল। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে পথ। খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। পাশেই গর্ত। স্টিয়ারিং একটু এদিক-ওদিক হলেই আর রক্ষে নেই। গাড়িটা ডান দিকের আরও সরু পথ ধরে চলল। পাহাড়ের গায়ে অজস্র সল্ট, চিলোনী, মহুয়া আর বাজ গাছের জটলা।
প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবার পর এক জায়গায় সরু রাস্তাটা তিন দিকে চলে গেছে। হঠাৎ ড্রাইভার সেখানে ব্রেক কষল। আমরা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দেখি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার প্রণাম করছে।
কাকে প্রণাম করছে?
মুখ বাড়িয়ে দেখি ঠিক মোড়ের মাথায় একটা মস্তবড়ো খুঁটের ওপর লাল এক টুকরো ন্যাকড়া, ওদেশের একরকম হলদে রঙের জায়ে আর জবার মতো লাল লালি গোলাপ ফুল, সরু সরু ডালসুষ্ঠু পাতা। ড্রাইভার সেইগুলোর উদ্দেশেই প্রণাম করছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে যেটুকু বুঝতে পারা গেল তা হচ্ছে এগুলো আমাদের দেশে তুক করার মতো। আজকাল অবশ্য তুকতাক বড়ো একটা দেখা যায় না। কিন্তু ছোটোবেলায় আমরা গ্রামে দেখেছি। রাস্তার মোড়ে এইরকম মন্ত্রপূত তুক সাজিয়ে রেখে দিত এক শ্রেণীর হিংস্র স্বভাবের মানুষ লোকের চরম ক্ষতি করার জন্যে। এই তুক মাড়ালে সর্বনাশ হয়। এও সেইরকমের তুক। ড্রাইভার জানাল এই তুক করেছে ভয়ংকর স্বভাবের তান্ত্রিক যে এই বিশেষ ঘণ্টাকর্ণ পুজো করে। রাস্তার মোড়ে তুক সাজিয়ে রেখে লোককে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে–কেউ যদি ভুল করেও এতদূর এসে পড়ে, তারা যেন আর না এগোয়।
কাজেই আমাদের ড্রাইভার আর এগোতে নারাজ। অগত্যা আমরা নেমে পড়লাম। জেনে নিলাম এই পাহাড়টা থেকে এক কিলোমিটার নেমে গেলেই বিষ্ণুমতী নদী। সেই নদীর তীরেই
ড্রাইভার আর কিছু বলতে চাইল না। আমরা নামতেই ও গাড়ি ঘুরিয়ে নিল যাতে দরকার হলেই স্টার্ট নিতে পারে। এমনও বিপদ হতে পারে যখন গাড়ি ঘোরাবার আর সময় থাকবে না। শুধু তাই নয়, গাড়িটা রাখল আরও এগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে। আমাদের পরিষ্কার বলে দিল বেশি দেরি হলে সে এখানে গাড়ি নিয়ে থাকবে না। কেননা বেশি দেরি হলে বুঝে নেবে আমরা আর বেঁচে নেই। নিষিদ্ধ পুজো দেখতে যাওয়ার শাস্তি মৃত্যু।
কথাটা শুনে আমাদের গা শিউরে উঠল। সত্যিই কি সব জেনেশুনে আমরা মৃত্যুর মুখে এগিয়ে চলেছি?
যাই হোক পকেটের ভেতর থেকে রিভলভারটা বের করে, মুঠোর মধ্যে ধরে আমরা নামতে লাগলাম।
ঢাল পথে আমরা হুড়মুড় করে নেমে চললাম। নিস্তব্ধ পাহাড়ে পথ। দুপাশে যেন পাথরের আকাশচুম্বী খাড়া প্রাচীর। এখানে মরে পড়ে থাকলে কাক-পক্ষীতেও টের পাবে না।
প্রায় দশ মিনিট ধরে নামার পর আমরা নিচে বিষ্ণুমতী নদী দেখতে পেলাম। তবে তো আমরা এসে পড়েছি।
পাহাড়ী নদী। জল কম। শীর্ণ। নদীর বুকে ছোটো-বড়ো নানারকমের নুড়ি।
হঠাৎ প্রণবেশ আমার হাতটা চেপে ধরল।
–কি হলো?
–ওগুলো কি? বলে প্রণবেশ নদীর ওপারে আঙুল তুলে দেখাল।
যা দেখলাম। মাথার চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠল। গোটা পনেরো মাথার খুলি ছড়িয়ে রয়েছে নদীর ওপরে। মাথার খুলিগুলো আকারে ছোটো।
আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। এত মড়ার মাথার খুলি এল কোথা থেকে?
আমরা আরও একটু নামলাম। দশ হাত নিচেই নদী। ওপরে পাহাড়টা আলসের মতো ঝুঁকে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মস্ত একটা গুহার মুখ!..ঐ যে কয়েকজন লোক..কী ভয়ংকর সব চেহারা! কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। অথচ ব্যস্ত। সবার গলায় ছোটো ছোটো পাতার মালা।
হঠাৎ দেখি দুজন লোক একটা ছেলেকে ধরে নদীর দিকে আসছে। হৃষ্টপুষ্ট ছেলেটি। ফর্সা রঙ। সুন্দর দেখতে। বয়েস বছর দশেক। খালি গা। শীতে কাঁপছে। গলায় লাল ফুলের মালা ছেলেটির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে।
–কি ব্যাপার? প্রণবেশকে ফিফিস্ করে জিজ্ঞেস করলাম।
–স্নান করাতে নিয়ে আসছে।
–ধরে নিয়ে আসছে কেন? গলায় মালা কেন?
প্রণবেশ ম্লান হাসল। বলল বুঝতে পারছ না?
এবার আর বুঝতে বাকি রইল না। ঘণ্টাকর্ণ পুজোয় ছেলেটাকে বলি দেবে। বলি এই প্রথম নয়। ঐ যে ছোটো খুলিগুলো দেখলাম, ওগুলোও হতভাগ্য ছেলেদের।
মুহূর্তেই কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। বড়ো পাথরের আড়ালে আমরা শিকারী কুকুরের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। দুজনের হাতে মুঠোয় শক্ত করে ধরা রিভলভার।
ওরা যখন ছেলেটাকে স্নান করিয়ে ফিরছে, আমরাও তখন সাবধানে হেঁটে হেঁটে নদী পার হলাম। এখনও পর্যন্ত ওরা আমাদের দেখতে পায়নি।
আমরা যথেষ্ট তফাৎ রেখে এগোচ্ছি। একটু দূরে গিয়ে ওরা থামল। এটা সেই ঝুলে পড়া পাহাড়ের মুখ। দেখলাম পাহাড়ের গুহায় অন্ধকারে পাথরের মস্ত একটা পিদিম জ্বলছে। ভেতরে বোধ হয় ঘণ্টাকর্ণের মূর্তি। মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সামনে পুজোর আয়োজন। একজন মোটাসোটা লোক পুজো করছে। গায়ে লাল চেলি। গলায় লাল ফুলের মালা। সামনে–ঐ যে হাঁড়িকাঠ। আর ওটা কী? একটা বেঁটেখাটো মানুষের কংকাল ঝুলছে গুহাটার বাঁ দিকে। বাতাসে কংকালটা দুলছে। এইরকম একটা কংকাল প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখার কারণ কী বুঝতে পারলাম না।
প্রায় দশ মিনিট পর লোকটা পুজোর আসন থেকে উঠল। এবার লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। জীবনে কখনো তান্ত্রিক বা কাঁপালিক দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। বড়ো বড়ো হিংস্র ভয়ংকর চোখ। কপালে সিঁদুর ল্যাপা। পেশিবহুল হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।
লোকটি এগিয়ে আসতেই আরও যে চার-পাঁচজন বসেছিল তারা উঠে দাঁড়াল। তান্ত্রিক বলিদানের নির্দেশ দিল।
এবার ছেলেটাকে ধরে আনা হলো। পাছে চেঁচায় তাই মুখটা কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা।
প্রণবেশ অধৈর্য হয়ে চাপা গলায় বলল, আর দেরি নয়। অ্যাকশান।
আমি বাধা দিয়ে বললাম, আর একটু দেখি। হ্যাঁ, শোনো তুমি আটকাবে তান্ত্রিকটাকে। আর আমি সামলাব ঐ পাঁচজনকে।
হাঁড়কাঠে ছেলেটার মাথা আটকে দেওয়া হলো। এবার স্বয়ং তান্ত্রিক বিরাট একটা খাঁড়া হাতে নিয়ে এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের আড়াল থেকে আমরা দুজনে দুদিকে রিভলভার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
প্রণবেশ একেবারে তান্ত্রিকটার মুখোমুখি। আমি একা বাকি পাঁচজনের সামনে রিভলভার ঘোরাতে লাগলাম।
এই অকস্মাৎ আক্রমণে ওরা প্রথমে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল। তার পরেই ওরা আমার দিকে তেড়ে এল। আমি একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলাম। পাহাড় কাঁপিয়ে গুলির শব্দটা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল। ওরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। তারপর প্রায় পাঁচ মিনিট ওরা আর এগোচ্ছে না। মাথার ওপর গাছের ডালে একটা মস্ত কাক কাঁক কাঁক করে ডেকে উঠল। কাক যে এত বড়ো হয় তা জানা ছিল না। বোধ হয় পাহাড়ী কাক বলেই এত বড়ো।
চকিতে প্রণবেশের দিকে তাকালাম। তান্ত্রিক আর প্রণবেশ পাঁচ হাতের ব্যবধানে মুখোমুখি নিশ্চল দাঁড়িয়ে। তান্ত্রিকের হাতে খাড়া। কিন্তু–এ কী! প্রণবেশ নেতিয়ে পড়ছে কেন? দেখি তান্ত্রিক ভয়ংকর দৃষ্টিতে প্রণবেশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। বুঝলাম তান্ত্রিক হিপনোটাইজ করছে। আর প্রণবেশের হাত থেকে রিভলভার খসে পড়ছে।
তখনই আমি বাঁ হাতের রিভলভারটা অন্যদিকে তাক করে প্রণবেশকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিলাম। ওর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিলাম। এখন আমি একা। শুধু দু হাতে দুটো রিভলভার। প্রণবেশ হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে মাটিতে বসে পড়েছে। তান্ত্রিক সেই একইভাবে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু প্রণবেশের চেয়ে আমার মনের জোর বোধহয় বেশি। আমি ওর চোখের দিকে না তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললাম–পিছু হটো।
ওরা শুনল না। কাঁপালিকও ছুটে এল আমার দিকে। আমি দ্রুত দশ পা পিছিয়ে গেলাম। কাকটা আবার বিকট শব্দে ডেকে আমাদের মাথার ওপর উড়তে লাগল। ওদের ভয় দেখাবার জন্যেই আমি উড়ন্ত কাকটাকে গুলি করলাম। দু-পাক ঘুরে কালো ডানায় রক্ত মেখে কাকটা এসে পড়ল তান্ত্রিকের মাথায়। আমি লাফিয়ে গিয়ে বুকে রিভলভার ঠেকালাম। অন্যরা ভয়ে পালাতে লাগল। মুহূর্তে পাহাড়ের আড়ালে কে যে কোথায় গা ঢাকা দিল আর তাদের দেখা গেল না। প্রণবেশও ততোক্ষণে সামলে উঠেছে। তখন উদ্যত রিভলভারের সামনে তান্ত্রিক আর ছেলেটাকে নিয়ে আমরা ওপরে উঠে এলাম। রিভলভারের সামনে তান্ত্রিক বাবাজি আর মেজাজ দেখাল না।
তান্ত্রিকের এই অবস্থা দেখে আমাদের এই ড্রাইভার ভয়ে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বোধহয় বোঝাতে চাইল তার দোষ নেই। সে নিরুপায়। তার ওপর তার যেন ক্রোধ না পড়ে।
ড্রাইভারকে বললাম–সোজা থানায় চলো।
কিন্তু–লিখতে লজ্জা করছে, শেষ রক্ষা হয়নি। মাঝপথে হঠাই আমাদের অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুলুনি এসেছিল। তন্দ্রা ছুটলে দেখি জিপের মধ্যে ছেলেটা রয়েছে। কিন্তু তান্ত্রিক নেই। তাকে আমাদের দুজনের মাঝখানে বসিয়েছিলাম। তবু কী করে যে পালাল বুঝতে পারলাম না।
থানায় গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সব কথা বললাম। পুলিশকর্তা আমাদের সাহসের জন্যে ধন্যবাদ দিলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন খোঁজখবর নিয়ে ছেলেটিকে ওর বাপ-মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।
হোটেলে ফিরে জং বাহাদুরকে সব ঘটনা বললাম। আশ্চর্য! সে মোটেই খুশি হলো না। মুখের ওপর রীতিমতো ক্রোধের ছায়া নেমে এল। যেন ওখানে গিয়ে আর ছেলেটাকে বাঁচিয়ে আমরা অন্যায় কাজ করেছি। শুধু থমথমে গলায় বলল, কাজটা ভালো করলেন না স্যার। ফল পাবেন। বলেই চলে গেল।
পরের দিন আমাদের ঘরে জল দিতে এল একজন বয়স্ক লোক। বাহাদুরের কথা জিজ্ঞেস করায় ও জানাল দুদিনের ছুটি নিয়ে ও কোথায় গিয়েছে।
মরুক গে। যে কেউ একজন আমাদের দেখাশোনা করলেই হলো।
দুদিন পর জং বাহাদুর ফিরে এল। দেখি কপালে ওর সিঁদুরের লম্বা তিলক। বুঝলাম কোনো ঠাকুর-দেবতার মন্দিরে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন কী ঘটল যার জন্যে ছুটি নিয়ে ঠাকুরবাড়ি যেতে হলো? তখনই–কেন জানি না সন্দেহ হলো সেই তান্ত্রিকের আখড়ায় যায়নি তো?
যাই হোক ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
যাবার আগের দিন সন্ধেবেলা হোটেলে ঢুকছি, দেখি একটা রোগা-পটকা ছেলে দরজার কাছে বসে আছে। জিজ্ঞেস করায় সে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, সে বাড়ির কাজ খুঁজছে। যদি দরকার হয় তাহলে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারে।
জং বাহাদুরকে ডাকলাম। শুনে বলল, আপনি তো কাজের ছেলে খুঁজছিলেন। তা এ যখন না ডাকতেই এসে পড়েছে তখন নিয়ে যান।
ওর চেহারা দেখে বললাম, এর শরীর তো এই। ও কি কাজ করতে পারবে?
এ কথা শুনেই ছেলেটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। ঐ প্রবল শীতে জামা খুলে ফেলে বার কতক ভল্ট খেলো। দুবার দুমদাম করে বড়ো বালতিটা নিয়ে পাঁই পাঁই করে নিচে নেমে গেল। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এক বালতি জল নিয়ে দৌড়ে এসে পড়ল। আশ্চর্য! এক ফোঁটা জল চলকে পড়েনি। দেখে যত না খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি হলাম অবাক। ছেলেটা কি ম্যাজিক জানে, না পাহাড়ী ছেলে বলেই এই গোপন শক্তি?
ইতস্তত করছি–জং বাহাদুর বলল, ভাবছেন কী, নিয়ে যান একে। এর কাজ দেখবেন।
ওকে নিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি, দেখি বাহাদুর দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। সে হাসিটা যেন কীরকম! ঠিক বিদায়ের হাসি নয়।
.
অশুভ সংকেত
আমার বন্ধু প্রণবেশ নেপাল থেকে ফিরে কলকাতাতেই থেকে গেল। আমি রাজু সুব্বাকে নিয়ে চলে এলাম দেশের বাড়িতে। প্রণবেশকে ছুটির মধ্যে অতি অবশ্য একবার আমার দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসতে বলেছি। ও আসবে বলেছে।
যদিও জুলাই মাস। বৃষ্টির সময়। আকাশ মেঘলা। কিন্তু ঝড়ের সময় নয়। আশ্চর্য! স্টেশনে নেমে সুব্বাকে নিয়ে রিকশা করে অর্ধেক পথ যেতেই হঠাৎ ঝড় উঠল। সে কী ঝড়! সঙ্গে সঙ্গে মেঘের তর্জন-গর্জন। স্টেশনে ফিরে যাবার উপায় নেই। ঐ ঝড়ের মধ্যেই রিকশার পর্দা দুহাতে চেপে ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ধরে একটা কীরকম পচা ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছিলাম। এখন বুঝলাম গন্ধটা আসছে সুব্বার গা থেকে। আমার ভেতরটা কীরকম ঘুলিয়ে উঠছিল। কিন্তু উপায় কি? গরিবের ঘরের ছেলে। নোংরা। ভালো করে সাবান মেখে স্নান করতে পায় না। গন্ধ তো হবেই। তাছাড়া ওর গায়ের জ্যাকেটটাও জঘন্য।
যাই হোক রিকশাটা যখন ঝড়ের মধ্যেই বাড়ির কাছে এসেছে তখন হঠাৎ আকাশের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কানের পর্দা ফাটিয়ে প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। জীবনে কখনও বাজ পড়া দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। আর আমার প্রথম দেখা বজ্রটি একটা আগুনের গোলা হয়ে প্রথমে আমাদেরই বাড়ির নারকেল গাছটার ওপর পড়ল। তারপর বাড়ির আলসে ভেঙে বেরিয়ে গেল।
চারিদিকে ভয়ার্ত চিৎকারের মধ্যে দিয়ে আমাদের রিকশাটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আমি বিহ্বল–সন্ত্রস্ত। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই বজ্রপাত!
কিন্তু আশ্চর্য, সুব্বার কোনো বিকার নেই। সে তার ড্যাবড্যাবে সাদা চোখ নিয়ে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রতিটা মুহূর্ত ও আমাকে ওর লক্ষের মধ্যে রাখতে চাইছে।
এইভাবেই বিশ্রী একটা দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে রাজু সুব্বা আমাদের বাড়ি ঢুকল। ঢুকল না বলে বরঞ্চ বলি আমাদের বাড়িতে নিজের অধিকার পাকা করে নিল।
.
এখানে এসে প্রথম কদিন আমার চেনাজানা প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করলাম।
হেরম্ব ভট্টাচার্যের কথা মনে ছিল না। বৃদ্ধ মানুষ। সারা জীবন ঠিকুজি, কুষ্ঠী, কররেখা গণনা করেই কাটালেন। ভালো জ্যোতিষী বলে ওঁর খুব নামডাক ছিল। আমি এ-সবে বিশ্বাসী কোনোদিনই ছিলাম না। তাই তার কাছে যেতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু উনি আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। বাবার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমি কোথায় থাকি, কি করি না করি সব খবরই রাখতেন। বোধহয় ভেতরে ভেতরে আমার ওপর টান ছিল।
সেদিন সকালে বাজার করে ফিরছি, দেখি হেরম্ব জ্যাঠা রাস্তার ধারে বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে পাঁজি দেখছেন। আমায় দেখে সোজা হয়ে বসে বললেন-সুশান্ত না? কবে এলে?
অগত্যা বারান্দায় উঠতে হলো। প্রণাম করলাম। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কাজকর্মের কথা জিজ্ঞেস করলেন।
পুলিশের অফিসার হয়েছি শুনে তিনি যেন বিশেষ খুশি হলেন না। শুধু বললেন, ওসব চাকরি বড়ো দায়িত্বজনক। বিপদের সামনে এগোতে হয়। না এগোলে দুর্নাম, এগোলে জীবন সংশয়।
হেসে বললাম, তবু তো পুলিশের কাজ কাউকে না কাউকে করতেই হবে। কেউ পুলিশের কাজ না নিলে চোর-ডাকাতদের ধরবে কে?
আমার কথায় হেরম্ব জ্যাঠা একটু অপ্রস্তুতে পড়লেন। সসংকোচে বললেন, আমি ও ভেবে বলিনি। আসলে এইসব কাজে বিপদ আছে। তুমি আমাদের ঘরের ছেলে বলেই তোমায় বললাম। নইলে আমার কি?
আমি নিতান্তই ওঁকে খুশি করবার জন্যে ভান করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, দেখুন তো আমার শিগগিরই জীবন সংশয়ের যোগ আছে কিনা।
খুশি হওয়া তো দূরের কথা, উনি যেন একটু বিরক্ত হলেন। বুঝলেন আমি মজা মারছি। তিনি আমার হাতের দিকে তো তাকালেনই না, শুধু চোখের দিকে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থেকে বললেন, ভবিষ্যৎবাণী করাটা ছেলেখেলা নয় সুশান্ত। অন্য কেউ হলে উত্তরই দিতাম না। তুমি বলেই বলছি–জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা অতি সন্নিকট।
আমি হেসেই বললাম, কবে?
উনি গম্ভীরভাবে বললেন, এক মাসের মধ্যে।
আমি আবার হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বাঁচবার উপায়?
এই সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে তার ডাক পড়ল। স্নানের সময় হয়েছে। তিনি ঘরে যেতে যেতে বললেন–এক মাসের মধ্যে কখনও একা থেকো না। বলেই চলে গেলেন। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এক মাসের মধ্যে একা থাকার সম্ভাবনা নেই।
.
অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা
যদিও হেরম্ব জ্যাঠার কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম তবু প্রথম কদিন মাঝে মাঝেই চিন্তা করতাম–কেন তিনি ঐরকম ভবিষ্যৎবাণী করলেন! তিনি তো অন্তত আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাবেন না। তাহলে?
কারও কারও ভবিষ্যত্বাণী তো মিলেও যায় বলে শুনেছি। তাহলে তাহলে কি সত্যিই এক মাসের মধ্যে এমন কোনো বিপদ আসছে যাতে আমার মৃত্যু হতে পারে?
কিন্তু তা সম্ভব কী করে? বিশেষ এটা তো কলকাতা নয় যে পথেঘাটে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এটা শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট গ্রাম। আমার নিজের দেশ। এখানে সবাই আমার চেনাজানা। কলকাতায় হলে না হয় বোঝা যেত চোর-ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু এখানে? এখানে আমি ছুটিতে। কোথাও ডাকাতি হলেও নিশ্চয় আমায় ছুটতে হবে না। তাহলে এখানে বাকি এই কটা দিনের মধ্যে আমার মৃত্যুর সম্ভাবনা কোথায়? যাই হোক দিন দুয়েকের মধ্যেই আমার মন থেকে হেরম্ব জ্যাঠার কথাটা দূর হয়ে গেল।
কয়েক দিন কেটে গিয়েছে। সুব্বা এ কয়দিনেই আমাদের বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে। যদিও ও এখন নিয়মিত তেল মেখে সাবান দিয়ে স্নান করে, নোটনের পুরনো জামাগুলো পরে, তবু যখনই ও আমার ঘরে ঢোকে তখনই হঠাৎ মুহূর্তের জন্যে সেই বিশ্রী গন্ধটা পাই। একদিন স্ত্রীকে গন্ধর কথা বললাম। স্ত্রী অবাক হয়ে বলল কই না তো!
আমার স্ত্রী বা বাড়ির অন্য কেউ যখন গন্ধ পায় না তখন বুঝলাম ওটা আমারই ভুল। প্রথম দিনের সেই বিশ্রী গন্ধটা এখনও আমার নাকে লেগে আছে।
নারকেল গাছটা ছিল বহুকালের। কোন ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। এত দিন পর তার মৃত্যু হলো বজ্রাঘাতে আমারই চোখের সামনে। দেখতে পাই পাতাগুলো কিরকম জ্বলে গেছে। একটা একটা করে বালদাসুদু পাতা সশব্দে খসে পড়ছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।
কিন্তু এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করলে চলবে না। যে জীবনকাহিনিটা লিখতে আরম্ভ করেছি, তাড়াতাড়ি সেটা শেষ করতে হবে। ছুটি ফুরোতে আর বেশি দিন নেই। আর এও জানি কলকাতায় গিয়ে কাজের মধ্যে পড়লে লেখা আর শেষ হবে না।
কিন্তু তাড়াতাড়ি শেষ করব বললেই তো আর শেষ করা যায় না। এই যে সেদিন সন্ধেবেলায় ঘটনাটা ঘটল, যত সামান্যই হোক, তবু তো ভুলতে পারছি না। কেন সুব্বা চুপি চুপি আমার ঘরে ঢুকেছিল, কেনই বা আলো নিভিয়ে দিয়ে আমায় ভয় দেখাতে চেয়েছিল, ঘরের মধ্যে কী এমন দেখে নোটন চিৎকার করে উঠেছিল? যতই সন্তোষজনক উত্তর পাই না, ততই কৌতূহল বাড়ে, ততই কেন যেন সুব্বাকে লক্ষ করি। ওকে বোঝবার চেষ্টা করি। ছেলেটা ঠিক আর-পাঁচটা ছেলের মতো নয়। ওর অদ্ভুত কাজকর্মের কিছু নমুনা নেপালের হোটেলে দেখেছিলাম। অবাক হয়েছিলাম বটে তবু কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এখানে এসেও একদিন ঐরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসল।
দুপুরবেলায় নোটন ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়। নেপালে ঘুড়ি ওড়ে কিনা জানি না তবে সুব্বা কখনো ঘুড়ি দেখেনি। তার খুব উৎসাহ। নোটনের সঙ্গে সেও ছাদে দাপাদাপি করে বেড়ায়।
সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে বসে লিখছিলাম। হঠাৎ বাড়ির পিছনে মড়মড় শব্দ করে কী যেন ভেঙে পড়ল। চমকে উঠলাম। কী ভাঙল! কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? ছুটে গেলাম ছাদে। ততক্ষণে আমার স্ত্রী, আমার ছোটো ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রীও ছাদে ছুটে এসেছে। যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম তাতে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। আমাদের বাড়ি থেকে বিশ ত্রিশ হাত দূরে একটা আমগাছ। দেখি তারই একটা ডাল ধরে সুব্বা ঝুলছে। ঝুলছে নয়, দোল খাচ্ছে। আর নোটন লাটাই হাতে করে স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।
কী ব্যাপার? ব্যাপারটা এই–নোটনের ঘুড়িটা আমগাছে আটকে গিয়েছিল। কিছুতেই ছাড়াতে পারছিল না। তখন নাকি সুব্বা পাঁচিলে উঠে এক লাফ দিয়ে আমগাছে গিয়ে পড়ল। ঘুড়িটা খুলে নিচে ফেলে দিল। আর তার পরেই গোটা ডালটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ে। রাজু ততক্ষণে আর একটা ডাল ধরে ঝুলতে থাকে।
আমাদের দেখে একটু যেন হেসে সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো ডাল থেকে দোল খেতে খেতে এক আঁকানি দিয়ে ছাদে এসে পড়ল।
ওর এই তাজ্জব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার রাগ হয়ে গেল। চিৎকার করে বললাম, হতভাগা, তুই নিজে মরবি, আমাকেও জেলে পাঠাবি? বলে ঠাস্ করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। কিন্তুগাল কোথায়? মনে হলো যেন এক টুকরো শক্ত কাঠে চড় বসালাম।
রাজু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। শুধু তার সেই অদ্ভুত চোখের মণিটা ওপর দিকে ঠেলে আমার দিকে তাকাল।
বাড়ির সবাই ওর এই দস্যিপনায় বিরক্ত হয়েছিল। কিছু না বলে তারা নেমে গেল। আমি ফের ধমক দিয়ে বললাম, এরকম করলে তোমায় আমি দূর করে দেব মনে রেখো।
রাজু সুব্বা কোনো জবাব দেয়নি।
ঘটনাটার কথা কদিন পর আর কারও মনে রইল না। সুব্বা দিব্যি বাড়ির কাজ করতে লাগল। নোটনের সঙ্গে খেলাধুলোও চলতে লাগল। কিন্তু আমার মন থেকে কিছুতেই একটা সংশয় ঘুচল না–ঐ রোগা হালকা ছেলেটার ভারে আমগাছের শক্ত ডাল ভেঙে পড়ে কী করে? নিজেকেই বোঝাই হয়তো ডালটা পা ছিল, ভেঙে পড়তই। রাজু উপলক্ষ মাত্র।
একটা জিনিস ইদানিং লক্ষ করছি–যে রাজুকে আমি নিয়ে এসেছিলাম সুদূর নেপাল থেকে–যার আদর-যত্নের অভাব এতটুকু রাখিনি, সেই রাজু সুব্বার ওপর আমার কেমন বিতৃষ্ণা জাগছে। কেন জানি না ওকে আর সহ্য করতে পারি না। মনে হচ্ছে ওকে না আনলেই হতো। ও চলে গেলেই বাঁচি। আর আমার ওপরও রাজুর রাগ যে ক্রমশই বাড়ছে তাও বুঝতে বাকি থাকে না। সেই বিরাগ এখন চাপা আগুনের মতো ওর চোখে-মুখে ফুটে উঠছে। আমাকে একলা পেলে ও ওর ড্যাবডেবে চোখের সাদা অংশটা এমন বিশ্রী বড়ো করে তাকায় যে আমার কেমন ভয় করে। সন্দেহ হয়–ও কি সত্যিই মানুষের বাচ্চা?
আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে অলৌকিক উপন্যাসখানা লিখছি, তার মধ্যে রাজু সুব্বার কথা লিখব কিনা ভাবছি। ভাবছি এই জন্যে যে, হয়তো সুব্বার ব্যাপার-স্যাপারগুলো কোনো অলৌকিক কাণ্ড নয়। হতে পারে অস্বাভাবিক। তাও অসম্ভব কিছু না। কেননা সুব্বা এদেশের ছেলে নয়। কোথায় হিমালয়ের কোলে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গলঘেষা নেপালে ওর জন্ম। ওখানেই তার ছেলেবেলা কেটেছে। ওখানেই ও বড়ো হয়ে উঠছে। হয়তো ওর মা নেই, বাবা নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই। নিতান্ত পেটের দায়ে আমার সঙ্গে এসেছে। কাজেই ও যদি লাফ দিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝোলে কিংবা অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি কাজ করে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। নোটনের মতো বাঙালি ঘরের আদুরে ছেলের সঙ্গে ওকে মেলাতে গেলে ভুল হবে। এও মনে রাখতে হবে ছেলেটা চোর নয়, টাকা-পয়সার দিকে বা খাওয়ার দিকে লোভ নেই। সবচেয়ে বড় কথা নোটনের সঙ্গে খুব ভাব। কাজেই ছেলেটার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকলেও ভয় পাবার মতো অলৌকিক কোনো ব্যাপার নেই। তবু আমার ডায়েরিতে ওর প্রতিদিনের আচার-আচরণ লিখে রাখছি।
এই যেমন সেদিন সন্ধেবেলা–আমার মেজো ভাই, ছোটো ভাই এক নেমন্তন্ন বাড়িতে গেছে। আমার স্ত্রী আর দুই ভাইয়ের বৌ নিচে রান্নাঘরে। নোটন বাইরের ঘরে পড়ছে। আমি আমার ঘরে বসে লিখছি।
পল্লীগ্রাম। এর মধ্যেই যেন নিশুতি হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকচলাচল বিশেষ নেই। বাড়ির পিছনে দীর্ঘ আমগাছের বাগানটা অন্ধকারে গা মিশিয়ে যেন কোনো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে।
আমি একমনে লিখছি। হঠাৎ পিছনের দরজার কাছ থেকে ছোটো বৌমার উত্তেজিত গলা শোনা গেল–সুব্বা, কী করছ? চমকে পিছন ফিরে দেখি আমার ঠিক পিছনে রাজু দাঁড়িয়ে আছে দু হাত বাড়িয়ে। ওর চোখের কটা রঙের মণি দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মুখের ওপর একটা হিংস্র ভাব যা কখনো দেখিনি।
–কী চাই? ধমকে উঠলাম।
সুব্বা শান্ত গলায় শুধু বলল, ম্যাচিস। ম্যাচিস অর্থাৎ দেশলাইটা চায়।
–দেশলাই নিয়ে কী করবে?
উত্তরে ও জানাল ওর ঘরে নাকি আলো নিভে গেছে। মোম জ্বালবে।
ততক্ষণে ছোটো বৌমা ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে। সুব্বাকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কখন আলো নিভল? এই তো দেখলাম আলো জ্বলছে।
আমি কিরকম ভয় পেলাম। একটা ফয়শালা করতেই হয়। চেয়ার থেকে উঠে বললাম, চল্ তো দেখি কেমন আলো নিভেছে?
ও দোতলার সিঁড়ির ঘরে থাকে। গিয়ে দেখি সত্যিই ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।
ছোটো বৌমা বললে, অবাক কাণ্ড! সুব্বা এ ঘরে যখন ঢুকে আসে, আমি তার পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি। দেখেছি ওর ঘরে আলো জ্বলছে।
বললাম, তার পরেই হয়তো আলো নিভে গেছে।
ছোটো বৌমা কঠিন সুরে বললেনা। সুব্বা বলছে আলো নিভে গেছে বলেই নাকি দেশলাই চাইতে এসেছিল। মিথ্যে কথা। আবার বলছি ও যখন এঘরে এসে আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি দেখেছি তখনও আলো জ্বলছিল।
আমি আর কিছু বললাম না। রাজুর হাতে দেশলাই দিয়ে ওকে চলে যেতে বললাম।
পরের দিন ছোটো বৌমা আমার ঘরে এসে চুপি চুপি বলল, দাদা, রাজুর ব্যাপার স্যাপার আমার ভালো ঠেকছে না। ও দেশলাই নিতে আসেনি। আমি স্পষ্ট দেখেছি ও আপনার গলা টিপে মেরে ফেলতে এসেছিল।
হেসে বললাম, না না, তাই কখনো ও পারে? কেনই বা আমাকে মারবে? তা ছাড়া ঐ তো দুখানা হাড়-বের করা চেহারা
ছোটো বৌমা বলল, ঐ দুখানা হাড়েই ও কিন্তু ভেল্কি দেখায় ভুলবেন না। যাই হোক আমার বিবেচনায় যত শিগগির পারেন ওকে বিদেয় করুন।
বলে চলে যাচ্ছিল, ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, এ কথা আর কাউকে না বলাই ভালো। ভয় পাবে। শুধু আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। বলেই চলে গেল।
এই একটা নতুন ভাবনা শুরু হলো। সুব্বা কি সত্যিই আমায় মেরে ফেলতে চায়? কিন্তু কেন? ওকে সেদিন মেরেছিলাম বলে? ওর এত বড়ো সাহস হবে বাড়িতে এত জনের মধ্যে আমায় মারার? তা হতে পারে না। ও হয়তো সেদিনের মতো ভয় দেখাতেই এসেছিল। ছোটো বৌমা দেখে ফেলায় ধরা পড়ে গেছে।
এর ঠিক তিন দিন পরে ছোটো ভাইয়ের কাছে চিঠি এল, সামনের সপ্তাহে ছোটো বৌমার বোনের বিয়ের দিন হঠাৎ ঠিক হয়েছে। দিন দশেকের জন্যে ওরা যেন চলে আসে।
ছোটো বৌমা মহা আনন্দে ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি চলে গেল। যাবার সময়ে আমায় গম্ভীর মুখে বলে গেল রাজুকে তো সরাবেন না। ওর কাছ থেকে সাবধানে থাকবেন।
আমিও চাই রাজুকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু সরাবার তো স্পষ্ট কারণ থাকা চাই। তা ছাড়া ও যাবে কোথায়? নেপালের সেই কাঠমাণ্ডুতে? ওখানে কি ও একা যেতে পারে? তা হলে ওকে একা কোথায় তাড়িয়ে দেব?
ছোটো বৌমা আমায় সাবধানে থাকতে বলল। কিন্তু নিজের বাড়িতে সবার মাঝখানে কী এমন সাবধান হতে পারি?
.
আরও কাণ্ড
সেদিন আবার একটা কাণ্ড হলো।
দুপুরবেলা। আমি আমার ঘরে একা বিছানায় বসে লিখছি। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। হঠাৎ মনে হলো ফ্যানের হাওয়াটা কিরকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একভাবে গায়ে লাগছে না। তাকিয়ে দেখি পাখাটা এদিক থেকে ওদিকে দুলছে।
অবাক হলাম। এ আবার কি! ফ্যানটা এমন দুলছে কেন? ভাবলাম নিশ্চয় ভূমিকম্প হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ভূমিকম্পের কথা জানাতে গেলাম। আর ঠিক তখনই পাখাটা ভীষণ শব্দ করে আমার বিছানার ওপর খুলে পড়ল সেই শব্দে সবাই ছুটে এল আমার ঘরে। সবাই বলল, খুব ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি। কিন্তু আর কারো ঘরে পাখা এতটুকু দোলেনি। সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে গেল।
আমি লক্ষ করলাম সবাই ছুটে এসেছে। আসেনি শুধু রাজু।
কী মনে হলো জিজ্ঞেস করলাম, সুব্বা কোথায়?
কেউ বলতে পারল না। আমি তখনই ছাদে উঠে গেলাম। দেখি হতভাগা সরু পাঁচিলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে পেয়ারা খাচ্ছে। পেয়ারা তো সব ছেলেই খায়। কিন্তু ও গোটা পেয়ারাটা মুখে পুরে ছাগলের মতো চিবোচ্ছে। আর সারা মুখে পেয়ারার বিচিগুলো বিচ্ছিরিভাবে লেগে রয়েছে।
–এখানে কি করছ? মেজাজ গরম করেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
ও কোনো উত্তর না দিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে বাঁদরের মতো ছাদের ওপর লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।
ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকা হলো। সে তো দেখে অবাক। বলল, যে আঁকশিতে পাখাটা ঝুলছিল সেটা ঠিকই আছে। পাখাও খারাপ হয়নি। তা হলে পড়ল কি করে?
পড়ল কী করে সে কথা আলাদা। আমার কিন্তু মনে হলো আমাকে মারবার জন্যেই যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি একাজ করেছিল। আমার কোনো শুভ শক্তি আমাকে এ যাত্রাতেও বাঁচিয়ে দিল।
.
ছোটো ভাইরা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেলে বাড়িটা অনেকখানি ফাঁকা হয়ে গেল। ওদের জন্যে হঠাৎ মন কেমন করতে লাগল। মনে হলো ওরা না গেলেই ভালো হতো। আর তো মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আছি। সবাই একসঙ্গে থাকলে ভালোই লাগত। বিশেষ করে ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী ঐ যে আমায় চুপি চুপি সাবধানে থাকার কথা বলে গিয়েছিল, সে কথা মনে করে আমার অস্বস্তি হতে লাগল। যাক, কদিন পরেই তো ওরা আসছে। তা ছাড়া বাড়িতে আমার স্ত্রী, নোটন ছাড়াও মেজো ভাই, মেজো ভাইয়ের স্ত্রী রয়েছে। কাজেই আমার কোনো অসুবিধা নেই।
সুব্বা বড়ো একটা এদিকে আসে না। আমার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে যখন যায় তখন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে আমাকে দেখে যেন আমি ওর দুচক্ষের বিষ। আমার মনেও একটা পৈশাচিক ভাবের উদয় হয়। ইচ্ছে করে ওর সরু গলাটা টিপে ধরি।
মাত্র দুদিন পরেই মেজো বৌমার বাপের বাড়ি থেকে জরুরি খবর এল–ওর বাপের বাড়ির জমিজমা ভাগ হচ্ছে। সেইজন্যে কয়েক দিনের জন্যে মেজো বৌমাকে যেতে হবে। পরের দিনই মেজো ভাই, মেজো বৌমা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময়ে মেজো বৌমা হেসে বলে গেল, দিদি তো রইলেন। আপনার অসুবিধে হবে না এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসব।
যাক মেজো ভাইরাও চলে গেল। এত বড়ো বাড়িটা এখন যেন আমায় গিলতে আসছে। এখন শুধু আমার স্ত্রী আর নোটন। রাজু তো দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেই।
ওরা না থাকায় আমার স্ত্রীর কোনো অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হলো না। এত বড়ো বাড়িটা খালি হয়ে গেল, তার জন্যে তার কোনো কষ্টও নেই। জোড়া বটতলায় শিগগিরই মেলা বসবে, অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসবে। তাদের দেখতে যাবে সেই আনন্দেই মশগুল।
আর নোটন? সে তো রাজুর সঙ্গে দিব্যি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
কিন্তু আমি? আমার যে শুধু খারাপই লাগছে তা নয়–সত্যি কথা বলব, পুলিশের লোক হয়েও আমার কেমন ভয় করছে। কিসের ভয় তা ঠিক বুঝতে পারি না। ঐ একফোঁটা ছেলে রাজু সুব্বাকে? পাগল হয়ে গেলাম নাকি? ওকে ভয় পেতে যাব কেন? ওর সাধ্য কী আমার ধারেকাছে ঘেঁষে!
.
রহস্যময় রাজু
আমাদের এই গ্রামে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। বিশেষ করে এই সময়ে জোড়া বটতলায় বিরাট মোচ্ছব হয়। মোচ্ছব চলতি কথা। আসল কথা হচ্ছে মহোৎসব (মহা উৎসব)। বহুকাল থেকে এই জোড়া বটতলায় এক পক্ষ কাল ধরে মেলা বসে। জোড়াবটের নিচে একটি ঠাকুর আছে। ঠাকুরের কোনো বিশেষ মূর্তি নেই। একটা পাথর আগাগোড়া সিঁদুর মাখানো।
এই মেলা উপলক্ষ করে পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জ থেকে বহু লোক আসে। কাছেই বিরাট একটা দীঘি। সেখানে স্নান করে সবাই জোড়া বটতলায় পুজো দেয়। সেদিন সবাই দীঘির পাড়েই রাঁধাবাড়া করে খায়। মেলায় নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক থেকে শুরু করে বাদামভাজা, পাঁপড়ভাজা সবই থাকে। মিষ্টির দোকানের তো ছড়াছড়ি। সবচেয়ে আকর্ষণের ব্যাপার এই মেলায় দূর-দূরান্তর থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে সাধু-সন্ন্যাসীরা আসেন। ভস্মমাখা দেহে, কপনিমাত্র পরে তারা ধুনি জ্বালিয়ে সারা রাত ধ্যান করেন। মাঝে মাঝে নাগা সন্ন্যাসীদেরও দেখা যায়। শোনা যায় তারা হিমালয় থেকে নেমে আসেন।
এইসব ভিড়ভাট্টা মেলা, ঠাকুর পুজো, সাধুদর্শন আমার ভালো লাগে না। আমি পুলিশ অফিসার। আগেই বলেছি আমরা সন্দিগ্ধ স্বভাবের। পুলিশের কাজ করতে করতে মনের কোমল বৃত্তিগুলো, ভাবাবেগ সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবকিছুই হাস্যকর বলে মনে হয়। কিন্তু আমার স্ত্রীর আবার উল্টো। তিনি বাচ্চা ছেলেদের মতো মেলা দেখতে ভালোবাসেন। পুজো না দিলে তার তৃপ্তি নেই। সাধু-সন্ন্যাসী পেলেই তাদের পায়ে আছড়ে পড়েন।
এখানে মেলা বসছে শুনে স্ত্রী বললেন, আমি যাব।
বললাম, যাও। দয়া করে সঙ্গে আমায় যেতে বোলো না।
স্ত্রী হেসে বললেন, তোমাকে দরকার নেই। আমি নোটন আর সুব্বাকে নিয়ে যাব।
–সেই ভালো, বলে লেখায় মন দিলাম। একটু পরে গৃহিণী ফিরে এসে বললেন, সুব্বা যেতে চাচ্ছে না।
বললাম, না গেল তো নাই গেল।
বাঃ! ছেলেটা এখানকার মেলা দেখেনি। দেখবে না?
বললাম, তার যেতে ইচ্ছে না করলে কি করবে?
স্ত্রী বললেন, তুমি একটু বল না।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ওকে আমি কিছু বলতে পারব না।
অগত্যা গৃহিণী বিমর্ষ মুখে চলে গেলেন।
হঠাৎই আমার মনে হলো–রাজু যেতে চাইল না কেন? বাড়িতে এখন ওর এমন কী রাজকার্য আছে?
বিকেলে গৃহিণী ফিরে এসে ঘটা করে মেলা দেখার কথা বললেন। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী দেখেছেন। গুনে গুনে পঞ্চাশ জন সাধুর পায়ের ধুলো নিয়েছেন। খুব ভালো লেগেছে। পরে হঠাৎ গলার স্বর খাটো করে বললেন, সুব্বা তো যাব না বলল। কিন্তু ও গিয়েছিল। আমি ওকে দেখেছি। কিন্তু ও আমাকে দেখেও এড়িয়ে গেল।
এর উত্তর আমি আর কী দেব? চুপ করে রইলাম। শুধু বললাম, ও বড়ো পাকা ছেলে। দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে।
গৃহিণী আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন।
মেজো, ছোটো ভাইরা কেউ নেই। বাড়িটা বড্ড খালি-খালি লাগছে। কলকাতায় দুখানা মাত্র ঘরে আমার সঙ্গে শুধু নোটন আর নোটনের মা থাকে। মাত্র তিনজন। সে একরকম সয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে এত বড়ো বাড়িতে মাত্র আমরা তিনজন আর হতচ্ছাড়া ঐ রাজুটা মোট চারজন। বড় ফাঁকা লাগে। এই সময়ে প্রণবেশ যদি এসে পড়ত তাহলে খুব ভালো হতো। বলেও ছিল–আসবে। কিন্তু এল কই?
সেদিন বিকেলে ছাদে পায়চারি করছিলাম। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু অন্ধকার হয়নি। হঠাৎ বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে এক ঝাক পাখির ভয়ার্ত চেঁচামেচি শুনে চমকে উঠলাম। পাখিগুলো অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন দেখবার জন্যে ছাদের ঐ দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে একটা সরু ধুলোভরা রাস্তা এঁকেবেঁকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই দীঘির দিকে গেছে। পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখলাম রাজু ঐ রাস্তা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। আর গাছে গাছে যত পাখি ছিল, সব ওর মাথার ওপর গোল হয়ে ঘুরছে আর কিচমিচ্ করছে। রাজু কিন্তু সেদিকে তাকাচ্ছে না। হনহন্ করে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।
আমি অবাক হলাম। এই ভর-সন্ধেবেলা রাজু জঙ্গলের মধ্যে গেল কেন? কেনই বা পাখিগুলো অমন করে আর্তস্বর চিৎকার করছিল? অনেক ভেবেও কোনো জুৎসই উত্তর খুঁজে পেলাম না।
নিচে নেমে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজুকে কোথাও পাঠিয়েছ?
স্ত্রী বললেন, না তো।
বললাম, তাহলে ওকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলাম কেন?
স্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, জঙ্গলে! জঙ্গলে কেন যাবে?
–সেটাই তো আমার প্রশ্ন। আর ও যখন ঐদিকে যাচ্ছিল তখন এক ঝাঁক পাখি ওর মাথার ওপর উড়ছিল আর চিৎকার করছিল।
-কী যে বল!
–ঠিক আছে। ও এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো।
–ও তো বাড়িতেই ছিল। দাঁড়াও দেখছি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজুকে নিয়ে ফিরে এলেন, এই তো। এখানেই রয়েছে।
আমি অবাক। দশ মিনিট আগে ছাদ থেকে ওকে আমি স্বচক্ষে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছি। এর মধ্যে কখন ফিরে এল? তবে কি আমি ভুল দেখলাম? এতখানি ভুল হওয়া কি সম্ভব?
তবু জিজ্ঞেস করলাম, তুই কোথায় ছিলি?
ও ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমার ঘরে।
–তুই পেছনের রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের দিকে যাসনি?
ও খুব সংক্ষেপে রুক্ষ গলায় বলল, নেহি।
আমার বেজায় রাগ হলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই রাগ প্রকাশের ছুতোও খুঁজে পেলাম। বললাম, সেদিন তোর মাইজি ওদের সঙ্গে মেলায় যেতে বলল। তুই বললি যাবি না। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে একা গিয়েছিলি। অথচ সেকথা বলিসনি। কেন? কেন একা একা মেলায় গিয়েছিলি?
ও আগের মতোই ঘাড় শক্ত করে শুধু বলল, নেহি।
আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠে বললেন, তুই তো আচ্ছা মিথ্যেবাদী! আমি নিজে চোখে দেখলাম যেখানে সাধুরা বসেছিল সেখানে ঘুরছিলি। আর বলছিস কিনা–
ও ফের ঘাড় নাড়ল–নেহি।
স্ত্রী বললেন, তুই ডাহা মিথ্যেবাদী। নোটনকে জিজ্ঞেস কর। সেও দেখেছে।
নেহিনেহি–বলতে বলতে রাজু যেন পালিয়ে গেল।
সেদিন রাত্রে স্ত্রী প্রথম বললেন, শোনেনা, রাজুকে আমার কেমন যেন লাগছে।
আমি চুপ করে রইলাম।
স্ত্রী আবার বললেন, কিছু বলছ না যে?
–কি আর বলব? আমিও টের পাচ্ছি। ওর ঐ রোগা-পটকা শরীর নিয়ে দুমদাম করে কাজ করা, ছাদ থেকে লাফিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝোলা, ছাদের সরু পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে মস্ত বড়ো হাঁ করে গোটা পেয়ারা চিবনো, ওর অস্বাভাবিক চোখ, আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকানো, মেলায় যাব না বলে লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়া, সন্ধেবেলায় দীঘির পথে জঙ্গলে ঢোকা, ওকে দেখে ভয় পেয়ে পাখির ঝাঁকের তাড়া করা–অথচ ও নাকি জঙ্গলের পথে যায়নি, ঘরেই ছিল–সবই রহস্যময়।
স্ত্রী শিউরে উঠে বললেন, কী হবে গো! আমার যে কেমন ভয় করছে। ওকে তাড়াও।
–ও নিজে থেকে চলে না গেলে কি তাড়ানো যায়? কোথায় যাবে?
স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এত বড়ো বাড়িতে এভাবে থাকতে আমার খুব ভয় করছে। কেবলই মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে। কবে যে ওরা সবাই আসবে–
পরের দিন হঠাৎ আমার স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে ওর এক ভাই এল। ওর মা খুব অসুস্থ। এখুনি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে।
শুনে চমকে উঠলাম। ওর মা অসুস্থ বলে নয়, আমাকে একা থাকতে হবে বলে।
যাবার সময়ে স্ত্রী ব্যাকুল হয়ে বললেন, বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। তোমায় একা ফেলে যেতে কিছুতেই মন সরছে না। খুব সাবধানে থেকো। যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব।
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, কিচ্ছু ভেবো না। আমি একজন পুলিশ অফিসার। কেউ না থাক সঙ্গে রিভলভার আছে।
বললাম বটে কিছু ভেব না। কিন্তু নিজেই কিরকম দুর্বল হয়ে গেছি।
রিভলভার? রিভলভার কি সব ক্ষেত্রে কাজ দেয়?
.
গভীর রাতে পায়ের শব্দ
নোটনকে নিয়ে আমার স্ত্রী চলে যাবার পরই আমি যেন কিরকম অসহায় হয়ে পড়লাম। আমি কিছুতেই আর এ বাড়িতে টিকতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু যেন ঘটতে যাচ্ছে। একটা কথা ভেবে অবাক হলাম–কী অদ্ভুতভাবে একে একে সবাইকে চলে যেতে হলো। ছোটো ভাই গেল, মেজো ভাই গেল, শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী-পুত্রও গেল। ব্যাপারটা কি? মনে হলো কোনো অশুভ শক্তি পরিষ্কার মতলব করে একে একে সবাইকে সরিয়ে দিচ্ছে। একটি মাত্রই উদ্দেশ্য–আমাকে একা রাখা। আর তখনই আমার জীবনহানির ব্যাপারে হেরম্ব জ্যাঠার সাবধানবাণী মনে পড়ল–এক মাসের মধ্যে জীবন সংশয় হতে পারে। এই সময়টায় যেন কখনো একা না থাকি।
কথাটায় তখন গুরুত্ব দিইনি। এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। ভয় পাচ্ছি।
আবার এটাও পরিষ্কার নয়–কিসের জন্যে ভয়? এখানে আপাতত একা থাকলেও পাড়া প্রতিবেশী আছে। দুবেলা তারা আমার খোঁজ-খবর নেয়। আমিও যাই তাদের বাড়ি। কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বিপদের আভাস পর্যন্ত নেই, যত ভয় শুধু আমার বাড়ির ভিতরেই। এইটুকু নিশ্চিতভাবে বুঝেছি ঐ নেপালী ছোঁড়াটাই আমার কাছে অস্বস্তির কারণ। ওর হাবভাব, চাল-চলন কেমন যেন অদ্ভুত। তার চোখ দুটো ঠিক মানুষের চোখ নয়। তার চোখের দৃষ্টিতে মরা জন্তুর চাউনি। অথচ সে বাড়ির কাজকর্ম করে, আমার ছেলের সঙ্গে খেলা করে, ঘুড়ি ওড়ায়।
তাহলে? তাকে ভয় কিসের জন্যে?
এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারি না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি শ্রীযুক্ত বাবু সুশান্তকুমার সরকার, কলকাতার পুলিশ অফিসার–এই আমি কিন্তু এই খালি বাড়িতে টিকতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে এখন অকাল অপমৃত্যুর ভয় পাচ্ছি। স্পষ্ট দেখছি–দুয়ারে মৃত্যুর দূত দাঁড়িয়ে।
প্রণবেশটাও যদি এই সময়ে এসে পড়ত!
ওরা চলে গেছে বেলা বারোটার সময়ে। যাবার আগে আমার স্ত্রী দুবেলার মতো বেঁধে দিয়ে গেছে। কাজেই আজকের দিনটা চলে যাবে। কাল থেকে আমাকেই যা হোক কিছু রাঁধতে হবে।
ওরা চলে যাবার পর আমি সারা দুপুর ঘরে বসে রইলাম। আর লক্ষ্য রাখলাম সুব্বার দিকে। বাঁচোয়া সে একবারও আমার সামনে আসেনি। যদিও জানি সে বাড়িতেই আছে।
কেমন করে জানলাম ও বাড়িতে আছে? ঠিক বলতে পারি না। তবে ইদানিং টের পাই ও বাড়িতে থাকলে বাড়ির মধ্যে বাতাসটা কিরকম ভারী হয়ে থাকে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও বাড়িতে থাকলে পরিষ্কার বুঝতে পারি এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট, কড়ি, বরগা, এমনকি কুয়োর জল পর্যন্ত থিরথির করে কাঁপে। আজ এখনও কাঁপছে। তাই বুঝতে পারছি ও বাড়িতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে, কী করছে জানি না।
হঠাৎ আমার দম বন্ধ হয়ে এল। মাথাটা কিরকম ঝিমঝিম করতে লাগল। আমি সচকিত হলাম–পায়ের শব্দ পাচ্ছি…সে শব্দ কখনোই তেরো বছরের ছেলের পায়ের শব্দ নয়– যেন একটা ভারী বোঝা টেনে নিয়ে যাবার শব্দ।…বুঝলাম রাজু সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। ও এল। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে ও একবার দাঁড়াল। আমার ঘরের দিকে তাকাল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমার বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠল।
ও কি আমায় দেখে হাসল? ও কি হাসতে জানে? ওকে তো কখনো হাসতে দেখিনি। ওটা কি হাসি? দাঁতের মতো কতকগুলো কী যেন ওর ঝুলে-পড়া ঠোঁটের ওপর ঝিকঝিক্ করে উঠল। আমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।
তারপরেই শুনলাম ধুপধাপ শব্দ করে ও ছাদে চলে গেল। ছাদটা ওর বড় প্রিয় জায়গা।
বিকেলে জোর করে একটু বেরোলাম। কতক্ষণ আর ঘরে একা চুপটি করে বসে থাকা যায়?
কোথায় যাব? কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে কী খেয়াল হলো বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে যে সরু রাস্তাটা গেছে, সেই রাস্তায় হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
কাজটা ভালো করিনি। কেননা তখন সন্ধের মুখ। অন্য কিছুর ভয় না পেলেও সাপের ভয় তো আছে। টর্চটাও আনিনি।
কিন্তু কেন এই অসময়ে এই পথে এলাম? বোধহয় মনের মধ্যে কালকের বিকেলের ঘটানাটা কৌতূহলী করে তুলেছিল। ঐ যে রাজু সুব্বা ঐ পথে যাচ্ছিল আর পাখির ঝাঁক ভয়ে চিৎকার করে ওকে তাড়া করছিল! বোধহয় ভেবেছিলাম ঐ পথে কী আছে তা দেখতে হবে।
বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছি, হঠাৎ দেখলাম একটা লোক–হ্যাঁ, লোকই–আমার সামনে সামনে হেঁটে চলেছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই সন্ধেবেলায় কে ওদিকে যাচ্ছে? একটু ঠাওর করতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ও রাজুই। ঐ যে ওর নারকেলের মতো মাথা, রোঁওয়া রোঁওয়া চুল।
কিন্তু রাজু হঠাৎ এত বড়ো হয়ে গেল কি করে? আমি কি তবে ভুল দেখছি? চোখ বগড়ে স্পষ্ট করে তাকালাম। হ্যাঁ, রাজুই।
আমি ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু না ডেকে ওর কাছে যাবার জন্যে জোরে হাঁটতে লাগলাম। অবাক কাণ্ড–যতই জোরে এগোচ্ছি ততই ও দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে।
একটা কুকুর আসছিল সামনে দিয়ে। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, কুকুরটা রাজুকে দেখেই কেঁউ কেউ শব্দে ভয়ার্ত চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল।
কুকুরটা অকারণে ভয় পেল কেন? রাজু তো ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম।
সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই রাজুর ঘরে ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে নিজের ঘরে ঢুকে খিল বন্ধ করে দিলাম।
রাজু তখন বাড়ি ছিল না। ও আজকাল কখন কোথায় যায় কিছুই জানায় না। ও আমাকে কেয়ারই করে না।
অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি। রাত নটা নাগাদ বাইরের দরজায় খিল দেবার শব্দ পেলাম। বুঝলাম শ্রীমান রাজু ফিরলেন। অমনি আমার বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগল। এই রহস্যময় ছেলেটার সঙ্গে আমায় একা সারারাত কাটাতে হবে! আগে মনে হতো ও আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে ও সবই করতে পারে। ওর ঐ হাড়-বেরকরা শরীরে অমিত শক্তি। যদি চোখের ভুল না হয়ে থাকে তা হলে আজই সন্ধেবেলায় আমবাগানের দিকে যেতে গিয়ে দেখেছি ওর অস্বাভাবিক লম্বা দেহটা। অস্বাভাবিক মানে–ওর বয়সী ছেলে অত লম্বা হতে পারে না। আর ও মোটেই লম্বা নয়। অথচ সে যে রাজুই তাতে সন্দেহ মাত্র ছিল না। এখন বুঝতে পারছি রাজু বলে যে ছেলেটাকে বিশ্বাস করে বাড়িতে এনেছিলাম সে অন্য ছেলেদের মতো নিতান্তই রক্তেমাংসে গড়া বালকমাত্র নয়। ওর ভেতর একটা পিশাচ লুকিয়ে আছে। এখন আমার স্থির বিশ্বাস হয়েছে–প্রথম দিন সন্ধেবেলা আমি যখন লিখছিলাম, রাজুই তখন নিঃশব্দে পিছন থেকে এসে আলো নিভিয়ে দিয়েছিল আমায় গলা টিপে মারবার জন্যে। এমনিতে সে স্বাভাবিক। কিন্তু যখন হিংস্র হয়ে ওঠে তখন ওর চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সেদিন নোটন যে জ্বলন্ত চোখ দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল সম্ভবত সে চোখ রাজুরই।
এরপরই ছোটো বৌমা রাজুকে দেখেছিল ঘরের মধ্যে দুহাত বাড়িয়ে ঢুকতে। রাজু যে আমাকে মারতেই ঢুকেছিল ছোটো বৌমা সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ।
কিন্তু কেন? কেন আমায় মারতে চায়? ও যদি সত্যিই কোনো অশুভ আত্মার দেহ হয় তাহলে ও কেন নিজে থেকেই এল আমার সঙ্গে সুদূর নেপাল থেকে এই গ্রামে? আমাকে মেরে ফেলার জন্যে? আবার সেই একই প্রশ্ন থেকে যায় কেন? কার কাছে আমি কী অপরাধ করেছি?
ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো কেউ যেন দরজা ঠেলছে। আমি কান খাড়া করে রইলাম। তারপর পরিষ্কার শুনলাম কেউ যেন ভারী ভারী পায়ের শব্দ করে আমার ঘরের সামনে চলাফেরা করছে। ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। তবুও মড়ার মতো পড়ে রইলাম। একটু পরে শুনলাম পায়ের শব্দটা নিচে নেমে যাচ্ছে।
তারও কিছুক্ষণ পরে শুনলাম নিচের খিড়কির দরজাটা কেউ খুলল।
দরজা কে খুলতে পরে রাজু ছাড়া? এত রাত্রে ও কোথায় বেরুচ্ছে?
এবার আমি এক লাফে উঠে পড়লাম। সাহস সঞ্চয় করলাম। মনকে বোঝালাম– এটা বিজ্ঞানের যুগ–আর আমি একজন নামকরা পুলিশ অফিসার। আমি ভয় করব অলৌকিক ব্যাপারকে? রাজু আর যাই হোক তবু তো সে রক্তেমাংসে গড়া একটা বালক মাত্র! সে খায়, ঘুমোয়, আমার ছেলের সঙ্গে খেলা করে। তা হলে তাকে এত ভয় কিসের?
রিভলভারটা বালিশের তলা থেকে তুলে নিয়ে আমি দরজা খুলে বেরোলাম। লাইট জ্বালোম না।
সিঁড়ির ঘরের সামনে এসে দেখি রাজুর ঘরের দরজা ঠেসাননা। আস্তে আস্তে ঠেলোম। কাচ করে একটা শব্দ হলো। সেই সামান্য শব্দেই বুকটা কেঁপে উঠল। দরজা খুলে গেল। টর্চের আলো ফেললাম। কেউ নেই।
নিচে নেমে এসে দেখলাম খিড়কির দরজা হাট করে খোলা। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম কী করি? ঠিক করলাম রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে দেখি। এই তো সোজা রাস্তা–কোথায় কতদূর ও যেতে পারে?
বেরোচ্ছিলাম–তখনই মনে হলো ও যদি বাগানের রাস্তায় গিয়ে থাকে?
না, ও রাস্তায় আমি এত রাত্রে যাব না। ঐভাবে দরজাটা ঠেসিয়ে রেখেই ওপরে উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।
ভেবেছিলাম যতক্ষণ না ও ফেরে ততক্ষণ জেগে থাকব। কিন্তু কখন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না।
সকালে উঠে দেখি রাজু অন্য দিনের মতোই ঘরদোর ঝাট দিচ্ছে। ও আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। ভাবলাম ওকে জিজ্ঞেস করি কাল রাত্রে ও কোথায় গিয়েছিল? কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলতেও সাহস হলো না। কটা দিন যত দূরে দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।
কিন্তু নিচে নেমে আসতেই চমকে উঠলাম। উঠোনের ঠিক মাঝখানে ওটা কি?
অবাক কাণ্ড! কে একটা বলিদানের হাঁড়িকাঠ পুঁতে রেখেছে।
এর মানে কি? বাড়িতে হাঁড়িকাঠ কেন? কার এত বড়ো সাহস এটা এখানে পুঁতল?
তখনই হাঁকলাম, রাজু!
রাজু এসে দাঁড়াল। ভাবলেশহীন মুখ। ওর চোখের সাদা অংশটা ড্যাবড্যাব করে নড়ছে।
–তুই ওটা এখানে পুঁতেছিস?
–নেহি। বলে সে তখনই চলে গেল।
ওর এত দূর স্পর্ধা আমার সামনে আর দাঁড়াল না! অনুমতি না নিয়ে চলে গেল।
আমি তখনই হাঁড়িকাঠটা উপড়ে বাইরে ফেলে দিলাম।
.
রাত্রে বাগানের পথে
নোটন আর নোটনের মা চলে গেছে মাত্র তিন দিন। কবে ফিরবে জানি না। যদি নোটনের দিদিমার খারাপ কিছু হয় তাহলে কবে ফিরবে কে জানে! ছোটো ভাইরা চলে গেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। বিয়ে কি এখনও মেটেনি? মেজো বৌমাদের বিষয়-সম্পত্তি ভাগ হতে আর কতদিন লাগবে? আমি তো আর এভাবে একা থাকতে পারি না। অথচ আমাদের পাড়াতে প্রতিবেশীরা রয়েছে। তাদের কাছে যাই আসি। ওদের এত কাছে থেকেও আমি কী নিদারুণ আতংকের মধ্যে রয়েছি, ওরা তা ভাবতেও পারে না। ওদের কিছু বলতেও পারি না। কেননা বললে ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না।
আমি এখন নিজের ঘরেই স্টোভ জ্বেলে যা হোক কিছু বেঁধে নিই। একা রান্নাঘরে যেতে সাহস হয় না। রাজুর খাবারটা রান্নাঘরে রেখে আসি। আমি যে ভয়ে ভয়ে আছি রাজু তা বুঝতে পারে।
এখন আবার মাঝে মাঝেই আর একটা প্রশ্ন জাগে, হাঁড়িকাঠটা পোঁতার কারণ কী? উত্তর পাই না। তখন আবার মন থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলি।
বিকেলে একটু বেরোই। বড়ো রাস্তাটা ধরে হাঁটি। সন্ধে হবার আগেই বাড়ি এসে ঢুকি। তখন বাইরে থাকতে ভয় করে। আবার বাড়িতে থাকতেও ভয়। বাড়িতে তো সেই মূর্তিমান আতঙ্কটি রয়েছে। সে বাড়ি থাকলেও ভয়–বাড়ি না থাকলেও ভয়। কোথায় কী মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে!
সেদিন রাত তখন সবে নটা। এরই মধ্যে পাড়া নিঝুম। আমি যৎসামান্য রাতের খাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত দশটা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গেল। ব্যস্ ঘুরঘুট্টে অন্ধকার।
সন্ধের পর থেকেই বাড়ির বাতাসটা ভারী হয়ে আছে। বাতাস ভারী হলেই নিশ্বাসের কষ্ট হয়। একটা চাপা কাশি গলা চেপে ধরে। এখন তাই হচ্ছে। বুঝলাম রাজু বাড়ি আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানি না। কেননা সন্ধে পর্যন্ত ও ওর ঘরে ছিল না। বইটা বুকের ওপর রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মনে হলো বারান্দার দিকের জানলাটা কেউ ভোলার চেষ্টা করছে। আমি রিভলভারটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত হয়ে শুয়ে রইলাম।
শব্দটা থেমে গেল। তারপরই নিচের দরজাটা খোলার শব্দ। আমি লাফিয়ে উঠে রাস্তার দিকে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম রাজু বেরোচ্ছে পা টিপে টিপে। আরও দেখলাম ও যাচ্ছে পিছনের রাস্তা দিয়ে বাগানের দিকে। তখনই আমি টর্চ আর রিভলভার নিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম।
আমি জানি কতবড়ো মারাত্মক ভুল করে সর্বনাশের পথে এগোচ্ছি। কিন্তু আজ আর কোনো বাধাই মানলাম না। আমার পৌরুষ অথবা নিয়তি আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল।
বিশ হাত দূরে রাজু চলেছে। আমিও নিঃশব্দে ওর কিছু পিছু চলেছি। রাজু বাগানের ভেতর ঢুকল। আমিও ঢুকলাম। শুকনো পাতায় যাতে শব্দ না হয় তার জন্যে খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগলাম। অন্ধকারে রাজু বার বার হারিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমি হুঁশিয়ার। আবার রাজুর সেই ঢ্যাঙা চেহারা। আমার গা শিউরে উঠল। কিন্তু না, আজ আমায় একটা ফয়শালা করতেই হবে। কোথায় ও যায় দেখতেই হবে। নিজেকে ঝাঁকানি দিয়ে দেখে নিলাম–আমি ঠিক আছি।
প্রায় মিনিট দশেক এগোবার পর দেখি এক জায়গায় আলো জ্বলছে। পরে বুঝলাম আলো নয়, আগুন। অবাক হলাম। নির্জন বাগানে আগুন জ্বালল কে? ওদিকে রাজুর গতি দ্রুত হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কি আমাকেও কেউ টানছে?
আর একটু এগোতেই দেখলাম একজন সন্ন্যাসী ধুনি জ্বেলে এই দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি চট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম। চোখের সামনেই দেখলাম রাজু গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে লম্বা হয়ে আছড়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই ধুনির আগুনের আভায় সন্ন্যাসীকে ভালো করে দেখতে পেলাম। চমকে উঠলাম–এ কী! এ যে কাঠমাণ্ডুর পাহাড়ের সেই তান্ত্রিক! কিন্তু
কিন্তু কী করে সে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে পথ চিনে চিনে আমার দেশে হাজির হলো?
আমার হাত-পা কিরকম অবশ হয়ে এল। বুঝলাম এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমি জ্ঞান হারাব। আর জ্ঞান হারালেই তান্ত্রিকের হাত থেকে রেহাই নেই।
আমি পায়ে পায়ে পিছোতে লাগলাম। একবার রাজুর দিকে তাকালাম। দেখি একটি কংকালসার দেহ–দেহ নয়, মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
সে রাত্রে কি করে যে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম মনে করতে পারি না। তবু ওরই মধ্যে ইচ্ছে করেই বাইরের দরজায় খিল এঁটে দিয়েছি যাতে রাজু আর বাড়ি ঢুকতে না পারে। নিজের ঘরের দরজাতেও ভালো করে খিল দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ততক্ষণে কারেন্ট এসে গেছে।
ঘুমের ঘোরের মধ্যেই একটা কথা মনে হতে চমকে উঠে বসলাম। মেলার কদিন ঐ বাগানের মধ্যে দিয়েই লোকজন নদীর ধারে জোড়া বটতলায় পুজো দিতে গিয়েছিল। তখন বাগানে কেউ এই তান্ত্রিককে দেখেনি। সব তান্ত্রিক, সাধু সন্ন্যাসীই ছিল নদীর ধারে। সম্ভবত ইনিও ওখানে ছিলেন।
মেলা তো শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন হলো। সব সাধুরাই ফিরে গেছেন। ইনি যাননি কেন? কেনই বা এখন বাড়ির কাছে আমবাগানে এসে একটা আস্তানা গেড়েছেন? রাজুর সঙ্গেই বা চেনা হলো কী করে? রাজু মেলায় চুপিচুপি একা গিয়েছিল। সে কি তবে তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করতে? তবে কি রাজু ঐ তান্ত্রিকেরই পাঠানো অলৌকিক জল্লাদ? আমাকে শেষ করে দেবার জন্যে অথবা আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে নিজেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে? রাজু শুধু ওঁকে নিশানা দিয়ে যাচ্ছে? তাহলে–তাহলে নির্জন বাড়িতে আমাকে বলি দেবার জন্যেই কি হাঁড়িকাঠ পোঁতা হয়েছিল?
.
সিঁড়ির ঘরে চোর?
পরের দিন সকালে দেখলাম বাইরের দরজার খিল বন্ধই আছে। বুঝলাম রাজু ফেরেনি। অথবা বাড়ি ঢুকতে পারেনি। খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম।
একটু বেলা হলে পাড়ার একটা ছেলেকে ডেকে বললাম, শুনছি একজন সাধু নাকি পিছনের বাগানের শেষের দিকে বসেছেন। একটু দেখে এসো তো। ছেলেটা তখনই যাচ্ছিল, ফের ডেকে বললাম, ওঁর কাছে যাবার দরকার নেই। দূর থেকে দেখো।
ঘণ্টাখানেক পরে ছেলেটা ফিরে এসে জানাল বাগানে কেউ নেই।
–কেউ নেই! তুমি জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলে তো?
ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, পোড়া কাঠ, ছাই পড়ে আছে দেখলাম।
নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, আপদ বিদেয় হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজুও।
কিন্তু সেদিনই সন্ধেবেলায় ছেলেটি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল–সাধুবাবা আবার এসেছেন। ধুনি জ্বালিয়ে বসেছেন। এবার অত দূর নয়, আরও কাছে।
আমি চমকে উঠলাম। ওকে বললাম, ঠিক আছে।
ছেলেটা চলে গেলে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। অদ্ভুত তো ঐ তান্ত্রিকটা। কেমন ধীরে ধীরে তিন মাইল দূরে জোড়া বটতলা থেকে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কেউ বাধা দেবার নেই। এবার তো বাড়ি এসে ঢুকবে।
তাহলে একা আমি এখন কী করব?
তখনই সাহস এনে মনকে বোঝালাম–এটা যে নেপালের নির্জন অরণ্য বা পাহাড়ের গুহা নয়, এটা যে কলকাতার কাছেই কোনো লোকালয়–একটা হাঁক দিলে দলে দলে লোক ছুটে আসবে, এটা কি তান্ত্রিক বাবাজি জানেন না? নাকি লোকবল, অস্ত্রবলের চেয়েও ওঁর কাছে আরও কোনো অব্যর্থ ভয়ংকর মারণাস্ত্র আছে যা দিয়ে আমায় শেষ করে দিতে অসুবিধে হবে না? চোখের সামনেই তো দেখলাম কী ক্ষমতায় রাজুকে অস্ত্র বানিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিল! রাজু কি সত্যিই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, না কোনো মৃতদেহ? তান্ত্রিকের পায়ের কাছে ও যখন আছড়ে পড়েছিল তখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম ওর দেহে প্রাণ ছিল না। একটা শুধু চামড়া-ঢাকা কংকাল যেন ঝন্ করে পড়ে গেল।
আরও সন্দেহ হচ্ছে কাঠমাণ্ডুর হোটেলের জং বাহাদুরও ঐ তান্ত্রিকের দলেরই একজন। তান্ত্রিকের সঙ্গে সেইই হয়তো যোগাযোগ করে রাজু সুব্বা নাম দিয়ে একটা জীবন্ত কংকালকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছিল। আর তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল গুহার মুখে সেই ঝুলন্ত কংকালটা। বাতাসে দুলছে।
যাক, রাজু বিদেয় হয়েছে। আজ দুদিন ও আর আসেনি। বাগানে তান্ত্রিকের কাছেও ওকে দেখা যায়নি। দেখা গেলে পাড়ার ছেলেটা বলত।
.
আজ রাত্রে পাড়ার একজনদের বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন ছিল। আমি একা থাকি বলে মাঝে মাঝে নেমন্তন্ন পাই।
রাত মাত্র আটটা।
আকাশে ঘন মেঘ থমথম্ করছে। এখনি হয়তো বৃষ্টি নামবে।
আমি তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।
রাস্তা ঘোর অন্ধকার। কোনোরকমে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বাড়ি এসে তালা খুলে ঢুকলাম।
একতলার উঠোন পার হয়ে ডান দিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সবে অর্ধেক উঠেছি– ওপরে সিঁড়ির ঘরে যেখানে সুব্বা থাকত সেখানে যেন কার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।
অবাক হলাম। তালাবন্ধ বাড়িতে কে কিভাবে আসতে পারে? থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোর নয় তো? ছাদ দিয়ে উঠে এসেছে?
ইস্! রিভলভারটাও কাছে নেই। এদিকে সদর দরজাটাও ভুলে খুলে এসেছি। এখন ওপরে উঠব, না পালাব? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কয়েক মুহূর্ত ধরে ভাবলাম। আর ঠিক তখনই সিঁড়ির ওপরে নজর পড়ল। অন্ধকারের মধ্যে দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আমার গায়ের প্রত্যেকটি লোম খাড়া হয়ে উঠল। ও কার চোখ?
কিছু ভেবে দেখবার আগেই দেখি চোখ দুটো নেমে আসছে। শুধু চোখ নয়, একটা ছেলের দেহ। সে দেহে এতটুকু মেদ নেই, মাংস নেই, হয়তো বা রক্তও নেই। শুধু কালো কুচকুচে চামড়া দিয়ে ঢাকা। চিনতে পারলাম নারকেলের মতো মাথাটা দেখে।
রাজু সুব্বা!
তিন দিন পর কোথা থেকে রাজুর আবির্ভাব?…কিন্তু–এ কি সেই রাজু, না তার প্রেতাত্মা?
দুটো সরু সরু হাত বাড়িয়ে রাজু এগিয়ে আসছে। আগে দুবার চেষ্টা করেছিল পিছন থেকে। এবার আর চুপি-চুপি লুকিয়ে নয়, একেবারে সামনে মুখোমুখি।
পালাতে গেলাম। কিন্তু পা দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আমি সিঁড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু করার নেই।…
রাজু মুখে একরকম অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওর দুটো হাত তখন আমার গলার কাছে। আমি নিজের দুহাত দিয়ে ওর সরু সরু হাত দুটো চেপে ধরতে গেলাম কিন্তু বরফের ছুরির মতো ওর হাত দুটো আমার হাত অবশ করে দিল। আমি শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠলাম বাঁচাও।
কাকে উদ্দেশ করে চেঁচালাম তা জানি না, তবে সাড়া পেলাম তখনি।
সুশান্ত, তুমি কোথায়, বড্ড অন্ধকার!
চমকে উঠলাম! এ যে প্রণবেশের গলা!
আমি দ্বিগুণ জোরে আবার চেঁচিয়ে উঠলাম–বাঁচাও!
সঙ্গে সঙ্গে নিচে থেকে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল সিঁড়ির ওপর।
–এ কী! সুশান্ত! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? কি হয়েছে?
হঠাৎ জ্বলন্ত চোখ দুটো নিভে গেল। টর্চের আলোয় রাজুকে পরিষ্কার দেখা গেল। রাজু আমাকে আর প্রণবেশকে ধাক্কা দিয়ে বিরাট এক লাফ মেরে নিচে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।
.
শেষ কথা
রাজু সুব্বাকে নিয়ে এই অলৌকিক কাহিনিও আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছি। তবে শেষটুকু লেখা হয়নি।
পরের দিনই সবাই ফিরে এল। সকলেই আমার এ কদিনের ঘটনা শুনল। ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী বলল–আমি তখনই বুঝেছিলাম ও ছেলেটা মানুষ নয়, সাংঘাতিক কিছু। যাক, খুব বেঁচে গেছেন।
আমার স্ত্রী তখনো ভয়ে নির্বাক।
তখনও তিনদিন ছুটি বাকি ছিল। ভেবেছিলাম প্রণবেশকে নিয়ে এই তিনটে দিন এখানেই কাটিয়ে যাব। কিন্তু সন্ধেবেলায় সেই ছেলেটা এসে খবর দিল–সাধু আজও এসে বসেছে। এবার বাড়ির আরও কাছে।
শুনে সবারই মুখ শুকিয়ে গেল। এ কি আমায় শেষ না করে এখান থেকে যাবে না?
সেদিনই আমার স্ত্রী সুটকেস গুছিয়ে নিলেন। বললেন–আর নয়। কাল ভোরের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরে চলল। ওসব পাহাড়ে তান্ত্রিকদের হাত থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না।
ভয়ে ভয়ে ভোরবেলাতেই একরকম পালিয়ে এলাম বলা চলে। যথাসময়ে ট্রেন এল। তাড়াতাড়ি সামনে যে বগি পেলাম তাতেই উঠে পড়লাম।
গার্ড হুইশল দিল। সবুজ ফ্ল্যাগ দুলে উঠল।
হঠাৎ নোটন চেঁচিয়ে উঠল–বাবা, দ্যাখো দ্যাখো সুব্বা!
জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি একটা কংকাল যেন অস্বাভাবিক জোর ছুটে আসছে ট্রেন ধরার জন্যে। অন্তত পিছনের বগিতেও যদি উঠতে পারে। কিন্তু তখনই ট্রেন চলতে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেল। রাজু অল্পের জন্যে ট্রেনের নাগাল পেল না।
.
প্রণবেশ বলল–সুব্বা তোমাকে ছাড়বে না দেখছি।
নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছেছি। কিন্তু এখনও সুস্থির হতে পারিনি। কি জানি রাজু আবার এখানেও এসে না পড়ে।
[শারদীয়া ১৩৯৭]
আতংক যখন হিলিতে
০১.
পাহাড়ি রাস্তায় হাজার ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। খুব অভিজ্ঞ ড্রাইভার না নিলে বিপদের সম্ভাবনা। তা আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা ভালোই গাড়ি চালাচ্ছে। ‘শার্প কার্ড’ এর মতো বিপদসংকুল জায়গাগুলোও গোঁয়ার ড্রাইভারের মতো ফুল স্পিডে না চালিয়ে স্পিড কমিয়ে খুব সাবধানে চালায়। এতে আমরা খুশি। শিলিগুড়ি থেকে ওঠার সময় থেকেই আমরা ওকে বলেছি–তাড়াহুড়োর কিছু নেই। আমরা স্রেফ বেড়াতে বেরিয়েছি। এই সময়ে পাহাড়ে ফুলের শোভা বিশেষ করে রডোড্রেনড্রনের সমারোহ দেখবার মতো।
বিক্রমের অবশ্য এসব কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, নিজের ইচ্ছেমতো যেমন স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিল তেমনি চালিয়ে যেতে লাগল।
গাড়িটা আমরা ভাড়া করেছিলাম শিলিগুড়ি থেকে। আমরা বার্সে যাব শুনে গ্যারেজের মালিক একটু চুপ করে ছিলেন। শান্তনু জিগ্যেস করেছিল–কী ভাবছেন? কোনো অসুবিধে আছে?
গ্যারেজের মালিক বলেছিলেন–আর কিছু নয়, অত উঁচুতে—
উঁচু আর এমন কী? ৯০০০ ফুট।
মালিক হেসে বলেছিলেন–হিলেই তো ৯০০০ ফুট। তারপর চার কিলোমিটার ঢাল। গাড়ি যাবে না। হাঁটতে পারবেন তো?
শান্তনু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব পারব।
ওখানে ভালো হোটেল-টোটেল আছে তো? মানে বেশ আরামদায়ক। মাংকিক্যাপ থেকে শুধু ঠোঁট দুটি বার করে প্রশ্ন করেছিলেন বিরূপাক্ষদা।
হোটেল? পাশের দুজন ড্রাইভার শ্রেণির লোকের দিকে তাকিয়ে হাসলেন গ্যারেজের মালিক।
হোটেলের আশা করে যাবেন না, স্যার। পথে সরাইখানা যদি দু-একটা পান তাহলে ভাগ্য বলতে হবে।
তা হলে শান্তনুভায়া, আমি ফিরে চললাম।
সে আবার কী? আপনারই উৎসাহে–
হ্যাঁ, পাহাড়ে সমতলে বেড়াতে ভালোবাসি বলে এই দুর্ধর্ষ শীতে হোটেল পাব না! নিউমোনিয়ায় পৈত্রিক প্রাণটা এই পাহাড়ের রাজ্যে হারাব নাকি?
অবস্থা বুঝে গ্যারেজের মালিক ভরসা দিয়ে বললেন-হোটেল নিশ্চয় পাবেন তবে বার্সেতে নয়। বার্সেতে পৌঁছাবার আগেই। সেখানেই রাতটা আরাম করে কাটিয়ে পরের দিন সকালে ফের রওনা দিয়ে বার্সেতে পৌঁছে যাবেন।
এ কথায় বিরপাক্ষদা তখনকার মতো শান্ত হলেও ড্রাইভারকে নিয়ে ঘটল বিপত্তি।
ভালো ড্রাইভারের কথা বলতে গ্যারেজের মালিক বিক্রমকে দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু বিক্রম গোড়া থেকে সেই যে মুখ ফিরিয়ে বসেছিল তখনও তেমনি রইল।
কি রে যাবি? জিগ্যেস করলেন মালিক।
বিক্রম মাথা নাড়ল। যাবে না।
কেন?
তার উত্তরে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক কথা বলল যা থেকে বোঝা গেল ও যেতে চায় না এটাই আসল কথা।
তারপর আমরা বেশি টাকার লোভ দেখালেও ও যখন যেতে রাজি হল না তখন আমরা মুশকিলে পড়লাম। কেন যাবে না তার কারণ কিছুই বোঝা গেল না। শুধু বিক্রমই নয়, সংক্রামক ব্যাধির মতো ‘না’ কথাটা ছড়িয়ে গেল সব ড্রাইভারের মুখে।
অনেক অনুরোধে গ্যারাজের মালিক আমাদের আড়ালে বিক্রমকে বোঝাতে লাগলেন। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, এক কাজ করুন। আপনাদের তো উদ্দেশ্য এই সময়ে পাহাড়ের ফুলের শোভা দেখা। তাহলে ‘সোমবারিয়া’, ‘হিলে’ হয়ে ‘বার্সে’ না গিয়ে জোংরি হয়ে ইয়ম পর্যন্ত গাড়িতে যান। তারপর কিছুটা হাঁটা পথ। এই পথ দিয়ে যেতে সব ড্রাইভার রাজি। এখানেও প্রকৃতির অফুরন্ত শোভা। যে দিকেই তাকাবেন দেখবেন সবুজের সমারোহ। এত সবুজ সমতল কোথাও নেই।
শান্তনু ঠোঁটের ফাঁকে হেসে ববল, সবই তো ঠিক। কিন্তু আসল কথাটাই চেপে গেলেন। ঐ যে বললেন ‘কিছুটা পথ’–সেটা কি সঠিক জানেন কতটা?
মালিক মুখ কাচুমাচু করে বললেন, না, ঠিক জানি না, তবে–
তবে-টবে নয়, আমি জানি পাক্কা ছাব্বিশ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হবে। আর সে পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। রীতিমত নির্জন।
মালিক লজ্জিত হয়ে বললেন–তা হবে।
শান্তনু বলল, শুনুন, আমরা বুঝতে পারছি না কোনো ড্রাইভার ঐ পথ দিয়ে যেতে চাইছে না কেন। তবে ঐ পথ দিয়েই আমরা ‘বার্সে’ যাব। আমাদের যেমন প্রোগ্রাম করা আছে তেমনিই থাকবে। দেখি তাহলে অন্য কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কিনা।
আমরা ফিরে যাবার জন্যে উঠতেই মালিক বললেন, দাঁড়ান, আর একবার কথা বলে দেখি। আবার কথা বলতে উঠলেন। এরপর কাজ হল।
বিক্রম থাপা রাজি। তবে সন্ধের আগেই বার্সের অনেক আগে ‘হিলে’ পৌঁছাতে চায়। তার বেশি যাবে না।
শান্তনু বলল, পাহাড়ে রাস্তায় এমনিতেই তো সন্ধের সময় গাড়ি চালানো নিষেধ।
বিক্রম বলল, তা তো সকলেরই জানা, আমি বলছি পথে কোথাও হল্ট করা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘হিলে পৌঁছতে হবে।
বেশ, তাই হবে।
আর একটা কথা, স্যার। পথে যদি কেউ এমনকি পুলিশও গাড়ি দাঁড় করিয়ে ন্যাকামি করে জিগ্যেস করে আজ কী বার? বলবেন, সরি, খেয়াল নেই। কিছুতেই যেন বলে ফেলবেন না–আজ শনিবার! প্লিজ স্যার, একথাটা মনে রাখবেন।
জিগ্যেস করলাম, কেন?
আমাকে থামিয়ে দিয়ে শান্তনু বিক্রমকে বলল, ঠিক আছে। রাজি।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার! বলে বিক্রম এবার চটপট গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিল।
নিচু গলায় বললাম, হঠাৎ বার নিয়ে লুকোচুরি?
ফিসফিস করে শান্তনু বলল, এসব অঞ্চলে কত রকমের কুসংস্কার।
এই সময়ে বিরূপাক্ষদা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, সবই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলে হবে না, ভায়া। আমাদের যাত্রাটাই অপয়া। আমি তো গোড়া থেকেই বলছি, ফুল দেখতে হিমালয়ে! এমন কথা কে কবে কস্মিনকালে শুনেছে! তাও গরমকালে নয়, মার্চ মাসের গোড়ায়! মার্চ মাস তো ওখানে ভরা শীতের সময়। জানলার কাচটা ভালো করে ফেলে দাও না। শীতে মলাম যে!
বললাম, কাচ তো ফেলাই আছে।
তা হলে ঠান্ডা ঢুকছে কোথা দিয়ে?
কাচের শার্সিটা ঠিকমতো লাগেনি বলে শান্তনু খানিকটা কাগজ গুঁজে দিয়ে বাতাস আটকে দিল।
কী ঝকমারি রে বাবা! ফুল দেখতে পাহাড়ে! কেন আমাদের দেশে কি ফুল নেই? গোলাপ, বেল, জুই, গাঁদা, রজনীগন্ধা, টগর, ডালিয়া–
শান্তনু রাগাবার জন্য বলল, কিন্তু ম্যাগনোলিয়া, ম্যাপল, পাইন, ওক, ফার, আরও কত কী!
বললাম, আসল নামটাই তো বললে না—’রডোড্রেনড্রন’?
ওটা না দেখলে বোঝানো যাবে না।
বিরূপাক্ষদা এসব কথা বুঝতে চান না। তিনি যেন কোনো ভালো প্রস্তাবেও প্রথম থেকে বিরূপ। উৎসাহ করে কোনো প্রস্তাব দিলে উনি প্রথমেই বলে উঠবেন, ‘পাগলের প্রলাপ। তাই আমরা ওঁকে ‘বিরূপাক্ষ’র বদলে ‘বিরূপ’দা বলে ডাকি। ভালো কথাতেও উনি বিরূপ। অন্তত প্রথমটা। তবু কোনো দূরপথে যেতে গেলে ওঁকে না পেলে যেন মন ভরে না। ঐ যে ওঁর মাংকিক্যাপ, ঐ যে মাংকিক্যাপের উপর দিয়ে মাফলারটা ভালো করে জড়ানো, ঐ যে গলার সবচেয়ে ওপরের বোতামটাও আটকানো, ঐ যে হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুল সেকেলে অলেস্টার–এমন অদ্ভুত পোশাকে মোড়া মানুষের যেন তুলনা নেই। তিনি সাধারণত ধুতি পরেন। প্যান্ট পরার অভ্যাস নেই, কিন্তু যেহেতু পর্বত আরোহণ করতে চলেছেন, অতএব তাকে ফুল প্যান্ট পরতেই হয়েছে। কথায় বলে, ‘অনভ্যাসের ফোঁটা কপাল চচ্চড়’–তারও সেই দশা। প্যান্ট তার পেট থেকে নেমে নেমে যাচ্ছে–ঢলঢল করছে। আর উনি প্রতিনিয়তই থাক সে কথা।
এঁকে না হলে যেমন আমাদের চলে না তেমনি আমাদের না হলে ওঁরও চলে না। আসলে তিনি নিজেও ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তা বলে তার সমবয়সীদের সঙ্গে নয়, আমাদের মতো ছোকরাদের সঙ্গে।
শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি ক্রমশই ওপরে উঠছে। আবার তিস্তা। টানা দেখা দেয় না। মাঝে মাঝে অন্তর্ধান করে। আবার ক্ষণেকের জন্যে দেখা মেলে। এ যেন লুকোচুরি খেলা। একটু পরে পাওয়া গেল রংগীতকে। যেন তিস্তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি। উইন্ডস্ক্রিনের মধ্যে দিয়ে দেখছি। প্রকৃতির এই রূপ তো শস্যশ্যামল সমতলদেশে মেলে না।
ও বিরূপদা, আপনি ঢুলছেন!
বিরূপাক্ষদা অর্ধনিমীলিত চোখে একবার তাকালেন–ঢুলব না তো কী করব? তোমাদের মতো শুধু পাহাড় আর খাদ দেখব? কী দেখবার আছে? বলেই মাংকিক্যাপটা ঠিক করে আবার চোখ বুজলেন। চোখ বুজিয়েই বললেন, ও ড্রাইভার-ভায়া, চায়ের দোকান দেখলে একটু থামিও। তুমি যে পক্ষীরাজ ঘোড়া ছোটাচ্ছ!
বিক্রম থাপা উত্তর দিল না।
বললাম, এখানে চায়ের দোকান নেই, বিরূপদা। আপনি ঘুমোন।
কিন্তু–
সত্যিই তো! বড়ো জোরে চালাচ্ছে গাড়ি। আমরা তো বারণ করেছিলাম। তবু–কিসের এত তাড়া?
ভেবেছিলাম বিরূপাক্ষদা বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু না, হঠাৎ তিনি চোখ বুজিয়েই সেই একই কথা নিয়ে বকবক করে চললেন।–পাগল! পাগল না হলে কেউ এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় ফুলের বাহার দেখার জন্যে পাহাড়ে পাহাড়ে ছোটে!
বিরূপদা, কিছু বলছেন?
বলব আর কী! তোমাদের পাল্লায় পড়ে এই বয়েসে আমার লাইফ খতম হতে চলেছে।
কিন্তু আপনি তো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতে ভালোবাসেন।
হ্যাঁ, এক্সকারশান, অ্যাডভেঞ্চার আমি ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি। তবে তা ফুলের শোভা কিংবা নদীর কুলুকুলু গান শোনার জন্যে নয়। হ্যাঁ, বুঝতাম যদি বৃহৎ শিকারের জন্য কোথাও গেলাম–
‘বৃহৎ শিকার’ জিনিসটা কী, দাদা?
যা নিছক পাখি, খরগোশ মারা নয়। যা লেপার্ড, হিমালিয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের পিছু পিছু চেজ করতে করতে গুলি করে মারা।
অবাক হলে গেলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল বহুদিনের পরিচিত তার সেই গোল মুখ, ভারী গাল, মোেটা বেঁটেখাটো, থপথপে চেহারা যা কোনোরকমেই শিকারীর উপযুক্ত নয়।
শান্তনু বলল, কিন্তু আপনি কি জীবনে কোনোদিন বন্দুক ধরেছেন? গুলি ছোঁড়া তো পরের কথা।
এইবার বিরগদা চোখ মেলে তাকালেন, বললেন, আমি বন্দুক ধরতে যাব কেন? হান্টার’দের সঙ্গে থাকব। বাহবা দেব। সেটাও একটা কাজ। ফুটবল খেলায় দেখ না প্লেয়ারদের চেয়ে চেঁচাবার লোক অনেকগুণ বেশি। এও তেমনি।
হান্টার!–হাসলাম আমরা। কথায় জোর দেবার জন্যে বিরূপদা মাঝে মাঝেই প্রচলিত সহজ বাংলার বদলে ইংরিজি বলেন। যেমন একদিন বললেন, ‘নো নো, আমি ওর মধ্যে নেই।’ আর একদিন বললেন, আমার ‘ফাদার’ ছিলেন অহিংস প্রকৃতির মানুষ। ইত্যাদি।
হান্টারদের সঙ্গে থাকলে তো শুধু থাকাই হবে। শিকার করা হবে না।
তা না হোক এনজয় তো করা হবে।
এ যাত্রায় শিকারে যাওয়া হল না। তাহলে?
পারের বার অন্য কিছু ভাবব। তবে কিছুতেই ফুল দেখতে কিংবা পাহাড়ে সূর্য ডোবা দেখতে যাব না। এই দুটো ছাড়া যে কোনো অ্যাডভেঞ্চার করতে–
মানে–যেখানে ভয়-ভয়, গা-ছমছমে কিছু—
বুঝেছি, যেখানে ভয় থাকবে কিন্তু বিপদ থাকবে না। তাই তো?
বিরূপদা যেন ধরা পড়ে গেলেন। দাঁতের ফাঁকে একটু হাসলেন।
হঠাৎ বিক্রম গাড়ির স্পিড কমিয়ে হাত পিছনে ফিরিয়ে সবাইকে কম কথা বলতে ইঙ্গিত করল।
আমরা তো অবাক। এতখানি পথ। রহস্য-রসিকতাও করা চলবে না? কিন্তু কারণ জিগ্যেস করতে ভরসা পেলাম না। গাড়িতে উঠে পর্যন্ত যা গম্ভীর হয়ে আছে! গম্ভীর হয়ে থাকাই কি বিক্রম থাপার স্বভাব, না কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে ও! ঈশ্বর জানেন!
আমরা এখন আরও ওপরে উঠে এসেছি। রংগীত নদীর তীরে জায়গাটার নাম জোরথাং। দক্ষিণ সিকিমের একটি বড়ো ব্যবসাকেন্দ্র।
জায়গাটা ভালোই মনে হল। ঠিক করলাম এখানে নেমে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। কারণ পথে কোথাও এরকম জায়গা পাওয়া যাবে কি না কে জানে! গাড়ি থেকে নেমে একটা মোটামুটি রেস্টুরেন্ট গোছের চায়ের দোকান পাওয়া গেল। আমরা চারটে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
বিক্রম থাপা কিন্তু এখনও কোনো কথা বলছে না। একপাশে বসে খেতে খেতে কেবলই আকাশের দিকে তাকাচ্ছে।
আশ্চর্য! কী আছে আকাশে? এমন রৌদ্রোজ্জ্বল বেলা এগারোটায়?
হঠাৎ এই সময়ে বিক্রম এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসল।
ও যেখানে বসেছিল তার সামনেই হাত দু-একের ব্যবধানে হোটেলের ম্যানেজারের টেবিল। টেবিলে একটা প্লেটে কিছু মশলা, ক্লিপ করা কতকগুলো ফর্দ আর সরু একটা খাতা। আর একটা ডেস্ক-ক্যালেন্ডার! ড্রয়ারটা খোলা। এইমাত্র একজন খদ্দের পয়সা দিয়ে গেল। ড্রয়ারটা খুলে রেখেই ম্যানেজার কিচেনে ঢুকলেন বোধহয় তদারকি করতে। বিক্রম তার চেয়ার থেকে বডিটা তুলে এক মুহূর্তের জন্যে হাত বাড়াল। তার পরেই হাত গুটিয়ে চুপচাপ নিজের চেয়ারে বসে কফির পেয়ালায় চুমুক দিল।
কিছু বোঝবার আগেই বিরূপদা নিঃশব্দে আমার গায়ে আঙুলের খোঁচা দিলেন। চাপা গলায় বললেন, দেখলে আমাদের গুণধর মৌনীবাবা বিক্রমের খেলা? কিছু একটা হাতসাফাই করল।
শান্তনু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, কিছুই হাতসাফাই করেনি। ডেস্ক-ক্যালেন্ডারের বড়ো বড়ো অক্ষরে ছাপা SATURDAY কথাটা উল্টে দিয়ে চোখের আড়াল করে দিল।
কেন?
শান্তনু যথাসম্ভব নিচু গলায় বলল, তা বলতে পারব না। হয়তো ঐ কথাটায় ওর এলার্জি হয়। বলে হাসল।
এ আবার কী রহস্য রে বাবা! গজগজ করে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।
.
০২.
চা আর টুকটাক কিছু খেয়ে নিয়ে আমরা একঘণ্টার মধ্যে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। পেটে খিদে ছিল। কিন্তু বিরূপাক্ষদা বারবার সাবধান করে দিয়েছিলেন, ভারী কিছু খাবে না ভায়ারা। পথে-ঘাটে হালকা খাওয়াই উচিত।
তার এই সাবধানবাণীটা শিরোধার্য করে নিয়েছিলাম আমরা।
গাড়িতে উঠেই বিক্রম স্টার্ট করে দিল। তার যেন একমুহূর্ত বিলম্ব সহ্য হচ্ছিল না। কীসের যে এত তাড়া বুঝতে পারছিলাম না। পাহাড়ের গা বেয়ে নুড়ি বিছানো আঁকাবাঁকা পথ ক্রমশ উঠে গেছে ওপরের দিকে। এই ভেবে আশ্চর্য হই যে, পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা এই দুর্গম জায়গায় কে তৈরি করেছিল এই পথ! কী করে তারা জেনেছিলেন এই পথের শেষ ঠিকানা কোথায়? সত্যি, ভাবতে গিয়ে অবাক হয়ে যাই।
এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়। প্রকৃতি যেন খেয়ালের বশে পর পর পাথর, গাছপালা দিয়ে দুর্লঙ্ প্রাচীরের পর প্রাচীর সৃষ্টি করে রেখেছেন। মনে হচ্ছে পাঁচিল টপকালেই অজানা রহস্যময় কোনো জগৎ খুঁজে পাওয়া যাবে।
ওপরে উঠতে উঠতেই দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের ঢালে অনেক নীচে ছোটো ছোটো ঘরবাড়ি। সবুজের পটভূমিতে আঁকা যেন অপরূপ ছবি। কিন্তু–ওগুলো কী?
এত ওপর থেকেও দেখা যাচ্ছি প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ওপরে বাঁশে বেঁধে ওড়ানো হয়েছে রঙ-বেরঙের লম্বা কাপড়ের পতাকা। দূর থেকে ভারী সুন্দর লাগছে দেখতে।
আমি বিক্রমকে জিগ্যেস করিনি। (জিগ্যেস করে লাভ নেই। কারণ ও তো কথাই বলছে। )। কিন্তু ওই হঠাৎ উত্তর দিল—’প্রেয়ার ফ্ল্যাগ’। বলেই দু’হাত তুলে কারও উদ্দেশে বার কয়েক নমস্কার করল।
বিরূপাক্ষদা চোখ বন্ধ করেই ছিলেন, এবার চোখ খুললেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, কীসের প্রেয়ার? কার কাছে?
এবার উত্তর দিল শান্তনু। বলল, অশুভ শক্তি তাড়াবার জন্যে নানা জায়গায় বিশেষ করে নির্জন জায়গায় ধর্মপুস্তক থেকে কোনো অমৃত বাণী লিখে লিখে টাঙিয়ে দেয় এখানকার মানুষ। এরা এমন অনেক কিছু বিশ্বাস করে যা আমরা ভাবতে পারি না। ‘অশুভ শক্তি’ মানে বুঝতে পারছেন তো, বিরূপদা?
বিরূপদা উত্তর দিলেন না। মুখ আরও গম্ভীর করে বসে রইলেন।
একটু হেসে শান্তনু বলতে লাগল, কলকাতায় একজন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল– ডাঃ দাস। কিছুকাল ভুটানে ছিলেন। সাউদার্ন ভুটানের ডিস্ট্রিক্ট টাউন সরভং। সেখানে সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার (M.O) হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন এইসব পাহাড়ি অঞ্চলের সাধারণ দরিদ্র মানুষজন ভূতে শুধু বিশ্বাস করাই নয়, প্রচণ্ড ভয় পায়। এরা তাই বাড়ির আনাচে কানাচে লাল-সাদা পতাকায় বুদ্ধের বাণী লিখে টাঙিয়ে দেয়। তাদের বিশ্বাস পতাকাগুলো যত নড়বে বুদ্ধের বাণী ততই অভয়বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়বে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে।
বিরূপাক্ষদা হাঁ করে শুনছিলেন। বলে উঠলেন, ও বাবা এখানেও ভূত! তবে কি আমরা ভূতের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি? কোথাও আর নিস্তার নেই। বলে মাংকিক্যাপের উপর দিয়ে গরম চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। যেন কোনো ফাঁক দিয়ে ভূতের নিঃশ্বাসটুকুও ঢুকতে না পারে।
হাসতে হাসতে বললাম, কোনো ভূতের গল্প-টল্প?
শান্তনু বলল, বলেছিলেন বৈকি! একেবারে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। শুনবে?
বলেই শান্তনু শুরু করল, দাস সাহেবের কোয়ার্টারটি পাহাড়ের ওপর। বেশ সুন্দর। কিন্তু ওখানে থাকতে না থাকতেই ছন্দপতন। রুগি থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য ডাক্তাররাও বলতে লাগলেন, দাস সাহেব, একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। সন্ধ্যার পর যেন মোটেই বেরোবেন না। বিশেষ করে পাহাড়তলিতে। জায়গাটা নাকি খারাপ। তারপর একদিন
হঠাৎ বিরূপাক্ষদা রেগেমেগে বলে উঠলেন, জায়গাটা যখন খারাপ বলে জেনেছ তখন ওসব নিয়ে কথা বাড়িয়ে লাভ কী?
শান্তনু হেসে বলল, ভয় পাচ্ছেন নাকি?
বিরূপাক্ষদা বললেন, স্থান-কাল ভেদে সব মানুষই ভয় পায়। ভয়ের কারণ যেখানে থাকে সেখানে তার ভয় না পাওয়াটা স্বাভাবিক নয়।
বললাম, তবে যে বললেন, ‘বৃহৎ শিকারে যেতে চান–হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার, রেডপান্ডা, আরো কত সব বৃহৎ জন্তু?
বিরূপাক্ষদা বললেন, ওদের কথা আলাদা। ওদের রক্ত-মাংসের শরীর আছে। বন্দুক ছুড়লে গায়ে লাগে। মরে। আর এরা? নাও আর কথা বাড়িও না। ও বাবা! থাপা সাহেব যে গাড়িটা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এবারে খাদে ফেলবে আর অশরীরীদের দলে আমাদেরও নাম লেখাবে।
সত্যি বিক্রমের আবার কী হল? জোরে চালাচ্ছিলই, এখন বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছে আর গাড়ির স্পিড বাড়াচ্ছে। পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি ছুটছে–নুড়িগুলো চাকার ধাক্কায় ছিটকে যাচ্ছে–যেন গুলি বৃষ্টি করছে! কেবলই মনে হচ্ছে এইবার বুঝি গাড়িটা উল্টে গড়িয়ে পড়বে পাশের গভীর গর্তে।
সত্যিই পাহাড়ের আবহাওয়ার মর্জি বোঝা দায়। এই মিষ্টি রোদ–তারপরেই হঠাৎ মেঘলা হয়ে গেল চারিদিক। শুরু হল টিপ টিপ বৃষ্টি। আবার একটু পরেই রোদ্দুর। এইজন্যেই ভ্রমণকারীরা ইংরেজিতে একটা কথা বলে থাকেন, ‘হিমালয়ের আবহাওয়া আনপ্রেডিক্টেবল।
এতক্ষণ দূরে দূরে কারু, র্যাটং, নরসিং প্রভৃতি যে পর্বতশিখরগুলি দেখা যাচ্ছিল হঠাৎ সেগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। চারিদিক থেকে রাশি রাশি ভাসমান তুলোর মতো কী যেন এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম। মনে হতে লাগল একটু পরেই ঐ ভাসমান তুলোর মতো ভয়ংকর জিনিসগুলো গাড়ির মধ্যে ঢুকে আমাদের দম বন্ধ করে মেরে দেবে।
এদিকে থাপা প্রাণপণে এক্সেলারেটারে ক্রমাগত চাপ দিয়েই যাচ্ছে। গাড়ি কখনও হেলতে দুলতে চলেছে–কখনও ঘটাং ঘটাং করে লাফাতে লাফাতে। বিক্রমের চুলগুলো মাথার ওপর খাড়া হয়ে উঠেছে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য।
এইবার বিরূপাক্ষদা হাঁকড়ে উঠলেন, ড্রাইভার, গাড়ি সামলে চালাও। কী পেয়েছে আমাদের? খাঁচায় আটকানো কতকগুলো ইঁদুর। তোমাকে পুলিশে দেব।
বিক্রম উত্তর দেবার দরকার মনে করল না। হঠাৎ ও উইন্ডস্ক্রিনের দিকে ঝুঁকে পড়ে চোখ ছোটো করে কী যেন লক্ষ করতে লাগল। গাড়ির স্পিড কমাতে লাগল। হঠাৎ থাপার এ আবার কী হল? ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও কেমন যেন মিইয়ে গেছে। সেই অবস্থাতেই ও চট করে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একটা দোলানি দিয়ে গাড়িটাকে বাঁ পাশে নিয়ে এল।
আমরা চমকে উঠলাম। সামনে অল্প দূরে যেন মাটি খুঁড়ে উঠে এল একটা বলদে টানা গাড়ি। একটাই বলদ। খুবই হৃষ্টপুষ্ট। কুচকুচে কালো রঙ। তার শিঙ দুটোতে সিঁদুর মাখানো। দু’দিকে তীক্ষ্ণ ফলা লাগানো একটা লম্বা শিক বলদটার নাক এফোড়-ওফোঁড় করে দু’দিকে বেরিয়ে পড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আর–
সেই ছাউনিহীন গাড়িতে চালকের আসনে বসে আছে যে, সাক্ষাৎ যমদূতের মতো তার চেহারা। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় তার গায়ে শুধু একটা চাদর আর মাথায় পাগড়ি। দু’চোখ লাল। কপাল জুড়ে সিঁদুর মাখা। একেবারে আমাদের গাড়ির সামনে এসে কোমরে দু’হাত রেখে দাঁড়াল।
বিক্রম গাড়ি থামিয়ে নীচে নেমে হাত জোড় করে হাঁটু গেড়ে বসল। আমরা তো অবাক! তারপর চলল দুজনের পাহাড়ি ভাষায় তর্ক-বিতর্ক। না, তর্কও নয়, বিতর্কও নয়। একজন ক্রমাগত চোখ গোল গোল করে ধমক দিয়ে যাচ্ছে আর আকাশের দিকে আঙুল তুলে কী দেখাচ্ছে। অপর দিকে আমাদের থাপা বাহাদুর হাত জোড় করে মুখ কাচুমাচু করে কিছু একটা উত্তর দিচ্ছে। বারকয়েক পাহাড়ি ভাষায় শনিবার কথাটা শোনা গেল। হাবেভাবে যতটুকু বোঝা গেল তা হচ্ছে যমদূত সদৃশ লোকটি বিক্রমকে ধমকাচ্ছে, কেন সে আজ এই পথে এল? বলছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখো। তুমি কি জান না এর পরিণতি কী? তুমি কি ভুলে গেছ আজ কী বার?
শান্তনু নিচু গলায় বলল, ও বোধ হয় এ অঞ্চলের একজন গুরু–মাতব্বর। এরা পাহাড়িদের কাছে পুজো পায়। দেবতার মতোই। এমন শুনেছি সেই ডাক্তার দাসের মুখে। সহজে এদের মতো উচ্চস্তরের মানুষের নাকি দেখা পাওয়া যায় না। ‘
তবে এ লোকটা ভালো। সে সাবধান করে কী যেন বলল, অমনি বিক্রম সভয়ে পিছনে তাকিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। আর আশ্চর্য! বলদের গাড়িটা সামনে তো এগোলই না যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেও গেল না। পাশের ঢাল দিয়ে দ্রুত নামতে লাগল–চাষের ভুই তছনছ করে।
আমরা তো হতবাক! ব্যাপারটা কী হল? কেন মাতব্বরটি সামনে গেল না, কেনই বা ফিরেও গেল না? যেন কোনো কিছুর আভাস পেয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি নেমে গেল!
আমরা যেন নিজেদেরকেই প্রশ্ন করলাম! নিজেরাই উত্তর খুঁজলাম। শেষ পর্যন্ত নিজেরাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চুপ করে গেলাম।
কেবলই শুনছি স্যাটারডে, স্যাটারডে–ব্যাপারটা কী হে!–গলার স্বর উঁচু করেই জিগ্যেস করলেন বিরূপাক্ষদা।
শান্তনু চাপা গলায় বলল, কিছু একটা ঘটনা আছে, যা আমরা জানি না। জানতে চাই এটাও হয়তো চায় না কেউ। বলে ইশারায় বিক্রমকে দেখিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, আমাদের একেবার চুপ করে থাকাই উচিত।
ভয় পেয়ে বিরূপাক্ষদা বললেন, ও বাবা! ফুল দেখতে বেরিয়েও স্পিকটি নট!
হ্যাঁ, অন্তত ‘হিলে’ পৌঁছানো পর্যন্ত।
এমনি সময়ে গুড় গুড় করে কয়েকবার মেঘ ডেকে উঠল। বিদ্যুৎচমকে পাহাড়ের ওপর গাছগুলোকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিল। তারপরই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। গগনচুম্বী পাহাড়ের শ্রেণিতে বজ্রপাত দেখেছ তোমরা? না দেখে থাকলে ভালোই। সুন্দরও যে সময়ে সময়ে কত ভয়ংকর হয় তা না দেখলে বুঝতে পারবে না।
বাজের শব্দে বিরূপাক্ষদা ওঁর ভারী শরীরটা নিয়ে প্রায় আধ হাত লাফিয়ে উঠেছিলেন। পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনো-রকমে ড্রাইভারের সিটটা আঁকড়ে ধরে সামলে নিলেন। তারপর দু’কান চেপে ধরে জিগ্যেস করলেন, বাজটা কোথায় পড়ল হে? খুব কাছেই মনে হচ্ছে?
শান্তনু আঙুল দিয়ে একটা বিশাল উঁচু পাহাড়ের শৃঙ্গ দেখিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল পাহাড়ের ওপর ছোটো ছোটো গাছপালা বাজের আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন পাহাড়টা আগুনের মালা মাথায় জড়িয়ে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল আগুনের কয়েকটা স্ফুলিঙ্গ পাশের পাহাড়ের গাছে গিয়ে পড়ল। যেন অগ্নিবৃষ্টি করছে।
চমকে উঠলাম সবাই। কী সর্বনাশ! দাবানল হয়ে যাবে নাকি?
হয়নি। রক্ষে, এই সময়ে নামল বৃষ্টি।
আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ড্রাইভার বিক্রমের ছটফটানি। গাড়ি চালাতে চালাতেই সে ফিরে ফিরে কাচ লাগানো স্ক্রিন দিয়ে দেখছিল। বৃষ্টি জোরে হচ্ছিল না। তাই বাইরের জিনিস মোটামুটি দেখা যাচ্ছিল।
বিক্রম সেই গাড়িতে ওঠার পর থেকে কেবল আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। এখন তাকাচ্ছে। পিছনের দিকে। কী যেন বারবার দেখার চেষ্টা করছে। ও যেন নিশ্চিত জানে আজ যখন শনিবার আর আকাশ থেকে যখন জল পড়েছে বজ্রপাতের সঙ্গে তখন কিছু একটা দেখা যাবেই। না ভালো নয়–ভালো নয়–মোটেই ভালো নয়। তবু যদি ওর একান্তই আবির্ভাব ঘটে তাহলে আগে থেকেই প্রস্তুত হতে হবে।
হঠাৎ বিক্রম অতিমাত্রায় সতর্ক হয়ে উঠল। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
শান্তনু চেঁচিয়ে উঠল, এ কী করছ? অ্যাকসিডেন্ট হবে যে!
ও কোনোরকমে অদ্ভুত কায়দায় গাড়ি সামলে বাঁ হাত তুলে পিছনের রাস্তাটা দেখিয়ে দিল। আমরা ঘাড় ঘোরালাম। স্ক্রিনের ভিতর দিয়ে বাইরে তেমন কিছু দেখা গেল না। সেই পাথর ছড়ানো উঁচু-নিচু পথ, পথের একপাশ থেকে মাথা উঁচু করে উঠেছে পাহাড়, অন্য পাশে গভীর গর্ত বা খাদ। তার পিছনে ঘন কুয়াশা। কিন্তু বিক্রম এরই মধ্যে দিয়ে। কিছু দেখতে পেয়েছিল। তাই মুহুর্মুহু তার মুখের ভাব বদলাচ্ছিল।
কই হে, কিছুই তো দেখছি না। অনেক কষ্টে বিরূপাক্ষদা তাঁর দেহভার উত্তোলন করে কোনোরকমে ঘাড়টা ফিরিয়েছিলেন। তারপরেই তিনি যেন চমকে উঠলেন–হ্যাঁ, হা, কী যেন আসছে!
কী আসছে?
আমি আর শান্তনু ফের ঝুঁকে পড়লাম। হাঁ, পিছনে অনেক দূরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসছে কী যেন–বৃষ্টির মধ্যেই নেমে আসছে–
কী ওটা?
বিক্রম না দেখেই বলল, কুকুর।
কুকুর! ও কীরকম কুকুর?
দেহের তুলনায় মুখটা বীভৎস রকম বড় ও উঁচলল। ছুটে আসছে। লক্ষ আমাদের গাড়িটা।
চোখে ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল। বিক্রমকে উদ্দেশ করে বললাম, ওটা তো কুকুর মনে হচ্ছে না।
তা হলে দেখুন বোধহয় বানর।
সে আবার কী? বিরূপাক্ষদা বললেন, ম্যাজিক না কি? এই বলছ কুকুর, তার পরই বলছ বানর! তাজ্জব!
আপনিই দেখুন না।
বিরূপাক্ষদা বললেন, আমার নজর কি অতদূরে পৌঁছাবে?
শান্তনু হঠাৎ গম্ভীর গলায় বলল, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। কুকুর নয়, বানরও নয়, কুচকুচে কালো কিছু একটা দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছে, লম্বা হাত দুটো পাশে ঝুলছে। ঠিক যেন ওরাং ওটাং!
হিমালয়ের পাহাড়ে ওরাং ওটাং!
তার চেয়ে অবাক কাণ্ড চেয়ে দ্যাখো কী জোরে ছুটে আসছে। …
বিক্রম তখন ভয়ংকর কিছু বুঝে স্টিয়ারিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে মরিয়া হয়ে স্পিড তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ও শান্তনু, আমার তো মনে হয় বানরও নয়, ওরাং ওটাংও নয়, একটা মানুষ–
তাই তো। হাঁটুর নীচে পর্যন্ত ঝোলা ঢিলে ওয়াটারপ্রুফ গায়ে ঢলঢল করছে। মাথায় কানে ওয়াটারপ্রুফ টুপি। ছুটে আসছে এই দিকে।
কী ওটা?
একবার মনে হল কুকুর, একবার মনে হল বানর। আবার পরক্ষণেই মনে হল ওরাং ওটাং। আর এখন মনে হচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসছে বর্ষাতি জড়ানো লম্বা একটা মানুষ! এ তো একটা রহস্য! আর কেনই বা উঁচু পাহাড়ের পথ দিয়ে ছুটে আসছে? কেনই বা ওর লক্ষ আমাদের গাড়িটা?
এসবের উত্তর একমাত্র দিতে পারে আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা। কিন্তু ও তো গাড়িতে উঠে পর্যন্ত মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। তারই বা কারণ কী? ও কি জানে এই পথে বৃষ্টি পড়লে এই অদ্ভুত পাহাড়ি জীবটির আবির্ভাব হয়? সেই জন্যেই এই পথে আসতে চায়নি। আর এও জানে ঐ যে বহুরূপী জীবটি গায়ে ওয়াটারপ্রুফ জড়িয়ে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে সে নিশ্চয় কলা, শাঁকালুভোজী প্রাণী নয়। আর আমাদের সঙ্গে নিছক আলাপ করার জন্যে ছুটে আসছে তাও নয়।
ও ভাই থাপাজি, কিছু একটা বলল। পেছনে ধাওয়া করে আসছে ওটা কী?
থাপাজি উত্তর দিল না। বাঁ হাতটা তুলে শুধু কথা বলতে বারণ করল।
দেখতে দেখতে ওয়াটারপ্রুফওলা ঢ্যাঙা লোকটা হুড়মুড় করে কাছে এসে পড়ল। একটা ছুটন্ত গাড়িকে ধরে ফেলে আর কি! এও আশ্চর্যের কথা! একটা মানুষ কী করে দৌড়ে একটা গাড়ির নাগাল পায়–যে গাড়িটা পাহাড়ের রাস্তাতেও অ্যাকসিডেন্টের ভয় তুচ্ছ করে ছুটছে দুর্দান্ত গতিতে!
আমরা বুঝতে পারলাম এসব রহস্য বিক্রম ভালো করেই জানে। আর হিংস্র লোকটার নাগালের মধ্যে এসে পড়লে কী পরিণতি হবে তাও তার অজানা নয়। অথচ পালানো ছাড়া পরিত্রাণের উপায় আর কী হতে পারে তা বোধহয় থাপাজি জানে না। এ অবস্থায় আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইলাম। একবার বিরূপাক্ষদাকে দেখলাম। চোখ বুজিয়ে শুধু ইষ্টনাম জপ করে যাচ্ছেন।
আকাশে এখন জমাট মেঘ তেমন নেই। তবু মেঘ আছে। টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানি। বিক্রম আগের মতোই আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে কিছু যেন প্রার্থনা করছে।
হঠাৎ মনে হল পিছনে যেন একটা ঝড়ের আভাস। অথচ আশেপাশে ঝড়ের চিহ্নমাত্র নেই। ঘাড় ঘোরাতেই চমকে উঠলাম। এখন আর পায়ে হেঁটে নয়, দু’পা শূন্যে তুলে ভেসে আসছে মানুষটা। এখন প্রায় দশ হাতের মধ্যে এসে পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে একবার নাগালের মধ্যে পেলে ঐ মানুষের আকারবিশিষ্ট জীবটা কী করবে।
এই সময়ে বৃষ্টিটা যেন প্রায় থেমে এল। আর তৎক্ষণাৎ অসাধারণ তৎপরতায় বিক্রম স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়িটাকে নিয়ে গেল পাহাড়ের কোল দিয়ে অন্যদিকে। সেখানে পৌঁছতে
কোথায় বৃষ্টি কোথায় ঝড়–কোথায় বা মেঘ ডাকা! একেবারে দুপুরবেলার সোনা গলানো বোদ!
পিছনে তাকিয়ে দেখলাম কোনো জীবজন্তুর চিহ্নমাত্র নেই। শুধু পাহাড়ের পর পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে একরাশ চাপা রহস্য বুকে নিয়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। সবচেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে। যেন বিক্রম। বার বার পিছনে ফিরে সেই পাহাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নত করতে লাগল। যেন কোনো অদৃশ্য দেবতার উদ্দেশে প্রণাম জানাল।
কিন্তু এতক্ষণ ধরে ব্যাপারটা কী ঘটল বুঝতে পারলাম না।
শান্তনু বলল, আমিও ঠিক জানি না। দেখি বিক্রম যদি এখন কিছু বলে!
গাড়ির স্পিড বিশেষ না কমিয়ে বিক্রম গাড়ি চালাচ্ছে। হিলে’ এখনও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। বিক্রমকে খুশি করার জন্য শান্তনু এবার ভাঙা ভাঙা পাহাড়ি ভাষায় জিগ্যেস করল, এখানে যা ঘটল সে বিষয়ে কিছু বলো। আমরা তো শুধু ভয়ই পেয়ে গেলাম। কিছু বুঝলাম না।
উত্তরে বিক্রম কোনো কথা না বলে স্টিয়ারিং থেকে বাঁ হাতটা তুলে শুধু একবার কায়দা করে ঘুরিয়ে দিল। তার অর্থ কী তা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও এটুকু বোঝা যায় যে, হয় সে নিজেও জানে না, নয় তো সে বলতে পারবে না।
অগত্যা আমাদের চুপ করে থাকতে হল। বিরূপাক্ষদা শুধু অধৈর্য হয়ে গজগজ করতে লাগলেন। বললেন, এ তো আচ্ছা রহস্য!–বলে যেন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে শার্সি বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করলেন।
গাড়ি এখন চলছে অনেকটা স্বাভাবিক গতিতে। তবু বিক্ৰম গাড়ি চালাতে চালাতেই মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। এতেও আমার ভয়-না জানি আবার কী হয়।
আমি ইশারাতে শান্তনুকে জিগ্যেস করলাম, এত ঘড়ি দেখার ঘটা কেন?
শান্তনু বললে, বাঃ! মনে নেই আমাদের সঙ্গে তো কথাই ছিল বেলা থাকতে থাকতেই এসে পৌঁছতে হবে ‘হিলে’তে।
তার মানে এখনও যথেষ্ট ভয় আছে।
শান্তনু একটিপ নস্যি নিয়ে বলল, ভয় পেয়েছি ঠিক। কিন্তু বিপদে পড়িনি এখনও। একটুর জন্যে মৃত্যুর ছোঁওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছি।
হ্যাঁ, বেঁচে গিয়েছি বিক্রমের তৎপরতার জন্যে। কিন্তু ওকে ধন্যবাদ জানিয়েও লাভ নেই। ও তো কথাই শুনবে না। আচ্ছা, বিক্রমের রহস্যটা কী বলে মনে হয় তোমার?
কী করে বলব? তুমিও যেখানে আমিও সেখানে। হয়তো আমি হিমালয়ের পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেছি কয়েকবার, তা বলে এমন রহস্যময় ঘটনা কখনো ঘটতে দেখিনি। শুধু বিক্রম কেন, জানতে ইচ্ছে করে কেন কোনো ড্রাইভার আসতে চায় না? কেন শনিবারটা যাত্রা করা নিষেধ? ঐ যে বহুরূপী মূর্তিটাকে ও? কেন, কী করে কখনও কুকুর, কখনও ওরাং ওটাং, কখনও মানুষের রূপ ধরছিল? বিজ্ঞানের যুগে একি সম্ভব? তা যদি না হয় তাহলে বলতেই হয়, সবটাই চোখের ভুল। পাহাড়ের মায়া।
কিন্তু এও তো গোঁজামিলের কথা। আমরা তো সম্পূর্ণ দেখলাম শেষ মুহূর্তে মনুষ্যমূর্তি জীবটি গাড়ির দিকে ওয়টারপ্রুফটা ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের আটকাতে চেয়েছিল। এ তো চোখের ভুল হতে পারে না। তাই না?
শান্তনু বলল, মনে হয় এসবের উত্তর আমরা পেতে পারি বার্সে পৌঁছে, ওখানকার কেউ না কেউ হয়তো জানতে পারে।
বললাম, হয়তো তাই, ও–আচ্ছা, আমাদের বার্সে পৌঁছে দিয়ে বিক্রম আমাদের নিয়ে ফিরবে তো? নাকি ফেলে পালাবে? তা হলেই তো চিত্তির!
শান্তনু বলল, আমাদের নিয়ে ফিরতে না পারে। সেটা তার ইচ্ছে। কিন্তু আজ হিলে পৌঁছে ওকে নাইট হল্ট করতেই হবে। রাত্রে পাহাড়ি রাস্তায় যাবে না। ফিরলে কাল সকালে। তবে এ কথাও ঠিক–এ পথ দিয়ে ফিরবে না। আর আমাদের না নিয়ে ফিরলে ওর লাভ কী?
বিরূপাক্ষদা হঠাৎ অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, এই ড্রাইভার সাহেব, গাড়িটা একবার রোখো। লং জার্নি–একটু নামার দরকার হয় তা কি তুমি বোঝ না?
কিন্তু থাপা শুনতেই পেল না। এবার শান্তনু ওকে একটু ঠেলা দিয়ে পাহাড়ি ভাষায় গাড়িটা একটু দাঁড় করাতে বলল। বিক্রম যেন বিরক্ত হয়েই একধারে গাড়িটি দাঁড় করাল।
বিরূপাক্ষদা দরজা খোলবার জন্যে ব্যস্ত হলেন। কিন্তু দরজার কলক্তি ঠিক বোঝেন না। শুরু করলেন ধাক্কাধাক্কি। বিক্রম ইশারায় বিরূপাক্ষদাকে নিরস্ত করে পিছু না ফিরেই ডান হাত বাড়িয়ে লকটা খুলে দিল। সবাইকে উদ্দেশ করে এতক্ষণে বিক্রম মাত্র আধখানা করা বলল, ‘Ten minutes only.’ বলে দশটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল।
ঠিক আছে। বলে এ দরজা দিয়ে আমি আর শান্তনু নেমে পড়লাম। আঃ! কী মুক্ত প্রকৃতি! এতক্ষণ বন্ধ গাড়ির মধ্যে থেকে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, এখন বেরোতেই শীত ধরে গেল। হাত-পা একটু খেলিয়ে নেবার জন্যে আমরা প্রথমে আলিস্যি ভেঙে তারপর জোরে জোরে পা ফেলে খানিকটা হাঁটলাম। একবার পিছনে ফিরে দেখলাম বিরূপদা আপাদমস্তক গরম কম্বল মুড়ে গুটিগুটি এদিকে আসছেন। কিন্তু বিক্রম কোথায় গেল? ও কি নামেনি? আশ্চর্য! এতখানি জার্নি করেও কি একবার মাটিতে পা রাখার দরকার ওর হয় না?
যাই হোক, বিক্রমের জন্যে ভাবার দরকার নেই। এসব অঞ্চলে আগে ঘুরেছে। বিরূপাক্ষদাকে নিয়েই যত ভাবনা। এই যে আমরা ওঁকে ফেলে এগিয়ে এসেছি তাতে উনি আমাদের প্রতি বিরূপ।
খাস হিমালয়ের গোটা পাহাড়ের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে এর আগে আমরা কখনো নগ্ন পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পাইনি। আজই দেখলাম, পাহাড়ের গায়ে যে জমা শ্যাওলা তারও মধ্যে যেন একটা বিশেষত্ব আছে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কতরকম গাছের চারা। একেবারে শীর্ষে বড়ো বড়ো গাছ যেন আকাশকে ধরতে চাইছে। তাছাড়া আছে। হরেকরকমের ফুল। বেশির ভাগই ভায়োলেট কালার। কোনো কোনো সাদা ফুলের পাপড়িতে পাপড়িতে রঙের শোভা। কোথাও থোকা থোকা লাল টকটকে ফুল। আর সেইসব ফুলে উড়ে এসে বসছে কতরকমের প্রজাপতি। আমরা তন্ময় হয়ে দেখছিলাম। শান্তনু উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে ঐ তো রডোড্রেনড্রন! দ্যাখো কেমন থোকা থোকা লাল ফুল। এই ফুল দেখে আর কোথায় কোনো ফুল মনে পড়ে বলো তো!
বললাম, আমাদের গরমকালের পলাশ। বসন্তে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় যেন আগুন ধরিয়ে দেয়।
রাইট! সিকিমিরা রডোড্রেনড্রনকে নাকি ‘গুরাস’ বলে। গুরাস ফুটলে গ্রামের সিকিমিরা আনন্দে মেতে ওঠে।
গুরাসও কি এমনি লাল?–বোকার মতোই প্রশ্ন করি।
শান্তনু হেসে বলল, লাল তো বটেই। যখন বলছি রডোড্রেনড্রন–এরই আর এক নাম ‘গুরাস’।
লজ্জিত হয়ে বললাম, স্যরি!
তবে এক রকমের সাদা গুরাসও নাকি হয়। দারুণ সুন্দর। আরে! ঐ তো সাদা গুরাস! কতো বড়ো! দ্যাখো দ্যাখো। চলো, ফুলটা তুলে আনি। যে ক’দিন পারি অচেনা পাহাড়ি বন্ধুর স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।
আমরা এগিয়ে গিয়ে ফুলটা তুলতে যাচ্ছি। হঠাৎ ভুইফেঁড়ের মতো জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল সেই বলদে টানা গাড়ির অদ্ভুত দর্শন লোকটি। যাকে দেখেছিলাম অনেক দূর পিছনে। চমকে উঠলাম। সেই সিঁদুর লেপা চওড়া কপাল। সেই খালি গা। হাতের ইশারায় ফুলটা ছুঁতে নিষেধ করল। তারপর সে একটি মাত্র কথা বলেই উধাও হয়ে গেল। কথাটার অর্থ আমি সঠিক বুঝতে না পারলেও শান্তনু বুঝতে পেরে বলল, ভয়ানক বিষ। কোনো রকমে ঠোঁটে ঠেকালেই মৃত্যু। এমনকি হাত দিয়ে ছুঁলেও তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ফেলতে হয়। নইলে ভুলে মুখে ঠেকিয়ে ফেললে আর রক্ষে নেই।
তা না হয় হল। কিন্তু ভোজবাজির মতো ব্যাপারটা কী হল? শান্তনুও বুড়ো আঙুল। দিয়ে গাল চুলকোতে চুলকোতে ঐ একটা কথাই বলল, তাই তো। ব্যাপারটা কী হল?
উত্তর তখনই পাওয়া গেল না। রিস্টওয়াচের ওপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। দশ মিনিট কখন হয়ে গেছে! চলো–চলো।
আমরা হুড়মুড় করে গাড়ির দিকে চললাম। পাহাড়টা ঘুরতেই যে জায়গাটা সেখানেই তো গাড়িটা থাকার কথা। কিন্তু–
তাহলে আমরাই জায়গা ভুল করেছি। শান্তনু বলল।
বললাম, না, আমরা কিছু ভুল করিনি। ঐ দ্যাখো বিরূপাক্ষদা দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল কী ভাবছেন।
বলিহারি যা হোক! আমাকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা? গাড়িটাও নিয়ে গেলে?
গাড়িটা নিয়ে গেলাম মানে?
মানে তো আমিই জানতে চাই। এই সরু রাস্তায় গাড়ি নিয়ে যাবার কী এমন দরকার পড়ল?
আমরা আবার গাড়ি নিয়ে কোথায় যাব? আমরা কি গাড়ি চালাতে জানি?
তোমরা চালাতে যাবে কেন? ড্রাইভারকে নিয়েই গেছ।
আমরা অবাক হয়ে দুজনের দিকে তাকালাম। নিশ্চয় বলতে পারতাম এই মায়াবী পাহাড়ি রাস্তায় এতক্ষণ ধরে ঘুরতে ঘুরতে বিরূপাক্ষদার মাথা গোলমাল হয়ে গেছে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম গাড়িটা সত্যিই নেই।
বাঃ রে মজা! ড্রাইভার সুষ্ঠু মোটর গাড়ি উধাও!
এবার আমাদের দুর্ভাবনা হল। কী সব হচ্ছে!
ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো বিরূপাক্ষদা!
খুলে আর বলব কী? প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঐ ঝোপটার দিকে গিয়েছিলাম। উঠে দাঁড়িয়ে আলিস্যি ভাঙলাম। দেখলাম অজস্র টকটকে লাল ফুল–থোকা থোকা লাল ফুল। শুনেছিলাম রডোড্রেনড্রন নাকি লালফুল। ভাবলাম এগুলোই যদি রডোড্রেনড্রন হয় তাহলে তোমাদের ডেকে দেখিয়ে দিই। ব্যাস এখানেই যদি নয়ন সার্থক হয়ে যায় তাহলে আর এগোবার দরকার কী? এই ভেবে ডাকতে গিয়ে দেখি তোমারও নেই গাড়িও নেই। আমি তো ভয়ে কাটা। এই জনমানবশূন্য জায়গায় অমি একেবারে একা! ভাবো তো কী অবস্থা!
শান্তনু বলল, এ ব্যাপারটা পরে গাড়িতে বসে ভাবলেও চলবে। এখন আরও গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার কথা হচ্ছে–থাপা আমাদের না জানিয়ে গাড়িটা নিয়ে গেল কোথায়?
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, আমাদের ফেলে রেখে পালাল নাকি?
শান্তনু বলল, পালাবে? কেন পালাবে? আমাদের জব্দ করার কারণ তো কিছু ঘটেনি। তাছাড়া ভাড়ার মোটা টাকা হাতছাড়া করবে বিক্রম এমন বুদ্ধ নয়।
আমি ইতস্তত করে বললাম, তবু লোকটাকে তো ঠিক স্বাভাবিক বলে মনে হয় না।
বিরূপাক্ষদা চোখ গোল গোল করে একবার আমার দিকে একবার শান্তনুর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর সভয়ে আমাদের কথা শোনবার এবং মানে বোঝবার চেষ্টা করছিলেন। এবার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বলে উঠলেন, পালানোর কথা কী সব বলছ তোমরা একটু স্পষ্ট করে বলো।
দেখছি গাড়িও নেই, বিক্রমও নেই। এর মানে কী হতে পারে তাই আলোচনা করছিলাম।
বিরূপাক্ষদা একেবারে আঁতকে উঠলেন–অ্যাঁ! এসব কী কথা! বিক্রম যদি চলে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা যাব কী করে? আর থাকবই বা কোথায়? এ তো মানিকতলা থেকে শ্যামবাজারের মোড় পর্যন্ত কিংবা বাড়ি থেকে বাজার যাওয়া নয়। হায় হায়! শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে মরতে হবে। আমার তো আবার বেজায় ঠান্ডার ধাত! ও শান্তনু, তুমি অমন গোমড়া হয়ে থেকো না।
শান্তনু বলল, না, আমি অন্য কথা ভাবছি।
কী? ভয়ে ভয়ে বিরূপাক্ষদা তাকালেন।
ভাবছি, আমরা শীতে মরব, না হিংস্র প্রাণীদের উদরপূর্তির সহায়ক হব?
আঁৎকে উঠলেন বিরূপাক্ষদা–আবার হিংস্র জন্তু-টন্তুর কথা কী বলছ? এই ঘোর বিপদের একেবারে মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে তোমরা কি মজা করছ? আমায় ভয় দেখাচ্ছ?
শান্তনু মাথা নাড়ল–না বিরূপদা, আমরা অমন বেরসিক নই। চেয়ে দেখুন। এই ছাপগুলো কোন জীবের বলতে পারেন?
চমকে লাফিয়ে উঠে দু’পা পিছিয়ে এসে চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ঠাওর করলেন বিরূপাক্ষদা। এ তো কুকুরের পা। ও বাবা এ তো দেখছি অনেকগুলো। এত কুকুর–একসঙ্গে!
কাছাকাছি গেছেন। কিন্তু ফুল মার্কস পেলেন না। এগুলো কুকুরের থাবা নয়। কুকুরের থাবা অন্যরকম। আপনি নেকড়ের থাবা দেখেছেন?
নেকড়ের থাবা! কলকাতায় ঘোরাঘুরি করে একটা গোটা নেকড়েই দেখলাম না তো নেকড়ের থাবা! কী বলতে চাও তুমি?
শান্তনু গম্ভীর গলায় বলল, এইসব অঞ্চলের পাহাড়ে এক ধরনের নেকড়ে আছে যারা আসল নেকড়ে নয়, তবে নেকড়েদের জাতভাই। ওরা সাধারণত কুকুরের চেয়ে বেশ ছোটো। মাটি শুঁকতে শুঁকতে, সামনের দিকে শরীর ঝুঁকিয়ে, ক্ষিপ্রগতিতে ছোটে। নেকড়ের চেয়ে আকারে ছোটো। কিন্তু ঢের বেশি হিংস্র। একটা বিদেশী বইয়ে পড়েছিলাম এরা একাই একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে খেয়ে ফেলতে সময় নেয় আট থেকে দশ মিনিট। মারাত্মক কথা হচ্ছে, এরা থাকে পাহাড়ে। এক জায়গা থেকে বেরিয়ে যখন অন্য জায়গায় যায় তখন দলবদ্ধভাবে ছুটতে ছুটতে যায়। সামনে কেউ পড়লে তার রক্ষা থাকে না।
বিরূপাক্ষদা বললেন, ও বাবা, তুমি এতও জান। গোয়েন্দাকেও হার মানাও দেখছি। তা এতগুলি নেকড়ে-শাবক একযোগে গেলেন কোথায়? ‘পুনরাগমনায় চ’–ফিরে আসার জন্যে যায়নি তো?
মনে হয় ফিরবে আর এই পথ দিয়েই। আমি যতদূর পড়েছি তাতে জেনেছি এদের স্বভাবই এই–দিক পরিবর্তন করে না।
এমনি সময়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে থেকে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আর মিনিট তিনেকের মধ্যেই পাইন বনের মধ্যে থেকে আমাদের গাড়িখানাকে আসতে দেখা গেল।
শান্তনু তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল–আরে বিক্রমজি, কাঁহা গিয়া থা?
বিক্রম তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দিল।
জলদি স্যার!
কোনোরকমে আমরা ঢুকতে ও গাড়ি স্টার্ট দিল। সংক্ষেপে যা বলল তা এই–
গাড়ি থেকে আমরা নেমে গেলেও বিক্রম নামেনি। কারণ সে জানত শনিবার দিনটা এখানে বড় অশুভ দিন। অনেক অঘটন ঘটে। সে এও জানত এইরকম কোনো জায়গায় এইরকম সময়ে উত্তরের পাহাড় থেকে দলবদ্ধ হয়ে নেমে আসে এক ধরনের জীব। তাদের সামনে পড়লে কারোর রক্ষা নেই। সে জন্যে সে ভাবছিল কী করবে?
গাড়িটা রাস্তা জুড়ে রাখা ঠিক নয়। ওদের জন্যে পথ ছেড়ে রাখতে হবে। কিন্তু ঠিক কখন কোন পথে ওরা নামবে সেটাই বুঝতে পারছিল না। আর তখনই চোখে পড়ল দূরে উত্তরের একটা পাহাড়ের দিকে। দেখল ছাই রঙের কী একদল জন্তু পাহাড়ের গায়ে গা মিলিয়ে সার বেঁধে নেমে আসছে। তখনই বিক্রম বুঝতে পারল আর একমুহূর্ত দেরি করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে সে পথ থেকে পাশের গভীর ঝোপের দিকে চলে এসেছিল।
ওরা কি দক্ষিণের পাহাড়গুলোর দিকে গেল?
হ্যাঁ।
আবার ফিরবে কখন?
তার ঠিক নেই। ফিরলে এই পথ দিয়েই ফিরবে। কথা শেষ করতে না করতেই বিক্রম হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে দিল।
কী হল?
ঐ দেখুন। ওরা নেমে আসছে।
যাক কী ভাগ্যি, ওরা এদিকে এল না। চলে গেল উত্তরের পাহাড়ের দিকে। যে পথ দিয়ে এসেছিল।
.
০৩.
অতঃপর একঘণ্টার মধ্যেই অর্থাৎ বিকেল তিনটে বাজবার আগেই আমরা ‘হিলে’ এসে পৌঁছালাম। পাহাড় ঘেরা ৯০০০ ফুট উঁচুতে ছোট্ট জায়গা। না গ্রাম, না পাহাড়। এখানে পৌঁছানোর পরই বিক্রম একেবারে অন্য মানুষ। মনের মধ্যে যেন একটা চাপা ভয় ছিল সেটা চলে গেছে।
যেখানে গাড়ি থামল সেটা গাড়ির স্ট্যান্ড। নানা দিক থেকে বাস আসে। কোনোটা আসে জোরথাং থেকে, কোনোটা সোমবারিয়া থেকে। তবে হুড়মুড় করে আসে না। তিন চার ঘণ্টা অন্তর। তার কারণ পাহাড়ি রাস্তা। সন্ধের ঢের আগেই বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে হয়। আরও যে সব জায়গা থেকে আসে তার নাম জানা নেই।
বিক্রম নেমেই চলে গেল কাছেই যে চায়ের দোকানে ড্রাইভাররা বসে সেখানে। অনেকক্ষণ গল্প করতে পারেনি। মন-প্রাণ আনচান করছিল।
আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়েছি। বিরূপাক্ষদা মাটিতে পা দিয়েই বলে উঠলেন, রাতে থাকব কোথায়? ভালো হটেল-টোটেল…
হেসে ছড়া কেটে বললাম, ‘মোটে মা রাঁধে না, তপ্ত আর পান্তা! ভালো হোটেল মাথায় থাকুক, একটা মাথা গোঁজার মতো সরাইখানা পেলেই ভাগ্যি বলে মানব।
বিরূপাক্ষদা কথাটা শুনেও যেন শুনলেন না। বললেন, ওহে শান্তনু, থাপা গেল কোথায়?
ভাববেন না, বলেই শান্তনু ডাকল, বিক্রমজি—
বিক্রম এসে দাঁড়াল।
তোমার ভাড়া কি মিটিয়ে দেব?
মিটিয়ে দেবেন? মানে ছেড়ে দেবেন? তারপর ফিরবেন কার গাড়িতে?
শান্তনু তাড়াতাড়ি বলল, না–না, ছেড়ে দেব কেন? আসলে আমরা বুঝতে পারছি আমরাই বা থাকব কোথায়? আর খাবই বা কোথায়?
বিক্রম বলল, আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনারা কী করবেন দেখুন।
আমরা কাল বার্সে যাব। চার কিলোমিটার পথ। দরকার হলে হেঁটেই যাব। (এ কথা শুনে বিরূপাক্ষদা মুখ কিছু না বললেও আঁৎকে উঠলেন) এসেছি তো বেড়াতে। এখন রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা কোথায় করব?
বিরূপাক্ষদা বললেন, কোথা ফাইভ স্টার মার্কা হোটেল-টোটেল–বেড়াতে এসেছি, টাকার মায়া করলে কি হয়?
খুব ঠান্ডা বলে এখন বিক্ৰম কাশ্মীরিদের মতো টুপি পরেছে। তার ফর্সা চ্যাপ্টা মুখে মানিয়েছে ভালো। টুপিটা ঠিক করে বসিয়ে নিয়ে চিন্তিত মুখে বলল, তেমন হোটেল তো এখানে নেই।
না না, ‘তেমন’ হোটেলের দরকার নেই। যেমন-তেমন পেলেই হল। বলল শান্তনু।
চলুন দেখি। বলে বিক্রম আমাদের নিয়ে চলল। দু-তিনটে হোটেল দেখাল। প্রথমটা খুব নোংরা। দ্বিতীয়টা ছোটো বলেই চার-পাঁচজন বোর্ডারের বেশি জায়গা দিতে পারে না। বলল, এঁরা আগেই ‘বুক’ করে এসেছেন।
এইটুকু শুনেই হতাশ হয়ে বিরূপাক্ষদা বলে উঠলেন, তাহলে কি পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে–
শান্তনু ধমক দিয়ে বলল, অল্পেতেই এত হতাশ হয়ে পড়েন কেন? চেষ্টা তো করা হচ্ছে। ছোট্ট জায়গা। কটাই বা হোটেল থাকতে পারে?
তারপর শান্তনু বিক্রমকে বলল, যা হোক কোনো ব্যবস্থা তো তোমাকেই করতে হবে।
বিক্রম নিরুপায় হয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। বাসের একজন খালাসিকে দেখতে পেয়ে ডাকল। পরিচিত লোক। বিক্রম তাকে আড়ালে অবস্থা বুঝিয়ে বলল, একটা থাকার ব্যবস্থা কি করা যায় বলো তো!
লোকটা চিন্তা করে বলল, হোটেল আর নেই। তবে ‘সুইট হোমে’ একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
শান্তনু উৎসাহিত হয়ে বলল, তাই চলুন।
বিক্রম একটু চিন্তা করে বলল, ওটা কোনো হোটেল নয়। প্রাইভেট বাড়ি। পেয়িং গেস্ট হিসেবে যতদিন খুশি থাকতে পারেন।
তা খারাপ কী? চার্জ কি খুব বেশি?
না, মডারেট। কিন্তু মালিক একজন চিনা মহিলা।
চিনেম্যান!–দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।
বললাম, ‘চিনেম্যান’ নয় বিরূপদা, ‘চিনা ওম্যান’।
ও-ই হল। কিন্তু চিনে খানা–মানে–আরশোলা, টিকটিকি খেতে পারব না। একটা চৌকি আর লেপ কি মিলবে?
খাবার কথাটা শুনে বিক্রম আর তার সঙ্গী দুজনেই হাসল।
শান্তনু বলল, আরশোলা, ব্যাঙ, সাপ খেতে হবে না। হাতরুটি আর তরকারি পাওয়া যাবে তো, বিক্রম?
অনেক। বুঝিয়ে দিল বিক্রম। সঙ্গে মাংস।
কীসের মাংস ভাই? আতংকিত বিরূপাক্ষদা ঝুঁকে পড়ে জিগ্যেস করলেন।
যে মাংস খেতে চাইবেন। দরকার হলে রেস্তোরাঁ থেকে আনিয়ে দেবে।
তবে চলল। এখন কিছু খেতে হবে। তারপর লেপমুড়ির ব্যবস্থা। হাত দুটো জমে গেছে।
কিন্তু বিক্রম যেন কিছু চিন্তা করছে।
এনি প্রবলেম? আর কোনো সমস্যা?
জায়গাটা কিন্তু একটু দূরে। আর–
মুখ শুকিয়ে গেল আমাদের। যদি বা আশ্রয়ের একটা সন্ধান পাওয়া গেল তাও দূরে। আর এই অবেলায়!
তবু কতদূরে?
বিক্রম মনে মনে হিসেব করে বলল, তা দু কিলোমিটার তো বটেই। ঐ যে পাহাড়টা দেখছেন ওর ঢালের মুখে। জায়গাটা অবশ্য খুবই ভালো লাগবে আপনাদের। খুব কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট।
বুঝতে পেরেছি। অর্থাৎ নির্জন–জনমানবশূন্য–
ভয়ংকর। বলে উঠলেন বিরক্ত বিরূপাক্ষদা। ‘কিন্তু আর’–বলে কী বলতে যাচ্ছিলে, ভাই বিক্রম?
না, কিছু নয়। দাঁড়ান, গাড়িটা আনি–বলে চলে গেল।
সুইট হোমের সামনে গিয়ে যখন বিক্রম গাড়ি দাঁড় করাল তখন পশ্চিম দিকের আড়ালে সূর্য নেমে গেছে। পাহাড়গুলোর চুড়ো যেন অস্তসূর্যের রাঙা আলোয় ঝলমল করছে।
কোথায় তোমার সেই চিনে গেস্ট হাউস? জিগ্যেস করল শান্তনু!
বিক্রম হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ যে সাইনবোর্ড।
তাকিয়ে দেখলাম সাইনবোর্ডে ইংরিজিতে লেখা ‘SWEET HOME’। তার নীচে অপেক্ষাকৃত ছোটো অক্ষরে ইংরিজিতে লেখা–পোর–জোঅ্যান্ড–চিয়াং।
বললাম, একজন চিনা মহিলার প্রাইভেট হোটেলের ইংরিজি নাম!
শান্তনু বলল, বুদ্ধিমতীর পরিচয়। এখানে চিনা ভাষা কে কত বুঝবে? তাই অতিথিশালার নাম দিয়েছে ইংরিজিতে। আর এ অতিথিশালা তো গতানুগতিক নয়, অন্যস্বাদের খাবার পাওয়া যাওয়া সম্ভব সেটা বোঝাবার জন্য প্রোপাইটার নিজের চিনা পরিচয়টুকুও প্রচার করে দিয়েছে।
বিরূপাক্ষদা তাড়া দিলেন, ঠান্ডায় মরে গেলাম। চলো চলো ভেতরে চলো।
বিক্রম জিগ্যেস করল, তাহলে কাল কখন আসব? কালই তো ফিরবেন?
শান্তনু বলল, একটু দাঁড়াও। আগে থাকার ব্যবস্থা করি।
চলে আসছিলাম–বিক্রম থামিয়ে দিয়ে চাপা গলায় বলল, অচেনা জায়গা তো। রাতে ঘর থেকে না বেরোনোই ভালো। বলেই গাড়িতে গিয়ে উঠল।
‘হোম’টি লম্বা একতলা। সামনে অনেকখানি জায়গা ঘিরে কম্পাউন্ড। কম্পাউন্ডের মাঝখানে পানপাতা আকারে সিমেন্টে বাঁধানো একটু বসার জায়গা। সামনেই অফিস ঘর। তার দু’পাশে টানা বারান্দা। বারান্দার ধারে ধারে কয়েকটি ঘর। বোঝাই যাচ্ছে এগুলিতে বোৰ্ডাররা থাকে।
অফিস ঘরের মেঝেটা কাঠের। কার্পেট বিছানো। ঘরটা মাঝারি সাইজের। আসবাবগুলো খুবই পুরোনো আমলের। কাজেই দামি। ঐরকম কাঠ এখন সচরাচর দেখা যায় না। টেবিলে রয়েছে পোর্টেবেল টাইপ মেশিন, একটা টেলিফোন। আর একটা পাথরের কালভৈরবের ভয়ংকর মূর্তি। মহিলাটির অল্প দূরে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটা টেবিল যেন আগলে বসে আছে এক বৃদ্ধ চিনা। তার মাথায় টুপি, গায়ে কালো কোট, থুতনিতে পাকা দাড়ি। বাদামের মতো দুটো চোখে নির্জীব দৃষ্টি। টেবিলে একটুকরো কাচের ফলকে লেখা RECEPTION। পাশেই পর্দা ফেলা একটা ছোটো ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে টাইপরাইটারের টকটক শব্দ।
বিশাল অর্ধবৃত্তাকার একটা টেবিলের সামনে বসে আছেন একজন সুন্দরী চিনা মহিলা। হলদেটে রঙ, সাদা ব্লাউজ গায়ে, নীচে নীল রঙের চাপা স্কার্ট। চকচকে কালো চুলে একটা বিনুনি। মহিলাটি একমনে নখে রঙ মাখাচ্ছিলেন, হঠাৎ অনেকগুলো জুতোর শব্দ শুনে উঠে দাঁড়ালেন। আমাদের ক্লান্ত মুখ, ধকল-সওয়া জামা-প্যান্টের অবস্থা আর পিঠে ঝোলানো স্যাক দেখে অনুমান করে নিলেন আমরা কী জন্য এখানে এসেছি।
নমস্তে, ওয়েলকাম বলে হেসে হাত জোড় করে নমস্কার করে অভ্যর্থনা করলেন। টেবিলের সামনেই খানকতক গদি-মোড়া চেয়ার ছিল। তাতেই বসলাম।
From Kolkata?
Yes.
সঙ্গে সঙ্গে চিনা মহিলা হেসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, বাংলাতেই বলুন, মহাশয়েরা। আমি কুছ কুছ বাংলা বুঝি।
বাংলা বোঝেন জেনে আমরা স্বস্তি পেলাম। বললাম, ধন্যবাদ। শান্তনু প্রথমেই বলল, রুম পাওয়া যাবে তো?
Oh! Yes!
বিরূপাক্ষদা তবু ইংরিজিতেই (সম্ভবত তিনি ইংরিজি বলতে পারেন জানাবার জন্যেই) Toyota, May we have each a cup of coffee? Hot coffee!
Oh sure! কিন্তু এখানেই খাবেন, না আপনাদের ঘরে গিয়ে আরামসে–হেসেই উত্তর দিলেন মহিলাটি। এবার হাসবার সময়ে তার একটি সোনা বাঁধানো দাঁত দেখা গেল।
ফাস্ট রাউন্ডটা এখানেই হয়ে যাক।-উৎসাহে বলে উঠলেন বিরূপাক্ষদা।
O.K.বলে মহিলাটি সেই বৃদ্ধকে ডেকে তিন কাপ কফি দেবার কথা বলে দিলেন।
কফি খাওয়া হয়ে গেলে চিনা মহিলা টেবিলে লাগানো অদৃশ্য কোনো বোতাম টিপলেন বোধ হয়। দু’মিনিটের মধ্যে একজন ভৃত্য গোছের লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। পরনে চেক চেক লুঙ্গি। গায়ে ভেড়ার লোমের ময়লা সোয়েটার। কণ্ঠনালীটা বেজায় উঁচু। যেন গলার চামড়া ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
মহিলাটি হিন্দিতে বললেন, ইস্কাইন, এঁরা তিনজন থাকবেন। স্পেশাল কোন ঘরটা দেবে?
চার।
ঠিক আছে বলে মহিলা ড্রয়ার থেকে এক থোকা চাবি বের করে দিলেন।
ইস্কাইন খালি কাপ তিনটে ট্রেতে তুলে নিল। মহিলাটি ইশারায় আমাদের ওর সঙ্গে যেতে বললেন।
এক নজরেই ঘর পছন্দ হয়ে গেল আমাদের। নিতান্ত ছোটো ঘর নয়। পাশাপাশি তিনটে বেড। তাছাড়াও আর একটা উল্টো দিকে। ঘরটা বেশ গরম। পায়ের কাছে ফর্সা ওয়াড় পরানো পুরু লেপ। লাগাও বাথরুম। বেসিনে সব সময় জল, গরম জলের ব্যবস্থা আছে। বড়ো কথা–ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিরূপাক্ষদা জানলার ধারটা বাদ দিয়ে অন্য দিকে শুলেন। শার্সি লাগানো সব জানলাই শীতের দাপটের জন্য বন্ধ।
থাকার ব্যবস্থা করে আমরা বিক্রমকে জানিয়ে দিলাম। কালই যাব কিনা সকালে জানিয়ে দেওয়া হবে।
রাতের খাওয়াও মন্দ হল না। লুচি আর মুরগির মাংস। তবে অনেক উৎসাহ নিয়ে খেতে বসলেও বিরূপাক্ষদা ভালো করে খেতে পারলেন না। বললেন, মাথাটা বেজায় ধরে আছে। বলে কপাল টিপে ধরলেন।
বললাম, এবার আপাদমস্তক লেপমুড়ি দিয়ে একটা টানা ঘুম লাগান।
কাল তো আবার কোথায় যেন যেতে হবে। চার মাইল পথ?
শান্তনু বলল, কালই যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। একদিন এখানে রেস্ট নিয়ে—
ঠিক আছে। তোমরাও এখন শুয়ে পড়বে?
না, ম্যানেজার মহিলা যদি থাকেন তাহলে খাতা-পত্রে সই-সাবুদগুলো সেরে নেব।
বলে আলো নিভিয়ে বেরোতে যাচ্ছি, উনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন–আলো জ্বালা থাক।
ঘরের আলো জ্বেলে রেখেই আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। মনটা বেশ ফুরফুরে। সারাদিন শরীর আরে মনের ওপর দিয়ে ধকল গেছে। এখন নিশ্চিত একটা ডেরা পেয়ে। যেন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি। কিন্তু হঠাৎ পা দুটো যেন আটকে গেল।
ওটা কী? ঐ যে—
শান্তনু আমার হাতটা চেপে ধরে গতি রূদ্ধ করে দিল।
প্যাসেজের বাম্বটা বোধ করি ফিউজ হয়ে গেছে। তাই অন্ধকার। তবু অফিস ঘরে যে আলো জ্বলছিল ওরই কিছুটা এসে পড়েছিল বারান্দার একদিকে। একটা ছোট্ট বাঁক ফিরলেই অফিস ঘর। আমরা নিশ্চিন্তেই এগোচ্ছিলাম হঠাৎ কুকুরের চেয়ে আকারে কিছু ছোটো কোনো জন্তু চক্ষের নিমেষে ছুটে পাঁচিল টপকে পিছনের ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
কী ওটা?
শান্তনু বলল, বুঝতে পারলাম না। তবে কুকুর নয়, ভাম বা খটাসও নয়, বনবেড়ালও নয়–
আমরা অফিস ঘরে গিয়ে দেখলাম মহিলাটি একটা খাতায় যেন কী লিখছেন। সামনে বসে আছে সেই বৃদ্ধ চিনাটি। বোধহয় সেদিনের হিসেব বুঝিয়ে দিচ্ছে।
আমাদের দেখেই মহিলাটি হেসে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন। খাওয়া হল?
বললাম, হ্যাঁ। ভালোই।
আপনাদের সিনিয়ার পার্টনারটি কি শুয়ে পড়েছেন? খাওয়ার কোনো অসুবিধা–
না, তবে বয়েস হয়েছে তো, ক্লান্তি—
আপনারা কি কালকেই বার্সে চলে যাচ্ছেন?
দেখি! ভাবছি একটা গোটা দিন যদি হিলেই কাটানো যায়—
সেটাই ভালো।
বৃদ্ধ চিনা কী একটা রেজিস্টার নিয়ে এসে দাঁড়াল।
মহিলাটি বললেন, এঁরা কাল থাকবেন। সকালে করলেই হবে।
বৃদ্ধটি চুপচাপ গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল।
মহিলাটি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ওয়ন, আপনি যেতে পারেন।
ওয়ন তখনই খাতাপত্র তুলে রেখে মহিলাটিকে অভিবাদন করে বেরিয়ে গেল।
এবার মহিলাটি আমাদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন জানতে চাইলেন আমরাও এখন শুতে যাব কিনা।
আন্দাজে প্রশ্নটা ধরে নিয়ে উল্টে আমরাই জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি সাধারণত কতক্ষণ অফিস ঘরে থাকেন?
উনি বললেন, যতক্ষণ না বোর্ডাররা সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ছেন ততক্ষণ থাকি।
একটু থেমে নিজেই বললেন, ক’জনই বা বোর্ডার! এগারোটার মধ্যেই হোম নিস্তব্ধ হয়ে যায়।
আপনার এখানে বোর্ডার বেশি নেই বোধহয়।
ঠিকই বলেছেন। আসলে যতই যত্ন-আত্তি করি, ভালো খাওয়াই, হিলের বাজার থেকে অনেকটা দূরে বলে লোক আসতে চায় না। আবার কখনও কখনও বেশ ভিড় হয়।
আপনি এখানেই থাকেন তো?
হ্যাঁ, এটাই আমার ঘরবাড়ি। আমার মাতামহই সেই কবে নানা জায়গা ঘুরে বহু বিপদ মাথায় নিয়ে হংকং থেকে এখানে আসেন। এই জায়গাটাকেই খুব নিরাপদ মনে করেছিলেন।
শান্তনু বিনীতভাবে বলল, কিছু যদি মনে করেন তাহলে জিগ্যেস করি বিপদটা কী ধরনের!
উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, অনেক কিছুই আমার জানা নেই। কারণ, তখন আমি নিতান্তই শিশু। পরেও বাবা-মা আমাকে সব ঘটনা বলত না। তবু যতদূর মনে আছে সে সময়ে রেড চায়না থেকে অনেককেই পালিয়ে যেতে হচ্ছিল। আমরাও সে দলে ছিলাম। কখনও পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, কখনও বোটে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। আমার দাদু ছিলেন খুব স্ট্রং, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি। বিপদে ঘাবড়ে যেতেন না। বাবা জোয়ান হয়েও যা পারত না, দাদু বুড়ো হয়েও তাই করে ফেলতেন।
একটু থেমে বললেন, একদিনের কথা আমার মনে আছে। বিদেশি পুলিশ আমাদের পুরো দলকে তাড়া করেছে। ঠিক কী কারণে রেড চায়না থেকে আমাদের পালাতে হয়েছিল জানি না, কেন পুলিশ তাড়া করেছিল তাও আজ পর্যন্ত জানি না। এইটুকু শুধু জানি অন্যদের মতো আমাদেরও কোনো সরকারি কাগজপত্র বা পরিচয়পত্র ছিল না। শেষে সেবার আমরা নৌকা নিয়ে ঐ অঞ্চলের জেলেদের নৌকোর মধ্যে ভিড়ে গিয়েছিলাম। মনে আছে আমাদের নৌকোর ছইটা ছিল ফুটো। বৃষ্টি পড়ছিল। টপটপ করে গায়ে জল পড়ছিল। শীতে খুব কাঁপছিলাম। মা একটা লাল রঙের টুপি মাথায় পরিয়ে দিয়েছিল।
মহিলাটি একটু থামলেন।
শান্তনু জিগ্যেস করল, তারপর?
তারপর অনেক ঘুরে, অনেক বাধা কাটিয়ে আমরা হংকং-এ একটা উদ্বাস্তু কলোনিতে এসে পৌঁছালাম। ভেবেছিলাম এখন নিশ্চিন্ত। কিন্তু তা হল না। একজন বিদেশী পুলিশ অফিসার দাদুর কাছ থেকে মোটা ডলার ঘুষ খেয়েও পেছনে লেগেছিল–আরও টাকা দিতে হবে। যেখানেই পালাই সেখানেই দুশমন হাজির।
সেই বিদেশী পুলিশটা খুবই নিষ্ঠুর ছিল। দাদুর ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে যখন-তখন পিছু পিছু ধাওয়া করে আসত। তার সঙ্গে থাকত একটি ভয়ংকর কুকুর। কখনও থাকত পোষা ওরাং ওটাং জাতীয় বিদেশী হিংস্র পশু। আমাদের পিছনে লেলিয়ে দিত।
তখন বাধ্য হয়ে দাদুকে অন্য ব্যবস্থা করতে হল। সেদিন সন্ধে থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছিল। দাদু পুলিশ অফিসারকে ডেকে আনলেন একটা নির্জন বারে কী কী শর্তে আরও ডলার দেবেন তাই নিয়ে আলোচনা করার জন্যে। তারপর গোপনে মদের গেলাসে বিষ মিশিয়ে মেরে দিয়ে পালিয়ে এলেন। সেদিনের তারিখ আর বার SATURDAY!
এই পর্যন্ত বলে মহিলাটি একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, অনেক খুঁজে শেষ পর্যন্ত এই হিলেতেই পাকাপাকিভাবে আশ্রয় নেন দাদু। কিন্তু তবু
তবু কী?
এখানেও সেই পুলিশটি—
মানে? সে তো তখন মৃত!
পরে বলব।
শান্তনু বলল, ম্যাডাম, আপনি কি এখুনি উঠবেন?
হাসলেন মহিলাটি। বললেন, কেন? গল্প করবেন?
শান্তনু বলল, কিছু জানবার ছিল। যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে।
বাবা! আপনাদের জ্ঞানের বাইরে! তা আমার মতো সামান্য একটা হোটেল-গার্লের পক্ষে—
যতটুকু পারেন।
বেশ। কী জানতে চান বলুন।
প্রথমেই জানতে চাই আপনার নাম। টাইটেল। নইলে কথা বলার অসুবিধে হবে।
আমার নাম! উনি একটু অবাক হয়ে তাকালেন। জানেন না? তারপর ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন। তাতে লেখা ‘SWEET HOME’। নীচে প্রোপাইটারের নাম ছাপা।
তাই তো! এই নামই তো বাইরের সাইনবোর্ডে জুলজুল করছে।
ধন্যবাদ মিস চিয়াং। আপনার নামটা আগেই আমাদের মনে করা উচিত ছিল।
উত্তরে চিয়াং হাসলেন একটু।
বলুন, এবার কী জানতে চান?
তার আগে কি আমরা শুনে নেব আপনার দাদুর বাকি কথা?
মিস চিয়াং বললেন, সেটা পরে বলব। আপনিই শুরু করুন মিস্টার রায়। আপনার কি ঘুম পাচ্ছে?
না না, আমি যখন চোখ বুজিয়ে থাকি তখন জানবেন আমি কিছু ভাবছি।
তাই নাকি? বাঃ! বেশ তো! তাহলে কী ভাবছেন বলুন। যদি দুর্ভাবনা হয় তাহলে ফয়সলা করবার চেষ্টা করব। বলে তাকালেন আমার দিকে।
বললাম, পৃথিবীর এমন কি কোথাও কোনো হোটেল, বোর্ডিং বা গেস্ট হাউস আছে যেখানে কোনো একজন বোর্ডারেরও সাড়া পাওয়া যায় না?
লক্ষ করলাম মিস চিয়াং-এর মুখটা যেন শুকিয়ে গেল।
আপনি কি আমার এই ‘হোমের’ কথা বলছেন?
ঠিক তাই।
মিস চিয়াং দুঃখমাখা গলায় বললেন, সে তো আমি আগেই বলেছি যতই যত্ন করি না কেন বাজার থেকে দূরে বলেই এখানে লোক আসে না। কিন্তু কী করব? ইচ্ছে করলেই তো নিজেদের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারি না। এই ‘হোম’ আমার দাদুর তৈরি। এর প্রতিটি পাথরে দাদুর স্মৃতি জড়িয়ে।
বললাম, সেটা বুঝি। কিন্তু বোর্ডার যেখানে নেই বললেই হয় সেখানে খরচ চালান কী করে? আপনার কর্মচারীদের মাইনেও দিতে হয়–তা যত কমই হোক।
মিস চিয়াং মাথা নিচু করে রইলেন। দেখে মায়া হল।
এখন ক’জন বোর্ডার আছে? আমাদের বাদ দিয়ে?
মিস চিয়াং নিঃশব্দে মাথা নাড়লেন। যার অর্থ একটিও না। তৎক্ষণাৎ বললাম, আমার মনে হচ্ছে আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে।
মিস চিয়াং অবাক হয়ে তাকালেন।
আমি নিশ্চিত যে, একটু আগে পর্যন্ত আরো কেউ ছিল।
কী বলছেন মিঃ রায়?
ঠিকই বলছি, আমি নিজে কানে কারো পায়ের শব্দ শুনেছি।
পায়ের শব্দ।
হ্যাঁ।
কোথায়?
আমাদের পাশের ঘরে।
তাহলে আরও বলি মিস চিয়াং, একটু আগে যখন আপনার অফিস ঘরে আসছিলাম তখন হঠাৎ দেখলাম কুকুরের চেয়ে ছোটো আকারের নেকড়ে জাতীয় কোনো জন্তু ছুটে ওদিকের পাঁচিলে উঠে পাহাড়ের দিকে মিলিয়ে গেল।
একথা শুনেই মিস চিয়াং চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিছু যেন বলতে চাইলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। উদ্ভ্রান্তের মতো একবার এদিক-ওদিক তাকালেন। তারপর ক্ষমা চেয়ে বললেন, আমি আর বসতে পারব না। বলে উঠে দাঁড়ালেন।
ঠিক আছে। বলে আমরাও উঠে পড়লাম।
চলুন, আপনাদের রুমে পৌঁছে দিই।
তার দরকার হবে না।
কিন্তু কথাটা তার কানে গেল না। তিনি আমাদের উদ্দেশ করে বললেন–আসুন আমার সঙ্গে। বলে ড্রয়ার থেকে কতকগুলো চাবি নিয়ে এগিয়ে চললেন। চার নম্বর ঘরের সামনে এসে বললেন, এটাই তো আপনাদের রুম?
হ্যাঁ, ম্যাডাম।
ভেতরটা একবার দেখে আসবেন?
দেখবার কিছু ছিল না। বিরূপাক্ষদা নিশ্চিন্তে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছেন।
ম্যাডাম আমাকে বললেন, আপনি কোন ঘরে পায়ের শব্দ পেয়েছিলেন?
আমি হাত দিয়ে পাশের ঘরটা দেখিয়ে দিলাম। ঘরটা তালাবন্ধ ছিল। উনি নিজেই তালা খুললেন। নিজেই সবার আগে ঢুকে গেলেন অন্ধকার ঘরে। সুইচ টিপলেন। আলো জ্বলল। বললেন, দেখুন ভালো করে।
দুজনেই দেখলাম। কেউ কোথাও নেই।
তাহলে সত্যিই এদিকে আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ নেই। তাই তো?
খুব জোরের সঙ্গে মিস চিয়াং নিজের কথাটা যে ঠিক তা বোঝাবার চেষ্টা করলেন বটে কিন্তু গলায় যেন তেমন জোর ছিল না।
.
০৪.
ভালোভাবেই রাতটা কেটে গেল। ভোরবেলা প্রথমেই ঘুম ভাঙল আমার। নতুন জায়গা বলে প্রথমটা ঠিক ঠাহর করতে পারিনি কোথায় আছি। একটু পরেই সব মনে পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম। তখনও শান্তনু ঘুমোচ্ছে। আর লেপের ওপর দু’খানা কম্বল চাপিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছেন বিরূপাক্ষদা।
পুরু সোয়েটারের ওপর একটা গরম চাদর জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
তখন ভোরের আলো সবে ফুটে উঠছে। বাড়ির পিছনেই পাহাড়টা। কাল সন্ধেবেলায় ভালো বোঝা যায়নি। আজ দেখে রীতিমতো ভয় করল। পাহাড়টা যেন কেমন অস্বাভাবিকভাবে ঝুঁকে আছে মিস চিয়াং-এর হোটেলের ওপর। কুচকুচে কালো পাথর। আর আশ্চর্য, পাহাড়ের গায়ে গাছপালার চিহ্নমাত্র নেই। বলা যেতে পারে ন্যাড়া পাহাড়। আর সেই পাহাড়ের পিছনেই ঘন অরণ্য। রহস্যঘেরা।
এবার একটু ঘুরে দাঁড়াতেই অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম হোটেলের গায়েই অজস্র লাল ফুলের সমারোহ। এত লাল ফুল! রডোড্রেনড্রন নয় তো? তাহলে তো ভালোই!
শান্তনুকে দেখাবার জন্যে ডাকতে যাব ভাবছি, দেখি শান্তনু ঘুমচোখে এসে দাঁড়িয়েছে, লাল ফুল দেখে সেও চমৎকৃত। বলল, আমারও মনে হচ্ছে এটাই প্রকৃত রডোড্রেনড্রন! তারপর হঠাৎ জিগ্যেস করল, কাল যে মিস চিয়াংকে বললে পায়ের শব্দ শুনেছিলে সেটা সত্যি?
অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি! মিথ্যে বলতে যাব কোন দুঃখে?
শান্তনু আমতা আমতা করে বলল, আয়্যাম স্যরি। আসলে, কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভেবেছি। বিশ্বাস করতে পারিনি। লোক নেই, জন নেই তবু পায়ের শব্দ! আচ্ছা সে কি হেঁটে বেড়াচ্ছিল?
ঠিক যে বেড়াচ্ছিল তা নয়। তুমি যখন অফিস ঘরে মিস চিয়াং-এর সঙ্গে গল্প করছিলে তখন একটু বিশেষ দরকারে আমি আমাদের রুমে ফিরে এসেছিলাম। দরজা ঠেসানো ছিল। ঘরে আলো তো জ্বালাই ছিল। বিরূপাক্ষদা নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ মনে হল পাশের ঘরে কেউ যেন আছে। তারপরেই শুনলাম তার পায়ের শব্দ।
শব্দটা কীরকম?
ভারী থপথপে পা ফেলে কেউ যেন ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে। মোটেই স্বাভাবিক মানুষের মতো স্টেপ ফেলা নয়। অনেকটা খোঁড়া মানুষের মতো পা ঘষটে হাঁটা।
সে কি ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল?
সেইরকমই মনে হল। পায়ের শব্দটা ঘর থেকে বেরিয়ে ঐ পাঁচিলের দিকে গেল।
অর্থাৎ পাহাড়ের দিকে?
তাই হবে। তারপরেই মিলিয়ে গেল।
শান্তনু জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মুখে বলল, হুঁ। বুঝলাম।
এমনি সময়ে হাসিমুখে ঢুকলেন মিস চিয়াং।
গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং–গুড মর্নিং! বলে আমরা দুজনেই সানন্দে অভ্যর্থনা জানালাম তাঁকে।
কেমন ঘুম হল নতুন জায়গায়?
বললাম, ফাইন। চমৎকার।
কিন্তু আপনাদের সিনিয়ার ফ্রেন্ড তো এখনও ঘুমোচ্ছে। শরীর ভালো তো?
না-না, মোটেই ভালো নয়। বলে বিরূপদা চোখ বুজিয়েই পাশ ফিরলেন।
কী হল আপনার? বলে মিস চিয়াং ঝুঁকে পড়লেন।
বিরূপাক্ষদা কোনোরকমে বললেন, জ্বর। পাহাড়ে জ্বর। এবার বোধহয় এই বিদেশ-বিভুঁয়ে প্রাণটাই রেখে যেতে হবে।
মিস চিয়াং নিঃসংকোচে বিরূপদার কপালে হাত রেখে জ্বর কতটা বুঝে নিলেন। মুখে বললেন, কোনো ভয় নেই। আমাদের জানা ডাক্তার আছে। ডাকলেই চলে আসবে। এখন একটু চা খাবেন?
না পরে। বলে পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
মিস চিয়াং বললেন, ওঁকে ঘুমোতে দিন। চলুন, আমার অফিস ঘরে। ওখানেই ব্রেকফাস্ট সারা যাক।
আমরা জিনজনেই ব্রেড, বাটার, এগ পোচ আর গরম কফি নিয়ে বসলাম। কাল যে মহিলাটিকে দেখেছিলাম আজ মনে হচ্ছে ইনি যেন তিনি নন। আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কাল রাত্তিরে তাঁর মুখের ভাবের যে পরিবর্তন ঘটেছিল, যে দুশ্চিন্তার ছাপ তার মুখে কাল ছায়া ফেলেছিল, আজ সকালে তার আর বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। একেবারেই স্বাভাবিক।
মিস চিয়াং কথা শুরু করলেন এইভাবে মিস্টার রায়, কাল রাত্তিরে বলছিলেন কার পায়ের শব্দ শুনেছিলেন, সারা রাতের মধ্যে আর কি কোনো শব্দ–
না না, তেমন কিছু নয়। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম।
তাহলে ভুল শুনেছিলেন স্বীকার করছেন তো?
হ্যাঁ, তা করছি।
যাক, নিশ্চিন্ত হলাম।
শান্তনু মিস চিয়াং-এর দৃষ্টি এড়িয়ে কটমট করে আমার দিকে তাকাল। আমি হেসে চোখ টিপে বুঝিয়ে দিলাম যা আমি শুনেছি তা ভুল কখনই নয়।
মিস চিয়াং আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, দরজায় জুতোর শব্দ শুনে তাকালেন।
কাকে চাই?
আগন্তুক ইশারায় আমাদের দেখিয়ে দিল। আমাদের উদ্দেশে বিক্রম সেলাম করল। বুঝলাম আজ আমরা শিলিগুড়ি ফিরব কিনা জানতে এসেছে।
শান্তনু বলল, বিক্রম, আজ আর ফেরা যাবে না। দাদাজির তবিয়ত খারাপ।
তবে কাল?
মিস চিয়াং আধা হিন্দি আধা চিনা ভাষায় বললেন, সন্ধেবেলা এসো। তখন জানিয়ে দেওয়া হবে।
বিক্রম ফের সেলাম করে চলে গেল। মনে হল আজ যেতে হবে না বলে যেন খুশিই হয়েছে। এখানে অনেকে তার জানাশোনা আছে। তাছাড়া একদিন থেকে যাওয়া মানেই ভালো টাকা লাভ।
বিক্রম চলে গেলে আমিই প্রথম কথা বললাম।
আপনার হোটেলের পিছনে বিস্তর লাল ফুল দেখলাম। এগুলো কি রডোড্রেনড্রন?
খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মিস চিয়াং-এর। বললেন–একেবারে আসল রডোড্রেনড্রন। রঙটা লক্ষ করলেন?
করেছি বৈকি!
শান্তনু বলল, এখানেই যখন আসল রডোড্রেনড্রনের দর্শন লাভ হয়েই গেল তখন আর বার্সে গিয়ে কী লাভ?
মিস চিয়াং বললেন, যদি শুধু ফুল দেখতে যাওয়াই উদ্দেশ্য হয় তাহলে ওখানে গিয়ে আর লাভ নেই।
তাহলে তো কালকেই আমরা এখান থেকে ব্যাক করতে পারি।
তা পারেন। অবশ্য কাল আপনাদের সিনিয়ার পার্টনারের শরীর কেমন থাকে তার ওপরই আপনাদের যাওয়া নির্ভর করছে। আর এককাপ করে চা হবে নাকি?
শান্তনু বলল, একটু পরে।
তাহলে এখন বলুন কাল কী কথা জানতে চাইছিলেন। আমার যদি উত্তর ঠিক জানা থাকে তাহলে সবই বলব।
শান্তনু বলল, দেখুন রহস্যটা গোড়া থেকেই। আর টানা অনেকক্ষণ ছিল।
মিস চিয়াং বললেন, আর একটু পরিষ্কার করে যদি বলেন। আপনারা কি কোনো অলৌকিক ব্যাপারের অভিজ্ঞতা বলতে চাইছেন?
বললাম, এক কথায় তা বলে বোঝানো যাবে না। দেখুন পাহাড়ে বেড়াতে ভালোবাসি বলেই আমি আর শান্তনু বেরিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ এসে জুটলেন বিরূপাক্ষদা–যাঁকে আপনি বলেন আমাদের সিনিয়ার পার্টনার।
মিস চিয়াং হাসলেন একটু–তারপর?
বিরূপাক্ষদা আমাদের চেয়ে বয়েসে অনেক বড়ো। ভ্রমণের নেশার কাছে উনি বয়েসকে পাত্তা দিতে চান না। তাই সহজেই মিশে আছেন আমাদের সঙ্গে।
তবে ফুল-টুলের মর্ম বুঝতে চান না। সামান্য ফুল দেখার জন্য শিলিগুড়ি থেকে পাহাড় ডিঙিয়ে সিকিমের বার্সে যাওয়াটা তার ভালো লাগেনি। তার মতে এটা পাগলামো।
মিস চিয়াং একটু হাসলেন। তারপর বললেন, রহস্যটা শুরু কোথা থেকে হল?
রহস্য শুরু হল শিলিগুড়ি থেকেই। কোনো ড্রাইভারই হিলের পথে যেতে রাজি হয় না। বিশেষ বারটা যখন শনিবার।
দেখলাম মিস চিয়াং কিছু নোট করলেন।
বললাম, আমাদের প্রথম প্রশ্ন–শনিবারে যেতে এত আপত্তি কীসের?
একটু থেমে বললাম, যাই হোক, অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে, বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে ঐ ড্রাইভারটিকে রাজি করানো হল। কিন্তু কিছুদূর যাবার পরই শুরু হল ড্রাইভারের ছটফটানি। ভয় পেতে লাগল। কীসের যেন আতংক।
এটা কোনখান থেকে?
আমার হয়ে শান্তনুই উত্তর দিল, জায়গাটার নাম জোরথাং। রংগীত নদীর কাছে।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। বিক্রম হিলে যেতে রাজি হলেও এই পথ দিয়ে কিছুতেই আসবে না। আমাদেরও জেদ এই পথ দিয়েই যেতে হবে। শেষে রাজি হল বটে কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না এলেই ভালো হত।
মিস চিয়াং টুকটুক করে কিছু নোট করে নিয়ে সকৌতূহলে জিগ্যেস করলেন, তারপর?
তারপরের ঘটনাগুলো (হিলে পৌঁছবার আগে পর্যন্ত) সব আমরা বলে গেলাম। উনি নোট করে নিলেন।
তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন মেঘ ডাকা, বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে ঐ কালো সুটপরা ওয়াটারপ্রুফ গায়ে লোকটির একটা সম্পর্ক আছে।
হ্যাঁ অবশ্যই।
তবে সবচেয়ে অবাক হচ্ছি যখন রাস্তার একদিকে পাহাড় থেকে দলে দলে নেকড়ের বাচ্চাগুলো নেমে অন্যদিকের পাহাড়ে গিয়ে উঠল। এত নেকড়ে দেখা যায়?
মিস চিয়াং একটু হাসলেন। বললেন, ওগুলো নেকড়ের বাচ্চা নয়।
তাহলে? অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
কিছুই না। চোখের ভ্রম। দুর্গম পাহাড়ে এইরকম চোখের ভুল হয়। খুবই বিপজ্জনক। এইভাবেই পাহাড়ের অশুভ শক্তি অসহায় মানুষকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেয়। খুব বেঁচে গেছেন।
না হয় তর্কের খাতিরে মেনেই নিলাম চোখের ভুল। কিন্তু কাল সন্ধেবেলাতেই আপনার এই হোটেলে যে জীবটিকে মুহূর্তের জন্য দেখা গিয়েছিল সেটাও কি চোখের ভ্রম? এ তো আর পাহাড় নয়। আপনার সাজানো-গোছানো ‘হোম’!
মিস চিয়াং এবার চট করে উত্তর দিতে পারলেন না। মুখটার ওপর একটা ছায়া নেমে এল। একটু চুপ করে থেকে বললেন, বুঝতে পারছি না। অন্য কেউ হলে বলতাম চোখের ভুল। কিন্তু আপনাদের সে কথা তো বলতে পারি না।
শান্তনু বলল, আপনি হয়তো জানেন শুধু ইন্ডিয়াতে নয়, ইন্ডিয়ার বাইরেও প্রায় সব দেশেই ভূতের ওপর অনেক ঘটনা আছে। তার সবই যে কাল্পনিক এমন ভাবার কারণ নেই। বেশির ভাগই যে সত্য তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আর এই সব সত্যি-মিথ্যে কাহিনির সঙ্গে দেখা যায় একটি হিংস্র পশুকে। সে পশু বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক নয়। নেকড়ে। প্রায় প্রতিটি কাহিনিতে নেকড়ে কী করে এল তার সঠিক তথ্য আমার জানা নেই।
তাই যদি হয়, অর্থাৎ আমাদের দেখা সেই নেকড়ের বাচ্চাগুলি যদি চোখের ভুলই হয়, তবে তো স্বীকার করে নিতেই হবে, শিলিগুড়ি থেকে হিলে পর্যন্ত আমরা পথে যা দেখেছি–যা কিছু ঘটল তা সমস্তই চোখের ভুল। কিছু মনে করবেন না মিস চিয়াং। একথা আমরা মানতে পারব না। বিশেষ করে আমরা স্বচক্ষে যা দেখেছি। আচ্ছা, আমাদের কথা না হয় বাদ দিন। কিন্তু আমাদের ড্রাইভার বিক্রম থাপা। ও তো আজ সন্ধ্যায় এখানে আসবে। তখন আপনিই ওকে জিজ্ঞাসা করবেন।
মিস চিয়াং একটু হাসলেন, বললেন, আপনাদের ধারণাকে না হয় সত্য বলে মেনে নিলাম। তা বলে নেকডের বাচ্চা এ বাড়িতে দেখার দুঃস্বপ্ন দু’চোখে নিয়ে বসে থাকলেও যেন ভেবে বসবেন না আমার এই হোমে ঘোস্ট জাতীয় কিছু আছে। আজ পর্যন্ত বহু বোর্ডার এখানে থেকে গেছে। তারা কেউ তেমন কথা বলেনি।
তারা কেউ বলেননি কেন তা জানি না, জানবার ইচ্ছেও নেই। আমরা এখানে ভূতের গল্পের প্লট খুঁজতে আসিনি। তবে যা দেখেছি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না।
মিস চিয়াং মুখ লাল করে বললেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার।
আমি আড়ালে শান্তনুকে বললাম, তর্ক কোরো না। মিস চিয়াং রেগে যাচ্ছেন। এখনও আমরা কিন্তু ওঁর আশ্রয়েই আছি।
শান্তনু একটু সামলে নিয়ে সহজ গলায় বলল, যাই হোক, ও প্রসঙ্গ থাক। আপনি কি আমাদের রহস্যটার ব্যাপার বুঝিয়ে বলবেন? আপনার কথামতো আমরা কিন্তু সব ঘটনা খুলে বলেছি। এখন আপনার ইচ্ছা।
মিস চিয়াং একটু ভেবে বললেন, বেশ বলুন কী জানতে চান?
শান্তনু বলল, প্রথমেই জানতে চাই শনিবারটা ড্রাইভারদের কাছে অপয়া কেন? কেন তারা এই পথ দিয়ে আসতে চাইছিল না? কে ঐ ওয়াটারপ্রুফ পরা লোকটা?
মিস চিয়াং একটুক্ষণ চোখ বুজিয়ে কী ভাবলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। ঠিক আছে। আমি উত্তর দেবার চেষ্টা করছি। শেষ থেকেই শুরু করব।
আপনাদের আমি যে লোভী অত্যাচারী বিদেশি পুলিশের কথা বলেছিলাম সেই হচ্ছে, যাকে আপনারা পাহাড়ের রাস্তায় ওয়াটারপ্রুফ গায়ে দিয়ে দাপাদাপি করতে দেখেছিলেন। ঐ পাহাড়ি রাস্তায় বৃষ্টির সময়েতেই অমনিটাই ঘটে। বৃষ্টি পড়ে বলেই ওয়াটারপ্রুফ। ওর নাম গর্ডন। দিনের পর দিন লোকটা দাদুকে ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত দাদু আর সহ্য করতে পারলেন না। ঠিক করেন সময়মতো সাহেবকে সরিয়ে দেবেন।
কিন্তু সেও তো যে-সে লোক নয়। হাতে প্রচুর ক্ষমতা। তখন দাদু মতলব ভাঁজতে লাগলেন। পুলিশ অফিসারটিকে আরও বেশি ডলারের লোভ দেখিয়ে হিলে ডেকে আনলেন। তারপর নানা অছিলায় নিয়ে গেলেন একেবারে জোরথাং। সেখানে একটা ছোটো রেস্টুরেন্টে আগে থেকেই ভালো ভালো খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন দাদু টাকা ছড়িয়ে। শুধু খাদ্য-পানীয়ের ব্যবস্থাই নয়, খাবার ঘরটির এক কোণে ভালো পর্দা, সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে ফ্লাওয়ার ভাস সাজিয়ে রাখার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলেন। তাছাড়াও রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে অনেক টাকা দিয়ে জনা দশেক গাড়ির ড্রাইভার আর স্থানীয় পাহাড়ি লোকের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
সাহেব টাকার লোভে দাদুর ফাঁদে পা দিলেন। আর তাকে ফিরতে হল না।
মৃত্যুর পর ঐ বিরাট দেহটার ব্যবস্থা কী করা হবে তাও ঠিক করা ছিল। একটু অন্ধকার হতেই সবাই ধরাধরি করে দেহটাকে পাশের খাদে ফেলে দিল। শত্রুর শেষকৃত্য এইভাবেই দাদু সম্পন্ন করে আমার কাছে ফিরে এলেন।
এই পর্যন্ত বলে মিস চিয়াং থামলেন।
শান্তনু জিগ্যেস করল, ঐ ড্রাইভারদের মধ্যে আমাদের বিক্রমও ছিল কিনা কে জানে?
মিস চিয়াং বললেন, গাড়ি চালাতে চালাতে ও যেরকম ভয় পাচ্ছিল বলছিলেন, তাতে মনে হয় ও-ও এসবের দলে ছিল। খুব বেঁচে গেছে।
আচ্ছা, এ ঘটনা কত বছর আগের মনে করেন?
বছর কুড়ি তো বটেই। আমার বয়সই দেখুন না। খুব বুড়িয়ে গেছি কি? বলে হাসলেন।
তারপর?
তারপর দাদু কিন্তু শান্তিতে থাকতে পারলেন না। কী এক দুশ্চিন্তায় ক্রমশই ভেঙে পড়তে লাগলেন। যতই জিগ্যেস করি, দাদু, কী হয়েছে তোমার?’ দাদু বলেন, না, কিছু হয়নি। আগে রোজ সকালে-বিকালে হিলের বাজারে বেড়াতে যেতেন। আস্তে আস্তে বিকালে বেরোনো বন্ধ করে দিলেন। তারপর একদিন দেখলাম সকালেও বেরোচ্ছেন না। সর্বক্ষণ শুয়ে থাকছেন। বললাম, ‘আজ একেবারেই বেরোলে না?’ দাদু আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, আমার মনে হচ্ছে বিদেশি পুলিশটা ঠিকমতো মরেনি।
‘ঠিকমতো’ মরেনি মানে কী? মরা তো মরাই। না মরলে বেঁচে থাকা।
দাদু অস্পষ্টভাবে কী বলতে চাইলেন প্রথমে কিছু বুঝতে পারিনি। তারপর অনেক কষ্টে বুঝলাম। দাদু বোঝাতে চাইছিলেন পুলিশটা গভীর খাদে পড়েও বেঁচে আছে।
শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। অত গভীর খাদে যাকে পাঁচ-ছ’জন মিলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল সে কখনও বাঁচতে পারে? আর সত্যিই যদি ভাগ্যক্রমে বেঁচে থাকে তাহলে তো দাদুকে শেষ করে দেবে?
তারপর দাদু এক-এক দিন এমন সব কাণ্ডকারখানার কথা বলতে লাগলেন যা থেকে বুঝলাম পুলিশটা ঠিকমতো মরে গেছে বলেই আরও শক্তি নিয়ে ফের জেগে উঠেছে। এখন তাকে ঠেকানো মানুষের অসাধ্য। মৃত্যুভয়ে দাদু অস্থির। হিলে’ থেকে একটু ওপর দিকে উঠলেই দেখা যাবে তাকে। পাহাড়ি জায়গায় বৃষ্টি প্রায় সব সময়েই লেগে থাকে। আর বৃষ্টি পড়লেই তার আবির্ভাব। ইউনিফর্মের ওপর ওয়াটারপ্রুফ জড়িয়ে হু হু করে তেড়ে আসছে। …এরই মধ্যে একদিন ঘটল একটা ঘটনা।
আমরা একটু নড়ে-চড়ে বসলাম।
… হিলেতে সবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জোর বৃষ্টি নয়। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। কনকনে বাতাস যেন গায়ে ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে। আমার হোটেলে এমনিতেই বোর্ডার কম। বৃষ্টি পড়লে তখন কোনো বোর্ডার আসবে এমন আশা করিনি। দরজা, জানলা বন্ধ করে ঘরে আলো জ্বেলে এইখানে ঐ চেয়ারটায় বসে আছি।
হঠাৎ কে যেন দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। অকারণেই আমি ভয় পেয়ে চমকে উঠলাম। বাইরের আলো জ্বালতে গেলাম। আশ্চর্য, জুলল না। অথচ ভেতরে আলো জ্বলছে।
আবার দরজায় ধাক্কা। এবার উঠতে হল। দরজার কাছ এগিয়ে ভারী পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। তারপর কাচের দরজা দিয়ে যা দেখলাম তাতে শিউরে উঠলাম। দেখলাম দাদু যে বিদেশি পুলিশটার কথা বলেন, যে আমার এখানে বারকয়েক এসেছিল, যাকে জোরথাং-এর রেস্টুরেন্টে দাদু মেরে ফেলেছিলেন, যার দেহটা পাঁচ-ছ’জন মিলে গভীর খাদে ফেলে দিয়েছিল সেই ‘গর্ডন’ সাহেব সশরীরে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ওয়াটারপ্রুফের হুডটা নেমে এসেছে কপাল পর্যন্ত। কপালের নীচে ভুরুশূন্য, পলকশূন্য দুটি লাল গর্তের মধ্যে ঝকঝক করছে দুটো হিংস্র চোখ। সে কথা বলার জন্য একবার হাঁ করল। অমনি বেরিয়ে এল কালো কালো দাঁত। দু’পাশের কষে কাদা।
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলাম, হুম ডু ইউ ওয়ান্ট?
সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় কী বলল বুঝতে পারলাম না। তবে যখন দরজার কাচের ওপর ‘হিপ হো’ নামটা আঙুল দিয়ে লিখে দিল তখন বুঝলাম দাদুকেই খুঁজছে। এও বুঝলাম দাদুর আর রক্ষে নেই।
তখনই দরজার ওপর পর্দা টেনে দিয়ে ভেতরে ছুটে এলাম দাদুর কাছে। দেখি দাদু কীভাবে বুঝতে পেরেছেন। ভয়ে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ করে শব্দ করছেন আর চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, আমি দাদুকে দু-তিন বার বললাম, ভয় পেও না। যে এসেছিল বুদ্ধের নাম করতেই সে চলে গেছে। দাদু দুই কঁপা কাঁপা হাত তুলে বুদ্ধের উদ্দেশে প্রণাম করলেন।
তারপর?
এবার মিস চিয়াং বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, তারপর চোখের জল সামলে বললেন, এরপর তিনি আর বাঁচতে চাননি। শেষের দিকে বলতেন, আমার বডি সাবধানে সমাধিস্থ কোরো। যত কম লোক সঙ্গে নিতে পারো, ততই ভালো। অন্ধকারে নিয়ে যাবে নিঃশব্দে। ও যেন জানতে না পারে কোথায় আমার বডি আছে। আমার বডির হদিস পেলে নানাভাবে উপদ্রব করবে তা জানি। সাবধান!
তারপর সেদিন ভোরবেলায় উঠে দাদুকে কফি দিতে গিয়ে দেখি দরজায় খিল দেওয়া নেই। অন্যদিন ঘড়ির কাটায় ছ’টা বাজতেই দাদু দরজা খুলে দিতেন। আমি কফির পেয়ালা নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। বলতাম… গুড মর্নিং গ্র্যান্ড!
হেসে, দাদু উত্তর দিতেন, ইয়েস! ভেরি গুড মর্নিং!
আজ দেখলাম দরজা ঠেসানো। ঠেলে ঘরে ঢুকতেই কাপ থেকে খানিকটা কফি চলকে পড়ে গেল। দেখলাম দাদু সিলিং থেকে ঝুলছেন! বলতে বলতে মিস চিয়াং দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন।
তারপর?
কিন্তু–
ওখানে কি কেউ দাঁড়িয়ে আছে?
না, দাঁড়িয়ে নেই। কালো কোট, কালো টুপি। কেউ যেন অন্ধকারে গা মিশিয়ে আমাদের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে।
আমি তখনই নিঃশব্দে মিস চিয়াং-এর চেম্বারে ফিরে এসে চাপা গলায় শান্তনুকে ডাকলাম, শিগগির।
শান্তনু চটপট উঠে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল। আমাদের হাবভাব দেখে মিস চিয়াং নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। নইলে তিনিও ব্যস্ত হয়ে আমাদের পিছু পিছু আসবেন কেন?
কিছু যেন দেখলাম।
কী দেখলে? কোথায় দেখলে?
আমাদের ঘরে ঢুকেছিল–ঐ যে ঐ যে বেরিয়ে যাচ্ছে।
মিস চিয়াং হয় তো দেখতে পাননি। কেননা তিনি তখনও দূরে ছিলেন। আমরা দুজনেই দেখলাম একটা চলন্ত প্যান্ট আর একটা কোট–আর একটা টুপি। দেহ নেই, কোনো অস্তিত্বই নেই। স্রেফ ভাসতে ভাসতে বাইরের পাঁচিলের দিকে চলে গেল। যেখানে মাত্র গত সন্ধ্যায় সেই নেকড়ের শাবক তার ছায়াশরীর নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সব শুনে মিস চিয়াং হতাশ সুরে বললেন, কই, আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না।
দুঃখের সঙ্গে কথাগুলো বললেও গলায় যেন ছিল আর একটা চাপা বেসুর।
শান্তনু ইশারা করে আমায় বলল, কী দেখলাম তা যেন চিয়াংকে না বলি।
কেন?
আমাদের ধারণা ও সব জানে। সব জেনেও না জানার ভান করছে। কেন?
কী উদ্দেশ্য?
আবার আমরা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। মিস চিয়াং আগের মতোই যেন গল্প করতে মন দিলেন। কিন্তু গল্প যেন জমছিল না। আমরা তিনজনেই কেমন অন্যমনস্ক।
এইভাবে ঘণ্টা দেড়েক চলল। এরই মধ্যে আমরা গিয়ে বিরূপদার সঙ্গে কথা বলে এসেছি। জ্বরটা অনেক কমে গেছে। একটু উঠে বসেছেন।
এই তো গুড বয়ের মতো ভালো হয়ে উঠেছেন। চলুন, বাইরের ঘরে গিয়ে বসবেন।
ওখানে বসে কী হবে? ওখানে তো যত অনাসৃষ্টি ইয়ের গল্প। সন্ধেবেলায় ওসব গল্প করা ঠিক নয়। বিশেষ এইরকম বাজে জায়গায়।
তাহলে আমরা যাই?
হ্যাঁ, তা যাও। আমি আর একটু ঘুমোবার চেষ্টা করি।
মিস চিয়াংকে এই খবর জানালে তিনি বললেন–বয়েস হয়েছে। তার ওপর জ্বর গেল। শরীরটা দুর্বল হয়ে গেছে। উনি কথা শেষ করেছেন, আর তখনই দরজায় জুতোর শব্দ। স্পষ্ট লক্ষ করলাম সামান্য জুতোর শব্দতেই …. উনি চমকে উঠলেন।
কে? কে ওখানে?
আমি ম্যাডাম। আসব?
আমরাও তাকালাম। বিক্রম থাপা।
ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বিক্ৰম বলল, আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে। বললাম, তাতে কোনো অসুবিধে হয়নি। হ্যাঁ, আমরা কালই যাব। এখনও পর্যন্ত এইরকমই
ঠিক।
কাল কখন গাড়ি আনব, স্যার?
ব্রেকফাস্ট করে বেরোব।
ঠিক আছে। বলে বিক্রম যাবার জন্য ঘাড় ঘোরাল। কিন্তু এরপরই তার ঘাড়টা যেন শক্ত হয়ে গেল। ওর দৃষ্টি তখন ঘরের জানলার ভেতর দিয়ে বারান্দার দিকে যেখানে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ অন্ধকারে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
মনে হল বিক্রমের চোখ দুটো যেন ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠল। আর সেই চোখের ভাষায় শুধু বিস্ময়–ভয়!
বিক্রম কি কিছু দেখেছে? অমন করে তাকাচ্ছে কেন?
বিক্রম!
বিক্রম উত্তর দিল না। তখনও ওর একটা পা দরজায় আর ঘাড়টা বেঁকিয়ে বিস্ফারিত চোখে সেই ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে। ঠোঁট দুটো কাঁপছে অস্বাভাবিকভাবে।
বিক্রম! ধমকে উঠল শান্তনু, কী দেখছ অমন করে?
কে ওখানে? কে ও? একজন বুড়ো-সাদা দাড়ি-ক্রমশই লম্বা হচ্ছে! … চললাম স্যার। এখানে আর একদণ্ড নয়। যদি বেঁচে থাকি তাহলে কাল ঠিক সময়ে গাড়ি নিয়ে আসব। বলতে বলতে বিক্রম যেন মরিয়া হয়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দিল।
শান্তুনু আর আমি মিস চিয়াং-এর অনুমতি না নিয়েই বাঁ দিকের সেই ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে ছুটলাম। গাছটার পিছনেই পাহাড়। তারই গায়ে একটা গুহার মতো। তখন কোনো মূর্তি দেখা গেল না। শুধু সাদা খানিকটা ধোঁওয়া গুহার মুখ দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে।
আশ্চর্য! মিস চিয়াং-এর কিন্তু ব্যস্ততা নেই। অনেক পিছনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে আসছেন। মুখে ভয়ের ছাপ–কিন্তু কৃত্রিম। তাঁর মুখে ভয় কিন্তু অন্তরে নয়।
কী ব্যাপার, মিস্টার রায়? কিছু কি দেখতে পেলেন?
আমরা যতটুকু দেখেছি তাতেই যা বোঝবার বুঝে নিয়েছি। মুখে বললাম, কই? কিছুই তো নেই।
আমি জানতাম। এসব আমার ‘হোম’-এর বিরুদ্ধে বদনাম রটানোর চেষ্টা। বলে আর এগিয়ে না এসে ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে।
এই অবসরে শান্তনু চাপা গলায় বলল, আজই আমাদের সুবর্ণ সুযোগ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস চিয়াং-এর দাদুকে এ বাড়িতেই রাখা আছে। আজ তার গোপন ডেরা থেকে বেরোনোর কথা বোধ হয় ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তিনি অস্বস্তিতে পড়েছেন। তবু দেখা করতেই হবে। তাই আমার বিশ্বাস আজ কিছু একটা ঘটবে। সজাগ থেকো।
মিস চিয়াং-এর চেম্বারে এসে বসলাম। এতক্ষণে লক্ষ পড়ল বৃদ্ধ চিনা ওয়ন একমনে খাতাপত্র নিয়ে ঘাড় গুঁজে বসে কাজ করেই যাচ্ছে। এত যে কাণ্ড ঘটে গেল তা কি ওর কানে যায়নি? না কি গুরুত্ব দেয়নি? আশ্চর্য!
ঘরে ঢুকতেই বিরূপাক্ষদা জিগ্যেস করলেন, কাল আমরা ফিরছি তো?
শান্তনু বলল, তাই তো ভাবছি।
অমন হেঁয়ালি করে কথা বল কেন? এই তো বললে কালই যাওয়া হবে। তাহলে—
শান্তনু হেসে বলল, আমি তো বলিনি কাল যাওয়া হবে না।
তাহলে?
আগে রাতটা নিরাপদে কাটুক।
বিরূপাক্ষদা যেন চুপসে গেলেন। বললেন, ওরে বাবা!
অনেক রাতে শান্তনুর খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠতেই শান্তনু আমাকে চুপ করে থাকতে বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছ?
বললাম, এ তো বিরূপাক্ষদার নাক ডাকা।
দূর! ভালো করে কান পেতে শোনো।
এবার শুনতে পেলাম। কাছেই কোথাও কেউ শাবল দিয়ে কোদাল দিয়ে পাথর সরাচ্ছে।
হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি।
তাহলে আর দেরি নয়। চটপট বেরিয়ে পড়ো।
তাই করলাম। কোনোরকমে পাজামার উপর পাঞ্জাবি চড়িয়ে দরজা বাইরে থেকে ঠেসিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়লাম।
মনে মনে বললাম, বিরূপদা, এইরকম বিপদের সময়ে আপনাকে কিছুক্ষণের জন্যেও একা রেখে যাচ্ছি। উপায় নেই। তার জন্য ক্ষমা করবেন। ঈশ্বর আপনার সহায় হোন।
আবার সেই অন্ধকার প্যাসেজ। এখন যেন আরও বেশি অন্ধকার মনে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে।
রাত বলেই মিস চিয়াং-এর চেম্বারে একটা হাল্কা আলো জ্বলছে। সেই আলোয় আমরা সাবধানে চেম্বারের বাঁদিকের প্যাসেজ ধরে এগিয়ে চললাম।
চাপা গলায় বললাম, নিরস্ত্র অবস্থায় এইভাবে কি যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে?
শান্তনু বলল, তাছাড়া উপায় কী? আমরা করো সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাচ্ছি না। শুধু রহস্যভেদ করতে যাচ্ছি। তবে যদি কেউ আক্রমণ করে তাহলে শক্তি পরীক্ষা দেব।
শান্তনুর অভয়বাণী শুনলাম বটে, কিন্তু সাহস পেলাম না। এই তো সেই জানালা। যে জানালা দিয়ে পিছনের বারান্দাটা দেখা যায়। কিন্তু এখন সব অন্ধকারে লেপা। আমরা আমাদের এদিকের বারান্দা দিয়ে পাঁচিল পর্যন্ত গিয়েছি। কিন্তু এদিকটা আসার সুযোগ হয়নি।
সাবধানে টর্চ জ্বালব?
বললাম, না–না!
আঃ! পেন্সিল টর্চটা আনলে হত।
সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে কোদালের শব্দ অনুসরণ করে আমরা আরও খানিকটা এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। আমরাও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সেই ইউক্যালিপটাস গাছটার নীচে থেকে যেন একটা মূর্তি উঠে দাঁড়াল।
সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনের হাতের টর্চ একসঙ্গে জ্বলে উঠল।
সেই জোরালো আলোয় কালো গাউন পরা মিস চিয়াং স্পষ্ট হয়ে দেখা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত থেকে শাবলটা পড়ে গেল।
এ কি আপনারা? এখানে কী করছেন?
আপনাকে জানতে চেষ্টা করছি।
মিস চিয়াং কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে এসে দু’চোখ তুলে বললেন–কী জানতে চান বলুন? এর আগে তো সব বলেছি।
না, সব বলা হয়নি। সেইটুকুই শুনব।
বেশ বলুন কী জানতে চান। এখানে কী করছিলাম?
তা জানি। আপনি পাথর সরিয়ে কোনো সুড়ঙ্গপথের দরজা খুলছিলেন।
মিস চিয়াং বললেন–হ্যাঁ তাই।
এখানে কী আছে?
অনেক গোল্ড অনেক–আমার সারা জীবনের সম্পদ।
গোল্ড!
শান্তনু এবার মিস চিয়াং-এর চোখের ওপর টর্চ ফেলল।
মিথ্যে কথা।
মিস চিয়াং চুপ করে রইলেন।
গোল্ডের চেয়ে ঢের মূল্যবান কিছু।
একটু থেমে শান্তনু বলল, আমরা কিন্তু জানতে পেরেছি কী আছে।
মিস চিয়াং আঁতকে উঠে বললেন, কী? কী জানতে পেরেছেন, বলুন।
শান্তনু বলল, ওখানেই শোয়ানো আছে আপনার দাদুর দেহ। যার মাথার চুল পাকা, যাঁর বুক পর্যন্ত লম্বা সাদা দাড়ি। যিনি এখন বাতাসের চেয়েও হালকা।
একটু থেমে শান্তনু আবার বলল–এও জানি সেই শয়তান লালমুখো পুলিশের প্রেতাত্মার ভয়ে দাদুর বডি আপনি অন্য কোথাও সমাধিস্থ না করে বাড়িতেই করেছিলেন।
মিস চিয়াং চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন। তারপর ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, তাহলে আর আমার বলার কিছু নেই। এখন কী করতে চান? লোকাল পুলিশকে জানাবেন আমার দাদুর আত্মঘাতী হওয়ার কথা? জানাবেন বেআইনিভাবে একটা ডেড-বডি আমারই হেফাজত থেকে লোপাট করে পাহাড়ের সুড়ঙ্গে লুকিয়ে রেখেছি। তাই যান। থানায় যেতেই বা হবে কেন? চলুন আমার অফিস ঘরে। ওখানে টেলিফোন আছে। বলতে বলতে মিস চিয়াং উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।
আসুন আমার অফিস ঘরে। বলে আমাদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বেলে দিলেন।
অনুগ্রহ করে বসুন।
আমরা বসতেই উনি টেলিফোনটা এগিয়ে দিলেন।
এই যে পুলিশ স্টেশনের নাম্বার। ওদের আসার অপেক্ষায় থাকব। আমায় অ্যারেস্ট করুন। আমি রেডি।
শান্তনু ফোনটা সরিয়ে দিয়ে বলল, আপনি দয়া করে শান্ত হন, মিস চিয়াং। আমরা তদন্ত করতে আসিনি। দাদুর কাছ থেকে সরিয়ে আপনাকে থানাতে পাঠাতেও নয়। যে রহস্যকে সঙ্গে নিয়ে এতদূর এসে পড়েছিলাম সেই রহস্যের সমাধান আজই হয়ে গেল। এখন কালই চলে যাব। কিন্তু একটা কথা–সেই পুলিশের প্রেতাত্মা আপনার দাদুর বডি খুঁজতে খুঁজতে আপনার হোম পর্যন্ত চলে এসেছে। জানেন তো?
জানি।
এখন বডিটাকে বাঁচাবেন কী করে?
জানি না। সপ্তাহে একদিন-দু’দিন বডিটাকে দেখে আসি। একটা তেল মাখাই। তবু দাদু মাঝে মাঝে কফিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। যেমন আজ হঠাৎ বেরিয়ে পড়েছিল। বোধহয় বুঝতে পেরেছে তার শত্রু কাছেই এসে পড়েছে। আমাকে সাবধান করতে চায়।
কিন্তু–
কিন্তু আমি আর কী করে সাবধান হব? বলুন–আপনারা বলুন—
বলতে বলতে মিস চিয়াং-এর দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ল।
বললাম–ভয় নেই। আপনি পারবেনই। কারণ আপনার দাদুর দেহই বলুন আর আত্মাই বলুন আপনার ভালোবাসা পেয়ে অজেয় হয়ে উঠেছে। কোনো অশুভ শক্তির সাধ্য নেই সেই পবিত্র দেহের ক্ষতি করতে পারে।
কথা শেষ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
ভোরের আকাশ তখন ফর্সা হয়ে আসছে।
[শারদীয়া ১৪১৫]
আতঙ্ক
হঠাৎ কলিংবেল বাজল। খুব আস্তে। বেল বাজানোর ধরন শুনেই বোঝা গেল অপরিচিত কেউ। নিশ্চয়ই ভদ্র, বিনীত। তবু অনাদিবাবু অবাক হলেন। এই অসময়ে কে আসতে পারে?
জায়গাটা কলকাতার টালিগঞ্জ এলাকার কুঁদঘাট। একসময়ে পরিত্যক্ত ছিল। এখন দিন যত যাচ্ছে ততই লোকবসতি বাড়ছে। তবু এখনো এখানে-ওখানে বাঁশঝাড়, জলা-জঙ্গল। বাইরে থেকে এসে সে সময়ে অনাদিবাবু বুদ্ধিমানের মতো সামান্য টাকায় বাড়িটা করে ফেলেছিলেন। পাড়ার সকলেই পরিচিত।
এখন বেলা দুটো। অনাদিবাবু খেয়েদেয়ে কাগজ পড়ছিলেন। এমনি সময়ে কলিংবেল বাজল কি-রিং।
অনাদিবাবু উঠে দরজা খুলে দিয়ে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেন। তারপরেই হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন, আসুন–আসুন।
সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীকে ডাকলেন, শুনছ? দেখে যাও কে এসেছেন।
ভদ্রমহিলাকে হঠাৎ দেখলে ভয় পেতে হয়। কুচকুচে কালো রঙ, মাথার চুল জট পাকিয়ে গিয়েছে। নাকটা থ্যাবড়া। চোখ দুটো গোল। একটু লালচেও। পরনে গেরুয়া কাপড়। কাছা দিয়ে পরা। হাতের ক্যাম্বিসের ব্যাগটা মাটিতে রেখে হাতজোড় করে অনাদিবাবুদের নমস্কার করে ইংরিজিতে বললেন, দেখা করতে এলাম।
অনাদিবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই নমস্কার করে বললেন, আমাদের সৌভাগ্য। মাদ্রাজী এই মহিলাটির সঙ্গে অনাদিবাবু আর তাঁর স্ত্রীর পরিচয় হয়েছিল বছর তিনেক আগে দক্ষিণ ভারতে তিরুপতির পাহাড়ে। ভদ্রমহিলা দীর্ঘদিন ধরে প্রেতচর্চা করেন। শুধু প্রেতচর্চাই নয়, মনোবিকারগ্রস্ত লোকেদের ওপর
প্রচণ্ড শক্তিতে প্রভাব বিস্তার করতেও পারেন।
এর সঙ্গে পরিচিত হয়ে অনাদিবাবুরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে আসবার সময়ে অনাদিবাবু বলেছিলেন, মাতাজি, কলকাতায় যখনই আসবেন, আমার বাড়িতে একবার পায়ের ধুলো দেবেন।
মাতাজি কথা দিয়েছিলেন। গতবার দার্জিলিং যাবার পথে কলকাতায় এসে দেখা করেছিলেন। এবার যাচ্ছেন কাশ্মীর-পহেলগাঁও। যাবার পথে তাই দেখা করতে এসেছেন।
দুপুরবেলায় বিশ্রামের পর বিকেলে ওঁরা তিনজন বসে গল্প করছেন, শুভা কলেজ থেকে ফিরল। তাকে দূর থেকে দেখেই মাতাজি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। অনাদিবাবু বললেন, আমাদের মেয়ে শুভা, একটিমাত্র মেয়ে।
শুভা ভুরু কুঁচকে মাতাজিকে একবার দেখেই চলে যাচ্ছিল, শুভার মা ডাকলেন, ও কি! চলে যাচ্ছ কেন? প্রণাম করো। সেবার সাউথে গিয়ে এঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল।
শুভা কোনোরকমে প্রণাম করে বেজার মুখে দাঁড়িয়ে রইল। মাতাজি যেন কেমন একরকমভাবে শুভকে দেখছিলেন।
–আপনাদের মেয়ে? তিরুপতিতে তো দেখিনি। আগের বার এসেও দেখিনি।
অনাদিবাবু বললেন, তিরুপতিতে ও যায়নি। আর যেবার আপনি এখানে এসেছিলেন তখন ও ছিল ওর মামার বাড়িতে।
মাতাজি শুভকে দেখতেই লাগলেন। শুভার মা বললেন, শরীরটা ওর মোটেই ভালো যাচ্ছে না। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া একরকম বন্ধ। সব সময়ে কী ভাবে। আর মেজাজ
মায়ের কথার মাঝখানেই শুভা বিরক্ত হয়ে চলে যাচ্ছিল, মাতাজি সস্নেহে ওর হাতটা চেপে ধরে ইংরিজিতে বললেন, রাতে তোমার বোধহয় ভালো ঘুম হয় না। তাই না?
শুভা এক মুহূর্তের জন্যে অবাক হয়ে মাতাজির দিকে তাকাল। তারপর জানি না বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল।
শুভার মা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখলেন তো কিরকম অভদ্র! কিন্তু এরকম ও ছিল না। বছর চারেক থেকে ও যেন কেমন হয়ে উঠছে।
বছর চারেক? এখন তো ও কলেজে পড়ছে। তাহলে তখন
–তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। পড়াশোনায় খুব ভালো। ধীর, শান্ত
বাধা দিয়ে মাতাজি বললেন, ইস্কুলে কি ওর কোনো অশান্তি ছিল?
শুভার বাবা বললেন, না, অশান্তি আর কি। পড়াশোনা নিয়েই থাকত। তবে–
এই পর্যন্ত বলে তিনি শুভার মায়ের দিকে তাকালেন।
শুভার মা বললেন, তবে অশান্তি বাধাত একটি মেয়ে–শিখা। গাজিয়াবাদ না কোথা থেকে নতুন এসেছিল। যেমনি রূপ, তেমনি দেমাক। সে শুভাকে একেবারে সহ্য করতে পারত না। ও পড়াশোনায় ভালো, দেখতে খারাপ নয়, সবাই ওকে ভালোবাসত। আর শিখা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরত। আশ্চর্য!
মাতাজি হেসে বললেন, আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এক ধরনের মানুষ থাকে যারা স্বভাবতই ঈর্ষাপরায়ণ। তারা কাউকে সুখী হতে দেয় না, নিজেও সুখী হতে পারে না।
একটু থেমে বললেন, মেয়েটিকে কি আপনি কখনো দেখেছিলেন?
-হ্যাঁ, একবারই।
মেয়েটি কি খুব বেপরোয়া?
খুবই। টিচারদেরও নাকি মানত না।
মাতাজি টেবিলের ওপর একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, হাতে ছড়ি জাতীয় কিছু নিয়ে বেড়াতে ভালোবাসত? পায়ের কাছে ঢিল পেলে কুড়িয়ে নিয়ে অকারণে কুকুর, ছাগল মারত?
শুভার মা হেসে বললেন, অত বলতে পারব না। তবে বিরাট একটা কুকুর নিয়ে ঘুরত। একদিন শুতাকে রাস্তায় একা পেয়ে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল। ভাগ্যি ঠিক সেই সময়ে মেয়েটার দাদা এসে পড়েছিল। তাই শুভা বেঁচে গিয়েছিল।
– যাক, একটা বড়ো রকমের অ্যাকসিডেন্ট থেকে আপনার মেয়ে বেঁচে গিয়েছে। আচ্ছা, সে কি আপনার মেয়েকে কোনোভাবে টিজ করত?
–নিশ্চয়। তার টিজ করার জ্বালায় তো শুভকে ইস্কুল ছাড়তে হতো।
–কিরকম টিজ করত একটু বলুন।
–সে আর কত বলব। দল পাকিয়ে ওর বিরুদ্ধে নানা কথা রটাত, অঙ্গভঙ্গি করে ভ্যাঙাত। সিঁড়ি দিয়ে হয়তো নামছে–শিখা ওপর থেকে এসে হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে চলে যেত। এমনি কত। শুভা তো সব বলত না।
মাতাজি মন দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন–মেয়েটি এখন কোথায়? নিশ্চয়ই এখানে নেই?
শুভার মা বললেন, ঠিকই বলেছেন। ওরা এখন আর এখানে নেই। ইস্কুল ছেড়ে দেবার পরই চলে যায়।
–ইস্কুল ছেড়ে দিল কেন?
–সেও এক কাণ্ড। একদিন শিখা টিফিনের সময়ে আর একটা মেয়ের বই চুপি চুপি নিয়ে শুভার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে চোর সাজাবার চেষ্টা করে। মেয়ে তো কেঁদেকেটে অস্থির। এই নিয়ে তুলকালাম। একটি মেয়ে বুঝি শিখার কাণ্ডকারখানা দেখে ফেলেছিল। সেই সব ফাঁস করে দেয়। শিখা ছুটে গিয়ে সেই মেয়েটার গলা টিপে ধরে। মেরেই ফেলত। ভাগ্যজোরে বেঁচে যায়। হেডমিস্ট্রেস শিখার গার্জেনের কাছে কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেন। ব্যস! তারপরই শিখা ইস্কুল ছেড়ে দিল।
মাতাজি বললেন, কিন্তু তাতেও অশান্তি ঘুচল না, কি বলুন?
–ওরে বাবা! অশান্তি ঘুচবে কি, আরো বেড়ে গেল। উড়ো চিঠি আসতে লাগল–পড়াশোনা না ছাড়লে শুভকে মরতে হবে। কী সাংঘাতিক কথা ভাবুন তো!
মাতাজি বললেন, শুভা নিশ্চয়ই ইস্কুল ছাড়েনি?
–সে মেয়েই নয়।
উড়ো চিঠির কথা পুলিশে জানিয়েছিলেন?
–হ্যাঁ। কিন্তু ওরা তখন এ তল্লাট থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালিয়েছে।
মাতাজি চুপ করে ভাবতে লাগলেন।
শুভার মা বললেন, মেয়ের যে তারপর কী হলো–হাসি নেই–আনন্দ নেই–দিন দিন যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে।
মাতাজি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি একবার আপনার মেয়ের সঙ্গে কথা বলব। আমি নিজেই যাচ্ছি ওর কাছে। আপনারা এখানেই থাকুন।
টেবিলের ওপর দুহাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসেছিল শুভা। মাতাজি ঢুকেই বললেন, রাত্তিরে তোমার ঘুম হয় না। নিশ্চয় তুমি ভয় পাও?
শুভা বিরক্ত হয়ে মুখ তুলে তাকাল। মাতাজি বলতে লাগলেন, আমি জানি যখনই তুমি একা থাক তখনই কিছু দেখতে পাও। ঠিক কিনা?
শুভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
–উত্তর দাও?
এবার শুভা নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়াল। কোনোরকমে বলল, হ্যাঁ।
–কি দ্যাখ, পরিষ্কার করে বলো।
শুভা একটু চুপ থেকে বলল, তেমন কিছু নয়, ঘরে হয়তো একা পড়ছি, বাড়িতে কেউ নেই, মনে হলো কেউ যেন চট্ করে সরে গেল। কখনো মনে হয় পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাতে প্রায় কিরকম একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। দেখি ঘরের মধ্যে কি যেন নড়ে বেড়াচ্ছে। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে যাই। বুকের মধ্যে কিরকম করে।
–মা-বাবাকে এ কথা বলেছিলে?
না।
–কেন?
–কেউ বিশ্বাস করবে না। উল্টে ঠাট্টা করবে। নইলে বলবে মানসিক ব্যাধি। আমি সায়েন্স-পড়া মেয়ে। আমি নিজেকে বুঝি। জানি এ আমার ব্যাধি নয়। কেউ একজন আমাকে মারবার চেষ্টা করছে।
মাতাজি শান্ত গলায় বললেন, কে মারবে তোমায়?
শুভার মুখটা হঠাৎ বিবর্ণ হয়ে গেল। বলল, তা জানি না। তবে যে আমাকে রোজ ভয় দেখাচ্ছে সেই-ই আমায় মারবে।
মাতাজি চুপ করে তাঁর নিজের আঙটির মস্তবড়ো পাথরটা অকারণ নাড়তে লাগলেন। তারপর বললেন, আমি শুধু আর একটা কথা জিগ্যেস করব। তুমি কি এর মধ্যে কোনোদিন তোমার ইস্কুলের সেই মেয়েটিকে শিখা যার নাম–স্বপ্নে কিংবা অন্য কোনোভাবে দেখেছ?
শুভা অবাক হয়ে বলল, তা কি করে দেখব! ও তো আর এখানে নেই। কোথায় আছে তাও জানি না।
মাতাজি একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, তাও হয়তো শীগগির জানতে পারবে। তবে আমার একটা কথা কিছুতেই ভয় পেও না। মনে রেখো দুষ্ট আত্মা ভয় দেখাতেই পারে, সজীব মানুষের কোনো ক্ষতি করতে পারে না, যদি না জীবিত মানুষ নার্ভাস হয়ে পড়ে।
কি-ন্তু- দুষ্টু আত্মার কথা বলছেন কেন? শুভার গলা কেঁপে উঠল। শিখা কি তবে–
–ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি আজ যাচ্ছি। পরে আবার দেখা হবে। বলে শুভার মাথায় হাত রাখলেন।
সঙ্গে সঙ্গে শুভার শরীরটা কেমন করে উঠল। যেন ইলেকট্রিকের শখ খেল।
.
তারপর একদিন।
গভীর রাত। আকাশে মেঘ থমথম করছে। শুভার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কেবলই এপাশ-ওপাশ করছে। পাশের ঘরেই বাবা ঘুমোচ্ছন। এখান থেকেই নাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। শুভার মনে হলো সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষই বুঝি ঘুমোচ্ছে। জেগে শুধু সে একা।
ভাবতে ভাবতে কখন একসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল কতকগুলো কুকুরের ডাকে। কুকুর তো ডাকতেই পারে। অমন কত দিন কত রাত্রে কত কুকুর ডেকে গেছে। কিন্তু আজকের ডাকটা যেন কেমন। যেন প্রচণ্ড ভয়ে কুকুরগুলোর গলা কাঁপছে। কুকুরের ডাকটা ক্রমে দূরে মিলিয়ে গেল। আর তারপরেই শুভার ঠিক মাথার জানলাটায় শব্দ হলো খট-খট-খ। সেই সঙ্গে ঝড়ের গোঙানি।
ঝড়েই কি জানলা খটখট করছে?
শুভা ধড়মড় করে হাতের ওপর ভর দিয়ে মাথা তুলে জানলার দিকে তাকাল। কি যেন দেখল। সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত দেহটা অবশ হয়ে গেল। একটা ছায়ামূর্তি। ঠিক যেন–ঠিক যেন–
কিরে চিনতে পারছিস? জানলার গ্রিলটা ধরে বাইরে ঝুলছে শিখা। ঝোড়ো হাওয়ায় তার লম্বা চুলগুলো উড়ছে। মুখটা ভালো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু গলার স্বর পরিষ্কার। চিনতে না পারিস তো মনে করিয়ে দিই। আমি তোদর সেই শিখা। তোর জন্যেই আমাকে ইস্কুল ছাড়তে হয়েছিল। তোর জন্যেই অনেক অপমান। প্রতিশোধ তখন নিতে পারিনি। এখন নেব। আজ আমার মৃত্যুদিন। তাই দেখা করে গেলাম।
শিখা একটু থামল। জানলার গ্রিলে মাথাটা রেখে কেমন একরকম চোখ বের করে তাকাল। তারপর বলল, আজ থেকে সাত দিনের মধ্যে তোকে মারবই। কথাটা জানিয়ে গেলাম।
আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। সেইটুকু আলোয় শুভা দেখল কী যেন একটা হাওয়ায় সাঁতার কেটে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শুভা চিৎকার করে উঠল।
ব্যাপারটা সবাই শুনল। এটা যে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না সে বিষয়ে সকলেই নিঃসন্দেহ। তবু সাতটা দিন সবাই শুভকে সাবধানে থাকতে বলল। শুভা বিমর্ষ গলায় বলল, কী আর সাবধান হব?
ছটা দিন কেটে গেল। এতটুকু অশুভ ছায়া নেই। রাত্তিরে সেই যে কুকুরের ডাক শুনেছিল, সে ডাকও আর শোনা যায়নি। এমন কি ঘুমেরও ব্যাঘাত হয়নি। কিন্তু পরের দিন–
দিনের বেলা। ঘড়িতে তিনটে বাজল। রোজকার মতো শুভা দোতলার ছাদে উঠল শুকনো কাপড় তুলতে। একমনে কাপড় তুলে যাচ্ছিল। লক্ষ্য পড়ল, কয়েকটা বাড়ির পরে যে বাড়িটা, তার ছাদে দাঁড়িয়ে তারই বয়সী একটি মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেয়েটিকে শুভা চিনতে পারল না। কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে হলো না। সে একটা একটা করে শাড়ি, ব্লাউজ, ধুতি আলসে থেকে তুলতে লাগল। কিন্তু মুশকিল হলো বাবার গেঞ্জিটা নিয়ে। গেঞ্জিটা উড়ে পড়েছে কার্নিসের ওপর। একটু জোর বাতাস পেলেই পড়বে রাস্তার নর্দমায়। অথচ আলসে থেকে ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ালেও নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। শুভা একটা লাঠি বা লম্বা কাঠি খুঁজল। কিন্তু তেমন কিছু পেল না। নিচে গিয়ে কিছু একটা নিয়ে এলেই হয়, কিন্তু শুভার আর নিচে নামতে ইচ্ছে করল না। ঠিক করল গেঞ্জিটা নিয়ে অবে যাবে।
কিন্তু নেবে কি করে? ওটা যে নাগালের বাইরে। নিতে গেলে তাকে আলসে টপকে ঐ সরু কার্নিসের ওপর নামতে হয়। আর ওখানে নামা মানেই হয় কার্নিস ভেঙে, না হয় মাথা ঘুরে একেবারে রাস্তায় পড়ে যাওয়া। পড়লে আর রক্ষে নেই।
শুভা আলসের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। তার মনে হলো পড়ে যাওয়া কি এতই সোজা? সার্কাসে সে শূন্যে দোল খাওয়ার কত খেলা দেখেছে। তারাও তো তারই মতো মেয়ে। তারা কি পড়ে যায়? তারা যদি অমন মারাত্মক খেলা খেলতে পারে তাহলে সে কেন কার্নিসে নেমে সামান্য একটা গেঞ্জি তুলে আনতে পারবে না?
কী করবে ভাবছে হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল সেই মেয়েটার দিকে। সে হাসছে। আর আশ্চর্য হাত দিয়ে ক্রমাগত ইশারা করছে কার্নিসে নামার জন্যে। এবার শুভা আর কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। লোকে যেমন করে ঘোড়ায় চাপে তেমনি করে পরনের শাড়িটা গুটিয়ে আলসের ওপর চেপে বসল। সে যে কী অদ্ভুত দৃশ্য! তারপর যেই ডান পা-টা বাড়িয়ে দিয়েছে মরণ-ফঁদের দিকে অমনি কে যেন কঠিন স্বরে ডাকল, শুভা! নেমে এসো শীগগির!
শুভা চমকে উঠে দেখল ছাদে কখন বাবা উঠে এসেছেন। বাবাকে দেখে তার যেমন আনন্দ হলো তেমনি ভয় হলো। তার মনে হলো সে যেন ইচ্ছে করে কত বড়ো অপরাধ করতে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি আলসে থেকে নেমে মাথা নিচু করে নিচে নেমে গেল।
.
কদিন মোটামুটিভাবে কাটল। শুভার মানসিক অবস্থার কিন্তু উন্নতি নেই। বরং আরো একটু খারাপ হয়েছে। যখন-তখন ছাদে যাচ্ছে। সেই মেয়েটাকে আর একবার দেখতে চায়। অনাদিবাবু শেষে বাধ্য হয়ে ছাদের সিঁড়ির দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন।
সেদিন গভীর রাতে আবার সেই কুকুরের ডাক। শুভার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার ঘর। তার কিরকম ভয় করল। পাশেই মা শুয়েছিলেন। শুভা অন্ধকারে মাকে একবার ছুঁলো। একটু পরে মাথার কাছে জানলায় চুক চুক শব্দ। কে যেন বন্ধ জানলাটা খুলতে বলছে। শুভার দেহ হিম হয়ে গেল। মাকে। ডাকতে গেল। স্বর বেরোল না।
–খুব বেঁচে গেলি সেদিন।
শুভা চমকে উঠল। শিখার গলা।–একেবারে ঘরের মধ্যে।
ভাগ্যি তোর বাবা এসে পড়েছিল। কিন্তু এবার আর কারো সাধ্য নেই বাঁচায়। কালই তোকে মারব। বলতে বলতে স্বরটা যেন ফ্যানের হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
পরের দিন। সকাল থেকেই শুভা মা-বাবার কড়া পাহারায়। শুধু মা-বাবাই নন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও বারে বারে আসছে-যাচ্ছে। কেবলই লক্ষ্য রাখছে শুভার ওপর। এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! অথচ উড়িয়ে দিতেও পারছে না। শুভা কিন্তু বিরক্ত হচ্ছে। সে কী চিড়িয়াখানার নতুন কোনো জন্তু যে সবাই তাকে দেখে যাচ্ছে? রাগ করে সে ঘরে খিল দিল।
বেলা তখন প্রায় একটা। অনাদিবাবু পুরনো খবরের কাগজ বিক্রি করছিলেন বাইরের ঘরে বসে। শুভার মা বাথরুমে। হঠাৎ অনাদিবাবু শুনলেন রাস্তায় একটা হৈচৈ গেল গেল–গেল
তিনি একলাফে বেরিয়ে এলেন। দেখলেন দুটো ট্যাক্সি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আর সেখানে লোকের ভিড়। একটু পরেই কারা একটি মেয়েকে ধরাধরি করে নিয়ে এল।
শীগগির একটু জল!
না, শুভা মরেনি। দুটো ট্যাক্সির মুখে পড়েও আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছে।
জ্ঞান ফিরে আসার পর শুভা অল্প দু-একটা কথা যা বলল তা এই
খিল বন্ধ করে জানলায় দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দেখল সেদিনের সেই মেয়েটা খুব সেজে রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হি-হি করে হাসছে। কে এই মেয়েটা, কোথায় তার বাড়ি, কেনই বা তাকে দেখলেই হাসে জানার জন্যে সে তখনি খিড়কির দরজা দিয়ে ছুটে গিয়েছিল। তারপর আর কিছুই মনে নেই।
.
কয়েকটা মাস বেশ ভালোভাবেই কাটল। আর কোনো উপদ্রব নেই। শুভা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। আজকাল সবার সঙ্গে গল্প করে, হাসে। ওকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে ওর মা এখন ওকে সংসারের টুকিটাকি কাজ দেন।
সেদিন বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। অনাদিবাবু বললেন, শুভা, একটু চা করো তো। বলে নিচে নেমে গেলেন। শুভার মা গেলেন ঠাকুরঘরে। দোতলাটা একেবারে ফাঁকা। নিস্তব্ধ। শুভা রান্নাঘরে এসে স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের জল চড়িয়ে দিল। একটু পরে তার শরীরটা কেমন করে উঠল। মনে হলো যেন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাথাটা ঝিঁঝিম্ করছে। শুভা উঠে দাঁড়াল। রান্নাঘরের সামনের বারান্দাটার দিকে তাকাল-খাঁ খাঁ করছে। সামনের ঘরগুলোও ফাঁকা। এরকম তো রোজই ফাঁকা থাকে। কিন্তু আজ কেন এত ভয় করছে? মনে হচ্ছে যেন বাড়িতে কেউ নেই। সবাই তাকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে এটা যেন কোনো ভুতুড়ে বাড়ি।
শুভা কেমন যেন ভয় পেয়ে গোঙাতে লাগল। মনে হতে লাগল এখুনি সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবে।
আর ঠিক সেই সময়ে সে স্পষ্ট দেখল তার সামনে শিখা দাঁড়িয়ে। রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। দুচোখে আগুন-ঝরা দৃষ্টি। একরাশ কালো চুল বাতাসে উড়ছে।
–দুবার বেঁচে গেছ। এবার রেহাই নেই। বলে শিখা দুহাত বাড়িয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল। আর শুভা পিছোতে লাগল জ্বলন্ত স্টোভের দিকে। ক্রমশ আগুনের তাত তার গায়ে লাগল। তবু পিছোচ্ছে শুভা। না পিছিয়ে উপায় নেই। শিখা রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে।
চিৎকার করতে গেল শুভা, পারল না। ঠিক এই মুহূর্তে বাইরের ঘরের দরজায় কলিংবেল বাজল–কি-রিং-কি-রিং–
শুভা শুনতে পেল বাবা দরজা খুলে দিলেন। শুনতে পেল, কাকে যেন সাদর অভ্যর্থনা করছেন–আসুন–আসুন।
সেই সঙ্গে আরো শুনতে পেল কোনো মহিলার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর, শীগগির আমায় ওপরে নিয়ে চলুন।
সিঁড়িতে দ্রুত পায়ের শব্দ। কে যেন হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসছে। শুভা যেন জ্ঞান ফিরে পাচ্ছে। দেওয়াল ধরে সামলে নিল কোনোরকমে। না, শিখা নেই। শুভা তবু ভয়ে ভয়ে তাকাল। দেখল সামনে ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে মাতাজি দাঁড়িয়ে।
মাতাজি হেসে বললেন, ভয় নেই। ও আর কোনোদিন আসবে না। আজ ওর আত্মা মুক্তি পেয়ে গেল।
ততক্ষণে শুভার মা-বাবাও এসে পড়েছেন। তাঁরা অবাক হলেন, রান্নাঘরের কাছ থেকে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করে আসছে।
ওরা চলেছে নিঃশব্দে
ট্রেনে নতুন সঙ্গী
হিমালয় আমাকে বরাবর টনে। সেই টানে আমি কখনও গিয়েছি দার্জিলিং, কখনও শ্রীনগর। শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলগাঁও। আবার এদিকে হিমালয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু। এসব জায়গায় যাওয়ার অসুবিধে ছিল না। পাহাড়ের বুক চিরে ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে যাত্রীবোঝাই বাস নির্বিঘ্নে পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট জায়গায়। খাওয়া-দাওয়ার কোনো অসুবিধে নেই। মাঝে-মাঝেই হোটেল। চা-কফি থেকে ভাত-ডাল-রুটি-মাংস সবই পাওয়া যায়।
কিন্তু এবার হিমালয়ের যেখান দিয়ে যাচ্ছি সে পথ খুবই বিপদসংকুল। সংকীর্ণ পথ, একজন কোনোরকমে পা ফেলে চলতে পারে। তাও পাহাড়ের একেবারে গা ঘেঁষে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী। নাম জানতে পারিনি। তবে স্রোতের গতি দেখলেই বুক কঁপে। একবার পা ফসকালে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এ দুর্ভোগে পড়তে হবে কে ভেবেছিল! মাঢ়িতে টাটা সুমো থেকে নেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে, কেউ আলু-পরোটা, কেউ ব্রেড-বাটার-ওমলেটের সঙ্গে গরম চা কিংবা কফি খেয়ে ফের গাড়িতে উঠে পড়েছিলাম নিশ্চিন্ত মনে। রাস্তা বলে কিছু নেই। কখনও শুকনো নদীখাতে, কখনও বা পাথরের ওপর দিয়ে ডাইনে, বাঁয়ে টাল খেতে খেতে গাড়ি এগিয়ে চলছিল। আমাদের গন্তব্যস্থল লে। লাদাখের রাজধানী। লাদাখ নাম হল কেন? কোন বই-এ যেন পড়েছিলাম লা শব্দটার মানে গিরিবর্ক্স বা পাহাড়ি রাস্তা। আর দাখ মানে দেশ। লাদাখ মানে তাই গিরিবক্সের দেশ।
সোলাং পেরিয়ে এসেছি। রাস্তার ধারে দেবদারু আর ওক গাছ। বরফঢাকা চুড়ো কখনও সামনে কখনও পিছনে। সামনে চড়াই। … এইভাবে চলতে চলতে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে একটুকরো সমতল ভূমি মাঢ়িতে এসে পৌঁছেছিলাম। এরপর টানা চড়াই প্রায় ষোলো কিলোমিটার। কিন্তু এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য স্থান রোটাং গিরিপথের মুখে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেল। গাড়ির আর দোষ কী? যা লম্ফঝম্ফ!
কিন্তু স্বল্পভাষী গাইডটি অস্পষ্ট হিন্দিতে নিজের মনেই বিড় বিড় করে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়–হঠাৎ গাড়ি খারাপ হওয়া লক্ষণটা ভালো নয়।
একপক্ষে ভালোই হল। সেই কখন মানালি থেকে রওনা হয়েছিলাম। একঘেয়ে গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। একেবারে খাস হিমালয়ের বুকে পা রেখে একটু চলাফেরা করে হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া মন্দ কী!
গাড়ির ড্রাইভার ছাড়া আমি, আমার কলকাতার বন্ধু বিভাস, একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী থুমি সামভোতা, আর একজন গাইড জিগমে। জিগমে জোয়ান মরদ। তিব্বতী। চওড়া চোয়াল, ছোটো ছোটো চুল। চ্যাপ্টা মুখ। ফ্যাকাশে রঙ। মানালিতে যে হোটেলে ছিলাম, দুই বাঙালি আনাড়ি বন্ধু হিমালয় ভ্রমণে (ভ্রমণ নয়, একরকম রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার) যাচ্ছি জেনে সেই হোটেলের বাঙালি ম্যানেজার অনুগ্রহ করে তার চেনা এই তিব্বতী ছেলেটিকে গাইড হিসেবে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জানি গাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু কোথাও কোথাও হাঁটতেই হবে। হাঁটার অসুবিধে যে কোনো মুহূর্তে ভুল পথে চলে যাওয়া। তা ছাড়া কোথায় খাবার পাবেন, কোথায় পানীয় জল পাবেন, কোন ফুল দেখতে সুন্দর কিন্তু বিষাক্ত–সে সব এর নখদর্পণে। তারপর কোন জায়গাটা কতখানি দূরে তা আপনারা আন্দাজও করতে পারবেন না।
আপত্তি করিনি। কেননা এই অচেনা, অজানা দুর্গম পাহাড়ি পথে, দুবেলা খেতে দেওয়া আর রোজ হিসেবে পাঁচ টাকা দিলেও লাভ বই লোকসান নেই।
বিভাস আমার সঙ্গে কলকাতার একই মেসে থাকে–একই ঘরে। আমারই মতো চাকুরে। মনের মিলও খুব। তবে আমার চেয়ে ওর স্বাস্থ্য অনেক ভালো। আর স্বাস্থ্য ভালো বলেই সাহসও বেশি। তবে দুজনের হবি দুরকম। আমি পছন্দ করি ঘরে বসে লিখতে, দেশ বিদেশের ওপর লেখা বই পড়তে। আর ওর নেশা ভ্রমণের। দুর্গম পথে। মাঝে মাঝে দুঃখ করে, এদেশে যদি আফ্রিকার জঙ্গলের মতো দুর্ভেদ্য জঙ্গল থাকত। কিংবা ক্ষ্যাপা সমুদ্রে ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে সাঁতার কেটে কোনো অজানা নির্জন দ্বীপে গিয়ে অসভ্য জাতির মতো প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে পারতাম!
সত্যি কথা বলতে কি, হাওড়া থেকে দিল্লি-কালকা মেলে চেপে ভোরে চণ্ডীগড়। তারপর মানালির বাস। তারপর মানালি থেকে রোটাং পাস। সম্ভব হলে আরও উঁচুতে ওঠার গোটা পরিকল্পনাটাই বিভাসের। মন থেকে আমার বিশেষ সায় ছিল না। কিন্তু বিধির ব্যবস্থা কী তা আগে কে জানতে পারে। নইলে দিল্লি কালকা মেলের একটা কামরায় হঠাৎই বা যোগাযোগ হবে কেন থুমি সামভোতার মতো একজন জ্ঞানতপস্বীর সঙ্গে? বয়েস ষাটের কাছে হলেও শরীর মজবুত। কোনোরকম রোগের লক্ষণ নেই। বিভাস ওঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তারপর ফিসফিস করে বলেছিল, তিব্বতী ভদ্রলোক। নিশ্চয় যোগব্যায়াম বা প্রাণায়াম জাতীয় কিছু করেন। নইলে এই বয়সে অত সুন্দর চেহারা হয় কী করে?
ফর্সা রঙ। ন্যাড়া মাথা। গেরুয়া রঙের কাপড়ের টুপি। পরনে গেরুয়া আলখাল্লা, গায়ে মেটে রঙের ফতুয়া আর বুক, পিঠ, জানু ঘিরে আড়াআড়ি ভাবে হলুদ চাদর। রিজার্ভড সিটে গা এলিয়ে নিশ্চিন্তভাবে তিনি পড়ছিলেন একটা ইংরিজি বই–History of Mongolians. মোঙ্গল জাতির ইতিহাস। বইটি যে বিদেশে প্রকাশিত তা মলাটের জৌলুস আর পরিচ্ছন্নতা দেখলেই বোঝা যায়।
ভদ্রলোকের শান্ত, সৌম্য, গাম্ভীর্যপূর্ণ চেহারা। দেখলে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে।
তিনি যে শুধু ইতিহাসই চর্চা করেন তা নয়। তাঁর সঙ্গে আলাপ করে বুঝলাম তিনি রীতিমতো একজন পণ্ডিত লোক। জ্ঞানের গভীরে যেন ডুবে রয়েছেন। কথায় কথায় যখন জানতে পারলাম সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় পুঁথি অনুবাদ করেছেন তখন শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল। তিনি যে একজন তিব্বতী মাত্র নন, প্রতিবেশী দেশগুলি যেমন চিন, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ প্রভৃতির সঙ্গে রীতিমতো সাংস্কৃতিক যোগ রাখেন তা তার কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারলাম। আর তিনি যখন জানালেন যে, কলকাতায় শুধু এবারই নয়, অনেকবার এসেছেন তখন তার মুখে বাংলা কথা এত সহজে সরে কী করে তার কারণ বুঝতে বাকি রইল না।
তারপর যখন আর একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলাম তখন জিগ্যেস করতে সাহস হল, কী জন্যে তিনি সুদূর তিব্বত থেকে বার বার কলকাতায় ছুটে আসেন? উত্তরে তিনি শুধু একটু মুখ টিপে হাসলেন। তারপর একটু যেন ভেবে বললেন, আপনাদের কলকাতার সবচেয়ে মূল্যবান অ্যাসেট কী বলুন তো?
বিভাস জিগ্যেস করল, আপনি কী দর্শনীয় স্থানের কথা বলছেন?
ধরুন তাই।
এবার আমরা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। কলকাতাতেই থাকি তবু কি কলকাতা শহরটা ভালো করে দেখতে পেরেছি? কত ঐতিহাসিক জায়গা আছে–
বাধা দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, কলকাতার মিউজিয়ামটা আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়ই?
কোনোরকমে মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। (সত্যি কথা বলতে কি কবে কোন ছোটবেলায় একবার কি দুবার দেখেছিলাম, তারপর যাদুঘরের পাশ দিয়ে হাজার বার গেলেও ভেতরে ঢোকার ইচ্ছে বা সময় হয়নি)।
তিব্বতী মানুষটি খুশি হয়ে বললেন, দেখেছেন নিশ্চয়ই। কলকাতার কোনো মানুষ যাদুঘর দেখেনি তা হতেই পারে না। তা কবার দেখেছেন?
বিভাস তড়বড় করে বলল, তা অনেকবার।
বেশ। সব ঘরে ঢুকেছিলেন?
হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। টিকিট কেটে যখন যেতে হয়েছিল তখন সবকিছুই তো দেখব।
ঘুরে ঘুরে সব দেখতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল?
বিভাসকে বলতে না দিয়ে আমিই বললাম, তা অনেকক্ষণ।
শুনে ভদ্রলোক মুচকে একটু হাসলেন।
মমি দেখেছিলেন?
বাবাঃ! মমি দেখার জন্যই তো যাওয়া। দেখলে গায়ের মধ্যে কেমন শিরশির করে ওঠে। কত যুগ আগের বাসি মড়া।
সামভোতা মুখ টিপে একটু হাসলেন। বললনে, ঐ মমি দেখার জন্যেই আমি কলকাতায় ছুটে আসি।
শুধু মমি দেখার জন্যে এতবার কলকাতায় আসেন! অবাক হয়ে আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। এ আবার কীরকম কথা!
হ্যাঁ, শুধু মমি দেখার জন্যেই বার বার আসি। তোমাদের সঙ্গে তফাত এই যে, তোমরা মমি দেখতে আস আর আমি মমির কাচের কেসের মধ্যে কিছু খুঁজতে আসি।
কিন্তু ওরা আপনাকে কি কেসের গায়ে হাত দিতে অ্যালাউ করে?
করে না বলেই তো বারবার আসতে হয়।
কেসের মধ্যে কী খোঁজেন?
সেটা এখনই এই ট্রেনের মধ্যে বলা যাবে না। পরে বলব। এখন বলো তোমরা কোথায় যাচ্ছ?
আমরা দুজনে আবার পরস্পরের দিকে তাকালাম। অর্থাৎ বলে ফেলা উচিত হবে কিনা। গোপনীয়তা কিছুই নেই। উদ্দেশ্যও তেমন নেই। হয়তো বিচক্ষণ লোকটি হাসবেন। তবু বলেই ফেললাম, এমনি পাহাড়ে ঘুরতে।
সামভোতা আবার একটু হাসলেন। বললেন, ভারতবর্ষে কি পাহাড়ের অভাব আছে? তা হলে উত্তর দিকেই কেন? কোথায় যাবে?
বললাম, আমার এই বন্ধুটি, বিভাস, অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসে। দুর্গম নির্জন পাহাড়ি জায়গাই ওর পছন্দ। তাই ওর কথামতোই আপাতত আমরা যাব মানালি। সেখান থেকে গাড়ি পাই তো ভালোই। না হলে হিমাচল পর্যটনের বাস। সেই বাসে বিখ্যাত রোটাং পাস। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।
সামভোতা উৎসাহ দিয়ে বললেন, খুব ভালো। রোটং পাসেই থেমে যেও না। গাড়ি যদি পাও, মানালিতে টাটা সুমো, টয়োটা কোয়ালিস এসব আধুনিক গাড়ি পেয়ে যাবে, তাহলে আরও উঁচু গিরিব পার হয়ে চলে যেও লাদাখ পর্যন্ত।
একটু থেমে বললেন, তা তোমরা এই পথটা ধরলে কেন? অন্য পথও তো ছিল শ্রীনগর থেকে। সেখান থেকে বাসে সোনমার্গ হয়ে জোজিলা গিরিপথ পেরিয়ে কার্গিলে। সেখানে রাত্রিবাস করে পরের দিন ভোরে রওনা দিয়ে সন্ধ্যায় লে। আমার তো মনে হয় এ পথটা অনেক কম হত। শত্রুপক্ষের গোলাগুলি ছাড়া অন্য ভয় নেই।
অন্য ভয়? চমকে উঠলাম দুজনেই। জিগ্যেস করলাম, অন্য ভয় বলতে?
প্রাজ্ঞ মানুষটি শান্তভাবে বললেন, পথটা তো দুর্গম। তাছাড়া বহুকাল আগের বহু ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু–না, তোমারা ভালো সিদ্ধান্তই নিয়েছ। এখন আমার ইচ্ছে করছে আমিও তোমাদের সঙ্গে যাই।
অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, সত্যিই আপনি যাবেন? অবশ্য শুধু শুধু কষ্ট করে, পয়সা খরচ করে কেনই বা যাবেন?
সামভোতা এতক্ষণ নিজের সিটে গা এলিয়ে বই হাতে বসেছিলেন। এবার সোজা হয়ে উঠে বসলেন। বললেন, ঐ পথে এর আগে আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু যেজন্য গিয়েছিলাম তা সফল হয়নি। আরও যেতে হবে। হয়তো বার বার।
সাহস করে বললাম, আপনি বিরক্ত না হলে বলি ঐ রাস্তার এমন কী আকর্ষণ আছে। যে আপনাকে আবার যেতে হবে?
পণ্ডিত ব্যক্তিটি অল্পক্ষণ চুপ করে চোখ বুজিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঐখানেই সেই বহু যুগ আগের পথ–যাকে বলা হত প্রাচীন সিল্করুট। ঐ পথ দিয়েই তো যাতায়াত করত হুন উপজাতির দল। সেই পথটা খুঁজে পাবার পর আরও অনুসন্ধান করার জায়গা আছে…এটা কোন স্টেশন এল?
আজিমগঞ্জ জংশন।
এতক্ষণে আজিমগঞ্জ।
হেসে বললাম, তবু তো বেশ তাড়াতাড়ি এসেছি। আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে আমাদের মনে হচ্ছে সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল। কিন্তু পুরনো পথ ছাড়াও আর কী খুঁজতে চান?
আসল কথা হচ্ছে, আমার ওপর বরাবর কর্তৃত্ব করে এসেছে ইতিহাস। আর সে ইতিহাস শুধু ভারতের বা ইউরোপের নয়, মধ্য এশিয়ার মোঙ্গোলীয়দের নিয়ে। আর আমার ইতিহাসের নায়ক হচ্ছে চেঙ্গিস খান যাঁর আসল নাম ছিল তেমুচিন। পরে যখন মোঙ্গল জাতির প্রধান হয়ে উঠলেন তখন ওঁর নাম হল চিঙ্গীজ খান। চিঙ্গীজ কথার অর্থ অসাধারণ শক্তিশালী আর খান বলতে বোঝায় নেতা। কালে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিভিন্ন ধরনের উচ্চারণের ফেরে চেঙ্গীজ খান শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় চেঙ্গিস খান। তোমরা চেঙ্গিস খানের নাম শুনেছ তো?
আমরা দুজনেই বলে উঠলাম, নিশ্চয়ই। চেঙ্গিস খান, তৈমুরলঙ্গ এঁরা ইতিহাসের কলঙ্ক। ওঁদের অত্যাচারের কথা কেউ ভুলবে না।
থুমি সামভোতা বললেন, চেঙ্গিস খান শুধু একজন মহা যোদ্ধা বা অত্যাচারী ছিলেন না, তাঁর মৃত্যু ও পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপও ছিল রহস্যময়।
রহস্যময়!
হ্যাঁ। কিন্তু সেই রহস্যের কথা এখুনি বলব না। তবে জেনো যতদিন সামর্থ্য থাকবে ততদিন সেই রহস্য সমাধান করার চেষ্টা করে যাব।
সেইজন্যেই কি আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছেন?
হ্যাঁ। বুঝতেই পারছ ওসব জায়গায় একা যাওয়া যায় না। যেতে হয় দলবদ্ধ হয়ে।
আপনাকে যদি সঙ্গে পাই তাহলে খুব খুশি হব।
বিভাস আরও একটু যোগ করল, শুধু খুশি হওয়াই নয় স্যার, আমরা উৎসাহ পাব, বিপদে পড়লে আপনার মতো ধীর শান্ত বিচক্ষণ মানুষের পরামর্শ উপদেশ পাব। তা ছাড়া রহস্য আমরাও ভালোবাসি।
বিচক্ষণ মানুষটি এ কথায় খুশি হলেন বলেই মনে হল। কেননা ভদ্রলোক এখটু চাপা স্বভাবের। উচ্ছ্বাস নেই। প্রাণ খুলে হাসেন না। তবু লোকটি ভালো।
বিভাসের কথা শুনে তিনি হাই তুলে, আলিস্যি ভেঙে বলে উঠলেন, বেশ তাহলে তোমাদের সঙ্গে যাওয়াই স্থির করলাম।
টিকিট?
বললেন, ভেব না। আপাতত চণ্ডীগড় পর্যন্ত টিকিট আছে। তারপর তো বাস। বাসে মানালি। তোমাদেরও তো সেইরকম ব্যবস্থা?
হ্যাঁ।
উনি যেন একটু ভেবে বললেন, আমি একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মাত্র। সুযোগ পেলে বৌদ্ধ তীর্থগুলিতে যাই। আর যাই বহু পুরনো গোম্ফাগুলোতে। সম্ভব হলে রাত কাটিয়ে দিই। কিন্তু ঐ রাত কাটানোই। ঘুম হয় না।
কেন?
ঠিক জানি না। বহু পুরনো জায়গা তো। কেমন যেন মনে হয়। যাক, ওসব কথা বাদ দাও। অনেক রাত হল। কিছু খাবার সঙ্গে থাকলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো।
কী জানি কেন এই মানুষটির কথায় আমরা বেশ উৎসাহ পেলাম।
আপনি কী খাবেন? জিগ্যেস করলাম সবিনয়ে।
আপেল আর মিষ্টি আছে। আমি সন্ন্যাসী মানুষ। স্বল্পাহারী।
.
অশরীরী অরোহী
গাড়ি থেকে আমরা চারজনে নামলাম। তার মধ্যে হাঁড়িমুখো গাইডটিও আছে। নেমেই সে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। যেন পথ চেনবার চেষ্টা করল। আমরাও রাস্তায় নেমে নিঃশ্বাস নিয়ে বাঁচলাম। একবার আকাশের দিকে তাকালাম। ভাবলাম যদি নীল আকাশ একটু দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু পাশের কালো কালো উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে লম্বা ফার, আর চিনার গাছগুলো যেন আকাশটাকে আড়াল করে রেখেছে।
ড্রাইভার ততক্ষণে ইঞ্জিনের বনেট খুলে ঝুঁকে পড়ে কলকজা পরীক্ষা করছে। জিগ্যেস করলাম, কত দেরি হবে?
ড্রাইভার বললে, দেখি। আপনারা এক কাজ করুন। এই পথ ধরে বেড়াতে বেড়াতে এগিয়ে যান। গাড়ি সারানো হলেই আপনাদের ধরে ফেলব।
এই প্রস্তাবে আমরা সকলেই খুশি। সন্ন্যাসী ভদ্রলোকের দুচোখ খুশিতে উৎসাহে চকচক করে উঠল। উনি যেন হাঁটতেই চাইছিলেন। আমরা যে পাশাপাশি হাঁটব, তেমন সুবিধে নেই। রাস্তাটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে। ইচ্ছে করেই বাসরাস্তা ছেড়ে এসেছি। বাসরাস্তায় এত নুড়ি ছড়ানো যে পা হড়কে যাবার ভয়।
আমাদের গাইড বোধহয় তার কাজ দেখাবার জন্যে এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। তিন-চারটে সরু পাহাড়ি পথ হেলেসাপের মতো হিলবিল করে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে। সে রকম একটা পথ ধরে আমাদের উঠতে ভালোই লাগছিল।
অনেকক্ষণ থেকে বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। গাইডকেই জিগ্যেস করলাম, কিসের গন্ধ হে? গাইড ছোকরা তার উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করল না। সে যেন মেন অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল। আর ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক দেখছিল। কিসের এত ভয় তা তো বুঝি না।
আমার কথার উত্তর পিছন থেকে দিলেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ঠাকুর। বললেন, গন্ধটা বন গোলাপের।
আমি মুগ্ধ হয়ে তখন দেখছিলাম পাইন গাছের বনগুলি। দেখছিলাম পাহাড়ের সবুজ চাদরে সাদা ফুলের ছিট। অপূর্ব!
আর ঐ দ্যাখো নাগলিলি। ঠিক যেন সাপের ফণা। আর কেশরগুলো যেন সাপের জিব। দেখতে খাসা কিন্তু সাপের মতোই বিষাক্ত।
বাসরাস্তা নীচে ফেলে আমরা ওপরে উঠছি তো উঠছিই। মনে হচ্ছে এই ভাবে পাহাড়টা পার হলে নতুন কোনো জায়গায় পৌঁছে যাব। কিন্তু আশ্চর্য, আমাদের কেউ একবারও ভাবল না, ইতিমধ্যে গাড়ি সারানো হয়ে গেলে ড্রাইভার আমাদের খুঁজে পাবে কী করে?
গাইডকে জিগ্যেস করা বৃথা। সন্ন্যাসী মশাইকে জিগ্যেস করলাম, শেষ পর্যন্ত বাসরাস্তায় ফিরে যেতে পারব তো?
উনি একবার একটা বড় পাথরের উপর দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখে কিছু একটা হিসেব করে বললেন, নিশ্চিন্ত থাকো।
তারপর সার সার পাহাড়ের উপর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার অনুমান যদি ভুল না হয় তা হলে আর অল্পক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের ওপারে আরও একটা রাস্তা পাব।
আমি ভীতু শান্ত প্রকৃতির মানুষ। মনে মনে বললাম, নতুন রাস্তা পেয়ে কাজ নেই। তখন সন্ন্যাসী মশাই বললেন ঐ রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে নীচের রাস্তায় নামবেন। তিনি এ কথা বললে বিভাসও লাফিয়ে উঠবে। কিন্তু আমি তা চাই না। এখন গাড়িটা সারানো হয়ে গিয়ে থাকলে উঠে বসতে পারলে বাঁচি।
হঠাৎ দেখি আমাদের গাইড খুব ভয় পেয়ে ইশারায় আমাদের নীচে নেমে যেতে বলছে। নিজেও দাঁড়িয়ে থাকল না। এক-এক লাফে পাথর ডিঙিয়ে নীচের দিকে ছুটছে।
কী ব্যাপার? কী হয়েছে জিগমে?
ও অস্ফুট স্বরে কোনোরকমে বলল, বক্সী-বক্সী–
বক্সী! সে আবার কী? ভুটানিরা নাকি ভূতকে বক্সী বলে। এরাও কি বলে?
যদি সত্যিই ভূত বোঝাতেই ও বকসীবী বলছে তাহলে এখানে ভূত কোথায়?
আমি তিব্বতী মানুষটার দিকে তাকালাম।
দেখি তিনিও যেন কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন।
হঠাৎ এই সময়ে নিস্তব্ধ পাহাড়ের উপরে থেকে একটা শব্দ শোনা গেল। টানা শব্দ। অনেকটা যেন ঘোড়ার খুরের মতো–খটাখটখটাখটখটাখট–যেন অনেকগুলো ঘোড়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে ছুটে আসছে।
শব্দটা সবাই শুনেছিলাম। তাই সকলেই থমকে গিয়েছিলাম।
পাহাড়ের ওপর এত ঘোড়া এল কোথা থেকে? যেন নিজের মনেই প্রশ্ন করল বিভাস।
এর উত্তর দিতে পারে একমাত্র আমাদের গাইড জিগমে গ্যাসো আর তিব্বতী পণ্ডিত থুমি সামভোতা। কিন্তু গ্যাটসো যেন কেমন হয়ে গেছে আরআর–আশ্চর্য, সন্ন্যাসী মশাই এর মুখ ফ্যাকাশে।
আশ্চর্য! তিব্বতী প্রবীণ জ্ঞানী মানুষটিও ভয় পেলেন নাকি? কিসের ভয়?
ততক্ষণে খুরের শব্দ দূর থেকে দূরান্তরে মিলিয়ে গেছে।
কী ব্যাপার পণ্ডিতজি?
উনি বিমর্ষ মুখে জোর করে হাসি টেনে বললেন, যা শুনলে তা নিয়ে আলোচনা করতে নেই। তবে আমি খুশি, যে পথটা সন্ধান করার জন্যে ইতিপূর্বে আসতে হয়েছে, আজ দৈবের বশে সে পথের সন্ধান বোধহয় পেয়ে গেলাম।
সে পথটা কোথায়?
আরও ওপরে।
ঘোড়াগুলো কোথা থেকে এল? ঘোড়সওয়ারই বা কারা?
শুনে ঘাবড়ে যেও না, ঘোড়ার অস্তিত্ব নেই, ঘোড়সওয়ারও নেই। থাকলেও চোখে দেখা যায় না।
চমকে উঠলাম। বললাম, সে আবার কী? অতগুলো ঘোড়া পাহাড়ের ওপারে রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটে গেল, কাছে থাকলেও দেখতে পেতাম না?
কাছে থাকলে চোখ মেলে দেখবার সময় পেতে না। ততক্ষণে ধড় থেকে মাথা খসে পড়ত।
আমাদের গাইড যখন প্রাণের ভয়ে পাহাড় থেকে নীচে নামতে যাচ্ছিল, বিভাস তখন ঘোড়াগুলোকে দেখবার জন্যে সামনের উঁচু পাহাড়টার দিকে ছুটছিল। শব্দটা আর শোনা না যেতে সে নেমে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। তিব্বতী সন্ন্যাসীর কথা শুনে দুহাত মাথায় চেপে ধরে বলে উঠল, হে ভগবান! এই বিজ্ঞানের যুগে এও বিশ্বাস করতে হবে? সামভোতার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, এসব কথা কি আপনার মস্তিষ্ক প্রসূত?
বিভাসের জিগ্যেস করার টোনটা এতই উগ্র ছিল যে ভেবেছিলাম সামভোতা বুঝি রেগে যাবেন। কিন্তু আশ্চর্য, তিনি এতটুকু রাগলেন না। একটু হেসে বললেন, না, আমার মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এটা তো ঠিক–ঘোড়া ছুটিয়ে যারা গেল তারা আজকের মানুষ নয়। আজকের মানুষ ঐরকম দুর্গম পাহাড়ের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে পারে না। ওরা সাধারণ অশ্বারোহী নয়। কোনো ত্রিভুবনজয়ী নৃপতির দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী সৈন্য। অথচ সে নৃপতি জীবিত ছিলেন সম্ভবত আটশো-নশো বছর আগে। হাজার বছরও হতে পারে। কাজেই তাদের চর্মচক্ষুতে দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। আমায় সাহায্য করেছে বই। বই পড়েই আমি জানতে পেরেছি। যেমন জানতে পেরেছি সিন্ধুসভ্যতার যুগে দুটি শহর হরপ্পা আর মহেঞ্জোদাড়োর অনেক কথা।
ভয় পেলাম। এইবার বুঝি তিব্বতী পণ্ডিতমশাই শুরু করেন সেই হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের ইতিহাস। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না। বিভাস অবশ্য চঁচাছোলা কথা বলে। সোজাসুজি বলল, খুব সংক্ষেপে যদি বলেন শুনতে পারি।
না শুনলেও আমার কোনো ক্ষতি নেই। উত্তর দিলেন সামভোতা। তবে তোমরা বুঝতে পারতে এই অদৃশ্য ঘোড়সওয়ারদের সূত্র কোথায়?
তাহলে বলুন।
এসো, তবে এই পাথরটার ওপর বসা যাক।
সামভোতা বলতে শুরু করলেন, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় তিন হাজার বছর আগে সিন্ধুসভ্যতার বিকাশ। তোমারা জান কিনা জানি না ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক বাঙালি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সহানী আর ঐ বিভাগের অধ্যক্ষ স্যার জন মার্শালের উদ্যোগে সিন্ধুনদের অববাহিকার কয়েকটি জায়গায় খননকার্য শুরু করা হয়। তার ফলে আবিষ্কৃত হল মহেঞ্জোদাড়ো আর হরপ্পা নামে দুটি প্রাচীন উন্নত নগরী। খননকার্যের ফলে সিন্ধুদেশবাসীর সেদিনের জীবনযাত্রার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। তা থেকে সে সময়ের পথঘাট, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, উপাস্য দেবতা প্রভৃতি অনেক কিছুর সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন সম্প্রতি চণ্ডীগড়ে পাওয়া গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সীলমোহর। সেগুলির গায়ে খোদাই করা ছিল ষাঁড়, মোয, হাতি, গণ্ডার প্রভৃতি মূর্তি। অর্থাৎ সিন্ধুসভ্যতার যুগে প্রধানত এই সব জন্তুর প্রাধান্য ছিল।
হরপ্পা আর মহেঞ্জোদাড়ো দুটি নগরীই বেশ শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল। তারপর একদিন শুরু হল বহিঃশত্রুর আক্রমণ। তারা আসত পশ্চিম আর উত্তর দিক থেকে। এদের গায়ের রঙ ছিল গৌরবর্ণ, উন্নত নাক–আর্য সম্প্রদায়ের মানুষ। দুর্ধর্ষ তাদের শক্তি। তারা আক্রমণ করত দ্রুতগামী ঘোড়ার পিঠে চড়ে। এদের দেশেও ঘোড়ার অভাব ছিল না। কিন্তু এরা কখনও ঘোড়াকে বশ করে তার পিঠে চড়ত না।
কেন? ভয় করত যদি ঘোড়া থেকে পড়ে যায়? খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই জিগ্যেস করল বিভাস।
না। আসলে এরা বিশ্বাস করত একমাত্র অশরীরী আত্মারাই ঘোড়ায় চেপে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে দাপাদাপি করে বেড়ায়। অর্থাৎ ঘোড়া মাত্রই অশরীরী আত্মার বাহন।
ফলে আক্রমণকারীরা যখন চোখের সামনেই ঘোড়া ছুটিয়ে এসে লুঠপাট করে ঘরবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে পালাত তখন এরা উটের পিটে চড়ে ওদের পিছনে ধাওয়া করত। কিন্তু দ্রুতগতি ঘোড়ার সঙ্গে উট পেরে উঠত না।
এই ভাবেই একদিন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো পিছিয়ে পড়ল। প্রভুত্ব করতে এগিয়ে এল আর্যরা।
সামভোতা একটু থামলেন। তারপর বললেন, সিন্ধুসভ্যতা কী করে ধ্বংস হয়ে গেল সে সব কথা বলার সময় এখন নয়। শুধু এইটুকুই জানাতে চেয়েছিলাম, খ্রিস্টপূর্ব তিন সহস্র বছর আগেও হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়োর লোকেরা ঘোড়া দেখে ভয় পেত। তারা অনুমান করতে পারত এক একটি ঘোড়ার ওপর এক একটি অপদেবতা বসে চারিদিকে লক্ষ রাখছে। অথচ তাদের দেখা যায় না।
এখন, এই কিছুক্ষণ আগে যে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের শব্দ আমরা শুনলাম, সেসব ঘোড়ার পিঠে যারা সওয়ার তারা কেউ জীবন্ত মানুষ নয়, প্রেতাত্মা। আর ঘোড়াগুলোও তাই।
বিভাস বলল, না হয় তাই হল। এখন আমার দুটো প্রশ্ন। এক–আপনি বলেছিলেন কলকাতার মিউজিয়ামে বারে বারে গিয়েছিলেন মমির কেসের মধ্যে কিছু খুঁজতে। কী খুঁজতে বলেননি। আজ বলবেন?
সামভোতা বললেন, যথাসময়ে বলব। এখন তোমার দ্বিতীয় প্রশ্ন কী?
বিভাস বলল, ঐ যে অদৃশ্য ঘোড়সওয়াররা ঘোড়া ছুটিয়ে গেল। কোথা থেকে এল বা কোথায় গেল বলে মনে করেন?
সামভোতা হাসলেন। বললেন, অন্তত আট-ন শ বছর আগে এই বিদেহীরা কোন জাতির দেহ ধারণ করে সৈনিকবৃত্তি নিয়েছিল, কোন রাজার সৈনিক কোন রাজ্য আক্রমণ করতে চলেছে এসব কি আমার মতো সামান্য একজন মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব? একজন খুব উঁচুদরের ইতিহাসবিদও এর উত্তর দিতে পারবেন না। কারণ ইতিহাসবেত্তারা মানুষ নিয়ে গবেষণা করেন, প্রেতাত্মাদের নাগাল পান না। তবে
সামভোতা একটু থামলেন।
তবে কী?
আমি সন্ন্যাসীই হই বা যাই হই মনে-প্রাণে আমি একজন ইতিহাসপ্রেমী। শুধু ইতিহাসপ্রেমী নই, প্রাচীন কালের মানুষদের সমাজ, তাদের সংস্কার, তাদের ধর্ম, তাদের ক্রিয়াকলাপ সব নিয়ে গবেষণা করতে ভালোবাসি। সারা জীবন আমি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমি তিব্বতী। তিব্বত আমার দেশ। ওখানকার প্রতিটি ধূলিকণায় কত না প্রাচীন সংস্কার লুকিয়ে আছে–আমি সেসবের সন্ধান করেছি। ওঁ মণিপদ্মে হুম এই শাস্ত্রীয় কথাটার মধ্যে যে কী যাদু আছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির মানুষকে বোঝাতে পারব না। এই কথাটা উচ্চারণ করলেই আমার সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। তিব্বতের কত প্রাচীন গোস্যায় গোম্ফায় আমি ঘুরে বেড়িয়েছি–শুধু চোখের দেখার জন্যে নয়, ঠিক কী খুঁজে পেতে চেয়েছি তা আমি নিজেও জানি না। বৌদ্ধদের দেবদেবীর শেষ নেই।
গিয়েফাং থেকে জোখাং মন্দিরে এগারো মাথা হাজার হাতযুক্ত অবলোকিতেশ্বর বুদ্ধ বা ঢেং রেজি–সবই আমি দেখেছি। দেখেছি দু-চার বার নয়, বহু বার। কিন্তু যা খুঁজতে চাই তা পাই না। বলে তিব্বতী সন্ন্যাসী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু হাতি-ঘোড়া কী যে খুঁজে পাচ্ছেন না তা বুঝতে পারলাম না।
একটু থেমে তিনি ফের বলতে লাগলেন, আমি কিছুকাল ধরে মোঙ্গলদের কথা পড়ছি। মোঙ্গলদের দেশ হচ্ছে মোঙ্গলিয়া। এটা কোথায় জান তো?
আমরা লজ্জায় পরস্পরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
সামভোতা একজন যোগ্য শিক্ষকের মতো গম্ভীর গলায় বললেন, শুধু এক ফালি পশ্চিমবঙ্গ, বড়োজোর ভারতবর্ষের ম্যাপটা মনে রাখলে চলবে না। চোখের সামনে রাখতে হবে গোটা পৃথিবীর মানচিত্র। যাই হোক এশিয়ার মানচিত্রটা একবার খুলে দেখো। চিনের ঠিক ওপরেই মোঙ্গোলিয়া। মোঙ্গোলিয়ার মাথার ওপরেই সোভিয়েত রাশিয়া। আর অনেক নীচে চিনের গায়ে গায়ে আমাদের দেশ তিব্বত। আর তিব্বতের গায়ে তোমাদের ভারতবর্ষ।
বিভাসটা সত্যিই তড়বড়ে। পণ্ডিত ব্যক্তিটি সবে একটু কথা বলতে শুরু করেছেন অমনি বিভাস বলে উঠল, কোথায় ভারতবর্ষ, কোথায় তিব্বত আর কোথায় মোঙ্গোলিয়া! পৃথিবীতে এত দেশ থাকতে হঠাৎ মোঙ্গোলিয়াকে নিয়ে পড়লেন কেন?
সামভোতা বিরক্ত না হয়ে বললেন, অধৈর্য হচ্ছ কেন? এই মোঙ্গোলিয়ার সঙ্গে এমন একটি ইতিহাস জড়িয়ে আছে যা সন্ধান করতে আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। এখন–এ কী! এখুনি অন্ধকার হয়ে আসছে কেন? আমার ঘড়িতে তো সবে সাড়ে তিনটে। তোমাদের?
আমরাও দেখলাম আমাদের কারও ঘড়িতে তিনটে পঁচিশ, কারও কয়েক মিনিট বেশি।
পাহাড়ে ঘেরা চারিদিক তো। তাই বেলা যতই থাক সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলেই দিনের আলো কমে আসে। নাও, ওঠো। আর দেরি হলে পথ খুঁজে পাব না। বলতে বলতে আকাশের দিকে আর একবার তাকিয়েই অদ্ভুত ব্যস্ত হয়ে পাহাড় থেকে নামতে লাগলেন।
আপনি যেন একটা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। সেই কথাটা শুনিয়ে দিন।
সামভোতা বললেন, শুধু সেই একটুকরো কথা শুনলে তোমরা কিছুই বুঝতে পারবে না। তবু বলছি, আমি নিশ্চিত যে, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উর্গা বা উলানবাটোর থেকে খারজম (Khawrizm), সমরখন্দ, বোখারা, আফগানিস্তান, হিরাট, গজনী হয়ে অন্তত পেশোয়ার পর্যন্ত একটা রাজপথ ছিল। যেমন রোটাং গিরিপথই বহু কাল ধরে লাহুল, স্পিতি, লে, লাদাখ এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যপথ হয়ে আছে। কত যুগ ধরে কত বণিকের দল উট, ঘোড়া কিংবা গাধার পিটে মাল চাপিয়ে বরফ-পড়া শীতে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেছে। কতজন পথশ্রম আর হিমপ্রাহ সহ্য করতে না পেরে মাঝপথেই প্রাণ হারিয়েছে। সেই সব মৃতদেহ পড়ে থেকেছে তুষারধবল পাহাড়ের নীচে কিংবা ভাগ্য ভালো হলে পাহাড়ি ঝর্নার জলে হয়েছে সলিলসমাধি। ফিরে তাকাবার বা শোক করবার বা ভয় পেয়ে পা গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নেই। মাইলের পর মাইল তাদের হাঁটতে হবে-১৩০০০/১৪০০০ ফুট চড়াই ভেঙে। প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তাদের চলে না।
বিভাস বলল, না হয় বুঝলাম এইখানেই কোথাও আদ্যিকালের সেই পথটা আছে। কিন্তু সে পথটা খোঁজার জন্যে আপনার এত আগ্রহ কেন? সারা পৃথিবীর স্থলভাগে আদিকাল থেকে কত পথই না ছড়িয়ে আছে। তার মধ্যে অনেক পথ হয়তো ধসে চাপা পড়ে গেছে কিংবা পাহাড়ি নদী গ্রাস করে ফেলেছে। তাহলে একটা বিশেষ পথের জন্যে মাথা ঘামানো কেন?
আমার মন ছটফট করছিল। গাড়িটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সারানো হয়ে গেছে। আপাতত গাড়িতে গিয়ে বসতে পারলে বাঁচি।
সামভোতার যেন কোনো দুর্ভাবনা নেই। পাহাড় থেকে নামতে নামতে এক জায়গায় একটু দাঁড়িয়ে পাশের পাহাড়ের পথে হাঁটতে লাগলেন। বিভাসের কথার উত্তরে বললেন, আমার ধারণা সেই পথ দিয়েই ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১২২১ সাল নাগাদ মোঙ্গোলীয় যোদ্ধা চেঙ্গিস খাঁ সসৈন্য দিগ্বিজয়ে যেতেন।
আমি অবাক হয়ে বলালম, তার মানে প্রায় আটশো বছর আগে!
বিভাস বিদ্রুপের সুরে বলল, রাজা বা সেনাপতিরা যুদ্ধ করতে সসৈন্য রাজপথ দিয়েই যাবে। আর রাজপথ যদি একটি থাকে তাহলে সেই পথেই যাবে। এতে আর ভাবনার কী আছে!
সামভোতা বললেন, যে রাজপথের কথা বলছিলাম সেই পথ দিয়েই যদি কফিনও নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেই পথ পরে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল।
কথা বলতে বলতে আমরা এক একটা পাহাড়ি পথ অতিক্রম করছিলাম। কেবলই ভাবছিলাম পাশের ঐ পাহাড়টা দিয়ে এগোলে হয়তো তাড়াতাড়ি নামা হবে।
আগে আগে যাচ্ছিলেন সামভোতা। পাহাড়ের বাতাসে তার গায়ের র্যাগ গরম কোট থেকে বারে বারে ঝুলে যাচ্ছিল। তিনি বারে বারেই সামলাচ্ছিলেন। আর হনহন করে হাঁটছিলেন। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল তিনি কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটছেন।
হঠাৎ পিছন ফিরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আমাদের উদ্দেশে বললেন, গাইড ছোঁড়াটা গেল কোথায়?
তাই তো!
আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। কোথাও নেই।
তাই তো! ছোকরা গেল কোথায়?
আমি বললাম, কিছুক্ষণ আগে দেখলাম ও মাথা নিচু করে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল যেন আমাদের এড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছিল।
সামভোতা গম্ভীরভাবে বললেন, গাড়ি খারাপ হওয়ার সময় থেকেই ওর মুখে চোখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখেছিলাম। তারপর ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনার পর থেকে ও যেন কেমন ভয় পেয়ে গেল। ও যেন অশুভ কোনো ঘটনার গন্ধ পাচ্ছিল। হাজার হোক ও তো এসব অঞ্চলের লোক। অনেক কিছুই জানে।
বিভাস বলল, ওসব কিছু নয়। যতক্ষণ গাড়ি ছিল, বেশ আরামে ছিল। তারপর পাহাড়ে উঠতে ভালো লাগছিল না। আমার মনে হচ্ছে ও কেটে পড়েছে।
কী পড়েছে? সামভোতা চলতি বাংলা কথাটা বুঝতে পারলেন না।
বললাম, এটা আমাদের এখনকার চলতি কথা। কেটে পড়েছে মানেনা বলে চলে গেছে।
ও আচ্ছা। তা যাক। কিন্তু আমার ভয় পথ হারিয়ে না ফেলে।
বলেই তিনি হন হন করে হাঁটতে গেলেন কিন্তু জোরে হাঁটতে পারছিলেন না। কারণ প্রথমত পাহাড়ি পথ, সর্বত্র পাথর ছড়ানো। দ্বিতীয়ত কিছুক্ষণ ধরে একটা ঝোড়ো বাতাস শুরু হয়েছে। সেই বাতাসটা আসছে সামনের দিক থেকে। ফলে বাতাস ঠেলে এগোনোই মুশকিল। এ অবস্থা আমাদের দুজনেরও। তাই তো, জিগমে গ্যাটসোটা কোথায় গেল? ও কি সত্যিই পালিয়ে গেল? না কি পথ হারাল?
যদি পথ হারায় তো সব্বনেশে কথা। যে হোটেল থেকে ওকে এনেছিলাম সেখানে তো পৌঁছে দিতে হবে।
একেই তো পাহাড়ের ওপর আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছিল না। তার ওপর এই এক দুশ্চিন্তা।
হিমালয়ের রাজত্বে এসে পর্যন্ত এখনকার আবহাওয়ার মর্জি বুঝতে পারছি না। কখনও মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, কখনও বৃষ্টি, কখনও দমকা হাওয়া, কখনও তুষারঝড়। কখনও ধূলিঝড়। শীতে হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়। তা ছাড়া হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশা তো আছেই। পথ হাঁটাই যায় না।
এখন আমার শীতের পোশাকের বর্ণনা একটু দিই। মোটা গেঞ্জি। তার ওপর দুটো ফুলহাতা সোয়েটার। তার ওপর উইন্ডচিটার। তার ওপর মোটা ওয়াটার প্রুফের কোট। পরনে উলের প্যান্ট। মাথায় মাঙ্কি টুপি। হাতে উলেন দস্তানা। পায়ে নাইলনের মোজা, তার ওপর উলেন মোজা। জুতোর কথা নাই বললাম।
কলকাতায় বসে তোমরা যখন এই উপন্যাস পড়বে তখন আমার এই পোশাক শুনে এখানে শীতটা কেমন কল্পনা করার চেষ্টা কোরো।
বিভাসের সব তাতেই বাড়াবাড়ি। আমার পোশাকের বহর দেখে হেসেই খুন। বললে, আস্ত একটা ক্লাউন। ও বলতেই পারে। কারণ তার গায়ে একটা হাফহাতা সোয়েটার, তার ওপর একটা ফুলহাতা সোয়েটার, তার ওপর উইন্ডচিটার। পরনে নাইলনের প্যান্ট, হাতে গ্লাভস। মাথায় টুপি। ওর টুপির বাহার দেখে ওকেই ক্লাউন বলে মনে হচ্ছিল আমার।
খুব সিমপল অথচ ফিটফাট লাগছিল তিব্বতী সন্ন্যাসীটিকে। যেমনই হোক তিনি সন্ন্যাসী। তাঁর আলখাল্লার আড়ালে পুরু সোয়েটার আর একটা গরম কম্বল আড়াআড়ি ভাবে জড়ানো। মাথায় সেই গেরুয়া টুপি। ফোলা ফোলা চোখ। ঠান্ডায় যেন আরো ফুলে উঠেছে। কাঁধে একটা বড়ো ব্যাগ। তার মধ্যে নিশ্চয় রাত্রে গায়ে দেবার কিছু কম্বল-টম্বল আছে।
কিন্তু জিগমে বেচারি গরিব। তার গায়ে একটা ফুলহাতা সোয়েটার আর মাথায় পাগড়ির মতো জড়ানো একটা মাফলার …।
সত্যি ছেলেটা গেল কোথায়? গাইড হিসেবে ওকে আনা আমাদের ভুল হয়েছে। এখন মানে মানে ওকে সেই হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারলে বাঁচি।
উতরাই ধরে অল্প একটু নামতেই হঠাৎ সামভোতা দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর চলার গতির মধ্যে হঠাৎ ব্রেক কষা দেখে আমরা বুঝলাম নিশ্চয় সামভোতা এমন কিছু দেখেছেন–
দ্রুত পায়ে তাঁর কাছে যেতেই তিনি আঙুল তুলি দেখালেন, Look!
দেখলাম। পাহাড়ি ঝোপের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে জিগমে পটাপট করে কী সব লতাপাতা ছিঁড়ছে। আর নিজের গলায়, মাথায়, বাহুতে জড়াচ্ছে।
সামভোতা কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকলেন। কিন্তু জিগমে সাড়া দিল না। একটু উঁচুতে একটা ফুল ফুটেছিল। সেটা নেবার জন্যে লাফালাফি করেই চলল।
সামভোতা এগিয়ে গেলেন। দেখলেন জিগমের চোখমুখ ভয়ে বসে গিয়েছে। কাটার আঁচড়ে তার কপাল, হাত ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে।
ঐ ফুলটা তোমার চাই?
জিগমে মাথা দোলাল। দীর্ঘদেহী সামভোতা ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে ফুলটা পেড়ে দিলেন। তাতে জিগমে কতটা খুশি হল বোঝা গেল না। তবে নিশ্চিন্ত হল।
এবার সে কিছু কিছু লতাপাতা আমাদের তিনজনের কব্জিতে বেঁধে দিল।
সামভোতা জিগ্যেস করলেন, এগুলো দিয়ে কী হবে?
জিগমে পাহাড়ি ভাষায় যা বলল সামভোতা বাংলা করে বুঝিয়ে দিলেন। জিগমে নিশ্চিত এই অঞ্চলে অপদেবতার ভয় আছে। গাড়িটা যখনই খারাপ হল তখনই ও নাকি বুঝতে পেরেছিল অদ্ভুত ঘটনা ঘটবেই। তারপর যত সবাই পাহাড়ে উঠতে লাগল ততই ও নাকি নিশ্চিত হয়েছিল জায়গাটা খারাপ। তাই এগোতে চাইছিল না। তারপর সেই অদৃশ্য ঘোড়া আর খুরের শব্দ ….
ও আরও বলল, এ কহানি তার জানা আছে।
থিবস–থিবস– বলে জিগমে হঠাৎ চিৎকার করে উঠেছিল।
থিবস! চমকে উঠলেন সামভোতা।
বোঝা গেল এই নাম তিনি জানেন।
থিবস্ কোথায় জিগমে?
ও উত্তর দিতে পারল না। শুধু সামনের একটা উঁচু পাহাড় দেখিয়ে দিল। বুঝিয়ে দিল যেখান দিয়ে ঘোড়াগুলো ছুটছিল সেখানেই আছে থিবস্–অতি ভয়ংকর …
এই বিশেষ ধরনের লতাপাতা ফুল গায়ে জড়ানো থাকলে প্রেতাত্মারা নাকি কোনো ক্ষতি করতে পারে না।
.
পাহাড়ে আতঙ্ক
জিগমের মতো একজন পাহাড়ি ছেলের ভয়-সন্ত্রস্ত মুখে যখন থিস্-এর কহানি উচ্চারিত হল তখন বিভাস খুব কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এসেছিল সব ঘটনাটা শুনতে। কিন্তু জিগমে আর একটি কথাও খরচ করল না। জোরে জোরে পা ফেলে এগিয়ে চলল।
তার ভাবখানা এমনই যেন একমাত্র প্রেতাত্মা ছাড়া আর কারও পরোয়া করে না।
সামভোতার মুখটা ক্রমশই গম্ভীর হয়ে উঠছিল। কিছু একটা বুঝে তিনি তিব্বতী ভাষায় জিগমেকে আস্তে আস্তে চলতে বললেন। কিন্তু জিগমে কারো কথা শোনার পাত্র নয়। শুধু পিছনের পাহাড়টার সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়েই জোরে হাঁটতে লাগল।
আমরা তিনজনেই সেই উঁচু চুড়োটার দিকে তাকালাম। বাদুড়ের পাখা ঝাঁপটানোর গতিতে ধোঁয়াটে অন্ধকার একটা আকার ধারণ করে ক্রমশ এই দিকে এগিয়ে আসছে … এছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।
বুঝলাম জিগমে ঐ অন্ধকারটাকেই ভয় পাচ্ছে।
আবার আমাদের পাহাড়ি পথে হাঁটা। কোথায় যাচ্ছি তা জানি না। জিগমে তো জানেই না। এমনকি মনে হচ্ছে সামভোতাও কেমন দিশেহারার মতো হাঁটছেন।
আমি তো আগেই বলেছি আমার বন্ধুটি যেমন দুঃসাহসী তেমনই বেপরোয়া। পরিবেশ পরিস্থিতির প্রতি খেয়াল না রেখেই সময় সময় এমন এক-একটা মন্তব্য করে বসে যা শুনে আমারই লজ্জা করে। যেমন এখন নানারকম দুশ্চিন্তার জন্যে তাড়াতাড়ি পাহাড় থেকে নামার সময়ে ও হঠাৎ সামভোতাকে জিগ্যেস করল, আচ্ছা সন্ন্যাসীজি, (সামভোতাকে কী বলে সম্বোধন করবে বিভাসের তা ঠিক থাকত না। আর যাই হোক অত বড়ো পণ্ডিত মানুষটি যিনি বাপ কাকার বয়সী তাকে তো মিস্টার সামভোতা বলা যায় না। সেদিন ট্রেনে মোঙ্গলদের কথা বলছিলেন, এরাই কি ইতিহাসের মোগল?
সামভোতাকে ভালো করে এখনও চেনা হয়ে না উঠলেও এইটুকু বুঝেছি উনি আমাদের মতো অর্বাচীন ছোকরাদের যেমন-তেমন কথাবার্তায় বা মন্তব্যে রেগে যান না, বিরক্তও হন না। বাইরের শান্ত ধীর, সৌম্য মূর্তির মতোই তাঁর অন্তঃকরণটাও যেন অমলিন, স্বচ্ছ, সুন্দর।
বললেন, এইরকম একটা সময়েও তোমার জানার আগ্রহ ভালো লাগল। না, মোঙ্গলরাই মোগল বা মুঘল নয়। তবে পরে–অন্তত একশো বছর পরে দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের অনেকেই তুর্কি জাতির সঙ্গে মিলে গিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে অনেকখানি সভ্য হয়ে ওঠে। তারাই পরে ইতিহাসে মুঘল নামে পরিচিত হয়।
একটা প্রশ্নের উত্তর পাবার সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর পরিস্থিতির কথা মনে না রেখেই আমার বেপরোয়া বন্ধুটি ফের জিগ্যেস করল, স্যার, এইমাত্র আপনি বললেন তুর্কি জাতির সঙ্গে মিলে আর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মোঙ্গলরা অনেকখানি সভ্য হয়ে উঠল। তা হলে কি মোঙ্গলরা অসভ্য ছিল?
সামভোতা একটা ছোটোখাটো পাথরের চাই লাফ দিয়ে ডিঙিয়ে পাশের ঢালের দিকে পা বাড়িয়ে বললেন, মোঙ্গল কথাটির উৎপত্তি হয়েছে মোঙ শব্দ থেকে যার মানে হচ্ছে নির্ভীক। তারা ছিল মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতি। তারা বেশিরভাগই ছিল সুদক্ষ অশ্বারোহী, নিষ্ঠুর আর দুর্ধর্ষ সৈনিক। তাদের হাতে থাকত বাঁকা তরোয়াল আর বর্শা। চেঙ্গিস খানের বাহিনীর বেশির ভাগই ছিল দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এই মোঙ্গল যাযাবররা।
এই রণোন্মাদ রক্তপিপাসু সৈন্যদের সাহায্যে তিনি পিকিং অধিকার করেন। আর এক বছরের মধ্যেই চিনের উত্তর ভাগ দখল করে নেন। মোঙ্গোলিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে যে বিশাল খোয়ারদাম সাম্রাজ্য তাও চেঙ্গিসের পদানত হয়। তারপর বুখারা, সমরখন্দ, বা এমনকি আফগানিস্তানের হিরাট প্রভৃতি শহরগুলি শুধু অধিকার করা নয়, ধ্বংস করে ফেলা হয়।
আর এইসব মোঙ্গলদের চেহারা কেমন ছিল শুনবে? শোনো
যা বলব তা আমার শোনা কথা নয়। বিখ্যাত কবি আমীর খসরু একবার এই মোঙ্গলদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। একে কবি মানুষ। ঝগড়াঝাটি, অশান্তি মোটেই পছন্দ করেন না। সেপাই-শাস্ত্রী, কারাগারের কথা ভাবলে ভয় পান। ঘটনাচক্রে তিনিই মোঙ্গলদের জালে পড়েন। তার জন্যে তার দোষ ছিল না। কিন্তু কে শুনবে তাঁর কথা? মোঙ্গলরা কবি টবির ধার ধারে না। আমীর খসরু তো মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হচ্ছেন, কিন্তু কী ভাবে যে তাঁর মুক্তি হল সে ইতিহাস অন্তত আমার জানা নেই। তবে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে এই মোঙ্গলদের যা বর্ণনা দিয়েছেন তা এই রকম–তাদের পশমের পাগড়ি বাঁধা লাল টকটকে মুখ দেখলে মনে হত পশমগুলো যেন জ্বলছে। তাদের মাথা ন্যাড়া। পাথরের গায়ে সরু ফাটলের মতো ছিল তাদের ক্রুর চোখ। তাদের সকলেরই শরীর থেকে পচা মৃতদেহের গন্ধ বেরোত, যে গন্ধ তাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। বিশাল জয়ঢাকের চামড়ার মতো খসখসে তাদের গায়ের চামড়া। তাদের নাকের গর্ত দুটো ছিল এ গাল থেকে ও গাল পর্যন্ত চওড়া। নাকের গর্ত সব সময়ে ভিজে থাকত। আর তা থেকে নর্দমার গন্ধ বেরোত। বড়ো বড়ো দাঁত দিয়ে তারা কুকুর-শুয়োরের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত। জল খেত নালা-নর্দমার। আস্বাদহীন ঘাস ছিল তাদের আর এক ধরনের প্রিয় খাদ্য।
সামভোতা এই পর্যন্ত বলে সকলকে নির্দেশ দিলেন, ওহে নওজোয়ানরা আরও একটু জোরে হাঁটতে হবে। মনে রেখো এখনও পর্যন্ত যেখানে আমরা রয়েছি তা সুখকর নয়।
কথাটা শুনে আমার খটকা বাধল। কী বলতে চাইছেন উনি–সুখকর নয়, না নিরাপদ নয়।
একবার চারিদিকে তাকালাম। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাহাড়ের ওপর লম্বা লম্বা ফার, পাইন আর চিনার গাছ।
ইতিমধ্যেই আমার নাছোড়বান্দা বন্ধুটি ফের ঝাঁপিয়ে পড়েছে
আচ্ছা স্যার, চেঙ্গিস খানের চেহারা পোশাক-পরিচ্ছদ কীরকম ছিল?
সামভোতা হেসে বললেন, সত্যিই তুমি অদ্ভুত। পাহাড়ে যখন ভয় দেখা দিয়েছে, আমরা যখন নামার জন্য ব্যস্ত তখনও তোমার যেন কোনো দুশ্চিন্তাই নেই। অবশ্যই এটা তোমার একটা গুণ।
একটু থেমে বললেন, প্রাচীন তিব্বতী গ্রন্থে এক জায়গায় বলা হয়েছে–দাঁড়াও পড়ে শোনাচ্ছি। বলে ঝুলি থেকে একটা বাঁধানো জীর্ণ বই বের করে পড়তে লাগলেন–একটু আগে ছোটো ছোটো বন্দি শিশুদের খাবারের লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে পাহাড়ের ওপর থেকে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে উঠেছিলেন মোঙ্গলদের ভয়ংকরদর্শন অধিপতি কটা দাড়িওয়ালা চেঙ্গিজ খান স্বয়ং।… তারপর তাঁর বাদামি রঙের তেজি ঘোড়ায় চেপে খান-ই খানানা আনন্দে শিস দিতে দিতে নিজের হলুদ রঙা তাঁবুতে ফিরে গেলেন। …।
আর এক জায়গায় …দীর্ঘদেহী চেঙ্গিজ খান স্বর্ণ সিংহাসনের ওপর পা গুটিয়ে বসেছিলেন। তাঁর কালো ভয়ংকর মুখে তামাটে রঙের দাড়ি। তাতে পাক ধরেছে, মাথায় গোলাকার কালো মুকুটের ওপর বিশাল পান্না বসানো। মুকুট থেকে কাঁধের ওপর ঝুলছে তিনটে শেয়ালের লেজ।
দাঁড়ান, দাঁড়ান। অবাক সুরে বিভাস বলে উঠল, শিয়ালের ন্যাজ!
হ্যাঁ।
কী বীভৎস!
আরও শোনো। তার চোখ দুটো ছিল পাহাড়ি বেড়ালের চোখের মণির মতো ঈযৎ সবুজ। সে তো মানুষের চোখ নয়, প্রেতের চোখ।
কথা বলতে বলতে ওরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। পথ কি ফুরোবে না? আমি ছটফট করছি কখন গাড়িতে গিয়ে বসব। এতক্ষণে নিশ্চয় গাড়ি সারানো হয়ে গেছে। অ্যাডভেঞ্চারের শখ মিটেছে। এখন পালাতে পারলে বাঁচি।
কিছুক্ষণ আগে থেকে একটা অস্পষ্ট গুমগুম শব্দ কানে আসছিল। পাইন গাছের ঘন। জঙ্গলটাকে বাঁ দিকে রেখে ডান দিকে ফিরতেই শব্দটা স্পষ্ট হল। আমরা পরস্পরকে জিগ্যেস করলাম, কিসের শব্দ?
সামভোতা মুখে কিছু বললেন না। দাঁড়িয়ে পড়ে শুনতে লাগলেন।
তোমরা আমার পিছু পিছু এসো। মনে হচ্ছে কোনো খরস্রোতা নদীর শব্দ। কিন্তু নদী এল কোথা থেকে? যেন নিজের মনে প্রশ্ন করলেন সামভোতাজি।
বিভাস বলল, পাহাড়-পর্বতে নদী থাকাটা কি অস্বাভাবিক? দাঁড়ান দেখছি। বলে সে একছুটে একটা ছোটো পাহাড়ের দিকে অনেকখানি চলে গিয়েছিল, সামভোতা লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে খপ করে বিভাসের হাত ধরে টেনে নিলেন।
চোখ মেলে দেখো।
সবাই দেখলাম মাত্র কয়েক হাত দূরে পাহাড়ের আড়ালে গভীর খাদ। আর তারই ধার ঘেঁষে ঘুরপাক খেতে খেতে ছুটছে সরু একটা খরস্রোতা নদী।
ইস্ এখুনি কী সব্বোনাশ হত! বললাম আমি।
কিছুই হত না। ঠিক সামলে নিতাম। কী বলুন সামভোতাজি! তা ছাড়া পাহাড়-পর্বতে খাদ থাকবেই। আমি তা ভালো করে জানতাম বলে সাবধানও ছিলাম।
ঘোড়ার ডিম ছিলে। চালবাজির একটা সীমা থাকা উচিত। কথাটা আমি মনে মনে বললাম।
সামভোতা বোধহয় কোনো কথাই শুনছিলেন না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছিলেন।
কী ভাবছেন? জিগ্যেস করলাম উদ্বেগের সুরে।
যাবার সময়ে অর্থাৎ পাহাড়ে ওঠার সময়ে তো কোনো খাদ বা নদী-নালা দেখিনি।
চমকে উঠলাম। তাই তো!
বিভাস কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে বলল, তা হলে নির্ঘাৎ আমাদের পথ ভুল হয়ে গেছে। ভালোই হল স্যার, অন্ধকার পথে অজানা ঠিকানার উদ্দেশে অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ জমবে।
সামভোতা কোনো উত্তর দিলেন না। আকাশের দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তখন অন্ধকার চরিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দোষ আমারই। দিক ঠিক করতে পারিনি।
জিগমে একটা পাথরের ওপর বসে একমনে গাছের সেই লতাপাতাগুলো জড়াচ্ছিল। বিভাস ধমকে উঠে বলল, তুই তো গাইড। ভুল পথে এলি কেন?
উত্তরে ও যা বলল সামভোতা তা বুঝিয়ে দিলেন। ও বলতে চাইছে প্রথম থেকেই পাহাড়ে ওঠায় ওর আপত্তি ছিল। তারপর অশরীরী ঘোড়সওয়ারগুলোর ঘোড়ার খুরের শব্দ ও …. তো পালিয়েই আসছিল–আমরাই দেরি করলাম।
বাঃ! খাসা জবাব।
তা বাবা, এখন কোন দিকে গেলে আমাদের গাড়ির টিকি দেখা যাবে বলতে পার?
জিগমে নিঃশব্দে এবং নির্ভীকভাবে মাথাকে শুধু এদিক থেকে ওদিকে নাড়ল। অর্থাৎ সে জানে না।
সামভোতা গম্ভীর মুখে বললেন, এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। যে রাস্তার ওপর আমাদের গাড়িটা রয়েছে তারই সমান্তরাল কোনো পথ আন্দাজে ঠিক করে এগোতে হবে। গাড়িটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে সারানো হয়ে গেছে, আর বোধ করি বুদ্ধিমান ড্রাইভার সেই পথ ধরে এগিয়ে গেছে আমাদের খোঁজে।
আমার বন্ধুটি যেন ব্যঙ্গ করে বলল, সেরকম হলে তো ভালোই হয়। কিন্তু আন্দাজে নতুন পথ ধরে যেতে যেতে সেই অশরীরী ঘোড়াদের রাস্তায় গিয়ে পড়ব না তো?
দেখা যাক। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে সামভোতা হাঁটতে শুরু করলেন।
হায় রে, ভেবেছিলাম এতক্ষণে কোথায় গাড়ির গদিতে পা ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকব। তা নয় অন্ধকার অজানা পথে চলেছি পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে।
সামভোতা পঁধের ঝুলি থেকে টর্চ বার করলেন। নতুন তেজি ব্যাটারি। বোতাম টিপতেই আলোর ছটা অনেক দূর গিয়ে পড়ল। কিন্তু তাতে মোটেই উৎসাহ পেলাম না। সামনে শুধুই কালো কালো পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে বিরাট বিরাট গাছ যেন পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
হতচ্ছাড়া বিভাসের দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা বলে ব্যাপারগুলোই নেই। এই প্রবল ঠান্ডায় অন্ধকার অজানা বিপদসংকুল পথে চলতে চলতে যখন ভয়ে আমার বুক কাঁপছে তখন ও কিনা সামভোতাকে সোজাসুজি বললে, এটাই কিন্তু স্যার, সবচেয়ে ভালো পরিবেশ যখন পথের ক্লান্তি ভোলার একমাত্র উপায় ভূতের গল্প শোনা।
রাগে আমার শিরাগুলো দপদপ করতে লাগল। ইচ্ছে করল সকলের সামনেই বিভাসটার কান দুটো আচ্ছা করে মুলে দিই। বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কি কেউ এই দুঃসময়ে দুর্গম পথে ভূতের গল্প শুনতে চায়? কয়েক ঘণ্টা আগে ঘোড়ার খুরের শব্দর কথা কি ভুলে গেছে? সত্যিই তারা অশরীরী কিনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি ঠিকই, তবু পাহাড়ের পর পাহাড়ের রাজ্যে এতগুলো ঘোড়া ছোটা কি বাস্তবে সম্ভব? কোন যুগের কোন দেশের কোন রাজা কোন রাজ্য দখল করতে ছুটল কে বলতে পারে? তা ছাড়া এ যুগে অশ্বারোহী সৈন্য পাঠিয়ে রাজ্য জয়ের কথা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এই অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার দেখার পরও এখন আবার ভূতপ্রেতদের ডাকা কেন?
সামভোতা কিন্তু একটুকুও বিরক্ত হলেন না। বললেন, তোমার সাহস দেখে আমি খুশি হচ্ছি। কিন্তু তিব্বতের মতো জায়গায় বাস করেও ভূতের ঘটনা বিশেষ জানি না। বরঞ্চ তুমি কিছু বলো।
বিভাস বললে, দূর! কলকাতায় ভূতটুত নেই। কাজেই ভূতের গল্প আমি জানি না। আমার প্রশ্ন–চেঙ্গিস খানের মতো ভয়ংকর নেতা ভূতটুত কি মানতেন? সে তো আজকের ব্যাপার নয়, প্রায় আটশো বছর আগের কথা। তখন ভূত-প্রেতরা বেশ জাঁকিয়েই রাজত্ব করে গেছে। তাই না?
সামভোতা এ কথার উত্তর না দিয়ে হয়তো নিছক সময় কাটাবার জন্যেই বললেন, আমি চেঙ্গিস খানের ওপর নানা ইতিহাসবিদের নানা বই পড়েছি। চেঙ্গিস খান যে কখনও ভূতের মুখোমুখি হয়েছিলেন এমন কথা পড়িনি। তবে উনি সংস্কার, গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব মানতেন, কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে তার কারণ না জানা পর্যন্ত স্বস্তি পেতেন না। আর এই কারণ খোঁজবার জন্যে নিজের বুদ্ধি, বোধশক্তি, বিচার-শক্তি খাটাতেন না। বৈজ্ঞানিক চিন্তার কোন ব্যাপারই ছিল না। কারণ জানার জন্যে তাঁর সাম্রাজ্যের সব বড়ো বড়ো গণৎকার, জ্যোতিষীদের ডেকে পাঠাতেন।
একবার শিকারে বেরিয়ে একটা বন্য বরাহর পিছনে ধাওয়া করতে গিয়ে তার ঘোড়া হোঁচট খায়। খান মাটিতে পড়ে যান। ঘোড়া ছুটে পালায়। বরাহটি খানের কাছে এসে থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু খানের কোনো ক্ষতি না করে ধীরে ধীরে নলখাগড়ার বনে চলে যায়। নির্ঘাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এই বেঁচে যাওয়াতেও দুশ্চিন্তায় তাঁর ঘুম হল না। মনের ভেতর ঘোরাফেরা করতে লাগল একটাই কথা–কে তাকে বাঁচাল? এতে অমর-লোকের কোনো উদ্দেশ্য আছে কিনা।
এই প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে তার অধিকৃত চিনের উত্তর ভাগ থেকে ঐ দেশের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী চানচুকে ডেকে আনালেন। সব শুনে সেই চৈনিক শাস্ত্রজ্ঞানী শুধু এই কথাই বলেছিলেন যে, মহামান্য খানের অনেক বয়স হয়েছে। স্বর্গীয় নির্দেশ–তিনি যেন শিকার করাটা এখন কমান।
চেঙ্গিস খান এ কথায় সন্তুষ্ট হননি। কারণ শিকারে যাওয়া তিনি বন্ধ করতে পারবেন না।
সুদূর চিন থেকে সহস্র লি [চিনা ভাষায় দূরত্বের পরিমাপ ও এক লি = প্রায় ২ কিলোমিটার।] পথ অতিক্রম করে আসা এই মহাজ্ঞানী তাপস চানচুকে কাছে পেয়ে খান আরও জিগ্যেস করেছিলেন, আচ্ছা আমাকে বুঝিয়ে বলুন দেখি বজ্র জিনিসটা কী? ওঝারা আর শামানদের সর্দার বেকি আমাকে বলে, মেঘলোকের ওপারে স্বর্গলোকে যে দেবতারা থাকেন তারা যখন মানুষের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে গর্জন করেন তখনই নাকি বজ্রপাত হয়। এ কথা কি সত্যি? তারা আরও বলে, লোকে যখন নিয়মমতো কালো রঙের প্রাণীর বদলে অন্য কোনো রঙের প্রাণী কুরবানি দেয় তখনই তিনি রুষ্ট হন, এ কথাও কি সত্যি? এছাড়াও লোকেরা আমাকে ভয় দেখায় গরমকালে স্নান করা বা নদীতে কাপড়-জামা ধোওয়া উচিত নয়, কম্বল বোনা কিংবা ব্যাঙের ছাতা তোলাও উচিত নয়। তাতে দেবতারা রুষ্ট হয়ে মানুষকে শাস্তি দেবার জন্যই বজ্র ও বিদ্যুতের সন্ত্রাস করেন।
বৃদ্ধ শাস্ত্রজ্ঞানী মানুষটি চেঙ্গিস খান-এর দিকে তাকিয়ে একটু হেসেছিলেন।
চেঙ্গিস খান তখন স্বর্ণসিংহাসনে সাদা পশমী গদির ওপর দুটি পা গুটিয়ে বসেছিলেন। মাথায় তার গোল মুকুট। মুকুটে লাগানো শেয়ালের কালো লেজ তাঁর মুখের ওপর ছায়া ফেলেছিল। স্বর্ণসিংহাসনের দুপাশের উঁচু উঁচু বাতিদানে জুলছিল মোটা মোটা মোমবাতি। শিবিরের মধ্যে কেউ ছিল না। থাকার মধ্যে গালিচার ওপরে বসে মোঙ্গল ও চিনাভাযায় দক্ষ তাঁর দুই দোভাষী।
পুণ্যবান চৈনিক শাস্ত্রজ্ঞানী বয়েসের কারণে দুর্বল কণ্ঠে শুধু বললেন, হে সম্রাট, আমি একজন সামান্য বুনো পর্বতবাসী। প্রাচীন পুঁথিপত্রে পড়েছি যে, মানুষের বিভিন্ন রকমের তিন হাজার অপরাধের মধ্যে ঘৃণ্যতম অপরাধ হল পিতা-মাতার উপর অশ্রদ্ধা। আর যিনি প্রজাপালক তার বাঁকা তরোয়ালে রক্তের ছোপ লাগা। আপনার রাজ্যে এসে দেখেছি প্রজারা নিজেরা ভোজসভায় মাতামাতি করে। অন্যদিকে বৃদ্ধ পিতা-মাতা, পিতামহ-পিতামহীকে শুকিয়ে মারে। এমনকি তাড়াতাড়ি ঘর খালি হওয়ার জন্যে তাদের মৃত্যু কামনা করে; সেবাশুশ্রূষা করা তো দূরের কথা। সম্রাট অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু এই দুটি কারণেই স্বর্গের দেবতারা অসন্তুষ্ট হয়ে নরাধমদের ধ্বংস করার জন্যে বজ্রবিদ্যুৎ নিক্ষেপ করেন। …সামনে আবার খাদ। সাবধান! বলে সামভোতা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলেন।
তবে চেঙ্গিস খানের স্ত্রী অশুভ আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন। তার প্রমাণ পুঁথিপত্রে পেয়েছি। একবার চেঙ্গিস খান পর্বতে বাস করছিলেন। সেখানে তাঁর স্ত্রী কুলান খাতুন আর চেঙ্গিসের শিশুপুত্র কুলকানও ছিলেন। তারা দুজনেই অসুস্থ হয়ে রেশমী গদির ওপর পশুলোমের চাদর জড়িয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে ছটফট করছিলেন। সেই পার্বত্য অঞ্চলে যতটুকু সম্ভব চেঙ্গিস খান চিকিৎসার ত্রুটি করেননি। কিন্তু রোগ সারার কোনো লক্ষণ নেই। হতাশ কুলান খাতুন কাঁদতে কাঁদতে স্বামীকে বললেন, যেভাবে আমার চিকিৎসা করছ, তা যতই যত্ন নিয়ে হোক, তবু আমরা সেরে উঠব না। এ হল এখানকার পাহাড়ি ভূত-প্রেতের কাণ্ড। এই অভিশপ্ত জায়গায় যে থাকবে ওনারা তাকেই কষ্ট দেবেন।
একটু থেমে বললেন, খাদের তলা থেকে কেমন কুয়াশা ওঠে দেখেছ? তোমার নিজের এবং তোমার ফৌজের হাতে যে সব কচি বাচ্চার প্রাণ গেছে এ হল তাদেরই আত্মা। আমি আর ছোট্ট কুলকান এখানেই মারা যাব। বাঁচাতে গেলে নিজের দেশ মোঙ্গলস্তেপে আমাদের ফিরে যেতে দাও।
চেঙ্গিস খান রেগে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, এখান থেকে অন্য কোথাও যাবার কথা মুখে আনবে না। আমাকে আগে দুনিয়ার বাকি অর্ধেকটা জয় করতে হবে। তারপর অন্য কথা।
কুলান খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, একটার পর একটা রাজ্য জয় করে, নিরাপরাধদের রক্তে হাত রাঙিয়ে আর কত গুনাহ বাড়িয়ে তুলবে? তানগুত-সম্রাট বুখানের বিকলাঙ্গ ছেলেটাকে তুমি কী নির্মমভাবে খুন করেছিলে সে কথা তো ভুলে যাওনি?
হু! বিকলাঙ্গ হলে কি হবে, ও ব্যাটা ছিল সাক্ষাৎ শয়তানের বাচ্চা। যে আমাকে মারবার চেষ্টা করবে তাকে আমিই আগে শেষ করে দেব। এটাই আমার নীতি।
তা কি তুমি পারতে যদি না তোমার অনুগত পদলেহী কিছু সাধারণ মানুষ মিথ্যের ফাঁদ পেতে বিশ্বাসঘাতকতা করে ওকে তোমার তরোয়ালের মুখে ঠেলে দিত?
সামভোতা আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন হঠাৎ পাহাড়ের নিচু অংশের শালগাছগুলোর মধ্যে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে কী একটা ভারী বস্তু বিকট শব্দ করে পাশের পাহাড়ের গাছগুলোর ওপর লাফিয়ে পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা টর্চের বোতাম টিপলেন। এদিক-ওদিক আলো ফেললেন। তারপর বললেন, ও কিছু না, বাঁদর। এখানকার পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁদররা রাতে লাফালাফি করে।
কিন্তু স্যার, হঠাৎ বলে উঠল জিগমে, টর্চের আলোয় আমি যে দেখলাম বাঁদর নয়। অন্য কিছু। বাঁদরের তো ল্যাজ থাকবে।
অন্য কিছু! চমকে উঠলাম আমরা তিনজনেই।
ঠিকঠাক বলো তো বাছা, অন্য কিছু বলতে কী বোঝাচ্ছ?
একটা বড়োসড়ো মোটাসোটা কালো ল্যাড়কা। ল্যাড়কা–কিন্তু গায়ে লোম। হ্যাঁ, আর যেন মনে হল তার মাথাটাই নেই।
.
অন্ধকার গুহায় কিছুক্ষণ
দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আমরা জনমানবশূন্য পথে হেঁটে চলেছি। কোথায় কোনদিকে যাচ্ছি কিছুই জানি না। পাঁচ-দশ মিনিট অন্তর আমরা প্রত্যেকেই হোঁচট খাচ্ছি। টর্চ থাকায় অবশ্য পাহাড়ি রাস্তায় সামান্য এক চিলতে পায়ে চলা পথের সন্ধান পাচ্ছি–এইটুকুই রক্ষে। শুধু চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সামভোতা বলতে চান রাতের মতো একটা মাথা গোঁজার জায়গা চাই-ই। আকাশে মেঘের ঘনঘটা–বিদ্যুতের চমকানি। পাহাড় কাঁপিয়ে গুড়গুড় করে মেঘ ডাকছে। এ যেন প্রলয়ের পূর্বাভাস! বৃষ্টি নামল বলে। তা হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজতে হবে। এই প্রবল শীতে বৃষ্টিতে ভিজলে, তারপর ভিজে জামা-প্যান্ট পরে রাত কাটালে মৃত্যুর ঘণ্টা বাজবেই।
আমার মাথায় তখনও ঘুরছিল সেই অন্যকিছু বস্তুটার কথা। সামলোমশাই বললেন, পাহাড়ি বাঁদর। বেশ কথা। তার না হয় একটা মানে আছে। কিন্তু হতভাগাটা যা বলল সে তো অদ্ভুত কথা। একটা জলজ্যান্ত ল্যাড়কা অর্থাৎ ছেলেমানুষ-বড়োসড়ো খোকা, মোটাসোটা, গায়ে লোম, আবার নাকি মাথাটাই নেই!–সে বস্তুটি কী?
টর্চের আলোয় চকিতের মধ্যে এমন বস্তুটি শুধু শ্রীমান জিগমের চোখেই পড়ল, আর কারও নয়!
আশ্চর্য, কারও মনে কোনোরকম খটকাই বাধল না? সন্ন্যাসীজি তো চুপ করেই গেলেন। মুখে যেন রুমাল গুঁজে আছেন।
আমি নিচু গলায় বিভাসকে জিগ্যেস করলাম, খোকাটিকে কী মনে হল শুনে?
তৎক্ষণাৎ বলল, নাথিং। স্রেফ ইলিউশন! চোখের ভুল!
ব্যস! তাহলে তো সমস্যার সমাধান হয়েই গেল। এদিকে জিগমে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে যেন ভয় পেয়ে আমাদের মাঝখানে থাকতে চাইছে। তবু এক এক সময় দলছুট হয়ে যাচ্ছে। একে গাঢ় অন্ধকার। তার ওপর কালো রঙ। মনে হল অন্ধকারে বুঝি মিশেই গেল।
জিগমে! স্তব্ধতা খান খান করে আমরা হাঁক দিই। দেখা তো নেই, সাড়াও নেই। তারপরই হঠাৎ ও যেন মাটি খুঁড়ে ওঠে।
কী বলছ?
কোথায় গিয়েছিলি?
ঐ যে কে একজন ডাকল আমায় ঐ পাহাড়টার দিকে …
কে ডাকল? আমরা তো ডাকিনি।
নির্লিপ্ত স্বরে বলল, তা হলে … কি জানি।
সামভোতা বললেন, ঐ পাহাড়ের পাশে খাদ আছে। শেষ হয়ে যেতে। খবরদার, স্বয়ং চেঙ্গিস খান ডাকলেও আমাদের কাছ থেকে কোথাও যাবে না। মালুম?
ও সুবোধ বালকের মতো উত্তর দিল, জি হাঁ।
তবু সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বোঝাতে চাইল ইচ্ছে করে সে ওদিকে যায়নি। কেউ ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
মরুক গে। এসব অদ্ভুত কথা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
কড়কড়কড়াৎ করে হঠাৎ বাজ পড়ল। বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো ঝিলিক ছুটে গেল সামনের পাহাড়টার দিকে। একটা দেবদারু গাছের মাথা জ্বলে উঠল। কতকগুলো পাথর গড়িয়ে পড়ল খাদের নীচে। পাহাড়ে এমন বজ্রপাত এই প্রথম দেখলাম।
তারপরই শুরু হল বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি। এই ভয়টাই করছিলাম আমরা। একটু আশ্রয়ের জন্যে সামভোতা টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ফেলতে লাগলেন।
চলো ঐ দিকে। ঐ পাহাড়টার নীচে। মনে হচ্ছে ওখানে মাথা গোঁজা যাবে।
ছুটতে ছুটতে আমরা পাহাড়টার নীচে এসে পৌঁছলাম। পাহাড়ের এই অংশ ছাদের মতো খানিকটা বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ভিতরটা ফাঁকা। এখানে চারজনে ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনোরকমে দাঁড়াতে পারব। সামভোতা টর্চের আলো ফেলে চারিপাশটা একবার দেখে নিলেন। গুহাটার চারিপাশে বুনো লতাপাতার ঝোপ। সাপখোপ চোখে পড়ল না। চোখে না পড়লেও আড়াল থেকে একটি নিঃশব্দ ছোবল হানতে কতক্ষণ। কিন্তু ভেবে লাভ কী?
জোর বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির সময় কলকাতার রাস্তায় পথ চলতে চলতে আমরা যেমন ছুটে গাড়িবারান্দার নীচে আশ্রয় নিয়ে হাঁট থেকে রেহাই পাবার জন্যে কেবল পিহোতেই থাকি, তেমনি এই সংকীর্ণ গুহায় ঢুকেই বুদ্ধিমানের মতো যতটা সম্ভব পিছিয়ে একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। এমন জায়গায় নিশ্চিন্ত হয়ে দাঁড়ালাম যে বৃষ্টির ছাঁট লাগা তো দূরের কথা, বাইরে যে শীতল প্রবাহ বইছে তার থেকেও রক্ষা পেয়ে যাচ্ছি।
সবাই যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, আমি তখন উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলাম, বসবার জায়গা যদি থাকত তাহলে এখানে বসেই বাকি রাতটুকু নিরাপদে কাটানো যেত।
বিভাস দাবড়ে উঠে বলল, রাতটুকু মানে? এখন কটা বেজেছে জান?
কটা?
স্যার, টর্চটা একবার জ্বালুন তো।
টর্চটা জ্বেলেই সামভোতা বললেন, দশটা পনেরো মিনিট।
মাত্র দশটা। আমি মুষড়ে পড়লাম, তা হলে তো বৃষ্টি থামলেই আবার হাঁটতে হবে। তাও যদি জানা একটা নির্দিষ্ট জায়গা থাকত! আচ্ছা, আমরা কোথায় চলেছি? তিব্বতী সন্ন্যাসী তো বলছিলেন কোন একটা বহু প্রাচীন রাস্তার খোঁজ করছেন। সে রাস্তা নাকি ভয়ংকর! আচ্ছা, পাগল না হলে কেউ এইরকম পাহাড়ে-পর্বতে ঐরকম ভয়ংকর রাস্তা খুঁজে বেড়ায়? সে রাস্তাটা খুঁজে পেলে নাকি একটা ঐতিহাসিক আবিষ্কার হবে। কী জানি! ওসব ব্যাপার বুঝি না।
আর আমরা কোথায় যাচ্ছি? গন্তব্যস্থল ছিল লাদাখের রাজধানী লে। কিন্তু গাড়ি খারাপ হয়ে যাবার পর ভুল রাস্তায় পড়ে এখন যে কোথায় এসে পড়েছি তার ঠিক নেই। তাই ঠিক করা গেছে যতটা সম্ভব পাহাড়ের পথ ধরে এগিয়ে যাব। তারপর? পথের শেষ কোথায় কে জানে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ভারী হয়ে যাওয়ায় পাথরের গায়ে হেলান দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলাম। যে জিনিসটা আমার গায়ে ঠেকল সেটা কিছুতেই পাহাড়ের খসখসে পাথর নয়, অন্য কিছু। শরীর বাঁকানো দূরের কথা, জায়গাটা এত সংকীর্ণ যে ঘাড় ফেরানোও কষ্টকর। সেই অন্যকিছুটা যে গুহা-ভেদ-করে-ওঠা কোনো গাছ ছাড়া আর কিছু হতে পারে না তা জানতাম, তবু ঘাড় না ফিরিয়ে দু হাত দিয়ে জিনিসটা কী বোঝবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারলাম না। গাছ নয়, এটা ঠিক। তাহলে? হাত বোলাতে বোলাতে মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকে যাচ্ছিল। সেইভাবেই দুটো হাত আরও একটু উপরে তুললাম। গোলমতো একটা কিছু হাতে ঠেকল। একটা ফুটোর মধ্যে দুটো আঙুল ঢুকে গেল স্বচ্ছন্দে। জিনিসটা যেন একটু নড়ে উঠল। তার পর….তার পর দুটো সরু সরু গাছের ডালের মতো কিছু যেন আমার গলার চামড়া ছুঁল। আমি শিউরে উঠলাম। হাঁকপাক করে বললাম, স্যার, একবার টর্চটা জালুন তো।
আমার গলার স্বরে নিশ্চয় ভয় ফুটে উঠেছিল তাই সাপটাপ ভেবে উনি চমকে উঠে টর্চটা জ্বাললেন।
অন্ধকার ঘুটঘুঁটে সেই গুহার কিছুটা অংশ আলোকিত হল। সেই আলোতেই দেখলাম।
দেখলাম যেটার গায়ে হেলান দিয়ে এতক্ষণ নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা একটি নরকংকাল। ঘাড়টা কাত হয়ে বুকের কাছে ঝুলছে। যে হাত দুটো উঠে আমার গলার দিকে এগিয়েছিল, এখন সেই হাড্ডিসার হাত দুটো তারই রক্তমাংসশূন্য গায়ের পাশে হাওয়ায় দুলছে। আর
আর দেখা গেল কবেকার সেই কংকালটি লতাপাতায় শক্ত করে বাঁধা। সেটি ঝুলছে গুহার ছাদের উপর থেকে।
তারপর কী করে যে সবাইকে ঠেলে দুই লাফে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম তা আমিই জানি।
আবার হাঁটা শুরু হয়েছে। কারও মুখে কথাটি নেই। আমার গা-টা কেমন ঘিন ঘিন করছে। কবেকার একটা কংকাল….
কিন্তু অন্ধকার গুহার মধ্যে মরল কী করে? আমাদের মধ্যে কেউ বলছে নির্জন জায়গা পছন্দ করে দড়ির অভাবে লতাপাতা জড়িয়ে ঝুলে মরেছে। কেউ বলছে খুন করে গুহার ভেতর ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিভাস প্রতিবাদ করে বলল, খুনটুন বাজে কথা। এখানে কে কাকে খুন করবে? খুন হয়েছে তার প্রমাণও নেই।
আমি বললাম, খুলিটা দেখেছিলে? কাঁধের উপর লটকে পড়েছিল না? আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি ও বেচারিকে ঘাড় মটকে মারা হয়েছে। তারপর শক্ত লতা দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু মারলটা কে?
এবার সামভোতা বললেন, ও তর্ক করে লাভ নেই। টর্চের আলোর যতটুকু লক্ষ করেছি তাতে বুঝেছি কংকালটা ঝুলে আছে বহুদিন। কংকালের গায়ে ছাতলা পড়ে গেছে। চটা উঠে গেছে।
এরপর কেউ আর কোনো কথা বলল না। কথা বলতে বলতে হাঁটলে ভয় থেকে দূরে থাকা যায়। কিন্তু কেউ কথা না বললে একা একা কি কথা বলা যায়? ফলে নিজেদের জুতোর শব্দ শুনে অন্তত আমি চমকে উঠছিলাম–কেউ পিছনে আসছে না তো?
সামভোতার মতো এক প্রবীণ ঋষিতুল্য তিব্বতী মানুষ কখন যেন আমাদের অভিভাবক হয়ে উঠেছেন। অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তিনিই এগিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। টর্চের আলো ফেলে ফেলে পথ দেখে নিচ্ছেন।
সহজ হবার জন্যে একসময়ে তিনি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি তো বেশ সাহসী ছেলে। দিব্যি একটা ঘাড়-মটকানো কংকালের গায়ে গা লাগিয়ে সময় কাটাচ্ছিলে।
সাহস আর কী স্যার, আমি যদি জানতাম গায়ের কাছে আস্ত একটা কংকাল ঝুলছে তাহলে কি ওখানে দাঁড়াতাম। তবে লোকটা কোনো এক কালে খুন হয়েছিল এ কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। হয়তো লোকটা নিরপরাধ ছিল। তবে যদি খুনটা ভূতে করে থাকে তাহলে বলার কিছু নেই।
সামভোতা বললেন, আমার দেশে তিব্বতে প্রেতচর্চা চলে নিষ্ঠার সঙ্গে। অনেক প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘাঁটা হয়। এইসব আলোচনাচক্রে আমিও বহুদিন ছিলাম। একটা সত্য জেনেছি ভূত মাত্রই মানুষের ক্ষতি করে না। অকারণে মানুষ মারে না। কিন্তু সে নিজে যদি অত্যাচারিত হয়ে খুন হয়ে থাকে তাহলে সে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করে। চেঙ্গিস খান কতখানি নিষ্ঠুর ছিলেন প্রাচীন পুঁথিপত্র তার সাক্ষ্য দেয়। তার নিজের হাতে বা তার ফৌজের হাতে কত নিরীহ মানুষ খুন হয়েছে তার হিসেব নেই। সেইসব ক্ষুব্ধ প্রেতাত্মা যদি তার বা তার পরিজনদের ওপর প্রতিশোধ নেয় তাহলে বলার কিছু নেই। এ কথা তিনিও বুঝতেন। তাই তিনি কী করলে মঙ্গল হবে, কী করে ফেললে ক্ষতি হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্যে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর নির্ভর না করে শামান, ওঝা, বৈদ্য, ফকিরদের ডাকতেন।
একবার তার খেয়াল হল চুলে পাক ধরেছে। চুল পেকে যাওয়াটাকে তিনি খুব ভয় পেতেন। মনে হত এবার বৃদ্ধ হয়ে পড়বেন, তারপরেই মৃত্যু।
মৃত্যু ব্যাপারটা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। অথচ সব মানুষকেই নাকি মরতে হবে–এ তো বড় অদ্ভুত কথা। যদিও তাঁর উপযুক্ত ছেলে ছিল জাগাতাই, পৌত্র ছিল মুতুগান–যে মুতুগানই ঠিক হয়েছিল সমস্ত মুসলিম দুনিয়ার ভাবী খাই-খানা, তবু তার হাতে গড়া বিরাট সাম্রাজ্য।
বাধা দিয়ে বিভাস জিগ্যেস করল, তার সাম্রাজ্য কতদূর পর্যন্ত ছিল?
তা ধরো উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে দক্ষিণে জর্জিয়া আর পুবে চিন থেকে পশ্চিমে রাশিয়া।
বাবাঃ! এ তো বিশাল সাম্রাজ্য!
হ্যাঁ, তাই। আর একটার পর একটা রাজ্য জয় করেছিলেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজে সৈন্য পরিচালনা করে। তাঁর দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী সৈন্য ছিল শত্রুদের ত্রাস। যেমন ধরো এ যুগে য়ুরোপ-কাঁপানো হিটলারের ট্যাঙ্ক বাহিনী। আর তার সেই বিশাল সাম্রাজ্য ভেবে রেখেছিলেন তিনিই শাসন করে যাবেন চিরকাল ধরে।মৃত্যু বলে ব্যাপারটা কোনোরকমেই বাধা না হয়ে দাঁড়ায়।
মন্ত্রীদের, পণ্ডিতদের তো মাথায় হাত। এই পৃথিবীতে জীবজন্তু তরুলতা মানুষ কেউই অমর নয়। অমর হওয়া সম্ভব নয়।
চেঙ্গিস খান শোনবার পাত্র নন। তাঁকে অমর হতেই হবে। তাও বিছানায় পড়ে থেকে নয়। রীতিমতো শাসনদণ্ড হাতে নিয়ে। তখন তিনি তার বিশাল সাম্রাজ্যের যত নামকরা বৈদ্য, ওঝা, কবিরাজ, হেকিমদের ডেকে পাঠালেন। এমন কিছু ওষুধ তৈরি করো যাতে অমর হওয়া যায়।
এই অসম্ভব আদেশ শুনে তাদের তো থুতনি ঝুলে গেল। এ কী করে সম্ভব?
চেঙ্গিস খান কোনো কথা শুনতে চান না। সাত দিন সময় দিলেন। সাত দিনের মধ্যে তার ওষুধ চাইই।
নির্দিষ্ট দিনে চারজন বৈদ্য অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পানীয় নিয়ে হাজির হলেন। সন্দিগ্ধস্বভাব, অবিশ্বাসী খান মুখে পাথরের ফাটলের মতো সরু হাসি হাসলেন। বললেন, যাক, তোমরা তাহলে দাওয়াই তৈরি করতে পেরেছ?
চারজনেই বলল, আজ্ঞে হাঁ সম্রাট।
বেশ তা হলে তো তোমাদের পুরস্কৃত করা উচিত।
আজ্ঞে সে আপনার মর্জি।
তখন তিনি ঐ সব বৈদ্যদের যার যার নিজের আবিষ্কৃত দাওয়াই পান করার হুকুম দিলেন। তার পরদিন তিনি তাদের বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে নিজে হাতে শিরোচ্ছেদ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ করতে থাকেন তারা সত্যিই মরে গেছে কিনা।
তারা কেউ বেঁচে ওঠেনি। তাই দেখে চেঙ্গিস খান মনে মনে গর্জে উঠেছিলেন–দুনিয়ার সবাই তাকে ঠকাতে চায়। সবাই শক্ত।
শেষে তার প্রধান অমাত্য ও জ্যোতিষী ইয়েলিও-এর পরামর্শে চিন দেশের শ্রেষ্ঠ গুণী মহাস্থবির চানচুকে সাদরে তার রাজসভায় আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি ত্রিকালদর্শী মহাসাধক। তিনি ধ্যান করেন কখনও মৃতদেহের মতো নিশ্চল হয়ে বসে; কখনও সারাদিন গাছের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েই থাকেন। তিনি তার দীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু দেখেছেন। বহু প্রাচীন পুঁথি পড়েছেন। তিনি বহু কষ্টে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে এলেন। তিনিই চেঙ্গিস খানকে বোঝাতে পেরেছিলেন, এ জগতে কেউ অমর হতে পারে না।
তারপর সামভোতা পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, নিরপরাধ মানুষকে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ না দিয়েই খেয়ালের বশে তিনি কতজনের প্রাণ সংহার করেছেন। এইসব ক্ষুব্ধ আত্মা সুযোগ পেলে কি সম্রাটের ক্ষতি করবে না?
ক্ষতি কি চেঙ্গিস খানেরও হয়নি? বালতান দুর্গের লড়াইয়ে শত্রুপক্ষের ছোঁড়া বর্শার আকারের এক বিশাল তীর এসে বেঁধে চেঙ্গির খানের বড়ো আদরের পৌত্র মুতুগানের বুকে। তাতেই সে শেযশয্যা গ্রহণ করেছিল। বেদনাহত, ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ চেঙ্গিস তখনই গণৎকারদের ডেকে এনে এত বড়ো দুর্ঘটনার কারণ জিগ্যেস করলেন। কিন্তু কেউ সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। শুধু একজন বৃদ্ধ গণৎকারই বলেছিল, এটা কোনো ক্ষুব্ধ আত্মার প্রতিহিংসা।…..
শুনতে শুনতে আমরা অনেক দূর চলে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল আমাদের দলটা যেন হাল্কা হয়ে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা টর্চ জ্বেলে সঙ্গীদের হিসেব নিয়ে নিলেন। জিগমে নেই। চমকে উঠে বার বার তার নাম ধরে ডাকা হল। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না।
হয় তো অন্ধকারে অন্যমনস্ক ভাবে চলতে চলতে পথ হারিয়ে ফেলেছে।
আমি কতকটা নিজের মনেই বলে উঠলাম, আচ্ছা সেই কংকালের গুহা থেকে আমরা যখন সবাই হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসি তখন ও-ও বেরিয়ে আসতে পেরেছিল তো?
এর উত্তরে আমরা শুধু নিঃশব্দে মুখ-চাওয়া-চাওয়ি করেছি। উত্তর দিতে পারিনি।
.
আঁধারে প্রদীপ জ্বলে
জিগমের কথা মনে করে আমরা সকলেই এমন ভারাক্রান্ত হয়ে আছি যে হাঁটার ক্লান্তিকে ক্লান্তি বলেই মনে হচ্ছে না। কতকগুলো যান্ত্রিক মানুষ যেন দম দেওয়া পুতুলের মতো এগিয়ে চলেছে দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। অথচ কোন নিরুদ্দেশের পথে, কোন মৃত্যুপুরীর ঠিকানায় চলেছি তার ধারণাটুকুও নেই।
হঠাৎ ডান দিকের পাহাড়ের গাছগুলো কেঁপে উঠল। আমরা চমকে উঠলাম। আবার কি সেই মনুষ্যাকৃতি লোমশ জন্তুটা–হ্যাঁ, তাই।
বেঁটেখাটো একটা প্রাণী অন্য একটা গাছে লাফিয়ে পড়ে তার ডাল ধরে ঝুলতে লাগল। আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু তারপর যা ঘটল–
সামভোতা হঠাৎ টর্চ-এর আলো ফেললেন জীবটার দিকে। চমকে উঠলাম। মনুষ্যাকৃতি একটা বামন। লোমে ভরা তার ছোট্ট দেহটা। বীভৎস তার মুখ। ক্রোধে ঝকঝক করছে চোখ দুটো। দেহের তুলনায় হলদে দাঁতগুলো বড় বড়ো। সেই দাঁতে চেপে আছে একটা ছোরা। আশ্চর্যের বিষয় তার মাথাটা ঠিক ঘাড়ের ওপর নেই। কাঁধের পাশে লেগে রয়েছে।
মুখের ওপর আলো পড়তেই ও মুখটা আরও ভয়ংকর করে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ল আমাদের সেই পাহাড়ি রাস্তার ওপর। তারপর দুহাত দোলাতে দোলাতে গুটগুট করে আমাদের সামনে সামনে এগিয়ে চলল। কাটা মাথাটা কাঁধের ওপর দুলতে লাগল।
গভীর রাতে নির্জন পাহাড়ি পথে এমন একজন বামনকে দুহাত দুলিয়ে বীরবিক্রমে হাঁটতে দেখব কল্পনা করিনি। এই কি জিগমের ভাষায় সেই থি?
কে উত্তর দেবে?
অল্পক্ষণের মধ্যেই বামনটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
তারপর আরও কিছুক্ষণ হাঁটা–কিছুক্ষণ পথের ধারে পাথরের ওপর বসে বিশ্রাম। আবার চলা। আশ্চর্য, কেউ কোনো কথা বলছে না। কোন অদৃশ্য শক্তি যেন আমাদের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য কী কথাই বা বলা যাবে? এ তো বেড়াতে যাওয়া নয়? সবাই নিজের মতো করে রহস্যের সমাধান করার চেষ্টা করছি। জিগমের কথা ছাড়াও আমার ভাবনা হচ্ছিল আমাদের ড্রাইভারকে নিয়ে। সে এই ভয়ানক জায়গায় একা গাড়ি নিয়ে কোথায় কত দূরে পড়ে আছে কে জানে!
হঠাৎ সামভোতা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। টর্চের আলো এদিক-ওদিক ফেললেন।
ইস! একী!
রাস্তার দুপাশে কংকালের পর কংকাল পড়ে আছে। তাদের কোনোটারই মাথা নেই।
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে সামভোতা চাপা গলায় বলেছিলেন, সাবধান! আর এগিয়ো না। ঐ দ্যাখো।
সবাই দেখলাম। না, চোখের ভুল নয়। স্পষ্ট দেখলাম, পাহাড়ি যে রাস্তা দিয়ে আমরা এতক্ষণ হাঁটছিলাম সেই রাস্তাটা যেখানে অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তায় এসে মিশে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে তারই কিছুদূরে কয়েক জন একটা কফিন কাঁধে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। তাদের একহাতে ভোলা তরোয়াল। শুধু চারজন শববাহকই নয়, তাদের সামনে-পিছনে জনা দশেক লোক নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। প্রত্যেকের হাতে বর্শা।
এত রাতে এই অন্ধকার নির্জন পথে ওরা কারা? কফিনে করে কার শব নিয়ে যেন অতি গোপনে অতি সন্ত্রস্তভাবে এগিয়ে চলেছে। আরও খানিক দূর এগিয়ে শবযাত্রীর দল হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সামভোতা আমাদের একটা বড় পাথরের আড়ালে বসে পড়তে ইশারা করলেন। আমরা তার নির্দেশ পালন করলাম।
অভিজ্ঞ সামভোতা ঠিকই বুঝেছিলেন শবযাত্রীর দল এবার একবার পিছন ফিরে তাকাবেই। তাকালও। বোধহয় দেখতে চাইল কেউ তাদের দেখছে কিনা।
তারপর তারা পথ ছেড়ে ডান দিকের গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলে গেল। রাতচরা একটা মস্ত শেয়াল জাতীয় পশু এত লোকজন দেখে ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছিল, শববাহী দলের সামনে যারা ছিল তাদেরই একজনের হাতের বর্শায় নিরপরাধ পশুটা দুবার ঘুরেই পড়ে গেল। শববাহীর দল খুব গোপনে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দশ-পনেরো মিনিট পরে আমরা উঠে দাঁড়ালাম। তারপর ফের এগিয়ে যাওয়া। আমার দুঃসাহসী বন্ধুটির ভাষায় যতই চোখের ভুল হোক না কেন, তবু আমরা, যেখান থেকে শববাহীর দল ডান দিকের জঙ্গলের পথ ধরেছিল সাবধানতার জন্যে সেই পথটুকু ছেড়ে দিয়ে একটু ঘুরপথ ধরে এসে আবার সেই অপেক্ষাকৃত চওড়া রাস্তা ধরলাম।
একটার পর একটা ঘটনায় আমরা বিমূঢ়, শ্রান্ত। আমাদের ব্রেন যেন আর কাজ করতে চাইছে না। রাত কটা বেজেছে? নিজের হাতে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। কী হবে কপ্রহর রাত হয়েছে জেনে? এ রাত কি কোনোদিন সূর্যের মুখ দেখবে? এ পথ কি কোনোদিন ফুরোবে?
এর পরেই আবার একটি আকস্মিক ব্যাপার!
সূর্যের মুখ কবে দেখতে পাব বা কোনোদিনই দেখতে পাব কিনা জানা না থাকলেও কিছু দূরে সেই জনমানবশূন্য অন্ধকার পথে হঠাৎ একটা বিন্দুর মতো আলো দেখা গেল।
আলো! আনন্দের আতিশয্যে আমাদের মুখ থেকে একটা চাপা উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এল। যেন আমরা কত যুগ পরে আলো দেখলাম।
কিন্তু এই অন্ধকারের রাজ্যে ওটা কিসের আলো, আনন্দে উৎসাহে তা ভেবে দেখার অবকাশই পাইনি। তিব্বতী প্রৌঢ়টির দিকে তাকালাম। তার মুখে কোনো উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনার চিহ্নমাত্র নেই।
জিগ্যেস করলাম, ওটা কিসের আলো?
উনি বিরক্ত হয়ে বললেন, এখান থেকে কী করে বলব? আমি গণৎকার নই। ওটা আলো নাও হতে পারে। চলো, সাবধানে এগোনো যাক।
না, আলোই। মরীচিকা বা অন্য কোনোরকম অলৌকিক চোখ-ভোলানো ব্যাপার নয়।
আমরা সবাই আলোটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একটা মস্তবড়ো পাথরের প্রদীপে তেল জাতীয় কিছুতে সলতে জ্বলছে। আর তা থেকে সুগন্ধ বেরোচ্ছে।
আরে! ঐ দ্যাখো, সামনে রাস্তার ধারে ধারে আরো কটা পিদিম জ্বলছে।
কাছে গিয়ে দেখা গেল একই রকমের প্রদীপ।
কিন্তু এগুলো এত যত্ন করে জ্বালাল কে? কেনই বা জ্বালিয়ে রেখেছে? পথিকদের সুবিধের জন্যে?
তা হলে কি সত্যিই আমরা এতক্ষণে অন্ধকার থেকে আলোর জগতে এসে পৌঁছলাম?
সামভোতা মুখ ভোঁতা করে বললেন, আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। এভাবে পথের ধারে ধারে এত সুন্দর দীপাধারে কারা আলো জ্বেলে রেখেছে? কেন রেখেছে? অথচ দ্যাখো কাছেপিঠে লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। আচ্ছা, গাছগুলোর আড়ালে ওটা কী?
উনি টর্চের বোতাম টিপলেন। একটা বহু পুরনো ভাঙা পোড়ামাটির ইটের বাড়ি।
এই দীর্ঘ পাহাড়ের রাজ্যে, হোক ভাঙা তবু, এই প্রথম একটা বাড়ি চোখে পড়ল। তাহলে?
দাঁড়াও-দাঁড়াও মনে পড়ছে। ইতিহাস….সিন্ধুসভ্যতা….মাটির নীচ থেকে তুলে আনা প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের দুটি গোটা নগরী হরপ্পা আর মহেঞ্জোদো! পোড়া ইটের বাড়ি, রাস্তার মাঝে মাঝে আবর্জনা ফেলার জায়গা, জল-নিকাশি ব্যবস্থা, নগরের বাইরে উঁচু উঁচু টিলার ওপর বড়ো বড়ো ট্যাঙ্কের মতো জলাধার, যাতে বৃষ্টি আর নদীর জল ধরে রাখা হত নগরবাসীর প্রয়োজন মেটাবার জন্যে! প্রধানত পুরোহিত আর ধনী সামন্ত বণিকরাই শাসন করত নগরবাসীদের। এই সময়ে এখানেই দেখা গেছে পথিকের সুবিধের জন্য রাস্তায় রাস্তায় প্রদীপ জ্বেলে রাখবার ব্যবস্থা। পূর্ণিমা শুক্লপক্ষ ছাড়া। বাড়ির আলো রাস্তায় পড়ত না। কেননা রাস্তার দিকে বাড়ির কোনো জানলা থাকত না। কেন থাকত না কে জানে!
সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সিন্ধুসভ্যতার ধারার এক চিলতে আলো কি আজও ধরে রেখেছে এই অঞ্চলের মানুষ?
কিন্তু মানুষজন কই?
.
রহস্যময় চৈনিক মহাজ্ঞানী
আপনারা দেখছি সারা রাত জেগে, পথ চলে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছেন। যান, অনুগ্রহ করে আপনাদের জন্যে নির্দিষ্ট কক্ষে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন।
সকাল তখন নটা। পাহাড়ের অন্ধকার রাজ্য পার হয়ে একটা সমতলভূমিতে আমরা এখন এসে পৌঁছেছি। এখানে লোকজন, বাড়িঘর, ঘোড়ায় টানা টাঙা সবই আছে। হোটেল আছে কিনা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে একজনকে জিগ্যেস করতেই সে একজন চ্যাপটা মুখ, হলদে রঙের ছোকরার হাতে আমাদের তুলে দিল। ছেলেটার শুধু চ্যাপটা মুখই নয়, মুখের তুলনায় বড়ো বড়ো কান। হাসলে মুখটা হাঁ হয়ে প্রায় কানের লতি ছোঁয় আর কি। দেখলে ভয় করে। মোঙ্গল নাকি?
এটা হোটেল?
ছোকরাটি উত্তর না দিয়ে মাথা দুলিয়ে সায় দিল।
তুমি এখানে কাজ কর?
ছোকরাটি আবার নিঃশব্দে সায় দিল।
এখানে দু-একটা দিন থাকা যাবে?
শুধু মাথা দুলিয়ে এবারও জানাল, হ্যাঁ।
হোটেলটি পুরনো। একতলা বাড়ি। দূরে পাহাড়ের শ্রেণি। ঐ সব পাহাড়ের কোনগুলির মধ্যে দিয়ে কাল সারা রাত্রি হেঁটেছি এখান থেকে তা অনুমান করার সাধ্য নেই।
ভেতরে ঢুকতেই কাজের লোকদের গলা পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে রান্নার সুগন্ধ। মনটা শান্ত হয়ে হল। মনে হল কত দিন এরকম ব্যস্তসমস্ত মানুষের গলা শোনা যায়নি। যদিও তাদের ভাষা আমাদের কাছে অজানা।
এরপর পীত বর্ণের কারুকার্য করা পর্দা সরিয়ে যে ঘরে আমাদের আনা হল সে ঘরটি বেশ সাজানো। দেওয়ালে দেওয়ালে চিনদেশীয় ছবি। ছবিগুলির মধ্যে অনেকগুলি পাহাড় পর্বতের। মাঝখানের ছবিটি ধ্যানস্থ বুদ্ধদেবের। একটা সাধারণ কার্পেটের ওপর পুরু ভেড়ার লোমে ঢাকা আরামকেদারায় দুপা গুটিয়ে শুয়ে শুয়ে দীর্ঘ সট্রা ঠোঁটে চেপে যে বৃদ্ধটি ভুরুক ভুরুক করে গড়গড়া টানছিলেন তাঁকে দেখে আমরা দুই বন্ধু যতটা অবাক হয়েছিলাম তার থেকে ঢের বেশি স্তম্ভিত হয়েছিলেন সামভোতা।
চিনদেশীয় বৃদ্ধটি এতই বৃদ্ধ যে তার বয়েস অনুমান করা যায় না। এই বয়েসে মুখের চামড়া হাতের মুঠোয় মোড়া কাগজের মতো অজস্র ভঁজে কুঁকড়ে গেছে। তা হলেও ফর্সা মুখখানায় লালচে আভা। থুতনির কাছে কয়েক গাছা পাকা দাড়ি। মাথায় চিন দেশের ধর্মগুরুদের মতো টুপি। মুখে স্নিগ্ধ হাসি।
ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে কথাগুলি বললেন তা কলকাতার চিনেপট্টির চৈনিকদের মুখে বাংলা ভাষার মতো। স্বচ্ছন্দ নয়, দুর্বোধ্যও নয়। থুমি সামভোতা হঠাৎ কেন যে কার্পেটের ওপর নতজানু হয়ে বৃদ্ধ চিনাটিকে শ্রদ্ধা জানালেন বুঝতে পারলাম না। দেখাদেখি আমাদেরও ঐভাবে নত হতে হল। একজন হোটেলের মালিককে এতখানি শ্রদ্ধা জানাবার কারণ প্রথমে বুঝতে পারিনি। একটু পরেই বুঝলাম।
সামভোতা হাত জোড় করে বললেন, আপনি কী করে জানলেন আমরা সারা রাত জেগে পথ হেঁটে এসেছি?
হাসলেন বৃদ্ধ চৈনিক। বললেন, শুধু এইটুকুই? আর সারা রাত কত ভয়ংকর ব্যাপার কাটিয়ে এসেছেন তাও কি আমি জানি না?
হঠাৎ আমার মনে হল–কে এই চৈনিক বৃদ্ধ? কোথায় এঁকে দেখেছি?
না, কোথাও দেখিনি। দেখা সম্ভবও নয়। তবে এঁর কথা শুনেছি সামভোতার মুখে। যে বর্ণনা শুনেছিলাম তাতে মনে হয় প্রায় আটশো বছর অতিক্রম করে সুদূর চিন দেশ থেকে এখানে এসে অবস্থান করছেন সেই মহাস্থবির গুণী–যিনি ধরণী ও আকাশের সমস্ত রহস্য উদঘাটন করেছেন এমনকি অমরত্ব লাভের পরশপাথর তান্-এরও নাকি সন্ধান জানেন–যাঁকে একদিন ডেকে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং চেঙ্গিস খান–যাঁর নাম চানচু।
কিন্তু তা সম্ভব কী করে? সুদূর চিন থেকে চেঙ্গিস খান-এর আহ্বানে তিনি পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তা বলে সেই মানুষ আটশো বছর বেঁচে থাকবেন। তিনি কি তা নামে সেই পরশপাথর সত্যিই আবিষ্কার করে ফেলেছেন?
বিভাসকে বলতেই ও ক্ষেপে গেল। বলল, যত আজগুবি ধারণা তোমাদের মাথায় আসে? একজন অতি বৃদ্ধ চিনা লোক হলেই কি তিনি আটশো বছর আগের চানচুন্ হবেন?
ইতস্তত করে বললাম, তা ঠিকই তবে সামভোতার মতো মানুষ হঠাৎ ওঁকে নতজানু হয়ে প্রণাম করলেন কেন? কী করেই বা ঐ বৃদ্ধ আমাদের গত রাত্রের কথা বলে দিলেন? তা ছাড়া ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কেমন একটা দৈব অভিব্যক্তি!
এমনি সময়ে একটি বিচিত্র ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তি বাইরে থেকে এসে দাঁড়াল। দুর্বোধ্য ভাষায় লোকটি কিছু বলল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের চাদরটি জোব্বার ওপর ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বৃদ্ধ সবিনয়ে আমাদের বললেন, হোটেল চালানো ছাড়াও আমার ছোটোখাটো একটি নার্সিংহোম আছে। এই সময়টা একবার পেশেন্টদের দেখে আসি। আপনারা ততক্ষণ বিশ্রাম করুন। অবশ্য ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতেও পারেন। গেলে খুশিই হব।
সারারাত্তির দুর্ভোগের পর আর রুগি দেখতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম প্রায় শত বছর বয়েসের ভার মাথায় নিয়ে কী উৎসাহে বৃদ্ধ স্বচ্ছন্দে রোগিরও সেবা করে যাচ্ছেন!
যেতে যেতে বোকার মতো বলেই ফেললাম, হোটেল চালাচ্ছেন, সে তত কম ঝামেলা নয়, তার ওপর আবার নার্সিংহোমের ব্যবসা।
বৃদ্ধ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সরু আকারের চশমার কাচটা একটু তুলে ধরে মিনিটখানেক আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে না বুঝে কথা বলা ঠিক নয়। হোটেল চালানোটা আমার জীবিকা কিন্তু আমার কোনো ঝামেলা নেই। আমার একদল দায়িত্ববান কর্মচারী আছে। তারাই সব ঝামেলা কাঁধে নিয়ে আছে। বিশ্বাসভঙ্গের কথা তারা ভাবতেই পারে না।
আর নার্সিংহোম? ওটা ব্যবসার জন্যে নয়। মানুষের সেবা করার জন্যে। শুধু মানুষের সেবা করাই নয়, পশুপাখির জন্যেও আমার নিরাময় কেন্দ্র আছে। দুদিন যদি থাকেন দেখাব। আমরা যে সম্প্রদায়ের মানুষ, সেবাই হচ্ছে তাদের একমাত্র ধর্ম–একমাত্র কর্ম। আপনাদের স্বামী বিবেকানন্দর মতো
হ্যাঁ, এমন মানবপ্রেমী
বিভাসকে থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ বললেন, তিনি শুধু মানবপ্রেমী নন, জীবপ্রেমীও…..
যাই হোক, প্রথম আলাপেই বৃদ্ধটিকে খুব ভালো লাগল। আর তার নার্সিংহোমে গিয়ে যে লাভ হল তার জন্যে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই।
একটি বেডের কাছে গিয়ে প্রাজ্ঞ বৃদ্ধটি বললেন, দেখুন তো একে চেনা মনে হচ্ছে কিনা?
আমরা তিনজনেই আনন্দে চমকে উঠলাম।
এ কী! জিগমে!
হ্যাঁ, আজ ভোরে একে ঐ পাহাড়টার নীচে অচৈতন্য অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। জ্ঞান ফিরলে ও সব কথা বলে। জিগ্যেস করেছিলাম, তা দল ছেড়ে কী করে ওদিকে গেলে? ও যা বলল তা অদ্ভুত। বলল, কে নাকি ওকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। খাদের ধারে গিয়েও গাছের শেকড় আঁকড়ে ধরে বেঁচে যায়।
এর আগেও ওকে অমনি কে ডেকে খাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। কে অমন মরণডাক দিয়েছিল আপনি কি বলতে পারেন?
বৃদ্ধটি একটু হাসলেন। বললেন, পারি। এখন আপনারা হোটেলে ফিরে গিয়ে খেয়ে নিয়ে বিশ্রাম করুন। সন্ধেবেলা বলব।
জিগ্যেস করলাম, জিগমের সুস্থ হতে কত দিন লাগবে?
আপনারা তো দুদিন আছেন। দুদিন রেস্ট পেলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। একসঙ্গে ফিরবেন।
.
সন্ধেবেলা।
সেই ঘরটিতে সাদা পশমী গদির ওপর বসে আছেন বৃদ্ধ চৈনিক জ্ঞানী মানুষটি। তাকে যেন এখন কেমন কুঁজো কুঁজো লাগছে। দুপাশে রুপোর উঁচু উঁচু বাতিদানে জ্বলছে মোটা মোটা মোমবাতি। তিনি ভাঙা ভাঙা গলায় সামভোতাকে জিগ্যেস করলেন, প্রথমেই আপনার কথা জানতে ইচ্ছে করছে। তিব্বতের পুণ্যভূমিতে আপনার জন্ম। সংসার করেননি। তবু সারা জীবন কিসের খোঁজে নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন?
সামভোতা বললেন, আমি জানি আপনি সর্বজ্ঞ। তবু বলি–খাতায় কলমে বা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসের ডিপ্লোমা না পেলেও আমি মনে-প্রাণে একজন ইতিহাসবিদ। পৃথিবীর যত প্রাচীন প্রখ্যাত পুরুষ, তাদের প্রকৃত জীবনকাহিনি, লুপ্তপ্রায় প্রাসাদ, জন্মভিটে, তাদের স্থাপত্যকীর্তি আমি খুঁজে বেড়াই। শুধু ছাপার বই নয়, প্রাচীন পুঁথিপত্রও কম পড়িনি।
একটু থেমে সামভোতা ফের শুরু করলেন–মহাযোদ্ধা রক্তলোলুপ চেঙ্গিস খানের কথা যতই পড়েছি ততই অবাক হয়েছি। তার কোনো মহৎ গুণের কথা কোথাও পাইনি। তবু নৃশংস সাম্রাজ্যবাদী একজন যোদ্ধা হিসেবে তিনি ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তার সম্বন্ধে আরও কিছু জানতে ইচ্ছে করে।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, আপনি যথার্থই ইতিহাসপ্রেমী।
সামভোতা বিনয়ে প্রণাম করে বললেন, আমার আর একটি কৌতূহল আছে। মমির অনুসন্ধান করা। মমিগুলি সম্বন্ধে ভালো করে জানা। তিন হাজার-চার হাজার বছরের পুরনো মমি–আমাকে বিহ্বল করে দেয়।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, আজ পর্যন্ত মিশরে প্রায় একশোটি মমি আবিষ্কৃত হয়েছে—
মার্জনা করবেন, সামভোতা বললেন, সংখ্যাটি বোধহয় আশির বেশি নয়।
তাই না হয় হল। কিন্তু ঐ আশিটি মমি পরীক্ষা করা কি সম্ভব? আর কী বা জানবেন?
সামভোতা বিনীতভাবে বললেন, সম্প্রতি মাত্র আঠারো বছর বয়স্ক রাজা তুতেনখামেনের মমি পরীক্ষা করে তার মৃত্যুরহস্য জানা গেছে। তার গায়ের একটা ক্ষতচিহ্ন থেকে শল্যবিা জানিয়েছেন তিনি নাকি ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তখন ক্যানসার নাম ছিল না। হয় তো অন্য নাম ছিল। এই থেকেই আমার এখন ইচ্ছে করে কলকাতার মিউজিয়ামে রক্ষিত মমি দুটোর মৃত্যুর কারণ সন্ধান করি।
সে কাজ কি সম্ভব হবে? কে আপনাকে সাহায্য করতে পারবে?
এখনও পর্যন্ত কোনো আশা দেখছি না। তবে কলকাতায় এলেই একবার করে যাই যদি কোনো ক্লু পাই।
চৈনিক বৃদ্ধটি বললেন, চেঙ্গিস খান সম্বন্ধে আপনার আগ্রহ শুনলাম। কিন্তু কতটা জানেন?
কিছুই না। টুকরো-টাকরা ইতিহাস পড়ে যেটুকু জানা যায় আর কি।
চৈনিক বৃদ্ধটি এই সময় যেন একটু অন্যমনস্ক হলেন। যেন কারও নিঃশব্দ উপস্থিতি টের পেলেন। তারপর থেমে থেমে বলতে লাগলেন, চেঙ্গিস খান দুবার বড়ো আঘাত পেয়েছিলেন। না, অস্ত্রাঘাত নয়, হৃদয়ে শোকের আঘাত। তাঁর পিতা ছিলেন আঞ্চলিক প্রধান। তাতারদের হাতে তার মৃত্যু হয়। প্রতিশোধ নেবার জন্যে তিনি তার সহ মোঙ্গলদের সব শত্রুদের নির্মমভাবে নিধন করে মোঙ্গোলিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি হন। রক্ত নিয়ে খেলার এই হল শুরু। দ্বিতীয় আঘাত পান–
হ্যাঁ, আগে বলে নিই চেঙ্গিস খানের চার পুত্র। জুচি, জানাতাই, উগেদেই আর তুলি খান। জাগাতাই-এর পুত্র, মোঙ্গল খানের বড়ো আদরের নাতি মুতুগান বালতান দুর্গের লড়াইয়ে নিহত হন। সেই খবর পেয়ে মোঙ্গল খান যাঁকে তোমরা চেঙ্গিস খান বল, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে বালতান ধ্বংস করে দেন।
সামভোতা বিনয় সহকারে বললেন, এটা আমার জানা।
খুব ভালো। একটা কথা জানো তো, যত দেশ জয় করা হবে, যত অত্যাচার করা হবে ততই শত্রু বাড়বে। মোঙ্গল খানের শত্রুদের মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে তার আত্মীয়-স্বজন, উত্তরাধিকারীরা যারা তার রক্তমাখা বিপুল সম্পত্তি গ্রাস করার জন্যে ওৎ পেতে ছিল।
তারপরই ছিল তার পুরনো শত্রু তানগুতে সম্রাট বুখান। যাকে তিনি কিছুতেই হটাতে পারেননি। উল্টে বুখানের একটি বিকলাঙ্গ ছেলে মোঙ্গল খানকে খুন করার জন্যে বারেবারে চেষ্টা করেছিল। তার একটা সুবিধে ছিল সে ছিল বেঁটে বামন। খুব সহজেই গাছের ডাল থেকে ঝুলে, কিংবা গুঁড়ি মেরে বাগিচার মধ্যে দিয়ে গিয়ে চেঙ্গিস খানের প্রাসাদের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারত। কিন্তু তবু মোঙ্গল খানের সতর্ক সশস্ত্র প্রহরীদের জন্যে খুন করবার সুযোগ পায়নি।
চেঙ্গিস খান বুর্খানের এই বামন ছেলেটাকে ধরবার অনেকরকম ফাঁদ পেতেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারই সে তার ছোটখাটো দেহ নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। তার নাম ছিল থিবস্–
থিবস! চমকে উঠলাম আমরা। নামটা যেন জিগমের মুখে শোনা!
চেঙ্গিস খানকে হত্যা করার জন্যে থিস্ গোপনে ষড়যন্ত্রীদের নিয়ে একটি দল করেছিল। তারা তাকে পালাবার সময়ে সাহায্য করত। একবার থিবস্ পালাতে গিয়ে পাবলিকের হাতে ধরা পড়ল। যে পাবলিকের হয়ে থিবস্ অত্যাচারী সম্রাটকে খুন করার ব্রত নিয়েছিল, তারা মোটা পুরস্কারের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করে থিবসকে সোজা তুলে দিল চেঙ্গিস খানের হাতে। পাবলিকের এই বিশ্বাসঘাতকতায় সে রাগে দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল। চেঙ্গিস খান নিজে হাতে তাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেন।
তারপর থেকে…..সব মানুষই থিবসের ক্রুদ্ধ আত্মার শিকার হয়ে পড়ল।
হঠাৎ এই সময়ে একটা দমকা হাওয়া ঘরের দরজা-জানলা কাঁপিয়ে দিল। বাতিগুলো নিভে গেল। হোটেলে আর যারা ছিল ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। শুধু শান্ত হয়ে বসে রইলেন চৈনিক বৃদ্ধটি।
একটু পরেই সব শান্ত হল। আলো জ্বালা হল।
সামভোতা জিগ্যেস করলেন, এটা কী হল?
চৈনিক বৃদ্ধটি এবার হাসলেন না। শুধু বললেন, ও যে এখানেও এসে পড়েছে, তা জানান দিল।
কে?
থিবস্।
থিবস!
হ্যাঁ।
এখানেও!
মানুষমাত্রই ওর শত্রু। সবাইকে নিধন করতে চায়। বিশেষ করে কোনো ক্ষতি না করেও আমি তার শত্রু।
কেন?
এই যে ওর কথা আমি তোমাদের কাছে বলে দিলাম। যাই হোক, আজ রাতটা সাবধানে থাকতে হবে।
বিভাস বলল, আপনার আশ্রয়ে আমরা নিশ্চয় নিরাপদ।
বৃদ্ধ বললেন, আমরা সকলেই কিন্তু মানুষ। অতএব মৃত্যুর অধীন।
এরপর অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেল। বৃদ্ধটি আগের মতোই রাত্রের অভিজ্ঞতার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর গড়গড়ার সট্রা ঠোঁটে চেপে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগলেন। তারপর একসময়ে বললেন, তোমাদের সৌভাগ্য সব বিপদ কাটিয়ে এখানে এসে পৌঁছেছ।
আমি বললাম, সবই তো হল। কিন্তু আমাদের গাড়িটা আর ড্রাইভারের দশা কী হল কে জানে।
বৃদ্ধ বললেন, ড্রাইভারকে নিয়ে চিন্তা কোরো না। গাড়ি সারানো হয়ে গেলে নিশ্চয় প্রচণ্ড ঠান্ডায় সারা রাত তোমাদের অপেক্ষায় পাহাড়-জঙ্গলের নীচে গাড়ির মধ্যে বসে থাকবে না। সে ফিরে গেছে।
আমরা ফিরব কোন পথে?
তোমরা তো লাদাখের দিকে যাবে?
হ্যাঁ।
কাছেই। তার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
এর পর আমাদের কৌতূহল নিবৃত্তি করে চৈনিক বৃদ্ধটি চেঙ্গিস খানের জীবনের শেষ পর্বটি আমাদের জানালেন। আশ্চর্য, তার বলার ভঙ্গি, বক্তব্যের দৃঢ়তা দেখে মনে হল একশো বছরেরও ঢের বেশি বয়স্ক এই বৃদ্ধ যেন চেঙ্গিস খানের মৃত্যুসময়ে নিজে উপস্থিত ছিলেন। তিনি এই বলে শুরু করলেন, এ কথাটা সবাই জানেন যে, সিন্ধুসভ্যতার যুগে নয়, তার ঢের পরে মাত্র আটশো বছর আগেও চেঙ্গিস খান নির্বোধের মতো জরা-মৃত্যুকে এড়িয়ে যাবার জন্যে নানা উপায় খুঁজছিলেন। পাননি।
তর তরুণী পত্নী কুলান খাতুনের মৃত্যুর তিন বছর পরেই চেঙ্গিস খান বুঝতে পেরেছিলেন তারও দিন ফুরিয়ে এসেছে।
মোঙ্গল খান বুঝতে পারছেন তার অন্তিম কাল আসন্ন। শ্বেত কম্বলের শয্যায় শায়িত। মাথার নীচে কৃষ্ণসার চর্মের নরম বালিশ। একটা কালো কম্বলে তার পা ঢাকা। তার দীর্ঘ শীর্ণ দেহটিকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছিল। নাড়াচাড়া করতে পারছিলেন না। তিনি তার মাত্র কয়েকজন বিশ্বস্ত কাজের মানুষকে ডেকে পাঠালেন। তারপর নিচু গলায় কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। তার মধ্যে একটি এইরকম–
আমি মারা গেলে আমার মৃত্যুসংবাদ যেন কোনোভাবে প্রকাশ না পায়। কান্নাকাটি বা বিলাপের রোল তুলো না। শত্রুরা জানতে পারলে তারা শুধু খুশি আর উৎসাহী হবে তাই নয়, তোমাদের শোকপালনের সুযোগ নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করে বসতে পারে। আমার চিরশত্রু তানগুতের রাজা আর রাজ্যের লোকজন যখন ভেট নিয়ে দুর্গের তোরণ থেকে বের হবে তক্ষুনি তাদের ওপর আক্রমণ করবে। দ্বিধা করবে না। তাদের ধ্বংস করবে….।
তিনি আরও বললেন, আমার নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে হুঁশিয়ার থেকে। আমার সেদিনের সেই জমজমাট ভোজসভার মাত্র তিন দিন পরেই হঠাৎ আমার সুস্থ প্রিয়তমা পত্নী কুলানের মৃত্যু হল। সে মৃত্যুর কারণ আর কেউ না জানলেও আমি অনুমান করতে পারি। তাকে হত্যা করেছিল আমারই নিকটতম আত্মীয়জন। প্রমাণ পাইনি। তাই তাদের প্রাণদণ্ড দিতে পারিনি।
তারপরই হঠাৎ সভয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করে বলে উঠলেন, সেই গলাকাটা বামনটা আমার চারদিকে ঘুরঘুর করছে কেন? ওকে তাড়িয়ে দাও। আমি সহ্য করতে পারছি না।
বলতে বলতে চেঙ্গিস খানের মুখ বিকৃত হল। ডান চোখ দীপ্তি হারিয়ে ঘোলাটে হয়ে গেছে। তিনি বিছানায় পড়ে গেলেন। তারপর সব শেষ।
চেঙ্গিস খান অনেক দিন আগে থেকেই একখণ্ড ভারী কাঠের খোল বানিয়ে রেখেছিলেন। ভেতরে সোনার পাত মোড়া একটা শবাধার। সেটা গোপনে তার কাছেই থাকত যাতে হঠাৎ মৃত্যু হলে লোকজানাজানি হবার আগেই সেই শবাধারে তার মৃতদেহটি ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।
আজ সেটা কাজে লাগল। গভীর রাত্রে সম্রাটের ছেলেরা শবাধারটি ঘরের মাঝখানে এনে রাখল। সামরিক বর্ম গায়ে পরিয়ে যোদ্ধার বেশে তাঁর মৃতদেহটি সযত্নে শবাধারে রাখা হল।
বুকের ওপর ভাঁজ করা দুটো হাত মুঠো করে ধরিয়ে দেওয়া হল তার কারুকার্য করা নিজস্ব তরোয়ালটি। মাথায় আটকানো ইস্পাতের কালো শিরস্ত্রাণ তার বোজানো চোখ আর মুখের ওপর একটা বিশ্রী ছায়া ফেলেছে। শবাধারে তার দুপাশে রাখা হল তীর-ধনুক, ছুরি, আগুন জ্বালাবার চকমকি পাথর আর সোনার পানপাত্র। চেঙ্গিস খানের আদেশমতো সেনা নায়করা তাঁর মৃত্যুর খবর গোপন রাখল। তানগুতরা যখন শহরের ফটক থেকে বেরিয়ে এসে চেঙ্গিস খানের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে সন্ধি প্রার্থনা করল তখন চেঙ্গিস খানের সেনা-নায়করা তারই নির্দেশমতো অতর্কিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সকলকে হত্যা করল। তারপর একটি শত্রুরও চিহ্ন না রেখে চেঙ্গিস খানের শবাধার কম্বলে জড়িয়ে বারোটি ষাঁড়েটানা দু চাকার গাড়িতে চাপিয়ে নির্দিষ্ট গোপন জায়গার দিকে এগিয়ে চলল। পাছে কেউ মোঙ্গল খানের শবদেহবাহী শকট যাচ্ছে বলে সন্দেহ করে তাই দুপাশের কী মানুষ কী জন্তু-জানোয়ার যে কেউ চোখে পড়েছিল তাদের সকলকেই তারা হত্যা করেছিল।
এক সময়ে তিনি বুরখান খালদুনের পাহাড়ে শিকার করতে গিয়েছিলেন। পাহাড়ের ঢালুতে নির্জন জায়গায় একটা আকাশে ছোঁওয়া উঁচু দেবদারু গাছের নীচে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই শান্ত নির্জন বনভূমি আর দেবদারু গাছটি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। সঙ্গের বিশ্বস্ত লোকদের তিনি বলেছিলেন, একান্তই যদি মরতে হয় তাহলে এই গাছটার নীচেই আমাকে চিরশান্তিতে থাকতে দিও। হ্যাঁ, গাছটা চিনে রেখো।
চেঙ্গিসের সেনানায়করা জঙ্গলের মধ্যে সেই দেবদারু গাছটি খুঁজে বের করে সেখানকার মাটির নীচে অনেক গভীরে তাদের প্রিয় খানের কফিনটা নামিয়ে দিল। তারপর মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর এমনভাবে বুনো গাছ বসিয়ে দিল যে, কেউ যেন বুঝতে না পারে এখানে এক বিরাট পুরুষের দেহ রক্ষিত আছে।
বৃদ্ধ চৈনিক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটির মুখে সব কথা শুনে আমরা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম, রাত যতই বাড়ছিল, বৃদ্ধটি ততই বাসি ফুলের মতো ম্লান হয়ে পড়ছিলেন। অথচ তিনি নিয়মিত রাত জেগে বসে থাকতেন। ঘুম আসত না। আর আজ এখন তো সবে রাত আটটা।
বিনীতভাবে সামভোতা বললেন, সেই কবরস্থানে লোকে যায়? সেখানে নিশ্চয় নাম লেখার পাথর গাঁথা আছে বাঁধানো সমাধির ওপরে?
কথা বলতেও বোধহয় কষ্ট হচ্ছে বৃদ্ধর। তিনি শুধু মাথা নাড়লেন। সে সমাধিস্থান আর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাঁধানো তো নয়ই, বুনো গাছপাতার আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে। এমনটাই তিনি চেয়েছিলেন।
এইটুকুই বলে বৃদ্ধ হাঁপাতে লাগলেন। তারপর নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলে তিনি বললেন, তা ছাড়া সেখানে পাহারা দিচ্ছে বেশ কিছু ভয়ংকর অশরীরী প্রেতাত্মা। ওখানে কেউ গেলে মৃত্যু নিশ্চিত। ছাগল-গোরুও ওখানে ঘাস খেতে যায় না।
সামভোতা বললেন, যে রাস্তা দিয়ে খানের শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই রাস্তাটা ঠিক কোথায় জানি না। তবু দেখবার সাধ ছিল।
বৃদ্ধ হাসবার চেষ্টা করে বললেন, কাল রাত্রে অজ্ঞাতে তোমরা ঐ পথ দিয়েই এসেছিলে।
কথা শেষ করেই তিনি সবাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে শুতে চলে গেলেন। বলে গেলেন, আজ রাতটা সাবধানে থেকো। ও এখানেই ঘুরছে। কারও ক্ষতি করবেই।
.
খুব ক্লান্ত ছিলাম। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত। একটা মোটামুটি ভালো হোটেল। বড়ো একটা ঘরেই তিনটে বেড পেয়েছিলাম। চৈনিক বৃদ্ধটি বারে বারে সাবধান করায় একটু যে ভয় করছিল না তা নয়। তবে যেহেতু ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধটি এখানেই আছেন সেইজন্যে খুব ভয় পাইনি। তা ছাড়া অ্যাটাচড বাথরুম। বাইরে বেরোবার দরকার হবে না।
বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম।
অকাতরেই ঘুমোচ্ছিলাম। তারপরে অনেক রাত্রে মাথার দিকের বন্ধ জানলার বাইরে কেমন একটা চাপা শব্দ। শব্দটা সাপের গর্জনের মতো। জানলায় দুবার ঠক্ঠক্ করে শব্দ হল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম, কে? উত্তর পাওয়া গেল না। শুধু হোটেলের কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা গাছের ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ। তার পরেই এমন কিছু ইঙ্গিত পেলাম যা বোঝাতে পারব না, কিন্তু নিজে বুঝলাম–যে এসেছিল সে কাজ শেষ করে চলে গেল।
কাল রাত্রেই ঠিক করা হয়েছিল আজই রওনা হব। হোটেলের বয় ট্রেতে করে চা আর টোস্ট আমাদের তিনজনকে দিয়ে গেল নিঃশব্দে।
এখানে দেখছি প্রায় সবাই কম কথা বলে।
ব্রেকফাস্ট শেষ হতেই একজন ইউনিফর্মপরা কর্মচারী এসে জানাল, আপনাদের লাদাখে পৌঁছে দেবার জন্যে গাড়ি এসে গেছে।
বাবাঃ! এ যে ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ!
গাড়ির ব্যবস্থা করতে কে বললেন?
থমথমে মুখে কর্মচারীটি চোখ বুজিয়ে হাত জোড় করে বলল, কাল রাত্তিরেই তিনি আদেশ দিয়েছিলেন।
ব্যস্! আর কিছু বলার নেই।
পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা বেরিয়ে এলাম।
কিন্তু আমাদের আর একজন? পেশেন্ট–
তিনি আগেই গাড়িতে উঠে পড়েছেন। বলল কর্মচারীটি। তাকে যেন খুব ব্যস্ত মনে হল। আমাদের জন্যে সময় নষ্ট করতে চাইছিল না। মানে মানে বিদেয় করে দিতে পারলেই যেন বাঁচে।
সামভোতা বললে, যাবার আগে একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
এ কথায় কর্মচারীটিকে বিব্রত লাগল। ইতস্তত করে বলল, দেখা করবেনই? তবে আসুন।
গত রাত্রে তাঁর সেই ঘর নয়। শোবার ঘর দেখলাম লোকে ভর্তি। সবাই মাটিতে বসে রয়েছে ধ্যানে বসার মতো। নিঃশব্দে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। বিছানায় শুয়ে যে মানুষটি, ফুলের মালার অন্তরালে তাঁর সর্বাঙ্গ ঢাকা পড়ে গেছে।
কী ব্যাপার?
কর্মচারীটি বিমর্ষ বেদনায় শুধু বলল–কাল রাত্রে হঠাৎই উনি দেহ রাখলেন। রাত তিনটের আগে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি।
ওঁকে শেষ প্রণাম জানিয়ে আমরা গাড়িতে এসে উঠলাম। কাল রাত আটটার পর থেকেই তার শরীর খারাপ করছিল। কিন্তু এমন কী হল যে রাতটুকুও কাটল না?
.
[চেঙ্গিস খানের জীবনের অনেক ঘটনা জেনেছি ভাসিলি ইয়ান রচিত চেঙ্গিস খান উপন্যাস থেকে।]
[শারদীয়া ১৪১২]
কালো মুখ সাদা চামড়া
বগলাবাবুর আবির্ভাব
এখানে এসে পর্যন্ত গত কয়েক দিনের মধ্যে এমন দুটো জিনিস চোখে পড়ল যা খুব আশ্চর্যজনক বা ভয়ঙ্কর কিছু না হলেও অস্বাভাবিক।
যে জায়গাটায় আমরা দুজন রয়েছি সেটা যে নির্জন হবে এটা তো জানা কথাই। কারণ নির্জন জেনেই আমরা এখানে এসেছি।
পাঁচিলঘেরা অল্প খানিকটা জায়গায় দুখানা ঘর। কাঠের গেটের বাইরেই মাঠ। মাঠের দক্ষিণে কিছু গাছ-গাছালি।
বন্ধু বাসুদেবকে একটু চমকে দেবার জন্য বললাম, পরশু দিন বিকেল বেলা একটা বিরাট শেয়াল দেখলাম হে! ধীরে সুস্থে গেল।
শেয়াল!
হ্যাঁ।
কোন দিকে গেল?
উ গাছ-গাছালির দিকে।
কথাটা শুনে বাসুদেব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বললাম, অবাক হচ্ছ কেন?
বাসুদেব বলল, না, এখন তো শেয়াল বড় একটা দেখা যায় না। এখানে হঠাৎ এল কোথা থেকে? তাও আবার বলছ ‘বিরাট’ শেয়াল।
বললাম, শেয়াল এখন দেখা যায় না ঠিক। তা বলে একটিও শেয়াল দেখা যাবে না এমন কথা জোর করে কেউ বলতে পারে না।
বাসুদেব চুপ করে রইল। তারপর যেন গভীর চিন্তা করে বলল, তা হয় তো ঠিক। কিন্তু ঐ যে বলছ ‘বিরাট’ শেয়াল। খটকা ওখানেই।
বললাম, হ্যাঁ, তা বেশ বড়সড়। অত বড় শেয়াল আমি দেখিনি।
বাসুদেব বলল, ওটা শেয়াল বটে তো? ঠিক দেখেছ?
হাজার বার ঠিক দেখেছি। তখন সবে বিকেল। দিব্যি রোদ। কাজেই শেয়াল চিনতে আমার ভুল হয়নি।
বাসুদেব চুপ করে রইল।
সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। তালগাছের মাথার উপর দিয়ে অন্ধকার হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। মাঠের ওপর, উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দিলাম।
কী ব্যাপার বলো তো? একটা শেয়াল নিয়ে এত কী গবেষণা করছ?
বাসুদেব চেয়ারে গা ছড়িয়ে বলল, তা গবেষণারই ব্যাপার বটে। দ্যাখো বিকাশ, শেয়ালটার কথা শুনে পর্যন্ত আমার মনে নানা প্রশ্ন উঠছে।
যেমন?
যেমন ধরো, অত বড় শেয়ালের কথা কখনও শুনিনি। দ্বিতীয়ত, শেয়াল সাধারণত সন্ধেবেলায় বেরোয়। আর শেষ প্রশ্ন হচ্ছে–শেয়াল কখনও ধীরে সুস্থে, হেলতে দুলতে যায় না। যায় দৌড়ে।
বললাম, বেশ তাই না হয় হল–তাতে কী? তোমার সন্দেহ হচ্ছে আমি সত্যিই শেয়াল দেখেছি কিনা?
বাসুদেব বলল, প্রথমে সেরকম সন্দেহ হয়নি। তারপর তুমি যখন জোর দিয়ে বললে, ওটা শেয়ালই, অন্য কিছু নয়, তখন মেনে নিলাম ওটা শেয়ালই। কিন্তু শেয়ালটা কোথা থেকে এসে কোথায় গেল তা তো বলতে পারছ না।
বললাম, ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। হঠাৎ দেখলাম একটা শেয়াল যাচ্ছে। সেটা গিয়ে ঢুকল ঐ ঝোপ-জঙ্গলে। ব্যস্। আমার কৌতূহলেরও শেষ।
ঠিক আছে বাবা। এখন বলো তো দ্বিতীয় অস্বাভাবিক জিনিসটা কী?
সেটা শুনে তুমি হাসবে। তবু বলছি গতকাল ঠিক ঐ সময়েই অর্থাৎ নির্জন দুপুরে দেখলাম একটা লোককে
কী হল? থামলে কেন?
ইশারায় চুপ করতে বলে দরজার দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে কেউ আসছে।
এই সন্ধেবেলায় অচেনা অজানা জায়গায় কে আবার আসবে?
চাপা গলায় বললাম, চুপ। ঐ যে–এসে গেছে।
কেন যে অমন ভয়ে ভয়ে চুপ করতে বললাম তা নিজেও জানি না। কেউ না কেউ তো আসতেই পারে! তখনই দরজার বাইরে অপরিচিত গলা পাওয়া গেল, এই যে বাবুমশাইরা, খুব ব্যস্ত নাকি?
কে? একটু রাগ-রাগ গলায় জিগ্যেস করল বাসুদেব।
যদি অনুমতি করেন তো ভেতরে ঢুকি।
এবার আমিই তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানালাম, অনুগ্রহ করে ভেতরে এসে বসুন।
বাঁ হাতে লণ্ঠন, ডান হাতে মোটা লাঠি, হাঁটু পর্যন্ত ভোলা ধুতি, গায়ে চাদর জড়িয়ে যে লোকটি ঢুকলেন তার বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। গায়ের চাদরটা দিয়ে এমন ভাবে মাথা-মুখ ঢেকে রেখেছেন যেন ভদ্রলোক নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন।
উনি হাসলেন একটু। গোল কালোমুখে সাদা দাঁতগুলো এমনভাবে প্রকট হল যে রীতিমতো ভয় ধরিয়ে দিল। মনে হল, কোনো অশুভ ঘটনার আগাম জানান দিতেই তিনি এসেছেন।
আমার নাম বগলা মজুমদার। এ অধমকে আপনারা চিনবেন না। তবে কাছাকাছি তিন চারটে গ্রামের লোক আমাকে মান্যি করে। যদি জিগ্যেস করেন কী এমন তালেবর মানুষ আপনি যে এত লোকে মান্যি করে, তাহলে তার সঠিক কারণ বলতে পারব না। এইটুকু বলতে পারি আমাদের তিন পুরুষের বাস এই গ্রামে। পাশাপাশি পাঁচখানা গ্রামের জমিদারি স্বত্ব কিনেছিলেন আমার পিতামহ করালিচরণ মজুমদার। দুর্ধর্ষ জমিদার ছিলেন মশাই। তার দাপটে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খেত। তারপর ইংরেজ আমলে আমার পিতাঠাকুর নীলকর সাহেবদের যে সাহায্য করেছিলেন তাতে ইংরেজরা খুশি হয়ে–ঐ দেখুন ভাই, আমিই বকে যাচ্ছি। এলাম আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করতে আমার ঠিক করে দেওয়া বাসাটা কেমন লাগছে?
বললাম, ভালোই।
কোনো অসুবিধে নেই তো?
নাঃ, দুজন তো ঝাড়া হাত-পা মানুষ। তা ছাড়া সপ্তাহ দু-একের তো মামলা।
বগলাবাবু সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বললেন, তা আপনারা তো কলকাতা থেকেই আসছেন?
বললাম, হ্যাঁ।
বাঃ, খুব ভালো। বসিরহাটের গগন কুণ্ডু যখন এখানে একটা ছোটো বাসা ভাড়ার জন্যে বললে তখন খুব অবাক হয়েছিলাম। কলকাতা থেকে এখানে কেউ বাসা ভাড়া করে থাকতে আসে নাকি? তাও মাত্র দিন পনেরোর জন্যে। গগনের সঙ্গে একসময়ে বারাসতের ইস্কুলে পড়তাম। ইস্কুল ছাড়ার পরও যোগাযযাগটা আছে। কী করে আছে? আসলে কি জানেন, বাবুমশাই, অন্তরের টান। ইস্কুলে এই যাদের সঙ্গে অনেক দিন ধরে ওঠাবসা–তাতে কোন স্বার্থের ভেজাল থাকে না। সে সম্পর্কটা একেবারে খাঁটি সোনা। তাই
বুঝলাম বগলাবাবু মানুষটি কথা শুরু করলে থামতে চান না। আর সেইজন্যে বাসুদেবও বেশ রেগে উঠছিল। তাই তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, গগনদা আমাদেরও অনেক দিনের চেনা। ওঁকে যখন কথায় কথায় এখানে ক’দিনের জন্যে বেড়াতে আসার প্ল্যানের কথা বললাম তখন উনিই বোধহয় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করে দিলেন।
এইটুকু বলতেই বগলাবাবু তৎক্ষণাৎ অল্প জলে ল্যাটা মাছ চেপে ধরার মতো আমার ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, ঠিক ঐ কথাটাই জানার জন্যে আমার আসা। বলে হেঁ হেঁ করে হাসতে লাগলেন।
কোন কথাটা বলুন তো।
ঐ যে বললেন এখানে আসার প্ল্যান। এইরকম গোভাগাড়ে জায়গায় আপনাদের মতো শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন যুবকদের আসার আসল উদ্দেশ্যটা কী?
বগলাবাবুর একথায় বাসুদেব রেগে যাচ্ছিল, তাকে কোনরকমে সামলে-সুমলে হেসে বললাম, এই সামান্য কথাটা জানবার জন্যে রাত্তিরেই চলে এলেন! আশ্চর্য!
বগলাবাবুর মুখটা যেন ঝুলে গেল। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ওটা বন্ধ করে দিলেই তো হয়। বাসুদেব বলল, কেন অসুবিধে কী, বেশ ফুরফুরে হাওয়া আসছে
ফুরফুরে হাওয়া বেরিয়ে যাবে। হঠাৎ যেন ভদ্রলোকটির ভদ্রতার মুখোশ খসে পড়ল। খেঁকিয়ে উঠলেন, জানেন না তো কোথায় এসেছেন।
অবাক হবার ভান করে বললাম, জায়গাটা খারাপ নাকি?
আমি কিছু বলব না। দুদিন থাকুন। তাহলেই বুঝবেন।
দিনে না এসে সন্ধেরাতে আসার কারণটা বগলাবাবু যেন এড়িয়ে যেতে চাইলেন। উল্টে চাপ দিলেন, এবার বলুন তো হঠাৎ এখানে আসার আসল কারণটা কী? বলে, যেন কিছুই নয় এমনি ভাব করে হাসি-হাসি মুখে আমাদের দিকে তাকালেন।
বললাম, এটা জানা কি আপনার একান্ত দরকার?
বগলাবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, দরকারটা ঠিক আমার একার নয়। এ অঞ্চলে কাছেপিঠে আরও যারা আছে তারাও জানতে চায়। তারাও আপনাদের দেখে অবাক হয়েছে। কৌতূহলী হয়েছে। বুঝতেই পারছেন একসময়ে আমার পূর্বপুরুষেরা জমিদার ছিলেন। প্রজাদের সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ তাদেরই দেখতে হত। এখন জমিদারও নেই, জমিদারিও নেই। তবু তাঁদের বংশধর হিসেবে আমি রয়েছি যখন
হ্যাঁ, তখন সব দায়িত্ব আপনার।
একটু থেমে বাসুদেব বললে, আচ্ছা, আমাদের দেখলে কি হিমালয় আর বঙ্গোপসাগরের মধ্যিখানের পশ্চিমবঙ্গ নামক একটি জায়গার মানুষ ছাড়া ভিন্ন গ্রহের কোনো জীব বলে মনে হয়?
বগলাবাবু জিব কেটে বললেন, আরে, নানা। ওসব কিছু নয়। আসলে আপনাদের মতো মানুষজন তো বড় একটা এ পোড়া দেশে পা দেয় না। তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই আপনারা এখানে এসেছেন। সেই উদ্দেশ্যটা সম্বন্ধে আমাদের যৎকিঞ্চিৎ কৌতূহল আর কি।
উদ্দেশ্য খুব সাদা সরল। আমরা দুই বন্ধুতে পশ্চিম বাংলার ছোটো ছোটো অখ্যাত গ্রামগুলো সমীক্ষা করতে এসেছি।
শুনে বগলাবাবু কয়েক মুহূর্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মুখ টিপে হেসে মাথাটা এদিক থেকে ওদিকে বাড়িয়ে বললেন, উ-হুঁ। ওসব সমীক্ষা-টমীক্ষা করতে এলে খাতা পত্তর, ম্যাপ, স্কেল, কম্পাস থাকে। আমি মুখ হলেও খুব বোকা নই।
মিথ্যে ধরা পড়ার জ্বালায় বাসুদেব একটু তেতে উঠে বলল, এতই যদি বুদ্ধিমান তাহলে আপনিই আন্দাজ করুন কোন মহৎ কার্যসিদ্ধির জন্যে কলকাতা থেকে এতদূরে মাত্র পনেরো দিনের জন্য ঘর ভাড়া করে রয়েছি!
বগলাবাবুর কুচকুচে কালো গোল মুখখানি আলোকিত করে শ্বেতশুভ্র দাঁতের মধ্যে দিয়ে একটুখানি হাসি দেখা দিল। মাথা দুলিয়ে বললেন, তাহলে আমিই বলব?
হ্যাঁ, বলুন।
আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবেন না মহাশয়রা। বলব?
হ্যাঁ, চটপট বলে ফেলুন।
আপনারা পুলিশের লোক।
বটে-বটে-বটে! দারুণ বলেছেন তো! কদিন এখানে রয়েছি কেউ আমাদের চিনতে পারেনি। আর আপনি কিন্তু কী উদ্দেশ্যে পুলিশযুগল এখানে এলেন বলতে পারেন কি? বাসুদেব যেন রুখে উঠল।
নিশ্চয় পারি–নিশ্চয় পারি। আর সে বিষয়ে আপনাদের সাহায্য করতেই আসা।
তা হলে বলুন। আমরা শুনি।
বলছি। তবে আপনাদের আরও আগে আসা উচিত ছিল। কেননা ও তো এরই মধ্যে কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। দু-দুটো আদিবাসী, তারপর
এবার আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। বললাম, কী বলতে চাইছেন একটু স্পষ্ট করে বলুন।
বগলাবাবু বললেন, ঐ দেখুন, আপনারাও আবার লুকোচুরি খেলা শুরু করলেন। আচ্ছা, আপনারা যে ক’দিন এখানে রয়েছেন তার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাননি?
অস্বাভাবিক। যেমন–?
যেমন রাত্তির বেলা ঘরের ঠিক বাইরে কারও নিঃশব্দে চলাফেরার শব্দ, কিংবা কোনো অজানা পশুর ডাক–
হঠাৎ বগলাবাবু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বললেন, ক’টা বাজল, স্যার?
পৌনে সাতটা।
ওরে বাবা! এবার আমাকে উঠতেই হবে। আমার হয়েছে সব দিক দিয়ে জ্বালা। দিনের বেলা এলে সাহেব ব্যাটা কিংবা ওর শাগরেদ হয়তো দেখে ফেলবে। আর রাত হলে কী একটা জানোয়ারের হাড়-হিম-করা ডাক।
হাড়-হিম করা ডাক! জন্তুটাকে আপনি দেখেছেন?
রক্ষে করুন, মশাইরা। আপনাদের বাবা-মায়ের আশীর্বাদে যেন কোনোদিন তেনার দর্শন পেতে না হয়।
পেলে কী হবে? বাসুদেব জিগ্যেস করল।
কী হবে? ঐ জগা মোড়লের দশা হবে। যে কেসের তদন্ত করতে আপনারা এসেছেন– বেচারি সন্ধেরাতের একটু পরে বাড়ির কাছেই খামার ঘরে কিছু একটা শব্দ শুনে লণ্ঠন হাতে দেখতে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের পথ মশাই, কিন্তু সারা রাত্রেও ফিরল না।..আচ্ছা, চলি।
দাঁড়ান-দাঁড়ান। তারপর তার কী হল বলে যান।
সবই তো জানেন। তবে না জানার ভান করছেন কেন? পরের দিন বাঁওড়ের জলে তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেল।
কে খুন করল তাকে?
সে তো আপনারাই খুঁজে বের করবেন। তবে মানুষ নয়। আমি চলি মশাই।
মানুষ নয়! তবে? আর পাঁচ মিনিট। ঐ যে বাঁওড় না কী বললেন ওটা কী? কোথায়?
বাঁওড় জানেন না? তা জানবেন কী করে? আপনারা যে কলকাত্তাই মানুষ। বাঁওড় হচ্ছে বড় দীঘির মতো। তবে অল্প জল, নোংরা। ছিরিছাঁদ নেই।
বলেই বগলাবাবু লণ্ঠনটা হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন।
আর একটা কথা। সাহেব’ না কী বলছিলেন?
ঐ দেখুন, আবার লুকোচুরি! ঐ মুখপোড়া সাহেবটার ওপর লক্ষ রাখার জন্যেই যে এসেছেন তা কি আমি জানিনে? অথচ দেখাচ্ছেন যেন কিচ্ছুটি জানেন না। তবে ওকে ধরতে পারবেন কি? দেখুন চেষ্টা করে।
বলতে বলতে মজুমদার মশাই লণ্ঠন হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়েই অন্ধকারে ঝাঁপ দিলেন।
আসবেন আবার।
বগলাবাবু কথা বললেন না। হাতের ইশারায় শুধু জানিয়ে দিলেন আসবেন।
দরজা বন্ধ করে আমরা জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম। মাঠের মধ্যে দিয়ে একটা আলো দুলতে দুলতে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
বড় অদ্ভুত লোক।
বাসুদেব বলল, হ্যাঁ।
.
মুখপোড়া সাহেব
এখানে এসেই একটি কাজের লোক পেয়ে গিয়েছিলাম। বড় গরিব। এ অঞ্চলের মানুষ। তাই মাইনে নিয়ে দরকষাকষি করেনি। দু’ বেলা পেট ভরে খেতে পাবে এতেই খুশি। শুধু বলেছিল, মাত্র পনেরো দিন?
হ্যাঁ, হরিপদ। আমাদের এখানে পনেরো দিনের জন্যেই আসা। তুমি অবশ্য পুরো মাসেরই মাইনে পাবে।
হরিপদর দু’চোখ জ্বলজ্বল করে উঠেছিল। যাক, গোটা এক মাসের জন্যে খাবার ভাবনা তাকে ভাবতে হবে না।
হরিপদর কাজ অল্প সময়ের জন্যে। সকালে এসে জলখাবার করে দিয়ে দুপুরের রান্না সেরে ফেলে। তারপর ও এক মালসা ভাত নিয়ে দু’মাইল দূরে বাড়ি চলে যায়। বিকেলে আসতে চাইছিল না। বলেছিল যে, না হয় টাকা কম দেবেন। কেন আসতে চায়নি তা অবশ্য স্পষ্ট করে বলেনি। আমরাও চাপ দিইনি। শেষ পর্যন্ত রফা হয় তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে চলে যাবে। তাতেও সন্ধে উৎরে যায়।
আজ ঢের আগেই অর্থাৎ বগলাবাবু থাকতেই ও চলে গিয়েছিল। যাবার জন্যে যেন তর সয় না। সোজা কথা নয়, পাক্কা দু’মাইল রাস্তা হাঁটতে হবে মাঠ, পুকুর পার হয়ে।
খাওয়া-দাওয়া করে মশারি টাঙিয়ে ভালো করে চারিদিক গুঁজে, মাথার কাছে দুজনে দুটো জোরালো টর্চ নিয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু তখনই ঘুম এল না।
লোকটা যেন কীরকম কীরকম।
কার কথা বলছ? বগলাবাবুর?
বললাম, ঠিক তাই। কী মতলবে এসেছিলেন তা বোঝা গেল না।
বাসুদেব মশা মারতে গিয়ে নিজের গালেই একটা চড় মেরে বলল, কিন্তু ভয়টা যে কীসের সেটাই বুঝলাম না। উনি তো দিনের বেলায় এদিকে আসতে ভয় পান পাছে কোন এক মুখপোড়া সাহেব দেখে ফেলে। আর, একটু রাত হলে কোন এক অজানা পশুর ভয়ঙ্কর নাকটা যেনয়ে শুয়ে পর ভালো করে চতে হবে ডাক!
তার ওপর আবার জগা মোড়লের ক্ষতবিক্ষত দেহ!
হ্যাঁ, আরও আছে। জিগ্যেস করেছিলেন, আমরা এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু দেখেছি কিনা বা বাড়ির ঠিক বাইরে কারও পায়ের শব্দ ইত্যাদি শুনেছি কিনা।
বললাম, ভদ্রলোক সম্ভবত অলৌকিক কিছু ব্যাপার দাঁড় করাতে চাইছেন।
বাসুদেব চুপ করে রইল। তারপর বলল, আচ্ছা, তুমি বলছিলে দুটো অস্বাভাবিক জিনিস দেখেছিলে। তার মধ্যে একটা অতিকায় শেয়াল। অন্যটা এখনও বলনি।
বললাম, হ্যাঁ, সেটা একটা লোক।
লোক!
কীরকম?
বললাম, দু’ তিন দিন আগে। বেলা তখন আড়াইটে। দুপুরে ঘুমোবার অভ্যেস নেই। তাই ওদিকের রকে চেয়ারে বসে নিস্তব্ধ পল্লী-প্রকৃতি উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ দেখি একটা মোটাসোটা লোক। খুব ফর্সা রঙ। সে যে কোথা থেকে এল বুঝতে পারলাম না। মাঠটার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে গুটিগুটি।
গুটিগুটি হাঁটছিল কেন?
তা কী করে বলব ভাই! কোমরে ব্যথাট্যথা হলে ওরকম হাঁটে। কিন্তু কেন যে বারে বারে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের বাড়িটা লক্ষ করছিল তা বুঝতে পারছিলাম না। তা ঘাড় ঘোরানোটাও অস্বাভাবিক। কোনো মানুষ তার ঘাড়টা এত দূর পর্যন্ত ঘোরাতে পারে না।
আচ্ছা! বাসুদেব অবাক হল। তারপর? কোন দিকে গেল?
বললাম, ঐ জঙ্গলের মধ্যে। যেখানে শেয়ালটা ঢুকে গিয়েছিল।
বাসুদেব একটু ভেবে বলল, লোকটার অতখানি ঘাড় ঘোরানোটা সত্যি একটু অস্বাভাবিক।
না বন্ধু, আরও আশ্চর্যের ব্যাপার আছে। লোকটার পরনে একটা আন্ডারপ্যান্ট ছাড়া গায়ে আর কিছু ছিল না। একদম খালি গা। গায়ে অস্বাভাবিক লোম। অথচ ধবধবে ফর্সা রঙ। ঘাড় পর্যন্ত কঁকড়া কটা চুল। আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে ওর মুখটা। যতবার এদিকে ঘাড় ফিরিয়েছে ততবারই দেখেছি মুখটা কালো। যেন পুড়ে গিয়েছে। অমন ফর্সা মানুষটার এমন পোড়া মুখ!
হঠাৎ বাসুদেব উৎসাহে উত্তেজনায় উঠে বসল বিকাশ–বিকাশ, বুঝতে পেরেছ কি?
আমি অবাক হয়ে তাকালাম, কী?
বগলা মজুমদার খুব মিথ্যে বলেননি। তাঁর সেই মুখপোড়া সাহেবকেই তোমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বললাম, তা হলে তো লোকটার ওপর নজর রাখতে হবে।
বাসুদেব বলল, কিন্তু লোকটাকে পাবে কোথায়? মাত্র তো কয়েক মিনিটের জন্যে দেখতে পেয়েছিলে। কোথা থেকে বা কোন দিক থেকে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল তাও তো বোঝা যাচ্ছে না। আর এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ভয় পাওয়ার ঘটনা ঘটেনি যার জন্যে আমাদের নড়েচড়ে বসতে হবে।
বললাম, তা ঠিকই, বগলাবাবুর মুখ থেকেই যেটুকু শোনা। আর ওঁর কথা সত্য হলে আশা করা যায় খুব শিগগির কিছু একটা ঘটবে।
একটু থেমে বললাম, মনে হচ্ছে বেলেঘাটার তিনু ঘোষ যা বলেছিল তার কিছুটা সত্য।
বাসুদেব বলল, তিনু ঘোষের কথা কতটা সত্য তা যাচাই করার জন্যেই তো আমাদের এখানে আসা। শতকরা পঞ্চাশভাগ সত্য হলেও আমাদের অর্থব্যয়, আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে করব।
আমি হেসে ফেললাম।
হাসছ যে?
বগলাবাবু বেশ বলেছেন আমরা ছদ্মবেশী পুলিশ!
বাসুদেবও হেসে বললে, হাঁ, পুলিশ হলে আগে পাকড়াও করতাম বগলাকেই। লোকটাকে বোঝা গেল না। ঠিক কী উদ্দেশ্যে ভয়ে ভয়ে এখানে এসেছিলেন। শুধু কি কতকগুলো ভয়ের কথা শোনাতে?
বললাম, না। আরও কিছু ছিল। ওঁর ধারণা ঐ সাহেবটাই এখানে অশান্তি সৃষ্টি করছে। কিছু একটা ঘটাতে চাচ্ছে। অথচ তাকে নাকি ধরা কঠিন।
তাহলে জন্তুর ডাকটা কী?
সে ডাক শোনার সৌভাগ্য এখনও আমাদের হয়নি। কে জানে জগা মণ্ডলকে হয়তো সেই জন্তুটাই খতম করেছিল।
আমি একটু থমকে গেলাম। মনে পড়ল বেলেঘাটার তিনু ঘোষও সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবার আগে সন্ধ্যার পর একটা জন্তুর ডাক শুনেছিলেন। তবে সেটা অনেকটা শেয়ালের ডাকের মতো।
বাসুদেব হালকা সুরে বলল, বগলাবাবু মনে করেন পুলিশের ছদ্মবেশে আমরা কলকাতা থেকে এখানে এসেছি ঐ পোড়ারমুখো সাহেবটার ওপর নজর রাখতে। ওকে ধরে জেলে পুরতে পারলেই এখানকার অশান্তির শেষ হবে। বাসুদেব মস্ত বড় হাই তুলে বলল, যাই হোক, লোকটা আমার কাছে রহস্যময় হয়ে উঠেছেন। কোথা থেকে এসেছেন, কত দূরে বাড়ি, কী করেন, কিছুই জানা গেল না। এতই যদি ভয় তাহলে সন্ধের পর একা একা এলেন কেন? কথা বলতে বলতে উঠে পালালেনই বা কেন?
হঠাৎ বাসুদেব চুপ করে গেল। কেমন যেন সতর্ক হল।
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, আমার মুখ চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, চুপ! কিছু শুনতে পেলে?
কই না তো।
ভালো করে কান পেতে থাকো।
এতক্ষণ বেশ হালকাভাবে কথা হচ্ছিল, এখন হঠাৎ এ আবার কী? নিশ্চয় বাসুদেবের কিছু ভুল হচ্ছে। তবু কান পেতে রইলাম।
এখানে কোনদিন এত রাত পর্যন্ত জাগা হয়নি। কাজ তো নেই, তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি। তাই গভীর রাতে জায়গাটার চেহারা কীরকম হয় আজ পর্যন্ত তা দেখা হয়নি। দুজনে পাশাপাশি উৎকর্ণ হয়ে শুয়ে আছি কোনো কিছু শোনার প্রতীক্ষায়। চৌকি থেকে হাত দশেক দূরে খোলা জানলা দিয়ে বাড়ির সামনের মাঠটা দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। এটা শুক্লপক্ষ কি কৃষ্ণপক্ষ জানি না। মুমূর্ষ মানুষের ফিকে হাসির মতো ম্লান চাঁদের আলো এসে পড়েছে মাঠের ওপর। কেমন যেন রহস্যঘন ছায়া-ছায়া ভাব। দিকভ্রম হয়ে যায়। কোন দিকে সেই অতিকায় শেয়ালটা বা রহস্যময় সাহেবটা ঘাড় ঘোরাতে ঘোরাতে গিয়েছিল, বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে এই মুহূর্তে তা মালুম হচ্ছে না।
কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি নিস্তব্ধ নিশুতি রাতেরও নাকি ভাষা আছে। এটা যে কতখানি সত্য তার প্রমাণ আজ পেলাম। দূরে বনঝোপে একটানা ঝিঁঝি ডেকেই চলেছে। কোথা থেকে মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে শোঁ শোঁ শব্দ। অনেকটা ঝাউবনে বাতাস খেলা করার মতো। এ ছাড়া দূরে বাঁওড়ের ধারের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে ভয়-পাওয়া কুকুরের ডাক। আচ্ছা, কুকুর তো গৃহপালিত পশু। রাস্তাতেও দেখা যায়। তা বনে-জঙ্গলে? কী জানি।
এইসব ভাবছিলাম হঠাৎ বাসুদেব আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। চাপা গলায় বলল, ঐ শোনো।
শুনলাম।
তেমন কিছু নয়। শুধু বাড়ির ওদিকের বাইরের দেওয়াল ঘেঁষে একটা চাপা শব্দ– খস্ স্ খস্….
কেউ যেন ভারী ভারী পা দুটো ঘাসটাতে ঘাসটাতে খুব সাবধানে বাড়ির চারিদিকে ঘোরবার চেষ্টা করছে।
কে? আমাকেও চমকে দিয়ে বাসুদেব চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে শব্দটা থেমে গেল। একটু পরে মনে হল যে এসেছিল সে যেন দ্রুত চলে গেল।
শিগগির টর্চটা বলেই টর্চ নিয়ে বাসুদেব দরজার খিল খুলতে যাচ্ছিল, আমি আটকে দিলাম।
অজানা অচেনা জায়গায় দুঃসাহস দেখিয়ে লাভ নেই। কেউ যে এসেছিল এটা যেমন সত্যি তেমনি সত্যি সে আর যাই হোক সামান্য চোর-ডাকাত নয়। কারণ, কোনো মানুষের পায়ের শব্দ অমন হতে পারে না।
বাসুদেব সুবোধ বালকের মতো না বেরিয়ে বিছানায় এসে বসল। বসেই রইল থমথমে মুখে।
কী ভাবছ?
ভাবছি ব্যাপারটা কী ঘটল। কেউ যে বাড়ির কাছে ঘুরছিল তা তুমিও বুঝতে পেরেছ, আমিও। আর সে যে চোর-ডাকাত নয় তাও বোঝা গেছে। আরও প্রমাণিত হল বগলা মজুমদারও এই কথাটা বলেছিলেন। মনে আছে তো?
খুব আছে।
তাহলে কে এই গভীর রাতে এখানে বেড়াতে এসেছিল? কেনই বা এসেছিল?
পরিবেশটা হাল্কা করার জন্যে হেসে বললাম, দ্যাখো, হয়তো ঘাড়-বাঁকানো সাহেবই আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল।
বাসুদেব একরকম ধমক দিয়ে বলল, তুমি হাসছ? দ্যাখো, কলকাতায় তিনু ঘোষ যা বলেছিল তা তেমন বিশ্বাস করিনি। ওর কথায় কৌতূহলী হয়ে নিছক বেড়াতে এসেছিলাম। তারপর আবির্ভাব হল বগলা মজুমদারের। তিনি যে কী বলতে এসেছিলেন বোঝা যায়নি। শুধু খানিকটা ভয় দেখিয়ে গেলেন। আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু আজ রাত্তিরে যা শোনা গেল সেটা তো ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝাড়ার মতো উড়িয়ে দিতে পারছি না। পারছ কি?
মাথা নেড়ে বললাম, না।
এটাই এখন আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আচ্ছা, পায়ের শব্দ শুনে আগন্তুকটির উচ্চতা, ওজন আন্দাজ করতে পার?
বললাম, না ভাই, অত এক্সপার্ট নই। তবে একথা বলতে পারি সাধারণ মানুষের চেয়ে ঢের ভারী চেহারা।
যেমন শেয়ালটাকে দেখেছিলে। তাই তো?
হ্যাঁ, তাই।
বাসুদেব বলল, আর দেরি নয়। কাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।
কিন্তু এ তো গোয়েন্দাগিরি নয় যে, হত্যার সূত্র ধরে হত্যাকারীকে খুঁজবে। কীসের ওপর নির্ভর করে কাজ শুরু করবে?
বাসুদেব আমার পিঠ চাপড়ে বলল, রাত্তিরে যিনি এখানে হানা দিয়েছিলেন, যে কোন কারণেই হোক, তিনি আমাদের টার্গেট করেছেন। অতএব চিন্তা নেই, তিনি আবার আসবেন। অল্প সূত্র রেখে যাবেন। অতএব এসো বন্ধু, বাকি রাতটুকু নিশ্চিন্তে গড়িয়ে নিই।
.
পায়ের ছাপ নেই, হাতের কারসাজি
ভেবেছিলাম এরপর বাকি রাতটুকু একটা লম্বা ঘুম দিয়ে কাটিয়ে দেব। একটু বেলা পর্যন্ত ঘুমোব। কিন্তু তা হল না। ঘুম ভাঙল অন্য দিনের মতোই ভোরবেলা।
ঘুম ভাঙ্গল, কিন্তু তখনই উঠতে পারলাম না। বড্ড দুর্বল লাগল। প্রথমে মনে হয়েছিল দেরিতে শোওয়ার জন্যেই বোধহয় ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু বোঝা গেল তা নয়। মাথাটা অসম্ভব ভার হয়ে আছে। সেই সঙ্গে বুকে কেমন চাপ ধরছে। মনে হল, বাড়িটা আর আশেপাশের বাতাস যেন খুব ভারী হয়ে উঠেছে। অথচ অন্য দিন তো এমন হয় না। তাহলে?
বাসু!
বিছানায় বাসুদেবকে দেখতে না পেয়ে ডাকলাম। সাড়া নেই। আবার ডাকলাম। সাড়া নেই। আবার ডাকলাম। এবারও সাড়া নেই। গেল কোথায়?
শরীরের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে বিছানা থেকে উঠে পাশের ঘরে গেলাম। না, সেখানেও নেই।
আশ্চর্য! গেল কোথায়? অন্য দিন তো এত সকালে ওঠে না। ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
বাসু!
দূর থেকে সাড়া পেলাম, এই যে এখানে। চলে এসো।
যাক, বাসুর তাহলে কিছু হয়নি। ইট বের করা সরু পথ ধরে ওদিকের ঝোপের দিকে গেলাম। দেখি বাসুদেব মাটির ওপর ঝুঁকে পড়ে খুব মন দিয়ে কিছু পরীক্ষা করছে।
এখানে কী করছ?
কাল রাত্তিরে যিনি এখানে পায়চারি করেছিলেন তিনি কোনো চিহ্ন রেখে গেছেন কিনা দেখছি।
তাই বলে এই সক্কালবেলায়?
দেরি করলে তো চিহ্ন হারিয়ে যেতে পারে।
কিছু পেলে?
বাসুদেব মাথা নেড়ে বলল, নাঃ।
অথচ কেউ এসেছিলই, অনেকক্ষণ ছিলও। আর তার শ্রীচরণে কোনো ‘শু’ ছিল না।
তাই তো ভাবছি। শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছি যিনি এসেছিলেন তার নিশ্চয় কোনো পা ছিল না। অথচ
অথচ কী?
হাত ছিল। আর সেই হাত দিয়ে কয়েকটি প্রাণীর জীবন সংহার করেছিলেন।
চমকে উঠলাম। মানে?
ঐ ঝোপের মধ্যে দেখো।
দেখলাম। কতগুলো গলা-ছেঁড়া বাদুড় পড়ে আছে।
আরে সর্বনাশ! তাহলে রাতের আগন্তুকটি তো রীতিমতো হিংস্র জন্তু।
বাসুদেব গম্ভীরভাবে বলল, জন্তু কিনা বলতে পারি না। তবে আগন্তুকটি হিংস্র।
বললাম, তাহলে তো বগলা মজুমদারের আরও একটা কথা সত্য বলে মনে হচ্ছে।
বাসুদেব বলল, তুমি কি জগা মোড়লের কথা ভেবে বলছ?
হ্যাঁ। বাড়ির কাছে পাঁচ মিনিটের পথ খামারবাড়ি। রাত আটটার সময়ে কোনো শব্দ শুনে দেখতে গেল। আর ফিরল না। পরের দিন তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল বাঁওড়ের জলে। বগলা যদি গুল মেরে না থাকেন তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কে মারল তাকে?
বাসুদেব শান্ত গলায় বলল, বগলা মজুমদার সম্বন্ধে আমাদের আগে যাই ধারণা থাক, এখন দেখা যাচ্ছে তিনি বাজে কথা বলেননি। কিন্তু আমি অন্য কথা ভাবছি।
কী?
ধরেই নিলাম বগলা যা বলেছিল, ব্যাপারটা তাই-ই। প্রশ্ন এই, যে শব্দটা শুনে জগা মোড়ল রাত্তির বেলাতেই খামারবাড়ি ছুটেছিল সে শব্দটা কেমন? নিশ্চয়ই পা ঘষটানোর শব্দ নয়। তার চেয়ে জোরে কোনো শব্দ যা বাড়ি থেকে শোনা গিয়েছিল।
বললাম, তা তো বটেই।
শব্দটা কীসের? সে কথাটাই আমায় ভাবিয়ে তুলেছে।
বললাম, অত ভাবাভাবিতে কাজ কী? বগলাবাবু তো আবার আসবেন বলে গেছেন।
বাসুদেব হতাশার হাসি হেসে বলল, তুমি কি সেই আশায় বসে থাকবে?
বললাম, আসবেন না কেন?
আসবেন না এমন কথা বলছি না। তবে অতখানি পথ হেঁটে, বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কেন বারবার আসবেন বলো তো?
বললাম, তা বটে। তাহলে?
ওঁর কাছেই আমাদের যেতে হবে।
কিন্তু–ঠিকানা?
বাসুদেব একটু হাসল। বলল, জানই তো মজুমদার মশাইরা এককালের ডাকসাইটে জমিদার পরিবার। আর এই জায়গাটা মুঠোর মধ্যে ধরা যায়। কাজেই তার ঠিকানা খুঁজতে খুব অসুবিধে হবে না।
.
তিনু ঘোষের কথা
বেলেঘাটার তিনু ঘোষ যদিও একজন মামলাবাজ লোক তবু তাকে আমার ভালো লাগত। আমার দাদামশায় নামজাদা উকিল ছিলেন। তিনু ঘোষ ছিলেন আমার দাদুর বাঁধা মক্কেল। বিরাট সম্পত্তি তাঁর। শরিকও অনেক। ফলে মামলা-মোকদ্দমা লেগেই থাকত। তবে ঘোষ মশাই-এর অঢেল টাকা। মোটা ফি দিয়ে দাদুকে কেস দিতে তার অসুবিধে ছিল না।
তিনু ঘোষ রোগা হলে কি হবে যেটা সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করত সেটা তার বিরাট একজোড়া গোঁফ। কোনো মানুষের অতবড় গোঁফ থাকে তা ভাবতে পারতাম না। তিনি চিরুনি দিয়ে গোঁফ আঁচড়াতেন দিনে চার-পাঁচ বার। তাই আলাদা একটা চিরুনি ঘুরত পকেটে পকেটে। মোমও দিতেন। তিনি জোরে হাসতেন না। হাসতেন নিঃশব্দে। হাসলে তার চোখ দুটো কুঁচকে যেত।
তিনু ঘোষ দাদুর চেম্বারে এসেছেন জানতে পারলেই আমি দোতলা থেকে নেমে আসতাম। আমায় দেখলেই তিনি চোখ ছোটো করে গোঁফের ফাঁকে হাসতেন। আমার লক্ষ ছিল তার পাকানো গোঁফ জোড়াটার দিকে। একবার হাত দিতে চাইতাম। উনি মুখটা বাড়িয়ে দিতেন। আমি ঠিক গুনে দুবার তার গোঁফে হাত বোলাতাম।
দাদু বলতেন, তিনু ঘোষ নাকি অনেক ভূতের গল্প জানেন। কয়েকবার নিজেই ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন।
এ খবর জানার পরই একদিন তাকে চেপে ধরলাম, একটা সত্যি ভূতের গল্প বলতেই হবে।
উনি হেসেছিলেন। বলেছিলেন, সত্যি ভূতের গল্প কীরকম?
বলেছিলাম, মানে আপনি নিজের চোখে যা দেখেছেন সেই রকম।
অ, আচ্ছা। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়েছিলেন। তারপর শুরু করেছিলেন তাঁর নিজের চোখে দেখা সত্যিকারের ভূতের গল্প।
বলেছিলেন, ভূত অনেকবার দেখেছি। মোকাবিলাও করেছি। কিন্তু এখন যার কথা বলব তাকে ভূত হিসাবে দেখেছি একটি বারই। তাও অনেক পরে। প্রথম তাকে দেখেছিলাম মানুষ হিসাবেই।
অবাক হয়েছিলাম। একই মানুষ আবার পরে সেই মানুষকেই ভূত হিসাবে দেখা। এমন তো বড় একটা ঘটে না।
নড়েচড়ে বসে বলেছিলাম, কাকু, বেশ জাঁকিয়ে ঘটনাটা বলুন না।
এরপর তিনি যা বললেন, তা এইরকম–
তখন ইংরেজ আমল। ইংরেজদের দাপট খুব। তারা আবার নেটিভদের অর্থাৎ কালা আদমি ভারতীয়দের সহ্য করতে পারত না। এক সাহেব ট্রেনে করে মুঙ্গের থেকে কলকাতা আসছিল। সঙ্গে একটা বিরাট কুকুর গ্ৰেহাউন্ড গোছের। সাহেব আর ওর কুকুর দুজনেরই চোখে হিংস্র দৃষ্টি।
সে সময়ে ট্রেনে চারটে ক্লাস ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, ইন্টার ক্লাস, আর থার্ড ক্লাস।
ফার্স্ট ক্লাসে যেত সাহেবসুবোরা, সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী ছিল মোটামুটি বড় অফিসাররা, ইন্টার ক্লাসে উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা। রুগি নিয়ে যাবার দরকার হলে এই ইন্টার ক্লাসটাই সুবিধের ছিল। আর থার্ড ক্লাস ছিল সাধারণ প্যাসেঞ্জারদের জন্য। ইন্টার ক্লাসের ভাড়া থার্ড ক্লাসের দেড়গুণ। তাই ইন্টার ক্লাসকে চলতি ভাষায় বলা ‘দেড়া গাড়ি। সেকেন্ড ক্লাসের ভাড়া ছিল থার্ড ক্লাসের ডবল, ফার্স্ট ক্লাসের ভাড়া থার্ড ক্লাসের চারগুণ। তখন ট্রেনে এত ভিড় হত না। এখনকার মতো তখন থার্ড ক্লাসে ফ্যান ছিল না। ফ্যান থাকত শুধু ফার্স্ট আর সেকেন্ড ক্লাসে। আপাদমস্তক পুরু গদি আঁটা সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস। সাধারণ প্যাসেঞ্জার ঐ সব কমপার্টমেন্টে ওঠা তো দূরের কথা, ফুটবোর্ডে পা রাখতেও সাহস পেত না। প্ল্যাটফর্ম থেকেই কোনোরকমে ভেতরের গদি, ফ্যানগুলো দেখত।
এছাড়া সাহেবদের সঙ্গে অন্তত একজন ‘অ্যাটেনডেন্ট’ বা সাহায্যকারী থাকত ফাইফরমাশ খাটার জন্যে। তারা তো আর সাহেবের সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে বা সেকেন্ড ক্লাসে যেতে পারে না। তাই ওদের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের লাগোয়া একটা সাধারণ কামরা থাকত। সেটা শুধু সাহেবদের সার্ভেন্টদের জন্যে। সেখানেও অন্য প্যাসেঞ্জাররা ঢুকতে পারত না।
তখন গার্ডও ছিল ফর্সা চামড়ার। ড্রাইভারদের মধ্যেও অনেক অ্যাংলোকে দেখা যেত। তারা ইংরিজিতেই কথা বলত। কখনও কখনও হিন্দিতে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেত কিন্তু বাংলা বলতে পারত না।
এই ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাসের মুষ্টিমেয় প্যাসেঞ্জারদের অহংকারের সীমা ছিল না। তারা বাঙালিদের সহ্য করতে পারত না। একবার এক নিতান্তই মধ্যবিত্ত বাঙালি তাড়াতাড়িতে ভুল করে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে যাচ্ছিল, ফার্স্ট ক্লাসের সাহেব প্যাসেঞ্জারটি তাকে লাথি মেরে নামিয়ে দিয়েছিল।
লাথি হজম করে মাথা নিচু করে বাঙালিটি অন্য গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। তখন সাহেবের বিরুদ্ধে নালিশ করার কোনো উপায় ছিল না। কে শুনবে নালিশ? ড্রাইভার, গার্ড, স্টেশন মাস্টার প্রায় সবাই তো ফর্সা চামড়ার সাহেব।
এইরকম সময়েই ঘটনাটা ঘটেছিল।
গাড়িতে সে সময়ে কুকুর বা হিংস্র কোনো পশু নিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না। অনেক লেখালেখি করে বিশেষ অনুমতি নিতে হত। যে সাহেবের কথা বলা হচ্ছে সে ওসব অনুমতি-টনুমতির ধার ধারত না। চিতাবাঘের মতো বিরাট কালো ছুঁচলে মুখ কুকুরটা তার নিত্যসঙ্গী। তার ঐ কুকুরটাকে দূর থেকে দেখলেই লোকে পালাত।
দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটা প্রথমে ঘটল আসানসোল স্টেশনে।
একজন মাড়োয়ারী সাহেবের কামরায় ঢুকতেই সাহেব তেড়ে গিয়েছিল।
-Get out!
মাড়োয়ারী ভয়ে কথা বলতে পারেনি। তবে টিকিটটা দেখিয়ে বলেছিল, Sir, here is my first class ticket. তাতে সাহেবের মাথা আরও গরম হয়ে গেল। শিস দিয়ে তার কুকুরটাকে লেলিয়ে দিল। কুকুরটা মূর্তিমান বিভীষিকার মতো গোঁ গোঁ শব্দ করে তেড়ে গেল। নির্দোষ প্যাসেঞ্জারটি ভয়ে চিৎকার করতে করতে নেমে গেল।
এবারে ঘটনা ঘটল বর্ধমানে। যে বাঙালি ভদ্রলোক ভুল করে সাহেবের কামরায় উঠেছিলেন, তাঁকে দেখেই সাহেব তার নিত্যসঙ্গী জ্বলন্ত চুরুটটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে দাঁত কড়মড় করে হাঁকড়ে উঠেছিল, ‘You bloody get out! This is first class.’
এই বাঙালি ভদ্রলোকটি ইংরিজিতেই উত্তর দিলেন, সাহেব আমি জানি এটা ফার্স্ট ক্লাস। ভুল করে উঠেছিলাম। এখনি নেমে যাচ্ছি। তবে আবার আসব।
বলেই প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলেন। একজন চেকারকে ডেকে তার সেকেন্ড ক্লাসের টিকিটটা বদলে ফার্স্ট ক্লাসের করে নিলেন। তারপর সদর্পে ঢুকলেন সাহেবেরই ফার্স্ট ক্লাস কামরায়। দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল সাহেব। হ্যাঁন্ডেল ঘুরিয়ে জোরে লাথি মেরে দরজাটা খুলে ফেললেন বাঙালি ভদ্রলোকটি।
সাহেব গদিতে হেলান দিয়ে নিশ্চিন্তে চুরুট টানছিল। বাঙালিবাবুকে ফের ঢুকতে দেখে আবার তেড়ে এল, Get out-Get out! I say get out!
বাঙালি ভদ্রলোক নেমে তো গেলেনই না। ফার্স্ট ক্লাস টিকিটটা বের করে সাহেবের নাকের ডগায় ধরলেন
সাহেব বলল, শোনো বাবু, ভালো কথায় বলছি অন্য গাড়িতে যাও। আরও ফার্স্ট ক্লাস কামরা আছে।
বাঙালিবাবু বললেন, কেন যাব? এ কামরা কি তোমার রিজার্ভ করা?
কোনো কালা আদমি মুখের ওপর কথা বলে সাহেবরা তা সহ্য করতে পারত না। মুখ লাল করে বলল, হ্যাঁ, রিজার্ভ করা। তুমি যাও।
এও এক নাছোড়বান্দা বাঙালি। সাহেব-টাহেব কেয়ার করে না। বললেন, দেখি তোমার টিকিটে কেমন রিজার্ভেশন আছে।
সাহেব আর সহ্য করতে পারল না। বাঙালিবাবুকে লক্ষ করে ঘুষি মারতে লাগল। বাবুটির ব্যায়াম করা শরীর। খপ করে সাহেবের হাতটা ধরে ফেললেন। তারপর দাঁতে দাঁত টিপে বললেন, সাহেব, বিনা দোষে আমার গায়ে হাত তুলে ভালো করলে না। আমি দুর্বল নই।
সাহেব এবার বাবুটির নাক লক্ষ করে ঘুষি মারতে গেল। বাবুটি মাথা সরিয়ে নিয়ে জুজুৎসুর কায়দায় সাহেবের ঘাড়ে এমন রদ্দা মারলেন যে সাহেবের ঘাড় বেঁকে গেল। সাহেব আর্তনাদ করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে তার প্রভুভক্ত কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঙালিবাবুর দিকে। বাবু চট করে সরে গিয়ে কুকুরটার পেটে পেল্লায় একটা লাথি মারলেন। খোলা দরজা দিয়ে কুকুরটা ছিটকে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। সঙ্গে সঙ্গে সাহেব পকেট থেকে রিভলবার বের করল।
বিপদ বুঝে নিরস্ত্র বাঙালিবাবুটি স্টেশনে লাফিয়ে পড়লেন। বাঁকা ঘাড়ের যন্ত্রণায় গোঁ গোঁ করতে করতে সাহেবও রিভলবার হাতে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ে তাড়া করে গেল।
প্ল্যাটফর্মে হৈচৈ চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। গোলমাল শুনে পাশের ছোটো কম্পার্টমেন্ট থেকে সাহেবের অ্যাটেনডেন্টটি ভোজালি হাতে বেরিয়ে এল। লোকটা নিগ্রো। বেঁটেখাটো কুচকুচে