অতসী মামি

যে শোনে সেই বলে, হ্যাঁ, শোনবার মতো বটে!

বিশেষ করে আমার মেজমামা। তার মুখে কোনো কিছুর এমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা খুব কম শুনেছি।

শুনে শুনে ভারী কৌতুহল হল। কী এমন বাঁশি বাজায় লোকটা যে সবাই এমনভাবে প্রশংসা করে? একদিন শুনতে গেলাম। মামার কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র সঙ্গে নিলাম।

আমি থাকি বালিগঞ্জে, আর যাঁর বাঁশি বাজানোর ওস্তাদির কথা বললাম তিনি থাকেন ভবানীপুর অঞ্চলে। মামার কাছে নাম শুনেছিলাম, যতীন। উপাধিটা শোনা হয়নি। আজ পরিচয়পত্রের উপরে পুরো নাম দেখলাম, যতীন্দ্রনাথ রায়।

বাড়িটা খুঁজে বার করে আমার তো চক্ষুস্থির! মামার কাছে যতীনবাবুর এবং তার বাঁশি বাজানোর যে রকম উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শুনেছিলাম তাতে মনে হয়েছিল লোকটা নিশ্চয় একজন কেষ্টবিষ্টু গোছের কেউ হবেন। আর কেষ্টবিষ্টু গোছের একজন লোক যে বৈকুণ্ঠ বা মথুরার রাজপ্রাসাদ না হোক, অন্তত বেশ বড়ো আর ভদ্রচেহারা একটা বাড়িতে বাস করেন এও তো স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিন্তু বাড়িটা যে গলিতে সেটার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, এ যে ইট-বার করা তিনকালের বুড়োর মতো নড়বড়ে একটা ইটের খাঁচা! সামনেটার চেহারাই যদি এ রকম, ভেতরটা না জানি কী রকম হবে।

উইয়ে ধরা দরজাব কড়া নাড়লাম।

একটু পরেই দরজা খুলে যে লোকটি সামনে এসে দাঁড়ালেন তাকে দেখে মনে হল ছাইগাদা নাড়তেই যেন একটা আগুন বার হয়ে পড়ল।

খুব রোগা। গায়ের রঙও অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু একদিন চেহারাখানা কী রকম ছিল অনুমান করা শক্ত নয়। এখনও যা আছে, অপুর্ব!

বছর ত্রিশেক বয়স, কী কিছু কম? মলিন হয়ে আসা গায়ের রং অপূর্ব, শরীরের গড়ন অপূর্ব; মুখের চেহারা অপূর্ব। আর সব মিলিয়ে যে রূপ তাও অপূর্ব। সব চেয়ে অপূর্ব চোখ দুটি। চোখে চোখে চাইলে যেন নেশা লেগে যায়।

পুরুষেরও তা হলে সৌন্দর্য থাকে! ইট-বার-করা নোনা-ধরা দেয়াল আর উইয়ে-ধরা দরজা, তার মাঝখানে লোকটিকে দেখে আমার মনে হল ভারী সুন্দর একটা ছবিকে কে যেন অতি বিশ্রী একটা ফ্রেমে বাঁধিয়েছে।

বললেন, আমি ছাড়া তো বাড়িতে কেউ নেই, সুতরাং আমাকেই চান। কিন্তু কী চান?

আমার মুগ্ধ চিত্তে কে যেন একটা ঘা দিল। কী বিশ্ৰী গলার স্বর! কর্কশ! কথাগুলি মোলায়েম কিন্তু লোকটির গলার স্বর শুনে মনে হল যেন আমায় গালাগালি দিচ্ছেন। ভাবলাম, নির্দোষ সৃষ্টি বিধাতার কুষ্ঠিতে লেখে না। এমন চেহারায় ওই গলা! সৃষ্টিকর্তা যত বড়ো কারিগর হোন, কোথায় কী মানায় সে জ্ঞানটা তার একদম নেই।

বললাম, আপনার নাম তো যতীন্দ্রনাথ রায়? আমি হরেনবাবুর ভাগনে।

পরিচয়পত্রখানা বাড়িয়ে দিলাম।

এক নিশ্বাসে পড়ে বললেন, ইস! আবার পরিচয়পত্র কেন হে? হরেন যদি তোমার মামা, আমিও তোমার মামা। হরেন যে আমায় দাদা বলে ডাকে! এসো, এসো, ভেতরে এসো।

আমি ভেতরে ঢুকতে তিনি দরজা বন্ধ করলেন।

সদর দরজা থেকে দু-ধারের দেয়ালে গা ঠেকিয়ে হাত পাঁচেক এসে একটা হাত তিনেক চওড়া বারান্দায় পড়ে ডান দিকে বাঁকতে হল। বাঁদিকে বাঁকবার জো নেই, কারণ দেখা গেল সেদিকটা প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা।

ছোট্ট একটু উঠান, বেশ পরিষ্কার। প্রত্যেক উঠানের চারটে করে পাশ থাকে, এটারও তাই আছে দেখলাম। দুপাশে দুখানা ঘর, এ বাড়িরই অঙ্গ। একটা দিক প্রাচীর দিয়ে বন্ধ করা, অপর দিকে অন্য এক বাড়ির একটা ঘরের পেছন দিক জানালা দরজার চিহ্নমাত্র নেই, প্রাচীরেরই শামিল।

আমার নবলব্ধ মামা ডাকলেন, অতসী, আমার ভাগনে এসেছে, এ ঘরে একটা মাদুর বিছিয়ে দিয়ে যাও। ও ঘরটা বড়ো অন্ধকার!

এ-ঘর মানে আমরা যে ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। ও-ঘর মানে ওদিককার ঘরটা। সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন এক তরুণী, মস্ত ঘোমটায় মুখ ঢেকে।

যতীন মামা বললেন, এ কী! ঘোমটা কেন? আরে, এ যে ভাগনে!

মামির ঘোমটা ঘুচবার লক্ষণ নেই দেখে আবার বললেন, ছি ছি, মামি হয়ে ভাগনের কাছে ঘোমটা টেনে কলাবউ সাজবে?

এবার মামির ঘোমটা উঠল। দেখলাম, আমার নতুন পাওয়া মামিটি মামারই উপযুক্ত স্ত্রী বটে। মামি এ-ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে দিলেন। ঘরে তক্তপোশ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদির বালাই নেই। একপাশে একটা রং-চটা ট্রাঙ্ক আর একটা কাঠের বাকসো। দেয়ালে এক কোণ থেকে আর এক কোণ পর্যন্ত একটা দড়ি টাঙানো, তাতে একটি মাত্র ধুতি ঝুলছে। একটা পেরেকে একটা আধ ময়লা খদ্দরের পাঞ্জাবি লটকানো, যতীন মামার সম্পত্তি। গোটা দুই দু-বছর আগেকার ক্যালেন্ডারেব ছবি। একটাতে এখনও চৈত্রমাসের তারিখ লেখা কাগজটা লাগানো রয়েছে, ছিঁড়ে ফেলতে বোধ হয় কারও খেয়াল হয়নি।

যতীন মামা বললেন, একটু সুজিটুজি থাকে তো ভাগনেকে করে দাও। না থাকে এক কাপ চাই খাবেখন।

বললাম, কিছু দরকার নেই যতীন মামা। আপনার বাঁশি শুনতে এসেছি, বাঁশির সুরেই খিদে মিটবে এখন। যদিও খিদে পায়নি মোটেই, বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

যতীন মামা বললেন, বাঁশি? বাঁশি তো এখন আমি বাজাই না।

বললাম, সে হবে না, আপনাকে শোনাতেই হবে।

বললেন, তা হলে বসো, রাত্রি হোক। সন্ধ্যার পর ছাড়া আমি বাঁশি ছুই না।

বললাম, কেন?

যতীন মামা মাথা নেড়ে বললেন, কেন জানি না ভাগনে, দিনের বেলা বঁশি বাজাতে পারি না। আজ পর্যন্ত কোনোদিন বাজাইনি। হ্যাঁ গা অতসী, বাজিয়েছি?

অতসী মামি মৃদু হেসে বললেন, না।

যেন প্রকাণ্ড একটা সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এমনিভাবে যতীন মামা বললেন, তবে?

বললাম, মোটে পাঁচটা বেজেছে, সন্ধ্যা হবে সাতটায়। এতক্ষণ বসে থেকে কেন আপনাদের অসুবিধা করব, ঘুরে-টুরে সন্ধ্যার পর আসব এখন।

যতীন মামা ইংরেজিতে বললেন, Tut! Tut! তারপর বাংলায় যোগ দিলেন, কী যে বল ভাগনে! অসুবিধেটা কী হে অ্যাঁ! পাড়ার লোকে তো বয়কট করেছে অপবাদ দিয়ে, তুমি থাকলে তবু কথা কয়ে বাঁচব।

আমি বললাম, পাড়ার লোকে কী অপবাদ দিয়েছে মামা? অতসী মামির দিকে চেয়ে যতীন মামা হাসলেন, বলব নাকি ভাগনেকে কথাটা অতসী? পাড়ার লোকে কী বলে জানো ভাগনে? বলে অতসী আমার বিযে করা বউ নয়!—চোখের পলকে হাসি মুছে রাগে যতীন মামা গরগর করতে লাগলেন, লক্ষ্মীছাড়া বজ্জাত লোক পাড়ার, ভাগনে। রীতিমতো দলিল আছে বিয়ের, কেউ কি তা দেখতে চাইবে? যত স—

ত্রস্তভাবে অতসী মামি বললে, কী যা-তা বলছ?

যতীন মামা বললেন, ঠিক ঠিক, ভাগনে নতুন লোক, তাকে এ সব বলা ঠিক হচ্ছে না বটে। ভারী রাগ হয় কিনা! বলে হাসলেন। হঠাৎ বললেন, তোমরা যে কেউ কারু সঙ্গে কথা বলছ না গো!

মামি মৃদু হেসে বললে, কী কথা বলব?

যতীন মামা বললেন, এই নাও! কী কথা বলবে তাও কি আমায় বলে, দিতে হবে নাকি? যা হোক কিছু বলে শুরু কর, গড়গড় করে কথা আপনি এসে যাবে।

মামি বললে, তোমার নামটি কী ভাগনে?

যতীন মামা সশব্দে হেসে উঠলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, এইবার ভাগনে, পালটা প্রশ্ন কর, আজ কী রাঁধবে মামি? ব্যস, খাসা আলাপ জমে যাবে। তোমার আরম্ভটি কিন্তু বেশ অতসী।

মামির মখ লাল হয়ে উঠল।

আমি বললাম, আমন বিশ্রী প্রশ্ন আমি কক্‌খনো করব না মামি, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার নাম সুরেশ।

সতীন মামা বললেন, সুরেশ কিনা সুরের রাজা, তাই সুর শুনতে এত আগ্রহ। নয় ভাগনে?

হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ইস! ভুবনবাবু যে টাকা দুটো ফেরত দেবে বলেছিল আজ! নিয়ে আসি, দুদিন বাজার হযনি। বসো ভাগনে, মামির সঙ্গে গল্প করো, দশ মিনিটের ভেতর আসছি।

ঘরের বাইবে গিয়ে বললেন, দোরটা দিয়ে যাও অতসী। ভাগনে ছেলেমানুষ, কেউ তোমার লোভে ঘরে ঢুকলে ঠেকাতে পারবে না।

মামিব মুখ আরক্ত হয়ে উঠল এবং সেটা গোপন করতে চট করে উঠে গেল। বাইরে তার চাপা গলা শুনলাম, কী যে রসিকতা কর, ছি! মামা কী জবাব দিলে- শোনা গেল না।

মামি ঘরে ঢুকে বললে, ওই রকম স্বভাব ওঁর। বাক্‌সে দুটি মোটে টাকা, তাই নিয়ে সেদিন বাজার গেলেন। বললাম, একটা থাক। জবাব দিলেন, কেন? রাস্তায় ভুবনবাবু চাইতে টাকা দুটি তাকে দিয়ে খালি হাতে ঘরে ঢুকলেন।

আমি বললাম, আশ্চর্য লোক তো! মামি বললে, ওই রকমই। আর দাখো ভাই—

বললাম, ভাই নয়, ভাগনে।

মামি বললে, তাও তো বটে। আগে থাকতেই যে সম্বন্ধটা পাতিয়ে যে বসে আছ! ওঁর ভাগনে না হয়ে আমার ভাই হলেই বেশ হত কিন্তু। সম্পর্কটা নতুন করে পাতো না? এখনও এক ঘণ্টাও হযনি, জমাট বাঁধেনি।

আমি বললাম, কেন? মামি-ভাগনে বেশ তো সম্পর্ক!

মামি বললে, আচ্ছা তবে তাই। কিন্তু আমার একটা কথা তোমায় রাখতে হবে ভাগনে। তুমি ওঁর বাঁশি শুনতে চেয়ো না।

বললাম, তার মানে? বাঁশি শুনতেই তো এলাম!

মামির মুখ গম্ভীর হল, বললে, কেন এলে? আমি ডেকেছিলাম? তোমাদের জ্বালায় আমি কি গলায় দড়ি দেব?

আমি অবাক হয়ে মামির মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। কথা জোগায় না।

মামি বললে, তোমাদের একটু শখ মেটাবার জন্য উনি আত্মহত্যা করছেন দেখতে পাও না? রোজ তোমরা একজন না একজন এসে বাঁশি শুনতে চাইবে। রোজ গলা দিয়ে রক্ত পড়লে মানুষ কদিন বাঁচে!

রক্ত! রক্ত নয়? দেখবে? বলে মামি চলে গেল। ফিরে এল একটা গামলা হাতে করে। গামলার ভেতরে জমাট-বাধা খানিকটা রক্ত।

মামি বললে, কাল উঠেছিল, ফেলতে মায়া হচ্ছিল তাই রেখে দিয়েছি। রেখে কোনো লাভ নেই জানি, তবু—

আমি অনুতপ্ত হয়ে বললাম, জানতাম না মামি। জানলে ককখনো শুনতে চাইতাম না। ইস, এই জন্যেই মামার শরীর এত খারাপ?

মামি বললে, কিছু মনে করো না ভাগনে। অন্য কারও সঙ্গে তো কথা কই না, তাই তোমাকেই গায়ের ঝাল মিটিয়ে বলে নিলাম। তোমার আর কী দোষ, আমার অদৃষ্ট!

আমি বললাম, এত রক্ত পড়ে, তবু মামা বাঁশি বাজান?

মামি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, হ্যাঁ, পৃথিবীর কোনো বাধাই ওঁর বাঁশি বাজানো বন্ধ করতে পারবে না। কত বলেছি, কত কেঁদেছি শোনেন না।

আমি চুপ করে রইলাম।

মামি বলে চলল, কতদিন ভেবেছি বাঁশি ভেঙে ফেলি, কিন্তু সাহস হয়নি। বাঁশির বদলে মদ খেয়েই নিজেকে শেষ করে ফেলবেন, নয়তো যেখানে যা আছে সব বিক্রি করে বাঁশি কিনে না খেয়ে মরবেন।

মামির শেষ কথাগুলি যেন গুমরে গুমরে কেঁদে ঘরের চারিদিকে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আমি কথা বলতে গেলাম, কিন্তু ফুটল না।

মামি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, অথচ ওই একটা ছাড়া আমার কোনো কথাই ফেলেন না। আগে আকণ্ঠ মদ খেতেন, বিয়ের পর যেদিন মিনতি করে মদ ছাড়তে বললাম সেইদিন থেকে ও জিনিস ছোঁয়াই ছেড়ে দিলেন। কিন্তু বাঁশির বিষয়ে কোনো কথাই শোনেন না।

আমি বলতে গেলাম, মামি—

মামি বোধ হয় শুনতেই পেল না, বলে চলল, একবার বাঁশি লুকিয়ে রেখেছিলাম, সে কী ছটফট করতে লাগলেন যেন ওঁর সর্বস্ব হারিয়ে গেছে।

 

বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ হল। মামি দরজা খুলতে উঠে গেল।

যতীন মামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, দিলে না টাকা অতসী, বললে পরশু যেতে।

পিছন থেকে মামি বললে, সে আমি আগেই জানি।

যতীন মামা বললেন, দোকানদারটাই বা কী পাজি, একপো সুজি চাইলাম, দিল না। মামার বাড়ি এসে ভাগনেকে দেখছি খালি পেটে ফিরতে হবে।

মামি ম্লান মুখে বললে, সুজি দেয়নি ভালোই করেছে। শুধু জল দিয়ে তো আর সুজি হয় না।

ঘি নেই?

কবে আবার ঘি আনলে তুমি?

তাও তো বটে! বলে যতীন মামা আমার দিকে চেয়ে হাসলেন। দিব্য সপ্রতিভ হাসি।

আমি বললাম, কেন ব্যস্ত হচ্ছেন মামা, খাবারের কিছু দরকার নেই। ভাগনের সঙ্গে অত ভদ্রতা করতে নেই।

মামি বললে, বসো তোমরা, আমি আসছি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মামা হেঁকে বললেন, কোথায় গো? বারান্দা থেকে জবাব এল, আসছি।

মিনিট পনেরো পরে মামি ফিরল। দু হাতে দুখানা রেকাবিতে গোটা চারেক করে রসগোল্লা, আর গোটা দুই সন্দেশ।

যতীন মামা বললেন, কোথেকে জোগাড় করলে গো? বলে, একটা রেকাবি টেনে নিয়ে একটা রসগোল্লা মুখে তুললেন।

অন্য রেকাবিটা আমার সামনে রাখতে রাখতে মামি বললে, তা দিয়ে তোমাব দরকার কী?

যতীন মামা নিশ্চিন্তভাবে বললেন, কিছু না! যা খিদেটা পেয়েছে; ডাকাতি করেও যদি এনে থাক কিছু দোষ হয়নি। স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে সাধ্বী অনেক কিছুই করে।

আমি কুণ্ঠিত হযে বলতে গেলাম, কেন মিথ্যে—

বাধা দিয়ে মামি বললে, আবার যদি ওই সব শুরু কর ভাগনে, আমি কেঁদে ফেলব।

আমি নিঃশব্দে খেতে আরম্ভ কবলাম।

মামি ও ঘর থেকে দুটো এনামেলের গ্রাসে জল এনে দিলেন। প্রথম রসগোল্লাটা গিলেই মামা বললেন, ওযাক্‌! কী বিশ্রী বসগোল্লা! রইল পড়ে, খেয়ো তুমি, নয় তো ফেলে দিযো। দেখি সন্দেশটা কেমন!

সন্দেশ মুখে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ এ জিনিসটা ভালো, এটা খাব। বলে সন্দেশ দুটো তুলে নিয়ে রেকাবিটা ঠেলে দিয়ে বললেন, যাও তোমার সুজির ঢিপি ফেলে দিয়োখন নর্দমায়।

অতসী মামির চোখ ছলছল করে এল। মামার ছলটুকু আমাদের কারুর কাছেই গোপন রইল না। কেন যে এমন খাসা রসগোল্লাও মামার কাছে সুজির টিপি হয়ে গেল বুঝে আমার চোখে প্রায় জল আসবার উপক্রম হল।

মাথা নিচু করে রেকাবিটা শেষ করলাম। মাঝখানে একবার চোখ তুলতেই নজরে পড়ল মামি মামার রেকাবিটা দরজার ওপরে তাকে তুলে রাখছে।

 

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এলে মামি ঘরে ঘরে প্রদীপ দেখাল, ধুনো দিল। আমাদের ঘরে একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে মামি চুপ করে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।

যতীন মামা হেসে বললেন, আরে লজ্জা কীসের! নিত্যকার অভ্যাস, বাদ পড়লে রাতে ঘুম হবে না।  ভাগনের কাছে লজ্জা করতে নেই।

আমি বললাম, আমি, না হয়—

মামি বললে, বসো, উঠতে হবে না, অত লজ্জা নেই আমার। বলে, গলায় আঁচল দিয়ে মামার পায়ের কাছে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল।

লজ্জায় সুখে তৃপ্তিতে আরক্ত মুখখানি নিয়ে অতসী মামি যখন উঠে দাঁড়াল, আমি বললাম, দাঁড়াও মামি, একটা প্রণাম করে নিই।

মামি বললে, না না ছি ছি—

বললাম, ছিছি নয় মামি। আমার নিত্যকার অভ্যাস না হতে পারে, কিন্তু তোমায় প্রণাম না করে যদি আজ বাড়ি ফিরি রাত্রে আমার ঘুম হবে না ঠিক। বলে মামির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম।

যতীন মামা হো হো করে হেসে উঠলেন।

মামি বললে, দ্যাখো তো ভাগনের কাও!

যতীন মামা বললেন, ভক্তি হয়েছে গো! সকালসন্ধা স্বামীকে প্রণাম করো জেনে শ্রদ্ধা হয়েছে ভাগনের।

কী যে বল!—বলে মামি পলায়ন করল। বারান্দা থেকে বলে গেল, আমি রান্না করতে গেলাম।

যতীন মামা বললেন, এইবার বাঁশি শোনো।

আমি বললাম, থাকগে, কাজ নেই মামা। শেষে আবার রক্ত পড়তে আরম্ভ করবে।

যতীন মামা বললেন, তুমিও শেষে ঘ্যানঘান পানপ্যান আরম্ভ করলে ভাগনে? রক্ত পড়বে তো হয়েছে কী? তুমি শুনলেও আমি বাজাব, না শুনলেও বাজাব। খুশি হয় রান্নাঘরে মামির কাছে বসে কানে আঙুল দিয়ে থাকো গে।

কাঠের বাক্সোটা খুলে বাঁশির কাঠের কেসটা বার করলেন। বললেন, বারান্দায় চলো, ঘরে বড়ো শব্দ হয়।

নিজেই বারান্দায় মাদুরটা তুলে এনে বিছিয়ে নিলেন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বাঁশিটা মুখে তুললেন।

হঠাৎ আমার মনে হল আমার ভেতরে যেন একটা উন্মাদ একটা খ্যাপা উদাসীন ঘুমিয়ে ছিল আজ বাঁশির সুরের নাড়া জেগে উঠল। বাঁশির সুর এসে লাগে কানে কিন্তু আমার মনে হল বুকের তলেও যেন সাড়া পৌঁছেছে। অতি তীব্র বেদনার মধুরতম আত্মপ্রকাশ কেবল বুকের মাঝে গিয়ে পৌঁছায়নি, বাইরের এই ঘরদেরকেও যেন স্পর্শ দিয়ে জীবন্ত করে তুলেছে, আর আকাশকে বাতাসকে মৃদুভাবে স্পর্শ করতে করতে যেন দূরে, বহুদূরে, যেখানে গোটা কয়েক তারা ফুটে উঠেছে দেখতে পাচ্ছি, সেইখানে স্বপ্নের মায়ার মধ্যে লয় পাচ্ছে। অন্তরে ব্যথা বোধ করে আনন্দ পাবার যতগুলি অনুভূতি আছে বাঁশির সুর যেন তাদের সঙ্গে কোলাকুলি আরম্ভ করেছে।

বাঁশি শুনেছি ঢের। বিশ্বাস হয়নি এই বাঁশি বাজিয়ে একজন একদিন এক কিশোরীর কুল মান লজ্জা ভয় সব ভুলিয়ে দিয়েছিল, যমুনাতে উজান বইয়েছিল। আজ মনে হল, আমার যতীন মামার বাঁশিতে সমগ্র প্রাণ যদি আচমকা জেগে উঠে নিরর্থক এমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে, তবে সেই বিশ্ববাঁশির বাদকের পক্ষে ওই দুটি কাজ আর এমন কী কঠিন!

দেখি, মামি কখন এসে নিঃশব্দে ওদিকের বারান্দায় বসে পড়েছে। খুব সম্ভব ওই ঘরটাই রান্নাঘর, কিংবা রান্নাঘরে যাবার পথ ওই ঘরের ভেতব দিয়ে।

যতীন মামার দিকে চেয়ে দেখলাম, খুব সম্ভব সংজ্ঞা নেই। এ যেন সুরের আত্মভোলা সাধক, সমাধি পেয়ে গেছে।

কতক্ষণ বাঁশি চলেছিল ঠিক মনে নেই, বোধ হয় ঘণ্টা দেড়েক হবে। হঠাৎ এক সময়ে বাঁশি থামিয়ে যতীন মামা ভয়ানক কাশতে আরম্ভ করলেন। বারান্দার ক্ষীণ আলোতেও বুঝতে পারলাম, মামার মুখ চোখ অস্বাভাবিক রকম লাল হয়ে উঠেছে।

অতসী মামি বোধ হয় প্রস্তুত ছিল, জল আর পাখা নিয়ে ছুটে এল। খানিকটা রক্ত তুলে মামির শুশ্রূষায় যতীন মামা অনেকটা সুস্থ হলেন। মাদুরের ওপর একটা বালিশ পেতে মামি তাকে শুইয়ে দিল। পাখা নেড়ে নীরবে হাওয়া করতে লাগল।

 

তারপর এক সময় উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আজ আসি যতীন মামা।

মামা কিছু বলবার আগেই মামি বললে, তুমি এখন কথা কয়ো না। ভাগনের বাড়িতে ভাববে, আজ থাক, আর একদিন এসে খেয়ে যাবে এখন। চলো আমি দরজা দিয়ে আসছি।

সদরের দরজা খুলে বাইরে যাব, মামি আমার একটা হাত চেপে ধরে বললে, একটু দাঁড়াও ভাগনে, সামলে নিই।

প্রদীপের আলোতে দেখলাম, মমির সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপিছে। একটু সুস্থ হয়ে বললে, ওর রক্ত পড়া দেখলেই আমার এরকম হয়। বাঁশি শুনেও হতে পারে। আচ্ছা এবার এসো ভাগনে, শিগগির আর একদিন আসবে কিন্তু।

বললাম, মামার বাঁশি ছাড়াতে পারি কি না একবার চেষ্টা করে দেখব মামি?

মামি বাগ্রকণ্ঠে বললে, পারবে? পারবে তুমি? যদি পার ভাগনে, শুধু তোমার যতীন মামাকে নয়, আমাকেও প্রাণ দেবে।

অতসী মামি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে।

রাস্তায় নেমে বললাম, খিলটা লাগিয়ে দাও মামি।

 

কেবলই মনে হয়, নেশাকে মানুষ এত বড়ো দাম দেয় কেন। লাভ কী? এই যে যতীন মামা পলে পলে জীবন উৎসর্গ করে সুরের জাল বুনবার নেশায় মেতে যান, মানি তাতে আনন্দ আছে। যে সৃষ্টি করে তারও, যে শোনে তারও। কিন্তু এত চড়া মূল্য দিযে কী সেই আনন্দ কিনতে হবে? এই যে স্বপ্ন সৃষ্টি, এ তো ক্ষণিকের। যতক্ষণ সৃষ্টি করা যায় শুধু ততক্ষণ এ্র স্থিতি। তারপর বাস্তবের কঠোরতার মাঝে এ স্বপ্নের চিহ্নও তো খুঁজে পাওয়া যায় না। এ নিরর্থক মায়া সৃষ্টি করে নিজেকে ভোলাবার প্রয়াস কেন? মানুষের মন কী বিচিত্র। আমারও ইচ্ছে করে যতীন মামার মতো সুরের আলোয় ভুবন ছে্য়ে ফেলে, সুবের আগুন গগনে বেয়ে তুলে পলে পলে নিজেকে শেষ করে আনি! লাভ নেই? নাই বা রইল।

এতদিন জানতাম, আমিও বাঁশি বাজাতে জানি। বন্ধুরা শুনে প্রশংসাও করে এসেছে। বাঁশি বাজিয়ে আনন্দও যে না পাই তা নয়। কিন্তু যতীন মামার বাঁশি শুনে এসে মনে হল, বাঁশি বাজানো আমার জন্যে নয়। এক একটা কাজ করতে এক একজন লোক জন্মায়, আমি বাঁশি বাজাতে জন্মাইনি। যতীন মামা ছাড়া বাঁশি বাজাবার অধিকার কারও নেই।

থাকতে পারে কারও অধিকার। কারও কারও বাঁশি হয়তো যতীন মামার বাঁশির চেয়েও মনকে উতলা কবে তোলে, আমি তাদের চিনি না।

একদিন বললাম, বাঁশি শিখিয়ে দেবে মামা?

যতীন মামা হেসে বললে, বাঁশি কি শেখাবার জিনিস ভাগনে? ও শিখতে হয়।

তা ঠিক। আর শিখতেও হয় মন দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, সমগ্র সত্তা দিযে। নইলে আমার বাঁশি শেখার মতোই সে শিক্ষা বাৰ্থ হয়ে যায়।

অতসী মামিকে সেদিন বিদায় নেবার সময় যে কথা বলেছিলাম সে কথা ভুলিনি। কিন্তু কী করে যে যতীন মামার বাঁশি ছাড়াব ভেবে পেলাম না। অথচ দিনের পর দিন যতীন মামা যে এই সর্বনাশা নেশায় পলে পলে মরণের দিকে এগিয়ে যাবেন। কথা ভাবতেও কষ্ট হল। কিন্তু করা যায় কী? মামির প্রতি যতীন মামার যে ভালোবাসা তার বোধ হয় তল নেই, মামির কান্নাই যখন ঠেলেছেন তখন আমার সাধ্য কী তাকে ঠেকিয়ে রাখি!

একদিন বললাম, মামা, আর বাঁশি বাজাবেন না।

যতীন মামা চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, বাঁশি বাজাব না? বল কী ভাগনে? তাহলে বাঁচব কী করে?

বললাম, গলা দিয়ে রক্ত উঠছে, মামি কত কাঁদে।

তা আমি কি করব? একটু-আধটু কাঁদা ভালো। বলে হাকলেন, অতসী! অতসী!

মামি এল।

মামা বললেন, কান্না কী জন্যে শুনি? বাঁশি ছেড়ে দিয়ে আমায় মরতে বল নাকি? তাতে কান্না বাড়বে, কমবে না।

মামি ম্লানমুখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

মামা বললেন, জানো ভাগনে, এই অতসীর জ্বালায় আমার বেঁচে থাকা ভার হয়ে উঠেছে। কোথেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন, নড়বার নাম নেই। ওর ভার ঘাড়ে না থাকলে বাঁশি বগলে মনের আনন্দে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতাম। বেড়ানো-টেড়ানো সব মাথায় উঠেছে।

মামি বললে, যাও না বেড়াতে, আমি ধরে রেখেছি?

রাখোনি? বলে মামা এমনিভাবে চাইলেন যেন নিজের চোখে তিনি অতসী মামিকে খুন করতে দেখেছেন আর মামি এখন তাঁর সমুখেই সে কথা অস্বীকার করছে।

মামির চোখে জল এল। অশু-জড়িত কণ্ঠে বললে, অমন কর তো আমি একদিন—

মামা একেবারে জল হয়ে গেলেন। আমার সামনেই মামির হাত ধরে কোঁচার কাপড় দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, ঠাট্টা করছিলাম, সত্যি বলছি অতসী,–

চট করে হাত ছাড়িয়ে মামি চলে গেল!

আমি বললাম, কেন মিথ্যে চটালেন মামিকে?

যতীন মামা বললেন, চটেনি। লজ্জায় পালাল।

 

কিন্তু একদিন যতীন মামাকে বাঁশি ছাড়তে হল। মামিই ছাড়াল।

মামির একদিন হঠাৎ টাইফয়েড জ্বর হল।

সেদিন বুঝি জ্বরের সতেরো দিন। সকাল নটা বাজে। মামি ঘুমুচ্ছে, আমি তার মাথায আইসব্যাগটা চেপে ধরে আছি। যতীন মামা একটু টুলে বসে স্নানমুখে চেয়ে আছেন। রাত্রি জেগে তার শরীর আরও শীর্ণ হয়ে গেছে, চোখ দুটি লাল হয়ে উঠেছে। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, চুল উশকোখুশকো।

হঠাৎ টুল ছেড়ে উঠে মামা ট্রাঙ্কটা খুলে বাঁশিটা বার কবলেন। আজ সতেরো দিন এটা বাক্সেই বন্ধ ছিল।

সবিস্ময়ে বললাম, বাঁশি কী হবে মামা?

ছেঁড়া পাম্পশুতে পা ঢুকোতে ঢুকোতে মামা বললেন, বেচে দিয়ে আসব।

তার মানে? যতীন মামা স্নান হাসি হেসে বললেন, তার মানে ডাক্তার বোসকে আর একটা কল দিতে হবে।

বললাম, বাঁশি থাক, আমার কাছে টাকা আছে।

প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হেসে যতীন মামা পেরেকে টাঙানো জামাটা টেনে নিলেন।

যদি দরকার পড়ে ভেবে পকেটে কিছু টাকা এনেছিলাম। মিথ্যা চেষ্টা। আমার মেজো মামা কতবার কত বিপদে যতীন মামাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছেন, যতীন মামা একটি পয়সা নেননি। বললাম, কোথাও যেতে হবে না মামা, আমি কিনব বাঁশি।

মামা ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন, তুমি কিনবে ভাগনে? বেশ তো! বললাম, কত দাম? বললেন, একশো পঁয়ত্ৰিশে কিনেছি, একশো টাকায় দেব। বাঁশি ঠিক আছে, কেবল সেকেন্ড হ্যাণ্ড এই যা।

বললাম, আপনি না সেদিন বলছিলেন মামা, এ রকম বঁশি খুঁজে পাওয়া দায়, অনেক বেছে আপনি কিনেছেন? আমি একশো পঁয়ত্রিশ দিয়েই ওটা কিনব।

যতীন মামা বললেন, তা কি হয়। পুরনো জিনিস–

বললাম, আমাকে কি জোচ্চোর পেলেন মামা? আপনাকে ঠকিয়ে কম দামে বাঁশি কিনব?

পকেটে দশ টাকার তিনটে নোট ছিল, বার করে মামার হাতে দিয়ে বললাম, ত্রিশ টাকা আগাম নিন, বাকি টাকাটা বিকেলে নিয়ে আসব।

যতীন মামা কিছুক্ষণ স্তব্ধভাবে নোটগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আচ্ছা!

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। যতীন মামার মুখের ভাবটা দেখবার সাধা হল না।

যতীন মামা ডাকলেন, ভাগনে—

ফিরে তাকালাম।

যতীন মামা হাসবার চেষ্টা করে বললেন, খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে ভেব না, বুঝলে ভাগনে?

আমার চোখে জল এল। তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে মামির শিয়বে গিয়ে বসলাম।

মামির ঘুম ভাঙেনি, জানতেও পারল না যে রক্তপিপাসু বাঁশিটা ঝলকে ঝলকে মামার রক্ত পান করেছে, আমি আজ সেই বাঁশিটা কিনে নিলাম।

মনে মনে বললাম, মিথ্যে আশা। এ যে বালির বাঁধ! একটা বাঁশি গেল, আর একটা কিনতে কতক্ষণ? লাভের মধ্যে যতীন মামা একান্ত প্রিয়বস্তু হাতছাড়া হয়ে যাবার বেদনাটাই পেলেন।

বিকালে বাকি টাকা এনে দিতেই যতীন মামা বললেন, বাড়ি যাবার সময় বাঁশিটা নিয়ে যেও। আমি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, থাক না এখন কদিন, এত তাড়াতাড়ি কীসের?

যতীন মামা বললেন, না। পরের জিনিস আমি বাড়িতে রাখি না। বুঝলাম, পরের হাতে চলে যাওয়া বাঁশিটা চোখের ওপরে থাকা তাঁর সহ্য হবে না।

বললাম, বেশ মামা, তাই নিয়ে যাবখন।

মামা ঘাড় নেডে বললেন, হ্যাঁ, নিয়েই যেও | তোমাব জিনিস এখানে কেন ফেলে রাখবে। বুঝলে না?

উনিশ দিনেব দিন মামির অবস্থা সংকটজনক হয়ে উঠল।

যতীন মামা টুলটা বিছানার কাছে টেনে টেনে মামির একটা হাত মুঠো করে ধরে নীরবে তার রোগশীর্ণ ঝরা ফুলের মতো স্নান মুখের দিকে চেয়েছিলেন, হঠাৎ অতসী মামি বললে, ওগো আমি বোধ হয় আর বাঁচিব না।

যতীন মামা বললেন, তা কি হয় অতসী, তোমায় বাঁচতে হবেই। তুমি না বাঁচলে আমিও যে বাঁচব না?

মামি বললে, বালাই, বাঁচবে বইকী। দ্যাখো, আমি যদি নাই বাঁচি, আমার একটা কথা রাখবে? যতীন মামা নত হয়ে বললেন, রাখব। বলো।

বঁশি বাজানো ছেড়ে দিয়ো। তিলতিল করে তোমার শরীর ক্ষয় হচ্ছে দেখে ওপারে গিয়েও আমার শান্তি থাকবে না। রাখবে আমার কথা?

মামা বললেন, তাই হবে অতসী। তুমি ভালো হয়ে ওঠে। আমি আর বঁশি ছোঁব না।

মামির শীর্ণ ঠোঁটে সুখের হাসি ফুটে উঠল। মামার একটা হাত বুকের ওপর টেনে শ্রান্তভাবে মামি চোখ বুজল।

আমি বুঝলাম যতীন মামা আজ তাঁর রোগশয্যাগতা অতসীর জন্য কত বড়ো একটা ত্যাগ করলেন। অতি মৃদুস্বরে উচ্চারিত ওই কটি কথা, তুমি ভালো হয়ে ওঠে, আমি আর বঁশি ছোব না, অন্যে না বুঝুক আমি তো যতীন মামাকে চিনি, আমি জানি, অতসী মামিও জানে ওই কথা কটির পেছনে কতখানি জোর আছে! বাঁশি বাজাবার জন্য মন উন্মাদ হয়ে উঠলেও যতীন মামা আর বাঁশি ছোঁবেন না।

শেষ পর্যন্ত মামি ভালো হয়ে উঠল। যতীন মামার মুখে হাসি ফুটল। মামি যেদিন পথ্য পেল সেদিন হেসে মামা বললেন, কী গো, বাঁচবে না বলে? অমনি মুখের কথা কি না! যে চাঁড়াল খুড়োর কাছ থেকেই তোমায় ছিনিয়ে এনেছি, যম ব্যাটা তো ভালোমানুষ।

আমি বললাম, চাঁড়াল খুড়ো আবার কী মামা?

মামা বললেন, তুমি জান না বুঝি? সে এক দ্বিতীয় মহাভারত।

মামি বললে, গুরুনিন্দা কোরো না।

মামা বললেন, গুরুনিন্দা কী? গুরুতর নিন্দা করব। ভাগনেকে দেখাও না। অতসী তোমার পিঠের দাগটা।

মামির বাধা দেওয়া সত্ত্বেও মামা ইতিহাসটা শুনিয়ে দিলেন। নিজের খুড়ো নয়, বাপের পিসতুতো ভাই। মা বাবাকে হারিয়ে সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত ওই খুড়োর কাছেই অতসী মামি ছিল। অত বড়ো মেয়ে, তাকে কিলচড় লাগাতে খুড়োটির বাধত না, আনুষঙ্গিক অন্য সব তো ছিলই। খুড়োর মেজাজের একটি অক্ষয় চিহ্ন আজ পর্যন্ত মামির পিঠে আছে। পাশের বাড়িতেই যতীন মামা বাঁশি বাজাতেন আর আকণ্ঠ মদ খেতেন। প্রায়ই খুড়োর গর্জন আর অনেক রাতে মামির চাপা কান্নার শব্দে তার নেশা ছুটে যেত। নিতান্ত চটে একদিন মেয়েটাকে নিয়ে পলায়ন করলেন এবং বিয়ে করে ফেললেন।

মামার ইতিহাস বলা শেষ হলে অতসী মামি ক্ষীণ হাসি হেসে বললে, তখন কি জানি মদ খায়! তাহলে কক্‌খনো আসতাম না।

মামা বললেন, তখন কী জানি তুমি মাথার রতন হয়ে আঠার মতো লেপটে থাকবে! তাহলে কক্‌খনো উদ্ধার করতাম না। আর মদ না খেলে কি এক ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে মেযে চুরি করার মতো বিশ্রী কাজটা করতে পারতাম গো! আমি ভেবেছিলাম, বছরখানেক—

মামি বললে, যাও, চুপ করো। ভাগনের সামনে যা তা বকো না।

মামা হেসে চুপ করলেন।

 

মাস দুই পরের কথা।

কলেজ থেকে সটান যতীন মামার ওখানে হাজির হলাম। দেখি, জিনিসপত্র যা ছিল বাঁধাছাঁদা হয়ে পড়ে আছে।

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, এ সব কী মামা?

যতীন মামা সংক্ষেপে বললেন, দেশে যাচ্ছি।

দেশে? দেশ আবার আপনার কোথায়?

যতীন মামা বললেন, আমার কী একটা দেশও নেই ভাগনে? পাঁচশো টাকা আয়ের জমিদারি আছে দেশে, খবর রাখ?

অতসী মামি বললে, হয়তো জন্মের মতোই তোমাদের ছেড়ে চললাম ভাগনে। আমার অসুখের জন্যই এটা হল।

বললাম, তোমার অসুখের জন্য? তার মানে?

মামা বললেন, তার মানে বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছি। যিনি কিনেছেন পাশের বাড়িতেই থাকেন, মাঝখানের প্রাচীরটা ভেঙে দুটো বাড়ি এক করে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

আমি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললাম, এত কাণ্ড করলে মামা, আমাকে একবার জানালে না পর্যন্ত! করে যাওয়া ঠিক হল?

বাঁধা বিছানা আর তালাবন্ধ বাক্সের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মামা বললেন, আজ। রাত্রে ঢাকা মেলে রওনা হব। আমরা বাঙাল হে ভাগনে, জানো না বুঝি? বলে মামা হাসলেন। অবাক মানুষ! এমন অবস্থায় হাসিও আসে!

গম্ভীরভাবে উঠে দাঁড়িযে বললাম, আচ্ছা, আসি যতীন মামা, আসি মামি। বলে দরজার দিকে

অগ্রসর হলাম।

অতসী মামি উঠে এসে আমার হাতটা চেপে ধবে বললে, লক্ষ্মী ভাগনে, রাগ কোরো না। আগে থাকতে তোমায় খবর দিয়ে লাভ তো কিছু ছিল না, কেবল মনে ব্যথা পেতে। যে ভাগনে তুমি, কত কী হাঙ্গামা বাঁধিয়ে তুলতে ঠিক আছে কিছু?

আমি ফিরে গিয়ে বাঁধা বিছানাটার ওপর বসে বললাম, আজ যদি না আসতাম, একটা খবরও তো পেতাম না। কাল এসে দেখতাম, বাড়িঘর খাঁখাঁ করছে।

যতীন মামা বললেন, আরে রামঃ! তোমায় না বলে কি যেতে পারি? দুপুরবেলা সেনের ডাক্তারখানা থেকে ফোন করে দিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরলেই খবর পেতে|

বাড়ি আর গেলাম না। শিযালদহ স্টেশনে মামা-মামিকে উঠিয়ে দিতে গেলাম। গাড়ি ছাড়ার আগে কতক্ষণ সময় যে কী করেই কাটল! কারও মুখেই কথা নেই। যতীন মামা কেবল মাঝে মাঝে দু একটা হাসির কথা বলছিলেন এবং হাসাচ্ছিলেনও। কিন্তু তার বুকের ভেতর যে কী করছিল সে খবর আামার অজ্ঞাত থাকেনি।

গাড়ি ছাড়বার ঘণ্টা বাজলে যতীন মামা আর অতসী মামিকে প্রণাম করে গাড়ি থেকে নামলাম। এইবার যতীন মামা অন্যদিকে মুখ ফঋয়ে নিলেন। আর বোধ হয় মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখা তার পক্ষে সম্ভব হল মা!

জানাল দিয়ে মুখ বার করে মামি ডাকলে, শোনো। কাছে গেলাম। মামি বললে, তোমাকে ভাগনে বলি আর যাই বলি, মনে মনে জানি তুমি আমার ছোটো ভাই। পার তো একবার বেড়াতে গিয়ে দেখা দিয়ে এসো। আমাদের হয়তো আর কলকাতা আসা হবে না, জমির ভা্রী ক্ষতি হয়ে গেছে। যেও, কেমন ভাগনে?

মামির চোখ দিয়ে টপটপ করে জল ঝরে পড়ল। ঘাড় নেড়ে জানালাম, যাব।

বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি ছাড়ল। যতক্ষণ গাড়ি দেখা গেল অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। দূরের লাল সবুজ আলোকবিন্দুর ওপারে যখন একটি চলন্ত লাল বিন্দু অদৃশ্য হয়ে গেল তখন ফিরলাম। চোখের জলে দৃষ্টি তখন ঝাপসা হয়ে গেছে।

 

মানুষের স্বভাবই এই যখন যে দুঃখটা পায় তখন সেই দুঃখটাকেই সকলের বড়ো কবে দেখে। নইলে কে ভেবেছিল, যে যতীন মামা আর অতসী মামির বিচ্ছেদে একুশ বছর বয়সে আমার দুচোখ জলে ভরে গিয়েছিল সেই যতীন মামা আর অতসী মামি একদিন আমার মনের এক কোণে সংসারের সহস্ৰ আবর্জনার তলে চাপা পড়ে যাবেন।

জীবনে অনেকগুলি ওলট-পালট হয়ে গেল। যথাসময়ে ভাগ্য আমার ঘাড় ধরে যৌবনের কল্পনার সুখস্বৰ্গ থেকে বাস্তবের কঠোর পৃথিবীতে নামিয়ে দিল। নানা কারণে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ল। বালিগঞ্জের বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি করে ঋণ শোধ দিয়ে আশি টাকা মাইনের একটা চাকরি নিয়ে শ্যামবাজার অঞ্চলে ছোটো একটা বাড়ি ভাড়া করে উঠে গেলাম। মার কাঁদাকাটায় গলে একটা বিয়েও করে ফেললাম।

প্রথম সমস্ত পৃথিবীটাই যেন তেতো লাগতে লাগল, জীবনটা বিস্বাদ হয়ে গেল, আশা-আনন্দের এতটুকু আলোড়নও ভেতরে খুঁজে পেলাম না।

তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেল। নতুন জীবনে রসের খোঁজ পেলাম। জীবনের জুয়াখেলায় হারজিতের কথা কদিন আর মানুষ বুকে পুষে রাখতে পারে?

জীবনে যখন এই সব বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটছে তখন নিজেকে নিয়ে আমি এমনি ব্যাপৃত হয়ে পড়লাম যে কবে এক যতীন মামা আর অতসী মামির স্নেহ পরমসম্পদ বলে গ্রহণ করেছিলাম সে কথা মনে ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে গেল। সাত বছর পরে আজ ক্কচিৎ কখনও হয়তো একটা অস্পষ্ট স্মৃতির মতো তাদের কথা মনে পড়ে।

মাঝে একবার মনে পড়েছিল, যতীন মামাদের দেশে চলে যাওয়ার বছর তিনেক পরে। সেইবার ঢাকা মেলে কলিশন হয়। মৃতদের নামের মাঝে যতীন্দ্রনাথ রায় নামটা দেখে যে খুব একটা ঘা লেগেছিল সে কথা আজও মনে আছে। ভেবেছিলাম একবার গিয়ে দেখে আসব, কিন্তু হয়নি। সেদিন আপিস থেকে ফিরে দেখি আমার স্ত্রীর কঠিন অসুখ। মনে পড়ে যতীন মামার দেশের ঠিকানায় একটা পত্র লিখে দিয়ে এই ভেবে মনকে সান্তনা দিয়েছিলাম, ও নিশ্চয় আমার যতীন মামা নয়। পৃথিবীতে যতীন্দ্রনাথ রায়ের অভাব তো নেই। সে চিঠির কোনো জবাব আসেনি। স্ত্রীর অসুখের হিড়িকে কথাটাও আমার মন থেকে মুছে গিয়েছিল।

তারপর গড়িয়ে গড়িয়ে আরও চারটে বছর কেটে গেছে।

আমার ছোটো বোন বীণার বিয়ে হয়েছিল ঢাকায়।

পুজোর সময় বীণাকে তারা পাঠালে না। অগ্রহায়ণ মাসে বীণাকে আনতে ঢাকা গেলাম। কিন্তু আনা হল না। গিয়েই দেখি বীণার শাশুড়ির খুব অসুখ। আমি যাবার আগের দিন হু হু করে জ্বর এসেছে। ডাক্তার আশঙ্কা করছেন নিউমোনিয়া।

ছুটি ছিল না, ক্ষুন্ন হয়ে একাই ফিরলাম। গোয়ালন্দে স্টিমার থেকে নেমে ট্রেনের একটা ইন্টারে ভিড় কম দেখে উঠে পড়লাম। দুটি মাত্র ভদ্রলোক, এক-কোণে র‍্যাপার মুড়ি দেওয়া একটি স্ত্রীলোক, খুব সম্ভব এদের একজনের স্ত্রী, জিনিসপত্রের একান্ত অভাব। খুশি হয়ে একটা বেঞ্চিতে কম্বলের ওপর চাদর বিছিয়ে বিছানা করলাম। বালিশ ঠেসান দিয়ে আরাম করে বসে, পা দুটো কম্বল দিয়ে ঢেকে একটা ইংরেজি মাসিকপত্র বার করে ওপেনহেমের ডিটেকটিভ গল্পে মনঃসংযোগ করলাম।

যথাসময়ে গাড়ি ছাড়ল এবং পরের স্টেশনে থামল। আবার চলল। এটা ঢাকা মেল বটে, কিন্তু পোড়াদ পর্যন্ত প্রত্যেক স্টেশনে থেমে থেমে প্যাসেঞ্জার হিসাবেই চলে। পোড়াদ-র পর ছোটোখাটো স্টেশনগুলি বাদ দেয় এবং গতিও কিছু বাড়ায়।

গোয়ালদের পর গোটা তিনেক স্টেশন পার হয়ে একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতে ভদ্রলোক দুটি জিনিসপত্র নিয়ে নেমে গেলেন। স্ত্রীলোকটি কিন্তু তেমনিভাবে বসে রইলেন।

ব্যাপার কী? একে ফেলেই দেখছি সব নেমে গেলেন। এমন অন্যমনস্কও তো কখনও দেখিনি! ছোটোখাটো জিনিসই মানুষের ভুল হয়, একটা আস্ত মানুষ, তাও আবার একজনের অর্ধাঙ্গ, তাকে আবার কেউ ভুল করে ফেলে যায় নাকি?

জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম পিছনে দৃকপাত-মাত্র না করে তাঁরা স্টেশনের গেট পার হচ্ছেন। হয়তো ভেবেছেন, চিরদিনের মতো আজও স্ত্রীটি তার পিছু পিছু চলেছে।

চেঁচিয়ে ডাকলাম ও মশায়—মশায় শুনছেন?

গেটের ওপারে ভদ্রলোক দুটি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। বাঁশি বাজিয়ে গাড়িও ছাড়ল।

অগত্যা নিজের জায়গায় বসে পড়ে ভাবলাম, তবে কি ইনি একাই চলেছেন নাকি? বাঙালির মেয়ে নিশ্চয়ই, র‍্যাপার দিয়ে নিজেকে ঢাকবার কায়দা দেখেই সেটা বোঝা যায়। বাঙালির মেয়ে, এই রাত্রিবেলা নিঃসঙ্গ যাচ্ছে, তাও আবার পুরুষদের গাড়িতে!

একটু ভেবে বললাম, দেখুন, শুনছেন?

সাড়া নেই।

বললাম, আপনার সঙ্গীরা সব নেমে গেছে, শুনছেন?

এইবার আলোয়ানের পোঁটলা নড়ল, এবং আলোয়ান ও ঘোমটা সরে গিয়ে যে মুখখানা বার হল দেখেই আমি চমকে উঠলাম।

কিছু নেই, সে মুখের কিছুই এতে নেই। আমার অতসী মামির মুখের সঙ্গে এ মুখের অনেক তফাত। কিন্তু তবু আমার মনে হল, এ আমার অতসী মামিই!

মৃদু হেসে বললে, গলা শুনেই মনে হয়েছিল এ আমার ভাগনের গলা। কিন্তু অতটা আশা করতে পারিনি। মুখ বার কবতে ভয় হচ্ছিল, পাছে আশা ভেঙে যায়।

আমি সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, অতসী মামি!

মামি বললে, খুব বদলে গেছি, না?

মামির সিথিতে সিঁদুর নেই, কাপড়ে পাড়ের চিহ্নও খুঁজে পেলাম না।

চার বছর আগে ঢাকা-মেল কলিশনে মৃতদের তালিকায় একটা অতি পরিচিত নামের কথা মনে। পড়ল। যতীন মামা তবে সত্যিই নেই।

আস্তে আস্তে বললাম, খবরের কাগজে মামার নাম দেখেছিলাম মামি, বিশ্বাস হয়নি সে আমার যতীন মামা। একটা চিঠি লিখেছিলাম, পাওনি?

মামি বললে, না। তারপরেই আমি ওখান থেকে দু-তিন মাসের জন্য চলে যাই।

বললাম, কোথায়?

আমার এক দিদির কাছে। দূর সম্পর্কের অবশ্য।

আমায় কেন একটা খবর দিলে না মামি?

মামি চুপ করে রইল।

ভাগনের কথা বুঝি মনে ছিল না?

মামি বললে, তা নয়, কিন্তু খবর দিয়ে আর কী হত। যা হবাব তা তো হয়েই গেল। বাঁশিকে ঠেকিয়ে রাখলাম, কিন্তু নিয়তিকে তো ঠেকাতে পারলাম না। তোমার মেজোমামার কাছে তোমার কথাও সব শুনলাম, আমার দুর্ভাগ্য নিয়ে তোমায় আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। জানি তো, একটা খবর দিলেই তুমি ছুটে আসবে!

চুপ করে রইলাম। বলবার কী আছে। কী নিয়েই বা অভিমান করব? খবরেব কাগজে যতীন মামার নাম পড়ে একটা চিঠি লিখেই তো আমার কর্তব্য শেষ করেছিলাম।

মামি বললে, কী করছ এখন ভাগনে?

চাকরি। এখন তুমি যাচ্ছ কোথায়?

মামি বললে, একটু পরেই বুঝবে। ছেলেপিলে কটি?

আশ্চর্য! জগতে এত প্রশ্ন থাকতে এই প্রশ্নটাই সকলের আগে মামির মনে জেগে উঠল!

বললাম, একটি ছেলে।

ভারী ইচ্ছে করছে আমার ভাগনের খোকাকে দেখে আসতে। দেখাবে একবার? কার মতো হয়েছে? তোমার মতো, না তার মার মতো? কত বড়ো হয়েছে?

বললাম, তিন বছর চলছে। চলো না আমাদের বাড়ি মামি, বাকি প্রশ্নগুলির জবাব নিজের চোখেই দেখে আসবে?

মামি হেসে বললে, গিয়ে যদি আর না নড়ি?

বললাম, তেমন ভাগ্য কি হবে! কিন্তু সত্যি কোথায় চলেছ মামি? এখন থাক কোথায়?

মামি বললে, থাকি দেশেই। কোথায় যাচ্ছি, একটু পরে বুঝবে। ভালো কথা, সেই বাঁশিটা কী হল ভাগনে?

এইখানে আছে। এইখানে? এই গাড়িতে?

বললাম, হুঁ। আমার ছোটো বোন বীণাকে আনতে গিয়েছিলাম, সে লিখেছিল বাঁশিটা নিয়ে যেতে। সবাই নাকি শুনতে চেয়েছিল।

মামি বললে, তুমি বাজাতে জান নাকি? বার করো না বাঁশিটা?—

ওপর থেকে বাঁশির কেসটা পাড়লাম। বাঁশিটা বার করতেই মামি ব্যগ্র হাতে টেনে নিয়ে এক দৃষ্টিতে সেটার দিকে চেয়ে রইল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, বিয়ের পর এটাকে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলাম, মাঝখানে এর চেয়ে বড়ো শত্ৰু আমার ছিল না, আজ আবার এটাকে বন্ধু মনে হচ্ছে। শেষ তিনটা বছর বাঁশিটার জন্য ছটফট করে কাটিয়েছিলেন। আজ মনে হচ্ছে বাঁশি বাজানো ছাড়তে না বললেই হয়তো ভালো হত। বাঁশির ভেতর দিয়ে মরণকে বরণ করলে তবু শান্তিতে যেতে পারতেন। শেষ কটা বছর এত মনঃকষ্ট ভোগ করতে হত না।

বাঁশির অংশগুলি লাগিয়ে মামি মুখে তুলল। পরক্ষণে ট্রেনের ঝমঝমানি ছাপিয়ে চমৎকার বাঁশি বেজে উঠল। পাকা গুণীর হাতের স্পর্শ পেয়ে বাঁশি যেন প্রাণ পেয়ে অপূর্ব বেদনাময় সুরের জাল বুনে চলল।

আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ তো অল্প সাধনার কাজ নয়। যার তার হাতে বাঁশি তো এমন অপূর্ব কান্না কাঁদে না। মামির চক্ষু ধীরে ধীরে নিমীলিত হয়ে গেল। তার দিকে চেয়ে ভবানীপুরেব একটা অতি ক্ষুদ্র বাড়ির প্রদীপের স্বল্পালোকে বারান্দার দেয়ালে ঠেস দেওয়া এক সুর-সাধকের মূর্তি আমার মনে জেগে উঠল।

মাঝে সাতটা বছর কেটে গেছে। যতীন মামার যে অপূর্ব বাঁশির সুর একদিন শুনেছিলাম, সে সুর মনের তলে কোথায় হারিয়ে গেছে। আজ অতসী মামির বাঁশি শুনে মনে হতে লাগল সেই হারিয়ে যাওয়া সুরগুলি যেন ফিরে এসে আমার প্রাণে মৃদুগুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে।

এক সময়ে বাঁশি থেমে গেল। মামির একটা দীর্ঘনিশ্বাস ঝরে পড়ল। আমারও!

কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে বললাম, এ কথাটাও তো গোপন রেখেছিলে!

মামি বললে, বিয়ের পর শিখিয়েছিলেন। বাঁশি শিখবার কী আগ্রহই তখন আমার ছিল। তারপর যেদিন বুঝলাম বাঁশি আমার শত্ৰু সেইদিন থেকে আর ছুঁইনি। আজ কতকাল পরে বাজালাম। মনে হয়েছিল, বুঝি ভুলে গেছি!

ট্রেন এসে একটা স্টেশনে দাঁড়াল। মামি জানালা দিয়ে মুখ বার করে আলোর গায়ে লেখা স্টেশনের নামটা পড়ে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে বললে, পরের স্টেশনে আমি নেমে যাব ভাগনে।

পরের স্টেশনে! কেন?

মামি বললে, আজ কত তারিখ, জান?

বললাম, সতেরোই অঘ্রান।

মামি বললে, চার বছর আগে আজকের দিনে—বুঝতে পারছ না তুমি?

মুহুর্তে সব দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল। ঠিক! চার বছর আগে এই সতেরোই অঘ্রান ঢাকা মেলে কলিশন হয়েছিল। সেদিনও এমনি সময়ে এই ঢাকা মেলটির মতো সেই গাড়িটা শত শত নিশ্চিন্ত আরোহীকে পলে পলে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

বলে উঠলাম, মামি!

মামি স্থিরদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললে, সামনের স্টেশনের অল্প ওদিকে লাইনের ধারে কঠিন মাটির ওপর তিনি মৃতু্যযন্ত্রণায় ছটফট করেছিলেন। প্রত্যেক বছর আজকের দিনটিতে আমি ওই তীর্থদর্শন করতে যাই। আমার কাছে আর কোনো তীর্থের এতটুকু মূল্য নেই।

হঠাৎ জানালার কাছে সরে গিয়ে বাইরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে মামি বলে উঠল, ওই ওই ওইখানে! দেখতে পাচ্ছ না? আমি তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনি যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একটু স্নেহশীতল স্পর্শের জন্য ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন। একটু জল, একটু জলের জন্যেই হয় তো!–উঃ মাগো, আমি তখন কোথায়!

দু-হাতে মুখ ঢেকে মামি ভেতরে এসে বসে পড়ল।

ধীরে ধীরে গাড়িখানা স্টেশনের ভেতর ঢুকল।

বিছানাটা গুটিয়ে নিযে আমি বললাম, চলো মামি, আমি তোমার সঙ্গে যাব।

মামি বললে, না।

বললাম, এই রাত্রে তোমাকে একলা যেতে দিতে পারব না মামি।

মামির চোখ জ্বলে উঠল, ছিঃ! তোমার তো বুদ্ধির অভাব নেই ভাগনে। আমি কি সঙ্গী নিয়ে সেখানে যেতে পারি? সেই নির্জন মাঠে সমস্ত রাত আমি তার সঙ্গ অনুভব করি, সেখানে কি কাউকে নিয়ে যাওয়া যায়! ওইখানের বাতাসে যে তার শেষ নিশ্বাস রয়েছে! অবুঝ হয়ো না—

গাড়ি দাঁড়াল।

বাঁশিটা তুলে নিযে মামি বললে, এটা নিয়ে গেলাম ভাগনে! এটার ওপর তোমার চেয়ে আমার দাবি বেশি।

দরজা খুলে অতসী মামি নেমে গেলেন। আমি নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আবার বাঁশি বাজিয়ে গাড়ি ছাড়ল। খোলা দরজাটা একটা করুণ শব্দ করে আছড়ে বন্ধ হয়ে গেল।

আত্মহত্যার অধিকার

বর্ষাকালেই ভয়ানক কষ্ট হয়।

ঘরের চালটা একেবারে ঝাঁঝরা হইয়া গিয়াছে। কিছু নারিকেল আর তাল-পাতা মানসম্রম বজায় রাখিয়াই কুড়াইয়া সংগ্রহ করা গিয়াছিল। চালের উপর সেগুলি বিছাইয়া দিয়া কোনো লাভ হয় নাই। বৃষ্টি নামিলেই। ঘরের মধ্যে সর্বত্র জল পড়ে।

বিছানাটা গুটাইয়া ফেলিতে হয়, ভাঙা বাক্সপেটরা কয়টা এ কোণে টানিয়া আনিতে হয়, জামাকাপড়গুলি দড়ি হইতে টানিয়া নামাইয়া পুঁটলি করিয়া, কোথায় রাখিলে যে ভিজিবে কম, তাই নিয়া মাথা ঘামাইতে হয়।

বড় ছেলেটা কাঁচা ঘুম ভাঙিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করে। আদর করিয়া তাহার কান্না থামানো যায় না, ধমক দিলে কান্না বাড়ে। মেয়েটা বড় হইয়াছে, কাঁদে না; কিন্তু ওদিকের দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া এমন করিয়াই চাহিয়া থাকে যে নীলমণির ইচ্ছা হয় চড় মারিয়া ওকেও সে কাঁদাইয়া দেয়। এতক্ষণ ঘুমাইবার পর এক ঘণ্টা জাগিয়া বসিয়া থাকিতে হইল বলিয়া ও কী চাহনি? আকাশ ভাঙিয়া বৃষ্টি নামিয়াছে, ঘরের চাল সাত বছর মেরামত হয় নাই। ঘরের মধ্যে জল পড়াটা নীলমণির এমন কী অপরাধ যে মেয়েটা তাকে ও-রকম ভাবে নিঃশব্দে গঞ্জনা দিবে?

ছোট ছেলেটাকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া নিভা একবার এধার একবার ওধার করিয়া বেড়াইতেছিল।

হঠাৎ বলিল, ওগো, ছাতিটা একবার ধরো, একেবারে ভিজে গেল যে! লক্ষ্মী, ধরো একবার ছাতিটা খুলে। ওরও কি শেষে নিমুনিয়া হবে?

নীলমণি বলিল, হয়তো হবে। বাঁচবে।

নিভা বলিল, বালাই, ষাট।–শ্যামা, তুইও তো ধরতে পারিস ছাতিটা একটু?

শ্যামা নীরবে ভাঙা ছাতিটা নিভার মাথার উপর ধরিল। ছাতি মেলিবার বাতাসে প্রদীপের শিখাটা কাঁপিয়া গেল। প্রদীপে তেল পুড়িতেছে। অপচয়! কিন্তু উপায় নাই। চাল-ভেদ-করা বাদলে ঘর যখন ভাসিয়া যাইতেছে তখনকার বিপদে প্রদীপের আলোর একান্ত প্রয়োজন। জিনিসপত্র লইয়া মানুষগুলি একোণ ওকোণ করিবে কেমন করিয়া?

এক ছিলুম তামাক দে শ্যামা। নীলমণি হুকুম দিল।

শ্যামা বলিল, ছাতিটা ধরো তবে।

নীলমণি আকাশের বজ্রের মতো ধমকাইয়া উঠিল : ফেলে দে ছাতি, চুলোয় খুঁজে দে। আমি ছাতি ধরব তবে উনি তামাক সাজবেন, হারামজাদী!

তামাক অবিলম্বেই হাতের কাছে আগাইয়া আসিল। ঘরের পশ্চিম কোণ দিয়া কলের জলের মতো মোটা ধারায় জল পড়িয়া ইতিমধ্যেই একটা বালতি ভরিয়া গিয়াছে। সেই জলে হাত ধুইয়া শ্যামা বলিল, তামাক আর একটুখানি আছে বাবা।

দুঃসংবাদ!

এত বড় দুসংবাদ-প্রদানকারিণীকে একটা গাল দিবার ইচ্ছা নীলমণিকে অতি কষ্টে চাপিয়া যাইতে হইল।

নীলমণি ভাবিল : বিনা তামাকে এই গভীর রাত্রির লড়াই জিতিব কেমন করিয়া? ছেলের কান্না দুই কানে তীরের ফলার মতো বিধিয়া চলিবে, মেয়েটার মুখের চাহনি লঙ্কাবাটার মতো সারাক্ষণ মুখে লাগিয়া থাকিবে, নিমুনিয়ার সঙ্গে নিভার ব্যাকুল কলহ চাহিয়া দেখিতে দেখিতে শিহরিয়া শিহরিয়া মনে হইবে বাঁচিয়া থাকাটা শুধু আজ এবং কাল নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন–আর ঘরে এখন তামাক আছে একটুখানি।

তামাক আনানো হয় নাই কেন জিজ্ঞাসা করিতে গিয়া নীলমণি চুপ করিয়া রহিল। প্রশ্ন করা অনর্থক, জবাব সে পরশু হইতে নিজেই সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে–পয়সা নাই। ছেলেটা বিকালে এক পয়সার মুড়ি খাইতে পায় নাই–তামাকের পয়সা কোথা হইতে আসিবে! নিজে গেলে হয়তো দোকান হইতে ধার আনিতে পারি, কিন্তু

নীলমণি খুশি হয়। এতক্ষণে ছুতা পাওয়া গিয়াছে।

তামাক নেই বিকেলে বলিসনি কেন?

আমি দেখিনি বাবা।

দেখিনি বাবা! কেন দেখনি বাবা? চোখের মাথা খেয়েছিলে?

তুমি নিজে সেজেছিলে যে? সারাদিন আমি একবারও তামাক সাজিনি বাবা!

তা সাজবে কেন? বাপের জন্য তামাক সাজলে সোনার অঙ্গ তোমার ক্ষয়ে যাবে যে!

নীলমণির কান্না আসিতেছিল। মুখ ফিরাইয়া সহসা উদ্গত অঞ সে দমন করিয়া লইল। না আছে তামাক, না থাক। পৃথিবীতে তার কী-ই বা আছে যে তামাক থাকিলেই সব দুঃখ দূর হইয়া যাইত!

বাহিরে যেন অবিরল ধারে জল পড়িতেছে না, ঘরের বায়ু যেন সাহারা হইতে আসিয়াছে, নীলমণির চোখ-মুখ এত জ্বালা করিতেছিল। খানিকক্ষণ হইতে তাহার হাঁটুর উপর বড় বড় ফোঁটার জল পড়িতেছিল–টপ টপ। অঞ্জলি পাতিয়া নীলমণি গুনিয়া গুনিয়া জলের ফোঁটাগুলি ধরিতে লাগিল। সিদ্ধ-করা চামড়ার মতো ফ্যাকাশে ঠোঁট নাড়িয়া সে কী বলিল, ঘরের কেহই তাহা শুনিতে পাইল না। ছেলেমানুষের মতো তাহার জলের ফোঁটা সঞ্চয় করার খেলাটাও কেহ চাহিয়া দেখিল না। কিন্তু হাতে খানিকটা জল জমিলে তাই দিয়া মুখ ধুইতে গিয়া নীলমণি ধরা পড়িয়া গেল।

নিভা ও শ্যামা প্রতিবাদ করিল দুজনেই।

শ্যামা বলিল, ও কী করছ বাবা?

নিভা বলিল, পচা গলা চাল-ধোয়া জল, হ্যাগো, ঘেন্নাও কি নেই তোমার?

নীলমণি হঠাৎ একটু হাসিয়া বলিল, হোক না পচা জল। চাল-ধোয়া জল তো! এও হয়তো কাল জুটবে না নিভা!

ইহাকে সূক্ষ্ম রসিকতা মনে করিয়া নীলমণি নিজের মনে একটু গর্ব অনুভব করিল। এমন অবস্থাতেও রসিকতা করিতে পারে, মনের জোর তো তার সহজ নয়। ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলাইয়া আনিয়া নিভার মুখের দিকে পুনরায় চাহিতে গিয়া কিন্তু তার হাসি ফুটিল না। নিভার দৃষ্টির নির্মমতা তাকে আঘাত করিল।

অবিকল শ্যামার মতো চাহিয়া আছে! এত দুঃখ, এত দুর্ভাবনা ওর চোখের দৃষ্টিকে কোমল করিতে পারে নাই, উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিতে পারে নাই, রূঢ় ভর্ৎসনা আর নিঃশব্দ অসহায় নালিশে ভরিয়া রাখিয়াছে।

নীলমণি মুষড়াইয়া পড়িল।

সব অপরাধ তার। সে ইচ্ছা করিয়া নিজের স্বাস্থ্য ও কার্যক্ষমতা নষ্ট করিয়াছে, খাদ্যের প্রাচুর্যে পরিতুষ্ট পৃথিবীতে নিজের গৃহকোণে সে সাধ করিয়া দুর্ভিক্ষ আনিয়াছে, ঘরের চাল পচাইয়া ফুটা করিয়াছে সে, তারই ইচ্ছাতে রাতদুপুরে মুষলধারে বৃষ্টি নামিয়াছে। শুধু তাই নয়। ওদের সমস্ত দুঃখ দূর করিবার মন্ত্র সে জানে। মুখে ফিসফিস করিয়া হোক, মনে মনে নিঃশব্দে হোক, ফুসমন্তরটি একবার আওড়াইয়া দিলেই তার এই ভাঙা ঘর সরকারদের পাকা দালান হইয়া যায়, আর ঘরের কোণার ওই ভাঙা বাক্সটা চোখের পলকে মস্ত লোহার সিন্দুক হইয়া ভিতরে টাকা ঝমঝম করিতে থাকে–টাকার ঝমঝমানিতে বৃষ্টির ঝমঝমানি কোনোমতেই আর শুনিবার উপায় থাকে না।

কিন্তু মন্ত্রটা সে ইচ্ছা করিয়া বলিতেছে না।

.

ঘণ্টাখানেক এমনিভাবে কাটিয়া গেল।

নিভা এক সময় জিজ্ঞাসা করিল, হ্যাগো, রাত কত?

তা হবে, দুটো-তিনটে হবে।

একটা কিছু ব্যবস্থা করো! সারারাত জল না ধরলে এমনি বসে বসে ভিজব?

বসে ভিজতে কষ্ট হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভেজো।

নিভা আর কিছু বলিল না। ছেঁড়া আলোয়ানটি দিয়া কোলের শিশুকে আরো ভালো করিয়া ঢাকিয়া রুক্ষ চুলের উপর খসিয়া-পড়া ঘোমটাটি তুলিয়া দিল। স্বামীর কাছে মাথায় কাপড় দেওয়ার অভ্যাস সে এখনো কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই।

ছাতি ধরিয়া আর দাঁড়াইয়া থাকিতে না পারিয়া শ্যামা তার গা ঘেঁষিয়া বসিয়া পড়িয়াছিল, মধ্যে মধ্যে তার শিহরণটা নিভা টের পাইতে লাগিল।

কাঁপছিস কেন শ্যামা? শীত করছে?

শ্যামা কথা বলিল না। একটু মাথা নাড়িল মাত্র।

নিভা বলিল, তবে ভালো করেই ছাতিটা ধর বাবু, খোকার গায়ে ছিটে লাগছে।

আঁচল দিয়া সে খোকার মুখ মুছিয়া লইল। ফিসফিস করিয়া আপন মনে বলিল, কত জন্ম পাপ করেছিলাম, এই তার শাস্তি। নীলমণি শুনিতে পাইল, কিন্তু কিছু বলিল না। মন তার সজাগ, নির্মমভাবে সজাগ, কিন্তু চোখের পাতা দিয়া দুই চোখকে সে অর্ধেক আবৃত করিয়া রাখিয়াছে। দেখিলে মনে হয়, একান্ত নির্বিকার চিত্তেই সে ঝিমাইতেছে।

কিন্তু নীলমণি সবই দেখিতে পায়। তার স্তিমিত দৃষ্টিতে নিভার মুখে তেরচা হইয়া বাঁকিয়া যায়, প্রদীপের শিখাটা ফুলিয়া ফাপিয়া ওঠে, দেয়ালের গায়ে ছায়াগুলি সহসা জীবন পাইয়া দুলিয়া উঠিতে শুরু করে। মুখ না ফিরাইয়াই নীলমণি দেখিতে পায়, ঘরের ও-কোণে গুটাইয়া রাখা বিছানার উপর উপুড় হইয়া নিমু ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। বিরক্তির তার সীমা থাকে না। তার মনে হয় ছেলেটা তাকে ব্যঙ্গ করিতেছে। দুই পা মেঝের জলস্রোতে প্রসারিত করিয়া দিয়া আকাশের গলিত মেঘে অর্ধেকটা শরীর ভিজাইতে ভিজাইতে ওইটুকু ছেলের অমন করিয়া ঘুমাইয়া পড়ার আর কী মানে হয়? এর চেয়ে ও যদি নাকী সুরে টানিয়া টানিয়া শেষ পর্যন্ত কাঁদিতে থাকিত তাও নীলমণির ভালো ছিল। এ সহ্য হয় না। সন্ধ্যায় ও পেট ভরিয়া খাইতে পায় নাই; ক্ষুধার জ্বালায় মাকে বিরক্ত করিয়া পেটের জ্বালায় চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে ঘুমাইয়াছিল। হয়তো ওর রূপকথার পোষা বিড়ালটি এই বাদলে রাজবাড়ির ভালো ভালো খাবার ওকে চুরি করিয়া আনিয়া দিতে পারে নাই। হয়তো ঘুমের মধ্যেই ওর গালে চোখের জলের শুকনো দাগ আবার চোখের জলে ভিজিয়া গিয়াছিল। এত রাত্রে দুঃখের এই প্রকৃত বন্যায় ভাসিতে ভাসিতে ও তবে ঘুমায় কোন হিসাবে?

নিমুকে তুলে দে তো শ্যামা।

নিভা প্রতিবাদ করিয়া বলিল, কেন, তুলবে কেন? ঘুমোচ্ছে ঘুমোক।

ঘুমোচ্ছে না ছাই। ইয়ার্কি দিচ্ছে। ঢং করছে।

হ্যাঁ, ইয়ার্কি দিচ্ছে! ঢং করছে! যেমন কথা তোমার! ঢং করার মতো সুখেই আছে কিনা!

আধ-ঢাকা চোখ নীলমণি একেবারে বন্ধ করিয়া ফেলিল। ওরা যা খুশি করুক, যা খুশি বলুক। সে আর কথাটি কহিবে না।

খানিক পরে নিভা বলিল, দ্যাখো, এমন করে আর তো থাকা যায় না। সরকারদের বাইরের ঘরটাতে উঠিগে চলো।

নীলমণি চোখ না খুলিয়াই বলিল, না।

নিভা রাগ করিয়া বলিল, তুমি যেতে না চাও থাকো, আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি।

নীলমণি চোখ মেলিয়া চাহিল।

না–যেতে পাবে না। ওরা ছোটলোক। সেবার কী বলেছিল মনে নেই?

বললে আর করছ কী শুনি? রাতদুপুরে বিরক্ত করলে অমন সবাই বলে থাকে।

নীলমণি ব্যঙ্গ করিয়া বলিল, বলে থাকে? রাতদুপুরে বিপদে পড়ে মানুষ আশ্রয় নিতে গেলে বলে থাকে–এ কী জ্বালাতন? ওইটুকু শিশুর জন্য একটু শুকনো ন্যাকড়া চাইলে বলে থাকে কাপড়জামা সব ভিজে? ময়লা হবার ভয়ে ফরাশ তুলে নিয়ে ছেঁড়া শতরঞ্চি অতিথিকে পেতে দেয়?–যেতে হবে না। বাস।

নিভা অনেক সহ্য করিয়াছে। এবার তার মাথা গরম হইয়া গেল।

ছেলে মেয়ে বৌকে বর্ষাবাদলে মাথা গুঁজবার ঠাঁই দিতে পারে না, অত মান-অপমান-জ্ঞান কী জন্যে? আজ বাদে কাল ভিক্ষে করতে হবে না?

নীলমণি বলিল, চুপ।

এক ধমকেই নিভা অনেকখানি ঠাণ্ডা হইয়া গেল।

চুপ করেই আছি চিরটা কাল। অন্য মানুষ হলে—

হাতের কাছে, ঘটিটা তুলিয়া লইয়া নীলমণি বলিল, চুপ। একদম চুপ। আর একটি কথা কইলে খুন করে ফেলব।

কথা কেউ বলছে না। নিভা একেবারে নিভিয়া গেল।

শ্যামা ঢুলিতে আরম্ভ করিয়াছিল, বাপের গর্জনে সে চমকাইয়া সজাগ হইয়া উঠিল। কান পাতিয়া শুনিয়া বলিল, মা, ভুলু দরজা আঁচড়াচ্ছে।

গরিবের মেয়ে, হা-ঘরের বৌ, নিভার মেরুদণ্ড বলিতে কিছু অবশিষ্ট ছিল না, কিন্তু তার বদলে যা ছিল নিরপরাধ মেয়ের উপর ঝাঝিয়া উঠিবার পক্ষে তাই যথেষ্ট।

আঁচড়াচ্ছে তো কী হবে? কোলে তুলে নিয়ে এসে নাচ!–ভালো করে ছাতি ধরে থাক শ্যামা, মেরে পিঠের চামড়া তুলে দেব।

নীলমণি বলিল, আমার লাঠিটা কই রে?

শ্যামার মুখ পাংশু হইয়া গেল। সে মিনতি করিয়া বলিল, মেরো না বাবা। দরজা খুললে ও আপনি চলে যাবে।

তোকে মাতব্বরি করতে হবে না, বুঝলি? চুপ করে থাক। বাঁ পা-টি আংশিকভাবে অবশ, হাতে ভর দিয়া নীলমণি কষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘরের কোণায়। তার মোটা বাঁশের লাঠিটা ঠেস দেওয়া ছিল, খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে গিয়া লাঠিটা সে আয়ত্ত করিল। উঠানবাসী লোমহীন নির্জীব কুকুরটার উপর তার সহসা এত রাগ হইয়া গেল কেন কে জানে। বেচারি খাইতে পায় না, কিন্তু প্রায়ই অদৃষ্টে প্রহার জোটে, তবু সে এখানেই পড়িয়া থাকে, সারারাত শিয়াল তাড়ায়। শ্যামা একটু করুণার চোখে না দেখিলে এত দিনে ওর অক্ষয় স্বর্গলাভ হইয়া যাইত। কিন্তু নীলমণি কুকুরটাকে দেখিতে পারে না। পুঁকিতে ধুকিতে লাথিঝাটা খাইয়া মৃত্যুর সঙ্গে ওর লজ্জাকর সকরুণ লড়াই চাহিয়া দেখিয়া তার ঘৃণা হয়, গা জ্বালা করে।

শ্যামা আবার বলিল, মেরো না বাবা, আমি তাড়িয়ে দিচ্ছি।

নীলমণি দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিল, মারব? মার খেয়ে আজ রেহাই পাবে ভেবেছিস? আজ ওর ভব-যন্ত্রণা দূর করে ছাড়ব।

ভব-যন্ত্রণা নিঃসন্দেহ, কিন্তু শ্যামা শুনিবে কেন? পেটের ক্ষুধায় এখনো তার কান্না। আসে, ছেঁড়া কাপড়ে তার সর্বাঙ্গ লজ্জায় সঙ্কুচিত হইয়া থাকে; তার বুকে ভাষা আছে, মনে আশা আছে। ভব-যন্ত্রণা সহ্য করিতে তার শক্তির অকুলান হয় না, বরং একটু বাড়তিই হয়। ওইটুকু শক্তি দিয়া সে বর্তমান জীবন হইতেও রস নিংড়াইয়া বাহির করে–হোক পানসা, এও তুচ্ছ নয়। ভুলুর মতো কুকুরটিকেও মারিবার অথবা তাকে মারিবার কল্পনা শ্যামার কাছে বিষাদের ব্যাপার। তার সহ্য হয় না।

ছাতি ফেলিয়া উঠিয়া আসিয়া শ্যামা নীলমণির লাঠি ধরিল। কাঁদিবার উপক্রম করিয়া বলিল, না বাবা, মেরো না বাবা, তোমার পায়ে পড়ি বাবা!

নীলমণি গর্জন করিয়া বলিল, লাঠি ছাড় শ্যামা, ছেড়ে দে বলছি। তোকেই খুন করে ফেলব আজ।

শ্যামা লাঠি ছাড়িল না। তারও কি মাথার ঠিক আছে? লাঠি ধরিয়া রাখিয়াই সে বারবার নীলমণির পায়ে পড়িতে লাগিল।

নিভা বলিল, কী জিদ মেয়ের! ছেড়েই দে না বাবু লাঠিটা।

রাগে কাঁপিতে কাপিতে নীলমণি বলিল, জিদ বার করছি।

লাঠিটা নীলমণিকে মেয়ের হাতে ছাড়িয়া দিতে হইল; কিন্তু বেড়ার ঘরের বেড়ার অনেকগুলি বাতাই আলগা ছিল।

.

মেয়েকে মারিয়া নীলমণির মন এমন খারাপ হইয়া গেল বলিবার নয়। না মারিয়া অবশ্য উপায় ছিল না। ও-রকম রাগ হইলে সে কখনো সামলাইতে পারে নাই, কখনো পারিবেও না। মন খারাপ হওয়ার কারণটাও হয়তো ভিন্ন। কে বলিতে পারে? মেয়েকে না মারিয়াও তো মাঝে মাঝে তার মরিতে ইচ্ছা করে!

জীবনে লজ্জা, দুঃখ, রোগ, মৃত্যু, শোকের তো অভাব নেই। মন খারাপ হইবার কারণ জাগিয়া থাকার প্রত্যেকটি মুহূর্তে এবং ঘুমানোর সময় দুঃস্বপ্নে!

কয়েক মিনিট আগে বৃষ্টি একটু ধরিয়া আসিয়াছিল; হঠাৎ আবার আগের চেয়েও জোরে আরম্ভ হইয়া গেল। নীলমণির মান-অপমান জ্ঞানটা এবার আর টিকিল না।

লণ্ঠনে তেল আছে শ্যামা?

শ্যামা একবার ভাবিল চুপ করিয়া থাকিয়া রাগ আর অভিমান দেখায়। কিন্তু সাহস পাইল না।

একটুখানি আছে বাবা।

জ্বাল তবে।

নিভা জিজ্ঞাসা করিল, লণ্ঠন কী হবে?

সরকারদের বাড়ি যাব। ফের চেপে বৃষ্টি এল দেখছ না?

যেন, সরকারদের বাড়ি যাইতে নিভাই আপত্তি করিয়াছিল।

শ্যামা বলিল, দেশলাই কোথা রাখলে মা?

নিভা বলিল, দেশলাই? কেন, পিদিম থেকে বুঝি লণ্ঠন জ্বালানো যায় না? চোখের সামনে পিদিম জ্বলছে, চোখ নেই?

নীলমণি বলিল, ওর কি জ্ঞান-গম্মি কিছু আছে?

নিজের মুখের কথাগুলি খচখচ করিয়া মনের মধ্যে বেঁধে। এ যেন তোতাপাখির মতো অভাবগ্রস্তের মানানসই মুখস্থ বুলি আওড়ানো। বলিতে হয় তাই বলা; না বলিলে চলে না সত্য; কিন্তু আসলে বলিয়া কোনো লাভ নাই।

সাত বছরের পুরনো লণ্ঠন জ্বালানো হইল।

নিভা মাথা নাড়িয়া বলিল, না বাবু, ছাতিতে আটকাবে না। আর একখানা কাপড় জড়িয়ে নি। দে তো শ্যামা, শুকনো কিছু দে তো। আর এক কাজ কর–দুটো-তিনটে কাপড় পুঁটলি করে নে। ওখানে গিয়ে সবাইকে কাপড় ছাড়তে হবে। আমার দোক্তার কৌটো নিস।

নীলমণি একটু মিষ্টি করিয়াই বলিল, হুঁকোটা নিতে পারবি শ্যামা? লক্ষ্মী মা আমার–পারবি? জল ফেলেই নে না, ওখানে গিয়ে ভরে নিলেই হবে। জলের কি অভাব?–তামাকটুকু ফেলে যাস নে ভুলে।

সব ব্যবস্থাই হইল, নিমুর কান্নায় কর্ণপাত না করিয়া তাকে টানিয়া হেঁচড়াইয়া দাঁড় করাইয়া দিয়া পিঠে একটা ছেঁড়া চটের বস্তা চাপাইয়া দেওয়া হইল।

দরজা খুলিয়া তারা উঠানে নামিয়া গেল। উত্তরের ভিটার ঘরখানা গত বৎসরও খাড়া ছিল, এবারকার চতুর্থ বৈশাখী ঝড়ে পড়িয়া গিয়াছে; সময়মতো অন্তত দুটি খুঁটি বদলাইতে পারিলেও এটা ঘটিত না। ভুলু বোধ হয় ওই ভগ্নস্তূপের মাঝেই কোথাও। মাথা গুঁজিয়া ছিল, মানুষের সাড়া পাইয়া বাহির হইয়া আসিল। তখন ঘরের দরজায় তালা লাগানো হইয়া গিয়াছে। দরজা আঁচড়াইয়া ভুলু সকরুণ কান্নার সঙ্গে কুকুরের ভাষায় বলিতে লাগিল–দরজা খোলো, দরজা খোলো।

বাড়ির সামনে একহাঁটু কাদা, তার পরেই পিছলে এঁটেল মাটি। ছেলে লইয়া আছাড় খাইতে খাইতে বাঁচিয়া গিয়া নিভা দেবতাকেই গাল দিতে আরম্ভ করিয়া দিল। কষ্ট নীলমণিরই বেশি; শুকনো ডাঙাতেই বা পায়ের পদক্ষেপটি তাকে চট করিয়া ডিঙাইয়া যাইতে হয়–এখন তার পা আর লাঠি দুই কাদায় ঢুকিয়া যাইতে লাগিল।

লাঠি টানিয়া তুলিলে পা আটকাইয়া থাকে, পা তুলিলে লাঠি পোঁতা হইয়া যায়। নিভার তাকাইবার অবসর নাই। শ্যামার ঘাড়ে কাপড়ের পুঁটলি, হুঁকা কলকি, লণ্ঠন আর নিমুর ভার। তবু শ্যামাই নীলমণির বিপদ উদ্ধার করিয়া দিতে লাগিল।

ঘোষেদের পুকুরটা পাক দিলে সরকারদের বাড়ি। পুকুরটা ভরিয়া গিয়া পাড় ছাপাইয়া উঠিয়াছে। পশ্চিম কোণার প্রকাণ্ড তেঁতুলগাছটার তলা দিয়া তিন-চারি হাত। চওড়া এক সংক্ষিপ্ত স্রোতস্বিনী সৃষ্টি হইয়াছে। তেঁতুলগাছটার জমকালো আবছা চেহারা দেখিলে গা ছমছম করে। ভরপুর পুকুরের বুকে শ্যামার হাতের আলো যে লম্বা সোনালি পাত ফেলিয়াছে, প্রত্যেক মুহূর্তে হাজার বৃষ্টির ফোঁটায় তাহা অজস্র। টুকরায় ভাঙিয়া যাইতেছে।

নীলমণি থমকিয়া দাঁড়াইল। কাতর স্বরে বলিল, ও শ্যামা, পার হব কী করে!

শ্যামা বলিল, জল বেশি নয় বাবা, নিমুর হাঁটু পর্যন্তও ওঠে নি। চলে এসো।

সুখের বিষয় স্রোতের নিচে কাদা ধুইয়া গিয়াছিল, নীলমণির পা অথবা লাঠি আঁটিয়া গিয়া তাকে বিপন্ন করিল না, তবু এতখানি সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও, নীলমণির দুচোখ একবার সজল হইয়া উঠিল। বাহির হওয়ার সময় সে কাপড়টা গায়ে জড়াইয়া লইয়াছিল, এখন ভিজিয়া গায়ের সঙ্গে আঁটিয়া গিয়াছে। খানিকক্ষণ হইতে জোর বাতাস উঠিয়াছিল, নীলমণির শীত করিতে লাগিল। জগতে কোটি কোটি মানুষ যখন উষ্ণ শয্যায় গাঢ় ঘুমে পাশ ফিরিয়া পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিতেছে–সপরিবারে অক্ষম দেহটা টানিয়া টানিয়া সে তখন চলিয়াছে। কোথায়? যে-প্রকৃতির অত্যাচারে ভাঙা ঘরে টিকিতে না পারিয়া তাকে আশ্রয়ের খোঁজে পথে নামিয়া আসিতে হইল, সেই প্রকৃতিরই দেওয়া নির্মমতায় হয়তো সরকাররা দরজা খুলিবে না, ঘুমের ভান করিয়া বিছানা আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে। না, নীলমণি আর যুঝিয়া উঠিতে পারিল না। তার শক্তি নাই, কিন্তু আক্রমণ চারিদিক হইতে; পেটের ক্ষুধা, দেহের ক্ষুধা, শীত, বর্ষা, রোগ বিধাতার অনিবার্য জন্মের বিধান–সে কোন দিক সামলাইবে? সকলে যেখানে বাঁচিতে চায়, লাখ মানুষের জীবিকা একা জমাইতে চায়, কিন্তু কাহাকেও বাঁচাইতে চায় না, সেখানে সে বাঁচিবে কিসের জোরে?

স্রোত পার হইয়া গিয়া লণ্ঠনটা উঁচু করিয়া ধরিয়া শ্যামা দাঁড়াইয়া আছে। পাশেই ভরাট পুকুরটা বৃষ্টির জলে টগবগ করিয়া ফুটিতেছে। নীলমণি সাঁতার জানিত না। কিন্তু জানিত যে পুকুরের পাড়টা এখানে একেবারে খাড়া! একবার গড়াইয়া পড়িলেই অথই জল, আর উঠিয়া আসিতে হইবে না।

নিভা তাড়া দিতেছিল। শ্যামা বলিল, বাবা, চলে এসো। দাঁড়ালে কেন?

নীলমণি চলিতে আরম্ভ করিল; ডাইনে নয় বাঁয়েও নয়। সাবধানে, সোজা শ্যামার দিকে।

হঠাৎ শ্যামা চিৎকার করিয়া উঠিল, মাগো, সাপ!

পরক্ষণে আনন্দে গদগদ হইয়া বলিল, সাপ নয় গো সাপ নয়, মস্ত শোল মাছ! ধরেছি ব্যাটাকে। ইঃ, কী পিছল!

তাড়াতাড়ি আগাইবার চেষ্টা করিয়া নীলমণি বলিল, শক্ত করে ধর, দুহাত দিয়ে ধর–পালালে কিন্তু মেরে ফেলব শ্যামা!

.

সরকাররা বছর তিনেক দালান তুলিয়াছে। এখনো বাড়িসুদ্ধ সকলে বাড়ি বাড়ি করিয়া পাগল। বলে, বেশ হয়েছে, না? দোতলায় দুখানা ঘর তুললে, বাস, আর দেখতে হবে না।

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর সরকারদের বড় ছেলে বাহিরের ঘরের দরজা খুলিল। বলিল, ব্যাপার কী? ডাকাত নাকি?

নীলমণি বলিল, না ভাই, আমরা। ঘরে তো টিকতে পারলাম না ভায়া, সব ভেসে গেছে। ভাবলাম তোমাদের বৈঠকখানায় তো কেউ শোয় না, রাতটুকু ওখানেই কাটিয়ে আসি।

বড় ছেলে বলিল, সন্ধ্যাবেলা এলেই হত!

নীলমণি কষ্টে একটু হাসিল : সন্ধ্যায় কি বৃষ্টি ছিল ভাই? দিব্যি ফুটফুটে আকাশ–মেঘের চিহ্ন নেই। রাতদুপুরে হঠাৎ জল আসবে কে জানত।

নিভা ছাতি বন্ধ করিয়া ঘোমটা দিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, মাসিকের ছবির সদ্যস্নাতার অবস্থায় পড়িয়া শ্যামা লজ্জায় মার অঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। নিভার এটা ভালো লাগিতেছিল না। কিন্তু বড় ছেলের সামনে কিছু বলিবার উপায় নাই।

বড় ছেলে বলিল, বেশ থাকুন। কিন্তু চৌকি পাবেন না, চৌকিতে আমার পিসে শুয়েছে। আপনাদের মেঝেতে শুতে হবে।

তা হোক ভাই, তা হোক। ভিজতে না হলেই ঢের। একখান কম্বল-টম্বল—

ওই কোণে চট আছে।

বড় ছেলে বাড়ির মধ্যে চলিয়া গেল।

নীলমণি ঝাঁজালো হাসি হাসিয়া বলিল, দেখলে? তখনি বলেছিলাম শুধু মারতে বাকি রাখবে।

নিভা বলিল, ঘরে যে থাকতে দিয়েছে তাই ভাগ্যি বলে জেনো!

নীলমণি তৎক্ষণাৎ সুর বদলাইয়া বলিল, তা ঠিক।

ঘরে অর্ধেকটা জুড়িয়া চৌকি পাতা, বড় ছেলের পিসে আগাগোড়া চাদর মুড়ি দিয়া তাহাতে কাত হইয়া শুইয়া আছে। শ্যামা লণ্ঠনটা মেঝেতে নামাইয়া রাখিয়াছিল বলিয়া চৌকির উপরে আলো পড়ে নাই, তবু এ বাড়ির আত্মীয়কেও ফরাশ তুলিয়া লইয়া শুধু শতরঞ্চির উপর শুইতে দেওয়া হইয়াছে, এটুকু টের পাইয়া নীলমণি একটু খুশি হইল। বড় ছেলের পিসে! আপনার লোক। সে যদি ও-রকম ব্যবহার পাইয়া থাকে তবে তারা যে লাথিঝটা পায় নাই, ইহাই আশ্চর্য!

.

চারিদিকে চাহিয়া নীলমণির খুশির পরিমাণ বৃদ্ধি পাইল। সুখশয্যা না জুটুক, নিবাত, শুষ্ক, মনোরম আশ্রয় তো জুটিয়াছে। ঘরের এদিকে একটিমাত্র ছোট জানালা খোলা ছিল, নিভা ইতিমধ্যেই সেটি ভালো করিয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছে। বাস, বাহিরের সঙ্গে আর তাদের কোনো সম্পর্ক নাই। আকাশটা আজ এক রাত্রেই গলিয়া নিঃশেষ হইয়া যাক, ঝড় উঠুক, শিল পড়ুক, পৃথিবীর সমস্ত খড়ের ঘরগুলি ভাঙিয়া পড়ুক–তারা টেরও পাইবে না।

নীলমণির মেজাজ যেন ম্যাজিকে ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। তার কণ্ঠস্বর পর্যন্ত মোলায়েম শোনাইল।

ও শ্যামা, দাঁড়িয়ে থাকিস নি মা, চটগুলি বিছিয়ে দে চট করে। একটু গড়াই। আহা, ভিজে কাপড়টা ছেড়েই নে আগে, মারামারির কী আছে। এতক্ষণই গেল না। হয় আরো খানিকক্ষণ যাবে। ওগো, শুনছ। দাও না, খোকাকে চৌকির একপাশেই একটু শুইয়ে দাও না, দিয়ে তুমিও কাপড়টা ছেড়ে ফেল। গলা নামাইয়া ফিসফিস করিয়া বলিল, ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন, অত লজ্জাটা কিসের শুনি? লজ্জা করলে দরজা খুলে বারান্দায় চলে যাও না!

কাপড় ছাড়া হইল। বাহিরে এখন পুরাদমে ঝড় উঠিয়াছে। ঘরের কোথাও এতটুকু ছিদ্র নাই, কিন্তু বাতাসের কান্না শোনা যায়, চাপা একটানা শাঁ শাঁ শব্দ। তাদের নীলমণি আর তার পরিবারকে, নাগালের মধ্যে না পাইয়া প্রকৃতি যেন ফুঁসিতেছে।

নীলমণির মনে হইল, এ একরকম শাসানো! পঞ্চভূতের মধ্যে যার ভাষা আছে সে ক্রুব্ধ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিতেছে, আজ বাঁচিয়া গেলে। কিন্তু কাল? কাল কী করিবে? পরশু? তার পরদিন? তারও পরের দিন।

শ্যামা চট বিছাইতেছিল, মাগো কী গন্ধ!

নিভা বলিল, নে, ঢং করতে হবে না, তাড়াতাড়ি কর।

নীলমণি বলিল, ঝেড়ে ঝেড়ে পাত না।

নিভা বলিল, না না, ঝাড়িস নি। ধুলোয় চাদ্দিক অন্ধকার হয়ে যাবে।

নিভা ছেলেকে স্তন দিতেছিল, কথাটা শেষ করিয়াই সে দমক মারিয়া চৌকির দিকে পিছন করিয়া বসিল।

নীলমণি চাহিয়া দেখিল, বড় ছেলের পিসে চাদর ফেলিয়া চৌকিতে উঠিয়া বসিয়াছে। লণ্ঠনের স্তিমিত আলোয় পিসের মূর্তি দেখিয়া নীলমণি শিহরিয়া উঠিল। একটা শব যেন সহসা বাঁচিয়া উঠিয়াছে। মাথার চুল প্রায় ন্যাড়া করিয়া দেওয়ার মতো ছোট ছোট করিয়া ছাঁটা, চোখ যেন অর্ধেকটা ভিতরে চলিয়া গিয়াছে, গালের ঢিলা চামড়ার তলে হাড় উঁচু হইয়া আছে। বুকের সবগুলি পাঁজর চোখ বুজিয়া গোনা যায়। বুকের বাঁ পাশে কি ঠিক চামড়ার নিচেই হৃৎপিণ্ডটা ধুকধুক করিতেছে।

পিসে নিশ্বাসের জন্য হাঁপাইতেছিল। খানিক পরে ক্ষীণস্বরে বলিল, একটা জানালা খুলে দিন।

নীলমণি সভয়ে বলিল, দে তো শ্যামা, জানালাটা খুলে দে।

শ্যামা আরো বেশি ভয়ে ভয়ে বলিল, ঝড় হচ্ছে যে বাবা!

হোক, খুলে দে।

শ্যামা পশ্চিমের ছোট জানালাটি খুলিয়া দিল। ঝড় পুবদিক হইতে বহিতেছিল, মাঝে মাঝে এলোমেলো একটু বাতাস আর ছিটেফোঁটা একটু বৃষ্টি ঘরে ঢোকা ছাড়া জানালাটি খুলিয়া দেওয়ার বিশেষ কোনো মারাত্মক ফল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু ভীরু নিভা ছেলের গায়ে আর-এক পরত কাপড় জড়াইয়া দিল।

পিসে বলিল, ঘুমের ঘোরে কখন চাদর মুড়ি দিয়ে ফেলেছি, আর একটু হলেই দম আটকাত! বাপ!

নীলমণি জিজ্ঞাসা করিল, আপনার অসুখ আছে নাকি? পিসে ভর্ৎসনার চোখে চাহিয়া বলিল, খুব মোটাসোটা দেখছেন বুঝি? অসুখ না থাকলে মানুষের এমন চেহারা হয়? চার বছর ভুগছি মশায়, মরে আছি একেবারে। যম ব্যাটাও কানা, এত লোককে নিচ্ছে, আমায় চোখে দেখতে পায় না। যে কষ্টটা পাচ্ছি মশায় শত্রুও যেন—

ব্যাপারটা কী?

পিসে রাগিয়া বলিল, টের পান না? এমন করে শ্বাস টানছি দেখতে পান না? পাবেন কেন, আপনার কী। যার হয় সে বোঝে।

বোঝা গেল, পিসের মেজাজটা খিটখিটে।

নীলমণি ভাবে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, আহা, সেরে যাবে, ভালোমতো চিকিচ্ছে। হলেই সেরে যাবে।

পিসে বলিল, হুঁ, সারবে। আমকাঠের তলে গেলে সারবে। চিকিচ্ছের কি আর কিছু বাকি আছে মশায়? ডাক্তার কবরেজ জলপড়া–কিচ্ছুটি বাদ যায়নি। আজ চার বছর ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খাচ্ছি, কোনো ব্যাটা সারাতে পারল!

কথার মাঝে মাঝে পিসে হাপরের মতো শ্বাস টানে, এক-একবার থামিয়া গিয়া ডাঙায় তোলা মাছের মতোই চোখ কপালে তুলিয়া খাবি খায়। নীলমণির গায়ে কাঁটা দিতে লাগিল। বাতাস। পৃথিবীতে কত বাতাস! তবুও ফুসফুস ভরাইতে পারে না। অন্নপূর্ণার ভাণ্ডারে সে উপবাসী, পঞ্চাশ মাইল গভীর বায়ুস্তরে ডুবিয়া। থাকিয়া ওর দম আটকাইল।

পিসে বলিল, কী করে জানেন? বলে, ভয় কী, সেরে যাবে। বলে, সবাই টাকা নেয় চিকিৎসে করে, শেষে বলে, না বাপু, তোমার সারবে না, এসব ব্যারাম সারে না। আমি বলি, ওরে চোর ডাকাত ছুঁচোর দল! সারাতে পারবি না তো মেরে ফ্যাল, দে, মরবার ওষুদ দে।

উত্তেজনায় পিসে জোরে জোরে হাঁপাইতে লাগিল। নীলমণি কথা বলিল না, তার বিদ্রি আরক্ত চোখ দুটি কেবলি মিটমিট করিয়া চলিল।

তেল কমিয়া আসায় আলোটা দপদপ করিতেছে, এখনই নিবিয়া যাইবে। ছেলেকে বুকে জড়াইয়া হাতকে বালিশ করিয়া নিভা দুর্গন্ধ চটে কাত হইয়া শুইয়া পড়িয়াছে। শ্যামা বসিয়া বসিয়া ঝিমাইতেছে।

নীলমণির হুঁকা-কলকি শ্যামা জানালায় নামাইয়া রাখিয়াছিল। আলোটা নিবি য়া যাওয়ার আগে নীলমণি বাকি তামাকটুকু সাজিয়া লইল। তারপর ঠেস দিয়া আরাম করিয়া পিসের শ্বাস টানার মতো শাঁ শাঁ করিয়া জলহীন হুঁকায় তামাক টানিতে লাগিল।

 আপিম

আজ সকালে বাজারে যাওয়ার লোকের অভাব ঘটিয়াছে। বাজার প্রতিদিন একরকম নরেন নিজেই করে, আজ সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া সে একগাদা আপিসের কাগজপত্র লইয়া বসিয়াছে। অথচ বাজারে একজনকে পাঠাইতে হইবে। আপিস আছে, স্কুল-কলেজ আছে, কিছু মাছ-তরকারি না আনাইলে চলিবে কেন? ব্যস্ত ও ব্ৰিত স্বামীর মুখ দেখিয়া মায়ার বড়ই মমতাবোধ হইল, বাজারের কথাটা না তুলিয়াই সে সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া গেল ছাতে।

ছাতের ঘুপচি-ঘরখানায় থাকে বিমল, সংসারের সমস্ত গণ্ডগোলের উর্ধ্বে থাকিয়া সে কলেজের পড়া করে। বিমল তখনো ঘুমাইতেছিল। বেলা আটটার আগে কোনোদিনই তার ঘুম ভাঙে না। ছোট কেরোসিন-কাঠের টেবিলটিতে গাদা করা বই-খাতা আর ইংরেজি-বাংলা মাসিকপত্র; বিছানাতেও কয়েকটা বই পড়িয়া আছে। মাথার কাছে একটা বার্লির কৌটা, দেশলাইয়ের কাঠি, পোড়া সিগারেটের টুকরা আর ছাইয়ে প্রায় ভর্তি হইয়া গিয়াছে, বিছানা পাতিয়া মেঝের যেটুকু ফাঁকা আছে সেখানেও এইসব আবর্জনাই বেশি।

এসব মায়ার নজরে পড়িল না, এতবড় ছেলে সিগারেট খাইবে সেটা আর এমন কী দোষের ব্যাপার? মায়ার শুধু চোখে পড়িল ঘুমন্ত ছেলের ক্লিষ্ট মুখোনি। আহা, কত রাত জাগিয়া না জানি ছেলে তার পড়িয়াছে! আজ যেমন করিয়াই হোক ওকে একটু বেশি দুধ খাওয়াইতেই হইবে। ভাশুরের দুধ যদি একটু কমাইয়া দেওয়া যায়–আপিম খায় বলিয়াই একজন রোজ একবাটি দুধ খাইবে আর এত খাঁটিয়া তার ছেলের যথেষ্ট দুধ জুটিবে না? যে ছেলে একদিন….

সেইখানে দাঁড়াইয়া মায়া হয়তো ছেলের ভবিষ্যতের এবং সেই সঙ্গে জড়ানো নিজের ও নিজের এই সংসারের ভবিষ্যতের স্বপ্নে কিছুক্ষণের জন্য বিভোর হইয়া থাকিত, গোঙানির মতো আওয়াজ করিয়া বিমল পাশ ফেরায় স্বপ্ন-দেখা তখনকার মতো স্থগিত রাখিতে হইল।

কাল যে ইংরেজি নভেলখানা পড়িতে পড়িতে বিমল ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক পিঠের নিচে সেই বইখানাই অনেকক্ষণ তার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করিতেছিল। মায়া ডাকিতেই সে জাগিয়া গেল।

বাজার? চা-টা খাইয়া একবার বাজার যাইতে হইবে? মস্ত একটা হাই তুলিয়া মাথা নাড়িয়া বিমল বলিল, আমি পারব না।

মায়া তা জানে। বিমল কোনোদিন বাজারে যায় না, বাজারে গেলে তার বিশ্রী লাগে, কেমন যেন লাগে, বড় খারাপ লাগে। তবু মায়া আর একবার চেষ্টা করিয়া দেখিল, কাকে পাঠাব তবে? আজকের মতো একবারটি যা লক্ষ্মী, উনি আপিসের কাজ নিয়ে বসেছেন, নইলে–

বিমল আবার মাথা নাড়িল, উঁহু, বাজার-টাজার আমার দ্বারা হবে না মা, বল তো দশবার গিয়ে দোকান থেকে জিনিস এনে দিচ্ছি; বাজারে ঢুকে মাছ, তরকারি কিনতে পারব না।

মায়া ফিরিয়া গেল। তাই হোক, কোনোদিন যেন ছেলেকে তার নিজে বাজার করিতে যাইতে না হয়, শুধু বাজার করার জন্যই যেন মাহিনা দিয়া লোক রাখিবার ক্ষমতা তার হয়।

আচ্ছা, তার ভাশুর কেন বাজারে যায় না? অন্তত আজকের মতো কেন যাইবে না? আপিম খায় বলিয়া? এ তো উচিত নয়! আগে যখন বড় চাকরি করিত, তখনকার কথা আলাদা। তখন কিছু বলিবার ছিল না, কিন্তু এখন যখন সপরিবারে ধরিতে গেলে একরকম ভাইয়ের ঘাড়ে চাপিয়া আছে, এখন একদিনের জন্য দরকার হইলে কেন সে যাইবে না?

কথাটা বুঝাইয়া বলিতে নরেনও সায় দিল, তারপর সন্দিগ্ধভাবে বলিল, দাদা কি যাবে? কাল কতটা গিলে ঘুমোচ্ছে কে জানে, ডেকে তুলতেই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। দাদার কথা বাদ দাও।

বড্ড বাড়াবাড়ি করছেন আজকাল।

নরেন একথাতেও সায় দিল। বলিল, কী জান, শোকে তাপে এরকম হয়েছেন। বৌদি মারা যাবার পর থেকে–

তার আগে বুঝি খেতেন না?

তা খেতেন, তবে সে নামমাত্র, এতটা বাড়েনি।

আপিমের নেশা বাড়ালেই বাড়ে।

মায়া উঠিয়া গেল, বাজারে পাঠাইয়া দিল ঠিকা-ঝি কালিদাসীকে। বাড়তি একটা কাজও কালিদাসী করে না, এক গ্লাস জল গড়াইয়া দিতে বলিলেও গজর গজর করে, কিন্তু বাজারে পাঠাইলেই যায়। পয়সা তো চুরি করেই, মাছ-তরকারিও কিছু কিছু সরায়, ভিন্ন একটা পুঁটুলি বাঁধিয়া আনিয়া নির্ভয়ে মায়াকে দেখায়, অন্তরঙ্গভাবে একগাল হাসিয়া বলে, ঘরের বাজারটাও এইসাথে সেরে এলাম মা। গরিবের বাজার দেখেছ মা, দুটি আলু, দুটি ঝিঙে–

মায়া বিশ্বাস করে না যে, তাদের বাজার হইতে সরানো এই সামান্য জিনিসেই কালিদাসীর বাড়ির সকলের পেট ভরে। তবে সে আরো যে তিনটি বাড়িতে কাজ করে তাদের প্রত্যেকের বাজারে এরকম ভাগ বসাইলে চলিয়া যাইতে পারে বটে। মাঝবয়সী এই স্ত্রীলোকটির আঁটসাঁট গড়ন আর চালচলন সমস্তই মায়ার চক্ষুশূল, ঝি পাওয়া এত কঠিন না হইলে সে কবে কালিদাসীকে দূর করিয়া দিত। তবু মেয়ে মানুষ মেয়েমানুষের ঘরের খবর না জানিয়া পারে না, তাই খুঁটিয়া খুঁটিয়া কালিদাসীর সংসারের সব বিবরণই মায়া প্রায় জানিয়া ফেলিয়াছে। খাওয়ার লোক এ বাড়ির চেয়ে দু-একজন বেশিই হইবে, তাছাড়া কালিদাসীর স্বামী মদন আপিম খায়।

প্রথম দিন খবরটা শুনিয়া মায়া গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বলিয়াছিল, আপিম খায়! তাই বুঝি রোজগারপাতি কিছুই করে না?

কালিদাসী আশ্চর্য হইয়া বলিয়াছিল, রোজগার করবে না কেনে গা? ওর মতো খাটতে পারে কটা লোক? তবে গরিবের রোজগার তো, কুলোয় না।

মায়াও আশ্চর্য হইয়া বলিয়াছিল, আপিম খায়, তবু নিয়মিত কাজকম্ম করে?

কালিদাসী বলিয়াছিল, আপিম খায় তো কাজকম্ম করবে না কেনে মা?

.

প্রায় দশটার সময় কালিদাসীর বাজার-করা মাছ-তরকারি মুখে গুঁজিয়া নরেন আপিস যাইতেছিল, আপিমশোর দাদা ডাকিতেছে শুনিয়া তার ঘরে গেল। তিনটি মাথার বালিশের উপর একটা পাশবালিশ চাপাইয়া আরামে ঠেস দিয়া হরেন আধশোয়া অবস্থায় পড়িয়া আছে। মুখে কিন্তু তার একটুও আরামের ছাপ নাই, আছে চটচটে ঘামের মতো ভোতা একটা অবসাদ আর নির্বিকার উদাসভাবের আবরণ। তোশকটা একটু ঘেঁড়া, বিছানার চাদরটা অত্যন্ত ময়লা, দুটি বালিশ আর পাশবালিশটিতে ওয়াড়ের অভাব, ঘরের সমস্ত জিনিসপত্রে পীড়াদায়ক বিশৃঙ্খলা। কিন্তু উপায় কী? শোকে তাপে মানুষ যখন কাতর হইয়া পড়ে, তখন আর তার কাছে কী প্রত্যাশা করা যায়?

হরেন বলিল, আপিস যাচ্ছ?

নরেন বলিল, হ্যাঁ।

একটা টাকা দাও দিকি আমাকে।

নরেন একটু ভাবিল। টাকার বড় টানাটানি, মাস শেষ হইয়া আসিয়াছে। অনেক দিন হইতে দাদাকে সে টাকা দিয়া আসিতেছে, কখনো একটা, কখনো দশটা। আজ ব্যাপারটা একটু বিবেচনা করিয়া দেখা দরকার। আর কি কোনোদিন হরেনের পক্ষে গা-ঝাড়া দিয়া উঠিয়া বড় চাকরি-বাকরি করা সম্ভব হইবে? আগের মতো অত বড় না হোক, মাঝারি রকমের বড়? দুবছরের মধ্যে যদি এত আপিম বাড়াইয়াও শোকতাপটা সামলাইয়া উঠিতে না পারিয়া থাকে, আর কি কোনোদিন পারিবে? আপিমটা হয়তো দিন দিন পরিমাণে বাড়িয়াই চলিবে। মায়া ঠিক বলিয়াছে, আপিমের নেশা বাড়াইলেই বাড়ে।

টাকা তো নেই দাদা। মাস কাবার হয়ে এল, আমি সামান্য মাইনে পাই–

একেবারে নেই? আনা চারেক হবে না?

নরেন মাথা নাড়িয়া বলিল, না, একটি পয়সা নেই। আপিমের জন্যে তো? আপিমটা এবার তুমি ছেড়ে দাও দাদা।

হরেন তৎক্ষণাৎ রাজি হইয়া গেল, আচ্ছা, ছেড়ে দেব। কিন্তু হঠাৎ তো ছাড়া যায় না, এ্যাদ্দিনের নেশা! কারো কাছে ধারধোর করে অল্প একটু এনো আজ কিনে, কমিয়ে কমিয়ে কদিন বাদেই একেবারে ছেড়ে দেব। সত্যি, এ নেশাটা এবার ছেড়ে দেওয়াই উচিত। এনো কিন্তু, কেমন?

দেখি-বলিয়া নরেন চলিয়া গেল।

জবাবটা হরেনের তেমন পছন্দ হইল না। অন্তত আজকের দিনটা চলিয়া যায় এ রকম সামান্য পরিমাণে আপিম নরেন কিনিয়া আনিবে এটুকু ভরসাও কি করা চলে, এ রকম জবাবের পর? যদি না আনে? অসময়ে সে ফিরিয়া আসিবে, তারপর হয়তো হাজার চেষ্টা করিয়াও এক রতি আপিমও সংগ্রহ করা চলিবে না। কী সর্বনাশ! সন্ধ্যার সময় একটু আপিম না হইলে তার চলিবে কেন? কথাটা ভাবিতে গিয়াই তার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।

.

বিমল কলেজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইলে বিমলকে সে ডাকে, গলা যথাসম্ভব মিহি করিয়া বলে, কলেজ যাচ্ছ, তোমার কাছে টাকা আছে, একটা দিতে পার আমায়?

বিমল বলে, আছে, তোমায় দেব না।

কেন?

আপিম খেয়ে খেয়ে তুমি গোল্লায় যাবে আর আমি–

হরেনের আধবোজা চোখ দুটি যেন এমন শ্রান্ত যে আড়চোখে ভাইপোর মুখের দিকে তাকানোর পরিশ্রমটুকু করিবার ক্ষমতাও চোখের নাই। চোখ দুটি একেবারে বুজিয়া ফেলিয়া বলে, আচ্ছা, থাক থাক। দরকার নেই।

স্নানাহারের পর হরেন আধ-ময়লা একটি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়া নিজেই বাহির হইয়া যায়। আপিম ছাড়া তো চলিবে না, যেভাবেই হোক জোগাড় করিতেই হইবে।

.

এদিকে আপিসে কাজ করিতে করিতে নরেনের মনটা খুঁতখুঁত করে। প্রথমটা হরেনের মঙ্গলের জন্য নিজের দৃঢ়তা প্রদর্শনের কথা ভাবিয়া বেশ গর্ববোধ হইতেছিল, আপিসে পৌঁছিতে পৌঁছিতেই প্রায় সে ভাবটা শেষ হইয়া গিয়াছে। এখন মনে হইতেছে, মোটে চারগণ্ডা পয়সা চাহিয়াছিল, না দেওয়া কি উচিত হইয়াছে? একদিনে আপিম ছাড়া আপিমখোরের পক্ষে সম্ভব নয়, এ কথাও সত্য। মনে কর, হরেন যদি সত্য সত্যই কমাইয়া ধীরে ধীরে আপিম ছাড়িয়া দেয়, আবার উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া ভালো একটা কাজ সংগ্রহ করিয়া ফেলে এবং আজকের ব্যাপারের জন্য তাকে কোনোদিন ক্ষমা না করে? কোনোদিন যদি তাকে আর টাকা-পয়সা কিছু না দেয়? কাজে নরেনের ভুল হইয়া যাইতে থাকে। হরেন যখন বড় চাকরি করিতেছিল তখনকার সেই সুখের দিনগুলির কথা মনে ভাসিয়া আসিতে থাকে। কী আরামেই তখন সে ছিল! কোনো ভাবনা ছিল না, কোনো অভাব ছিল না, নিজের বেতনের প্রায় সব টাকাই নিজের সুখের জন্য খরচ করিলেও কিছু আসিয়া যাইত না। আজ চারিদিকে টানাটানি, কেবল অভাব আর অভিযোগ, দিনে পাঁচটির বেশি সিগারেট খাওয়ার পর্যন্ত তার উপায় নাই, বিড়ি টানিতে হয়! আপিমের নেশাটা ছাড়িয়া হরেন যদি আবার…

টিফিনের সময় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, একমাথা ঝাঁকড়া চুল লইয়াই মাঝবয়সী এক লোক আসিয়া বলিল, এ মাসে নেবেন তো? আপনার জন্যে বাছা বাছা নম্বর রেখেছি–সব কটা জোড় সংখ্যা, একটা বিজোড় নেই। এই দেখুন, চার, আট, ছয়–

ছটি লটারির টিকিট বাহির করিয়া সে নরেনের হাতে দেয়। নরেন নিশ্বাস ফেলিয়া বলে, কিনছি তো প্রত্যেক মাসে, লাগছে কই!

প্রথমে তিনখানা, তারপর জোড়া সংখ্যার টিকিট কেনা ভালো মনে করিয়া চারখানা টিকিট রাখিয়া নরেন একটি টাকা বাহির করিয়া দিল। টাকাটা পকেটে ভরিয়া লোকটি বলিল, এক টাকা দামের একখানা টিকিট আছে, নেবেন? ফার্স্ট প্রাইজ চল্লিশ পার্সেন্ট, গতবার সাতান্ন হাজার হয়েছিল, এবার আরো বেশি হবে। মস্ত ব্যাপার!

টিকিটখানা হাতে করিয়া নাড়িয়া চাড়িয়া নানাভাবে দেখিয়া নরেন বলিল, নেব কী, টাকাই যে নেই। একেবারে মাসকাবারে এলেন, কদিন আগে যদি আসতেন! তেসরা আসবেন, নেবখন।

লোকটি ঝাঁকড়া চুলে ঝাঁকি দিয়া বলিল, তেসরা আসব কী মশায়, আজকে লাস্ট ডেট। সব টিকিট সেল হয়ে গেছে, ওই একখানা রেখেছিলাম আপনার জন্য–কী জানেন, এতে আপনার চান্স বেশি, টিকিট লিমিটেড কিনা। থার্ড প্রাইজও যদি পান, বিশ হাজার টাকা তো বটেই, বেশিও পেতে পারেন।

আর একটি টাকা মানিব্যাগে ছিল, টাকাটি নরেন বাহির করিয়া দিল।

এদিকে কলেজে বিমলের মনটাও খুঁতখুঁত করে। হরেন যখন তাকে ডাকিয়াছিল, তার খানিক আগেই কাগজে দেশনেতার মস্ত একটা বিবৃতি সে পড়িয়া ফেলিয়াছিল। বিবৃতিটি অবশ্য আপিম সম্পর্কে নয়, তবু সেটি পড়িয়া দেশসুদ্ধ লোকের উপর যে তীব্র আক্রোশ আর যে অনির্দিষ্ট আত্মগ্লানি তাকে পীড়ন করিতেছিল, অর্ধশায়িত জেঠাকে দেখিয়া তার প্রতিক্রিয়া একটা নির্দিষ্ট উপলক্ষ পাইয়া প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, হঠাৎ-জাগা বেপরোয়া উদ্ধতভাবের আর সীমা ছিল না। কলেজে পৌঁছিতে পৌঁছিতেই সে ভাবটা প্রায় উবিয়া গিয়াছে। এখন মনে হইতেছে, ওরকম বাহাদুরি না করিলেই বোধ হয় ভালো হইত। কেবল সবিতাদের বাড়িতে নয়, আরো যে কয়েকটি উঁচুস্তরের পরিবারে সে মেলামেশার সুযোগ পাইয়াছে, একটু খাতিরও পাইতেছে, তা তো কেবল সে হরেন মিত্রের ভাইপো বলিয়াই! তার জেঠামশায়ের সুদিন যদি কোনোদিন ফিরিয়া আসে আর জেঠামশায় যদি তাকে উঁচুস্তরে উঠিবার বিশেষ ব্যবস্থা করিয়া দেয়, তবেই তো কেবল সবিতার সম্বন্ধে আশাভরসা পোষণ করা তার পক্ষে সম্ভব হইতে পারে। অবশ্য সবিতা যদি তার জন্য পাগল হইয়া ওঠে, যদি বুঝিতে পারে যে তাকে ছাড়া বাঁচিয়া থাকিয়া কোনো সুখ নাই, তবে হয়তো জেঠামশায় পিছনে নাই জানিয়াও এবং সে যে একদিন বড় হইবেই হইবে তার কোনো সুনিশ্চিত প্রমাণ সে এখন দেখাইতে না পারিলেও, তাকেই সবিতা বরণ করিবে। তবুও, জেঠামশায়কে চটানো বোধ হয় উচিত হয় নাই।

তিনটার সময় বিমল গেটের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। তার ক্লাস এক ঘণ্টা আগেই শেষ হইয়াছে, এবার শেষ হইল সবিতার।

প্রায় আধঘণ্টা পরে সবিতা আসিল, বিনা ভূমিকাতেই বলিল, আজ তো আপনাকে মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারব না। আমি অন্যদিকে যাব।

বিমল বলিল, কোন দিকে?

সবিতা বলিল, এই–অন্যদিকে। মানে, আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি যাব।

বিমল বলিল, কতক্ষণ থাকবেন?

সবিতা মৃদু হাসিয়া বলিল, তার কি ঠিক আছে কিছু!

সবিতার গাড়ি চলিয়া গেলে বিমল ভাবিতে লাগিল, এখন কী করা যায়? একবার সে বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা দামি ঘড়িটার দিকে চাহিয়া দেখিল। হরেন তাকে একদিন ঘড়িটি কিনিয়া দিয়াছিল। এত শিগগির বাড়ি ফিরিয়া কোনো লাভ নাই। মাধুরীদের বাড়িতে যদি যায়, কেমন হয়? মাধুরী হয়তো দু-একখানা গান শোনাইতে পারে, তারপর হয়তো তার সঙ্গে বেড়াইতে যাইতেও রাজি হইতে পারে। কিন্তু বড় ক্ষুধা পাইয়াছে, কিছু খাইয়া যাওয়া দরকার, মাধুরী তো শুধু এক কাপ চা খাইতে দিবে।

.

সেদিন রাত্রি নটার সময়ও হরেন বাড়ি ফিরিল না। নরেন আর বিমলকে ভাত দিয়া। মায়া দুটি দুধও দুজনের থালার সামনে আগাইয়া দিল।

বিমল আশ্চর্য হইয়া বলিল, দুধ কেন?

নরেন বলিল, দাদার দুধ আছে তো?

মায়া বলিল, ওঁর দুধ লাগবে না।

খাইয়া উঠিয়া নরেন ঘরে গেল, আপিসে একজন একপয়সা দামের একটি চুরুট উপহার দিয়াছিল, বিছানায় আরাম করিয়া বসিয়া সবে চুরুটটি ধরাইয়াছে, হরেনের ছোট মেয়ে অমলা আসিয়া খবর দিল, বাবা তোমায় ডাকছে কাকু।

নরেন অন্য কথা ভাবিতেছিল, ইতিমধ্যে দাদা কখন বাড়ি ফিরিয়াছে টেরও পায় নাই। জানালার সিমেন্টের উপর চুরুটটি নামাইয়া রাখিয়া একটু অস্বস্তির সঙ্গেই সে হরেনের কথা শুনিতে গেল। এমন সময় বাড়ি ফিরিয়া তাকে ডাকিয়া হরেনের কী বলিবার থাকিতে পারে?

হরেন তাকে পাঁচটি টাকা দিয়া বলিল, একেবারেই টাকা নেই বলছিলে, এই টাকা কটা রাখো। আর শোনো, বসাকদের কোম্পানিতে একটা কাজ ঠিক করে এলাম। বুড়ো কদিন থেকে আমায় বলছিল–তুমি তো চেন বুড়োকে, চেন না? শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, কিন্তু কী আর করা যায়, সংসার তো চালানো চাই। মেয়েটারও বিয়ে দিতে হবে দুদিন পরে।

এইসব ভেবে–

হরেনের ভাব দেখিয়া মনে হয়, একটা চাকরি ঠিক করিয়া আসিয়া সে যেন অপরাধ করিয়াছে এবং নিজেকে সমর্থন করার জন্য নরেনের কাছে কৈফিয়ত দিতেছে। হঠাৎ থামিয়া গিয়া সে ডাকিল, অলি!

অমলা আসিলে বলিল তোর কাকিমাকে বল তো গিয়ে, আমি ভাত খাব না, শুধু দুধ খাব।

নরেন নিজেই মায়াকে খবরটা জানাইয়া আসিল। হরেনের চাকরির খবরের চেয়ে সে শুধু দুধ খাইবে এই খবরটাই যেন মায়াকে বিচলিত করিয়া দিল বেশি। গৃহিণীর কর্তব্য পালনের জন্যই সে যে আজ একফোঁটা দুধও রাখে নাই, দুধের কড়াইটা পর্যন্ত মাজিবার জন্য কলতলায় বাহির করিয়া দিয়াছে! কী হইবে এখন?

বিমলকে ডাকো শিগগির–আর, কআনা পয়সা দাও।

বিমল মোড়ের ময়রার দোকান হইতে দুধ আনিতে গেল, নরেন ঘরে গিয়া আবার বিছানায় আরাম করিয়া বসিল। চুরুটটা নিভিয়া গিয়াছে। রাত্রে সহজে ঘুম না আসিলে দরকার হইতে পারে ভাবিয়া দুটি সিগারেট নরেন সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছিল–ঘুম না আসিলে গভীর রাত্রে ক্রমাগত সিগারেট টানিবার ইচ্ছাটা কেন যে প্রচণ্ড হইয়া ওঠে কে জানে! বিমলকে পাঁচটা সিগারেটও আনিতে দেওয়া হইয়াছে, সুতরাং নিশ্চিন্ত মনেই সঞ্চিত সিগারেটের একটি ধরাইয়া সে টানিতে লাগিল। যার যা টানা অভ্যাস সেটা না হইলে কি তার আরাম হয়!

হরেন আবার চাকরি করিবে, সংসারের অভাব অনটন দূর হইবে, এ চিন্তার চেয়ে অন্য একটা অতি তুচ্ছ কথা নরেনের বেশি মনে হইতে থাকে। কাল বাজার করার পয়সা কোথায় পাইবে সে ভাবিয়া পাইতেছিল না, হরেন পাঁচটা টাকা দেওয়ায় এই দুশ্চিন্তার হাত হইতে সে রেহাই পাইয়াছে। বাজারের পয়সা পর্যন্ত না রাখিয়া দুটাকা দিয়া লটারির টিকিট কিনিয়াছে, এই চিন্তাটাও মনের মধ্যে বড় বেশি বিধিতেছিল। হাজার পঞ্চাশেক টাকা পাইয়া গেলে যে কী মজাটাই হইবে; এ কল্পনায় যেন তেমন সুখ হইতেছিল না। এবার চোখ বুজিয়া নিশ্চিন্ত মনে কল্পনাকে আমল দেওয়া সম্ভব হইয়াছে।

পড়ার টেবিলের সামনে বসিয়া বিমল ভাবিতে থাকে, এতরাত্রে সে যে কষ্ট করিয়া তার খাওয়ার জন্য দুধ কিনিয়া আনিয়াছে, পাকে-প্রকারে জেঠামহাশয়কে এ খবরটা জানাইয়া দিতে পারিলে বোধ হয় ভালো হইত। সকালের ব্যাপারেও জেঠামশায় যদি চটিয়া থাকে, কথাটা শুনিয়া খুশি হইতে পারে। খুশি হইলে হয়তো–

রাত্রির মতো মায়ার সংসারের হাঙ্গামা চুকিতে এগারটা বাজিয়া গেল। হরেন তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। অন্যদিন সন্ধ্যার পরেই নেশা জমিয়া আসে, এগারটা-বারটা পর্যন্ত ঝিমানোর আরাম ভোগ করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়ে। আজ সে সুখটা ফসকাইয়া গিয়াছে। রাত নটা পর্যন্ত বাহিরে বাহিরে ঘুরিয়া এমন শ্রান্তই সে হইয়া পড়িয়াছিল যে ভালো করিয়া নেশা জমিবার আগেই ঘুম আসিয়া গিয়াছে। নরেন চিৎ হইয়া শুইয়া তৃতীয়বার লটারির টিকিটের লেখাগুলি খুঁটিয়া খুঁটিয়া পড়িতেছে। বিমলও পড়ার টেবিল ছাড়িয়া কয়েকখানা বই আর খাতা-পেন্সিল লইয়া বিছানায় আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মুখে তার গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ হইতে সে মনে মনে একটা গল্প গড়িয়া তুলিতেছিল।কলেজ হইতে সবিতার গাড়িতে মোড় পর্যন্ত আসিবার সময় একটা অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়া গিয়াছে, হাসপাতালে সে আর সবিতা একটা ঘরে পাশাপাশি দুটি বেডে পড়িয়া আছে। সবিতার বিশেষ কিছু হয় নাই, সবিতাকে বাঁচাইতে গিয়া তার আঘাত লাগিয়াছে গুরুতর। ডাক্তারের বারণ না মানিয়া সবিতা বেড ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া তার কপালে হাত বুলাইয়া দিতেছে। গল্পটি যখন জমিয়া আসিয়াছে, হঠাৎ তখন বিমলের মনে পড়িয়া গিয়াছে, আহত হইয়া এক হাসপাতালে গেলেও তাদের তো এক ওয়ার্ডে রাখিবে না!

টেবিলের ওপর এক গ্লাস জল ঢাকা দিয়া রাখিয়া মায়া খানিকক্ষণ ছেলের দিকে চাহিয়া রহিল। একবার ভাবিল, আর বেশি রাত জাগিতে ছেলেকে বারণ করে। তারপর ভাবিল, বড় হইতে হইলে রাত জাগিয়া না পড়িলে চলিবে কেন! এ পর্যন্ত ছেলের পরীক্ষাগুলি ভালো হয় নাই, এবার একটু রাত জাগিয়া যদি মেডেল পায়, বৃত্তি পায়–

শরীরে শ্রান্তি আসিয়াছে কিন্তু চোখে ঘুম আসে নাই। একটি পান মুখে দিয়া দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়া মায়া দ্রুতবেগে ছেলের মেডেল আর বৃত্তি পাওয়ার দিনগুলি অতিক্রম করিয়া যায়। গিয়া পৌঁছায় সেইসব দিনে, বিমল যখন মস্ত চাকরি করিতেছে, ঘরে একটি টুকটুকে বৌ আসিয়াছে–

বাড়িতে আপিম খায় একজন, কিন্তু জাগিয়া স্বপ্ন দেখে সকলেই। হরেনের পনের বছরের মেয়ে অমলা পর্যন্ত কাকিমার চোখ এড়াইয়া এতরাত্রে খোলা ছাতে একটু বেড়াইতে যায়–ছাতে গিয়া নানা কথা ভাবিতে তার বড় ভালো লাগে।

 একান্নবর্তী

চার ভাই, বীরেন, ধীরেন, হীরেন ও নীরেন। পরিবারের লজ্জা ও কলঙ্ক সেজ ভাই হীরেন। সে কেরানি। বীরেন ডাক্তার, ধীরেন উকিল, নীরেন দুশ টাকায় শুরুর গ্রেডে সরকারি চাকরি পেয়েছে আর বছর। হীরেন সাতাশ টাকার কেরানি, যুদ্ধের দরুন। পাঁচ-দশ টাকা বোনাস এলাওন্স বুঝি পায়। হীরেনকে ভাই বলে পরিচয় দিতে একটু শরম লাগে ভাইদের। চার ভাই তিন ভাগে ভাগ হয়ে গেছে তবু।

বাপের তৈরি বাড়িটাতে ভিন্ন ভিন্নভাবে বাজার করে বেঁধে বেড়ে, ঝি চাকর ঠাকুর, শুধু নিজেদের ভালোমন্দ সুখদুঃখ নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তিনটি অনাত্মীয় ভাড়াটের মতো তারা বাস করে। হঠাৎ টান পড়লে একটু চিনি, দু-পলা তেল বা এক খাবলা নুন ধার নেওয়া হয়, এ সংসার থেকে ও সংসারে দান হিসেবে নয়। দু-চার দিনের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। রেশনের বা কালোবাজারের মাল আনা হলে সঙ্গে সঙ্গে নিখুঁত মাপে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বড় দু-ভাইয়ের বৌদের তরফের কোনো আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিশেষ কোনো উপলক্ষে খাবারটাবার মাছটাছ এমন জিনিস যদি এত বেশি পরিমাণে আসে যে নিজেরা খেয়ে শেষ করবার আগেই পচে নষ্ট হয়ে যাবে, বাড়তিটা ভাগ করে দেওয়া হয়। হীরেনদেরও দিতে হবে। কেরানি বলে তার বৌ এসেছে গরিব পরিবার থেকে, তার বাপের বাড়ির দিক থেকে কখনো কিছু আসে না পাঁচজনকে দেবার মতো, কখনো কিছু আসে না পাঁচজনকে দেখানোর মতো, কখনো আসবেও না, তবু উপায় কী। এটাই আসল কথা তাকে নিয়ে লজ্জা পাবার। একেবারে অনাত্মীয় ভাড়াটের মতো বাস করুক, বাস তো করে একই বাড়িতে, সবাই তো জানে সে তাদের ভাই, আত্মীয় বন্ধু পাড়াপড়শি সকলে। সেটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না কোনোমতেই।

বিশেষত বুড়ি মা আছেন হীরেনের দলে। প্রায়ই তিনি অসুখে ভোগেন, সর্বদা জপতপ নিয়ে থাকেন। খান তিনি নিজের খরচে, কিন্তু তার দুধটুকু জ্বাল দেওয়া, দইটুকু পেতে রাখা, চাল ডাল তরকারিটুকু সিদ্ধ করে দেওয়া, এসব করতে হয়। হীরেনের বৌকে। অসুখেবিসুখে ব্রত পার্বণে বাড়তি দরকারের জন্য বৌদের ডেকে হুকুম দেন কিন্তু রোজকার খুঁটিনাটি সেবা গ্রহণ করেন শুধু হীরেনের বৌয়ের কাছ থেকে। তার রেশন কার্ড, কার্ডের মাল হীরেন পায়, মাসে দেড় মণ দুমণ কয়লার দাম তিনি দেন, ঠিকা ঝির আট টাকা বেতনের দুটাকা দেন আর সাধারণভাবে সংসার খরচের হিসাব দেন দশ টাকা।

হীরেন ছাড়া সব ছেলের কাছে তিনি ভরণপোষণের মাসিক খরচও নিয়মমতো আদায় করেন কড়াকড়িভাবে। বীরেনের পসার বেশি, সে দেয় তিরিশ টাকা। ধীরেনের পসার হচ্ছে, সে দেয় কুড়ি টাকা। চাকরি হবার পর নীরেন বিশ বা পঞ্চাশ। মা যা চাইতেন তাই দিত, আজকাল বড় বৌয়ের পরামর্শে দায়টা মাসিক পঁচিশ। টাকায় বেঁধে দিয়েছে। নীরেনের বৌ নেই। এখনো বিয়ে করেনি।

ভাইরা যখন ভাগ হয়, এক বাড়িতে উনান জ্বালাবার আয়োজন করে তিনটে, চটে লাল হয়ে গিয়েছিল নীরেন, লজ্জায় দুঃখে দাপাদাপি করে গালাগালি দিয়েছিল দাদাদের, বিশেষভাবে বড় দুজনকে। তখনো তার চাকরি হয়নি। তার খাওয়া-পরা, পড়াশোনার খরচ দেওয়ার দায়িত্ব এড়াতে বিশেষ করে ভাইরা ভিন্ন হচ্ছে মনে করে আঁতে তার ঘা লেগেছিল। আরো তার পড়বার ইচ্ছা ছিল, বিলাত যাওয়ার কথাটাও নাড়াচাড়া করছিল মনে মনে। এ সময় এ রকম পারিবারিক বিপর্যয় ঘটাতে তার আঁতকে ওঠার কথাই।

হীরেন তাকে বুঝিয়ে বলেছিল, কেন, এ তো ভালো হল! রোজ বিশ্রী খিটখিটে ঝগড়াঝাটি লেগেই আছে। একটু দুধ, একটু করে মাছ, এই নিয়ে কী মন কষাকষি বল তো? দাদার আয় বেশি, তিনি ভালোভাবে থাকতে চান। মেজদার ভালো উপার্জন হচ্ছে তিনিও খানিকটা ভালোভাবে থাকতে চান। আমি সংসারে মোটে চল্লিশটা টাকা দিয়ে মজা করব, ওরা কষ্ট করবেন সেটা উচিত নয়। ভাই বলে কি কেউ কারো মাথা কিনেছে নাকি যে খাওয়াখাওয়ি কামড়াকামড়ি করেও একসাথে থাকতে হবে ভাই সেজে? তার চেয়ে ভিন্ন হয়ে সদ্ভাবে ভাইয়ের বদলে ভদ্রলোকের মতো থাকাই ভালো।

তোমার চলবে?

চলবে না? কষ্ট করে চলবে। তবে অন্যদিকে লাভ হবে। মাথা হেঁট করে থাকতে হবে না, যাই খাই খুদকুঁড়ো হজম হবে।

নিজে ভিন্ন হলেই পারতে তবে এতদিন।

অ্যাঁ? হ্যাঁ, তা পারতাম। তবে কিনা কথাটা হল এই যে–

দুঃখী অসহায় গরিব কেরানি ভাইকে দয়া বা শ্রদ্ধা করে নয়, বড় বড় দুভাইয়ের ওপর নিদারুণ অভিমানের জ্বালায় নীরেন আরো পড়েশুনে আরো পরীক্ষা পাস করে বড় কিছু হবার কল্পনা ছেড়ে চাকরির চেষ্টায় নেমেছিল। মার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল হীরেনের সংসারে।

চাকরি হবার পরেও, দুশ টাকার শুরুর গ্রেডের সরকারি চাকরি হবার পরেও প্রায় দুমাস হীরেনের সংসারে ছিল।

তিন সংসারের পার্থক্য ততদিনে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। বড়বৌ পুলকময়ী আর মেজবৌ কৃষ্ণুপ্রিয়া চটপট অদল-বদল করে নিজের নিজের সংসার সেজে ঢেলে গুছিয়ে নিয়েছে। আগেকার সর্বজনীন ভাড়ারঘরটা ভেঙেচুরে নতুন জানালা দরজা তাক বসিয়ে পুলক করে নিয়েছে ঝকঝকে তকতকে সাজানো গোছানো, আলো-বাতাস ভরা বড় আধুনিক রান্নাঘর। দেখে বুক ফেটে গেছে কৃষ্ণ প্রিয়ার আফসোসে। সে যদি চেয়ে নিত ভাড়ারঘরটা রান্নাঘর করার জন্য। উনান টুনান বসানো নতুন তৈরি রান্নাঘরটা পেয়ে ভেবেছিল, খুব জেতা জিতে গেছে, ভাবতেও পারেনি দিন কয়েক বারান্দায় তোলা-উনানে রান্নার কষ্ট সহ্য করে ভাড়ারঘরকে এমন সুন্দর রান্নাঘর করা চলে। সেজবৌ লক্ষ্মীও তাকে ঠকিয়ে জিতে গেছে পুরনো নোংরা রান্নাঘরটা পেয়ে। মেঝেতে ফাটল আর গর্ত কালি-ঝুল মাখা চুন-বালি খসা দেয়াল, একটু অন্ধকার কিন্তু ঘরটা মস্ত বড়, মিস্ত্রি লাগিয়ে কিছু পয়সা। খরচ করলে ওই ঘরখানা দিয়েই বৌকে হারানো যেত।

চাকর বাজার করে, ঠাকুর ভাত রাঁধে, পুলকময়ী ঘরদুয়ার সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে, নিজে সাজে আর ছেলেমেয়েকে সাজায়, পাড়া বেড়ায়, নিন্দে করে কেরানি দেওর আর তার বৌয়ের। ধীরেন বাজার করে, ঠাকুর ভাত রাধে, কৃষ্ণুপ্রিয়া সস্তা চটকদার আসবাব ও শাড়ি কিনে বড় বৌয়ের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দেবার চেষ্টায়, নিজের ঘরদুয়ার সাজিয়ে গুছিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে, নিজে সাজে, মেয়েটাকে সাজায়, অর্গান বাজিয়ে গান করে, কেঁদেকেটে চিঠি লিখে ঘনঘন বড়লোক মামা-মামি মামাতো ভাইবোনদের দামি মোটরে চাপিয়ে বাড়ি আনায় পাড়ার লোকের কাছে নিজেকে বাড়াবার জন্য, ফরসা রং আর থলথলে মাংসল যৌবনের গর্বে মাস্টারনির মতো পাড়ার মেয়েদের কাছে বর্ণনা করে পাড়ার প্রত্যেকটি মেয়ে-বৌয়ের শোচনীয় রূপের অভাব, বানিয়ে বানিয়ে যা মুখে আসে বলে। যায়, শাশুড়ি ননদ জা দেওরদের বিরুদ্ধে।

তবু, পুলকময়ীর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না বলে জ্বলেপুড়ে মরে যায়। যুদ্ধের বাজারে বীরেনের পসার বড় বেশি বেড়েছে, দুটাকার বদলে আট টাকা ফী করেও গাদা গাদা কল পাচ্ছে, ঘরে এনেছে দামি আসবাব, পুলককে দিয়েছে শাড়ি গয়না, মোটর কিনেছে সেকেন্ডহ্যান্ড, জমি কিনেছে সেকেন্ডহ্যান্ড, জমি কিনে আয়োজন। করছে বাড়ি করবার। ধীরেনেরও ওকালতিতে পসার বেড়েছে বেশ, তবে বীরেনের ডাক্তারি পসারের সঙ্গে তুলনাই হয় না।

ভেবেচিন্তে কৃষ্ণপ্রিয়া হাত বাড়াল নীরেনের দিকে। মাসে চারশ পাঁচশ টাকা। আনছে ছেলেটা মাইনে আর উপরিতে, বিয়ে করেনি, বৌ নেই।

নীরেনও যেন তার হাত বাড়ানোর জন্যই প্রস্তুত হয়েছিল। হীরেনের সংসারের অশান্তি, উদ্বেগ আর অভাবের সঙ্গে একটানা লড়াই, মার গুমখাওয়া একগুঁয়ে। সেকেলে ভাব জীবনে তার বিতৃষ্ণা এনে দিয়েছে। প্রায়ই তাকে বাজার করতে হয়, প্রায়ই তাকে গিয়ে দাঁড়াতে হয় রেশনের লাইনে, মার আবদার আর হুকুম সমানে। চলেছে তারই ওপরে, আর যেন তার ছেলে নেই। তাছাড়া, সব বড় ভোতা, বড় নোংরা। বড়বৌ আর মেজবৌয়ের প্রায় চার বছর পরে বৌ হয়ে এসেছে লক্ষ্মী, তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা ওদের দুজনের ছেলেমেয়ের সমান। সারাদিন সে শুধু রাধছে। বাড়ছে, ছেলেমেয়েদের খাওয়াচ্ছে পরাচ্ছে, বুড়ি শাশুড়ির সেবা করছে, গাদা গাদা জামাকাপড় সিদ্ধ করছে, কপালকে দোষ দিচ্ছে, সর্বদা বলছে : মরলে জুড়োব, তার আগে নয় ঘর-সংসার সে সাজায় গোছায় অতি যত্নে, পুরনো বাক্স পেঁটরা, রংচটা খাট-চেয়ার, ছেঁড়া কাপড়-জামা, ময়লা কথাকানি নিয়ে যতটা সাজাতে গোছাতে। পারে। রান্নাঘর ধোয়ায় দুবেলা-নোংরা রান্নাঘর, এ ঘরে রান্না-করা ডাল ভাত মাছ। তরকারি খেতে ঘেন্না করে নীরেনের। খেতে বসলে আবার প্রায়ই পুলক বা কৃষ্ণুপ্রিয়ার রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে ঘি মাংস পেঁয়াজ এলাচের গন্ধ।

ঠাকুরপো, কাল তোমার নেমন্তন্ন। নিজে বেঁধে খাওয়াব।

কৃষ্ণুপ্রিয়া বললে একদিন হাসিহাসি মুখে। সহজে সে হাসে না, তার দাঁতগুলো খারাপ।

এমন অগোছালো কী করে থাক ঠাকুরপো? ছি, ছি, চারদিকে ঝুল, খাটের নিচে নরক হয়েছে ধুলো জমে। কী ছড়িয়ে ভড়িয়ে রেখেছ সব। এতগুলো টাকা ঢালছ। মাসে মাসে, ঘরটাও কি কেউ একটু সাফসুরত করে দিতে পারে না তোমার?

তখন তখন নিজের ঝিকে নিয়ে ঝুল ঝেড়ে ধুয়েমুছে সাফ করে কৃষ্ণপ্রিয়া, ঘরটা সাজিয়ে গুছিয়ে দেয়। আগে থেকেই সে ঠিক করে এসেছিল এটা সে করবে, নীরেন বুঝতে পারে। স্নান করতে যাওয়ার ঠিক আগে এসেছে পরদিন খেতে বলতে। ধুলো ঘেঁটে ঝুল মেখে ঘর সাফ করে সাবান মেখে স্নান করবে। খুশিই হয় নীরেন টের পেয়ে। খাতির পেয়ে অসুখী হবার কী আছে।

খেয়ে আরো খুশি হয় নীরেন। সব রান্নাই প্রায় ঠাকুরের, দুটি বিশেষ জিনিস শুধু কৃষ্ণুপ্রিয়া বেঁধেছে। লক্ষ্মীর কোনোমতে তাড়াতাড়ি হাত চালিয়ে দায়সারা একঘেয়ে রান্না নয়। চব্বিশ ঘণ্টা ছেলেমেয়ের নোংরামি-ঘাটা কোনো মানুষের রান্না নয়, অপরিষ্কার স্যাঁতসেঁতে ঘরে পুরনো মলিন পাত্রে মটকাহীন মরচেধরা টিনের কৌটার মসলার রান্না নয়। পরিবেশনে বারবার ব্যাঘাত নেই অন্য ঝামেলার, পরিবেশকের ভাবভঙ্গিতে নেই খাইয়ে দিয়ে আরেকটা হাঙ্গামা চুকিয়ে দেবার অধীরতা। পরিবেশক মাইনে-করা ঠাকুর। বসে বসে ধীরে সুস্থে হাসিগল্পের সঙ্গে একসাথে খাওয়া।

কৃষ্ণুপ্রিয়া চালিয়ে যায় টানার আয়োজন, ওদিকে এতদিন পরে হীরেন আর লক্ষ্মীর সঙ্গে নীরেনের বাধতে থাকে খিটিমিটি।

মাসের শেষে আরো কয়েকটা টাকা সংসারে দরকার হলে নীরেন বলে, আমি টাকা দিতে পারব না। যা দিয়েছি আমার একার জন্য তার সিকিও লাগে না।

হীরেন বলে, তা লাগে না। কিন্তু তুই একা মানুষ কী করবি অত টাকা দিয়ে?

যাই করি না।

লক্ষ্মীর সঙ্গে বাধে অন্যভাবে, অনেকভাবে।

ছুটির দিন একটু দেরি করেও খেতে পারব না খুশিমতো?

ঠাকুর রেখে দাও, যত খুশি দেরি করে খেয়ো। চোখ নেই তোমার ঠাকুরপো? দেখতে পাও না সেই কোন ভোরে উঠে জোয়াল ঘাড়ে নিয়েছি? দেড়টা বাজে, এখনো বলছ রান্নাঘর আগলে বসে থাকতে?

আমি যে টাকা দিই—

টাকা দাও বলে বাদী কিনেছ আমায়?

এই দোষ লক্ষ্মীর, খাতির করে না, এতগুলো করে টাকা নীরেন ঢালে তার সংসারে, তবু। হীরেনও যেন কেমন ভাব দেখায়, ঠিক ছোট ভাইয়ের মতো ব্যবহার করে তার সঙ্গে। মাসে মাসে এতগুলো টাকা সাহায্য করেও সংসার সে চালু রেখেছে, একটু যে বিশেষ তার সঙ্গে একটু বিশেষ মিষ্টি সুরে কথা বলবে তার সঙ্গে সে চেষ্টাও নেই। মোটেই যেন কৃতজ্ঞ নয়, অনুগত নয় দুজনে। হাড়ভাঙা খাটুনি আছে, অভাব অনটন চিন্তাভাবনা আছে, ঝঞ্ঝাট আছে অঢেল, কিন্তু সেইজন্যেই তো তাকে বেশি করে খাতির করা উচিত। তার সাহায্য বন্ধ হলে অবস্থা কী দাঁড়াবে ওরা কি ভাবে না? এত ভাবে, এ কথাটা ভাবে না। নীরেন নিজেই আশ্চর্য হয়ে যায় ভেবে।

পরের মাসের পয়লা থেকে নীরেন ভিড়ে গেল কৃষ্ণপ্রিয়ার সংসারে। হীরেনকে কিছু কিছু সাহায্য করবার ইচ্ছা তার ছিল, কৃষ্ণপ্রিয়া অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে সে ইচ্ছাকে ফাঁসিয়ে দিল। বুড়ি মাকে মাসে মাসে সে চল্লিশ টাকা দেবে ঠিক হয়েছে। বুড়ি কি খাবে ও টাকাটা? হীরেনকেই দেবে। ও চল্লিশ টাকা একরকম সে হীরেনকেই দিচ্ছে। সোজাসুজি আরো দেবার কি দরকার আছে কিছু? না সেটা উচিত? ওরা তো যত পাবে ততই নেবে, কিছুতেই কিছু হবে না ওদের।

তলে তলে টাকা জমাচ্ছে। বাইরে গরিবানা। বুঝলে না ঠাকুরপো?

কৃষ্ণপ্রিয়াকে নিজের জন্য খরচের টাকা দিয়ে প্রতিদানে স্পষ্ট কৃতজ্ঞতা পেয়ে পুলক বোধ করে নীরেন। মাসে মাসে লক্ষ্মীর হাতে খরচের টাকা দিয়েছে, খরচ করে যা বেঁচেছে ব্যাংকে জমা দিয়ে এসেছে, লক্ষ্মী নির্বিকারভাবে আঁচলে বেঁধেছে নোটগুলো, ব্যাংকের লোকেরা যেন তাকে গ্রাহ্যও করেনি। কৃষ্ণপ্রিয়ার হাতে নোটগুলো দিতেই আনন্দে সে এমন বিহ্বল হয়ে যায়! কথা বলতে গিয়ে এমন করে তোতলায়।

হেস্তনেস্ত যা হবার তা হল, পৃথিবীজোড়া মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে তাদের পারিবারিক যুদ্ধ পর্যন্ত। যার যা দখল সে তা নিয়েছে, যে যেভাবে যার সাথে বাঁচতে চায়, সে সেইভাবে তার সাথে বাঁচবার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। কেনা জমিটাতে এবার বাড়ি তৈরি আরম্ভ করবে ভাবছে বীরেন। ইট বালি চুন সুরকি পাওয়া যাচ্ছে, লোহা এবং সিমেন্টও পাওয়া যাচ্ছে তলায় তলায়, কিছু বাড়তি খরচ আর ধরাধরি করার বিশেষ চেষ্টায়। কৃষ্ণুপ্রিয়া মেয়ে খুঁজছে নীরেনের জন্যে, বাংলাদেশে একটিও মেয়ে মিলছে না পছন্দমতো, মেয়েদের যেন মেয়ে রেখে যায়নি যুদ্ধটা। মা জপতপ কমিয়েছেন। ভাবছেন তীর্থে যাবার কথা। ডাক্তার জোর দিয়ে বলেছে, গাড়ির কষ্ট আর বিদেশের অনিয়ম তাঁর সইবে না, মরে যাবেন।

মরতেও পাব না আমি। এ হতভাগার জন্য মরবারও জো নেই আমার। দুর্বল ক্ষীণস্বরে বুড়ি মা কাতরিয়ে কাতরিয়ে আফসোস করেন, হঠাৎ গুম খেয়ে আশ্চর্যরকম শান্তকণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন, আমি মরলে তো না-খেয়ে মরবি তোরা, গুষ্টিসুদ্ধ?

হীরেন বাহাদুরি দেখায় না, ক্ষীণ দুর্বল সুরে বলে, কেন অত ভাবছ বলো তো মা? অত সহজে কি মানুষ মরে? দুর্ভিক্ষে দেখনি, একটু খুদ একটু ফ্যান খেতে পেয়ে কত লোক বেঁচে গেছে। তুমি এখন মরলে যেটুকু ভদ্রভাবে বাচছি তা থাকবে না বটে, ভদ্রত্ব ছাড়লে কি মানুষ বাঁচে না তাই বলে? চারটে ছেলেমেয়ের জন্য রোজ একপো দুধ, হপ্তায় দুদিন একপো মাছ, তা-ও নয় বন্ধ করব, রেশনের চাল আর চার। পয়সার পুঁইশাক বেঁধে খাব। আমি বাঁচব, তোমার বৌটা বাঁচবে, ছেলেমেয়ে কটাও বাঁচবে দেখো। তবে হ্যাঁ, এ কথা সত্যি, এভাবে বাঁচার কোনো মানে হয় না।

কী বললি?

বললাম বাঁচা কষ্ট বলে কি সাহেবের গাড়ির সামনে ঝাঁপ দিয়ে মরব? সাহেবের টুটিটা কামড়ে ধরে মরব। অত ভাবছ কেন? মরব না। কেউ আমরা মরব না।

বুড়ি মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। ভাবেন, তীর্থে যাবার ছুতো করে এবার মরলে কেমন হয়? ভাবতে ভাবতে সামান্য একটা অসুখ হয়ে, চার ছেলের চেষ্টা বিফল করে, চৌষট্টি টাকা ফী-র ডাক্তারের ওষুধকে তুচ্ছ করে স্বাভাবিকভাবেই তিনি মারা গেলেন। তখন আরো শোচনীয় হয়ে পড়ল হীরেনের অবস্থা।

পুলকময়ীর ও কৃষ্ণপ্রিয়ার শাড়ি গয়না ঠাকুর চাকর, নিশ্চিত নির্ভর চালচলন, অবসর, শৌখিনতা, ভালো ভালো জিনিস খাওয়া, হাসি আহ্লাদ করা সবকিছু ঈর্ষা ক্ষোভ হতাশা হয়ে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে লক্ষ্মীর মন। মনে সে এই ভাবনার মলম দিয়ে সামলে থেকেছে যে বেশ্যারা পরম সুখেই থাকে। স্বামী পুত্র বুড়ি শাশুড়ির জন্য জীবনপাত করে খাটা, শাক-পাতা ডাল-ভাত পেটে গুঁজে কাজ করা, এ গৌরব ওরা কোথায় পাবে। নিজের মনে সে গজরগজর করছে, মরণ কামনা করছে শুধু গোপনে নিজেকে শুনিয়ে, হীরেনের ওপর ঝাঁজ ঝেড়েছে শুধু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চিরদিনের চলিত দাম্পত্য কলহের মধ্যে।

কিন্তু এবার আর সইল না।

চারটি ছেলেমেয়ের দুটি বড় হয়েছে, তারা শাক-পাতা ডাল-ভাত খেতে পারে, অন্য দুটিকেও তাই খাওয়ানো যায় কিছু কিছু, কিন্তু একটু তো দুধ চাই? একপে দুধ আসত, সেটা বন্ধ হল। সপ্তাহে দুদিন মাছের আঁশটে গন্ধ নাকেমুখে লাগত, তা আর লাগে না। যে সায়াটা ন্যাকড়ার কাজে লাগাতে হয়েছে, কৃষ্ণুপ্রিয়ার মতো থলথলে যৌবন না থাক সে-ও তো যুবতী, বয়স তো তার মোটে সাতাশ বছর, সায়াহীন ছেঁড়া কাপড়ে দেহ ঢেকে তাকে চলতে ফিরতে হচ্ছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সবাই। কী এক কলাকৌশল জেনেছে হীরেন, অভয় দিয়ে বলছে যে ভয় নেই আর ছেলেমেয়ে হবে না। এসব কি সত্যি? কখনো হতে পারে সত্যি মানুষের জীবনে? এসব ফাঁকি, এসব যুদ্ধের বোমা, এসব ভূমিকম্পের দিশেহারা পাগলামি, বাঁচতে হলে তেতলার ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে হবে, নইলে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ছাতের আলসেয় উঠবার সময় হীরেন তাকে আটকায়। এত এলোমেলো কথার পর এতরাত্রে তাকে ছাতে যেতে দেখে আগেই সে খানিকটা অনুমান করেছিল।

আমি যদি মরি তোমার তাতে কী? লক্ষ্মী বলে ঝাঁজের সঙ্গে, ছাড়া পাবার জন্য লড়তে লড়তে হীরেনের বাহুমূলে কামড় বসিয়ে দিয়ে। হীরেন জানে লক্ষ্মীকে, ভালোভাবেই জানে, সে তার চারটি সন্তানের মা।

কাঁদ-কাঁদ হয়ে সে বলে, তুমি খালি নিজের কথাই ভাবছ লক্ষ্মী।

চমকে থমকে যায় লক্ষ্মী। নিজের কথা ভাবছি? আমি মরলেই তো তোমার ভালো।

ভালো? তুমি মরলে আমি বাঁচব?

বাঁচবে না? আমি মরলে তুমি বাঁচবে না? দাঁড়াও বাবু, ভাবতে দাও।

বাঁচবে না? সে হার মেনে ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ে মরলে হীরেনও মরবে অন্যকোনো রকমে। তাই হবে বোধ হয়। যে কষ্ট আর তার সইছে না সেই কষ্ট তো লোকটা তারই সঙ্গে সমানভাবে সয়ে আসছে আজ দশ-এগার বছর। তাই বটে। লোকটা অন্য সব দিকে অপদার্থ হোক, এই এক দিকে খাঁটি আছে।

আমার বড় ঘুম পাচ্ছে। কতকাল জেগে আছি বলো তো। একটু ঘুমাব আমি।

ঘরে ফিরে গিয়ে চাদরহীন তুলো গিজগিজ-করা ছেঁড়া তোশকে হীরেনের বুকে মাথা রেখে সে জেগে থাকে। হীরেনের কথা শোনে।

সাতটা দিন সময় দেবে আমাকে লক্ষ্মী? আমি বুঝেও বুঝি নি। যা করা দরকার করেও করিনি। মাছিমারা কেরানি তো। এইরকম স্বভাব আমাদের। যাই হোক, তুমি আমায় সাতটা দিন সময় দাও।

ওমা, কিসের সময়?

তুমি কিছু করবে না, ছাত থেকে লাফিয়ে পড়বে না–

আমি গিয়েছিলাম নাকি লাফিয়ে পড়তে? লক্ষ্মী রাগ করে বলে, আমি যাইনি। কিসে যেন টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমায়।

সাত দিন সময় চেয়ে নেয় হীরেন, কিন্তু ব্যবস্থা সে করে ফেলে একদিনের মধ্যে। লজ্জায় লাল হয়ে দুঃখে ম্লান হয়ে লক্ষ্মী শুধু ভাবে যে, এত দুঃখের মধ্যে একটা খাপছাড়া পাগলামি করে বসে না জানি মনে কত দুঃখ বাড়িয়েছে সে লোকটার।

রাত নটায় হীরেন বাড়ি ফেরে। কচু সিদ্ধ আর ঝিঙে চচ্চড়ি দিয়ে দুজনে একসঙ্গে বসে ভাত খেয়ে ঘরে গিয়ে শোবার ব্যবস্থা করে রাত ১১টার সময়। লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলে?

পাড়াতেই ছিলাম। রমেশ, ভূপেন আর কানাই আমারই মতো কেরানি, চেন তো ওদের? ওদের বাড়িতে। ভালো কথা, কাল ভোরে ওদের বৌরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে।

লক্ষ্মী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে।-বুঝেছি। তোমার তিন বন্ধুর তিন বৌ আমাকে কাল বোঝাতে আসবে ছাত থেকে লাফিয়ে পড়া কত অন্যায়।

না ওরা তোমার সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থা করতে আসবে, ওদেরও যাতে তেতলার ছাত থেকে লাফিয়ে পড়বার দরকার না হয়।

মোরগ-ডাকা ভোরে এল লতিকা, মাধবী আর অলকা। সঙ্গে এল এগারটি কাচ্চাবাচ্চা। আর বাজারের থলিতে ভরা চাল ডাল তরিতরকারি, বোতলে ভরা। সরষের তেল, ভাঙা টি-পটে নুন, বস্তায় ভরা আধ মণ কি পৌনে এক মণ কয়লা। কচিদের মাই দিয়ে ছড়া গেয়ে গা চুলকে থাপড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে রাখা হল হীরেনের শোবার ঘরে! বাড়তি ছোট ঘুপচি ঘরখানা সাফ করে রাখা হল চাল ডাল। তেল নুন তরিতরকারি। লতিকা উনানে আঁচ দিল, হীরেনদের রাত্রের এঁটো বাসন। মাজতে গেল কলতলায়।

উনানে প্রথমে কেটলিটা চাপিয়ে সেটা নামিয়ে নিয়ে মাধবী চাপাল বড় স্যসপ্যানটা।

আমাদেরই কম পড়ত এক কেটলি চায়ে, দুজন ভাগীদার বেড়েছে। তুমি চা খাও তো ভাই লক্ষ্মী? জানি খাও। কে না খায় চা?

লক্ষ্মী জিভ কামড়ায়, জোরে কামড়ায়। ঘুমিয়ে না হয় স্বপ্ন দেখে আবোল-তাবোল অনেক কিছু, জেগেও স্বপ্ন দেখবে। কিন্তু কোনো প্রশ্ন সে করে না। দুর্বোধ্য যা-তা কথার ব্যাখ্যা শুনে বুঝতে তার ইচ্ছা হয় না। এরা সবাই তার চেনা। আশপাশে থাকে। তার মতো গরিব কেরানির বৌ। চা রুটি খাওয়া থেকে ডাল-ভাত খাওয়ার সব ব্যবস্থা এরা নিয়ে এসেছে। তার চিনিটুকু, চালটুকু কালকের বাড়তি তরকারিটুকু, তেল নুনটুকু নিয়ে বাড়তি ছোট ঘরটায় জমা করেছে, নিজেদের সঙ্গে আনা জিনিসের সঙ্গে।

লতিকা বলে, বাঁচলাম ভাই। তিন বাড়ির খাওয়ার জিনিস বাসনপত্র-জায়গা পাই না, সব ছড়িয়ে থাকে, এ ঘরটা ছোট হোক ঘুপচি হোক, খাসা ভাড়ারঘরের কাজ দেবে।

মাধবী বলে, মস্ত রান্নাঘর। দুশ লোকের রান্না হয়। বাঁচা গেল।

অলকা বলে, ভালোই হল, তুমিই দলে এলে ভাই লক্ষ্মী। তিনজনে মিলে খরচ কমিয়েছিলাম, এবার আরো কমবে। পালা করে রাঁধব বাড়ব তারও একটা জায়গা। নেই ভালোমতো, না ভঁড়ার না রান্নাঘর, কী যন্ত্রণা বলো দিকি।

অন্য কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভয় করে লক্ষ্মীর। সারাদিন চুপচাপ থেকে রাত্রে সে হীরেনের কাছে জবাব চায়।

লাগবে না? চার বাড়ির চারটে উনানে কয়লা পোড়ার বদলে একটা উনানে পুড়ছে। চার বাড়ির এক দিনের কয়লা খরচে চার দিন না চলুক, তিন দিন তো চলবে? চারটের বদলে একটা ঝিতে চলবে। চারজনের বাজার যাওয়ার বদলে পালা করে এক জনের গেলেই চলবে। চারজনের রাধার বদলে এক জনের রাঁধলেই। চলবে-চার দিনে তিন দিন ছুটি। এমন তো নয় যে অনেক দূর থেকে ভাত খেতে আসতে হবে কাউকে? চার-পাঁচ হাত উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ডাল ভাত খাওয়ার বদলে দশ-বিশ হাত রাস্তা পেরিয়ে এসে খাওয়া এইটুকু তফাত। তার তুলনায় সুবিধা কত।

লতিকা আজ রাধবে। একা যখন ছিল, নিজের বাড়িতে রোজ রাঁধতে হত, এখন এক দিন বেঁধে সে তিন দিন ছুটি পায়। একদিন মানুষের খাওয়ার মতো কিছু যদি রাধত তো দুদিন কী রাঁধবে, কার পাতে কী দেবে ভেবে পেত না, আজ সে ভালো মাছ তরকারি রাঁধতে পেরেছে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই।

তিন দিন পরে এই চার অনাত্মীয় পাড়াপড়শি একান্নবর্তী পরিবারের জন্য রান্না করার ভার পায় লক্ষ্মী। বিয়ের পর একটানা তিন দিন বিশ্রাম ভোগ করা তার জীবনে এই প্রথম জুটেছে। ছেলে বিয়োতে আঁতুড়ে গিয়ে রান্নাবান্না না করতে হওয়াটা ছুটি নয়, ছেলে বিয়োনোর খাটুনি ঢের বেশি রান্নাবাড়ার চেয়ে।

আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে সে বলে, লতিকা, মাধবী, অলকা তোরাই আমায় বাঁচালি। লতিকার ছেলে, মাধবীর মেয়ে, অলকার ভাই, এই তিনজনের সঙ্গে নিজের বাচ্চা দুটোকে সে দুধ খাওয়ায়। ছাত থেকে লাফিয়ে পড়ে সে মরতে গিয়েছিল কদিন আগে দিশেহারা হরিণীর মতো, আজ বাঘিনীর মতো বাঁচতে শুধু সে রাজি নয়, বাঁচবেই এই তার জিদ।

কংক্রিট

সিমেন্ট ঘাঁটতে এমন ভালো লাগে রঘুর। দশটা আঙুল সে ঢুকিয়ে দেয় সিমেন্টের স্কুপে, দু-হাতে ভরতি করে তোলে, আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝুরঝুর করে ঝরে যায়। হাত দিয়ে সে থাপড়ায় সিমেন্ট, নয়, শুধু এলোমেলোভাবে ঘাটাঘাটি করে। জোয়ান বয়সে ছেলেবেলার ধুলোখেলার সুখ। কখনো খাবলা দিয়ে মুঠো করে ধরে, যতটা ধরতে চায় পারে না, অল্পই থাকে মুঠোর মধ্যে। হাসি ফোটে রঘুর ঠোঁটে। এখনো গঙ্গামাটির ভাগটা মেশাল পড়েনি–ও চোরামিটা কোম্পানি একটু গোপনে করে। কী চিকন মোলায়েম জিনিসটা, কেমন মিঠে মেঘলাবরণ। মুক্তার বুক দুটির মতো। বলতে হবে মুক্তাকে তামাশা করে, আবার যখন দেখা হবে।

এই শালা খচ্চর! গিরীনের গাল, ছিদামের নয়। ছিদাম বিড়ি টানছে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে, ব্যাটার তিনটে আব-বসানো কিম্ভুত মুখ দেখলে গা জ্বলে যায় রঘুর, গাল শুনলে আরো বেশি। রুমাল-পোছা আসছে বুঝি তার চাকে পাক দিতে, ব্যাটা হুলো বোলতা, গিরীন তাই সামলে দিয়েছে তাকে। চট করে কাজে মন লাগায় রঘু। গিরীনকে ভালো লাগে রঘুর, লোকটা হুলো বেড়ালের মতো রগচটা আর বেঁটেখাটো ষাড়ের মতো একগুঁয়ে হলেও যত বদমেজাজি হোক, যেকোনো হাসির কথায় হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসে যেন শেয়াল ডাকছে ফুর্তির চোটে। আবার কারো দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনলে বাঘের মতো গুম হয়ে যায়, মাঝে মাঝে গলা-খাকারি দেয় যেন রোলার মেশিনে পাথর গুড়োচ্ছে মড়মড়িয়ে।

রুমাল-পোছা এল না দিকি?

না।

এল না এল, তোর কী রে বাঞ্চোৎ ছিদাম বলে দাঁত খিঁচিয়ে, ওনার আর কাজ নেই, তোর কাজ দেখতে আসবেন? আমি আছি কী করতে?

কথা না কয়ে খেটে যায় রঘু। পোঁছাবাবু আসে এদিক-ওদিক তেরচা চোখে চাইতে চাইতে, দুবার রুমাল দিয়ে মুখ পুঁছে ফেলে দশ পা আসতে আসতেই। তার গালভরা নাম বিরামনারায়ণ–এই মুদ্রাদোষে চিরতরে তলিয়ে গিয়ে হয়েছে রুমাল-পোছা, সংক্ষেপে পোঁছাবাবু। গিরীন, গফু, ভগলু, নিতাই, শিউলালেরা একটু শক্ত বনে-গিয়েই কাজ করে যায়, ছিদাম যেন খানিকটা নেতিয়ে বেঁকিয়ে যায় পোষা কুকুরের ঢঙে, উৎসুক চোখে তাকায় বারবার মুখ তুলে, লেজ থাকলে বুঝি নেড়ে দিত।

তোর ওটা এখন হবে না গিরীন, সাফ কথা। হাঙ্গামা মিটলে দেখা যাবে।

দুমাস হয়ে গেল বাবু। হাঙ্গামার সাথে মোর ওটার—

বাস, বাস। এখন হবে না। সাফ কথা।

রুমালে মুখ পুঁছে এগিয়ে যায় পোঁছাবাবু। রগচটা গিরীন রাগের চোটে বিড়বিড় করে বুঝি গাল দিতে থাকে তাকে। ছিদাম একটু অবাক হয়ে ভাবে যে দুপুরের ভো পড়ার মোটে দেরি নেই, টহল দিতে বার হল কেন পোঁছাবাবু অসময়ে। ভোয়ের টাইম হয়ে এলে কাজে ঢিল পড়ে কেমন, ফাঁকি চলে কী রকম দেখতে? দেখবে কচু, পোঁছাবাবু টহলে বেরোলে টের পায় সবাই। এর বদলে তাকে ডেকে শুধোলেই সে বলে দিতে পারত সব।

খিদেয় ভেতরটা চো-চো করছে রঘুর, তেষ্টায় কি না তাও যেন ঠিক আন্দাজ করা যায় না, ঘেমে ঘেমে দেহটা লাগছে যেন কলে-মাড়া আখের ছিবড়ে। ভোর জন্য সে কান পেতে থাকে। আগে মুখ হাত ধোবে না সোজা গেটে চলে যাবে, বন্ধ গেটের শিকের ফাঁক দিয়ে চানা কিনবে না মুড়ি কিনবে, আগে পেট পুরে জল খাবে না দুমুঠো খেয়ে নেবে আগে, এইসব ভাবে রঘু। মুক্তাকে এনে রাখতে পারলে হত দেশ থেকে, রোজ পুঁটলি করে খাবার সাথে দিত বেন্দার বৌটার মতো। বৌ একটা বটে বেন্দার! রঙে ঢঙে ছেনালিতে গনগনে কী বাস রে মাগীটা, মুক্তার মতো কচি মিষ্টি নয় যদিও মোটে। তবে পুঁটলি করে বেন্দাকে খাবার দেয় সাথে রোজ, রুটি চচ্চড়ি ভাজা, নয়তো ঝাল-ঝাল শুখা ডাল, নয়তো চিচিঙার পেঁয়াজ হেঁচকি।

হঠাৎ বড় শ্রান্ত, অবসন্ন লাগে নিজেকে রঘুর। সে জানে এ রকম লাগলে কী ঘটবে এখুনি। কাশি আসছে। আঁতকানির মতো একটা টান লাগে ভেতরে, তারপর শুরু হয় কাশি; কাশতে কাশতে বেদম হয়ে পড়ে রঘু। হাঁটু গেড়ে সে বসে পড়ে, দুহাতে শক্ত করে নিজের হাঁটু জড়িয়ে হাঁটুতেই মুখ গুঁজে দেয়। এমনি করে আস্তে আস্তে শ্বাস টানবার চেষ্টা করলে কাশিটা নরম পড়ে, এক দলা সিমেন্ট-রঙা কফ উঠে আসবার পর কাশিটা থামে।

গিরীন গুম হয়ে তাকিয়ে থাকে বাঘের মতো, গলায় দুবার খাকারি দেয় আড়ালের রোলার মেশিনটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।

আমি সাত বচ্ছর খাটছি, তুই শালা দু-চার বছরে খতম হয়ে যাবি!

ট্যাক ফ্যা-ফ্যা করছে রঘুর, পয়সা নেইকো। বেন্দার ট্র্যাকে দু-এক টাকা আছেই সব সময়, মাল টেনে এত পয়সা ওড়ায়, তবু। রঘু তাই দু-এক আনা ধার করতে যায় বেন্দার কাছে আর তাই সে দেখতে পায় রোলার মেশিনে কেষ্ট বাতাপির পিষে থেঁতলে যাবার রকমটা।

মাটিতে শিকড়-আঁটা গুমোটের গাছের মতো রঘু নড়েচড়ে না, মুখ হাঁ হয়ে যায়, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। সরে পড়তে গিয়ে তাকে দ্যাখে বেন্দা, দাঁতে দাঁতে ঠেকে গিয়ে খিচে উঠে ছিরকুটে যায় বেন্দার মুখ। দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে সাপের হিশহিশানির আওয়াজে সে বলে, যা যা, ভাগ। পালা শিগগির।

দিশেহারা রঘু পালাতে গেলে কিন্তু ফের তাকে ডেকে বেন্দা বলে, শোন। এখানে এইছিলি খপরদার বলিসনি কাউকে, মারা পড়বিখপরদার।

পাতা হয়ে ঝড়ে উড়ে যেন রঘু ফিরে আসে নিজের জায়গায়, রঘুর প্রাণটা আর কি, নয়তো ফেরে সে পায়ে পায়ে হেঁটেই। মেঘলা গুমোটের কাল ঘাম ছুটেছে, সেটা দেখা যায়। ভাবসাব দেখে মনে হয়, কাশির ধমকটা ঝাঁকি দিয়ে গেছে তাকে, কাবু করে দিয়েছে। কিন্তু রঘু ভাবে তার ভেতরের উলটেপালটে পাক-খাওয়াটা বুঝি চোখে পড়েছে সকলের, এই বুঝি কে শুধিয়ে বসে, ব্যাপারখানা কী রে!

জল খেলি? গিরীন শুধোয় বাপের মতো সুরে।

হ্যাঁ, খেলাম।

প্রথম ভোঁ বাজে দুপুরের। হাঁপ ফেলবার, ঢিল দেবার, জল-চানা খাবার এতটুকু অবকাশ। দমে আর হাতপায়ে একটু ঢিল পড়ে, মনটা শিথিল হবার সুযোগ পায় না কারো। হবু ধর্মঘট নিয়ে ব্যগ্র উত্তেজিত হয়ে আছে মজুরেরা, ও ছাড়া চিন্তা নেই, আলোচনা নেই। তার মধ্যে খবর ছড়ায় দুর্ঘটনার, কী তাড়াতাড়ি যে ছড়ায়। কেষ্ট বাতাপি রোলার মেশিনে পিষে থেঁতলে মারা গেছে খানিক আগে–এ খবর যে শোনে সে গুম হয়ে যায় খানিকক্ষণের জন্য, তারপর অকথ্য বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে, এটা কী রকম হল? হু-হুঁ করে উত্তেজনা বেড়ে যায়, ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাতে থাকে উত্তেজনার, সবার কথার মোট আওয়াজটা নতুন রকমের ধ্বনি হয়ে উঠে। প্রথম দিকে খবর পেয়ে কয়েকজন যারা ছুটে গিয়েছিল দেখতে, তারাই শুধু দেখতে পেয়েছে কেষ্ট বাতাপির হেঁচা দেহটা, জিজ্ঞেস করে ভাসা-ভাসা শুনতে পেয়েছে কিসে কী ঘটল। তারপর খেদিয়ে দেওয়া হয়েছে সকলকে, ওখানে। গণ্ডগোল করা বারণ হয়ে গেছে।

ছিদাম বলে, আহা রে! বিষবারের বারবেলায় পেরানটা গেল কপাল দোষে।

রগচটা গিরীন যেন চটেই ছিল আগে থেকে, শুনেই গর্জে ওঠে, বারবেলার কপালদোষ! পোঁছা বুঝি বলেছে তোকে বলে বেড়াতে? পোঁছার পা-চাটা শালা ঘাসি-বুড়ো! পোঁছা খুন করিয়েছে কেষ্টকে, জানিস? বজ্জাত শকুন তুই, চুপ করে থাক।

ছিদাম সরে পড়ে, চমক লেগে, চমৎকৃত হয়ে। কৌতূহলে ফেটে পড়ে তার মনটা। এদিক-ওদিক ঘোরে সে, ছাড়া ছাড়া কথা শুনতে ছোট ছোট দলের উত্তেজিত আলোচনার। কাছে যেতে তার ভরসা হয় না। সবাই হয়তো চুপ হয়ে যাবে, কেউ তাকাবে আড়চোখে, কেউ কটমটিয়ে। যেটুকু সে শোনে তাতেই টের পায়, শুধু গিরীন নয়, অনেকেই বলাবলি করছে ষড়যন্ত্র–গোপন কারসাজির কথা।

আর একবার ভো বাজে। যে যার কাজে যায়। যন্ত্রের একটানা গম্ভীর গর্জনে চাপা পড়ে যায় বটে কথার গুঞ্জন কিন্তু খাটুনেদের কানাঘুষা চলতে থাকে কাজের মধ্যেই।

ছিদাম আমতা আমতা করে বলে, একটা কথার হদিস পাচ্ছি না, তোকে শুধাই গিরীন। কেষ্ট ভিন্ন ডিপাটে, রোলার মেশিনে ও গেছল কেন?

বদলি করল না ওকে ক-রোজ আগে? এই মতলব পোঁছা শালার, খুনে ব্যাটা!

হ্যাঁ–? বটে–?

কী তবে? গিরীন ফের চটে যায়, রগচটা গিরীন, কী বলতে চাস তুই? এক রোজ যে-কাজ করেনি সে-কাজে বদলি করবার মানেটা কী?

রঘু শোনে। তার খাপছাড়া ভয়ংকর অভিজ্ঞতা মানে পেয়ে পেয়ে বীভৎসতর হয়ে উঠেছিল আগে থেকেই, গিরীনের কথার মানে আরো পরিষ্কার হয়ে যায়।

ম্যানেজারের ডান হাত পোঁছাবাবু। কিছুদিন আগেও বড় খুশি ছিল পোঁছাবাবু তার ওপর। কত গোপন কথা পৌঁছাবাবু জেনে নিত তার কাছে, ওপরের কত গোপন ব্যাপারের হদিস তাকে দিত, সেই সঙ্গে খোলা হাতে বোতল বোতল মদের দাম বকশিশ। সে রকম অনুগ্রহ পোঁছাবাবু আর তাকে করে না আজকাল, যদিও ছোটখাটো দয়া আজও তার জোটে, ছোটখাটো কাজে সে লাগে। দোষ তার নিজের। সবাই জেনে গেল তার ব্যাপার আর সাপের মতো বিছার মতো তাকে এড়িয়ে চলতে লাগল, ফলে আজ তার এই অবস্থা। তার নিজের গুখুরি ছাড়া আন্দাজ কি করতে পারত কেউ! আফসোসে বুকটা বিছার বিষে জ্বলে যায় ছিদামের। নিজের ঘরে সিঁধ দেওয়ার মতো কী বোকামিটাই সে করেছে। ম্যানেজার পর্যন্ত তাকে খাতির করে জানিয়ে জানিয়ে খাতিরের সাঙ্গাতদের কাছে নিজের মান বাড়াবার কী ভূতটাই চেপেছিল তার ঘাড়ে। তা না হলে কি জানাজানি হয়, আর এমন ভাবে তার খাতির কমে যায় পৌঁছাবাবুর কাছে। বড় বেশি মাল খাচ্ছিল সে কাঁচা টাকা পেয়ে পেয়ে, মাথার তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না কিছু, বিগড়ে গিয়েছিল একদম। একটু যদি সে সামলে চলত, কর্তারা তাকে খাতির করে এটা চেপে গিয়ে যদি বলে বেড়াত ওপর থেকে তাকে পিষে মারছে, আজ কি তাহলে তার অগোচরে কেষ্ট বাতাপিকে রোলার মেশিনে পিষে মারবার ব্যবস্থা করতে পারত পৌঁছাবাবু, কয়েকটা নোট তার পকেটে আসত না!

জ্বালা যেন সয় না ছিদামের। এত পাকা বুদ্ধি নিয়ে বোকামি করে সব হারাল, এখন যে একটা চাল চালবার বুদ্ধি গজাচ্ছে মাথায় সেটাকে দাবিয়ে রেখে ফের কি একটা সুযোগ হারাবে বোকার মতো? উসখুস করতে করতে এক সময় মরিয়া হয়ে সে বেন্দার কাছে যায়। ভয়ে এদিকে বুকটা কাপেও।

কী যে বোকার মতো কাজ করিস বেন্দা। চুপি চুপি বলে সে বেন্দাকে।

সরু সরু লাল শিরায় আচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে বেন্দা বলে, কী বলছ? বোকার মতো কী কাজ?

সবাই কী বলাবলি করছে জানিস?

কী বলাবলি করছে? চমকে আঁতকে ওঠে বেন্দা।

হুঁ, হুঁ, ছিদাম মুচকে হাসে প্রাণপণ চেষ্টায়, আরে বাবা, আমার কাছে চাল মারিস কেন? পোঁছাবাবু আমাকে জানে, আমি পোঁছাবাবুকে জানি। সবাই কী বলাবলি করছে জানা দরকার পোঁছাবাবুর।

বেন্দা ঢোক গিলে গিলে ভাবে। তারপর বলে, চলো, বলবে চলো পোঁছাবাবুকে।

পোঁছাবাবু বলে, কী রে ছিদাম, খবর আছে?

আজ্ঞে।

পৌঁছাবাবু তাকে বসতে বলে চেয়ারে। প্রায় রোমাঞ্চ হয় ছিদামের বুড়ো শরীরে। চাল খেটেছে তার। কাজে আর সে লাগে না, দরকার তার ফুরিয়ে গেছে, তবু এ ব্যাপারের কিছু সে টের পেয়েছে। ধরে নিয়ে একটু কি খাতির তাকে করবেন না পৌঁছাবাবু–ভেবেছিল সে। ঠিকই ভেবেছিল। নিজের পাকা বুদ্ধির তারিফ করে ছিদাম মনে মনে।

যেন আলাপ করছে এমনিভাবে পোঁছাবাবু তাকে জেরা করে। সে টেরও পায় না। পোঁছাবাবু কী করে জেনে নিচ্ছে যে সবাই ভোলাখুলিভাবে যা বলাবলি করছে তাও। সে ভালোরকম জানে না, পোঁছাবাবু তার চেয়ে অনেক বেশি জেনে এর মধ্যেই ব্যবস্থা আরম্ভ করেছে প্রতিবিধানের।

গালে প্রকাণ্ড একটা চড় খেয়ে সে বুঝতে পারে চালাকি তার খাটেনি, আর একটা সে বোকামি করে ফেলেছে।

তবে সে আপনার লোক, যতই বোকা হোক। দুটো টাকা হাতে দিয়ে পোঁছা বলে, কাজ করবি যা। বজ্জাতি করিস না। কংক্রিটের গাঁথনি উঠেছে, ওর মধ্যে পুঁতে ফেলব তোকে।

কাজে যখন ফিরে যায় ছিদাম, মাথাটা ভোঁতা হয়ে গেছে। মাথায় শুধু আছে যে আজ আস্ত একটা বোতল কিনে খাবে, দুটো টাকা তো দিয়েছে পোঁছাবাবু। কিন্তু। প্রতিশোধ নেবে। এবার থেকে সে ওদের দলে।

শোন বলি গিরীন। কেষ্টকে ওরা মেরেছে টের পেয়েছি। আমি সাক্ষি দেব তোদের হয়ে।

তোর সাক্ষি চাই না।

.

অতি রহস্যময় দুর্ঘটনা, অতি সন্দেহজনক যোগাযোগ। মুখে মুখে আরো তথ্য ছড়িয়ে যায়, রহস্য আরো ঘনীভূত হয়ে আসে। গোবর্ধন নাকি সময়মতো এসেও কার্ড পায়নি ভেতরে ঢুকবার, সে তাহলে উপস্থিত থাকত দুর্ঘটনার সময়, যদি না কোনো ছুতায় সরিয়ে দেওয়া হত তাকে,-নাসিরকে যেমন ঠিক ওই সময় পোছা। ডেকে পাঠিয়েছিল সামান্য বিষয় নিয়ে বকাবকি করার জন্য। হানিফ ছুটির জন্য ঝুলোঝুলি করছিল আট-দশ থেকে, হঠাৎ কালকে তার ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। পিষে থেঁতলে মরল কেষ্ট বাতাপি কিন্তু একজনও তার মরণ-চিৎকার শোনেনি, মেশিনের আওয়াজ নাকি চাপা দিতে পারে মরবার আগে মানুষের শেষ আর্তনাদকে! সোজাসুজি প্রমাণ কিছু নেই, কিন্তু সবাই জানে মনে মনে কেষ্ট দুর্ঘটনায় মরেনি, তাকে হত্যা করা হয়েছে। ম্যানেজারের, রুমাল-পোছার বুকে কাঁটা হয়ে বিধে ছিল কেষ্ট, বুঝতে কি বাকি থাকে কারো কেন তাকে মরতে হল, কী করে সে মরল।

রঘু টের পায়, ক্ষোভে আফসোসে অনেকে ফুঁসছে মনে মনে গিরীনের মতো যে, এমন একটা কিছু পাওয়া যাচ্ছে না যার জোরে পৌঁছার টুটি টিপে ম্যানেজারকে চেপে ধরে বাধ্য করা যায় পুরো নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি মানতে।

সে পারে। একমাত্র সে-ই শুধু পারে ওই অস্ত্রটি ওদের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু বড় যে একটা খটকা আছে রঘুর মনে। কারসাজি কি ফাঁস হবে ওপরওয়ালাদের? আটঘাট বেঁধে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা কি করে রাখেনি ওরা-ধরি-মাছ-না। ছুঁই-পানির কায়দায়? কোনো যোগসাজশ কি প্রমাণ করতে পারবে কেউ? অস্ত্রটা শুধু পড়বে গিয়ে বেন্দার গর্দানে। আর কেউ যদি হত বেন্দা ছাড়া।

গাঁয়ের মানুষ, বন্ধু মানুষ। পয়সা ধার চাইলে কখনো না বলে না, ঘরে বোতল খুললে তাকে ডেকে দুপাত্র খাওয়ায়। রানী খুশি হয় তাকে দেখলে, এসো বোসো বলে ডেকে বসায় আদর করে, ঘরে রাধা এটা-ওটা খাওয়ায়, হাসি-তামাশা রঙ্গরসে মশগুল করে রাখে। মুক্তার জন্য বুকটা যে খা-খা করে তার, তাও যেন ভুলিয়ে দেয় রানী। ওর চলন-ফিরন নড়নচড়ন দেখে রক্ত তাজা হয়ে ওঠে তার, বুকের মধ্যে কেমন করে। আর কী বুঝদার মেয়েটা, কত আপন ভাবে তাকে। কদিন আগে হঠাৎ খেপে গিয়ে সে যে বলা নেই কওয়া নেই জড়িয়ে ধরেছিল তাকে, সে রাগ করেনি, শুধু একটা ধমক দিয়েছিল। বেন্দাকে কিছু বলেনি, নিজে তফাত হয়ে থাকেনি, আগেরই মতো হাসিখুশি আপন ভাব বজায় রেখেছে।

কিন্তু বেন্দা শুধু খুন করেনি কেষ্ট বাতাপিকে পোছার টাকা খেয়ে, সে দালাল এই ছিদামের মতো। ব্ল্যাক তার ফাঁকা থাকে না কখনো, ঘরে-বাইরে সে বোতল বোতল মাল টানে, মিহি শাড়ি কিনে দেয় রানীকে, সব পাপের যা সেরা পাপ তারই টাকাতে। রঘুর মাথার মধ্যে বিছার হুলের মতো বিধে থাকে এই চিন্তা।

ছুটির পর ক্রুদ্ধ উত্তেজিত মানুষগুলো কেষ্ট বাতাপির দেহটা দাবি করে। ওকে যারা মেরেছে আজ তাদের মারা না যাক, শোভাযাত্রা করে কেষ্টকে তারা শ্মশানে নিয়ে যাবে। এদের মধ্যে নিজেকে কেমন একা আর অসহায় মনে হয় রঘুর। দুর্বল অবসন্ন লাগে শরীরটা, মুখটা এমন শুকনো যে ঢোক গেলা যায় না। মাথার মধ্যে রোলার মেশিনের ঘর্ঘর আওয়াজ চলে, জ্যান্ত একটা মানুষের খুলি চুরমার হয়ে যায় প্রচণ্ড শব্দে, তারপর সব যেন স্তব্ধ হয়ে যায় মানুষের নরম মাংস ঘেঁচে যাবার রক্তাক্ত শব্দহীনতায়।

বস্তিতে নিজের ঘরটিতেও সে একা। অন্য ঘরের বাসিন্দাদের হইচই বেড়েছে সন্ধ্যার সময়, রোজ যেমন বাড়ে। গলির ওপারে দুটো বাড়ির পরের বাড়ি থেকে শোনা যাচ্ছে ছিদামের গলা-ফাটানো বেসুরো গান, এর মধ্যে বুড়ো নেশা জমিয়েছে। একটানা কোদল চলছে সামনের বাড়ির তিন-চারটি স্ত্রীলোকের, ওদের মধ্যে কুজার বয়স গড়ন মুক্তার মতো, গলাটা কিন্তু ফাটা বাঁশির মতো–ভাঙা। সন্ধ্যার সময় বাড়ি যেতে বলে, বেন্দা কী দরকারে কোথায় গেছে। যাবে জেনেও রঘু মনে মনে নাড়াচাড়া করে, না গেলে কেমন হয়। রানী তাকে টানছে, এখন। থেকেই টানছে জোরালো টানে। এই যে তার একা একা মন খারাপ করে থাকা, রানী যেন ম্যাজিকে সব উড়িয়ে দেবে। তবু সে ভাবছে, না গেলে কেমন হয়। মনটা তার বিগড়ে গেছে বেন্দার ওপর, বিতৃষ্ণায় বিষিয়ে উঠেছে। সোজা সহজ একটা কথা বার বার মনে পড়েছে যে এসব লোকের সঙ্গে দহরম-মহরম রাখতে নেই, হোক গাঁয়ের মানুষ, হোক বন্ধু মানুষ, চোর ডাকাত খুনের চেয়ে এরা বদ, ওদের সঙ্গে থাকলেই বিপদ। রানী যদি বেন্দার বউ না হত–

মালতীর ন বছরের মেয়ে পুষ্প এসে দুয়ারে দাঁড়িয়ে বুড়ির মতো বলে, কী গো, আজ রাধবে না?

বলে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে থাকে জবাবের। অসুখ-বিসুখ যদি হয়ে থাকে, যদি আলসেমি ধরে থাকে না-রাধবার; যদি বলে, দুটি বেঁধে দিবি পুষ্প, সে ছুটে গিয়ে মাকে ডেকে আনবে। পুষ্পর আজ পেটটা ভালো করে ভরবে। উঠোনে পা ঝুলিয়ে ভিজে দাওয়ায় বসে বাতাসের সঙ্গে বকাবকি করছে পুষ্পর মা মালতী। থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছে, ঠ্যাং ছিড়ো না, ঠ্যাং ছিড়ো না বলছি। ওবছর পুস্পর বাপ লক্ষ্মণের পা আটকে গিয়েছিল কলে, পাটা কেটে ফেলতে হয়েছিল পাছার নিচে থেকে, শেষ পর্যন্ত বাঁচেনি।

আলসেমি লাগছে পুষ্প।

মাকে ডাকি? বলেই পুষ্প ছুট দেয় রঘুর সায় শুনবার আগেই।

রানী আসে রঘুকে ডাকতে।

যাওয়ার যে চাড় দেখি না, হাপিত্যেশ করে বসে আছে লোকটা ঢেলে-ঢুলে।

চলো যাই।

গলিতে নেমে ছিদামের গান আরো স্পষ্ট শোনা যায়, কথাগুলো জড়ানো। নেশা আরো চড়িয়ে চলেছে ছিদাম। নয়তো মিনিট-কয়েক চেঁচানোর পর সে ঝিমিয়ে যায়, আশপাশের লোক স্বস্তি পেয়ে বলে, যাক, শ্যাল-শকুনের কোদল থামল।

গলি থেকে আরো সরু গলি, তার মধ্যে বেন্দার ঘর, কাছেই। লণ্ঠনের আলোয় ফুর্তির সরঞ্জাম সাজিয়ে বসে আছে বেন্দা। ভাড়ের বদলে আজ কাঁচের গেলাস, কিনেই এনেছে বুঝি। খুরিতে ঝাল মাংস, কাগজে ডাল বাদাম। জলের বদলে চারটে সোডা।

হুঁ হুঁ বাবা, আজ খাঁটি বিলিতি, দামি চিজ।

কফে গলাটা ধরা ছিল বেন্দার, রঘু ঘড়ঘড় আওয়াজ পায়। একদিনে যেন বেন্দার মুখটা আরো ছুঁচলো হয়ে চামড়া আরো বেশি কুঁচকিয়ে গেছে। মিহি শাড়িটা পরেছে রানী, তলায় বুঝি সালুর শেমিজ, রং বেরোচ্ছে। দানা দানা মিহি বুদবুদ উঠছে ভরতি গেলাসের টলটলে রঙিন পানীয় থেকে।

ঢেলে বসে আছি তোর জন্যে। মাইরি ঠেকাই নি ঠোঁট।

আজ তার বিশেষ খাতির। হবে না কেন, হওয়াই উচিত। গেলাস তুলে এক। চুমুকে শেষ করে ফেলে রঘু হঠাৎ যেন মরিয়া হয়ে, হঠাৎ খেপে গিয়ে সেদিন যেমন সাপটে ধরেছিল রানীকে।

আরে আরে, রয়ে-সয়ে খাও। রানী বলে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে তার কাণ্ড দেখে।

বেন্দা বোতল থেকে তার গেলাসে মদ ঢেলে দেয়, খানিকটা সোডা দিয়ে খানিক জল মেশায়, সোডায় কুলোবে না।

নিজের গেলাসে চুমুক দিয়ে বলে, বাপস! ভাগ্যে তুই এলি আচমকা, অন্য কেউ নয়! প্রাণটা লাফিয়ে উঠেছিল কণ্ঠাতে মানুষ দেখে, তারপর দেখি তুই। ধড়ে প্রাণ এল। আরো দুবার চুমুক দেয়, খানিকটা বেপরোয়াভাবে বলে, তবে, কী আর হত! একটু হাঙ্গামা, বাস। পোঁছাবাবু ঝানু লোক, ঠিক করে নিত সব।

আর এক গেলাস ঢেলেছে সবে বেন্দা নিজের জন্য, লোক আসে পোঁছাবাবুর কাছ থেকে।

পোঁছাবাবু একবার ডেকেছে বেন্দাকে, এখুনি যেতে হবে, জরুরি দরকার। পোঁছাবাবু আছে ম্যানেজার সাহেবের কাছে, সেখানে যেতে হবে। ম্যানেজার সাহেব নিজের গাড়ি পাঠিয়েছে, বড় রাস্তার মোড়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি।

দুত্তেরি শালার নিকুচি করেছে। বেন্দা বলে বেজার হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, তুই বোস রঘু, খা। চটপট আসছি কাজটা সেরে। গাড়ি করে যদি না দিয়ে যায় তো–

বেন্দা বেরিয়ে যেতে দরজা বন্ধ করে রানী। টুক করে এসে উবু হয়ে বসেই বেন্দার খালি গেলাসে বোতল থেকে মদ ঢেলে এক চুমুকে গিলে ফেলে জল বা সোডা না দিয়েই, ঝাঁজে মুখ বাঁকিয়ে থাকে কতক্ষণ।

রঘুর চাউনি দেখে বলে, কী হল, খাও? হাত বাড়িয়ে গালটা সে টিপে দেয় রঘুর।

ভালো করে বসে আর একটু ঢালে, এবার সোডা মিশিয়ে রসিয়ে রসিয়ে খায় একটু একটু করে। রঘু গেলাস তুলে ধরে তার মুখে।

কাছে ঘেঁষে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ওকে বোলো না খেয়েছি। ফিরে এসে নেশা চড়লে নিজেই ডাকবে, তখন একটুখানি খাবখন দেখিয়ে। ফিরতে দেরি আছে, এক ঘণ্টা তো কম করে।

গায়ে লেগে কানে কানে কথা কয় রানী, তার মদ-পেঁয়াজের গন্ধ-ভরা নিশ্বাসে ঝড় ওঠে রঘুর মাথার রঙিন ধোঁয়ায়। গেলাস রেখে সে ধরে রানীকে।

রানী বলে, বাস রে, ধৈর্য নেই এতটুকু? গেলাসটা শেষ করো।

খালি গেলাস মদ সোডার বোতল তফাতে সরিয়ে জায়গা করে মুচকে হেসে নিজে থেকেই সে নেতিয়ে পড়ে রঘুর বুকে।

আর একটু ঢেলে খায়, রঘুকে দেয়। বলে, আর তোমার ভাবনাটা কী? কত বিলিতি খাবে তুমি এবার নিজের রোজগারে। তুমি চালাক-চতুর আছ ওর চেয়ে, ও তো একটা গোঁয়ার। এবার কত কাজে লাগাবে তোমায় পৌঁছাবাবু, কত টাকা। কামাবে তুমি।

মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে রঘুর এতক্ষণ পরে।

যাই বাবা ওঘরে, কখন এসে পড়বে। যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে রানী আবার বলে, একটা কথা বলি শোনো। তোমার জন্যেও পোঁছাবাবু টাকা দিয়েছে ওকে, চেয়ে নিও। ভাগ ছাড়বে কেন নিজের? এমনি হয়তো চেপে যাবে, কথায় কথায় বোলো, মোকে কিছু দিলে না পৌঁছাবাবু? তাহলে দেবে। চোখ ঠেরে রানী হাসে, বাৎলে দিলাম, ভাগ দিবে কিন্তু মোকে।

কানে তালা লেগে গেছে রঘুর, সেটা যেন মানুষের নরম মাংস পিষে তেলে যাবার যে শব্দ সেই–তার মতো। এই কাজ করতে হবে তাকে এবার, বেলা যা করে, ছিদাম যা করে। চুপ করে থাকলে তার চলবে না, পোঁছাবাবু তাকে কাছে টেনে কাজে লাগাবে বেন্দার মতো ছিদামের মতো। এই তার পথ। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকলে তার যেন প্রাণটা যাবে এমনিভাবে চট করে খিল খুলে রঘু পথে নেমে যায়। হনহন করে এগিয়ে যায় অন্ধকার গলি ধরে। নেশা তার কেটে গেছে। মদের নেশার চেয়ে অন্য নেশাই তার হয়েছিল জোরালো। ছিদামের ঘরের কাছাকাছি সে হোঁচট খায় একটা মানুষের দেহে। নেশার ঝেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ছিদাম রাস্তায় পড়ে আছে, কেউ তাকে তোলেনি। হোঁচট খাওয়ার রাগে একটা লাথি তুলে পা নামিয়ে নেয় রঘু। জোরে জোরে হাঁটতে শুরু করে। তার ধৈর্য ধরছিল না। কতক্ষণে গিরীনের কাছে গিয়ে বলবে নিজের চোখে যা কিছু দেখেছে–রোলার মেশিনের ঘটনা। সবাই যে অস্ত্রটি খুঁজছে, নিজের কাছে অকারণে একমুহূর্তের বেশি সেটি লুকিয়ে রাখবার কথা সে ভাবতেও পারছিল না।

কালোবাজারের প্রেমের দর

ধনঞ্জয় ও লীলার মধ্যে গভীর ভালোবাসা।

কোনো নাটকীয় রোমাঞ্চকর ঘটনার মধ্যে তাদের ভালোবাসা জন্মেনি, প্রেমে পড়ার বয়স হবার পর ঘটনাচক্রে হঠাৎ দেখা এবং পরিচয় হয়েও নয়। অল্প বয়স থেকে ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও স্নেহ-মমতার সম্পর্ক বড় হয়ে ক্রমে ক্রমে যে ভালোবাসায় পরিণত হয়, তাদের প্রেমটা সেই জাতের।

লীলা যখন স্কুল পার হয়ে কলেজে ঢুকেছে এবং ধনঞ্জয় ব্যবসায়ে নেমেছে তখনো তারা ভালোবাসা টের পায়নি। মাঝখানে ধনঞ্জয় ব্যবসা উপলক্ষে বছর তিনেক বাইরে ছিল–সেই সময় দুজনের মনেই খটকা লাগে যে ব্যাপারটা তবে কি এই? ধনঞ্জয় ফিরে আসা মাত্র সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়ে যায়–প্রথম দর্শনের দিনেই।

তা, হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে এত আশ্চর্য হবার কিছুই নেই। বিশেষ এ রকম পাকাঁপোক্ত বনিয়াদের ওপর অনেককাল ধরে যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে সেটা বিরাট দালানের মতোই–গাঁথুনি শেষ হবার আগে কে সেটাকে ইমারত বলে মনে করে?

তারপর বছরখানেক ধরে তাদের ভালোবাসা জমাট বেঁধেছে। এখন বিয়ের মধ্যে যথারীতি সমাপ্তি ঘটলেই হয়।

একটু বাধা আছে, তেমন মারাত্মক কিছু নয়। ব্যবসা ধনঞ্জয় মন্দ করছে না। কিন্তু এখনো ততটা ভালো করতে পারেনি লীলার বাবা পশুপতির যেটুকু দাবি। এমন একটা কিছু এখনো ধনঞ্জয় করতে পারেনি যাতে ব্যবসায়ী জাতের বড় বা মাঝারি রাঘব বোয়ালদের সঙ্গে তুলনায় যতই ছোট হোক অন্তত বড় ব্যবসায়ীর জাতে উঠতে পেরেছে বলে তাকে গণ্য করা যায়।

কথাটা স্পষ্ট করার জন্য ধনঞ্জয় বলেছে, যেমন ধরুন লাখ টাকা? কিন্তু সেটা কীভাবে দেখতে চান? কারবারে খাটছে অথবা ব্যাংকে জমা হয়েছে?

পশুপতি বলেছে, না না, এমন কথা আমি বলছি না যে আগে তোমাকে লাখপতি হতে হবে? লাখ টাকার কারবারি কি দেউলে হয় না? সে হল আলাদা কথা। ব্যবসার আসল ঘাটিতে তুমি মাথা গলিয়েছ–এটুকু হলেই যথেষ্ট। তারপর তোমার লাক আর আমার মেয়ের লাক। তুমি এখনো যাকে বলে ব্যবসায়ে এপ্রেন্টিস।

লীলার ইচ্ছা হলে অবশ্য এ বাধাটুকু কোথা ভেসে যেত। কিন্তু লীলাও এ বিষয়ে বাপের মতের সমর্থক।

সে বলে, যাই বল তাই বল; এদিকে ঢিল দিলে চলবে না। তোমার চাড় নষ্ট হয়ে যাবে–আমাকে নিয়ে মেতে থাকবে দিনরাত। তোমার ফিউচার নষ্ট করতে রাজি হব অত সস্তা পাওনি আমাকে।

ধনঞ্জয়ের ভবিষ্যৎ অবশ্য লীলারও ভবিষ্যৎ। কিন্তু ভালোবাসার মানেও তো তাই। কাজেই, এটা লীলার স্বার্থপরতা মনে করা ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়। ধনঞ্জয়। তা মনেও করে না।

খুব বেশি দুর্ভাবনার কারণও তার নেই। অপূর্ব যে কালোবাজার সৃষ্টি হয়েছে, অপূর্ব যে স্বাধীনতা পাওয়া গেছে ব্যবসা করে মুনাফা লুটবার, তাতে একবার একটা লাগসই সুযোগ পাকড়াতে পারলে আর দেখতে হবে না, রাতারাতি ব্যবসাজগতে নিজেকে এমন স্তরে তুলে নিতে পারবে যে লীলা বা তার বাবার কিছু বলার থাকবে না।

লীলা মাঝে মাঝে বলে, কী করছ তুমি? অ্যাদ্দিনেও কিছু করতে পারলে না, টুকটাক চালিয়ে যাচ্ছ! এদিকে কত বাজে লোক উতরে গেল। লোকেশবাবুর হতভাগা ছেলেটা পর্যন্ত একটা পারমিট বাগিয়ে কী রেটে কামাচ্ছে!

ধনঞ্জয় বলে, তোমরা শুধু ব্ল্যাকমার্কেটটা দেখছ আর এটা বাগিয়ে ওটা বাগিয়ে কত সহজে কে বড়লোক হচ্ছে সেটা দেখছ। ওই বাগানোর জন্য যে কী ভয়ানক কম্পিটিশন, কত কাঠখড় পোড়াতে হয়–সেটা তো দেখছ না।

লীলা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে হেসে বলে, তুমি পারবে। বাবা বলেন, মালটা তুমি খাঁটি।

ধনঞ্জয় হেসে বলে, আর তুমি কী বল? ভেজাল?

ভেজাল! আমার কাছে ভেজাল চলে? খাঁটি না হলে তোমায় আমি হাত ধরতে দিলাম?

ইতোমধ্যে ধনজ্ঞয়ের আশা-লোলুপতার বৃন্তে ফুল ধরবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। একদিকে যেমন বেড়ে যায় তার কর্মব্যস্ততা আর কমে যায় লীলার সঙ্গে দেখা করা গল্প করার সময়, অন্যদিকে তেমনি তার কথাবার্তা চালচলনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নতুন ধরনের একটা উৎসাহ ও উত্তেজনা।

কী হয়েছে তোমার?

লীলার প্রশ্নের জবাবে ধনঞ্জয় তাকে শুধু একটু আদর করে।

ব্যাপারটা কী?

বলব পরে।

লীলা হেসে বলে, বলতে হবে না, আমি বুঝেছি।

বুঝেছ?

বুঝব না? বিয়ের তারিখ ঘনিয়ে না এলে পুরুষমানুষের এ রকম ফুর্তি হয়!

কয়েকদিন পরে তারা দুজনে এক ভাটিয়া কোটিপতির বাড়িতে এক উৎসবের নিমন্ত্রণ রক্ষা করে ফিরেছে। ধনঞ্জয় বলে, একটা মোটা কন্ট্রাক্ট বোধ হয় পাব।

লীলা গিয়েছিল পশুপতির সঙ্গে, ধনঞ্জয় গিয়েছিল একা। প্রীতি অনুষ্ঠানে ধনঞ্জয় অযাচিত উপেক্ষিত হয়ে ছিল আগাগোড়া–যেটুকু খাতির পেয়েছিল সবটুকুই লীলার জন্য। কিন্তু আজ ধনঞ্জয়ের কোনো ক্ষোভ আছে মনে হয় না।

লীলা খুশি হয়ে বলে, খুলে বলো।

ধনঞ্জয় খুলেই বলে। হাজার আশি টাকার ব্যাপার। পরে কৌশলে আরো কিছু বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।

মি. নিরঞ্জন দাস দেবার মালিক, তাকে অনেক চেষ্টায় বাগানো গেছে।

বাবা কম হাঙ্গামা করতে হয়েছে আমাকে! লোকটা নিজে এতটুকু রিস্ক নেবে না, সব নিয়মদুরস্ত হওয়া চাই! কোনো দিক ফাঁক থাকলে চলবে না। অথচ এদিকে চাহিদাটি ঠিক আছে। দশ বছরের পুরনো ফার্ম ছাড়া কন্ট্রাক্ট দেওয়া চলবে না। এরকম একটা ফার্ম কোথায় লালবাতি জ্বালতে বসেছে খুঁজে খুঁজে গা বাঁচিয়ে কিনে নেওয়া কি সোজা কাজ!

কিনেছ?

হ্যাঁ। তবে মোটা রকম ঢালতে হয়েছে। তিনটে দিন মোটে সময়, করি কী। গরজ বুঝে গেল। যাকগে, সব তুলে নেব। হাজার গুণ তুলে নেব।

লীলা একটু ভেবে বলে, সব একেবারে ঠিকঠাক তো?

ধনঞ্জয় বলে, তা একরকম ঠিকঠাক বৈকি!

একরকম!

লীলা ধনঞ্জয়ের একটা কান আদর করে মলে দেয়, বাবা যে বলেন তুমি এপ্রেন্টিস, সেটা মিছে নয়। এত টাকা ঢেলে এতদূর এগিয়ে এখনো বলছ একরকম ঠিক! মোটা নিরঞ্জনকে বাধনি বুঝি যাতে কোনোরকম গোলমাল করতে না পারে? কী বুদ্ধি। এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি এই বাজারে ব্যবসা করবে!

ধনঞ্জয় রীতিমতো ভড়কে যেতে লীলা সাহস দিয়ে বলে, মোটা নিরঞ্জন তো? গোলমাল করবে না মনে হয়। আমি বরং একটু চাপ দেব। লোকটা খুব শিভালরাস।

চাপ দেবে মানে?

লীলা সশব্দে হেসে ওঠে, অমনি ঈর্ষা জাগল? এই মোটা নিরঞ্জনকেও তুমি ঈর্ষা করতে পার আমার বিষয়ে! ধন্য তুমি! মেয়েরা কী করে গা বাঁচিয়ে চাপ দেয় জান না?

গা বাঁচিয়ে চাপ দিতে গেলেও কাছে যেতে হয়, মিশতে হয়, হাসি আর মিষ্টি কথায় মন ভুলাতে হয়। তার ফলেই সৃষ্টি হল সমস্যা।

প্রেমের সমস্যা।

এতদিন পর্যন্ত তাদের ধারণা ছিল যে জগতে অন্য সমস্ত কিছুর দরদাম আছে, একটা ফুটো পয়সায় হোক বা লক্ষ টাকায় হোক সবকিছুর দাম ঠিক করা যায়–প্রেম অমূল্য। কারণ প্রেম তো কোনো বস্তু নয়–মাল নয় যে দাম দিয়ে কেনা যাবে।

নিরঞ্জন স্বয়ং ক্রেতা হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের ধারণা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।

নিরঞ্জন লীলাকে বিয়ে করতে চায়। কোনোরকম সস্তা বা কুৎসিত মতলব তার নেই, সে শুদ্ধ পবিত্র শাস্ত্রীয় অথবা ততোধিক শুদ্ধ আইনসঙ্গতভাবে লীলাকে গরীয়সী মহীয়সী স্ত্রী হিসেবে পেতে চায়। এর মধ্যে কালোবাজারি কোনো চাল নেই।

সে নিজে কিছু বলেনি। খ্যাতনামা একজনকে ঘটক হিসেবে পাঠিয়েছে পশুপতির কাছে। লীলার কাছে প্রেম নিবেদন করাও সে দরকার মনে করেনি। কারণ সে ভালো করেই জানে যে সোজাসুজি লীলার কাছে কথা পাড়লে লীলা সোজাসুজি জবাব দেবে–না।

ধনঞ্জয় গিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ সুদৃঢ় করার প্রত্যাশায়, নিরঞ্জন তাকে একটু অকারণ লজ্জা-মেশানো হাসি দিয়ে খাপছাড়া অভ্যর্থনা জানিয়ে সরলভাবে বলে, শুনলে তুমি ঠাট্টা করবে, কিন্তু বিয়েটিয়ে করে সংসারী হচ্ছি ভাই! তুমি চেন, পশুপতিবাবুর মেয়ে। সামনের মাসেই একটা শুভদিন দেখে যাতে হয় তার প্রস্তাব পাঠিয়েছি। নিরঞ্জন তাকে একটা সিগারেট দেয়। হাসিমুখেই আবার বলে, পশুপতিবাবু অনেকদিন ঘোরাফেরা করছেন–এ পর্যন্ত কিছু করা হয়নি। এবার কিছু করে দিতে হবে। তোমাকে কথা দিয়ে ফেলেছি–অন্য কেউ হলে এই কন্ট্রাক্টই পশুপতিবাবুকে দিয়ে দিতাম। কিন্তু তোমার কথা আলাদা–তোমাকে তো আর না। বলতে পারি না এখন!

কথাটা সহজেই বুঝতে পারে ধনঞ্জয়। অতি সরল স্পষ্ট মানে নিরঞ্জনের কথার। লীলাকে তার চাই, ধনঞ্জয় যদি ব্যাঘাত ঘটায় তবে বর্তমানের আশি হাজার এবং অদূর ভবিষ্যতে যা লক্ষাধিক টাকার কন্ট্রাক্ট দাঁড়াবে সেটা ফসকে যাবে ধনঞ্জয়ের হাত থেকে। শুধু তাই নয়, পশুপতিরও ভবিষ্যতে কোনোদিন কিছু বাগাবার আশা ভরসা থাকবে না নিরঞ্জনের মারফতে।

তারপরে কাজের কথায় আসে নিরঞ্জন। বলে, খুব সাবধানে হিসেব করে সব করবে! কোনো দিকে যেন কোনো ফাঁক না থাকে। এদিককার সব আমি সামলে নেব।

বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই ঠেকে ব্যাপারটা তাদের কাছে। পরস্পরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা করতে পর্যন্ত দুজনেই তারা ভয় পায়। নিজের নিজের ঘরে একা বসে তলিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে যে কিসে কী হল এবং এখন কী করার আছে!

নিরঞ্জনের প্রস্তাব নিয়ে যে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিটি ঘটকালি করতে গিয়েছিল তাকে। পশুপতি জানায় যে মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দু-তিন দিনের মধ্যেই নিরঞ্জনের সঙ্গে দেখা করবে।

নিরঞ্জনের আপিস থেকে ধনঞ্জয় সোজা বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। পশুপতি ধনঞ্জয়কে টেলিফোনে ডেকে পাঠায়।

ধনঞ্জয় বলে, আমি সব শুনেছি। কাল সকালে আপনার ওখানে যাব।

লীলাকে ডেকে দেব?

থাক।

ধনঞ্জয় ও লীলা দুজনেই সারারাত জেগে কাটায়–মাইলখানেক তফাতে শহরের দুটি বাড়ির দুখানা ঘরে, যে ব্যবধান তারা যে কেউ একজন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে কয়েক মিনিটে ঘুচিয়ে দিতে পারে!

সকালে ধনঞ্জয় আসে পশুপতির বাড়ি।

পশুপতি বলে, লীলার সঙ্গেই কথা বলো। তোমরা ছেলেমানুষ নও, তোমরা যা ঠিক করবে আমি তাই মেনে নেব।

লীলার চোখ লাল। বোঝা যায় রাত্রে বেশ খানিকটা কেঁদেছে। ধনঞ্জয়ের শুকনো বিবর্ণ মুখ একনজরে দেখেই আবার সে কেঁদে ফেলে। চোখ মুছতে মুছতে বলে, বোসো।

ধনঞ্জয় বসে, ধীরে ধীরে বলে, কিছু ঠিক করেছ?

লীলা বলে, তুমি?

তারপর দুজনেই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে।

প্রথমে লীলার কাছেই অসহ্য হয়ে ওঠে এই নীরবতা। বলে, নিরঞ্জন ছাড়বে না, সব ভেঙে দেবে। ধনঞ্জয় বলে, সে তো স্পষ্ট বলেই দিয়েছে।

আবার কবে তুমি এ রকম চান্স পাবে। কে জানে! একেবারে পাবে কি না তারও কিছু ঠিক নেই।

ধনঞ্জয় নীরবে সায় দেয়।

লীলা বলে, তাছাড়া এদিক ওদিক টাকাও ঢালতে হয়েছে অনেক। সব নষ্ট হবে।

ধনঞ্জয় বলে, তা হবে। এমনিতেও তোমাকে পাবার আশা একরকম ঘুচে যাবে।

লীলা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, তুমি যা ভেবেছ, আমিও তাই ভাবছি। কাল আমরা বিয়ে করতে চাইলে এ জগতে কারো সাধ্য আছে ঠেকায়? কিন্তু আমরা ছেলেমানুষ নই। বিয়ে নয় হল, তারপর? তোমার আমার দুজনেরই জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। কোনো লাভ নেই।

ধনঞ্জয় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সত্যি লাভ নেই।

 কে বাঁচায়, কে বাঁচে!

সেদিন আপিস যাবার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল-অনাহারে মৃত্যু! এতদিন শুধু শুনে আর পড়ে এসেছিল ফুটপাথে মৃত্যুর কথা, আজ চোখে পড়ল প্রথম। ফুটপাথে হাঁটা তার বেশি প্রয়োজন হয় না। নইলে দর্শনটা অনেক আগেই ঘটে যেত সন্দেহ নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু-পা হেঁটেই সে ট্রামে ওঠে, নামে গিয়ে প্রায়। আপিসেরই দরজায়। বাড়িটাও তার শহরের এমন এক নিরিবিলি অঞ্চলে যে সে পাড়ায় ফুটপাথও বেশি নেই, লোকে মরতেও যায় না বেশি। চাকর ও ছোট ভাই তার বাজার ও কেনাকাটা করে।

কয়েক মিনিটে মৃত্যুঞ্জয়ের সুস্থ শরীরটা অসুস্থ হয়ে গেল। মনে আঘাত পেলে মৃত্যুঞ্জয়ের শরীরে তার প্রতিক্রিয়া হয়, মানসিক বেদনাবোধের সঙ্গে চলতে থাকে শারীরিক কষ্টবোধ। আপিসে পৌঁছে নিজের ছোট কুঠরিতে ঢুকে সে যখন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল, তখন সে রীতিমতো কাবু হয়ে পড়েছে। একটু বসেই তাই উঠে গেল কলঘরে। দরজা বন্ধ করে বাড়ি থেকে পেট ভরে যতকিছু খেয়ে এসেছিল ভাজা, ডাল, তরকারি, মাছ, দই আর ভাত, প্রায় সব বমি করে উগড়ে দিল।

পাশের কুঠরি থেকে নিখিল যখন খবর নিতে এল, কলঘর থেকে ফিরে মৃত্যুঞ্জয়। কাঁচের গ্লাসে জল পান করছে। গ্লাসটা খালি করে নামিয়ে রেখে সে শূন্যদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল।

আপিসে সে আর নিখিল প্রায় সমপদস্থ। মাইনে দুজনের সমান, একটা বাড়তি দায়িত্বের জন্য মৃত্যুঞ্জয় পঞ্চাশ টাকা বেশি পায়। নিখিল রোগা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং একটু আলসে প্রকৃতির লোক। মৃত্যুঞ্জয়ের দু-বছর আগে বিয়ে করে আট বছরে সে মোটে দুটি সন্তানের পিতা হয়েছে। সংসারে তার নাকি মন নেই। অবসর জীবনটা সে বই পড়ে আর একটা চিন্তাজগৎ গড়ে তুলে কাটিয়ে দিতে চায়।

অন্য সকলের মতো মৃত্যুঞ্জয়কে সেও খুব পছন্দ করে। হয়তো মৃদু একটু অবজ্ঞার সঙ্গে ভালোও বাসে। মৃত্যুঞ্জয় শুধু নিরীহ শান্ত দরদী ভালোমানুষ বলে নয়, সৎ ও সরল বলেও নয়, মানবসভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা ঐতিহ্য-আদর্শবাদের কল্পনা-তাপস বলে। মৃত্যুঞ্জয় দুর্বলচিত্ত ভাবপ্রবণ আদর্শবাদী হলে কোনো কথা ছিল না, দুটো খোঁচা দিয়ে খেপিয়ে তুললেই তার মনে পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার বেরিয়ে এসে তাকে অবজ্ঞেয় করে দিত। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শ্লথ, নিস্তেজ নয়। শক্তির একটা উৎস আছে তার মধ্যে, অব্যয়কে শব্দরূপ দেবার চেষ্টায় যে শক্তি বহু ক্ষয় হয়ে গেছে মানুষের জগতে তারই একটা অংশ। নিখিল পর্যন্ত তাই মাঝে মাঝে কাবু হয়ে যায় মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে। মৃদু ঈর্ষার সঙ্গে সে তখন ভাবে যে নিখিল না হয়ে মৃত্যুঞ্জয় হলে মন্দ ছিল না।

মৃত্যুঞ্জয়ের রকম দেখেই নিখিল অনুমান করতে পারল, বড় একটা সমস্যার সঙ্গে তার সংঘর্ষ হয়েছে এবং শার্শিতে-আটকানো মৌমাছির মতো সে মাথা খুঁড়ছে সেই স্বচ্ছ সমস্যার অকারণ অর্থহীন অনুচিত কাঠিন্যে।

কী হল হে তোমার? নিখিল সন্তর্পণে প্রশ্ন করলে।

মরে গেল! না খেয়ে মরে গেল! আনমনে অর্ধভাষণে যেন আর্তনাদ করে উঠল মৃত্যুঞ্জয়।

আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে নিখিলের মনে হল, মৃত্যুঞ্জয়ের ভিতরটা সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। ফুটপাথে অনাহারে মৃত্যুর মতো সাধারণ সহজবোধ্য ব্যাপারটা সে ধারণা করতে পারছে না। সেটা আশ্চর্য নয়। সে একসঙ্গে পাহাড়প্রমাণ মালমশলা ঢোকাবার চেষ্টা করছে তার ক্ষুদ্র ধারণাশক্তির থলিটিতে। ফুটপাথের ওই বীভৎসতা ক্ষুধা অথবা মৃত্যুর রূপ? না-খেয়ে মরা, কী ও কেমন? কত কষ্ট হয় না-খেয়ে মরতে, কী রকম কষ্ট? ক্ষুধার যাতনা বেশি, না মৃত্যুযন্ত্রণা বেশি–ভয়ঙ্কর?

অথচ নিখিল প্রশ্ন করলে সে জবাবে বলল অন্য কথা-ভাবছি, আমি বেঁচে থাকতে যে-লোকটা না-খেয়ে মরে গেল, এ অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কী? জেনেশুনেও এতকাল চার বেলা করে খেয়েছি পেট ভরে। যথেষ্ট রিলিফওয়ার্ক হচ্ছে লোকের অভাবে, আর এদিকে ভেবে পাই না কী করে সময় কাটাব। ধিক, শত ধিক আমাকে।

মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করছে দেখে নিখিল চুপ করে থাকে। দরদের চেয়ে ছোঁয়াচে কিছুই নেই এ জগতে। নিখিলের মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দেশের সমস্ত দরদ পুঞ্জীভূত করে ঢাললেও এ আগুন নিভবে না ক্ষুধার, অন্নের বদলে বরং সমিধে পরিণত হয়ে যাবে। ভিক্ষা দেওয়ার মতো অস্বাভাবিক পাপ যদি আজও পুণ্য হয়ে থাকে, জীবনধারণের অন্নে মানুষের দাবি জন্মাবে কিসে? রূঢ় বাস্তব নিয়মকে উল্টে মধুর আধ্যাত্মিক নীতি করা যায়, কিন্তু সেটা হয় অনিয়ম। চিতার আগুনে যত কোটি মড়াই এ পর্যন্ত পোড়ানো হয়ে থাক, পৃথিবীর সমস্ত জ্যান্ত মানুষগুলোকে চিতায় তুলে দিলে আগুন তাদেরও পুড়িয়ে ছাই করে দেবে।

বিক্ষুব্ধ চিত্তে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নিখিল সংবাদপত্রটি তুলে নিল। চোখ বুলিয়ে যেতে যেতে নজরে পড়ল, ভালোভাবে সাতির ব্যবস্থা করে গোটা কুড়ি মৃতদেহকে স্বর্গে পাঠানো হয়নি বলে একস্থানে তীক্ষ্ণধার হা-হুঁতাশভরা মন্তব্য। করা হয়েছে।

কদিন পরেই মাইনের তারিখ এল। নিখিলকে প্রতিমাসে তিন জায়গায় কিছু কিছু টাকা পাঠাতে হয়। মানিঅর্ডারের ফর্ম আনিয়ে কলম ধরে সে ভেবে ঠিক করবার চেষ্টা করছে তিনটি সাহায্য এবার পাঁচ টাকা করে কমিয়ে দেবে কি না। মৃত্যুঞ্জয় ঘরে এসে বসল। সেদিনের পর থেকে মৃত্যুঞ্জয়ের মুখ বিষণ্ণ গম্ভীর হয়ে আছে। নিখিলের সঙ্গেও বেশি কথা বলেনি।

একটা কাজ করে দিতে হবে ভাই। মৃত্যুঞ্জয় একতাড়া নোট নিখিলের সামনে রাখল।–টাকাটা কোনো রিলিফ ফান্ডে দিয়ে আসতে হবে।

আমি কেন?

আমি পারব না।

নিখিল ধীরে ধীরে টাকাটা গুনল।

সমস্ত মাইনেটা?

হ্যাঁ।

বাড়িতে তোর ন-জন লোক। মাইনের টাকায় মাস চলে না। প্রতিমাসে ধার করছিস।

তা হোক। আমায় কিছু একটা করতেই হবে ভাই। রাতে ঘুম হয় না, খেতে বসলে খেতে পারি না। এক বেলা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। আমার আর টুনুর মার একবেলার ভাত বিলিয়ে দি।

নিখিল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জ্বর হলে যেমন দেখায়, মৃত্যুঞ্জয়ের গোলগাল মুখখানা তেমনি থমথম করছে। ভেতরে সে পুড়ছে সন্দেহ নেই।

টুনুর মার যা স্বাস্থ্য, একবেলা খেয়ে দিন পনের-কুড়ি টিকতে পারবে।

মন্তব্য শুনে মৃত্যুঞ্জয় ঝাঁপিয়ে উঠল। আমি কী করব? কত বলেছি, কত বুঝিয়েছি, কথা শুনবে না। আমি না খেলে উনিও খাবেন না। এ অন্যায় নয়? অত্যাচার নয়? মরে তো মরবে না-খেয়ে।

নিখিল ভেবেছিল বন্ধুকে বুঝিয়ে বলবে, এভাবে দেশের লোককে বাঁচানো যায় না। যে অন্ন পাওয়া যাচ্ছে সে অন্ন তো পেটে যাবেই কারো-না-কারো। যে রিলিফ চলছে তা শুধু একজনের বদলে আর একজনকে খাওয়ানো। এতে শুধু আড়ালে যারা মরছে তাদের মরতে দিয়ে চোখের সামনে যারা মরছে তাদের কয়েকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করার সান্ত্বনা। কিন্তু এসব কোনো কথাই সে বলতে পারল না, গলায় আটকে গেল।

সে শুধু বলল, ভুরিভোজনটা অন্যায়, কিন্তু না-খেয়ে মরাটা উচিত নয় ভাই। আমি কেটেছেটে যতদূর সম্ভব খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। বেঁচে থাকতে যতটুকু দরকার খাই এবং দেশের সমস্ত লোক মরে গেলেও যদি সেইটুকু সংগ্রহ করার ক্ষমতা আমার থাকে, কাউকে না দিয়ে নিজেই আমি তা খাব। নীতিধর্মের দিক থেকে বলছি না, সমাজধর্মের দিক থেকে বিচার করলে দশজনকে খুন করার চেয়ে নিজেকে না-খাইয়ে মারা বড় পাপ।

ওটা পাশবিক স্বার্থপরতা।

কিন্তু যারা না-খেয়ে মরছে তাদের যদি এই স্বার্থপরতা থাকত? এক কাপ অখাদ্য গ্রুয়েল দেওয়ার বদলে তাদের যদি স্বার্থপর করে তোলা হত? অন্ন থাকতে বাংলায় না-খেয়ে কেউ মরত না। তা সে অন্ন হাজার মাইল দূরেই থাক আর একত্রিশটা তালা লাগানো গুদামেই থাক।

তুই পাগল নিখিল। বদ্ধ পাগল। বলে মৃত্যুঞ্জয় উঠে গেল।

তারপর, দিন দিন কেমন যেন হয়ে যেতে লাগল মৃত্যুঞ্জয়। দেরি করে আপিসে আসে, কাজে ভুল করে, চুপ করে বসে ভাবে, এক সময় বেরিয়ে যায়। বাড়িতে তাকে পাওয়া যায় না। শহরের আদি অন্তহীন ফুটপাথ ধরে সে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। ডাস্টবিনের ধারে, গাছের নিচে খোলা ফুটপাথে যারা পড়ে থাকে, অনেক রাত্রে। দোকান বন্ধ হলে যারা হামাগুড়ি দিয়ে সামনের রোয়াকে উঠে একটু ভালো আশ্রয় খোঁজে, ভোর চারটে থেকে যারা লাইন দিয়ে বসে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয় তাদের লক্ষ্য করে। পাড়ায় পাড়ায় লঙ্গরখানা খুঁজে বার করে অন্নপ্রার্থীর ভিড় দেখে। প্রথম প্রথম সে এইসব নরনারীর যতজনের সঙ্গে সম্ভব আলাপ করত, এখন সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। সকলে এক কথাই বলে। ভাষা ও বলার ভঙ্গি পর্যন্ত তাদের এক ধাঁচের। নেশায় আচ্ছন্ন অর্ধচেতন মানুষের প্যানপ্যানানির মতো ঝিমানো সুরে সেই এক ভাগ্যের কথা, দুঃখের কাহিনী। কারো বুকে নালিশ নেই, কারো মনে প্রতিবাদ নেই। কোথা থেকে কীভাবে কেমন করে সব ওলটপালট হয়ে গেল তারা জানেনি, বোঝেনি, কিন্তু মেনে নিয়েছে।

মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়ির অবস্থা শোচনীয়। টুনুর মা বিছানা নিয়েছে, বিছানায় পড়ে থেকেই সে বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলকে তাগিদ দিয়ে দিয়ে স্বামীর খোঁজে বার বার বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু এই বিরাট শহরের কোথায় আগন্তুক মানুষের কোন। জঞ্জালের মধ্যে তাকে তারা খুঁজে বার করবে! কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে তারা ফিরে আসে, টুনুর মাকে মিথ্যা করে বলে যে মৃত্যুঞ্জয় আসছে–খানিক পরেই আসছে। খবর দিয়ে বাড়ির সকলে কেউ গম্ভীর, কেউ কাদাঁদ মুখ করে বসে থাকে, ছেলেমেয়েগুলো অনাদরে অবহেলায় ক্ষুধার জ্বালায় চেঁচিয়ে কাঁদে।

নিখিলকে বারবার আসতে হয়। টুনুর মা তাকে সকাতর অনুরোধ জানায়, সে যেন একটু নজর রাখে মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে, একটু যেন সে সঙ্গে থাকে তার।

নিখিল বলে, আপনি যদি সুস্থ হয়ে উঠে ঘরের দিকে তাকান তাহলে যতক্ষণ পারি সঙ্গে থাকব, নইলে নয়।

টুনুর মা বলে, উঠতে পারলে আমিই তো ওর সঙ্গে ঘুরতাম ঠাকুরপো।

ঘুরতেন?

নিশ্চয়। ওঁর সঙ্গে থেকে থেকে আমিও অনেকটা ওঁর মতো হয়ে গেছি। উনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন, আমারও মনে হচ্ছে যেন পাগল হয়ে যাব। ছেলেমেয়েগুলোর জন্য সত্যি আমার ভাবনা হয় না। কেবলি মনে পড়ে ফুটপাথের ওই লোকগুলোর কথা। আমাকে দু-তিন দিন সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে টুনুর মা আবার বলে, আচ্ছা, কিছুই কি করা যায় না? এই ভাবনাতেই ওঁর মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কেমন একটা ধারণা জন্মেছে, যথাসর্বস্ব দান করলেও কিছুই ভালো করতে পারবেন না। দারুণ একটা হতাশা জেগেছে ওঁর মনে। একেবারে মুষড়ে যাচ্ছেন দিন-কে-দিন।

নিখিল শোনে আর তার মুখ কালি হয়ে যায়।

মৃত্যুঞ্জয় আপিসে যায় না। নিখিল চেষ্টা করে তার ছুটির ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছে। আপিসের ছুটির পর সে মৃত্যুঞ্জয়ের কাছে যায়–মৃত্যুঞ্জয়ের ঘোরাফেরার স্থানগুলো এখন অনেকটা নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেও মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে কাটিয়ে দেয়, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে তাকে উল্টো কথা শোনায়, নিজের আগেকার যুক্তিতর্কগুলো নিজেই খণ্ড খণ্ড করে দেয়। মৃত্যুঞ্জয় শোনে কিন্তু তার চোখ দেখেই টের পাওয়া যায় যে কথার মানে সে আর বুঝতে পারছে না, তার অভিজ্ঞতার কাছে কথার মারপ্যাঁচ অর্থহীন হয়ে গেছে। ক্রমে ক্রমে নিখিলকে হাল ছেড়ে দিতে হয়।

তারপর মৃত্যুঞ্জয়ের গা থেকে ধূলিমলিন সিল্কের জামা অদৃশ্য হয়ে যায়। পরনের ধুতির বদলে আসে ছেঁড়া ন্যাকড়া, গায়ে তার মাটি জমা হয়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। দাড়িতে মুখ ঢেকে যায়। ছোট একটি মগ হাতে আরো দশজনের সঙ্গে সে পড়ে থাকে ফুটপাথে আর কাড়াকাড়ি মারামারি করে লঙ্গরখানার খিঁচুড়ি খায়। বলে, গা থেকে এইছি। খেতে পাই নে বাবা। আমায় খেতে দাও।

ছিনিয়ে খায়নি কেন

দলে দলে মরছে তবু ছিনিয়ে খায়নি। কেন জানেন বাবু?

এক জন নয়, দশজন, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে বরবাদ হয়ে গেছে। ভিক্ষের জন্য হাত বাড়িয়েছে, ফেন চেয়ে কাতরেছে, কিন্তু ছিনিয়ে নেবার জন্য, কেড়ে নেবার জন্য হাত বাড়ায়নি। অথচ হাত বাড়ালেই পায়। দোকানে থরে থরে সাজানো রয়েছে খাবার, সামনে রাস্তায় ধন্না দিয়েছে ফেলে-দেওয়া ঠোঙার রসটুকু, খাবারের কণাটুকু চাটবার জন্যে। হাটবাজারে রয়েছে ফলমূল তরিতরকারি, দোকানে আড়তে চাল ডাল তেল নুন, লুকানো গুদামে চালের পাহাড়, বড়লোকের ভাঁড়ারে দশ-বিশ বছরের ফুড-ফুড কথাটা চালু হয়েছে বাবু আপনাদের কল্যাণে, ভোতকা গাঁয়ের হোঁতকা তাঁতিও জানে কথাটা আর কথাটার মানে। গরিবের মুখে

উঠে যে চাল ডাল তেল নুন গুদোম থেকে গুদোমে কেনাবেচা হয়ে চালান যায়, তাকে বলে ফুড। হ্যাঁ, মাছ-মাংস, দুধ-ঘিও ফুড বটে। দশটা জিনিসের দশটা নাম বলতে লিখতে কষ্ট হয় বলে আপনারা ফুড চালিয়েছেন, চেঁচিয়েছেন ফুড সমস্যার বিধান চাই। তা, অত কষ্টে কাজ কী ছিল। ফুড না বলে চাল বললেই হত। শুধু চাল কাড়া-আকাঁড়া, পোকায় ধরা, যেমন হোক চাল। মাছ-মাংস, দুধ-ঘি, তেল-নুন এসব দশটা জিনিস তো চায়নি যারা না-খেয়ে মেরেছে। শুধু দুটি চাল দিলে হত তাদের, ফুডের জন্য মাথা না ঘামিয়ে। গাছে পাতা আছে, জঙ্গলে কচু আছে। তারা মরত না। রোজ দুটি আসেদ্ধ শুকনো চাল চিবিয়ে খেলেও মানুষ মরে না। আপনি মানবেন না, কিন্তু সত্যি মরে না বাবু। যত নেতিয়ে যাক, ধুকধুক প্রাণটা নিয়ে জীবন্ত থাকে।

চালার বাইরে ক্ষেতখামার আম-জাম কাঁঠাল-ঘেরা খড়ো ঘরগুলোতে বেলাশেষের ছায়া গাঢ় হয়ে যাচ্ছিল সন্ধ্যায়। উবু হয়ে বসে আনমনে যোগী জোর টানে তামাকের ধোঁয়ায় বুক ভরে নিয়ে আস্তে আস্তে ধোঁয়াটা বার করে দিতে থাকে। সামনেই টানছে। তামাক, আড়াল খোঁজেনি, একটু পিছু ফিরে বা একটু ঘরেও বসেনি। এটা লক্ষ্য করবার বিষয়। তামাক সেজে আগে অবশ্য আমাকেই বাড়িয়ে দিয়েছে ডান হাতে থেলো হুঁকোটা ধরে, বাঁ হাতে সেই হাতের কনুই ছুঁয়ে থেকে। জলহীন হুঁকোয় অত কড়া তামাকের তপ্ত ধোঁয়া টানবার ক্ষমতা প্রথম বয়সে ছিল, এখন আর পারি না। সিগারেট ধরিয়ে যোগীকেও একটা অফার করেছিলাম। মৃদু হেসে সিগারেটটা নিয়ে সে খুঁজেছিল কানে।

শুনেছিলাম সে নাকি নামকরা ডাকাত, তার নামে লোক ভয়ে কাঁপে। যে রকম কল্পনা করেছিলাম, চেহারাটা মোটেই মেলেনি তার সঙ্গে। বেঁটেখাটো লোকটা, শরীরটা খুব শক্তই হবে, আর কিছুই নয়। বাবরি-ছাঁটা ঝাঁকড়া চুল পর্যন্ত নেই। জেলে হয়তো হেঁটে দিয়ে থাকবে কদমছাটা করে, এখনো বড় হবার সময় পায়নি। এদেশের রণ-পা চড়া, লাঠি ঘুরিয়ে বুলেট ঠেকানো, নোটিশ দিয়ে ধনী জমিদারের বাড়ি ডাকাতি করতে যাওয়া, বড়লোকের ওপর ভীষণ নিষ্ঠুর, গরিবের ওপর পরম দয়ালু, খেয়ালি, ধূর্ত, উদার বিখ্যাত ডাকাতদের কাহিনীতে তাদের বিরাট দেহ আর অদ্ভুত অমানুষিক শক্তির কথা পড়েছি। যাদের ভীষণ আকৃতি দেখলেই লোকের দাঁতকপাটি লাগত, হুঙ্কার শুনলে কয়েক মাইল তফাতে গর্ভপাত হত স্ত্রীলোকের। বড়লোকের টাকা লুটে তারা গরিবকে বিলিয়ে দিত। দুর্ভিক্ষের সময় যোগী ডাকাতও নাকি মানুষ বাঁচাবার মহৎ কাজে নেমেছিল। সেবাও করত পথেঘাটে মুমূর্ষর, সুযোগমতো চুরি-ডাকাতি করে খাদ্য জুটিয়ে বিলিয়ে দিত। কয়েকটা মেয়েকে ক্রেতার কবল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বাঁচিয়েছে শোনা যায়। সাতকোশি খালে সরকারি। চালের নৌকায় ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পড়ে দু-বছর জেল হয় তার।

যোগী কথার সূত্র হারিয়ে ফেলেছে বুঝে মনে করিয়ে দিলাম, মরছে তবু ছিনিয়ে খায়নি কেন–যে কথা বলছিলে?

ও, হ্যাঁ বাবু, হ্যাঁ। আমি জানি কেন ছিনিয়ে খায়নি, শুধু আমি, একমাত্র আমিই জানি। কেউ জানে না আর। আপনার মতো অনেক বাবুকে শুধিয়েছি, তারা সবাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটা-সেটা বলেন, বড় বড় কথা। আবোল-তাবোল লম্বাচওড়া কথা। আসল ব্যাপারে সেরেফ ফাঁক। বোঝেন না কিছু, জানেন না কিছু বলবেন কী। এক বাবু বললেন, বেশিরভাগ তো গরিব চাষি, নিরীহ গোবেচারা লোক, কোনোকালে বেআইনি কাজ করেনি। লুট করে কেড়ে নিয়ে খাবার কথা ওরা ভাবতেও পারে না। শুনলে গা জ্বলে বাবু। সাধ যায় না, চাছা গালে একটা থাপড় দিয়ে কানডা মলে দিতে? বেআইনি কাজ, বেআইনি! যে জানে মরে যাবে কেড়ে না খেলে, সে হিসেব করেছে কাজটা আইনি না বেআইনি, ছিনিয়ে খেলে তাকে পুলিশ ধরবে, তার জেল হবে। জেলে যেতে পারলে তো ভাগ্যি ছিল তার? মেয়ে বৌকে ভাড়া দিচ্ছে, বেচে দিচ্ছে, সুযোগ পেলে তার চেয়ে কমজোরি মর-মর সাথির গলা টিপে মেরে ফেলেছে যদি একমুঠো খুদ জোটে, তার কাছে আইন। আরেক বাবু বললেন, ওটা কী জান যোগী, ওরা সব মুখ গরিব, চাষাভুষো মানুষ, অদেষ্ট মানে। না-খেয়ে মরতে হবে, বিধাতার এই বিধান, উপায় কী–এই ভেবে মরেছে না-খেয়ে, লুটেপুটে খেয়ে বাঁচবার চেষ্টা করেনি। শুনেছেন বাবু কথা, আঁতজ্বালানি পণ্ডিতি কথা? সাপে কাটে, রোগে ধরে, আগুন লাগে, বন্যা হয়, আকাল আসেসব অদেষ্ট বটেই তো, কে না জানে সেটা? তাই বলে সাপে কাটলে বাঁধন আঁটে না, ওঝা ডাকে না? রোগে বড়ি-পাঁচন, শিকড়-পাতা খায় না, মানত করে না? ঘরে আগুন লাগলে দাওয়ায় বসে তামুক টানে? ফসল বাঁচাতে যায় না বন্যা এলে? আকাল অদেষ্ট বলে কেউ ঘরে বসে হাত-পা গুটিয়ে মরেছে একজন কেউ ওদের? যা কিছু আছে বেচে দেয়নি বাঁচার জন্যে, ছেলেমেয়ে, বৌ, বোনসুদ্ধ? ছুটে যায়নি শহরে, বাবুদের রিলিফখানায়? অদেষ্ট মানে, হ্যাঁ, অদেষ্টে মরণ থাকলে মরবে জানে, হ্যাঁ, তাই বলে ছিনিয়ে খেয়ে বাচতে পারলে চেষ্টা করে দেখবে না একবারটি? আরেক বাবু বললেন–

বাবুরা কী বলেন জানি যোগী। তোমার কথা বলল। শোনেন না বাবু মজার কথা, হাসি পাবে শুনলে। বললেন কী? না আধপেটা খাওয়া, উপোস দেয়া ওদের চিরকেলে অভ্যাস। ঘটিবাটি, জমিজমা তো চিরজন্মই বেচে আসছে পেটের জন্যে। আকাল তো ওদের লেগেই আছে বছর বছর। বলতে বলতে গলা সত্যি ধরে এসেছিল তেনার, দুঃখীর তরে দরদ ছিল বাবুর। নাক ঝেড়ে, গলা খাঁকরে তারপর বললেন, বড় আকাল এল, ওরাও এইভাবে লড়াই করল বাঁচতে, চিরকাল যেমন করে এসেছে, ঘরে ভাত না থাকলে যা করা ওদের অভ্যেস। আমি বললাম, তা নয় বুঝলাম বাবু, না-খাওয়াটা ওদের অভ্যেস ছিল। কিন্তু মরাটাও কি অভ্যেস ছিল বাবু?

যোগী হা হা করে হাসিতে ফেটে পড়ে। বুঝতে পারি অনেকবার অনেককে শোনালেও এই পুরনো মর্মান্তিক রসিকতার রস তার কাছে জলো হয়নি।

বললাম, ধরুন একটা দোকান, তাতে কিছু চাল আছে। লোক মোটে দুটো কি তিনটে দোকানে। সাত দিন উপোস দিয়ে আছে এক কুড়ি দেড় কুড়ি লোক, জানে যে চাল কটা পেলে বাঁচবে নয়তো মিত্যু নিচ্চয়। অত সব নয় না-ই জানল, পেটে তো খিদে ডাকছে। হানা দিয়ে চাল কটা ছিনিয়ে নিলে ঠেকাবার কেউ নেই। তা না করে ফেউ ফেউ করে শুধু ভিক্ষে চাইল কেন ওরা? দোকানি দূর-দূর করে খেদিয়ে দিতে আবার গেল কেন অন্য জায়গায় ভিক্ষে চাইতে? এমন কত দেখেছি সহজে ছিনিয়ে নেবার খাসা সুযোগ কিন্তু ছিনিয়ে না নিয়ে বিনিয়ে বিনিয়ে দয়া চেয়েছে, না পেয়ে মরেছে। বাবু আমতা আমতা করে একটা জবাব দিলেন। সেই অভ্যেসের কথা, দশজনে মিলে দল বেঁধে লুট করতে কি ওরা জানত, না কথাটা ভাবতে পেরেছে, খুদকুঁড়ো নিয়ে বরং মারামারিই করছে নিজেদের মধ্যে। আসল কথাটার জবাব নেই। জানলে তো বলবেন? জবাবটা জানি আমি। শুধু আমি। আর কেউ জানে না। তবে বলি শুনুন।

ডাকতেছ?

ঘরের ভিতরে অন্ধকার হয়ে এসেছে, একটি প্রদীপ জ্বলতে সেদিকে নজর পড়েছিল। প্রদীপটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল কালোপেড়ে কোরা শাড়ি পরা ঢ্যাঙা একটি যুবতী। মনে হল, যোগীর উদ্ধার-করা মেয়েদের একজন নয় তো? তার পরেই খেয়াল হল, যোগী প্রায় দুবছর জেলে কাটিয়ে মোটে মাস তিন-চারেক আগে জেল থেকে বেরিয়েছে।

তামাক দে।

প্রদীপটা চৌকাটে বসিয়ে দিয়ে সে তামাক সাজতে গেল।

আমার পরিবার, যোগী বলল, হারিয়ে গেছিল। জেল থেকে বেরিয়ে এক মাস দেড় মাস ধরে খুঁজে খুঁজে বার করেছি সদরে।

ব্যাপারটার ইঙ্গিত বুঝে চুপ করে রইলাম। বাইরে দিনের আলো নিভে গিয়ে প্রায় গোটা চাঁদটার জোছনা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যা বলছিলাম বাবু। সর্বনাশা দিনগুলোর কথা জানেন তো সব, নিজের চোখে দেখেছেন সব। আপনাকে বলতে হবে না বন্ননা করে। আমি তখন হকচকিয়ে গেছি। না খেয়ে তোক পথেঘাটে মরছে দেখে মনে বড় কষ্ট। আর গায়ে জ্বালা, ভীষণ জ্বালা, সা জোতদার, নন্দ আড়তদার, সরকারি কর্তা করিম সায়েব, পুলিনবাবু- এদের কাণ্ডকারখানা দেখে এলাম। কলকাতা গিয়ে পর্যন্ত কাটিয়ে এলাম সাতদিন, সাতদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে। বুঝি না ব্যাপারটা কিছু, যত ভাবি মাথা গুলোয়ে যায়, অন্নের তো অভাব কিছু নেই, এত লোক মরে কেন ছিনিয়ে না খেয়ে? গরুছাগল তো মাঠে ঘাস না পেলে ক্ষেতে ঢোকে, মার খেয়ে নড়তে চায় না সহজে, বাগানে ফুলগাছ খায়, ঘরের চালা থেকে খড় টেনে নেয়। এগুলো মানুষ হয়ে করছে কী? ধান-চাল লুট করি দু-এক জাগায়, বিলিয়ে দি এদিক ওদিক, মন মানে না। একা আমি দু-চার জনকে নিয়ে লুটেপুটে কটাকে খাওয়াব? বাঁধা দল আমার ছিল না বাবু কোনোকালে, পেশাদার ডাকাত আমি নইকো, যাই বলুক লোকে আর পুলিশে আমার নামে অকথা কুকথা। আপনার কাছে লুকাব না, মাঝে দল গড়ে হানা দিয়ে লুট করেছি টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি, মারধর করেছি, কিন্তু মানুষ একটা মারিনি বাপের জন্মে, বাপ যদি জন্ম দিয়ে থাকে মোকে। কাজ ফতে করে দল ভেঙে দিয়েছি ফের। টাকা-পয়সার বদলিতে ধানচাল লুটের জন্য দল একটা গড়তে চাইলাম, স্যাঙাতেরা কেউ স্বীকার গেল না দুজন ছাড়া। ডাকাতি করব সোনাদানার বদলে ধানচালের জন্যে, তাও আবার বিলিয়ে দেব, শুনে ওরা ভাবল হয় মাথাটা মোর বিগড়ে গেছে একদম, নয় তামাশা করছি ওদের সাথে। দুজন যারা এল, তারা ছোকরা বয়সী, ওস্তাদ বলে মোকে মানত। দুজনকে নিয়ে মোটা দাও কী মারব বলুন, চুক-ছাক দু-দশ মণ চাল তো পেলে কেড়ে নি, বিলোতে গিয়ে শুরু করতে-না-করতে ফুরিয়ে যায়। দেশজুড়ে সবার পেটের চামড়া চামচিকে, কজনকে দেব আমি? ভাবলাম দুত্তোর! এ শখের কেদানি দেখিয়ে আর কাজ নেই। মোর দুমুঠো বালির বাঁধে কি এই মড়কের বন্যা ঠেকানো যাবে? তার চেয়ে এক কাজ যদি করি তবে হয়তো ফল হবে কিছুটা। না-খেয়ে মরছে যারা তাদের শেখাতে হবে ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচতে। নিজের পেট ভরাবার ব্যবস্থা নিজে যদি না ওরা করতে পারে আমার গরজ! না, কী বলেন বাবু?।

সদরের মন্দ বস্তি থেকে খুঁজে উদ্ধার করে-আনা যোগীর পরিবার ফুঁ দিতে দিতে কলকে এনে দেয়। কলকের আগুনে লালিয়ে লালিয়ে ওঠা তার ভোতা লম্বাটে মুখে। মন্দ মেয়ের বস্তির জীবনের কোনো ছাপ চোখে পড়ে না, বরং শান্ত নিশ্চিন্ত নির্ভর খুঁজে পাই।

সেই থেকে বসে আছেন, যোগী বলে কলকেটা হুঁকোয় বসিয়ে, তার পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে কথা শেষ হবার অপেক্ষায়, একটু চা দিয়ে যে ভদ্রস্থতা করব তার ব্যবস্থা নেই গরিবের ঘরে। দুটো চিঁড়ের মোয়া খাবেন বাবু, নতুন গুড়ের টাটকা মোয়া?

ভদ্র অতিথিকে নিয়ে তার বিপন্ন ভাব অনুভব করে বলি, খাব না? এতক্ষণ বলতে হয়। জোর খিদে পেয়েছে, আমি ভাবছি কী ব্যাপার, মুড়ি চিঁড়ে কিছু কি নেই যোগীর, খেতে বলছে না। যোগীর পরিবারের হাসিটা আধা দেখতে পাই প্রদীপের আলোয়।

সদরে রিলিফখানা খুলেছে, খিঁচুড়ি বিলি করে। সটান গিয়ে হাজির হলাম সেখানে। সেজেগুঁজে গেলাম, ছেঁড়া নেংটি পরে, উদলা গায়ে, মোচদাড়ি না কামিয়ে। তবু অন্নের অভাব তো ভোগ করিনি কোনো একটা দিন দু-চার বছরের মধ্যে, ওসব কাঁকলাসের সাথে কি মিশ খায় মোর। আড়চোখে আড়চোখে তাকায় সবাই, ভাবে যে এ আবার কোত্থেকে এল। ঝোলের মতো ট্যাকটেকে পাতলা খিঁচুড়ি যে বিলোয় সে ব্যাটাচ্ছেলে মোকে দেখলেই বলে, হারামজাদা, তুই এখানে কেন, খেটে খাবি যা। মেয়েছেলে দু-একটা দেখেশুনে ভাব জমাতে চেষ্টা করে মোর সাথে, ভাবে যে মোর বুঝি সঙ্গতি আছে অন্তত দু-চার বেলা খাবার–চুপিচুপি শার্ট গায়ে দিয়ে ধুতি পরে শহরে ঢুরতে বেরুবার সময় হয়তো-বা দেখে ফেলতে পারে। কান্না পেত বাবু মেয়েছেলে কটার রকম দেখে। মেয়েছেলে। হাড়ে জড়ানো সিটে চামড়া, তাতে ঘা-প্যাঁচড়া। আধ-ওঠা চুলের জট খ্যাপার মতো চুলকোচ্ছে উকুনের কামড়ে। মাই বলতে লবঙ্গের মতো শুকনো বোটা, পাছা বলতে লাঠির ডগার মতো, খোঁচানো হাড়ি। আর কী দুর্গন্ধ গায়ে, পচা ইঁদুর, মরা সাপের মতো। তাদের চেষ্টা পুরুষের মন ভুলিয়ে একটা বেলা একটু খাওয়া জোগাড় করা পেট ভরে।

যোগী গুম খেয়ে থাকে যতক্ষণ না তার পরিবার ডালায় আট-দশটা চিড়ার মোয়া আর ছোটখাটো নৈবিদ্যের মতো নারকেল নাড় সাজিয়ে এনে আমার সামনে ধরে। পরিবারটিও তার রোগা ঢ্যাঙা ছিপছিপে–তবে সুস্থ। কোরা কাপড়ের ভাজে ছোট মাই, আবার সন্তান আসতে চাইলে যা সুধায় ভরে উঠবে অনায়াসে।

মারাত্মক গুম-খাওয়া ভাবটা কেটে যায় যোগীর। ওর দিকে তাকিয়েই বলে, বাবুকে কি রাক্ষস ঠাওরালি নাকি, আঁ? দুটো মোয়া, দুটো। নাড় রেখে তুলে নিয়ে যা সব। গেলাস নেই তো কী হবে, ঘটিটা মাজা আছে, টিউবওয়েলের জলের কলসি থেকে জল এনে দে ঘটিতে। একটু থেমে বিনয়ের সুরে হঠাৎ অন্য একটা কৈফিয়ত সে বলে তার পরিবারকে, মাছ আর আজ আনা হল না, বিন্দি।

মাছের তরে মরছি। বিন্দি এতক্ষণে এবার প্রথম মুখ খোলে ঝংকার দিয়ে।

সবাইকে বলি, ছিনিয়ে নিয়ে খাও না? এসো, আমরা সবাই মিলে ছিনিয়ে নিয়ে খাই। ব্যাপার বুঝছ তো, মোদের খিঁচুড়ি ভোগের জন্য যে চাল ডাল আসে তার বেশিরভাগ চোরাগোপ্তা হয়ে যায়, নইলে খিঁচুড়ি এমন নুন জলের মতো লাগে? এমনিও মরব, ওমনিও মরব, এসো বাঁচার তরে লড়াই করে মরি। কর্তারা ভোজ খাবেন, মোরা না খেয়ে মরব! কেড়ে খাই এসো। এমনিভাবে কত করে কত রকমে বুঝিয়ে বলি, কেউ যেন কান দেয় না কথায়। কান দেয় না ঠিক নয়, কানে যেন যায় না কথা। ঝিমোতে ঝিমোতে বলে, আঁ, আঁ, কী বলছিলে? বলে আবার ঝিমোয়, জলো খিঁচুড়ি এক চুমুকে খাবার খানিক পরে যদি-বা কেউ কেউ একটু উৎসাহ দেখায়, একটু জ্বালা জানায় যে সত্যি এত অন্ন থাকতে তারা না-খেয়ে মরবে এ ভারি অন্যায়-বিকালে তারা নিঝুম হয়ে যায়। রিলিফখানায় সারি দিতে আগুপিছু নিয়ে কামড়াকামড়ি করে, ছোট এক মগ সেদ্ধ চাল ডালের ঝোলের জন্যে–ছিনিয়ে নিয়ে। পেট ভরে ডালভাত খাবার জন্যে কারো উৎসাহ দেখি না।

একদিন খবর পেলাম, রিলিফখানার জন্যে মোটামতো সরকারি চালান আরেকটা এয়েছে এ্যাদ্দিন পরে, সাত দিন কেন পুরো আধ মাস সত্যিকারের ঘন খিঁচুড়ি বিলানো চলবে। কিন্তু দেখেশুনে তখন অভিজ্ঞতা জন্মে গেছে বাবু। যত চালান আসুক, একটা দিনের বিলানো খিঁচুড়িও সত্যিকারের খিঁচুড়ি হবে না, চাল ডাল বেশিরভাগ চলে যাবে। চোরাবাজারে। সদরে জানাচেনা লোক ছিল কটা। মানে আর কি, আপনার কাছে ঢাকঢাক গুড়গুড় করব না, শহরের চোর, হ্যাঁচড়, গুণ্ডা বজ্জাত, চোরাগোপ্তা ছোরামারা-গোছের লোকের সর্দার কজন আর কি। ওপরওলাদের সাথে খাতির ছিল ওদের, ওদের ছাড়া চলে না সরকারি বেসরকারি বড়কর্তাদের চোরাকারবার। ওদের একজন একটা ব্যাপারে সাথে ছিল মোর ক-বছর আগে, বড় বাঁচান বাঁচিয়েছিলাম। দু-দশ বছরের জেল থেকে। একটু খাতির করল, খানিকটা মাত্তর। ওর মারফতে আর দু-চার জনকে জড়ো করে, তারাও চিনত জানত মোকে, চাল চেলে, ভাওতা মেরে কাণ্ড করিয়ে দিলাম একটা রেলের ইস্টিশানে। চাদ্দিকে হইচই পড়ে গেল। চালানি চালডাল সব গেল রিলিফখান্মর গুদামে, শেষ বস্তাটি।

বললে না পিত্যয় যাবেন বাবু পুরো চারটে দিন ঘন খিঁচুড়ির সাথে একটা করে আলুসেদ্ধ খেল ভিখিরির দলকে দল সবাই। আদ্দেক লোককে দিতে না দিতে ফুরিয়ে গেল না খিঁচুড়ি, কেউ বলল না ধমক দিয়ে, ওবেলা আসিস, এখন ভাগ শালার ব্যাটা শালা। আর এটাই আসল কথা মন দিয়ে শোনেন বাবু। ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচবার কথা যারা কেউ কানে তোলেনি, দুটো দিন দু-বেলা এক মগ চাল ডাল আর একটা করে আলুসেদ্ধ খেয়ে সকলে কান পেতে শুনতে লাগল আমার কথা, সায় দিতে লাগল যে এই ঠিক, এ ছাড়া বাঁচবার উপায় নেই। মুখের গ্রাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে বজ্জাতরা, কেড়ে নিতে হবে সব, পেট পুরে খেয়ে বাঁচতে হবে দু-বেলা। আমি যা বলি, সবাই সায় দিয়ে তাই বলে। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারি না, মাথা গুলিয়ে যায়। পরদিন যেন উৎসাহ আরো বেড়ে যায়। পরের দিন তাদেরই কজন আমার কাছে এসে বলে যে তারা গুদোম থেকে চাল ডাল ছিনিয়ে নিতে রাজি, নিজেরা বেঁধেবেড়ে খাবে। আমি অ্যাদ্দিন জপাচ্ছি তাদের, আমাকে ঠিকঠাক করে চালাতে হবে কখন কীভাবে কোথায় কী করতে হবে গুদোম থেকে মালপত্তর সব লুটপাট করে নিতে হলে।

কী বোকামিটাই করলাম সেদিন বাবু। ভাবলাম কী, এমন আবোলতাবোল ভাবে নয়, মাঝে মাঝে তিন বন্দুকওয়ালা জমিদারের বাড়ি হানা দেবার আগে যেমনভাবে দল গড়েছি শিখিয়ে পড়িয়ে তালিম দিয়ে, তেমনিভাবে এদের গড়ে তুলব টাকা-পয়সা লুটতে নয়, ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচবার কায়দা। এই-না ভেবে পিছিয়ে দিলাম সবাইকে নিয়ে যাওয়াটা কদিনের জন্যে। রাতারাতি মিলিটারি লরিতে চালান হয়ে গেল রিলিফখানার গুদোমের আদ্দেক মাল। পরদিন সেই রং-করা জলো খিঁচুড়ি।

তাতে যেন জোর বেড়েছে মনে হল সকলের দল বেঁধে ছিনিয়ে খাওয়ার সাধটার। মোকে ঘিরে ধরে শ-দেড়েক মাগীমদ্দ বলতে লাগল, চলো না যাই, ছিনিয়ে আনি ধানচাল। বাচ্চাগুলো পর্যন্ত তড়পাতে লাগল।

বৈকুণ্ঠ সা-র গুদামে কম করে তিন হাজার মন চাল আছে জানতাম। চালান দেবার ব্যাপারে কত্তাদের সাথে ভাগবাটোয়ারার মীমাংসা না হওয়ায় ব্যাটার গুদোমে মাল শুধু জমছিল মাসখানেক। গুদোমটার হদিস টদিস নিয়ে কালক্ষণ সুযোগ ঠাহর করতে দুটো দিন কেটে গেল। যখন বললাম কীভাবে কী মতলব করেছি সা-র গুদোমের জমানো অন্ন ছিনিয়ে নেবার, তেমন যেন সাড়া এল না সবার কাছ থেকে। শুধু তাদের নয়, চাদ্দিকের কম করে হাজারটা ভুখা মেয়ে-পুরুষ বাচ্চা-কাচ্চাদের বাঁচাবার উপায় হবে বললাম, সায় এল কেমন মনমরা ঝিমানো মতন।

পরদিন কেউ যেন কান দিল না আমার কথায়। জলো খিঁচুড়ি বাগাবার ভাবনায় সবাই যেন ফের আবার মশগুল হয়ে গেছে, আর কিছু ভাববার ক্ষেমতা নেই, মন নেই।

সেদিন বুঝলাম বাবু কেন এত লোক না-খেয়ে মরেছে, এত খাবার হাতের কাছে থাকতে ছিনিয়ে খায়নি কেন। এক দিন খেতে না পেলে শরীরটা শুধু শুকায় না, লড়াই করে ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচার তাগিদও ঝিমিয়ে যায়। দু-চার দিন একটু কিছু খেতে পেলেই সেটা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। দুদিন খেতে না পেলে ফের ঝিমিয়ে যায়। তা এতে আশ্চর্য কী। এ তো সহজ সোজা কথা। কেউ বোঝে না কেন তাই ভাবি। শান্তরে বলে নি বাবু, অন্ন জল প্রাণ? খেতে না পেলে গরু দুধ দেয় না বলদ জমি চষে? কয়লা না-খেয়ে ইঞ্জিন গাড়ি টানে? মহাভারতে সেই মুনির কথা আছে। না-খেয়ে তপ করেন, একদিন দ্যাখেন কী, গর্তের মুখে পুতুলের মতো জ্যান্ত জ্যান্ত মানুষ ঝুলছে ঘাসের শিকড় ধরে, শিকড়গুলো দাঁতে কাটছে ইঁদুর। মুনি বললে, করছ কী তোমরা সব, ইঁদুরে শিকড় কাটছে দেখছ না, গর্তে পড়বে যে ধপাস করে? খুদে খুদে লোকগুলো বললে, বাপু, মোরা তোমার পূর্বপুরুষ। বংশে শুধু তুমি আছ। তুমি হলে এই শিকড়টা, যা ধরে মোরা ঝুলছি, হা দ্যাখো–নিচে নরক। শিকড় যিনি কাটছেন চোখা ধারালো দাঁত দিয়ে, তিনি হলেন ধম্ম মশায়। বিয়ে করো, পুতুর। জন্মাও, মোদের বাঁচাও নরক থেকে। মুনি ভড়কে গিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করলে এক রাজার মেয়েকে, রাজভোগ খেয়ে পুষ্ট মেয়ে, চটপট ছেলে হবে, পূর্বপুরুষ উদ্ধার পাবে। বছর কাটে দুটো তিনটে, গভ হয় না রাজার মেয়ের। মুনি চটে বলে, এ কী কাণ্ড বলো তো বৌ, তুমি বাজা নাকি? রাজার মেয়ে বলে ঝংকার দিয়ে, নজ্জা করে না বলতে? উপোস করে শুকনো কাঠি হয়ে উনি বনে গিয়ে তপস্যা করবেন, এক রাত্তির খেয়ে শুতে বসবাস করতে পারবেন না বিয়ে-করা বৌয়ের সাথে, ফের বলবেন যে ছেলে হয় না কেন, বৌ তুমি বাজা নাকি। নজ্জা করে না? না-খেয়ে না-খেয়ে নিজে বাঁজা হয়েছ। শক্তি নেই, ক্ষেমতা নেই, বৌকে বাজা বলতে নজ্জা করে না? কথার মানে বুঝে, তপস্যা করে যে সোজা কথা বোঝে নি, সেটা চট করে। বুঝে নিয়ে মুনি ঠাকুর তাড়াতাড়ি গিয়ে বিত্তি চায় রাজার কাছে। দুধ-ঘি, লুচি-মাংস, পোলাও-কালিয়া খায় পেট ভরে যত খেতে পারে। বললে না পিত্যয় যাবেন বাবু, এক বছরে ছেলে বিয়োয় মুনির বৌ-

রাত হয়নি? যেতে হবে না বাবুকে দেড়কোশ পথ? যোগী ডাকাতের পরিবার এসে বলে।

মনে হয়, সত্যি কি মিথ্যা জানি না, মেয়েটার গড়ন এমন রোগাটে ছিপছিপে বলেই বোধ হয় আগামী মাতৃত্ব এতখানি স্পষ্ট হয়েছে। মনে হয় তিন-চার মাসের মধ্যে যোগী ডাকাতকে সে ছেলে বা মেয়ের বাপ করবেই। জোছনায় গেঁয়ো পথে চার মাইল দূরের স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, যোগী কি এতই বোকা, সে এত জানে আর এই সহজ সত্যটা জানে না খুব কম করেও কটা মাস অন্তত লাগে মেয়েমানুষের মা হয়ে ছেলে বা মেয়ে বিয়েতে?

আমার দেশের মাটিতে আমি সমান তালে চলতে পারি না যোগীর সাথে। আলোর বাঁকে হোঁচট খাই, কাটা ধানের গোড়ার খোঁচায় ব্যথা পাই, কাঁচা মাটির রাস্তায় উঠতে দেড় হাত নালায় পড়ে যাই। যোগী সামলে-সুমলে টেনে নিয়ে চলে আমায়। তার মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারি আমার হিসাব-নিকাশ। বিশেষণের ভুল। যোগী ডাকাত মহাভারতের সেই মুনি নয়। স্বর্গ নরক তার কল্পনায় আছে কি নেই সন্দেহ। বংশ রক্ষায় সে মোটেই ব্যগ্র নয়। ইংরেজের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে খুঁজে খুঁজে মন্দ বস্তি থেকে হারানো বৌকে ফিরে এনে সে আজ শুধু এই কারণে অখুশি হতে নারাজ যে, বৌ তার যে-ছেলে বা মেয়ের মা হবে সে তার জন্মদাতা নয়। সে বাপ হবে তার পরিবারের বাচ্চার, ছেলে বা মেয়ে যাই হোক সেটা। আজেবাজে খেয়ালে–যেসব খেয়াল তাদেরই মানায়, তাদেরই ফ্যাশান, যারা ছিনিয়ে খেয়ে বাঁচার প্রবৃত্তিটা পর্যন্ত কেঁচে দিয়ে মারতে পারে লাখে লাখে মা-বাপ, ছেলে-মেয়ে–অনর্থক অখুশি হতে রাজি নয় মানুষ।

তার পরিবার খেতে না পেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল তো? যে ভাবে পারে খেতে পেয়ে নিজেকে বাঁচিয়েছে তো? তারপর আর কোনো কথা আছে?

ছেলেমানুষি

ব্যবধান টেকেনি। হাত দুই চওড়া সরু একটা বন্ধ প্যাসেজ বাড়ির সামনের দিকটা তফাত করে রেখেছে, দু-বাড়ির মুখোমুখি সদর দরজাও এই প্যাসেজটুকুর মধ্যে। পিছনে দু-বাড়ির ছাদ এক, মাঝখানে দেয়াল উঠে ভাগ হয়েছে, মানুষ-সমান উঁচু। টুল বা চেয়ার পেতে দাঁড়ালে বড়দের মাথা দেয়াল ছাড়িয়ে ওঠে।

ব্যবধান টেকেনি। কতটুকু আর পার্থক্য জীবন-যাপনের, সুখদুঃখ, হাসি-কান্না, আশা-আনন্দের, ঘৃণা ভালোবাসার। সকালে কাজে যায় তারাপদ আর নাসিরুদ্দীন, অপরাহ্নে ফিরে আসে অবসন্ন হয়ে। ব্যর্থ স্বপ্ন উৎসুক কল্পনা দিন দিন জমে ওঠে একই ধরনের, ক্ষোভ দিনে দিনে তীব্র হয় দুটি বুকে একই শক্তির বিরুদ্ধে। ইন্দিরা আর হালিমা যাপন করে বন্দি জীবন-রাধে-বাড়ে, বাসন মাজে, স্বপ্ন দেখে আর অকারণ আঘাত মুখ বুজে সয়ে চলে অবুঝ নিষ্ঠুর সংসারের। ইন্দিরার কোলে একদিন আসে গীতা। পরের বছর অবিকল তারই বেদনাকে নকল করে হালিমা পৃথিবীতে আনে হাবিবকে।

যদি-বা টিকতে পারত খানিক ব্যবধান, দুরন্ত দুটি ছেলেমেয়ে মানুষের তৈরি কোনো কৃত্রিম দূরত্ব মানতে অস্বীকার করে তা-ও ভেঙে দেয়। কাছে আনে পরিবার দুটিকে। অন্তরঙ্গ করে দেয় ইন্দিরা আর হালিমাকে।

একদিন একটি শুভ লগ্নে দুটি ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় পাড়ায়। গীতা পায় নতুন খেলা। মার শাড়ি ভাঁজ করে সে পরে, সিঁদুরের টিপ আর চন্দনের এলোমেলো ফোঁটা আঁকে কপালে আর গালে, পাড় দিয়ে বাবার লাল টুথব্রাশটির মুকুট এঁটে সে কনে সাজে হাবিবের। কপালে চন্দন লেপে গলায় গামছা-পাকানো উড়ুনি ঝুলিয়ে দিয়ে হাবিবকে বরবেশে সে-ই সাজিয়ে দেয়। শাশুড়ির অভিনয় করতে হয় ইন্দিরা আর হালিমা দু-জনকেই। উলু দিয়ে বরণ করতে হয় জামাইকে ইন্দিরার, বৌকে হালিমার। খাবার আনিয়ে জামাই-আদরে বৌ-আদরে দুজনকে খাওয়াতে হয় মুখে খাবার তুলে দিয়ে। নইলে নাকি খায় না নতুন বর-বৌ। থেকে থেকে দু-জনে তারা ফেটে পড়ে কৌতুকের হাসিতে। তাতে রাগতে রাগতে হঠাৎ বিয়ের কনের লজ্জা-শরম ভুলে গিয়ে মেঝেতে হাতপা ছুঁড়ে কান্না শুরু করে গীতা। তারপর থেকে থেকে তাদের হাসতে হয় মুখে আঁচল গুঁজে।

মাকে নকল করে গীতা হাবিবকে ডাকে, ওগো? ওগো শুনছ? জামাই। এই জামাই! ডাকছি যে?

হাবিব বলে, অ্যাঁ?

অ্যাঁ কী? অ্যাঁ না। বলে কী গো?

হালিমা আর ইন্দিরা ঢলে পড়ে পরস্পরের গায়ে। মুখ ভার করে থাকে পিসি। হালিমা বাড়ি ফিরে যাওয়ামাত্র বলে, এ সব কী কাণ্ড বৌমা?

কেন পিসিমা?

চা খাওয়ালে, বেশ করলে। তা চা যে খেয়ে গেল কাপে মুখ ঠেকিয়ে, কাপটা শুধু ধুয়ে তুলে রাখলে সব বাসনের সাথে? গঙ্গাজলের ছিটেও দিতে পারলে না? ভিন্ন একটা কাপ রাখলেই হয় ওর জন্যে। জাতধর্ম রইল না আর।

গঙ্গাজলে ধুয়েছি।–ইন্দিরা অনায়াসে বানিয়ে বলে।

এ বাড়িতে নাসিরুদ্দীনের মায়েরও মুখ ভার।

ও বাড়ি থাকলেই পারতে? এত বাড়াবাড়ি ভালো নয়। ওরা পছন্দ করে কি না কে তা জানে।

হালিমাও হাসিমুখেই বলে, চা না খাইয়ে ছাড়লে। দেরি হয়ে গেল।

তুমি তো খেয়ে এলে চা খুশিমনে। তুমি দিও তো একদিন কেমন খায়?

চা তো খায়!

সব কাজ পড়ে থাকে সংসারের, সময়মতো শুরু হয়নি। নাসিরের র আসল রাগ কেন হালিমা জানে, তাই জবাব দিতে দিতে সে চটপট কাজে লেগে যায়। বিশেষ কিছুই আর শুনতে হয় না তাকে।

ঘণ্টাখানেক পরে দেখা যায় ছোট নাতনিকে কোলে নিয়ে সদর দরজায় দাঁড়িয়ে নাসিরুদ্দীনের মা আর ছোট নাতি কোলে প্যাসেজে দাঁড়িয়ে তারাপদর পিসি গল্প। জুড়েছে সুখ-দুঃখের।

ব্যবধান টেকেনি।

কাজ সেরে দুপুরে হালিমা যেদিন একটু অপরাধিনীর মতোই এসে বসে, সেদিনও নয়। মৃদু অস্বস্তির সঙ্গে বলে হালিমা, একটা কাণ্ড হয়েছে ভাই।

ওমা, কী হয়েছে?

তোমার মেয়ে একটু গোসত খেয়ে ফেলেছে। আজ আমাদের খেতে হয় জান। হাবিব খেতে বসেছে, আমি কিছুতে দেব না, বেটি এমন নাছোড়। হঠাৎ পাত থেকে নিয়ে মুখে পুরে দিলে।

কিছু হবে না তো?–ইন্দিরা বলে চমকে গিয়ে।

হালিমার মুখ দেখে তারপর ইন্দিরা হাসে, বলে, কী যে বলি আমি বোকার মতো। হাবিবের কিছু হবে না, ওর হবে! খেয়েছে তো কী আর হবে, ওইটুকু মেয়ে। কাউকে বোলো না কিন্তু ভাই।

তাই কি বলি? হালিমা স্বস্তি পায়–বাব্বা; আমি জানি না? ও রোজ আলি সাব আর তার বিবি এসে কী দাবড়ানি দিয়ে গেল। হাবিব তোমাদের সরস্বতী পুজোয় অঞ্জলি দিয়েছে, প্রসাদ খেয়েছে, এসব কে যেন কানে তুলে দিয়েছিল।

শোনো বলি তবে তোমায় কাণ্ডখানা।ঘরে কেউ নেই, তবু ইন্দিরা কাছে সরে নিচু গলায় বলে, হাবিব অঞ্জলি দিয়েছে বলে পিসির কী রাগ! উনি শেষে পঞ্জিকা খুলে আবোল-তাবোল খানিকটা সংস্কৃত আউড়ে পিসিকে বললেন, সরস্বতী পুজোয় দোষ হয় না, শাস্ত্রে লিখেছে! তখন পিসি ঠাণ্ডা হয়ে বললে, তাই নাকি!

শান্ত দুপুর। ফেরিওলা গলিতে হেঁকে যাচ্ছে, শাড়ি-সায়া-শেমিজ চাই। দুজনে তারা খড়ি নিয়ে মেঝেতে কাটাকাটি খেলতে বসে। হাই ওঠে, বুজে আসে চোখ। চোখে চোখে চেয়ে ক্ষীণ শ্রান্ত হাসি ফোটে দুজনের মুখে। আঁচল বিছিয়ে পাশাপাশি একটু শোয় তারা দুটি স্ত্রী, দুটি মা, দুটি রাঁধুনি, দুটি দাসী।

ঘুমোয় না। সে আরামের খানিক সুযোগ জোটে বেলা যখন আরো অনেক বড় হয় গরমের দিনে। আজকাল শুধু একটু ঝিমিয়ে নেবার অবসর মেলে। ঝিমানো। চেতনায় ঘা মারে স্তব্ধ দুপুরের ছাড়াছাড়া শব্দগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে থাকে ছাতে হাবিব আর গীতার দাপাদাপির শব্দ।

ব্যবধান টেকেনি। কেন যে সেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল আচমকা এমন ভয়ানক এমন বীভৎস রূপ নিয়ে, কেন এত হানাহানি খুনোখুনি চারদিকে বোঝে না তারা, থতমত খেয়ে ভড়কে যায়, দুরুদুরু করে বুক। সেবার মাঝে মাঝে বুক কেঁপেছিল সাইরেনের আওয়াজে জাপানি বোমার দিনগুলোতে, দূর থেকে হাওয়ায় ভর করে উড়ে আসা অনিশ্চিত বিদেশি বিপদের ভয়ে। তার চেয়ে ব্যাপক, ভয়ানক সর্বনাশ আজ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে দেশের বুকে, শহর জুড়ে, পাড়ায় ঘরের দুয়ারে। বুকের জোরালো ধড়ফড়ানি থামবার অবকাশ পায় না আজ, বাড়ে আর কমে, কমে আর বাড়ে।

তবে কথা এই যে, এটা মেশাল পাড়া। নিজেরাই বলাবলি করে নিজেদের মধ্যে যতটা নিরুপায় নয় তার চেয়ে অনেক বেশি মরিয়ার মতো। এতেই অনেকটা ভরসা খাড়া আছে মারাত্মক আতঙ্ক গুজব আর উসকানির সোজাসুজি প্যাচালো আর চোরাগোপ্তা আঘাত সয়ে, যে আঘাত চলেছেই। বাস্তব একটা অবলম্বনও পাওয়া গেছে সকলে মিলে গড়া পিস-কমিটিতে, বিভ্রান্ত না করে যার জন্মলাভের প্রক্রিয়াটাও জাগিয়েছে আস্থা। কারণ, বড় বড় কথা উথলায়নি সভার আদর্শমূলক ভাবোচ্ছ্বাস, মিলনকে আয়ত্ত করার চেষ্টা হয়নি শুধু মিলনের জয়গান গেয়ে, এই খাঁটি বাস্তব সত্যটার উপরেই বেশি জোর পড়েছে যে এ পাড়ায় হাঙ্গামা হলে সবার সমান বিপদ, এটা মেশাল পাড়া।

হয়তো এ পাড়ায় শুরু হবে না সে তাণ্ডব, কে জানে। চারদিকে যে আগুন জ্বলেছে। তার হলকাতে ছ্যাকা লেগে লেগেই মনে কি কম জ্বালা। সর্বহারা শোকাতুর দিশেহারা আপনজনেরা এসে অভিশাপ দিচ্ছে, বলছে : মারো, কাটো, জবাই করো, শেষ করে ফেলো। এ এসে ও এসে বুঝিয়ে যাচ্ছে মারা ছাড়া বাঁচার উপায় নেই।

অনেক কালের মেশামিশি বসবাস। হয়তো তেমন ঘনিষ্ঠ নয় মেলামেশা সবার মধ্যে, সেটা আসলে কিন্তু এটা শহর বলেই। পাখা সবারই পঙ্গু, মানুষকে হাঁস-মুরগি করে রাখা মর্জি মালিকের। পাখা ঝাঁপটিয়ে চলতে হয় জীবনের পথে।

তাই তো বলি পাখি নাকি আমরা? হালিমা বলে মুখোমুখি জানালায় দাঁড়িয়ে, তাড়া খেয়ে খেয়ে আজ এখানে কাল সেখানে উড়ে বেড়াব? গাছের ডালে বাসা বানাব?

আর বোলো না ভাই, ইন্দিরা বলে, মাথা ঘুরচে কদিন থেকে। এসব কী কাণ্ড। এ্যাঁ কী রাঁধলে?

তেমন প্রাণখোলা আলাপ কিন্তু নয়, কদিন আগের মতো। গলায় মৃদু অস্বস্তির সুর দুজনেরই; চোখ এড়িয়ে সন্তর্পণে জানালা দুটির একটি করে পাট খুলে কথা কইছে, কাজটা যেন অনুচিত, আসা-যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। দুজনের বাড়িতেই আচমকা আশ্রয় নিতে আত্মীয়স্বজনের আবির্ভাব ঘটেছে বলেই নয় শুধু, বাড়ির মানুষ। বারণ করে দিয়েছে মেলামেশা, ঘনিষ্ঠতা–অন্তত সাময়িকভাবে।

কী যে হবে, ভাবছি।

দুধে নাকি বিষ মেশাচ্ছে গয়লারা। দুধ জ্বাল দিয়ে আগে বেড়ালটাকে খানিকটা খাওয়াতে হয়, ছেলেপিলেরা খিদেয় কাঁদে, দেওয়া বারণ। আধঘণ্টা বেড়ালটা কেমন থাকে দেখে তবে ওরা পায়। রুটি আনা বন্ধ করেছেন। রুটি যারা বানায় তাদের মধ্যে তোমরাই নাকি বেশি। এক টুকরো রুটি আর চা জুটত সকালে, এখন শুধু একটু গুড়ের চা খেয়ে থাকো সেই একটা-দুটো পর্যন্ত।

এত লোক বেড়েছে, ডাল তরকারি ছিটেফোঁটা এক রোজ থাকে, আর এক রোজ একদম সাফ। ভাতেও টান পড়ে।

আজ চিঁড়ে খেয়েছি নুন দিয়ে। গুড়ও নেই।

চোখে চোখে চেয়ে খানিক মাথা নিচু করে থাকে দুজন। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়। জানালার পাট দুটি।

ছেলেমেয়ের সংখ্যাও বেড়ে গেছে দুবাড়িতে। অন্য অঞ্চল থেকে উৎখাত হয়ে তারা বড়দের সঙ্গে এসে আশ্রয় নিয়েছে। মুখ চেনাচিনিও হয়নি বড়দের মধ্যে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কে ঠেকিয়ে রাখবে? তাদের মেলামেশার দাবি রাজনীতির ধার ধারে না, আপস অনুমতির তোয়াক্কা রাখে না, জাতধর্মের বালাই মানে না। স্কুল নেই, লেখাপড়া নেই, বেড়ানো নেই, বাড়ির এলাকার বাইরে যাওয়া পর্যন্ত বারণ। বড়দের মুখে অন্ধকার, বাড়িতে থমথমে ভাব, মুমূর্ষ রোগী থাকলে ঘন ঘন ডাক্তার আসবার সময় যেমন হয়। ওরা তাই করে কী, হাবিব আর গীতার নেতৃত্বে নিজেরাই আয়োজন করে মিলেমিশে খেলাধুলো করার। বাড়িতে ঠাঁই নেই, নিজেরাই তৈরি। করে নেয় খেলাঘর। হাঙ্গামা করতে হয় না বেশি, বাইরের প্যাসেজে দুপাশের দেয়ালে দুটো পেরেক পুঁতে একটা কাপড় টাঙিয়ে দিতেই প্যাসেজের শেষের অংশটুকু পরিণত হয়ে যায় চারপাশ ঘেরা ছোটখাটো একটি ঘরে। কিছু চাল ডাল উঁটাপাতা জোগাড় হয়েছে। গীতা এনে দিয়েছে ছোট তোলা উনুনটি আর তেলমশলা! তরকারির অনটনে সবার মন খুঁতখুঁত করতে থাকায় হাবিব এক ফাঁকে বাড়ির ভেতর থেকে সরিয়ে এনেছে কিছু আলু পেঁয়াজ আর একটা আস্ত বেগুন। জোরালো পরামর্শ চলছে, সবকিছু দিয়ে এক কড়া খিঁচুড়ি রাধা অথবা খিঁচুড়ি, ভাজা, তরকারি সবই রাধা হবে। রান্নার ভার নিয়েছে মেহের, তার বয়স ন-দশ বছর, এই বয়সেই বড়দের আসল রান্নার কাজে তাকে সাহায্য করতে হয় বলে তার অভিজ্ঞতার দাবি সবাই বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে।

কিন্তু উনুনে তাদের আঁচও পড়ে না, রান্নাও শুরু হতে পায় না। টের পেয়ে হা হা করে ছুটে আসে দুবাড়ির বড়রা। মেহেরের বাপের নিকা-বৌ নুরুন্নেসা মেয়ের বেণি ধরে মাথা টেনে গালে চড় বসায়। পুষ্পর মাসিমা এক ঠোনায় রক্ত বার করে দেয় ভাগ্নির ঠোঁটে। কান ছাড়াতে হাত-পা ছোড়ে গীতা, লাথি লাগে তারাপদর পেটে। হাবিব কামড় বসিয়ে দেয় নাসিরুদ্দীনের হাতে। বাচ্চাদের কাদাকাটা বড়দের হইচই মিলে সৃষ্টি হয় আওয়াজ। প্রতিবেশীরা ছুটে এসে কী হয়েছে জানতে চেয়ে বাধিয়ে নেয় রীতিমতো হুল্লোড়, প্যাসেজের মুখে গলিতে জমে ওঠে লাঠি রড ইট হাতে ছোটখাটো ভিড়।

কয়েক মুহূর্ত, আর কয়েক মুহূর্তে স্থির হয়ে যাবে মেশাল পাড়ার ভাগ্য-জিইয়ে রাখা শান্তি অথবা অকারণে ডেকে আনা সর্বনাশ। কান্না তুলে বড় বড় চোখ মেলে ছেলেমেয়েরা, চেয়ে দেখে বড়দের অর্থহীন কাণ্ড।

ভলান্টিয়ার সঙ্গে নিয়ে পিস-কমিটির যুগ্মসম্পাদক দুজন ছুটে আসায় অল্পের জন্য হাঙ্গামা ঠেকে যায়। সম্পাদক দুজন ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন।

ভিড়ে ভাঙন ধরে। দুচার মিনিটের মধ্যে ভলান্টিয়াররা ভিড় সাফ করে দেয়।

তখন যুগ্মসম্পাদক দুজন পরামর্শ করে ভলান্টিয়ারদের পাঠান পাড়ায় পাড়ায় সত্য ঘটনা প্রচার করতে। এমন স্পর্শকাতর হয়ে আছে মানুষের মন যে, এ রকম তুচ্ছ ঘটনাও দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়তে পারে মারাত্মক গুজব হয়ে।

বিকালে একটা লরি আসে পুলিশ ও সৈন্যের ছোট একটি দল নিয়ে। চারদিক তখন শান্ত। বুটের আওয়াজ তুলে কিছুক্ষণ তারা এদিক ওদিক টহল দেয়। এ বাড়ির দরজায় ঘা মেরে, এর ওর দোকানে ঢুকে, জিজ্ঞাসা করে কোথায় গোলমাল হয়েছিল। জবাব শোনে আশ্চর্য ও অবিশ্বাস্য, যে কোথাও গোলমাল হয়নি। ক্রুদ্ধ অসন্তুষ্ট মনে হয় তাদের, আগমন কি তাদের অনর্থক হবে? গলির মোড়ে নিতাইয়ের দোকানের একপাশে তক্তপোশ পেতে চারজন সশস্ত্র সৈন্যের ঘাঁটি বসিয়ে লরি ফিরে যায় বাকি সবাইকে নিয়ে। নতুন এক সশঙ্ক অস্বস্তিবোধ ছড়িয়ে পড়ে মেশাল পাড়ায়। সজবাতির আগেই বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট, মানুষ গিয়ে ঢোকে কোটরে, শূন্য হয়ে যায় পথ।

এ বাড়ি থেকে কথা শোনা যায় ও বাড়ির! কিন্তু কথার আদান-প্রদান বন্ধ হয়ে গেছে। চুপিচুপি দু-এক মুহূর্তের জন্য মুখোমুখি জানালার পাটও একটু ফাঁক হয় না। এ বাড়ি ভাবে ও বাড়ির জন্য মিলিটারি এসে পাড়ায় গেড়ে বসেছে, কী জানি কখন কী হয়। ছেলেমেয়েদের বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ। ঘরের জেলে তারা কয়েদ।

ছাত ভাগ করা দেয়ালের এপাশ থেকে গীতা বলে, আসবি হাবিব?

মারবে যে?

না, পিসির ঘরে চুপিচুপি খেলব।

পিসি বকবে তো?

দূর। রান্না করে নেয়ে আসতে পিসির বিকেল বেজে যাবে।

ছাতের সিঁড়ির মাঝে বাকের নিচু লম্বাটে কোটরটি পিসি বহুদিন দখল করে আছে, তার নিচে দোতলার কলঘর। লম্বা মানুষ এ ঘরে দাঁড়ালে ছাতে মাথা ঠেকবে। পিসির নিজস্ব হাঁড়িকুড়ি কাঠের বাক্স কাঁথা বিছানায় কোটরটি ভরা। কুশের আসন পেতে এ ঘরে পিসি আহ্নিক করে। আমিষ-রান্নাঘরে একবার ঢুকলে স্নান করে শুদ্ধ হবার আগে পিসি আর এ ঘরে আসে না।

ঘরের মধ্যে এভাবে লুকিয়ে চুপিচুপি কী খেলা করবে, হাবিবকে নিয়ে এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যোগ দেবার উপায় নেই, ওদেরও ডাকা যায় না এখানে। তাই। নতুন খেলা আবিষ্কার করে নিতে হয়।

দাঙ্গা দাঙ্গা খেলবি? গীতা বলে।

লাঠি কই? ছোরা কই? প্রশ্ন করে হাবিব।

গীতা বলে, দাঁড়া।

গীতা চুপিচুপি অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তারাপদর ক্ষুর আর ছুরি। ক্ষুরটি পুরনো, কামানো হয় না, কাগজ পেন্সিল দড়ি কাটার কাজেই লাগে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে গীতা ভেতর থেকে দরজার ছিটকিনি এঁটে দেয়। হাবিবের চেয়ে সে একটু ঢ্যাঙা।

তুই আকবর আমি পদ্মিনী। আয়!

খেলা, ছেলেখেলা। অসাবধানে কখন যে সামান্য কেটে যায় একজনের গা অপরের অস্ত্রে।

মারলি?

ব্যথা পেয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে সে প্রতিশোধ নেয় অপরের গায়ে। জেদি দুরন্ত ছেলেমেয়ে দুজন, ব্যথায় রাগে অভিমানে দিশেহারা হয়ে কাটাকাটি হানাহানি শুরু করে ভোতা ক্ষুর আর ভোতা ছুরি দিয়ে। সেই সঙ্গে চলে গলা ফাটিয়ে আর্ত কান্না। ইন্দিরা পিসিমারা ছুটে আসে কলরব করে। ছুটে আসে ও বাড়ির হালিমা নুরুন্নেসারা। তারা সিঁড়িতে উঠে পিসির কোটরের দরজার সামনে ভিড় করে থাকায় তারাপদ ও বাড়ির অন্য পুরুষদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সিঁড়ির নিচে।

সদর দরজায় বাড়ির অন্য পুরুষদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে নাসিরুদ্দীন হাঁকে, তারাপদ!

দুটি মাত্র শিক বসানো ছোট্ট একটি খোপ আছে পিসির ঘরে, একসময় একজনের বেশি দেখতে পারে না ভেতরের কাণ্ড। একনজর ভেতরে তাকিয়ে ইন্দিরা আর্তনাদ করে ওঠে, মেরে ফেলল! মেয়েটাকে মেরে ফেলল গো।

দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে চেঁচায় : খোল! খোল! দরজা খোল! খুনে ছেঁড়া দরজা বন্ধ করে খুন করছে মেয়েটাকে! দরজা খোল!

হালিমাও একনজর তাকিয়ে অবিকল তেমনি সুরে আর্তনাদ করে ওঠে, মেরে ফেলল! ছেলেটাকে মেরে ফেলল!

দরজায় ধাক্কা মারতে মারতে চেঁচায়! খোল! খোল! দরজা খোেল! খুনে ঘুড়ি দরজা বন্ধ করে খুন করছে ছেলেটাকে! দরজা খোল!

পিসি চেঁচায়, হায় হায় হায়! সব ছোঁয়াছুঁয়ি করে দিলে গো!

নিচে থেকে নাসিরুদ্দীন হাঁকে, তারাপদ! আমরা অন্দরে ঢুকব বলে দিচ্ছি।

পিসিকে ঠেলে সরিয়ে ইন্দিরা আর হালিমা একসঙ্গে পাগলিনীর মতো খোপের ফোকর দিয়ে ভেতরে তাকাতে চায়, মাথায় মাথায় ঠোকাঠেকি হয়ে যায় দুজনের। আক্রমণে উদ্যত বাঘিনীর মতো হিংস্র চোখে তারা পরস্পরের দিকে তাকায়।

ভেতরে ততক্ষণে গীতা আর হাবিবের হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়েছে। বাইরের হট্টগোলে চুপ হয়ে গেছে তারা। কিন্তু লড়াই থামায়নি, আগে কে হার মানবে অপরের কাছে! নিঃশব্দে মেঝেতে পড়ে জড়াজড়ি কামড়াকামড়ি করে। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় পিসির হাঁড়িকুড়ি।

হায়, হায়! সব গেল গো, সব গেল!

নাসিরুদ্দীনকে ওপরে ডেকে আনে তারাপদ।

সে-ই লাথি মেরে দরজা ভাঙে। দরজাটা ঠিক ভাঙে না, ছিটকিনিটা খসে যায়।

ওপর ওপর চামড়া কাটাকুটি হয়েছে খানিকটা, কিছু রক্তপাত ঘটেছে। নিজের নিজের সন্তানকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ ইন্দিরা আর হালিমা ব্যাকুল দৃষ্টি বুলিয়ে যায় তাদের সর্বাঙ্গে। তারপর প্রায় একই সময় দুজনে মুখ তোলে চোখে অকথ্য হিংসার আগুন নিয়ে। দুজনেই যেন অবাক হয়ে যায় অপর কোলে আহত নির্জীব অপরের সন্তানটিকে দেখে, বহুকাল ভুলে থাকার পর দুজনেই যেন হঠাৎ আবিষ্কার করেছে অন্যজনও মা, তার সন্তানের গায়েও রক্ত।

বাইরে আবার ভিড় জমেছিল। আবার অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সংঘর্ষ। তারাপদ আর নাসিরুদ্দীন দু-বাড়ির এই দুই কর্তাকে পাশাপাশি সামনে হাজির করতে না পারলে পিস-কমিটি এবার কোনোমতেই ঠেকাতে পারত না সর্বনাশ।

আইডিন লাগিয়ে নাইয়ে খাইয়ে দুবাড়িতে শুইয়ে রাখা হয় হাবিব আর গীতাকে। ছুটির দিন, ঢিমেতালে সংসারের হাঙ্গামা চুকতে ঢুকতে এমনিই দুপুর গড়িয়ে যেত আগে, এখন আবার বাড়তি লোকের ভিড়। বিকালের দিকে কিছুক্ষণ আগে পরে। দু-বাড়িতে খোঁজ পড়ে ছেলেমেয়ে দুটির।

খোঁজ মেলে না একজনেরও।

আবার তন্নতন্ন করে খোঁজা হয় বাড়ি, আনাচ কানাচ, চৌকির তলা। গীতা বাড়িতে নেই। হাবিব বাড়িতে নেই।

শঙ্কায় কালো হয়ে যায় দু-বাড়ির মুখ। কিছুক্ষণ গমগম করে স্তব্ধতা, তারপর ফেটে পড়ে মুখর গুঞ্জন।

এ বাড়ি বলে বুক চাপড়ে : শোধ নিয়েছে। ভুলিয়ে ভালিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে হয় গুম করে রেখেছে, নয়–

ও বাড়ি প্রতিধ্বনি তোলে মাথা কপাল কুটে।

তারাপদ বলে, গীতা নিশ্চয় আছে তোমার বাড়িতে নাসির।

নাসিরুদ্দীন বলে, হাবিবকে তোমরা নিশ্চয় গুম করেছ তারাপদ।

এবার আর রোখা যায় না, আগুনের মতো গুজব আর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এত চেষ্টা করেও উসকানিদাতারা এ মেশাল পাড়ার শান্তিতে দাঁত ফোঁটাতে পারেনি, এমনি একটি সুযোগের জন্য তারা যেন ওত পেতে ছিল, সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেখতে দেখতে বাড়ি দুটির সামনে জড়ো হয় দু-দল উন্মাদ মানুষ। এরা ও বাড়িতে চড়াও হবে, ওরা এ বাড়িতে। কিন্তু দল যখন দুটি তখন আগে বাইরে রাস্তায় লড়াই করে–অন্য দলকে হটিয়ে জয়ী হতে না পারলে কোনো দলের পক্ষেই বাড়ি চড়াও হওয়া সম্ভব নয়।

মারামারি হবেই। সেটা জানা কথা। আগেই বেঁধে যেত, পিস-কমিটির চেষ্টায় শুধু দু-দশ মিনিটের জন্য ঠেকে আছে।

যুগ্ম সম্পাদক বলেন, আমরা তল্লাশ করাচ্ছি বাড়ি।

জনতা সে কথা কানে তোলে না। তাদের শান্ত রাখতে গিয়ে গালাগালি শোনে, মারও খায় কয়েকজন ভলান্টিয়ার। তবু তারা চেষ্টা করে যায়। গলির মোড়ের সৈন্য চারজন চুপচাপ বসে আছে।

এমন সময় কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ওই যে হাবিব! ওই যে।

আরেকজন চেঁচায়, ওই তো গীতা!

সকলের দৃষ্টিই ছিল নিচের দিকে, এ অবস্থায় কে চোখ তুলে তাকাবে ওপরে। কারো নজরে পড়েনি যে, নাসিরুদ্দীন আর তারাপদর বাড়ির চিলেকুঠির ছাত থেকে। কিছুক্ষণ ধরে পাশাপাশি একটি ছেলে ও মেয়ে মুখ বাড়িয়ে নিচের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছে। ছাত ভাগ করা দেয়ালের দুপাশে দুবাটীর ছাতের সিঁড়ির চিলেকুঠি একটাই। কখন যে তারা দুজন চুপিচুপি সকলের চোখ এড়িয়ে ওই নিরাপদ আশ্রয়ে খেলতে উঠেছিল! মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে কয়েকজন কলরব করে ওঠে, পাওয়া গেছে। দুজনকেই পাওয়া গেছে!

সবার চোখের সামনে হারানো ছেলেমেয়ে দুটোর অকাট্য জলজ্যান্ত আবির্ভাব হল বলেই যে মারামারি ঠেকানো যেত, তা নয়। হিংসায় উত্তেজনায় জ্ঞান হারিয়ে যারা খুনোখুনি করতে এসেছে, অনেকে তারা জানেও না ওদের দুটিকে নিয়েই আজকের মতো গণ্ডগোলের সূত্রপাত। হঠাৎ এই খাপছাড়া ঘটনায়, দু-দলেরই কিছু লোক চঞ্চল হয়ে সোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠায়, ব্যাপারটি কী জানবার জন্য যে কৌতূহল জাগল জনতার মধ্যে; সঙ্গে সঙ্গে পিস-কমিটির সম্পাদক দুজন সেটা কাজে লাগিয়ে ফেলায় ঘটনার মোড় ঘুরে গেল।

জনতা সাফ হয়ে যাবার অনেক পরে আবার লরি বোঝাই মিলিটারি এল।

বহুক্ষণ সার্চ চলে নাসিরুদ্দীন আর তারাপদর বাড়িতে, গুম করা ছেলেমেয়ে দুটির সন্ধানে। হালিমা আর ইন্দিরার গা ঠেসে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাই দেখতে থাকে গীতা আর হাবিব।

টিচার

রাজমাতা হাইস্কুলের সেক্রেটারি রায়বাহাদুর অবিনাশ তরফদার ভেবেচিন্তে শেষপর্যন্ত টিচারদের কিছু সদুপদেশ দেওয়া স্থির করল। বুড়ো বয়সে এমনিতেই তার ঘুম হয়। কম, তার ওপর এইসব যাচ্ছেতাই খাপছাড়া ব্যাপারে মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় কদিন আর ঘুম হয়নি। টিচাররা ধর্মঘট করবে বেতন কম বলে, বেতন বাকি থাকে বলে, এটা সেটা হরেকরকম অসুবিধা আছে বলে চাকরি করতে। বাপের জন্মে রায়বাহাদুর এমন কথা শোনেনি। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তারা কি মজুর না ধাঙড় যে ধর্মঘট করবে?

শুধু তার স্কুলে এসব গোলমালের সম্ভাবনা ঘটলে সে অবশ্য ব্যাপারটা গ্রাহ্য করত না। দুটো ধমক দিয়ে একটা মিষ্টি কথা বলে, সকলকে খেপাচ্ছে কোন মাথাপাগলা ইয়ং টিচারটি সন্ধান নিয়ে তাকে একচোট মজা দেখিয়ে সব ঠিক করে দিত অনায়াসে। কিন্তু সারা বাংলাদেশের সব স্কুলটিচাররা জোট বেঁধেছে, সম্মেলন করছে। খেতে পায় না ব্যাজ পরছে। করুক, পরুক। যা খুশি করুক অন্য স্কুলের টিচাররা, তার স্কুলে সে ওসব বিশ্রী কাণ্ড ঘটতে দেবে না, ওসব হীনতা স্বার্থপরতা স্বেচ্ছাচারিতা ঢুকতে পারবে না তার পবিত্র শিক্ষায়তনে।

স্বার্থ ভুলে, বিলাসের লোভ জয় করে, স্বেচ্ছাকৃত দারিদ্র্যকে হাসিমুখে বরণ করে, বিদ্যালয়ের মহান আদর্শ যারা গ্রহণ করেছে, দেশের যারা ভবিষ্যৎ মেরুদণ্ড তাদের গড়ে তোলার বিরাট দায়িত্ব পালন যাদের জীবনের ব্রত, বুনো রামনাথ যাদের গর্ব ও গৌরব; তুচ্ছ দুটো পয়সার জন্য, সামান্য দুটো অসুবিধার জন্য, তারা নিজেদের নামিয়ে আনবে, আদর্শ চুলোয় দেবে, শিক্ষা-দীক্ষাহীন অসভ্য মজুর ধাঙড়ের মতো হাঙ্গামা করবে, তা কখনো হতে পারে না, রায়বাহাদুর তা বিশ্বাস করে না। মোটামুটি এই ধরনের সদুপদেশ রায়বাহাদুর শোনাল শনিবার স্কুল ছুটি হবার পর। অবশ্য অনেক ফেনিয়ে-ফাঁপিয়ে, দমক-গমক-মূৰ্ছনা আমদানি করে, গুরু-গম্ভীর চালে।

আপনারা কী বলেন?

কে কী বলবে? সকলে চুপ করে থাকে। রায়বাহাদুরের ধৈর্য বড় কম, বিশেষত এখন এত লম্বা বক্তৃতা দেবার পর এই গরম একফোঁটাও আছে কি না সন্দেহ, কেউ কিছু বলতে গেলে হয়তো গালাগালি দিয়ে বসবেন, গালে চড় বসিয়ে দেওয়াও আশ্চর্য নয়। কিছু বলার দরকারও ছিল না। টিচারদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে এটা অফিসিয়াল মিটিং নয়, রায়বাহাদুরের নিজস্ব সদুপদেশ দানের সভা। চুপচাপ বসে শোনাই এখানে যথেষ্ট।

প্রৌঢ় হেডমাস্টার শশাঙ্ক কেবল একবার মাথা চুলকিয়ে বলে, আজ্ঞে তা বৈকি। শিক্ষক জীবনের মহান আদর্শের কথা কি তারা ভুলতে পারে।

সভার শেষে শশাঙ্ক একান্তে আবার বলে, গত মাসের বাকি মাইনেটার জন্য একটু, যে রকম দিনকাল, সংসার চালানোই–

কে উসকানি দিচ্ছে জানেন?

ক-বছর আগে হলে শশাঙ্ক হয়তো দু-একটা কথা উচ্চারণ করে ফেলত। কিন্তু শশাঙ্কবাবুও আর সে শশাঙ্কবাবু নেই, অনেক বদলে গেছে।

আজ্ঞে, উসকানি কে দেবে। একজন দুজনের উসকানির ব্যাপার নয়, আপনি তো জানেন, দেশজুড়ে এ রকম চলছে।

স্কুলের বাগানের দিকে চেয়ে থেকে রায়বাহাদুর বলে, গিরীন খুব পলিটিক্স করে বেড়ায় নাকি?

বুকটা ধড়াস করে ওঠে শশাঙ্কর, গিরীন তার জামাই। মনে মনে আরেকবার গিরীনকে অভিশাপ দিয়ে বলে, পলিটিক্স করে না। মিটিং-ফিটিং হলে হয়তো কখনো শুনতে যায়। আর স্কুলে পলিটিক্স নিয়ে কিছুই হয় না।

হয় না? সেদিন স্ট্রাইক করে ছেলেরা স্কুলের মাঠে যে মিটিং করল?

আজ্ঞে সেটা ঠিক পলিটিক্যাল মিটিং নয়। প্রোটেস্ট মিটিং মাত্র। কলকাতায় স্টুডেন্টদের ওপর গুলি চালানো হল, তারই প্রোটেস্ট–

কলার কাঁদিটা বাড়তি হয়েছে না? এবার কেটে ঝুলিয়ে রাখলে পেকে যাবে দু-এক দিনের মধ্যে, কী বলেন?

কাল মালিকে বলব। রাতারাতি যেন চুরি হয়ে যায় না, দেখবেন।

রায়বাহাদুর হাসল।

সন্ধ্যার পর গিরীন বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে রায়বাহাদুর আশ্চর্য হল না। গিরীনের সম্পর্কে তার প্রশ্নে ভড়কে গিয়ে শশাঙ্ক নিশ্চয় তাকে পাঠিয়ে দিয়েছে দোষ কাটাতে, কথায় কথায় তাকে জানিয়ে দিয়ে যেতে যে ভুলচুক যদি সে করেই থাকে তিনি যেন ক্ষমা করে নেন, এবার থেকে সে সাবধান হবে। তাই যদি হয় তবে ভালোই।

গিরীন কিন্তু ওসব কথার ধার দিয়েও যায় না। খুব বিনীত ও নম্রভাবে পরদিন তার ছোট ছেলের অন্নপ্রাশনে নেমন্তন্ন জানায়। রায়বাহাদুর অবশ্য বুঝতে পারে তার মানেও তাই। খানিকটা স্পষ্টভাবে জানানোর বদলে ইঙ্গিতে জানানো যে সে অনুগতই, রায়বাহাদুর যা অপছন্দ করেন তা থেকে সে তফাত থাকবে, তাকে চটাবে না।

অন্নপ্রাশন? ছোট ছেলের? তা বেশ, কিন্তু আমি নেমন্তন্নে যাই না, বুড়ো শরীরে সয় না ওসব। রায়বাহাদুর অমায়িকভাবে হাসে।

আপনাকে পায়ের ধুলো দিতেই হবে। গিরীন বলে নাছোড়বান্দার জোরালো অনুনয়ের সুরে, সকাল সকাল গিয়ে আশীর্বাদ করে আসবেন শুধু, একটু ফলমূল মুখে দেবেন। সবাই আশা করছি, মনে বড় আঘাত পাব না গেলে।

রায়বাহাদুর যেতে রাজি হয়েছে ধরে নিয়েই যেন একটু ইতস্তত করে গিরীন। আবার বলে, একটা কথা বলি আপনাকে, দোষ নেবেন না। খেলনা বা উপহার কিছু নিয়ে আসবেন না খোকার জন্য। আমাদের বংশের রীতি আছে, কোনো কাজে রক্তের সম্পর্ক ছাড়া কারো কাছে সামান্য উপহারও নেওয়া চলবে না। ঠাকুরদা বা তাঁর বাবা অভিশাপ দিয়ে গিয়েছেন, একগাছি তৃণ নিলে নাকি বংশের সর্বনাশ হবে।

বল কী হে?

একটা দুশ্চিন্তা কেটে যায়, অন্নপ্রাশনের নিমন্ত্রণে গেলে কিছু দিতে হবে এ চিন্তাটা ছিল রায়বাহাদুরের। এবারে একটু ভেবে গিরীনের একান্ত আগ্রহ দেখে, রাজি হয়ে বলল, এত করে যখন বলছ–

সে কিছু খাবে না, কিন্তু এই সুযোগে মিষ্টি প্রভৃতি তার সঙ্গে কি দেবে না গিরীন? রায়বাহাদুর ভাবে। অনেকেই দেয়।

প্রায় দশটায় রায়বাহাদুর গিরীনের বাড়ি পৌঁছল। বাড়ি দেখে একটু আশ্চর্য হয়ে গেল, ছোট ছেলের অন্নপ্রাশন উৎসবের চিহ্ন না দেখে আরো বেশি। এত ছোট, এত পুরনো, এমন দীনহীন চেহারায় একতলা পাকা বাড়ি হয়, রায়বাহাদুর জানত না। কারণ, এর চেয়েও খারাপ বাড়ি চারিদিকে অসংখ্য ছড়ানো থাকলেও সে কোনোটার দিকে কখনো তাকিয়ে দেখেনি–এ ধরনের বাড়ির অধিবাসী কস্মিনকালেও তাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে সাহস পায়নি। ছেলের অন্নপ্রাশন রীতিমতো একটা উৎসবের ব্যাপার। তার ছেলের অন্নপ্রাশনে ব্যান্ড বেজেছিল। মেয়ের ছেলের অন্নপ্রাশনে সে অন্তত সানাই বাজায়। লোকে গিজগিজ করে তার বাড়িতে, ছেলের বেলা বেশি হোক, মেয়ের ছেলের বেলা কম হোক, গিজগিজ করে। গিরীনের বাড়িতে লোক আছে বলেই মনে হয় না। ভেতর থেকে শুধু ভেসে আসে ছোট একটা ছেলে বা মেয়ের কান-চেরা কান্না।

গাড়ির আওয়াজে বেরিয়ে এসে গিরীন তাকে অভ্যর্থনা জানায়, যথাসাধ্য আয়োজন করেছি, দোষত্রুটি ক্ষমা করবেন।

যথাসাধ্য আয়োজন? বৈঠকখানার ভাঙা তক্তপোশে-বিছানো-ছেঁড়া ময়লা শতরঞ্চির এক প্রান্তে কুণ্ডলী-পাকানো ঘেয়ো কুকুরের মতো দলা পাকিয়ে বসে আছে খালি-গায়ে জবুথবু একটা মানুষ, মেঝেতে লোম-ওঠা বিড়ালটা ছাড়া আর কোনো জীবন্ত প্রাণী নেই ঘরে। তক্তপোশ ছাড়া বসবার আসন আছে আর একটি, কেরোসিন কাঠের একটা টেবিলের সামনে কালিমাখা একটি কাঠের চেয়ার। দিনে বৈঠকখানা হলেও ঘরটি যে রাত্রে শোবার ঘরে পরিণত হয়। তার প্রমাণ, গুটানো কাঁথা-মশারির বান্ডিলটা জানালায় তোলা রয়েছে, তক্তপোশের নিচে ঢুকিয়ে আড়াল করে গোপন করে ফেলবার বুদ্ধিটা বোধ হয় কারো মাথায় আসেনি।

ইনি আমার বাবা, গিরীন পরিচয় করিয়ে দেয়, দুবছর ভুগছেন। আর বছর ডাক্তার বলেছিলেন, কলকাতা নিয়ে গিয়ে ট্রিটমেন্ট করাতে, পেরে উঠিনি, সাত-আটশ টাকার ব্যাপার।

জবুথবু বৃদ্ধ কষ্টে চোখ মেলে তাকায়। দুটি হাত একত্র করে নমস্কার জানাবার মতোই যেন চেষ্টা করে মনে হয়। ক্ষীণকণ্ঠে কী বলে ভালো বোঝা যায় না।

আসুন। ভেতরে চলুন।

রায়বাহাদুরকে গিরীন বাড়ির মধ্যে একেবারে তার শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসায়। উঠান পেরিয়ে যাবার সময় এদিক-ওদিক তাকায়, তাকিয়ে রায়বাহাদুর যথাসাধ্য আয়োজনের কোনো চিহ্নই দেখতে পায় না। রোয়াকে একজন অল্প একটু হলুদ বাটছে, তার বাড়িতে দৈনিক রান্নার জন্য যতটা হলুদ বাটা হয় তার সিকিও হবে না। যে বাটছে তার বেশটা তার বাড়ির ঝিয়ের মতোই, তবে রায়বাহাদুর অনুমান করতে পারে মেয়েটি ঝি নয়, বাড়িরই কোনো বৌ-ঝি। ওপাশে রান্নাঘরে খুন্তি দিয়ে কড়ায় ব্যান্নন নাড়ায় রত বৌটির শাখা-পরা হাতটি শুধু চোখের এক পলকে দেখেই কী করে যেন রায়বাহাদুর টের পেয়ে যায় যে সে গিরীনের বৌ।

চার ভিটেয় চারখানা ঘর তোলার সুযোগ থাকলেও, বৈঠকখানাটি বাদ দিলে ভেতরে ঘর মোটে দুখানা-রান্নাঘরের চালটি ছাড়া। গিরীনের শোবার ঘরখানার নমুনা দেখেই রায়বাহাদুর বুঝতে পারে অন্য ঘরখানা কেমন, নড়াচড়ার স্থান কতটা, কী রকম আলোবাতাস আসে।

জলচৌকিতে পাতা পুরনো কার্পেটের আসনে বসে রায়বাহাদুরের দম আটকে আসে। ছোট ছেলে বা মেয়ের কান-চেরা কান্নাটা এখন খুব কাছে মনে হয়।

কে কাঁদে?

ছেলেটা কাঁদছে, ছোট ছেলেটা। যার মুখে ভাত, জ্বর আসছে বোধ হয়, জ্বর আসবার সময় এমনি করে কাঁদে। জ্বর এসে গেলে চুপ করে যাবে।

রায়বাহাদুর অস্বস্তি বোধ করে, এদিক-ওদিক তাকায়, একটা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে মনে হয় তার। গিরীন নীরবে তাকে লক্ষ্য করে, ফাঁদে-পড়া হিংস্র জন্তুর দিকে শিকারি ব্যাধের মতো শান্ত নির্বিকারভাবে। মুখ তার থমথম করে মনের আপসহীন মনোভাবে।

আপনি তো ভালো হোমিওপ্যাথি জানেন। সবাই বলে যে ডাক্তারি পাস করেননি বটে, কিন্তু আপনার ওষুধ একেবারে অব্যর্থ। সে বলে ব্যঙ্গ ও তোষামোদের সুরে। ছেলেটাকে দেখে দিন না একটু ওষুধ? বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে ছেলেটা।

রায়বাহাদুর যেন রাজি হয়েছে তার ছেলেকে দেখে ওষুধ দিতে এমনিভাবে দরজার কাছে গিয়ে গিরীন ডাকে, শুনছ? খোকাকে নিয়ে এসো শিগগির। আহ্, এসো না নিয়ে! দেরি করছ কেন?

নিজের অতিরিক্ত ধৈর্যের কৈফিয়ত দেবার জন্যই যেন রায়বাহাদুরের কাছে গিয়ে বিরক্তির সঙ্গে বলে, আর পারি না এদের সঙ্গে। আপনার সামনে আসবে যা পরে আছে তাই পরে, তাতেও লজ্জা। সম্বল তো সেই বিয়ের একখানা শাড়ি, এক ঘণ্টা লাগবে এখন সেখানা বার করে পরতে। আর পারি না সত্যি।

সে এসে কৈফিয়তের বিরক্তি জানানো শুরু করতে-না-করতেই ছোট একটি কঙ্কাল বুকের কাছে ধরে পাশুটে রঙের রোগা একটি বৌ দরজা দিয়ে ঢুকছিল। একনজর তাকিয়েই রায়বাহাদুর টের পায় পরনের কাপড় বদলে বিয়ের সময়কার একমাত্র শাড়িটি সে পরে আসেনি। এটাও সে টের পায় যে ওকে আসতে দেখেই গিরীন তার কাছে এসে শোনাচ্ছে তার বৌয়ের মানুষের সামনে বার হবার উপযুক্ত কাপড়ের অভাবের কথা। তার প্রায় পিছুপিছুই বৌটি ঘরে ঢুকেছে। মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে রায়বাহাদুরের। তার ভয় করে।

ও তুমি এসেছ, গিরীন বলে নির্বিকারভাবে, এইখানে শুইয়ে দাও।

রায়বাহাদুরের উলের মোজা আর পালিশ-করা দামি চকচকে জুতো-পরা পায়ের কাছে মেঝেটা সে দেখিয়ে দেয়। বৌ তার ইতস্তত করে, বড় বড় জিজ্ঞাসু চোখ তুলে তাকায় তার মুখের দিকে। এত শীর্ণ বৌটি, এমন শুকনো বিবর্ণ তার রক্তশূন্য মুখ, কিন্তু তার রূপ দেখে ভেতরে ভেতরে মুচড়ে যায় রায়বাহাদুর। তার বাড়ির মেয়েরা, ফুলি ঝিটা পর্যন্ত যেন শুধু মেদ আর মাংস। গিন্নির কথা ধর্তব্যই নয়। তিনি প্রায় গোলাকার। তাঁর মেজ মেয়ে আর মেজ ছেলের বৌ রোগা ছিপছিপে, বড় ছেলের বৌটাও ছিপছিপে ছিল বিয়ের সময়, আজকাল মুটোচ্ছে। গিরীনের ক্ষীণাঙ্গী বৌটির সাথে মিলিয়ে রায়বাহাদুর বুঝতে পারে। তার মেয়ে-বৌদের গড়নটাই শুধু ছিপছিপে, অতি বেশি মেদ-মাংসেই তারা গড়া, প্রত্যেকে তারা তার গিন্নিরই সূচনা। সত্যিকারের রোগা, ক্যাংটা তরুণীকে চেয়ে চেয়ে দেখতে এত ভালো লাগে–রায়বাহাদুরের এত তীব্র ইচ্ছা করে টিপেটুপে ছেনেছুনে দেখতে সত্যিকারের কঙ্কালসার তরুণীকে।

কী করছ? গিরীন বলে বৌকে অনুযোগ দিয়ে, ওখানে শুইয়ে দাও। উনি পায়ের ধুলো ছোঁয়াবেন, আশীর্বাদ করবেন। ওষুধ দেবেন।

না! মা! রায়বাহাদুর প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে, আমি ওকে ওষুধ দিতে পারব না। ওর ভালো চিকিৎসা দরকার। ওকে তুমি ডাক্তার দেখাও, ভালো ডাক্তার দেখাও।

বিনা ফী-তে কোন ডাক্তার দেখবে বলুন? গিরীন যেন আমোদ পেয়ে মুচকে মুচকে হাসে।

ভয় করে রায়বাহাদুরের। মাথাটা আবার ঝিমঝিম করে ওঠে। কতক্ষণ খেলা করবে গিরীন তার সঙ্গে কে জানে, তারপর এই বর্বর নিষ্ঠুর খেলার শেষে কী করবে তাই-বা কে জানে। এরা বিপ্লবী, এরা খুনে, এরা সব পারে। শশাঙ্কর জামাই বলে, তার স্কুলের একজন টিচার বলে বিশ্বাস করে একা একা এই ছদ্মবেশী খুনের খপ্পরে এসে পড়ে কী বোকামিটাই সে করেছে।

সব অবস্থাতে যেভাবেই হোক নিজেকে বাঁচানোর কৌশল খুঁজে বার করে কাজে লাগানোর চেষ্টা রায়বাহাদুরের মজ্জাগত। রায়বাহাদুর মাথা হেঁট করে থাকে কয়েক। মুহূর্ত, সশব্দে নিশ্বাস ত্যাগ করে। হাতের তালুতে মুছে নেয় নিজের কপাল। তারপর। মুখ তুলে বলে, মা, খোকাকে শুইয়ে দাওগে। কিছু তুমি ভেবো না মা। বৌমাই বলি তোমাকে, গিরীন আমার ছেলের মতো। তোমার কোনো ভাবনা নেই বৌমা, ছেলে তোমার ভালো হয়ে যাবে, আমি তোমার ছেলের চিকিৎসার ভার নিলাম। আমি এক্ষুনি গিয়ে ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি–

এখুনি যাবেন? তা হবে না, ফলটল একটু মুখে না দিয়ে গেলে বড় কষ্ট হবে আমাদের মনে। অকল্যাণ হবে আমাদের। আপনার মতো মানুষ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন–

গিরীনের বিনয়ে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে রায়বাহাদুরের। অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে পায়ের চকচকে জুতোর দিকে। অতি কষ্টে বলে, বেলা মন্দ হয়নি। নিমন্ত্রিতেরা আর কেউ?

আজ্ঞে বলিনি আর কাউকে। ইচ্ছে ছিল বলবার, ভেবেছিলাম ওনার হাতের দুগাছা চুরি আছে তার একটা বেচে দিয়ে কয়েকজনকে বলব, স্কুলমাস্টারের স্ত্রীর হাতে শাঁখা থাকলেই ঢের। তারপর ভাবলাম ছেলের মুখে-ভাতে শেষ সম্বলটুকু খোয়াব, তার চেয়ে বরং সম্বলটা থাক, ও মাসেও পুরো মাইনে না পেলে উপোসটা ঠেকানো যাবে।

বুড়ো হলেও বুদ্ধির ধার একেবারে পড়ে যায়নি রায়বাহাদুরের। জীবনে উঠতে গিয়ে মুশকিলে পড়তে হয়েছে অনেকবার, নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়েই নিজের মুশকিল আসান করেছে। আজকের বিপদের ধরনটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এটাই হয়েছে ফ্যাসাদ। উদ্দেশ্যটা ধরতে পারছে না গিরীনের। নিজের দুর্দশা চোখে দেখিয়ে তার দয়া জাগাবার সাধ থাকলে চোখে এভাবে আঙুলের খোঁচা দিয়ে কি কেউ তা দেখায়, পাগল ছাড়া? তাকে বিরক্ত করে, চটিয়ে এমন টিটকারি দেওয়ার ভঙ্গিতে দেখায়, এমন উদ্ধত বিনয়ের সঙ্গে কাল টিচারদের সভায় কিছু না বলে গিরীন যেন ঘাড় ধরে তাকে বাড়ি টেনে এনে বাস্তব প্রতিবাদ জানাচ্ছে তার বক্তৃতার, ব্যঙ্গ করছে তাকে। কিন্তু কেন করছে সেটা তো কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না রায়বাহাদুরের। তার স্কুলের একজন টিচার কি এত বড় গাধা যে এই সহজ কথাটা বুঝতে পারে না। এভাবে তার কাছ থেকে কোনো অনুগ্রহ আদায় করা যায় না। এতে বরং তারই বিপদ, সমূহ বিপদ?

মুখের ভাব গলার সুরে সহানুভূতি আনার চেষ্টা করে রায়বাহাদুর বলে, তোমার অবস্থা এত খারাপ তা তো জানতাম না গিরীন। অ্যাপ্লিকেশন দিও, ও মাস থেকে দশ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দেব। তুমি ভালো পড়াও শুনেছি। আর বাকি মাইনেটাও বরং পাইয়ে দেব তোমায় সোমবার।

গিরীন ভয় পেয়ে হাতজোড় করে বলে, তা করবেন না স্যার। লোকে বলবে ছেলের মুখে-ভাতের ছলে আপনাকে বাড়িতে ডেকে খাতির করে মাইনে বাড়িয়ে নিয়েছি, বাকি মাইনে আদায় করেছি। আমার সর্বনাশ করবেন না স্যার।

চোখের পলক আটকে যায় রায়বাহাদুরের, ঢোক গিলতে গিয়ে দেখে সেটাও আটকে গেছে। ঘরে যে অসীম দৈন্য ভিখারির সকরুণ আবেদনের মতো এতক্ষণ। তাকে পীড়ন করছিল হঠাৎ যেন সেটা দাবিদারের শাসানির মতো ফুঁসে উঠেছে। উঠানে তিনটি উলঙ্গ ছেলেমেয়ে খেলা করছে ধুলামাটি নিয়ে, খেলা যেন ছল ওদের, রায়বাহাদুরকে ওরা অবজ্ঞা জানাচ্ছে। ও-ঘরে জ্বরো ছেলেটার কান্না ঝিমিয়ে এসেছে–কিন্তু সেও যেন ভয় দেখাল রায়বাহাদুরকে, কান্না নিস্তেজ হয়ে আসা যেন ঘোষণা বাচ্চাটার যে কান্না সে চিরতরে থামিয়ে দেবে, সে মরবে, মরে দায়ী করে রেখে যাবে তাকে।

তাকে আরো শাসানো দরকার বলেই যেন গিরীনের পরিবারের আরো দুজনে এবার আসরে নামে। প্রৌঢ়া একটি স্ত্রীলোক তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে একটি কুমারী মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে আসে।

দ্যাখ গিরীন, দ্যাখ, ধেড়ে মেয়ের কাণ্ড দ্যাখ। ডাল ধুতে দিয়েছি, লুকিয়ে কাঁচা ডাল চিবোচ্ছে!

গিরীনের মা থেমে যান, জিভ কাটেন। মেয়েটি পালিয়ে যায় হাত ছিনিয়ে নিয়ে। এক মুহূর্ত হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থেকে মা-ও সরে যান।

আমি এবার উঠি গিরীন।

একটু বসুন।

গিরীন বেরিয়ে যায়। গিরীন ফিরে আসবার একটু পরে সেই চুপি চুপি ডাল-খাওয়া মেয়েটি একটি রেকাবিতে দুটি সন্দেশ, একটি কলা, কয়েক টুকরো আপেল ও শশা নিয়ে জড়সড় হয়ে ঘরে আসে। বাঙালি গেরস্থঘরের হিসেবে বিয়ের বয়স তার পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। মেয়েটি রোগা, পুষ্টির অভাবে সত্যিকারের রোগা। সত্যিকারের রোগা মেয়ের দিকে তাকাবার মোহ কিন্তু তখনকার মতো কেটে গিয়েছিল। রায়বাহাদুরের, নীরবে সে দু-এক টুকরো ফল মুখে দিতে থাকে।

বৈঠকখানা দিয়ে যাবার সময় চৌকির প্রান্তের জরাজীর্ণ মানুষটি কষ্টে চোখ মেলে। তাকায়, রায়বাহাদুর একনজর দেখেই তাড়াতাড়ি চলে যায় বাইরে।

সোমবার গিরীন নোটিশ পায়, বরখাস্তের নোটিশ। সে প্রত্যাশা করছিল। ক্ষমতা থাকলে ফাঁসির হুকুম দিত রায়বাহাদুর। কিন্তু একটা কথা জানে গিরীন। রায়বাহাদুর ভুলতে পারে না, তার ভয় করবে। শিক্ষকদের দারিদ্র্যের মাহাত্ম কীর্তন করে শোনাতে গিয়ে একটু আটকে আটকে যাবে কথাগুলো, উচ্ছ্বাসটা হবে মন্দা, দয়া-মায়া সহানুভূতিতে নয়, ভয়ে।

প্রাগৈতিহাসিক

সমস্ত বর্ষাকালটা ভিখু ভয়ানক কষ্ট পাইয়াছে। আষাঢ় মাসের প্রথমে বসন্তপুরের বৈকুণ্ঠ সাহার গদিতে ডাকাতি করিতে গিয়া তাহাদের দলকে-দল ধরা পড়িয়া যায়। এগারজনের মধ্যে কেবল ভিখুই কাঁধে একটা বর্শার খোঁচা খাইয়া পলাইতে পারিয়াছিল। রাতারাতি দশ মাইল দূরের মাথা-ভাঙা পুলটার নিচে পৌঁছিয়া অর্ধেকটা শরীর কাদায় ডুবাইয়া শরবনের মধ্যে দিনের বেলাটা লুকাইয়া ছিল। রাত্রে আরো ন ক্রোশ পথ হাঁটিয়া একেবারে পেহলাদ বাগ্দীর বাড়ি চিতলপুরে।
পেহলাদ তাহাকে আশ্রয় দেয় নাই।
কাঁধটা দেখাইয়া বলিয়াছিল, ‘ঘাওখান সহজ লয় স্যাঙ্গাত। উটি পাকব। গা ফুলব। জানাজানি হইয়া গেলে আমি কনে যামু? খুনটো যদি না করতিস—’
‘তরেই খুন করতে মন লইতেছে পেহলাদ।’
‘এই জনমে লা, স্যাঙ্গাত।’
বন কাছেই ছিল, মাইল পাঁচেক উত্তরে। ভিখু অগত্যা বনেই আশ্রয় লইল। পেহলাদ নিজে বাঁশ কাটিয়া বনের একটা দুর্গম অংশে সিনজুরি গাছের নিবিড় ঝোপের মধ্যে তাহাকে একটা মাচা বাঁধিয়া দিল। তালপাতা দিয়া একটা আচ্ছাদনও করিয়া দিল। বলিল, ‘বাদলায় বাঘটাঘ সব পাহাড়ের ওপরে গেছে গা। সাপে যদি না কাটে তো আরাম কইরাই থাকবি ভিখু।’
‘খামু কী?’
‘চিঁড়া-গুড় দিলাম যে? দুদিন বাদে বাদে ভাত লইয়া আসুম; রোজ আইলে মাইনসে সন্দ করব।’
কাঁধের ঘা-টা লতাপাতা দিয়া বাঁধিয়া আবার আসিবার আশ্বাস দিয়া পেহলাদ চলিয়া গেল। রাত্রে ভিখুর জ্বর আসিল। পরদিন টের পাওয়া গেল পেহলাদের কথাই ঠিক, কাঁধের ঘা ভিখুর দুনাইয়া উঠিয়াছে। ডান হাতটি ফুলিয়া ঢোল হইয়া গিয়াছে এবং হাতটি তাহার নাড়িবার সামর্থ্য নাই।
বর্ষাকালে যে বনে বাঘ বাস করিতে চায় না এমনি অবস্থায় সেই বনে জলে ভিজিয়া মশা ও পোকার উৎপাত সহিয়া, দেহের কোনো না কোনো অংশ হইতে ঘণ্টায় একটি করিয়া জোঁক টানিয়া ছাড়াইয়া জ্বরে ও ঘায়ের ব্যথায় ধুঁকিতে ধুঁকিতে ভিখু দুদিন দুরাত্রি সঙ্কীর্ণ মাচাটুকুর ওপর কাটাইয়া দিল। বৃষ্টির সময় ছাট লাগিয়া সে ভিজিয়া গেল, রোদের সময় ভাপসা গাঢ় গুমোটে সে হাঁপাইয়া শ্বাস টানিল, পোকার অত্যাচারে দিবারাত্রি তাহার এক মুহূর্তের স্বস্তি রহিল না। পেহলাদ কয়েকটা বিড়ি দিয়া গিয়াছিল, সেগুলি ফুরাইয়া গিয়াছে। তিন-চার দিনের মতো চিঁড়া আছে বটে কিন্তু গুড় একটুও নাই। গুড় ফুরাইয়াছে, কিন্তু গুড়ের লোভে যে লাল পিঁপড়াগুলি ঝাঁক বাঁধিয়া আসিয়াছিল তাহারা এখনো মাচার উপরে ভিড় করিয়া আছে। ওদের হতাশার জ্বালা ভিখুই অবিরত ভোগ করিতেছে সর্বাঙ্গে।
মনে মনে পেহলাদের মৃত্যু কামনা করিতে করিতে ভিখু তবু বাঁচিবার জন্য প্রাণপণে যুঝিতে লাগিল। যেদিন পেহলাদের আসিবার কথা সেদিন সকালে কলসির জলটাও তাহার ফুরাইয়া গেল। বিকাল পর্যন্ত পেহলাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া তৃষ্ণার পীড়ন আর সহিতে না পারিয়া কলসিটা লইয়া সে যে কত কষ্টে খানিক দূরের নালা হইতে আধ কলসি জল ভরিয়া আনিয়া আবার মাচায় উঠিল তাহার বর্ণনা হয় না; অসহ্য ক্ষুধা পাইলে চিঁড়া চিবাইয়া সে পেট ভরাইল। একহাতে ক্রমাগত পোকা ও পিঁপড়াগুলি টিপিয়া মারিল। বিষাক্ত রস শুষিয়া লইবে বলিয়া জোঁক ধরিয়া নিজেই ঘায়ের চারিদিকে লাগাইয়া দিল। সবুজ রঙের একটা সাপকে একবার মাথার কাছে সিনজুরি গাছের পাতার ফাঁকে উঁকি দিতে দেখিয়া পুরা দুঘণ্টা লাঠি হাতে সেদিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল এবং তাহার পর দু-এক ঘণ্টা অন্তরই চারিদিকে ঝোপে ঝপাঝপ লাঠির বাড়ি দিয়া যথাসাধ্য শব্দ করিয়া সাপ তাড়াইতে লাগিল।
মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।
পেহলাদ গ্রামান্তরে কুটুমবাড়ি গিয়াছিল। পরদিনও সে আসিল না। কুটুমবাড়ির বিবাহোৎসবে তাড়ি টানিয়া বেহুঁশ হইয়া পড়িয়া রহিল। বনের মধ্যে ভিখু কীভাবে দিনরাত্রি কাটাইতেছে তিন দিনের মধ্যে সে কথা একবার তাহার মনেও পড়িল না।
ইতিমধ্যে ভিখুর ঘা পচিয়া উঠিয়া লালচে রস গড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে। শরীরও তাহার অল্প অল্প ফুলিয়াছে। জ্বরটা একটু কমিয়াছে, কিন্তু সর্বাঙ্গের অসহ্য বেদনা দম-ছুটানো তাড়ির নেশার মতোই ভিখুকে আচ্ছন্ন, অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছে। সে আর এখন ক্ষুধা-তৃষ্ণা অনুভব করিতে পারে না। জোঁকেরা তাহার রক্ত শুষিয়া শুষিয়া কচি পটোলের মতো ফুলিয়া উঠিয়া আপনা হইতেই নিচে খসিয়া পড়িয়া যায়, সে টেরও পায় না। পায়ের ধাক্কায় জলের কলসিটা এক সময় নিচে পড়িয়া ভাঙিয়া যায়, বৃষ্টির জলে ভিজিয়া পুঁটুলির মধ্যে চিঁড়াগুলি পচিতে আরম্ভ করে, রাত্রে তাহার গন্ধে আকৃষ্ট হইয়া মাচার আশপাশে শিয়াল ঘুরিয়া বেড়ায়।
কুটুমবাড়ি হইতে ফিরিয়া বিকালের দিকে ভিখুর খবর লইতে গিয়া ব্যাপার দেখিয়া পেহলাদ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়িল। ভিখুর জন্য একবাটি ভাত ও কয়েকটি পুঁটিমাছ ভাজা আর একটু পুঁই-চচ্চড়ি সে সঙ্গে লইয়া গিয়াছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিখুর কাছে বসিয়া থাকিয়া ওগুলি সে নিজেই খাইয়া ফেলিল। তারপর বাড়ি গিয়া বাঁশের একটা ছোট মই এবং তাহার বোনাই ভরতকে সঙ্গে করিয়া ফিরিয়া আসিল।
মইয়ে শোয়াইয়া তাহারা দুজনে ভিখুকে বাড়ি লইয়া গেল। ঘরের মাচার ওপর খড় বিছাইয়া শয্যা রচনা করিয়া তাহাকে শোয়াইয়া রাখিল।
আর এমনি শক্তপ্রাণ ভিখুর যে শুধু এই আশ্রয়টুকু পাইয়াই বিনা চিকিৎসায় ও এক রকম বিনা যত্নেই এক মাস মুমূর্ষু অবস্থায় কাটাইয়া সে ক্রমে ক্রমে নিশ্চিত মরণকে জয় করিয়া ফেলিল। কিন্তু ডান হাতটি তাহার আর ভালো হইল না। গাছের মরা ডালের মতো শুকাইয়া গিয়া অবশ অকর্মণ্য হইয়া পড়িল। প্রথমে অতি কষ্টে হাতটা সে একটু নাড়িতে পারিত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে ক্ষমতাটুকুও তাহার নষ্ট হইয়া গেল।
কাঁধের ঘা শুকাইয়া আসিবার পর বাড়িতে বাহিরের লোক কেহ উপস্থিত না থাকিলে ভিখু তাহার একটি মাত্র হাতের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে বাঁশের মই বাহিয়া নিচে নামিতে লাগিল এবং একদিন সন্ধ্যার সময় এক কাণ্ড করিয়া বসিল।
পেহলাদ সে সময় বাড়ি ছিল না, ভরতের সঙ্গে তাড়ি গিলিতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। পেহলাদের বোন গিয়াছিল ঘাটে। পেহলাদের বৌ ছেলেকে ঘরে শোয়াইতে আসিয়া ভিখুর চাহনি দেখিয়া তাড়াতাড়ি পলাইয়া যাইতেছিল, ভিখু তাহার একটা হাত চাপিয়া ধরিল।
কিন্তু পেহলাদের বৌ বাগ্দীর মেয়ে। দুর্বল শরীরে বাঁ হাতে তাহাকে আয়ত্ত করা সহজ নয়। এক ঝটকায় হাত ছাড়াইয়া সে গাল দিতে দিতে চলিয়া গেল। পেহলাদ বাড়ি ফিরিলে সব বলিয়া দিল।
তাড়ির নেশায় পেহলাদের মনে হইল, এমন নেমকহারাম মানুষটাকে একেবারে খুন করিয়া ফেলাই কর্তব্য। হাতের মোটা বাঁশের লাঠিটা বৌয়ের পিঠে এক ঘা বসাইয়া দিয়া ভিখুর মাথা ফাটাইতে গিয়া নেশার মধ্যেও কিন্তু টের পাইতে বাকি রহিল না যে কাজটা যত বড় কর্তব্যই হোক সম্ভব একেবারেই নয়। ভিখু তাহার ধারালো দা-টি বাঁ হাতে শক্ত করিয়া বাগাইয়া ধরিয়া আছে। সুতরাং খুনোখুনির পরিবর্তে তাহাদের মধ্যে কিছু অশ্লীল কথার আদান-প্রদান হইয়া গেল।
শেষে পেহলাদ বলিল, ‘তোর লাইগ্যা আমার সাত টাকা খরচ গেছে, টাকাটা দে, দিয়া বাইর’ আমার বাড়ি থেইকা,—দূর হ।’
ভিখু বলিল, ‘আমার কোমরে একটা বাজু বাইন্ধা রাখছিলাম, তুই চুরি করছস। আগে আমার বাজু ফিরাইয়া দে, তবে যামু।’
‘তোর বাজুর খপর জানে কেডা রে?’
‘বাজু দে কইলাম পেহলাদ, ভালো চাস তো! বাজু না দিলি সা-বাড়ির মেজোকত্তার মতো গলাডা তোর একখান কোপেই দুই ফাঁক কইরা ফেলুম, এই তোরে আমি কইয়া রাখলাম। বাজু পালি আমি অখনি যামু গিয়া।’
কিন্তু বাজু ভিখু ফেরত পাইল না। তাহাদের বিবাদের মধ্যে ভরত আসিয়া পড়ায় দুজনে মিলিয়া ভিখুকে তাহারা কায়দা করিয়া ফেলিল। পেহলাদের বাহুমূলে একটা কামড় বসাইয় দেওয়া ছাড়া দুর্বল ও পঙ্গু ভিখু আর বিশেষ কিছুই করিয়া উঠিতে পারিল না। পেহলাদ ও তাহার বোনাই তাহাকে মারিতে মারিতে আধমরা করিয়া ফেলিয়া বাড়ির বাহির করিয়া দিল। ভিখুর শুকাইয়া-আসা ঘা ফাটিয়া রক্ত পড়িতেছিল, হাত দিয়া রক্ত মুছিতে মুছিতে ধুঁকিতে ধুঁকিতে সে চলিয়া গেল। রাত্রির অন্ধকারে সে কোথায় গেল কেহই তাহা জানিতে পারিল না বটে, কিন্তু দুপুর রাতে পেহলাদের ঘর জ্বলিয়া উঠিয়া বাগ্দীপাড়ায় বিষম হইচই বাধাইয়া দিল।
পেহলাদ কপাল চাপড়াইয়া বলিতে লাগিল, ‘হায় সব্বনাশ, হায় সব্বনাশ! ঘরকে আমার শনি আইছিল, হায় সব্বনাশ!’
কিন্তু পুলিশের টানাটানির ভয়ে মুখ ফুটিয়া বেচারা ভিখুর নামটা পর্যন্ত করিতে পারিল না।
সেই রাত্রি হইতে ভিখুর আদিম, অসভ্য জীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হইল। চিতলপুরের পাশে একটা নদী আছে। পেহলাদের ঘরে আগুন দিয়া আসিয়া একটা জেলেডিঙি চুরি করিয়া ভিখু নদীর স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল। লগি ঠেলিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না, একটা চ্যাপটা বাঁশকে হালের মতো করিয়া ধরিয়া রাখিয়া সে সমস্ত রাত কোনোরকমে নৌকার মুখ সিধা রাখিয়াছিল। সকাল হওয়ার আগে শুধু স্রোতের টানে সে বেশিদূর আগাইতে পারে নাই।
ভিখুর মনে আশঙ্কা ছিল ঘরে আগুন দেওয়ার শোধ লইতে পেহলাদ হয়তো তাহার নামটা প্রকাশ করিয়া দিবে, মনের জ্বালায় নিজের অসুবিধার কথাটা ভাবিবে না। পুলিশ বহুদিন যাবত তাহাকে ধরিবার চেষ্টা করিতেছে, বৈকুণ্ঠ সাহার বাড়িতে খুনটা হওয়ার ফলে চেষ্টা তাহাদের বাড়িয়াছে বৈ কমে নাই। পেহলাদের কাছে খবর পাইলে পুলিশ আশেপাশে চারিদিকেই তাহার খোঁজ করিবে। বিশ-ত্রিশ মাইলের মধ্যে লোকালয়ে মুখ দেখানো তাহার পক্ষে বিপদের কথা। কিন্তু ভিখু তখন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। কাল বিকাল হইতে সে কিছু খায় নাই। দুজন জোয়ান মানুষের হাতে বেদম মার খাইয়া এখনো দুর্বল শরীরটা তাহার ব্যথায় আড়ষ্ট হইয়া আছে। ভোর-ভোর মহকুমা শহরের ঘাটের সামনে পৌঁছিয়া সে ঘাটে নৌকা লাগাইল। নদীর জলে ডুবিয়া ডুবিয়া স্নান করিয়া গায়ের রক্তের চিহ্ন ধুইয়া ফেলিয়া শহরের ভিতর প্রবেশ করিল। ক্ষুধায় সে চোখে অন্ধকার দেখিতেছিল। একটি পয়সাও তাহার সঙ্গে নাই যে মুড়ি কিনিয়া খায়। বাজারের রাস্তায় প্রথম যে ভদ্রলোকটির সঙ্গে দেখা হইল তাঁহারই সামনে হাত পাতিয়া সে বলিল, ‘দুটো পয়সা দিবান কর্তা?’
তাহার মাথার জটবাঁধা চাপ-চাপ রুক্ষ ধূসর চুল, কোমরে জড়ানো মাটির মতো ময়লা ছেঁড়া ন্যাকড়া, আর দড়ির মতো শীর্ণ দোদুল্যমান হাতটি দেখিয়া ভদ্রলোকটির বুঝি দয়াই হইল। তিনি তাহাকে একটি পয়সা দান করিলেন।
ভিখু বলিল—’একটা দিলেন বাবু? আর একটা দেন।’
ভদ্রলোক চটিয়া বলিলেন—’একটা দিলাম, তাতে হল না—ভাগ।’
এক মুহূর্তের জন্য মনে হইল ভিখু বুঝি তাহাকে একটা বিশ্রী গালই দিয়া বসে। কিন্তু সে আত্মসংবরণ করিল। গাল দেওয়ার বদলে আরক্ত চোখে তাহার দিকে একবার কটমট করিয়া তাকাইয়া সামনের মুড়িমুড়কির দোকানে গিয়া পয়সাটা দিয়া মুড়ি কিনিয়া গোগ্রাসে গিলিতে আরম্ভ করিল।
সেই হইল তাহার ভিক্ষা করিবার হাতেখড়ি।
কয়েক দিনের ভিতরেই সে পৃথিবীর বহু পুরাতন ব্যবসাটির এই প্রকাশ্যতম বিভাগের আইনকানুন সব শিখিয়া ফেলিল। আবেদনের ভঙ্গি ও ভাষা তাহার জন্মভিখারির মতো আয়ত্ত হইয়া গেল। শরীর এখন আর সে একেবারেই সাফ করে না, মাথার চুল তাহার ক্রমেই জট বাঁধিয়া দলা-দলা হইয়া যায় এবং তাহাতে অনেকগুলি উকুন-পরিবার দিনের পর দিন বংশবৃদ্ধি করিয়া চলে। ভিখু মাঝে মাঝে খ্যাপার মতো দুই হাতে মাথা চুলকায় কিন্তু বাড়তি চুল কাটিয়া ফেলিতে ভরসা পায় না। ভিক্ষা করিয়া সে একটি ছেঁড়া কোট পাইছে, কাঁধের ক্ষতচিহ্নটা ঢাকিয়া রাখিবার জন্য দারুণ গুমোটের সময়েও কোটটা সে গায়ে চাপাইয়া রাখে। শুকনো হাতখানা তাহার ব্যবসার সবচেয়ে জোরালো বিজ্ঞাপন, এই অঙ্গটি ঢাকিয়া রাখিলে তাহার চলে না। কোটের ডানদিকের হাতাটি সে তাই বগলের কাছ হইতে ছিঁড়িয়া বাদ দিয়াছে। একটি টিনের মগ ও একটা লাঠিও সে সংগ্রহ করিয়া লইয়াছে।
সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাজারের কাছে রাস্তার ধারে একটা তেঁতুলগাছের নিচে বসিয়া সে ভিক্ষা করে। সকালে এক পয়সার মুড়ি খাইয়া নেয়, দুপুরে বাজারের খানিক তফাতে একটা পোড়ো বাগানের মধ্যে ঢুকিয়া বটগাছের নিচে ইটের উনুনে মেটে হাঁড়িতে ভাত রান্না করে, মাটির মালসায় কোনোদিন রাঁধে ছোট মাছ, কোনোদিন তরকারি। পেট ভরিয়া খাইয়া বটগাছটাতেই হেলান দিয়া বসিয়া আরামে বিড়ি টানে। তারপর আবার তেঁতুলগাছটার নিচে গিয়া বসে।
সারাটা দিন শ্বাস-টানা কাতরানির সঙ্গে সে বলিয়া যায় : হেই বাবা একটা পয়সা : আমায় দিলে ভগবান দিবে : হেই বাবা একটা পয়সা—
অনেক প্রাচীন বুলির মতো ‘ভিক্ষায়াং নৈব নৈব চ’ শ্লোকটা আসলে অসত্য। সারাদিনে ভিখুর সামনে দিয়া হাজার-দেড় হাজার লোক যাতায়াত করে এবং গড়ে প্রতি পঞ্চাশ জনের মধ্যে একজন তাহাকে পয়সা অথবা আধলা দেয়। আধলার সংখ্যা বেশি হইলেও সারাদিনে ভিখুর পাঁচ-ছ আনা রোজগার হয়, কিন্তু সাধারণত তাহার উপার্জন আট আনার কাছাকাছি থাকে। সপ্তাহে এখানে দুদিন হাট বসে। হাটবারের উপার্জন তাহার একটি পুরা টাকার নিচে নামে না।
এখন বর্ষাকাল অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। নদীর দুই তীর কাশে সাদা হইয়া উঠিয়াছে। নদীর কাছেই বিন্নু মাঝির বাড়ির পাশে ভাঙা চালাটা ভিখু মাসিক আট আনায় ভাড়া করিয়াছে। রাত্রে সে ওখানেই শুইয়া থাকে। ম্যালেরিয়ায় মৃত এক ব্যক্তির জীর্ণ কিন্তু পুরু একটি কাঁথা সংগ্রহ করিয়াছে, লোকের বাড়ির খড়ের গাদা হইতে চুরি করিয়া আনা খড় বিছাইয়া তাহার উপর কাঁথাটি পাতিয়া সে আরাম করিয়া ঘুমায়। মাঝে মাঝে শহরের ভিতরে গৃহস্থবাড়িতে ভিক্ষা করিতে গিয়া সে কয়েকখানা ছেঁড়া কাপড় পাইয়াছে। তাই পুঁটলি করিয়া বালিশের মতো ব্যবহার করে। রাত্রে নদীর জোলো-বাতাসে শীত করিতে থাকিলে পুঁটলি খুলিয়া একটি কাপড় গায়ে জড়াইয়া লয়।
সুখে থাকিয়া এবং পেট ভরিয়া খাইয়া কিছুদিনের মধ্যে ভিখুর দেহে পূর্বের স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিল। তাহার ছাতি ফুলিয়া উঠিল, প্রত্যেকটি অঙ্গ সঞ্চালনে হাতের ও পিঠের মাংসপেশি নাচিয়া উঠিতে লাগিল। অবরুদ্ধ শক্তির উত্তেজনায় ক্রমে ক্রমে তাহার মেজাজ উদ্ধত ও অসহিঞ্চু হইয়া পড়িল। অভ্যস্ত বুলি আওড়াইয়া কাতরভাবেই সে এখনো ভিক্ষা চায় কিন্তু ভিক্ষা না পাইলে তাহার ক্রোধের সীমা থাকে না। পথে লোকজন না থাকিলে তাহার প্রতি উদাসীন পথিককে সে অশ্লীল গাল দিয়া বসে। এক পয়সার জিনিস কিনিয়া ফাউ না পাইলে দোকানিকে মারিতে ওঠে। নদীর ঘাটে মেয়েরা স্নান করিতে নামিলে ভিক্ষা চাহিবার ছলে জলের ধারে গিয়া দাঁড়ায়। মেয়েরা ভয় পাইলে সে খুশি হয় এবং সরিয়া যাইতে বলিলে নড়ে না, দাঁত বাহির করিয়া দুর্বিনীত হাসি হাসে।
রাত্রে স্বরচিত শয্যায় সে ছটফট করে।
নারী-সঙ্গহীন এই নিরুৎসব জীবন আর তার ভালো লাগে না। অতীতের উদ্দাম ঘটনাবহুল জীবনটির জন্য তাহার মন হাহাকার করে।
তাড়ির দোকানে ভাঁড়ে ভাঁড়ে তাড়ি গিলিয়া সে হল্লা করিত, টলিতে টলিতে বাসির ঘরে গিয়া উন্মত্ত রাত্রি যাপন করিত, আর মাঝে মাঝে দল বাঁধিয়া গভীর রাত্রে গৃহস্থের বাড়ি চড়াও হইয়া সকলকে মারিয়া কাটিয়া টাকা ও গহনা লুটিয়া রাতারাতি উধাও হইয়া যাইত। স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীকে বাঁধিয়া মারিলে তাহার মুখে যে অবর্ণনীয় ভাব দেখা দিত, পুত্রের অঙ্গ হইতে ফিনকি দিয়া রক্ত ছুটিলে মা যেমন করিয়া আর্তনাদ করিয়া উঠিত; মশালের আলোয় সে দৃশ্য দেখা আর আর্তনাদ শোনার চেয়ে উন্মাদনাকর নেশা জগতে আর কী আছে? পুলিশের ভয়ে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে পলাইয়া বেড়াইয়া আর বনে-জঙ্গলে লুকাইয়া থাকিয়াও যেন তখন সুখী ছিল। তাহার দলের অনেকেই বারবার ধরা পড়িয়া জেল খাটিয়াছে কিন্তু জীবনে একবারের বেশি পুলিশ তাহার নাগাল পায় নাই। রাখু বাগ্দীর সঙ্গে পানাহার শ্রীপতি বিশ্বাসের বোনটাকে যেবার সে চুরি করিয়াছিল সেইবার সাত বছরের জন্য তাহার কয়েদ হইয়াছিল, কিন্তু দুবছরের বেশি কেহ তাহাকে জেলে আটকাইয়া রাখিতে পারে নাই। এক বর্ষার সন্ধ্যায় জেলের প্রাচীর ডিঙাইয়া সে পলাইয়াছিল। তারপর একা সে গৃহস্থবাড়িতে ঘরের বেড়া কাটিয়া চুরি করিয়াছে, দিনদুপুরে পুকুরঘাটে একাকিনী গৃহস্থবধূর মুখ চাপিয়া গলার হার, হাতের বালা খুলিয়া লইয়াছে, রাখুর বৌকে সঙ্গে নিয়া নোয়াখালী হইয়া সমুদ্র ডিঙাইয়া পাড়ি দিয়াছে একেবারে হাতিয়ায়। ছ মাস পরে রাখুর বৌকে হাতিয়ায় ফেলিয়া আসিয়া পরপর তিনবার তিনটা দল করিয়া দূরে দূরে কত গ্রামে যে ডাকাতি করিয়া বেড়াইয়াছে তাহার সবগুলির নামও এখন তাহার স্মরণ নাই। তারপর এই সেদিন বৈকুণ্ঠ সাহার মেজ ভাইটার গলাটা সে দায়ের এক কোপে দু ফাঁক করিয়া দিয়া আসিয়াছে।
কী জীবন তাহার ছিল, এখন কী হইয়াছে!
মানুষ খুন করিতে যাহার ভালো লাগিত সে আজ ভিক্ষা না দিয়া চলিয়া গেলে পথচারীকে একটি টিটকারি দেওয়ার মধ্যে মনের জ্বালা নিঃশেষ করে। দেহের শক্তি তাহার এখনো তেমনি অক্ষুণ্ন আছে। সে শক্তি প্রয়োগ করিবার উপায়টাই তাহার নাই। কত দোকানে গভীর রাত্রে সামনে টাকার থোক সাজাইয়া একা বসিয়া দোকানি হিসাব মেলায়, বিদেশগত কত পুরুষের গৃহে মেয়েরা থাকে একা। এদিকে ধারালো একটা অস্ত্র হাতে ওদের সামনে হুমকি দিয়া পড়িয়া একদিনে বড়লোক হওয়ার পরিবর্তে বিন্নু মাঝির চালাটার নিচে সে চুপচাপ শুইয়া থাকে।
ডান হাতটাতে অন্ধকারে হাত বুলাইয়া ভিখুর আফসোসের সীমা থাকে না। সংসারের অসংখ্য ভীরু ও দুর্বল নরনারীর মধ্যে এত বড় বুকের পাটা আর এমন একটা জোরালো শরীর নিয়া শুধু একটা হাতের অভাবে সে যে মরিয়া আছে! এমন কপালও মানুষের হয়?
তবুও এ দুর্ভাগ্য সে সহ্য করিতে পারে। আফসোসেই নিবৃত্তি। একা ভিখু আর থাকিতে পারে না।
বাজারে ঢুকিবার মুখেই একটি ভিখারিনী ভিক্ষা করিতে বসে। বয়স তাহার বেশি নয়, দেহের বাঁধুনিও বেশ আছে। কিন্তু একটা পায়ে হাঁটুর নিচ হইতে পাতা পর্যন্ত তাহার থকথকে তৈলাক্ত ঘা।
এই ঘায়ের জোরে সে ভিখুর চেয়ে বেশি রোজগার করে। সেজন্য ঘা-টিকে সে বিশেষ যত্নে সারিতে দেয় না।
ভিখু মধ্যে মধ্যে গিয়া তাহার কাছে বসে। বলে, ‘ঘা-টি সারব না, লয়?’
ভিখারিনী বলে, ‘খুব! ওষুদ দিলে অখনি সারে।’
ভিখু সাগ্রহে বলে, ‘সারা তবে, ওষুদ দিয়ে চটপট সারাইয়া ল। ঘা সারলে তোর আর ভিক্ মাগতি অইবো না,—জানস? আমি তোরে রাখুম।’
‘আমি থাকলি তো।’
‘ক্যান? থাকবি না ক্যান? খাওয়ামু পরামু, আরামে রাখুম, পায়ের পরনি পা দিয়া গাঁট হইয়া বইয়া থাকবি। না করস তুই কিয়ের লেগে?’
অত সহজে ভুলিবার মেয়ে ভিখারিনী নয়। খানিকটা তামাকপাতা মুখে গুঁজিয়া সে বলে, ‘দুদিন বাদে মোরে যখন তুই খেদাইয়া দিবি, ঘা মুই তখন পামু কোয়ানে?’
ভিখু আজীবন একনিষ্ঠতার প্রতিজ্ঞা করে, সুখে রাখিবার লোভ দেখায়। কিন্তু ভিখারিনী কোনোমতেই রাজি হয় না। ভিখু ক্ষুণ্ন মনে ফিরিয়া আসে।
এদিকে আকাশে চাঁদ ওঠে, নদীতে জোয়ার-ভাটা বয়, শীতের আমেজে বায়ুস্তরে মাদকতা দেখা দেয়। ভিখুর চালার পাশে কলাবাগানে চাঁপাকলার কাঁদি শেষ হইয়া আসে। বিন্নু মাঝি কলা বিক্রির পয়সায় বৌকে রুপার গোট কিনিয়া দেয়। তালের রসের মধ্যে নেশা ক্রমেই ঘোরালো ও জমাট হইয়া ওঠে। ভিখুর প্রেমের উত্তাপে ঘৃণা উবিয়া যায়। নিজেকে সে আর সামলাইয়া রাখিতে পারে না।
একদিন সকালে উঠিয়াই সে ভিখারিনীর কাছে যায়। বলে, ‘আইচ্ছা, ল, ঘা লইয়াই চল্।’
ভিখারিনী বলে, ‘আগে আইবার পার নাই? যা, অখন মর গিয়া আখার তলের ছালি খা গিয়া।’
‘ক্যান? ছালি খাওনের কথাডা কী?’
‘তোর লাইগা হাঁ কইরা বইসা আছি ভাবছস তুই, বটে? আমি উই উয়ার সাথে রইছি।’
ওদিকে তাকাইয়া ভিখু দেখিতে পায় তাহারই মতো জোয়ান দাড়িওলা এক খঞ্জ ভিখারি খানিক তফাতে আসন করিয়াছে। তাহার ডান হাতটির মতো একটি পা হাঁটুর নিচে শুকাইয়া গিয়াছে, বিশেষ যত্নসহকারে ওই অংশটুকু সামনে মেলিয়া সে আল্লার নামে দয়া প্রার্থনা করিতেছে।
পাশে পড়িয়া আছে কাঠের একটা কৃত্রিম হ্রস্ব পা।
ভিখারিনী আবার বলিল—’বসস যে? যা পালাইয়া যা, দেখলি খুন কইরা ফেলাইবো কইয়া দিলাম।’
ভিখু বলে, ‘আরে থো, খুন অমন সব হালাই করতিছে। উয়ার মতো দশটা মাইনষের একা ঘায়েল কইরা দিবার পাত্তাম, তা জানস?’
ভিখারিনী বলে, ‘পারস তো যা না, উয়ার সাথে লাগ না গিয়া। আমার কাছে কী?’
‘উয়াকে তুই ছাড়ান দে। আমার কাছে চ’।’
‘ইরে সোনা! তামুক খাবা? ঘা দেইখা পিছাইছিলি, তোর লগে আর খাতির কিরে হালার পুত? উয়ারে ছাড়ুম ক্যান? উয়ার মতো কামাস তুই? ঘর আছে তোর? ভাগবি তো ভাগ, নইলে গাল দিমু কইলাম।’
ভিখু তখনকার মতো প্রস্থান করে। কিন্তু হাল ছাড়ে না। ভিখারিনীকে একা দেখিলেই কাছে আসিয়া দাঁড়ায়। ভাব জমাইবার চেষ্টা করিয়া বলে, ‘তোর নামটো কী র্যা?’
এমনি তাহারা পরিচয়হীন যে এতকাল পরস্পরের নাম জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজনও তাহারা বোধ করে নাই।
ভিখারিনী কালো দাঁতের ফাঁকে হাসে।
‘ফের লাগতে আইছস? হোই ও বুড়ির কাছে যা।’ ভিখু তাহার কাছে উবু হইয়া বসে। পয়সার বদলে অনেকে চাল ভিক্ষা দেয় বলিয়া আজকাল সে কাঁধে একটা ঝুলি ঝুলাইয়া বেড়ায়। ঝুলির ভিতর হইতে মর্তমান কলা বাহির করিয়া ভিখারিনীর সামনে রাখিয়া বলে ‘খা। তোর লগে চুরি কইরা আনছি।’
ভিখারিনী তৎক্ষণাৎ খোসা ছাড়াইয়া প্রেমিকের দান আত্মসাৎ করে। খুশি হইয়া বলে, ‘নাম শুনবার চাস? পাঁচী কয় মোরে,—পাঁচী। তুই কলা দিছস, নাম কইলাম, এবারে ভাগ।’
ভিখু উঠিবার নাম করে না। অতবড় একটা কলা দিয়া শুধু নাম শুনিয়া খুশি হওয়ার মতো শৌখিন সে নয়। যতক্ষণ পারে ধুলার উপর উবু হইয়া বসিয়া পাঁচীর সঙ্গে সে আলাপ করে। ওদের স্তরে নামিয়া না গেলে সে আলাপকে কেহ আলাপ বলিয়া চিনিতে পারিবে না। মনে হইবে পরস্পরকে তাহারা যেন গাল দিতেছে। পাঁচীর সঙ্গীটির নাম বসির। তার সঙ্গেও সে একদিন আলাপ জমাইবার চেষ্টা করিল।
‘সেলাম মিয়া।’
বসির বলিল, ‘ইদিকে ঘুরাফিরা কী জন্য? সেলাম মিয়া হতিছে! লাঠির একঘায়ে শিরটি ছেঁচ্যা দিমু নে!’
দুজনে খুব খানিকটা গালাগালি হইয়া গেল। ভিখুর হাতে লাঠি ও বসিরের হাতে মস্ত একটা পাথর থাকায় মারামারিটা আর হইল না।
নিজের তেঁতুলগাছের তলায় ফিরিয়া যাওয়ার আগে ভিখু বলিল, ‘র, তোরে নিপাত করতেছি।’
বসির বলিল, ‘ফের উয়ার সাথে বাতচিত করলি জানে মাইরা দিমু। আল্লার কিরে।’
এই সময় ভিখুর উপার্জন কমিয়া আসিল।
পথ দিয়া প্রত্যহ নূতন নূতন লোক যাতায়াত করে না। একেবারে প্রথমবারের জন্য যাহারা পথটি ব্যবহার করে, দৈনন্দিন পথিকদের মধ্যে তাহাদের সংখ্যা দুই মাসের ভিতরই মুষ্টিমেয় হইয়া আসে। ভিখুকে একবার তাহারা একটি পয়সা দিয়াছে, পুনরায় তাহাকে দান করিবার প্রয়োজন তাহাদের অনেকেই বোধ করে না। সংসারে ভিখারির অভাব নাই।
কোনো রকমে ভিখুর পেট চলিতে লাগিল। হাটবার ছাড়া রোজগারের একটি পয়সাও সে বাঁচাইতে পারিল না। সে ভাবনায় পড়িয়া গেল।
শীত পড়িলে খোলা চালার নিচে থাকা কষ্টকর হইবে। যেখানে হোক চারদিক-ঘেরা যেমন-তেমন ঘর একখানা তাহার চাই। মাথা গুঁজিবার একটা ঠাঁই আর দুবেলা খাইতে না পাইলে কোনো যুবতী ভিখারিনীই তাহার সঙ্গে বাস করিতে রাজি হইবে না। অথচ উপার্জন তাহার যেভাবে কমিয়া আসিতেছে এভাবে কমিতে থাকিলে শীতকালে নিজেই হয়তো পেট ভরিয়া খাইতে পাইবে না।
যেভাবেই হোক আয় তাহাকে বাড়াইতেই হইবে।
এখানে থাকিয়া আয় বাড়াইবার কোনো উপায়ই সে দেখিতে পায় না। চুরি-ডাকাতির উপায় নাই, মজুর খাটিবার উপায় নাই, একেবারে খুন করিয়া না ফেলিলে কাহারো কাছে অর্থ ছিনাইয়া লওয়া একহাতে সম্ভব নয়। পাঁচীকে ফেলিয়া এই শহর ছাড়িয়া কোথাও যাইতে তাহার ইচ্ছা হয় না। আপনার ভাগের বিরুদ্ধে ভিখুর মন বিদ্রোহী হইয়া ওঠে। তাহার চালার পাশে বিন্নু মাঝির সুখী পারিবারিক জীবনটা তাহাকে হিংসায় জর্জরিত করিয়া দেয়। এক-একদিন বিন্নুর ঘরে আগুন ধরাইয়া দিবার জন্য মন ছটফট করিয়া ওঠে। নদীর ধারে খ্যাপার মতো ঘুরিতে ঘুরিতে তাহার মনে হয় পৃথিবীর যত খাদ্য ও যত নারী আছে একা সব দখল করিতে না পারিলে তাহার তৃপ্তি হইবে না।
আর কিছুকাল ভিখু এমনি অসন্তোষের মধ্যে কাটাইয়া দিল। তারপর একদিন গভীর রাত্রে ঝুলির মধ্যে তাহার সমস্ত মূল্যবান জিনিস ভরিয়া, জমানো টাকা কটি কোমরের কাপড়ে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া ভিখু তাহার চালা হইতে বাহির হইয়া পড়িল। নদীর ধারে একদিন সে হাতখানেক লম্বা একটা লোহার শিক কুড়াইয়া পাইয়াছিল। অবসরমতো পাথরে ঘষিয়া শিকটির একটা মুখ সে চোখা করিয়াছে। এই অস্ত্রটি সে ঝুলির মধ্যে ভরিয়া সঙ্গে লইল।
অমাবস্যার অন্ধকারে আকাশভরা তারা তখন ঝিকিমিকি করিতেছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা। বহুকাল পরে মধ্যরাত্রির জনহীন জগতে মনের মধ্যে ভয়ানক একটা কল্পনা লইয়া বিচরণ করিতে বাহির হইয়া ভিখুর অকথনীয় উল্লাস বোধ হইল। নিজের মনে অস্ফুটস্বরে সে বলিয়া উঠিল, ‘বাঁটি লইয়া ডানটির যদি রেহাই দিতা ভগমান!’
নদীর ধারে ধারে আধমাইল হাঁটিয়া গিয়া একটি সঙ্কীর্ণ পথ দিয়া সে শহরে প্রবেশ করিল। বাজার বাঁ-হাতি রাখিয়া ঘুমন্ত শহরের বুকে ছোট ছোট অলিগলি দিয়া শহরের অপর প্রান্তে গিয়া পৌঁছিল। শহরে যাওয়ার পাকা রাস্তাটি এখান দিয়া শহর হইতে বাহির হইয়াছে। নদী ঘুরিয়া আসিয়া দু মাইল তফাত এই রাস্তারই পাশে মাইলখানেক রহিয়া গিয়া আবার দক্ষিণে দিক পরিবর্তন করিয়াছে।
কিছু দূর পর্যন্ত রাস্তার দুদিকে ফাঁকে ফাঁকে দু-একটি বাড়ি চোখে পড়ে। তারপর ধানের ক্ষেত ও মাঝে মাঝে জঙ্গলাকীর্ণ পতিত ডাঙার দেখা পাওয়া যায়। এমনি একটা জঙ্গলের ধারে জমি সাফ করিয়া পাঁচ-সাতখানা কুঁড়ে তুলিয়া কয়েকটা হতভাগা মানুষ একটি দরিদ্রতম পল্লী স্থাপিত করিয়াছে। তার মধ্যে একটি কুঁড়ে বসিরের। ভোরে উঠিয়া ঠকঠক শব্দে কাঠির পা ফেলিয়া সে শহরে ভিক্ষা করিতে যায়, সন্ধ্যার সময় ফিরিয়া আসে। পাঁচী গাছের পাতা জ্বালাইয়া ভাত রাঁধে, বসির টানে তামাক। রাত্রে পাঁচী পায়ের ঘায়ে ন্যাকড়ার পটি জড়ায়। বাঁশের খাটে পাশাপাশি শুইয়া তাহাদের কাটা কাটা কদর্য ভাষায় গল্প করিতে করিতে তাহারা ঘুমাইয়া পড়ে। তাহাদের নীড়, তাহাদের শয্যা ও তাহাদের দেহ হইতে একটা ভাপসা পচা দুর্গন্ধ উঠিয়া খড়ের চালের ফুটা দিয়া বাহিরের বাতাসে মিশিতে থাকে।
ঘুমের ঘোরে বসির নাক ডাকায়। পাঁচী বিড়বিড় করিয়া বকে।
ভিখু একদিন ওদের পিছু পিছু আসিয়া ঘর দেখিয়া গিয়াছিল। অন্ধকারে সাবধানে ঘরের পিছনে গিয়া বেড়ার ফাঁকে কান পাতিয়া সে কিছুক্ষণ কচুবনের মধ্যে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর ঘুরিয়া ঘরের সামনে আসিল। ভিখারির কুঁড়ে, দরজার ঝাঁপটি পাঁচী ভিতর হইতে বন্ধ করে নাই, শুধু ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল। ঝাঁপটা সন্তর্পণে একপাশে সরাইয়া ঝুলির ভিতর হইতে শিকটি বাহির করিয়া শক্ত করিয়া ধরিল। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। বাহিরে তারার আলো ছিল, ঘরের ভিতরে সেটুকু আলোরও অভাব। দেশলাই জ্বালিবার অতিরিক্ত হাত নাই; ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া ভিখু ভাবিয়া দেখিল বসিরের হৃৎপিণ্ডের অবস্থানটি নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বাঁ হাতের আঘাত, ঠিক জায়গামতো না পড়িলে বসির গোলমাল করিবার সুযোগ পাইবে। তাহাতে মুশকিল অনেক।
কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করিয়া বসিরের শিয়রের কাছে সরিয়া গিয়া একটিমাত্র আঘাতে ঘুমন্ত লোকটার তালুর মধ্যে শিকের চোখা দিকটা সে প্রায় তিন আঙুল ভিতরে ঢুকাইয়া দিল। অন্ধকারে আঘাত কতদূর মারাত্মক হইয়াছে বুঝিবার উপায় ছিল না। শিকটা মাথার মধ্যে ঢুকিয়াছে টের পাইয়াও ভিখু তাই নিশ্চিন্ত হইতে পারিল না। একহাতে সবলে বসিরের গলা চাপিয়া ধরিল।
পাঁচীকে বলিল, ‘চুপ থাক; চিল্লোবি তো তোরেও মাইরা ফেলামু।’
পাঁচী চেঁচাইল না, ভয়ে গোঙাইতে লাগিল।
ভিখু তখন আবার বলিল, ‘একটুকু আওয়াজ লয়, ভালো চাস তো একদম চুপ মাইরা থাক।’
বসির নিস্পন্দ হইয়া গেলে ভিখু তাহার গলা হইতে হাত সরাইয়া লইল।
দম লইয়া বলিল, ‘আলোটা জ্বাইলা দে পাঁচী।’
পাঁচী আলো জ্বালিলে ভিখু পরম তৃপ্তির সঙ্গে নিজের কীর্তি চাহিয়া দেখিল। একটিমাত্র হাতের সাহায্যে অমন জোয়ান মানুষটাকে ঘায়েল করিয়া গর্বের তাহার সীমা ছিল না। পাঁচীর দিকে তাকাইয়া সে বলিল, ‘দেখছস? কেডা কারে খুন করল দেখছস? তখন পই-পই কইরা কইলাম; মিয়াবাই ঘোড়া ডিঙ্গাইয়া ঘাস খাইবার লারবা গো, ছাড়ান দেও। শুইনে মিয়াবায়ের অইল গোসা! কয় কিনা, শির ছেঁচ্যা দিমু! দেন গো দেন, শির ছেঁচ্যাই দেন মিয়াবাই।’ বসিরের মৃতদেহের সামনে ব্যঙ্গভরে মাথাটা একবার নত করিয়া ভিখু মাথা দুলাইয়া হা-হা করিয়া হাসিতে লাগিল। সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল, ‘ঠ্যারাইন বোবা ক্যান গো? আরে কথা ক হাড়হাবাইতা মাইয়া! তোরে দিমু নাকি সাবার কইরা,—অ্যাঁ?’
পাঁচী কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, ‘ইবারে কী করবি?’
‘দ্যাখ কী করি। পয়সাকরি কনে গুইনা রাখছে, আগে তাই ক।’
বসিরের গোপন সঞ্চয়ের স্থানটি পাঁচী অনেক কষ্টে আবিষ্কার করিয়াছিল। ভিখুর কাছে প্রথমে সে অজ্ঞতার ভান করিল। কিন্তু ভিখু আসিয়া চুলের মুঠি চাপিয়া ধরিলে প্রকাশ করিতে পথ পাইল না।
বসিরের সমস্ত জীবনের সঞ্চয় কম নয়, টাকায় আধুলিতে একশত টাকার ওপর। একটা মানুষকে হত্যা করিয়া ভিখু পূর্বে ইহার চেয়ে বেশি উপার্জন করিয়াছে। তবু সে খুশি হইল। বলিল, ‘কী কী নিবি পুঁটলি বাঁইধা ফ্যালা পাঁচী। তারপর ল’ রাইত থাকতে মেলা করি। খানিক বাদে নওমির চান্দ উঠব, আলোয় পথটুকু পার হমু।’
পাঁচী পুঁটুলি বাঁধিয়া লইল। তারপর ভিখুর হাত ধরিয়া খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে ঘরের বাহির হইয়া রাস্তায় গিয়া উঠিল। পূর্বাকাশের দিকে চাহিয়া ভিখু বলিল, ‘অখনই চান্দ উঠব পাঁচী।’
পাঁচী বলিল, ‘আমরা যামু কনে?’
‘সদর। ঘাটে না’ চুরি করুম। বিয়ানে ছিপতিপুরের সামনে জংলার মদ্যি ঢুইকা থাকুম, রাইতে একদম সদর। পা চালাইয়া চ’ পাঁচী, এক কোশ পথ হাঁটন লাগব।’
পায়ের ঘা লইয়া তাড়াতাড়ি চলিতে পাঁচীর কষ্ট হইতেছিল। ভিখু সহসা একসময় দাঁড়াইয়া পড়িল। বলিল, ‘পায়ে নি তুই ব্যথা পাস পাঁচী?’
‘হ, ব্যথা জানায়।’
‘পিঠে চাপামু?’
‘পারবি ক্যান?’
‘পারুম, আয়।’
ভিখুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া পাঁচী তাহার পিঠের ওপর ঝুলিয়া রহিল। তাহার দেহের ভারে সামনে ঝুঁকিয়া ভিখু জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল। পথে দুদিকে ধানের ক্ষেত আবছা আলোয় নিঃসাড়ে পড়িয়া আছে। দূরে গ্রামের গাছপালার পিছন হইতে নবমীর চাঁদ আকাশে উঠিয়া আসিয়াছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা।
হয়তো ওই চাঁদ আর এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।

ফাঁসি

সন্দেহ নাই যে, ব্যাপারটা বড় শোচনীয়। কে কল্পনা করিতে পারিত, বত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত স্বাভাবিক শান্ত জীবন যাপন করিবার পর গণপতি শেষপর্যন্ত এমন একটা ভয়ানক ব্যাপারে জড়াইয়া পড়িবে। শিক্ষিত সদ্বংশের ছেলে, কথায় ব্যবহারে ভদ্র ও নিরীহ, জীবনে ধরিতে গেলে, এক রকম সব দিক দিয়াই সুখী, সে কিনা একটা লজ্জাকর হত্যাকাণ্ডের আসামি হিসাবে ধরা পড়িল! লোকে একেবারে থ বনিয়া গেল। চরিত্রবান সংযত প্রকৃতির ভদ্রলোকের মুখোশ পরিয়া কীভাবে সকলকে এতদিন খুনিটা ঠকাইয়া আসিয়াছিল। কী সাংঘাতিক মানুষ,-এ্যাঁ? জগতে এমন মানুষও থাকে।

গণপতিকে পুলিশে ধরিবার পর ভীত-ব্ৰিত ও লজ্জায় দুঃখে আধমরা আত্মীয়স্বজনের চেয়ে পরিচিত ও অর্ধপরিচিত অনাত্মীয় মানুষগুলির উত্তেজনাই যেন মনে লাগিল প্রখরতর। বিচারের দিন আদালতে ভিড় যা জমিতে লাগিল বলিবার নয়! টিকিট কিনিয়া রঙ্গমঞ্চে মিথ্যা নাটকের অভিনয় দেখার চেয়ে আদালতে নারীঘটিত খুনি মোকদ্দমার বিচার দেখা যে কত বেশি মুখরোচক, সে শুধু তারাই জানে–রোজ খবরের কাগজে আগের দিনের আইন-আদালতের কার্যকলাপের বিবরণ পড়িয়াও যাদের কৌতূহল মেটে না, বেলা দশটায় খাওয়াদাওয়া সারিয়া উকিল মোক্তারের মতো যারা আদালতে ছুটিয়া যায়।

বাড়িতেই গণপতির তিনজন উকিল। তার বাবা রাজেন্দ্রনাথ এককালে মস্ত উকিল ছিলেন, মাসে একসময় তিনি দশ হাজার টাকাও উপার্জন করিয়াছেন–এখন, সত্তর বৎসর বয়সে আর কোর্টে যান না। বড়ছেলে পশুপতি বছর বার প্র্যাকটিস করিতেছে–বাপের মতো না হোক নামডাক তারও মন্দ নয়। গণপতির ছোটভাই মহীপতিও উকিল, তবে আনকোরা নতুন। বড় উকিলের বড় উকিল বন্ধু থাকে–সমব্যবসায়ী কি না! গণপতির পক্ষ সমর্থনের জন্য অনেকগুলি নামকরা আইনজ্ঞ মানুষ একত্রিত হইলেন, যে তাতেও মামলার গুরুত্ত্ব গুরুতর রকম বাড়িয়া গেল। তবে গণপতিকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো চলিবে কি না সে বিষয়ে ভরসা করিবার সাহস এঁদের রহিল কম। মুশকিল হইল এই যে, মামলাটা একেবারেই জটিল নয়। মামলা যত জটিল হয়, আইনের বড় বড় মাথাওয়ালা লোক মামলাকে জটিলতর করিয়া খুশিমতো মীমাংসার দিকে ঠেলিয়া দিবার সুযোগ পান তত বেশি!

সহজ সরল ঘটনা। বাহির হইতে ঘরে শিকল তোলা ছিল আর স্বয়ং পুলিশ গিয়া খুলিয়াছিল সে শিকল। ভিতরে ছিল মাত্র রক্তমাখা মৃতদেহটা আর ভয়ে আধপাগলা গণপতি। গোটা দুই টিকটিকি আর কয়েকটা মশা ছাড়া ঘরে আর দ্বিতীয় প্রাণী ছিল না। মশা অবশ্য মানুষ মারে, মানুষ যত মানুষ মারে তার চেয়েও ঢের ঢের বেশি, তবু কেন যেন এই খুনের অপরাধটা মশার ঘাড়ে চাপানোর কথাটা গণপতির পক্ষের উকিলেরা একবার ভাবিয়াও দেখিলেন না। তারা শুধু প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন যে, মৃতদেহটা আগেই ঘরের মধ্যে ছিল, পরে গণপতিকে ফাঁকি দিয়া ঘরে ঢুকাইয়া বাহির হইতে শিকল তুলিয়া দেওয়া হয়।

বড় বিপদ, দয়া করে একবার আসবেন?–এই কথা বলিয়া গণপতিকে ফাঁকি দিয়াছিল একটি লোক, যার বয়স ছিল প্রায় চল্লিশ, পরনে ছিল কোচানো ধুতি, সিল্কের পাঞ্জাবি আর পালিশ করা ডার্বি স্যু। গোপদাড়ি কামানো, চোখে পুরু কাঁচের চশমা, বিবর্ণ ফরসা রং-লোকটাকে দেখতে নাকি অনেকটা ছিল কলেজের প্রফেসরের মতো! (কলেজের প্রফেসর হইলেই মানুষের চেহারা কোনো বৈশিষ্ট্য অর্জন করে কি না গণপতিকে এই কথা জিজ্ঞাসা করা হইলে সে জবাব দিতে পারে নাই, বোকার মতো হাঁ করিয়া বিচারকের দিকে চাহিয়া ছিল।) এই লোকটি ছাড়া আরো তিন জন লোককে গণপতি দেখিতে পাইয়াছিল, বাড়ির সরু লম্বা বারান্দাটার শেষে। তিনতলার সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে কারা দাঁড়াইয়াছিল। (অন্ধকারে দাঁড়াইয়া থাকিলে গণপতি তাদের দেখিতে পাইল কেমন করিয়া?–বিচারক এই কথা জিজ্ঞাসা করিলে গণপতি এতক্ষণ বোকার মতো চুপ করিয়া থাকিয়া এমন জবাব দিয়াছিল যে বিচারক সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাইয়াছিলেন।)

গণপতি যে কৈফিয়ত দিল, সেটা যে একেবারে অসম্ভব-তা অবশ্য বলা যায় না, অমন কত মজার ব্যাপার এই মজার জগতে ঘটিয়া থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আট-দশ জন দেশপ্রসিদ্ধ উকিল ব্যারিস্টারের চেষ্টাতেও এটা ভালোমতো প্রমাণ করা গেল না। গণপতির ফাঁসির হুকুম হইয়া গেল।

ফাঁসি! বিচারক হুকুমটা দিলেন ইংরাজিতে, বাঙলায় যার মোটামুটি চুম্বক এই যে, গলায় দড়ির ফাঁস পরাইয়া গণপতিকে যথাবিধি ঝুলাইয়া দেওয়া হইবে, যতক্ষণ সে না মরে। তবে হুকুমটা যদি গণপতির পছন্দ না হয়, সে ইচ্ছা করিলে আপিল করিতে পারে।

.

বুড়ো রাজেন্দ্রনাথের ক্ষীণদৃষ্টি চোখ দুটি কাঁদিতে কাঁদিতে প্রায় অন্ধ হইয়া গেল। গণপতির বোনেরা ও বৌদিরা যে কান্নার রোল তুলিল–সমস্ত পাড়ার আবহাওয়াটা যেন তাতে বিষণ্ণ হইয়া আসিল। গণপতির বৌ রমার এত ঘন ঘন মূৰ্ছা হইতে লাগিল যে, তার যে গাল দুটি লজ্জা না পাইলেও সারাক্ষণ গোলাপের মতো আরক্ত দেখাইত, একেবারে কাগজের মতো ফ্যাকাশে বিবর্ণ হইয়া রহিল। গণপতির বিধবা পিসি ঠাকুরঘরে এত জোরে মাথা খুঁড়িলেন যে, ফাটা কপালের রক্তে চোখের জল তাহার খানিক ধুইয়া গেল।

যথাসময়ে করা হইল আপিল।

অনেক চেষ্টা ও অর্থব্যয়ের দ্বারা গণপতির পক্ষে আরো কয়েকটি সাক্ষী এবং প্রমাণও সংগ্রহ করা হইল। তার ফলে, সন্দেহের সুযোগে গণপতি পাইল মুক্তি। যে লোকটিকে খুন করার জন্য গণপতির ফাঁসির হুকুম হইয়াছিল, তাহাকে কে বা কাহারা খুন করিয়াছে–পুলিশ তাহারই খোঁজ করিতে লাগিল।

বাড়ি ফিরিবার অধিকার জুটিল অপরাহ্নে–আকাশ ভরিয়া তখন মেঘ করিয়াছে। অপরাহ্নে খুব ঘটা করিয়া মেঘ করিলে মনে হয় বৈকি যে, এ আর কিছুই নয়, রাত্রিরই বাড়াবাড়ি। গণপতির কান্না আসিতেছিল। আনন্দে নয়, শ্রান্তিতে নয়, বিগলিত মানসিক ভাবপ্রবণতার জন্য নয়, সম্পূর্ণ অকারণে–একটা চিন্তাহীন স্তব্ধ অন্যমনস্কতায়। বন্ধুবান্ধবের হাত এড়াইয়া সে পশুপতির সঙ্গে ব্যারিস্টার মিস্টার দের মোটরে উঠিয়া বসিল। মোটরের কোণে গা এলাইয়া দিয়া পশুপতি ফোঁস করিয়া ফেলিল একটা নিশ্বাস, তারপর নিজেই মিস্টার দের পকেটে হাত ঢুকাইয়া মোটা একটা সিগার সংগ্রহ করিয়া সাদা ধবধবে দাঁতে কামড়াইয়া ধরিল। মিস্টার দে একগাল হাসিয়া বলিলেন,-যাক।

কী যে তাহার যাওয়ার অনুমতি পাইল বোঝা গেল না। হয়তো গণপতির দুর্ভোগ, নয়তো অসংখ্য মানুষের পাগলামি-ভরা দিনটা–আর নয়তো পশুপতি যে সিগারটা ধরাইয়াছে–তাই। গণপতি পাংশু মুখ তুলিয়া একবার তাহার পরিতৃপ্ত উদার মুখের দিকে চাহিল, তারপর তাড়াতাড়ি মুখ ফিরাইয়া লইল বাহিরের দিকে। একবার এই গাড়িতেই সে মিস্টার দের সঙ্গে বসিয়া ছিল, কোথায় যাওয়ার জন্য আজ সে কথা ঠিক মনে নাই। গাড়ি ছাড়িবার আগে মিস্টার দে হঠাৎ হাত বাড়াইয়া ফুটপাতের একটা ভিখারির দিকে একটা আনি ছুড়িয়া দিয়াছিলেন। দানের পুণ্য আলোর মতো সেদিন যেভাবে মিস্টার দের মুখোনিকে উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছিল আজ জীবনদানের পুণ্য তো তার চেয়ে প্রখর জ্যোতির রূপ লইয়া ফুটিয়া নাই! অবিকল তেমনি মুখভঙ্গি মিস্টার দের–ভিখারিকে একটা আনি দিয়া তিনি যেমন করেন।

মানুষের অনুভূতির জগতের রীতিই হয়তো এইরকম–মুড়িমুড়কির এক দর! জীবন ফিরিয়া পাইয়া তার নিজেরও তেমন উল্লাস হইল কই? জীবনের কত অসংখ্য। ছোট ছোট পাওনা তাকে এর চেয়ে শতগুণে উত্তেজিত করিয়াছে, নিবিড় শান্তি দিয়াছে, আনিয়া দিয়াছে দীর্ঘস্থায়ী মনোরম উপভোগ। সুদীর্ঘ ভবিষ্যৎ ব্যাপিয়া বাঁচিয়া থাকিবার প্রত্যর্পিত অধিকারটা যতভাবে যতদিক দিয়াই, সে কল্পনা করিবার চেষ্টা করুক, জোৎস্নলোকে ছাদে বসিয়া রমার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলিবার কল্পনা তার চেয়ে কত ব্যাপক, কত গাঢ়তর রসে রসালো!

দু-ভাইকে বাড়ির দরজায় নামাইয়া দিয়া মিস্টার দে চলিয়া গেলেন। তখন ঝম ঝম করিয়া বৃষ্টি নামিয়াছে। গাড়িবারান্দার সিঁড়িতে বাড়ির সকলে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল; বৃষ্টি না নামিলে হয়তো প্রতিবেশীরাও অনেকে আসিত। গণপতি নামিয়া প্রথমে রাজেন্দ্রনাথকে প্রণাম করিবে, পিসিমা তাই সে-পর্যন্ত ধৈর্য ধরিয়া রহিলেন। গণপতির প্রণাম শেষ হইতেই তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া হু হু করিয়া উঠিলেন কাঁদিয়া। এ কান্না অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়, সকলেই জানিত পিসিমা এমনিভাবে কাঁদিবেন। তাই খানিকক্ষণ সকলেই চুপচাপ দাঁড়াইয়া থাকিয়া তাহাকে কাঁদিতে দিল। গণপতির কেমন একটা অস্বাভাবিক লজ্জা বোধ হইতেছিল। বাড়ি আসিবার জন্য মিস্টার দের গাড়িতে উঠিয়া কাঁদিবার যে জোরালো ইচ্ছা তাহার হইয়াছিল, হঠাৎ কখন তাহা লোপ পাইয়া গিয়াছে। নিজেকে লুকাইতে পারিলে এখন যেন সে বাঁচিয়া যায়। নিজের বাড়িতে আপনার জনের আবেষ্টনীর মধ্যে ক্রন্দনশীল পিসিমার বক্ষলগ্ন হইয়া থাকিবার সময় জেলখানায় তাহার সেই নিভৃত সেলটির জন্য গণপতির সমস্ত মনটা লোলুপ হইয়া উঠিয়াছে। মনে হইতেছে, আর কিছুক্ষণ এমনিভাবে কাটিলে তার মাথার মধ্যে একটা কিছু ছিঁড়িয়া যাইবে।

আর কেহ কাঁদিতেছে না দেখিয়া পিসিমা একটু পরে আত্মসংবরণ করিলেন। তখন পশুপতির স্ত্রী পরিমল বলিল, কী চেহারাই তোমার হয়েছে ঠাকুরপো!

গণপতি গলা সাফ করিয়া মৃদু একটু হাসিয়া বিনয়ের সঙ্গে বলিল, আর চেহারা…?

যার জীবন যাইতে বসিয়াছিল, চেহারা দিয়া সে কী করিবে-এই কথাটাই গণপতি এমনিভাবে বলিতে চাহিয়াছিল, কিন্তু শোনাইল অন্যরকম, মনে হইল, বৌদির স্নেহপূর্ণ উৎকণ্ঠার জবাবে সে যেন ভারি রূঢ় একটা দ্ৰতা করিয়াছে। গণপতিও হঠাৎ তাহা খেয়াল করিয়া মনে মনে অবাক হইয়া গেল! এমন শোনাইল কেন কথাটা? রোগ হইয়া যার জীবন যাইতে বসে, সে ভালো হইয়া উঠিলে এমনিভাবে যখন কেহ তাহার চেহারা সম্বন্ধে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে, তখন অবিকল এমনিভাবেই তো জবাব দিতে হয়! চেহারা কেন খারাপ হইয়াছে, উভয় পক্ষেরই যখন তাহা জানা থাকে, চেহারা সম্বন্ধে এই তো তখন বলাবলির রীতি। অথচ আজ এই কথোপকথন তার এতগুলি আপনার জনের কানে গিয়া আঘাত করিয়াছে।

কারণটা গণপতি যেন বুঝিতে পারিল, রোগে যে রোগা হয়, চেহারা খারাপ হওয়ার অধিকার তাহার আছে, সেটা তার দোষ নয়। কিন্তু খুনের দায়ে জেলে গিয়া রোগা হইয়া আসিবার অধিকার এ জগতে কারো তো নাই–সে তো পাপের ফল,-অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া। তার দুর্বল দেহ ও পাংশু মুখ যে শুধু এই কথাটাই ঘোষণা করিতেছে,অতি লজ্জাকর একটা খুনের দায়ে সে পুলিশের হাতে ধরা পড়িয়াছিল।

মাথাটা ঘুরিতেছিল, গণপতি একবার বিহ্বলের মতো সকলের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। এতক্ষণে তাহার চোখ পড়িল রমার দিকে। আর সকলে তাহার চারিদিকে ভিড় করিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। রমা কিন্তু কাছে আসে নাই, পাশের লাইব্রেরিঘরে ঢুকিবার দরজাটার আড়ালে সে পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হইয়া আছে,অনেক দূরে… দীর্ঘ ব্যবধানে। চাহিয়া থাকিতে থাকিতে ব্যবধানটা যেন ক্রমেই বাড়িতে লাগিল, তারপর লুপ্ত হইয়া গেল অন্ধকারে।

.

বাড়ি ফিরিয়া পরিমলের সঙ্গে একটা কথা বলিয়াই গণপতি যে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল–এতে কারো অবাক হওয়ার কারণ ছিল না। আহা! প্রায় ছমাস ধরিয়া বেচারা কি কম সহ্য করিয়াছে! কারাগারের পাষাণ প্রাচীরের অন্তরালে নিজের জীবন লইয়া ভাগ্যের লটারি খেলার অনিশ্চিত ফলাফলের প্রতীক্ষায় একাকী দিন কাটানো তো শুধু নয়,-বাহিরের অদৃশ্য জগতের কাছে ঘাড়-মোচড়ানো অফুরন্ত কাল্পনিক লজ্জা ভোগ করাও তো শুধু নয়, গণপতি যে অনেকগুলি দিন ধরিয়া ফাঁসির দিনও গুণিয়াছে। ফাঁসি! ভাবিতে গেলেও নিরাপদ সহজ মানুষের দম আটকাইয়া আসে না? মূৰ্ছিত হইয়া পড়িবে বৈকি গণপতি! অনেক আগেই তার দুবার মূৰ্ছা যাওয়া উচিত ছিল। একবার যখন সে নিজের ফাঁসির হুকুম শোনে-আর যখন সে জানিতে পারে, এ জীবনের মতো ফাঁসিটা তাহার বাতিল হইয়া গিয়াছে। আশ্চর্যরকম শক্ত মানুষ বলিয়াই না মূৰ্ছাটা সে এতক্ষণ ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল।

সহ্যশক্তি রমারও কম নয়। আজ কতকাল সে খুনি-আসামির বৌ হইয়া বাঁচিয়া আছে–অপাপবিদ্ধ পবিত্র মানুষের ঘরকন্নার মধ্যে পাড়ার একপাল ভদ্রমহিলার কৌতুক ও কৌতূহল-মেশানো সহানুভূতির আকণ্ঠ আবর্তে। কতদিন ধরিয়া সে অহোরাত্রি যাপন করিয়াছে–স্বামীর আগামী ফাঁসির তারিখের বৈধব্যকে ক্রমাগত বরণ করিয়া করিয়া! আপিল যদি না করা হইত–আজ রাত্রি প্রভাত হইলে কারো সাধ্য ছিল না রমাকে বৌ করিয়া রাখে। তবু এখনো লাইব্রেরিঘরে ঢুকিবার দরজার আড়ালে পাষাণপ্রতিমার মতো তাহার দাঁড়াইয়া থাকিবার ভঙ্গি দেখিলে অবাক হইয়া যাইতে হয়। না আছে চোখে ভয়, না আছে দেহে শিহরণ। পাষাণপ্রতিমার মতোই। তার কাঠিন্য যেন অকৃত্রিম। গণপতি যে মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল, তাতেও যেন তার। কিছু আসিয়া গেল না। এক পা আগানো দূরে থাক, এক পা পিছাইয়া লাইব্রেরিঘরের ভিতরে আত্মগোপন করাটাই সে যেন ভালো মনে করিল। স্বামীর,-সত্যবানের মতোই যে স্বামী তাহার–মৃত্যুর কবল হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে, সেই স্বামীর মূৰ্ছা ভাঙিবার কী আয়োজন হইল, একবার তাহা চাহিয়া দেখিবার শখটাও অন্ততপক্ষে রমার গেল কোথায়? এ কৌতূহল যে-মেয়েমানুষ দমন করিতে পারে-ধরিত্রীর মতো তার সহ্যশক্তিও সত্যই অতুলনীয়-মৃত ও অসাড়!

মাথায় জল দিতে দিতে অল্পক্ষণ পরেই গণপতির জ্ঞান ফিরিয়া আসিল। জামাকাপড় বদলাইয়া এক বাটি গরম দুধ খাইয়া সে সকলের সঙ্গে ভিতরের বড় ঘরে গিয়া বসিল। পশুপতি একবার প্রস্তাব করিয়াছিল যে, গণপতি নিজের ঘরে গিয়া। বিছানায় শুইয়া বিশ্রাম করুক। গণপতি নিজেই তাহাতে রাজি হইল না। মূৰ্ছা ভাঙিবার পর নিজেকে লুকানোর ইচ্ছাটা কী কারণে যেন তাহার কমিয়া গিয়াছে। অনেক জল ঢালবার ফলে মাথাটা বোধ হয় তাহার ঠাণ্ডা হইয়া আসিয়াছিল, সকলের সঙ্গে কথা বলিবার জন্য এতক্ষণে সে একটু একটু আগ্রহই বরং বোধ করিতে লাগিল।

অল্পে অল্পে একথা-সেকথা হইতে কথাবার্তা অনেকটা সহজ হইয়া আসিল। ছ-মাসের মধ্যে আত্মীয়স্বজন অনেকের সঙ্গেই বহুবার গণপতির দেখা হইয়াছে, তবু সে এমনভাবে কথা বলিতে লাগিল, যেন ওই সময়কার পারিবারিক ইতিহাসটা ঘুর্ণাক্ষরে জানিবার উপায়ও তাহার ছিল না। তিন মাস আগে জেলে বসিয়া পশুপতির কাছে বাড়ির যে ঘটনার কথা শুনিয়া সে আশ্চর্য হইয়াছিল, আজ পিসিমার মুখে সেই ঘটনার কথা শুনিয়া সে নবজাগ্রত বিস্ময় বোধ করিল, এমনকি–যে ব্যাপার এখানে সে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়া জেলে গিয়াছিল–পরিমল তার বর্ণনা দিতে আরম্ভ করিলে, আজই যেন প্রথম শুনিতেছে এমনিভাবে শুনিয়া গেল। স্মৃতি, চিন্তা, অনুভূতি, কল্পনা প্রভৃতি গণপতির ভিতরে কমবেশি জড়াইয়া গিয়াছে সত্য, তবু জানা কথা ভুলিবার মতো অন্যমনস্কতা তো ফাঁসির আসামিরও আসিবার কথা নয়! কিন্তু এই অভিনয়ই গণপতির ভালো লাগিতেছিল। এমনই উৎসুকভাবে একথা-সেকথা জানিতে চাহিলে এবং তার জবাবে যে যাই বলুক গভীর মনোযোগর সঙ্গে তাই শুনিয়া গেলে, ক্রমে ক্রমে তার নিজের ও অন্যান্য সকলেরই যেন বিশ্বাস জন্মিয়া যাইবে দীর্ঘকালের জন্য সে দূরদেশে বেড়াইতে গিয়াছিল। এতদিন তার গৃহে অনুপস্থিত থাকিবার আসল কারণটা সকলে ভুলিয়া যাইবে।

হয়তো তাই যাইতে লাগিল এবং সেইজন্য হয়তো যখন আবার ওই আসল কারণটা মনে পড়িবার অনিবার্য কারণ ঘটিতে লাগিল, সকলেই যেন তখন হঠাৎ একটু একটু চমকাইয়া উঠিতে লাগিল। গণপতিকে পুলিশে ধরিবার অল্প কিছুদিন আগে মহাসমারোহে তার ছোটবোন রেণুর বিবাহ হইয়াছিল। গণপতি একসময় রেণুর সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে সকলের এমনি সচকিতভাব দেখা গেল। এ ওর মুখের দিকে চাহিল–কিন্তু বয়স্ক কেহ জবাব দিল না। শুধু পশুপতির সাতবছরের মেয়ে মায়া বলিল, পিসিমাকে শ্বশুরবাড়িতে রোজ মারে, কাকা।

গণপতি অবাক হইয়া বলিল, মারে?

মায়া বলিল, তুমি মানুষ মেরেছ কিনা তাই জন্যে।

তিন-চার জন একসঙ্গে ধমক দিতে মায়া সভয়ে চুপ করিয়া গেল। মনে হইল, ধমকটা যেন গণপতিকেই দেওয়া হইয়াছে। কারণ, মায়ার চেয়েও তার মুখখানা শুকাইয়া গেল বেশি। আবার কিছুক্ষণ এখন তাহার কারো মুখের দিকে চোখ তুলিয়া, চাহিবার ক্ষমতা হইবে না।

পশুপতি গলা সাফ করিল। বলিল, ঠিক যে মারে তা নয়, তবে ওরা ব্যবহারটা ভালো করছে না।

বড় বোন বেণু বলিল, বিয়ের পর সেই যে নিয়ে গেল মেয়েটাকে এ পর্যন্ত আর একবারও পাঠায়নি। মহী দু-বার আনতে গেল।

মহীপতি বলিল, আমার সঙ্গে একবার দেখা করতেও দেয় নি। বললে—

রাজেন্দ্রনাথ কাঁপা গলায় বলিলেন, আহা, থাক না ওসব কথা, বাড়িতে ঢুকতে-না-ঢুকতে ওকে ওসব শোনাবার দরকার কী! ও তো আর পালিয়ে যাবে না।

খানিকক্ষণ সকলে চুপ করিয়া রহিল। বাহিরে বাদল মাঝখানে একটু কমিয়াছিল, এখন আবার আরো জোরের সঙ্গে বর্ষণ শুরু হইয়াছে। ঘরের মধ্যে এখন ভিজা বাতাসের গাঢ়তম স্পর্শ মেলে। রমা এবারও ঘরে আসে নাই, এবারও সে নিজেকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে–পাশের ঘরের দরজার ওদিকে। তবে এবার আর সে দাঁড়াইয়া নাই, মেঝেতে বসিয়াছে। একতলার রান্নাঘর হইতে ডালসম্ভারের গন্ধ ভিজা বাতাসকে আশ্রয় করিয়া আসিয়া এ ঘরে জমা হইয়াছে, বেণুর বড় মেয়ে শৌখিন সুহাসের অঙ্গ হইতে এসেন্সের যে গন্ধ এতক্ষণ পাওয়া যাইতেছিল তাও গিয়াছে ঢাকিয়া। পিসিমা কয়েক মিনিটের জন্য ঠাকুরঘরে গিয়াছিলেন, প্রসাদ ও প্রসাদি ফুলের রেকাবি হাতে তিনি এই সময় ফিরিয়া আসিলেন। সকলের আগে গণপতিকে বলিলেন, জুতো থেকে পা-টা খোল তো বাবা।

জুতার স্পর্শ ত্যাগ করিয়া গণপতি পবিত্র হইলে, পিসিমা প্রসাদি ফুল লইয়া তাহার কপালে ঠেকাইলেন, তারপর হাতে দিলেন প্রসাদ এবং আজও আধা-মমতা আধা-ধমকের সুরে তাহার চিরন্তন অনুযোগটা শুনাইয়া দিলেন–ঠাকুরদেবতা কিছু তো মানবি নে, শুধু অনাচার করে বেড়াবি।

এ ঘরে কেহ কিছু বলিল না; কিন্তু পাশের ঘরের দরজার ওদিক হইতে অস্ফুট কণ্ঠে শোনা গেল, মাগো।

পিসিমা চমকাইয়া বলিলেন, কে গো ওখানে বৌমা?

পরিমল জিজ্ঞাসা করিল, কী হল রে রমা?

রমার আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। পরিমলের কোলের ছেলেটি মেঝেতে হামা দিতে দিতে নাগালের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল, গণপতি হাত বাড়াইয়া তাকে কোলে তুলিয়া লইল–ওকে আদর করিবার ছলে মাথা হেঁট করিয়া থাকা সহজ। রাজেন্দ্রনাথ কাঁপা গলায় বলিলেন, দ্যাখ তো সুহাস, মেজ-বৌমার কী হল? ফিট-টিট হল নাকি?

পরিমল বলিল, তুই বোস, আমি দেখছি।

উঠিয়া গিয়া নিচুগলায় রমাকে কী যেন জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া সে ফিরিয়া আসিল; বলিল, না, কিছু হয় নি।

কিছু না। একেবারেই কিছু হয় নাই। কী হইবে ওই পাথরের মতো শক্ত মেয়েমানুষটার? এই যে এতকাল গণপতি জেলখানায় আটক ছিল, ফাঁসি এড়ানোর ভরসা কয়েকদিন আগেও তাহার ছিল না,রমা কি একদিন আবেগে ভাঙিয়া পড়িয়াছিল, কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁদিতে কাঁদিতে ননদ, জা কারো বুকে একবার আশ্রয় খুঁজিয়াছিল, কারোকে টের পাইতে দিয়াছিল–তার কিছুমাত্র সান্ত্বনার প্রয়োজন আছে? এ কথা সত্য যে, যেদিন হইতে গণপতিকে পুলিশে ধরিয়াছিল, সেদিন হইতে সে হাসিতে ভুলিয়া গিয়াছে, দিনের পর দিন কথা কমাইয়া কমাইয়া প্রায় বোবা হইয়া গিয়াছে, রোগা হইতে হইতে সোনার বরন তাহার হইয়া গিয়াছে কালি। তা, সেটা আর এমন কী বেশি! দুঃখের ভাগ তো সে দেয় নাই, সান্ত্বনা তো নেয় নাই, লুটাইয়া বুকফাটা কান্না তো কাঁদে নাই।

একদিন বুঝি কাঁদিয়াছিল। শুধু একদিন!

গভীর রাত্রে বাড়ির সকলে তখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছে–সুহাস ছাড়া। সেদিন সুহাসের বর আসিয়াছিল, তাই বর-বৌ দুজনেরই হইয়াছিল অনিদ্রা-রোগ। অত রাত্রে ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া দুজনে হাত ধরাধরি করিয়া রমার ঘরের সামনে দিয়া তাদের কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন হইয়াছিল–সে কথা বলা মিছে। নিজের ঘরে রমা একা থাকিত, এখনো তাই থাকে। অনেক বলিয়া অনেক বকিয়াও তাকে কারো সঙ্গে শুইতে রাজি করা যায় নাই। এমনকি শ্বশুরের অনুরোধেও না।

যাই হোক, রমার ঘরের সামনে সুহাস থমকিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। কান পাতিয়া ঘরের মধ্যে বিশ্রী একটা গোঙানির আওয়াজ শুনিয়া ভয়ে বেচারির স্বামী সোহাগে তাতানো দেহটা হইয়া গিয়াছিল হিম। বরকে ঘরে পাঠাইয়া, তারপর সে ডাকিয়া তুলিয়াছিল পরিমলকে; বলিয়াছিল, বড়মামি, ঘরের মধ্যে মেজমামি গোঙাচ্ছে, শিগগির এসো।

গোঙাচ্ছে? ডাক ডাক তোর মামাকে ডেকে তোল, সুহাস!–কী হবে মা গো!

পশুপতিকে পিছনে করিয়া পা টিপিয়া টিপিয়া গিয়া পরিমল খানিকক্ষণ রুদ্ধ দরজায় কান পাতিয়া রমার গোঙানি শুনিয়াছিল। তারপর জোরে জোরে দরজা ঠেলিয়া ডাকিয়াছিল, মেজ-বৌ! ও মেজবৌ, শিগগির দরজা খোল।

প্রথম ডাকেই গোঙানি থামিয়া গিয়াছিল, কিন্তু তারপর অনেক ডাকাডাকিতেও রমা প্রথমে সাড়া দেয় নাই। শেষে ধরা গলায় বলিয়াছিল, কে?

আমি। দরজা খোল তো মেজ-বৌ, শিগগির।

কেন দিদি?

পরিমল অবশ্য সে কৈফিয়ত দেয় নাই, আরো জোরে ধমক দিয়া আবার দরজাই খুলিতে বলিয়াছিল। রমারও আর দরজা না খুলিয়া উপায় থাকে নাই।

কী হয়েছে দিদি?

তুই গোঙাচ্ছিলি কেন রে, মেজ-বৌ? রমা বিস্ময়ের ভান করিয়া বলিয়াছিল, গোঙাচ্ছিলাম? কে বললে?

বারান্দার আলোয় রমার মুখে চোখের জলের দাগগুলি স্পষ্টই দেখা যাইতেছিল। একটু থামিয়া ঢোক গিলিয়া পরিমল বলিয়াছিল–আমি নিজে শুনেছি, তুই তবে কাঁদছিলি?

না, কাঁদি নি তো! কে বললে কাঁদছিলাম?-বলিয়া পশুপতির দিকে নজর পড়ায় রমা লম্বা ঘোমটা টানিয়া দিয়াছিল।

তখন পরিমল বলিয়াছিল, আমি আজ তোর ঘরে শোব রমা?

রমা বলিয়াছিল, কেন?

কী কৈফিয়তই যে মেয়েটা দাবি করিতে জানে! অফুরন্ত!

পরিমল ইতস্তত করিয়া বলিয়াছিল, ভয়টয় যদি পাস—

রমা বলিয়াছিল, ভয় পাব কেন? আমার অত ভয় নেই… বড্ড ঘুম পাচ্ছে দিদি।

বলিয়া সকলের মুখের উপর দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। কী রূঢ় ব্যবহার! মনে। করলে আজও পরিমলের গা জ্বালা করে।

যাই হোক, তার পর হইতে রাত্রে বাহিরে গেলে বাড়ির অনেকেই চুপিচুপি রমার ঘরের দরজায় কান পাতিয়া ভিতরের শব্দ শুনিবার চেষ্টা করিয়াছে। কিন্তু আর কোনোদিন কিছু শোনা যায় নাই।

শোনা যাইবে কী, রমা কি সহজ মেয়ে! হোক না স্বামীর ফাঁসি, সে দিব্যি মস্ত একটা ঘরে সারারাত একা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতে পারে। আজ হঠাৎ অস্ফুট স্বরে একবার মাগো বলিয়া ফেলিয়াছে বলিয়াই ওর যে কিছু হইয়াছে–এ কথা মনে। করিবার কোনো প্রয়োজন নাই।

মিস্টার দের কড়া সিগার টানিয়া পশুপতির বোধ হয় গলাটা খুসখুস করিতেছিল, সে আর একবার গলা সাফ করিয়া বলিল, রেণুর জন্য তুমি ভেবো না গনু। ওকে আসতে দেয় নি বটে, কিন্তু ওকে কষ্ট ওরা দেয় না।

বিবাহের পর প্রথম শ্বশুরবাড়ি গিয়া আর আসিতে না দিলে, মোল বছরের মেয়েকে কষ্ট দেওয়া হয় কি না, গণপতি ধারণা করিয়া উঠিতে পারিল না; কিন্তু বোনটার জন্য তার নিজের বড় কষ্ট হইতে লাগিল। মৃদুস্বরে সে বলিল, ওকে একটা তার করে দিলে হত না?

পশুপতি বলিল, তোমার কথা? থাকগে, কাজ নেই, কী আর হবে ওতে? মাঝখান থেকে বাড়ির লোকে হয়তো অসন্তুষ্ট হবে। কাল খবরের কাগজেই সব। পড়তে পারবে।

খবরের কাগজ? তা ঠিক, খবরের কাগজে কাল সব খবরই বাহির হইবে বটে। কিন্তু রেণু কি খবরের কাগজ পড়িতে পায়? ভাই খুনের দায়ে ধরা পড়িয়াছে বলিয়া অতটুকু মেয়েকে যারা আটক করিয়া রাখিতে পারে–এতখানি উদার কি তাদের হওয়া সম্ভব? গণপতি পরিমলের ছেলেকে মেঝেতে নামাইয়া দিয়া বলিল, তবু আপিলের ফলটা আগে থাকতে জানতে পারলে–

রাজেন্দ্র বলিলেন, তাই বরং দাও পশু, রেণুর শ্বশুরকে একটা তার করে দাও। লিখে দিও প্লিজ ইনফর্ম রেণু–নয়তো সে ব্যাটা হয়তো মেয়েটাকে কিছু জানাবে না।

তার লিখিতে পশুপতি আপিসঘরে গেল।

.

মানুষের মধ্যে খোঁজ করিলে সব সময়ে মানুষকে খুঁজিয়া পাওয়া যায়, পাশবিকতা দিয়া হোক, দেবত্ব দিয়া হোক, কে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢাকিয়া রাখিতে পারে? বত্রিশ বছর যে পরিবারে গণপতি সহজ স্বাভাবিক জীবন যাপন করিয়াছে, আজ সেখানে একটা বীভৎস অসাধারণত্ব অর্জন করিয়া ফিরিয়া আসিয়া সে যে বিশেষভাবে অনুসন্ধিৎসু হইয়া উঠিবে এবং এতগুলি মানুষের মধ্যে ক্রমাগত মানুষকে খুঁজিয়া পাইতে থাকিবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নাই। পলকে পলকে সে টের পাইতে লাগিল, এরা ভুলিতে পারিতেছে না। বিচার নয় বিশ্লেষণ নয়, বিরাগ অথবা ক্ষুধাও নয়, শুধু স্মরণ করিয়া রাখা–স্মরণ করিয়া রাখা যে, তাদের এই গণপতির অকথ্য কলঙ্ক রটিয়াছে, দেশের ও দশের কাছে সে পরিবারের মাথা হেঁট করিয়া দিয়াছে। আইনের আদালতে ভালোরকম প্রমাণ না হোক, মানুষের আদালতে তার পাশবিকতা প্রমাণিত হইয়া গিয়াছে। ফাঁসির হুকুম রদ হোক, এ ব্যাপারে এইখানে শেষ নয়, এখনো অনেক বাকি, অনেক মন ও মানের লড়াই। প্রত্যেকের ভিতরের মানুষটি এই অনিবার্য ক্ষতি ও বিপদের চিন্তায় ভীত ও বিমর্ষ হইয়া আছে, এই যে মানুষ, ভিতরের মানুষ, এ বড় দুর্বল, বড় স্বার্থপরতাই এ কথাটাও কে না ভাবিয়া থাকিতে পারিয়াছে যে, এর চেয়ে ফাঁসি হইয়া গেলেই অনেক সহজে সব চুকিয়া যাইতে পারিত। যে নাই, কতকাল কে তার কলঙ্ককাহিনী মনে করিয়া রাখে? মনে করিয়া রাখিলেই বা কী? গণপতি না থাকিলে, এ বাড়িতে কেন তার কলঙ্কের ছায়াপাত হইবে? সেটা নিয়ম নয়। লোকে শুধু এই পর্যন্ত ভাবিতে পারিত যে, এ বাড়িতে একটা বদলোক থাকিত, যে একটা স্ত্রীলোকঘটিত অপরাধে জড়িত হইয়া একটা মানুষ খুন করিয়া ফেলিয়াছিল–কিন্তু সে লোকটা এখন আর নাই, এই বাড়ির আবহাওয়া এখন আবার পবিত্র, এ বাড়ির মানুষগুলি ভালো।

আর তা হইবার নয়! দুষ্ট মানুষ ঘরে আসিয়াছে, তার দোষে ঘরের আবহাওয়া দূষিত হইয়াছে, দূষিত আবহাওয়া মানবগুলিকে করিয়াছে মন্দ! অন্তত লোকে তো তা-ই ভাবিবে।

এত স্পষ্টভাবে না হোক, মোটামুটি এই চিন্তাগুলিই গণপতির অনুসন্ধান তার মনে আনিয়া দিতে লাগিল। ভাবিতে ভাবিতে সহসা রমার জন্য তার মনে দেখা দিল গভীর মমতা! জেলে বসিয়া রমার কথা ভাবিয়া তার খুব কষ্ট হইত, কিন্তু সে ছিল। শুধু তার দুর্ভাগ্যের কথা ভাবিয়া-রমা যে যাতনা ভোগ করিতেছে, তাই ভাবার কষ্ট। কিন্তু এখন হঠাৎ সে বুঝিতে পারিল, স্বামীর জন্য শুধু ভাবিয়াই রমা রেহাই পায় নাই, নিজের অন্ধকার ভবিষ্যতটার পীড়ন সহিয়াই তার মহাশক্তির পরীক্ষা শেষ হয় নাই, আরো অনেক কিছু জুটিয়াছে। বাহিরের জগৎ নরঘাতকের স্ত্রীকে যা দেয় সে সব যে কী এবং সে সব সহ্য করিতে একটি নিরুপায় ভীরু বধূর যে কতখানি কষ্ট হইতে পারে–ধারণা করিবার মতো কল্পনাশক্তি গণপতির ছিল না। যেটুকু সে অনুমান করিতে পারিল তাতেই বুকের ভিতরটা তাহার তোলপাড় করিতে লাগিল।

নিজেকে সে বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল যে, যাক, রমার একটা প্রকাণ্ড দুর্ভাবনা তো দূর হইয়াছে! স্বামীকে ফিরিয়া পাইয়া আজ তো মনে তার আনন্দের বান ডাকিয়াছে। এতদিন সে যদি অকথ্য দুঃখ পাইয়াই থাকে আজ আর সেকথা ভাবিয়া লাভ কী? প্রতিকারের উপায়ও তাহার হাতে ছিল না যে, রমার দুঃখ কমানোর চেষ্টা করার জন্য আজ আফসোস করিলে চলিবে। জেলে বসিয়া রমার দুঃখটা সে ঠিকমতো পরিমাপ করিতে পারে নাই; অন্যায় যদি কিছু হইয়া থাকে তা শুধু এই। তা এ অন্যায়ের জন্য রমার আর কী আসিয়া গিয়াছে। সে বুঝিলেই তো রমার দুঃখ কমিত না।

রাত্রি দুটার সময় বৃষ্টি বন্ধ হইলে, পাড়ার দু-একজন ভদ্রলোক এবং পাড়ার বাহিরের দু-চার জন বন্ধুবান্ধব দেখা করিতে আসিলেন। পশুপতির ইচ্ছা ছিল, গণপতি আজ কারো সঙ্গে দেখা না করে-সে-ই সকলকে বলিয়া দেয় যে, গণপতির শরীর খুব খারাপ, সে শুইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু গণপতি এ কথা কানে তুলিল না, নিচে গিয়া সকলের সঙ্গে দেখা ও বসিয়া আলাপ করিল। রমার কথা নূতনভাবে ভাবিতে আরম্ভ করিবার পর গণপতি নিজের মধ্যে একটা নূতন তেজের আবির্ভাব অনুভব করিতেছিল। সে বুঝিতে পারিয়াছিল, যা-ই ঘটিয়া থাক, ভীরু ও দুর্বলের মতো হাল ছাড়িয়া দিলে চলিবে না; নিজের জোরে আবার তাহাকে নিজের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। ভূমিকম্পে বাড়ি অল্পবিস্তর জখম হইয়াছে বলিয়া মাঠে বাস করিলে তো তাহার চলিবে না? বাড়িটা আবার মেরামত করিয়া লইতে হইবে। লজ্জায় সে যদি এখন মুখ লুকায়, তার লজ্জার কারণটা যে লোকে আরো বেশি সত্য বলিয়া মনে করিতে আরম্ভ করিবে, আরো বড় বলিয়া ভাবিতে থাকিবে।

যাঁরা আসিয়াছিলেন, গণপতির মুক্তিতে আনন্দ জানানোর ছলে কৌতূহল মিটাইতেই তাদের আগমন। গণপতির সঙ্গে কথা বলিয়া সকলে একটু অবাক হইয়াই বাড়ি গেলেন। মানুষটা ভাঙিয়া-চুরিয়া গিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু খুব যে নীচে নামিয়াছে–কারো তা মনে হইল না। সে নিজেই একরকম চেষ্টা করিয়া প্রথম আলাপের আড়ষ্টতা কাটাইয়া আনিল। বেশি বকিল না, বেশি গম্ভীর হইয়া থাকিল না, গোঁয়ারের মতো ফাঁসির হুকুম পাওয়ার ব্যাপারটাকে অবহেলা করিয়া একেবারে উড়াইয়াও দিল না, আবার এমন ভাবও দেখাইল না যে, ফাঁসির হাত এড়ানোর আনন্দে বিগলিত হইয়া পড়িয়াছে। ভগবান তো আছেন, বিনা দোষে একজনকে তিনি কি শাস্তি দিতে পারেন? এমন আশ্চর্য সরলতার সঙ্গে এমনভাবে গণপতি একবার এই কথাগুলি বলিল যে, শ্রোতাদের মনে তার প্রতি সত্য সত্যই একটু শ্ৰদ্ধার ভাব দেখা দিল, মনে হইল–আসিবার সময় লোকটার সম্বন্ধে যে ধারণা তাঁদের ছিল, লোকটা হয়তো সত্যই অতটা খারাপ নয়।

আগন্তুকদের মধ্যে এই পরিবর্তনটুকু টের পাইতে গণপতির বাকি রহিল না। জয়ের গর্বে ও আশার আনন্দে তার বুক ভরিয়া গেল। এবার তাহার বিশ্বাস হইতে লাগিল যে, সে পারিবে, তার ভাঙা মানসম্রমকে আবার সে নিটোল করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিবে। তার নামে চারিদিকে যে ঢিঢ়ি শব্দ পড়িয়া গিয়াছে–ক্রমে ক্রমে একদিন সে শব্দ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া আসিয়া একেবারে মিলাইয়া যাইবে। তার সম্বন্ধে ঘৃণা ও অশ্রদ্ধার ভাব মরিয়া গিয়া মানুষের মনে আবার জাগিয়া উঠিবে প্রীতি ও শ্রদ্ধা–মানুষের মাঝখানে মানুষের মতো বাঁচিয়া থাকিতে আর তার কোনো অসুবিধা থাকিবে না।

রাত্রি বাড়িয়া যাইতেছিল, বাহিরের সকলে চলিয়া গেল, গণপতি আর বেশি দেরি না করিয়া সামান্য কিছু খাইয়া নিজের ঘরে শুইতে গেল। নবজীবনের সূচনা করিতে বাহিরের কয়েকটি লোকের কাছে খানিক আগে সে যে সাফল্য লাভ করিয়াছিল, তখনো তার মন হইতে তার মাদকতাভরা মোহ কাটিয়া যায় নাই এবং খানিক পরে সেই জন্যই রমার সঙ্গে তার বাধিল বিবাদ।

বিবাদ? এমন প্রত্যাবর্তনের পর রমার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার রাত্রে–বিবাদ? হয়তো ঠিক তা নয়; কিন্তু রমা ঘরে আসিবার ঘণ্টাখানেক পরে দুজনের মধ্যে যেসব কথার আদান-প্রদান হইল, সেগুলি বিবাদের মতোই একটা কিছু হইবে।

আবেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবার সাহস দুজনের কাহারো ছিল না। ঘরে ঢুকিয়া রমা তাই যেমন ধীরপদে তার কাছে আসিল, সে-ও তেমনি ধীরভাবেই তাহাকে বুকের মধ্যে গ্রহণ করিল। রমার ওজন অর্ধেক হালকা হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু গণপতি সেটা ভালোরকম টের পাইল না। তার গায়ের জোরও যে অর্ধেক কমিয়া গিয়াছে!

রমার দুচোখ দিয়া আস্তে আস্তে জলের ফোঁটা নামিতেছিল। খানিকক্ষণ পরে সে বলিল, তোমায় ফিরে পাব ভাবিনি।

গণপতি তার মাথাটা কাঁধের পাশে চাপিয়া ধরিয়া বলিল, আমিও ভাবিনি আবার এ ঘরে তোমার কাছে ফিরে আসতে পাব।

শুধু রমার কাছে নয়, এ ঘরে রমার কাছে ফিরিয়া আসিবার সাধ! রমাকে দেখিবার ফাঁকে ফাঁকে এখনো গণপতি ঘরখানাকেও দেখিতেছিল। প্রায় কিছুই বদলায় নাই ঘরের। বাগানের দিকে দুটি জানালার কাছে, যেখানে যেভাবে খাট পাতা ছিল আজও সেইখানে তেমনিভাবে পাতা আছে। ও-কোণে দেওয়ালে বসানো আলোটার ঠিক নিচে রমার প্রসাধনের টেবিল, ছমাস কি সে প্রসাধন করিয়াছিল? এখানে খাটে বসিয়া আজও আয়নাটাতে তাদের প্রতিবিম্ব দেখা যাইতেছে : রমা আগে মাঝে মাঝে কৌতুক করিয়া জিজ্ঞাসা করিত, ওরা কে গো? আমাদের দেখছে না তো? দেওয়ালে তাদের বিবাহের বেশে তোলা ফটো এবং এ বাড়ির ও রমার বাড়ির কয়েকজনের ফটো টাঙানো আছে। কেবল পুরনো যে তিনটি দামি ক্যালেন্ডার ছিল তার একটির বদলে আসিয়াছে দুটি সাধারণ ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডার। তার অনুপস্থিতির সময়ের মধ্যে একটা বছর কাবার হইয়া গিয়া নতুন একটা বছর যে আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। আরো একটা পরিবর্তন হইয়াছে ঘরের। ঘরের ঔজ্জ্বল্য কমিয়া গিয়াছে। মেঝেটা সেরকম ঝকঝকে নয়, ফটো আর ছবিগুলোতে অল্প অল্প ধুলা আর ঝুল পড়িয়াছে, চারিদিকে আরো যেন আসিয়া জুটিয়াছে কত অদৃশ্য মলিনতা।

কী দেখছ?-রমা একসময় জিজ্ঞাসা করিল। প্রায় এক ঘণ্টা পরে।

গণপতি বলিল, ঘর দেখছি।

রমা বলিল, ঘর দেখে আর কী হবে? এ ঘরে তো আমরা থাকব না।

থাকব না? কোন ঘরে যাব তবে?

আমরা চলে যাব।

রমা বিছানায় নামিয়া একটু সরিয়া ভালো করিয়া বসিল! বিবাদ শুরু হইয়া গিয়াছে। গণপতি একটু বিস্মিত হইয়া বলিল, কোথা চলে যাব রমা?…

অনেক বিনিদ্র রাত্রি ব্যাপিয়া রমা এ প্রশ্নের জবাব ভাবিয়া রাখিয়াছে, সে সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, যেদিকে দুচোখ যায় অনেক দূর অচেনা দেশে, কেউ যেখানে আমাদের চেনে না, নামধাম জানে না–সেখানে গিয়ে আমরা বাসা বাঁধব। আজ রাত্রেই সব বেঁধে-হেঁদে রাখি, কাল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব, কেমন? আর একটা দিনও আমি এখানে থাকতে পারব না।

গণপতি বোকার মতো জিজ্ঞাসা করিল, কেন?…

রমা স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, বুঝতে পারছ না? সবাই আমাদের ঘেন্না করবে, আমরা এখানে থাকব কী করে?

এমনিভাবে শুরু হইল তাহাদের কথা-কাটাকাটি। গণপতি বলিল যে, এমন পাগলের মতো কি কথা বলিতে আছে, বাড়ি-ঘর আত্মীয়স্বজন অর্থোপার্জন সব ফেলিয়া গেলেই কি চলে? কী-ই বা দরকার যাওয়ার? দু-চার দিন লোকে হয়তো একটু কেমন কেমন ব্যবহার করিতে পারে, তারপর সব ঠিক হইয়া যাইবে। এত ভাবিতেছে কেন রমা? বিবাদ করার মতো করিয়া নয়, আদর করিয়া–খুব মিষ্টি ভাষাতেই গণপতি তাহাকে কথাগুলি বুঝাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল। বাহিরের ঘরে, বাহিরের কয়েকটি লোকের মন হইতে অন্ধকার ভাব সে যে মোটে আধঘণ্টার চেষ্টাতে প্রায় দূর করিয়া দিয়াছিল, এ কথা গণপতি কিছুতেই ভুলিতে পারিতেছিল না। দেশ ছাড়িয়া চিরদিনের জন্য বহুদূরদেশে–অজানা লোকের মাঝে আত্মগোপন করিয়া থাকিবার ইচ্ছাটা রমার, তাই তার মনে হইতেছিল ছেলেমানুষি।

রমা শেষে হতাশ হইয়া বলিল, যাবে না?

গণপতি তাহাকে বুকে টানিয়া আনিল, সস্নেহে তাহার পাংশু কপোলে চুম্বন করিয়া বলিল, যাব না বলেছি, পাগলী? চলো না দু-জনে দু-চার মাসের জন্য কোথা থেকে বেড়িয়ে আসি।

রমা অসহিষ্ণুভাবে মাথা নাড়িয়া বলিল, দু-চার মাসের জন্য আমি কোথাও যাব না। চিরদিনের জন্য।

আচ্ছা, কাল এসব কথা হবে রমা।

না, আজকে বলো যাবে কিনা, এখুনি বলো। কাল ভোরে উঠে আমরা চলে যাব।

গণপতি এবার হাসিয়া ফেলিল। বলিল, আচ্ছা, তোমার কী হয়েছে বলো তো? এমন করে কেউ কখনো যায়?

রমা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, আচ্ছা, তবে থাকো।

গণপতি আরো খানিকক্ষণ তাহাকে আদর করিল, আরো খানিকক্ষণ বুঝাইল। কিন্তু দুর্বল শরীরটা তাহার শ্রান্তিতে ভাঙিয়া পড়িতেছিল, তাই আধঘণ্টাখানেক পরে ছেলেমানুষ বৌকে আদর করা ও বোঝানো দুটাই যথেষ্ট হইয়াছে, মনে করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িল।

.

পরদিন সকালে রাজেন্দ্র উকিলের বাড়িতে একটা বিরাট হইচই শোনা গেল। বাড়ির মেজ-বৌ রমা নাকি গলায় ফাঁসি দিয়া মরিয়াছে।

বিবেক

শেষ রাত্রে একবার মণিমালার নাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইল। শিয়রে ঘনশ্যাম অত্যন্ত সজাগ হইয়াই বসিয়াছিল। স্ত্রীর মুখে একটু মকরধ্বজ দিয়া সে বড় ছেলেকে ডাকিয়া তুলিল।

ডাক্তারবাবুকে ডেকে নিয়ে আয় সন্তু। নিখিলবাবু যদি না আসেন, মোড়ের বাড়িটাতে যে নতুন ডাক্তার এসেছেন, ওঁকে আনিস, উনি ডাকলেই আসবেন।

ঘরে একটিও টাকা নাই, শুধু কয়েক আনা পয়সা। ভিজিটের টাকাটা ডাক্তারকে নগদ দেওয়া চলিবে না। বাড়িতে ডাক্তার আনিলে একেবারে শেষের দিকে বিদায়ের সময় তাকে টাকা দেওয়া সাধারণ নিয়ম, এইটুকু যা ভরসা ঘনশ্যামের। ডাক্তার অবশ্য ঘরে ঢুকিয়াই তার অবস্থা টের পাইবেন, কিন্তু একটি টাকাও যে তার সম্বল নাই এটা নিশ্চয় তার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হইবে না। মণিমালাকে ভালোভাবেই পরীক্ষা করিবেন, মরণকে ঠেকানোর চেষ্টার কোনো ত্রুটি হইবে না। বাঁচাইয়া রাখার জন্য দরকারি ব্যবস্থার নির্দেশও তাঁর কাছে পাওয়া যাইবে। তারপর, শুধু তারপর, ঘনশ্যাম ডাক্তারের সামনে দুটি হাত জোড়া করিয়া বলিবে, আপনার ফী-টা সকালে পাঠিয়ে দেব ডাক্তারবাবু–

মণিমালার সামনে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাতজোড় করিয়া বিড়বিড় করিয়া কথাগুলি বলিতেছে। ঘুমভরা কাঁদ-কাঁদ চোখে বড় মেয়েটা তাকে দেখিতেছে। আঙুলে করিয়া আরো খানিকটা মকরধ্বজ সে মণিমালার মুখে গুঁজিয়া দিল। ওষুধ গিলিবার ক্ষমতা অথবা চেষ্টা মণিমালার আছে, মনে হয় না। হিসাবে হয়তো তার ভুল হইয়া গিয়াছে। আরো আগে ডাক্তার ডাকিতে পাঠানো উচিত ছিল। ডাক্তারকে সে ঠকাইতে চায় না, ডাক্তারের প্রাপ্য সে দু-চার দিনের মধ্যে পাঠাইয়া দিবে, মণিমালা মরুক অথবা বাঁচুক। তবু, গোড়ায় কিছু না বলিয়া রোগিণীকে দেখাইয়া ডাক্তারের কাছে ব্যবস্থা আদায় করার হিসাবে একটু প্রবঞ্চনা আছে বৈকি। এসব হিসাবে গলদ থাকিয়া যায়।

কিন্তু উপায় কী! ডাক্তার না দেখাইয়া মণিমালাকে তো মরিতে দেওয়া যায় না।

আগুন করে হাতে পায়ে সেঁক দে লতা। কাদিস নে হারামজাদী, ওরা উঠে যদি কান্না শুরু করে, তোকে মেরে ফেলব।

মণিমালার একটি হাত তুলিয়া সে নাড়ি পরীক্ষার চেষ্টা করিল। দুহাতে দুটি রুলি এখনো তার আছে। সজ্ঞানে এ রুলি সে কিছুতেই খুলিতে দেয় নাই। কাল সন্ধ্যায় জ্ঞান প্রায় ছিল না, তখন একবার খুলিবার চেষ্টা করিয়াছিল। চোখ কপালে তুলিয়া যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করিয়া মণিমালাকে খাবি খাওয়ার উপক্রম করিতে দেখিয়া সাহস হয় নাই। এখন অনায়াসে খুলিয়া নেওয়া যায়। সে টেরও পাইবে না! সকালেই ডাক্তারকে টাকা দেওয়া চলিবে, ওষুধপত্র আনা যাইবে। কিন্তু লাভ কি কিছু হইবে শেষ পর্যন্ত? সেইটাই ভাবনার বিষয়। রুলি-বেচা পয়সায় কেনা ওষুধ খাইয়া জ্ঞান হইলে হাত খালি দেখিয়া মণিমালা যদি হার্ট ফেল করে!

সন্তু যখন ফিরিয়া আসিল, চারিদিক ফরসা হইয়া আসিয়াছে। মণিমালা ততক্ষণে খানিকটা সামলাইয়া উঠিয়াছিল। খুঁজিয়া নাড়ি পাওয়া যাইতেছে, নিশ্বাস সহজ হইয়া আসিয়াছে! ডাক্তার আসেন নাই শুনিয়া ঘনশ্যাম আরাম বোধ করিল।

নিখিল ডাক্তার বলিয়া দিয়াছেন, বেলা দশটা নাগাদ আসিবেন। মোড়ের বাড়ির নতুন ডাক্তারটি ডাকামাত্র উৎসাহের সঙ্গে জামা গায়ে দিয়া ব্যাগ হাতে রওনা হইতেছিলেন, হঠাৎ কী ভাবিয়া সন্তুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কাঁদছ কেন খোকা?

মা মরে যাবে ডাক্তারবাবু?

শেষ অবস্থা নাকি? বলে ডাক্তার নিরুৎসাহ হইয়া পড়িলেন। তারপর ভাবিয়া চিন্তিয়া চারটে টাকার জন্য সন্তুকে বাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছেন! কাছেই তো বাড়ি। তিনি প্রস্তুত হইয়া রহিলেন, টাকা লইয়া গেলেই আসিবেন। সন্তুকে তিনি আরো বলিয়া দিয়াছেন, নগদ চারটে টাকা যদি বাড়িতে নাও থাকে তিনটে কি অন্তত দুটো টাকা নিয়েও সে যেন যায়। বাকি টাকাটা পরে দিলেই চলিবে।

তুই কাঁদতে গেলি কেন লক্ষ্মীছাড়া?

এ ডাক্তারটি আসিলে মন্দ হইত না। ডাক্তারকে ডাক্তার, ছ্যাচড়াকে ছ্যাচড়া। টাকাটা যতদিন খুশি ফেলিয়া রাখা চলিত। একেবারে না দিলেও কিছু আসিয়া যাইত না। এসব অর্থের কাঙাল নীচু স্তরের মানুষ সম্বন্ধে ঘনশ্যামের মনে গভীর অবজ্ঞা আছে। এদের একজন তাকে মিথ্যাবাদী প্রবঞ্চক বলিয়া জানিয়া রাখিয়াছে, ভাবিলে সে গভীর অস্বস্তি বোধ করে না, মনের শান্তি নষ্ট হইয়া যায় না।

ঘরের অপর প্রান্তে, মণিমালার বিছানার হাত তিনেক তফাতে, নিজের বিছানায় গিয়া ঘনশ্যাম শুইয়া পড়িল। ভিজা ভিজা লাগিতেছে বিছানাটা। ছোট মেয়েটা সারারাত চরকির মতো বিছানায় পাক খায়, কখন আসিয়া এদিকে তার বিছানা ভিজাইয়া ওপাশে থোকার ঘাড়ে পা তুলিয়া দিয়া অকাতরে ঘুমাইতেছে। মারিবে? এখন মারিলে অন্যায় হয় না। সজোরে একটা চড় বসাইয়া দিবে ওর পিঠের ওই পাঁজরায় অথবা লোল ও তুলার আঁশ-মাখানো গালে? আধঘণ্টা ধরিয়া চিৎকার করিবে মেয়েটা। মণিমালা ছাড়া কারো সাধ্য হইবে না সহজে ওর সেই কান্না থামায়।

আধঘণ্টা মরার মতো পড়িয়া থাকিয়া ঘনশ্যাম উঠিয়া পড়িল। অশ্বিনীর কাছেই আবার সে কয়েকটা টাকা ধার চাহিবে, যা থাকে কপালে। এবার হয়তো রাগ করিবে। অশ্বিনী, মুখ ফিরাইয়া বলিবে তার টাকা নাই। হয়তো দেখাই করিবে না। তবু অশ্বিনীর কাছেই তাকে হাত পাতিতে হইবে। আর কোনো উপায়ই নাই।

বহুকালের পুরনো পোকায়-কাটা সিল্কের জামাটি দিন তিনেক আগে বাহির করা। হইয়াছিল, গায়ে দিতে গিয়া ঘনশ্যাম থামিয়া গেল। আর জামা নাই বলিয়া সে যে এই জামাটি ব্যবহার করিতেছে, এই জামা গায়ে দিয়া বাজার পর্যন্ত করিতে যায়, অশ্বিনী তা টের পাইবে না। ভাবিবে, বড়লোক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করিতে যাইবে বলিয়া বাক্স প্যাটরা ঘাটিয়া মান্ধাতার আমলের পোকায়-কাটা, দাগ-ধরা সিল্কের পাঞ্জাবিটি সে বাহির করিয়াছে। মনে মনে হয়তো হাসিবে অশ্বিনী।

তারচেয়ে ছেঁড়া ময়লা শার্টটা পরিয়া যাওয়াই ভালো। শার্টের ভেঁড়াটুকু সেলাই করা হয় নাই দেখিয়া ঘনশ্যামের অপূর্ব সুখকর অনুভূতি জাগিল। কাল লতাকে সেলাই করিতে বলিয়াছিল। একবার নয়, দুবার। সে ভুলিয়া গিয়াছে। ন্যায়সঙ্গত কারণে মেয়েটাকে মারা চলে। ও বড় হইয়াছে, কাদাকাটা করিবে না। কাঁদিলেও নিঃশব্দে কাঁদিবে, মুখ বুজিয়া।

লতা ইদিকে আয়। ইদিকে আয় হারামজাদী মেয়ে!

চড় খাইয়া ঘনশ্যামের অনুমানমতো নিঃশব্দে কাঁদিতে কাঁদিতে লতা শার্ট সেলাই করে, আর বিড়ি ধরাইয়া টানিতে টানিতে গভীর তৃপ্তির সঙ্গে ঘনশ্যাম আড়চোখে তার দিকে তাকায়। মায়া হয়, কিন্তু আফসোস হয় না। অন্যায় করিয়া মারিলে আফসোস ও অনুতাপের কারণ থাকিত।

অশ্বিনীর মস্ত বাড়ির বাহারে গেট পার হওয়ার সময় সবিনয় নম্রতায় ঘনশ্যামের মন যেন গলিয়া যায়। দাসানুদাস কীটাণুকীটের চেয়ে নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়! সমস্ত ক্ষণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে যে ধনহীনতার মতো পাপ নাই। রাস্তায় নামিয়া যাওয়ার পর বহুক্ষণ পর্যন্ত এই ভয়াবহ অপরাধের ভারে সে যেন দু-এক ডিগ্রি সামনে বাঁকিয়া কুঁজো হইয়া থাকে।

সবে তখন আটটা বাজিয়াছে। সদর বৈঠকখানার পর অশ্বিনীর নিজের বসিবার ঘর, মাঝখানের দরজায় পুরু দুর্ভেদ্য পরদা ফেলা থাকে। এত সকালেও বৈঠকখানায় তিনজন অচেনা ভদ্রলোক ধরনা দিয়া বসিয়া আছেন; ঘনশ্যাম দমিয়া গেল। একটু ইতস্তত করিয়া সাহসে বুক বাঁধিয়া পরদা ঠেলিয়া ঢুকিয়া পড়িল অশ্বিনীর বসিবার ঘরে। অন্দর হইতে অশ্বিনী প্রথমে এ ঘরে আসিবে।

ঘরে ঢুকিয়াই ঘনশ্যাম সাধারণভাবে বুঝিতে পারিয়াছিল ঘরে কেউ নাই। সোনার ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ার পর আর একবার বিশেষভাবে সে বুঝিতে পারিল ঘর খালি। উনানে বসানো কেটলিতে যেমন হঠাৎ শোঁ শোঁ আওয়াজ শুরু হয় এবং খানিক পরে আওয়াজ কমিয়া জল ফুটিতে থাকে, ঘনশ্যামের মাথাটা তেমনি খানিকক্ষণ শব্দিত হইয়া থাকিয়া থাকিয়া ভাঙা ভাঙা ছাড়া ছাড়া চিন্তায় টগবগ করিয়া উঠিল। হৃৎপিণ্ড পাজরে আছাড় খাইতে শুরু করিয়াছে। গলা শুকাইয়া গিয়াছে। হাত পা কাঁপিতেছে ঘনশ্যামের। নির্জন ঘরে টেবিল হইতে তুলিয়া একটা ঘড়ি পকেটে রাখা এত কঠিন! কিন্তু দেরি করা বিপজ্জনক। ঘড়িটা যদি তাকে নিতেই হয়, অবিলম্বে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। দেরি করিতে করিতে হয়তো শেষপর্যন্ত সে যখন ঘড়িটা তুলিয়া পকেটে ভরিতে যাইবে ঠিক সেই সময় কেহ ঘরে ঢুকিয়া সব দেখিয়া ফেলিবে। কেউ না দেখিলে তার কোনো ভয় নাই। সদ্বংশজাত শিক্ষিত। দ্রসন্তান সে, সকলে তাহাকে নিরীহ ভালোমানুষ বলিয়া জানে, যেমন হোক অশ্বিনীর সে বন্ধু। তাকে সন্দেহ করার কথা কে ভাবিবে! ঘড়ি সহজেই হারাইয়া যায়। চাকর ঠাকুর চুরি করে, সন্ন্যাসী ভিখারি চুরি করে। শেষবার ঘড়ি কোথায় খুলিয়া রাখিয়াছিল মনে পড়িয়াও যেন মনে পড়িতে চায় না মানুষের। অশ্বিনীর সোনার ঘড়ি কোথায় ছিল, কে নিয়াছে, কে বলিতে পারিবে!

তারপর ঘড়িটা অবশ্য এক সময় ঘনশ্যামের পকেটে চলিয়া গেল। বুকের ধড়ফড়ানি ও হাতপায়ের কাঁপুনি থামিয়া তখন নিজেকে তার অসুস্থ, দুর্বল মনে হইতেছে। হাঁটু দুটি যেন অবশ হইয়া গিয়াছে। পেটের ভিতর কিসে জোরে টানিয়া ধরিয়াছে আর সেই টানে মুখের চামড়া পর্যন্ত শির শির করিতেছে।

বৈঠকখানায় পা দিয়াই ঘনশ্যাম থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। অশ্বিনীর পুরনো চাকর পশুপতি উপস্থিত ভদ্রলোকদের চা পরিবেশন করিতেছে। ঘড়িটা পকেটে রাখিতে সে যে এতক্ষণ ইতস্তত করিয়াছে, ঘনশ্যামের ধারণা ছিল না। হিসাবে একটা ভুল হইয়া গেল। পশুপতি মনে রাখিবে। এ ঘর হইতে তার বাহির হওয়া, তার থমক, চমক, শুকনো মুখ, কিছুই সে ভুলিবে না।

কেমন আছেন ঘোনোসশ্যামবাবু? চা দিই?

দাও একটু।

ধোপদুরস্ত ফরসা ধুতি ও শার্ট, পায়ে স্যান্ডেল। তার চেয়ে পশুপতিকে ঢের বেশি দ্রলোকের মতো দেখাইতেছে। ঘনশ্যামের শুধু এটুকু সান্ত্বনা যে আসলে পশুপতি চোর; অশ্বিনী নিজেই অনেকবার বলিয়াছে, সে এক নম্বরের চোর! কিন্তু কী প্রশ্রয় বড়লোকের এই পেয়ারের চোর-চাকরের! এক কাপ চা দেওয়ার সঙ্গে বড়লোক বন্ধুর চাকর যে কতখানি অপমান পরিবেশন করিতে পারে খেয়াল করিয়া ঘনশ্যামের গায়ে যেন জ্বালা ধরিয়া গেল। আজ কিন্তু প্রথম নয়। পশুপতি তাকে কোনোদিন খাতির করে না, একটা অদ্ভুত মার্জিত অবহেলার সঙ্গে তাকে শুধু সহ্য করিয়া যায়। এ বাড়িতে আসিলে অশ্বিনীর ব্যবহারেই ঘনশ্যামকে এত বেশি মরণ কামনা করিতে হয়। যে, পশুপতির ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন হওয়ার অবসর সে পায় না। চায়ে চুমুক দিতে। জিভ পুড়াইয়া পশুপতির বাঁকা হাসি দেখিতে দেখিতে আজ সব মনে পড়িতে লাগিল। মনের মধ্যে তীব্র জ্বালা-ভরা অনুযোগ পাক দিয়া উঠিতে লাগিল অশ্বিনীর। বিরুদ্ধে! অসহ্য অভিমানে চোখ ফাটিয়া যেন কান্না আসিবে। বন্ধু একটা ঘড়ি চুরি করিয়াছে জানিতে পারিলে পুলিশে না দিক, জীবনে অশ্বিনী তার মুখ দেখিবে না। সন্দেহ নাই। অথচ প্রথার মতো নিয়মিতভাবে যে চুরি করিতেছে সেই চাকরের কত আদর তার কাছে। অশ্বিনীর সোনার ঘড়ি চুরি করা অন্যায় নয়। ওরকম মানুষের দামি জিনিস চুরি করাই উচিত।

একঘণ্টা পরে মিনিট পাঁচেকের জন্য অশ্বিনীর সঙ্গে দেখা হইল। প্রতিদিনের মতো আজও সে বড় ব্যস্ত হইয়া আছে। মস্ত চেয়ারে মোটা দেহটি ন্যস্ত করিয়া অত্যধিক ব্যস্ততায় মেঘ-গম্ভীর মুখে হাঁসফাঁস করিতেছে। ঘনশ্যামের কথাগুলি সে শুনিল কি না বোঝা গেল না। চিরদিন এমনিভাবেই সে তার কথা শোনে, খানিক তফাতে বসাইয়া আধঘণ্টা ধরিয়া ঘনশ্যামকে দিয়া সে দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী আবৃত্তি করায়। নিজে কাগজ পড়ে, লোকজনের সঙ্গে কথা কয়, মাঝে মাঝে আচমকা কিছুক্ষণের জন্য উঠিয়াও যায়। ঘনশ্যাম থামিয়া গেলে তার দিকে তাকায়হাকিম যেভাবে কাঠগড়ায় ছ্যাচড়া চোর আসামির দিকে তাকায় তেমনিভাবে। জিজ্ঞাসা করে, কী বলছিলে?

ঘনশ্যামকে আবার রলিতে হয়।

আজ পাঁচ মিনিটও গেল না, নীরবে ড্রয়ার খুলিয়া পাঁচ টাকার একটা নোট বাহির করিয়া ঘনশ্যামের দিকে ছুড়িয়া দিল। ডাকিল, পশু!

পশুপতি আসিয়া দাঁড়াইলে তাকে জিজ্ঞাসা করিল, কাপড়-কাঁচা সাবান আছে?

আছে বাবু!

এই বাবুকে একখণ্ড সাবান এনে দাও। জামা-কাপড়টা বাড়িতে নিজেই একটু কষ্ট করে কেচে নিও ঘনশ্যাম। গরিব বলে নোংরা থাকতে হবে? পঁচিশ টাকা ধার চাহিলে এ পর্যন্ত অশ্বিনী তাকে অন্তত পনেরটা টাকা দিয়াছে, তার নিচে কোনোদিন নামে নাই। এ অপমানটাই ঘনশ্যামের অসহ্য মনে হইতে লাগিল। মণিমালাকে বাঁচানোর জন্য পাঁচটি টাকা দেয়, কী অমার্জিত অসভ্যতা অশ্বিনীর, কী স্পর্ধা! পথে নামিয়া ট্রাম-রাস্তার দিকে চলিতে চলিতে ঘনশ্যাম প্রথম টের পায়, তার রাগ হইয়াছে। ট্রামে উঠিয়া বাড়ির দিকে অর্ধেক আগাইয়া যাওয়ার পর সে বুঝিতে পারে, অশ্বিনীর বিরুদ্ধে গভীর বিদ্বেষে বুকের ভিতরটা সত্যই তার জ্বালা করিতেছে। এ বিদ্বেষ ঘনশ্যাম অনেকক্ষণ জিয়াইয়া রাখিবে। হয়তো আজ সারাটা দিন, হয়তো কাল পর্যন্ত।

ঘনশ্যামের একটা বৈঠকখানা আছে। একটু সঁতসেঁতে এবং ছায়ান্ধকার। তক্তপোশের ছেঁড়া শতরঞ্চিতে কিছুক্ষণ বসিয়া থাকিলে দেহ মন জুড়াইয়া যায়, চোখ আর জ্বালা করে না, ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে হয়। মিনিট পনের ঘনশ্যামের প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকার পর তার বন্ধু শ্রীনিবাস চিৎ হইয়া শুইয়া চোখ বুজিয়াছিল। আরো আধঘণ্টা হয়তো সে এমনিভাবে পড়িয়া থাকিত, কিন্তু যাওয়ার তাগিদটা মনে তার এতই প্রবল হইয়াছিল যে, ঘনশ্যাম ঘরে ঢোকামাত্র ব্যস্তভাবে উঠিয়া বসিয়া বলিল, ভালোই হল, এসে পড়েছিস। আর এক মিনিট দেখে চলে যেতাম ভাই। ডাক্তার আনলে না?

ডাক্তার ডাকতে যাইনি। টাকার খোঁজে বেরিয়েছিলাম।

শ্রীনিবাস ক্লিষ্টভাবে একটু হাসিল।–দুজনেরই সমান অবস্থা, আমিও টাকার খোঁজেই বেরিয়েছিলাম, ওনার বালা দুটো বাঁধা রেখে এলাম। শেষ রাতে খোকারও যায় যায় অবস্থা–অক্সিজেন দিতে হল। একটু চুপ করিয়া কী ভাবিতে ভাবিতে শ্রীনিবাস আস্তে আস্তে সিধা হইয়া গেল, আচ্ছা, আমাদের সব একসঙ্গে আরম্ভ হয়েছে কেন বল তো? এক মাস আগে-পরে চাকরি গেল, একসঙ্গে অসুখ-বিসুখ শুরু হল, কাল রাত্রে এক সময়ে এদিকে সন্তুর মা, ওদিকে খোকা–

দুর্ভাগ্যের এই বিস্ময়কর সামঞ্জস্য দুই বন্ধুকে নির্বাক করিয়া রাখে। বন্ধু তারা অনেক দিনের, সব মানুষের মধ্যে দুজনে তারা সবচেয়ে কাছাকাছি। আজ হঠাৎ পরস্পরকে ঘনিষ্ঠতর-নিকটতর মনে হইতে থাকে। দুজনেই আশ্চর্য হইয়া যায়।

টাকা পেলি না?

ঘনশ্যাম মাথা নাড়িল।

গোটা দশেক টাকা রাখ। নিখিলবাবুকে একবার আনিস।

পকেট হইতে পুরনো একটা চামড়ার মানিব্যাগ বাহির করিয়া কতগুলি ভাজ-করা নোট হইতে একটি সন্তর্পণে খুলিয়া ঘনশ্যামের হাতে দিল। কিছু আবেগ ও কিছু অনির্দিষ্ট উত্তেজনায় সে নার্ভাস হইয়া পড়িয়াছে। তার স্ত্রীর বালা বিক্রির টাকা, মরণাপন্ন ছেলের চিকিৎসার টাকা। আবেগ ও উত্তেজনায় একটু কাবু হইয়া ঝোঁকের মাথায় না দিলে একেবারে দশটা টাকা বন্ধুকে সে দিতেই-বা পারিবে কেন? গেলাম ভাই। বসবার সময় নেই। একেবারে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যাব।

একটু অতিরিক্ত ব্যস্তভাবেই সে চলিয়া গেল। নিজের উদারতায় লজ্জা পাইয়া বোধ হয় অস্বস্তি বোধ করিতেছিল। দুমিনিটের মধ্যে আরো বেশি ব্যস্তভাবে সে ফিরিয়া আসিল। আতঙ্কে ধরা গলায় বলিল, ব্যাগটা ফেলে গেছি।

এখানে? পকেটে রাখলি যে?

পকেটে রাখবার সময় বোধ হয় পড়ে গেছে।

তাই যদি হয়, তক্তপোশে পড়িয়া থাকার কথা। ঘনশ্যামকে টাকা দিয়া পকেটে ব্যাগ রাখিবার সময় শ্রীনিবাস বসিয়া ছিল। ঘর এত বেশি অন্ধকার নয় যে, চামড়ার একটা মানিব্যাগ চোখে পড়িবে না। তবে তক্তপোশের নিচে বেশ অন্ধকার। আলো জ্বালিয়া তক্তপোশের নিচে আয়নায় প্রতিফলিত আলো ফেলিয়া খোঁজা হইল। মেঝেতে চোখ বুলাইয়া কতবার যে শ্রীনিবাস সমস্ত ঘরে পাক খাইয়া বেড়াইল। ঘনশ্যামের সঙ্গে তিনবার পথে নামিয়া দুটি বাড়ির পরে পান-বিড়ির দোকানের সামনে পর্যন্ত খুঁজিয়া আসিল। তারপর তক্তপোশে বসিয়া পড়িয়া মরার মতো বলিল, কোথায় পড়ল তবে? এইটুকু মোটে গেছি, বিড়ির দোকান পর্যন্ত। এক পয়সার বিড়ি কিনব বলে পকেটে হাত দিয়েই দেখি ব্যাগ নেই।

ঘনশ্যাম আরো বেশি মরার মতো বলিল, রাস্তায় পড়েছে মনে হয়। পড়ামাত্র হয়তো কেউ কুড়িয়ে নিয়েছে।

তাই হবে। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে রাস্তায় পড়ল, একজন কুড়িয়ে নিল! পকেট থেকে পড়বেই-বা কেন তাই ভাবছি।

যখন যায়, এমনিভাবেই যায়। শনির দৃষ্টি লাগলে পোড়া শোল মাছ পালাতে পারে।

তাই দেখছি। বিনা চিকিৎসায় ছেলেটা মারা যাবে।

ঘনশ্যামের মুখের চামড়ায় টান পড়িয়া শিরশির করিতে থাকে। অশ্বিনীর সোনার ঘড়িটা পকেটে ভরিবার পর এমনি হইয়াছিল। এখনো ব্যাগটা ফিরাইয়া দেওয়া যায়। অসাবধান বন্ধুর সঙ্গে এটুকু তামাশা করা চলে, তাতে দোষ হয় না। তবে দশটা টাকা দিলেও ডাক্তার লইয়া গিয়াও ছেলেকে দেখাইতে পারিবে। দশ টাকায় মণিমালার যদি চিকিৎসা হয়, ওর ছেলের হইবে না কেন!

শ্রীনিবাস নীরবে নোটটি ফিরাইয়া লইল। পকেটে রাখিল না, মুঠা করিয়া ধরিয়া বসিয়া রহিল। সমান বিপন্ন বন্ধুকে খানিক আগে যাচিয়া যে টাকা দিয়াছিল সেটা ফিরাইয়া লওয়ার সঙ্গতি-অসঙ্গতির বিচার হয়তো করিতেছে। নিরুপায় দুঃখ, ব্যাগ হারানোর দুঃখ নয়, এই দশ টাকা ফেরত লইতে হওয়ার দুঃখ, হয়তো ওর কান্না আসিবার উপক্রম হইয়াছে। ওর পক্ষে কিছুই আশ্চর্য নয়। ঘনশ্যাম মমতা বোধ করে। ভাবে, মিছামিছি ওর মনে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়।

গোটা পঁচিশেক টাকা জোগাড় করতে পারব শ্রীনিবাস।

পারবি? বাঁচা গেল। আমি তাই ভাবছিলাম। সন্তুর মার চিকিৎসা না করলেও তো চলবে না।

শ্রীনিবাস চলিয়া যাওয়ার খানিক পরেই হঠাৎ বিনা ভূমিকায় ঘনশ্যামের সর্বাঙ্গে একবার শিহরণ বহিয়া গেল। ঝাঁকুনি লাগার মতো জোরে। শ্রীনিবাস যদি কোনো কারণে গা ঘেঁষিয়া আসিত, কোনোরকমে যদি পেটের কাছে তার কোনো অঙ্গ ঠেকিয়া যাইত! তাড়াতাড়িতে শার্টের নিচে কোচার সঙ্গে ব্যাগটা বেশি খুঁজিয়া দিয়াছিল, শ্রীনিবাসের সঙ্গে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া খোঁজার সময় আলগা হইয়া যদি ব্যাগটা পড়িয়া যাইত! পেট ফুলাইয়া ব্যাগটা শক্ত করিয়া আটকাইতেও তার সাহস হইতেছিল, বেশি উঁচু হইয়া উঠিলে যদি চোখে পড়ে। অশ্বিনীর সোনার ঘড়ি আলগাভাবে শার্টের পকেটে ফেলিয়া রাখিয়া কতক্ষণ ধরিয়া চা খাইয়াছে, লোকের সঙ্গে আলাপ করিয়াছে, অশ্বিনীর সঙ্গে আলাপ করিয়াছে, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর আতঙ্ক তো একবারও হয় নাই। সেইখানেই ভয় ছিল বেশি। তার ব্যাগ লুকানোকে শ্রীনিবাস নিছক তামাশা ছাড়া আর কিছু মনে করিত না। এখনো যদি ব্যাগ বাহির করিয়া দেয়, শ্রীনিবাস তাই মনে করিবে। তাকে চুরি করিতে দেখিলেও শ্রীনিবাস বিশ্বাস করিবে না সে চুরি করিতে পারে। কিন্তু কোনোরকমে তার পকেটে ঘড়িটার অস্তিত্ব টের পাইলে অশ্বিনী তো ওরকম কিছু মনে করিত না। সোজাসুজি বিনা দ্বিধায় তাকে চোর ভাবিয়া বসিত। ভাবিলে এখন তার আতঙ্ক হয়। সেখানে কী নিশ্চিত হইয়াই ছিল! ঘড়ির ভারে ঝুলিয়া পড়িয়াছিল পাতলা শার্টের পকেটটা। তখন সে খেয়ালও করে নাই। অশ্বিনী যদি জিজ্ঞাসা করিয়া বসিত, তোমার পকেটে কী ঘনশ্যাম!

ঘরের স্যাঁতসেঁতে শৈত্যে ঘনশ্যামের অন্য সব দুশ্চিন্তা টান-করা-চামড়ার ভিজিয়া-ওঠার মতো শিথিল হইয়া যায়, উত্তেজনা ঝিমাইয়া পড়ে, মনের মধ্যে কষ্টরোধের মতো চাপ দিতে থাকে, শুধু এক দুর্বহ উদ্বেগ। অশ্বিনীর মনে খটকা লাগিবে। অশ্বিনী সন্দেহ করিবে। পশুপতি তাকে অশ্বিনীর বসিবার ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল। পশুপতি যদি ওকথা তাকে বলে, বলিবে নিশ্চয়ই, অশ্বিনীর কি মনে হইবে না ঘড়িটা ঘনশ্যাম নিলেও নিতে পারে?

এই ভাবনাটাই মনের মধ্যে অবিরত পাক খাইতে থাকে। শরীরটা কেমন অস্থির অস্থির করে ঘনশ্যামের। সন্দেহ যদি অশ্বিনীর হয়, ভাসা-ভাসা ভিত্তিহীন কাল্পনিক সন্দেহ, তার তাতে কী আসিয়া যায়, ঘনশ্যাম বুঝিয়া উঠিতে পারে না। এতদিন সে যে অশ্বিনীর ঘড়ি চুরি করে নাই, কোনো সন্দেহও তার সম্বন্ধে জাগে নাই অশ্বিনীর, কী এমন খাতিরটা সে তাকে করিয়াছে? শেষরাত্রে মণিমালার নাড়ি ছাড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইয়াছিল শুনিয়া পাঁচটি টাকা সে তাকে দিয়াছে, একতাড়া দশ টাকার নোটের ভিতর হইতে খুঁজিয়া বাহির করিয়া পাঁচ টাকার একটি নোট ছুড়িয়া দিয়াছে। আর দিয়াছে একখানা কাপড়-কাঁচা সাবান। চাকরকে দিয়া আনাইয়া দিয়াছে। সন্দেহ ছোট কথা, অশ্বিনী তাকে চোর বলিয়া জানিলেই বা তার ক্ষতি কী?

বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড়ানোর শব্দে চমকিয়া ওঠে। নিশ্চয়ই অশ্বিনী আসিয়াছে। পুলিশ নয় তো? অশ্বিনীকে বিশ্বাস নাই। ঘড়ি হারাইয়াছে টের পাওয়ামাত্র পশুপতির কাছে খবর শুনিয়া সে হয়তো একেবারে পুলিশ লইয়া বাড়ি সার্চ করিতে আসিয়াছে। অশ্বিনী সব পারে।

না, অশ্বিনী নয়। নিখিল ডাক্তার মণিমালাকে দেখিতে আসিয়াছে।

কিন্তু ঘড়িটা এভাবে কাছে রাখা উচিত নয়। বাড়িতে রাখাও উচিত নয়। ডাক্তার বিদায় হইলে সে ঘড়িটা বেচিয়া দিয়া আসিবে। যেখানে হোক, যত দামে হোক। নিখিল ডাক্তার মণিমালাকে পরীক্ষা করে, অর্ধেক মন দিয়া ঘনশ্যাম তার প্রশ্নের জবাব দেয়। সোনার ঘড়ি কোথায় বিক্রি করা সহজ ও নিরাপদ তাই সে ভাবিতে থাকে সমস্তক্ষণ। বাহিরের ঘরে গিয়া কিছুক্ষণের সঙ্কেতময় নীরবতার পর নিখিল ডাক্তার গম্ভীরমুখে যা বলে তার মানে সে প্রথমটা বুঝিয়া উঠিতে পারে না।

মণিমালা বাঁচিবে না? কেন বাঁচিবে না, এখন তো আর টাকার অভাব নাই, যতবার খুশি ডাক্তার আনিয়া চিকিৎসা করাইতে পারিবে। মণিমালার না বাঁচিবার কী কারণ থাকিতে পারে!

ভালো করে দেখেছেন?

বোকার মতো প্রশ্ন করা। মাথার মধ্যে সব যেরকম গোলমাল হইয়া যাইতেছে। তাতে বোকা না বনিয়াই-বা সে কী করে। গোড়ায় ডাক্তার ডাকিলে, সময়মতো দু-চারটা ইনজেকশন পড়িলে মণিমালা বাঁচিত। তিন-চার দিন আগে ব্রেন। কমপ্লিকেশন আরম্ভ হওয়ার প্রথম দিকে চিকিৎসা আরম্ভ হইলেও বাঁচানোর সম্ভাবনা ছিল। তিন-চার দিন! মণিমালা যে ক্রমাগত মাথাটা এপাশ-ওপাশ করিত, চোখ কপালে তুলিয়া রাখিত, সেটা তবে ব্রেন খারাপ হওয়ার লক্ষণ। রুলি খুলিতে গেলে সে সজ্ঞানে বাধা দেয় নাই, হাতে টান লাগায় আপনা হইতে মুখ বিকৃত করিয়া গলায় বিশ্রী ভাঙা ভাঙা আওয়াজ করিয়াছিল। স্থির নিশ্চল না হইয়াও মানুষের জ্ঞান যে লোপ পাইতে পারে অত কি ঘনশ্যাম জানিত।

চেষ্টা প্রাণপণে করিতে হইবে। তবে এখন সব ভগবানের হাতে।

ডাক্তার ভগবানের দোহাই দেয়। এতদিন সব ডাক্তারের হাতে ছিল, এখন। ভগবানের হাতে চলিয়া গিয়াছে। নিখিল ডাক্তার চলিয়া গেলে বাহিরের ঘরে বসিয়াই ঘনশ্যাম চিন্তাগুলি গুছাইবার চেষ্টা করে। কালও মণিমালার মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত ছিল, ডাক্তারের এ কথায় তার কিছুতেই বিশ্বাস হইতে চায় না। শেষরাত্রে নাড়ি ছাড়িয়া একরকম মরিয়া গিয়াও মণিমালা তবে বাঁচিয়া উঠিল কেন? তখন তো শেষ হইয়া যাইতে পারিত। মণিমালার মরণ নিশ্চিত হইয়াছে আজ সকালে। ডাক্তার বুঝিতে পারে নাই, এখনকার অবস্থা দেখিয়া আন্দাজে ভুল অনুমান করিয়াছে। ঘনশ্যাম যখন অশ্বিনীর ঘড়িটা চুরি করিয়াছিল, তার জীবনে প্রথম চুরি, তখন মণিমালা চিকিৎসার বাহিরে চলিয়া গিয়াছিল। ওর চিকিৎসার জন্য সে পাপ করিয়াছে কিনা, ওর চিকিৎসা তাই হইয়া গিয়াছে নিরর্থক। সকালে বাড়ি হইতে বাহির হওয়ার আগে নিখিল ডাক্তারকে আনিয়া সে যদি মণিমালাকে দেখাইত, নিখিল ডাক্তার নিশ্চয় অন্য কথা বলিত।

ঘড়িটা ফিরাইয়া দিবে?

খুব সহজে তা পারা যায়। এখনো হয়তো জানাজানিও হয় নাই। কোনো এক ছুতায় অশ্বিনীর বাড়ি গিয়া একফাঁকে টেবিলের উপর ঘড়িটা রাখিয়া দিলেই হইল।

আর কিছু না হোক, মনের মধ্যে এই যে তার পীড়ন চলিতেছে আতঙ্ক ও উদ্বেগের, তার হাত হইতে সে তো মুক্তি পাইবে। যাই সে ভাবুক, অশ্বিনী যে তাকে মনে মনে সন্দেহ করিবে সে সহ্য করিতে পারিবে না। এই কয়েকঘণ্টা সে কি সহজ। যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছে? পশুপতি যখন তাকে অশ্বিনীর ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখিয়াছিল, তাকে সন্দেহ করার সম্ভাবনা যখন আছে অশ্বিনীর, ঘড়িটা রাখিয়া আসাই ভালো। এমনিই অশ্বিনী তাকে যে রকম অবজ্ঞা করে গরিব বলিয়া, অপদার্থ বলিয়া, তার উপর চোর বলিয়া সন্দেহ করিলে না জানি কী ঘৃণাটাই সে তাকে করিবে! কাজ নাই তার তুচ্ছ একটা সোনার ঘড়িতে।

টাকাও তার আছে। পঁচিশ টাকা।

ভিতরে গিয়া মণিমালাকে একবার দেখিয়া আসিয়া ঘনশ্যাম বাহির হইয়া পড়িল। ট্রাম-রাস্তা ধরিয়া কিছুদূর আগাইয়া সে শ্রীনিবাসের মানিব্যাগটা বাহির করিল। নোটগুলি পকেটে রাখিয়া ব্যাগটা হাতে করিয়াই চলিতে চলিতে এক সময় আলগোছে ব্যাগটা রাস্তায় ফেলিয়া দিল। খানিকটা গিয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিল, ছাতি হাতে পাঞ্জাবি গায়ে একজন মাঝবয়সী গোঁফওয়ালা লোক খালি ব্যাগটার উপর পা দিয়া দাঁড়াইয়া কতই যেন আনমনে অন্যদিকে চাহিয়া আছে।

ঘনশ্যাম একটু হাসিল। একটু পরেই ব্যাগটা তুলিয়া লইয়া লোকটি সরিয়া পড়িবে। হয়তো কোনো পার্কে নির্জন বেঞ্চে বসিয়া পরম আগ্রহে সে ব্যাগটা খুলিবে। যখন দেখিবে ভিতরটা একেবারে খালি, কী মজাই হইবে তখন! খুচরা সাড়ে সাত আনা পর্যন্ত সে ব্যাগটা হইতে বাহির করিয়া লইয়াছে।

স্টপেজে ট্রাম থামাইয়া ঘনশ্যাম উঠিয়া পড়িল। খুচরা সাড়ে সাত আনা পয়সা থাকায় সুবিধা হইয়াছে। নয়তো ট্রামের টিকিট কেনা যাইত না। তার কাছে শুধু দশ টাকা আর পাঁচ টাকার নোট।

অশ্বিনীর বৈঠকখানায় লোক ছিল না। তার নিজের বসিবার ঘরটিও খালি। টেবিলে চিঠির উপর ঘড়িটা চাপা দেওয়া ছিল, চিঠিগুলি এখনো তেমনিভাবে পড়িয়া আছে। ঘড়িটি চিঠিগুলির উপর রাখিয়া ঘনশ্যাম বৈঠকখানায় গিয়া বসিল।

বেল টিপিতে আসিল পশুপতি।–বাবু যে আবার এলেন?

বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করব।

ভিতরে গিয়া অল্পক্ষণের মধ্যেই পশুপতি ফিরিয়া আসিল।

বিকেলে আসতে বললেন ঘনোসশ্যামবাবু, চারটের সময়।

ঘনশ্যাম কাতর হইয়া বলিল, আমার এখুনি দেখা করা দরকার, তুমি আর একবার বলো গিয়ে পশুপতি। বোলো যে ডাক্তার সেনের কাছে একটা চিঠির জন্য এসেছি।

তারপর অশ্বিনী ঘনশ্যামকে ভিতরে ডাকিয়া পাঠাইল, অর্ধেক ফী-তে মণিমালাকে একবার দেখিবার জন্য অনুরোধ জানাইয়া তার বন্ধু ডাক্তার সেনের নামে একখানা চিঠিও লিখিয়া দিল। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির এইসব লীলাখেলা অশ্বিনী ভালোবাসে, নিজেকে তার গৌরবান্বিত মনে হয়।

চিঠিখানা ঘনশ্যামের হাতে দেওয়ার আগে সে কিন্তু একবার জিজ্ঞাসা করিল, ফী-র টাকা বাকি রাখলে চলবে না কিন্তু। আমি অপদস্থ হব। টাকা আছে তো?

ঘনশ্যাম বলিল, আছে। ওনার গয়না বেচে দিলাম, কী করি।

যাকে ঘুষ দিতে হয়

মোটর চলে আস্তে। ড্রাইভার ঘনশ্যাম মনে মনে বিরক্ত হয়, স্পিড় দেবার জন্য অভ্যাস নিশপিশ করে ওঠে প্রত্যঙ্গে, কিন্তু উপায় নেই। বাবুর আস্তে চালাবার হুকুম। কাজে যাবার সময় গাড়ি জোরে চললে তার কোনো আপত্তি হয় না কিন্তু সস্ত্রীক হাওয়া খেতে বার হলে তারা দুজনেই কলকাতার পথে মোটর চড়ে–নিজেদের দামি মোটর চড়ে বেড়াবার অকথ্য আনন্দ রয়ে-সয়ে চেটেপুটে উপভোগ করতে ভালোবাসে।

এত বড়, এত দামি এমন চকচকে মোটর গড়িয়ে চলেছে শহরের পিচ-ঢালা। পথে, শুধু এই সত্যটাই যেন একটানা শিহরণ হয়ে থাকে সুশীলার। তারপর আছে পুরনো, সস্তা, বাজে মোটরগাড়ির চলা দেখে মুখ বাঁকানোর সুখ। আর আছে বোঝাই ট্রাম-বাসের দিকে তাকিয়ে তিন বছর আগেকার কল্পনাতীত স্বপ্নজগতে বাস্তব, প্রত্যক্ষ বিচরণের অনুভূতি। ট্রামের হাতল ধরে আর বাসের পিছনে মানুষকে ঝুলতে দেখে সুশীলার মায়া হয়, এক অদ্ভুত মায়া! যাতে গর্ব বেশি। তিন বছর আগে মাখনকেও তো এমনভাবে ঝুলতে ঝুলতে কাজে যেতে হত। স্বামীর অতীত সাধারণত্বের দুর্দশা আজ বড় বেশি মনে হওয়ায় ট্রাম-বাসের বাদুর-ঝোলা মানুষদের প্রতি উত্তপ্ত দরদ জাগে সুশীলার। মাখন সিগারেট ধরিয়ে এপাশে ধোয়া ছেড়ে ওপাশে সুশীলার দিকে আড়চোখে চেয়ে প্রায় সবিনয় নিবেদনের সুরে বলে, কে ভেবেছিল আমরা একদিন মোটর হাঁকাব?

সুশীলা বিবেচনা করে জবাব দেয়। সে মধ্যবিত্ত ভালো ঘরের মেয়ে, পরীক্ষায় ভালো পাস করা গরিবের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হল। ওমা, এত ভালো ছেলের চাকরি কিনা একশ টাকার! কত অবজ্ঞা, অপমান, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা স্বামীকে দিয়েছে সুশীলার মনে পড়ে। চালাকও হয়েছে সে আজকাল একটু। ভেবেচিন্তে তাই সে বলে, আমি জানতাম।

মাখনের মনে পড়ে সুশীলার আগের ব্যবহার। একটু খাপছাড়া সুরে সে জিজ্ঞাসা করে, জানতে?

জানতাম বৈকি। বড় হবার, টাকা রোজগার করবার ক্ষমতা তোমার ছিল আমি জানতাম। তাই না অত খোঁচাতাম তোমাকে। টের পেয়েছিলাম, নিজেকে তুমি জান না। তাই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমায় মরিয়া করে জিদ জাগালাম–

সত্যি! তোমার জন্যে ছাড়া এত টাকা–ড্রাইভার, আস্তে চালাও।

সুশীলা তখন বলে, কিন্তু যাই বল, দাস সাহেব না থাকলে তোমার কিছুই হত না।

মাখন হাসে, বলে, তা ঠিক, কিন্তু আমি না থাকলেও আর দাস সাহেব ফাঁপত না।

কী ঘুষটাই দিয়েছি শালাকে!

কত কন্ট্রাক্ট দিয়েছে তোমাকে!

এমনি দিয়েছে? এত ঘুষ কে দিত?

গাড়ি চলছে। আস্তে আস্তে গড়িয়ে চলছে। আর একখানা গাড়ি, দামি কিন্তু পুরনো, পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে খানিক এগিয়ে স্পিড কমিয়ে প্রায় থেমে গেল। মাখনের গাড়ি কাছে গেলে পাশাপাশি চলতে লাগল দাস সাহেবের গাড়িটা।

কোথায় চলেছেন?

একটু ঘুরতে বেরিয়েছি।

দাস সাহেবের দৃষ্টি তার মুখে-বুকে-কোমরে চলাফেরা করছে টের পায় সুশীলা। অন্দর থেকে উঁকি দিয়ে বৈঠকখানায় দাস সাহেবকে সে অনেকবার দেখেছে। লজ্জায় তার সর্বাঙ্গ কুঁচকে যায়। এই মহাপুরুষটি তার স্বামীর ট্রামে ঝোলার অবস্থা থেকে এই দামি মোটরে চড়ার অবস্থায় এনেছেন। শ্বশুর-ভাশুর ইত্যাদি গুরুজনের চেয়েও ইনি গুরুজন। ইনি দেবতার শামিল।

আপনার স্ত্রী?

আজ্ঞে।

দাস সাহেবের প্রশ্নের মানে মাখন বোঝে। তার মতো হঠাৎ লাখপতি কয়েকজনকে সে জানে, যারা মোটর হাঁকায় শুধু বাজারের স্ত্রীলোক নিয়ে বাড়ির স্ত্রী বাড়িতেই থাকে।

সুশীলা ভাবে, তাতে আশ্চর্য কী! যে-রকম উনি বুড়িয়ে গেছেন অল্পদিনে! ওঁর কাছে আমাকে নেহাত কচিই দেখায়। দুটি গাড়িই ততক্ষণে থেমেছে। পিছনে অন্য গাড়ির হর্ন শুরু করেছে অভদ্র আওয়াজ।

দাস সাহেব নেমে এ গাড়িতে এসে ওঠে। ড্রাইভারকে বলে দেওয়া হয় এ গাড়ির পিছনে আসতে। দাস সাহেব ভেতরে ঢোকা মাত্র মাখন আর সুশীলা টের পায় এই বিকেলবেলাই সে মদ খেয়েছে।

আপনার স্ত্রীর সঙ্গে তো পরিচয় করিয়ে দেননি?

এই যে দিচ্ছি। শুনছ, ইনি আমাদের মি. দাস।

পরনের বেনারসীর রঙের মতো সুশীলা সলজ্জ ভঙ্গিতে একটু হাসে, নববধূর মতো। বৌয়ের মতোই যে তাকে দেখাচ্ছে সুশীলার তাতে সন্দেহ ছিল না। দাস সাহেব আলাপি লোক, অল্প সময়ে আলাপ জমিয়ে ফেলে। যে চাপা ক্ষোভ শুরু হয়েছিল মাখনের মনে, অল্পে অল্পে তলে তলে তা বাড়তে থাকে। স্ত্রীর সঙ্গে একজন। যখন কোথাও যাচ্ছে, বিনা আহ্বানে কেউ এভাবে গাড়ি চড়াও হয়ে তাদের ঘাড়ে চাপে না–অন্তত তাদের সঙ্গে সাধারণ ভদ্রতা বজায় রাখবার কিছুমাত্র প্রয়োজনও মানুষটা যদি বোধ করে। বার বার এই কথাটাই মাখনের মনে হতে থাকে যে অন্য কেউ হলে তার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করার কথা দাস ভাবতে পারত না।

দাস বলে, চা খেয়েছেন?

সুশীলা বলে, না।

আসুন না আমার ওখানে, চা-টা খাওয়া যাবে।

মাখনের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাস যোগ দেয়, সেই কন্ট্রাক্টের কথাটাও আপনার সঙ্গে আলোচনা করা যাবে। আপনাকে খুঁজছিলাম।

মাখনের দুচোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। সুশীলার নিশ্বাস আটকে যায়। আজ কদিন ধরে মাখন এই কন্ট্রাক্টটা বাগাবার চেষ্টা করছিল–প্রকাণ্ড কন্ট্রাক্ট, লাখ টাকার ওপর ঘরে আসবে। দাস যেন কেমন আমল দিচ্ছিল না তাকে, কথা তুললে এড়িয়ে এড়িয়ে যাচ্ছিল। ঈশ্বরীপ্রসাদকে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করতে দেখে আর তার সঙ্গে দাসের দহরম-মহরম দেখে ব্যাপার অনেকটা অনুমান করে নিয়ে আশা একরকম মাখন ছেড়ে দিয়েছিল। দাস আজ ও-বিষয়েই তার সঙ্গে কথা কইতে চায়। এই দরকারে তাকে দাস খুঁজছিল।

সম্ভ্রান্ত শহরতলিতে দাসের মস্ত বাড়ি। সামনে সম্ভ্রান্ত বাগান। অনেকগুলো চাকর-খানসামা নিয়ে এত বড় বাড়িতে দাস একা থাকে। বিয়ে করেনি, বৌ নেই। আত্মীয়স্বজনের সে সাহায্য করে কিন্তু কাছে রাখে না। শখ হলে মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গ উপভোগ করে দু-চার দিনের জন্য, ছুটি ভোগ করার মতো।

যেই আসুক সাহেব বাড়ি নেই বলে দরজা থেকে বিদায় করে দেবার হুকুম জারি করে দাস তাদের ভেতরে নিয়ে বসায়। ঘরের সাজসজ্জা আর আসবাবপত্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে সুশীলা, নিজেদের বাড়িতে এখানকার কোনো বিশেষত্ব আমদানি করবে মনে মনে স্থির করে। তারপর আসে চা। এ কথা হতে হতে আসে কন্ট্রাক্টের। কথা। সুশীলার সামনেই আলোচনা চলতে থাকে, গভীর আগ্রহের সঙ্গে সে সব কথা শোনবার ও বোঝবার চেষ্টা করে, উত্তেজনায় তার বুকের মধ্যে টিপটিপ করে। মাখনের সঙ্গে আলোচনা আরম্ভ হবার পর সুশীলার দিকে দাসের বিশেষ মনোযোগ দেখা যায় না, কথাতেই তাকে মশগুল মনে হয়। বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ঘরে আলো জ্বলে স্নিগ্ধ।

তারপর দাস বলে, হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলা দরকার। বসুন, ফোন করে আসছি।

ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে সুশীলার দিকে চেয়ে হেসে বলে, খালি কাজের কথা বলছি, রাগ করবেন না।

সুশীলা তাড়াতাড়ি বলে, না, না।

দাস চলে গেলে চাপা গলায় সুশীলা বলে, সোয়া লক্ষের মতো হবে!

বেশিও হতে পারে।

ফেরবার পথে কালীঘাটে পুজো দিয়ে বাড়ি যাব। গলা বুজে আসে সুশীলার।

খানিক পরে ফিরে আসে দাস।

মাখনবাবু!

আজ্ঞে?

হাওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বললাম। আপনাকে গিয়ে একবার কথা বলতে হবে। কাগজপত্রগুলো নিয়ে আপনি এখুনি চলে যান। দুটো সই করিয়ে নিয়ে আসবেন। দাস নিশ্চিন্তভাবে বসে।-আমরা ততক্ষণ গল্প করি। আপনাদের না-খাইয়ে ছাড়ছি না। দাস একটা সিগারেট ধরায়। সুশীলাকে বলে, উনি ঘুরে আসুন, আমরা ততক্ষণ আলাপ জমাই। আর এক কাপ চা খাবেন?

সুশীলা আর মাখন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। পাখা ঘোরবার আওয়াজে ঘরের স্তব্ধতা গমগম করতে থাকে। মাখন সুশীলা দুজনেরই মনে হয় আওয়াজটা হচ্ছে তাদের মাথার মধ্যে-অকথ্য বিশৃঙ্খল উদ্ভট আওয়াজ।

তারপর মাখন বলে, তুমি চা-টা খাও, আমি চট করে ঘুরে আসছি।

সুশীলা ঢোক গিলে বলে, দেরি কোরো না।

না, যাব আর আসব।

গাড়ি রাস্তায় পড়তেই মাখন ড্রাইভারকে বলে, জোরসে চালাও। জোরসে।

রাসের মেলা

আজ রাস পূর্ণিমা। রাসের মেলা বসেছে শহরতলির খালধারের এই রাস্তা আর দু-পাশে যেখানে যেটুকু ফাঁকা ঠাঁই আছে তাই জুড়ে। নামকরা মস্ত মেলা, প্রতিবছর হয়। দোকানপাট বসে অনেক, দূর থেকে বহু লোক আসে কেনাবেচা করতে, অনেকে সারা বছরের দরকারি মাদুর পাটি বঁটি-দা হাতা খুন্তি ঝুড়ি ধামা কুলো ঝাঁটা গেলাস বাটি থালা কেনে এই মেলাতে। মনোহারি কাজের জিনিস ও শখের জিনিস, জামাকাপড়, খেলনা পুতুল, খাবারদাবার এসব যতই কেনাবেচা হোক আসলে গেঁয়ো কারিগরের তৈরি গেরস্তের ওইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের কেনাবেচাটাই মেলার বৈশিষ্ট্য। পাশে ফাঁপতে পারে না, রাস্তা চওড়া কম, একপাশে নর্দমার খাতটা আরো সংকীর্ণ করেছে রাস্তাটাকে মেলা তাই লম্বায় বড় হয়। হরদম লরিগাড়ির চলনে এবড়োখেবড়ো বড় রাস্তাটা খাল ডিঙিয়েছে কংক্রিটের পুলে উঠে। পুলের খানিক এদিকে ডাইনে গেছে মেলার রাস্তা খালের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আধমাইল দূরে রেললাইনের তল দিয়ে উত্তরমুখে সোজা। মেলা বসে রাস্তার এ-মাথা থেকে রেলের পুল ছাড়িয়ে আরো প্রায় পোয়া মাইল দূর তক। মেলা সবচেয়ে জমাট হয় মাঝামাঝি স্থানে, সেখানে ওদিকে আছে রাস্তা থেকে খাল পর্যন্ত অনেকটা ফাঁকা জায়গা, আর এদিকে আছে পাশের রাস্তাটার ফাপালো মোড়। ফাঁকা জায়গায় থাকে নাগরদোলা, পুতুলনাচ আর সার্কাস, মজার খেলা ও নাচগানের তাঁবু! লোক গিজগিজ করে এখানে।

রাস্তা আর খালের মধ্যে টিন-ছাওয়া ছোটবড় গোলা ও আড়ত, মাঝে মাঝে দু-একটি জরাজীর্ণ পুরনো দালান। এখানে যে লাখ লাখ টাকার কারবার চলে, ভাটার সময় খালের কাদা ঠেলে সালতি ছাড়া ছোট নৌকা চলতে না পারলেও এও। বন্দরতুল্য, দেখে তা মনে হয় না–ঠাকুরদাদার জীবদ্দশার শৈথিল্য যেন শুধু মরচে পড়ে মরছে এখানে, আর কিছু নয়! এ পাশের দোকান ও বাড়িঘরগুলো অনেক উন্নত, যেহেতু আধুনিক।

লড়াইয়ের আঁধার বছরগুলোতে মেলা জমেনি। আলো না জ্বালাতে পারলে কি মেলা জমে, দিনে দিনে পাততাড়ি গুটোতে হলে। এ বছর শুধু ওই সাঁঝের বাতি না জ্বালাবার হুকুমটা বাতিল হতেই মেলা জীবন্ত হয়েছে আশ্চর্যরকম। সবাই যেন হা করে অপেক্ষা করছিল লড়াই শেষ হবার জন্য যতটা নয়, লড়াই শেষ হলে সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে মেলা করার জন্য। গায়ে গায়ে ঘেঁসে দোকান বসেছে। তিন পো মাইল রাস্তার যেখানে ঠাঁই মিলিছে সেখানে, ভদ্রলোকের বাড়ির সামনের এক হাত চওড়া রোয়াকটুকু পর্যন্ত ভাড়া নিয়ে। চৌকি পেতে, কাঠের তক্তায় কিংবা স্রেফ বাঁশ দিয়ে মঞ্চ বেঁধে, চাচের বেড়া ও হোগলার চালা তুলে হয়েছে কোনো। দোকান, কারো ছাউনি একখানি কুড়িয়ে আনার মতো মরচে-পড়া ঢেউটিনের, কারো দুখানা রিজেক্ট পিপে, কেটেকুটে হাতুড়ি পিটে সোজা-করা ছাদ, কারো ভোলা। আকাশের নিচে ড্যাম রোদবিষ্টি ড্যাম ফ্যাশনের দোকান–যেন পটারি কারখানার নলভাঙা কেটলি, চটলা-ওঠা হাতলহীন কাপ ইত্যাদির দোকান-দোকানটাই যেন ঘোষণা যে বড়লোক বাবুদের জিনিস, একটু খুঁতওলা জিনিস, তাতে আর কী হয়েছে, এখানে কিনতে পাবে এমন সস্তায় তোমার পয়সায় কুলোয়, এ সুযোগ ছেড়ো না, টিনের মগে চা না খেয়ে বাবুরা যে কাপে খান সেই কাপে, শুধু একটু চটলা-ওঠা হাতলহীন কাপে, চা খাও! আর সত্যি কথা, কাপ-কেটলির দোকানে কী ভিড় মেয়েপুরুষের, চা খাওয়া যাদের নমাসে মাসে সর্দিকাশির ওষুধ হিসেবে, বিয়োনি মেয়ের ব্যথার জোর বাড়িয়ে তাকে রেহাই দেবার টোটকা হিসাবে।

.

খাদু বলে, মেলা নাকি? মেলা? মেলায় তো যামু তবে আইজ!

দত্তগিন্নির গা জ্বলে যায় শুনে,প্রায় দেড় বছর কাজ করছে যে মনমরা খাটুনে ভালো ঝিটা হঠাৎ মেলার নাম শুনেই তাকে আহ্বাদে উল্লাসে ডগমগিয়ে উঠতে দেখে।

মুখ ভার করে বলে, খাদু, কী করে মেলায় যাবি আজ? আমার শরীর ভালো না। উনি আজ একটায় আসবেন, খেয়েদেয়ে উঠে আমায় একটু না পেলে, খোকা। গোলমাল করলে–

দত্তগিনি হেসে ফেলে, বুঝছিস তো খাদু? হপ্তায় একটা দিন দুপুরের ছুটি, তা-ও আধখানা। খোকা কাদাকাটা করলে বড় রাগেন। উনি বিকেলে বেরোবার আগে তো মেলায় তোর যাওয়া হয় না।

অ মা! খাদু বলে অবাক হয়ে, তা ক্যান যামু? বেলা না পড়লেনি কেউ মেলায় যায়!

মেলায় যাবার নামেই যেন বদলে গেছে খাদু। দুর্ভিক্ষের বন্যায় কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকেছে এই শহরে বাবুদের বাড়ি ঝিগিরিতে। কোথায় দেশ গা আপনজন, জানাচেনা অবস্থায় অভ্যাসের ধাচে দিন কাটানোর সুখ আর কোথায় এই বিদেশে খাপছাড়া না-বনা মানুষের ঘরে দাসীপনা, এই দুঃখে সে একেবারে মিইয়ে ছিল। আজ যেন ডাক দিয়েছে আগের জীবন, ছেলেমানুষি ফুর্তি আর। উত্তেজনা জেগেছে। চুলে ভালো করে তেল মেখে স্নান করে খাদু। দত্তগিন্নির সাবানটা একফাঁকে মুখে হাতে ঘষে নেয় একটু। টিনের ছোট তোরঙ্গে তোলা সাফ। থানটি বার করে রাখে। শেমিজটা বড় ময়লা হয়েছিল, স্নানের আগেই সাবান দিয়ে সাফ করে রেখেছে।

একটা কথা ভেবে খাদু একটু দমে যায়। এই ঘটির দেশের মেলা না জানি কেমন হবে! খোকাকে কোলে নিয়ে গিন্নিমার পিছু পিছু একজিবিশনে ঘুরে এসেছে সেদিন, সাজানো গোছানো আলোয় ঝলমলে চোখ ঝলসানো কাণ্ড বটে সেটা, থ বানিয়ে দেয় মানুষকে, কিন্তু মেলার মজা নেই একফোঁটা, প্রাণ ভরে না ঘুরে ঘুরে। ওমনি একজিবিশনকে এদেশে মেলা বলে কি না কে জানে!

বাবু বেরিয়ে যেতে না যেতে শেমিজ কাপড় পরে খাদু বলে, যাই মা?

দত্তগিন্নি মুখ ভার করে বলে, যাবার জন্য তড়পাচ্ছিস দেখি! যা, কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরবি, দেরি করিসনে।

কংক্রিটের পুলটার নিচে মেলার এ মাথায় পৌঁছে খুশিতে হাসি ফোটে খাদুর পুরু ঠোঁটের ফাঁকে মিশিঘষা কালো মজবুত দাঁতে। এ মেলা মেলাই। গরিব গেঁয়ো। মেয়ে-পুরুষের ভিড়, রঙিন কাগজের ঘূর্ণি, ফুল, বাঁশের বাঁশির ফেরিওলা, মাটির ডুগডুগি বেহালা, পুতুল, কাঠের খেলনা, তেলেভাজার দোকান, হোগলার নিচে মাটিতেই যা-কিছু হোক বিছিয়ে পসরা সাজানো–সব আছে! পুলকে কেমন করে ওঠে মনটা খাদুর। হায় গো, কেউ যদি একজন সাথী থাকত তার।

পায়ে পায়ে এগোয় খাদু এদিক-ওদিক চেয়ে চেয়ে থেমে থেমে ঘুরে ঘুরে পিছু ফিরে এপাশ-ওপাশ গিয়ে গিয়ে। কিনবার জন্য, যা-কিছু হোক কিনবার জন্য, মনটা তার নিশপিশ করে। পিঠে সে অনুভব করে আঁচলে-বাঁধা একটা টাকা আর খুচরো এগার আনার চাপ। কোমরের আঁচলের কোণেও বাধা আছে এক টাকার চারটে নোট। জীবনে আর কখনো কোনো মেলায় খাদু এত টাকা-পয়সা নিয়ে যায়নি, তাও আবার সব তার নিজের রোজগারের টাকা-পয়সা। বাপভায়ের কাছে চেয়েচিন্তে, একরকম ভিক্ষে করে কয়েক গণ্ডা পয়সা নিয়ে সে মেলায় যেত, আজ এসেছে নিজের কামানো পাঁচ টাকা এগার আনা নিয়ে! টাকা থাকার মজাটা যেন খেয়ালও করেনি খাদু এতদিন, আজ যেন তার প্রথম মনে পড়ে যে দত্তগিন্নির কাছে তার দেড়-দুবছরের মাইনের অনেক টাকা জমা আছে, দু-এক টাকার বেশি কোনো মাসেই সে নেয়নি। সে কত টাকা হবে কে জানে! টাকার জোরে বুকের জোর যেন বেড়ে যায় খাদুর, আজ মেলায় এসে নিজের পয়সা যেমন খুশি খরচ করতে পারবে খেয়াল হওয়ায়।

সেইসঙ্গে এতদিন পরে একটা ভয় ঢোকে খাদুর মনে। এতকালের মাইনের টাকাগুলো জমা রেখেছে দত্তগিন্নির কাছে, হিসেবও জানে না সে কত টাকা হবে, দত্তগিন্নি যদি তাকে ফাঁকি দেয়, যদি একেবারে না-ই দেয় টাকা? বোকার মতো কাজ করেছে, খাদু ভাবে মাসে মাসে মাইনে চুকিয়ে নিয়ে নিজের কাছে টিনের তোরঙ্গে রাখেনি বলে আফসোস করে খাদু। হায় গো, টাকাগুলো যদি মারা যায় তার।

কী কিনবে ভাবতে ভাবতে সোনার একটা আংটি কিনে বসে খাদু বার আনা দিয়ে। খাঁটি সোনার নয় কিন্তু ঠিক যেন সোনা, কী সুন্দর যে মানিয়েছে তার বা হাতের সেজো আঙুলে। বিয়েতে একটা আসল সোনার আংটি পেয়েছিল খাদু, বছর না ঘুরতে সে আংটি কেড়ে নিয়েছিল বরটা তার, ফিরে দেবে বলেছিল বটে কিন্তু। আরো যে বছরখানেক বেঁচেছিল তার মধ্যে দেয়নি। ও মিছে কথা, বেঁচে থাকলেও দিত না, খাদু জানে। তারপর কতকাল আংটি পরার শখটা খাদু চেপে রেখেছিল, এতদিনে মিটল। কিন্তু না গো, মিটেও যেন মিটল না, প্রথম বয়সের সাধ কি আর মেটে মাঝ বয়সে, নিজে নিজের সাধ মেটালে, কেউ আদর করে কিনে না দিলে।

বজ্জাতেরা তাকায়, গায়ে গা ঘসে যায় ছলে কৌশলে, খানিক আগে থেকেই পিছু নিয়েছে ওই বাবুসাজা লোকটা। ফিনফিনে পাঞ্জাবির নিচে গেঞ্জিটা যেমন স্পষ্ট ওর মতলবও স্পষ্ট তেমনি। খাদু ওসব গায়ে মাখে না, রাগ করে না, বিচলিত হয় না। মেলাতে এ রকম হয়, কতকগুলো লোক এই করতেই আসে মেলায়, মেয়েলোকের গায়ে একটু গা ঠেকিয়ে মজা পেতে, পুরুষ হয়ে চোরের মতো এইটুকু নিয়ে বর্তে যায়– কী ঘেন্না মাগো! আসল বজ্জাত ওই লোকটা যে পিছু নিয়েছে একলা মেয়েলোক দেখে, গুণ্ডা না হলে কেউ কখনো গাড়োয়ানের চেহারা নিয়ে বাবু সাজে। নিক পিছু, ঘুরুক সাথে সাথে। বোকা-হাবা মেয়ে ভেবেছে খাদুকে, টের পাবে ভাব করতে এলে, এই ভিড়ের মাঝে খাদু যখন গলা ছেড়ে শুরু করবে গাল দিয়ে ওর চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে।

পড়ন্ত রোদের মতো তেজ কমে কমে আসে খাদুর আনন্দ ও উত্তেজনার, নিভে যেতে থাকে উন্মাদনা। একা আর কতক্ষণ ভালো লাগে মেলা, কথা কওয়ার কেউ একজন সাথে নেই।

খিদে পায়। এত লোকের মাঝে খেতে লজ্জা করে খাদুর। ভাজা পাঁপড় কিনে আঁচলের তলে লুকিয়ে ফেলে বা হাতে, ডান হাতে এক-এক টুকরো ভেঙে নিয়ে এমনভাবে মুখ দিয়ে চিবোয় যে কেউ টেরও পাবে না পানসুপুরি মুখ দিয়ে চিবোচ্ছে কিছু খাচ্ছে। এমন সময় কাণ্ড দেখ কপালের, খাদু সোজাসুজি সামনে পড়ে যায় দত্তবাবুর।

তাকিয়ে দেখতে দেখতে দত্তবাবু উদাসীনের মতো এগিয়ে যায় পাশ কাটিয়ে, আস্তে আস্তে থামে, ফিরে কাছে গিয়ে বলে, মেলা দেখতে এয়েছিস?

যেন মেলাতে মেলা দেখতে আসেনি খাদু, এসেছে ঘাস কাটতে। তিরিশের ওপরে বয়স হবে দত্তবাবুর, বিয়ের চার বছর পরে জন্মেছে খোকাটি, খোকার তিনবারের জন্মদিন বলে কমাস আগে খাওয়াদাওয়া হল বাড়িতে। টুকটুকে ফরসা রঙের না-মোটা না-রোগা সুন্দর চেহারা দত্তবাবুর, মুখখানা ফ্যাকাশে, চুপসানো। দেখে এমন মায়া হয় খাদুর। গিন্নিমা শুষে শুষে শেষ করে দিয়েছে বাবুকে, টাকার জন্য আপিসে খাঁটিয়ে আর বাড়িতে নিজের রাক্ষুসী হিড়িম্বার খিদে মিটিয়ে। আড়ি পেতে সব শুনেছে, সব জেনেছে খাদু। বৌ-বর খেল দেল শুতে গেল মিলল মিশল ঘুমাল, এই তো নিয়ম জানে খাদু, গিন্নিমা যেন মাগী-মাকড়সার মতো তাতে খুশি নয়, রাত বারটায় শ্রান্তিতে ক্লান্তিতে অবসাদে মর-মর বরটাকে যে করে তোক জাগিয়ে তুলে খাবেই খাবে, বেশি যদি নেতিয়ে পড়ে তো ঝাঁঝিয়ে ঝাঁঝিয়ে বলবে, মেয়েবন্ধু তো গাদা গাদা, কার সাথে কারবার করে এলে আজ যে বিয়ে-করা বৌকে এত অবহেলা?

আড়ি পেতে বাবুর কাতরতা দেখতে দেখতে যেন একশ বিছে কামড়েছে খাদুকে, চিৎকার করে বলতে সাধ গেছে, লাথি মেরে রাক্ষুসীকে বার করে দিয়ে ঘুমো না, কেমন ধারা পুরুষ তুই!

এই ক-আনা পয়সা নে, কিছু কিনিস, দত্তবাবু বলে খানিকটা কাঁচুমাচু ভাবে, আর শোন খাদু, বাড়িতে যেন বলিস না আমায় মেলায় দেখেছিস।

পয়সা পেয়ে খাদু মুচকে হেসে মাথা নাড়ে। দত্তবাবু এগিয়ে গেলে পিছু থেকে জিভের ডগাটুকু বার করে তাকে অবজ্ঞার ভেংচি কাটে। এমনও পুরুষ হয়, বৌয়ের ভয়ে মনখুশিতে মেলায় আসতে ডরায়!

.

মেলার মাঝখানে জমজমাট অংশে আটকে যায় খাদ, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। এইখানেই। মোড়ের মাথায় মন্দিরের বদলে একটা চেপ্টা ঘরের মধ্যে সিঁদুরলেপা দাঁত-খিচানো ভীষণাকৃতি দানবরূপী প্রকাণ্ড দেবতা, খাদু ভক্তিভরে প্রণাম করে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ পুতুলনাচ দেখে, রামায়ণ মহাভারতের রাজা-রানীদের চেয়ে দেখে, তার মজা লাগে শণের দাড়িওলা মুনিগুলো আর হনুমানকে। নুলো খঞ্জ অন্ধ ভিখারিদের দিকে না তাকিয়ে সে দুটি পয়সা দেয় জোয়ানমর্দ ভিখারিকে, কেঁদে কেঁদে ভগবান ভালো করবেন বলার বদলে সে হেঁড়ে গলায় সবাইকে শাসিয়ে ভিক্ষা চাইছে, তাকে না দিলে তুমি মরবে, তোমার সর্বনাশ হবে। অনেক কিছু কেনার এত সাধ নিয়েও ওই আংটি আর একটি আরশি ছাড়া আর কিছুই কেনা হয়নি খাদুর। কিছু কিনতে গেলেই মনে হয়েছে, কার জন্য কিনবে, তার কে আছে, কী কাজে লাগবে তার জিনিসটা। তার ঘর নেই, সংসার নেই, সাজাগোজা নেই, আরামবিরাম নেই। কী করতে সে মেলায় এল, কী সুখটা তার হল মেলায় এসে। আপন মনে এমনভাবে ঘুরে বেড়াতে কি ভালো লাগে মেলায়। এত লোকের হাসি আনন্দ উৎসবের মধ্যে থেকে খোঁচা দিয়ে দিয়ে মনটাতে ব্যস্ততা এনে শুধু খা-খা করানো।

মেয়েছেলেরাও উঠেছে নাগরদোলায়, দুজন চারজনে একসঙ্গে নয়তো পুরুষ সাথীর সঙ্গে, লজ্জাশরম ভুলে আওয়াজ ছাড়ছে অদ্ভুত, দিশেহারা হয়ে আঁকড়ে ধরেছে সাথীকে, খিলখিলিয়ে হাসছে যেন ভূতে-পাওয়ার হাসি। একসঙ্গে ওই ভয় আর ফুর্তি, ওপরে উঠে নিচে নেমে দোল খাওয়ার ওই বিষম মজা আর তীব্র সুখের শিহরণ যে কেমন খাদু কি আর জানে না। সাথী কেউ থাকলে সেও একটু নাগরদোলায় চাপত, অনেকদিন পরে আবার একটু চেখে দেখত কেমন লাগে নিজের ভেতরে ওই শিরশির করা।

কী ভাবো?

মাঝখানে কোথায় সরে গিয়েছিল, আবার পিছু নিয়েছিল লোকটা পুতুলনাচ দেখবার সময়, এখন পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথা কয়েছে। বেঁজে উঠত খাদু সন্দেহ নেই, সে করে উঠে এক নিমিষে টের পাইয়ে দিত বাড়াবাড়ি করতে গেলেই বিষদাঁতে সে ছোবল দেবে। কিন্তু কথা হল কী, লোকটার কথায় তার দেশি টান। দেশগাঁয়ের চেনাজানা কেউ যেন ছদ্মবেশে তাকে এতক্ষণ ঠকিয়ে এবার নিজেকে জানান দিল কথা কয়ে। তাই শুধু মুখটা গোমড়া করে বলতে হয় খাদুকে, কী ভাবুম?

দেইখাই চিনছি দেশের মানুষ তুমি।

চিনছ তো চিনছ।

পাতলা পাঞ্জাবির নিচে শুধু গেঞ্জি নয়, গেঞ্জি-আঁটা চওড়া মোটা শক্ত বুক আর কাঁধ আছে, ঘনকালো কিছু লোম দেখা যায় গেঞ্জির ওপরে। জবরদস্ত গর্দান লোকটার। মুখের চামড়া ক্ষেতমজুরের মতো পুরু আর কর্কশ। দু-এক নজরে দেখে খাদু আবার ভাবে আফসোসের সঙ্গে, চাষাভুষোর এমনধারা বেমানান বাবু সাজা কেন?

দোলায় চাপবা?

না।

ডর নাই, আমারে কোনো ডর নাই তোমার। লোকটা বলে হঠাৎ আবেগের সঙ্গে, পুবের আকাশের যেখানে আড়াল থেকেই পূর্ণিমার চাঁদ ফ্যাকাশে করে রেখেছে। সন্ধ্যাকে সেই দিকে মুখ তুলে চেয়ে থেকে ধীরে ধীরে একটা বিড়ি ধরায়। সিগারেটের প্যাকেটটা বার করেও আবার পকেটে রেখে বিড়িটা বার করে।

তোমারে ভাবছিলাম বাবুগো মাইয়া বুঝি, কথা কইবার চাইয়া ডরাইছি। তবু মনডা কইল কী, না, বাবুগো ঘরের মাইয়ালোক সাহস পাইব কই যে একা আসব মেলায়? কথা কমু ভাবি, ডরাই। শ্যাষে অখনে কইলাম। ডর নাই, আমারে ডর নাই।

ডরে তো মরি। লোকটার কথা শুনে বিষম খটকা লাগে খাদুর মনে। সেও কি তবে বেমানান সাজ করেছে লোকটার মতো খাপছাড়া আর হাস্যকর, চাষাভুষো ঘরের মেয়ে হয়ে বাবুর ব্লাড়ীর বেশ ধরে? ছোট একটা তাঁবুতে পরীর নাচ আর ম্যাজিক দেখাচ্ছে। নাচের নমুনা ধরা হয়েছে সবার সামনে। রোগা-ক্যাংটা কালো কুৎসিত তিনটি মেয়ে মুখ গলা হাতে পুরু করে রং লেপে পায়ে ঘুঙুর বেঁধে তাবুর সামনে ছোট বাঁশের মঞ্চে ভঙ্গি করছে নাচের, গলা ছেড়ে পাঁচমেশালি সুরে গান ধরেছে ভাঙা হারমোনিয়ামের সঙ্গে–একজন ওদের মধ্যে হিজড়ে। মাঝে মাঝে তাবুর সামনের পরদা সরিয়ে দেখানো হচ্ছে যে শুধু এরা নয় আরো অঙ্গরা আছেন ভেতরে, দু আনা-চার আনায় ওই পরীদের মজাদার নাচ দেখার সুযোগ ছেড়ো না, তার সঙ্গে ম্যাজিক, ভাড়ামি। চলা আও, চলা আও–দো দো আনা, চার চার আনা।

আমার পয়সা আমি দিমু কইলাম। গায়ে-পড়া ঝগড়ার সুরে খাদু বলে দু আনা পয়সা বাড়িয়ে দিয়ে। নাচ দেখতে ভেতরে যাবার তাদের মধ্যে কথাও হয়নি তখন পর্যন্ত, তার হয়ে লোকটির টিকিটের পয়সা দেবার কথা দূরে থাক।

দিও, তুমিই পয়সা দিও। লোকটি বলে আমোদ পেয়ে, কিন্তু অ্যানে কী দেখবা? খালি ফাঁকিবাজি, ঠকাইয়া পয়সা নেওনের ফিকির। দেখবা যদি, চীনাগো সার্কাস দেখি গা চলো। খাসা দেখায়, পয়সা দিয়া খুশি হইবা।

দেখি না কী আছে।

সব দেখবে খাদু এবার, ভালোমন্দ যা কিছু দেখার আছে; এত মানুষ ঠকছে সাধ করে, সেও নয় ঠকবে, বিশ্বাসী সাথী যখন পেয়েছে একজন। বিশ্বাস রাখবে কি না শেষ পর্যন্ত ভগবান জানে, কী বিপদ আজ তার অদৃষ্টে আছে তাও জানে ওই পোড়ারমুখো ভগবান, তবে মেলায় কোনোরকম নষ্টামি গুণ্ডামি যে করবে না লোকটা এটুকু খাদু জানে। বুঝদার বিশ্বাসী সাথীর মতোই সে সাথে থাকবে, মনখোলা আলাপী কথায় হাসি-তামাশায় খুশি থাকবে দুজনেই, ভালো লাগবে মেলা দেখা। মতলব যা আছে তা মনেই থাকবে ওর চাপা-পড়া।

ঘেন্না জন্মে যায় সস্তা নাচ, বাজে ম্যাজিক, বগলে লাঠি খুঁচিয়ে কাতুকুতু দেওয়ার মতো ভাড়ামি দেখে। তবু শেষ পর্যন্ত থাকে খাদু, উপভোগও করে। এও মেলারই অঙ্গ জেনে শুনে কত বাজে জিনিস কেনে পয়সা দিয়ে, অন্য সময় যেভাবে পয়সা নষ্ট করার কথা ভাবলেও গা জ্বালা করত, নইলে আর মেলার উন্মাদনা কিসের। নিজের ভিতর উথলাচ্ছে আনন্দ আর উত্তেজনা, তাই দিয়ে ফাঁকিকেও সার্থকতা দেওয়া যায়। মেলায় না হলে একটা পয়সা দিয়েও কি কেউ দেখতে চাইত এসব!

বয়সের পাকামি আছে, সে যাবার নয়, তবে ছেলেবয়সের আবেগপুলকের বন্যাও থইথই করছে মনে। ফাঁকি যাচাই করতে করতেও উৎসুক লোভী মন নিয়ে খুশি। হয়েই খাদু দেখে হিমালয় পারের অজগর সাপ, এক ছেলের দুই মাথা, জন্ম থেকে। জোড়া-লাগা দুই মেয়ে।

অচেনা মানুষের সঙ্গে কথা কয় খাদু, ছেলে কাখে বৌটির সঙ্গে, কুলো আর পাখা হাতে বিধবাটির সঙ্গে একপাল বৌ ছেলে নাতিনাতনি নিয়ে বেসামাল সধবা গিন্নিটির সঙ্গে। দেখা হয় চেনা মানুষের সঙ্গে। সুবলের মা পাড়ার তিন বাড়িতে ঠিকে কাজ করে। চুপি চুপি শুধোয় সুবলের মা, সাথে কে?

দ্যাশের মানুষ, কুটুম। খাদু বলে নির্ভয় নিশ্চিন্তভাবে।

চাঁদ উঠেছে আকাশে, নিচে অসংখ্য আলো জ্বলছে মেলার। একজিবিশনের চোখ ঝলসানো বাড়াবাড়ি আলো নয়, কাছে তেল মোম গ্যাসের শিখা, কোনোটা কাঁচের মধ্যে কোনোটা খোলা, তফাতে জোছনারাতের তারার মতো।

আরো দেখবা?

দেখুম না; চীনা সার্কাস? তুমিই তো কইলা।

চীনা সার্কাসের তাঁবুটা অনেক বড়। চার আনা টিকিটের দাম। লোক টানবার জন্য সামনে খেলার নমুনা দেখানো হচ্ছে এখানেও, ভিন্ন রকম নমুনা। মেয়ে আছে তিনটি, দুজন হলদে রঙের চীনা, একজন কালো রঙের বাঙালি। কালো হলেও ছিরি ছাদ আছে মেয়েটির, রং মেখে ভূতও সাজেনি, সস্তা ঢঙের ভঙ্গিও নেই। চীনা মেয়ে দুটিকে বড়-ছোট বোন মনে হয় খাদুর। পিছু বেঁকে পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে, হাতের ভরে শূন্যে পা তুলে দাঁড়িয়ে, ছোট লোহার চাকার ভেতর দিয়ে কৌশলে গলে গিয়ে ওরা খেলার নমুনা দেখাচ্ছে! আঁটোসাঁটো জোয়ান-বয়সী চীনাটি দুহাতের দুটি ছড়ির ডগায় বসানো প্লেট দুটিকে বন-বন করে ঘোরাচ্ছে। আরেকজন, তাকে ওর ভাই মনে হয় খাদুর, পাঁচ ছটা লোহার শিকের আস্ত চাকা নিয়ে চাকার সঙ্গে চাকা আটকে আবার খুলে ফেলেছে, কী করে কে জানে! ভেতরে গিয়ে খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় খাদু। পাঁচ-ছ বছরের একটা ছেলে, সে দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে মাটি না ছুঁয়ে শূন্যে পাক খেয়ে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াচ্ছে, বড় একজনের মাথায় হাতের ভর দিয়ে শূন্যে পা তুলে দিচ্ছে, এসব দেখে রোমাঞ্চ হয় খাদুর। টেবিলে কাঠের গোলায় বসানো তক্তার দুপাশে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে তক্তা গড়িয়ে গড়িয়ে একটি মেয়ের দোল খাওয়া দেখে সে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে, মেজো চীনা মেয়েটিকে শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে টেবিল ডিঙোতে দেখে, আগুনের চাকার মাঝখান দিয়ে গলে যেতে দেখে সে অভিভূত হয়ে যায়, ভাবে, কত কাল ধরে কী ধৈর্যের সঙ্গে তপস্যা করে না জানি এসব কসরত আর কায়দা ওরা আয়ত্ত করেছে।

খাদু সবচেয়ে অভিভূত হয় ভেবে যে এক সংসারের বাপ ছেলে মেয়ে পুরুষ সবাই মিলে এমন চমৎকার সার্কাস দেখাচ্ছে। ভেতরে ঢুকে দলের সবাইকে দেখার পর এতে আর তার সন্দেহের লেশটুকু নেই। চেহারার মিল নয় না-ই ধরতে পারল সে ওদের, বয়স কখনো সবার খাপ খায় এমনভাবে এক পরিবারের না হলে-বুড়ো একজন বাপ, মাঝবয়সী, জোয়ান, কিশোর আর ছেলেবয়সী এই চার ছেলে; তিন-চার বছর বয়সের ফারাকের দুটি জোয়ান আর ন-দশ বছরের একটি, এই তিন মেয়ে। মা বুঝি নেই ওদের। বৌ মরেছে বুড়ো বেচারার। আহা।

জোয়ান মেয়ে দুটির দুজনেই মেয়ে, না একজন ছেলের বৌ আর একজন মেয়ে কিংবা দুজনেই ছেলের বৌ, এই একটু খটকা থাকে খাদুর। সিঁদুরও দেয় না যে আন্দাজ করে নেবে। কালো মেয়েটা এদের সঙ্গে কেন, সেও আরেক ধাঁধা খাদুর।

আমাগো মাইয়াটা কী করে চীনাগো লগে? সে শুধোয় সঙ্গীকে।

ভাড়া করছে।

এরা নাকি সাধারণত অল্প বয়সে চুরি-করা অথবা অনাথা মেয়ে, সংসারে যাদের দেখবার শুনবার কেউ নেই। বড় হলে কাউকে দিয়ে করানো হয় দেহের ব্যবসা, কেউ শেখে চুরিচামারির কায়দা, কেউ শেখে কসরত। এ মেয়েটা হয়তো ভাড়াও খাটছে, নতুন খেলাও শিখছে চীনাদের কাছে, পরে আরো দাম বাড়বে। অবাক হয়ে শোনে খাদু। বিরাট এ জগৎ সংসার, অদ্ভুত কাণ্ডকারখানার সীমা নেই তাতে। কোথাকার এই বিদেশি পরিবার সার্কাস দেখিয়ে পয়সা রোজগার করছে, কোথায় কার ঘরে জন্মে আজ ওদের সঙ্গে খেলা দেখাচ্ছে এই কালো মেয়েটা। এক দুর্বোধ্য বিস্ময়কর অনুভূতিতে বুকটা তার কেমন করে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে ভাবে, মানুষ কী যে করে সংসারে আর কী যে করে না!

নাগরদোলায় বুক-শিরশির-করা সুখটা তিন-চার পাকের বেশি সয় না খাদুর, কাতর হয়ে বলে, নামুম। থামান যায় না?

যায় না?

জোরে হাঁক দিয়ে নাগরদোলা থামাতে বলে লোকটি, যেন হুকুম দেয়। আর এমন আশ্চর্য, তার হুকুমে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে থামতে আরম্ভ করে দোলা। পাশ থেকে উঠে লোকটি আগে নামতে গেলে খাদুর খেয়াল হয়, লজ্জাশরম ভুলে দুহাতে কীভাবে ওকে সে আঁকড়ে ধরেছে।

ডর করে নাকি?

না। খাদু জোর দিয়ে বলে, গা গুলায়।

মেলায় মানুষ কমতে শুরু করেছে। বিকালে মানুষের জোয়ার এসেছিল, তাতে ধরেছে ভাটার টান। মেলা আর ভালো লাগে না, শ্রান্তি বোধ করে খাদু। মেলায় ছড়ানো নিজেকে এবার গুটিয়ে নিয়ে বিশ্রাম করতে ইচ্ছা হয়। ফিরে গেলে ঘ্যানঘ্যান। করবে দত্তগিন্নি, কৈফিয়ত চাইবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। তারপর দত্তবাবুর বুড়ি মায়ের ঘুপচি ঘরটির মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে শোয়া। সারারাত বুড়ি কাশবে, বার বার উঠবে। ভাবলেও মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায় খাদুর।

কিন্তু বাড়ি সে যে যাবে, বিশ্রাম সে যে করবে, সে তো এতক্ষণের সাথীটি রেহাই দিলে তবেই? এবার সময় হল ওর মতলব হাসিলের। বেশ ভালো করেই জড়িয়ে জড়িয়ে ফাঁদে ফেলেছে তাকে। এতক্ষণ ভুলিয়ে ভালিয়ে বাগিয়েছে, এবার কোন। ভয়ংকর স্থানে নিয়ে যাবে কে জানে, যা খুশি করবে তাকে নিয়ে, হয়তো ছেড়ে দেবে দলের খুনে গুণ্ডাদের হাতে, হয়তো শেষরাতে গলাটা কেটে ফাঁক করে ভাসিয়ে দেবে খালে। বুকটা ঢিপঢিপ করে খাদুর। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে লোকটা কিছুক্ষণ থেকে, বার বার চোখ বুলাচ্ছে তার পা থেকে মাথা অবধি। গায়ে কাঁটা দেয় খাদুর।

যাইগা অখন রাইত হইছে। সে বলে ভয়ে ভয়ে।

যাইবা? রাইত হয় নাই বেশি। ক্ষুব্ধ চিন্তিতভাবে লোকটা খাদুর নতুন ভাবসাব লক্ষ্য করে, চলো যাই, দিয়া আসি তোমারে। কলাপাড়া নন্দ লেন কইলা না?

আমি যাইতে পারুম। ক্ষীণস্বরে খাদু বলে। পারবা না ক্যান?

বাড়িটা চিনা আসুম, বুঝলা না?

বোঝে না? সব বোঝে খাদু। চলুক সাথে, বড় রাস্তা ধরে সে যাবে, রাস্তায় এখন গাড়ি ঘোড়া লোকজনের ভিড়। পাড়ায় গিয়ে নির্জন গলিতে ঢুকবে, কিন্তু পাড়ার মধ্যে তার ভয়টা কী, লোকজন জেগেই আছে সব বাড়িতে এখন।

কী কিনা দিমু কও।

তিণ্যটি না।

তোমার খালি না আর না। লোকটা বলে বেজার হয়ে।

কংক্রিটের পুলের গোড়ায় বড় রাস্তার পাড়ে লোকটা রিকশা ডেকে বসে একটা, খাদুকে চমকে আর ভড়কে দিয়ে।

না, না, রিকশা লাগব না।

লাগব। ধমকে দিয়ে বলে এবার লোকটা, সব কথায় না না কর ক্যান? উইঠা বসো রিকশায়, কও তো হাইটা যামুনে আমি লগে।

খাদু কিছু বলে না, কী আর বলবে। লোকটা তার পাশে উঠে বসে। আংটিপরা হাতে একবার হাত বুলিয়ে দেয়, ধমক দেবার দোষ কাটিয়ে সান্ত্বনা দিতে। ঘেমে জল হয়ে গেছে খাদুর গা তখন, হাত-পা যেন অবশ হয়ে এসেছে।

রিকশা চলে ঘণ্টা বাজিয়ে, চলতে চলতে লোকটা হঠাৎ বলে রিকশাওয়ালাকে, ডাইনে যাও।

না, না, বড় রাস্তায় চলুক।

এইটা রাস্তা না?

রিকশা ঢোকে ডাইনের রাস্তায়। এটা সোজা পথ কলাপাড়া যাবার খাদু জানে, কিন্তু বড় রাস্তা ছেড়ে রিকশা যখন ঢুকেছে এই গলিতে তখনি খাদু জেনেছে কলাপাড়ায় নন্দ লেনে দত্তবাড়িতে আর সে পৌঁছবে কি না সন্দেহ। দু-পাশে ঘিঞ্জি বস্তি, টিন আর খোলার চালে জোছনা, সরু সরু গলিতে অন্ধকার। ওর মধ্যে কোথায় যেন জোরালো হল্লা চলেছে, মেয়েমানুষ গানও গাচ্ছে হারমোনিয়ামের সঙ্গে! এর মধ্যে নিয়ে যাবে কি নোকটা তাকে? এ অঞ্চল পেরিয়ে রিকশা রাস্তায় বাঁক ঘুরলে খাদু একটু স্বস্তি পায়। এ অঞ্চলটা শান্ত, দু-পাশে কাঁচাপাকা বাড়িতে গেরস্ত, আধা-গেরস্তের বাস।

কিন্তু খানিক এগিয়েই লোকটা থামতে বলে রিকশাওয়ালাকে। ঘনিষ্ঠ সুরে বলে, আমার ঘরখানা চিনাইয়া দেই তোমারে, কী কও?

পুরনো একটা পাকা গ্যারেজ ঘর, দরজা এখন তালাবন্ধ। এখানে সে থাকে, রাধে বাড়ে খায়, ঘুমোয়। পাশে গায়ে-গায়ে লাগানো টিনের চাল ও টিনের বেড়ার একটা ঘর, সামনে দোকানের মতো মস্ত দু-পাট কপাট, ওপরে-নিচে দুটো তালা সাঁটা। ওপরে একটা তেরাবাঁকা সাইনবোর্ড, দু-পাশে সাইকেলের দুটো পুরনো টায়ার ঝুলছে। এটা তার সাইকেল মেরামতি দোকানদামোদর সাইকেল ওয়ার্কস।

নাম কই নাই তোমারে? আমার নাম দামোদর।

রিকশার জোয়াল নামিয়ে রিকশাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে তাদের নামবার অপেক্ষায়। শক্ত করে পাশটা চেপে ধরে ঝোঁক ঠেকিয়ে খাদু কাঠ হয়ে বসে থাকে।

নামবা না?

না। তুমি নামো।

চাঁদের আলোয় পথের আলোয় বেশ দেখা যায় মুখে যেন তপ্ত রাগের ছাকা লেগেছে দামোদরের। একহাতে সে খাদুর আংটিপরা হাতের কব্জি চেপে ধরে, এত জোরে ধরে যেন খেয়াল নেই ওটা মেয়েছেলের নরম হাত, হাড় ভেঙে যেতে পারে মট করে, আরেক হাতে সে মুঠো করে ধরে খাদুর বুকের কাপড় শেমিজ।

মারো। আমারে মাইরা ফেলাও। খাদু কেঁদে ফেলে হুস করে, জোরে নয়, চেপেচুপে, কহাত দূরে রিকশাওয়ালাও টের পায় কি না পায়! আগে থেকে সে যেন তৈরি হয়েই ছিল এমনিভাবে কাঁদবার জন্য।

দামোদর ভড়কে গিয়ে বুকের কাপড় হাতের কব্জি ছেড়ে দেয় তৎক্ষণাৎ। থবনে গিয়ে গুম হয়ে থাকে কয়েক লহমা। তারপর রিকশাওয়ালাকে চলতে বলে কলাপাড়ার দিকে।

রিকশাওয়ালা চলতে আরম্ভ করলে খাদুকে বলে, ব্যারাম স্যারাম নি আছে মাথার?

সে রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় পড়ে রিকশা, আবার ইটের রাস্তায় বাঁক নেয় শহরতলির শান্ত নিঝুম উঠতি দ্রপাড়ার এলাকায়। মাঠ, পুকুর বাগানের ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো নতুন বাড়ি, ছোট সীমানায় ঠাসা গরিবের পুরনো বস্তি। শরীর-জুড়ানো হাওয়া বইছে, অবাধে, শোনা যাচ্ছে ঝিঁঝির ডাক, কোনো বাড়ির ছাদ থেকে ভেসে আসা বাঁশির বাবুয়ানি মিহি সুর।

আকাশে মুখ তুলে চাঁদ দেখতে হয় না, চারদিকে চাঁদের আলো চোখের সামনে ছড়ানো।

নন্দ লেনের মোড়ে ঘন তেঁতুলগাছের ছায়া। খাদু দাঁড়াতে বলে রিকশাওয়ালাকে। তোমার লগে দেখলে বাড়ির লোক কী কইব? আমি নামি।

নামো।

খাদু রিকশায় বসে থেকেই হাত বাড়িয়ে দত্তবাবুর বাড়ির হদিস তাকে বাৎলে দেয়, বলে, ডাইনা দিকে তিনখান বাড়ির পরের বাড়িখান, দোতলা বাড়ি। দেইখাই চিনবা।

বাড়ি চিনতে হাঙ্গামা কী। দামোদর বলে উদাস গলায়, নন্দ লেনে দত্তবাবুর বাড়ি খুঁইজা নিতে পারতাম না?

ফুরফুরে হাওয়ায় তেঁতুলগাছের ছায়া ঘেঁষে জোছনায় দাঁড়িয়ে খাদু যেন চোখের সামনে দেখতে পায় দত্তবাড়ির অন্তঃপুর, খোকার কান্নায় স্বামীর পাশে শুতে দেরি হচ্ছে বলে রেগে গজর গজর করে শাপছে তাকে, মাছের মতো মরা চোখে চেয়ে দেখছে ঘুমকাতুরে গাল-চুপসানো দত্তবাবু, নিজের ঘরে চৌকিতে কাথার বিছানায় বসে দত্তবাবুর বুড়ি মা কেশে চলেছে খক খক করে আর মেঝেতে শুয়ে খাদু ঝি এপাশ ওপাশ করছে অজানা কষ্টে। আজ রাতে কব্জিটা টন টন করবে।

হাতটা মুচরাইয়া দিছ একেবারে, ব্যথা জানায়। আহত কব্জি তুলে ধরে খাদু তাতে অন্য হাতের তালু ঘষে আস্তে আস্তে।

ষাইট, সোনা ষাইট। দামোদর বলে ব্যঙ্গ করে, কবিরাজি ত্যাল আইনা লাগাইও, মাথায়ও মাইখো ঘইষা ঘইষা।

লোক আসতে দেখে খাদু তেঁতুলগাছের ছায়ায় পিছিয়ে যায়। রিকশা আর গাছের ছায়ায় তার আবছা মূর্তির দিকে চাইতে চাইতে মানুষটা চলে গেলে এগিয়ে আসে। রিকশাওয়ালা তখন জোয়াল তুলে ধরেছে রিকশার।

আসি গো ঠাইরান। বলে খাদুর কাছে বিদায় নিয়ে দামোদর রিকশাকে বলে, যাও জোরসে চলো। বকশিশ দিমু।

খাদু বলে শোনো, শুনছ? একটা কথা ভাবতেছিলাম।

রিকশা থেকে ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে দেয় দামোদর।

খাদু বলে, তুমি তো বাড়ি চিনা গেলা আমার। কই দিয়া ঘুরাইয়া ফিরাইয়া আনলা আমারে, তোমার ঘর চিনা নিতে পারুম কি না ভাবি।

কী করবা তবে? দামোদর জিজ্ঞাসা করে ভয়ে উৎকণ্ঠায় গলা কাঁপিয়ে।

গিয়া দেইখা চিনা আসুম? খাদু বলে প্রায় অস্ফুট স্বরে। দামোদর স্পষ্ট শুনতে পায় প্রত্যেকটি কথা। রাসপূর্ণিমার বিদ্রি রাত্রি হলেও সেখানে তাদের আশপাশে আর তো কোনো শব্দ ছিল না।

রোমান্স

কলসি কাঁখে পাতলা ছিপছিপে একটি বৌ বেগুনক্ষেতের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কলসির ভারে একটু সে বাঁকা হয়ে পড়েছে। পিতলের প্রকাণ্ড কলসি, মাজা ঘষা চকচকে। বৌটির পরনের কাপড়খানি ভেজা, এখানে ওখানে গায়ে এঁটে গেছে, লটপট করছে। গড়ন পাতলা হলেও স্বাস্থ্য তার খুব ভালো। গায়ে রীতিমতো জোর না থাকলে অতবড় কলসির ভারে কোমর তার মচকে যেতে পারত।

সূর্য এখন প্রায় মাথার উপর। রোদের তাপে পায়েচলা সরু পথটির পাশে ঘাসে-ঢাকা মাটি পর্যন্ত তেতে গেছে। ভিজে গামছা ভাঁজ করে বৌটি মাথায় বসিয়েছে।

বেগুনক্ষেতের পরে ছোটখাটো আম-কাঁঠালের বাগান। গাছে গাছে বাগানটি জমজমাট। কিন্তু কেমন যেন শুকনো নিষ্ফল চেহারা গাছগুলোর, কয়েকটি গাছে শুধু কাঁচাপাকা দু-চারটি আম ঝুলছে। বাগানের ওপাশে টিনের চাল আর দরমার বেড়ার বাড়ি আছে টের পাওয়া যায়, গাছের ফাঁকে ভালো করে চোখ পড়ে না। বাকি তিনদিকে দূর বিস্তৃত মাঠ আর ক্ষেত, এখানে-ওখানে বাড়িঘর গাছপালার ছোট ছোট চাপড়া বসানো। বেগুনক্ষেতের চারদিক নির্জন, দিনে-রাতে সবসময় কারো কারো এখানে কমবেশি গা ছমছম করে।

বেগুনক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পুরনো প্যাঙাসে আলপাকার উর্দি আর কোলবালিশের সরু খোলসের মতো প্যান্টালুন-পরা মাঝবয়সী একটি লোক জোরে জোরে আম-কাঁঠালের বাগানটির দিকে চলছিল। বারবার সে বৌটির দিকে চেয়ে দেখছে। গোঁফদাড়ি চাছা এবং কানের ডগা পর্যন্ত জুলপি তোলা তার লম্বা ফরসাটে মুখ চোখ দুটি বেশ বড় বড়, যদিও ছোট হলেই মানাত বেশি।

বাগানের একটা কাঁঠালগাছের নিচে সে বৌটির পথ আটকাল। পাশ কাটিয়ে যাবার পথ অবশ্য চারদিকে অনেক ছিল। পায়েচলা যে সরুপথটি ধরে বৌটি আসছিল সেটাও কাঁঠালগাছটির হাত তিনেক তফাত দিয়েই গিয়েছে। বৌটি নিজেই সরে তার সামনে আসায় এগোবার আর পথ রইল না।

ওমা, সুবলবাবু যে! পেন্নাম।

এ তোমার কেমন ব্যাভার সুখময়ী?

তোমারই বা এ কেমন ব্যাভার সুবলবাবু, দিনদুপুরে নাগাল ধরা?

দুহাতে কানা ধরে কলসিটা যে নামিয়ে রাখল। সে কাঁখে কলসি ছিল তার উল্টো দিকে বেঁকে বেঁকে সোজা করে নিল কোমরটা। সুবলের ক্রুদ্ধ নালিশভরা দৃষ্টি দেখে একবার সে অপরাধিনীর মতো একটু হাসল। অবহেলার সঙ্গে কাঁধে ফেলা ভিজে আঁচলটি নামিয়ে ধীরে ধীরে ভাঁজ খুলে আবার ভালো করে গায়ে জড়াল।

গোড়ায় তো ডরিয়ে লোম, কোন মুখপোড়া উঁকি মারছে গো? শেষে দেখি মোদের সুবলবাবু। নিশ্চিন্দি হয়ে তখন সাঁতার কেটে চান করলাম। ফিক করে হেসে লজ্জায় মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে বলল, তোমার জন্যে। সত্যি তোমার জন্যে কাল ফিরে যেতে হল তোমার!

সুবল ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, কাল তো প্রথম নয়। ফিরেই তো যাচ্ছি। এলে না কেন কাল? রাতদুপুর তক শিরীষতলায় মশার কামড় খেলাম। মা মনসা না করুন,দুহাত জড়ো হয়ে সুবলের কপালে ঠেকে গেল সাপের কামড়ে মরব একদিন।

সুখময়ী আফসোসের আওয়াজ করল চুকচুক, বালাই ষাট। কিন্তু কী করি, তেনা যে ফিরে এল গো!

একবার জানান দিয়া তো যেতে পারতে, সবাই ঘুমুলে পর? ঘুরঘুটি আঁধারে একটা মানুষ হাঁ করে–

ঘুমিয়ে পড়লাম যে! ওনার সাথে ঝগড়া করে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ঝগড়া হল? বেশ, বেশ! তা ঝগড়াটা হল কী নিয়ে?

সোয়ামির সাথে মেয়েমানুষের আবার কী নিয়ে ঝগড়া হয়? শাড়ি গয়না নিয়ে।

সুবল হঠাৎ উত্তেজিত, উৎসুক হয়ে বলল, তুমি যত শাড়ি গয়না চাও—

ইস? ফতুর হয়ে যাবেন! ছায়ায় চাপা আলো লেগে সুখময়ীর পান-খাওয়া দাঁতের ঘষামাজা অংশগুলোতে ভোতা ঝকমকি খেলে গেল।–

ফতুর নয় হলে। মোর তরে ফতুর হইতে তো চাইছ তুমি হাজারবার। কিন্তু শাউড়ি সোয়ামি যখন শুধোবে মোকে, অ বৌ, শাড়ি গয়না কোথায় পেলি লো, কী জবাব দেব শুনি? বলব নাকি, কুড়িয়ে পেইছি গো, ঘাটের পথে কুড়িয়ে পেইছি? তার চেয়ে এক কাজ করো না? শিরীষতলায় মশার কামড় খেয়ে তোমারও কাজ নেই, শাড়ি গয়না পরে বেড়ালে কেউ যে শুধোবে তাতেও মোর কাজ নেই–এমনি কিছু করো?

সুবলের মুখখানা লম্বাটে হয়ে গেল।–তা জানি, তোর শুধু গয়না শাড়িতে মন।

না গো না, গয়না শাড়ি আমি চাইনে। আমার মনটি তোমার।

তাই যদি হত সুখী—

হত মানে? তুমি ভাবো গয়নার লোভে তোমায় মন দিইছি। কত গয়না দেবে তুমি? কত মুরোদ তোমার? কলকাতায় নিয়ে সেজবাবু সোনায় মুড়ে রানী সাজিয়ে রাখতে চেয়েছিল, তা গিইছি আমি? আমি বলি–না, যাকে মন দিইছি তার সাথেই চুলোয় যাব, চুলোয় যদি যাই।

হু।

বিশ্বেস হয় না, না? বেশ তো, চলো না এখুনি যাই। এক কাপড়ে এখুনি গিয়ে গাড়ি ধরি তিনটের। তুমিও ফকির, আমিও ফকির।

পাতার ফাঁক দিয়ে সুবলের সর্বাঙ্গে চাকাঁচাকা আলো আঁকা হয়ে গেছে। ভিজে গামছা দিয়ে সুখময়ী তার মুখ আর ঘাড়ের ঘাম সযত্নে মুছে দিল। কিন্তু সুবল খুশি হয়েছে মনে হল না, সুখময়ীর কাছ থেকে এ রকম ছোটখাট আদর পাওয়ার বিশেষ দাম যেন নেই, পুরোনো হয়ে গেছে।

অমন যার মন হয় সে একবারটি শিরীষতলায় আসে। কাল নিয়ে চারবার ঠকালে আমায়।

ওগো মাগো, ঠকালাম! আমি তোমায় ঠকালাম! ভেস্তে গেল তো কী করব আমি? হাতপা বাধা মেয়েলোক বৈ তো নই। ঘরের বৌ, পরের দাসী, কী খ্যামতা মোর আছে বলো, তোমায় ঠকাব, তোমার জন্য মরণ হয়েছে আমার? কিছু ভালো লাগে না সুবলবাবু, একদণ্ড ঘরে মনে বসে না। মাইরি বলছি, কালীর দিব্যি। মন করে কী, দূর ছাই, ঘর-সংসার ফেলে তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাই।

বড় একটা ফাঁক দিয়ে এক ঝলক রোদ সুখময়ীর মুখ ঘেঁসে কাঁধ ছুঁয়ে মাটিতে পড়েছে। আবেগ আর উত্তেজনায় এতক্ষণে যেন চোখ দুটি তার সেই আলোতে জ্বলজ্বল করে উঠল। সুবল কথাটি বলে না। উশখুশ করে আর এক পা থেকে ও পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল।

দেশ গা ছেড়ে দূর দেশে পালিয়ে যাই, দেশে কেউ মোদের চিনবে না। সব বালাই চুকিয়ে দুজনে ঘরকন্না করি।

তা হয় না সুখময়ী। চাদ্দিকে বড় নিন্দে হবে, আর ফেরা যাবে না।

কে ফিরছে হেথা? জমি-জায়গা সব বেচে দিয়ে আমায় নিয়ে পালাবে। মোদের ফিরবার দরকার!

মোক্তারি করে দুটো পয়সা পাচ্ছি–

এখানে গাছের ছায়াতে গুমোটে নরম, সুবলের কপাল ঘেমে চোখে এসে পড়তে চায়। আঙুল দিয়ে সে কপালের ঘাম মুছে মুছে ঝেড়ে ফেলতে থাকে। সুখময়ীর ভিজে। চেহারায় ঘাম টের পাওয়া যায় না। আগ্রহ উত্তেজনা ফুরিয়ে গিয়ে সে শান্ত হয়ে গেছে। ঝুঁকে কাপড় তুলে সে একবার হাঁটুর কাছে চুলকে নিল, সোজা হয়ে হাঁটু চুলকানো আঙুলেরই একটার ডগা কামড়ে ধরল। ঘাড় তার কাত হয়ে গেল ভাবনায়।

কলসির কানা ধরে তুলতে গিয়ে সে আবার ঘুরে দাঁড়াল। সুখময়ীর রাগ হয়েছে। কলসি ছেড়ে পাক দিয়ে সোজা হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা তার ফোঁস করে ফণা তুলে সাপের কামড়ে দিতে চাওয়ার মতো। কী মিষ্টি হাসিই সুখময়ী হাসল। আড়চোখে চেয়ে চেয়ে দ্বিধা-সঙ্কোচের ভঙ্গি করে হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে বুক দিয়ে সে সুবলকে গাছের সঙ্গে চেপে ধরল, মুখ উঁচু করল, সুবলের মুখের কাছে কিন্তু পৌঁছল না। গাছে পিঠ দিয়ে সুবল তখন কাঠ হয়ে গেছে।

মোর চেয়ে তোমার মোক্তারি বড় হল?

কত কষ্টে পসার করেছি, দুটো পয়সা পাচ্ছি–

সুখময়ী এতক্ষণে দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরেছে। সুবল নরম হয়ে আসছে।

একটি হাত তার সুখময়ীর পিঠে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।

তুমি না ফতুর হতে পার আমার জন্যে? ঘর বাড়ি জমি জায়গা বেচে ঢের টাকা পাবে, ব্যবসা করে রাজা হয়ে যাবে তুমি! রানীর মতো খাটে শুয়ে আমি হাই তুলব, আর চাকরানী মাগীগুলোকে হুকুম করব। চানের ঘরে তুমি আমার চান দেখবে সত্যি দেখাব, দিব্যি গালছি।

আচ্ছা, তাই যাব সুখময়ী, সব বেচে দিয়ে তোমায় নিয়ে বিদেশে যাব। কিন্তু সে তো দু-চার দিনে হবে না–

মোক্তারি জান বটে তুমি সুবলবাবু। দাঁড়াও আমি আসছি কলসি রেখে।

কাঁখে কলসি তুলতে গিয়ে সুখময়ী আজ বোধ হয় এই প্রথম টলে পড়ে গেল। কলসির জল শুষে নিল মাটি, আর তার ভিজে কাপড় কুড়িয়ে নিল মাটির লাল ধুলো।

অদেষ্টে কত আছে! বলে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভোতা গলায় সে বলল, দাঁড়াও বাবু। একটু সাবুন আনি, নইলে এ মেটে রং ওঠবার নয়। ফের নাইতে হবে।

বাড়ির অঙ্গন শূন্য, ঘরের বাইরে কেউ নেই। বাইরে কেউ থাকেও না এ সময়। সুখময়ী বেঁধেবেড়ে খাইয়েছে সবাইকে, আর কোনো কাজ কারো নেই। রসুইঘরের দাওয়ায় একতাড়া মাজা বাসন। ঘাটে গিয়ে বাসন মেজে এনে তবে তার কলসি নিয়ে নাইতে যাবার ছুটি হয়। কলসি ভরে জলটি আনা চাই। পুবের ঘরে নটবর হুঁকো টানছে, কথা বলছে পাড়ার কানাই ধরের সঙ্গে। শাশুড়ি শুয়েছে, নটবরের বৌ-মরা ভাই তার সঙ্গে পরামর্শ করছে আগামী বিয়ের-জ্যৈষ্ঠ মাসের সাতুই আসতে মাসেক সময় নেই!

বাড়ির কুকুরটা উঠে এসে লেজ নেড়ে অভ্যর্থনা জানাতেই সুখময়ী তাকে একটা লাথি কষিয়ে দিল। আর সেই অবোধ প্রাণীর কেউ কেউ আর্তনাদ শেষ হবার আগেই রসুইঘরের দাওয়ায় বাসনের গাদায় আছড়িয়ে পড়ে শুরু করল নিজের আর্তনাদ–একটু চাপা, একটু অস্বাভাবিক সুরে। ভয়ে তার গা কাঁপছিল।

সবাই ছুটে এল। একসঙ্গে শুধোতে লাগল, কী হয়েছে? বৌকে জড়িয়ে ধরে নটবরের মা জুড়ে দিল কান্না। কুকুরটা তখনো কেউ কেউ করে মরছে! সুখময়ীর বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছিল। কী থেকে কী হবে তা ভগবান জানেন, এই তার শেষ লড়াই।

সুখময়ী কেঁপে কেঁপে কেঁদে বলল, বড় ভয় পেইছি মা। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। কত বলি একলাটি ঘাটে যেতে ডর লাগে, কেউ তো যাবে না সাথে। নইলে কী ওই মুখপোড়া সুবল মোক্তার–

শুনে সবই একসাথে চুপ মেরে গেল। ইতিমধ্যে পাশের দুবাড়ির মেয়ে-পুরুষ ছুটে এসেছিল। তারাও হঠাৎ চুপ হয়ে গেল জন্ম-বোবার মতো। নীরবে মুখ চাওয়াচাওয়ি ছাড়া কী আর করার আছে এমন একটা অসম্পূর্ণ খবর শুনে? নটবরের মার কান্না থেমে গিয়েছিল, প্রথমে অধীর হয়ে শুধোল, কী করেছে সুবল মোক্তার? অ বৌ, বল না কী করেছে সুবল মোক্তার।

বাগানে একলাটি পেয়ে হাত চেপে ধরেছিল গো, কলসি ফেলে পালিয়ে এইছি। ছুটতে ছুটতে আছাড় যা খেইছি কবার–হা দ্যাখো।

হাতের তালু আর কাপড়ে রক্তমাটি ও রক্তের দাগ সে দেখিয়ে দিল। কয়েকজনের চাপা নিশ্বাস পড়ল একটু নিরাশার সঙ্গে, কতবড় সম্ভাবনার এই পরিণতি! শুধু হাত ধরেছিল! দুপুরবেলা জনহীন বাগানে মেয়েমানুষকে নাগালে পেয়ে শুধু হাত ধরেছে সুবল মোক্তার? মামলা মোকদ্দমা হবে না, ব্যাপারটা চাপা পড়ে যাবে আজকালের মধ্যে। এ কি একটা ঘটনা!

তবু সবাই ছি-ছি করে আর সুবল মোক্তারকে গাল দেয়। বাগানে গিয়ে তাকে শাসন করে আসার কথাটা কেউ ভাবেও না, বলেও না। শেষে সুখময়ীকে আঁজ দেখিয়ে বলতে হয়, অ ঠাকুরপো, দাঁড়িয়ে শুধু জটলা করবে তোমরা? যাও না, দু-ঘা দিয়ে এস না বজ্জাতটাকে?

নটবরের মা বলে, চুপ কর মাগী, চুপ কর।

কেন চুপ করব? আমার হাত ধরবে, তোমরা তা চুপ করে সয়ে যাবে!

নটবর বলল, ও শালা কি আর আছে, পালিয়ে গেছে।

থাকতে তো পারে? কলসি আনতে ফিরে যাব ভেবে থাকতে তো পারে ঘুপচি মেরে? যাও না একবার, দেখে এস!

তখন নটবর, শশধর, নিতাই আর পাড়ার একজন সুবলকে খুঁজতে যায়, নটবরের মা চেঁচিয়ে বলে দেয়, কলসিটা আনিস কেউ। শুনছিস কলসিটা আনিস।

সুখময়ীকে ঘিরে মেয়েদের জটলা চলতে থাকে। চারদিকে তারা রটাবে, তবু তারাই বলে যে এমন হইচই করা উচিত হয়নি সুখময়ীর, জানাজানি হওয়া কি ভালো! চুপিচুপি শাউড়ি বা সোয়ামিকে বললেই পারত সে, পুকুরঘাটে যাওয়ার সময় একজন কেউ সঙ্গে যেত। সুখময়ী শুনে যায়, কথা বলে না। নটবরের মার চাপা আফসোস আর গালাগালির জবাবে শুধু ফোঁস করে ওঠে।

সুবলকে পাওয়া গেল কাঁঠালবাগানেই, কিন্তু ধরে মারবার সাহস হল না একজনেরও।

নিতাই নেহাত বদরাগী মানুষ, সে শুধু জিজ্ঞেস করল, বৌ-ঝির হাত ধরে টানা কেন মোক্তারবাবু? সুবল রেগে বলল, তোর তো বড় বাড় বেড়েছে নিতাই, যা মুখে আসে তাই বলিস! শশধর মৃদুভাবে সাবধান করে দিল, আর যেন এসব না ঘটে মোক্তারবাবু।

সুবল আর কথা না বলে হনহন করে এগিয়ে গেল। মুখখানা তার একটু ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সুখময়ী ফুরিয়ে গেল, চিরতরে সরে গেল তার জীবন থেকে। একটু কলঙ্ক তার রটবে–কিন্তু তীব্র অস্বীকারের জোরে সে তা উড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু আবার যদি এমন কিছু ঘটে, দুর্নাম তার জোর পাবে।

বড় একটা মামলা ছিল সুবলের এ সময়, মনটা একেবারে খিঁচড়ে গেল! নাহ, মনটা একটু শক্ত করতে হবে তার। সবে প্র্যাকটিস জমছে। বাকি দিনটুকুতে ছোট মহকুমা শহরের চারিদিকে যে তাদের নামে ঢিঢি পড়ে গেছে, সেটা সুখময়ী টের পেলে সন্ধ্যার পর নটবরের হাতে বাখারি খেয়ে। বাকি দিনটা বাড়ির সকলে মুখ ভার করে থেকেছে, তাকে বাদ দিয়ে করেছে জটলা। বিকেলে আড্ডা দিতে বেরিয়ে সন্ধ্যার পর মুখ অন্ধকার করে নটবর বাড়ি ফিরে এল, গর্জাতে গর্জাতে মা আর ভাইকে জানিয়ে দিল সহরসুদ্ধ লোক কী বলাবলি করছে এবং খবরটা ভালো করে শুনবার আগ্রহে সুখময়ী কাছে এসে দাঁড়াতে সরু একটা বাখারি তুলে তার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। সরু বাখারির বেতের মতো ধার, পিঠ কেটে রক্ত বেরিয়ে গেল সুখময়ীর।

কিন্তু সে তীব্র ব্যথা তার কাছে অতিরিক্ত ঝাল-খাওয়া সুখের মতো লাগল। কলঙ্ক তবে রটেছে! তবে আর এখন কী বাধা রইল সুবলের তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার? এ বদনাম সয়ে সে তো টিকতে পারবে না এখানে। যেতে হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে না কেন?

নটবরের মা বলল, থাক, থাক। মারধর করে কাজ নেই। ও-বৌকে তো আর ঘরে রাখা যাবে না। কাল সকালে খেদিয়ে দিস। মামার বাড়ি যাক, নয়তো চুলোয় যাক।

শুনে একটু ভাবনা হল সুখময়ীর। সত্যি তাকে তাড়িয়ে দেবে নাকি? গালাগালির জন্য সে তৈরি হয়েই ছিল, তার উপর নয় কিছু মারধর হয়েছে। কিন্তু খেদিয়ে দিলে তো মুশকিল! সুবলের যদি বেশিরকম রাগ হয়ে থাকে, তাকে যদি সঙ্গে নিয়ে যেতে না চায়! পুরুষের মন তো, বিগড়ে যেতে কতক্ষণ! তবে তো তার একূল-ওকূল দুকূল যাবে, মাথা গুঁজবার ঠাঁই থাকবে না জগতে। মামা কি ঠাঁই দেবে তাকে? মামারও তো শুনতে বাকি থাকবে না এ কেলেঙ্কারির কথা।

ভাবে আর সুবলের প্রেমে বিশ্বাস হারিয়ে সে পিঠের জ্বালায় কাতরায়। চুলোর ধোঁয়ায় তার চোখ জ্বলে আর ভাতের হাঁড়ির বাষ্পে জগৎ ঝাঁপসা হয়ে যায়। আগুনের আঁচে মাঝে মাঝে শরীরটা শিউরে ওঠে, জ্বর আসবার মতো উদ্ভট শিহরণ। জল ছুঁতে গিয়ে গা ছমছম করে। জ্বর কি একটু এসেছে তাহলে তার? সকলকে ভাত দিয়ে হেঁসেল তুলে খাওয়ার অনিচ্ছা নিয়ে খিদের জ্বালায় কিছু খায়। রসুইঘর বন্ধ করে কুপি হাতে উঠোন পেরিয়ে ঘরের দাওয়ায় কুপিটা নিভিয়ে রেখে ঘরে ঢোকে। চৌকিতে বসে নটবর তামাক টানছে। কাল তাকে খেদিয়ে দেবে নটবর। এতকাল সোহাগ করে কাল তাকে দূর করে দেবে। সুবলের সঙ্গেই পালিয়ে গিয়ে-বা তার তবে কী লাভ হবে? বৌকে যদি মানুষ খেদিয়ে দিতে পারে, দুদিন পরে সুবল কেন তাকে ফেলে পালাবে না?

নটবরকে একটু নরম করার চেষ্টার কথা মনে আসে, কিন্তু সুখময়ী উৎসাহ পায়। রাগ কমিয়ে কতবার সে নটবরের সোহাগ আদায় করেছে, কৌশল তার অজানা নয়, কোনোদিন ব্যর্থও হয়নি। আজ সে মনে জোর পায় না। বাখারির মার খেয়েছে বলে নয়। মার খেলেও মান বাঁচিয়ে সোহাগ যাচা যায়। নিজের উপরেই আজ তার বিশ্বাস নেই। নিজেকে কেমন রূপহীনা, কুৎসিত মনে হচ্ছে। তার যেন কাঠির মতো সরু আর কাঠের মতো শক্ত দেহ। কী দিয়ে সে নটবরকে নরম করবে? তার চেয়ে শুয়ে পড়া ভালো। মাথা ঘুরছে, পিঠ জ্বলছে, শরীর ভেঙে পড়ছে, চুপ করে শুয়ে চোখ বুজে রাতটা কাটানো যাক। সুবল নটবর সকলের ভরসাই যখন তার ফুরিয়ে গেছে, কী আর হবে আকাশপাতাল ভেবে।

চৌকিতে উঠতে তার ভরসা হল না। মেঝেতে মাদুর বিছাতে গেল। তখন কথা কইল নটবর।

দোর দে, হুঁকোটা রাখ।

সুখময়ী দুয়ার বন্ধ করে হুঁকোটা রেখে মাদুরে শুয়ে পড়ল। পিঠে ব্যথা ছিল, মনে। খেয়াল ছিল না, অভ্যাসমতো চিৎ হয়ে শুয়েই মৃদু আর্তনাদ করে সে পাশ ফিরল। চৌকিতে বসে প্রদীপের আলোতে নটবর তাকে খানিক দেখল, পা গুটিয়ে কী অদ্ভুত ভঙ্গিতে বৌটা তার শুয়েছে!

পিঠ ব্যথা হয়েছে নাকি বৌ? গোসা হয়েছে? আর মারব না তোকে। কোন শালা আর তোর গায়ে হাত তোলে!

আমায় কাল তাড়িয়ে দেবে?

দূর পাগলী। ও কথার কথা বলছিলাম। তোকে ছেড়ে কি থাকতে পারি?

সুখময়ী নিজেই স্বামীকে বুকে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত লাগিয়ে চোখ বুজল। মাদুরের ঘষায় পিঠে যেন তার করাত চলতে লাগল অনেকগুলো। একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়ে আবার চেতনা ফিরে এল, তবু সে শব্দ করল না। আর্তনাদগুলো বুকে চেপে, গোঙানিগুলো গলায় আটকে রেখে দিল। নটবর ছেড়ে দেওয়ামাত্র সে পাশ ফিরল। আলো নিভিয়ে চৌকির বিছানায় শোবার সময় কর্তব্যবোধে নটবর বলল, গা যেন তোর গরম দেখলাম, জ্বর হয়েছে নাকি?

একটু হয়েছে।

মেঝেতে কেন তবে? চৌকিতে আয়।

যাই।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত চৌকিতে সে গেল না। আলো নেবার আগে সে দেখেছে, পিঠের রক্তে মাদুর লাল হয়ে গেছে।

নটবর ঘুমিয়ে পড়ল অল্পক্ষণের মধ্যেই। ঘুম গাঢ় হয়ে এলে তার নাক ডাকতে আরম্ভ করল। তখন চুপিচুপি দরজা খুলে সুখময়ী বাইরে বেরিয়ে গেল। রাত বেশি হয়নি, শশধর জেগে আছে। পাড়ার লোকও হয়তো জেগে আছে অনেকে। থাক জেগে! কতক্ষণ লাগবে তার সুবলকে দুটি কথা শুধিয়ে আসতে? বাগান হয়ে বেগুনক্ষেত পার হলেই সুবলের বাড়ি।

ডুবুডুবু চাঁদের জোছনা এখনো একটু আছে। বাগানের গাঢ় অন্ধকার কোনো রকমে পার হলে পথের চিহ্ন নজরে পড়ে। সুখময়ী তরতর করে বেগুনক্ষেতের বেড়া ঘেঁসে এগিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ফেরা চাই, নটবরের ঘুম ভেঙে গেলে যাতে সহজ স্বাভাবিক বিশ্বাসযোগ্য কৈফিয়তটা দেওয়া যায়। সুবলের বাড়ির ঘরে ঘরে আলো নিভেছে। তার ঘরের পাশে গাঁদাফুলের বাগান। একটু তার ফুলের বাগান করার শখ আছে। বাড়ির সামনের বাগানটি তার দেখবার মতো, এখান থেকে নানা ফুলের মেশানো গন্ধ নাকে আসে। প্রথম ডাকেই সাড়া দিয়ে সুবল বেরিয়ে এল।

চুপ। আস্তে! আবার কেন?

দ্যাখো, তোমার জন্যে কী মারটা মেরেছে আমায়।

তোমার জন্যে আমার বদনাম হল সুখময়ী। কত ভালো বলত লোকে আমায়, কত সম্মান করত, তোমার জন্যে সব গেল।

চলো আমরা পালিয়ে যাই দু-চার দিনেই মধ্যে। সব বেচে দাও–

তোমার খালি বাজে কথা। সব বেচে মোক্তারি ফেলে কোথায় যাব?

এত কেলেঙ্কারি হল, চারিদিকে ঢিঢি পড়ে গেল, তবু থাকবে? কী করে থাকবে?

আস্তে আস্তে ভুলে যাবে লোকে।

সুখময়ী আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছিল, সুবল তার হাত চেপে ধরল।

শিগগির ফিরতে হবে।

একটু বসে যাও? বৌ মরে গেছে কবে, এতকাল বিয়ে করিনি তোমার জন্যে। একটু বসে যাও।

সুবলের ঘাট বাঁধানো। মোক্তারির টাকায় সবে ঘাট বাঁধিয়েছে, এখনো কোথাও ফাটল পর্যন্ত ধরেনি। ঘাটের বোয়ামোছা–পরিষ্কার সিমেন্টও সুখময়ীর পিঠের রক্তে লাল হয়ে গেল। সমস্ত ঘাট নয়, সুখময়ীর পিঠের নিচেকার অংশটুকু।

পরদিন নাইতে এসে লোকে বলল, কুকুর বা বিড়াল ছানা বিইয়েছে সেখানে। কিংবা বুনো শেয়াল।

 শিল্পী

সকালে দাওয়ায় বসে মদন সারা গায়ে শীতের রোদের সেঁক খাচ্ছিল, হঠাৎ তার পায়ে খিঁচ ধরল ভীষণভাবে।

একেবারে সাত-সাতটা দিন তাঁত না চালিয়ে হাতে-পায়ে কোমরে পিঠে কেমন আড়ষ্ট মতো বেতো ব্যথা ধরেছিল, তাতে আবার গাঁটে গাঁটে ঝিলিকমারা কামড়ানি। সুতো মেলে না, তাঁত চলে না, বিনা রোগে ব্যারাম ধরার মতো হদ্দ করে ফেলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা ধরাবাধা নড়নচড়ন তাঁত চালানোর কাজে, তার অভাবে শরীরটা মিইয়ে ঝিমিয়ে ব্যথিয়ে ওঠে দুদিনে, ঘুম আসে না, মনটা টনটন করে একধরনের উদাস-করা কষ্টে, সব যেন ফুরিয়ে গেছে। যাত্রা শুনতে গিয়ে নিমাই সন্ন্যাসী হয়ে বেরিয়ে যাবার সময় যেমন লাগে তেমনি ধারা কষ্ট, ঢের বেশি জোরালো আর অফুরন্ত। শরীর মনের ওসব উদ্বেগ সয়ে চুপচাপ থাকে মদন। যা সয় তা সইবে না কেন।

সকালে উঠেই মা গেছে বৌকে সঙ্গে নিয়ে বাবুদের বাড়ি। বাড়ির মেয়েদের ধরবে, বাবুর ছোট মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে দু-একখানা ভালো, মদন তাঁতির নামকরা বিশেষ রকম ভালো কাপড় বুনে দেবার ফরমাশ যদি আদায় করতে পারে। বাবুর বাড়ির বায়না পেলে সুতো অনায়াসে জোগাড় হয়ে যাবে বাবুদের কল্যাণে। বাড়িতে ছিল শুধু মদনের মাসি। তার আবার একটা হাত নুলো, শরীরটি পাকাটির মতো রোগা। মদনের হাউমাউ চিৎকার শুনে সে ছুটে এসে মদনের দুবছরের ছেলেটাকে কোলে নিয়ে, সঙ্গে আসে মাসির চার বছরের মেয়ে। মাসির কি ক্ষমতা আছে একহাতে টেনে খিচ-ধরা পা ঠিক করে দেয় মদনের? মাসিও চেঁচায়। মদনের চিৎকারে ভয় পেয়ে ছেলেমেয়ে দুটো আগেই গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়েছিল।

তখন রাস্তা থেকে ভুবন ঘোষাল এসে ব্যাপারটা বুঝেই গোড়ালির কাছে মদনের পা ধরে কয়েকটা হ্যাচকা টান দেয় আর উরুতে জোরে জোরে থাপড় মারে। যন্ত্রণাটা। সামালের মধ্যে আসে মদনের, মুচড়ে মুচড়ে ভেঙে পড়ার বদলে বশে আনে পা-টা।

বাঁচালেন মোকে।

মুখে শুষতে শুষতে মদন পায়ে হাত ঘসে। খড়ি-ওঠা ফাটা পায়ে হাতের কড়া তালুর ঘষায় শব্দ হয় শোষেরই মতো।

ভুবন পরামর্শ দেয় : উঠে হাঁটো দুপা। সেরে যাবে।

মদন কথা কয় না। এতক্ষণে আশেপাশের বাড়ির কয়েকজন মেয়ে-পুরুষ ছুটে এসে হাজির হয়েছে হুল্লোড় শুনে। শুধু উদি আসেনি প্রায়-লাগাও কুঁড়ে থেকে, কয়েকটা কলাগাছের মোটে ফারাক মদন আর উদির কুঁড়ের মধ্যে। ঘর থেকেই সে তাঁতিপাড়ার মেয়ে-পুরুষের পিত্তি-জ্বালানো মিষ্টি গলায় চেঁচাচ্ছে : কী হল গো? বলি হল কী?

ভুবন রাস্তা থেকে উঠে এলেও এটা জানা কথাই যে উদির কুঁড়ে থেকেই সে ডোবা ঘুরে রাস্তা হয়ে এসেছে। উদিই হয়তো তাড়া দিয়ে পাঠিয়েছে তাকে। সাত দিন তাঁত বন্ধ মদনের, বৌটা তার ন-মাস পোয়াতি, না খেয়ে তার ঘরে পাছে কেউ মরে যায় উদির এই ভাবনা হয়েছে, জানা গেছে কাল। কিছু চাল আর ডাল সে চুপিচুপি দিয়েছে কাল মদনের বৌকে, চুপিচুপি শুধিয়েছে মদনের মতিগতির কথা, সবার মতো মজুরি নিয়ে সাধারণ কাপড় বুনতে মন হয়েছে কি না মদনের। কেঁদে উদিকে বলেছে মদনের বৌ, না, একগুঁয়েমি তার কাটেনি।

পাড়ার যারা ছুটে এসেছিল, ভুবনকে এখানে দেখে মুখের ভাব তাদের স্পষ্টই বদলে যায়। ইতিমধ্যে পিসি পিঁড়ি এনে বসতে দিয়েছিল ভুবনকে। বার বার সবাই তাকায় মদন আর ভুবনের দিকে দুচোখে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা নিয়ে। সেও কি শেষে ভুবনের ব্যবস্থা মেনে নিল, রাজি হল প্রায় বেগার-খাটা মজুরি নিয়ে সস্তা ধুতিশাড়ি গামছা বুনে দিতে? মদন অস্বস্তি বোধ করে। মুখের খোঁচা খোঁচা গোঁফদাড়ি মুছে ফেলে হাতের চেটোতে।

সবার নিঃশব্দ জিজ্ঞাসার জবাবেই যেন বুড়ো ভোলাকে শুনিয়ে সে বলে, পায়ে খিঁচ ধরল হঠাৎ। সে কী যন্ত্রণা, বাপ, একদম যেন মৃত্যুযন্ত্রণা, মরি আর কি। উনি ছুটে এসে টেনে-টুনে ঠিক করে দিলেন পা-টা, বাঁচালেন মোকে।

গগন তাঁতির বেঁটে মোটা বৌ অদ্ভুত আওয়াজ করে বলে, অ! কাছেই ছিলেন তা এলেন ভালো তাইতো বলি মোরা।

তাঁত না চালিয়ে গা-টা ঠিক নেই। তাড়াতাড়ি বলে মদন। গগন তাঁতির বৌয়ের মুখকে তার বড় ভয়।

বৃন্দাবন দাঁড়িয়েছিল পিছনে, অপরাধীর মতো। তার কুঁড়েও মদনের ঘরের প্রায় লাগাও–উত্তরে একটা আমগাছের ওপাশে, যার দুপাশের ডালপালা দুজনের চালকে প্রায় ছোয়-ছোয়।

বুড়ো ভোলার চেয়ে বৃন্দাবনের বয়স অনেক কম কিন্তু শরীর তার অনেক বেশি জরাজীর্ণ। একটি তার পুরনো জীর্ণ তাঁত, গামছা আর আটহাতি কাপড় শুধু বোনা যায়। তাতে সে আর বসে না, ক্ষমতা নেই। তার বড় ছেলে রসিক তাঁত চালায়। সুতোর অভাবে তাঁতিপাড়ার সমস্ত তাঁত বন্ধ, অভাব ও আতঙ্কে সমস্ত তাঁতিপাড়া থমথম করছে; শুধু তাঁত চলছে কেশবের আর বৃন্দাবনের।

ভুবন অমায়িকভাবে বৃন্দাবনকে জিজ্ঞাসা করে, কখানা গামছা হয়েছে বৃন্দাবন?

বৃন্দাবন যেন চমকে ওঠে। এক পা পিছিয়ে যায়।

জানি না বাবু, মোর ছেলা বলতে পারে।

কেশবকে বলে বোনা হলে যেন পয়সা নিয়ে যায়।

বাঁকা মেরুদণ্ডটা একবার সোজা করবার চেষ্টা করে বৃন্দাবন, অসহায় করুণ দৃষ্টিতে সবার দিকে একবার তাকায়।

ছেলেকে শুধোবেন বাবু। ওসব জানি না কিছু আমি।

পিছু ফিরে ধীরে ধীরে চলে যায় বৃন্দাবন।

গগনের বৌ বলে মুখ বাঁকিয়ে ঝাজের সঙ্গে, আমি কিছু জানি না গো, মোর ছেলা জানে! কত ঢং জানে বুড়ো।

বুড়ো ভোলা বলে, আহা থাম না বুনোর মা। অত কথায় কাজ কী? যন্তনা গেছে না মদন? মোরা তবে যাই।

কেশব গেলেই পয়সা পাবে, গামছা কাপড় বুনে দিলেই পয়সা মেলে, এসব কথা–এসব ইঙ্গিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে তারা ভয় পায়। সব ঘরে রোজগার বন্ধ, উপোস।

ভুবন বলে, তোমার গাঁয়ের তাঁতিরা, জানো মদন, বড় বোকা।

মদন নিজেও সাতপুরুষে তাঁতি। রাগের মাথায় সে ব্যঙ্গই করে বসে, সে কথা বলতে। তাঁতি জাতটাই বোকা।

ভুবন নিজের কথা বলে যায়, সুতো কিনতে পাচ্ছিস না, পাবিও না কিছুকাল। তাঁত বসিয়ে রেখে, নিজে বসে থেকে লাভ কী? মিহিরবাবু সুতো দিচ্ছেন, বুনে দে, যা পাস তাই লাভ। তা নয় সুতো না কিনতে দিলে কাপড়ই বুনবে না, এ কী কথা? তোমার কথা নয় বুঝতে পারি, সস্তা কাপড় বুনবেই না তুমি, কিন্তু ওরা–

পোষায় না ওদের। সুতো কি সবাই কেনে, না কিনতে পারে? আপনি তো জানেন, বেশিরভাগ দাদন-কর্জে তাঁত চালায়। পড়তা রাখে দিবারাত্তির তাঁত চালিয়ে, মুখে রক্ত তুলে। আপনি তাও আদ্দেক করতে চান, পারব কেন মোরা?

নইলে ইদিকে যে পড়তা থাকে না বাপু। কী দরে সুতো কেনা, জান? ভুবন আফসোসের শ্বাস ফেলে, যাক গে, কী করা। কত্তাকে কত বলে তোমাদের জন্য সুতো বরাদ্দ করেছিলাম, তোমরা না মানলে উপায় কী। বুঝি তো সব কিন্তু দিনকাল পড়েছে খারাপ, তাঁত রেখে কোনোমতে টিকে থাকা। নয়তো দু-দিন বাদে তাঁত বেচতে হবে তোমাদের। ভালো সময় যখন আসবে, সুতো মিলবে আবার, তখন। মনে পড়বে এই ভুবন ঘোষালের কথা বলে রাখছি, দেখো মিলিয়ে। তখন আফসোস করবে–আমার কথা শুনলে তাঁতও বজায় থাকত, নিজেরাও টিকতে।

তাঁত বাধা দিতে বেচতে হলে মিহিরবাবুর হয়ে ভুবনই কিনবে। সেই ভরসাতেই। হয়তো গ্যাঁট হয়ে বসে আছে লোকটা। কিন্তু সে পর্যন্ত কি গড়াবে? তার আগে হয়তো ভুবনের কাছে সুতো নিয়ে বুনতে শুরু করবে তাঁতিরা।

মাসি এসে ঘুরঘুর করে আশপাশ। বামুনের ছেলে পায়ে হাত দিয়েছে মদনের, গড় হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে ভুবনকে যতক্ষণ সে প্রণাম না করছে মাসির মনে স্বস্তি নেই। মদনের বুঝি খেয়াল হয়নি, ভুলে গেছে। মদনের পা দুটো টান হয়ে ভুবনের পিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলে মাসির আর ধৈর্য থাকে না। মদনের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে প্রণামের কথাটা মনে করিয়ে দেয়।

মদন একেবারে খিঁচড়ে ওঠে, মেয়েটাকে নেয় না কোলে, কেঁদে মরছে। মরগে না হেথা থেকে যেথা মরবি!

ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে মাসি পালায়। মদনের এ মেজাজ চেনে মাসি। মেয়ে কাঁদছে বলে বকুনি মিছে, ওটা ছুতো। ছেলেপিলে কানের কাছে চেঁচালে মানুষের অশান্তি কেন হবে মাসিও জানে না, মদনও বোঝে না। ছেলেমেয়ের কান্না মদনের কানে লাগে না। তাতের ঠকঠকি, মেয়েদের বকাবকি, ঝিঁঝির ডাকের। মতো। মেজাজটাই বিগড়েছে মদনের। না করুক প্রণাম সে বামুনের ছেলেকে। মদনের ওপর মাসিমার বিশ্বাস খাঁটি। রামায়ণ সে পড়তে পারে সুর করে, তাতের কাজে বাপের নাম সে বজায় রেখেছে, সেরা জিনিস তৈরির বায়না পায় মদন তাঁতি। মদনের মার সঙ্গে কচি বয়সে এ বাড়িতে এসে মাসি শুনেছিল, বাবুদের বাপের আমলে বেনারসী বুনে দেবার বায়না পেয়েছিল মদনের বাপ। বিয়ের সময় জালের মতো ছিষ্টিছাড়া শাড়ি বুনে পরতে দিয়ে তার সঙ্গে যে মশকরা। করেছিল মদনের বাপ সে কথা কোনোদিন ভুলবে না মাসি। আজ আকাল, বায়না আসে না, সুতো মেলে না, তাঁত চলে না, তবু মদন ওঁচা কাপড় বোনে না। ওর জন্য কষ্ট হয় মাসির, ওর বাপের কথা ভেবে। মা বৌ যেন কেমন ব্যাভার করে ওর সঙ্গে।

মদনের বাপ যদি আজ বেঁচে থাকত, মাসি ভাবে। বেঁচে থাকলে সাড়ে চার কুড়ির বেশি বয়স হত তার। মাসি তা ভালো বোঝে না। শুধু শ্রীধরের চেয়ে সে বেশি বুড়ো হয়ে পড়ত ভাবতে মনটা তার মুষড়ে যায়। শ্রীধর তাঁতির বেঁচে থাকার দুর্ভাগ্য দেখে সে নিজেই যে কামনা করে, এবার বুড়োর যাওয়াই ভালো।

না থাক মদনের বাপ। মদন তো আছে।

মদনের মা-বৌ ফিরে আসে গুটি-গুটি, পেটের ভারে মদনের বৌ থপথপ পা ফেলে হাঁটে, হাত-পা তার ফুলছে কদিন থেকে। পরনের জীর্ণ পুরনো শাড়িখানা মদন নিজে বুনে দিয়েছিল তাকে বিয়ের সময়। এখনো পাড়ের বৈচিত্র্য, মিহি বুননের কোমল খাপি উজ্জ্বলতা সব মিলে এমন সুন্দর আছে কাপড়খানা যে অতি বিশ্রীভাবে পরলেও রুক্ষ জটাধা-চুল চোকলা-ওঠা ফাটা চামড়া এসব চিহ্ন না থাকলে বাবুদের বাড়ির মেয়ে মনে করা যেত তাকে।

মদনের মা বিড়বিড় করে বকতে বকতে আসছিল লাঠি ধরে কুঁজো হয়ে, ভুবনের সামনে সে কিছু না বললেই মদন খুশি হত। কিন্তু বুড়ির কি সে কাণ্ডজ্ঞান আছে! সামনে এসেই সে শুরু করে দেয়-মদন তাঁতির এয়োতি বশীকরণ বসন্ত শাড়ির বায়নার কথা শুনেই বাবুর বাড়ির মেয়েদের হাসি-টিটকারি দিয়ে তাদের বিদেয় করার কাহিনী। ওসব কাপড়ের চল আছে নাকি আর, দিদিমারা ঝিরা আর চাষার ঘরের মেয়েরা পরে ওসব শাড়ি।

মদন তাঁতি! মদন তাঁতির কাপড়! বনগাঁয় শ্যাল রাজা মদন তাঁতি!

বলল? বলল ওসব কথা? পা গুটিয়ে সিধে হয়ে বলে মদন; বেড়েছে বাবুরা। অতি বাড় হয়েছে বাবুদের, মরবে এবার।

দাওয়ায় উঠতে টলে পড়বার উপক্রম করে মদনের বৌ। খুঁটি ধরে সামলে নিয়ে ভিতরে চলে যায়, ভেতর থেকে তার উগ্র মন্তব্য আসে : এক পয়সার মুরোদ নেই, গব্বো কত!

ভুবন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, মেয়েরা অমন বলে মদন, ওসব কথায় কান দিতে নেই।

তা বলে, বাবুদের বাড়ির মেয়েরাও বলে, তার মা-বৌও বলে, উদিও বলে। কিন্তু সব মেয়েরা বলে না। এই তাঁতিপাড়ার অনেক মেয়েই বলে না। মদন। তাঁতিকে সামনে খাড়া করিয়ে তারা বরং ঝগড়া করে ঘরের পুরুষদের সঙ্গে। মদনও তাঁত বোনে, তারাও তাঁত বোনে, পায়ের ধুলোর যুগ্যি নয় তারা মদনের। এক আঙুল গোঁফদাড়ির মধ্যে ভাঙা দাঁতের হাসি জাগিয়ে মদন শোনায় ভুবনকে। একটা এঁড়ে তাঁতির তেজ আর নিষ্ঠায় একটু খটকাই যেন লাগে ভুবনের। একটু রাগ একটু হিংসার জ্বালাও যেন হয়। সম্প্রতি মিহিরবাবুর তাঁতের কারবারে জড়িয়ে পড়ার পর সে শুনেছিল এ অঞ্চলের তাঁতি-মহলে একটা কথা চলিত আছে : মদন যখন গামছা বুনবে। গোড়ায় কথাটার মানে ভালো বোঝেনি, পরে টের পেয়েছিল, সূর্য যখন পশ্চিমে উঠবে-এর বদলে ওই কথাটা এদিকের তাঁতিরা ব্যবহার করে। সে জানে, মদন যদি তার কাছ থেকে সুতো নিয়ে কাপড় বুনে দিতে রাজি হয় আজ, কাল তাঁতিপাড়ার বেশিরভাগ লোক ছুটে আসবে তার কাছে সুতোর জন্য। বড় খামখেয়ালি একগুঁয়ে লোকটা, এই রাগে, এই হাসে, হা-হুঁতাশ করে, এই লম্বা-চওড়া কথা কয় যেন রাজা-মহারাজা!

উঠবার সময় ভুবনের মনে হয় ঘর থেকে যেন একটা গোঙানির আওয়াজ কানে এল।

তারপরেই মাসির গলা : ও মদন, দ্যাখসে বৌ কেমন করছে।

ভুবন গিয়ে উদিকে পাঠিয়ে দেয় খবর নিতে। বেলা হয়েছে, তার বেরিয়ে পড়া দরকার, কাজ অনেক। কিন্তু মদনের ঘরর খবরটা না জেনে যেতে পারে না। তেমন একটা বিপদ ঘাড়ে চাপলে মদন হয়তো ভাঙতে পারে। উদির জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে বিরক্ত হয়ে ওঠে। ও চুড়ির বড় বাড়াবাড়ি আছে সব বিষয়ে, খবর আনতে গিয়ে হয়তো সেবা করতেই লেগে গেছে মদনের বৌয়ের। কী হয়েছে মদনের বৌয়ের? কী হতে পারে? গুরুতর কিছু যদি হয়…

উদি ফেরে অনেকক্ষণের পরে। অনেকটা পথ হেঁটে মদনের বৌয়ের শরীরটা কেমন কেমন করছিল, একবার মূৰ্ছা গেছে। মনে হয়েছিল বুঝি ওই পর্যন্তই থাকবে, কিন্তু পরে মনে হচ্ছে প্রসব ব্যথাটাও উঠবে।

প্রসব হতে গেলে মরবে মাগী এবার। একবেলা একমুঠো ভাত পায় তো তিন বেলা উপোস। এমনি চলছে দুমাস। গাল দিয়ে এলাম তাঁতিকে, মরণ হয় না?

আখায় কাঠ খুঁজে নামানো হাঁড়িটা চাপিয়ে দেয়। বেঁটে আঁটো দেহটা পর্যন্ত তার পরিচয় দেয় দুর্জয় রাগের। বসাতে গিয়ে মাটি হাঁড়িটা যে ভাঙে না তাই আশ্চর্য।

এখনো গেলে না যে?

যাব। আলিস্যে লাগছে।

ভাত খাবে, মোর রাধা ভাত? উদি আব্দার জানায়।

ভুবন রেগে বলে, তোর কথা বড় বিচ্ছিরি।

মদন দাওয়ায় এসে বসেছে। উঁকি মেরে দেখে ডোবা ঘুরে রাস্তা হয়ে ভুবন আবার যায়। সকালের পিঁড়িটা সেইখানে পড়ে ছিল, তাতে জাকিয়ে বসে।

কেমন আছে বৌ?

ব্যথা উঠেছে কম। রক্ত ভাঙছে বেশি, ব্যথা তেমন নয়। দুগগা বুড়িকে আনতে গেছে।

মদনের শান্ত নিশ্চিন্ত ভাব দেখে ভুবন রীতিমতো ভড়কে যায়। একটা বিড়ি ধরিয়ে ভাবে, ভেবে মদনকেও একটা বিড়ি দেয়।

মদন বলে হঠাৎ : ভালো কিছু বোনান না, একটু দামি কিছু? সুততা নেই বুঝি?

মনটা খুশি হয়ে ওঠে ভুবনের।

সামান্য আছে। কিন্তু বেনারসী ছাড়া তুমি কি কিছু বুনবে?

বেনারসী? বেনারসী না-বোনা যেন তারই অপরাধ, তারই অধঃপতন এমনি আফসোসের সঙ্গে বলে মদন, বেনারসী জীবনে বুনি নি।

এক ঘণ্টার মধ্যে সুতো এসে পড়ে। ভুবন লোক দিয়ে সুতো পৌঁছে দেয় মদনের ঘরে। সুতো দেখে কান্না আসে মদনের। এই সুতো দিয়ে তাকে ভালো কাপড়, দামি কাপড় বুনে দিতে হবে! এর চেয়ে কেশবের মতো গামছাই নয় সে বুনত, লোকে বলত মদন তাঁতি গামছা বুনেছে দায়ে পড়ে কিন্তু যা-তা ওঁচা কাপড় বোনেনি। সকালে পায়ে যেমন খিচ ধরেছিল তেমনিভাবে কী যেন টেনে ধরে তার বুকের মধ্যে। তাঁকে গোঁজা দাদনের টাকা দুটো যেন ছ্যাকা দিতে থাকে চামড়ায়। কিন্তু এদিকে হাত না চালিয়ে চালিয়ে সর্বাঙ্গে আড়ষ্টমতো ব্যথা, পেটে খিদেটা মরে মরে জাগছে বারবার, বৌটা গোঙাচ্ছে একটানা।

কী করবে মদন তাঁতি?

.

সেদিন রাত্রি যখন গম্ভীর হয়ে এসেছে, শীতের চাঁদের ম্লান আলোয় গা ঘুমিয়ে পড়েছে, চারদিক স্তব্ধ নিঝুম হয়ে আছে, মাঝে মাঝে কাছে ও দূরে কুকুর-শিয়ালের ডাক ছাড়া, মদন তাঁতির তাঁতঘরে শব্দ শুরু হল ঠকাঠক, ঠকাঠক! খুব জোরে তাঁত চালিয়েছে মদন, শব্দ উঠছে জোরে। উদির ঘরে তো বটেই, বৃন্দাবনের ঘরে পর্যন্ত। শব্দ পৌঁছতে থাকে তার তাঁত চালানোর।

ভুবন বলে আশ্চর্য হয়ে, এর মধ্যে তাঁত চাপাল? একা মানুষ কখন ঠিক করল সব?

উদিও অবাক হয়ে গিয়েছিল–ও খাঁটি গুণী লোক, ও সব পারে। সে বলে ভয়ে ও বিস্ময়ে কান পেতে থাকে।

বুড়ো বৃন্দাবন ছেলেকে ডেকে বলে, মদন তাঁত চালায় নাকি রে?

তা ছাড়া কী আর? কেশব জবাব দেয় ঝাজের সঙ্গে, রাতদুকুরে চুপে চুপে তাঁত চালাচ্ছেন, ঘাট শুধু মোদের বেলা।

ভুবনের সুতো না হতে পারে।

কার সুতো তবে? কার আছে সুতো ভুবন ছাড়া শুনি?

মদনের তাঁত কখন থেমেছিল উদি জানে না। ভোরে ঘুম ভেঙেই ছুটে যায় মদনের কাছে। মদনকে ডেকে তুলে সাগ্রহে বলে, কতটা বুনলে তাঁতি?

আয় দেখবি।

মদন তাকে নিয়ে যায় তাঁতঘরে। ফাঁকা শূন্য তাঁত দেখে থ বনে থাকে উদি। সুতোর বান্ডিল যেমন ছিল তেমনি পড়ে আছে।

সুতো মদন উদির হাতে তুলে দেয়, টাকা দুটোও দেয়। বলে, নিয়ে যা, ফিরে দে গা ভুবনবাবুকে। বলিস, মদন তাঁতি যেদিন গামছা বুনবে–

একটু বেলা হতে তাঁতিপাড়ার অর্ধেক মেয়ে-পুরুষ দল বেঁধে মদনের ঘরের দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ দেখলেই বোঝা যায় তাদের মনের অবস্থা। রোষে ক্ষোভে কারো চোখে জল এসে পড়ার উপক্রম করেছে। গগন তাঁতির বৌটা পর্যন্ত নির্বাক হয়ে গেছে।

বুড়ো ভোলা শুধোয় : ভুবনের ঠেয়ে নাকি সুতো নিয়েছ, মদন? তাঁত চালিয়েছ দুকুররাতে চুপিচুপি?

দেখে এসো তাঁত।

তাঁত চালাওনি রাতে?

চালিয়েছি। খালি তাঁত। তাঁত না চালিয়ে খিচ ধরল পায়ে বাতে, তাই খালি তাঁত চালালাম এটটু। ভুবনের সুতো নিয়ে তাঁত বুনব? বেইমানি করব তোমাদের সাথে কথা দিয়ে? মদন তাঁতি যেদিন কথা খেলাপ করবে

মদন হঠাৎ থেমে যায়।

সখী

সদরের কড়া নড়তে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বিভা বলে, দ্যাখ তো রিনা কে, কাদের চায়।

উপরে নিচে পাঁচ ঘর ভাড়াটে। উপরে তিন, নিচে দুই। বাইরে লোক এলে দরজা খুলে খোঁজ নেবার দায়িত্ব স্বভাবতই নিচের তলার ভাড়াটে তাদের উপর পড়েছে, বিভা এবং কল্যাণীদের। সদর থেকে ভিজে স্যাঁতসেঁতে একরত্তি উঠানটুকু পর্যন্ত সরু

প্যাসেজের এপাশের ঘরটা তাদের, ওপাশেরটা কল্যাণীদের। ভিতরে আরো। একখানা করে ছোট ঘর তারা পেয়েছে–কিন্তু রান্নাঘর মোটে একটি। কল্যাণীরা রান্নাঘরের ভেতরে রাধে, বিভা রাধে বারান্দায়। তবে সুবিধা অসুবিধার হিসাব ধরলে লাভটা কাদের হয়েছে ঠিক করা অসম্ভব। রান্নাঘরখানা খুপচি, আলো-বাতাস খেলে না, উনান ধরলে একেবারে হাড়কাঁপানো দিনগুলো ছাড়া শীতকালেও ভাপসা গরমে বেশ কষ্ট হয়। নিশ্বাস আটকে আসে, মাঝে মাঝে ছুটে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের ফালিটুকুর দিকে মুখ তুলে হাঁপ ছাড়তে হয়। বারান্দায় আবার জায়গা এই এতটুকু, নড়াচড়া করতেও অসুবিধা হয়।

সাধারণত কল্যাণীরাই সদরের কড়া নাড়ায় বেশি সাড়া দেয়–তাড়াতাড়ি বেশ একটু আগ্রহের সঙ্গে দেয়। বিভাদের বা উপরতলার ভাড়াটেদের কাছে লোকজন কদাচিৎ আসে, কল্যাণীরা নিজেরাও সংখ্যায় অনেক বেশি, দেখা করতে বেড়াতে বা কাজে বাইরের লোকও ওদের কাছেই বেশি আসে। অন্য ভাড়াটেদের তুলনায় বাইরের জগতের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ অনেক বেশি।

কল্যাণীরা সম্ভবত রান্নাঘরে খেতে বসেছে বা অন্য কাজে ব্যস্ত আছে, বিভার রান্না খাওয়ার পাট অনেক আগেই চুকে যায়। দু-এক মিনিট দেখে ওদের কাছেই লোক এসেছে ধরে নিয়েও শোয়া রিনাকে তুলে সে খবর নিতে পাঠিয়ে দেয়। এটুকু করতে হয় এক বাড়িতে থাকলে।

ক্ষীণ অস্পষ্ট আশা কি জাগে বিভার মনে যে আজ হয়তো তার কাছেই কেউ এসেছে? কেউ তো একরকম আসেই না, যদিই-বা কেউ আজ এসে থাকে!

একটু পরেই ফ্রক-পরা তিন বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে বিভার সমবয়সী একটি মেয়ে খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।

ভাবতে পেরেছিলি? কেমন চমকে দিয়েছি।

তাকে দেখেই বিভা ধড়মড় করে উঠে বসেছিল, ব্যাকুল ও উৎসুক কণ্ঠে সে বলে, রানী! ইস, কী রোগা হয়ে গেছিস! কী চেহারা হয়েছে তোর?

রানী যেন বেশ একটু ভড়কে যায়, মুখের হাসি খানিকটা মিলিয়ে আসে।

তা যদি বলিস, তুইও তো কম রোগা হসনি। কালো হয়ে গেছিস যে, তোর অমন রং ছিল?

দুই সখী ব্যাকুল ও প্রায় খানিকটা ভীতভাবে পরস্পরের সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে দেখতে থাকে। দুজনেরই ভাঙাচোরা অতীতের প্রতিবিম্ব নিয়ে যেন দুটি আয়নার মতো তারা পরস্পরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন খারাপ হয়ে গেছে চেহারা, এত ময়লা হয়েছে রং, অমন ক্লিষ্ট হয়েছে চোখ? এতখানি উপে গেছে স্বাস্থ্যের জ্যোতি, রূপ-লাবণ্য? প্রতিদিন আয়নার সামনে তারা চুল বাঁধে, মুখে পাউডার, সিঁথিতে সিঁদুর দেয়, নিজেকে রোগা মনে হয়, কখনো একটু আফসোস জাগে। কিন্তু আজ বন্ধুর চেহারা চেয়ে দেখার আগে পর্যন্ত তারা ধরতেও পারেনি কবছরে কী শোচনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে নিজের দেহেও, কীভাবে শুকিয়ে সিটকে গেছে।

আয় রানী বোস। কটি হল?

বিভা রানীর মেয়ের হাত ধরে কোলে টেনে নেয়।

কটি আবার? এই একটি। তোর?

.

কতকাল কেটেছে, কবছর? এই তো সেদিন তাদের বিয়ে হল, যুদ্ধ বাঁধার পর একে একে দুজনেরই। বছর পাঁচেক কেটেছে তাদের শেষ দেখা হবার পর। পাঁচ বছরে একটি মেয়ে হয়ে রানীর সেই আঁটো ছিপছিপে গড়ন, যা দেখে তার প্রতিদিন হিংসা হত, সে গড়ন ভেঙে এমন চাঁচাছোলা প্যাকাটির মতো বেঢপ হয়ে গেছে? কণ্ঠার হাড় উঁকি মারছে, চিবুকের ডৌল বুঝি আর খুঁজলেও মেলে না। অমন মিষ্টি কোমল ফরসা রং জলে-ধোয়া কাটা মাছের মতো কটকটে সাদা হয়ে গেছে। বিভা ভাবে আর উতলা হয়, তার চোখে জল আসে। বিভার দুটি ছেলেই ঘুমোচ্ছিল, ছোটটির দিকে। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে রানী মৃদুস্বরে বলে, ওর কত বয়স হল?

দু-বছর।

দুটি ছেলেই রোগা, ছোটটির পেট বড়, হাতপা কাঠির মতো সরু। ওদিকে দেখতে দেখতে রানী নিজের চেহারার কথা ভুলে গিয়েছিল। আচমকা সে বলে, কী আর করা যাবে, বেঁচেবর্তে যে আছি তাই ঢের। যা দিনকাল পড়েছে।

সত্যি! শেষ করে দেবে।

বিভা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। সে ভুলে গিয়েছিল কী ভয়ংকর দুর্দিনের মধ্যে কী প্রাণান্তকর কষ্টে তারা বেঁচে আছে, ভুলে গিয়েছিল কী অবস্থায় কী খেয়ে কত দুশ্চিন্তা আর আতঙ্ক বুকে নিয়ে তারা দিন কাটায়। ছেলেবেলা থেকে শুনে শুনে আর অস্পষ্ট অনুভব করে মনের মধ্যে যে রহস্যময় ভীতিকর একটা চোরাবালির স্তর গড়ে উঠেছে, যার অতল বিষাদ আর হতাশায় মিছে মায়ার মতো দুদিনের অর্থহীন। লীলাখেলার মতো জীবন যৌবন তলিয়ে যায়, সেটা আজ আলোড়িত হয়ে উঠেছিল। এই তবে জীবনের রীতিনীতি মানুষের বাঁধাধরা অদৃষ্ট যে এত তাড়াতাড়ি তারুণ্য আনন্দ উৎসাহ সব শেষ হয়ে যায়? জীবনের এই চিরন্তন নিয়মেই সে আর বিভা জীবনটা শুরু করতে না করতে মাত্র পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে এমন হয়ে গেছে? রানী তাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে, না, তা নয়! জীবন অত ফাঁকিবাজি নয়, এমন ভঙ্গুর নয় দেহ। শুধু খেতে পরতে না পেয়ে, চিন্তায় ভাবনায় জর্জরিত হয়ে, হাসিখুশি আমোদ-আহ্লাদের অভাবে তাদের এই দশা।

একা এসেছিস রানী?

একা কেন? ঘোড়ায় চেপেই এসেছি, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।

কী আশ্চর্য! তুই কী বল তো? এতক্ষণ বলতে নেই?

অসহায়ভাবে বিভা পরনের কাপড়খানার দিকে তাকায়। রানী একখানা ভালো কাপড় পরে এসেছে, আগেকার দিনের সঞ্চিত তোরঙ্গে তোলা কাপড়ের একখানা, বিয়েবাড়ির মতো বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া কেউ যা পরে না, পরলে মানায়ও না। এ রহস্যের মানে বিভা জানে, তারও একই অবস্থা। আত্মীয়-বন্ধুর বাড়ি যেতে, সিনেমা। দেখতে, বেড়াতে বার হতে সাধারণ রকম ভালো কাপড় যা মানায় তার তোরঙ্গেও আগেকার পাঁচ-সাতখানা ছিল, বাড়িতে পরে পরে সে ভাণ্ডার শেষ হয়েছে। এ দুঃশাসনের শেষে দ্রৌপদীদের কাপড় টানাটানির শেষ নেই।

বিয়ের সময়ের দামি শাড়ি আর ঘরে পরার শাড়ির মাঝামাঝি কিছু নেই, রাখা অসম্ভব। ঘরেও তো উলঙ্গ হয়ে থাকতে পারে না মেয়েমানুষ? ইতিমধ্যে মরিয়া হয়ে চোখ কান বুজে সাধারণ সামাজিকতা রাখার জন্য সাধারণ রকম ভালো দু-একটা কাপড় সে কিনেছে, প্রাণপণে চেষ্টা করেছে এই প্রয়োজন ছাড়া ব্যবহার না করার কিন্তু সম্ভব হয়নি। চব্বিশ ঘণ্টা দেহ ঢাকতে হয়, বাসি কাপড় ছাড়তে হয়, স্নান করে ধুতে হয়, সাবান কেচে ধোপে দিয়ে ধোয়াতে হয়–নিত্যকার এই চলতি প্রয়োজনের দাবি সবচেয়ে কঠোর। তাই ভাবতে হয়েছে, এখনকার মতো পরে কটা দিন চালিয়ে দিই, উপায় কী, ধোপ দিয়ে এনে তুলে রাখব। তুলে রেখেছে কিন্তু বেশি দিন তুলে রাখা যায়নি।

আলনার শাড়ি দু-খানার একটি পরনের খানার মতোই ছেঁড়া, অন্যটি বড় বেশি ময়লা। বাক্স কি খোলা যায়? রানীর স্বামী সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, এখন কি অত সমারোহ করা চলে? হাত বাড়িয়ে সে ময়লা কাপড়খানাই টেনে নেয়।

কল্যাণী অমিয়কে জিজ্ঞাসা করছিল, কাকে চান? কল্যাণী বিভার চেয়ে দশ বছরের বড় হবে, তার বেশি নয়। তার দুটি ছেলেমেয়ে, সংসারে এগারজন লোক। সেই চাপে তার লজ্জাশরম মুষড়ে গেছে। আঁচিয়ে উঠে সদরে মানুষ দেখে এক কাপড়ে সে অনায়াসে তার প্রয়োজন জানতে এসেছে, তার সংকোচ নেই দ্বিধা নেই অস্বস্তি নেই। দাসীর মতো দেখায় না রানীর মতো দেখায়, বাইরের অজানা লোকের। চোখে কেমন লজ্জাকর ঠেকে এ চিন্তার অঙ্কুরও বুঝি আর গজায় না তার মনে, এমন শক্ত অনুর্বর হয়ে গেছে তার মধ্যবিত্তের অভিমান। ২০০

কিন্তু কী ভয়ানক কথা, নিজেও বিভা যে এগিয়ে এসেছে ব্লাউজ না গায়ে দিয়েই! এটা তারও খেয়াল হয়নি। তাড়াতাড়ি ছিঁড়ে যায় বলে দশটা নাগাদ বাড়ির পুরুষরা আপিসে কাজে বেরিয়ে গেলেই সে ব্লাউজ খুলে ফেলে, বিকালে পুরুষদের ফেরার আগে একেবারে গা ধুয়ে আবার গায়ে দেয়। খালি গায়ে থাকাটা কি তারও অভ্যাস হয়ে গেল কল্যাণীর মতোই। দাসী চাকরানি মজুরনির মতোই? কান দুটি গরম হয়ে ওঠে বিভার।

আমাদের এখানে এসেছেন, সে কল্যাণীকে বলে, সেই যে রানীর কথা বলেছি আপনাকে, আমার ছেলেবেলার বন্ধু? তার স্বামী।

আপনার অসুখ নাকি? কল্যাণী বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করে।

অসুখে পড়েছিলাম, এখন সেরে উঠেছি।

কল্যাণী বোধ হয় কথাটা বিশ্বাস করে না, অমিয়র চেহারায় সেরে ওঠার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া সত্যই কঠিন। কোনো রোগ সেরে গেলে এ রকম চেহারা হয় না মানুষের, রোগ বজায় থাকলেই হয়। কালিপড়া চোখে শুধু তার দৃষ্টিটা উজ্জ্বল ঝকঝকে।

ওহ, মনে পড়েছে, কল্যাণী আচমকা বলে, আপনারই গুলি লেগেছিল। কাগজে পড়ে বিভা বলেছিল আপনার কথা।

এত বড় কথাটা ভুলে যাবার জন্য কল্যাণী অপরাধীর মতো হাসে।

অসুখও হয়েছিল। অমিয় বলে।

দশ মিনিটের বেশি অমিয় বসে না। কাজে যাবার পথে সে রানীকে শুধু পৌঁছে দিতে এসেছে। বেচারির গুলিও লেগেছে, সরকারি দপ্তরের চাকরিটিও গেছে। বন্ধুরা একটি কাগজে মোটামুটি একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। ঘটনাচক্রে কাগজটি আবার সরকারবিরোধী, কাগজটাই কবে বন্ধ হয়ে যায় ঠিক নেই।

কিন্তু অমিয়কে বিশেষ শঙ্কিত মনে হল না। বরং কেমন একটা বেপরোয়া ভাব এসেছে। কী জানেন সব উনিশ আর বিশ, সে বিভাকে বলে, ও ছাতার চাকরি থেকেই-বা কী এমন স্বর্গলাভ হচ্ছিল? ঘরে বাইরে চাকরির মর্যাদা রাখতে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। নিজের মনটাও মানে না, যেমন যোক চাকরি তো করি, মাস গেলে মাইনে তো পাই যা হোক, একদম মিনিমাম ভদ্রলোকের স্ট্যান্ডার্ড তো অন্তত রাখতে হবে? সে এক ছুঁচো গেলার অবস্থা, পেটও ভরতে পারি না, না-খেয়ে মরতেও পারি না। এখন শালা বেশ আছি, হয় এসপার নয় ওসপার; ব্যস!

অনায়াসে বিনা দ্বিধা সংকোচে সে বিভার সামনে শালা শব্দটা উচ্চারণ করে। সত্যই করে। কী ছোট লোক হয়ে গেছে শিক্ষিত মার্জিত ভদ্রসন্তান! পাশে কোথায় রেডিওতে মিষ্টি অলস সুরে গান বাজছে, উঠোনে এঁটো বাসনের ঝনঝনানি। কল্যাণীদের বাসনের সঙ্গে দোতলার এঁটো বাসনও উঠোনে এসে জড়ো হচ্ছে। একসঙ্গে ছোট ছেলেমেয়ে কাঁদছে তিনটে অথবা চারটে, সংখ্যাটা ঠিক ধরা যায় না।

উঠে দাঁড়িয়ে অমিয় বলে, আপনার চিঠি পাবার পর থেকে বাড়ি বয়ে এসে ঝগড়া করার জন্য কোমর এঁটে বসেছিল, আমার অসুখের জন্য দেরি হয়ে গেল।

কিসের ঝগড়া?

বলে নি? চিঠিটা পড়ে কেবলি বলত, দেখলে? ছেলেবেলার বন্ধু, কত ভাব ছিল, কাগজে গুলি লাগার খবর পড়ে একটা চিঠি লিখে দায় সেরেছে। কর্তাটিকে পাঠিয়েও তো খবর নিতে পারত?

ওহ! এই ঝগড়া!–বিভা সত্যই ব্ৰিত বোধ করে,–যাব মনে করেছিলাম। ওঁকে তাগিদ দিয়েছি, এক মাসের ওপর যাব যাব করছেন–

কিন্তু যেতে পারেননি। কোটরে বসা চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টিতে সোজা বিভার মুখের দিকে তাকিয়ে দশ মিনিটে গড়া আশ্চর্য অন্তরঙ্গতায় মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অমিয় সহজ সহানুভূতির সায় জানিয়ে বলে, আপিস, ছেলে পড়ানো, বাজার, রেশন, কয়লা, ওষুধ, ডাক্তার-কী করেই-বা পারবেন?

এখনো ছুঁচো গেলার অবস্থা।–বিভা প্রাণ খুলে হাসে।

অমিয় চলে গেলে বিভা সহজভাবে বলে, নে কাপড়টা ছেড়ে হাতপা এলিয়ে বোস, সং সেজে থাকতে হবে না।

সত্য কথা বলতে কী, রানীকে এতক্ষণ সে প্রাণ খুলে গ্রহণ করতে পারেনি, ভিতরে একটা আবিষ্ট ভাব বজায় থেকে গিয়েছিল। খুশি হলেও সে আনন্দে খাদ ছিল। হোক সে ছেলেবেলার সখী, মাঝখানে অনেক ওলটপালট হয়ে গেছে চারদিকে ও তার নিজের জীবনে। কে বলতে পারে তাকে কী রকম দেখবে কল্পনা করে এসেছে রানী, তার কাছে কী রকম ব্যবহার আগে থেকে মনে মনে চেয়ে এসেছে? হয়তো অনেক কিছু অন্য রকম দেখে তার ভালো লাগছে না–হয়তো সে ভুল বুঝছে তার কথা ও ব্যবহার, আরো হয়তো ভুল বুঝবে! এই একখানা আর পাশের আধখানা নিয়ে দেড়খানা ঘরে কত দিকে যে বিষিয়ে গেছে জীবনটা, সে নিজেই কি খানিক খানিক জানে না? রানী এসে দাঁড়ানো মাত্র তার ফ্যাকাশে ম্লান চেহারা দেখে উতলা হওয়ার সঙ্গে প্রাণটা তার ধক করে উঠেছিল বিপদের আশঙ্কায়! তার সখী এসেছে, এককালে দিনে অন্তত একবার যাকে কাছে না পেলে সে অস্থির হয়ে পড়ত, এতদিন পরে সেই সখী এসেছে তার ঘরের দরজায়–আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওকে তো সে অভ্যর্থনা করতে পারবে না, হেসে কেঁদে অনর্গল আবোল-তাবোল কথা যা মনে আসে বলে গিয়ে প্রমাণ দিতে পারবে না সে কৃতার্থ হয়েছে! সে সাধ্য তার নেই, হাজার চেষ্টা করেও বেশিক্ষণ সে আনন্দোচ্ছ্বাস বজায় রাখতে পারবে না, ঝিমিয়ে মিইয়ে তাকে যেতেই হবে। কী ভাববে তখন রানী? কী বিশ্রী অবস্থা সৃষ্টি হবে?

আরো ভেবেছিল : বিকাল পর্যন্ত যদি থাকে, চায়ের সঙ্গে ওকে কী খেতে দেব? ওর মেয়ে যদি দুধ খায়, দুধ কোথায় পাব? শ্রান্তিতে যদি ওর হাই ওঠে, বিছানায় কী পেতে দিয়ে ওকে আমি শুতে দেব?

দশ মিনিটের মধ্যে অমিয় তাদের সখিত্বকে সহজ করে বাস্তবের দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে। বিভার আর কোনো ভয় নেই, ভাবনা নেই, সংকোচও নেই। কারণ, কোনো অভাব, কোনো অব্যবস্থার জন্য রানী তাকে দায়ী করবে না, তার মেয়ে দুধের খিদেয় কাঁদলে সে যদি শুকনো দুটি মুড়ি শুধু তাকে খেতে দেয়, তাতেও নয়! চাঁদরের বদলে ময়লা ন্যাকড়া পেতে দিলেও গা এলিয়ে রানী তাকে গাল দেবে না মনে মনে।

এটুকু অমিয় তাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে।

ময়লা শাড়িখানা পরে রানীও যেন বাঁচে।

একটা পান দে না বিভা?

কোথা পাব পান? ত্যাগ করেছি। মাসে তিন-চার টাকা খরচ–কী হয় পান খেয়ে? একটি লবঙ্গ মুখে দিলে মুখশুদ্ধি হয়। নে। বিভার বাড়ানো হাতে প্ল্যাসটিকের চুড়ি নজর করে রানী হাসে। তুইও ধরেছিস? ভাগ্যে এ ফ্যাশনটা চালু হচ্ছে–সোনা না দেখে লোকে কিছু ভাবে না।

ফ্যাশন কি এমনি চালু হয়? যেমন অবস্থা, তেমন ফ্যাশন। সোনা নেই তোর?

টুকটাক আছে। তোর?

চারগাছা চুড়ি, সরু হারটা আর কানপাশা। ও বছর টাইফয়েডের এক পালা গেল, তারপর আমার কপাল টানল হাসপাতালে। মরবে জেনেও কেন যে পেটে আসে বুঝি না ভাই। আমাকেও প্রায় মেরেছিল, কী যে কষ্ট পেলাম এবার। অথচ দ্যাখ, এ দুটোর বেলা ভালো করে টেরও পাইনি। দিনকাল খারাপ পড়লে কি মানুষের বিয়োনের কষ্টও বাড়ে?

বাড়ে না? খেতে পাবে না, মনে শান্তি থাকবে না, গায়ে পুষ্টি হবে না; বিয়োলেই হল?

দুই সখী অদ্ভুত এক জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে চোখে চোখে তাকায়, দুজনের মনে একসঙ্গে একই অভিজ্ঞতা একই সমস্যা জেগেছে, আজ দুজনের নিরিবিলি দুপুরে কাছাকাছি আসার সুযোগে পরস্পরের কাছে প্রশ্নটা তাদের যাচাই করে নিতেই হবে। জানতে হবে, খাপছাড়া অদ্ভুত একটা ফাঁদে পড়ার যে রহস্যময় ব্যাপারটা নিয়ে যন্ত্রণার অন্ত নেই, সেটা শুধু একজনের বেলাই ঘটেছে না দুজনেরই সমান অবস্থা। বুঝতে হবে কেন এমন হয়, এমন অঘটনের মানে কী?

রানী বলে, বল না? তুই আগে বল।

আগেও ঠিক এমনিভাবেই জীবনের গহন গভীর গোপন রহস্যের কথা উঠত, কেউ একজন মুখ খোলার আগে চোখমুখের ভাবভঙ্গি দেখেই দুজনে টের পেত যে জগতের সমস্ত মানুষের কাছ থেকে আড়াল করা শুধু তাদের দুই সখীর প্রাণের কথা বলাবলি হবে।

বিভা বলে, কিছু বুঝতে পারি না ভাই। এ রকম যাচ্ছেতাই শরীর, কী যে খারাপ লাগে বলার নয়, তবু আমার যেন বেশি করে ভূত চেপেছে। বিয়ের পর দু-এক বছর সবারই পাগলামি আসে; ও বাবা, এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে তখন রীতিমতো সংযমী ছিলাম বলা চলে। আগে ভাবতাম ও বেচারির দোষ, ঝগড়া করে ও-ঘরের ঘুপটির মধ্যে বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। তখন টের পেলাম কী বিপদ, আমারও দেখি মরণ নেই! ঘুম আসবে ছাই, উঠে এসে যদি ডাকে ভেবে কী ছটফটানি আমার। বিশ্বাস করবি? থাকতে না পেরে শেষে নিজেই এলাম।

রানী একটু হাসে, উঠে এসে বললি তো একা শুতে ভয় করছে?

তোরও তবে ওই রকম?–বিভা যেন স্বস্তি পায়।

কী তবে? তোর একরকম আমার অন্যরকম?

দুই সখী আশ্চর্য হয়ে পরস্পরের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

রানী বলে, তবে আমার আজকাল কেটে গেছে, অন্যদিকে মন দিতে হয়। তোরও কেটে যাবে।

একটু ভেবে রানী আবার বলে, আমার মনে হয় এ একটা ব্যারাম। ভালো খেতে না পেলে ভাবনায় চিন্তায় কাহিল হলে এ রকম হয়। ছেলেপিলেকে দেখিস না পেটের ব্যারাম হলে বেশি খাই খাই করে, চুরি করে যা-তা খায়?

চুরি করেও খাস নাকি তুই?

দুই সখী হেসে ওঠে।

সেই এক মুহূর্তের হাসির ক্ষীণ শব্দ সঙ্গে সঙ্গে কোথায় মিলিয়ে যায় শিশুর কান্না বাসন-নাড়ার-শব্দ মেশানো দুপুরের স্তব্ধতায়। শুধু শিশুর কান্না নয়, এ বাড়ির দোতলাতেই মেয়েলি গলায় একজন সুর করে কাঁদছে। উপরতলায় একজন ভাড়াটে রমেশ, তার বুড়ি মা। রমেশের ছোট ভাই অশেষ, সবে কলেজ থেকে বেরিয়ে চাকরির ধান্ধায় ঘুরতে শুরু করেছিল, কদিন আগে টিবি রোগে সে মারা গেছে।

এই সেদিন দেখেছি চলাফেরা করছে, বিভা হঠাৎ শিউরে উঠে বলে, দিনরাত ঘুরে বেড়াত। ওর সঙ্গে তর্ক করত আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি কি না। এই বিছানায় বসে একদিন রাত্রে কথা কইতে কইতে কাশতে শুরু করল, এক ঝলক রক্ত উঠে চাঁদরে পড়ল। কী রকম ভ্যাবাচেকা খেয়ে যে চেয়ে রইল ছেলেটা। আগে একটু আধটু রক্ত পড়েছে গ্রাহ্যও করেনি, সেদিন প্রথম বেশি পড়ল। নিজের শরীরটাকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করে না, কী যে হয়েছে আজকালকার ছেলেরা–

আনমনে কী যেন ভাবে, একটু ম্লান হেসে বলে, প্রথমে ঠিক হয়েছিল চাদরটা পুড়িয়ে ফেলব। কিন্তু তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আবার একটা চাদর কিনতে হয়। শেষ পর্যন্ত তাই–

এ কথাটাও বিভা শেষ পর্যন্ত বলে উঠতে পারে না, আবার আনমনা হয়ে যায়।

কী ভাবি জানিস রানী? শুধু শাক-পাতা আর পচা চালের দুমুঠো ভাত খায়, না একফোঁটা দুধ না একফোঁটা মাছ। এই খেয়ে আপিস করা, রাত ৯টা পর্যন্ত ছেলে পড়ানো। একদিন যদি ওইরকম কথা কইতে কইতে কাশতে শুরু করে আর

এ কথারও শেষটা মুখে উচ্চারণ করা অসম্ভব।

রানী অসম্ভবকে সম্ভব করে যোগ দেয়,রক্তে বিছানা যদি লাল হয়ে যায়? আমিও আগে এ রকম আবোল-তাবোল কত কী ভাবতাম। রক্তে একদিন রাস্তাই লাল হয়ে গেল। আর ভাবি না। কী আছে অত ভয় পাবার, ভাবনা করার? সংসারে কুলি-মজুরও তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে।

সরীসৃপ

চারদিকে বাগান, মাঝখানে প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়ি। জমি কিনিয়া বাড়িটি তৈরি করিতে চারুর শ্বশুরের লাখ টাকার উপর খরচ হইয়াছিল। কিন্তু মোটে তিরিশ হাজার টাকার দেনার দায়ে এই সম্পত্তি চারুর হাত হইতে খসিয়া বনমালীর হাতে। চলিয়া গিয়াছে।

প্রথম বয়সে চারু তার টনটনে বুদ্ধির সাহায্যে শ্বশুরের সম্পত্তির এমন চমৎকার বিলি-ব্যবস্থাই করিয়াছিল যে, আত্মীয়-পর কেহ কোনোদিন কোনো দিক দিয়া তাহার একটি পয়সা অপচয় করিতে পারে নাই। কিন্তু বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা ও বিকারহীনতা বজায় রাখিতে চারুর তিনটি বিশেষ অসুবিধা ছিল। প্রথমত, আজীবন। তাহাকে স্ত্রীলোক হইয়াই থাকিতে হইল। দ্বিতীয়ত, তাহার আধপাগলা স্বামী বিশ বছরের মধ্যে একদিনও প্রাণত্যাগ করিল না, অথচ এই বিশ বছরে প্রত্যেকটি মুহূর্ত বেশ ভালোমানুষের মতোই স্ত্রীর চরিত্রে ভয়ঙ্কর সন্দিহান হইয়া রহিল। তৃতীয়ত, বয়স বাড়ার সঙ্গে চারুর একমাত্র পুত্রটিরও স্বাভাবিক বুদ্ধি বিকাশ পাইবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

.

শেষ জীবনে শ্রান্ত ক্লান্ত ভীরুতাগ্রস্ত চারু তাই সম্পত্তির সুব্যবস্থার নামে নানা রকম মজা করিতে লাগিল। যেদিকে ক্ষতির সম্ভাবনা নাই সেদিকে সে তার অতি-সাবধানী দৃষ্টিকে ব্যাপৃত রাখিল। আর যেদিকে সর্বনাশের পথ খোলা রহিল সেদিকটা লাভ করিল তাহার উদাসীনতা; যাহাকে বিশ্বাস করার কথা, তাহাকে সে করিল একান্ত ভাবে অবিশ্বাস, আর যাহাকে জেলে দিয়া নিজেকে বাঁচানোই ছিল উচিত তাহার মতো বিশ্বাসী লোক সংসারে সে আর দেখিতে পাইল না।

ফলে চারুর যাহা রহিল তাহার নাম কিছুই-না-থাকা।

কোনো লাভ হোক বা না হোক সকলের সঙ্গে শুধু গায়ের জ্বালাতেই বিবাদ করিয়া তবে চারু হার মানিয়াছিল। বনমালীর সঙ্গে সে লড়াই করিল, কিন্তু বিবাদ করিল না।

চারুর বিবাহ হয় সতের বৎসর বয়সে। বনমালী তখন পনের বৎসরের বালক মাত্র। চারুর শ্বশুর রামতারণ প্রত্যেক শনিবার ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে একটা বাগানবাড়িতে স্ফুর্তি করিতে যাইত। বনমালীর বাবা ছিল তাহার প্রতিবেশী, বন্ধু এবং মোসাহেব। তাহাদের ছোট দ্বিতল গৃহের সামনে মোটর থামাইয়া রামতারণ বনমালীর বাবাকে মোটরে তুলিয়া লইত। বনমালীকে হাসিয়া বলিত, বৌমাকে পাহারা দিস বুনো।

হাসিয়া বলিলেও কথাটা পরিহাস নয়। নিজের পাগল ছেলের বৌ বলিয়া নয়, স্ত্রী-জাতির সতীত্বেই রামতারণ অবিশ্বাস করিত। কোথাও যাওয়ার আগে সে তাই বাড়িতে পাহারা রাখিয়া যাইত। কিন্তু রামতারণের বুদ্ধি ছিল। চারুর দাসীকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া ব্যাপারটা প্রকাশ্য করিয়া দিবার ইচ্ছা তাহার ছিল না। মোসাহেবের সরল ছেলেটাকে সে তাই বাড়িতে রাখিয়া যাইত এবং ফিরিয়া আসিয়া নানা কৌশলে নিজের অনুপস্থিতির সময়ে চারুর গতিবিধির ইতিহাস জানিয়া লইত। বনমালীর বাবা সবই বুঝিত কিন্তু কিছু বলিত না। হাসিত এবং কর্তব্যে অবহেলা করিয়া রামতারণের বাড়ি ছাড়িয়া মার জন্য মন-কেমন করায় বনমালী নিজের বাড়ি চলিয়া আসিয়াছিল জানিতে পারিলে আচ্ছা করিয়া তাহার কান মলিয়া দিত।

চারুও বুঝিত। কিন্তু অবুঝের মতো তাহার রাগটা বনমালীর উপরে গিয়া পড়িত। বনমালীকে সে যত্ন করিয়া খাওয়াইত, সারাদিন তাহার সঙ্গে গল্প করিত এবং রাত্রে নিজের শোবার ঘরের পাশের ঘরখানায় তাহাকে বিছানা করিয়া দিয়া মাঝখানের দরজাটা খোলা রাখিয়া দিত। স্বামী গোলমাল করিলে সভয়ে বলিত, চুপ। চুপ! বাবার হুকুম। এবং রামতারণকে তাহার ছেলে এমনি যমের মতো ভয় করিত যে আর কথাটি না কহিয়া সে শান্ত শিশুর মতো ঘুমাইয়া পড়িত।

কয়েক বৎসর পরে রামতারণের মৃত্যুর পর ব্যবস্থা রহিত হইয়া গেল বটে কিন্তু বনমালীর যাতায়াত বজায় রহিল। যাতায়াত সে কমাইয়া ফেলিল অনেক বয়সে, শহরের ভিতরে একটা বাড়ি করিয়া উঠিয়া যাইবার পর।

আজ বিপদে পড়িয়া বনমালীকে অতিরিক্ত খাতির করিয়া কোনো সুবিধা আদায় করিবার চেষ্টার মধ্যে নানা কারণে চারুর যথেষ্ট লজ্জা ও অপমান ছিল। তবু একদিন নিমন্ত্রণ করিয়া পাখা হাতে কাছে বসিয়া এমনি উত্তপ্ত সমাদরের সঙ্গেই বনমালীকে সে খাওয়াইতে বসাইল যে তাহাতে পাষাণও গলিয়া জল হইয়া যায়।

বলিল, ভগবান সুবুদ্ধি দিয়েছিলেন তাই বাগানবাড়ি তোমার কাছে বাঁধা রাখবার কথা মনে হয়েছিল, ভাই। আমার সর্বস্ব গেছে, যাক, কী আর করব;–সবই মানুষের কপাল। মাথা গুঁজবার ঠাঁইটুকু যে রইল, এই আমার ঢের।

বনমালী একবার মুখ তুলিয়া চাহিল মাত্র। চারুর মাথার চুলের কালিমা ফ্যাকাশে হইয়া আসিয়াছে কেবল এইটুকু লক্ষ্য করিয়া আবার সে আহারে মন দিল।

আসল ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এইবার একটু মিঠা কথা বলা প্রয়োজন বোধ করিয়া চারু বলিল,-নিরামিষ কপির ডালনা তোমার বোধ হয় ভালো লাগছে না, ভাই?

বেশ লাগছে।

চারুর ছোট বোন পরী এক মাসের ছেলে-কোলে কাছে বসিয়া ছিল। এতক্ষণ কথা বলিতে না পারিয়া তার ভালো লাগিতেছিল না। এইবার সুযোগ পাইয়া বলিল, এটা কিন্তু আপনি ভদ্রতা করে বললেন, বনমালীদাদা। ডালনা নিশ্চয় ভালো হয়নি। দিদিকে কত বললাম, আমি রাঁধি দিদি, আমি রাঁধি, দিদি কি কিছুতেই আমাকে রাঁধতে দিলে!

চারু মনে মনে বিরক্ত হইয়া বলিল, না বেঁধেছিস বেশ করেছিস বাপু। ওইটুকু ছেলে নিয়ে রান্না করলে খেতে মানুষের ঘেন্না হত না?

পরী উত্তেজিত হইয়া বলিল, ঘেন্না হত! আমার রান্না খেতে বনমালীদাদার ঘেন্না হত, স্বয়ং বিধাতা এ কথা বললেও আমি বিশ্বাস করি নে দিদি!

চারু একটু হাসিয়া বলিল, আচ্ছা নে, না করিস না করিস একটু চুপ কর। মানুষের সঙ্গে দুটো কথা বলতে দে।

আমিও কথাই বলছি।

চারু ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকাইল। কুড়ি-বাইশ হাজার টাকা খরচ করিয়া সে যে তাহার বিবাহ দিয়াছিল এমনি রাগের সময় সে কথাটা মনে পড়িয়া আজকাল চারুর মনের মধ্যে খচখচ করিয়া বেঁধে।

পরীর ছেলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। দিদি উপস্থিত থাকিতে বনমালীর কাছে আমল পাওয়ার সুবিধা হইবে না টের পাইয়া ছেলেকে শোয়ানোর প্রয়োজনটা এতক্ষণে সে অনুভব করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, অমন করে তাকাচ্ছ কেন দিদি? মুখে কিছু লেগে আছে নাকি আমার? বলিয়া বনমালীর দিকে চাহিয়া একটু হাসিয়া সে চলিয়া গেল।

চারু বলিল, দেখলে ভাই? শুনলে মেয়ের কথাবার্তা? আমি যেন ওর ইয়ার! আর এই সেদিনও কেঁদে কেঁদে আমায় চিঠি লিখেছে, ও দিদি, আমাকে শ পাঁচেক টাকা পাঠিয়ে দিও দিদি! টাকার বেলা দিদি, দিদি, অন্য সময় সে কেউ নয়!

বনমালী বলিল, ছেলেমানুষ, বোঝে না!

বোঝে না? হুঁঃ, কচি খুকি কিনা বোঝে না! বোঝে সব, সব বুঝে ও এমনি করে এ আর আমি টের পাই নে! দিদির যে আর টাকা নেই, দিদি যে হুট বলতে পাঁচশ। টাকা পাঠিয়ে দেয়নি!

বনমালী কিছু বলিল না। চারুও নিজের জ্বালা আর অভিমানে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল।

উহাদের স্তব্ধতা নিঃসম্পর্কীয়। কারণ আজ একজন প্রৌঢ়া নারী এবং অপরজন মধ্যবয়সী পাটের দালাল।

খানিক পরে চারু বলিল, যা বলছিলাম। ভাগ্যে এই বাড়ি আর বাগান তোমার কাছে বাঁধা রাখার কথা মনে হয়েছিল! টাকা দেবার মেয়াদ পার হয়ে গেছে বলে তুমি অবিশ্যি বাড়িটা নিয়ে নেবে না, কিন্তু আর কারো কাছে বাঁধা রাখলে কী সর্বনাশ হত বলো তো!

তা বৈকি। বাগানবাড়ি পরের হাতে চলে যেত। কিন্তু আমার কাছে বাড়ি তো তুমি বাঁধা রাখনি চারুদি, বিক্রি করেছিলে।

ওমা, সে কী? বাড়ি আমি বিক্রি করলাম কখন?

বনমালী একটু হাসিয়া বলিল, দলিলের নকলটা একবার পড়ে দেখো, তিরিশ হাজার নগদ আর ওই টাকার পাঁচ বছরের সুদের দামে তুমি আমাকে বাড়ি বিক্রি করেছ। বরাবর সুদ দিয়ে এলে বলতে পারতে বাঁধা আছে।

মুখ পাংশু হইয়া যাওয়াটা চারু সম্পূর্ণ নিবারণ করিতে পারিল না। কী বলিবে হঠাৎ সে ভাবিয়া পাইল না। শেষে বলিল, তুমি হাসছ, তাই বলো!

বনমালীর মুখের হাসি অনেক আগেই মুছিয়া গিয়াছিল। কিন্তু সে কিছু বলিল না। জীবনের একটা অভিজ্ঞতাকে বনমালী খুব দামি মনে করিয়া থাকে। তাহা এই যে, বক্তব্য সহজে দুবার মুখ দিয়া বাহির করিতে নাই। পুনরুক্তিতে কথার দাম কমিয়া যায়।

চারু আবার বলিল, আমি বলি কী, ত্রিশ হোক বত্রিশ হোক দেনা তো তোমার আমি শুধতে পারছি না, এ বাড়ি দিয়ে তুমিই-বা করবে কী; তার চেয়ে বিক্রি করে ফেলে তোমার টাকাটা তুমি নিয়ে নাও, বাকিটা আমাকে দাও। তোমার ত্রিশ হাজার কেটে নিলে আমার যা থাকবে তাই দিয়ে দেশে একটা ছোটখাটো বাড়ি তুলে বাস করিগে। জমি-জায়গা যা আছে দু-চার বিঘে তার খাজনা পাই না, ফসল পাই না, নিজে থাকলে একটা ব্যবস্থা হবে।

বনমালী খাওয়া বন্ধ করিল। আজকাল কোনোকিছুতেই সে বিস্ময় বোধ করে না, আকাশের একটা বজ্র পাখি হইয়া পাশ দিয়া উড়িয়া গেলেও না। কিন্তু চারুর কথায় সে যেন অবাক হইয়া গিয়াছে এমনি মুখের ভাব করিয়া বলিল, তুমি এ বাড়ি বিক্রি করতে চাও? খেপেছ!

চারু সভয়ে বলিল, কেন? তোমার টাকা তো তুমি পাবে!

আমার টাকা চুলোয় যাক।

চারু আরো ভয় পাইয়া বলিল, রাগ করো না ভাই। মেয়েমানুষ কিছুই তো বুঝি নে!

বনমালী বলিল, ভুবনের বাড়ি বিক্রি করার পরামর্শ তোমাকে দিলে কে? ওসব দুর্বুদ্ধি কোরো না। সময়টা, কি জান চারুদি, আমারও তেমন সুবিধে যাচ্ছে না। তোমার এই বাড়িটা বন্ধক রেখে কিছু ধার পেয়েছি। একটু সামলে উঠলেই। ছাড়িয়ে নেব।

চারু রুদ্ধ নিশ্বাসে বলিল, তারপর?

ভুবনের বাড়ি ভুবন ফিরে পাবে।

গলনালী প্রায় রুদ্ধ করিয়া চারু বলিল, কিন্তু তোমার টাকা? তোমার তিরিশ হাজার টাকা?

ভুবনের কাছে জমা থাকবে।

এ কথা কেহ বিশ্বাস করে! নিমূল আশার শোকে চারু কাঁদিয়া ফেলিল।

বনমালী বলিল, কেঁদো না চারুদি। আমি কি তোমার পর? আগে তুমি আমাকে কত ভালবাসতে।

শুনিয়া চারুর কান্না থমকিয়া থামিয়া গেল। বনমালী যদি পরিহাস করিয়া থাকে, বিশেষ করিয়া আগের কথা তুলিয়া পরিহাস করিয়া থাকে, তবে সত্য সত্যই আর কোনো আশা নাই।

আমি যদি তোমার মনে কোনোদিন ব্যথা দিয়ে থাকি, জেনো

বনমালী আবার খাওয়া বন্ধ করিল।

তুমি আমার মনে ব্যথা দেবে কেন?

চারু চোর বনিয়া গেল–দির কথা বলছি।

বনমালী একেই গম্ভীর, সে আরো গম্ভীর হইয়া বলিল, ভুবন কোথায় চারুদি?

চারু নিশ্বাস ফেলিয়া ডাকিল, ও ভুবন, ভুবন! একবারটি এদিকে শুনে যাও তো, বাবা।

ঘরের ভিতর হইতে ভুবন থুপথুপ করিয়া পা ফেলিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। সে অত্যাশ্চর্য মোটা। তাহার গলায় দুটি খাঁজ আছে, মনে হয় গালেও খাঁজ পড়িবে।

বনমালী ভাবিল, এই ছেলেকে অত ভালবাসে, চারু তো আশ্চর্য মেয়েমানুষ!

.

মাসখানেক পরে পরী শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গেল। বলিয়া গেল, আর আসব না দিদি।

আরো এক মাস পরে বনমালী তার বুড়ো মা, আশ্রিত-আশ্রিতা, দাস-দাসী ও মোট-বহর লইয়া শহরের ভিতরের বাড়ি ছাড়িয়া চারুর শহরতলির বাড়িতে উঠিয়া আসিল। চারুর অনুমান করিতে কষ্ট হইল না যে বনমালীর অবস্থানটা সাময়িক হইবে না।

পাংশু মুখে জিজ্ঞাসা করিল, ওখানে কি তোমাদের অসুবিধে হচ্ছিল ভাই?

বনমালী বলিল, অসুবিধে হলে এতদিন বাস করলাম কী করে, চারুদি? সে জন্য নয়। মনে করছি, বাড়িটা আগাগোড়া মেরামত করব আর দুখানা ঘর তুলব ছাদে। মাস দুই তোমার এখানেই আশ্রয় নিতে এলাম।

চারুকে বলিতে হইল, আহা আসবে বৈকি, সে কী কথা, বেশ করেছ।

তারপর দুই মাসের মধ্যেও বনমালীর বাড়ি মেরামত আরম্ভ হইল না, ছাদে ঘর উঠিবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। চারু গোপনে সংবাদ লইয়া জানিতে পারিল, নিজের বাড়ি বনমালী দুইশ দশ টাকায় ভাড়া দিয়াছে। ইতিমধ্যে বনমালীর নিরঙ্কুশ তৈলাক্ত অধিকার সদরের গেট হইতে পেছনের গলিতে খিড়কির দরজা পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া গেল। অতিথির আদর ও সম্মান পাইয়া চারু তার নিজের বাড়িতে বাস করিতে লাগিল।

বনমালী বলে, অসুবিধে হচ্ছে চারুদি?

প্রশ্ন শুনিলে রাগ হয়।

না ভাই, অসুবিধে কিছু নেই।

কিছুদিন যদি দেশে গিয়ে থেকে আসতে চাও, কেষ্টকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পার। দেশেটেশে মধ্যে মধ্যে যাওয়া দরকার বৈকি!

দেশে কি বাড়ি ঘর দোর কিছু আছে ভাই, যে যাব?

হাজার দুই খরচ করলেই দেশে দিব্যি বাড়ি হয়। জমি-জায়গা আছে, খাজনা পাওনা, ফসল পাওনা, সব লুটেপুটে নিচ্ছে। নিজে থাকলে লোকসানটা রদ হত।

জমি! জমি কই দেশে? কিছু কি আর আছে ভাই, আমার সর্বস্ব গেছে।

বনমালী তখনকার মতো চুপ করিয়া যায়।

তাহার মা হেমলতা বলেন, হ্যাঁ রে, ওরা কি যাবে না?

কোথায় যাবে?

যে চুলোয় খুশি, আমাদের তা ভাববার দরকার? ক-দিন দ্যাখ, তারপর নিজের পথ দেখে নিতে বলে দে।

তাড়িয়ে দিতে পারব না, মা। ওসব আমার ধাতে নেই। নিজে থেকে যায় তো যাবে, নইলে রইল।

.

কয়েক দিন পরে বনমালী আবার চারুকে বলে, শুনলাম, তুমি নাকি তীর্থে যেতে চাও?

আমায় বলনি কেন চারুদি? আমি সব ব্যবস্থা করে দিতাম। তোমার ধর্মকর্মে আমি বাধা দেব কেন?

বুদ্ধির ধার পড়িয়া গেলেও চারু এত বোকা হইয়া পড়ে নাই যে ভুবনকে লইয়া এ বাড়ি হইতে নড়িবে। বনমালীর দুর্বলতা সে জানে। বনমালী সোজাসুজি কাহারো প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখাইতে পারে না। সামনে যে উপস্থিত থাকে তাহার মনে বেদনা দেওয়া বনমালীর সাধ্যাতীত। তার মনের চলাফেরার প্রস্তরময় পথে সে একপরত। মাটি বিছাইয়া ফুল ফুটাইয়া রাখিবারই চেষ্টা করে।

তীর্থদর্শন কামনা রাখার অপবাদ চারু তাই অস্বীকার করে। বলে, কই, তীর্থে যাওয়ার কথা আমি তো কিছু বলিনি? ও, হ্যাঁ মনে পড়েছে। মাসিকে বলছিলাম, স্বামী-শ্বশুরের এই তীর্থ ছেড়ে আমার এক পা কোথাও নড়তে ইচ্ছে করে না। মাসিমা বুঝি মনে করেছেন, আমি তীর্থে যেতে চাই?

বনমালী একটা হাই তোলে। মেয়েমানুষের এত বুদ্ধি তার ভালো লাগে না। তবু, দেশ-বেড়ালে ভুবনের একটু উপকার হত। হায়রে কপাল, ওর আবার দেশ বেড়ানো! চারু কাদাকাটা করার উপক্রম করে।

বনমালী আর কিছু না বলিয়া বাগানে পায়চারি করিতে যায়। ভাবে, কী আর হইবে, থাক। গ্রামকে গ্রাম ঘাড়ে আসিয়া চাপিয়া বসিয়া আছে, চারুদির ভারটা। আর এমন কী গুরু!

কাঁকর বিছানো পথের ঠিক মাঝখান হইতে দুটি কচি সবুজ ঘাসের শিষ বাহির হইয়াছে দেখিয়া বনমালী থমকিয়া দাঁড়ায়। পকেট হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া যমজ ভাইয়ের মতো তাদের দুটিকে সে চাপা দিয়া দেয়। ভাবে, আগে চারুর যদি টাকা না থাকিত! তারপর একদিন পরী বিধবা হইয়া দিদির কাছে চলিয়া আসিল। ছেলেকে সাবধানে মাটিতে নামাইয়া রাখিয়া গড়াগড়ি দিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে বলিতে লাগিল, দিদি গো, আমার কপাল পুড়েছে গো! কে অভিশাপ দিয়ে আমার এমন করলে গো, কে করলে!

গলায় আঁচল জড়াইয়া পাক দিয়া চারু গলায় ফাঁস দিবার চেষ্টা করিতেছিল, কিন্তু হেমলতা ফাঁস খুলিয়া দেওয়ায় সে চেষ্টা সে ত্যাগ করিল। খানিকক্ষণ মেঝেতে কপাল কুটিয়া হাত কামড়াইয়া চেঁচাইয়া এক বিষম কাণ্ড বাধাইয়া তুলিল ও ছুটিয়া নিজের ঘরে গিয়া দড়াম করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল। গলায় সে যে আর ফাঁস দিতেছে না সেটা বেশ বুঝা গেল, কারণ বাহির হইতে ভগবানের কাছে তাহার একটানা আবেদন শোনা যাইতে লাগিল, আমায় নাও ভগবান, এবার আমায় নাও।

বনমালী পরীকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, অমন করে কাঁদিস নে পরী; ছেলের মুখ চেয়ে বুক বাঁধ। নে ওঠ, উঠে মাই দে ছেলেকে, ককিয়ে ককিয়ে গলা যে ওর কাঠ হয়ে গেল রে।

হেমলতা বনমালীর সান্তনা প্রত্যাহার করিয়া নিলেন।

ওকে এখন ওসব বলিস নে বনমালী, কাঁদতে দে। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর শুনেছি যে দজ্জাল, প্রাণ খুলে সেখানে কি একটু কাঁদতেও পেরেছে রে! এই প্রাণঘাতী শোক জোর করে চেপে রেখে শেষে কি অসুখে পড়বে মেয়েটা? খানিক কেঁদে নিক।

পরী আরো জোরে কাঁদিয়া উঠিল। বনমালীর বিপদের আর সীমা রহিল না। কান্না তাহার একেবারেই সহ্য হয় না। অথচ উঠিয়া যাইবার উপায় নাই। পরী মনে করিবে, দেখো কী নির্মম; আমার এমন শোকটা চোখ মেলে একটু চেয়েও দেখলে না!

ওদিকে চারুর সাড়াশব্দ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। খানিক পরে দম লইয়া পরী বলিল, ও মাসিমা, দিদি কী করছে দেখুন।

হেমলতা খোকাকে বনমালীর দিকে আগাইয়া দিলেন।

ধর তো, দেখেই আসি একবার।

বনমালী হাত বাড়াইল না।

আমি দেখে আসছি।

তুই এখানে বোস। পরীর ছেলেকে নিজের ছেলের কোলে একরকম ফেলিয়া দিয়াই হেমলতা পলাইয়া গেলেন। খোকাকে সঙ্গে লইলে অল্পক্ষণের মধ্যেই তাঁহাকে আবার ফিরিয়া আসিতে হইত, সে ইচ্ছা হেমলতার ছিল না। এসব তাহার ভালো লাগে না–সদ্য বিধবার এই কান্নাকাটি! তা ছাড়া কুপিত বায়ুর প্রকোপে সর্বদা তাহার মনের মধ্যে আগুন জ্বলিতেছে, কোনো প্রকার উত্তেজনা হওয়া কবিরাজের নিষেধ। পরের মেয়ের কপাল পোড়ার ঝাঁজে শেষে কি তাঁর তালু জ্বলিবে?

চারুর ঘরের দরজা ঠেলিয়া বলিলেন, দরজা খোলো মা, দরজা খোলো, ওসব কি করতে আছে? মাথা ঠাণ্ডা রাখো।

বলিয়া ওদিকের জানালায় সরিয়া গিয়া ঘরের ভিতরে তাকাইয়া তিনি অবাক হইয়া গেলেন। শরৎকালের ফাজিল মেঘের মতো চারুর শোক ইতিমধ্যেই কোথায় চলিয়া গিয়াছে। ভুবনকে আদর করিয়া সে তাহার মাথায় মাখাইতেছে কবিরাজি তেল।

হেমলতা চলিয়া গেলে পরী উঠিয়া বসিল। বনমালীর কাছে একা একা কাঁদিতে তাহার লজ্জা করে। মুখ হইতে এলোচুল সরাইয়া সে ভগ্নস্বরে বলিল, খোকাকে দিন, হাতটা বোধ হয় ওর ভেঙেই গেল।

খোকাকে তার কোলে দিয়া বনমালী বলিল, তোর ছেলেটা তো বেশ। হয়েছে রে।

থাক, আপনাকে আর ঠাট্টা করতে হবে না।

বনমালীর দিকে পিছন করিয়া বসিয়া পরী খোকার মুখে মাই তুলিয়া দিল।

এবার বনমালী উঠিয়া যাইতে পারে, যাওয়াই সঙ্গত; কিন্তু সে বসিয়াই রহিল। পরীর অস্তিত্ব সম্বন্ধে বনমালীর চেতনা কোনোদিন বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ ছিল না। সে তার কাছে চিরদিনই চারুর ছোট বোন। আজ বনমালী লক্ষ্য করিল যে বিধবার বেশ ধারণ করায় পরীকে কমবয়সী চারুর মতো দেখাইতেছে। তার ব্যবহার, তার মনোবিকার, তার কথা বলিবার ভঙ্গি যেন চারুর যৌবনকাল হইতে নকল করা। কেবল চারুর চেয়ে সে স্পষ্ট, স্বচ্ছ।

তোর ঘাড়ে কী লেগে আছে রে, পরী?

ঘাড়ে হাত বুলাইয়া পরী জবাব দিল, কী লেগে থাকবে? কিছু না।

তুই পাউডার মেখেছিস?

পরী জোরে নিশ্বাস লইয়া বলিল, মেখেছিই তো, একশ বার মেখেছি। আপনি কেন আমায় কালো বলেন?

পরীর বৈধব্যের আঘাতেই বোধ হয় চারুর মাথা আর একটু খারাপ হইয়া গেল। চল্লিশ বছর বয়সেই তার চুলে এবার পাক ধরিল, কোমরে বাত দেখা দিল আর পেটে। হইল অম্বল। শোক আর অম্বলের মধ্যে কোন কারণে তাহার বুক সর্বদা জ্বালা করিতেছে সেটা আর সব সময় ঠিকমতো বুঝিবার উপায় রহিল না।

হেমলতার কাছে সে কাঁদিয়া বলে, আমার মতো অবস্থা মাসিমা শত্রুরও যেন না হয়, দিনরাত ভগবানের কাছে এই কামনা জানাচ্ছি। কোনো দিকে কূল-কিনারা নেই মাসিমা, আমি অকূলে ডুবেছি।

হেমলতা বিরক্ত হন। মুখে বলেন, মাথা ঠাণ্ডা রাখো মা, কী করবে, মাথা ঠাণ্ডা রাখ।

মাথা চারু ঠাণ্ডা রাখিতে পারে না, ভাবিয়া ভাবিয়া মাথা গরম করে। একটা পেটের ছেলের ভবিষ্যৎ ভাবিয়া যে আকুল হইয়া উঠিয়াছিল, ছেলে লইয়া কচি বোনটাও আসিয়া ঘাড়ে চাপিল। সে কোন দিক সামলাইবে!

পরীকে সে জিজ্ঞাসা করিল, কিছু রেখে গেছে?

না।

কিছু না? পোস্টাফিসে, ব্যাংকে, তোর নামে কিছুই রেখে যায়নি?

কী রোজগার করত যে রেখে যাবে দিদি? মাস গেলে হাত-খরচের টাকার জন্য বাপের কাছে হাত পাততো, রেখে যাবে!

আমি যা দিয়েছিলাম?

শ্বশুরের সিন্দুকে ঢুকেছে-খাট-পালঙ্ক ছাড়া।

চারু কপালে চোখ তুলিয়া বলিল, তোর গয়নাও দেয়নি নাকি? তোকে যে আমি তের-চৌদ্দ হাজারের গয়না দিয়েছিলাম রে!

কিচ্ছুটি আমাকে দেয়নি দিদি, সব আটকে রেখেছে। আঁচল থেকে চাবি কেড়ে নিয়ে বাক্স খুলে শ্বশুর নিজে সব বার করে নিল। খোকার গয়না পর্যন্ত।

এমন চামার! তা, আর দুটো মাস তুই ধৈর্য ধরে থাকলি না কেন? কেমন করে আদায় করে নিতে হয় আমি দেখতাম।

বড় খারাপ ব্যবহার করে দিদি, থাকতে ভালো লাগল না।

চারু হঠাৎ রাগিয়া উঠিল, থাকতে ভালো লাগল না! মেয়েমানুষের অত ভালো লাগা মন্দ লাগা কী লো, যা, কালকেই ফিরে যা তুই,-বুড়ো মরবার সময় খোকাকে তো কিছু দিয়ে যাবে।

পরী ঠোঁট উল্টাইয়া বলিল, আছে ছাই, দিয়েও যাবে ছাই। সাত ছেলের। একটা রোজগার করে? তাদের দিয়ে যেতে হবে না? ও বাড়ি আমি আর যাচ্ছি না বাপু, হ্যাঁ।

চারু আগুন হইয়া বলিল, ছেলে তবে তোর মানুষ করবে কে শুনি? তোকে খাওয়াবে কে শুনি? আমি! আমার আর সেদিন নেই পরী, বনমালী তাড়িয়ে দিলে নিজের ছেলে আমার খেতে পাবে না।

আমার ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না দিদি, বলিয়া মুখ ঘুরাইয়া পরী চলিয়া গেল।

চারু দাঁতে দাঁত ঘষিয়া বলিল, আমার ভাবনা তোমায় ভাবতে হবে না দিদি! ভাবতে হবে না তো আমাদের বাড়িতে এসেছিস কেন লো হারামজাদী?

তিন দিন পরীর সঙ্গে সে কথা কহিল না। কিন্তু তাহাতেও পরীর কিছুমাত্র অনুতাপের লক্ষণ নাই দেখিয়া চারুর নিজের হাত-পা কামড়াইবার ইচ্ছা হইতে লাগিল।

দেখ পরী, এত বাড় ভালো নয়।

নয় তো নয়, কী হবে?

খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করিনি তোকে আমি?

সবাই করে থাকে, তুমি একা নও।

চারু বনমালীর শরণ নিল।

মেয়েটা নিজের সর্বনাশ করছে ভাই। সব ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে এলে তাদেরই সুবিধে, একেবারে বঞ্চিত করবে।

বনমালী কাজের ভিড়ে ব্যস্ততার ভান করিয়া বলিল, আহা, যাবে বৈকি চারুদি, যাবে। দুদিন জুড়িয়ে গেলে ক্ষতি কী?

চারু আর কিছু বলিতে সাহস পাইল না।

পরদিন পরী মুখ ভার করিয়া বলিল, লেগেছ তো পিছনে? জগতে কারো ভালো করতে নেই।

তুই আবার কবে আমার কী ভালো করলি লো?

এখানে আছ কার জন্য? ভেবে দেখছ একবার?

চারু চোখ পাকাইয়া বলিল, তোর জন্য, না? তুই দয়া করে থাকতে দিয়েছিস!

তাই।

চট করিয়া ঘুরিয়া দম দম পা ফেলিয়া পরী চলিয়া গেল। চারু নিজের ঘরে গিয়া দেয়ালকে শুনাইয়া বলিতে লাগিল, ওর জন্য আমি আর কিছু করব না। করব না, করব না, করব না, এই তিন সত্যি করলাম, নারায়ণ সাক্ষী।

পরীর ঔদ্ধত্য তার কাছে বেশি দিন অন্ধকার হইয়া রহিল না। ক্রমে ক্রমে ব্যাপারখানা বোঝা গেল।

বনমালীর খাওয়ার সময় চারু উপস্থিত থাকে, কয়েক দিন পরে পরীকেও দেখা যাইতে লাগিল। চারুর চেয়ে সে বনমালীর বেশি কাছ ঘেঁষিয়া বসে, চারুর হাতের পাখা অনেক আগেই দখল করিয়া রাখে, চারুর মুখের কথা কাড়িয়া লইয়া বলে, খান, পেট আপনার ভরেনি। কখখনো ভরেনি। আমি বুঝি না! ওই খেয়ে মানুষ বাঁচে?

বলে, কাল আপনাকে পেঁপের ডালনা বেঁধে দেব। খেয়ে দেখবেন, বেশ রাঁধি।

চারু এমন করিয়া বলিতে পারে না, এমন স্নেহসিঞ্চিত গাঢ় কণ্ঠে, এমন মনোহর আবদারের ভঙ্গিমায়। অবাক হইয়া সে বোনের মুখের দিকে তাকাইয়া থাকে।

পরী বলে, হাঁ করে তাকিয়ে কী দেখছ দিদি? দুধটা এনে দাও। খাওয়া যে হয়ে এল, উঠে গেলে ভালো হবে?

পরী যেন বনমালীর ছায়াটিকে বেদখল করিতে চায়। আশেপাশে কোথাও সে সর্বদা আছেই। বনমালীকে কখনো চুরুট খুঁজিতে হয় না, ওষুধ খাইতে ভুলিয়া যাইতে হয় না, দিনের মধ্যে দু-চার মিনিটের জন্য কারো সঙ্গে হালকা কথা বলিবার সাধ জাগিলে কেমন করিয়া টের পাইয়া পরী আসিয়া দাঁড়ায়, বলে স্নান করতে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম দেখে যাই আপনি কী করছেন।

রাত্রে বনমালী বিছানায় শুইলে চুপি চুপি ঘরে আসে।

বলে, কী চাই বলুন।

বনমালী হাসি গোপন করিয়া বলে, পা কামড়াচ্ছে–কেষ্টকে ডেকে দিয়ে যা। আর কিছু চাই না।

পরী বলে, কেষ্ট কেন? আমি কি পা টিপতে জানি নে?

অবশ্য পা টেপে না, অতবোকা পরী নয়; কেষ্টকেই ডাকিয়া দেয়। হুকুম দিয়া যায়, যাবার সময় আলো নিভিয়ে দিস কেষ্ট।

ছেলের দিকে চাহিবার সময় পরীর হয় না। ঝির কোলে পরীর ছেলে প্রায়ই মাতৃস্তনের জন্য কাঁদিয়া কাঁদিয়া ঘুমাইয়া পড়ে।

বনমালীর চারিদিকে পরী যে বৃত্ত রচনা করিয়া রাখে তার পরিধির বাহিরে চারু পাক খাইয়া বেড়ায়, কোথাও প্রবেশের ফাঁক দেখিতে পায় না। ভাবে, কী মেয়ে বাবা! ও দেখছি সর্বনাশ করে ছাড়বে!

.

একদিন একটু বেশি রাত্রে খুব বাদল নামিয়াছে।

খানিক বর্ষণের পর অবিরত বিদ্যুৎ-চমক আর বজ্রপাত আরম্ভ হইয়া গেল; প্রকৃতির সে এক মহামারী কাণ্ড।

চারু ভাবিল, অন্য ঘরে একা একা পরী বড় ভয় পাইতেছে।

উঠিয়া দরজা খুলিয়া সে বাহিরে আসিল। একটু খোঁজ-খবর লইলে পরী খুশি হইবে। বনমালীকে ও যে-রকম বাগ মানাইয়া আনিতেছে ওকে একটু খুশি রাখা দরকার বৈকি!

নিশুতি রাত, বাড়িটা এক-একবার প্রাণঘাতী আলোয় চমকাইয়া উঠিয়া অন্ধকারে আড়ষ্ট হইয়া যাইতেছে। চারু পা চালাইয়া বারান্দাটুকু পার হইয়া গেল। কী জানি, একটা বজ্র যদি তাহার ঘাড়েই আসিয়া পড়ে!

পরীর ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, ঠেলিতে খুলিয়া গেল। ঘরের মধ্যে দুপা আগাইয়া চারু থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। এ দৃশ্য তাহাকে দেখিতে হইবে চারু তাহা কল্পনাও করে নাই। মেঘগর্জনে পরী ভয় পাইবে এ আশঙ্কা কয়েক মিনিটের জন্যও তাহার পোষণ করার প্রয়োজন ছিল না। পরী একা নয়। বনমালীর বুকের কাছে যদিও সে জড়সড় হইয়াই তাহার কথা শুনিতেছে, সেটা ভয়ে নয়।

খোকার ছোট বিছানাটি মেঝেতে নামানো, বিছানা হইতে গড়াইয়া বনমালীর একপাটি জুতা দুহাতে বুকের কাছে আঁকড়াইয়া ধরিয়া খোকা শান্তভাবে ঘুমাইয়া আছে।

পা হইতে মাথা অবধি চারু একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করিল। একটা ভয়ানক চিৎকার করিয়া বিছানায় ঝাঁপাইয়া পড়িয়া পরীকে আঁচড়াইয়া কামড়াইয়া ক্ষতবিক্ষত করিয়া দেওয়ার জন্য, গলা টিপিয়া তাহাকে একেবারে মারিবার জন্য, সে একটা অদম্য অস্থির প্রেরণা অনুভব করিতেছিল।

কিন্তু সংসারে সব কাজ করা যায় না। কাকে সে কী বলিবে? এটা তাহার বোনের শয়ন-ঘর, কিন্তু ঘরের মালিক বনমালী। বনমালীকে কিছুতে বলা যায়ই না, পরীকে কিছু বলিলেও বনমালী নিজে অপমানিত জ্ঞান করিবে। দারোয়ান দিয়া এই রাত্রেই যদি তাহাকে আর ভুবনকে বনমালী বাহির করিয়া দেয়, আটকাইবে কে? ছেলের হাত ধরিয়া এই দুর্যোগে সে যাইবে কোথায়?

চারু আস্তে আস্তে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। দরজা যেমন ভেজানো ছিল, তেমনি ভেজাইয়া দিল।

আকাশে এখনো বিদ্যুৎ চমকাইতেছে, আকাশের এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত চিড়-খাওয়া বিদ্যুৎ। চারু ভাবিতে লাগিল, এ কী মহা বিস্ময়ের ব্যাপার যে পরী শেষ পর্যন্ত বনমালীকে জয় করিয়া ছাড়িল, সেদিনকার কচি মেয়ে পরী! এমন মূল্য দিয়াই সে বনমালীকে কিনিয়া লইল যে তার ছেলের সমগ্র ভবিষ্যণ্টা সোনায় মণ্ডিত হইয়া গেল। বনমালী এইবার সারাজীবন অনুতাপ করিবে আর পরীর ছেলের পিছনে টাকা ঢালিবে।

হয়তো ভুবনকে না দিয়া এ বাড়িটা সে পরীকেই দান করিবে। বলিবে, ভুবন। আর বাড়ি নিয়ে করবে কী চারুদি? পরীকেই দিয়ে দিলাম।

ঘরে গিয়া খাটে বসিয়া ছেলের গায়ে হাত রাখিয়া চারু অনেকক্ষণ চুপচাপ ভাবিল।

সে জানে উহারা তাহার যাওয়া-আসা টের পাইয়াছে। পাক টের। কাল তারা যদি তাহার কাছে লজ্জা বোধ না করে, তাহারও লজ্জা পাইবার কোনো কারণ থাকিবে না। পরী তাহার কে? কেউ নয়। ছুঁইতেও ঘৃণায় গা শিহরিয়া উঠিল বলিয়া

সে যাহার চোখ দুটো উপড়াইয়া আনিল না, সে তাহার বোন হইবে কোন দুঃখে? কপাল পুড়িয়া যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে এমন কাজ যে করিতে পারে। বাড়ির ঝিয়ের চেয়েও সে পর, অনাত্মীয়া। ওর অক্ষয় নরকের সঙ্গে তাহার কোনো সম্পর্ক নাই।

মনে মনে মস্ত এক প্রতিজ্ঞা করিয়া আঠার বছরের ঘুমন্ত ছেলের মাথায় সস্নেহ চুমা খাইয়া চারু মেঝেতে তাহার সংক্ষিপ্ত কম্বলের শয্যায় নামিয়া গেল।

এ বাড়িতে পাপের বন্যা বহিয়া যাক, এ ঘরখানাকে সে পবিত্র মনে করিবে। যতদিন বাঁচে সপুত্র এই ঘরের বায়ু সে নিশ্বাসে গ্রহণ করিবে। বাহিরে এমন বৃষ্টি হইয়া গেল, তাহাদের গায়ে লাগিল কি? বাহিরে যত অন্যায়ই ঘটিয়া চলুক তাহাদের গায়ে ছোঁয়াচ লাগিবে না।

এই কথাটা বারবার ভাবিয়া এবং শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করিয়াও চারু কিন্তু সমস্ত রাত ঘুমাইতে পারিল না। পরীর আদিম শৈশবের ইতিহাস ছায়াছবির রূপ লইয়া তাহার চোখের সামনে ভাসিয়া আসিতে লাগিল। বাপের বাড়ির গ্রামে পরী যখন ছেঁড়া ডুরে পরিয়া ঘুরিয়া বেড়াইত, আর বিবাহের পর এখানে আসিয়া পিঠে বেণি দুলাইয়া স্কুলে যাইত, তখনকার কথা। কত আদরে কত যত্নে তাকে সে মানুষ করিয়াছিল। সেই পরী যে আজ তাহার ভুবনের মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইবার জন্য এমনভাবে নিজের সর্বনাশ করিল ইহার আকস্মিকতা, ইহার অসামঞ্জস্য সমস্ত রাত চারুকে অভিভূত করিয়া রাখিল।

বনমালীকে ভালোবাসিয়া, যৌবনের অপরিতৃপ্ত অসংযত ক্ষুধায় অথবা নেহাত ছেলেমানুষি খেয়ালে যে পরী এই নিদারুণ ভুল করিয়া থাকিতে পারে, চারুর মনে ঘুণাক্ষরেও সে কথা উদিত হইল না। যাহার বিবাহ হইয়াছে, যে তিন বছর স্বামীর ঘর করিয়াছে, বিশেষ করিয়া যে তাহার বোন, তাহার মধ্যে ওসব পাগলামি চারু কল্পনা করিতে পারে না। চল্লিশ বছরের জীবনে কাহারো মধ্যেই আভিজাত্যের চিহ্ন। তো সে খুঁজিয়া পায় নাই।

মতলব থাকে। যেদিকে যেভাবে মানুষ পা ফেলুক, পিছনে মতলব থাকে।

বনমালীর আটত্রিশ বৎসর বয়স হইয়াছে। টাকা ছাড়া তার আর কী আছে যে তার টানে মেয়েমানুষ লক্ষ্যভ্রষ্ট হইবে? মানুষটা একটু অদ্ভুত, একটু গভীর। প্রথম। বয়সে মনে মনে সেও তাহাকে একটু ভয় করিত। মনে হইত তাহার ভিতরটা কী কারণে মুচড়াইয়া পাক খাইতেছে, তার বড় যন্ত্রণা। তখন বনমালী যুবক। তার মধ্যে সে তো তখনো কোনো আকর্ষণ আবিষ্কার করিতে পারে নাই! তার নৈকট্যকে, তার। নির্বাক আবেদনকে, তার দু-চোখের গভীর তৃষ্ণাকে, সে যে কতবার অপমান করিয়াছে তাহার হিসাব হয় না।

তার সঙ্গে কথা কহিবার সময়ও কি সব সময় সে পাইত!

তাহার কাছে মানুষ হইয়া পরী কি তাহার মনের জোর এতটুকু পায় নাই? অসহায় আক্রোশে থাকিয়া থাকিয়া চারুর মনে হইতে লাগিল, ইহার চেয়ে সে-ই যদি সে সময় বনমালীর নিকট আত্মসমর্পণ করিত তাও ভালো ছিল, এ রকম বিপদ ঘটাইবার সুযোগ পরী আজ তাহা হইলে পাইত না।

চারুর জীবনে অন্ধ আবেগের স্থান ছিল না। সমস্ত জীবন তাহাকে সংসারের এলোমেলো বিরুদ্ধশক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। প্রথম জীবনে তাহার লড়াই ছিল অভাবের সঙ্গে আর গ্রামের দু-তিনটি যুবকের স্বভাবের সঙ্গে। বিবাহের পর তাহার লড়াই শুরু হইয়াছিল ধনসম্পদের পলাতক প্রবৃত্তির সঙ্গে আর নিজেকে সামলাইয়া না-চলার দুরন্ত ইচ্ছার সঙ্গে। ইহার কোনোটাই সহজ ছিল না। পুরুষ অভিভাবকের অভাবে সম্পত্তির ব্যবস্থা করিতে তাহার যেমন প্রাণান্ত হইত, অবাধ স্বাধীনতার সঙ্গে পাগলা স্বামীকে খাপ খাওয়াইতেও তাহার তেমনি অবিরাম নিজেকে শাসন করিয়া চলিতে হইত। হাতে টাকা, দেহে রূপ, মনে অতৃপ্ত যৌবন–এ রকম ভয়ানক সমন্বয় ঘটিয়াছিল বলিয়া সারাজীবন তাহাকে অনেক ভুগিতে হইয়াছে।

চারুর হৃদয়ের কতকগুলো স্থান তাই ভয়ানক শক্ত।

পরদিন সকালে সে নিজে গিয়া পরীকে ডাকিয়া তুলিল, কিছুই যেন ঘটে নাই এমনিভাবে বলিল, নে, ওঠ এবার। অনেক বেলা হয়েছে।

পরী সাড়া দিল না। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া শুইয়া রহিল।

খোকাকে তুলিয়া লইয়া বাহিরে আসিয়া চারু হাঁফ ছাড়িল।

কিন্তু তখনো আর একজন বাকি।

বনমালীকে চারু আবিষ্কার করিল বাগানে।

এক মুহূর্তের জন্য তার হৃদয় স্পন্দিত হইয়া উঠিল। এই বাগানে এক স্বপ্নধূসর সন্ধ্যায় বনমালী একরকম জোর করিয়াই একদিন তাকে প্রায়-চুম্বন করিয়া বসিয়াছিল। সেদিন যদি সে বাধা না দিত!

গাছের ডাল হইতে টপটপ জল পড়িতেছিল। কতকগুলি ফুলের গাছ নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

চারু বলিল, কী বৃষ্টিটাই কাল হয়ে গেল!

বনমালী বলিল, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে।

হ্যাঁ। কদিন গরমে প্রাণটা গেছে–আমি আজ একবার তারকেশ্বর যাব ভাই।

বনমালী আচমকা বলিল, ক্ষেন্তির মা দুশ টাকা চেয়েছে, মেয়েকে নিয়ে কাশী যেতে চায়, তুমি যাবে ওদের সঙ্গে?

চারু মাথা নাড়িল।

কাশী মাথায় থাক, তোদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না ভাই। ক্ষেন্তির মার কী? হুট বলতে ও যেখানে খুশি যেতে পারে, আমরা পারি নে। আমাদের মায়া-মমতা আছে। বিশ বছর ধরে যার সঙ্গে–

চারু একটা নিশ্বাস ফেলিল।

.

তারকেশ্বর রওয়ানা হওয়ার আগে চারু বলিয়া গেল, ভুবন রইল ভাই, একটু দেখো। আর শোনো, কাল পরীর একাদশী, এই বয়সে ওর একাদশী করার কী দরকার কে জানে! কথা কি শুনবে মেয়ে! তোমাকে মানে, ফলটল যদি খাওয়াতে পার একটু চেষ্টা করে দেখো ভাই।

আগে, চারুর সরকার প্রথমে গিয়ে একটা আস্ত বাড়ি ভাড়া করিয়া আসিত তবে চারু তারকেশ্বর যাইত। এবার সে সোজাসুজি যাত্রীনিবাসে গিয়া উঠিল।

প্রত্যেক দিন এই মানত করিয়া সে দেবতার কাছে পূজা দিল যে তার ফিরিয়া যাওয়ার আগেই পরী যেন কলেরা হইয়া মরিয়া যায়। পরীর যে আর বাঁচিয়া থাকার দরকার নাই দেবতাকে এই কথাটা সে খুব ভালো করিয়াই বুঝাইয়া দিল।

পরীর ছেলে? পরীর ছেলেকে সে মানুষ করিবে।

তৃতীয় দিন মন্দিরে পূজা দিয়া যাত্রীনিবাসে ফিরিয়া চারু দেখিল, একটি বৌয়ের কলেরা হইয়াছে। তাকে বিদায় করিবার ষড়যন্ত্র আর পলায়নপর যাত্রীদের কোলাহলে যাত্রীশালা সরগরম।

সকালে বৌটির সঙ্গে চারুর পরিচয় হইয়াছিল। স্বামীর অম্বলের অসুখের জন্য ছেলেমানুষ দেওরকে সঙ্গে লইয়াই মরিয়া হইয়া সে ধরনা দিতে আসিয়াছে। বৌটির নাম কনক, বয়স অল্প; গুপথুপ করিয়া পা ফেলিয়া ওর চলার ভঙ্গি অনেকটা পরীর মতো।

দেওর শিশুকে দুধ খাইতে দিবে বলিয়া সকালে চারুর কাছে একটি পাথরের বাটি ধার করিতে আসিয়াছিল। ঘনিষ্ঠতা হইতে মিনিট দশেক লাগিল বৈকি।

হ্যাঁ মাসিমা, কদিন থাকবেন আপনি?

চারু হিসাব করিয়া বলিল, আজ নিয়ে হল তিন দিন, আরো পাঁচ-ছ দিন থাকবার ইচ্ছে আছে, এখন বাবা যা করেন। পরের কাছে পাগল ছেলে ফেলে এসেছি মা, থাকতে কি মন চায়। কিন্তু দেখি কটা দিন, ছেলেটাকে কেমন যত্ন-আত্তি করে। আমি চোখ বুজলে ওদের কাছেই তো থাকতে হবে। বোসো বাছা এইখানে, পা গুটিয়েই বোসোনা, বিছানা একটু নোংরা হয়তো হবে। তুমি বুঝি ভাবছ ছেলেকে ওরা কীভাবে রাখছে ফিরে গিয়ে আমি তা কী করে জানব? এতকাল একটা জমিদারি চালিয়ে এলাম, আমার কি ওসব ভুল হয় বাছা? সে ব্যবস্থা করেই এসেছি, আমাদের। পদ্ম ঝিকে দুটো টাকা দিয়ে এসেছি, চোখ দিয়ে সব দেখবে, কান দিয়ে সব শুনবে, ফিরে গেলে আমায় সব বলবে।

এখানে আসিয়া চারু কথা বলিয়া বাঁচিয়াছে। বাড়িতে থাকিলে ভাষার একটু সংযম দরকার হয়, কে জানে কে গ্রাম্য মনে করিবে, বুড়ি মনে করিবে!

কিন্তু যে যার হৃদয়-চর্চা লইয়া থাকে।

কনক বলিয়াছিল, আপনি তাহলে আছেন কদিন? আমার দেওরকে একটু দেখবেন মাসিমা। বাবার দয়া হতে দুদিন লাগে কি তিন দিন লাগে ঠিক তো কিছু। নেই, একা কী করে থাকবে এখানে ভেবে বড় ভাবনা হচ্ছিল। আপনি যখন রইলেন তখন অবিশ্যি আর–

কনক একটু হাসিয়াছিল, শিশুকে ডাকিয়া বলিয়াছিল, মাসিমাকে প্রণাম কর শিশু।

কাল কনক ধরনা দিবে স্থির হইয়াছিল, এখন আজ তাদের এই বিপদ।

ছেলেমানুষ শিশু একেবারে দিশেহারা হইয়া গিয়াছে, যে যা বলিতেছে তাই করিতে গিয়া কিছুই সে করিতে পারিতেছে না।

এদিকে যাত্রীবাসের কর্তা একটা গাড়ি ডাকাইয়া আনিয়া ক্রমাগতই বলিতেছে, যাও না হে ছোকরা, হাসপাতালে নিয়ে যাও না, সবাইকে মারবে নাকি? আচ্ছা। বেয়াক্কেলে লোক বাপু তুমি, কথাটা জানাজানি হবার আগে আমাকে একবার বলতে নেই! দেখুন, আপনারা কেউ যাবেন না, কোনো ভয় নেই–আমি বলছি কোনো ভয় নেই। রোগি হাসপাতালে পাঠিয়ে এখুনি প্রত্যেক ঘরের চৌকাঠ থেকে চাল পর্যন্ত ডিসেনফিট করে দিচ্ছি। আপনাদের যদি কিছু হয় তো আমায় বলবেন তখন।

হলে আর তোমায় বলে কী হবে বাপু? এই ধরনের প্রশ্ন করিলে যাত্রীনিবাসের কর্তা চোখ লাল করিয়া একবার তার দিকে তাকাইতেছে, কিন্তু কোনো জবাব দিবার লক্ষণ দেখাইতেছে না।

চারু সঙ্গের চাকরকে গাড়ি আনিতে পাঠাইয়া দিল।

শিশু এতক্ষণ তাহাকে দেখিতে পায় নাই, এবার তাহার দিকে চোখ পড়ায় সে যেন অকূলে কূল পাইল।

মাসিমা, দেখুন না, এরা জোর করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আপনি একটু বলে দিন না।

চারু বলিল, তা যাও না বাছা, হাসপাতালেই নিয়ে যাও। এখানে কি চিকিৎসে হয়? তারপর ভৎর্সনা করিয়া বলিল, এখনো একজন ডাক্তার ডাকনি, করেছ কী? ডাক্তার আনতে পাঠাও বাছা, আগে ডাক্তার আনতে পাঠাও। তারপর অন্য কথা। বলিয়া নিজের ঘরে ঢুকিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল।

বাহির হইল গাড়ি লইয়া চাকর ফিরিয়া আসিলে।

শিশুকে ইশারায় কাছে ডাকিয়া বলিল, আমার পাথরের বাটিটা?

বাটিটা বৌদি নোংরা করে ফেলেছে, মাসিমা।

চারু বিরক্ত হইয়া বলিল, কেন নোংরা করেছে? পরের জিনিস নিলে সাবধানে রাখতে হয় বাপু। আচ্ছা, যা করেছে, বেশ করেছে, এবার বাটিটা এনে দাও।

একটু দাঁড়ান, ধুয়ে দিচ্ছি।

চারু অনাবশ্যক রূঢ়তার সঙ্গে বলিল, দাঁড়াবার আমার সময় নেই বাছা, তোমার বাটি ধোবার জন্য গাড়ি ফেল করব নাকি? যেমন আছে তেমনি এনে দাও।

শিশু আর কথা না কহিয়া বাটি আনিয়া দিল। চারু তার একখানা পরনের কাপড় মাটিতে বিছাইয়া বলিল, এইতে দাও। অনেক পরত কাপড়ে বাটিটা সন্তর্পণে জড়াইয়া পুঁটলি করিয়া চারু সেটা আলগোছে তুলিয়া লইল। নিজের জিনিস ফিরাইয়া লইয়া চোরের মতো কয়েকবার চারিদিকে চাহিয়া শিশুর হাতে দশ টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়া সে পলাইয়া আসিল।

বাড়ি ফিরিয়া ধুলাপায়ে সকলের আগে চারু পরীর হাতে পাথরের বাটিতে নির্মাল্য তুলিয়া দিল।

বলিল, এক হাতে নয়, দুহাতে ধর। ছেলের মা তুই, তোর তো সাহস কম নয় পরী! কপালে ঠেকিয়ে খেয়ে ফেল।

দুটো ভাত দে দিদি!

ভাত নয় প্রসাদ, খা।

দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সে পরীর নির্মাল্য-পান চাহিয়া দেখিল। তারপর বাটিটা লইয়া স্নানের ঘরে সাবান দিয়া সোডা দিয়া অনেকবার মাজিল। নিজে এক ঘণ্টা ধরিয়া স্নান করিয়া আসিয়া বেতের বাস্কেট হইতে দেবতার ফুল বাহির করিয়া ভুবনের কপালে ছোঁয়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোকে সকলে ভালবেসেছে ভুবন?

ভুবন অস্বীকার করিল।

তোমার কাছে পালিয়ে যাচ্ছিলাম, কেষ্ট আমায় ধরে আনল কেন? আমায় ঘরে। বন্ধ করে রেখেছিল।

চারু ঝিকে জিজ্ঞাসা করিল, কী রে পদ্ম? সকলের ভাবসাব কী রকম দেখলি বল তো?

পদ্ম জানাইল সকলের ভাবসাব মন্দ নয়। আবার ভালোও নয় কিন্তু। দুয়ের মাঝামাঝি। পরী তার বোনপোকে ঠিক সময়মতো না হোক ডাকিয়া খাওয়াইয়াছে, মার জন্য হাউহাউ করিয়া কাঁদিলে ভোলানোর চেষ্টাও যে করে নাই এমন নয়। তবে চোখে চোখে ওকে কেউ রাখে নাই। কাল দুপুরবেলা ভুবন চুপি চুপি পলাইতেছিল, পদ্ম দেখিতে পাইয়া কেষ্টকে দিয়া ধরাইয়া আনিয়াছে। গোলমাল শুনিয়া আসিয়া বনমালী তাকে কয়েক ঘণ্টা ঘরে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল।

কি জান মা, মার মতো কেউ কি করে?

চারু বলিল, আমি চিরকাল বাঁচব না পদ্ম, তখন কী হবে? মারধর করেনি তো কেউ?

ধরিয়া আনিবার সময় কাল কেষ্ট বুঝি ভুবনকে একটু মারিয়াছিল, কিন্তু পদ্ম সে কথা গোপন করিয়া গেল।

না, মারধর কেউ করেনি।

.

চারুর পুরা নাম চারুদর্শনা, পরীর পুরা নাম পরীরানী। এগুলি কেবল যে নাম তা নয়,–মানানসই নাম।

সারাদিন পরীকে চারু আজ বিশেষভাবে সুন্দরী দেখিল,–অপরূপ, অভিনব। পরী যতবার তার লাল-করা ঠোঁট দুইটি ফাঁক করিয়া হাসিল, ততবারই চারুর সর্বাঙ্গে একটা শিহরণ বহিয়া গেল।

ভাবিল, না, এত রূপ নিয়ে সংসারে থাকাটা কিছু নয়। চাদ্দিকে আগুন জ্বেলে দিত বৈ তো নয়।

শরীরটা চারুর ভালো লাগিতেছিল না। সে সকাল সকাল শুইয়া পড়িল। একটা আশঙ্কা সে মন হইতে কোনোমতেই দূর করিতে পারিতেছিল না যে, আজ রাত্রেই যদি পরীর কলেরার লক্ষণ প্রকাশ পায়। ভুবনকে কোথাও সরানোর সময় পাওয়া যাইবে না। তারকেশ্বরের সেই বৌটির ভেদবমির কথা স্মরণ করিয়া চারুর গা ঘিনঘিন করিতে লাগিল। মনে হইতে লাগিল একটা নোংরামির মধ্যে সে শুইয়া। আছে, বিছানাটা অপবিত্র, অশুচি।

সম্ভবত মনের ঘেন্নাতেই খানিক পরে চারুর বমি আসিতে লাগিল।

আর খানিক পরে সে প্রথমবার বমি করিল। একবার বমি করিয়াই তার মনে হইল সমস্ত শরীরের রস তার শুকাইয়া গিয়াছে।

বমির শব্দে পরী উঠিয়া আসিয়াছিল, চারু কাঁদিয়া তাকে বলিল, ও পরী, আমার কলেরা হয়েছে, বনমালীকে ডাক শিগগির।

বনমালী উঠিয়া আসিল। ডাক্তারকে ফোন করা হইল।

ডাক্তার আসিল এক ঘণ্টা পরে। ইতিমধ্যে চারুর মাথা একেবারে খারাপ হইয়া গিয়াছে। বিড়বিড় করিয়া আপন মনে কী যে সে বকিতে লাগিল কেহ তার মানে বুঝিল না। মানে বুঝুক আর না বুঝুক, বনমালী বারকতক তাকে শুনাইয়া দিল যে। ভুবনের জন্য তার কোনো ভয় নাই, ভুবনের ভার সে লইল।

পরীর মনে হইল তাহারও কিছু বলা দরকার।

ভুবনকে আমি চোখে চোখে রাখব দিদি, চোখের আড়াল করব না কখনো। কিন্তু মরিয়া গেলেও চারু কি ইহার একটি কথা বিশ্বাস করে? চল্লিশটা বছর সংসারে বাস করিয়া মানুষের কাছে সে যে শিক্ষা পাইয়াছে শুধু মৃত্যু কেন, যাহার বিধান তারও বোধ হয় ক্ষমতা নাই সে-শিক্ষা তাহাকে ভুলাইয়া দেয়।

.

কদিন পরী খুব কাঁদিল। দিদি আমায় বড় ভালোবাসত, এই কথা বনমালীকে সে কতবার যে শোনাইল তার ইয়ত্তা নাই। বনমালী সভয়ে তাহাকে এড়াইয়া চলিতে লাগিল।

তখন পরী সভয়ে কান্নাও বন্ধ করিল এবং সুরও বদলাইয়া ফেলিল।

এক দিনের তরে সুখ কাকে বলে জানেনি। তারপর ওই তো ছেলে। গিয়েছে না বেঁচেছে-বনমালী বলিল, শরীরও ভেঙে গিয়েছিল।

পরী বলিল, হ্যাঁ। অম্বলের অসুখটা হবার পর থেকে একরকম মরবার দাখিল হয়েছিল।

অথচ একটু যত্ন হয়নি!

না। নিলে তো কারো যত্ন! তেমন মানুষই ছিল না দিদি। সকলের সেবাই করেছে প্রাণপণে, পরের জন্য খেটে প্রাণটা দিয়েছে।

আড়চোখে চাহিয়া আবার বলিল, বড় ঘা খেয়ে গেল। আমাদের একটু সাবধান হওয়া উচিত ছিল, কী বল?

হলে না কেন?

পরী হাসিয়া বলিল, বাহ, বেশ; আমি হলাম মেয়েমানুষ, আমাদের কি অত হিসাব থাকে? তুমি ঘরে এলে আমার বলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুল হয়ে যায়, সাবধান থাকব!

বনমালী বলিল, তাই নাকি!

চারুর মৃত্যুর পর বনমালী দিনে অথবা রাত্রে কখনো পরীর ঘরে আসে নাই। দুর্ভাবনার পরীর আর সীমা ছিল না। চুলে সেদিন সে অল্প একটু তেল দিল, এলোচুলে একটু স্নিগ্ধ রুক্ষতাই ভালো মানায়। আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ ভাবিবার পর বাটিতে পাতলা করিয়া আলতা গুলিয়া গালে লাগাইয়া সিল্কের রুমাল দিয়া মুছিয়া লইল। ছোট একটি পান সাজিয়া মুখে লইয়া একটু চিবাইয়া ফেলিয়া দিল।

তারপর বনমালী বেড়াইতে যাওয়ার সময় সামনে পড়িয়া একটু হাসিল।

শোনো। কাছে সরে এসো, কানে কানে বলি। একটা ফিডিং বোতল এনো, আমি মরুভূমি হয়ে গেছি। আনবে তো?

আনব। পদ্মর কাছে খোকা ভারি কাঁদছে পরী।

পদ্ম ওকে ইচ্ছে করে কাঁদায়।

পদ্মর কাছে না দিলেই হয়।

আমাকে সেজেগুঁজে ফিটফাট থাকতে না বললেই হয়।

বনমালী তাহার গালে একটা টোকা দিল।

না সাজলেই তোকে ভালো দেখায় পরী।

বনমালী চলিয়া গেলে পরী ছুটিয়া গিয়া পদ্ম-ঝির কাছ হইতে খোকাকে ছিনাইয়া লইল। চোখ পাকাইয়া বলিল, তোকে না পাঁচশ বার বলেছি বাবুর ধারে-কাছেও খোকাকে নিয়ে যাবি না?

পদ্ম একগাল হাসিয়া বলিল, বাবু নিজে ডাকলে গো। বললে, খোকাকে আন তো পদ্ম। ভয়ে মরি দিদিমণি।

মরণ তোমার! ভয় আবার কিসের?

তা যাই বল, বাবুকে আমি বড্ড ডরাই বাপু। দেখলে বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে থাকে দিদিমণি। এই অ্যাদূর থেকে বাবুকে আমি গড় করি।

পরী হাসিয়া বলিল, আচ্ছা আচ্ছা, বেশ করিস। তার পর কী হল বল।

ভয়ে ভয়ে খোকাকে তো নিয়ে গেলাম। বাবু কোলে নিলে, আদর করলে, চুমো পর্যন্ত খেলে। তারপর বললে, বেশ ছেলেটা, না রে পদ্ম? লজ্জায় মরি দিদিমণি।

বনমালী বেড়াইয়া ফিরিলে পরী বলিল, আচ্ছা, পরের ছেলেকে তুমি এত ভালোবাসলে কী করে বলো তো? তোমার হিংসা হয় না?

বনমালী হাসিয়া বলিল, না, দুদিনের জন্য এসেছে, ওকে আবার হিংসে করব

কী? বরং তোর ছেলে বলে ভালোই বাসি।

পরীর মুখ শুকাইয়া গেল।

এ কী পরিণাম! সংক্ষিপ্ত ও সাংঘাতিক!

আরশি কি প্রত্যহ তাহাকে মিথ্যা বলিয়াছে? বনমালীর সেই উ